গল্প এক_তুমিতেই_আসক্ত পর্ব ১৩

 #এক_তুমিতেই_আসক্ত 

#আয়ান_মাহমুদ 

|১৩|

পর্তুগালের ক্যাম্পাসে প্রতিটি দিনই যেন নতুন কোনো চমক নিয়ে আসে। আজ ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মিউজিক নাইট ছিল, যেখানে সবাই তাদের প্রতিভা প্রদর্শন করতে পারত। টিভি স্ক্রিনে আর ক্যাম্পাসের পোস্টারে এদিনের জন্য অনেক প্রচারণা হয়েছিল। যদিও তন্নী তুর্যকে অনেকটাই এড়িয়ে চলছিল, তুর্য জানত, এই ধরনের অনুষ্ঠানে তাদের বন্ধুবান্ধবরা একসাথে উপস্থিত থাকবে এবং তন্নীও একসময় অংশ নেবে।

অথচ আজ, তুর্য কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিল। কয়েক দিন ধরে তন্নী এতটা চুপচাপ, যেন তার মধ্যে কোনো অজানা বেদনা লুকিয়ে ছিল। তবে আজকের মিউজিক নাইট ছিল এক বিশেষ দিন—একটি সান্ধ্য অনুষ্ঠান, যেখানে গানের অনুষ্ঠান, সংগীত, এবং নানা ধরনের পরিবেশনা ছিল। সবাই প্রস্তুত ছিল, বিশেষ করে তিহান, তাসনিম, এবং অন্যান্য বন্ধুদের মধ্যে যার মধ্যে এক ধরণের উত্তেজনা ছিল। তুর্য জানত, আজ তন্নী যদি না আসে, তাহলে তার মধ্যে আরো এক ধরনের শূন্যতা অনুভব হবে।

মিউজিক নাইটে প্রথমেই তাসনিম একটি ছোট্ট গান গেয়ে উপস্থিত হল, এবং তার পর তিহানকে দেখা গেল, যে নিজের গিটার নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। সবাই জানত, তিহান একজন দুর্দান্ত গিটারিস্ট, কিন্তু আজকের পরিবেশনা ছিল কিছুটা অন্যরকম। তিহান সাধারণত হাস্যরসের মধ্যে থাকতো, কিন্তু আজ সে কিছুটা ভিন্ন মেজাজে ছিল। তার চোখের মধ্যে কিছুটা দুঃখ, কিছুটা অস্থিরতা ছিল, যা তুর্য বুঝতে পারছিল না।

তুর্য একে একে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান ঘুরে সবাইকে দেখা শুরু করল। এর মধ্যেই তন্নীকে হঠাৎ চোখে পড়ল, সে এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল, কিছুটা সরে গিয়েছিল। তার মুখে কোনও হাসি ছিল না, শুধু এক গভীর নীরবতা। তুর্য তার দিকে এগিয়ে গেল, এবং ধীরে ধীরে বলল, "তন্নী, তুমি কি আসবে আজকের অনুষ্ঠানে?"

তন্নী কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিল, "আমি ঠিক জানি না, তুর্য। আমি অনেক চিন্তার ভিতরে আছি।

"তন্নী, তোমার চিন্তার কারণ গুলো কি আমাকে বলতে পারবে?" তুর্য নরম সুরে বলল, "কিছু সমস্যা হলে, আমি এখানে আছি।"

তন্নী কিছুক্ষণ চুপ ছিল, তারপর মৃদু হাসল, "না, কিছু না। আমি শুধু একটু একা থাকতে চাইছিলাম।"

এ কথা বলে তন্নী আবার চুপ হয়ে গেল। তুর্য বুঝতে পারছিল না, কেন তন্নী এতটা নিজের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। তন্নী আসলে কি ভয় পাচ্ছিল? সে কি নিজেকে আরও বেশি দূরে নিয়ে যাচ্ছে? তুর্য মনে মনে ভেবে গেল, কিন্তু কিছুতেই তার মনকে শান্ত করতে পারছিল না।

ঠিক তখনই মিউজিক নাইট শুরু হলো। ক্যাম্পাসের বিশাল অডিটোরিয়ামে প্রবল হর্ষধ্বনি, গিটার, পিয়ানো—সবকিছু এক নতুন আলোর রূপ ধারণ করল। তুর্য তন্নীকে পাশেই দেখতে পেল, তবে তার মনোযোগ এখনো সেই দূরত্ব এবং বিচ্ছিন্নতায় আটকে ছিল। এর মাঝেই, মঞ্চে তিহান উঠে গিটার হাতে। তার হাতে থাকা গিটার চিমটি চিমটি কেঁপে উঠল, এবং সেই রেশমী সুর সবকিছুকে কাটিয়ে ছড়িয়ে পড়ল ক্যাম্পাসের চারপাশে।

তিহান গিটার বাজাতে শুরু করল, এবং তার গায়কীও এক এক করে জাদুর মতো ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে সবার মুখে হাসি ছিল, কিন্তু তার পর পরই, তুর্য বুঝল, তিহান যে গানটি গাইছে, তা ছিল একটি অনুভূতিপূর্ণ, গভীর গান—একটি দুঃখের গানের সুর। তুর্য বুঝতে পারছিল, গানের মধ্যে তিহানের নিজস্ব কিছু অনুভূতি ছিল, যার মধ্যে ছিল এক অজানা যন্ত্রণা, এক আক্ষেপ।

তুর্য তন্নীর দিকে তাকাল, কিন্তু সে কোথাও ছিল না। তার চোখে সেই পুরনো নীরবতা, সেই চাপা বেদনা, যেন সে গানের মতো কিছু অনুভব করছে, যা সে সবার সামনে প্রকাশ করতে চায় না।

তিহানের গান শেষ হওয়ার পর, তুর্য তন্নীকে খুঁজতে শুরু করল, কিন্তু তন্নী তার চোখের আড়ালে চলে গিয়েছিল। তুর্য কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়ল। সে জানত, তন্নী আজ কিছু অনুভব করছে, এমন কিছু যা তাকে অসহায় করে দিচ্ছে। তার মনে হলো, তন্নী আজও সেই গভীর অন্ধকারে আটকে আছে, যেখান থেকে সে কোনোভাবেই বের হয়ে আসতে পারছে না।

কিছু সময় পর, তুর্য অবশেষে তন্নীকে খুঁজে পেল। সে এক কোণে বসে ছিল, নিজের গলা জড়িয়ে এক পা অন্য পায়ের উপর রেখে। তার মুখাবয়বে স্নিগ্ধতা ছিল, কিন্তু চোখের কোণে ছিল কিছুটা অশ্রু। তুর্য ধীরে ধীরে তার কাছে গিয়ে বলল, "তন্নী, তুমি ঠিক আছো?"

তন্নী তার চোখ মুছে বলল, "হ্যাঁ, তুর্য। কিছুটা ভেতরে আটকে গেছি।"

তুর্য মৃদু হাসল, "তন্নী, তুমি জানো, যখনই তুমি চাইবে, আমি তোমার পাশে আছি। তুমি যা অনুভব করছো, তা বুঝতে আমার কিছু সময় লাগবে, কিন্তু তুমি একা কখনো থাকবে না।"

তন্নী একটুখানি হাসল, তার চোখে আবার কিছুটা স্নিগ্ধতা ফিরল, কিন্তু তার মনে তেমন কিছু ছিল না। তুর্য জানত, তন্নী নিজেকে সহজে খুলে বলতে পারে না, কিন্তু তার কাছে তন্নী যখন-তখন ফিরে আসবে, তেমন বিশ্বাস তাকে ছিল।

মিউজিক নাইট শেষ হলো, কিন্তু তুর্য জানত, এই রাতের পরেও অনেক কিছু বাকী ছিল—তন্নীর ভেতরের সেই অদ্ভুত ভেদ, সেই এক অজানা রহস্য, যা একদিন তার সামনে পুরোপুরি উন্মোচিত হবে।

---