গল্প আমার_রুদ্রাণী পর্ব ১৯

 #আমার_রুদ্রাণী

#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা

#part: 19


🍂🍂🍂


বদ্ধঘরে হাত পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে একজন ব্যক্তি। চেহারায় ভয়ের রেশ বিদ্যমান, গায়ে বিভিন্ন স্থানে ক্ষত চিহ্ন, মাথা ফেটে গাল বেয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। চিৎকার করে আর্তনাদ করছে কিন্তু এই চিৎকার আদৌ এই ঘরের বাইরে যাচ্ছে কিনা জানা নেই। হাত জোড় করে নিজের প্রাণ ভিক্ষা চাইতেই তার সামনের চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তিটি ভয়ংকরভাবে হেসে উঠে। থমথমে পরিবেশে তার এমন এক হাসিতে লোকটির মনে থাকা ভয়ের পরিমাণ যেনো আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলো। লোকটি প্রাণ বাঁচানোর জন্য পুনরায় বললো,

ক্ষমা করে দিন স্যার, আর কখনো এমন কিছু করবো না। দয়া করে আমাকে যেতে দিন।

বুকে স্বজোরে এক লাথি পড়তেই লোকটি ছিটকে চেয়ারসহ মাটিতে মুখথুবড়ে পড়ে। রুদ্রর পাশেই দাড়িয়ে থাকা গার্ড দুজনকে ইশারা করতেই তারা লোকটিকে তুলে আবার সোজা করে, হাত পায়ের বাঁধন খুলে চেয়ারে বসায়। রুদ্র এবার একটা হাতুড়ি নিয়ে বসে। তা দেখেই যেনো লোকটির অন্তর আত্মা কেপে উঠে। মাথা দিয়ে বার বার না বুঝাচ্ছে। লোকটির চোখে ভয় দেখে রুদ্র বাকা হেসে বলে,

শেষ বারের মত প্রশ্ন করছি। কে পাঠিয়েছে তোকে?

লোকটি আবারো না বোধকে মাথা নেড়ে বোঝায় যে সে বলবে না। এতে রুদ্র আরো রেগে যায়। পাশের ছোট টেবিলটিতে লোকটির এক হাত রেখে হাতুড়ি দিয়ে স্বজরে আঘাত করতেই লোকটি বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠে। আবার আঘাত করতে নিতেই লোকটি মিনতির সুরে বলে,

বলছি, ব-বলছি। মারবেন না বলছি আমি।

~বল

~ শ-শরীফ মির্জা। উনি, উনি আমাকে বলেছিল তীব্র আহমেদ এর গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করাতে। 

নাম শুনেই রুদ্রর হাসি যেনো আরো প্রশস্ত হয়। আয়মানের দিকে তাকাতেই আয়মান বলে,

বিয়ের আগে খবর নিবেন নাকি বিয়ের পর স্যার?

~বিয়ের আগে খবর চাই। আর বিয়ের পর স্বশরীরে শরীফ মির্জাকে আমার সামনে চাই। 

রুদ্রর কথা শুনে মাথা নাড়ায় আয়মান। রুদ্র লোকটির দিকে আবারো ঘুরে বসতেই লোকটি হাত জোর করে বলে,

আমি তো সব বলেছি। এবার আমাকে যেতে দিন স্যার। আমি আর কখনও আপনাদের সামনে আসবো না।

লোকটির কথায় রুদ্র হাসে। ঘাড় কাত করে বলে,

হুঁ বলেছিস এর জন্য মাফ করলাম। কিন্তু....

লোকটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই রুদ্র পুনরায় হেসে বলে,

এতক্ষণ মার খেলি নাম না বলার জন্য। এখনও আরেক হিসাব বাকি। আমার ভাই কে মারার সাহস কি করে হয় তোর!!!

শেষের কথাটি চিৎকার করে বলেই গার্ড এর হাত থেকে একটু রড নিয়ে লোকটিকে মারতে থাকে।

আমার ভাই কে মারার জন্য এই হাত দিয়ে টাকা নিয়েছিলি না তুই!

বলেই হাত ভেঙে ফেলে। পরবর্তীতে পায়ে স্বজোরে আঘাত করতে থাকে আর বলে,

এই পা, এই পা এ ভর করেই তো আমার ভাইকে মারার জন্য এগিয়ে এসেছিলি। তাই না!

বলেই আবারো আঘাত করতে থাকে। লোকটির আর্তনাদ সারাঘরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

রুদ্রর থেকে কিছুটা দূরেই দাড়িয়ে আছে আয়মান আর তীব্র। তীব্রকে মেরেছে দেখে এই কয়েকদিনে আয়মান বেশ কয়েকবার মেরেছে এই লোককে তাতেও যেনো তার রাগ কমেনি। কিন্তু আজ রুদ্রর মার দেওয়া দেখে বেচারার নিজেরই খারাপ লাগছে। পর মুহূর্তেই ভাবে 'ঠিকই করছে রুদ্র, আহমেদ পরিবারের দিকে হাত বাড়ানোর সাহস কি করে হয়'। অন্যদিকে তীব্র দাড়িয়ে কি করবে ভাবছে। এইমুহুর্তে ছোট ভাই এর হিংস্র রূপ দেখে তার নিজেরই ভয় লাগছে। তীব্র অ্যাকসিডেন্ট করে যেই ব্যাথা পেয়েছি তার থেকে তিনগুণ কষ্ট এই লোককে অলরেডী দিয়ে দিয়েছে রুদ্র। এমনিও এখানে এসে লোকটিকে আধমরা অবস্থায় পেয়েছে তারা কারণ আয়মান খুব মার মেরেছে লোকটিকে। এখন রুদ্রর মার দেখে মনে হচ্ছে লোকটি নির্ঘাত মনে মনে বলছে 'এত যন্ত্রণার থেকে মৃত্যু অনেক বেশি আরামদায়ক'।

তীব্র এবার রুদ্রর থেকে চোখ সরিয়ে আয়মান এর দিকে তাকায়। আয়মানকে এমন ভাবলেসহীন ভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তীব্র বিড়বিড় করে বলে,

আজ বুঝলাম আয়মান কেনো রুদ্রর এত প্রিয় পাত্র। এই জন্যই ও রুদ্রর পি এ হতে পেরেছে। যেমন বস তার এমন পি এ, দুটোই ডেঞ্জারাস। বাপ রে বাপ!

তীব্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আয়মানের দিকে এগিয়ে দাড়াতেই আয়মান তীব্রর দিকে চেয়ে ভ্রু নাচায়। এর অর্থ 'কি হয়েছে'। তীব্র ভ্রু কুচকে বলে,

আরেকটু মার খেলে তো বেচারা পটল তুলবে।

~পটল না তুলে কুমড়ো তুলুক। আপনি এত টেনশন নিচ্ছেন কেন! রিলাক্স মুডে দেখুন শুধু। বেটার সাহস কি করে হয় আপনাকে মারার চেষ্টা করার।

চোখ মুখ গম্ভীর করে বলে আয়মান। আয়মানের কথা শুনে কপাল চাপড়ায় তীব্র। আয়মান ভ্রু কুচকে চেয়ে থাকে তীব্রর দিকে।

~রুদ্রর সাথে থেকে থেকে তুইও বেশ ঘাড়ত্যাড়া হয়ে যাচ্ছিস। আরে বেটা যা না ওকে আটকা। যথেষ্ট শাস্তি দিয়েছে। মাফ করতে বল এখন।

~আপনি আসলেই স্যার এর ভাই! আমি পারলে যেয়ে উল্টো আরো হাতে হাতে কয়েক ঘা বসিয়ে আসি আর আপনি বলছেন ওনাকে আটকাতে! আমি মোটেও যাবো না।

মুখ ফুলিয়ে বলে আয়মান। আয়মান এর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে এখন ভীষণ হতাশ। লোকটিকে শাস্তি দিতে না পেরে তার আফসোস এর শেষ নেই। তীব্র বুঝলো আয়মান কে বোঝানো মানে এখন বালুতে পানি ঢালার সমান। আয়মান আর রুদ্র যে তীব্রকে অনেক ভালোবাসে এতে সন্দেহ নেই তীব্রর। কিন্তু এতে যে একটা মানুষের প্রাণ যাচ্ছে তা মানতে নারাজ সে। আয়মান এর দিকে চেয়ে মিনমিন করে,

রুদ্রর লেজ একটা!

বলেই তীব্র রুদ্রর দিকে এগিয়ে যায়। রুদ্র এখনও লোকটিকে মারছে দেখে শুকনো ঢোক গিলে তীব্র রুদ্রর কাধে হাত রাখে। রুদ্র এক ঝাড়া দিয়ে হাত সরিয়ে দিলে তীব্র আবারো হাত রাখে। রুদ্র রেগে ঘুরে তাকাতেই তীব্র জোরপূর্বক হেসে বলে,

বেচারাকে আর কত মারবি ভাই! মাফ করে দে একে। দেখ অলরেডী আধমরা হয়ে গেছে। আরো মারলে মরেই যাবে। ছেড়ে দে না ওকে।

তীব্রর অনেক বুঝানোর পর রুদ্র আর আয়মান লোকটিকে ছাড়তে রাজি হয়। রুদ্র গার্ডদের দিয়ে লোকটিকে হাসপাতালে পাঠায়।

.

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। মাঝ রাস্তায় হটাৎ রুদ্র ড্রাইভার এর উদ্দেশ্যে বলে,

গাড়ি মেহেরজান এর বাড়ির দিকে ঘুরাও। মান তুই বাড়ি যেয়ে একটা গাড়ি আমার জন্য মেহেরজানের বাড়িতে পাঠিয়ে দিস। তোর আসা লাগবে না, বাড়িতে রেস্ট নিস। আর ভাইয়াও রেস্ট নিও যেয়ে।

তীব্র প্রশ্ন করে,

কেনো? মেহেরের বাড়ি কেনো? এখন আবার সেখানে কি কাজ?

~তুমি তোমার বউ এর কাছে কেনো যাও? অবশ্যই দেশের রাজনৈতিক ঝামেলা নিয়ে গবেষনা করতে যাও না।

তীব্রর আড় চোখে চেয়ে থাকে। রুদ্র সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে সিটে মাথা ঠেকিয়ে মুচকি হেসে বলে,

মুড প্রচন্ড খারাপ। মুড ফ্রেশ করতে যাচ্ছি।

~ওওওওওও...।

বলে তীব্রও মুচকি হেসে জানালার বাহিরে তাকায়।


🍂🍂🍂


খাটে আধশোয়া হয়ে মনোযোগ দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের লেখা "ময়ূরাক্ষী" বইটি পড়ছে মেহের। হটাৎ কেউ ঝড়ের বেগে এসে মেহেরের কোলে মাথা রাখতেই মেহের হকচকিয়ে যায়। পরে কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকা মানুষটির দিকে তাকাতেই কপাল কুঁচকে তাকায় মেহের।

~আপনি এখন, এখানে কি করছেন?

~মুড ফ্রেশ করছি

~মানে কি?

~বড্ড বেশি কথা বলো তুমি মেহেরজান। রেস্ট নিতে দাও।

বলেই আবারো মেহেরের পেটে মুখ গুজে শুয়ে পড়ে। মেহের কতক্ষন হা হয়ে চেয়ে থাকে। পরমুহূর্তেই রেগে বলে,

সরুন। বই পড়ছি দেখছেন না! রেস্ট নিতে হলে বাড়ি যান। আপনার আহমেদ ভিলা কি কম বড় নাকি যে আমার ঘরে এসে রেস্ট নেওয়া লাগছে আপনার! যান আপনার ঘরে যেয়ে রেস্ট নিন। আমাকে ছাড়ুন। আমি বই পড়বো।

~ওই বাড়ি অবশ্যই বড়। কিন্তু বউ তো আমার এই বাড়িতে। তাই আমিও এখানেই। বাই দ্যা ওয়ে আরেকবার ছাড়তে বললে ডিরেক্ট তোমার প্রিয় বই এ আগুন লাগিয়ে দিবো বললাম।

মেহের সাথে বই বন্ধ করে বালিশের নীচে লুকায়। রুদ্র মেহেরের পেটে মুখ গুজেই হেসে দেয়। মেহের আলতো হাতে রুদ্রর চুলের ভাঁজে আঙুল চালাতে চালাতে বলে,

কি হয়েছে আপনার?

~মাথাটা ভীষণ ব্যাথা করছে।

~কফি খাবেন?

~তুমি বানাবে?

~ছাড়ুন আমি নিয়ে আসছি।

রুদ্র উঠে বসে। মেহের কফি বানানোর জন্য কিচেন এ যায়। কফি নিয়ে ঘরে এসে দেখে রুদ্র ঘরে দেই। বারান্দা থেকে দোলনার আওয়াজ পেতেই বুঝতে পারে রুদ্র সেখানেই আছে। বারান্দায় এসে দেখে রুদ্র দোলনায় বসে বাইরের দিকে চেয়ে বাড়ি সাজানো দেখছে। মেহের গিয়ে রুদ্রর পাশে দাঁড়াতেই রুদ্র মেহেরের হাত থেকে কফি মগ টা নিয়ে তাতে এক চুমুক দেয়। চোখের ইশারায় মেহেরকে পাশে বসতে বললে মেহেরও বাধ্য মেয়ের মত রুদ্র পাশে বসে। রুদ্র কফি খাওয়া শেষ করে মেহেরের দিকে চেয়ে এক প্রাণবন্ত হাসি দেয়। রুদ্রর চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারছে যে কফিটা রুদ্রর ভালো লেগেছে। হাসি বজায় রেখেই রুদ্র বলে,

এত ভালো কফি বানানো কোথা থেকে শিখেছো?

~নিজ থেকেই শিখেছি।

~বিয়ের পর রোজ সকাল বিকেল আমার তোমার হাতে বানানো কফি চাই।

~আর কোনো আবদার?

~আপাতত এটাই। রুদ্রানী...

মায়াভরা কণ্ঠে ডেকে উঠে রুদ্র। মেহের রুদ্রর দিকে তাকায়। রুদ্র মেহেরের কাধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বলে,

বড্ড বেশি ভালোবাসি তোমার। তোমাতে আসক্ত আমি। কখনো বলবো না যে আমার মত ভালোবাসো না কেনো তুমি আমায়। তুমি শুধু আমার হয়ে থেকো তাতেই আমি খুশি।

উত্তরে মেহের কিছুই বলে না। মানুষটার প্রতি মেহের ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে তা মেহের নিজেও বুঝতে পারছে। রুদ্র মাথা তুলে মেহেরের দিকে তাকায়। 

~আর মাত্র ২ দিন। তারপর তুমি আমার। একান্তই #আমার_রুদ্রাণী।

বলেই নিঃশব্দে হাসে রুদ্র। মেহেরের গেলে হাত রেখে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলে,

আমার হবু স্ত্রীর খেয়াল রেখ, আসছি।

রুদ্র উঠে চলে যেতে নিলেই মেহের রুদ্রর হাত ধরে আটকায়। রুদ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই মেহের ধীর গলায় বলে,

সাবধানে যাবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন।

রুদ্র কিছুক্ষণ মেহেরের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর ঠোঁটের হাসি আরো চওড়া করে বলে,

অবশ্যই।

মেহের বারান্দায় দাড়িয়ে রুদ্রর যাওয়া দেখে। গাড়িতে উঠার সময় রুদ্র একবার বারান্দার দিকে তাকায়। মেহের এখনও রুদ্রর দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র ফ্লায়িং কিস দেখাতেই মেহের অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকে। পরমুহূর্তেই লজ্জা রাঙ্গা এক হাসি দেয়। রুদ্রর গাড়ি দৃষ্টিসীমার বাহিরে যাওয়া পর্যন্ত মেহের দাড়িয়ে থাকে। রুদ্রর কথা মনে হতেই একরাশ ভালো লাগা মনের মাঝে ছেয়ে যায়। মেহের হাসিমুখে ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

~~~

চলবে~

0 Comments:

Post a Comment