গল্প: বাধন হারা বেনী
লেখিকা: সানজিদা আহমেদ শাহারা
পর্ব: ১৩
যখন মন মস্তিষ্ক একই সাথে কাজ করা বন্ধ করে দেয় তখনই মানুষ ভুল করে বসে। দোটানা মানুষকে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগায়। মেহরাবের আগমনে আলোরা নিজেকে বারংবার ছাড়তে বাধ্য হয়। এই স্পর্শ, এই টান, এই মায়া তাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। সে কি করবে, এই যন্ত্রণা যে এক বুক সুখ হিসাবে গায়ে মেখে নেবে, সে উপায় তো তার নেই।
মেহরাব ধীর পায়ে এগিয়ে আসে আলোরার দিকে, পেছন থেকে কোমর আগলে উন্মুক্ত পেটে হাত রাখে। হালকা চাপ লাগে পেটে, আলোরার দু'কদম পিছিয়ে মেহরাবের গায়ে হেলে পড়ে সে। চোখের কোন বেয়ে এখনে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মেহরাব তার পিঠে ঠোঁট রেখে বলে:
- কান্না থামা, আমি কি তোকে মেরেছি? আমি তোর শরীর থেকে পাবেলের স্পর্শগুলো মুছে দিচ্ছি।
- আমার পাপা হবে।
- হবে না।
- আমায় ছেড়ে দিন, মেহরাব ভাই।
- কেনো?
- আপনাকে আমার ভয় লাগে।
- কেনো?
- আমি বলতে পারবো না।
- না বললে ছাড়বো না।
- আপনি কাছে এলে আমার শরীর, আমার মন, আমার মস্তিষ্ক, আমার আওতার বাইরে চলে যায়।
- কেনো?
- জানি না।
- আহ্, মেহরাব ভাই।
- কি হয়েছে?
- এভাবে কামড় দিয়েন না। আমি সহ্য করতে পারি না।
- ঐ দেখ, আকাশে একটা পূর্ণ চন্দ্র উঠেছে। আমি ওকে জ্বালাচ্ছি, তুমি জ্বলছিস কেনো?
মেহরাব তার হাত অনবরত আলোরার পেটের এপাশে ওপাশে বিচরণে ব্যস্ত, উন্মুক্ত গলায় ঠোঁট রেখেই সে প্রশ্ন করে:
- বিয়ে করবি আমায়?
আলোরা হতবিহ্বল হয়ে তাকাতে চায় তার পানে। কিন্ত ব্যর্থ হয়ে মেহরাব তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আলোরা হতবিহ্বল হয়েই প্রশ্ন করে:
- আমি আপনাকে কিভাবে প্রশ্ন করতে পারি? আপনি তো...
- আমি যাই হই, তোর ক্ষতির কারণ হবো না।
- আই নিড ই আলোরা।
- আমার যে কত কাজ বাকি।
- আমি তোকে চাইছি আর তুই কাজ খুঁজছিস?
- বাড়ির লোক?
- আমি কিছু জানি না, আমি এখন এই মুহূর্তে তোকে বিয়ে করবো।
- আমার ভয় করছে।
- আমি ভয় ভেঙে দেবো তো।
- কিন্তু আপনি যদি হারিয়ে যান।
- না, আমি সব সময় তোর আশে পাশেই থাকবো।
মেহরাব আলোরার হাত ধরে তাকে নিচে হলরুমে নিয়ে আসে। সকলের মোটামুটি খাওয়া শেষ, পাবেল লোকচক্ষুর আড়াল হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। আলোরা জানে না সে কেন কাঁদছে, কিন্তু তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়েই যাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো, বেণীটা বাধনহারা হয়ে আধখোলা অবস্থায়। শাড়িটার আয়রন নষ্ট হয়ে গিয়েছে, জায়গায় জায়গায় ভাঁজ ভেঙেছে। ওদের এভাবে নামতে দেখে সকলে এগিয়ে আসে। মেহরাব তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে:
- আমি আলুকে বিয়ে করবো।
তার বাবা একথায় বিষম খায়, কাশি উঠে যায় তার। সে জানে ছেলে একদিন এই আবদার তার কাছে করবে কিন্তু এভাবে? এখুনি? এটা সে কস্মিনকালেও ভাবেনি।
- কি হলো, এতে কাশি আসছে কেনো? পানি খাও আর কাজি ডাকো।
এবার তার বাবার সাথে বাকি সকলে ও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অমাবস্থায়, ছেলে কি আইসক্রিম চাচ্ছে যে বাবা যাবে আর এনে দেবে! তার দাদি হায়হয় করে ওঠে।
- আমি ছোট বউকে কইলাম, কি ও মাইয়া ঘরে আছে? কাল সাপ ফণা একদিন মেলবেই। দেখছো মিলছে কিনা?
তার ফুফুও মায়ের সাথে তাল মিলায়।
- ছোট ভাবী, দেখো, দেখো, ঘরের মেয়ে করে রেখেছিলে না? কি একটা অবস্থায় পড়তে হলো এখন! ছেলেটার মাথা চিবিয়ে খেলো?
তোফা পাশ থেকে টিটকিরি করে বলে,
- এই আলোরা তোমাকে কি এমন করলো যে একটা অনাথের দায় ঘাড়ে নিচ্ছো?
মেহরাবের মা ঠাস করে একটা চড় মারে তোফার মুখে আর বলে, বেয়াদব হয়েছো? অনাথ কাকে বলছো? এতো বড় একটা পরিবার আছে, ওর চোখে দেখতে পাও না? আমার ভাগ্নি, তুমি ভাবতেই আমার লজ্জা হচ্ছে। তোফা রেখে জ্বলজ্বলে করে তাকায় আলোরার দিকে।
মেহরাব আবারও বলে, আমি আলুকে এখন এই মুহূর্তে বিয়ে করতে চাই। মেহরাবের চাচা বদরুল সাহেব গম্ভীর স্বরে বলেন:
- বিয়ে কি ছেলে খেলা? বললে আর দিয়ে দিলাম, একটা ভাবনা চিন্তার ব্যাপার আছে।
মেহরাব বলে, আমি এই রাতেই আলুকে বিয়ে করতে চাই, কাকা।
- বেয়াদব হয়েছো?
- না।
- তাহলে বড়দের মুখে মুখে কথা বলছো কেনো? আলোরা, তুমি কি এই গর্ধবটাকে বিয়ে করতে চাও?
আলোরা একবার তালায় মেহরাবের দিকে দেখে, কি থেকে কি হয়ে গেলো, কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। সে কি স্বপ্ন দেখছে? নাকি সত্যি? মেহরাবের কাকা আবারও প্রশ্ন করে:
- কি ব্যাপার, তোমার কি মত নেই?
মেহরাব রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায় আলোরার দিকে। সে মেহরাবের এমন রাগ দেখে ভয় মাথা নাড়ায়, সে রাজি। মেহরাব মুচকি হাসে। মেহরাবের চাচা চিন্তিত হয়ে মেহরাবের বাবার দিকে তাকায়, সে চোখ দিয়ে ইশারা করে আশস্ত করে। তাদের মা রাজি হয় না এই বিয়েতে। আলোরা অনাথ, তার বাবা-মা নেই এজন্য তাকে মেনে নিতে চায় না দাদি। মেহরাবের বাবা বলেন:
- আমার ছেলের যেখানে আলো মাকে পছন্দ, সেখানে আমি কোন কথা শুনবো না। লারণ জন্ম-মৃত্যু কারো হাতে নেই। তার বাবা-মা বেঁচে নেই, এতে তার কি দোষ? আল্লাহ যা ভালো মনে করেছেন, করেছেন।
আজকে তোমাদের বিয়ে দেওয়া সম্ভব না। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ো। কালকে তোমাদের এই ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিবো।
চলবে।
0 Comments:
Post a Comment