গল্প আমার_রুদ্রাণী পর্ব ২৭

 #আমার_রুদ্রাণী

#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা

#part: 27


🍂🍂🍂


~আমাকে ছাড়ার কথা ভুলেও মাথায় এনো না মেহেরজান।

বলেই উঠে বসে রুদ্র। রুদ্রকে বিয়ে করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিলেও একজন মাফিয়ার সাথে সংসার করা মেহেরের পক্ষে সম্ভব না।

~আপনার মাফিয়া জগতে পা রাখার কারণ আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আপনার সাথে আমার পক্ষে সংসার করা সম্ভব না। আমি কখনোই চাইনি যে আমার বর কোনো মাফিয়া হোক। তাই আমি...আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।

এতক্ষণ শান্ত ভঙ্গিতে কথা বললেও রুদ্রর চোখে মুখে এখন রাগ ফুটে উঠে। মেহেরের দুই কাধ শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

বিয়ে করতে পারবেন না মানে কি? আমাকে কি রাস্তার গুন্ডা মনে হয়? একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নাও মেহেরজান। আমি ছাড়া আর কোনো পথ নেই তোমার কাছে।

এক বিন্দু অশ্রু মেহেরের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তেই রুদ্র টা স্বযত্নে মুছে দেয়। 

~কাদঁছো কেনো? একটু মন মতো বকাও দেওয়া যায় না দেখছি। বিয়ের কনে তো সত্যিই পিচ্চি।

~আমাকে যেতে দিন প্লীজ। আমি আপনাকে বিয়ে করবো না।

~দেখা যাক!

~আপনি প্লীজ!

~চুপ চাপ ঘুমাও। আমি পাশের রুমেই আছি। কিছু লাগলে আমাকে অবশ্যই জানাবে। 

বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় রুদ্র।


🍂🍂🍂


ফজরের আযান দিতেই অজু করে নামাজ পড়ে নেয় মেহের। আজ কি হবে জানা নেই মেহেরের। মনে মনে শুধু দোয়া করছে সব কিছু যেনো ঠিক হয়ে যায়। নামাজ শেষে বারান্দায় দাড়িয়ে সকাল হওয়া দেখতে থাকে। প্রায় অনেকক্ষণ বারান্দায় দাড়িয়ে থাকে মেহের। ঘরে এসে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে ৬:৪৫ বাজে। মেহের ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলে,

সময় কত জলদি অতিবাহিত হয়।

কিছুক্ষণ পরেই ঘরে স্নেহা আসে। স্নেহাকে দেখতেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে মেহেরের। মেহেরকে হাসতে দেখে স্নেহার মনেও কিছুটা শান্তি অনুভব হয়। মেহের পাশে বসতে ইশারা করতেই স্নেহা যেয়ে মেহেরের পাশে বসে। দীর্ঘসময় দুজন চুপচাপ বসে থাকে। মৌনতা ভেঙে স্নেহা বলে,

কি সিদ্ধান্ত নিলি মেহের? বিয়েটা করবি?

~বুঝতে পারছি না আমি। কালকের পর থেকে রুদ্রকে দেখতেই মনের মধ্যে ভয় জেগে ওঠে। এই ভয় নিয়ে আমি সংসার করতে পারবো না।

~ভাইয়া তোকে যেতে দেবে?

মাথা নেড়ে না বোঝায় মেহের। স্নেহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

~তুই তীব্র ভাইয়া সাথে কথা বলিস নি?

~না

~কেনো?

~আমার কাছে কেনো লুকালো এসব? আমি তার অর্ধাঙ্গিনী। সে আমার কাছেও বলতে যদি দ্বিধা করে তবে আমার থাকা না থাকা সমান নয় কি?

~ভাইয়া তোকে টেনশন দিতে চায়নি হয়তো।

~বাদ দে। এখন কি করবি?

~পালিয়ে যাই?

~পাগল হয়েছিস! ভাইয়া যে করেই হোক তোকে খুজে বের করবে।

~তো কি করবো? মাকে বুঝালে বিয়ে ভাঙতে রাজি হবে?

~চেষ্টা করে দেখবি?

~দেখি। বাসায় কখন যাবো? জানিস কিছু?

~কালকের ঘটনার পর রুদ্র ভাইয়া জানিয়েছে বিয়ে এই বাড়িতেই হবে। ও বাড়িতে কষ্ট করে যাওয়া আসা করা লাগবে না।

~মানে কি!

~মানে হলো তোর বরমশাই তোর পালানোর রাস্তা খুব কড়াভাবে বন্ধ করে দিয়েছে।

কথার মাঝেই দিয়া ঘুমু ঘুমু চোখে ঘরে প্রবেশ করে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে দিয়াও সারা রাত ঘুমায়নি। দিয়া এসে জোরপূর্বক হেসে বলে,

কেমন আছিস তোরা?

~আলহামদুলিল্লাহ্। তুই? (স্নেহা)

~হুঁ (দিয়া)

দিয়াকে দেখতেই রুদ্রর বলা আয়মান এর কথা মনে পড়ে মেহেরের। মেহের দিয়া কে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে,

তুই কি কেঁদেছিস?

~না (অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দেয় দিয়া)

~আয়মান ভাইয়া তোকে ভালোবাসে জানিস? (দাত কেলিয়ে বলে মেহের)

~এই আজাইরা কথা তোরে কোন আহাম্মক এ বললো? (তাচ্ছিল্য হেসে বলে দিয়া)

~স্নেহার দেবর। (খাটে গা এলিয়ে দিয়ে বলে মেহের)

~রুদ্র ভাইয়া বলেছে? (স্নেহা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে)

~হুঁ। (পাশে থাকা ছবির ফ্রেমটি হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলে মেহের)

~ফাজলামো করিস না মেহের। কাল রাত থেকে এমনিই মন মেজাজ ভালো না। (গম্ভীর কণ্ঠে বলে দিয়া)

~তুই কি আমার বিয়াইন লাগস যে তোর সাথে ফাজলামি করতে যাবো! স্নেহার দেবর যা বলেছে তাই তো বললাম। 

(চোখ ছোট ছোট করে বলে মেহের)

~কি বলেছে ভাইয়া তোকে? (স্নেহা)

আড়চোখে একবার স্নেহার দিকে চেয়ে সব বলে মেহের। মেহেরের কথায় প্রথমে অবাক হলেও পরে হাসে দিয়া।

~ভালোবাসা যাক জাহান্নামে। আমি তাকে কখনো বিয়ে করবো না। (দিয়া)

~কেনো কেনো? (মেহের)

~তুই যেই কারণে রুদ্র ভাইয়াকে বিয়ে করবি না। আমিও ঠিক একই কারণে করবো না। কেননা সে সব কাজে রুদ্র ভাইয়ার সাথে সাথে থাকে। মানে সে সমান দোষী। (দিয়া)

~কি কপাল তোদের! তিন বান্ধবীকে তিন ভাই পছন্দ করলো! তাদের দুটো বোন থাকলে আমাদেরও আজ কপাল খুলে যেতো। 

আফসোসের সুরে কথাটি বলে ধুপ করে খাটে এসে বসে কাব্য। পেছন পেছন আহিল ও ঘরে প্রবেশ করে। 

~তুই এত জলদি ঘুম থেকে উঠলি কেমনে? (দিয়া)

~ঘুমাইলে তো উঠমু। (কাব্য)

~সারা রাত বসে বসে টেনশন করেছি। ঠিক আছিস তোরা? (আহিল)

~হুঁ। (মেহের)

~৮ টা বাজে। এতক্ষণে নাস্তা রেডি হয়ে গেছে হয়তো। চল নাস্তা করে আসি। (স্নেহা)

~হ্যাঁ চল। (কাব্য)

সবাই এক সাথে নাস্তা করে আবার ঘরে ফিরে এসে ভাবতে থাকে যে কিভাবে মেহেরের মা কে রাজি করানো যায়।


🍂🍂🍂


ডাইনিং টেবিলে বসে আছে মেহেরের মা, নানা নানি আর রুদ্র, রুদ্রর মা, বাবা, তীব্র আর আয়মান। পাশেই দাড়িয়ে কাচুমাচু হয়ে দিয়া, স্নেহা, আহিল আর কাব্য একে অপরকে খোঁচাচ্ছে মেহরিশ বেগম কে ডাক দিতে। পাশের চেয়ারে রুদ্রকে বসা দেখতেই ওদের ভয়ে জান যায় যায় অবস্থা। কাব্য ধাক্কা দিয়ে দিয়াকে আগে বাড়িয়ে দিতেই সকলের দৃষ্টি দিয়ার দিকে একবার চেয়ে আবারো খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।

~আন্টি!

দিয়ার ডাকে এবার রুদ্র বাদে সকলেই দিয়ার দিকে তাকায়। দিয়া করুন দৃষ্টিতে কাব্যদের দিকে তাকায়। ওরা চোখ দিয়ে দিয়াকে বলতে ইশারা করছে। দিয়া একটা শুকনো ঢোক গিলে রুদ্রর দিকে তাকায়। রুদ্র বাম হাতে থাকা ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখেই খাবার খাচ্ছে।

~কিছু বলবি? (মেহরিশ)

দিয়া মাথা না বোধকে নেড়ে আবার মুখে হ্যাঁ বলতেই মেহরিশ চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।

~মেহের ডেকেছিল তোমাকে। একটু দরকার ছিল।

এখন যদি রুদ্র ওদের মতলব বুঝে তাকে যেতে মানা করেন? তাই ভেবে রুদ্রর দিকে চোখ পিটপিট করে তাকায় দিয়া। কিন্তু না রুদ্র স্বাভাবিক ভাবেই এক হাতে ফোন স্ক্রল করতে করতে খাবার খাচ্ছে। তার ভাবখানা দেখে মনেই হচ্ছে না সে এখানে এসে ব্যতীত অন্য কেউ আদৌ আছে।

~এইটুকু কথা বলতে এত ইতস্তত বোধ করার কি আছে?

~তুমি ব্যস্ত তো তাই বলতে হেজিট্যাট ফিল করছিলাম আর কি।(জোর পূর্বক হেসে বলে দিয়া)

~আচ্ছা যা আসছি।

মেহরিশ বেগমের কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই দ্রুত স্থান ত্যাগ করে মেহেরের বন্ধুরা।

.

সকলে ঘরে হুড়মুড় করে প্রবেশ করতেই মেহের কিছুটা হকচকিয়ে যায়। বুকে থুথু দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে ওদের জিজ্ঞেস করে,

এভাবে ঘরে ঢুকে কেউ! এই বয়সে মিনি হার্ট এ্যাটাক দিতে মারার ধান্দা!

~রাখ তোর মিনি হার্ট এ্যাটাক! তোর থেকেও বড় হার্ট এ্যাটাক হওয়ার থেকে বেঁচে ফিরেছি। (কাব্য)

মেহের কিছু বুঝতে না পেরে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে,

মানে?

~রুদ্র ভাইয়াও সেখানে ছিল। ভয়ে আমাদের অবস্থা খারাপ। (দিয়া)

~উনি কিছু বলেছে?

~না। (দিয়া)

ওদের কথার মাঝেই ঘরে প্রবেশ করে মেহরিশ। মেহরিশ কে আসতে দেখে সকলেই চুপ হয়ে যায়।

~কিরে এত দ্রুত আসতে বললি যে? কি হয়েছে? শরীর খারাপ করলো নাকি আবার? জ্বর এসেছে? 

অস্থির কণ্ঠে মেহেরের গালে কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে মেহরিশ। মেহের মায়ের দিকে কিছুক্ষন এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে গাল থেকে মায়ের হাত সরিয়ে তাকে বসতে বলে। মেয়ের কথা মত তিনিও সোফায় যেয়ে বসে। মেহেরের বন্ধুদের মেহের খাটে বসতে ইশারা করে। তারাও যেয়ে চুপচাপ বসে। মেহের যেয়ে মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। মিহি স্বরে বলে,

আমার কিছুই হয়নি মা। চিন্তা করো না।

~তবে?

~জীবনে যা চেয়েছি সব দিয়েছো। কখনো কোনো কিছুর কমতি রাখোনি। তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

মেহরিশ মেয়ের মাথায় ডান হাত রাখে। মেহের মায়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। শান্ত কণ্ঠে বলে,

আজ আমার একটা কথা রাখবে মা?

মেহেরের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই মেহের বলে,

আমি এই বিয়ে করতে পারব না মা। আমি রুদ্রকে কোনোমতেই বিয়ে করতে পারব না। তুমি বিয়ে টা ভেঙে দাও প্লীজ!

মায়ের চোখের নমনীয় ভাবটা মুহূর্তেই গম্ভিরতায় রূপ নিলো। শক্তহাতে ধরে রাখা মেহেরের হাতটি চোখের পলকেই আলগা হয়ে গেলো। মেহের একবার মায়ের হাতের দিকে চেয়ে আবারো তার মুখের দিকে তাকায়।

~তুই কি কাউকে পছন্দ করিস?

গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চায় মেহরিশ। মেহের মাথা নেড়ে না জানায়। মেহরিশ এর মুখটা যেনো আরো গম্ভীর হয়ে এলো।

~তবে কি সমস্যা?

~আমি তার সাথে সংসার করতে পারবো না।

~কেনো?

~তার মাফিয়া জগতে আনাগোনা আছে। তুমি জানো না মা।

কিছুটা চিল্লিয়ে বলে মেহের।

~জানি আমি।

মেহরিশ এর নির্লিপ্ত জবাবে থমকে যায় ঘরে উপস্থিত থাকা সকলে। মেহের বিস্ময়ের দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চেয়ে থেকেই উঠে দাড়ায়। ধরা গলায় বলে,

তুমি জানতে?

~হ্যাঁ

মায়ের ফের শান্ত জবাব।

~তুমি তবুও তার সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইছো? তুমি জানতে না আমার খুন খারাবি পছন্দ না?

~জানি

মায়ের এই ঠান্ডা ব্যবহারটা যেনো মেহের আর নিতে পারছে না। চিৎকার করে বলে,

জানো মানে কি! এমন এক মানুষের সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইছো তুমি যে কিনা মানুষ মারে!

~রুদ্র কেনো এসব করেছে সব ই তোর জানার কথা। ও কেনো এমন হয়েছে তাও তোর জানা। ও তো শুধু উপযুক্ত শাস্তি দিচ্ছে মেহের। তাছাড়া ও তোকে অনেক ভালোবাসে।

~তাকে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না। তুমি এই বিয়ে ভেঙে দাও মা।

~তোর কি মনে হয়? রুদ্র এই বিয়ে ভাঙতে দিবে? তোকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবে? তাছাড়া বিয়ের দিন কি করে বিয়েতে অমত পোষণ করিস তুই! সমাজে জানাজানি হলে আমাদের সম্মান এর কি হবে জানা আছে!

~মানুষের কথা আমি কেয়ার করি না মা। আমি তাকে বিয়ে করবো না।

~তুই না করলেও আমরা পরোয়া করি। যাই হোক না কেনো বিয়ে তোর রুদ্রকেই করতে হবে।

~আন্টি...

দিয়া কিছু বলতে নিতেই থামিয়ে দেয় মেহরিশ। ওদের উদ্দেশ্য করে বলে,

তোরা তো ওর বন্ধু। ওর ভালো খারাপ তোরা অবশ্যই ভালো বুঝিস। ওকে বুঝাচ্ছিস না কেনো? রুদ্র ওর জন্য কতটা পসেসিভ জানিস তো তোরা! আর স্নেহা! রুদ্র তো তোর দেবর। তবে মেহেরকে বুঝাচ্ছিস না কেন তুই!

একটু থেমে আবার বলে,

কিছুক্ষণের মধ্যেই পার্লার এর লোক আসবে সাজাতে। সবাই তৈরি হয়ে নিস। 

বলেই হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে যায় মেহরিশ। মেহের তার মায়ের যাওয়ার দিকে অপলকভাবে চেয়ে থাকে।

~~~

চলবে~

0 Comments:

Post a Comment