গল্প: বাধন হারা বেনী পর্ব ১৫

 গল্প: বাধন হারা বেনী

লেখনী: সানজিদা আহমেদ শাহারা

পর্ব: ১৫



দুর থেকে ভেসে আশা আজান এর শব্দে ঘুম ভাঙে আলোরার।এতক্ষন সে স্বপ্ন দেখছিলো?ভাবতেই তার লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে যায়।ফ্রেস হয়ে ঘরেই বসে আছে আলোরা নিচে যেতে মন চাচ্ছে না।কালকে ঐ ঘটনার পর তার ভীষন কান্না পাচ্ছে।বাড়ির সকলে তাকে নিয়ে কি ভাববে এসব ভেবেই তার মন খারাপ ।আপু, ভাইয়া,তনিমা অনিমা কেউ আসেনি তার কাছে কাল থেকে।ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যায় তার।এমন সময় দরজায় নক করে কেউ আলোরা উঠে দরজা খুলে দেয়।ফুফু আর দাদি এসেছে।কিছু টুকি টাকি কথা বলে তারা চলে যায়।আলোরা শুনতে পায় তাদের বিয়ের দিন পড়েছে আগামী পরশু সন্ধ্যায়।


খবরটা তাকে দিয়েছে তনিমা।তারা মুলত মানতে পারছে না তাদের কাজিন গুষ্টীতে শান্ত আর রাগী দুই ভাই-বোন তাদের নাকের নিচে দিয়ে প্রেম করেছে? তা তারা জানতে ও পারেনি।তারপর আলোরা সকলকে ডেকে সবটা বোঝায়।এরপর সকলে গালে হাত দিয়ে ভাবে এটা পরিস্থিতি নাকি সুযোগ এর সৎ ব্যাবহার।

বাড়িতে একটা বেশ বিয়ে বিয়ে আমেজ হয়ে উঠেছে।সকলেই হাতে হাতে কাজ করছে।


গায়ে হলুদ এর কেনা কাটা করতে বাড়ি শুদ্ধ সকলে চলে গিয়েছে শুধু বর বউই যায়নি।সকাল বেলা আলোরাকে একটা গাড়ো সবুজ রং এর শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে সোমেহরা।হাতে চিকন দুটো বালা।

সকালে অল্প কিছু খেয়েছিলো তাই বেলা বাড়তেই ক্ষুধা লাগছে।আচল কোমরে গুজে চুল গুলো খোপা করে দক্ষ হাতে নুডুলস রান্না করছে আলোরা।মেহরাব মাত্রই গোসল করে বাইরে এসেছে বের হবে একটু।পরনে একটা সাদা শার্ট নীল প্যান্ট।ফোন টিপতে টিপতে এসে রান্না ঘরে দাড়ায় এরপর কি জানি কি হলো হাতে থাকা ফোন টা সোফাতে ছুড়ে মেরে এক  বড় বড় পা ফেলে শ্বাস টানতে টানতে এগিয়ে যায় রান্না ঘরে।আলোরা তখন ব্যাস্ত ডিম গোলাতে।মেহরাব এসে এক টানে আলোরাকে তুলে বসায় কিচেনের বাড়তি দেওয়ালের অংশে।উন্মুক্ত কোমরের হাত রাখে শক্ত করে,কানের 

কাছে ফিস ফিস করে বলে


- তোমাকে আমার বউ মনে হচ্ছে বিয়ে তো হয়নি জান।এখনি আমায় জ্বালাচ্ছ?


- কি বলছেন?


- বলছি বউ যখন সাজলে আসো একটু সাজ নষ্ট করি?


- রান্না পুড়ে যাবে যান এখান থেকে।।


- উহু  আজ আর যাওয়া হবে না।


- বিয়ে হয়নি এখনো।


- হয়ে যাবে এখনি।


মেহরাব গ্যাসের চুলা টা বন্ধ করে আলোরার কপালে পুর পর কয়েকটা চুমু দেয়।এরপর তার চুল শক্ত করে মুঠো ধরে এবং কোমড় আকড়ে ধরে ওষ্ঠে ওষ্ঠ স্পর্শ করে।আলোরা মুহূর্তেই কেপে ওঠে।ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়।আলোরা শুনেছিলো আজ প্রমান পেলো।তার আত্মা কায়া ছেড়েছে।আলোরা স্বপ্নের থেকে ও বেশি হাসফাস করছে।দুই হাতে মেহরাব এর পিঠের শার্ট আর চুল খামচে ধরে আছে।মেহরাব তাকে যত্ন করে চুম্বন করে।এরপর দুজনে লম্বা শ্বাস নিতে থাকে।আলোরা এক অদৃশ্য বেদনা অনুভব করে তার ভেতরে।মেহরাব তাকে আরো কয়েকটা চুমু দিয়ে চলে যায়।


আলোরা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে।


-ওহে প্রিয় তুমি যদি আমার ভাগ্যে থাকতে তাহলে আমার আর কিছুই চাওয়ার থাকতো না।এজন্য আল্লাহ্ তোমায় আমার করে দিলো না।নসিব, ভাগ্য,কপাল সবার এক না তো এজন্য আমার শখের মানুষ আমার হয়ে ও আমার হলো না।


আলোরার চোখে আর বাধ মানলো না।কান্না তার গলা ছাপিয়ে বেরিয়ে এলো।অঝরে কান্না করতে থাকে সে।কান্নার দমকে বার বার তার শ্বাস আটকে আসছে।আর কিছুই খাওয়া হয় না তার।শরিরটা বড্ড ক্লান্ত।সন্ধ্যায় সকলে সপিং শেষ এ ফিরে আসে।চারপাশে এতো আলোক বাতি অথচ আলোরা দরজা আটকে অন্ধকারে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। যেনো এই কান্না টুকুই তার শেষ সম্বল। রাত পোহালেই তার গায়ে হলুদ।বাবা-মার জন্য বড্ড মন খারাপ তার।আজ তারা বেচে থাকলে হয়তো আলোরার জীবন টা অন্য রকম হতো।কিন্তু সবার কপালে তো আর সব সুখ সয় না।কান্না করতে করতে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে তা তার মনে নেয়।যখন ঘুম ভাঙে তখন বাহিরে আজান দিচ্ছে।আলোরা উঠে নামাজ পড়ে অনেক কান্না করে মোনাজাত এ।এরপর উঠে ব্যাগ গুছিয়ে নেয়।তারপর গুটি গুটি পায়ে যায় মেহরাব এর রুমে।মেহরাব তখন গভীর ঘুমে।আলোরা তার পায়ের কাছে বসে তারপর তার পা ধরে বলে


-আপনাকে আমি না পেয়েই এতো ভালো বাসি।না জানি আপনি আমার জন্য হালাল হলে কতটা ভালোবাসা উজাড় করে দিতে পারতাম। মেহরাব এর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আলোরা।তারপর তার কপালে কয়েকটা চুমো দেয়।মন চাচ্ছে বুকে জড়িয়ে ধরে হাও মাও করে কেঁদে নিজেকে হালকা করতে কিন্তু তা তো সম্ভব না।


আলোরা চলে যায় দুর আজানায়।যেখানে কেউ তাকে খুজে পাবে না।আর যোগাযোগ করনি কখনো মেহরাব এর সাথে বা তাদের কারো সাথে।আজ প্রায় ৭ টা বছর সে একা একা রয়েছে জাপানে।

এই সময়ে জাপানে প্রচুর চেরি ব্লাসম হয়।আলোরা একটি নামহীন নদীর পাড়ে সাকুরা গাছের নিচে বসে আছে। হাতে তার একটা পুরনো ডাইরি।ফুফু বাড়ি থাকা কালীন লিখতো সে।গাছের নিচে মাটিতে সে একটু পিঠ এলিয়ে শুয়ে পড়ে তখনি বাতাসের দমকে মাঝে মাঝেই সাকুরা ফুলগুলো তার উপর বৃষ্টির পানির ন্যায় এসে পড়ছে।কিভাবে কিভাবে যেনো নয়টা বছর পেরিয়ে গিয়েছে জীবন থেকে।হয়তো মেহরাব ভাই সেদিন সম্মান বাঁচাতে তোফাকে বিয়ে করেছিলো।দাদী হয়তো তার বংশ বাচাতে পেরেছিলেন। কোন অজাত কুজাত তার ঘরে বউ হয়ে আসেনি।চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে তার।আটকাতে আর মন চায় না।আঠারোর আলোরা এখন চব্বিশ বছরের নারী। ফোনে একটা ইমারজেন্সি কল আসে তার।ডাক্তারদের নিজেদের দুঃখ বলতে কিছু হয় না হাজারো ডিপ্রেশন নিয়ে ও তাদের মানুষের সেবা করতে হয়। এজন্য হয়তো এটাকে নোনেল প্রফেশন বলে।আলোরা উঠে গাড়ির কাছে যায় দ্রুত ড্রাইভ করে পৌছায় হাসপাতালে।

তাকে দেখে নার্সরা দ্রু দৌড়ে আসে।


-Kanja no yōdai wa yokunaku, hinpan ni hossa o okoshite iru.

(রোগীর অবস্থা ভালো না বার বার খিচুনি উঠছে।)


-Sugu ni sanso o tehai shite kudasai.

(অক্সিজেন এর ব্যাবস্থা করো দ্রুত)


প্রায় দুই ঘন্টা চেষ্টা করার পর রোগীর হার্ট বিট স্বাভাবিক রেসপন্স করতে শুরু করে।সকলে একটা শান্তির নিশ্বাস নেয়।আলোরা তার কেবিনে এসে বসে।নতুন রুগী উনি নাম Sora অর্থাৎ আকাশ।রোগীর স্ত্রী কে ডেকে পাঠায় আলোরা।সবটা বুঝিয়ে দিয়ার পর যখন সে চলে যেতে নিবে তখন ফিরে তাকিয়ে আলোরাকে মহিলা টি প্রশ্ন করে।


- আপনি মেহরাব ভাই এর বউ না? আমি তোফা মনে আছে আমাকে?


আলোরা থমকায় কিছুক্ষন।নির্বিকার তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে সেই আদুরে মায়াবী মুখে এখন গাড় বয়সের ছাপ,চোখের নিচে কালো দাগ মুখটা মলিন হয়ে আছে।আলোরা ভাবে পরিচয় কি দেবে? নাকি থাকবে?কি জানি ভেবে বলে


- আপনার ভুল হচ্ছে আমি ওনার বউ না বোন হই।


- আপনাদের তো বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তারপর? 


- তারপর আর বিয়ে হয় নি।


- ওহ আচ্ছা।


- আমি আপনাদের গায়ে হলুদ এর আগের রাতেই সোরার সংঙ্গে পালিয়ে জাপানে আসি।বড্ড ভালেবাসতো ছেলে টা আমায়।আপনাকে অনেক কটু কথা বলতাম আগে মাফ করে দেবেন।


- আচ্ছা দিলাম।এখন আপনি দ্রুত ওষুধ গুলো আনুন।

অনেক দিন পর কারো সাথে বাংলায় কথা বলতে পেরে 

ভালো লাগলো।


থ্রি পিচের ওড়না টা মাথায় টেনে গায়ের এপ্রোন টা ঠিক করে রাউন্ড দিতে বের হয় আলোরা।


চলবে।

0 Comments:

Post a Comment