গল্প আমার_রুদ্রাণী পর্ব ৩১

 #আমার_রুদ্রাণী

#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা

#part: 31


🍂🍂🍂


অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে চাঁদের আলো ছেয়ে আছে সারা ঘরে। বারান্দায় বসে আকাশের দিকে চেয়ে আছে আহিল। চোখে মুখে বিষন্নভাব বিদ্যমান। আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাম হাতে থাকা সিগারেট এর প্যাকেট আর লাইটার এর দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে আবারো আকাশে দৃষ্টি স্থির করে। বারান্দাটা প্রায় সম্পূর্ণই খোলা, মাথার ওপরে ছাদ নেই, সামনে কাঠের তৈরি রেলিং। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, এক পা ছড়িয়ে, আরেক পা ভাজ করে তাতে ডান হাত রেখে বসে আছে। আকাশে মেঘ এর আনাগোনা খুব একটা নেই, ভরা পূর্ণিমা আজ, আকাশের তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। আহিল চোখ বন্ধ করতেই এক বিন্দু অশ্রু তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। আহিল চোখ বন্ধ করেই দীর্ঘ সময় পার করে। বাড়িটা শহর থেকে কিছুটা দূরে। আহিলের ১৫ তম জন্মদিনে তার দাদা তাকে এই বাড়িটা উপহার হিসেবে দিয়েছিল। ছোট বেলা থেকেই সে তার দাদা-দাদির খুব কাছের ছিল। বাড়িটা আহিল এর ঠিক পছন্দ মতই বানিয়েছিলেন আহিলের দাদা। কাঠের তৈরি দোতলা বাড়িটি, বেশ পরিপাটি আর মুগ্ধকর, বাড়ির সামনেই পিচঢালা রাস্তা, রাস্তার এক পাশে বিশাল দীঘি আর অন্যপাশে ক্ষেত। আহিল এর ১৫ তম জন্মদিনের বেশ কয়েকমাস পরেই তার দাদা হার্ট এ্যাটাক করে মৃত্যু বরণ করেন। স্বামীর শোকে তার দাদীও সে বছরই পরলোক গমন করেন। আহিল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারো আকাশের দিকে তাকায়।

.

দাদুর পছন্দেই বাবা মাকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর প্রায় সময়ই মন মালিন্য চলতো এদের। আহিল জন্মের পর হয়তো সম্পর্কটা ভালো হয়ে যাবে তা সকলের ভাবনায় থাকলেও এমন কিছুই হয় না। আহিল তার দাদা দাদীর সাথেই বেশি সময় ব্যয় করতো। বাবা মা এর ঝগড়া দেখে ভয় পেলেই দাদা দাদীর কাছে ছুটে যেতো। দাদা দাদীর মৃত্যুর পর সে প্রায় ভেঙে পড়েছিল। মা বাবার সম্পর্কও যেনো দিন দিন নষ্টই হচ্ছিলো। সে যে একজন সেই বাড়িতে আছে তা যেনো তাদের মনেই থাকে না। মা বাবার ঝগড়ায় অতিষ্ট হয়ে উঠলেই সে এই বাড়িতে এসে পড়ে। যেনো এই বাড়িই সব থেকে শান্তির। সারাদিন একা একা থাকা, প্রয়োজন ছাড়া কথা না বলা, কিছুটা গম্ভীর স্বভাবেরও হয়ে উঠেছিল। কলেজ এ পদার্পণ এর পর তার দেখা হয় মেহের আর তার বন্ধুদের সাথে। সারাদিন ভাই বোনের মতো খুনসুটি, আড্ডাগুলো আহিলকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনছিল। এই মানুষগুলোই যেনো এখন তার ভালো থাকার খোড়াক। আমরা পরিবারে শান্তি না পেলে বন্ধুদের মধ্যেই নিজের ভালো থাকার কারণ খুঁজি। আহিলের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। বন্ধুদের সাথে থাকলে মা বাবার ঝগড়া, একাকিত্ব যেনো আর তার মন, মস্তিষ্ককে ছুঁতেই পারে না। আহিল হাতে থাকা সিগারেট এর প্যাকেটটা পাশে রাখে। কখনোই এইসব ছাইপাশ সে ছুঁয়ে দেখেনি, আজ সখের বশে কিনে এনেছে। মেহের, দিয়া আর স্নেহা জানতে পারলে হয়তো তার সাথে এখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতো, হয়তো তাদের সাথে কাব্যও সায় দিয়ে তার পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দিতো। বন্ধুদের পাগলামির কথা মনে পড়তেই কান্নারত অবস্থায় ই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠে। ছলছল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে থেকে ঘরে ফিরে আসে আহিল। যাওয়ার আগে সিগারেট এর প্যাকেটটা বারান্দা হতে বাইরের দিকে ছুড়ে মারে।


🍂🍂🍂


সকালের রোদটা চোখে মুখে পড়তেই বিরক্তিতে ভ্রু জোড়া কুঁচকে দোলনা ছেড়ে উঠে দাড়ায় রুদ্র। কাল রাতে কথা বলতে বলতে দোলনাতেই ঘুমিয়ে পড়ে ছিল রুদ্র আর মেহের। মেহেরের কথা মাথায় আসতেই ঘুরে দাঁড়ায় রুদ্র। মেহেরকে বারান্দায় না দেখে দ্রুত পায়ে ঘরে এসে সেখানেও মেহেরকে না পেয়ে কপাল কুঁচকায়। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে সবে মাত্র ৬:১৫ বাজে। এই সময়ে হয়তো বাড়ির কেউই ঘুম থেকে উঠেনি। মেহের কি তাকে রেখে চলে গেলো? সে কি তার থেকে পালিয়ে গেছে? ভাবতেই ঘামতে শুরু করে রুদ্র। মুহূর্তেই যেনো মাথায় রাগ চড়ে বসে। দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। বাড়ির সকল গেটই বন্ধ দেখে সারাবাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে আবারো ঘরে ফিরে আসে রুদ্র। মেহের যদি পালিয়ে থাকে তবে মেহেরকে এবার খুব কঠোর শাস্তি দিবে তা ভেবে নেয় রুদ্র। চোখে পানি টলমল করছে, আয়মানকে কল করার জন্য ফোন হাতে নিতেই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে সেদিকে ঘুরে তাকায় রুদ্র। সামনে মেহেরকে দেখে সস্তির নিশ্বাস ছেড়ে দ্রুত পায়ে মেহেরের কাছে এগিয়ে যায়। রুদ্রর হটাৎ জড়িয়ে ধরায় মেহের দু কদম পিছিয়ে যায়। মেহের ছাড়াতে চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়। বেশ সময় পর রুদ্র মেহেরের থেকে দূরে সরে দাঁড়াতেই মেহের প্রশ্ন করে,

কি হয়েছে? সকাল সকাল এমন করছেন কেনো?

~আমাকে না বলে কোথায় গিয়েছিলে?

রুদ্রর এমন প্রশ্নে কপাল চাপড়ায় মেহের। বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বলে,

ওয়াশরুমে মানুষ কি করতে যায়? আর আমাকে দেখে অবশ্যই আপনার বোঝা উচিত যে আমি কি করছিলাম।

রুদ্রকে সরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেয়ে দাড়ায়।এবার খেয়াল করে রুদ্র। মেহের কলাপাতা রঙের শাড়ি পড়েছে, চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে, স্নিগ্ধতা মেহেরের চোঁখে মুখে ফুটে উঠেছে। রুদ্র ফের প্রশ্ন করে,

এখন গোসল কেনো করলে?

মেহের আয়নায় রুদ্রর প্রতিবিম্বের দিকে তাকায়। রুদ্র বাঁকা হেসে আবারো বলে,

আমি তো কিছুই করিনি।

মেহের লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায়। রোজ সকালে গোসল করা মেহেরের অভ্যাস তাই আজও তার ব্যতিক্রম করেনি। কিন্তু এখন রুদ্রর কথা শুনে মন চাইছে কোথাও যেয়ে লুকাতে পারলে ভালো হতো। মেহের আমতা আমতা করে জবাব দেয়,

সকালে গোসল করা আমার অভ্যাস তাই করেছি।

~ওওওও আচ্ছা আচ্ছা।

রুদ্র এসে মেহেরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই মেহের চোখ বড় বড় করে আয়নায় রুদ্রর দিকে তাকায়। রুদ্রর ছোয়ায় মেহেরকে কাপতে দেখে রুদ্র নিঃশব্দে হেসে মেহেরের কানে ফিসফিস করে বলে,

শীত করছে? কম্বল এনে দিবো?

মেহের মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। রুদ্র নিজ হাতে মেহের গলায় চেইন, কানে ছোট এক জোড়া দুল, হাতে চুড়ি আর নাকে নথ পড়িয়ে দিয়ে কতক্ষন মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে চেয়ে থাকে।

~এখন থেকে এইগুলা পড়ে থাকবা। কালকে রাতে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম তাই এখন দিলাম।

মেহের ঘাড় কাত করে 'আচ্ছা' বলতেই রুদ্র আলতো হাসে। মেহেরের দুগাল টেনে বলে,

আমার বউ। ইশ! আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না এই পিচ্চি মেহেরজান আমার বউ।

মেহের চেয়ে থাকে রুদ্রর দিকে। একবার পিচ্চি বলছে আবার বউ বলছে। অনার্সে পড়ুয়া মেয়েকে তার কাছে পিচ্চি মনে হচ্ছে! মেহের কপাট রাগ দেখিয়ে বলে,

আমি মোটেও পিচ্চি নই।

~অবশ্যই তুমি পিচ্চি। ছোটো খাটো, গুল্লুমুল্লু পিচ্চি বউ।

মেহের রেগে গিয়ে কিছু বলার আগেই রুদ্র দৌড় দিয়ে দ্রুত কাবার্ড থেকে জামা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। মেহের কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকে। রুদ্রর যাওয়া দেখে মেহেরের হাসি পেলেও রুদ্র তাকে পিচ্চি বলেছে ভেবেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকে মেহের।

~~~

চলবে~

(দেরি করে গল্প দেওয়ায় আবার কেউ মেহেরের মতো গাল ফুলিয়ে থাকবেন না।)

0 Comments:

Post a Comment