গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ২০
#টক_ঝাল_মিষ্টি
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-২০
শাহাদ দুহাত দিয়ে চোখেমুখে কয়েকবার ঘষলো।দীর্ঘ সময় ধরে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থাকার কারনে তার চোখমুখে ক্লান্তিভাব দেখা দিয়েছে।তার গায়ে কোনো শার্ট নেই।ছুড়ে ফেলা শার্টটা এখনো ফ্লোরে পড়ে আছে। দীর্ঘ চেষ্টার পর ওয়েবসাইট উদ্ধার করা গেছে। তবে জিমেইল এখনো হ্যাক করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে হ্যাকাররা। ওয়েবসাইট উদ্ধার হয়ে যাওয়ায় সাইবার এক্সপার্টরা এখন পূর্ন মনোযোগ জিমেইলে দিতে পারবে।শাহাদ লম্বা শ্বাস ফেলে সোফায় শরীরা হেলিয়ে দিলো।ছাদের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে থাকলো। কয়েক সেকেন্ড পরেই তড়াক করে সোজা হয়ে বসে পড়লো।চোখ মুখে একটা বিহ্বল ভাব ফুটে উঠলো। তড়িঘড়ি করে ফোনে টাইম দেখলো। অনেক্ষন আগেই মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। কুহুকে দেয়া একঘন্টার বদলে তিনঘন্টার মতো কেটে গেছে। শাহাদ অস্থির পায়ে বেডরুমে ছুটে এলো। বেডরুমে ঢুকেই ওর পা দুটো থেমে গেলো। বিছানার দিকে তাকিয়ে ওর চোখ জোড়ায় অপরাধবোধ ফুটে উঠলো। আস্তে আস্তে হেঁটে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালো।
ছড়ানো ছিটানো লাল গোলাপের পাপড়ির মাঝে কুহু শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। বিছানার চাদর কিছুটা এলোমেলো। কালো শাড়ি পরিহিত কুহুকে সাদা বিছানায় গোলাপের পাপড়ির উপর ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় অপ্সরী লাগছে। শাহাদ চোখ বন্ধ করে ফেললো।ঢোক গিলতে গিয়ে গলার কাছে আটকে যাচ্ছে। নিজের উপর প্রচন্ড বিতৃষ্ণা কাজ করছে তার। সে আস্তে করে বিছানার এক কোনায় বসে পড়লো। মাথা ঝুঁকিয়ে দুহাত দিয়ে চুল টেনে ধরলো।মুখ তুলে পিছন ফিরে শুয়ে থাকা কুহুর দিকে তাকালো আবার। এত বড় ভুল সে কি করে করলো? মেয়েটাকে এতক্ষন অপেক্ষা করালো? নিজের স্বার্থ নিয়ে এতটাই বিভোর ছিলো যে নিজের স্ত্রীর মনের অবস্থাটাও চিন্তা করলো না?
শাহাদের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো হ্যাকারগুলোর উপর। ওদের মাঝ বরাবর টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হলো। মাথায় আগুন ধরে গেলো। বাম হাত দিয়ে বারকয়েক ঘাড় ঘষলো। রাগ কিছুটা দমন করে উঠে দাঁড়ালো।একটা বালিশ নিয়ে কুহুর উপর উবু হয়ে আস্তে করে কুহুর মাথার নিচে দিলো। কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মুখ এগিয়ে নিলো কুহুর কপালে চুম্বন এঁকে দেয়ার জন্য। কপালের কাছাকাছি গিয়েও সে চুমু দিতে পারলো না।অদৃশ্য এক বাঁধা তাকে আটকে দিলো। আবারো প্রচন্ড ক্রোধে তার শ্বাস ভারী হয়ে আসলো। ছিটকে সরে আসলো কুহুর কাছে থেকে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে একবার নজর পড়লো কাচের দরজার ওপাশে ডিনার টেবিলটার দিকে।টেবিলের উপর থাকা জুসের গ্লাসটা নিচে পড়ে আছে,একটা চেয়ার উলটানো,মোমবাতিগুলো নিভানো।শাহাদ বুঝতে পারলো কি ঘটেছে। না চাইতেও তার বুক চিড়ে একটা শ্বাস বের হয়ে আসলো।
বেডরুমে ছেড়ে লিভিং রুমে এসে ফ্রিজ থেকে একটা তরল পানীয়ের ক্যান বের করলো। ল্যাপটপের সামনে সোফায় বসে ক্যানটা খুলে ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নিলো। টেবিল থেকে মাইক্রোফোনটা তুলে মুখের কাছে এনে কিছু নির্দেশনা দিয়ে মাইক্রোফোনটা ঠাস করে টেবিলের উপর রেখে দিলো।পরপর ল্যাপটপটাও শব্দ করে বন্ধ করে ফেললো।এই সবকিছুই তার কাছে বিষাক্ত লাগছে। কিছুক্ষন থম মেরে বসে থাকলো। তারপর চিৎ হয়ে সোফায় শুয়ে পড়লো। কপালের উপর একটা হাত রেখে চোখ বন্ধ করলো।
__________
সকালে কুহুর ঘুম ভাংলো টুংটাং আওয়াজে। প্রথমে চোখ খুলে কোথায় আছে বুঝতে পারলো না।আস্তে আস্তে বুঝতে পারলো সে শাহাদের সাথে একটা স্বীপে এসেছে হানিমুন কাটাতে।শাহাদ,হানিমুন - এই দুটো শব্দ মাথায় আসতেই কুহুর মন প্রানে অভিমান আকড়ে ধরলো।সে বিছানায় উঠে বসলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে শাহাদকে খুঁজলো।কোথাও না পেয়ে ঘর ছেড়ে লিভিং রুমে এসে দাঁড়ালো। লিভিং রুমে এসে টুংটাং শব্দটা আরো জোরালোভাবে পেলো। পাশে তাকিয়ে দেখলো কটেজের কিচেনে শাহাদ রান্না করছে। ওখান থেকেই শব্দটা আসছে। শাহাদের পড়নে একটা ছাই রঙা টিশার্ট। চুলগুলো আধভেজা,গোসল করেছে বোধহয়।
শাহাদ কুহুর দিকে পিছন ফিরে চুলায় ভেজিটেবল রান্না করছিলো।চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে পিছনে ফিরতেই কুহুকে দেখে হাসলো। কিচেন ছেড়ে এগিয়ে এসে কুহুর সামনে দাঁড়ালো। হাসিমুখে বললো-
"ফ্রেশ হয়ে নাও। ব্রেকফাস্ট প্রায় রেডি।"
কুহু মাথা নাড়ালো উপর নীচ। ঘুরে ঘরের দিকে যেতে নিলেই শাহাদ আটকে দিলো। এক হাতে কান ধরে নাক কুচকে বললো -
"গত রাতের জন্য স্যরি। ক্যান্ডেললাইট ডিনার হয় নি তবে চাইলে আমরা সানলাইট ব্রেকফাস্ট করতে পারি।দিনের আলোয়।"
শাহাদের দিকে তাকিয়ে কুহুর মনের কালো মেঘটা কিছুটা সরে গেলো। শাহাদের কান ধরার ভঙ্গি দেখে মনে মনে হাসলো সে। তারপর ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে। গোসল করে একটা গাউন পড়ে বের হলো। লিভিং রুমে এসে দেখলো শাহাদ লিভিং রুমের বাইরে সাগরের তীরে ব্রেকফাস্ট টেবিল রেডি করছে৷ কুহু পায়ের জুতা খুলে নরম বালু মাড়িয়ে টেবিলের কাছে দাঁড়ালো। শাহাদ তাড়াতাড়ি এসে চেয়ার টেনে দিয়ে কুহুকে বসালো। তারপর নিজেও গিয়ে বসলো চেয়ারে। নিজেই সার্ভ করে দিলো কুহুকে। কুহু খাবার মুখে দিয়ে আশ্চর্য হলো। যথেষ্ট ভালো হয়েছে। শাহাদ যে এত ভালো করে রান্না করতে পারে তা সে ভাবেই নি।
শাহাদ কাটা চামচ দিয়ে এক স্লাইস চিকেন নিয়ে হাত বাড়িয়ে কুহুর মুখের কাছে ধরলো। প্রিয়তমা স্ত্রীর মন ভালো করতে সব ধরনের চেষ্টা সে করবে। কুহুর মনের মেঘ এখনো সরে নি। তবে শাহাদের এমন কেয়ার তার ভালো লাগছে।সে মুখ বাড়িয়ে খেয়ে নিলো। খাওয়ার মাঝে শাহাদ মাঝে মাঝেই কুহুকে এটা ওটা দিলো। আরো কয়েকবার মুখে তুলে খাইয়েও দিলো। খাওয়া শেষ করে ঘরে এসে কুহুকে বললো-
"আমি একটু দ্বীপের অপোজিট সাইটে যাচ্ছি। তোমাকে এক দু ঘন্টা একা থাকতে হবে।থাকতে পারবে তো?"
"পারব।"
কুহুর উত্তরে শাহাদ অভিমান টের পেলো।কিছুটা নরম স্বরে বলল-
"বেশিক্ষন লাগবে না চলে আসব। আমি আসা অব্ধি তুমি কটেজটা ঘুরে দেখো।আর হ্যা,একা একা সাগরে নামবে না,এমনকি পুলেও নামবে না।পুলটা তোমার হাইটের তুলনায় গভীর।"
কুহু শুধু ঘাড় হেলিয়ে সায় জানালো, কিছু বললো না।শাহাদের ইচ্ছে হচ্ছে না কুহুকে এভাবে রেখে যেতে কিন্তু কিছু করার নেই, তাকে যেতে হবে। এইখানে আরো কয়েকদিন থাকার প্ল্যান করেছে সে। সেজন্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে হবে। চাইলে কেয়ার টেকারকে বলে আনাতে পারে কিন্তু শাহাদ নিজে গিয়ে আনতে চাচ্ছে।
শাহাদ বেরিয়ে যাওয়ার পর কুহু একা কটেজে এটা ওটা ধরে দেখলো। কিছুক্ষন সাগরের পাড়ে হাঁটলো। লবণাক্ত পানিতে পা ভেজালো,সাদা নরম বালুতে বসে রইলো। ফোন এনে অনেক অনেক ছবি তুললো। কিন্তু কোনো কিছুতেই তার মন ভালো হলো না। শেষে পুলে এসে পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো। কিছুক্ষন পা দিয়ে পানিতে নড়াচড়া করলো। কুহুর মাথায় পুলে নামার ভূত চাপলো। শাহাদের নিষেধ স্বত্তেও সে পুলে নামার জন্য তৈরি হলো। এক প্রকার শাহাদের উপর রাগ করেই সে শাহাদের নিষেধ অমান্য করে এক লাফে পুলে নেমে পড়ল।
কুহু পুলে নামার সাথে সাথেই তলিয়ে গেলো। পুলের গভীরতা তার হাইটের তুলনায় কয়েক ইঞ্চি বেশি। সাঁতার না জানা কুহু উপরে ভাসার জন্য হাত পা ছুড়লো। কয়েকবার মুখ পানির উপরে তুলতে পারলেও পরক্ষনেই আবার তলিয়ে গেলো। তার পা ঠেকলো পুলের তলদেশের ফ্লোরে। স্বচ্ছ পানি ভেদ করে উপরে সব কিছুই সে দেখতে পেলো। আর কয়েক ইঞ্চি লম্বা হলেই তার মুখ ভেসে থাকতো। কুহু শ্বাস নিতে না পেরে আতংকিত হয়ে হাত পা ছুড়লো,ভাসার চেষ্টা করলো। এতে সে পুলের মাঝ বরাবর চলে এলো। পানির উপরে কেবল কুহুর ছুড়তে থাকা হাত দুটোই দেখা গেলো।
শাহাদ কটেজে এসে কুহুকে কোথাও পেলো না। এদিক ওদিক খুজলো। বেডরুমে এসেও যখন কুহুকে পেলো না তখন তার চিন্তা হতে লাগলো। তারপর কানে আসলো পানির আওয়াজ। পুল সাইডে যাওয়ার দরজাটার দিকে একটু উঁকি দিতেই ওর ভ্রু টানটান হয়ে গেলো।পানির উপর হুটোপুটি খাওয়া দুটো হাত দেখা যাচ্ছে। শাহাদের কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো। হাতে থাকা ফুলের তোড়াটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে গেলো পুলের দিকে। পুলের মাঝ বরাবর লাফ দিলো।
পানির নিচে শ্বাস আটকে প্রায় ম*রতে বসা কুহু হঠাৎ দুটো শক্ত হাতের টান অনুভব করলো। পরক্ষনেই নিজেকে বাইরের পৃথিবীতে আবিষ্কার করলো,দেখতে পেলো শাহাদকে। হা করে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো।আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো শাহাদকে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে শাহাদের দিকে তাকালো। আচমকা প্রশ্ন করলো-
"আমি কি ম*রে গেছি?"
কুহুকে কথা বলতে শুনে শাহাদ চোখ বন্ধ করে শ্বাস ফেললো। এতক্ষন তার দমটা গলা অব্দি আটকে ছিলো। কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল-
"ম*রে গেলে আমাকে দেখতে পেতে?"
কুহু নিজের করা প্রশ্নে নিজেই লজ্জিত হলো। মনে পড়লো শাহাদের নিষেধ করার কথা।শাহাদের উপর জেদ করে আরেকটু হলেই ম*রতে বসেছিলো সে। শাহাদ এক হাতে কুহুর কোমড় আকড়ে ধরে অন্য হাতে সামনের পানি কেটে পুলের কিনারার দিকে এগুতে লাগলো। পুলটা শাহাদের হাইটের সাথে সামঞ্জস্য থাকায় শাহাদ ডুবে গেলো না।পানি তার কাঁধ ছুই ছুই হলো। কুহু শাহাদের গলা জড়িয়ে ধরে ভেসে ভেসে যেতে লাগলো। পুলের কিনারে এসে শাহাদ দুহাতে কুহুর কোমড় ধরে কিনারে বসিয়ে দিলো। তারপর নিজেও উঠে বসলো কুহুর পাশে। কুহুর পাশে বসে পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে কিছুক্ষন বসে রইলো। হাত দিয়ে ভেজা চুলগুলো পিছনে ঠেলে গম্ভীর কণ্ঠে বললো -
"আমার নিষেধ স্বত্তেও পুলে নামলে কেন? আমি আরেকটু দেরিতে আসলে কি হতো আইডিয়া আছে তোমার?"
"হ্যা আছে,আপনার দেরি সম্পর্কে যথেষ্ট আইডিয়া আছে আমার।"
কঠিন কন্ঠে এমন কথা বলে কুহু উঠে ঘরে চলে গেলো। শাহাদ বিস্মিত হয়ে কুহুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। গতরাতের ঘটনা যে কুহুর মনে খুব দাগ কেটেছে তা বুঝতে শাহাদের তেমন সময় লাগলো না।
---------
হিশাম শক্ত মুখে পার্টি অফিসে তার নিজস্ব ঘরে বসে আছে। তার টেবিলের অপর পাশে চেয়ারে হেলান দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে নাইমুর। বসে থেকে খুব মনোযোগ সহকারে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। হিশামের ইচ্ছে হলো নাইমুরকে ইচ্ছামতো পিটাতে। চাইলেই সে এখন নাইমুরকে পিটাতে পারে।নাইমুরও মুখ বন্ধ করে পিটুনি খাবে কিন্তু এরপর এই ঘটনার ফল হবে খুব খারাপ।হিশামের রাতের দুঃস্বপ্ন হয়ে যাবে এই নাইমুর। সে এজন্যই লোকাল মাফিয়াদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। কিন্তু খান পরিবারের জন্য নাইমুরের সাহায্য নেয়া ছাড়া উপায় ছিলো না।হিশাম রুক্ষ কন্ঠে বললো-
"তুমি আমার কত ক্ষতি করেছো জানো?"
নাইমুর দাঁত দিয়ে কাটা নখটা মুখ থেকে ছুড়ে ফেলে বলল-
"নাহ জানিনা। বলে দিন।"
রাগে হিশামের দাঁতে দাঁত লেগে গেলো। মুখ শক্ত করে বলল-
"তুমি কাজের কাজ কিছুই করতে পারো নি। শাহাদ খান দেশের বাইরে তারপরও তুমি সাধারন একটা ওয়েবসাইট হ্যাক করে ধরে রাখতে পারো নি। তার উপর তুমি হ্যাকারদের কয়েকজনকে পিটিয়ে আহত করেছো,হাসপাতালে পাঠিয়েছো। হ্যাকাররা ক্ষেপে গিয়ে যেন পুলিশে না যায় তাই ওদেরকে মোটা অংকের টাকা দিতে হয়েছে আমাকে। এই সবকিছুর মাঝে আমার লাভের চেয়ে ক্ষতি হয়েছে।"
"ক্ষতি পুষিয়ে দিব পরের বার। আপনার সাথে কন্ট্রাক্ট যেহেতু হয়েছে পুরোপুরি কাজ করে দিয়েই তারপর যাব।।এত কথা বলার সময় নেই। আজ গেলাম।"
নাইমুর স্যালুট জানিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। হিশামের রাগ তরতর করে বাড়লো।চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হিশামের সেক্রেটারি ঝুঁকে হিশামের কানের কাছে এসে বললো-
"স্যার এসব সন্ত্রাস-চাঁদাবাজদের বিশ্বাস নেই এরা টাকার জন্য যাকে তাকে মে*রে দিতে পারে। এদের সাথে একটু সাবধানে কথা বলবেন।"
-----------
পুলের ঠান্ডা পানিতে পড়ে যাওয়া অথবা পড়ে গিয়ে প্রচন্ড ভয় পাওয়া যেকারনেই হোক না কেন সেদিন রাতে কুহুর শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসলো।শাহাদ প্রথম দফায় বিচলিত না হয়ে শান্ত থেকে কুহুকে জ্বরের মেডিসিন খাইয়ে দিলো। কিন্তু রাত দশটার পর পরই কুহু কাঁপতে লাগলো। শাহাদ ভয় পেয়ে গেলো। বাংলাদেশে কল করে তার মাকে জানাতে চাইলো কিন্তু পরক্ষনে ওঁদের চিন্তার কথা ভেবে আর দিলো না। একটা রুমাল পানিতে ভিজিয়ে কুহুকে জলপট্টি দিলো। কিন্তু এতেও কাজ হলো না কুহুর কাঁপুনি বেড়েই গেলো৷ বিদেশে নির্জন দ্বীপের একটা কটেজে কুহুর অসুস্থতায় শাহাদ নিজেকে খুব অসহায় অনুভব করলো। কি করবে, কি করবে না ভেবে পেলো না। শেষে আর উপায় না পেয়ে কেয়ার টেকার কে কল করে বিষয়টা জানালো।
কেয়ার টেকার আধাঘন্টা পর তার স্ত্রীকে সাথে করে নিয়ে আসলো। ভদ্রমহিলা এসে কম্বল মোড়ানো কম্পরত কুহুর পাশে বসলো। কপালে গলায় হত দিয়ে জ্বর পরখ করলো। সাথে করে নিয়ে আসা একটা তরল রস চামচে করে কুহুর মুখে দিলো। কোনো গাছ গাছরার রস হবে বোধ হয়। কুহু রসটা খেয়েই মুখটা কুচকে ফেললো,হালকা গুঙিয়ে উঠলো। শাহাদ অন্য সাইডে কুহুর পাশে বসে কুহুর মুখের উপর ঝুঁকে পড়লো।অস্থির কন্ঠে বললো-
"কি হয়েছে কুহু? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?"
ভদ্রমহিলা স্থানীয় ভাষায় বললো-
"রসটা তেতো হওয়ার কারনে ওর খেতে খারাপ লাগছে। তাই এমন করেছে।"
শাহাদ স্থানীয় ভাষা কিছুটা বুঝে তাই সে মহিলার কথা ভাসা ভাসা বুঝতে পারলো। মহিলাটা কুহুর হাতে-পায়ে তেল মালিশ করতে লাগলো।আস্তে আস্তে কুহুর কাঁপুনি কমে গেলো। এক সময় কুহু আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। কেয়ার টেকার আর স্ত্রী বিদায় নিলো।বিদায় নেয়ার আগে শাহাদ বিনীতভাবে ধন্যবাদ জানালো দুজনকেই।দুজনকে বিদায় করে দিয়ে এসে কুহুর পাশে বসলো। কুহুর ঘুমন্ত মুখের দিকে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কম্বলের ভিতর থেকে কুহুর গরম হাতটা বের করে ঠোঁটে চেপে ধরলো। তার নিজেকে খুব দোষী মনে হলো।শুধু যদি সে কুহুকে এভাবে একা রেখে না যেত,শুধু যদি সে কুহুর সাথে থেকে পুলে নেমে সময় কাটাতো তাহলে হয়তো কুহু একা একা পুলে নামতো না। কুহু যে একাকীত্ব অনুভব করে একা একাই পুলে নেমেছে এটার দায়ভার সম্পূর্ন তার। শাহাদ তীব্র অপরাধবোধে নেতিয়ে গেলো। গত রাতের ব্যাপারটা সেই অপরাধবোধ আরো দ্বিগুন করে তুললো।
কুহুর সেরে উঠতে আরো একদিন লেগে গেলো।পুরোটা সময় শাহাদ কুহুর সাথে সাথে থাকলো। সেরে উঠার পরদিনই শাহাদ দেশে ফেরার জন্য বন্দোবস্ত করে ফেললো। সে আর পরিবার ছেড়ে কুহুকে নিয়ে একা এই দ্বীপে থাকার সাহস পেলো না। আরো অনেকদিন এই দ্বীপে থাকার ইচ্ছা থাকলেও কুহুর অসুস্থতায় ভয় পেয়ে শাহাদ সেই প্ল্যান বাদ দিলো। যাওয়ার দিন সকাল থেকেই সব গোছগাছ করতে আরম্ভ করলো কুহু।শাহাদ তাকে সাহায্যও করলো। এক সময় শাহাদ রেডি হয়ে বাইরে গেলো কেয়ারটেকারকে সব বুঝিয়ে দিতে। কুহু তখন নিজের লাগেজটা নিয়ে বিপাকে পড়ে গেলো। লাগেজে জামাকাপড় বেশি হয়ে যাওয়ায় লাগেজটার চেইন আটকাতে পারছে না। শেষমেশ বিছানার এক কোনায় লাগেজটা রাখলো। তারপর বিছানায় উঠে সে এক লাফ দিয়ে লাগজের উপর বসে পড়লো যাতে করে লাগেজটা লাগানো সহজ হয়। জোরে লাফ দিয়ে লাগেজে বসার কারনে আর লাগেজের ভারে কাঠের বিছানার কোনাটা হেলে গেলো।তার উপর কুহু নিজের টাল সামলাতে বিছানার কোনায় লাগানো স্ট্যান্ডটা হাতে আকড়ে ধরলো। স্ট্যান্ডটা কুহুর ভার সইতে না পেরে বেঁকে গেলো। স্ট্যান্ডটার সাথে জুড়ে থাকা অন্যান্য স্ট্যান্ড গুলোও হেলে গেলো।
শব্দ শুনে শাহাদ ঘরে এসে ঢুকলো।দেখলো বিছানার এক কোনা নিচে নেমে গেছে।সেই কোনায় লাগেজের উপর কুহু বসে আছে।তার এক হাত হেলে পড়া বিছানার স্ট্যান্ডে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে খুব কষ্টে পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে আটকাচ্ছে। শাহাদ বড় বড় পা ফেলে এসে স্ট্যান্ডটায় ধরলো তারপর হাত ধরে টেনে কুহুকে নামালো লাগাজের উপর থেকে। স্ট্যান্ডটা ছেড়ে দিতেই বাকি স্ট্যান্ডগুলোও হেলে গেলো। হতবাক কন্ঠে কুহুকে জিজ্ঞেস করলো-
"তুমি লাগেজের উপর কি করছিলে?আর বেড এভাবে হেলে গেলো কি করে?"
কুহু হঠাৎ এমন হওয়াতে খুব ভয় পেয়েছিলো শাহাদের কথায় আমতা আমতা করে উত্তর দিলো-
"লাগেজের চেইনটা আটকাচ্ছিলো না তাইই......."
"আমাকে ডাকতে পারতে। তা না করে নিজেই বিধ্বংসী কাজে লেগে পড়েছো।"
কুহু অপরাধী চোখে তাকালো। শাহাদ ভালো করে কুহুকে পরখ করলো। কোথাও লেগেছে কিনা দেখলো। তারপর তাকালো হেলে পড়া খাটটার দিকে। একটা হতাশ শ্বাস ফেললো সে। নিজেই এসে কুহুর লাগেজের চেইন টেনে লাগিয়ে দিলো। তারপর কুহুকে বললো লিভিং রুমে গিয়ে দাঁড়াতে। কুহু হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে লিভিং রুমে এসে দাঁড়ালো। শাহাদ লাগেজগুলো একসাথে করলো।কেয়ারটেকারের অল্প বয়সী ছেলেটা এসে ঢুকলো লাগেজ গুলো নিয়ে ইয়টে তুলে দেয়ার জন্য। ছেলেটা শাহাদের চেয়ে বছর পাঁচেক ছোট হবে। ঘরে ঢুকেই হেলে পড়া খাট দেখে তার চোখ দুটো রসগোল্লার মতো হয়ে গেলো। সে এমন এক দৃষ্টিতে শাহাদের দিকে তাকালো যেন শাহাদ কোনো এলিয়েন।শাহাদ ছেলেটির ভাবভঙ্গি বুঝতে পেরে বিব্রত অনুভব করলো। লাগেজগুলো ছেলেটাকে ইশারায় দেখিয়ে দিয়ে সে বেডরুমের দরজার বাইরে দাঁড়ালো। ছেলেটা নিজের বিস্ময় কাটিয়ে লাগেজগুলো তুলে নিলো। রুম থেকে বের হওয়ার আগে দরজার বাইরে দাঁড়ানো শাহাদের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে ইংরেজিতে বলল-
"হোয়াট আ পারফরম্যান্স ব্রো। ইউ আর গ্রেট।ইউ আর হিরো।"
একটা চোখ মেরে সে হাটা ধরলো বাইরের দিকে।ছেলেটার কথা শুনে শাহাদের কাশি উঠে গেলো, সে অল্প কাশলোও।ছেলেটা এখানেই থেমে থাকলো না।লিভিং রুমে দাঁড়ানো কুহুকে পাস করার সময় কুহুর সামনে দাঁড়িয়ে গলা নামিয়ে স্থানীয় ভাষায় কিছু বললো। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়-
"আপা জিতছেন।"
কুহু ভ্রু কুচকে ছেলেটার যাওয়ার দিকে দেখলো।তারপর শাহাদের দিকে তাকিয়ে বলল-
"কি বলে গেলো ছেলেটা?"
শাহাদ ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে ছেলেটার কথা।সে কুহুকে মিথ্যা করে বলল-
"বলেছে তুমি অনেক সুন্দরী।"
কুহুর ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেলো।লজ্জামিশ্রিত বিব্রত হেসে তাকালো ছেলেটির যাওয়ার দিকে।তারপর শাহাদের দিকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলল-
"আশ্চর্য!! ছেলেটা তো ভারী বেয়াদব।"
চলবে
No comments