#এক_তুমিতেই_আসক্ত
#আয়ান_মাহমুদ
|১৬|
এমন একটা দিন, যখন লিসবনের আকাশে মেঘের কোনো চিহ্ন ছিল না, সেদিন তন্নী ও তুর্য একে অপরকে একটু বেশি মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। ক্যাম্পাসের ভেতরে আজ কিছুটা নিরবতা ছিল। পরীক্ষার মাঝখানে সবাই যেন একটু বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ দিনের আলোয় কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পেতে চেয়েছিল। তন্নী জানত, তাকে আজ আর একটু বেশি খোলামেলা হতে হবে, কারণ কিছু দিনের মধ্যে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার সময় আসবে—যা তার কাছে বড় একটা চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিন তন্নী সিদ্ধান্ত নিল, আজ সে ফোন করবে তার মায়ের সাথে। কিন্তু, ফোন করার আগে তার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা ছিল। কী বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে? তুর্য, যে তার সঙ্গী হিসেবে প্রতিদিন তার পাশে ছিল, তাকে জানানো সম্ভব ছিল না যে তার কাছে বাড়ির কথাগুলো কতটা কঠিন। বিশেষ করে, তার বাবার সাথে সম্পর্কের বিষাক্ততা, যেগুলো সে কোনোদিন স্বাভাবিকভাবে মুখ ফুটে বলেনি।
তন্নী কিছুক্ষণ চুপচাপ ছিল, তার চোখে কিছুটা অস্বস্তি ছিল। তারপর একবার ভাবল, তুর্যকে বলবে কি না। কিন্তু তুর্য জানত, তন্নী সবসময়ই নিজের সমস্যাগুলো একা সামলাতে চায়, তাই সে জিজ্ঞেস না করে শুধু পাশে বসে থাকতে পছন্দ করল।
"তন্নী, তুমি কিছু ভাবছো?" তুর্য হালকাভাবে প্রশ্ন করল, তার চোখে ছিল কৌতূহল, তবে তন্নী সেটা খেয়াল করল না।
তন্নী একটু চুপ করে থেকে বলল, "হ্যাঁ, ভাবছি। আমি আজ আমার মাকে ফোন করতে যাচ্ছি।"
তুর্য চুপচাপ মাথা নেড়ে বলল, "তুমি জানো, তোমার জন্য যা ভালো, সেটাই করবে। তবে, আমি জানি, তুমি কখনোই সহজভাবে কাউকে তোমার অন্তরের কথা বলো না।"
"হ্যাঁ, ঠিক," তন্নী ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলল, "কিন্তু আমার মায়ের সাথে কথা বলাটা আমার জন্য সবসময় কঠিন। বাবা তো মাঝে মাঝে একদমই আমাকে এড়িয়ে চলে, এবং আমার মা কখনোই আমার সিদ্ধান্তগুলো সহজভাবে নেয় না।"
"তুমিই তো তাদের কন্যা," তুর্য বলল, "তাদের ভালোবাসা তোমার জন্য, তন্নী। হয়তো তাদের কাছে কিছু বোঝানো কঠিন, কিন্তু আমি জানি, তারা তোমাকে বুঝবে।"
তন্নী কিছু সময় চুপ থেকে বলল, "বাবা আর আমি কখনোই খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে পারিনি। মা তো জানে, কিন্তু সে কিছু বলতে চায় না। তবে, আমি জানি, তার মনে কিছু চিন্তা রয়েছে।"
তুর্য তার হাত টানল, এবং একটি সংবেদনশীল হাসি দিল, "তন্নী, তুমি যতই ভাবো, তোমার পরিবার তোমার জন্য। তারা বুঝবে।"
এরপর তন্নী তার ফোনে মা'র নম্বর ডায়াল করল। কিছু সময় পরেই ফোনটা ধরল তার মা।
"হ্যালো, মা," তন্নী মৃদু কণ্ঠে বলল।
"কেমন আছিস, মা? পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে তো?" তার মায়ের চিন্তাশীল কণ্ঠ শোনা গেল।
"হ্যাঁ, মা। সব ঠিকই চলছে। তবে, আমি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলাম।"
তন্নীর কথা শোনার পর তার মা বললেন, "বলো, কী হয়েছে? তুমি তো সব সময় কিছু না কিছু ভাবো, তবে কি সমস্যা হয়েছে?"
তন্নী কিছু সময় চুপ থেকে বলল, "মা, আমি জানি আমাদের সম্পর্ক অনেক কঠিন ছিল, কিন্তু আমি চাই তুমি বুঝো... আমি এখানে সুখে আছি, ভালো আছি।"
মা কিছু সময় চুপ করে থাকল। তারপর বললেন, "তুমি জানো, তন্নী, আমি কখনোই চাইনি যে আমাদের সম্পর্কটা এমন হোক। কিন্তু কিছু জায়গায় আমাদের ভুল ছিল।"
তন্নীর চোখে এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছিল। তার মন একটা বেদনায় পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সে জানত, মা আর বাবা তাদের ভুলগুলো কখনোই মেনে নেবে না। কিন্তু, তন্নী জানত, সে তাদের ভালোবাসার মাঝেই নিরাপত্তা পাবে। সে আর বেশি কিছু বলতে চাইল না।
"মা, আমি এখানে ভালো আছি। আমি শুধু চাই, তোমরা জানো, আমি সুখী।"
তন্নীর মায়ের কণ্ঠে একটি নরমতা ছিল, "তুমি ভালো থাকলে আমাদেরও ভালো লাগবে। তবে তোমার সিদ্ধান্তগুলো সব সময় আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং থাকবে।"
ফোনের ওপাশ থেকে তন্নীর মায়ের স্নেহময় কণ্ঠ শুনে তন্নী কিছুটা স্বস্তি পেল, তবে তার চোখে কিছুটা দুঃখ ছিল। সে জানত, নিজের পরিবার থেকে মুক্তির পথে তাকে অনেকটা সময় দিতে হবে।
ফোন রাখার পর, তন্নী একটু হালকা হয়ে উঠল, কিন্তু তার মনে ছিল একটা বড় দুঃখ। সে জানত, সব কিছু সহজ হবে না, তবে সে তার নিজের পথে হাঁটতে চায়। তুর্য তার পাশে ছিল, তার অনুভূতিগুলো শেয়ার করার জন্য।
"তন্নী," তুর্য বলল, "যখন তুমি তোমার পরিবারের কাছে ফিরবে, তখন তোমাকে কিছু সময় দেবার প্রয়োজন হবে। তুমি জানো, তাদের ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না, শুধু কখনো কিছু সময় লাগতে পারে বুঝতে।"
তন্নী মাথা নেড়ে বলল, "হ্যাঁ, আমি জানি। ধন্যবাদ, তুর্য।"
আজ, তন্নী বুঝতে পেরেছিল, সে যা কিছু চায়, তা শুধুমাত্র তার নিজের পথেই আসবে, তবে তার পরিবারে কিছু শূন্যতা থাকবে, সেটা মেনে চলতে হবে। কিন্তু তুর্য—তার পাশে, তার অনুভূতির সাথে—তার যাত্রা একদম নতুন পথে প্রবাহিত হবে।
---
0 Comments:
Post a Comment