#টক_ঝাল_মিষ্টি
#তামান্না_আঁখি
#শেষপর্ব
নাইমুর আর মনসুর আলীর নামে অনেক জোরালো ভাবে মামলা করা হলো।দুজনের কারোরই আপনজন তাদের কে সাপোর্ট করতে এলো না।তাদের পক্ষের উকিলও বিন্দুমাত্র সুবিধা করতে পারলো না কারন সমস্ত প্রমান তাদের বিরুদ্ধে। শাহাদ সমস্ত সাক্ষী প্রমান আদালতে হাজির করেছে। আদালত দুজনকেই যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছে। দুজনেরই জায়গা হয়েছে অন্ধকার কারাগারে। দুজনকে আলাদা সেলে রাখা হয়েছিলো।শাহাদ দুজনকে নিজেদের মধ্যে আরেকবার কামড়াকামড়ি করার সুযোগ করে দিলো। নিজের কিছুটা ক্ষমতা খাটিয়ে দুজনকে এক সেলে থাকার ব্যবস্থা করলো। যেদিন দুজনকে এক সেলে দেয়া হলো সেদিন একজন আরেকজনকে দেখে রাগে ফেটে পড়লো। নাইমুর তেড়ে এসে মনসুর আলীর গলা টিপে ধরলো। রাগে কিড়মিড়িয়ে বললো-
"তোর জন্য আজকে আমার এই অবস্থা? তোকে আমি খু*ন করব।"
মনসুর আলী নাইমুরের নাক বরাবর একটা ঘুষি দিলেন। নাইমুর আঘাত পেয়ে তার গলা ছেড়ে দিলো।মনসুর আলী চিৎকার করে বললেন-
" তোর মতো অপদার্থ কে নিয়ে পরিকল্পনা করার জন্যই আমাকে ধরা পড়তে হয়েছে। শাহাদ খানের একটা চুলও ছিড়তে পারলি না।তোর মুখে থুথু।"
মনসুর আলী থুথু ছুড়ে মারলেন নাইমুরের দিকে। নাইমুর সরে গিয়ে থুথু থেকে নিজেকে বাঁচালো। মনসুর আলীকে কুৎসিত একটা গালি দিয়ে বলল-
" ভুলে যাস না আমি আন্ডারওয়ার্ল্ড এর ডন। সুযোগ এলে তোকে আমি মাছির মতো পিষে ফেলব।"
মনসুর আলীর মাথায় হঠাৎ করে একটা চিন্তা আসলো।মুহুর্তেই সে নিজের ভোল পালটে ফেললো। ইনিয়ে বিনিয়ে বললো-
"ইয়ে মানে নাইমুর। বদ্ধ সেলে থেকে মাথাটা আউলে গেছে তাই তোমার সাথে বেয়াদবি করে ফেলেছি।বাবা তুমি কিছু মনে করো না।"
নাইমুর ওসব কথায় ভুললো না। সে মনসুর আলীর স্বভাব জানে। সে সেলের এক কোনায় তার জন্য পাতা শক্ত বিছানায় গিয়ে বসলো। মনসুর আলী মুখে হাসি রেখে বলল-
" বলছি আন্ডারওয়ার্ল্ড এ তো তোমার অনেক নামডাক। ওখানকার সবাই তোমার আপন লোক।তাদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে কি?"
নাইমুর কঠিন চোখে তাকালো নাইমুর আলীর দিকে। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল-
"আন্ডারওয়ার্ল্ড এর কেউ আপন না। ওখানে আমার আর কোনো ক্ষমতা নেই। শাহাদ খান এখন ওই জায়গায় আসল ডন।"
মনসুর আলী অবিশ্বাসী চোখে তাকালেন।অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করলো-
"মানে?"
নাইমুর গর্জে উঠে বললো-
" মানে শাহাদ খান আসিফকে দিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ড এর দখল নিয়েছে। আসিফ এখন আন্ডারওয়ার্ল্ড এর কিং। আসিফের আড়ালে আন্ডারওয়ার্ল্ড কন্ট্রোল করবে শাহাদ খান। এখন এই শহরের সব কিছু হবে শাহাদ খানের অনুমতিতে।"
মনসুর আলী যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। এই জন্যই কি শাহাদের উপর গু*লি চালানো আসিফকে সে কোনো শাস্তি না দিয়ে শেল্টার দিয়েছিলো? শাহাদ কি অনেক আগে থেকেই এসব প্ল্যান করে রেখেছে? নাইমুর বললো-
" আর তুই টাকার ভাগ পাবার আশায় আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিস শাহাদ খানের হাতে। ভেবেছিস সে তোকে কিছু করবে না।এখন দেখ বিশ্বাসঘাতকতার স্বাদ কেমন!"
মনসুর আলী হতাশ মুখে নিজের বিছানায় বসে পড়লেন। শাহাদ কে তার বিশ্বাস করা উচিত হয় নি তা আগেই বুঝেছেন। আশা ছিলো শহরে অবৈধ কার্যকলাপে লিপ্ত এমন কাউকে টাকা খাইয়ে এখান থেকে বের হবেন।কিন্তু তাও এখন সম্ভব না।কারন শাহাদ খান এখন সমস্ত কিছুর কন্ট্রোল নিজের হাতে নিয়েছে। এখন মৃত্যু পর্যন্ত এই বদ্ধ কারাগারে পচে ম*রতে হবে।
----------
————––—————দুই বছর পর —————————
শাহাদ তার বেডরুমের সোফায় বসে ফাইল দেখছে। তার সামনের টেবিলের উপরেও ফাইল জমে পাহাড় হয়ে আছে। ফাইল দেখার ফাঁকে একবার সে সামনের দিকে তাকালো।কুহু ড্রেসিং টেবিলের বিশাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা ড্রেস ট্রায়াল দিচ্ছে। কোনোটাই তার পছন্দ হচ্ছে না।ড্রেসগুলো ছুড়ে বিছানায় ফেলছে। বিছানার উপর রীতিমতো একটা কাপড়ের দোকান হয়ে গেছে। শাহাদ তার ডানপাশে তাকালো। ঘন কালো চুলের শাবাব খেলনা গাড়ি হাতে নিয়ে তার মায়ের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে থেকে কুহুর কান্ডকারখানা দেখছে।তার পড়নে সি গ্রীন কালারের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা।দেখতে রাজপুত্রের মতো লাগছে।
শাহাদ ছেলেকে দেখে হালকা হাসলো।অনেক্ষন যাবত ছেলেটা সোফায় তার পাশে বসে আছে। একদম শান্তশিষ্ট স্বভাবের হয়েছে ছেলেটা। কিন্তু মেয়েটা হয়েছে অনেক দুষ্টু।এক জায়গায় স্থির থাকে না সে। অথচ দুজন জমজ।এক সাথে এক মায়ের পেট শেয়ার করেছে কিন্তু হয়েছে ভিন্ন স্বভাবের। আদর করে তাই শাহাদ নাম রেখেছে রায়া।
রায়া পেয়েছে মায়ের স্বভাব। সারাক্ষন এটা ওটা করে দুষ্টুমি করে। শাবাব পেয়েছে বাবার স্বভাব৷ একদম শান্ত প্রকৃতির। রায়া মায়ের স্বভাব পেলেও বাবাকে ছাড়া সে কিচ্ছু বুঝে না।সর্বক্ষন বাবার সাথে সাথে থাকে। শাবাব হয়েছে মা ঘেঁষা। মায়ের আঁচল ধরে মায়ের পিছু পিছু ঘুরে সে।
শাহাদ দরজার দিকে তাকিয়ে উঁকি দিলো। রায়া এখনো আসছে না তার মানে আরো কিছুক্ষন কাজ করার সুযোগ পাবে সে। রায়া থাকলে কাজ করা যায় না।সে সমস্ত ফাইল ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেলে।শাহাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইলের এই দশা সে করেছে। মেয়ের খেলার জন্য শাহাদ সেম ফাইল এনে দিয়েছে কিন্তু রায়া তা ছুয়েও দেখে না।সে শাহাদের গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলোই ধরে।স্টাডিরুম লক করেও কাজ করবে তার জো নেই শাহাদের।বাড়িতে থাকলে বাবাকে এক সেকেন্ডের জন্য হাতছাড়া করতে চায় না রাফা। সে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয়।
রায়া না থাকার এই সুযোগে শাহাদ কাজ গুলো এগিয়ে রাখছে। কুহু হতাশ হয়ে শ্বাস ছেড়ে বললো-
"উফফফ... একটা কিছু পছন্দ হচ্ছে না। আপনি একটা ড্রেস পছন্দ করে দিন না।"
শাহাদ কুহুর দিকে তাকালো। বেচারি ড্রেস ট্রায়াল দিতে দিতে হয়রান হয়ে গেছে।শাহাদের হাসি পেলো কুহুকে দেখে। সে ফাইলটা কোল থেকে নিচে নামিয়ে উঠে কুহুর কাছে আসলো।কুহুকে আয়নার দিকে ঘুরিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।কুহু চোখ রাঙিয়ে শাহাদকে ছাড়াতে চাইলো।বললো-
"কি করছেন! শাবাব দেখছে তো।"
শাহাদ কুহুর গালে চুমু খেয়ে বললো-
" শাবাব এসব বুঝবে না।"
ছোট্ট শাবাব সবে মাত্র হাঁটতে শিখেছে। মা বাবাকে একসাথে রোমান্স করতে দেখে সে সোফা থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে হেটে বাবা মায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। শাহাদের পাঞ্জাবির কোনা ধরে টান দিলো। ঘাড় বাঁকিয়ে উচু করে শাহাদের দিকে তাকিয়ে বলল-
"বাব..বাবা।"
শাহাদ মাথা নিচু করে ছেলের দিকে তাকালো।ঘাড় বাকিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকার কারনে ছোট্ট শাবাব টাল হারিয়ে দুম করে ফ্লোরে বসে পড়লো।ছেলের কান্ডে শাহাদ চওড়া হেসে এক টানে ছেলেকে কোলে তুলে উপরের দিকে ছুড়ে দিয়ে আবারো দু হাতে ধরে ফেললো।ছোট্ট শাবাব খিলখিল করে হেসে উঠলো।শাহাদ শাবাবের গালে শব্দ করে দু তিনটা চুমু খেলো।কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল-
" তোমার দুষ্টু মেয়েকে নিয়ে রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি নিচে এসো। গেস্ট রা সবাই চলে আসবে।"
শাহাদ শাবাবকে কোলে নিয়ে নিচে নামলো।পুরো বাড়ি সাজানো হয়েছে। আজ শাবাব আর রায়ার প্রথম জন্মদিন।নাতি নাতনীর জন্মদিনে বিশাল আয়োজন করেছেন আশফাক খান। কোনো কিছুতেই কমতি রাখেন নি। বাড়ির বাগানে খাবার খাওয়ানোর টেবিল পাতা হয়েছে।শহরের গরীব দুখী সবাইকেই দাওয়াত করা হয়েছে। শাহাদ নিচে নেমে রাফাকে সোফায় বসা দেখতে পেলো।ভারী লেহেঙ্গা পড়ে ফোনে কার সাথে চ্যাটিং করছে আর হাসছে। শাহাদ রাফার মাথায় টোকা দিয়ে বলল-
" দাদী জানের ঘর থেকে রায়াকে নিয়ে ওর মায়ের কাছে দিয়ে আয়। ওর তৈরি হতে হবে।"
এটা বলে শাহাদ বাইরের দিকে হাঁটা দিলো। কুলসুমা বেগম এত করে ছেলে চাইতেন অথচ শাবাবের চেয়ে রায়াকে নিয়েই তার সময় কাটে বেশি। আর রায়াটাও হয়েছে এমন আধো আধো বুলিতে সে কুলসুমা বেগমের সাথে গল্প জুড়ে দেয়।কুলসুমা বেগমে পানের বাটা নিয়ে খেলতে বসে যায়।
বাগানের মাঝখানে স্টেজ করা হয়েছে।সেখানে টেবিল পাতা হয়েছে। টেবিলের উপর বিশাল বড় একটা কেক। টেবিলের চারপাশে চারটা পিলার মাটিতে বসিয়ে সেখানে তাজা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। চারদিক মঁ মঁ করছে গন্ধে। স্টেজের পাশে রাহাতকে দেখা যাচ্ছে। সে তমালকে ধমকাচ্ছে। শাহাদ এগিয়ে গিয়ে রসিকতা করে বলল-
"দুলাভাইয়ের কি মেজাজ গরম? আমার বোন কি আজ ডোজটা বেশি দিয়েছে?"
রাহাত বাকা চোখে শাহাদের দিকে তাকালো। তমালকে এটা ওটা করতে পাঠিয়ে দিয়ে বলল-
" মেয়ে মানুষ বিয়ের পর ডাইনী হয়ে যায় বুঝলে।একটু মধু যদি মুখে থাকত। সকাল থেকে বলে আসছি সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান আমার পাঞ্জাবিটা বের করে ইস্ত্রী করে দাও। বের করেও রাখলো না ইস্ত্রীও করলো না। নিজে ঠিকই সাজতে বসে গেছে। এখন দেখো শশুড় বাড়িতে কুচকানো পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরছি।"
রাহাতের পাঞ্জাবি দেখে আসলেই শাহাদের মায়া লাগলো। দরদী কন্ঠে বললো-
"আহহা!! কোনো একটা কাজের লোককে দিয়ে ইস্ত্রী করালেই পারতে।"
"এটা করলে আমার আর বেঁচে থাকা লাগবে না। ইমোশনাল টর্চার করে আমাকে মে*রে ফেলবে। বলবে আমি অনেক খারাপ বউ যার কারনে কাজের লোককে দিয়ে পাঞ্জাবি ইস্ত্রী করিয়ে তুমি সেটা সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছো।"
শাহাদ ঠোঁট চেপে হাসলো।রাহাত গরম চোখে তাকালো। কার কাছে এতক্ষন তার দুঃখের কথা বললো। সেই বোনেরই তো ভাই,সে তো মজা নিবেই।শশুড় বাড়িতে এসে বউ এর উপর রাগ দেখাবে তারও জো নেই। শশুড় মশাই জানতে পারলে শটগান নিয়ে গু*লি টুলি করে দিতে পারে।
খানিক পরেই মোয়াজ্জেম আলী শিরিনা বেগম আর যিয়াদ এসে ঢুকলো বাড়িতে। শাহাদ শশুড় শাশুড়ীকে সালাম দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসলো। কেক কাটার সময় হয়ে আসলেও কুহুর সাজ শেষ হলো না।শাহাদ আবারো লোক পাঠালো কুহুকে ডেকে আনতে।আনিশা তার ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে সোফায় বসিয়ে রেখে বলল-
" খামোখা কেন মেয়েটাকে তাড়া দিচ্ছিস। আজ এই স্পেশাল দিনে মা মেয়েকে একটু মন ভরে সাজতে দে।"
শাহাদ হতাশ হয়ে মাথা নাড়লো।মা মেয়ে সাজতে বসলে দুনিয়া ভুলে যায়। এত দিন কুহুর এসব সহ্য করেছে মুখ বুঝে।এইবার সাথে এসে যোগ হয়েছে তার নিজের মেয়ে। মা মেয়ে দুজন একদম একে অন্যের জেরক্স কপি।আরেকটু সময় পরেই কুহু আর রায়াকে সিড়ির মাথায় দেখা গেলো।মা মেয়ে দুজনেই বেবি পিংক ফেইরি গাউন পড়ে নিচে নামলো।দুজনের মাথাতে ক্রাউন। শাহাদ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে স্ত্রী আর কন্যাকে দেখলো। ঘর আলো করে রাখতে এর চেয়ে বেশি আর কি লাগে জীবনে।
রেজিয়া সুলতানা কেক কাটার তাড়া দিলেন। কিন্তু শাহাদ বাধ সাধলো।বললো-
"আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে মা।হিশাম ভাই এখনো আসে নি।"
আর মিনিট কয়েক পরেই হিশাম তার পুরো পরিবার নিয়ে খান বাড়িতে ঢুকলো। কোমা থেকে জেগে উঠার দু বছর পরেও হিশাম পুরোপুরি সুস্থ হয়নি।তাকে ডক্টরের পর্যবেক্ষনে থাকতে হয়। শাহাদ হিশামকে দেখে এগিয়ে গেলো। হিশাম শাহাদকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো। শাহাদও বুক মিলালো হিশামের সাথে। হাসিব অস্থির চোখ নিয়ে খান বাড়ির আনাচে কানাচে দৃষ্টি ফেললো। যাকে খুঁজছে তাকে পেলো না।পকেট থেকে ফোনটা বের করলো কল করার জন্য।তখনি দুতলার করিডোরে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো আকাংখিত ব্যাক্তিটিকে।
রাফা উপর থেকে হাসিবের দিকে ফ্লাইংস কিস ছুড়ে দিলো। হাসিব যতটা না মুগ্ধ হয়েছিলো রাফাকে দেখে তার থেকে বেশি লজ্জা পেলো এই কান্ডে। সে দ্রুত অন্যদিকে তাকালো।এই মেয়ে এত পাজি হয়েছে তা বলার বাইরে।
রেজিয়া সুলতানা বেশ রাগ করে হিশামকে প্রশ্ন করলেন-
"আপাকে আনলে না কেন?"
তৃপ্তি হেসে জবাব দিলো-
"মায়ের প্রেশার টা একটু বেড়েছে তাই এত কোলাহলে নিয়ে আসি নি।"
মঞ্জুরা বেগম না আসায় রেজিয়া সুলতানার বড্ড মন খারাপ হলো। ভেবেছিলো একসাথে মিলে একটু সুখ দুঃখের গল্প করবে তা আর হলো কই।
হৈ হুল্লোড়ের মাঝে শাবাব আর রায়ার কেক কাটা হলো। পুরো খান বাড়িতে আলোর রোশনাই যেন দ্বিগুন বেড়ে গেলো। কেকের প্লেট হাতে আশফাক খান মোয়াজ্জেম সাহেবের পাশে বসলেন। প্রিয় বন্ধুকে কেক খাইয়ে দিয়ে বললেন-
" বুঝেছিস মোয়াজ, আজ এই খুশির দিনে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।দোয়া করি আল্লাহ যেন ওদের নেক হায়াত দান করে। সারাজীবন যেন এইভাবেই হাসিখুশি থাকে।"
মোয়াজ্জেম হোসেন রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন। মেয়ের জন্য এমন সুখের স্বপ্নই তিনি দেখতেন। সবসময় চাইতেন মেয়ে যেন মহাসুখে সংসার করে।আজ চোখের সামনে মেয়ের সুখ দেখে তাঁর বুকটা ভরে গেছে।
অনুষ্টানের এক পর্যায়ে খান বাড়ির বিশাল ড্রয়িং রুমে সবাই বসে আলোচনায় ব্যস্ত। হিশামের পাশে শাহাদ রায়াকে কোলে নিয়ে বসলো।হিশামের অপর পাশে বসে থাকা রিশাম পরীর সাজে থাকা ছোট্ট রায়াকে একবার উঁকি দিয়ে দেখলো।রায়ার হাতে বড়সড় একটা মেয়ে পুতুল দেখে বাবার কাছে কানে কানে বললো তারও এরকম বড় পুতুল চাই তবে সেটা ছেলে পুতুল হতে হবে। হিশাম মৃদু হেসে ছেলেকে এরকম পুতুল কিনে দিতে রাজি হলো। তার পর সে সবার দিকে তাকালো।এখানে রেজিয়া সুলতানা থেকে শুরু করে জয়া বেগম, কুলসুমা বেগম সবাই আছেন।আনিশা আর রাহাতও তাদের ছেলে আনাস কে নিয়ে হাসিমুখে বসে আছে। কুহুর মাও আছেন এইখানে। আশফাক খান মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে এক পাশে বসে আলোচনায় মেতেছেন। তাদের সাথে শাহাদের ছোট চাচা এমদাদ খানও উপস্থিত।আব্দুল গাফফার খান ও লাঠিতে দুহাত রেখে সোফায় বসে তাদের আলোচনা শুনছেন। হিশাম এই পরিবেশটাকেই তার প্রস্তাব পেশ করার জন্য উপযুক্ত মনে করলো। পাশে বসা তৃপ্তির দিকে তাকালো। ইশারায় জানতে চাইলো হাসিব কোথায়। তৃপ্তি নিচু স্বরে বলল-
"বাগানে বোধ হয়। "
হিশাম গলা ঝেড়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল-
" আমি একটা প্রস্তাব পেশ করতে চাই।"
সবার দৃষ্টি ঘুরে গেলো হিশামের দিকে।হিশাম সবার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে বললো-
" আমি চাই আমাদের পারিবারিক বন্ধনটা দৃঢ় হোক যাতে আর কোনো বহিশত্রু আমাদের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি করতে না পারে। আর বন্ধন্টা দৃঢ় করতে দুই পরিবারের মাঝে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেয়া প্রয়োজন।"
কুহু সামনের সোফায় বসে শাবাবকে কেক খাওয়াচ্ছিলো।সে শাহাদের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকালো।এরপর বললো-
" কিন্ত রায়া আর রিশাম তো এখনো ছোট। এত আগে থেকেই ওদের বিয়ে ঠিক করে রাখা কি ঠিক হবে?"
স্ত্রীর কথা শুনে শাহাদ অবাক চোখে হিশামের দিকে তাকালো। হিশাম কি রায়া আর রিশামের ব্যাপারে কথা বলছে নাকি? হিশাম কিছুক্ষন থমকে গিয়ে তাকিয়ে রইলো এরপর হো হো করে হেসে উঠলো। মাথা নেড়ে বললো-
" আমি রায়া রিশামের কথা বলছি না, আমি হাসিব আর রাফার কথা বলছি।"
কুহু প্রচন্ড লজ্জা পেলো। সে লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিলো। রাফা তার মায়ের পাশে বসা ছিলো এই কথা শুনে সে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো। হিশাম আশফাক খানের দিকে তাকিয়ে বলল-
" আর দু বছর পর হাসিবের গ্র্যাজুয়েশন কম্পলিট হবে। সে পড়াশোনার পাশাপাশি আমার ব্যবসাতেও সাহায্য করে।তবে রাজনীতিতে আমি আমার ভাইকে জড়াব না।সামনের ইলেকশনেও তাকে আমি দূরে রাখব।আমি চাই সে ব্যবসা সামলাক।। আমার মা ইদানিং অসুস্থ থাকেন।তাই উনার খুব ইচ্ছে ছোট ছেলের বউ দেখবেন। যদিও ওদের বয়স অল্প কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি আপনাদের বাড়ির মেয়ে আমার বাড়িতে খুব যত্নে থাকবে।"
আশফাক খান এমদাদ খানের দিকে তাকালেন। মেয়ের পিতা যা বলবে এখানে তাই-ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।এমদাদ খান স্ত্রী জয়া বেগমের দিকে তাকালেন।জয়া বেগমকে একটু মনমরা দেখা গেলো। তবে এমদাদ খানের দিকে তাকিয়ে ইশারায় নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন।এমদাদ বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো।অর্থাৎ তিনি এবং তার স্ত্রী রাজি।
হিশাম হাল্কা হেসে শাহাদের দিকে তাকিয়ে বলল-
" শাহাদ তর আর আমার মাঝে যেই শত্রুতা তৃতীয় পক্ষ সৃষ্টি করেছিলো আশা করি তার অবসান ঘটেছে। সামনের নির্বাচনে আমি আর তুই আবারো প্রতিপক্ষ হয়ে লড়ব,কিন্তু এতে আমাদের সম্পর্কে কখনো শত্রুতা তৈরি হবে না। কুহুর মুখ থেকে যেহেতু এই কথা বের হয়েছে সেহেতু রায়া আর রিশামের বিয়ে আমি দেবই। তুই অমান্য করতে পারবি না আমার কথা। "
শাহাদ মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো। মেয়ে অনেক ছোট এরপরেও কলিজার টুকরা মেয়ের বিয়ে দিতে হবে ভেবে বুকের ভেয়রটা মোচড় দিয়ে উঠলো। উপস্থিত সবাই হাসিব আর রাফার ব্যাপারে হিশামের প্রস্তাব মেনে নিলো। রাফা পর্দার আড়াল থেকে সেই কথা শুনলো।সে দ্রুত মোবাইলের কী বোর্ডে হাত চালিয়ে খুশির সংবাদটা হাসিবকে জানালো। অবশেষে দু বছরের প্রেম সফল হতে যাচ্ছে তাদের। রাফার মেসেজ পেয়ে হাসিব বিন্দুমাত্র অবাক হলো না।সে উলটো রাফাকে অবাক করে দিয়ে জানালো হিশামের কাছে সে নিজেই রাফাকে বিয়ে করার কথা বলেছে। সে সূত্র ধরেই হিশাম আজ বাড়িতে এই প্রস্তাব পেশ করেছে। রাফা হা হয়ে গেলো এমন কথা শুনে। সবসময় ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে থাকলেও হাসিব যে তলে তলে এত দূর এগিয়ে যাবে তা রাফার কল্পনাতেও ছিলো না।
পরিষ্কার আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। চারদিকে এক মায়াবী জোৎস্না। খান বাড়িতে এখনো লাল নীল বাতি জ্বলছে। বাগানে আউটহাউজের সামনে দলের কয়েকটা ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কুহু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনে চাঁদের দিকে তাকালো। এত সুন্দর চাঁদ এর আগে কখনো দেখে নি সে। নাকি জীবনে এত সুখ বলেই চাঁদটাকে বেশি সুন্দর লাগছে আজ।
হঠাৎ উষ্ণ স্পর্শ টের পেলো। শাহাদ জড়িয়ে ধরেছে পিছন থেকে। উষ্ণ আবেশে কুহুর চোখ লেগে আসতে চাইলো।শাহাদ কানের কাছে মুখ এনে বললো-
" শাবাব আর রায়া আজ তাদের দাদীর সাথে ঘুমোতে গিয়েছে।"
কুহু চোখ বন্ধ করে শাহাদের গায়ের গন্ধ নিতে নিতে বললো-
"হুম তো?"
শাহাদ কুহুর কানের কাছে মুখ নিয়ে কানে কানে কিছু বললো। কুহু কনুই দিয়ে শাহাদের বুকে গুতো দিয়ে বলল-
" যাহ!!অসভ্য কথাবার্তা। "
শাহাদ কুহুর চুলে নাক ডুবালো। মনে পড়লো কয়েক বছর আগের কথা যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিলো দুজনের। তখনও কি ভেবেছিলো এই মেয়েটি একদিন তার ঘরের রানী হবে? তার সন্তানদের মা হবে? শাহাদ গভীর কন্ঠে কুহুকে ডাকলো-
"কুহু।"
এমন ডাক শুনে কুহুর বুকের ভেতর কাঁপন ধরে গেলো। তার কন্ঠ রোধ হয়ে আসতে চাইলো। সে কাঁপা গলায় উত্তর দিলো-
"হুম্মম?"
শাহাদ আরো গভীর কন্ঠে বললো-
"আমায় ভালোবাসো কুহু?"
কুহুর পুরো শরীর জুড়ে স্রোত বয়ে গেলো।সে মৃদু কন্ঠে উত্তর দিলো-
" ভালোবাসি।"
" তাই? তাহলে সেটার প্রমান কই?"
কুহু অস্থির হয়ে গেলো। কি এমন প্রমান চায় শাহাদ? এত বছর পরেও কি কুহুর ভালোবাসা নিয়ে তার মনে সন্দেহ আছে? সন্দেহ থাকলে কুহু যেকোনো প্রমান দিতে রাজি আছে।সে প্রশ্ন করলো-
"কি প্রমান?"
শাহাদ দুষ্টু হাসলো।কুহুর কানের কাছে মুখ নিয়ে আগের অসভ্য কথা গুলো পুনরায় বললো। কুহু গাল ফুলিয়ে তাকালো শাহাদের দিকে। শাহাদ ঠোঁট কামড়ে হাসছে। কুহু প্রমান দেয়ার কথা শুনে অস্থির হয়ে গিয়েছিলো আর এই লোক কিনা মজা করছে তার সাথে। সে জোর দিয়ে বলল-
"না, একদম না।"
শাহাদ কন্ঠ অসহায় করে বলল-
"প্লিজ হুকু।"
কুহু গরম চোখে তাকালো।শাহাদের বুকে ঘুষি মারতে উদ্ধত হলো।শাহাদ শক্ত হাতে কুহুর হাত ধরে ফেললো। তারপর এক টানে কোলে তুলে নিলো কুহুকে। কুহু হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগলো।তবে এতে শাহাদের কিছু যায় আসে না। তার রানীকে পোষ মানানোর মন্ত্র তার জানা আছে। সে কুহুকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো।খানিক পরেই লাইট অফ হয়ে গেলো।
আকাশে থাকা চাঁদ টা যেন তার জোছনার আলো আরেকটু বাড়িয়ে দিলো।সেই জোছনার আলো এনে ফেললো কুহু আর শাহাদের বারান্দায়। জোছনার আলো যেন বারান্দার দরজা দিয়ে কিছুটা হলেও কুহু আর শাহাদের অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করে তাদের ভালোবাসার মুহুর্তটা আরো দ্বিগুন প্রেমময় করে দেয় তারই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালালো চাঁদটা। এই ভরা জোছনাও যেন প্রাণপণ চেষ্টা করছে এই যুগলের প্রেমের সাক্ষী হয়ে থাকতে।
সমাপ্ত
0 Comments:
Post a Comment