গল্প আমার_রুদ্রাণী পর্ব ৪৩

 #আমার_রুদ্রাণী

#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা

#part: 43


🍂🍂🍂


দিয়ার কল পেতেই দ্রুত মেহেরের বাড়িতে এলো রুদ্র। বাড়িতে ঢুকতেই মেহরিশ বেগমের সাথে দেখা হলো রুদ্রর। তিনি শীতল কণ্ঠে রুদ্রকে মেহেরের ঘরে যেতে বললে রুদ্র এক মুহূর্ত দেরি না করেই মেহেরের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেলো মেহেরের একপাশে দিয়া আর অন্য পাশে মেহেরের নানি বসে আছে। রুদ্রকে দেখতেই মেহেরের নানা নানি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। দিয়া গেলো না। সে মেহেরের পাশেই বসে রইলো। রুদ্র গিয়ে মেহেরের পাশে বসলো। অতি সন্তপর্নে মেহেরের হাতটি নিজের হাতে নিলো। মেহেরের মলিন মুখখানার দিকে তাকাতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো তার "এক দিনেই নিজের কি হাল করেছে মেয়েটা!" আনমনেই বলে উঠলো সে। দিয়ার দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলো,

ওর এ অবস্থা কি করে হলো?

দিয়া মেহেরের দিকে চেয়ে শুকনো ঢোক গিললো। জিভ দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,

বাড়িতে আসার কিছুক্ষণ পরই ঘুমাবে বলে ঘরে এসেছে। কড়াভাবে বলেছে কেউ যেনো ঘুমে ডিস্টার্ব না করে। সারাদিন বাহিরে না আসায় ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে আছে। রাতের ডিনার নিজেই উঠে খেয়ে নিবে ভেবে খাবার টেবিলে সাজিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি খাবার যেমন রেখে গিয়েছিলাম তেমনই আছে। ও কাল থেকে কিছুই মুখে দেয়নি বুঝতে পেরেই দরজা ধাক্কাচ্ছিলাম। এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখলাম বারান্দায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে।

দিয়ার সব কথা মেহেরের দিকে চেয়ে থেকেই শুনলো রুদ্র। জানতে চাইলো,

ডক্টর কি বলেছে? ও আর... ও আর আমার বাচ্চা ঠিক আছে?

দিয়া উত্তপ্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,

প্রেশার লো হয়ে গিয়েছিলো, চিন্তার কোনো বিষয় নেই। কিন্তু ওদের খেয়াল কি আপনার আছে?

রুদ্র কপাল কুঁচকে তাকাতেই দিয়া আবার বললো,

বউ যে বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এসেছে তার খবর রাখেন? মেয়েটা আপনাকে কতবার কল দিয়েছে? একবারও ব্যাক করার সুযোগ পাননি?

রুদ্র জবাব দিলো না। মেহেরের হাতে নিজের ঠোট চেপে বসে রইলো। মেহের নড়েচড়ে উঠতেই রুদ্র দিয়াকে চলে যেতে বললো। মেহেরের জ্ঞান ফিরলে সে সামনে রুদ্রকে দেখেই এক লাফ দিয়ে উঠে বসে। রুদ্র মেহেরকে বাধা দিয়ে বললো শুয়ে থাকতে। মেহের শুনলো না, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো। রুদ্র নরম গলায় বললো,

ঠিক আছো? এ অবস্থা কেনো করলে নিজের?

মেহের জবাব দিল না। রুদ্র কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

শুনেছি বউ নাকি রাগ করে বাপের বাড়ি চলে এসেছে? এতো সাহস এলো কি করে?

মেহের রুদ্রর দিকে তাকালো। নির্মল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

আপনি এই বাচ্চাটা চাইছেন না রুদ্র? আপনি কি আমাকে এবর্শন করতে জোর করবেন?

রুদ্রর অবাক চাহনিকে উপেক্ষা করে মেহের আবার বললো,

আমি এই বাচ্চাটা রাখতে চাইছি রুদ্র। আপনার যদি এতে আমাকে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয় তবে...

~তবে?

রুদ্রর গম্ভীর কণ্ঠ। মেহের কম্পিত গলায় বললো,

আমি মানা করবো না। আপনি চাইলেই আমাকে ডিভোর্স দিতে পারেন। আমি সাইন করে দিবো।

রুদ্র হটাৎ ই ভয়ানক রেগে গেলো। মেহেরের গাল খুব শক্ত করে চেপে ধরলো। মেহের ভয় পেয়ে গেলো রুদ্রর এই রূপে। কিছুক্ষন আগের শান্ত রুদ্রটা মুহূর্তেই এমন ভয়ানক রূপ নিলো কেনো? সে তো খারাপ কিছুই বলেনি। মেহেরের চোখের কোনে জমে থাকা অশ্রুকেও উপেক্ষা করলো রুদ্র। কেনো এই চোখের পানি দেখে নরম হবে? এতো ভালোবাসার পরও আজ আবার এই মেয়ে বলছে ডিভোর্স এর কথা? এ যেনো তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করাতে সক্ষম হলো। রাগে রুদ্রর চোখেও পানি জমা হলো। মেহেরকে চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,

কি বললেন মেহেরীন? ডিভোর্স? হ্যা? ডিভোর্স বলেছেন আপনি? আপনার সাহস কি করে হলো এই শব্দগুলো উচ্চারণ করার? আর কি বললেন? আমি... আমি আমার বাচ্চা মেরে ফেলবো?

মেহের ভয়ে চোখ চেপে বন্ধ করে নিলো। রুদ্রকে সে ভয় পাচ্ছে। রুদ্রর এতো রাগী রূপ সে বিয়ের সময়ও দেখেনি। ভীতুস্বরে বললো,

ছাড়ুন রুদ্র! আমার ব্যাথা লাগছে। রুদ্র তৎক্ষণাৎ তার গাল ছেড়ে দিলো। নিজের মাথার চুল দু হাতে টেনে ধরলো। উন্মাদের মতো বললো,

আপনার ব্যাথা লাগছে? আর আমার?

মেহেরের ডান হাত নিজের বুকের বা পাশে চেপে ধরে বললো,

আমার যে এখানে ব্যাথা করছে? সেই ব্যাথা আপনার নজরে আসছে না?

মেহের নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও রুদ্র হাত ছাড়লো না। শক্ত করে চেপে ধরলো নিজের বুকের সাথে। চিৎকার করে বললো,

আপনি নিজেই বলেছিলেন আমার সাথে নতুন করে জীবন শুরু করবেন। এখন? এতো মাসেও আমায় চিনতে পারলেন না রুদ্রাণী? এই! এই মেয়ে! আমার প্রতি মায়া হয় না?

রুদ্রর চিৎকারে কেপে উঠলো মেহের। কান্না আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেলো। রুদ্র করুন স্বরে বললো,

আমাকে এতটাই খারাপ মানুষ মনে হয় আপনার? আমি? আমি আমার সন্তান মারতে বলবো আপনাকে? আমার সাথে কোনো প্রকার কথা না বলে আপনি বাড়ি ছেড়ে চলে এলেন? আমার কথা আপনার ভাবনায়ও এলো না? আপনাকে ছেড়ে দিবো আমি? ছেড়ে দেওয়ার জন্য বিয়ে করেছি আমি?

মেহেরের জবাব না পেয়ে যেনো আরো রেগে গেলো রুদ্র। ধমকে উঠে বললো,

জবাব দিচ্ছেন না কেনো?

মেহের হটাৎই রুদ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলো।

~সরি রুদ্র। প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দিন। আর কক্ষনো এমন করবো না।

রুদ্র মেহেরকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলে মেহের আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রুদ্রকে। রুদ্র ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে,

ছাড়ুন আমাকে! আর কখনো আপনার কাছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসবো না। চলে যাবো আমি। ছাড়ুন!

মেহের বুক থেকে মুখ তুলে রুদ্রর দিকে তাকালো। নাক টানতে টানতে বললো,

আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন আপনি?

রুদ্র মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,

যে আমাকে ছাড়া থাকতে পারে তাকে ছাড়া আমিও থাকতে পারবো। না পারলে নিজেকে মেরে...

মেহের রুদ্রর মুখ চেপে ধরলো। পুনরায় রুদ্রর বুকে মাথা গুঁজে বললো,

এসব কথা কখনোই বলবেন না রুদ্র। আমার কষ্ট হয়।

~আমার কষ্ট হয় না? আমার চোখ দেখেছেন? কাল সারারাত ঘুমাইনি। আজ বিকেলেই আপনাকে নিয়ে যেতে আসতাম। প্রয়োজন পড়লে এখানেই থেকে যেতাম তাও আপনাকে ছাড়া থাকতাম না। আর আপনি? আমাকেই ছেড়ে দেওয়ার প্ল্যান করছিলেন। আপনি ছাড়ুন আমাকে!

মেহের চেঁচিয়ে বললো,

মাফ চাইছি তো! এতো রাগ করলে দেখবেন আমাদের বাচ্চাকে পৃথিবীতে আনার সময় আপনার প্রতি রাগ করে আমি সত্যি সত্যি চলে গেছি। তখন বুঝবেন মজা।

রুদ্র মেহেরকে জড়িয়ে ধরতেই মেহের মুচকি হাসলো। রুদ্র মাথা নেড়ে বললো,

এমন কথা কখনো বলবে না বউ, কখনোই না। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমার কষ্ট হয়।

মেহের হাসলো। রুদ্রর বুক থেকে মাথা তুলে বললো,

রাগ কমেছে?

রুদ্র জবাব দিলো না। মেহেরকে জড়িয়ে ধরেই বসে রইলো বেশ অনেক সময়। রুদ্র ধীর কণ্ঠে  বললো,

আমি কখনোই আমার বউ বাচ্চাকে কষ্ট পেতে দিবো না রুদ্রাণী। আমার বাচ্চাকে আমি কি করে মারতে বলবো? এই বাচ্চা তোমার আর আমার অংশ। আমি তোমাকে নিয়ে অবশ্যই পসেসিভ কিন্তু আমি খারাপ মানুষ কিংবা খারাপ বাবা হতে চাই না যে নিজের সন্তানের অস্তিত্ব মিটিয়ে দিতে চায়। কখনোই পারবো না আমি এমন কাজ করতে।

মেহের তৃপ্তির হাসি হাসলো। অনেক সময় পর আজ যেনো তার মনে শান্তি লাগলো। মেহের রুদ্রর থেকে তার সাথে কথা না বলার, তাকে ইগনোর করার কারণ জিজ্ঞেস করতেই রুদ্র অবাক হলো। তার মতে সে মেহেরকে ইগনোর করেনি। মেহের অভিযোগের সুরে সব জানাতেই রুদ্র হু হা করে হেসে উঠলো। পরে তার চুপ থাকার কারণও সব বুঝিয়ে বললো। মেহের নিজের কাজে নিজেই অনেক লজ্জিত বোধ করলো। কোনো প্রকার পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তার অবশ্যই রুদ্রর সাথে বসে সময় নিয়ে কথা বলা উচিত ছিল। তবে হয়তো আজ এমন কিছুই হতো না।


🍂৬ মাস পর🍂


সকালে নাস্তার সময় আয়মান রুদ্রকে জানালো আজ অনেক ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে। সে আজ না গেলে কিছুতেই হবে না। রুদ্র যেনো আয়মানের কথা শুনলোই না। চুপ চাপ নিজে খাচ্ছে আর মেহেরকে খাইয়ে দিচ্ছে। মেহের চোখ পিটপিট করে সকলের দিকে তাকাচ্ছে। আয়মানের কথায় সকলে আয়মানের দিকে তাকালেও যাকে বলেছে সে ই তাকালো না। আয়মান হতাশার শ্বাস ফেলে মেহেরের দিকে তাকাতেই মেহের ঠোঁট উল্টে বুঝালো তার করার কিছুই নেই। নিজের ভাইকে সে পারলে নিজেই টেনেটুনে কাধে তুলে নিয়ে যাক। এই কয়েকমাসে রুদ্র যথাসম্ভব বাড়িতে থেকেই সকল কাজ করেছে। আয়মান অফিসে যাওয়ার কথা বললেই রুদ্র এমনভাবে বেকে মাথা নিচু করে বসে থাকে যেনো সে কিছু শুনেইনি। আগে রুদ্র আয়মানকে টেনে অফিসে নিয়ে যেতো আর এখন আয়মান রুদ্রকে ঠেলে ধাক্কিয়ে সাথে নিয়ে যায়। মেহের আড়চোখে রুদ্রর দিকে তাকাতেই রুদ্র এক গ্লাস দুধ মেহেরের সামনে ধরলো। মেহের মাথা নেড়ে বললো,

আমার পেটে বাবু আছে। এতো খাবার খেলে তো বাবুর থাকতে কষ্ট হবে। এই টুকু জায়গায় কি করে থাকবে? তাই এত খাবার খাওয়া উচিত না।

মেহেরের কথায় তীব্র ফিক করে হেসে উঠলো। স্নেহা তার ছেলে তাজওয়ারের গালে আঙুল ছুইয়ে বললো,

খাবারের সময়ই তোর যত বাহানা। তুই এই কয়েক মাসে কত বাহানা দিয়েছিস তা নিয়ে নির্দ্বিধায় দুই শত বা তিন শত পেজ এর একটা বই লিখে ফেলতে পারি।

দিয়া তাল মিলিয়ে বললো,

বইয়ের নাম হতো "খাবার না খাওয়ার হাজার ধরনের বাহানা"

মেহের রুদ্রর দিকে চোখ পিট পিট করে তাকাতেই রুদ্রর সাবধানতার সুরে বললো,

আমার মন গলানোর চেষ্টা করবে না। যবে থেকে শুনেছি তুমি প্রেগনেন্ট তবে থেকে এমনিই দিনে ১০/১২ বার আমার প্রেসার আপ ডাউন করে। বউ মনির ডেলিভারি দেখে আমার কলিজা এমনিই শুকিয়ে আছে। তুমি ঠিক মত না খেলে আমি নির্ঘাত হার্ট এ্যাটাক ফ্যাটাক করে বসবো মেহেরজান। প্লীজ নিজের একটু যত্ন নাও।

দিয়া স্বশব্দে হেসে উঠে বললো,

আমার মনে হয় মেহেরের পেইন উঠলে মেহেরের চিন্তায় ভাইয়াই আগে জ্ঞান হারাবে।

দিয়ার কথা শুনেই তীব্র ঘর কাপিয়ে হেসে উঠলো। দিয়াকে হাই ফাইভ দিয়ে হা হা করে হাসতে থাকলো। রুদ্র চোখ ছোট ছোট করে আয়মানের দিকে চেয়ে বললো,

তুই একবার বাবা হ। আমিও এমন খেপিয়ে খেপিয়ে এর শোধ তুলবো দেখিস। 

আয়মান রুদ্রর দিকে একবার চেয়ে রেদোয়ানের দিকে তাকালো। সকালের নাস্তায় এমন সভা রোজই বসে। এ আর নতুন কিছু নয়। আজ রুদ্রকে মিটিংয়ের জন্য অফিসে নিয়ে যেতে পারলেই যেনো বাঁচে আয়মান। সারাদিন অফিসের পেছনে ছুটতে থাকা মানুষটিকে আজকাল ঘর থেকে বের করাও বেশ দুষ্কর কাজ। কি অদ্ভুত!

~~~

চলবে~

(কেমন আছেন সবাই? অবশ্যই গঠনমূলক কমেন্টস করবেন। আপনাদের সুন্দর কমেন্টস আমাকে গল্প লিখতে উৎসাহ দেয়। হ্যাপি রিডিং~)

0 Comments:

Post a Comment