#এক_তুমিতেই_আসক্ত
#আয়ান_মাহমুদ
|৩|
লিসবন শহরের আকাশে সেদিন এক অদ্ভুত মেঘ জমেছিল। বাতাসে একটু ঠাণ্ডা অনুভূতি ছিল, তবে সুর্যাস্তের সময়, আকাশে গোলাপী ও কমলা রঙের আভা মিশে এমন এক রূপ নিয়েছিল, যা চোখ থেকে মুছে ফেলা ছিল কঠিন। ক্যাম্পাসের বাইরের সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে তুর্য তার মনে খুঁজছিল কিছু শান্তি। ক্লাসগুলো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল, তবে তার মনের ভেতর এক অন্য ধরনের শান্তি ঘিরে ছিল।
এদিকে, তন্নীও সেদিন ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে কেবল শান্ত পায়ে হেঁটে চলছিল, যেন তার প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যে এক ধরনের নিরবতা ছিল, আর সেই নিরবতায় যেন অনেক কিছু বলা হচ্ছিল। তন্নী কখনোই ব্যস্ততায় হারাতে চায়নি, সে তার নিজস্ব জায়গায় থাকতে ভালোবাসত। তার চোখে একটি অবিরাম চিন্তার খোঁজ ছিল, আর সেই চিন্তা কখনো প্রকাশ পেত না। তন্নী আসলে কাউকে কিছু বলত না, কারণ সে জানত, কথার চেয়ে অনেক গভীর কিছু আছে যা শব্দে প্রকাশ করা যায় না।
একদিন সন্ধ্যায়, তুর্য ক্যাম্পাসের সাঁকো পার হয়ে যাচ্ছিল, তখন হঠাৎ তন্নীকে দেখতে পেল। সে চুপচাপ নিচু চোখে হাঁটছিল। তুর্য কিছু মুহূর্তের জন্য থেমে দাঁড়ালো, কেননা তার কাছে তন্নী যেন এক রহস্য। তার প্রশান্ত দৃষ্টি, শান্ত পায়ে হাঁটা, আর সেই নিস্পলঙ্ক রূপ যেন তুর্যকে আকৃষ্ট করছিল। তুর্য তন্নীর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, "তন্নী, কেমন আছো? আজকে কি তুমি কোথাও যাচ্ছ?"
তন্নী একটু থেমে, তার স্বাভাবিক ধীর গতি বজায় রেখে তাকালো। তার চোখের মধ্যে এক অদ্ভুত ভাব ছিল, তবে মুখে কোনো পরিবর্তন ছিল না। "আমি ভালো আছি," তন্নী সংক্ষেপে উত্তর দিল, "একটু হাঁটছিলাম, একটু একা থাকতে ভালো লাগছিল।"
তুর্য হাসি দিয়ে বলল, "এটা তো অনেক ভালো, কিন্তু মাঝে মাঝে একা থাকাও ভালো। আমি কিন্তু আছি এখানে যদি তোমার কিছু বলার থাকে।"
তন্নী এবার এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেছিল। তার চোখে কোনো বিচলনা ছিল না, তবে কিছু একটা ভেতর থেকে পিপাসার মতো অনুভব হচ্ছিল। সেদিন তন্নী বুঝতে পারছিল, তার জীবন আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে—এ মুহূর্তে, সে যেন তার স্নিগ্ধ জীবনের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন চাইছিল। কিন্তু সেই পরিবর্তনটি কিভাবে আসবে, তা সে জানত না।
"আমিও বেশি কথা বলতে পছন্দ করি না," তন্নী ধীরে ধীরে বলল, "কিন্তু অনেক সময় কথা বলার মতো কিছু না থাকলে, চুপ থাকা ভালো।"
তুর্য বুঝতে পারছিল, তন্নী তার মতো নয়। সে খুব কম কথা বলত, তবে প্রতিটি শব্দে গভীরতা ছিল। তুর্য এই মুহূর্তে বুঝতে পারল—তন্নী সবার মতো নয়। তার মধ্যে এমন এক রূপ ছিল, যা কিছুতেই ঠিকভাবে ধরতে পারছিল না। তুর্য জানত, তার কাছে তন্নী এক রহস্যের মতো।
তন্নী কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর বলল, "তুমি কি এখানে আসো নিয়মিত?"
"হ্যাঁ," তুর্য একটু হেসে বলল, "বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম মেনে চলতে হয়। তবে মাঝে মাঝে একা হাঁটতে ভালো লাগে।"
তন্নী আর কিছু বলল না, তবে কিছু মুহূর্তের জন্য দুজনেই একে অপরকে কিছুটা সময়ের জন্য মোনালিসার ছবির মতো, নিঃশব্দভাবে লক্ষ্য করছিল।
এরপর, তন্নী তার দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি কি পর্তুগালের অন্যান্য জায়গা দেখেছো? আমি কিছু জায়গা সম্পর্কে জানি, খুব সুন্দর।"
এ কথা শুনে তুর্য অবাক হয়ে বলল, "হ্যাঁ, পর্তুগাল অনেক সুন্দর জায়গা। তবে আমি সব জায়গা ঘুরে দেখিনি, কেন তুমি কোথাও যেতে চাও?"
তন্নী হালকা হাসি দিয়ে বলল, "হ্যাঁ, কিছু জায়গা খুব সুন্দর, কিন্তু আমি যাইনি। হয়তো একদিন আমরা একসাথে ঘুরতে যেতে পারি।"
তুর্য এই কথায় একটু থমকে গেল। যদিও এটা খুব সাধারণ প্রস্তাব ছিল, তবে তন্নীর মুখ থেকে কথাটা শুনে সে বুঝতে পারল—তন্নী আসলে এই প্রস্তাব দিচ্ছিল এক বিশেষ অর্থে।
"তাহলে, পরবর্তী সপ্তাহে আমরা কোথাও যেতে পারি," তুর্য কিছুটা অবাক হয়ে বলল।
তন্নী মাথা নেড়ে একমত হলো, তবে কোনো কথাই বলল না। তারপর তারা একে অপরকে একপাশে বিদায় জানিয়ে ক্যাম্পাসের মধ্যে মিশে গেল। তুর্য জানত, পরবর্তী সপ্তাহে কিছু একটা হবে, কিন্তু তন্নীর কাছ থেকে সে কেমন এক অনুভূতি অনুভব করছিল—যা কখনো শব্দে প্রকাশ করতে পারবে না।
তন্নী চলে যাওয়ার পর, তুর্য এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে রইল, যেন এই ছোট্ট কথোপকথন তার মনে গভীর ছাপ রেখে গেল।
এটাই ছিল তাদের মধ্যে প্রথম অনুভূতি।
চলবে__
0 Comments:
Post a Comment