#আমার_রুদ্রাণী
#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা
#part: 33
🍂🍂🍂
~কি সমস্যা ফারাজ ভাই! কতবার বলেছি আমাকে অকারণে কল দিবেন না। আমার এটা অপছন্দ।
ফোনের ওপাশ থেকে দিয়ার ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর শুনেও মুচকি হাসলো ফারাজ। কারণে অকারণে দিয়াকে ডিস্টার্ব করতে তার ভীষণ আনন্দ লাগে। প্রায় সময়ই দিয়া কথা শুনায় তাতেও সে দমে যাবার পাত্র নয়। ঠোঁটের হাসি আরেকটু প্রশস্ত করে বললো,
রাগ করো না দিয়াপাখি। আমার আজকে সত্যিই তোমার সাহায্যের দরকার তাই কল করেছি।
ফারাজের 'দিয়াপাখি' ডাকায় বিরক্তিতে 'চ্' শব্দ করে বললো,
~কতদিন বলেছি এই নামে আমাকে সম্বোধন করবেন না। কি দরকার সেটা বলুন।
ফারাজ ফোঁস করে এক দম ছেড়ে বললো,
~পরশু মায়ের জন্মদিন। আমি চাইছিলাম তাকে একটা শাড়ি গিফট্ করতে। কিন্তু...
~কিন্তু কি? কথার মাঝে থামেন কেনো। আজব!
~আরে বলছি তো! এতো রেগে যাচ্ছো কেনো? শাড়ির ব্যাপারে আমার মাথা সম্পূর্ণ খালি। কাল গিয়ে একবার দোকানে ঘুরে এসেছি। কিছুই বুঝিনি, উল্টো মাথা চক্কর দিচ্ছিলো। তুমি একটু চলো না আমার সাথে।
দিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে,
ফারাজ ভাই! আপনার না কত্ত গুলা মেয়ে ফ্রেন্ড! তাদের সব গুলোকে দোকানে নিলে আই বেট তারা অর্ধেক দোকান খালি করে দিবে। সবাইকে না নিলেও তাদের মধ্যে একজনকে ধরে নিয়ে হাটা ধরলেই হয়।
~ওদের নিয়ে যাওয়া আর দেওয়ালে কপাল ঠুকা এক ব্যাপার।
~মানে?
~ওদের বুঝিয়ে নিয়ে যেতে গেলেও আগে ওদের বয়ফ্রেন্ড এর পারমিশন লাগবে, তারপর তাদের মা বাবার, তারপর তাদের যদি মন চায় তবেই যাবে। গেলেও কল এর মধ্যে বয়ফ্রেন্ড এর সাথেই লেগে থাকে। এর থেকে ভালো তুমিই চলো প্লীজ। আমি ফুচকা খাওয়াবো।
~সত্যি?
~যাবে তুমি?
~ফুচকা খাওয়ালে যাবো।
~আচ্ছা। তবে তুমি রেডী হও। আমি আধ ঘণ্টা পর নিতে আসছি।
~আচ্ছা।
🍂🍂🍂
শপিং মলের বাইরে আসতেই দিয়া বিদায় জানিয়ে চলে আসতে নেয়। তবে ফারাজ বাঁধা দিয়ে বলে সে নিজেই বাড়ি পৌঁছে দিবে। দিয়া কিছু একটা বলবে তার আগেই একটা গাড়ি দিয়াদের সামনে থামে। দিয়া এক লাফে ফারাজের পিছনে যেয়ে তার হাত চেপে ধরে। দিয়া হতভম্ব হয়ে ফারাজের দিকে চেয়ে থেকে আবার উকি দিয়ে গাড়িটির দিকে তাকায়। গাড়িতে আয়মানকে দেখে দিয়ার কপাল কুঁচকে আসে। তার এখনও খেয়াল নেই যে সে ফারাজের হাত জড়িয়ে দাড়িয়ে আছে। বিড়বিড় করে বলে,
এবার আমাকেও মারার প্ল্যান করছে নাকি? ভালোই তো!
আয়মান দিয়াদের সামনে এসে ফারাজের হাতের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
ভাবিমা তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। কাল বৌভাত তাই আজকে ওই বাড়িতে থাকতে বলেছেন তোমাকে। কাব্য আর আহিলকেও গার্ডরা নিয়ে গেছে ইতিমধ্যে।
~আপনি চলে যান। মেহেরকে বলবেন আমি কাল আসবো। আজকে যেতে পারবো না।
~ভাবিমা নিয়ে যেতে বলেছেন। আমি চাইছি না তার মন খারাপ করতে। দ্রুত গাড়িতে উঠো। আম ওয়েটিং।
বলেই গাড়ির দিকে যেতে নিয়েও দিয়ার পাশে দাড়িয়ে থাকে। দিয়া ফারাজের দিকে চেয়ে বলে,
আমি তবে মেহেরের বাসায় যাই। আপনি চলে যান।
দিয়া যেতে নিতেই ফারাজ দিয়ার হাত ধরে আটকে বলে,
এইটা তোমার জন্য।
ফারাজ এর হাতে থাকা ব্যাগ এর দিকে চেয়ে বলে,
এর কোনো প্রয়োজন নেই।
~আজকে সময় দেওয়ার জন্য মনে করে নাও এটা থ্যাংক ইউ গিফট্। তোমার পছন্দ আসলেই অনেক সুন্দর।
দিয়া একবার আয়মান এর দিকে চেয়ে দেখলো সে চোয়াল শক্ত করে তার দিকেই চেয়ে আছে। দিয়া দ্রুত ফারাজ এর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে এক হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়েই গাড়ির দিকে দৌড় লাগায়। পেছনের সিটে বসতে নিলেই আয়মান ওকে টেনে এনে সামনের সিটে বসায়। দ্রুত ড্রাইভ করে সেখান থেকে চলে আসে। দিয়া চুপচাপ চোখ বন্ধ করে গাড়িতে বসে থাকে। গাড়ি থামলেই বের হতে নিলে দেখে দরজা লক করা। গাড়ির বাইরের দিকে চেয়ে দেখে তারা এখনও আহমেদ ভিলায় পৌঁছায়নি। দিয়া কিছু বলার আগেই আয়মান দু হাত ছড়িয়ে বলে,
~জড়িয়ে ধরো।
দিয়ার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। গম্ভীরতা বজায় রেখে প্রশ্ন করে,
~এখানে গাড়ি থামালেন কেনো?
~কি বললাম শুনোনি? জড়িয়ে ধরো!
~পারবো না।
'চ্' শব্দ করে নিজেই দিয়াকে টেনে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে,
~ইদানিং খুব জ্বালাচ্ছ তুমি। বিয়েটা একবার হতে দাও। তখন দেখবো আর কিভাবে জ্বালাও।
🍂🍂🍂
মাথায় লম্বা এক ঘোমটা দিয়ে বসে আছে মেহের। তাকে ঘিরে বসে আছে রুদ্রর নানি আর মামীরা। রুদ্র কেমন মানুষ, তার কি পছন্দ-অপছন্দ, রুদ্র রাগ হলে তার কি করণীয় এসব তাকে রুদ্রর নানি বলছে আর মেহের ক্লাসের ভালো ছাত্রীর মতো মনোযোগ দিয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে শুনছে। রুদ্রর নানি এক জোড়া বালা মেহেরের হাতে পড়িয়ে দিতে নিলেই মেহের দ্রুত মানা করে দেয়।
~এত দামী গহনা দিয়ে আমি কি করবো নানি? এর প্রয়োজন নেই।
~মানা করতে হয় না মেহের। মা দিচ্ছেন তো! নাও।
শাশুড়ির কথা শুনে করুন চোখে তাকালো মেহের। এত দামী গহনা সে কিছুতেই নিতে চাইছে না।
~কিছু মা এগুলো তো!
~শোনো পিচ্চি নাতবউ! বড়রা কিছু দিলে মানা করতে হয় না। এতে তাদের দোয়া মিশে থাকে তাই বড়রা কিছু দিলে চুপচাপ নিবে। বুঝলে?
নানীর পিচ্চি বলতেই মুখ ফুলালো মেহের। নানি, নাতি দুজনই পিচ্চি বলে ডাকে তাকে। এতো বড়ো মেয়েকে পিচ্চি ডাকার মানে হয়! নানী হাতে বালা পড়িয়ে দিতে থাকলে মেহের গাল ফুলিয়ে বলে,
আমি মোটেও পিচ্চি না। তোমরা সবাই আমাকে পিচ্চি ডাকো কেনো? স্নেহা আর আমি তো সমবয়সী।
মেহেরের কথা রুদ্রর নানী আর মামীরা হেসে উঠে। ছোট মামী মেহেরের গালে হাত রেখে বলে,
রুদ্র তো এই বাড়ির ছোট ছেলে। ওই হিসেবে তুমি এই বাড়ির ছোট বউ মানে সব থেকে ছোট। তাই তোমাকে পিচ্চি বলে।
সকলের কথা শুনে মেহের মাথা নিচু করে বসে থাকে। একে একে সকলেই মেহেরকে বিভিন্ন উপহার দেয়। মেহের প্রথমে নিতে না চাইলেও পরবর্তীতে শাশুড়ির কথায় নিতে হয়।
.
রাতে ডিনার করে ঘরে ফিরতেই রুদ্র দেখে মেহের ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে। পায়চারি করছে বললে ভুল হবে। সে রীতিমতো দৌড়াদৌড়ি করছে। রুদ্র বিছানায় গিয়ে বসতেই মেহের প্রশ্ন করে,
আমি কোথায় ঘুমাবো?
মেহেরের প্রশ্নে রুদ্র সারা বিছানায় এক বার চোখ বুলিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে,
কেনো? এই বিছানা কি তোমার কাছে ছোট মনে হচ্ছে?
~আপনার সাথে ঘুমাবো?
~তোমার কি আরো একটা বর আছে যে তার সাথে গিয়ে ঘুমাবে?
রুদ্রর এমন ত্যাড়া কথায় মেজাজ খারাপ হয় মেহেরের। দাতে দাত চেপে বলে,
আমি মোটেও আপনার সাথে ঘুমাবো না।
~তবে অন্ধকার ঘরে এক বস্তা তেলাপোকার সাথে দিয়ে আসি? ওখানেই আজ ঘুমাও। চলো তোমাকে দিয়ে আসি।
বলেই মেহেরের হাত ধরে টান দিতে নেয়। তার আগেই মেহের দৌড় দিয়ে সোফায় গিয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে বলে,
~আমি যাবো না ওই ঘরে। আমি এই ঘরেই থাকবো।
~তবে বিছানায় যাও।
মেহের মাথা নেড়ে না বুঝাতেই রুদ্র বলে,
~তাহলে চলো ঐ ঘরে রেখে আসি।
মেহের দ্রুত খাটে গিয়ে কম্বল গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। রুদ্র হালকা হেসে বারান্দায় চলে যায়। গিটারের টুংটাং শব্দ কানে আসতেই মেহের কম্বলের ভেতর থেকে মাথা বের করে সারা ঘরে চোখ বুলায়। নাহ! রুদ্র ঘরে নেই। বারান্দা থেকে গিটারের আওয়াজ আসায় বুঝতে পারে যে রুদ্র বারান্দায় আছে। মেহের ধীর পায়ে গিয়ে বারান্দায় উকি দেয়। রুদ্র সেখানেই বসে গিটারে সুর তুলছে। মেহের রুদ্রর পাশে গিয়ে বসতেই রুদ্র মেহেরের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে গাইতে শুরু করে,
তুমি না ডাকলে আসব না
কাছে না এসে ভালোবাসব না
দুরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
না কি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়?
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরনো
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।
মেহেরের মনে হলো গানটা রুদ্র তাকেই উদ্দেশ্য করে গাইছে। আকাশের চাঁদটা যেনো আজ মেঘেদের সাথে লুকোচুরি খেলতে ব্যস্ত। মেহের উঠে রেলিং ধরে আকাশে দৃষ্টি স্থির করলো। বসন্তের মৃদু বাতাস থেমে থেমেই গায়ে এসে লাগছে। হটাৎ রুদ্র ধীর কণ্ঠে ডাকলো,
মেহেরজান!
মেহের চোখ চেপে বন্ধ করে নিলো। এই ডাকটাই তার হৃদপিণ্ডের গতি বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। এমন শীতল আবহাওয়াতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। রুদ্র আবারো সম্মোহনী কণ্ঠে ডাক দিলো,
রুদ্রাণী?
মেহের রুদ্রর দিকে ঘুরে মাথা নুয়ে দাড়িয়ে রইলো। রুদ্র আবারো বললো,
এদিকে এসো।
মেহের ধীর পায়ে রুদ্রর সামনে গিয়ে দাড়াতেই রুদ্র এক টানে মেহেরকে নিজের কোলে বসিয়ে মেহেরের অধরে অধর ছোঁয়ালো। মেহেরের হৃদপিণ্ড এবার বেরিয়ে আসার উপক্রম। এমন ছোঁয়া আর পরিস্থিতির সাথে সে বরাবরই অপরিচিত। রুদ্র মেহেরের অধর ছেড়ে কপালে কপাল ঠেকালো। বেশ কিছুক্ষণ পর লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো,
যাও ঘরে যাও।
রুদ্রর কথা যেনো মেহেরের কান অব্দি গেলো না। সে তার কোলে বসেই ফ্যাল ফ্যাল করে রুদ্রর দিকে চেয়ে রইলো। রুদ্র বাকা হেসে বললো,
আবার চাই?
রুদ্রর কথায় এবার মেহেরের টনক নড়লো। মুহূর্তেই গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো। দ্রুত পায়ে রুদ্রর থেকে দূরে সরে এলো। বিড়বিড় করে বললো,
অসভ্য একটা!
বলেই দৌড়ে ঘরে চলে এলো। ঘরে এসেই কম্বল পেঁচিয়ে শুয়ে পড়লো। এই মুহূর্তে সে রুদ্রর মুখোমুখি হতে চায় না, কিছুতেই না। নয়তো দেখা গেলো আগামীকাল খবর ছেপেছে "স্বামীর চুমু দেওয়ার ফলে বিয়ের পরদিনই লজ্জায় পটল তুলেছে মেহের নামের এক রমণী"। ভুত সমাজেও তো লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না। তখন কি এক বাজে পরিস্থিতি হবে। ভাবা যায়!!!
~~~
চলবে~
(পরের পর্বের জন্য নাকি অনেকেই অপেক্ষা করছেন? আমি অনেক অসুস্থ থাকায় গল্প দিতে দেরি হলো। কেউ রাগ করবেন না। আর অবশ্যই গঠনমূলক কমেন্ট করবেন। হ্যাপি রিডিং~)
0 Comments:
Post a Comment