গল্প:বাধন হারা বেনী
লেখীকা:সানজিদা আহমেদ শাহারা
পর্ব:২৩
ভোর চারটে জাপান সূর্যদ্বয়ের দেশ হওয়ায় সূর্য উদিত হওয়ার এই দৃশ্য প্রায়শই উপভোগ করা যায়।শেষ রাতে মেহরাব একটু ঘুমিয়েছে আলোরার আর ঘুম হয়নি।হাসপাতাল থেকে ইমারজেন্সি ফোন করেছিলো তাদের হেড ডক্টার জাফর আহমেদ।ঘটনার কিছু কিছু সে জেনেছে আর কিছু কিছু সে আন্দাজ করে নিয়েছে তবু ও সরজমিনে না দেখলে ঠিক বিশ্বাস যোগ্য নয় ব্যাপার টা।ভোরের আভা ফুটতে না ফুটতেই আলোরা ছুটলো হাসপাতাল এর উদ্দ্যেশে সাথী হয়েছে তার সোহরাব ও সোমেহরা।মেহরাব তার কলেজ এর স্টুডেন্টদের নিয়ে বের হয়েছে কাজে।সেখান থেকে সরাসরি রাতে এসে তাদের সাথে জয়েন করবে।অনিমা ও তনিমা হোটেলেই ছিলো আজকাল তনিমা একটু বেশিই ফোন ব্যাবহার করে যা অনিমার একদম পছন্দ না কাজ ছাড়া সারাদিন কেনো সে ফোন চালাবে?অনিমা সকালের নাস্তা অর্ডার দিয়ে গোসলে যায় দুপুরের পর তাদের ও বের হতে হবে আলোরার হাসপাতাল এর উদ্দ্যেশে। অনিমা ফিরে এসে দেখে তনিমা ফোন টি-টেবিলের পাশে রেখেই নিচে গিয়েছে খাবার আনতে।এই সুযোগে অনিমা তনিমার ফোন চেক করে তাস্কি খেয়ে আবার ও ফোন জায়গা মতো রেখে নিজের কাজে মন দেয়। তনিমা খাবার নিয়ে এলে দুজনে খাবার খায় এরপর তৈরি হতে যায়।অনিমা তনিমাকে দেখে মিচকি মুচকি হাসছে এই ব্যাপার টা তনিমা বেশ কিছুক্ষন পর লক্ষ্য করে। সে আড় চোখে অনিমার ব্যাপার স্যাপার লক্ষ্য করে এরপর সোজা সাপটা তাকে প্রশ্ন করে কিন্তু অনিমা ও সুকৌশলে ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়।
অন্যদিকে তাহিয়ানা মেহরাব সহ আরো ছেলে-মেয়েরা এসেছে একটি পুরাতন কবর স্থানের সম্পর্কে আলোচনা করতে এবং সেই কবর স্থান এর সঠিক বয়স সহ নানান বিষয় খুজে বের করতে।প্রত্নতত্ত্ব এমনি একটা বিষয় যা আমাদের অতীতকে আমার ভবিষ্যৎ এর সামনে বহমান নদীর মতোই তুলে ধরে।তাহিয়ানা বারবার মেহরাব এর আশে পাশে ঘুরছে দেখে মেহরাব তাকে এড়িয়ে চলছে প্রতিবার কিন্তু লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না।সেই আবার তার আশে পাশে ঘুরছে।মেহরাব বিরক্ত হয়ে কবরস্থানের পিছনের দিকে হাটা দেয়।সেখানটা ভীষন নিরিবিলি এতটাই নিরিবিলি যে মেহরাব তার নিশ্বাসের আওয়াজ এই চকচকে দিনের আলোতে ও শুনতে পাচ্ছে।মেহরাব একটু শান্ত হয় কেনো যেনো সে তাহিয়ানাকে একটু ও সহ্য করতে পারে না বড্ড বিরক্তিকর একটা মেয়ে।
-আপনি আমার থেকে পালাচ্ছেন কেনো।
-আমার বউ আছে।
-কে আপনার বউ।
- আমার বউই আমার বউ।
- আমি হলপ করে বলতে পারি সে আপনার বউ নয়।
- আমি আপনাকে ভালোবাসি।
- আমি তোমাকে আগেই বলেছি আমি আমার বউ আছে।
- আমি যা চাই তা আমি পেয়েই ছাড়ি।
- আমাকে পেতে মরিয়া হইয়ো না আমি আমার নারীতেই আসক্ত।
- আর আমি আপনাতে আসক্ত।
ঠাস ঠাস করে কয়েকটা থাপ্পড় পড়ে তাহিয়ানার গালে।থাপ্পড় খেয়ে তাহিয়ানা ছল ছল চোখে তাকায় মেহরাব এর দিকে।
ক্রোধে মেহরাব চোখ-মুখ লাল হয়ে গিয়েছে সে তাহিয়ানাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে
-ভদ্র ঘরের মেয়ে ভদ্র হয়েই থাকো।অসভ্যতা করবে না।
তাহিয়ানা গালে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল
- আপনি আজকের জন্য ভীষন অনুতপ্ত হবেন।
তাহিয়ানা চলে যেতেই মেহরাব একটা বড়ো পাথরের আড়ালে যেয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বাকা হাসে।নিচে আর একটি মেহরাব এর দেহ পড়ে আছে।দাড়িয়ে থাকা মেহরাব মাটিতে পড়ে থাকা মেহরাবকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল
- তোমার জীবন ধংসের সব প্রচেষ্টায় আমি প্রায় কামিয়াব।তুমি তো জানোই না আমি কে আর কেনো তোমার এই অবস্থা।
মাটিতে পড়ে থাকা মেহরাবকে জোরে হাওয়ায় উঠিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়।এরপর সে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
অন্যদিকে হাসপাতালে কাফির অবস্থা ধীরে ধীরে আরো খারাপ হতে থাকে। প্রথমে কাফিকে দেখে আলোরা ভয় পেয়ে যায়।রাতের পরিপাটি ছেলেটা কিভাবে কয়েক ঘন্টায় জীবন্ত কঙ্কালে পরিনত হয়েছে। চোখের নিচে হাড়ির কালি হয়ে আছে।সারা শরির শুকিয়ে যা তা অবস্থা।আলোরা এই প্রথমবার কাফির হাত ধরল।হালকা স্বরে বলল
- তোমার ভীতর যে হায়না বাসা বেধেছে তার সাথে তোমাকেই লড়তে হবে।আমি হয়তো তোমাকে প্রিয় মানুষ হিসাবে ভালোবাসি না।কিন্তু আমার চরম দুরবস্থায় আমার সব থেকে আপন বন্ধু তুমি।তোমাকে ছাড়া আমি জাপানে হয়তো এতগুলো বছর থাকতে পারতাম না।আর আমি জানি কাফি তুমি নিশ্চই তোমার ভীতরে গেড়ে বসা জীন টাকে তাড়িয়ে জয়ী হবে।আমার প্রিয় বন্ধু নিশ্চই আমার কাছে আবার ও ফিরে আসবে।
কোমায় চলে যাওয়া কাফির চোখ বেয়ে পানি আসতে দেখে আলোরা সস্তি পায় সে সফল হয়েছে কাফি তাকে শুনতে পেয়েছে।
এরপর সে বের হয়ে ফজলে হাসান আবেদ এর কেবিনে যায় তিনি কথা বলতে পারছেন না স্ট্রোক করেছেন সাথে হার্ট অ্যাটাক।পিতা সমতুল্য একজন মানুষ আলোরার মাথায় যার স্নেহের হাত শুরু থেকেই ছিলো হঠাৎ এভাবে নিথর হয়ে যাওয়াতে আলোরা কেমন নিঃস্ব অনুভব করছে নিজেকে।কিন্তু সে জানে ভেঙে পড়লে চলবে না এটা তার একার লড়াই।সোহরাব,সোমেহরা,অনিমা,তনিমা সকলে কেবলি তার সহযোদ্ধা।
কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে করিডরের পাতানো চেয়ার গুলোর একটায় বসে সে।পাশে এসে বসে মেহরাব আলোরা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয় তার বুকে কান্নায় ভেঙে পড়ে।মেহরাব তাকে বলে
- চলো ফিরে যায়।
আলোরা হঠাৎ মেহরাব এর বুক থেকে মাথা তুলে বলে আপনি কে? আপনি তো মেহরাব ভাই না।কে আপনি?
আলোরাকে অবাক করল দিয়ে সে বলল
- চলো আমরা কিছু একান্তে সময় কাটায়।
আলোরা বিষ্ময়ে তাকিয়ে রইলো মেহরাব এর দিকে একেবারে নিখুদ চেহারা কিন্তু মানুষটার স্পর্ষ আলাদা কেনো? যে স্পর্শে শান্তি লুকানো থাকতো সে স্পর্শে কেমন একটা লালসার ছাপ স্পষ্ঠ। আলোরা ভীত হয়ে পড়ে।এমন সময় দুজন মিস্ত্রি যারা হাসপাতালের পনেরো তলার কিছু কাজ করছিলো তারা একটি আয়না নিয়ে এক লিফ্ট থেকে অন্য পাশের লিফ্টের দিকে যাচ্ছিলো সে আয়নার প্রতিবিম্বে মেহরাব এর প্রতিচ্ছবির জায়গায় একটি জ্বলেপুড়ে যাওয়া মানুষের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। তাতে আলোরা যা বুজার বুঝে যায়।এতে করে আলোরা আরো অসহায় মনে করতে থাকে নিজেকে।কিন্তু তবু ও সে নিজেকে শক্ত করে মেহরাব এর সাথে তালে তাল দিতে থাকে।যাতে মেহরাব রুপী এই জিন কিছু বুঝতে না পারে।
চলবে....
0 Comments:
Post a Comment