গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ৪৪

 #টক_ঝাল_মিষ্টি 

#তামান্না_আঁখি 

#পর্ব-৪৪


হাসিব বাড়িতে ড্রয়িংরুমের সিড়ির প্রথম ধাপে পাথরের মতো বসে আছে। তার পাশে বসে রিশাম চিপ্স খাচ্ছে। খাওয়ার এক ফাকে হাসিবের দিকে ছোট্ট হাতে চিপ্স নিয়ে বাড়িয়ে দিলো। হাসিব অল্প হেসে মাথা নেড়ে না করলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো-


"তুমি খাও চাচ্চু।"


রিশাম এক মনে আবারো খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। হাসিব ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রিশামের দিকে। অন্যসময় হলে রিশামের কাছ থেকে চিপ্স নিয়ে কাড়াকাড়ি করে খেতো। হিশাম তখন এসে দুজনের মাঝে কাড়াকাড়ি তে আরো দু একটা চিপ্স এর প্যাকেট দিতো। দুই চাচা ভাতিজা মিলে সেখানেও কাড়াকাড়ি করতো।তৃপ্তি দূর থেকে এক দুইবার মিষ্টি করে ধমকে দিতো। মঞ্জুরা বেগম এক কোনায় বসে সুপারি কাটতেন আর হাসিমুখে নাতির দূরন্তপনা দেখতেন।কিন্তু আজ কিছুই নেই। বাড়িটা কেমন জানি হয়ে গেছে। কেউ হাসে না কথা বলে না, শুধু কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়।কখনো তৃপ্তির, কখনো মঞ্জুরা বেগমের। হিশামের এক্সিডেন্টের পর বেশ কিছুদিন হাসপাতালেই কাটিয়েছে মঞ্জুরা বেগম আর তৃপ্তি।গতকাল তাদেরকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। হিশাম আপাতত নার্সদের তত্ত্বাবধানে আছে।


মনসুর আলী চোখে মুখে দুঃখী ভাব ফুটিয়ে মঞ্জুরা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার পাশে বসে আছে নাইমুর। মঞ্জুরা বেগম বিষন্ন মুখে একটা সিংগেল সোফায় বসে আছেন। এই কদিনে তিনি শুকিয়ে গেছেন অনেক। আগের মতো লাবণ্যতা নেই চেহারায়। আগে যেমন বাড়ির কাজের লোকেরা তার ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতো এখন আর এমন কিছু নেই। জ্বলন্ত প্রদীপ নিভে গেলে যেমন হয়ে যায় তিনিও নিভে গিয়ে তেমন হয়ে গেছেন। 

ডায়নিং এর একটা চেয়ারে তৃপ্তি বসে আছে। তার দৃষ্টি ড্রয়িং রুমের সোফার দিকে। নিজ চোখে স্বামীর তিল তিল করে গড়ে তোলা রাজনৈতিক দলটার করুণ দশা দেখছে সে। মনসুর আলী হাত কচলিয়ে বল্লেন-


" আপা আপনিই এখন আমাদের একমাত্র ভরসা। হিশাম বাবা নেই কিন্ত আমাদের থেমে থাকলে চলবে না। হিশাম বাবার স্বপ্নকে সফল করতে হবে।তার বাবার মৃ*ত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে।"


মঞ্জুরা বেগম বুকে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-

" আপনারা যা ভাল বুঝেন তাই করেন। আমি আর এসবের কি বুঝি?"


হিশামের সেক্রেটারি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে মঞ্জুরা বেগমের কাছে এসে ঝুঁকে নিচু স্বরে বলল- 


"ম্যাডাম, হিশাম স্যারের জায়গায় তৃপ্তি ম্যাম ই সবচেয়ে বেস্ট অপশন হবে। এতে করে জনগনের উপর একটা ইমোশনাল প্রভাব খাটানো যাবে। আর দলের লোকেরাও বিনা প্রশ্নে রিশামের দিকে তাকিয়ে মেনে নিবে তৃপ্তি ম্যাম কে।"


মনসুর আলী শকুনের দৃষ্টিতে তাকালো সেক্রেটারির দিকে। মঞ্জুরা বেগম কিছু বলার আগেই বললো-

"আপনিও দেখি শাহাদ খানের শিখানো বুলি আওড়াচ্ছেন।ব্যাপার কি?"


সেক্রেটারি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। মঞ্জুরা বেগম কড়া কন্ঠে বললেন- 

"শাহাদ খানের কোনো পরিকল্পনাই সফল হতে দিব না। কি মনে করেছে বাড়ির বউকে বাইরে নির্বাচন করতে দিব আর সে এই সুযোগে তাকে হাত করে নির্বাচনে জিতে যাবে। তা হবে না।"


তৃপ্তি উত্তপ্ত শ্বাস ফেললো। মঞ্জুরা বেগম মনে করে শাহাদ তাকে হাত করে রেখেছে। এই মহিলাকে সে কিছুই বুঝাতে চায় না। আর কোনো কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না।যে রাজনীতি তার স্বামীকে কেড়ে নিয়ে গেছে সে রাজনীতি সে ঘৃণা করে। 


মঞ্জুরা বেগমের কথা শুনে সেক্রেটারি পিছিয়ে গেলো। দলটাকে বাচানোর শেষ চেষ্টা সে করেছিলো কিন্ত তাও বিফলে গেলো। মনসুর আলী গদগদ কন্ঠে বললো- 


"তাহলে আপা আপনিই ঠিক করে দেন কে নেতৃত্ব দিবে দলের। হাসিব বাবার তো বয়স হয় নি নির্বাচনে দাঁড়ানোর।"


পাশ থেকে নাইমুর বললো-

" আপনি থাকতে অন্য কাউকে নেতৃত্ব দেয়ার কি দরকার। আপ্নিই দলের সুযোগ্য নেতা।"


মনসুর আলী জিভে কামড় দিয়ে অনিচ্ছা দেখিয়ে বলল- 

" না না,এত বড় দুঃসাহস আমার নেই। আমি কি করে হিশাম বাবার জায়গায় বসব।"


নাইমুর আড়চোখে মনসুর আলীর মিথ্যা অভিনয় দেখলো। এই কথা বলার জন্য মনসুর আলীই তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে এনেছে। আর এখন অভিনয় করছে।


মঞ্জুরা বেগম বললেন-

"ও তো ঠিক ই বলেছে। এই মুহুর্তে আপনি ছাড়া আর বিশ্বাসযোগ্য কেউ নেই। আপনাকেই দলের হাল ধরতে হবে।"


মনসুর আলী খুব না করলেন শেষে না পেরে তাকে রাজি হতে হলো এমন ভাণ করে রুমাল দিয়ে চোখের কোণা মুছে বললেন-

"ঠিক আছে আপা, আপনার কথাই রাখলাম। তবে হিশাম বাবা সুস্থ হওয়ার সংগে সংগে আমি তাকে তার জায়গা ফিরিয়ে দেব।"


মনসুর আলী এগাল ওগাল হাসি নিয়ে চৌধুরি বাড়ির সদর দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালেন। বাড়ির বাগানে ভীড় করে থাকা নেতাকর্মীরা তার দিকে বাঁকা চোখে তাকালো।একজন সিনিয়র নেতা সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে চাইলে নাইমুর বাধা হয়ে দাঁড়ালো।সিনিয়র নেতা চোখ গরম করে বলল- 


"সরে দাঁড়াও। হিশামের মায়ের সাথে আমার জরুরি কথা আছে।"


মনসুর আলী বললেন-

" হিশামের মা হিশামের পরিবর্তে আমাকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর ব্যাপারে মত দিয়েছেন। উনি সেই মত দ্বিতীয় বার বদলাবেন না।আপনাদের কিছু বলার থাকলে পার্টি অফিসে আসুন।"


মনসুর আলী গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সব নেতাকর্মীরাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।পার্টি অফিসে সবাই গিয়ে হাজির হলো। মিটিং রুমে সিনিয়র নেতাদের ঘোর আপত্তির সম্মুখীন হলো মনসুর আলী। সে আগে বিরোধী দলের নেতা ছিলো। দুদিন এই দলে থেকে সে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যাবে তা কেউই মেনে নিতে চাইলো না।তারা মনসুর আলীকে দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দিতে অস্বীকৃতি জানালো। এই পর্যায়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকা নাইমুর সক্রিয় হলো। সে তার সাথের একটা ছেলেকে ইশারা করলে ছেলেটা টেবিলের উপর একটা টাকা ভর্তি ব্রিফকেস রাখলো। নাইমুর তার কোমড় থেকে কালো রঙের রিভ*লবার বের করে টাকাগুলোর পাশে রাখলো। তারপর ক্লান্ত ভংগিতে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চেয়ার দুলিয়ে বললো-


" কে কোনটা তুলতে চান ডিসাইড করে নিন।প্রত্যকের জন্য এক বান্ডিল টাকা নয়তো একটা বুলেট বরাদ্দ আছে। এখন ডিসিশন আপনাদের।"


ইয়াং নেতাকর্মীরা দাঁড়িয়ে গেলো। নাইমুরের সাহস দেখে তারা অবাক।তারা নাইমুরের দিকে তেড়ে আসতে চাইলো। কিন্তু পারলো না তার আগেই নাইমুরের লোকেরা তাদের দিকে অস্ত্র তাক করলো।


-------


আজ আনিশা চলে যাচ্ছে। বাড়িতে মোটামুটি সবারই মন খারাপ। রেজিয়া সুলতানা মেয়েকে সাবধানে গাড়িতে তুলে দিলেন। যাওয়ার আগে রাহাত কথা দিলো সবাইকে যে নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনিশাকে নিয়ে আবার আসবে।শাহাদ বোনকে বিদায় জানিয়ে সোজা চলে গেলো আউটহাউজে। সেখানে দলের ছেলে ছোকরারা কিছু নিয়ে আলাপ করছে।শাহাদ ঢুকতেই তমাল এগিয়ে আসলো। বললো-


"ভাই, মনসুর আলী নমিনেশন জমা দিয়েছে।"


শাহাদ চেয়ারে বসতে বসতে কথাটা শুনলো। তবে সে অবাক হলো না।এটাই যে হবে সে আগে থেকেই ধারনা করেছিলো।তবে এতে ভালোই হলো তৃপ্তি নির্বাচনে দাঁড়ালে তাকে হারাতে কঠিন হতো। স্বামীকে হাসপাতালে রেখে নির্বাচন করতে আসা অসহায় মেয়েটির প্রতি সবারই মায়া লাগতো।অন্তত আবেগের বশে হলেও সাধারন মানুষ তৃপ্তিকে ভোট দিতো।কিন্তু এখন ব্যাপার উলটো।বাটপার মনসুর আলীকে জনগন ভোট দিবে না। তার পক্ষে সে কোনো জনমত পাবে না।তাই শাহাদের জন্য সহজ হয়ে গেলো। শাহাদ তমালকে বললো-


" একটা কাজ কর।মনসুর আলীর পিছনে লোক সেট কর।সে কোথায় যাচ্ছে কি করছে সব জেনে নে। নির্বাচনে সে অবশ্যই অবৈধ পথে জিততে চাইবে। সে যেন কোনোভাবেই জিততে না পারে সেই রাস্তা বন্ধ করে দিতে হবে।"


শাহাদ বেছে বেছে কয়েকজন ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিলো। আসিফকে ডেকে একটা সিক্রেট মিটিং করলো।নাইমুরের ব্যাপারে অনেক তথ্য জোগাড় করলো।শুধু তাই নয় আন্ডারওয়ার্ল্ড সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য জেনে নিলো যা সে জানতো না।


দিনে দিনে নির্বাচনের দিন এগিয়ে আসলো। আশফাক খানও এইবার নিরাপদেই নমিনেশন জমা দিতে পেরেছে। নির্বাচনের চাপে শাহাদের ঘুম খাওয়া সব মাথায় উঠেছে।সারাদিন মিছিল মিটিং লেগেই থাকে। সেই সাথে সমাবেশ ও করতে হচ্ছে। সমাবেশে কড়া নিরাপত্তা স্থাপনের জন্য শাহাদ নিজেই সব সমাবেশে তার বাবার সাথে সাথে থাকছে।


কুহুর দিনগুলোও খুব ব্যস্ততার সাথে কাটছে। নির্বাচন আসায় বাড়িতে একটা উৎসবমুখর পরিবেশে। সাধারন ঘরের মেয়ে কুহু রাজনৈতিক পরিবারের বউ হয়ে এই ব্যাপার গুলো খুব এঞ্জয় করছে।কিন্তু মাঝেই মাঝেই তার খুব হাসফাস লাগে। এত লোক এত সমাগম দেখে সে অভ্যস্ত না। শাহাদের জন্য তার বড্ড চিন্তা হয়। রাত জেগে শাহাদের জন্য বসে থাকে সে। শাহাদ যত রাত করে ফেরে তার চিন্তা তত বাড়ে। অবশেষে শাহাদ বাড়ি ফিরলে তার বুকে মাথা রেখে শান্তির ঘুম দেয়।


 নির্বাচনের কয়েকদিন আগে খান বাড়িতে বড় করে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হলো। বাড়ির পুরুষরা পাঞ্জাবি পায়জামা পড়ে বাইরে বাগানে অংশ নিলো। আর বাড়ির মহিলারা ভিতরে ড্রয়িং রুমে।খান বাড়ির মহিলারা ছাড়াও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত হলো দোয়ায় অংশ নিতে।কুহু সাদা সালোয়ার কামিজ পড়ে মাথায় ওড়না দিয়ে মহিলাদের মাঝে এসে বসলো। এক পাশে কয়েকজন বয়স্ক মহিলা কোরান পাঠ করছে।কুহু মনোযোগ দিয়ে শুনছে। বাড়ির মহিলাদের আড়াল করার জন্য সাদা রঙের বিশাল পর্দা টানানো হয়েছে ড্রয়িং রুমের চারপাশে।


দোয়া মাহফিল শেষ হলেও শাহাদের ছুটি হলো না। তাকে অনেক রাত অব্দি বাগানে কাটাতে হলো। সব কাজ শেষ করে যখন ঘরে ফিরলো তখন রাত বাজে দশটা। ঘরে এসে দেখলো কুহু আয়নার সামনে বসে চুল আচড়াচ্ছে। এতক্ষন পর বউকে দেখে শাহাদের বুকের ভেতরে শীতল বাতাস বয়ে গেলো।সে মৃদু হেসে সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। কুহু এভাবে শাহাদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বললো- 


" ঘামে ভেজা পাঞ্জাবি নিয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কে? যান এক্ষুনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।"


শাহাদ তৎক্ষনাৎ বউয়ের আদেশ মান্য করলো।ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। কুহু চুল বেধে শাহাদের টি শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ওয়াশরুমের দরজার সামনে। শাহাদ কোমড়ে সাদা টাওয়াল পেচিয়ে বের হয়ে আসলো। হাতের টাওয়াল টা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বিছানার উপর এসে বসলো। কুহু লজ্জা পেলো শাহাদকে এভাবে দেখে। কিন্ত শাহাদের কোনো লজ্জা নেই। সে কুহুকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো-


"স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন? জামা কাপড় গুলো দাও।"


এরপর দুষ্টু হেসে বলল- 

"নাকি চাও যে আমি এভাবেই থাকি।"


কুহু লাজুক হেসে নাক মুখ কুচকে বললো-

"ছি!! বেশরম!!"


কুহু শাহাদকে জামাকাপড় গুলো দিতে আসলে শাহাদ তাকে টেনে পাশে বসালো। গাঢ় আলিঙ্গন করে বলল- 


"আজ আমাদের অনেক মুরুব্বি আত্নীয় এসেছিল।তাদের সবাই আমাকে কি বলেছে জানো?"


কুহু জানে তারা শাহাদকে কি বলেছে কারন একই রকম কথা কুহুকেও শুনতে হয়েছে। কুহু না জানার ভান করে বলল- 

"কি বলেছে?"


"বলেছে শাহাদের এখন একটা ছোট্ট শাহাদের প্রয়োজন নাহলে মিছিল মিটিং এগুলো জমছে না।"


কুহু শাহাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল- 

" এ কদিন ধরে অনেক আপনি অনেকবারই বাচ্চার কথা বলেছেন। "


" আমার সত্যিই একটা ছোট্ট সোনামণি চাই কুহু। তোমার আমার ভালবাসার চিহ্ন।এই বাড়ির বংশধর।"


কুহু শাহাদকে পর্যবেক্ষণ করলো।শাহাদের চোখমুখে আবেগ উপচে পড়ছে। তার কথার স্বর অনেক সিরিয়াস। শাহাদ কুহুর গালে হাত রেখে বলল- 


" হিশাম ভাইয়ের কি হাল করেছে ওরা তা তো দেখেছো। আর কোনো দিন জ্ঞান ফিরবে কিনা জানা নেই। তৃপ্তি ভাবির জন্য হিশাম ভাইয়ের শোক কাটানোর জন্য রিশাম আছে। আন্টির শোক কাটানোর হাসিব আছে।কিন্তু আমার কিছু হয়ে গেলে এই শোক কাটানোর মতো কেউ থাকবে না। এই বাড়ির সব আলো নিভে যাবে।"


কুহু বিস্ফোরিত চোখে শাহাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। ধরা গলায় বলল- 

"এমন ভয়ংকর কথা আপনি কিভাবে বলতে পারলেন।"


শাহাদ মাথা নিচ দিকে দিয়ে দু হাত হাঁটু উপর রেখে গম্ভীর অথচ ঠান্ডা গলায় বলল- 

" যা বলেছি এটাই আসল বাস্তবতা। আমি রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে। এতদিনে নিশ্চয়ই তুমি বুঝে গেছো আমার জীবনের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই । যখন তখন আমার জীবন প্রদীপ নিভে যেতে পারে। তাই আমি চাই অন্তত স্মৃতি হিসেবে আমার একটা অংশ এই দুনিয়ায় থাকুক।"


কুহু চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কঠিন স্বরে বলল- 

" আপনার সেই অংশকেও যদি ওরা দুনিয়া থেকে বিলীন করে দেয় তখন?"


শাহাদ তড়িৎ গতিতে সোজা হয়ে বসে কুহুর দিকে তাকালো। কুহুর চোখে পানি দেখে তার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে গেলো। কোমল স্বরে বলল- 

" তুমি অতিরিক্ত চিন্তা করছো। আমি শুধু ভবিষ্যতে হয়তো এমন কিছু ঘটতে পারে তার কথা বলেছি।কিন্তু সত্যিই ঘটবে তা বলি নি।"


কুহু উঠে দাঁড়িয়ে গেলো।চিৎকার করে বলল- 


" অবশ্যই ঘটবে। নিজের মৃ*ত্যুর কথা চিন্তা করে আপনি সন্তান রেখে যেতে চাচ্ছেন। কিন্তু সেই সন্তান যে নিরাপদ থাকবে তার কি গ্যারান্টি। নিজের সুবিধার জন্য একটা অনাগত প্রাণকে এখনি বিপদে ফেলে দিতে চাচ্ছেন। "


শাহাদ অপরাধী দৃষ্টিতে তাকালো। বললো-


"আমি সেটা বলিনি কুহু।"


"বলেছেন। পৃথিবীর সব বাবারা সন্তানের সাথে জীবন কাটাতে চায়।আর আপনি তার আসার আগেই নিজের মৃত্যুর কথা ভেবে বসে আছেন। তাহলে ওই অনাগত প্রাণটা তো পিতৃহীন হয়ে বড় হবে।"


শাহাদ কুহুকে ছুতে চাইলে কুহু সরে গিয়ে বারান্দায় চলে গেলো।রেলিং ধরে বাইরে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগলো।শাহাদ এই প্রথম রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেয়ার জন্য নিজের জন্য করুনা অনুভব করলো। সে কিছুতেই হিশামের পরিনতি থেকে শুরু করে তৃপ্তি রিশামের অবস্থা কোনো কিছুই ভুলতে পারছিলো না। বারবার শুধু কুহু আর নিজের পরিবারের কথা মনে হচ্ছিল।কারন সে জানে সামনে যে নির্বাচন আসছে তাতে করে শাহাদের জীবনের উপর অনেক বড় আঘাত আসবে। তা নিয়েই সে কুহুকে বুঝিয়ে একটু শক্ত করতে চেয়েছিলো। কিন্তু কুহু তো এর আগেই ভেঙে পড়লো। কুহুর এই অবস্থা দেখে শাহাদের মন টা আরো খারাপ হয়ে গেলো।


বারান্দায় গিয়ে কুহুকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।কুহু ছাড়িয়ে নিতে চাইলে শক্ত বাহুদ্বয় দিয়ে কুহুকে আরো পেঁচিয়ে ধরলো। ফিসফিস করে বলল- 


"আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যাব না কুহু। আমরা মৃ*ত্যু পর্যন্ত এক সংগে থাকব  ইন্ শা আল্লাহ।।"


কুহু ঘুরে শাহাদের উদোম চওড়া বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে পড়লো-

"মৃ*ত্যুর কথা বলবেন না।আমার ভয় করে।আমি তৃপ্তি আপুর মতো কষ্ট পেতে চাই না। আমি সারাজীবন আপনার বুকে মোমের পুতুল হয়ে থাকতে চাই।"


শাহাদ গাভীর ভাবে আলিঙ্গন করলো কুহুকে। ঠোট ছুয়ালো কুহুর চুলের ভাঁজে। সে নিজেও কুহুকে সারাজীবন পুতুলের মতো করে রাখতে চায়। তবে হিশামের পরিনতি দেখে মাঝে মাঝেই তার বুকের ভেতর কেমন জানি শূণ্য শূণ্য লাগে। বিভিন্ন অমঙ্গল চিন্তাভাবনা আসে মনে।শাহাদ জোর করে সেগুলো দূরে ঠেলে দিতে চায় কিন্তু পারে না।চারদিকে শত্রুর কালো ছায়া তার মনের শংকাকে বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। 


চলবে

0 Comments:

Post a Comment