#এক_তুমিতেই_আসক্ত
#আয়ান_মাহমুদ
|১১|
পর্তুগালের সেই সুপরিচিত ক্যাম্পাসে এক নতুন দিন শুরু হয়েছিল। সূর্যের আলো ঢুকছিল সোজা তুর্য আর তন্নীর কক্ষে, কিন্তু এই এক নতুন দিন তাদের সম্পর্কের জন্য কিছুটা অস্বাভাবিক ছিল। গত কয়েকদিন ধরে, তুর্য অনুভব করছিল যে কিছু একটা অদ্ভুতভাবে বদলেছে। তন্নী আর আগের মতো খোলামেলা ছিল না, সে যেন নিজেকে আরও অনেক বেশি ভেতরে ধারণ করে রেখেছে। কিছুটা দুরত্ব, কিছুটা অনিশ্চয়তা। তুর্য এই পরিবর্তনটা ঠিকভাবে ধরতে পারছিল না, কিন্তু তার মনেও একটা শূন্যতা ঘুরপাক খাচ্ছিল।
একদিন ক্যাম্পাসে একটি সেমিনার ছিল, যেখানে আন্তর্জাতিক ছাত্রদের মধ্যে বৈশ্বিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা চলছিল। তুর্য ও তন্নী দুজনেই সেই সেমিনারে অংশ নিল, তবে অদ্ভুতভাবে আজ তারা একে অপরের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে গেল। তন্নী, যাকে সে সবসময় তার পাশে পেত, আজ দূরে ছিল। মাঝে মাঝে সে নিজের ফোনে তন্নীকে দেখত, কিন্তু তন্নী কোনো মনোযোগ দিচ্ছিল না। তুর্য নিজেও বুঝতে পারছিল না, কেন সে আজ এভাবে দূরে সরে গেছে।
সেমিনার শেষে তুর্য একাকী ক্যাফেটেরিয়ার দিকে হাঁটছিল। তার মাথায় ঘুরছিল নানা প্রশ্ন—"কেন তন্নী আজ এতটা দূরে? কী হলো? সে কি কিছু জানায়নি?" এভাবেই ভাবতে ভাবতে, তুর্য তার পথ চলছিল। ক্যাফে রুমের কাছে পৌঁছালে, সে তন্নীকে এক কোণে বসে থাকতে দেখল, অন্য বন্ধুদের সঙ্গে কিছুটা মগ্ন। তন্নী আজ অনেকটা চুপচাপ, তার মুখাবয়বে কিছুটা বিষণ্ণতা ছিল।
তুর্য অতি সাবধানে তার দিকে এগিয়ে গেল। "তন্নী, তুমি কোথায় ছিলে? কিছু কি ঠিক আছে?" তুর্য তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল।
তন্নী মাথা তুলে তাকাল, তারপর তার মুখে এক অদ্ভুত হাসি ফুটল, "হ্যাঁ, তুর্য। সব ঠিক আছে।" তার কথায় কিছুটা অস্থিরতা ছিল, তন্নী যেন চেষ্টা করছিল তার মনোভাব লুকানোর।
তুর্য চুপচাপ ছিল, মনে হচ্ছিল, কিছু একটা জানার চেষ্টা করছে, তবে তন্নী এভাবে নিজেকে চাপিয়ে রেখেছিল। কিছু সময় পরে, তুর্য একটু নরমভাবে বলল, "তন্নী, তুমি জানো, আমি যদি কিছু জানাতে চাইলে, তোমার পাশে আছি।"
তন্নী কিছু সময় চুপ ছিল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, "তুর্য, আমি কিছুটা নিজের ভেতর মগ্ন হয়ে গেছি। কিছু কিছু ভাবনা, কিছু কিছু অনুভূতি… আজকাল খুব অস্থির মনে হচ্ছে।"
"তন্নী, তুমি কি আমার সঙ্গে কিছু শেয়ার করতে চাও?" তুর্য নরমভাবে বলল, "আমি বুঝি, যদি তুমি কিছু বলতে চাও, আমি শুনবো।"
তন্নী মৃদু শ্বাস নিল, কিছু সময় চুপ থেকে বলল, "হয়তো এখনই আমি কিছু বলতে পারব না, তুর্য। কিছু বিষয় এমনভাবে চাপিয়ে রাখা উচিত, যখন মনে হবে তখন বলব।"
তুর্য তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না, শুধু মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল যে সে বিষয়টি গ্রহণ করেছে। তবে তার মনের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি জমে উঠেছিল। সে জানত, তন্নী কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে, কিন্তু সে সেটি চাপিয়ে রাখতে চায়।
এরপর, পরবর্তী দিনগুলোতে তন্নী আরও অনেকটাই নিজেকে দূরে সরে রাখতে শুরু করল। তুর্য চেষ্টা করছিল তন্নীকে বোঝানোর, কিন্তু সে জানত, কোনো কিছু জোর করে জিজ্ঞাসা করলে তন্নী আরও বেশি দূরে চলে যাবে। তাই তুর্য নিজেকে থামিয়ে রাখল, সে চাইছিল না তাদের সম্পর্কটা বেশি অস্বস্তিকর হয়ে উঠুক।
তন্নীর এই আচরণে তুর্য একটু বিভ্রান্ত ছিল, তবে সে নিজে থেকে এটিকে দূরত্ব হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিল। সে জানত, কখনো কখনো, সম্পর্কের মধ্যে এমন সময় আসে যখন কিছুটা নিরবতা বা দূরত্ব জরুরি হয়। তবে তুর্য অনুভব করছিল, এই মুহূর্তে তন্নী কিছুটা অস্বস্তির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, এবং সে সেটি কোনোভাবেই চাপিয়ে দিতে চায় না।
ক্যাম্পাসের মধ্যে যেভাবে তারা একে অপরের পাশে থাকতে অভ্যস্ত ছিল, সেই একই ক্যাম্পাসে এখন তন্নী তার ভেতরকার পৃথিবীকে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছিল। তুর্য জানত, হয়তো কিছু সময় পর, তন্নী নিজেই তা বের করবে। তবে সে কীভাবে সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকবে, সে নিয়ে তুর্য কিছুটা চিন্তা করছিল। তন্নী তাকে নিজের অনুভূতি খুলে বলবে কিনা, সেটি সময়ই বলবে।
এই দূরত্বটা, তুর্য জানত, এটি শুধু এক টুকরো সময়ের ব্যাপার। সম্পর্কের গভীরতা তৈরি হতে কিছু সময় লাগবে, এবং কখনো কখনো, সেই গভীরতা তৈরি হওয়ার জন্য একটু দূরত্বও দরকার। তুর্য বুঝেছিল, তন্নী যখন প্রস্তুত হবে, সে তার সবকিছু শেয়ার করবে। আর তুর্য তখন প্রস্তুত ছিল, যেন তন্নী যা বলবে, তাকে সাদরে গ্রহণ করতে পারে।
---
0 Comments:
Post a Comment