গল্প: বাধন হারা বেনী পর্ব ১২

 গল্প: বাধন হারা বেনী

লেখিকা: সানজিদা আহমেদ শাহারা

পর্ব: ১২


সন্ধ্যার পর থেকে টানা তিনবার সোমেহরা এসে আলোরার ঘরের দরজা ধাক্কাধাক্কি করে গিয়েছে কিন্তু বান্দা দরজা খোলার নামও নিচ্ছে না। সোমেহরা অসন্তুষ্ট হয়ে নিচে চলে যায়, এভাবে কিভাবে হবে? তারা বাসায় এসেছে সেই কখন, তখন থেকে মেয়েটা ঘরে দরজা দিয়েছে। মেহরাব ভাই নও বাসায় নেই। থাকলে হয়তো দরজা লাগানোর সাহস পেতো না।


সোহরাব কি মনে করে যেন মেহরাবকে ফোন দেয়। কিন্তু মেহরাব ফোন তোলে না। এতো বড় একটা রহস্য তারা সমাধান করলো অথচ এখনো কেউ সে ব্যাপারটা সেলিব্রেটই করলো না, আবার আলোরা চলে যাবে তাই সকলের মন খারাপ। তাই ভাই-বোনেরা মিলে ঠিক করেছে তারা ঘুরতে যাবে। বড়রাও আর আপত্তি জানায়নি। যাক, তারা ঘুরে আসুক। সেই ব্যাপারেই আলোরার সাথে কথা বলতে চেয়েছে সবাই কিন্তু সে ঘরে খিল আটেছে।


অন্যদিকে মেহরাব বাগানে তার প্রিয় চেয়ারে বসে চাঁদের দিকে ক্রোধের নজরে তাকিয়ে আছে।


চাঁদের তাতে বয়ে গেলো। হয়তো মুচকি হেসে টিপ্পনী কাটছে।


- কি মেহরাব সাহেব, এতো দুরত্ব, এতো গম্ভীরতা ছাপিয়ে অষ্টাদশী তোমাকে হারিয়ে দিলো?


(মেহরাব যেনে তা ভেবে ও ক্ষীপ্ত হলো)


- সব তোমার দোষ, চাঁদ। আমি অভিশাপ দেব তোমার, গায়েলও কলঙ্ক লাগুক।


- আমার গায়ে কলঙ্ক বহু আগেই লেগেছে। আমি তোমার মতো সুদ্ধো নষ্ট নই, আমি নষ্টই।


- আমি কন্ট্রোল করেছিলাম, বেলাজ চাঁদ।


- তারপর কি হলো?


- তোমার অষ্টাদশী আমার জলন্ত হৃদয়ে আগুনের ঘি ঢেলে পালালো।


- মূর্খ তুমি, মেহরাব সাহেব।


- শোন, চাঁদ, আমার আগুনে যেদিন আমি তেমন অষ্টাদশীকে পোড়াবো, পুরো দুনিয়া গোপন থাকবে, শুধু তুমি সাক্ষী থাকবে।


- যাও যাও, ব্যর্থ পাপী।


মেহরাব চাদের দিক থেকে চোখ না নামিয়েই কন্ঠে সুর তোলে...


বড়ই ইচ্ছে করছে ডাকতে


তার গন্ধে মেখে থাকতে


কেনো সন্ধ্যে সন্ধ্যে নামলে সে পালায়


তাকে আটকে রাখার চেষ্টা


আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে তেষ্টা


আমি দাঁড়িয়ে দেখছি শেষটা জানালায়


বোঝেনা সে, বোঝেনা


বোঝেনা, বোঝেনা, বোঝেনা


সে বোঝেনা


বোঝেনা.....


সন্ধ্যার সেই নিদারুণ লজ্জার কথা মনে পড়ায় আলোরাও আর বাইরে বের হয়নি। লজ্জা যতটুকু না এই ব্যাপারটার যে মেহরাব তার কাছে এসেছিলো, তার তিন গুণ এই ব্যাপারে যে সে ও মেহরাবের অন্যায় আবদারসভায়ের সায় দিয়েছে। কেনো সে আবেগের বহু দুর্ভFear ছেড়ে সামনের দিকে এগোতে পারে? কেনো সে এভাবে নিজেকে হলাকা হওয়াতেই ভাসিয়ে দিলো? সে আর বেরই হবে না।


তখন মেহরাব তার কাছে এসে তাকে স্পর্শ করতেই সে নিজেকে হারাতে থাকে, যদিওবা মেহরাব তার ঠোঁটের নিকটে গিয়ে বারংবার ফিরে আসছিলো; কিন্তু এই ফিরে আসা তার মন-মস্তিষ্ক মেনে নিতে অক্ষম হয়েছিল। সে ও মেহরাবের বুকের কাছের শার্ট খামচে ধরে, শক্ত করে অন্য হাতে তার পিঠের শার্ট মিশে যেতে নিলে মেহরাবের বাহু দোড়োনে মেহরাব সংবৎ ফিটে পায়, ছেড়ে দেয় আলোরাকে। আলোরাও এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে। আবেগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠার পর তার পদক্ষেপগুলো মনে পড়ার নিজেকে গুটিয়ে নেয় সে। এই লজ্জার কি জবাব সে দেবে? মেহরাবের সামনে এভাবে গুড়িয়ে যাওয়া তার মোটেও ঠিক হয়নি। মেহরাব তার ঠোঁট স্পর্শ করেনি। নিজেকে ধাতস্ত করে সে এগিয়ে যেতে তাকে দুজনেই বাড়ির দিকে। বাড়ির কাছাকাছি এসে মেহরাব চলে যায় বাগানে। আজ রাতটা সে চাঁদের সাথে বোঝাপড়া করেই কাটাবে। আর আলোরা এক ছুটে নিজের ঘরে ফিরে দরজাটা লাগিয়ে দেয়।


অন্যদিকে মেহরাব তাকায় চাঁদের দিকে। এবার চাঁদ ত্যক্ত বিরক্ত বোধ হয়। তাই তো তুই তোকারি সম্মোধন চলছে তাদের মাঝে।


- তুই অষ্টাদশীর ডাকে অষ্টারম্ভ প্রমাণিত হয়েছিস, তাতে আমার কি দোষ?


- তুই কেনো আমায় এমন মুহূর্ত পড়তে দিলি?


- তোকে কে অষ্টাদশী ঠোঁটে নির্জের দুভরলা জানান দিতে বলেছিল?


- আর একটা কথা বললে তোকে আকাশ থেকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিবো।


- সত্যি কথা সবার গায়ে লাগে।


- এখনো সময় আছে, মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়।


- এখনো সময় আছে, চুপচাপ অষ্টাদশীকে নিজের করে নে।


- আমি অপারগ।


- ও সব বাহানা।


- তুই আমার কল্পনা।


- আমি তোর ভেতরের সত্তা।


- যা তোহ্।


- আমি ছিলাম।


- চুপ, বড্ড কথা তোর।


তাদের এই নিরব বাক্যালাপের মাঝে সোহরাব ও তনিমা আসে বাগানে। বাগানের ঢোকার ফটকে বাইরে দাঁড়িয়ে মেহরাবকে ডাকে। মেহরাব পেছনে তাকিয়ে তাদের থেকে হালকা হাসে, প্রশ্ন করে কি হয়েছে। তারা বলে তারা কোথাও ঘুরতে যেতে চায়। মেহরাব বলে, এখনি না। মাত্রই তো হেমলপুর থেকে এলাম, আলোরা চলে গেলে আবার পুবালীপুরে যেতে হবে। এমন সময় একটা ফোন আসে মেহরাবের কাছে। ফোনটা কেটে দিয়ে সে হাসে সোহরাবকে বলে, সোমেহরার জন্মদিন উপলক্ষে একটা ছোটখাটো পার্টির আয়োজন কর। বাকিরা ও আসছে। অর্থাৎ তাদের খালাতো মামাতো ভাইবোনেরা। সোহরাব আর তনিমাও খুশি হয়ে যায়। এরপর তারা চলে যায়। মেহরাব আবারও আকাশ পানে তাকায়।


অন্যদিকে আলোরা কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছে কারণ এভাবে দরজা আটকে রাখলে আসতে আসতে বাড়ির সকলে এসে হাজির হবে, তা আবার বিশেষ ভালো দেখায় না। অনিমা ডাকতে এসে দরজা খোলা দেখে নিচে গিয়ে সোমেহরা ও তনিমা সোহরাবকে ডেকে আনে।


এরপর শুরু হয় তাদের বিস্তার আলোচনা কে কি করবো, পড়বে, আলোচনা সবকিছু। পরের দিন সকালে সব আয়োজন শুরু হতে থাকে। বিকালের দিকে তোফা আর রবি আসে মেহরাবদের বাড়িতে। তোফা মেহরাবের খালাতো বোন আর রবি মামাতো ভাই। আলোরার মা একা ছিলেন আর অনিমাদের মায়ের দুই ভাই-বোন তা আলোরার বাবা তো মারা গিয়েছেন। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান, আলোরা আজ শাড়ি পরবে, মেয়েদের শাড়ি পরার প্ল্যান হয়েছে শুনেই মেহরাব একপাল চেচিয়ে গিয়েছে, কিন্তু কেউ সে কথা কানে তোলেনি। সন্ধ্যায় সকলে রেডি হয়ে নিচে আসে। ছেলেরা শার্টের সাথে পছন্দসই প্যান্ট আর মেয়েরা পছন্দের শাড়ি। সবাই একসাথে হয়ে ছবি তুলতে শুরু করে। বড়রাও তাদের মোটামুটি কথা বলতে থাকে। কেক কাটার পর ডিনারের আগে সকলে নিজেদের মতো গল্প-গুজব করতে থাকে। তোফা আলোরার শাড়িতে বেখালী হয়ে পানি ফেলে দিলে সে চেঞ্জ করতে রুমে যায়। রুমটা অন্ধকার, তাই লাইট জ্বালাতে সুইচবোর্ডের দিকে এগোতে গেলে পেছন থেকে কেউ তার পেট খামচে ধরে এবং মুখ চেপে ধরে আতঙ্কে কেঁদে ফেলে সে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। ছোটাছুটি করতে গিয়ে এক পর্যায়ে সে লোকটার হাতে কামড় দেয়। এমন সময় মেহরাব তার রুমে আসে। এই পরিস্থিতিতে তখন আলোরা লাইট জ্বালাতে সক্ষম হয়। মেহরাব লোকটার পেছন থেকে কলার ধরে বসে। এটা পাবেল, মেহরাবদের ফুফুর ছেলে। মেহরাব তাকে ইচ্ছামতো পিটাতে থাকে। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে গেলে সে ছাড়ে আর ওয়ার্নিং দেয় যেনো এই বাড়ির সীমার মধ্যে তাকে না দেখা যায়। আলোরার দিকে ঘুরতেই দেখে আলোরা কাপড় জাপটে ধরে কান্না করছে। কান্নার ধমকে তার নিশ্বাস নিতে ও কষ্ট হচ্ছে। মেহরাব তার কাছে এগিয়ে গেলে সে মেহরাবের কলার ধরে বলে।


- পাবেল ভাই, কেন আমাকে এভাবে স্পর্শ করলো?


মেহরাব মলিন মুখে তাকায় আলোরার দিকে। আলোরা মেহরাবের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে বলে:


- চলে যাচ্ছি। এত কিসের ক্ষোভ, মা-ছেলের আমার প্রতি। আমায় এভাবে কেন ছুয়ে দিলো। কেন এভাবে আমাকে ছুয়ে দেবে? কেনো?


- চুপ।


- না। আমার গা ঘিণ ঘিণ করছে।


- আমি যখন কাল তোকে ছুয়ে দিলাম, তখন তোর গা ঘিণ ঘিণ করেনি?


- না।


- কেনো?


- আপনার স্পর্শে ভালোবাসা ছিলো। তাঁর স্পর্শে লালসা ছিলো।


- আমি ছুয়ে দেবো?


- মুর্ছা যাবো।


- না।


- হ্যা।


- আমি ছুয়ে দিলে সতেজ হয়ে যাবি।


- পাপা হবে আমার।


- আমার পাপেই না হয় তুমি পাপী হলে।


- না, মেহরাব ভাই।


- তাহলে কান্না থামা।


- থামছে না। কষ্ট হচ্ছে এখানে (মেহরাবের বুকে হাত দিয়ে আলোরা দেখায়)।


মেহরাব আলোরার চোখের পানি মুছে দেয়। কান্নার ধমকে কাপতে থাকা ঠোঁটজোড়া টানে তাকে। সে এগিয়ে আসে আলোরার দিকে। আলোরা ভীতু চোখে তাকায়। মেহরাব তার চোখের ভাষায় এক আকাশ সমান আকুলতা প্রকাশ করে। আলোরা সরে যায়। মেহরাব এগিয়ে যেতে থাকে আলোরার দিকে।


চলবে।


#ghiblitrend

0 Comments:

Post a Comment