গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ৩৩

 #টক_ঝাল_মিষ্টি 

#তামান্না_আঁখি 

#পর্ব-৩৩


খান বাড়িতে উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই আনন্দ করছে। গতরাতের ঘটনার প্রভাব সবাই কাটিয়ে উঠেছে। সকালেই খবর এসেছে আনিশা প্রেগন্যান্ট। খবর শুনে রেজিয়া সুলতানা প্রথমেই জানালেন আশফাক খান কে। আশফাক খান কিছুক্ষন বিমুড় হয়ে তাকিয়ে রইলেন।চোখে পানি জমেছে উনার। একমাত্র আদরের মেয়েকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। সেই মেয়ে মা হতে যাচ্ছে এমন সংবাদে আনন্দে তার চোখে পানি চলে এলো। তর্জনী দিয়ে চোখের পানি মুছলেন। মেয়ের সাথে ফোনে কথা  বলে হৃদয়টা শীতল করলেন। আস্তে আস্তে বাড়ির সবাই জানলো বিষয়টা। রাফা রিদি খুশিতে লাফাতে লাগলো। ছোট নরম তুলতুলে একটা বাচ্চাকে কোলে নেয়ার তর সইছে না তাদের। তার জন্য খেলনা কিনবে, বাগানে ফুল কুড়াবে সবকিছু নিয়ে তাদের ব্যাপক উৎসাহ। 


আনিশা বাড়ির সবার সাথেই ফোনে কথা বললো।কুহুর সাথে কথা বলার সময় কুহুকে সাবধান থাকতে বললো৷ এমন খুশির খবরে কুহুরও আনন্দের শেষ নেই। বাড়ির মহিলারা ব্রেকফাস্টেই অনেকগুলো পদ রেঁধে ফেললো। বাজার থেকে মিষ্টি আনানো হলো। কুলসুমা বেগম এমন সুসংবাদের দুই রাকাত শোকরানা নামাজ পড়লেন।হাতে তসবিহ নিয়ে সোফায় বসে শাহাদ আর কুহুকে ডাকলেন। কুহু রান্নাঘরে ছিলো। ডাক পেয়ে এসে দেখলো শাহাদ আগে থেকেই বসে আছে। কুহুকে দেখে একবার তাকালো কুহুর দিকে।কুহু বসলে কুলসুমা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললেন- 


" খুশির খবর তো শুনলে। বাড়িতে বাচ্চা আসা মানে আল্লাহর রহমত। বাচ্চা কাচ্চা ছাড়া বাড়ির প্রান থাকে না। এই বাড়িরও কোনো প্রান নেই৷ এই বাড়িকে প্রান দেয়া এখন তোমাদের দায়িত্ব।আমি কি বলছি বুঝতে পারছো তো?"


কুলসুমা বেগম পাশাপাশি বসা শাহাদ কুহু দুজনের দিকেই তাকালেন। শাহাদ হালকা গলা ঝাড়লো। বিনয়ের সাথে বললো-


" বাবার সাথে দেখা করার কথা ছিলো, আমি আসছি।"


শাহাদ উঠে চলে গেলো,পালিয়ে যাওয়া যাকে বলে আর কি! কুহু আড়চোখে তাকিয়ে শাহাদের যাওয়া দেখলো।কেমন স্বার্থপর লোক!! বউকে ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজে ঠিকই কেটে পড়েছে। কুলসুমা বেগম কুহুকে উদ্দেশ্য করে বললেন-


"পুরুষ মানুষের এসবে তেমন মন থাকে না। এসব নিয়ে মেয়েদেরকেই ভাবতে হবে। শোনো নাতবউ, আমি আমার বাড়িতে একটা বাচ্চা চাই। যেভাবেই হোক তার ব্যবস্থা কর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।'


কুহু ওড়না হাতে প্যাচাতে প্যাচাতে মাথা হেলিয়ে সায় দিলো। তারপর আস্তে করে উঠে চলে গেলো। কুলসুমা বেগমের বিশেষ ভালো লাগলো না এদের দুজনের উদাসীনতা। বিরস মুখে বিরবির করে বললেন-


" নিজের বাড়ির মেয়ে অন্য বাড়িতে খুশি এনে দিচ্ছে। আর আমার বাড়ি ধু ধু মরুভূমিই রয়ে গেলো।"


কুহু রান্না ঘরে এসে শিরিনা বেগমের পাশ ঘেষে দাঁড়ালেন। শিরিনা বেগম রেজিয়া সুলতানা আর জয়া বেগমের সাথে এসে রান্না করছেন। না করলেও শুনছেন না। তিনজন মিলে বেশ গল্প জুড়েছেন।কুহুর ছোয়া পেয়ে শিরিনা বেগম কুহুর দিকে তাকিয়ে ইশারায় জানতে চাইলেন "কি হয়েছে"। কুহু আমতা আমতা করে মৃদু কণ্ঠে  বললো-


" দাদীজান কিসব বলে! বাচ্চার কথা।"


শিরিনা বেগম কিছুক্ষন হা করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।পরক্ষনেই হেসে দিয়ে বললেন-


" বড়রা এমন বলেই। আমিও শুনেছি এসব। সব মেয়েদেরই বিয়ের পর এসব শুনতে হয়। এগুলো নিয়ে মন খারাপ করলে চলে না।"


" কিন্তু মা উনি প্রায়ই বলে।আমি এখন বাচ্চা কিভাবে আনব উনার জন্য?"


শিরিনা বেগম হতভম্ব হয়ে তাকালো।নিচু স্বরে বলল-


"কিভাবে আনবি মানে! "


কুহুও থতমত খেয়ে গেলো। কি থেকে কি বলে ফেলেছে সে নিজেও জানে না। এদিক ওদিক তাকিয়ে সালাদের প্লেট হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি ডায়নিং এর দিকে চলে গেলো। 


আশফাক খানের অফিস ঘরে মোয়াজ্জেম হোসেন কে নিয়ে আড্ডায় বসেছে সবাই। শাহাদ ঘরে ঢুকে এক কোনায় সোফায় গিয়ে বসলো। বিনীত কন্ঠে মোয়াজ্জেম হোসেন কে সালাম দিলো।মোয়াজ্জেম হোসেন সবার দিকে একবার তাকিয়ে আব্দুল গাফফার খানকে উদ্দেশ্য করে অনুরোধের সুরে বললো-


"আমি একটা আবদার করতে চাই যদি আপনি অনুমতি দেন।"


আব্দুল গাফফার খান মাথা নেড়ে অনুমতি দিলেন।মোয়াজ্জেম হোসেন বললেন -


" বিয়ের পর মেয়েটা আর বাপের বাড়িতে যায় নি।আপনাদের অনুমতি থাকলে আমি কুহুকে কয়েকদিনের জন্য সাথে করে নিয়ে যেতাম।"


শ্বশুড়ের কথা শুনে শাহাদ সোজা হয়ে বসলো। তাকালো তার বাবার দিকে। আশফাক খান তাকালো আব্দুল গাফফার খানের দিকে। আব্দুল গাফফার খান বললেন-


"তোমার মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার অধিকার তোমার আছে। তবে শাহাদের মত থাকলে আমাদের ত কিছু বলার নেই।"


সবার দৃষ্টি শাহাদের দিকে ঘুরে গেলো। শাহাদ দ্বিধা নিয়ে বললো-

"ঠিক আছে, কুহুর যেতে ইচ্ছা হলে কুহু যাবে।"


খাওয়া শেষে শাহাদের কাজে বেরিয়ে যাওয়ার অভ্যাস থাকলেও আজ সে তার ঘরে আসলো। আসার সময় কুহুকে ইশারায় ঘরে আসতে বললো।কুহু ঘরে আসতেই টেনে নিজের কাছে এনে বাহুবন্দী করে বললো-


"আমাকে ছাড়াই বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছ যে। আমাকে মিস করবে না?"


কুহু শাহাদের পাঞ্জাবির বোতাম নড়াচড়া করে বলল- 

"তবে আপনিও চলেন সাথে।বাবা আপনাকে যেতে বলেনি?"


"বলেছে। কিন্তু কাজ ফেলে যাই কি করে। হুট করে শ্বশুর মশাইকে শত্রু মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাংলা সিনেমার ভিলেন।"


কুহু হো হো করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লো শাহাদের বাহুতে। শাহাদ শক্ত বাহু বন্ধনীতে লুটিয়ে পড়া কুহুকে ধরে রাখলো।শক্ত বন্ধনের আভাস পেয়ে কুহু নিজের ভার ছেড়ে দিলো।শাহাদ মৃদু হেসে স্থির চোখে তাকিয়ে স্ত্রীর হাসি দেখলো।এই চঞ্চলা হাসি কয়েকদিন বোধ হয় আর দেখা হবে না।


হাসিব বিছানার কোনায় হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। গত রাত থেকেই এইভাবে বসা সে। মাঝখানে একবার এইভাবে বসে খাটে মাথা দিয়ে ঘন্টা দুয়েকের জন্য ঘুমিয়েছিলো।সকালে ঘুম ভেঙেছে তার মায়ের ডাকে। তৃপ্তিও ডেকে গেছে কয়েকবার। কিন্তু হাসিব দরজা খুলে নি।এইভাবেই বসে আছে।হিশামের মুখোমুখি হতে সাহস পাচ্ছে না। জেদের বশে এত বড় কাজটা করার সময় তার তেমন কিছু মনে হয় নি।কিন্তু এখন সে নিজের ভুল বুঝতে পারছে। সে যে একটা নির্দোষ মেয়ের কত বড় ক্ষতি করতে যাচ্ছিল তা বুঝতে পারছে।মেয়েটা যে সামাজিকভাবে কত বড় অপমানের মুখোমুখি হত তা বুঝতে পেরে ভেতরে ভেতরে গুমড়ে ম*রে যাচ্ছে । চৌধুরী বাড়ির সম্মান সে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। শাহাদ খানের উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শাহাদ খানের কাছে হিশামকে অপমানিত করেছে সে। এতসব চিন্তা করে মাথার চুল টেনে ধরলো। দরজার শব্দে মাথা তুলে তাকালো। তৃপ্তি ডাকছে। সাথে এসেছে রিশাম। আধো আধো কন্ঠে "চাচ্চু" বলে সম্বোধন করে ডাকছে।হাসিব এখন আর বসে থাকতে পারলো না উঠে গিয়ে খুলে দিলো দরজা।রিশাম হাসিবকে দেখে হাসলো। হাত বাড়িয়ে দিলো হাসিবের দিকে। হাসিব রিশামকে কোলে তুলে গালে চুমু খেলো। তৃপ্তি বললো-


"ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো।সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে।"


হাসিব অপরাধী চোখে তাকালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু দেখলো।হাসিবের মনোভাব বুঝতে পেরে তৃপ্তি বললো-

"তোমার ভাই নেই বাড়িতে৷ একটু আগেই বেরিয়েছে। "


এই কথা শুনে হাসিব যেন কিছুটা সহজ হলো।রিশামকে কোলে নিয়েই ঘরে ঢুকে গেলো। রিশামকে সাথে নিয়েই ফ্রেশ হবে সে। 


মোয়াজ্জেম আলী উপরের পাটির দাঁত দিয়ে জিভের কাটা জায়গাটায় আনমনে স্পর্শ করছে।তার চোখের দৃষ্টি ক্রোধে পরিপূর্ণ। হয়তো শাহাদের জিভ কাটার দৃশ্যটা মনে পড়ছে।নাইমুর বিরস মুখে মোয়াজ্জেম আলীর দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো- 


"হিশাম চৌধুরী কখন আসবে? এভাবে সময় নষ্ট করলে আমার চলে না। এই সময়টাতে কয়েকটা মামলা ডিশমিশ করতে পারতাম।"


মোয়াজ্জেম আলী অমায়িক হেসে বলল-

"হিশাম আসুক,এই সময়টাতে আমরা একটু গল্পটল্প করলে অসুবিধা কি?"


নাইমুরের মুখ কুচকে গেলো।বললো- 

"আপনার সাথে গল্পটল্প আবার কি করব,আপনি কি আমার প্রেমিকা?"


মোয়াজ্জেম আলী জিভে কামড় দিলেন। বললেন-

"নাউজুবিল্লাহ!! "


"আমি গল্প করি টাকার সাথে।টাকা ফেলবেন,কাজ করব। চোখের পলকে খু*ন করে লা*শ ভ্যানিশ করে দিব। যত টাকা, তত খু*ন।"


" কিন্ত হিশামের কাছ থেকে টাকা নিয়েও তো তুমি কিছু করতে পারলে না।শাহাদ খানের একটা চুলও তো ছিড়তে পারলে না।উলটা শুনলাম শাহাদ খান ই তোমার এক লোককে নিজের বিশ্বস্ত বানিয়েছে। সেই লোক তোমার সমস্ত সিক্রেট ফাঁস করবে শাহাদের কাছে। সেই হিসেবে তোমাকে এখন কাজ দেয়াই তো লস প্রজেক্ট। "


নাইমুর কড়া চোখে তাকালো। তার চেয়ারের দুই পাশে দুজন চামচা দাঁড়ানো। তাদের সামনে এরকম অপমান সে গিলতে পারছে না। চোয়াল শক্ত করে বলল- 

"এসব আমি হিশাম চৌধুরীর সাথে বুঝব আপনার সাথে না।"


" এখন থেকে আমার সাথে বুঝবে। আমি এই দলের সিনিয়র নেতা। হিশাম আমার পরামর্শে চলে। তুমিও চলবে।"


"বুড়া মানুষ, একটা টিপ দিলেই দুনিয়ার খেল খতম।আর আপনি কিনা আমাকে পরামর্শ দেখান।"


মোয়াজ্জেম আলী থতমত খেলো। আবারো অমায়িক হেসে বললো-


"না না, আমরা তো একই দলের। আমাদের মতো লোকদের পরামর্শ করে চলতে হবে। নাহলে শাহাদ খান আর হিশাম চৌধুরী এদের জন্য খেটেখুটেও শেষে  লস আমাদেরই।"


"মানে?"


মোয়াজ্জেম আলী একটু এগিয়ে বসলো।চাপাস্বরে ষড়যন্ত্র করার সুরে বললো- 


"অন্যের কামড়াকামড়ি তে সাহায্য করে আমাদের কি লাভ বলো? তার চেয়ে ওদেরকে কামড়াকামড়ি করতে দিয়ে আমাদের আখের গোছানো ভাল না? এই যেমন ধর তোমার দরকার টাকা আমার দরকার এলাকার এমপির পদ। আমি একা করার চেয়ে দুজনে মিলে মিশে দুটো জিনিস বাজেয়াপ্ত কর‍তে সহজ হবে না? হিশাম চৌধুরী এলাকার এমপি হলে অবৈধ ব্যবসা বাণিজ্য দিয়ে বেশি টাকা তো কামাতে পারবা না।"


নাইমুর ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে মোয়াজ্জেম আলীর দিকে। এই লোক এক দল থেকে অন্য দলে কেন এসেছে এখন সে বুঝতে পারছে। হিশামের প্রতি বিশ্বস্ত থাকলে এক্ষুনি গু*লি করে এর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিত।কিন্তু দলাদলিতে তার কোনো আগ্রহ নেই।তার দরকার টাকা আর এই শহরের আন্ডারওয়ার্ল্ড এর পূর্ন ক্ষমতা। এটা যদি মোয়াজ্জেম আলীকে দিয়ে আসে তাতেও তার অসুবিধা নেই।


-----------


রাতে বাড়ি ফিরে শাহাদের বড্ড সমস্যা হলো। একা ঘরে তেমন ভালো লাগলো না। সে চলে এলো তার স্টাডি রুমে।এখানেও ভালো লাগছে না। কুহু থাকাকালীন স্টাডিরুমে বসে কাজ করলেও বেডরুম থেকে কুহুর হাসির শব্দ আসতো।গ্রুপ কলে বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেয়ার আওয়াজ পাওয়া যেত।কিন্তু এখন একদম নীরব। অথচ কয়েকমাস আগেও সে এরকম একা ঘরেই থেকেছে, এরকম নীরবতাই ছিল তার প্রিয়।কিন্তু এখন কেমন দমবন্ধ লাগছে। বিয়ে করে আরো যন্ত্রনা হয়েছে।


 শাহাদ কিছুক্ষন পায়চারি করলো। ঘরে গিয়ে শূন্য বিছানার দিকে তাকিয়ে রইলো। কুহু থাকলে এখন বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে ফোন টিপতো। শাহাদ মাইন্ড ফ্রেশ করার জন্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।একদিনও হয়নি বউ বাপের বাড়ি গেছে এখনি এরকম অবস্থা হলে বাকি দিনগুলো কিভাবে থাকবে? ঘড়িতে দেখলো রাত এগারোটা বাজে। এখন কি যাবে কুহুর বাড়িতে? ওর বাবা মা তো যেতে বলে দিয়েছে।কিন্তু এভাবে যাওয়া কি উচিত? নির্লজ্জ দেখাবে না? শাহাদ মন থেকে এই ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলে দিলো।পুরুষ মানুষের নির্লজ্জ হওয়া উচিত না।এই ধরনের কাজ সে কোনোদিন করবে না। যেতে হলে কাল সকালে গিয়ে কুহুকে চোখের দেখা দেখে চলে আসবে। এরকম চিন্তা করে শাহাদ লাইট অফ করে ফাঁকা বিছানায় শুয়ে পড়লো। 


এর পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে খান বাড়ির ড্রাইভওয়েতে শাহাদকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখা গেলো। ফাঁকা রাস্তায় এক টানে গাড়ি নিয়ে চলে এলো কুহুর বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে কুহুর ঘরের বারান্দার দিকে তাকালো। বিয়ের দিন এই বারান্দাতেই কুহু এসে দাঁড়িয়েছিলো। একটু ভেবে পকেট থেকে ফোন বের করে কল করলো কুহুকে। কল ধরলো না কেউ। কয়েকটা কল দেয়ার পর অস্থির লাগতে শুরু করলো। গেটের সামনে পায়চারি করতে করতে আরো একটা কল দিলো। কল রিসিভ হলো এইবার। শাহাদ যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেলো।অস্থির হয়ে বললো-


"কোথায় ছিলে তুমি?কল ধরছো না কেন? কখন থেকে তোমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি?"


ওপাশ থেকে বিস্ময় মিশ্রিত কন্ঠে যিয়াদ বললো-

"আপনি এত রাতে আমাদের বাড়ির সামনে এসেছেন?"


শাহাদ থতমত খেয়ে গেলো যিয়াদের কন্ঠ শুনে।ওপাশ থেকে ভেসে আসলো যিয়াদের চিৎকার। সে চিৎকার করে তার মা কে ডাকছে।শাহাদের আসার খবর জানাচ্ছে।শাহাদ তাড়াতাড়ি কলটা কেটে দিলো। গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে বসে পড়লো। তর্জনি দিয়ে কপাল চুলকালো। কুহুকে এক নজর দেখে চলে যেতে চেয়েছিলো সে। কল দিয়েছিলো যাতে কাউকে না জানিয়ে বারান্দায় এসে একটু দাঁড়ায়।এখন তো পুরো বাড়িই জেনে গেলো। এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত তাএর।মাঝরাতে নতুন জামাই চুপি চুপি শ্বশুর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে এর চেয়ে লজ্জার কি আছে। শাহাদ গাড়ি স্টার্ট দিতে নিবে তখনি কুহুর বারান্দার লাইটটা জ্বলে উঠলো। শাহাদ তাকালো বারান্দার দিকে।দেখলো হহন্তদন্ত হয়ে কুহু এসে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়েছে। হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাহাদের গাড়ির দিকে।শাহাদ সব ভুলে কুহুর দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনে হচ্ছে এক জনম পর সে কুহুকে দেখছে। তার ঘোর কাটলো গেট খোলার শব্দে। দেখলো কুহুর বাবা মোয়াজ্জেম সাহেব চিন্তিত মুখে বের হয়ে এসেছেন।পিছু পিছু এসেছে যিয়াদ।শাহাদের গাড়ি থেকে বের হওয়া ছাড়া উপায় রইলো না। শাহাদ বের হয়ে সালাম দিলো।মোয়াজ্জেম সাহেব সালামের জবাব দিয়ে জানতে চাইলেন-


"হঠাৎ এত রাতে? কিছু হয়েছে?"


শাহাদ গলা পরিষ্কার করলো।বেশ বিব্রত অনুভব করছে সে।নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল- 


"জী না,সব ঠিক আছে। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম তাই.....।"


শাহাদের কথা কেড়ে নিয়ে যিয়াদ বললো-

"ভাইয়া আসলে আপুর কাছে এসেছে।তাই না ভাইয়া?"


শাহাদ আরো বিব্রত হলো। একবার যিয়াদের দিকে আরেক বার মোয়াজ্জেম সাহেবের দিকে তাকালো। মোয়াজ্জেম সাহেব এতক্ষনে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন।তিনি শাহাদকে বাড়িতে নিয়ে আসলেন। শিরিনা বেগম ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মেয়ে জামাইকে আপ্যায়ন করতে। কুহু নিচে নেমে আসলো। তার বিস্ময় যেন কাটছেই না। শাহাদ রাতে খেয়ে আসলেও শিরিনা বেগমের অনুরোধে আরেকবার খেতে হলো তাকে। তার সংকোচের সীমা রইলো না।প্রথম বার শ্বশুর বাড়ি এসেছে টি শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে তাও আবার খালি হাতে। অন্তত পাঞ্জাবিটা তো গায়ে দিয়ে আসতে পারতো।


কুহুর ঘরে শাহাদ এদিক ওদিক হেটে হেটে দেখছে। মেয়েলি সাজে সাজানো ঘরটা। খাটের স্ট্যান্ডে রঙিন কাপড় মুড়ানো। মাথার উপর কিসব ঝুলছে। দেয়ালে দেয়ালে স্টিকার লাগানো। শাহাদ বেশ আগ্রহ নিয়ে এসব দেখছে।কুহু যে শশুড় বাড়ি গিয়ে তার ঘরটাকে এভাবে সাজায় নি তা ভেবে বেশ আশ্চর্য হলো শাহাদ। দরজা খুলে কুহু এসে ঢুকলো। ঢুকেই ঠাস করে দরজা লাগিয়ে উড়ে চলে এলো শাহাদের কাছে।এরকম হঠাৎ আগমনে শাহাদ ভড়কে গিয়ে তাকালো।কুহু আহাজারি করে বলল- 


" মাঝ রাতে আসার দরকার কি ছিলো? সবার সামনে কি লজ্জাই না পেলাম। আমার লজ্জায় ম*রে যেতে ইচ্ছে করছে।"


শাহাদ বলল-

" তুমি খুশি হও নি?"


কুহু উত্তর দেয়ার আগেই শাহাদ কুহুকে কাছে টেনে বললো-

"খুশি না হলেও সমস্যা নেই।আমার বউকে আমি দেখতে এসেছি এতে কোনো কিছুর ধার ধারি না আমি।"


কুহু লাজুক হাসলো। বললো-

"দাদীজান শুধু বাচ্চার কথা বলে।বলে তাড়াতাড়ি করে বাচ্চা নিতে।"


শাহাদ কুহুর কানে ফিসফিস করে বললো- 

" তাহলে চলো তাড়াতাড়ি করি।"


কুহু মুখে "ধ্যেত" বলে শাহাদের বুকে আলতো করে কিল দিলো।শাহাদ মুগ্ধ চোখে তাকালো কুহুর দিকে। সারাজীবন এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকলেও ক্লান্তি আসবে না।সে কুহুর অবনত লজ্জামিশ্রিত মুখটা  তুললো। গভীর ভালোবাসায় কুহুর কপালে ঠোঁট ছুয়ালো।এর কিছুক্ষনের মাঝেই তাদের ঘরের লাইট অফ হয়ে গেলো।


চলবে


[ কুহুর বাবার নামের সাথে আরেকটা চরিত্রের নাম সেম হয়ে গেছে। এখন চেঞ্জ করার উপায় নেই। তবে দুটো চরিত্র সবসময় আলাদা আলাদা ভাবেই গল্পে আসবে, তাই গুলিয়ে ফেলবেন না আশা করি।]

0 Comments:

Post a Comment