গল্প এক_তুমিতেই_আসক্ত পর্ব ১৫

 #এক_তুমিতেই_আসক্ত 

#আয়ান_মাহমুদ 


|১৫|


পর্তুগালের আকাশ আজ একটু বেশি সুনির্দিষ্টভাবে নীল, তার মাঝে সূর্যও যেন তার অগ্নিস্বভাব ভুলে চুপচাপ কিছুটা মৃদুভাবে বিকিরণ ছড়াচ্ছে। ক্যাম্পাসে এখনো একটু শীত, কিন্তু তন্নী যে নিজের ভিতরে এক ধরনের উষ্ণতার অনুভব করছিল, সেটা আলাদা কিছু ছিল। তবে, তার মন আরও কিছু সময় ধরে প্যাঁচানো ছিল। তুর্যর সাথে সেদিনের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সে নিজেকে আবারো একটু আড়াল করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে জানত, এই অদৃশ্য আড়াল তার কাছে ভালো নয়—কারণ এখানে, লিসবনে, সবার চোখে চোখ রেখে কোনো কিছু না বলা সম্ভব নয়।


সেদিন ক্যাফেটেরিয়ায় তন্নী একা বসে ছিল, কফি কাপ হাতে, একা, কিন্তু শান্ত। হঠাৎ রাফায়েল তার সামনে এসে দাঁড়াল। তন্নী চমকে উঠল, তার চোখে কিছুটা বিস্ময় ছিল। রাফায়েল, যার সাথে তন্নীর কখনো খুব একটা কথা হয়নি, সে আজ কেন তন্নীর পাশে বসবে?


"তন্নী, তুমি একা কেন?" রাফায়েল এরকম সহজভাবে প্রশ্ন করল, যেন তাদের একে অপরকে চেনা আছে বহু বছর।


তন্নী একটু অস্বস্তি অনুভব করল, তবে গলায় অল্প হাসি দিয়ে উত্তর দিল, "না, কিছু না। আমি শুধু একটু একা থাকতে চেয়েছিলাম।"


"কিন্তু তুমি জানো, ক্যাফেটেরিয়া সব সময় এতটা শূন্য থাকে না," রাফায়েল তার হালকা হাসি দিয়ে বলল। "তুমি কি জানো, আমি সবসময় মানুষের মধ্যে সেই অদ্ভুত সৌন্দর্য দেখি, যে সৌন্দর্য কোনো দৃষ্টি থেকে নয়, বরং মনের গভীর থেকে উঠে আসে। তুমি অনেক বেশি গম্ভীর, কিন্তু কিছু একটা আমাকে বলে যে, তোমার ভিতরে অনেক কিছু চাপা পড়ে আছে।"


তন্নী অস্বস্তি অনুভব করেছিল। তার মাথার মধ্যে সব কিছু একসাথে ভিড়ে যাচ্ছিল। সে কফি কাপটা একটু শক্ত করে ধরল। রাফায়েলের কথা মনে তার এক প্রকার ঝড় বয়ে গেল। সে জানত, এই ধরনের কথা তার প্রতি মানুষের আগ্রহের ইঙ্গিত হতে পারে। কিন্তু তন্নী জানতো, সে নিজের জীবনে কিছু বিষয় নিয়ে পূর্ণরূপে প্রস্তুত নয়। বিশেষ করে, রাফায়েলের মতো কেউ তাকে খুব সহজে পরিণতি দেখাতে চায় না। তুর্য ছাড়া তার কাছে কেউ কখনো এতটা স্পষ্টভাবে ঢুকে পড়েনি। তুর্য ছিল আলাদা। তার সঙ্গ, তার উপস্থিতি—এটা ছিল নিরাপত্তার অনুভূতি। রাফায়েলের চোখে কিছুটা দৃষ্টি ছিল, যা তন্নী খুব একটা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারছিল না।


"তন্নী, তুমি কি কখনো ভাবো, একজন মানুষের গুণ তাকে আকর্ষণ করে?" রাফায়েল তন্নীর চোখে চোখ রেখে কথা বলল। "আমি বিশ্বাস করি, সুন্দরী ছেলেরা সবসময় আকর্ষণীয় হয় না। আমাদের ভিতরের সৌন্দর্যও অনেক সময় দুর্বল হতে পারে, তবে তা আবিষ্কার করার জন্য কখনো কখনো অন্যরা তাদের সাহায্য দেয়। আমি এখানে তোমার পাশে আছি, তন্নী, যদি কখনো তোমার প্রয়োজন হয়।"


তন্নী তার কফি কাপটা কিছুটা নেড়ে দিয়ে বলল, "ধন্যবাদ, রাফায়েল। তবে, আমি ভালো আছি।"


রাফায়েল কিছু সময় চুপ থাকার পর বলল, "তুমি জানো, ক্যাম্পাসে আমি তোমাকে দেখতে বেশি আগ্রহী। তুমি খুবই গম্ভীর, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, তোমার ভিতরে কিছু আছে, যা তুমি এখনও কাউকে দেখাতে চাও না। তবে আমি জানি, তুমি একজন মেধাবী এবং শক্তিশালী মেয়ে।"


তন্নী কিছুটা বিরক্ত হলেও শান্তভাবে বলল, "এটা তোমার মতামত, রাফায়েল। কিন্তু আমি শুধু আমার নিজস্ব পথে চলতে চাই।"


রাফায়েল তন্নীর উত্তরে কোনো বিরোধিতা করল না। সে বুঝেছিল, তন্নী তার জন্য সরাসরি কোনো সম্পর্ক স্থাপন করতে প্রস্তুত নয়। তবে, তন্নী তার দিকে এক দৃষ্টি দিল, যার মধ্যে কিছুটা স্নিগ্ধতা ছিল, তবে তা তুর্যকে নিয়েই। তুর্য ছিল তার জন্য সেই একমাত্র পথ, যে পথে সে হাঁটতে পারবে।


রাফায়েল অবশেষে হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়াল, "যাই হোক, তন্নী, আমার কোন অস্বস্তি বা চাপ তৈরি করার ইচ্ছে ছিল না। আমি শুধু বলছিলাম, মাঝে মাঝে আমরা আমাদের গভীর দিকগুলো আরও ভালোভাবে জানি, যখন আমরা অন্যদের সাথে তাদের অনুভূতি শেয়ার করি।"


তন্নী একটু নির্লিপ্তভাবে মাথা নেড়ে বলল, "ধন্যবাদ, রাফায়েল।"


রাফায়েল চলে যাওয়ার পর তন্নী কিছু সময় বসে রইল, তার মাথার ভিতর একরকম ধাক্কা খাচ্ছিল। রাফায়েল কিছুটা সরল ছিল, কিন্তু তার কথা তন্নীকে আরও অস্বস্তি তৈরি করছিল। সে জানত, তার অনুভূতি শুধু তুর্যর সাথে শেয়ার করা উচিত, না হলে কিছুটা অস্বস্তি তৈরি হবে।


তুর্যকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে তন্নী একটু হালকা হাসল। সে জানতো, তুর্য ছাড়া অন্য কেউ তাকে একদম ঠিকভাবে বুঝবে না, এবং সে একমাত্র তুর্যকেই খুঁজে পাবে, যে তার অজানা অনুভূতিগুলো ঠিকভাবে সমর্থন করবে।


তন্নী আজ বুঝে গিয়েছিল, সে এবং তুর্য যা অনুভব করে, তা কেউ সহজে বুঝতে পারবে না। তুর্য তার সাথে থাকার কারণে সে সব কিছু একত্রিত করতে পারবে।


---

0 Comments:

Post a Comment