#এক_তুমিতেই_আসক্ত
#আয়ান_মাহমুদ
|৫|
ক্যাম্পাসের লাইব্রেরির করিডোরে চুপচাপ বাতাসের হাওয়ার সঙ্গে মিশে চলছিল দুইজনের পায়ের শব্দ। তুর্য ও তন্নী একে অপরের খুব কাছাকাছি ছিল, তবে তন্নী তার পরিচিত নিরবতা বজায় রাখছিল। লাইব্রেরির শেলফের মাঝে বইয়ের সারি ছিল, আর প্রতিটি বই যেন সময়ের এক টুকরো, যা তাঁদের মাঝে একটি অদৃশ্য গাঁথুনি তৈরি করছিল।
তুর্য, যে প্রায়ই একা সময় কাটাতে পছন্দ করতো, আজকের এই শান্ত পরিবেশে অস্বস্তি অনুভব করছিল। তন্নী যে এতটাই শান্ত, সেই দৃশ্য তার মনে এক ধরনের অজানা আকর্ষণ তৈরি করছিল। তবে, সেই আকর্ষণ কখনও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় না। শুধু চোখে চোখে অল্প একটু সম্পর্ক, কিছু অস্পষ্ট অনুভূতি।
"তন্নী, তুমি কি এখানে প্রায়ই আসো ?" তুর্য হালকা করে প্রশ্ন করল, তবে তার কণ্ঠে কোনো জোর ছিল না। এটা যেন শুধুমাত্র একটি সাধারণ প্রশ্ন ছিল, যার পেছনে কোন গভীরতা ছিল না—তবে তন্নীর জন্য সেটা একটু আলাদা ছিল।
তন্নী মৃদু মাথা নেড়ে বলল, "হ্যাঁ, আমি এখানে প্রায়ই আসি। বই পড়তে ভালো লাগে।"
তার ঠাণ্ডা সুরে উত্তর শুনে তুর্য মনে মনে বুঝতে পারছিল, তন্নী তেমন কোনো উন্মুক্তি পছন্দ করে না। সে নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু তা কোনোভাবে তার সৌন্দর্য ও রহস্যকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে।
তুর্য সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে বলল, "বই পড়াটা বেশ ভালো। আমি তো প্রায় সব সময়ই নিজের মধ্যে মগ্ন থাকি, কিন্তু কখনো কখনো একটু শান্তি লাগে, কিছুটা সময় বের করে আসে।"
তন্নী শুধু মাথা নেড়ে তার সম্মতি জানাল, তবে সে কিছু বলল না। তুর্য অনুভব করল, তন্নী অনেকটা পাথরের মতো স্থির, যেন কোনো শব্দ বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নয়।
বইয়ের শেলফে হাত রেখে, তুর্য বলল, "তুমি এখানে এত সময় কাটাও, তুমি কি কখনো বাইরে কোথাও যেতে চাও? ক্যাম্পাসের বাইরে, কিছু ভিন্ন জায়গায়?"
তন্নী এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল, তারপর খুব আস্তে বলল, "এটা এক ধরনের অভ্যস্ততা, জানো। বাইরে যাওয়াটা হয়তো আমার মতো নয়। এখানে এসে বই পড়ে, একটু নিজের মধ্যে হারিয়ে যাই, তাতেই ভালো লাগে।"
তুর্য কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল। তন্নী কীভাবে নিজের জীবনের প্রতি এতটাই নিষ্কলঙ্ক এবং সুরক্ষিত থাকতে চায়, তা ভাবতে ভাবতে, সে একসময় উঠে দাঁড়িয়ে লাইব্রেরির এক পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তার মাথায় এক ধরনের প্রশ্ন ছিল, তবে সে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছিল না।
"তন্নী," তুর্য অবশেষে বলল, "তুমি তো খুব ভদ্র আর মার্জিত। এভাবে একা একা সময় কাটানো, একধরনের শান্তির মধ্যে থাকার বিষয়টা বেশ মজার।"
তন্নী, যেন এক মুহূর্তের জন্য তার মনের ভেতর ঢুকতে দিয়েছিল, "ধন্যবাদ," বলে অল্প হাসল, তারপর আবার নিশ্চুপ হয়ে রইল।
এখন তারা দুজনই প্রায় একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে, কিছু বলতে যাচ্ছিল না। লাইব্রেরি এমন এক জায়গা, যেখানে শব্দকে যতটা সম্ভব কম রাখা হয়, যেন প্রতিটি শব্দ নিজেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়ে ওঠে। তুর্যও উপলব্ধি করছিল, এই নিরবতা, এই মুহূর্তের স্নিগ্ধতা তাদের সম্পর্কের জন্য এক নতুন ক্যালিগ্রাফি হয়ে উঠছিল। যেন প্রতিটি চুপচাপ কথা ও ইশারায় একে অপরকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসছে।
একটি মৃদু পায়ে তন্নী উঠে লাইব্রেরির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। তুর্য তার পিছনে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু কিছুই বলার ছিল না। তাদের মধ্যে খুব সোজা কথাবার্তা হয়নি, কিন্তু অনুভূতি ছিল—এক প্রকার নিরব স্নিগ্ধতা, যা শুধু তাদেরই জানা ছিল।
এই ঘটনাটি এক নতুন বাস্তবতার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, যেখানে তুর্য আর তন্নী পরস্পরের অনুভূতিকে আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করছিল, কিন্তু কোনো বিশেষ ঘোষণা ছাড়াই।
চলবে__
0 Comments:
Post a Comment