গল্প আমার_রুদ্রাণী পর্ব ৩৭

 #আমার_রুদ্রাণী

#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা

#part: 37


🍂🍂🍂


রাত প্রায় বারোটা বাজে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। মেহের সোফায় বসে রুদ্রর ঘরে ফেরার অপেক্ষা করছে। বিয়ের দিন স্নেহার বলা কথাগুলো যথাযথ মানতে চেষ্টা করছে সে। রুদ্রর প্রতি দূর্বল সে তবে রুদ্রর মাফিয়াগিরির জন্য তার কাছে যেতে ভয় পায় মেহের। আয়মান এর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর পরই জানতে পেরেছে শরীফ মির্জাকে তার প্রাপ্য শাস্তি দিয়েছে রুদ্র। যেনো তেনো শাস্তি নয় বরং বেশ নির্মম আর ভয়ংকর শাস্তি। কাব্যর কাছ থেকে শরীফ মির্জাকে মার দেওয়ার বর্ণনা শুনে গা গুলিয়ে এসেছিল মেহেরের। এমন শাস্তি পেলে হয়তো মানুষ নিজের মৃত্যুকেই সব থেকে বেশি শান্তির মনে করে। কিন্তু রুদ্র তাকে মৃত্যু দেয়নি। বেচেঁ থাকার চেয়ে হয়তো তার কাছে মৃত্যুই বেস্ট উপায় ছিলো কিন্তু রুদ্র তাকে সেই উপায় দিলো না। সুস্থ হলে সে পাগল রূপে সারাজীবন হাসপাতালে পড়ে থাকবে এমন শাস্তিই সে ঠিক করেছে শরীফ মির্জার জন্য। মেহেরের ইচ্ছা করছিল কাব্যকে আধঘন্টা উত্তম মাধ্যম দিতে। মানুষ কিভাবে মারা গেছে, কতটা জখম পেয়েছে সব তার জানা লাগবে। জানবে তো জানবে আবার এসে ওদের সবাইকে জানাবেও। অদ্ভুত এক চরিত্র এই ছেলে। রুদ্রকে নিজের আদর্শ বলে সারাদিন লাফায়। ভবিষ্যতে নাকি সেও রুদ্রর মতো মাফিয়া হতে চায়। এ জন্য মেহের আর স্নেহার কাছে কম ধমক খায়নি সে। আজ রুদ্রর সাথে কথা বলে সে তাদের সম্পর্কের একটা পরিণতি ঠিক করে তবেই দম নিবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে মেহের। দিয়ার ধমক খেয়ে কেউ আর ওদের বাসরে ডিস্টার্ব করেনি। মেহের নিজের ঘরে চলে এলেও রুদ্র এখনও আসেনি। সে এলেই আজ কথা বলবে তার সাথে মেহের। রুদ্র ঘরে ঢুকতেই নড়েচড়ে বসলো মেহের। কণ্ঠস্বরে বেশ গম্ভীরতা এনে বললো,

বিছানায় কাপড় রাখা আছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমার কিছু কথা আছে আপনার সাথে।

রুদ্রও ভদ্র ছেলের মত দ্রুত ফ্রেশ হয়ে এলো। মেহের চোখের ইশারায় রুদ্রকে তার পাশে বসতে বললো। রুদ্রও তাই করলো। মেহের লম্বা এক শ্বাস নিয়ে বললো,

আজ আপনার কাছে কিছু চাইলে দিবেন রুদ্র? মানা করবেন না প্লীজ।

রুদ্র মেহেরের দিকে তাকালো। বিয়ের এত মাসের মধ্যে মেহের কখনোই কিছু আবদার করেনি রুদ্রর কাছে। এই প্রথম তার রুদ্রাণীর মুখে সে নিজের নাম শুনলো। সে যথাসম্ভব তার বউয়ের আবদার পূরণ করার চেষ্টা করবে। তবে কি চাইবে মেহের? যদি ডিভোর্স চেয়ে বসে? ভাবতেই বুকটা কেপে উঠলো রুদ্রর। মেহেরের এমন আবদার সে কখনোই পূরণ করতে পারবে না, কখনোই না। দরকার পড়লে সে হাত পা বেঁধে মেহেরকে নিজের সাথে রেখে দিবে তাও সে ছাড়তে পারবে না। রুদ্র ঢোক গিলে তটস্থ কণ্ঠে বললো,

কি? কি চাও তুমি? আমি আগেই বলে দিচ্ছি রুদ্রাণী, তোমাকে ছাড়া আমার পক্ষে অসম্ভব। ডিভোর্স বাদে যা ইচ্ছা চাও তাতে সমস্যা নেই। আমি প্রাণ দিয়ে হলেও তা পূরণ করার চেষ্টা করবো তবে তোমাকে ছাড়তে পারবো না। মোটেও না, ভুলেও না।

মেহের ফিক করে হেসে দিলো রুদ্রর কথায়। ডিভোর্সের কথা তো সে স্বপ্নেও ভাবেনি কখনো আর রুদ্র এসব ভেবে ভয় পেয়ে আছে। ব্যাপারটা আসলেই বেশ হাস্যকর। রুদ্র নিষ্পলকভাবে চেয়ে রইলো মেহেরের হাসি মাখা মুখটির পানে। প্রেয়সীর হাসি রাঙা মুখ দেখার মত সুযোগ কোনো প্রেমিক পুরুষই মিস করতে চাইবে বলে তার মনে হয় না। এমন সুযোগ মিস করলে তার নিজেকে প্রেমিক পুরুষ দাবি করা উচিত না। মেহের হাসি থামিয়ে বললো,

আমি ডিভোর্স চাইছি না রুদ্র। আপনি আগে বলুন আমার কথা রাখবেন কি না।

রুদ্র নির্মল কণ্ঠে বললো,

বলো। রাখার চেষ্টা করবো।

মেহের মুচকি হেসে রুদ্রর ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে কাধে মাথা রাখলো। রুদ্রর অবাক চাহনী উপেক্ষা করে বললো,

আমি চাইছি আমাদের সম্পর্ককে একটা সুযোগ দিতে। কিন্তু...

রুদ্র দেরি না করে বললো,

কিন্তু কি? জলদি বলো মেহেরজান।

মেহের রুদ্রর কাধ থেকে মাথা তুলে তাকালো। রুদ্রর হাতটা নিজের গালে ছুইয়ে বললো,

আপনার এই মাফিয়া জগৎটা আমাকে আপনার কাছে আসতে দেয় না রুদ্র। যাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এ পথে এসেছিলেন তাকে তো শাস্তি দেওয়া শেষই। আপনি প্লীজ এসব ছেড়ে দিন। এসবে লাইফের খুব রিস্ক থাকে রুদ্র। আমি খুব সাধারণ একটা জীবন চাই রুদ্র। এসব খুন খারাবি আমার ভালো লাগে না।

রুদ্র এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার প্রেয়সীর পানে। প্রেয়সীর এই নিঃসংকোচ আবদার যেনো তার মনে আজ খুশির স্রোত নিয়ে এসেছে। ঠিক এ কারণেই তো সে তার রুদ্রাণীকে এতো ভালোবাসে। খারাপ কাজ মেহেরের অপছন্দ। সে যেভাবেই হোক বুঝিয়ে ঠিক পথে তাকে ফিরিয়ে আনবে তা বেশ জানতো রুদ্র। রুদ্র প্রশান্তির হাসি হেসে বললো,

আজ থেকে ছেড়ে দিচ্ছি। আমি সত্যিই ওই জগৎ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবো। তুমি শুধু আমার সাথে থেকো।

মেহের মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। তার ঠোঁটের কোনেও দেখা মিললো হাসির রেখার।

____________________________________


ইদানিং বাড়ির মানুষের কাজে, আচরণে বেশ অবাক হচ্ছে আহিল। বাবা মা এক সাথে খাওয়া দাওয়া করে, বেশ হেসে কথা বলে, আহিলের সাথেও যথেষ্ট সময় কাটায়। এমন পরিবর্তনের কারণ তার বুঝে আসছে না। কি এমন হলো যে আহিলের মা বাবার এত পরিবর্তন হলো? ভেবেছিলো আজ আহমেদ ভিলাতেই থাকবে। কিন্তু তার বাবা মা ফোন করে বাড়ি ফেরার জন্য পাগল প্রায় করে তুলছিল। বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখলো তার মা বাবা সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। আহিল ভেবেই নিয়েছে যে আজ জেনেই ছাড়বে তাদের এই পরিবর্তনের কারণ। আহিলকে দেখতেই আহীলের বাবা বললো,

আহি এসে গেছে। আয় বস।

আহিল তাদের ঠিক সামনের সোফায় গিয়ে বসলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,

হটাৎ এই পরিবর্তনের কারণ কি? কখনো তো এক সাথে ঘরে দাড়াতেও দেখলাম না আপনাদের। আর ইদানিং এক সাথেই খাওয়া, ঘুরা, ইভেন আজ আড্ডাও দিচ্ছেন।

আহিলের বাবা মলিন হাসলেন। স্বামী স্ত্রীর দ্বন্দ্বে যেনো তার ছেলের দিকে তাকাতেই ভুলে গিয়েছিল তারা। মেহের, দিয়া, স্নেহা আর কাব্য তাদের না বুঝালে হয়তো কখনোই তাদের এই ভুল শুধরানো হতো না। আহিলের মা আহিলের হাত ধরে কেঁদে উঠলো,

মাফ করে দে বাবা। আমরা ভালো বাবা মা হতে পারিনি। আমাদের নিজ দ্বন্দ্বে আমরা যেনো ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমরা এখন শুধু স্বামী স্ত্রীই নয়, মা বাবাও। আমাদের উপর রাগ করে থাকিস না বাবা। আমরা আর ঝগড়া করবো না। একদম স্বাভাবিক একটা পরিবার হবে আমাদের।

আহিল অবাকের পাশাপাশি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

প্লীজ কান্না করবেন না। আমি... আমি আপনাদের এমন ঝগড়া দেখে কষ্ট পেয়েছি ঠিকই তবে আপনাদের চোখে কখনো অশ্রু দেখতে চাইনি। প্লীজ কান্না থামান। 

তার মা কান্না থামালো না বরং কান্নার পরিমাণ আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। এক পর্যায়ে আহিল জানতে পারলো এসব তার বন্ধুদের জন্যই সম্ভব হয়েছে। কাব্য নাকি তাকে খুঁজতে ওদের বাসায় এসেছিল। আহিল না থাকায় সেদিন আব্দুল্লাহর কাছে থেকে আহিলের ব্যাপারে জেনেছিল সব। আহিল বাবা মাকে শান্ত করে তাদের রুমে পাঠিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। লম্বা এক শ্বাস নিলো। আজ মনে হচ্ছে এটা তার শান্তির নীড়। আজও আহিলের চোখের কোণে জলের আভাস পেলো তবে তা দুঃখের নয় বরং খুশির। পকেট থেকে ফোন বের করেই কাব্যর নাম্বারে কল লাগালো সে।

~কোন শালায় রে? আমার এত সাধের ঘুমটা নষ্ট করতে কল দিছে।

~শালা বলদ! নম্বর দেখে কল রিসিভ করস না?

আহিলের ধমকে হুড়মুড় করে উঠে বসলো কাব্য। কান থেকে ফোন সরিয়ে দেখলো এটা আহিলের নম্বর। চেঁচিয়ে বললো,

আমার কোনো বইন নাই। তুই আমারে শালা কস কেন? আর এত রাইতে কল দিলি কেন!

আহিল হেসে বললো,

তুই নিজে আমাকে আগে শালা বলেছিস। যাই হোক বাসার নিচে নাম। আমি দাড়িয়ে আছি।

~তুই আমার বাড়ির নিচে কি করস? আমি তো আহমেদ ভিলায়।

~লাথি মেরে ছাদ থেকে ফেলে দিবো একদম। আমি চলে এসেছি বলে তুইও চলে এসেছিস। আমি জানি না মনে করিস!

কাব্য হাসলো। "আসছি" বলেই দ্রুত নিচে চলে এলো। কাব্যকে দেখতেই আহিল দ্রুত গিয়ে কাব্যকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। হটাৎ এভাবে জড়িয়ে ধরায় দু কদম পিছিয়ে গেলো কাব্য। আহিলের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

এই কাদিস কেন? ও মাই আল্লাহ! আহিল! তুই প্রেম করিস? ব্রেক আপ হইছে? একদম ঠিক আছে। আমাদের বলিস নাই তো তাই উচিত বিচার হইছে।

আহিল ওকে ছেড়ে দিয়ে বললো,

বেক্কল! সব সময় উল্টা পাল্টা কথা! দেখছস কোনো মেয়ের পিছে ঘুরতে কখনো?

~তাইলে কান্দস কেন?

~আমার মা বাবাকে বুঝিয়ে আমাকে একটা স্বাভাবিক পরিবার এনে দেওয়ার জন্য থ্যাংকস ভাই। তোরা না বুঝালে হয়তো কখনোই এমন দিন দেখতে পেতাম না আমি।

বলেই আবার ডুকরে কেঁদে উঠলো আহিল। কাব্য আহিলের মাথায় এক থাপ্পর দিয়ে বললো,

তোর মত গরু আর একটা দেখি নাই আমি। বন্ধুরা হয়ই এই জন্য যেনো তাদের সাথে মনের সব দুঃখ কষ্ট শেয়ার করতে পারি আমরা। তাই যদি না করি তবে বন্ধু হলাম কেমনে? তুই কি আদৌ আমাদের ওপর বিশ্বাস আনতে পারিসনি আহি?

আহিল আবারো কাব্যকে জড়িয়ে ধরে বললো,

মাফ করে দে ভাই। আর কখনো কোনো কথা লুকাবো না। সব বলবো তোদের।

কাব্য হেসে বললো,

বুঝলাম। কিন্তু দোস্ত! ছাড় আমারে। পাশের বাড়ির দারোয়ান যেমনে তাকাইয়া আছে! নির্ঘাত গে ভাববো আমাদের। তুই সন্ন্যাসী হইয়া ঘুর সমস্যা নাই। আমার তো বিয়ার কইরা বাচ্চা কাচ্চার মুখ দেখার সখ আহ্লাদ আছে। গে মনে করলে আর কেউ মাইয়া দিবো না ভাই। ছাড় আমারে!

আহিল কাব্যকে ছেড়ে দিয়ে দারোয়ানের দিকে তাকালো। লোকটা আসলেই আড়চোখে ওদের দিকে চেয়ে আছে। কাব্য দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে দারোয়ানের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

এমনে তাকাইয়া আছো কেলা? আহো তোমারেও একটু জড়াইয়া ধইরা কষ্ট প্রকাশ করি। আহো, আহো!

কাব্যর কথা শুনে লোকটা দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। দারোয়ানের দৌড় দেখে আহিল আর কাব্য হু হা করে হেসে উঠলো।

~~~

চলবে~

(আজকের পর্ব কেমন লেগেছে অবশ্যই বলবেন। গল্পটা খুব শীঘ্রই শেষ করে দিবো ভাবছি। হ্যাপি এন্ডিং দিবো নাকি স্যাড এন্ডিং তা নিয়ে আম কনফিউজড। আপনারা সাজেস্ট করেন দেখি। হ্যাপি রিডিং~)

0 Comments:

Post a Comment