গল্প আমার_রুদ্রাণী পর্ব ২১

 #আমার_রুদ্রাণী

#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা

#part: 21


🍂🍂🍂


গাড়ি চলছে আহমেদ ভিলার উদ্দেশ্যে। সকলে বেশ উৎফুল্ল হয়ে আড্ডা দিলেও মেহের চুপ করে চোখ বন্ধকরে সিটে মাথা হেলিয়ে বসে আছে। সারাদিন ঘরে একা থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে। ২ দিন যাবত এত গান বাজনা চিৎকার চেঁচামেচি তার বিরক্তির অন্যতম কারণ মনে হচ্ছে এখন। আহমেদ ভিলার সামনে গাড়ি থামতেই একে একে সবাই নেমে পড়ে। মেহের সবার শেষে নেমে একবার মাথা তুলে বাড়ির দিকে চোখ বুলায়। কি সুন্দর করেই বিভিন্ন লাইটিং আর ফুল দিয়ে সেজে উঠেছে আহমেদ ভিলা। মেহের কতক্ষন চেয়ে থেকে আবারো মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বাড়ির ভেতরের দিকে হেঁটে যায়। দরজায় পৌঁছাতেই সামনে কাউকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ তুলে ব্যক্তিটির দিকে তাকায়। তিথি আহমেদ আর স্নেহা হাসি হাসি মুখে মেহেরের জন্য দাড়িয়ে ছিলেন এতক্ষণ। চোখ মুখ দেখলে কোনো কানাও এই মুহূর্তে বলতে পারবে যে উনি এই বিয়েতে বেজায় খুশি। মেহেরের গালে হাত রেগে বলে,

কেমন আছে আমার মেয়েটা? আসতে সমস্যা হয়নি তো?

~জ্বি আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। আসতে কোনো সমস্যা হয়নি। আপনি কেমন আছে? (মুচকি হেসে প্রশ্ন করে মেহের)

~আমিও ভালো আছি। (তিথি)

~দেখি দেখি সরো সবাই। আমার মেয়ে এসেছে। সরো সরো।

বলতে বলতে সকলকে সরিয়ে এগিয়ে আসেন রেদোয়ান।

~আসসালামু ওয়ালাইকুম আংকেল। কেমন আছেন? (মেহের)

রেদোয়ান জবাব না দিয়ে ডানে বামে খুঁজতে থাকে। নাহ! সে ব্যতীত এদিকে ওনার বয়সী অন্য কাউকে দেখছেন না। আংকেল কাকে বললো তবে? ভ্রু কুঁচকে মেহেরকে জিজ্ঞেস করে,

কাকে জিজ্ঞেস করলি রে মা?

বলে আবারো ডানে বামে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিকে চোখ বুলান। রেদোয়ানের প্রশ্নতে মেহের থতমত খেয়ে যায়।

~আপনাকে (মেহের)

মেহের এর জবাবে রেদোয়ান বিস্ফোরক দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে চেয়ে থাকে। মেহের করুন দৃষ্টিতে একবার তিথি আহমেদ তো একবার রেদোয়ান এর দিকে তাকায়। আরেকবার সকলের দিকে চোখ বুলায়। সবাই যে মেহেরের মতই কিছু বুঝতে পারেনি তা সবার চোখ মুখের ভঙ্গিতেই বুঝা যাচ্ছে। শুধু মাত্র তিথি আর স্নেহা ই স্বাভাবিক ভাবে দাড়িয়ে আছে। মেহের ভাবে সে ভুল কিছু বললো কি না। মেহের এবার অপ্রস্তুত হয়ে তিথিকে জিজ্ঞেস করে,

আমি কি কিছু ভুল বলেছি আন্টি?

তিথি এবার দু কদম পিছিয়ে আরো বিস্ময়ের দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। মেহের এবার কেঁদে দিবে দিবে ভাব। রেদোয়ান আহমেদ অবাক স্বরে বলে,

আমরা তোর আংকেল আন্টি হলাম কবে?

মেহের এবার বুঝতে পারে যে সে কি ভুল করেছে। তারা তাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসলেও মেহের এখনও তাদের ঐভাবে ডাকেনি। মেহের মাথা নিচু করে দুজনের হাত ধরে মিনমিনে গলায় বলে,

তোমরা রাগ না করলে মামনি আর বা... বাবা বলে ডাকি?

তিথি আর রেদোয়ান দুজনের মুখেই হাসি ফুটে ওঠে। রেদোয়ান মেহেরের মাথায় এক হাত রেখে বলে,

দেখো মেয়ের কথা! মেয়ে বাবা বলে ডাকলে রাগ করবো কেনো? উল্টো খুশি হয়েছি আমি।

~আমি বুঝি কেউ না? (মুখ ফুলিয়ে বলে স্নেহা)

রেদোয়ান হেসে বলে,

তুই তো আমার বড় মেয়ে। আর মেহের আমার ছোট মেয়ে।

মেহের মুচকি হেসে তিথির দিকে তাকাতেই উনি কোমরে হাত রেখে বলেন,

হ্যাঁ ৩ বাপ ঝি মিলে বাড়ির বাইরেই থাকো। বাড়ির ভেতরে আর যাওয়া লাগবে না। মেয়েটাকে এখন পর্যন্ত বাইরে দাড় করিয়ে রেখেছে। সরো তো!

.

মেহের বাড়ির ভেতরে এসে সোফায় বসে সবার সাথে টুকটাক কথা বলছিল। সবার নজর সিড়ির দিকে দেখে মেহেরও সকলের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকায়। এলো মেলো চুল, ঘুমুঘুমু চোখ, চেহারায় একরাশ গম্ভীরতা, একটা কালো আর সাদার সংমিশ্রণে টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়ে, মেহেরের দিকে দৃষ্টি রেখেই ধীর পায়ে ওদের দিকেই আসছে রুদ্র। রুদ্রকে আসতে দেখে তিথি স্নেহা আর তীব্রকে সবার রুম দেখিয়ে দিতে বলে নিজেও রান্নাঘরের দিকে চলে যান। ওরাও সকলকে ঘর দেখিয়ে দেওয়ার জন্য সেখান থেকে চলে যেতে থাকে। মেহের উঠে স্নেহাদের পেছনে যেতে নিতেই রুদ্র সোফায় বসে মেহেরের হাত টেনে ধরে জিজ্ঞেস করে,

কই যাও?

মেহের ঘুরে রুদ্রর দিকে তাকায়। শুষ্ক ঢোক গিলে চারদিকে তাকায়। এতক্ষণ মানুষে ভরপুর থাকা জায়গাটায় এখন দু একজন কাজের লোক আর বডিগার্ড ছাড়া কেউ নেই এইদিকে।

~আব... স্নেহাদের সাথে।

~কেনো?

~মামনি স্নেহাকে বললো তো ঘর দেখিয়ে দিতে।

~হ্যা তো?

~তো আমি না গেলে আমার ঘর কোনটা জানবো কিভাবে?

~আমি আছি না! আমি দেখিয়ে দিবো নে।

~আ... আচ্ছা।

মেহের মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আড়চোখে বার বার রুদ্রর দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু রুদ্র তো গালে হাত দিয়ে সোজা মেহেরের দিকেই চেয়ে আছে। রুদ্র উঠে দাড়িয়ে একজনকে ফোন করে। কথা শুনেই বুঝা যায় যে সে আয়মানকে ফোন করেছে।

মান! মেহেরজানের কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে জানিয়ে দিবে সে এখন ঘুমাচ্ছে। কেউ যেনো ডিস্টার্ব না করে।

মেহের ভ্রু কুচকে চেয়ে আছে রুদ্রর দিকে। সে এখন জেগে আছে তাও একদম বাড়ির মাঝ বরাবর দাড়িয়ে আর সে কিনা আয়মান কে বলতে বলছে কেউ জিজ্ঞেস করলে যেনো বলে সে ঘুমিয়ে! এখন হাজার মাথা ব্যথা করলেও ঘুমানো যাবে না। মেহমানরা কি ভাববে! বউ এসেই ঘুমিয়ে আছে! ইশ!!!

~চলো

~কোথায়?

~গেলেই দেখতে পাবে।

বলেই মেহেরকে টানতে টানতে ঐদিনের সেই কর্নার এর রুমটিতে নিয়ে যায়। ঐদিনের মত আজও এইদিকে কোনো মানুষ নেই। ঘরে ঢুকেই মেহের সারা ঘরে চোখ বুলায়। এখন বুঝতে পারে যে সে গতবার স্নেহার না বরং রুদ্রর ঘরে এসেছিলো। তাইতো রুদ্র বলেছিল "আমার ঘরে আমি না থাকলে আর কে থাকতো?" গতবার তাড়াহুড়ায় মেহের ঘরের দিকে ঠিক মত খেয়াল ই করেনি। ওয়াশরুম দেখতেই সেদিকে দৌড় চলে গিয়েছিল। একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারতো এটা রুদ্রর ঘর। কেননা রুদর ঘরে বিছানার ওপরের দেয়ালে রুদ্রর মস্ত বড় একটা ছবি টাঙানো। মেহের মনে মনে নিজেকে কয়েকটা অসাব্র গালি দেয়। আগে ঠিক মত খেয়াল করলে আর ওইদিন রুদ্রর হাতে ধরাই পড়তো না। মেহের আরেকটু এগিয়ে যেতে খাটের পাশে দাড়িয়ে ছবিটি মনোযোগ দিয়ে দেখে বুঝতে পারে রুদ্রর ছবিটি মেহেরের অনেকগুলো ছবি দিয়ে তৈরি। মেহের অবাক হয়ে কতক্ষন ছবিটির দিকে চেয়ে থাকে। বেশিরভাগ ছবিই ক্যান্ডিড আর এইসব ছবি মেহের কখনোই তুলেনি। তবে এইসব ছবি উনি কোথায় পেলো? ভাবতেই মেহেরের মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। 

~পছন্দ হয়েছে?

রুদ্রর কণ্ঠ শুনে মেহের পেছনে ঘুরে তাকায়। রুদ্রর প্রশ্নর জবাব না দিয়ে উকি দিয়ে দরজার দিকে একবার তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে আসে মেহেরের।

দরজা লক করেছেন কেনো?

~তোমার সাথে প্রেম করবো বলে।

রুদ্রর কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকায় মেহের। মেহের এর  এই লুক দেখে রুদ্র ফিক করে হেসে দেয়। মেহেরের নাক টেনে বলে,

কিউট এর বস্তা একটা।

মেহের মুখ ফুলিয়ে তাকাতেই রুদ্রর আবারো গা দুলিয়ে হাসে। পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

ঘর পছন্দ হয়েছে? 

মেহের আরেকবার ঘরে নজর বুলায়। ঘরের প্রায় জিনিসই সাদা আর কালোর কম্বিনেশনের, বেশির ভাগই সাদা রঙের। রুদ্রর ঘরটা বেশ বড়,ঘরের দেয়াল গুলো সাদা রঙের, রুমের মাঝেই খাট, হাতের বাম পাশে আলমারি, ড্রেসিং টেবিল আর ওয়াশরুমের দরজা। খাটের ডান পাশে একটা বুকশেলফ যাতে নানান ধরনের বই রয়েছে, বুক সেলফ এর পাশের দেওয়ালটি একটি জানালা রয়েছে, প্রতিটি দরজা জানালায় সাদা রঙের ফিনফিনে পাতলা পর্দা বিদ্যমান, জানালার কাছের পর্দাটা মৃদু বাতাসে থেকে থেকেই উড়ছে, ঐদিকে একটা দরজা রয়েছে যা দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে এটি বারান্দার দরজা, রুদ্রর পিছনের দেওয়ালের ঐদিকে একটা সোফা যাতে মেহের চাইলেই অনায়াসে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারবে, সোফার ওপরের দেওয়ালে রুদ্রর, আহমেদ পরিবারের সবার সাথে এবং মেহেরের ও বিভিন্ন ছবি রয়েছে। ঘরটা আসলেই বেশ পছন্দ হয়েছে মেহেরের। মেহের মুগ্ধ হয়ে সারা ঘর দেখতে থাকে।

বিয়ের পর থেকে এখানেই থাকবে তুমি। একচুয়ালি বিয়ের পর না তুমি আজকে থেকেই এখানে থাকবে।

~আমি এখানে থাকলে আপনি কোথায় থাকবেন?

~কেনো! তোমার সাথেই থাকবো।

~কিহ! আপনি ভুলে গেছেন আমাদের এখনও বিয়ে হয়নি!

~হ্যা তো?

~হ্যাঁ তো মানে! আমি মোটেও বিয়ের আগে আপনার সাথে এক ঘরে থাকবো না।

~তোমার কি মনে হয়? আমি থাকবো? পাগল একটা! আমি মজা করছিলাম। আমি পাশের ঘরটাতে থাকবো আজকে।

মেহের একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে। লোকটা যেই পাগল! দেখা যেত সত্যিই ওর সাথে এই ঘরে আছে।

~তোমার নিশ্চিত মাথা ব্যাথা করছে? তুমি ঘুমাও। কিছু লাগলে আমাকে বা বাড়ির কাউকে জানিয়ে দিও। ঠিকাছে? আমি আসছি। টেক কেয়ার।

বলেই মেহেরের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে চলে যায়। মেহের তার যাওয়ার দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। আসলেই তার ভীষণ মাথা ব্যাথা করছিলো। রুদ্র কি করে বুঝলো? পরে জানা যাবে আপাতত মেহের নিজের ঘুমকেই প্রাধান্য দেওয়া বেশি জরুরি মনে করলো। সকল চিন্তা এক সাইডে রেখে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।

~~~

চলবে~

0 Comments:

Post a Comment