গল্প: বাধন হারা বেনী পর্ব ৫

 গল্প: বাধন হারা বেনী

লেখিকা: সানজিদা আহমেদ শাহারা

পর্ব:৫


প্রকান্ড এক লোহার গেট এর সামনে এসে দাড়ালো তাদের গাড়িটি।গাড়ি থেকে একে একে নেমে এলো আলোরা,সোমেহরা,সোহরাব,তনিমা অনিমা।গাট এর সামনে দাড়িয়ে তারা দেখলো বিশাল দোতলা বিশিষ্ট এক জমিদার বাড়ি।


জমিদার রাজেন্দ্র তরোবারি এই জমিদার বাড়িতে রাজত্ব করতেন তার ছয় পুরুষের কোন কন্যা সন্তান ছিলো না।তার ভীষন ইচ্ছা ছিলো অযোগ্য পুত্র সন্তান থাকার থেকে যোগ্য একটি কন্যা সন্তান তার গৃহে আসুক।সেই মোতাবেক বহু দান ধ্যান যোগ্য তিনি করেন।এরপর একে একে তার তিন টি স্ত্রীর কোল আলো করে চারটি জমিদারকন্যা আসেন।তার খুশির ছটা ছড়িয়ে পরে পুরো হেমল পুরে।তবে সেই খুশিতে ভাটা টানে এক তান্ত্রিক সে একদিন এক বট গাছের নিচে বসে সাধনা করছিলো তখন দুর থেকে জমিদার কন্যা দের হাসির আওয়াজ এ তার সাধনায় ভঙ্গ হয় তখন সে জমিদার কন্যাদের অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং শশানে বলি দিয়ে সিদ্ধি অর্জন করেন।এই খবর রাজার কানে এসে সে শোকে কাতর হয়ে শয্যা নেয় এবং কিছু দিনের ব্যাবধানে মারা যান।মরার আগে তিনি কামরুপ কামাক্ষা থেকে এক সাধু তান্ত্রিক কে এনে সেই শয়তান তান্ত্রীকের সিদ্ধি নষ্ট করে তাকে জীবিত কোন এক জমিদার বাড়ির কক্ষে পুতে রাখেন। এভাবেই হেমল পুরে রাজেন্দ্র তরোবারির জমিদারিত্বের অবসান ঘটে।


কথা গুলো এক টানা বলে থামে সোমেহরা। সকলে অবাক হয়ে দেখতে থাকে জমিদার বাড়িটা।আলোরা এগিয়ে বাড়ির গেট টা ধরে।পুরাতন জংঘরা গেট টা ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ তুলে খুলে যায়।সকলে বাড়িটার দিকে এগিয়ে যেতে যাকে।বাড়িটা ভীষন সুন্দর ছিলো তা এখনো দেখলে বোঝা যায়।


গেট পেরিয়ে ডুকতেই একটা ছোটা খাটো লম্বা ঘর হয়তো এটা সেই সময়কার বিশ্রামাগার।সাথে প্রহরীদের পাহারা দেওয়ার যায়গা।আশে পাশে ভাঙা প্রাচীরের ইট পড়ে  আছে।আরো কিছু দুর এগিয়ে গেলে একটা লম্বা পানিবিহীন সরোবর,তার পাশে বেশ কিছু ভাসকার্য দাড়িয়ে রয়েছে তা ও ভাঙা প্রায়।সরোবরের থেকে দুই মিনিট হাটলেই বাহির মহল।তা পেরিয়ে আরো কিছুদুর এগোলে অন্দরমহল এর দেখা পাওয়া যায়।তনিমার মন টা খারাপ হয়ে গেলো।এতো সুন্দর বাড়িটা কালের বিবর্তনে নিঃশ্ব প্রায় এক সময় এখানে কত কলোরব ছিলো।বাধা নিষেদ ছিলো।কায়দা কানুন ছিলো।আহা'রে এখন সময়ের টানে তা হারিয়ে গিয়েছে।অনিমা হেটে এগিয়ে এসে মাকোড়সার জাল সরিয়ে বড়ো দরজাটা খুলতেই এক ঝাক বাদুর লাল লাল চোখ পাকিয়ে উড়ে গেলো।সকলের হাতের ফোনের ফ্লাস লাইট জ্বালানো। নিচ তলায় কোন রুম নেই তা বিশাল বড় একটা ফাকা জায়গা কয়েক টা রুম  আছে শেষ এর দিকে কিন্তু তা ব্যবহার উপযোগী না হওয়ায় তারা দোতলায় যায়। সেখানে পুরনো খাট সহ কিছু আসবাব পত্র  রয়েছে।হয়তো কোন কালে যদি কেউ এখানে ঘুরতে আসে তবে থাকবে সে জন্য এই ব্যবস্থা কিন্তু জঙ্গল দেখে কেউ হয়তো থাকতেই চায়নি।

সকলে ফ্রেস হয়ে নেয়।নিজেদের সাথে আনা পানি দিয়ে।একটা ছোট্ট কোয়ার ব্যবস্থা আছে তবে এই রাতে আর বাইরে বের হওয়ার ইচ্ছা কারো নেই।

সকলে মোটা মুটি ফ্রেস হয়ে টুকি টাকি কথা বলেই ঘুম দিয়েছে।

তবে নতুন জায়গায় ঘুম হয় না আলোরার। সে এপাশ ওপাশ করতে করতে একটা কাতর আওয়াজ শুনে সচেতন হয়ে যায়।উঠে বসে ভালো করে শোনার চেষ্টা করে কিন্তু সে আওয়াজের উৎস কোথায় তা বুঝতে পারে না।

...................................................................................


-কি রে কি ব্যাপার তোর? আজকাল সামনে আসিস না কেনো আমার?


হঠাৎ মেহরাব এর গলার আওয়াজ শুনে ভড়কে যায় আলোরা।লজ্জায় আড়ষ্ঠ হয়ে ওঠে তার তনুমন।মস্তিষ্ক বলছে চলে যেতে আর মন টা চায়ছে কিছু টা সময় থাকতে।মন মস্তিষ্কের যুদ্ধে দেহখানা মনকেই জিতিয়ে দিলো।একরাশ জড়াতা নিয়ে সে উত্তর দিলো

 

- কোন ব্যাপার ই না এমনিতেই কাজ এর চাপ তাই হয়তো ওভাবে দেখা হয়নি।

মেহরাব এসে তার ঠিক বিপরিত পাশে বসলো।পিঠ তার মুখটা করেছে আড়াল যেনো একে অন্যকে না দেখের পায়তাড়া দুজনেরই।


- আচ্ছা?


- হ্যা


- তাহলে কি বোঝাতে চাইছিস তুই টিম এর সব কাজ নিজে করছিস আমরা নদীর পানিতে ভেসে এসেছি?


- না আপনি সব সময় এক গ্রেড বেশি বোঝেন আমি মোটেই তেমন কিছু বলিনি আপনাকে।


- তাহলে সত্যি বল সামনে আসতেছিস না কেনো?


- আরে বললাম তো কাজে ছিলাম তাই হয় তো সামনা-সামনি হওয়া হয়নি।


- আচ্ছা? আমার চোখে কি তবে নেবা হয়েছিলো?


- আপনি এমন খুতখুতে কেনো?


- তুই এতো সরল-সহজ মার্কা জটিল কেনো?


- জানি না।


- এটা একটা ভালো উত্তর দায় সারার জন্য খুব ভালো পন্থা।


- হয়তো।


-আলু


- জ্বি


- একটা কথা বলি


- বলেন।


- তুই এখনি এখান থেকে চলে যা।


- কেন?


- আমি বললাম তাই।


- আজকে আমি যাবো না,এই ঝিরি ঝিরি বাতাস আমার ভালো লাগছে।


- আমার ও ভালো লাগছে এজন্য চলে যেতে বলছি,যাহ্।


-আপনি সব সময় আমার সাথে এমন করেন।


-আর তুই কি করিস?


-কিছুই না।


কিছু সময় দুজনেই চুপচাপ বসে থাকে।এরপর আলোরা উঠে চলে যায়।নিচে সোমেহরা খাবারের ব্যবস্থা করছে।আজ দুই দিন হলো তারা এখানে এসেছে।কিন্তু জুত সই করে কাজ এগোতে পারেনি।কেউ তেমন সেই ব্যাপারে কথা বলতে আগ্রহী না।তবে এভাবে থেমে থেমে কাজ করলে তো তাদের হবে না।এজন্য ইন্টারনেট এ সার্চ করেছিলো আসলেই এই ধরনের ব্যাপার গুলো ঘটে কিনা? যদি ঘটে তবে কোন কোন জায়গায় ঘটেছে এবং কিভাবে? কয়েকটা ঘটনা জানা গিয়েছে তা ভীষণ আলাদা ধরনের।সোমেহরা আর অনিমা খাবার গুছিয়ে ওদের ডাক দেয়।সকলে এসে খেতে বসে কিন্তু মেহরাব আসেনি।সে পরে আসবে।খেতে বসে তনিমা তোলে দুদিন আগের সেই যাত্রা পথের কাহীনি।


সেদিন গাড়িটা হঠাৎ এসে থামে জঙ্গলের মাঝখানে। গাড়ি এমন অস্বাভাবিক ভাবে থেমে যাওয়াতে সকলে বিরক্ত।সোহরাব বের হয়ে গাড়ির ইন্জিন ঠিক করার চেষ্টা করে প্রচুর গরম হয়ে গিয়েছে পানি ডালতে হবে।সে এগিয়ে যায় একটা বোতল হাতে এদিক ওদিক যদি অল্প সল্প পানি পাওয়া যায়।তার আশা অনুরুপ ভাবে একটা মাঝারি আকৃতির কোয়ার দেখা পায় সে।সেখান থেকে পানি তুলে নিয়ে আশার পথে সে দেখতে পায় বেশ দুরে কিছু একটা নড়ছে।প্রথমে জন্তু জানোয়ার মনে করে নজর আন্দাজ করতে চায়লে একটা চিকন চিন চিনে কন্ঠ এসে সোহরাবের কানে লাগে। 


সে বলে " ফিরে যাও সাহেব,ফিরে যাও।" 


সোহরূব মৃদু হাসে এরপর গাড়ির কাছে এগিয়ে যায়।গিয়ে দেখে তারা গাড়িতে বেশ ভয় পেয়ে আছে।সোহরাব কে দেখে সস্তি পায়।সোহরাব তাদের বলে কি হয়েছে এমন ভয় পেয়ে আছে কেনো তারা।তনিমা বলে সোহরাব জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষন পর থেকে তার করুন আর্তনাদ এর আওয়াজ ভেসে আসছিলো।সে তো চেয়েছিলো এগিয়ে যেতে কিন্তু সোমেহরা তাকে আটকে দেয়।সোহরাব তাকে আসস্থ করে যে সে ঠিক আছে।তারপর গাড়ি আবার ও চলতে শুরু করলো।


খাওয়া শেষ করে সকলে নিজেদের বরাদ্ধ করা জায়গাতে গিয়ে শুয়ে পড়ে।রাত বেশ গাঢ় ঘুমে আড়ষ্ট প্রায় সবাই।এমন সময় বাইরে থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এলো।গত দুদিন ও এমন আওয়াজ এসেছে আলোরা আজ সেই আওয়াজ এর পিছু নেয় ছুটে যায় উপরের ঘর গুলোর দিকে।আওয়াজের দিকে যত এগোচ্ছে আওয়াজ টা তত গাঢ় হচ্ছে।গত দুই দিনে অনেক গল্প কথা তারা শুনেছে এই বাড়ি নিয়ে।একের পর এক ঘর ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে আলোরা।ছুটে চলার ফলে তার উড়না পড়ে যায় মাথা থেকে।শেষমেশ কাঙ্ক্ষিত ঘরটির সামনে হাজির হয় আলোরা। দরজাটা বন্ধ যেনো কত বছর কেউ আসে না।আওয়াজ টা কান্নার যেনো তার প্রচন্ড যন্ত্রনা হচ্ছে।এত বড় তালা খোলার চাবিটা সে খুজতে থাকে।চাবি না পেয়ে একরাশ হতাশায় ঢুবে যায় সে। দরজার কাছে বসে পড়ে সে তীরে এসে বোধ হয় তরী ডুবলো।তখন তার সামনে চাবি ধরে মেহরাব।চোখের সামনে চাবি টা দেখে খুশিতে চক চক করে ওঠে। মেহরাব তার দিকে চাবি টা বাড়িয়ে দিয়েছিলো। সে চাবিটা হাতে নিয়ে সাত পাঁচ না ভেবে তালা টা খোলে।অনেক দিনের বন্ধ দরজা একটা ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ তুলে খুলে গেলো।


চলবে.........

0 Comments:

Post a Comment