#টক_ঝাল_মিষ্টি
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-৩৫
দেখতে দেখতে নির্বাচন এগিয়ে আসলো। খান বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব আমেজ। প্রতিদিনই প্রচুর মানুষ আসছে। বাগানে আর আউটহাউজে সবসময়ই মিটিং লেগেই আছে। কম লোক থাকলে বাড়ির গৃহিণীরা চা নাস্তা বানিয়ে পাঠায়। বেশি লোকের সমাগমে বাবুর্চি আলাদা বড় পাতিলে রান্না বসায়। বাড়ির পুরুষরা খুবই ব্যস্ত।শাহাদ খাওয়ার সময়টাও পায় না। রাতে ফেরে অনেক দেরিতে। সর্বদাই মিটিং সমাবেশ নিয়ে সে ব্যস্ত থাকে। আশফাক খান সমস্ত কাজ শাহাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে অন্যান্য নেতাকর্মীদের সাথে আলোচনায় বসে কর্ম পরিকল্পনা করেন। প্রতিদিনই শাহাদ অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে।আর প্রতিদিনই কুহু ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। প্রথম প্রথম না খেয়ে অপেক্ষা করতো এরপর শাহাদ কড়াভাবে নিষেধ করায় এখন খেয়ে দেয়ে অপেক্ষা করে। আজ যখন শাহাদ "খান বাড়িতে" ঢুকলো তখন রাত বাজে দেড়টা। সারাদিনের কাজের চাপে ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে তার। সদর দরজার বেল টিপতেই একটা কাজের লোক খুলে দিলো। দরজা খোলার সাথে সাথেই তার চোখ গেলো ড্রয়িং রুমের সোফার দিকে। সবসময়ের মতো আজও কুহু অপেক্ষা করছে। অন্যদিন জেগে থাকলেও আজ সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে গেছে মেয়েটা। শাহাদ ঘরে ঢুকে কাজের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো-
"কুহু খেয়েছে?"
কাজের মেয়েটা "জী স্যার " বলে উত্তর দিয়ে দরজা লাগিয়ে চলে গেলো। শাহাদ কুহুর কাছে সোফায় বসলো। ক্লান্ত চোখে কুহুর দিকে তাকিয়ে রইলো।কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে কুহু।বেগুনি রঙের শাড়ি পড়েছে। দেখতে অপ্সরীর মতো লাগছে। শাহাদ মুগ্ধ হয়ে নিজের স্ত্রীকে দেখলো। মনে পড়লো তাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনটার কথা।কুহুর ব্যাগ থেকে আধ খাওয়া রুটি বের হওয়ার কথা মনে পড়তেই হালকা শব্দ করে হাসলো। তারপর ঝুকে আসলো কুহুর দিকে। চোখে মুখে ক্লান্তি শাহাদের, ঘুম পাচ্ছে খুব।তারপরও সেই ক্লান্তিকর চোখে কুহুকে দেখতে ভালো লাগছে। শাহাদ উঠে দাঁড়ালো। আশেপাশে দেখলো কেউ আছে কিনা।কেউ নেই নিশ্চিত হয়ে আস্তে করে কোলে তুলে নিলো কুহুকে। কুহু এত গভীরভাবে ঘুমাচ্ছে যে জাগাতে ইচ্ছে হলো না। কুহুকে কোলে নিয়ে ঘরে চলে আসলো। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আলতো করে চুমু খেলো কপালে। তারপর ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
শাহাদ চলে যেতেই কুহু চোখ খুললো। বালিশে মুখ গুজে দুই পা কয়েকবার নাড়লো।মুখে তুলে চাইলো ওয়াশরুমের দরজার দিকে। তারপর উঠে বসলো।
লজ্জায় ওর গাল দুটো লাল হয়ে গেছে।বিয়ে হয়েছে এতদিন হলো তারপরেও শাহাদের একটু ছোয়াতেই তার উপর লজ্জার পাহাড় ধ্বসে পড়ে। তার তো কলিং বেল বাজানোর আওয়াজেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো।তারপরেও ঘাপটি মেরে সোফায় পড়ে ছিলো।এই পুরোটা সময় তার অনেক হাসি পেয়েছে কিন্তু কষ্ট করে হাসি চেপে রেখে চোখ বন্ধ করে পড়ে ছিলো। শাহাদ ওয়াশরুম থেকে গোসল করে বেরিয়ে কুহুকে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো-
"ঘুম ভেঙেছে?"
কুহু উত্তর দিলো না।সে মুগ্ধ হয়ে শাহাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।ভেজা চুলে শাহাদকে দেখতে রাজপুত্রের মতো লাগছে।যেই ঘোড়ায় চড়া রাজকুমারের স্বপ্ন সে দেখতো এইটাই হচ্ছে শাহাদ। শাহাদ বিছানায় এসে কুহুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। তার মুখে ক্লান্তিরা উপচে পড়ছে। ঘুম ঘুম চোখে কুহুর দিকে তাকিয়ে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে কুহুর গালে আলতো স্পর্শ করলো।জড়ানো কন্ঠে বললো- -
"মাথায় হাত বুলিয়ে দাও কুহু। তার আগে কপালটায় একটা চুমু দাও। মাথা ব্যথা করছে।"
কুহু লাজুক হাসলো। আলতো করে শাহাদের কপালে চুমু দিলো।শাহাদ হাত নামিয়ে চোখ বন্ধ করে জড়ানো কন্ঠে বলল-
" উম্মম্মম্ম... মাথা ব্যথা কমে গেছে।"
কুহু ফিক করে হেসে বললো-
"চুমু দিলে মাথা ব্যথা কমে?"
"হুম্মম।বউএর দেয়া চুমুতে কমে।"
কুহু আবারো লাজুক হাসলো। শাহাদের ভেজা চুলে হাত বুলাতে বুলাতে ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি নিষ্পাপ লাগছে!! শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। যতবারই দেখে ততবারই বুকের ভেতর ভালোবাসার ঢেউ খেলে যায়। কুহু মনে মনে আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জানালো এমন একজন সুপুরুষকে তার স্বামী করার জন্য।
হিশাম গম্ভীর মুখে পার্টি অফিসে বসে আছে। পার্টি অফিসে অনেক লোকের সমাগম। দলের সব নেতারা নিজেদের মধ্যে এদিক ওদিক বসে আলোচনা করছে। একটু আগে শেষ হওয়া মিটিং নিয়ে সবাই কথা বলছে। চারদিকে নির্বাচনের সাজ সাজ রব। কর্মীরা উত্তেজিত হয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে নিজেদের ভেতর তর্ক বিতর্ক করছে। হিশামকে এসব কোনো কিছুই ছুতে পারছে না। তার বুকের ভেতর যেন ভারী পাথর চাপা দেয়া আছে। শ্বাস ফেলতেও বেগ পোহাতে হচ্ছে তাকে। হাসিবকে হলে পাঠানো হয়েছে দুইদিন হলো। এই দুইদিনের একদিনও সে কোনো কাজে মন দিতে পারছে না। আগে হাসিব হলে থাকলে নিশ্চিন্ত থাকতো কিন্তু ওই ঘটনার পর চিন্তা আর বেড়েছে। হলে থেকে হাসিব আর কিছু ঘটায় কিনা সেই চিন্তায় হিশাম সবসময় অস্থির হয়ে আছে। হিশামের চিন্তার সুতা কাটলো মোশাররফ আলীর আগমনে। মোশাররফ আলী চেয়ার টেনে বসে পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসলো। টেবিলের উপর হাত রেখে হিশামের দিকে ঝুঁকে আসলো। গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীর মতো বললো-
"মনে হচ্ছে এবারের নির্বাচনে তুমি জিতেই যাবে।তোমার নির্বাচনী মাঠ খুব ভালো।বুঝলে?"
হিশাম আগের মতোই গম্ভীর থেকে মাথা নাড়লো। মোশাররফ আলী সোজা হয়ে বসে বললো-
"তবে শাহাদ খানের জন্য একটু সমস্যা হতে পারে। ও তো অনেক চালাক। টাকা খাইয়ে ভোট নিজেদের বাক্সে নিয়ে ফেলবে।"
"ওরা টাকা খাওয়ায় আপনি জানেন কিভাবে?"
"তুমি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছ আগে আমি ওই দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলাম।"
"খান পরিবারের লোকজন টাকা খাইয়ে ভোট নেয় এ আমি বিশ্বাস করি না। শাহাদ তো এই কাজ কোনোদিনও করবে না।"
মোশাররফ আলীর ভ্রু কুচকে গেলো। হিশামের হঠাৎ এত শাহাদপ্রীতির কারন সে বুঝতে পারছে না। সে শয়তানি বুদ্ধি দিয়ে মোক্ষম একটা চাল দিলো।বললো-
"তোমার বাবাকে গু*লি করার কাজ যে শাহাদ করতে পারে এটা নিশ্চয়ই অবিশ্বাস করো না।"
হিশামের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। বড় বড় দুটো শ্বাস ফেললো সে। মোশাররফ আলীর দিকে তাকিয়ে বলল-
"কি বলতে চান?"
"বলতে চাই গত নির্বাচনে তোমার বাবার জিতে যাওয়া আটকাতে শাহাদ গু*লি ছুড়েছিলো। সবাই যখন হাংগামায় ব্যস্ত ছিলো তখন সে ভোট চুরি করে নিজের বাবাকে জিতিয়ে দিয়েছে।"
হিশাম আগের মতোই চোয়াল শক্ত করে মোশাররফ আলীর দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু বললো না। তার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝার উপায় নেই যে সেই এই কথা বিশ্বাস করেছে কি করে নি।মোশাররফ আলী চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল-
"বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। তবে আমি ওই দলের অনেক উচ্চ পর্যায়ের পদে ছিলাম।দলের কোনো সিক্রেট ই আমার অজানা নয়। তবে শাহাদ এই সিদ্ধান্ত আগে নেয় নি। নির্বাচনের ভোট শুরু হওয়ার শেষের দিকে নিয়েছে।তাই অনেকে এই ব্যাপারটা জানে না।তবে আমি গোপন সূত্রে সেটা জানতে পেরেছি পরে।। নয়তো আগে জানলে কখনোই এটা ঘটতে দিতাম না। জানোই তো আমি তোমার বাবাকে কত সম্মান করি।"
মোশাররফ আলী আড়চোখে একবার হিশামকে পরখ করলো। হিশামের মতিগতি তার বুঝে আসছে না। কথা গুলো হিশামের উপর প্রভাব ফেলেছে কিনা তাও বুঝা যাচ্ছে না। হিশাম বললো-
"এই নির্বাচনে আমিই জিতব আর বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধও নিব এবং সেটা বৈধভাবে।"
"কিন্তু শাহাদ থাকলে নির্বাচনে জিতবে কি করে। সে তোমার বাবাকে খু*ন করেছে। এইবারও যে নির্বাচনে জেতার জন্য আরো ভয়ংকর কিছু করবে না তার কি গ্যারান্টি। "
"তাহলে আপনি কি করতে বলেন?"
মোশাররফ আলী নড়েচড়ে বসলো। তার মুখ হাসি হাসি। এতক্ষনে ব্যাটে বল লেগেছে। সে হিশামের দিকে চেয়ার টেনে এগিয়ে এসে বসলো।নিচু গলায় বললো-
" শাহাদকে জে*লে পাঠানোর ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত সে জে*লে থাকলো। শাহাদ জেলে গেলে তাদের দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, দলের লোকদের মনোবলও কমে যাবে। এই সুযোগে তুমি ছক্কা মারবে। শুধু লাভ ই লাভ হবে তোমার।"
হিশাম বিস্ময় চোখে তাকালো মোশাররফ আলীর দিকে। এই লোক যে এমন কূট বুদ্ধি আটতে পারে তা তার জানা ছিলো না।মোশাররফ আলী তাড়া দিলো-
"ভেবেচিন্তে বল।এখনি কাজ শুরু করে দেই। দেরি করে কি লাভ।"
হিশাম কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে বসে রইলো।দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। কিছুক্ষন পর চোখ খুলে বললো-
"কাজ শুরু করুন। তবে আমার দলের কোনো ছেলে যেন এই ঘটনায় জড়িত না থাকে।"
---------
দুপুরের খাওয়া শেষ করে শাহাদ চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। আসন্ন নির্বাচনের কাজের চাপে পার্টি অফিসেই তাকে খাওয়া দাওয়া করতে হচ্ছে। চাইলেও বাড়ি যেতে পারছে না। কারন সে চলে গেলে অন্যরাও কাজে ঢিল দিবে। তাই তাকে থাকতে হচ্ছে সমস্ত ব্যাপারে। এভাবে বসে থেকে চোখটা লেগে এসেছিলো হঠাৎ শোরগোল শুনে চোখ খুললো সে। কি হচ্ছে তা বুঝতে চেষ্টা করলো। এক ঝটকায় সে সোজা হয়ে বসলো চেয়ারে। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দোতলায় যে ঘরে সে বসে ছিলো তার বারান্দায় গেলো। পার্টি অফিসের সামনে ছেলেরা লাঠিসোটা নিয়ে জমায়েত হয়েছে। অফিসের বাইরে গেটের ওপাশে অনেকগুলো বাইক। বাইরের কিছু ছেলে দেশীয় অস্ত্র আর লাঠি নিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। ছেলেরা গেট লাগিয়ে ওদের প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। সদ্য ঘুম ভেঙে উঠে আসা শাহাদের মেজাজ টগবগ করে উঠলো। পার্টি অফিসে হামলা করার সাহস কোথায় পেলো ওরা?
তমালকে দেখতে পেয়ে শাহাদ চিৎকার করে বলল-
"তমাল ওদের আটকে রাখ।ভেতরে যেন না আসে।"
তমাল মাথা নাড়লো। কিন্তু বাইরে থাকা ছেলেগুলো ক্রমাগত গেটে আঘাত করতে লাগলো। কয়েকটা ছেলে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে গেলো। ঢুকেই লাঠি হাতে দলের ছেলেদেরকে পিটাতে লাগলো। এই সুযোগে গেট খুলে অন্য ছেলেগুলোও ঢুকে পড়লো। লেগে গেলো মারা*মারি। মুহুর্তেই পার্টি অফিসের সামনের খালি জায়গাটা একটা হট্টগোলে পরিণত হলো। শাহাদ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো। এখন আর ওর বাবা এমপি নয়। তাই এদের হা*মলা করার ব্যাপারেও তেমন কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। নরমাল ঝগড়াঝাঁটি বলে চালিয়ে দিবে। শাহাদ বেশ বুঝতে পারলো এরা স*ন্ত্রাসী গোষ্টীর লোক। বিরোধী দলই ওদেরকে পাঠিয়েছে। চোখের সামনে দলের ছেলেদেরকে এভাবে মার খেতে দেখে শাহাদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। গত কয়েকদিন ভালো করে ঘুম না হওয়া শাহাদের রাগ সীমা অতিক্রম করলো। সে নিজের কুলন্যাস আর ধরে রাখতে পারলো না। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসলো। সিড়ির পাশের ছোট ঘরটায় গিয়ে একটা হকিস্টিক নিয়ে বেরিয়ে এলো। আশেপাশে থাকা কয়েকটা ছেলেকে বললো-
"আমার সাথে আয়।"
ছেলেগুলোও ঘরটায় ঢুকে হকিস্টিক নিয়ে বের হয়ে শাহাদের পিছু পিছু রওয়ানা দিলো। শাহাদ হকিস্টিক ধরে রাখা হাতটার গোটানো পাঞ্জাবির হাতাটা আরেকটু গোটাতে গোটাতে বারান্দার দুটো সিড়ি টপকে মাটিতে নেমে আসলো। তার হাতে থাকা সিলভার কালার ঘড়িটায় রোদ পড়ে আলো প্রতিফলিত হলো। রোদের আলোয় শাহাদের শক্ত চোয়াল আরো কিছুটা দৃশ্যমান হলো।ক্রোধে উন্মত্ত শাহাদ নিজের চিরচরিত ঠান্ডা মেজাজ হারিয়ে একটা ভুলের দিকে এগিয়ে গেলো যেই ভুলটা সে গত পাঁচ বছর আগে করেছিলো, যে ভুলের কারনে সে খু*নি তকমা পেয়েছিলো।
চলবে
0 Comments:
Post a Comment