গল্প এক_তুমিতেই_আসক্ত পর্ব ২৭

 #এক_তুমিতেই_আসক্ত 

#আয়ান_মাহমুদ 

|২৭|


মে মাসের সকালগুলো অন্যরকম। পোর্তো ট্রিপ থেকে ফিরে সবাই পড়েছে প্রস্তুতির ঘূর্ণিপাকে। চারপাশে শুধু ফাইনাল রিপোর্ট, প্রেজেন্টেশন, সাবমিশনের তারিখ আর ডেডলাইন।


তাসনিম এমনভাবে বোর্ডে এক্সেল শিট টাঙিয়ে রেখেছে যেন যুদ্ধের ঘোষণা। তিহান তো ঘুমোতেই ভুলে গেছে।


তুর্য তার ডেস্কে বসে একাগ্রভাবে কোড লিখছে। তন্নী লাইব্রেরির কোণার একটা টেবিলে নিজের নোট সাজাচ্ছে।


তাদের চোখে চোখ হয়। হাসি হয় না। কারণ সময় আর ক্লান্তি মাঝখানে।


---


তন্নী লক্ষ্য করে—তুর্য এখন অনেক কম কথা বলে। এমনকি সামনাসামনি দেখা হলেও, কেবল মাথা নোয়ানো, অথবা একরকম নীরব অভিবাদন।


তাসনিম একদিন বলল,

— “তোরাই তো আমাদের রোমান্সের আশা! এখন দেখি যেন বরফ!”


তন্নী শুধু হেসে বলে,

— “সব কিছু আসলে বাইরে থেকে বোঝা যায় না। সময় অনেক কিছু বদলায়।”


তাসনিম কপালে চিন্তার রেখা টানে।


---


তুর্য আসলে এক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়ে গেছে। তার বাবা-মার পুরনো বন্ধু সম্প্রতি তাকে পোর্তুগালের বাইরের একটি কোম্পানি থেকে ইন্টার্নশিপ অফার পাঠিয়েছেন। এটি দারুণ সুযোগ, কিন্তু তার মানে ৩ মাস অন্য শহরে থাকা।


তুর্য দ্বিধায়। তন্নীকে কিছু বলতে পারছে না। পরীক্ষার চাপের ভেতরে এমন কথা বলা মানেই ভেঙে ফেলা।


তিহান একদিন বলল,

— “তুই কি তন্নীর সঙ্গে সত্যি কথা বলবি না?”

— “তানির এখন মাথা ভর্তি প্রেজেন্টেশন আর ওর মায়ের অসুস্থতা। আমি চাই না এই সময় ওর মন ভেঙে দিতে।”

— “কিন্তু দূরত্ব বলেই তো অনেক কিছু মিস হয়ে যায় রে!”


তুর্য চুপ।


---


একদিন লাইব্রেরিতে বসে তন্নী খুঁজে পায় একটা কাগজ। তুর্যর হাতের লেখা—


---


> তন্নী,


আমি জানি তুমি অনেক কিছুর মধ্যে আছো। আমি ও তোমার পাশে সবসময় ছিলাম—তবে এখন একটু সরে যেতে হবে।


এটা শেষ না, শুধু একধরনের পরিবর্তন।


আমি যাচ্ছি তিন মাসের জন্য। জানি, না বলা চলে না। কিন্তু সময়ের গায়ে চাপা দিয়ে বলাটা ভুল মনে হচ্ছিল।


আমি জানি, তুমি দূরত্বকে ভয় পাও না। আমিও না।


ফিরে এসে যদি তোর চোখে আবার সেই শান্তি দেখি, তাহলে বলব—

তোমাতেই আসক্ত আমি।


— তুর্য


---


তন্নী চিঠিটা পড়েও কিছু বলতে পারে না। শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখে ধরা পড়ে অল্প অল্প কুয়াশা।


---


তুর্য চলে যাওয়ার আগে আর দেখা হয়নি তন্নীর সঙ্গে।

তন্নী যখন গিফট রেডি করেছিল, তখন তুর্যর ফ্লাইট ছুটে গেছে।


তাসনিম তাকে ফোনে বলে,

— “তুই ওকে মিস করবি?”

— “করবো না, এটা বলা কি সম্ভব?”


তাসনিম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে।

— “তাদের প্রেমই গভীর হয়, যারা দূরে থেকেও একে অপরকে আগলে রাখে।”


---

গল্প এক_তুমিতেই_আসক্ত পর্ব ২৬

 #এক_তুমিতেই_আসক্ত 

#আয়ান_মাহমুদ 


|২৬|


ক্যাম্পাসের ক্লাসরুমে সেদিন একটু অন্যরকম গতি। তাসনিম বলেই ফেলল,

— "তন্নীকে নিয়ে এত চাপ! চল, একটা রিফ্রেশমেন্ট দরকার আমাদের। ট্রিপে যাওয়া হোক!"


তিহান তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে,

— "পোর্তো? উইকেন্ডে ছোট্ট একটা রোড ট্রিপ করে আসা যায়। রিভারসাইড, হ্যারিটেজ এলাকা, পুরনো সড়ক আর সানসেট!"


তুর্য তখন চুপ। তন্নীর দিকে তাকিয়ে শুধুই বলল,

— "তুই যাবি?"


তন্নীর চোখে লুকানো হাসি, মাথা হালকা নেড়ে সম্মতি।

বাকিটা ইতিহাস!


---


সাদা মাইক্রোবাসে বসে তাসনিম বাজিয়ে দেয় সেলিন ডিওনের “Taking Chances”.


রাস্তায় চুপচাপ বসে তুর্য, তন্নী জানালার দিকে তাকিয়ে। মাঝেমাঝে তাসনিম আর তিহান তর্কে জড়িয়ে পড়ে। রাফায়েল ড্রাইভ করছে, হালকা গলায় গুনগুন।


তুর্য হঠাৎ বলে,

— “তোর গান শুনতে ইচ্ছা করে। লাইভ।”

তন্নী হেসে চোখে চোখ রাখে।

— “আমি তো গাই না।”

— “তবু, একদিন শুনতে চাই।”


এই ছোট ছোট বাক্যগুলোতেই যেন জমে থাকা অনুভবের জাল বোনা হচ্ছিল।


---


পোর্তো শহর তাদের স্বাগত জানাল পুরনো ছাদ আর কাচের জানালাওয়ালা ঘর দিয়ে। লাল ইঁটের পথ, রেলিং দিয়ে সাজানো রিভার সাইড আর দূরের পাহাড়ঘেরা আকাশ।


তাসনিম সেলফি নিতে ব্যস্ত, তিহান জোর করে রাফায়েলের হাত ধরে পোজ দিতে বাধ্য করল।


তুর্য তন্নীর পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

— “এই শহরটা কেমন যেন চুপচাপ, অথচ বলে অনেক কিছু।”

তন্নী বলে,

— “তুইও তো এমন। চুপচাপ, কিন্তু ভেতরে অনেক কিছু।”


তুর্য তার দিকে তাকিয়ে থাকে একটুক্ষণ। কিছু বলে না। কিন্তু ওর চোখে যেন কিছু বলার ইচ্ছে ফোটে।


---


রাতের পোর্তো অন্যরকম। নদীটার পাশ ঘেঁষে হালকা বাতাস। রঙিন আলোয় আলোকিত ঘাট।


তুর্য আর তন্নী হাঁটছে দূরে একসাথে। বাকিরা পেছনে।


হঠাৎ হালকা ঠান্ডা বাতাসে তন্নীর চুল এলোমেলো হয়ে যায়। তুর্য নিজের হাত দিয়ে ওর চুল গুছিয়ে দেয়।


তন্নী হেসে বলে,

— “এটা তো সিনেমার সিন!”

তুর্য হেসে ফেলে, তারপর বলে,

— “তুই তো আমার সিনেমার নায়িকা।”


তন্নী চুপ করে থাকে, কিন্তু ওর হাতটা আর পেছনে থাকে না। তুর্যর হাত ধরা হয় হালকাভাবে—নীরবে।


---


ছোট্ট রেস্টুরেন্ট। চারদিকে হালকা হলুদ আলো। গিটারিস্ট স্প্যানিশ ফ্লেমিঙ্গো বাজাচ্ছে।


তাসনিম রঙিন ড্রেসে দুলে ওঠে। তিহান বলে,

— “তাসনিম, এবার তুই গান গা।”

তাসনিম মাইক হাতে নেয়। শুরু করে রবীন্দ্রসংগীত—


“এত যে তব কাছে আমি,

কাছে যে তব থাকি—

তবু কেন জানি মনে হয়,

দূরে কোথাও থাকি…”


তুর্য তন্নীর দিকে তাকায়। ওর চোখে জল চিকচিক করছে। তুর্য আস্তে বলে,

— “তোর চোখেই তো আমার বাড়ি।”


তন্নী কিছু বলে না। শুধু একফোঁটা নীরবতা জমে থাকে গালের পাশে।


---


হোটেলের ছাদে সবাই জড়ো হয় শেষে। তারার নিচে চারপাশে নিঃস্তব্ধতা।


তাসনিম বলল,

— “আজকের রাতটা আমি সারাজীবন মনে রাখব। এই শহর, এই বন্ধুত্ব, এই অনুভব।”


তিহান বলল,

— “ভালোবাসা একরকম না। কোনোটা চুপচাপ, কোনোটা ঝড়ের মতো। আমরা শুধু ঠিক মানুষটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি।”


তুর্য তন্নীর দিকে তাকিয়ে বলল,

— “তুই পাশে থাকলেই সব সহজ হয়ে যায়।”

তন্নী কিছু বলে না। ও শুধু তুর্যর পাশে দাঁড়িয়ে থাকে—হাত ছুঁয়ে, চুপচাপ।


---

গল্প এক_তুমিতেই_আসক্ত পর্ব ২৫

 #এক_তুমিতেই_আসক্ত 

#আয়ান_মাহমুদ 

|২৫|


---


ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়া। কফির কাপ ঠোঁট ছোঁয়ায়নি কেউ। তাসনিম যেন মুখে আগুন নিয়ে বসে আছে।


– “তন্নী, তুই কি সত্যি চুপ করে থাকবি?”

তাসনিম গর্জে ওঠে।


তন্নী ধীরে মাথা নেড়ে বলে,

– “আমি জোর করতে চাই না, তাসু। আব্বু সময় চাইছে…”


– “ওই ‘সময়’ নামক ধারণাটা তো তোর আব্বু একাই নিয়েছেন! তুই কি জানিস, তোর আব্বু এখনো কেমন ভেবে বসে আছে সমাজটাকে? তুই কি জানিস, তুর্যকে নিয়ে ওরা কত নিচু ধারণা পোষণ করছে?”


তিহান শান্তভাবে বলে,

– “তাসু, রাগ দিয়ে কিছু হবে না। আমাদের যুক্তি দিয়ে ওদের মানাতে হবে।”


রাফায়েল সোজাসুজি বলে,

– “We need to face him. Tanni’s father. Eye to eye.”


---


তুর্য তাসনিমের কথা শুনে বলে,

– “আমি কারও বাবার সামনে গিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে চাই না। আমি আমার মতো চলতে চাই, কারো কাছে বিক্রি হতে চাই না।”


তাসনিম হঠাৎ থেমে যায়। তারপর হালকা গলায় বলে,

– “তুই বিক্রি হচিস না তুর্য। তুই দাঁড়িয়ে যাচ্ছিস। তোর মতো একজন ছেলের সামনে মাথা নত করা উচিত ছিল ওদের।”


তিহান বলে,

– “তুর্য, তুই তন্নীর জীবনে আছিস কারণ তুই ভালোবাসিস, না? তাহলে তোর ভালোবাসাকে ওর পরিবারকে বোঝানোও তোর দায়িত্ব। জোর নয়, বোঝানো।”


রাফায়েল জানায়,

– “তন্নীর বাবা কিছুদিন পর পর্তুগাল আসবেন বিজনেস ট্যুরে। আমাদের কাছে সময় আছে নিজেকে মেলে ধরার।”


---


ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে শিগগিরই হতে যাচ্ছে Cultural Night। প্রতিটি দেশের শিক্ষার্থীরা তাদের দেশের সংস্কৃতি ও পরিচয় তুলে ধরবে।


তাসনিম বলে,

– “এই হচ্ছে আমাদের প্ল্যাটফর্ম। আমরা এখানে তুর্যকে মঞ্চে দাঁড় করাবো—তাকে নিয়ে এক ডকু-পারফর্ম্যান্স বানাবো। ওর জীবন, সংগ্রাম, ওর অর্জন, ওর আবেগ—সব।”


তন্নীর চোখ বড় হয়ে যায়।

– “কিন্তু সেটা তো ব্যক্তিগত হয়ে যাবে না?”


তিহান হাসে,

– “না, ওটা হবে সত্যিকার ভালোবাসার একটা মঞ্চ। যেখানে তোর বাবা বসে দেখবে, সেই ছেলেটা কতটা অন্যরকম।”


---


রাতের লাইব্রেরি রুমে সবাই মিলে স্ক্রিপ্ট লিখছে। তুর্য হালকা বিরক্ত হয়,

– “তোমরা এত কিছু করছো, অথচ আমি কিছুই বলতে পারছি না।”


তাসনিম বলে,

– “তুই শুধু থাক, তোর মতো করে। বাকিটা আমরা সামলে নেবো।”


তিহান হেসে বলে,

– “ভালোবাসা যখন শুধু অনুভবেই সীমাবদ্ধ থাকে, তখন তাকে প্রমাণ করার দায়িত্ব পড়ে বন্ধুদের উপর।”


---


তন্নী একদিন সকালে আব্বুর চিঠির উত্তর পায়। সংক্ষিপ্ত, কেবল এক লাইন:


> “ভালোবাসা বুঝতে পারি, কিন্তু বিশ্বাস গড়তে সময় নিতে হয়।”


তন্নীর চোখে জল আসে। সে চিঠি তুর্যকে পড়ে শোনায়।


তুর্য বলে,

– “আচ্ছা, তাহলে সময়ই সঠিক উত্তর হবে। তবে এবার সময়কে আমাদের পক্ষে কাজ করাতে হবে।”


---


রাত বাড়ছে, তাসনিম স্টেজ রিহার্সালের জন্য পাগল। তিহান একজোড়া কবিতা তৈরি করেছে। রাফায়েল ভিডিওর জন্য পুরোনো ছবি আর ফুটেজ জোগাড় করছে।


তাসনিম বলে,

– “এই রাতটা হবে এমন, যেটা তন্নীর বাবাও ভুলতে পারবে না। যে কোনো সমাজের পুরনো চিন্তাধারা হঠাৎই ভেঙে পড়ে, যদি সেখানে ভালোবাসার আলো পড়ে।”


---


রাতের ছাদে তুর্য ও তন্নী চুপচাপ দাঁড়িয়ে। দূরে টাগুস নদীর জলরাশি হালকা জ্যোৎস্নায় ঝিকমিক করছে।


তন্নী মাথা হেলিয়ে বলে,

– “তুই জানিস, আমি জিততে চাই না তুর্য। আমি শুধু চাই, আমরা কেউ হেরে না যাই।”


তুর্য উত্তর দেয়,

– “তুই পাশে থাকলেই আমি জিতেই থাকি, তন্নী।”


---

গল্প এক_তুমিতেই_আসক্ত পর্ব ২৪

 |২৪|


---


১. লিসবনের এক শীতল সন্ধ্যা – দূর থেকে আসা হাওয়ায় ভারী হয় মন

তুর্যর মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে সব কিছু যেন নিখুঁতভাবে এগোচ্ছিল। কিন্তু সম্পর্ক শুধু দুইজন মানুষের বিষয় না—তাদের পরিবার, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা সবই তার অংশ।


তন্নী আজ একটু চুপচাপ। তুর্য জিজ্ঞেস করে,

“তোর চোখ এত ভাবুক কেন আজ?”


তন্নী ধীরে উত্তর দেয়,

“আজ আব্বুর সাথে কথা বলেছি। তোকে নিয়ে বললাম। কিছুটা আশা ছিল... কিন্তু...”


তুর্য চোখ বড় করে তাকায়, “কী বললেন তিনি?”


তন্নী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,

“তিনি বললেন, তুই ‘ভালো ছেলে’ হলেও, তুই আমার জন্য ঠিক না। বিদেশে পড়া মানেই স্বাধীনতা নয়। আর, তুই... একা, পরিবারহীন, অস্পষ্ট অতীত—এটা নাকি রিস্ক।”


তুর্য কিছু বলে না। তার ঠোঁট শক্ত হয়ে যায়। ভেতরের একটা কিছু যেন কেঁপে ওঠে।


---


২. ফ্ল্যাশব্যাক – তন্নী ও তার বাবার ফোনকল

তন্নী বাবাকে ফোন করেছিল সন্ধ্যার একটু পর। একেবারে সোজাসাপটা বলেছিল,

“আব্বু, আমি যাকে পছন্দ করি, সে তুর্য। ও ভালো মানুষ। আমার পাশে দাঁড়ায়, বুঝে, সম্মান করে। আমি...”


তার বাবা ঠান্ডা গলায় বলেন,

“তুমি ভালো বলতে পারো, কিন্তু আমরা বিচার করি ভবিষ্যৎ দিয়ে। ছেলেটার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড কী? বাবা-মা নেই, আর তুমি বলছো সে বিদেশেই থাকতে চায়। এইরকম একটা মানুষকে তুমি সারাজীবনের ভরসা ভাবছো?”


তন্নী বলে,

“ভরসা তো রক্তে নয়, আচরণে তৈরি হয়।”


তার বাবা থেমে যান, তারপর বলেন,

“তুমি এখন আবেগে আছো। আমি সময় দিতে বলি। আমি এই সম্পর্ক সমর্থন করতে পারি না।”


কল কেটে যায়। তন্নী একদৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।


---


৩. বর্তমানে ফিরে – তুর্যর প্রতিক্রিয়া

তুর্য মাথা নিচু করে বলে,

“তোর বাবা ঠিকই বলেছেন। আমি হয়তো প্রমাণ করতে পারিনি যে আমি তোর জন্য ‘যোগ্য’। আমি শুধু তোর পাশে থাকতে চেয়েছি, কখনো দাবি করিনি।”


তন্নী হালকা গলায় বলে,

“তুই কখনো দাবি করিস না বলেই আমি তোর হয়ে উঠছি তুর্য।”


তুর্য তাকায় তন্নীর চোখে—গভীর, দৃঢ়, নিঃশব্দে কথা বলে।


---


৪. ক্যাম্পাসের করিডোর – বন্ধুরা পাশে দাঁড়ায়

তাসনিম শুনে রীতিমতো ক্ষেপে যায়,

“মানে! এত কিছু দেখে শুনে, এত সম্মান দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে—তবুও না? কিসের ভিত্তিতে এই রিজেকশন?”


তিহান ঠাণ্ডা মাথায় বলে,

“সামাজিক ধারণা সহজে বদলায় না। তবে বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা একসাথে থাকলে, যেকোনো প্রতিরোধ ভেঙে যায়।”


রাফায়েল একটু গম্ভীর হয়ে বলে,

“আমি জানি, তুর্যর মধ্যে এমন কিছু আছে, যা ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানো যায় না। ওর অভ্যন্তরীণ শক্তি একদিন সবার ধারণা বদলে দেবে।”


---


৫. একটি চিঠি – তন্নীর আব্বুর উদ্দেশ্যে

তন্নী রাতে আব্বুকে একটি চিঠি লেখে। ইমেইল নয়, সত্যিকারের কাগজে—হাতে লেখা।


> “আব্বু,

আমি জানি তুমি চিন্তা করো। আমিও করি। তুর্য হয়তো পরিবারের কাঠামোয় নিখুঁত না, কিন্তু তার মূল্যবোধ, মানবিকতা, সাহস—এসবই আমার জীবনের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠছে। আমি কারো অন্ধ প্রেমে পড়িনি, ধীরে ধীরে, বুঝে, দেখে ভালোবাসছি। তুমি যদি একদিন ওকে সামনে থেকে দেখো, তাহলে আমি বিশ্বাস করি, তুমি নিজেই বলবে—এই ছেলেটা আমার মেয়ের জন্য ঠিক।”


তন্নী চিঠি শেষ করে চোখ বন্ধ করে। বাইরে বৃষ্টি পড়ে। তুর্য ঠিক তখন ফোন করে।


“সব ঠিক তো?”


তন্নী হেসে বলে,

“সব ঠিক হয়ে যাবে তুর্য। কারণ তুই আছিস।”


---

গল্প এক_তুমিতেই_আসক্ত পর্ব ২৩

 #এক_তুমিতেই_আসক্ত 

#আয়ান_মাহমুদ 

|২৩|


সকালবেলা ক্যাম্পাস – নিরব সম্পর্ক, প্রাণবন্ত হাসি

পোর্চুগালের বসন্তকাল। ক্যাম্পাসের চারপাশে গোলাপি সাকুরা ফুটে উঠেছে। নিঃশব্দে বসন্তের ছোঁয়া যেন তুর্য ও তন্নীর সম্পর্কেও লেগে গেছে।


তাসনিম, তিহান, রাফায়েল সবাই একসাথে বসে। তাসনিম আড়ালে তন্নীকে বলে, “তুই জানিস, তোর চোখ এখন অনেক কথা বলে। হয়তো তুই বলিস না, কিন্তু আমি জানি তোর মন কী বলছে।”


তন্নী একটুখানি হাসে, “শব্দে তো সব বলা যায় না, তাসনিম। কিছু অনুভব নিঃশব্দেই বেশি গভীর হয়।”


এমন সময় তুর্য আসে, গলায় হালকা ঝুলন্ত স্কার্ফ, চোখে শান্ত ছায়া। তন্নীর পাশে বসে বলে,

“আজ বিকেলে একটু ফ্রি থাকবি? মা কল করবে। তোকে পরিচয় করাব ভাবছি।”


তন্নীর চোখ ছলছল করে ওঠে। সে কিছু বলে না, শুধু হালকা মাথা নাড়ে।


---


তুর্যর রুম। লাইট মৃদু, জানালার পাশে বসে আছে তারা দুজন। তুর্যর ল্যাপটপে জুম ওপেন।


স্ক্রিনে হাসিমুখে ভেসে ওঠে তুর্যের মা—একজন পরিপাটি, রুচিশীল, নরম গলার নারী।


“আমার ছেলে বলছিল তোর কথা। তুই কি তন্নী?”


তন্নী ভদ্রভাবে মাথা নত করে বলে, “জী আন্টি। আমি তন্নী।”


তুর্যের মা একটু হেসে বলেন, “তোর চোখে আমার ছেলের ছায়া দেখি। তুই শান্ত, কিন্তু গভীর। আমার তুর্য শান্তির খোঁজে থাকে—তুই কী ওর সেই শান্তি?”


তন্নী কেঁপে ওঠে হালকা, একটুও নাটক না করে সে বলে, “আমি চেষ্টা করব ওর পাশে থাকার, যদি সে চায়।”


তুর্য একটু থমকে যায়, তারপর বলে, “আমি চাই।”


এক নিঃশব্দ কবুল।


---


কল শেষে তুর্যর মা বলে,

“তোমরা যদি একে অপরকে সত্যিই বুঝতে পারো, তাহলে কোনো রকম জোর বা বাধা আসবে না। আমি শুধু চাই, আমার ছেলে যেন ভালো থাকে। আর তুই যদি ওর ভালো থাকা হয়ে ওঠিস, তাহলে আমি তোর মা হয়ে যাবো।”


তন্নীর চোখে পানি। নিজের মা অসুস্থ, দূরে। এই অপরিচিত নারীর মুখে মাতৃত্বের ছায়া খুঁজে পায় সে।


---


কথা শেষে, তুর্য আর তন্নী কিছু বলে না। একে অপরের পাশে বসে থাকে, চুপচাপ।


হঠাৎ তুর্য বলে,

“মায়ের কথাগুলো শুনে আমার বুক হালকা লাগছে। জানিস, আমি তোকে ভয় পেতাম আগে—ভয় পেতাম যে তুই আমার জীবনে এসে সব ওলটপালট করে দিবি। এখন বুঝি, তুই এসেছিস গুছিয়ে দিতে।”


তন্নী হালকা হেসে বলে, “তুইও তো আমার জীবনের কুয়াশা সরাচ্ছিস তুর্য।”


---


তুর্য আর তন্নী ইউনিভার্সিটির রুফটপে গিয়ে দাঁড়ায়। নীচে শহরের আলো, ওপরে নীরব আকাশ।


তুর্য হালকা গলায় বলে,

“তুই জানিস, মা বলার পর থেকে তুই আর ‘তন্নী’ না, তুই এখন ‘আমাদের তন্নী।’”


তন্নী ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে তুর্যের হাতটা ধরে। না, কোনো লজ্জা নেই, কোনো ভয় নেই।


শুধু একটা অদৃশ্য স্বীকারোক্তি—তারা একে অপরের জন্য তৈরি হচ্ছে, ধীরে, স্থিরভাবে, ভালোবাসায়।


---

গল্প এক_তুমিতেই_আসক্ত পর্ব ২২

 #এক_তুমিতেই_আসক্ত #আয়ান_মাহমুদ 

|২২|


--


সিন্ত্রার পাহাড়ি ট্রিপ শেষ। ক্যাম্পফায়ার, রাতে অচেনা স্বীকারোক্তি আর দিনের রোদে দেখা দুটো ছায়া—তুর্য আর তন্নী যেন নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করল। ফিরে এল তারা লিসবনের ব্যস্ত রুটিনে।


কিন্তু ফিরে আসার পর, যেন একটা নীরবতা ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ মুখে কিছু বলছে না, কিন্তু চোখে চোখ পড়লে, চুপচাপ একটা ব্যাখাহীন টান খেলে যায়।


ক্লাসে আবার মুখোমুখি


ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুমে সেদিন তাদের আবার একসঙ্গে বসার পালা। একটা গ্রুপ প্রেজেন্টেশন ছিল, তাদের টিমে তাসনিম, তিহান, তুর্য আর তন্নী।


তাসনিম হাসিমুখে বলে, “তোমাদের ট্যুরের রিফ্রেশমেন্ট এখনও গেছে বলে মনে হয় না!”


তুর্য তন্নীর দিকে তাকিয়ে বলে, “সব কিছুতে সময় লাগে। কখনও কখনও অনুভবগুলো এত গভীর হয়ে যায় যে, স্বাভাবিক হতে সময় লাগে।”


তন্নী চোখ নামিয়ে ফেলে, কিন্তু মুখে একটা হালকা হাসি। তিহান ঠাট্টা করে বলে, “ভাই, প্রেজেন্টেশনটা না করলে তোমাদের সেই ‘গভীর অনুভব’ ফেইল হয়ে যাবে।”


সবাই হেসে ওঠে। সেই হাসির মধ্যে, তুর্য তন্নীর দিকে তাকিয়ে একটা শব্দ বলে না। কিন্তু তার চোখ বলছিল—"আমি আছি, তোর পাশেই।"


---


প্রেজেন্টেশন শেষে সবাই ক্যাম্পাসের ক্যাফেতে যায়। রোদেলা বিকেল, ইউনিভার্সিটির সামনে লম্বা বেঞ্চে বসে তন্নী বই পড়ছিল। তুর্য পাশে এসে বসে।


কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর তুর্য বলল, “তুই জানিস, তোর সেই স্বীকারোক্তির পর থেকে আমি আর আগের মতো নেই। তুই আমাকে ছুঁয়েছিস, গভীরভাবে। এমনভাবে, যা কেউ কখনও পারেনি।”


তন্নী কিছু বলে না।


তুর্য তার পাশে থাকা তন্নীর হাতটা ধীরে ধীরে ধরে ফেলে।


না, কোনো ড্রামা না। না কোনো নাটকীয়তা। নিঃশব্দে, নিঃশ্বাসের মতো এক স্পর্শ।


তন্নীর ঠোঁটের কোণে একটা চুপচাপ হাসি—আর চোখে এক অদ্ভুত আলো।


হাতটা সে ছাড়ায় না।


তুর্য ফিসফিস করে বলে, “এই ছায়ার মতো হাত রাখা, আমার সবচেয়ে নিরাপদ অনুভব।”


---


বন্ধুদের চোখে প্রেমের আভাস


তাসনিম আর তিহান দূর থেকে দেখে।


তিহান হেসে বলে, “তুই কী বলবি?”


তাসনিম বলে, “যে ভালোবাসা শব্দ ছাড়াও প্রকাশ পায়, সেটা সবচেয়ে শক্তিশালী। তন্নী পারছে ওকে নিজের মতো করে ভালোবাসতে। আর তুর্য? সে তো শুরু থেকেই তন্নীর মতো কাউকে খুঁজছিল।”


---


সেদিন রাতে তন্নীর মায়ের ফোন আসে। অসুস্থ মায়ের গলায় কষ্ট, কিন্তু ভালোবাসা উপচে পড়ে।


“তোর গলায় যেন কিছু বদলে গেছে মা। তুই কি সুখী?”


তন্নী জানে, সে এখনো প্রেমের গল্প মাকে বলেনি।


তবু বলে—“হ্যাঁ মা, আমি একটু একটু করে সুখ খুঁজে নিচ্ছি।”


--


তুর্য রাতে তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে, মোবাইলে তন্নীকে মেসেজ পাঠায়—


“তুই আমার জীবনে এক ছায়া, যেটা আমি হারাতেও চাই না, আবার শব্দে বাঁধতেও ভয় পাই। তুই আছিস, আর সেটাই এখন সবচেয়ে বড় পাওয়া।”


তন্নী শুধু রিপ্লাই দেয়—

“হাতে হাত, মনেতে রঙ... আমরা হয়তো বলি না, কিন্তু বুঝি। আর তাতেই আসক্তি বাড়ে...”


---

গল্প এক_তুমিতেই_আসক্ত পর্ব ২১

 #এক_তুমিতেই_আসক্ত 

#আয়ান_মাহমুদ 


|২১|


---


ভোরের হাওয়া আর এক নতুন সকাল


সিন্ত্রার পাহাড়ঘেরা এক ছোট্ট রিসোর্টে ক্লাসের ট্যুরের দ্বিতীয় দিন। সকালের হালকা রোদ্দুর আর কুয়াশা মিলে এক অপার্থিব দৃশ্য। সবাই ব্যস্ত সকালের নাশতা আর ফটোসেশনে। তুর্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে। তার পেছনে আস্তে পায়ে এসে দাঁড়ায় তন্নী।


তুর্য মুখ ফেরায় না, শুধু বলে, “সিন্ত্রা এত সুন্দর, কিন্তু আমি যেন আজ অন্য কিছুর জন্য অপেক্ষা করছি।”


তন্নী শান্ত গলায় বলে, “কি সেটা?”


তুর্য এবার তাকায়। “তুই।”


তন্নী একটু হেসে বলে, “আমি তো আছি।”


তুর্য নিচু গলায় বলে, “তুই আছিস, কিন্তু পুরোটা নিয়ে না।”


---


রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে সকলে ঘুরতে যায়। পাহাড়ি ট্রেইলে হাঁটার সময় তুর্য আর তন্নী একটু পিছিয়ে পড়ে। ঝোপের আড়াল দিয়ে দূরে ঝর্ণার শব্দ ভেসে আসছে।


হঠাৎ তন্নী দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর ধীরে ধীরে তুর্যের দিকে ঘুরে বলে—


“তুই জানিস, আমি তোকে কেন দূরে রাখি?”


তুর্য কোনো শব্দ করে না। শুধু তার চোখে অদ্ভুত এক তৃষ্ণা।


তন্নী বলে, “কারণ আমি তোকে ভয় পাই। তুই আমাকে এতটাই প্রভাবিত করিস যে, নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারি।”


তুর্য একটা ধীরে পা এগিয়ে বলে, “হারিয়ে যাস। আমি তোকে ধরবো।”


তন্নীর গলায় একটা কাঁপুনি—“তুই তো জানিস, আমি খুব স্বাভাবিক কেউ না। আমার ভেতর অনেক অনিশ্চয়তা। কিন্তু...”


তুর্য এগিয়ে এসে একদম কাছে দাঁড়ায়।


তন্নী চোখ নিচু করে বলে, “আমি তোমাতেই আসক্ত... কিন্তু সেটা স্বীকার করতে ভয় পাইছিলাম।”


তুর্য মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, “এই স্বীকারোক্তি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর শব্দ।”


---


একটা না বলা চিঠি


সেই রাতে তন্নী তার নোটবুকে লিখে—


“তুর্য, তোর মাঝে আমি সেই ছায়া খুঁজি যেটা রোদে পথ দেখায়, আর বৃষ্টিতে ছাতা হয়ে দাঁড়ায়। তুই না বললেও, আমি জানি তুই বুঝে গেছিস। আমার এই আসক্তি আসলে ভালোবাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তুই সেই ভালোবাসার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।”


চিঠিটা সে দেয় না। শুধু রাখে তার ব্যাগে, খুব যত্নে।


---


রিসোর্টের শেষ রাতে ক্যাম্পফায়ার হয়। গান-বাজনার মাঝে তাসনিম তন্নীর পাশে এসে বলে, “তুই তো মুখে কিছু বলিস না, কিন্তু তোর চোখ আজ বলছে সব কিছু।”


তন্নী কাঁধে মাথা রাখে, “তুই জানিস, তুর্যকে আমি হারাতে চাই না। ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।”


তাসনিম চোখের জল মুছে বলে, “তুই পেরেছিস তন্নী। তোদের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, সেটা অনেক গভীর।”


---


রাতের শেষে তুর্য একা বসে তার নোটবুকে লেখে—


“আজ তন্নীর চোখে আমি আমার নিজের ছায়া দেখেছি। ওর স্বীকারোক্তি কোনো শারীরিক বন্ধনের নয়, বরং আত্মার। আমি জানি, এই ভালোবাসা আমার সারা জীবনের মতো আসক্তি হয়ে থাকবে।”


---


রিসোর্ট ছাড়ার আগে, বাসে ওঠার সময় তন্নী হালকা করে তুর্যের হাত ছুঁয়ে বলে, “তুই আমার মতো কাউকে চাসনি, আমি জানি। কিন্তু আমি তোকে নিজের মতো করে ভালোবাসি।”


তুর্য হাসে, আর তন্নীর হাতে গোপনে একটা ছোট্ট কাগজ গুঁজে দেয়।

লিখা—

“তুই যেমন আছিস, তেমনটাই আমার জন্য পারফেক্ট। আর আমি তোর ভালোবাসাতেই আসক্ত হয়ে যাচ্ছি...”


---