গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ৪১

 #টক_ঝাল_মিষ্টি 

#তামান্না_আঁখি 

#পর্ব-৪১


ভোরবেলা হঠাৎ খান বাড়ির বেল কর্কশ শব্দে বেজে উঠলো। কুহু শাহাদের সাথে জিমেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। বেলের কর্কশ শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেলো।নিজেকে শাহাদের বুকে আবিষ্কার করলো,

 দুজনেই গত রাতে ফ্লোরে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। শাহাদের মাথার নিচে সোফায় থাকা ছোট্ট একটা কুশন আর কুহু ঘুমিয়ে ছিলো শাহাদের বুকের উপর। আবার বেল বাজতেই কুহু হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো।কুহু সরে যেতেই ঘুমন্ত শাহাদ নড়েচড়ে পাশ ফিরে ঘুমালো।।কুহু প্রথমে বুঝার চেষ্টা করলো এখন সকাল না রাত। জিমের কাচের দেয়ালে তাকিয়ে দেখলো দেয়ালের বাইরে বাগানে ভোরের আলো ফুটেছে। সে পাশ থেকে ওড়না তুলে নিয়ে গায়ে পেচিয়ে পা চালিয়ে সদর দরজার দিকে গেলো।


পুরো খান বাড়ি নীরব নিস্তব্ধ হয়ে আছে। কুহু বিশাল ড্রয়িং রুম পেরিয়ে বড় বড় পা ফেলে চললো সদর দরজার দিকে। বেল লাগাতার বেজেই যাচ্ছে। কুহু তাড়াতাড়ি লক খুলে ভারী কাঠের দরজা টেনে খুললো। বাইরের দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেলো। আনিশা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ মুখ বিষন্ন। সাথে দাঁড়িয়ে  আছে রাহাত। কুহুকে দেখেই আনিশা জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। কুহু নিজেকে সামলে নিয়ে আনিশাকে ধরে ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসালো। ততক্ষনে দুটো কাজের লোক চলে এসেছে। কুহু রেজিয়া সুলতানাকে ডেকে আনতে বললো তাদেরকে। রাহাত ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসে পড়লো।রাহাতের অবস্থা দেখে কুহু কাজের লোককে পানি দিতে বললো।পানি নিয়ে এলে রাহাত ঢকঢক করে সবটা শেষ করলো।কুহুর দিকে তাকিয়ে বললো-


"গতকাল থেকে কান্না করছে। এই অবস্থায় এত কান্না করলে ত বাচ্চারও ক্ষতি ওরও ক্ষতি।"


কুহু ক্রন্দনরত আনিশার দিকে তাকালো। পেট উঁচু হয়েছে আনিশার। আনিশাকে আগলে ধরে কুহু স্বান্তনা দিলো। কান্না করতে না করলো। আনিশা আসার খবর পেয়ে রেজিয়া সুলতানা ছুটে এলেন।পিছু পিছু এলো আশফাক খান। বাবা মাকে দেখে আনিশার কান্না আরো বেড়ে গেলো।আশফাক খানের কপালে ব্যান্ডেজ দেখে সে মুষড়ে পড়লো। রেজিয়া সুলতানা তাকে স্বান্তনা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন। আনিশা ফুপিয়ে উঠে বললো-


"এত বড় ঘটনা হয়েছে তোমরা আমাকে জানালে না।আমাকে নিউজ দেখে সব ঘটনা জানতে হয়েছে। রাহাতকে দিয়ে ম্যানেজার কে কল করিয়ে নিশ্চিত হয়েছি।"


আশফাক খান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন- 

"আমি ঠিক আছি রে মা।সবটাই একটা ছোট  এক্সিডেন্ট।আল্লাহ নিজেই বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন।আলহামদুলিল্লাহ। "


"আমি শুনেছি হিশাম চৌধুরিকে বাঁচাতে শাহাদ নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলো।এত বড় রিস্ক ও কি করে নিলো।"


আশফাক খান নীরব হয়ে গেলেন।এই বিষয়ে তার কিছু বলার নেই। ওই ঘটনার কথা মনে পড়লেই তার কলিজা কেঁপে উঠে। আহত হয়ে গাড়িতে পড়ে থাকা অবস্থায় উনি যখন দেখলেন শাহাদ ব্রিজ থেকে লাফ দিয়েছে তখনি উনার হার্ট এটাক হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিলো।আল্লাহ সহায় যে শাহাদ সুস্থভাবে ফিরে এসেছে। রাহাত বিনীত কন্ঠে আশফাক খান কে বললো- 


" আপনাকে নিয়ে বাবা মা খুব চিন্তিত। নির্বাচনের ব্যস্ততার কারনে আসতে পারে নি। বাবা চায় ঘটনার একটা তদন্ত হোক। আসল দোষী বের হয়ে আসুক।"


"অবশ্যই তদন্ত হবে। ট্রাক ড্রাইভার পলাতক। তাকে ধরলেই সব জানা যাবে।"


বাড়ির সবাই ততক্ষনে চলে এসেছে ড্রয়িং রুমে। কুলসুমা বেগম আর আব্দুল গাফফার খানকে সালাম দিলো রাহাত। দুজনেই সালাম নিয়ে আদরের নাতনীকে নিজেদের পাশে বসালেন। কুলসুমা বেগম নাতনিকে স্বান্তনা দিলেন।নাতনির বেবি বাম্প দেখে তিনি মনে মনে অনেক খুশি হলেন। কদিন ধরেই আনিশাকে দেখার জন্য মন ছটফট করছিল তার। ভাগ্যক্রমে সে ইচ্ছা পূরন হয়ে গিয়েছে। রাফা রিদি জয়া বেগমের সাথে নিচে নেমে আসলো।আনিশাকে দেখে দুজনেই খুশিতে বাক বাকুম করে উঠলো।বাড়ির পরিস্থিতির চাপে এই কদিন দুজন খুব নিরানন্দ অবস্থায় কাটিয়েছে। কুহুর ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার পর থেকে দুজনের সমস্ত দুষ্টুমি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল  আনিশাকে দেখে তারা প্রাণ ফিরে পেলো। আনিশাকে ঘিরে তাদের আবদারের শেষ রইলো না। 


পরিবারের লোকজনের সংস্পর্শে এসে আনিশা কষ্ট ভুলে গেলো। জয়া বেগমকে প্রশ্ন করলো- 

"চাচ্চু কি বাড়িতে নেই?"


জয়া বেগম শ্বাস ফেলে বললেন -

"না,ব্যবসার কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছে। তবে নির্বাচনের আগে চলে আসবে বলেছে।"


বাড়িতে এত শোরগোলের কারনে শাহাদের ঘুম ভেঙে গেলো।বিশেষ করে রাফা রিদির চিৎকার তার কানে লেগেছে খুব। পকেটে দুহাত পুরে শাহাদ জিম ছেড়ে বেরিয়ে আসলো। ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই তার ভ্রু কুচকে গেলো।রাহাতকে দেখা যাচ্ছে বসে থাকতে। আনিশা তার দিকে পিছন ফিরে বসে আছে বলে দেখতে পেলো না। শাহাদ চোখ রগড়ে দেখলো, না এটা রাহাত ই। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে আনিশা যে সোফায় বসে আছে সেখানে ঘাড় কাত করে তাকালো। আনিশাকে দেখে তার চোখের পাতা ভারি হয়ে গেলো। আনিশারও চোখ পড়লো শাহাদের দিকে।সে সোফা ছেড়ে উঠতে চাইলে শাহাদ তাড়াতাড়ি এসে আনিশার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। আনিশার বেবি বাম্প দেখে শাহাদ খুশিতে হাসলো। আনিশার দুহাত নিজের হাত নিয়ে হাতের উলটো পিঠে চুমু খেলো।


আনিশা স্নেহের দৃষ্টিতে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকালো। ধরা গলায় বলল- 

" কিভাবে পারলি এত বড় রিস্ক নিতে। একবারও আমাদের কথা মনে হয়নি?"


শাহাদ মুখের হাসি ধরে রেখে বলল- 

"মনে হয়েছে বলেই ত এই কাজ করেছি। নাহলে সবাই বলতো আনিশার ভাই কাপুরুষ। এখন সবাই বলবে আনিশার ভাই সাহসী।"


আনিশা কপট রাগের দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকালো।গাল ধরে জোরে টেনে দিলো। পরিবারের অন্যান্যরা মৃদু হাসলো।রাহাত উঠে এসে বললো- 

"হ্যা এটাই আমার সাহসী শা*লা, সে নিজের শত্রুকে বাঁচানোর জন্য নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। তাই না রে শালা!"


শাহাদ দাঁড়িয়ে রাহাতের সাথে বুক মেলালো। দুজন হাসিঠাট্টা করে কথা বলতে বলতে একটু সাইডে চলে গেলো। রেজিয়া সুলতানা বললো-


" এখন তাহলে ঘরে গিয়ে রেস্ট কর।মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে। কুহু ওকে ঘরে নিয়ে যাও।"


কুহু আনিশাকে নিয়ে উপরে চলে গেলো। আনিশাকে ঘরে দিয়ে এসে নিজের ঘরে এসে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিলো। এখন তার অনেক কাজ।। ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে একটু পরিপাটি হয়ে নেয়ার মাঝখানে শাহাদ ঘরে ঢুকলো। কুহুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আয়নার দিকে তাকালো। গাঢ় স্বরে বললো-


" ভাবছি আর দুইজন এই ঘরে থাকা উচিত হবে না। আমাদের তুলনায় ঘরটা অনেক বড়।"


কুহু ভ্রু কুচকে ঘাড় বেকিয়ে শাহাদের দিকে তাকিয়ে বলল- 

" তাহলে কোথায় থাকব আমরা?"


শাহাদ হতাশ চোখে কুহুর দিকে তাকালো। সে কি বললো আর এই মেয়ে কি বুঝলো!! সে কুহুর কপালে নিজের কপাল দিয়ে ঢুস মেরে বললো-

"এই ঘরেই থাকব বোকা মেয়ে। শুধু দুইজন থাকব না আরো এক দুইজন সাথে নিয়ে থাকব ।"


কুহু বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে রইলো। শাহাদের কাছে আর অন্য কোনো রাস্তা রইলো না সে গলার স্বর নিচু করে যা বলার বলে দিলো।কুহু শাহাদের দিকে ঘুরে বুকে কিল দিয়ে বলল- 

"শুধু অসভ্য কথা বলেন।"


"সত্যিই আমি এমনটা চাই।একটা ছোট কুহু ঘর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে,জিনিসপত্র এলোমেলো করছে, আমার কাজের ডিস্টার্ব করছে এরকমটা সত্যিই চাই।তুমি চাও না?"


কুহু অবনত মস্তকে লাজুক কন্ঠে বললো- 

" একটা ছোট শাহাদ খান চাই আমি। যাতে আপনার সাথে ঝগড়া হলে ওর কান মলতে পারি।"


" হূয়াট? দুষ্টু মেয়ে!! আমার কান মলতে চাও তুমি?হুম্ম?"


কুহু "চাই চাই চাই" বলে শাহাদকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড় দিলো। শাহাদ কুহুকে ধরার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো এর আগেই কুহু ঘর ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো।


-------


সকালের খাওয়া দাওয়ার পর কুহুর জন্য অনেক বড় একটা আনন্দের ব্যাপার ঘটে গেলো। শিরিনা বেগিম আর মোয়াজ্জেম হোসেন এলেন সাথে এলো যিয়াদ। বাবা মা আর ভাইকে দেখে কুহুর আনন্দের সীমা রইলো না। মোয়াজ্জেম হোসেন প্রানপ্রিয় বন্ধুর এক্সিডেন্টের কথা শুনে আর থাকতে পারেন নি তাই ছুটে চলে এসেছেন। আশফাক খান কেন জানায় নি এজন্য খুব রাগ করলেন। আশফাক খান বন্ধুকে শান্ত করে বললেন-

"তেমন কিছুই হয় নি তাই আর তোদের জানাতে চাই নি।কিন্তু সাংবাদিকগুলো তো আর চুপ থাকে না।ঠিক ই খবর জোগাড় করে নিউজে ছেড়ে দিয়েছে।"


শ্বশুর শ্বাশুড়ি আসা উপলক্ষে শাহাদ আর ওইদিন কোথাও গেলো না। শ্বশুড় শ্বাশুড়িকে বিনয়ের সাথে ভাল মন্দ জিজ্ঞেস করলো। একমাত্র শালা যিয়াদের সাথে সময় কাটালো। 


দুপুর যখন ছুই ছুই তখন সপরিবারে আশফাক খানের আরেক বন্ধু বদরুল আলম এসে হাজির হলো। তার সাথে আসলো তার স্থী মলিনা বেগম আর কন্যা এনা। মোয়াজ্জেম হোসেনেরও বন্ধু সে।তিন বন্ধু অনেক দিন পর একসাথে হয়ে গলাগলি অবস্থা। তারা আশফাক খানের অফিস রুমে আড্ডা বসালো। রেজিয়া সুলতানা মলিনা বেগমকে নিয়ে বাড়ির মহিলাদের সাথে ড্রয়িং রুমে বসলেন।এনাও তার মায়ের পাশে বসে কথাবার্তা শুনছে।ওই সময় শাহাদ উপর থেকে নিচে নামলো। তার পড়নে ক্যাজুয়াল সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট। শাহাদকে দেখেই এনা লাফ দিয়ে উঠে গেলো। এক প্রকার উড়ে গিয়ে শাহাদের সামনে দাঁড়ালো।হাত বাড়ালো হ্যান্ডশেকের জন্য। শরীর হেলদুলে নাড়িয়ে ন্যাকা কন্ঠে বললো- 


"হ্যালো শাহাদ, হাউ আর ইউ?"


কুহু তার মায়ের পাশে বসে ছিলো।পুরো ব্যাপারটাই সে আগাগোড়া লক্ষ্য করছিলো।এনাকে শাহাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে দেখে কঠিন চোখে তাকালো শাহাদের দিকে।শাহাদ হঠাৎ এনাকে সামনে দেখে আশ্চর্য হলো।প্রশ্ন করলো-


"আরে এনা!! বিদেশ থেকে কবে এলে?"


এনা আগের মতো ন্যাকা কন্ঠে বললো- 

" তার খবর কি আর তুমি রেখেছো।ইভেন এখনো আমার বাড়িয়ে রাখা হাত টা পর্যন্ত দেখোনি তুমি।"


শাহাদ বিব্রত হলো। এইভাবে মেয়েদের সাথে হাত মেলানোর অভ্যাস তার নেই।মহিলারা যেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে সেখানে তাকিয়ে সে আরো বিব্রত অনুভব করলো।সবাই যে যার মতো হেসে হেসে কথা বলছে কিন্তু কুহু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাহাদের দিকে। তার দৃষ্টির অর্থ হল একবার হাত ধরলেই শাহাদের খবর আছে।শাহাদ দৃষ্টি সরিয়ে এনার দিকে তাকালো। বললো-

"আমার তাড়া আছে।পরে কথা হবে তোমার সাথে।"


শাহাদ এনাকে এড়িয়ে চলে যেতে চাইলো।দু পা এগোতেই এনা নিজেই শাহাদের বাহু ধরে টেনে ধরলো। শাহাদ মনে মনে এরকমটাই ভাবছিলো। এনাকে তার বেশ ভালোভাবেই চেনা আছে। কুহুর দিকে তাকিয়ে দেখলো কুহু বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। এনা বললো-


"আগের চেয়ে অনেক বেশি হ্যান্ডসাম হয়েছো তুমি। এতদিন পর এসেছি এখন আর তোমাকে ছাড়ছি না। চল, আমিও তোমার সাথে যাব।"


শাহাদ দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলালো।এই ধরনের মেয়ে মানুষ তার ঘোর অপছন্দ। মন চাচ্ছে ঘাড়ে ধরে একে ছুড়ে ফেলে দিতে। সে এনার হাত ছাড়িয়ে নিলো জোর করে। তারপর কড়া করে বলল- 


" তুমি আমার স্ত্রীর সামনে অসভ্যতা করছো। ও এসব দেখে অন্য কিছু ভাবতে পারে।অনেকদিন পর যেহেতু এসেছো তাই সবার সাথে গিয়ে কথা বল।"


শাহাদ দ্রুত বেরিয়ে গেলো।এনা প্রত্যাখ্যাত হয়ে সাপের মতো ফোস ফোস করতে লাগল।ঘাড় বাকিয়ে কুহুর দিকে তাকালো। কুহু এনার দিকেই তাকিয়ে আছে।তার চোখেমুখে বিদ্রুপের হাসি। এনা পরাজিত হয়ে ধুপধাপ পা ফেলে সিড়ির দিকে গেলো। একটা কাজের লোককে ধমক দিয়ে তার রুম কোনটা দেখিয়ে দিতে বলে তাকে নিয়ে উপরে চলে গেলো।কুহু  মুখে বিদ্রুপের হাসি হাসলেও মনের গহীনে শাহাদের প্রতি কেন জানি একটা অভিমান চলে আসলো।


 বিয়ের আগে কি শাহাদের প্রেম ছিল? অন্য কোনো মেয়েকে পছন্দ ছিল? এসব নানা প্রশ্ন আসলো মনের ভিতর। কুহুর বুকের ভেতর হালকা ভার অনুভব হলো এসব চিন্তা করে। চিন্তাগুলো মাথা থেকে সরিয়ে আড্ডায় মনোযোগ দিতে চাইলেও পারলো না। মনের ভেতর একটা চাপা অভিমান রয়ে গেলো। 


--------


শাহাদ হাসপাতালের ভি আই পি কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সে একা এসেছে সাথে কাউকে নিয়ে আসে নি। হিশামের পরিবারকে এভাবে অসহায় অবস্থায় একা ছেড়ে দিতে পারে না সে। ভালো করেই জানে এই অসহায় অবস্থায় এই পরিবারটাকে ছিড়েখুঁড়ে খাবে শকুনের দলেরা। 


গার্ড দুইজন দরজার দুপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তারা শাহাদকে ঢুকতে দিচ্ছে না। বলছে এখন কারো ঢোকার অনুমতি নেই। শাহাদ ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জীবনে সে কোনো দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে অথচ তাকে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে এমন কখনো হয়নি। পারিবারিক হোক আর নিজের ক্ষমতা হোক দুটোই তার আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে কোনো ক্ষমতার প্রয়োগ করতে চায় না। সে এখন হিশামের ভার্সিটির জুনিয়র হয়ে এসেছে। শাহাদ অপেক্ষা করার এক পর্যায়ে হাসিব এসে উপস্থিত হলো। শাহাদকে অপেক্ষা করতে দেখে সে রাগান্বিত হয়ে গার্ডদের বললো-


"উনাকে বাইরে অপেক্ষা করানোর সাহস তোমাদের কিভাবে হলো?"


গার্ডদের একজন বললো-

"স্যার, উনাকে মনসুর আলী স্যার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে বলেছেন।"


হাসিব দাঁত কিড়মিড় করে বলল- 

"ওই বুইড়া তোমার স্যার হলো কিভাবে? ও তোমাকে পেমেন্ট দেয়? আর কোনোদিন শাহাদ ভাইকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখার সাহস দেখাবে না।বুঝেছো?"


হাসিব ধমকে উঠলো।শাহাদ হাসিবের কাঁধে হাত রেখে হাসিবকে শান্ত হতে বললো। হাসিব এই ঘটনার জন্য শাহাদের কাছে কিছুটা লজ্জিত হলো।তারপর শাহাদকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। বিশাল কেবিনের এক পাশের সোফায় মনসুর আলী আর নাইমুর বসে আছে। দুজনেই শাহাদকে দেখে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে তাকালো। মঞ্জুরা বেগম সিংগেল একটা সোফায় তাদের সাথে বসে আছেন। শাহাদকে দেখে ছেৎ করে উঠলেন-

"এই ছেলে তুমি আবার এসেছো? আর কি চাও তুমি? আমার ছোট ছেলেটাকেও মা*রতে চাও নাকি।"


শাহাদ গায়ে মাখলো না এসব কথা। সে ডানদিকের সোফায় তাকালো। তৃপ্তি শুকনো মুখে রিশামকে কোলে নিয়ে কোমায় থাকা হিশামের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। শাহাদকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তৃপ্তি বললো-


"তার বাবার জন্য কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে গেছে। বারবার গিয়ে তাকে স্পর্শ করে, হাত ধরে টানাটানি করে উঠতে বলে।"বাবা বাবা" বলে ডেকে কান্না করে। কি করে ওকে বুঝাই যে কোমায় থাকা মানুষ উঠতে পারে না কথা বলতে পারে না। বাবা না উঠলে খাবে না বলে জেদ ধরে আছে। আমি কোথা থেকে ওর বাবাকে এনে দিব বলতে পার?"


তৃপ্তি ঘুমন্ত রিশামকে বুকে চেপে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। শাহাদ বিষন্ন দৃষ্টিতে সে কান্না দেখলো। তৃপ্তির জায়গায় কেন জানি কুহুর মুখ টা ভেসে উঠলো।সহ্য করতে পারলো না চোখ সরিয়ে নিলো। মঞ্জুরা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল- 

" হিশাম ভাই নেই, হাসিবেরও বয়স হয় নি। এবারের নির্বাচনে কি করবেন ভাবছেন?"


মঞ্জুরা বেগম বললেন-

"সেটা কি তোমাকে বলতে হবে?"


মনসুর আলী মাথা নাড়িয়ে বললেন-

"বাবা শাহাদ,কিছু মনে কর না।বিরোধী দলের সাথে এসব আলোচনা করা তো উচিত না। নির্বাচন কিভাবে হবে না হবে এটা আমরা ঠিক করে নিব।"


শাহাদ মনসুর আলীর কথায় পাত্তা দিল না।মঞ্জুরা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল- 

"আমি একটা পরামর্শ দিতে চাই আপনাকে। হিশাম ভাইয়ের জায়গায় ভাবি নির্বাচনে দাঁড়াক।দলের লোকজন নেত্রী হিসেবে হিশাম চৌধুরীর স্ত্রীকে সহজেই গ্রহন করে নিবে। ভালো করে প্রচারণা চালালে নির্বাচনেও জেতার সুযোগ বেড়ে যাবে।"


মনসুর আলী "খেয়ে ফেলব" টাইপ দৃষ্টিতে শাহাদের দিকে তাকালো। নাইমুর কনুই দিয়ে মনসুর আলীকে গুতো দিয়ে চোখ টিপলো।এই ভয়টার কথাই একটু আগে সে মনসুর আলীকে বলেছিলো। মনসুর আলী সটান দাঁড়িয়ে গেলো।রাগীস্বরে বললো-


" অসম্ভব। তোমার এসব পরামর্শ কেউ মানবে না।"


শাহাদ বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল- 

"সেটা ঠিক করার আপনি কেউ না।"


মনসুর আলী মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিলো। মুখ থেকে রাগ সরিয়ে হালকা হেসে মঞ্জুরা বেগমকে বললো-

" হিশামের পরিবর্তে আপনিই আমাদের অভিভাবক। আপনিই ঠিক করুন কি হবে? বাড়ির বউ বাইরে গিয়ে নির্বাচন করবে এসবে তো বাড়ির মান সম্মানই থাকবে না নির্বাচনে জয় হওয়া তো দূরের কথা।"


মঞ্জুরা বেগম ক্ষুব্ধ চোখে শাহাদের দিকে তাকিয়ে বলল- 

"তূমি আমার পরিবারের যথেষ্ট ক্ষতি করেছো।আর না!কি ভেবেছো তৃপ্তিকে দিয়ে নির্বাচন করাব আর তুমি ওকে হারিয়ে সহজেই জিতে যাবে।তা হবে না।বের হয়ে যাও।নাইমুর ওকে বের করে দাও।"


হাসিব চিৎকার দিয়ে উঠলো -

"মা এসব কি করছো তুমি?"


মঞ্জুরা বেগম পরোয়া করলেন না ছেলের কথা। নাইমুর শাহাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো -


" খান সাহেব কি নিজে যাবেন নাকি আমাকে ঘাড় ধরতে হবে আপনার।"


এই কথায় শাহাদ একদমই বিচলিত হলো না।শান্ত দৃষ্টিতে নাইমুরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল- 


"আমি শাহাদ খান। তোর মতো ড্রেনের নিচে বাস করা কীট আমায় স্পর্শ করবে, এত সাহস তোর?"


নাইমুরের চোখে আগুন জ্বলে উঠলো।অপমানের সূক্ষ্ম খোচা লাগলো তার শরীর জুড়ে। আন্ডারওয়ার্ল্ড এর রাজা সে, আর শাহাদ তাকে ড্রেনের নিচের কীট বললো? সে শক্ত হয়ে শাহাদের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো,কিছু বললো না। 


শাহাদ মঞ্জুরা বেগমের দিকে তাকালো। মঞ্জুরা বেগম ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন। শাহাদ ব্যথিত হয়ে মনসুর আলীর দিকে এক নজর তাকিয়ে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। মনসুর আলী খুশিতে বাক বাকুম করে উঠলেন। এ যাত্রায় এই আপদকে বিদায় করা ।এবার মঞ্জুরা বেগমকে বুঝিয়ে শুনিয়ে দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে তাকে। তবেই তার আশা পূরন হবে।


চলবে

0 Comments:

Post a Comment