গল্প: বাধন হারা বেনী
লেখিকা: সানজিদা আহমেদ শাহারা
পর্ব: ১১
তোমার ভোলাভালা হাসি
আমার বুকের ভেতর ঝড়
তুমি চলতি ট্রেনের হাওয়া
আমি কাপি থরথর
তোমার নানান বাহানায়
আমার জায়গাটা কোথায়?
আমি কি এক ঘোরে থাকি
ছিল কতো কথা বাকি
তোমার গোপন সবই রয়
আমার আপন মনে হয়
আমি ভোরের ঝরা পাতা
আমার মরার কিসের ভয়........
- মন খারাপ কেনো, আলু?
- যদি বলি মেঘ শূন্য আকাশে আশ্রয় চায়তে গিয়ে বাতাস আমাকে ভূপৃষ্ঠে আছড়ে ফেলেছে?
- এমন আশ্রয়ে তুই চায়বি কেনো?
- মেঘের গর্জনে আপনার বর্ষণ বাড়ে কেনো?
- তুই মাটি হয়ে যদি সূর্যের আদলে থাকা চন্দ্রের দিকে তাকাস, তোর পতন তো নিশ্চিত।
- তবে কেনো ভুমি থেকে চন্দ্রের দুরত্ব বহুদূর হওয়ার পরও তা এতোটা কাছে মনে হয় যেনো, এইতো হাত বাড়ালেই স্পর্শ পাবো।
- বড্ড বোকা তুই।
- ইশ, যদি চালাক হতাম।
- ফিরে যা, অলু, তুই না পেয়েই সব হারালি।
- হয়তো...
- হয়তো বা না।
# আলোরাও সব না পেয়েই হারায়।
হেমলপুর থেকে তারা ফিরেছে কয়েক দিন আগেই। সেখান থেকে ফিরেই সোহরাব আর মেহরাব মিলে কোথাও একটা উধাও হয়ে গিয়েছিলো। আজ সন্ধ্যায় অনজুমান বেগমের সাথে তার কথা কাটাকাটি হয়েছে। কারণটা অবশ্য সামান্য; সকলে মিলে যখন গল্প করছিলো, তখন অনজুমান বেগম এসে তাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়েই হাতে থাকা চায়ের ট্রেটা ফেলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা তিনি পারেননি বলে উল্টো আলোরাকে একটু বেশিই কথা বললেন। তাতে আলোরা ব্যাপারটা গায়ে মাখেননি, কিন্ত যখন ঘুরে ফিরে কথা বাবামায়ের দিকে এলো, তখন আর চুপ থাকতে পারলেন না। সে তো চাইতেই যাবে, আর মাত্র সপ্তাহ খানেক এ বাড়িতে সে আছে। তা ও এতো কিসের অসুবিধা, অনজুমান বেগমের তা সে বোঝে না। তাই চুপ-চাপ ছাদে এসে বসে ছিলো সে। চাঁদের দিকে চোখ পড়তেই মন ভাকো হয়ে গেলো তার। তাই আধভাঙা সুরে একটু গান গেয়ে উঠলো। এমন সময় পেছন থেকে এসে তাকে মন খারাপের কারণ জানতে চায়।
- আপনি কখন আসলেন?
- আমি এসেছি বহু কাল আগেই।
- ওহ!
- তাহলে চলে যাচ্ছিস?
- হ্যা।
- যাক বাবা, একটা রুম ফাঁকা হবে। হাওয়া বাতাস আসবে বাড়িতে।
- হ্যা, তা আসবে।
- অনেক রাত হয়েছে, যা রুমে যা।
- এখনি না। আজ পরিবেশটা সুন্দর।
- চটপটি খাবি?
- আপনার মনে আছে?
- নাহ।
- সত্যি মনে নেই?
- কি মনে থাকবে?
- সেদিন রাতের কথা।
- কোন রাত?
- নাহ, কিছু না।
মুখে কথাটা বললেও মেহরাব মনে মনে একবার হেসে নেয়। সে রাতের কথা সে কিভাবে ভুলবে। সচরাচর বাড়ির মেয়েরা সলিন ভাবেই গেঞ্জি, প্লাজু আর উড়না বাড়িতে ব্যবহার করে। ছোট বেলা থেকে তাদের এভাবে দেখে অভ্যস্ত সকলে। মেহরাব যখন ইন্টার পরীক্ষার্থী, তখন ছোট্ট আলোরা কেবল বারো বছরের নাদান বাচ্চা, অঙ্কে কম নম্বর পাওয়াতে কোচিং এ দেওয়া হলো তাকে বাসা থেকে বেশ দূরে। কিন্তু সেখানকার টিচার তাকে মারতো। এ কথা জানতে পেয়ে মেহরাব তাকে নিজে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে তার দাদি, ফুফুসহ দুই এক জন নাখোশ হয়। কিন্তু পরে দেখা যায় যে মেহরাবের কাছে পড়ে তার রিজাল্ট আসলেই অনেক ভালো হয়। এরপর থেকে সুদীর্ঘ সময় সে তার কাছেই পড়েছে। এক অবাধ চাল চলন তার মাঝে লক্ষ্য করা যায়। মেহরাব বুঝতো এ আচরণের মানে। ঠিক তেমনভাবে সে লুকিয়ে রেখেছিলো তার না বোঝা অনুভূতিকে, তেমনি আলোরা ও সাবধানী চলাচল করতো। আলোরা একদিন পড়তে বসে খুবই ইচ্ছা করে মেহরাবের কাছে একটা সন্ধ্যা উপহার চেয়েছিলো। মেহরাব তাকে সেই সন্ধ্যার পুরোটা সময় দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু তা আর দেওয়া হয় নি। সেদিন যখন মেহরাব আর আলোরা বের হবে বলে বিকাল থেকে লাল শাড়ি, সাদা কোড়ির গয়না, কোকড়া চুলগুলোকে গুছিয়ে বাঁধছিলো, তখন তার ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে।
"আজ যাওয়া হবে না, তোফা অসুস্থ।"
এই তোফা হলো মেহরাব ভাইদের খালাতো বোন। আগুন সুন্দরী। মেহরাব ভাই তাকে বেশ গুরুত্ব দেয়। সে যা আবদার করে, দ্রুতই মেনে নেয়। তাদের পাশাপাশি মানায় ও দারুণ। তোফা আপু অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে। সেদিন কেনো যেনো বড্ড কান্না পেয়ছিলো, তার একটা সন্ধ্যায়ই তো সে চেয়েছিলো। তা ও দেওয়া গেলো না? কান্না করলে তার মাথা ব্যাথা করে, প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে সব সাজ তুলে ফেলে, সে অগোছালে হয়ে পানিতে ভিজতে থাকে। এরপর তেমন কিছু তার মনে নেয়। তবে মেহরাব সে কথা মনে করে আজও অনুসূচনা আর হারানোর ভয় অনুভব করে।
তারা সদর দরজা পেরিয়ে অনেকটা পথ হেটে এসেছে। ল্যাম্প পোস্টের নিয়ন আলোয় বড় বড় জারুল, হেজল, আম, মেহগুনি গাছের ছায়াতে দুজন নর-নারী হেঁটে চলেছে পায়ে পা মিলিয়ে। তাড়া নেই, নিরব নিভৃতে হেঁটে যাচ্ছে।
- আপনার সঙ্গে এটা আমার প্রথম সন্ধ্যা দেখা।
- শেষ দেখা।
- ওহ হ্যা।
- সামনের মোড়ে চল, চটপটি আছে।
- খাবেন?
- না।
- ও, আপনি তো আবার ঝাল খান না।
- একদম না।
- আচ্ছা, তোফা আপু কেমন আছে?
- জানি না।
- সে কি? আপনারা তো বন্ধু আবার ভাই-বোন।
- সময় দূরত্ব এনে দেয়।
- সময় নয়, আমরা নিজেদের মাঝে দূরত্ব এনে দেয়।
- কি বলতে চায়ছিস?
- যা আপনি শুনতে চান না।
- তাহলে ভাবিসও না।
- ঠিক আছে।
- আয়....
- মামা, এক বাটি চটপটি দেন তো।
- না মামা, দু'বাটি।
- আমি খাবো না।
- আজ একটু খান।
(মেহরাব তাকায় আলোরার মুখের দিক, কি বিপর্যয় মায়া মেয়েটার মুখের মধ্যে।)
- আচ্ছা মামা, দু'বাটি দিন।
- আচ্ছা।
- কোন শহরে যাবি?
- ক্যালিফোর্নিয়া।
- এতো দূর?
- একটু দূর।
- এই ne ধর এই বাটি তোর।
(প্রসন্ন অধরে হাসে আলোরা, হাত বাড়িয়ে বাটিটা নেয়। অন্যটা মেহরাব নেয়।)
মিনিট পনের পরে খাওয়া শেষ হয় তাদের।
- চল বাসায় যাই।
- চলেন।
- ঐ তো একটা আইসক্রিমের ভ্যান, চল যাই।
- চলেন।
- মামা, দুটো আইসক্রিম দেন তো।
- দুটো নেই। গরম আজকে একটা আছে।
- তবে একটায় দেন।
- নে ধর, তুই খা। পিচ্চি।
- আমি পিচ্চি না।
- না, তুই তো পচা আলু।
- আপনি আমাকে রাগাচ্ছেন কেনো?
- তুই ঠোট চাবাচ্ছিস কেনো?
- ওই তো ঠান্ডা আইসক্রিম ঠোঁটে লাগায়, শিরশির করছে তাই।
- যন্ত্রণা, বন্ধ কর ঠোঁট চাবানো।
- আরে।
- আগে কর।
- ওকে।
মেহরাব হাপ ছেড়ে বাঁচে। আজ মেয়েটা কুর্তি আর সালোয়ার পরে এসেছে। খোলা চুল, কানে ছোট একদুল, কানের পাশে তিলটা তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। গোলাপি আভাযুক্ত ঠোঁটের নিচের পাশে বাম কোনায় তিলটা জ্বলজ্বল করে রয়েছে। উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁটে বাইট করলে তা আলো স্পর্শকাতরভাবে আবেদনীয় হয়ে উঠছে। মেহরাব ঘন শ্বাস ফেলে। তার পরে মনে পড়ে সেদিন রাতের কথা; এলোমেলো অবস্থায় বাথরুমের ফ্লোরে শাওয়ারের পানিতে লেপ্টে থাকা আলোরা শ্বাস নিতে অক্ষমতা প্রকাশ প্রায়। বাড়িতে তেমন কেউ ছিলো না, ফুফু বাড়িতে দাওয়াত থাকায় তখন সেখানে গিয়েছিলো সকলে। আলোরা গেলে একটা ঝামেলা হবে ভেবে সে এড়িয়ে যায়। বাহানা দিয়ে থেকে যায়। মেহরাব খাবার খেয়ে আগপই বাড়ি চলে আসে। তোফা তাকে মিথ্যা বলেছে অসুস্থতার কথা। প্রাঙ্ক করেছিলো তার সাথে আর সে না বুঝে আলোরার সন্ধ্যাটা মাটি করে দিয়েছিলো। অনুসূচনায় দগ্ধ হয়ে সে সরি বলতে এগিয়ে যায় আলোরার ঘরের দিকে। এরপর সেই দৃশ্য দেখে থমকে যায়। শ্বাস না নিতে পারা আলোরাকে সিপিয়ার দেওয়ার জন্য প্রথমবার তার ঠোঁটে ঠোঁট ছোয়ায়। জান বাঁচানো ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তখন। কিন্তু তিন-চারবারে না হলে ছয়বার দেওয়া লাগে তার। এতে প্রতিবারেই তার কাছে আলোরার ঠোঁট বহু গুণ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে আকাঙ্ক্ষা জাগতে থাকে এক অন্যরকম পিপাসায়, সে আসক্ত হয়ে পড়ে।
মেহরাব আবারো একবার পাশ ফিরে তাকায়। না, এই মেয়েকে নিয়ে সে পারবে না। অঘটন বোঝে, আজ একটা ঘটবে। আলোরা আইসক্রিম খেতে গিয়ে সমস্ত গালে লেপ্টে নিয়েছে। আর তা আবার জিহ্বা দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে। মেহরাব এক দম নেয় আর আলোরার লোমড় আকড়ে ধরে শক্ত করে। এক হাতে তার চুলের মুঠি আকড়ে ধরেছে, ঠোঁটের খুব কাছ থেকে জিহ্বা বুলিয়ে আইসক্রিমের টুকু খেতে থাকে। এমন অনিয়ন্ত্রিত, শক্ত, বলিষ্ঠ, পুরুষালী আচমকা স্পর্শে তার শরীর ভার ছাড়তে থাকে। ছোটাছুটি তো আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে।
চলবে।
দুঃখিত কোন এক সমস্যার জন্য ১১ পর্বটি ডিলিট হয়ে গিয়েছিলো পোস্ট হওয়ার পরপর।
0 Comments:
Post a Comment