1t/Banner 728x90

গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ৪৯

 #টক_ঝাল_মিষ্টি 

#তামান্না_আঁখি 

#পর্ব-৪৯


আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চাঁদের জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। বারান্দার দোলনায় কুহুকে বুকে নিয়ে শুয়ে থেকে সেই চাঁদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাহাদ। ইদানিং নিজেকে তার খুব সুখী সুখী লাগে। আবার এত সুখের কারনে ভয়ও লাগে যদি সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী না হয়। শাহাদ জোর করে মন থেকে এসব ভাবনা দূর করার চেষ্টা করলো। অনাগত সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে সেই ভয় কাটাতে চেষ্টা  করলো। চাঁদ থেকে চোখ সরিয়ে কুহুর মুখের দিকে তাকালো। চাঁদের আলোতে ঘুমন্ত কুহুকে দেখতে অপূর্ব লাগছে। সে আলতো করে কুহুর কপালে চুমু খেয়ে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরলো। 


শাহাদের উষ্ণ ছোয়াতে কুহুর ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে গেলো।চোখ মেলে তাকালো। দোলনার হালকা দুলুনিতে বুঝতে পারলো সে শাহাদের সাথে দোলনায় শুয়ে আছে। প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে বদ্ধ ঘরে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই শাহাদ বিশাল এক দোলনা এনে বারান্দায় টানিয়ে দিয়েছে।গোল সাইজের বিশাল দোলনার চারপাশে পর্দা টানানো। প্রায় রাতেই শাহাদ তাকে নিয়ে দোলনায়ই ঘুমিয়ে যায়।কুহু মুখ উচু করে শাহাদের দিকে তাকালো। শাহাদও তাকালো কুহুর দিকে।কুহু শাহাদের বুক থেকে মাথা তুলে উঠে বসলো। শাহাদের দিকে তাকিয়ে আচমকা প্রশ্ন করলো- 


"আপনার ছেলে চাই নাকি মেয়ে চাই?"


আচমকা এমন প্রশ্নে শাহাদ কিছুটা বিস্মিত হলো। এক হাত মাথার নিচে দিয়ে প্রশ্ন করলো- 

"হঠাৎ এই প্রশ্ন?"


"দাদীজান বলেছে উনার নাকি ছেলে চাই।ছেলে যদি না হয় তাহলে আমি কই থেকে ছেলে আনব শুনি। "


শাহাদ মুচকি হেসে বলল- 

" দাদীজান শুধু তোমাকেই বলে না আমার উপরেও একই অত্যাচার শুরু করেছেন।"


" দাদীজান আমাকে এই জন্য পানি পড়াও এনে দিয়েছে।"


শাহাদ ভ্রু কুচকে বিস্মিত কন্ঠে বললো-

" তাই নাকি? মাই গড!!"


কুহু বললো-

"আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই পানিপড়া আমি একা খাব না, আপনাকেও খাওয়াব। বাচ্চা তো আর আমার একার না। এইখানে আপনারও অবদান আছে।"


শাহাদ দুষ্টু হেসে উঠে বসলো।কুহুর গা ঘেষে বসে তার গালে নাক ছুয়ে মোহনীয় কন্ঠে বললো- 

"তাই!! কি ধরনের অবদান? কেমন অবদান?"


কুহু শাহাদের দুষ্টুমি বুঝে গেলো।শাহাদ আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার আগেই লাফ দিয়ে দোলনা থেকে নেমে গেলো।বললো-

"এসব কিছু বুঝি না। আপনাকেও খেতে হবে পানিপড়া।"


"কিন্তু বেবি তো তোমার পেটে। আমি খেয়ে কি করব?"


কুহু ঘর থেকে পানিপড়ার গ্লাস নিয়ে এসে বললো- 

"কি করবেন তা আপনি জানেন। কিন্তু আমার সমস্ত কিছুর অর্ধেক ভাগ আপনাকে নিতে হবে।"


কুহুর কথা শুনে শাহাদ মজা পেলো। কৌতুকপূর্ন কন্ঠে বললো- 

" অর্ধেক ভাগ দিতে চাইলে তো তোমার সাথে সাথে আমাকেও মাদার হরলিকস খেতে হবে। ডেলিভারির দিন আমাকেও লেবার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়তে হবে।"


কুহু চোখ রাঙিয়ে তাকালো শাহাদের দিকে। শাহাদকে গ্লাস টা দিয়ে বলল-

" নিন ধরুন। গ্লাসের অর্ধেক আপনি খাবেন বাকি অর্ধেক আমি।"


শাহাদ ছোট একটা শ্বাস ফেলে গ্লাসটা নিলো। প্রেগন্যান্সির সময় মেয়েদের মুড সুইং হয় শুনেছে কিন্তু এই ধরনের ভূত চাপে ওদের মাথায় তা জানা ছিলো না। এই সময় সে বউকে রাগাতে চায় না। তাই গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দিলো। এক চুমুক খাওয়ার পর সে কুহুর দিকে ছোট ছোট চোখে তাকালো। বললো-


"এই তোমার পানিপড়া?"


কুহু হি হি করে হাসলো। বললো-

"সন্ধ্যায় মা এই শরবত টা বানিয়ে রেখে গিয়েছিলেন।খেতে আর মনে নেই। এখন মনে পড়লো। তাই আপনার সাথে একটু দুষ্টুমি করলাম। দাদীজান এরকম কোনো পানিপড়া দেয় নি আমাকে।"


শাহাদ চাঁদের আলোয় কুহুর হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। কুহুকে নিজের পাশে বসিয়ে শরবতটা তাকে খাওয়ালো। এরপ কুহুকে বুকে নিয়ে দোলনায় রাখা বালিশটায় শুয়ে পড়লো। দুজনের ভারে দোলনাটা এদিক ওদিক দোল খেলো। কুহু শাহাদের বুকে শুয়ে গল্প জুড়ে দিলো। তাদের ছেলে হলে কি করবে,মেয়ে হলে কি করবে এসব কথাবার্তা। শাহাদ মনোযোগ দিয়ে শুনছে সব।এসব শুনতে ভালো লাগে। এসব কথা কুহু হাজার বার বলে ফেলেছে।এরপরও এসব শুনতে তার বিরক্ত লাগে না বরং সুখ লাগে।


শাহাদ আবারো চাঁদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।মনে মনে অনেক প্ল্যান তার। এতদিনের গজিয়ে উঠা বিষদাঁত উপড়ে ফেলার প্ল্যান।সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে খুব শীঘ্রই সব অপরাধীকে শাস্তি দিবে। তার সন্তান যখন দুনিয়ায় আসবে তখন যেন তার নিরাপত্তায় কেউ বাঁধা দিতে না পারে সেই ব্যবস্থা এখন ই করে রাখবে সে।


------------


মনসুর আলী নাইমুরের সাথে হিশামের অফিসে বসে আছে। হিশাম না থাকায় এই অফিসের একচ্ছত্র অধিপতি এখন সে। নাইমুর রাগে ফুসছে। তার চোখমুখ কঠিন। কঠিন চোখে সে মনসুর আলীর দিকে তাকিয়ে আছে। মনসুর আলী নিজেও চরম বিরক্ত। সে টেবিলে থাবা দিয়ে বলল- 


"ওই বুড়িকে কিছুতেই বুঝাতে পারলাম না। বুড়ি ছেলে আর ছেলের বউ এর পাল্লায় পড়ে বাড়ি নিলামে তুলতে রাজি হলো না।"


নাইমুর চোয়াল শক্ত করে বসে রইলো।তার চোখ লাল হয়ে আসছে। গত দু তিন রাত তার ঘুম নেই। মনসুর আলীর উপর বিশ্বাস করে সে এতগুলো টাকা মাঠে নামিয়েছিল। এখন সব টাকাই জলে গেছে। হিশামের অফিসের একাউন্টে তেমন টাকা মেলেনি। আন্ডারওয়ার্ল্ড টাকায় চলে। সেখানকার লোকেদের কন্ট্রোল হাতে রাখার জন্য তার টাকা দরকার। ভেবেছিলো মনসুর আলী জিতে গেলে শহরে অবৈধ ব্যবসাগুলোকে নতুন করে গড়ে তুলে সব টাকা সুদ সমেত তুলে নিবে। কিন্তু এখন আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে সাধারন ব্যবসা গুলো নিয়ন্ত্রণ করাই কঠিন হয়ে গেছে। শাহাদ খান সব জায়গায় দ্বিগুন প্রভাব বিস্তার করছে। সে অবৈধ কার্যকলাপ গুলো বন্ধ না করে সব নিজের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে৷যার ফলে অবৈধ ব্যবসায় জড়িত সবাই শাহাদ খানকে তোষামোদ করায় ব্যস্ত।আগে যেখানে সবকিছুতে আন্ডারওয়ার্ল্ড এর প্রভাব ছিলো সেখানে সবকিছুতে শাহাদ খানের প্রভাব। এখন আগের মতো নাইমুরকে কেউ ভয় পাচ্ছে না।


নাইমুরের মুখ দেখে মনসুর আলী কিছুটা মিইয়ে গেলেন। ইনিয়ে বিনিয়ে বললেন-

" তোমার টাকা আমি সময় মতো পরিশোধ করে দিব নাইমুর। হিশামের কোম্পানি দেওলিয়া হয়ে গিয়েছে নয়তো এখান থেকে কিছু......"


মনসুর আলীকে কথা শেষ করতে না দিয়ে নাইমুর খেকিয়ে উঠলো। বললো-


" আমার টাকা চাই, যেকোনো মূল্যে টাকা চাই। টাকা না পেলে আমি তোকে খু*ন করব।এরপর তোর বাড়ি সম্পত্তি দখল করব।"


মনসুর আলী ভয় পেয়ে গেলেন নাইমুরের হুমকিতে।নাইমুর যেভাবে ফুসছে এখন কোনো কিছু বলে স্বান্তনা দিবে যে সেটারও জো নেই। কোনো মিথ্যা কথা বলেও কাজ হবে না।মনসুর আলী একটু কঠিন স্বরে বললেন-


" তুমি আমায় তুই তোকারি করছো কোন সাহসে? ভুলে গেছ আমি এখন একটা দলের সভাপতি। সামনের নির্বাচনে আমার হার ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই।"


নাইমুর তেড়ে এসে মনসুর আলীর পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরলো। বিশ্রি একটা গালি দিয়ে বলল- 


"সামনের নির্বাচন পর্যন্ত তুই জানে বাচবি কিনা দেখ। আমার টাকা না পেলে তোকে আমি খু*ন করব।তোকে বাচানোর জন্য তোর দলের কেউ আসবে না।কারন তুই জোর করে ওই দলের সভাপতি হয়েছিস। "


বাকবিতণ্ডার মাঝে নাইমুরের একটা চ্যালা এসে হাজির হলো। নাইমুরের কানে কানে কিছু কথা বলে আবার বেরিয়ে গেলো। নাইমুর মনসুর আলীর কলার ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে বসে একটা শয়তানি হাসি দিলো। মনসুর আলী ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলো -


"কি হয়েছে? কি বলে গেলো ওই ছোকরা? "


নাইমুর বাকা হেসে মনসুর আলীর দিকে তাকিয়ে বলল- 

" তুরুপের তাস পেয়ে গেছি। হিশাম চৌধুরী অনেক চালাক। সে তার পরিবারের প্রত্যেকের নামে আলাদা আলাদা একাউন্ট খুলে বড় অংকের টাকা রেখেছে সেখানে।"


মনসুর আলী বললো -

"এই জন্যই ওই বুড়ি বাড়ি নিলামে তুলতে রাজি হলো না।কারন হিশামের চিকিৎসা চালানোর টাকা আছে ওদের কাছে। তুমি শিওর তো এই ব্যাপারে?"


" হ্যা। হাসিবের পিছনে লোক লাগিয়েছিলাম। হাসিব হিশাম চৌধুরীর সেক্রেটারি কে সাথে নিয়ে ব্যাংকে গিয়েছিলো।সেখানে সে তাদের প্রত্যেকটা একাউন্টের ব্যালেন্স চেক করেছে।"


মনসুর আলী টেবিলের ওপর পাশে চেয়ারে বসলেন।তার মুখ হাসি হাসি।মুখের হাসি ধরে রেখে বললেন-


" কত টাকা হবে সব মিলিয়ে?"


নাইমুর খ্যাক করে শব্দ করে হাসলো। বললো-


"যত টাকাই হোক সব আমি নিব। তাই টাকার এমাউন্ট আপনার না জানলেও চলবে।"


মনসুর আলী কিছুটা দমে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন -

"আমার সাহায্য ছাড়া সেই টাকা তুমি হাতে আনতে পারবে না।"


" পারব। আমি এইবার আর কোনো ঝামেলায় যাব না।সরাসরি একশনে যাব। হাসপাতালে হিশাম চৌধুরীর মাথায় ব*ন্দুক ঠেকিয়ে হলেও সবার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিব।"


মনসুর আলী চোখ মুখ বিকৃত করে বসে রইলো। নাইমুর তাতে পাত্তা দিলো না। তার এখন মূল লক্ষ্য হাতে টাকা পাওয়া।টাকা হাতে না এলে আন্ডারওয়ার্ল্ড এ নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে হবে। আন্ডারওয়ার্ল্ড এ নিয়ন্ত্রণ হারানো মানেই আজ না হয় কাল কারো হাতে খু*ন হতে হবে তাকে। অন্য কেউ আন্ডারওয়ার্ল্ড এ রাজ করতে খু*ন করে সরিয়ে দিবে তাকে। তাই এই মুহূর্তে যেকোনো মূল্যে তার টাকা প্রয়োজন। 


--------


মঞ্জুরা বেগম ছেলের পাশে বসে তসবি জপছেন আর চোখের পানি ফেলছেন। তৃপ্তি রিশামকে কোলে নিয়ে হিশামের বেডের পাশের সোফাটায় বসে আছে। তার দৃষ্টি হিশামের দিকে। এতগুলো দিন হয়ে গেলো অথচ মানুষটার একটুও নড়চড় নেই। একদম প্রাণহীন জড়বস্তুর মতো শুয়ে আছে। প্রাণহীন কথাটায় তৃপ্তির গা কাঁটা দিয়ে উঠলো।এই ধরনের চিন্তা মাথায় আসার জন্য নিজেকে ভর্ৎসনা দিলো।অবশ্যই তার স্বামী জেগে উঠবে।আবার আগের মতো মাথা উঁচু করে হেঁটে বেড়াবে। তার হুংকারে বাড়ির সবাই ভয়ে ভয়ে থাকবে। রিশাম বাবার আদর পাবে।এসব ভেবে তৃপ্তির বুক চিড়ে একটা শ্বাস বেরিয়ে আসলো। 


হঠাৎ করে ওর মনে হলো হিশামের আঙুলটা যেন নড়লো। তৃপ্তি চমকে তাকালো। কিন্তু না হিশামের হাত আগের মতোই অসাড় হয়ে পড়ে আছে। হতাশ হয়ে আনমনা হতেই আবারো মনে হলো যেন আঙুল নাড়াচ্ছে হিশাম। তৃপ্তি সোজা হলো।চোখ রগড়ে ভাল করে মনোযোগ দিয়ে তাকালো।হ্যা হিশামের আঙুল অল্প নড়ছে। তৃপ্তির বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠলো।কিছুক্ষনের জন্য শ্বাস আটকে এলো তার। অস্পষ্ট স্বরে শ্বাশুড়িকে ডাকলো-


"ম..মা,মা।"


মঞ্জুরা বেগম তসবীহ পড়ার মাঝখানে বাঁধা পেয়ে বড্ড বিরক্ত হলেন। ছেলের সুস্থতা কামনায় খতম দিচ্ছেন তিনি। এই সময় তৃপ্তি ডিস্টার্ব করছে কোন আক্কেলে? তিনি চোখ মেলে তাকালেন তৃপ্তির দিকে। তৃপ্তির চোখে পানি। সে আঙুল তুলে একদিকে কি যেন দেখাচ্ছে। তার হাত কাঁপছে। মঞ্জুরা বেগম বিরক্ত মুখে হিশামের পাশ থেকে চশমা টা নিয়ে চোখে পড়লেন। এই মেয়ে কি দেখাচ্ছে তিনি দেখবেন। এরপর তাকে ইচ্ছামতো ঝাড়ি দিবেন। তিনি মনে মনে তৃপ্তিকে বকাঝকা করার জন্য তৈরি হয়ে তৃপ্তির দেখানো হিশামের হাতের দিকে তাকালেন। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে তিনি বুকে হাত চেপে ধরলেন৷ হাহাকার করে বললেন-


"ও তৃপ্তি। আমার হিশাম... ডাক্তারকে ডাকো। আমার হিশাম....!"


মঞ্জুরা বেগম হিশামের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কান্না করতে থাকলেন। তৃপ্তি নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে রিশামকে কোলে থেকে নামিয়ে সোফায় বসালো।তারপর ছুটে এসে হিশামের নড়াচড়া করতে থাকা হাতটা ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। কান্নারত কন্ঠে বললো- 


"শুধু একটা বার চোখ মেলে তাকাও।তাকিয়ে দেখো তুমি ছাড়া কত কষ্টে আছি আমরা।"


তৃপ্তির কথার কারনেই কিনা জানা নেই খানিক পরেই হিশামের চোখ খুলে গেলো। মঞ্জুরা বেগম ছেলের চোখ মেলে তাকানো দেখে থমকে গেলেন। তৃপ্তিকে ডেকে বললেন-

"তৃপ্তি দেখো। "


তৃপ্তি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না।সে হিশামের মুখের কাছে এসে দুপাশে গালে হাত রেখে ঝাঁকিয়ে বললো-

" তুমি চোখ খুলেছো!!! তুমি সুস্থ হয়ে গেছো!"


হিশামের চোখ খুললেও সেখানে কোনো নড়াচড়া নেই। খোলা চোখ দুটো স্থির হয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু সময় পরপর চোখের পলক পড়ছে।


 মঞ্জুরা বেগম ছেলের বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তৃপ্তি কে উদ্দেশ্য করে বললেন-


"হাসিবকে ডাকো, ডাক্তারকে ডাকো।"


শ্বাশুড়ির কথায় তৃপ্তির হুঁশ ফিরে এলো। ডাক্তারকে ডাকা প্রয়োজন।হাসিবকেও খবরটা দিতে হবে। হাসিব নিশ্চয়ই করিডোরে পায়চারি করছে। তৃপ্তি স্বামীকে ছেড়ে হাসিবকে ডাকার জন্য দরজার দিকে পা বাড়াতেই হাসিবকে ভিতরে ঢুকতে দেখলো। কিন্ত্য হাসিবের মাথায় বন্দু*ক ঠেকিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো নাইমুর। সাথে অ*স্ত্রধারী আরো কিছু গুন্ডা।


হাসিবকে এভাবে দেখে মঞ্জুরা বেগম ছুটে আসতে চাইলেন ছেলের কাছে। সাথে সাথে অন্য ছেলেগুলো অ*স্ত্র তাক করলো।নাইমুর মিষ্টি কন্ঠে বললো- 


"আন্টি এই বয়সে দৌড়াদৌড়ি করবেন না। আমরা বেশিক্ষন থাকব না।কাজ হয়ে গেলে চলে যাব।দয়া করে বাধা সৃষ্টি করে আরেকটা ছেলের প্রাণ সংশয় করবেন না।"


মঞ্জুরা বেগম ভয়ে হিশামের এক হাত নিজের হাতে নিলেন। এক ছেলে মৃত্যুশয্যায় আরেক ছেলে অস্ত্রের ডগায়। এই অবস্থায় সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ বাঁচাতে পারবে না। তৃপ্তি জিজ্ঞেস করলো- 

"কি চাও তোমরা?"


নাইমুর হাসিবকে ধাক্কা দিয়ে ছেলেগুলোর হাতে দিয়ে বলল- 

" শুনেছি হিশাম চৌধুরী আপনাদের নামে কিছু টাকা রেখে গেছে। সেগুলো আমাকে দিয়ে দিন। আমি ভদ্রলোকের মতো চলে যাব।"


মঞ্জুরা বেগম চিৎকার করে বললেন-

"কিছুতেই না। এগুলো আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য৷ এক পয়সাও তুই পাবি না।"


নাইমুর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল-

" আপনার ছেলে তো প্রায় ম*রে গেছে।ওর আবার চিকিৎসা কি?"


তৃপ্তি গলা উঁচিয়ে বললো-

" না ও ম*রে নি। ও চোখ খুলে তাকিয়েছে। ও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে তোর বিচার করবে।"


হিশাম চোখ খুলে তাকিয়েছে শুনে নাইমুর অবাক।হলো। ঘাড় বাকিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বললো- 

"তাই নাকি?"


উঁকি দিয়ে হিশামের দিকে ভাল করে তাকিয়ে বুঝলো হিশাম চোখ খুলে তাকিয়ে আছে। হাতের রিভ*লবারটা এক পাক ঘুরিয়ে হিশামের দিকে তাক করে বলল- 

"ম*রে নি  যেহেতু তাহলে আমি মে*রে দেই।তাহলে ত চিকিৎসার টাকা লাগবে না।"


হিশামের দিকে বন্দুক তাক করা দেখে হাসিব তেড়ে আসতে চাইলো।কিন্তু তাকে দুপাশে দুজন ধরে রাখায় পারলো না।যথাসম্ভব ওদের উপর ভর দিয়ে সজোরে লাথি মারলো নাইমুরের পিঠে। পিঠে লাথি খেয়ে নাইমুর সামনের দিকে ঝুঁকে গেলো। তার হাত থেকে  রি*ভলবারটা ছিটকে পড়ে গেলো ফ্লোরে। ক্রোধে উন্মাদ হয়ে নাইমুর হাসিবের পেটে মুখে ঘুষি মা*র‍তে লাগলো।


ছেলের মা*র খাওয়ার দৃশ্য মঞ্জুরা বেগম সহ্য করতে পারলেন না। তিনি দৌড়ে এসে নাইমুরের হাত ধরে টেনে সরাতে লাগলেন।নাইমুরে বাধা পেয়ে মঞ্জুরা বেগমের দিকে তাকালো। এক হাতে হাসিবের কলার ধরে রেখে আরেক হাতে মঞ্জুরা বেগমকে জোরে ধাক্কা দিলো। মঞ্জুরা বেগম হিশামের বেডের কাছে ফ্লোরে পড়ে গেলেন।শ্বাশুড়িকে বাঁচাতে এসেও তৃপ্তি তাকে ফ্লোরে পড়া থেকে আটকাতে পারল না।সে রাগে কষ্টে নাইমুরকে কিল ঘুষি মারতে উদ্ধত হলে নাইমুর তার হাত ধরে ফেললো। তৃপ্তি তাও থেমে থাকলো না।সে পা দিয়ে নাইমুরের হাঁটুর নিচে লাথি দিলো।


 তৃপ্তির জুতার আঘাতে নাইমুর হাঁটুর নিচে প্রচন্ড আঘাত পেলো। প্রচন্ড রাগে সে সজোরে তৃপ্তির গালে চড় বসিয়ে দিলো। শক্ত হাতের চড় খেয়ে তৃপ্তি ছিটকে পড়লো ফ্লোরে। পরিবারের সবার এমন অবস্থায় ছোট্ট  রিশাম চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।


নাইমুর হাসিবকে আবারো মা*র শুরু করলো।চিৎকার করে বললো-

"এক্ষনি সব টাকা আমার হাতে তুলে দে।নয়তো তুই সহ তোর পরিবারের কাউকে বাচতে দিব না।"


স্থির হয়ে ছাদের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকা হিশামের চোখের পাপড়ি দুটো কাঁপছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। পরিবারের হাহাকার তার কানে পৌছাচ্ছে। ছোট্ট রিশামের কান্না তার ভেতরটা ছিড়ে ফেলছে। তার হাতের আঙুল গুলো কাঁপছে। শরীরেও হালকা কাঁপুনি হচ্ছে। বোধ হয় সর্বশক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।


তৃপ্তি হামাগুড়ি দিয়ে কান্নারত ছেলের কাছে গেলো।ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর দিকে তাকালো। খুলে রাখা চোখ দুটো দিয়ে হিশাম কি দেখছে ওদের দুর্দশা? নাকি পাথরের মতো স্থির হওয়া চোখগুলোতে কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই?


হিশামের ভিআইপি কেবিনটায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। রিশামের কান্না আর মঞ্জুরা বেগমের হাহাকারে বাতাস ভারী হয়ে গেছে। সেই সাথে যোগ হয়েছে হাসিবের মা*র খাওয়ার আওয়াজ।ভেতরে এত কিছু ঘটে গেলেও সাউন্ডপ্রুফ কেবিনটার বাইরে সব স্বাভাবিক। বাইরে নাইমুরের দুজন লোক করিডোরে বসে থেকে পাহারা দিচ্ছে আর খোশমেজাজে হাসিঠাট্টা করছে।


চলবে


[ চোখে সমস্যা হওয়ার কারনে এতদিন গল্প লিখতে পারি নি। এই জন্য দুঃখিত।]

No comments

Powered by Blogger.