গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ২

 প্রিয় বেলা

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা 


২.

চোখে ঠান্ডা পানির স্পর্শ অনুভব করতেই চোখ মেলে তাকালো বেলা। তবে আশপাশটা কেমন ঝাপসা দেখছে সে। আঁখিজোড়া বড্ড জ্বালা করছে। মাথার সূক্ষ্ণ যন্ত্রণায় উঠে বসার জো নেই। ধীরেধীরে চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হলো। চারিদিকের অচেনা, অপরিচিত দেওয়াল, সিলিং আর মানুষগুলোকে দেখে বেলা প্রথমেই বুঝলো না সে কোথায় আছে। পরে যখন নিজের মাথার কাছে রেখাকে বসে থাকতে দেখল, তখনই যেন আস্তে আস্তে সব মনে পরতে লাগলো তার। জ্ঞান হারানোর মতো বিশ্রী কাণ্ড ঘটিয়ে ভীষণ লজ্জা নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল বেলা। রেখা উদগ্রীব হয়ে তার মাথায় হাত বুলালেন। মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

---"এখন কেমন লাগছে বেলা? তুমি ঠিক আছো?"


বেলা ক্ষীণ মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। আড়চোখে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলো আশপাশটা। অনুষ্ঠানের সবাই কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন সবার কেন্দ্রবিন্দু একমাত্র বেলাই। বেলার লজ্জা বাড়লো। গলার সঙ্গে থুতনি ঠেকিয়ে দৃষ্টি পুরোপুরি ঝুঁকিয়ে বসে রইলো সে। রেখা আবার বললেন,

---"ক্ষুধা লেগেছে বেলা? কিছু খাবে?"

বেলা অতি মৃদুস্বরে জবাব দিলো,

---"খেতে ইচ্ছে করছে না আন্টি---। আমি এখানে কতক্ষণ ধরে আছি?"


এ কথায় আয়াজ হাসতে হাসতে উত্তর দিলো,

---"বেশিক্ষণ হয় নি। আধঘণ্টা। তুমি যে আমাদের দুই ভাইকে দেখে এভাবে ভয় পেয়ে জ্ঞান হারাবে, আমরা তো কল্পনাও করিনি। আর কিছুক্ষণ জ্ঞানহীন থাকলেই তো তোমার মাকে ডাকতে যেতে হতো আমার।"


বেলা আরেকদফা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। আয়াজের কথার প্রতিউত্তরে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলো না। তবে চোরা দৃষ্টিতে আদ্রের দিকে তাকালো একবার। আয়াজ আর আদ্র দুজন পাশাপাশিই বসে আছে। তাদের মধ্যিখানে নিশ্চিন্তে বসে বসে আপেল খাচ্ছে বিহান।

বেলা দৃষ্টি সরাতে গিয়েও সরালো না। ক্ষীণ পর্যবেক্ষণ করলো ওদের দুই ভাইকে। আয়াজ থেকে আদ্র একটু স্বাস্থ্যবান। হাতগুলো পেশিবহুল। আয়াজের মতো অত বেশি চিকন না। ওদের গায়ের রঙেও ক্ষীণ ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। দুজনেই ফর্সা হলেও আদ্র উজ্জ্বল গৌর বর্ণের অধিকারী। বেলা এবার সরাসরি আদ্রর মুখপানে তাকানো চেষ্টা করলো। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাকালো আদ্রও। বেলা হকচকালো, অপ্রস্তুত হলো। দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো আবার। গাল দু'টো গরম হয়ে যাচ্ছে তার। ভারী ভারী লাগছে। সেই রক্তিম গালদু'টোর দিকেই একমনে চেয়ে রইলো আদ্র। মেয়েটার চেহারা ভীষণ মায়াবী। পানির ছটায় পাঁপড়িগুচ্ছ ভিঁজে একে অপরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। সুন্দর দেখাচ্ছে। আদ্রর চোখ সরাতে ইচ্ছে করছে না। মনের খুব গোপনে সে আনমনেই আওড়ালো,

---"শুনো মেয়ে, তোমার চোখ দু'টো অদ্ভুদ সুন্দর। আমার চেয়ে চেয়ে দেখতে ক্লান্তি আসছে না।"


_____


পরেরদিন থেকে ভীষণ বৃষ্টি। কিছুক্ষণ পরপরই সুদূর হতে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম ডাক শোনা যাচ্ছে। স্বচ্ছ পানিতে রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গ্রাম বাংলায় এ দিনে কাঁচা মাটির ঘ্রাণে চারদিক মৌ মৌ করে। আকাশে কাক, পক্ষীর সাক্ষাত একেবারেই নেই। বেলা বিরক্ত ভঙ্গিতে ছাতাটা শক্ত করে ধরলো। সকালে বৃষ্টি কম থাকায় ভার্সিটির কাজে বের হয়েছিল সে। এখন মারাত্ত্বক বিপদে পরে গেছে। প্রবল বর্ষণের তেজে রাস্তা পুরো ফাঁকা। রিকশা, সিএনজি যাত্রীতে ভরপুর। মাঝে মাঝে বাস-স্টেশনের ছাউনিতে কিছু মানুষকে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে। তাদের সঙ্গ দিতেই বেলাও দ্রুত পদে ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। 


পরনের কামিজের নিচের অংশ ভিঁজে গেছে তার। ছাতা বন্ধ করে সেটা একটু ঝেরে নিলো বেলা। হঠাৎ চেনা এক ভরাট কণ্ঠ কানে এলো,

---"হ্যাঁ, আমি আসছি একটু পর। ওকে বেঁধে রাখ। একটু উত্তম-মধ্যম না খেলে ও সোজা হবে না।"


এটুকু শুনেই চটজলদি পাশ ফিরে তাকালো বেলা। নিজের পাশে আদ্রকে দেখে চমকে উঠলো খুব। কিন্তু বুঝতে পারছে না, এটা কি আদ্রই? নাকি আয়াজ? দ্বিধান্বিত চাহনিতে কিছুপলক সেদিকে চেয়ে রইলো সে। আনমনেই মুখ ফঁসকে প্রশ্ন করলো,

---"আপনি আয়াজ ভাইয়া নাকি আদ্র?"


আদ্র তখনো খেয়াল করেনি বেলাকে। প্রশ্ন শুনে বেলার দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে এলো তার। ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে 'আসছি' বলে কান থেকে ফোন নামালো। গম্ভীর স্বরে বললো,

---"আদ্র।"

---"ওহ্! আমি বেলা। আপনার সঙ্গে কাল দেখা হয়েছিল আমার। চিনতে পেরেছেন?"


পকেটে ফোন ভরে আদ্র ঠাট্টার সুরে বললো,

---"চিনেছি। আমাকে দেখে যে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল, আপনি সেই বেলা না?"

প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না বেলা। লজ্জাবোধে তৎক্ষনাৎ মাথা নুয়ালো। পরিচিত বিধায় এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাটা সমীচীন বলে মনে হয় নি তার। তাই কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে এই লোক কি-না তাকেই অপমান করে দিলো! মনে মনে খুব রাগ হলো বেলার। আদ্রকে অসভ্য উপাধিতে ভূষিত করতে দু'বার ভাবলো না সে।


পরিবেশ তখন অল্প কোলাহল আর অল্প নিস্তব্ধতায় সম্মিলিত। তখনের অপমানের পর বেলা আর একটা কথাও বলেনি। চুপ করে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছে। আদ্র পকেট থেকে ফোন বের করে তা আবার চাপতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছে বেলাকে। সরব খেয়ালে এলো, বেলা হাঁচি দিচ্ছে বারবার। একটু কেঁশে আদ্র প্রশ্ন করলো,

---"বৃষ্টি যখন সহ্য হয় না, তখন বাহিরে বের হয়েছেন কেন?"


বেলা উত্তর দেবে না, দেবে না করেও শেষে ছোট্ট করে উত্তর দিলো,"কাজ ছিল একটু।"

বলতে বলতে আবারও হাঁচি দিলো সে। হুট করে হাসি পেয়ে গেল আদ্রর। ঠোঁট বাঁকিয়ে অল্প হাসলোও সে। তবে তা বেলার অজান্তে। বেলাকে বললো,

---"সেদিন তুমি বারান্দায় কি করছিলে?"


আদ্রের হঠাৎ তুমি বলা খেয়ালে আসেনি বেলার। সে অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করলো,

---"কোন দিন?"

---"পরশু।"

বেলার চোখে একরাশ বিস্ময় এসে হাজিরা দিলো এবার। পিটপিট করে তাকিয়ে সে আবারও জিজ্ঞেস করলো,

---"তার মানে, সেটা আপনি ছিলেন?"

---"অবশ্যই। আমি ছাড়া আর কে হবে?"


আদ্র এমন ভাবে বললো, বেলা না হেসে পারলো না। খিলখিল শব্দে বিস্তর হাসলো। আদ্র চেয়ে, চেয়ে দেখলো সে হাসি। নির্নিমেষভাবে, নিভৃতে। তার কেমন গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো। মুগ্ধ হলো নেত্র। শান্ত কণ্ঠে আদ্র বললো,

---"বেলা, শুনছো? চোখের পাশাপাশি তোমার হাসিটাও ভীষণ সুন্দর।"


___________________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ১

 ---"বুবু জানিস কি হয়েছে? পাশের বাসার ভাইয়াটা এলাকার ছেলেপেলেদের নিয়ে একটা ছেলেকে খুব মারছে। আধমরা করে ফেলেছে একদম।"

কথাটা শুনে আঁতকে উঠলো বেলা। এক ছুটে বারান্দার কাছে যেতেই আয়াজ নামক ছেলেটিকে পাশের এলাকার একটা ছেলেকে খুব বাজে ভাবে মারতে দেখলো। সঙ্গে ১৮, ২০ বছরের কিছু ছেলেও দাঁড়িয়ে আছে। আয়াজকে ভাই ডাকে সম্মোধন করছে বারংবার। বেলা অবাক হয়ে বিষয়টা দেখলো। তারা এ এলাকায় নতুন। বাবার ঢাকা থেকে ট্রান্সফার হওয়ায় কুমিল্লায় নিজস্ব বাড়িতে এসেছে কিছুদিন হলো। আয়াজ তাদের পাশের বাড়িতেই থাকে। বেলা কয়েকদিন আগে গিয়েছিল সেখানে। আয়াজের সাথেও ক্ষীণ সময়ের জন্য দেখা হয়েছিল তার। তখন এ ছেলেটির আচরণ কতইনা ভদ্র-সভ্য ছিল। অথচ এখন! কিভাবে রাস্তায় মারপিট করে গুন্ডামি করছে! বিশ্বাসই হচ্ছে না, এই ভদ্র, শান্ত ব্যক্তিটি ভেতরে ভেতরে কি দারুণ উগ্র মেজাজি। 

বিহানের কথায় সম্বিৎ ফিরলো বেলার, "আয়াজ ভাইয়াকে কত ভদ্র ভেবেছিলাম, তাই না বুবু? কিন্তু উনি যে এমন, আমি কল্পনাও করিনি।"


বেলা একবার বিহানের দিকে তাকালো। তারপর আবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে আয়াজের মুখপানে স্থির চাহনি নিক্ষেপ করলো। আয়াজ তখন ঘাড় এদিক ওদিক নাড়িয়ে নিজেকে শান্ত করছিল। রাস্তায় জ্ঞানহারা ছেলেটার উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলে পাশের ছেলেটির দিকে হাত বাড়ালো সে। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আয়াজের হাতে তা ধরিয়ে দিলো ছেলেটি। সিগারেট জ্বালিয়ে আয়াজ আশেপাশে তাকাতে লাগলো। সুদূরে দাঁড়ানোরত বেলা দৃষ্টিগোচর হতেই ভ্রু কুঁচকালো সে। তীক্ষ্ণ, ভয়ংকর লাল চোখ জোড়ার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ভড়লে গেল বেলা। হকচকালো, থমকালো। ভীতু কণ্ঠে বিহানকে তাড়া দিয়ে বললো,

---"ভেতরে চল বিহান। এখানে থাকা নিরাপদ হবে না।"


অতঃপর বেলা বিহানকে নিয়ে ব্যস্ত পায়ে চলে গেল রুমের ভেতর। অথচ আয়াজ তার দৃষ্টি সরালো না। তার ঈগল চোখের সূক্ষ্মতা ওই খালি বারান্দাটাতেই এঁটে রইলো।


_____


বেলার মা প্রভা বেগম বেশ শান্তশিষ্ট মহিলা। কারো সঙ্গে ঝামেলা বিশেষ পছন্দ না উনার। প্রয়োজন হলে তিনি নিজে অপর জনের দোষ মাথা পেতে নিবেন, কিন্তু সে বিষয় নিয়ে বাড়তি দু'কথা বাড়ানো তার স্বভাবে নেই। আবার প্রচন্ড মিশুকও তিনি। কুমিল্লা আসার কয়েকদিনের মাথায়ই পাশের বাড়ির সদস্যদের সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে উনার। আয়াজের মা রেখাও বড্ড মিশুক স্বভাবের। বিহান আর বেলাকে নিজের মেয়েছেলের মতোই আপ্যায়ন করেন তিনি।


দুপুরের খাবার শেষে প্রভা বেগম টেবিল গোছাচ্ছিলেন। বেলা আর বিহান তার ঠিক উল্টো দিকেই সোফায় বসে টেলিভিশন দেখছে। কাজ করতে করতে প্রভা বেগম ডাকলেন,

---"বেলা, শুন। একটা কথা আছে।"

বেলা টিভির পর্দায় চোখ রেখেই উত্তর দিলো,

---"বলো মা।"

---"ওই যে পাশের বাড়ির ভাবী আছে না? পরশু যার বাসায় গেলি?"

---"হ্যাঁ, কি হয়েছে সেখানে?"


মেয়ের জিজ্ঞাসাবাদে প্রবল আগ্রহী হয়ে উঠলেন প্রভা বেগম। কাজ ছেড়ে বেলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। বললেন,

---"উনার মেয়েকে নাকি ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে আজ বিকালে। তোকে যেতে বললো। বিহানকে নিয়ে যাবি?"

বেলার বিরক্ত কণ্ঠ,

---"ওখানে যেয়ে আমি কি করব?"

---"কি করবি মানে? ভাবী কত অনুরোধ করলো। তোকে উনি মেয়ের মতোই দেখে। আমি উনার অনুরোধ কিভাবে ফেলি?"


টিভি দেখে চোখ সরালো বেলা। কণ্ঠে বিরক্তির রেশ আরও বাড়িয়ে বললো,

---"উনার মেয়েকে দেখতে আসছে মা। উনার মেয়ে থাকলেই তো হলো। আমার দরকার কি সেখানে? তাছাড়া যদি উনার মেয়ের জায়গায় ছেলে আমাকে পছন্দ করে ফেলে, তখন কি করবে?"


প্রভা বেগম খুশি হয়ে বললেন,

---"তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ। এ ফাঁকে তোর বিয়েটাও হয়ে যাবে।"

বেলার বিরক্তি আরও এক কদম চড়ে গেল। মাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বললো,

---"তুমি তোমার আজগুবি কথা বন্ধ করবে? পাত্রপক্ষ যাওয়ার পর আমি যাবো, যাও।"


প্রভা বেগম তবুও দিরুক্তি করলেন। কিন্তু বেলা শুনলো না। ঠিকই বিকালের পর অর্থাৎ সন্ধ্যা হওয়ার একটু আগে গেল ও বাড়ি। বাড়িটিকে অল্পস্বল্প বিয়ে বাড়িই মনে হচ্ছিল। বেলা দুরুদুরু বুকে বিহানকে নিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করলো। এখানে আসার তার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে ছিল না। বিশেষ করে ওই আয়াজ নামক ছেলেটির জন্য। মনে মনে প্রার্থনা করলো, আয়াজের সাথে যেন তার দেখা না হয়।


রেখা বেলাকে দেখে এগিয়ে এলেন। বিহানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

---"তোমরা এখন এলে যে? বিকালে এলে না কেন? আমি তো ভাবলাম আর আসবেই না।"

বেলা মিথ্যে বললো,

---"আসলে একটু কাজ ছিল তো আন্টি।"

রেখা অতটা গুরুত্ব দিলেন না সেকথায়। বেলাকে সোফায় বসিয়ে উৎফুল্ল মনে বললেন,

---"আমার আরুকে ছেলেপক্ষ পছন্দ করেছে বুঝলে? কয়েকদিন পর আকদ ওর। এরপর আরুর পরীক্ষা শেষে অনুষ্ঠান করে উঠিয়ে নিবেন। তুমি তো ছেলেকে দেখো নি, তাই না? দাঁড়াও আমি ছবি দেখাচ্ছি।"


বলে তিনি ফোন থেকে ছবি বের করতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। বেলা মৃদু হাসার চেষ্টা করলো। মনে মনে ভাবলো, রেখা আন্টি অনেকটা তার মায়ের মতোই। অত্যাধিক মিশুক। বেলা এবার আরুর দিকে তাকালো। রেখার ছোট মেয়ে। চাচাতো, মামাতো ভাই-বোনেরা ঘিরে ধরেছে তাকে। আরুও বেশ হেসে হেসে কথা বলছে তাদের সঙ্গে। আরু হতে নজর ফিরিয়ে বেলা বিহানকে খুঁজতে লাগলো। এখানে আসার পরপরই ছেলেটা তার বয়সী ছোট্ট সৈন্যদের পেয়ে কোথায় যে চলে গেছে! বেলা দেখতেও পায় নি। বাম দিকের জায়গাটাতে একটু খোঁজাখুঁজির অভিযান চালাতেই হঠাৎ আয়াজকে দেখতে পেল বেলা। হৃদযন্ত্র যেন সেখানেই ক্ষণিকের জন্য থমকালো। আঁখিজোড়া বিরক্ত হলো ভীষণ। আয়াজ এদিকেই আসছে। বেলার কাছাকাছি আসতেই মুচকি হেসে বেলাকে জিজ্ঞেস করলো,

---"কেমন আছো বেলা? তোমার পিচ্চি ভাইটা কোথায়?"


বেলা আয়াজের এত সুন্দর ব্যবহার দেখে আবারও অবাক হলো। এ ছেলে আসলে কি? বাড়ির সামনে মারপিট করে এখন আবার সাধুসন্ন্যাসী সেজে ঘোরাফেরা করছে। রাগ হলেও বেলা আয়াজের মতো হেসেই অকপটে বললো,

---"ভালো আছি ভাইয়া। বিহান বোধহয় ওদিকটায় খেলছে।"


জবান শুনে হালকা মাথা দোলালো আয়াজ। ফের রেখাকে বললো,

---"ভাইকে দেখেছ মা? বাগানে তো দেখছি না।"

রেখা ফোন ঘাটতে ঘাটতে জবাব দিলেন,

---"এই তোর কাছে আরুর হবু বরের ছবি আছে না? ওকে একটু দেখা তো। আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আর আদ্র তো দোকানে গেছে মনে হয়।"


বলে একটু থামলেন তিনি। সামনের দিকে তাকাতেই আবার বলে উঠলেন,

---"ওই তো, আদ্র এসে গেছে।"


রেখার ইশারাকৃত জায়গায় আয়াজের পাশাপাশি বেলাও তাকালো। এবার যেন আগের চেয়েও বেশি চমকালো সে। বিস্ফোরিত নয়নে চেয়েই রইলো। হৃদযন্ত্রের আওয়াজ বাড়ছে, ধুকধুক শব্দের গতি নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গেছে। আয়াজের মতো দেখতে আরও একটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। মুখে বিরক্তিভাব। দৃষ্টি বেলার আতঙ্কিত মুখশ্রীর পানে।

বেলার শরীর ঘামছে। নিশ্বাস ভারী হচ্ছে। আটকে আসা কণ্ঠে বহুকষ্টে রেখাকে সে জিজ্ঞেস করলো,

---"আমি এসব কি দেখছি আন্টি? আয়াজ ভাইয়া তো আমার পাশে। উনি ওখানে গেলেন কিভাবে?"


রেখা একটু থতমত খেয়ে বললেন,

---"ওটা আয়াজ না বেলা। ও তো আমার আরেক ছেলে আদ্র।"


বেলার অস্থিরতা কমলো না। আস্তে আস্তে চোখ বুজে এলো।


________________


চলবে~


প্রিয় বেলা

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

সূচনা পর্ব

গল্প রাজনীতি পর্ব ১৬ সমাপ্ত

 #রাজনীতি

#পর্ব_১৬_এবং_শেষ

#রাসমিক_আরিফিন_আসিফ


-------------------------------------------------------------------------------------


আসাদের কথা শুনে সেলিনা বেগম আনন্দের হাসি হাসলেন । সে কি হাসি । মায়ের মুখের হাসির কাছে হয়তো দুনিয়ার সব সুখ তুচ্ছ ।


-------------------------------------------------------------------------------------


অন্যদিকে , সিফাত প্রাপ্তির সামনে বসে আছে । হাত-বাঁধধা , পা-বাঁধা অবস্থায় বেশ অসহায় প্রাপ্তি । একমনে সিফাতের দিকে তাকিয়ে আছে । চোখ দিয়ে গিলে ফেলার উপক্রম । সিফাত নিজের চেয়ারটা হাত দিয়ে আরেকটু সামনে টেনে নিয়ে প্রাপ্তিকে বলে , "কেমন আছো ?"


প্রাপ্তি গলা ফাটিয়ে উত্তর দিলো , "মজা নিচ্ছিস তুই আমার সাথে ? হাত-পা খোল আমার । জানে মেরে দিবো একদম !"


- "উফ , কি তেজ ! সত্যি অসাধারন একটা চরিত্র তুমি । তোমার তো রাজনীতিতে থাকা উচিত । আমার কি মনে হয় জানো ? আসাদ ভুলে রাজনীতিতে চলে এসেছে । ওর জায়গায় তুমি হলে হয়তো এতদিনে অনেক সফলতা অর্জন করতে পারতে ।"


- "তুই কিন্তু এবার বেশি বাড়াবাড়ি করছিস । আমাকে এভাবে বেঁধে রাখার কারন কি ? তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমি ? শুধু শুধু আমার পথের কাঁটা কেনো হচ্ছিস ?"


- "গুড কোশ্চেন ! উত্তরটা হলো , তুমি আমার কোনো পাকা ধানে মই দাওনি । তবে , আমার ভাইয়ের পাকা ধানে মই দিয়েছো । আর নিজের ভাইয়ের ক্ষতি কিভাবে সহ্য করি , বলো ?"


- "কে তোর ভাই ?"


- "কেনো , আসাদ !"


- "দুইদিন আগে পরিচিত হওয়া একটা ছেলো তোর ভাই ? হাউ ফানি । আগে কি কমেডিয়ান ছিলি নাকি ?"


- "তা ঠিক না , তবে তুমি আসাদকে মারার জন্য যে জগতে পা দিয়েছো । সেই জগতের বাদশা আমি !"


- "মানে ?"


- "মস্টারের নাম শুনেছো কখনো ?"


- "আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাস্টার !"


- "হুম !"


- "না শোনার কি আছে ? তবে কেউ নাকি কখনো দেখেনি ওনাকে !"


- "সামনে আসলে না দেখবে । মাস্টার নামটা শুধু শুধু সবাই ভয় পায়না । মাস্টার একটা ব্রান্ড । মাস্টার নামটা ভালো মানুষদের জন্য যেমন আনন্দের কারন , ঠিক তেমনি খারাপদের জন্য ভয়ের আভা । তোমার কাছে ছোট্ট একটা প্রশ্ন , যদি মস্টার তোমাকে এখন মেরে ফেলতে চায় তাহলে তুমি কি করবে ?"


- "হাসালি । আমাকে মারতে এলে ও নিজে'ই ফেরত যেতে পারবে না । জিন্দা কবর দিয়ে দিবো !"


- "তাই ?"


- "কোনো সন্দেহ আছে ?"


- "ইয়াহ , অভিয়াসলি ।"


- "মাস্টারকে এনে দে , তোর সন্দেহ দূর করে দেবো !"


- "এইতো সামনে বসে আছি , মারো !"


সিফাতের কথায় হতভম্ব হয়ে যায় প্রাপ্তি । সিফাতের মুখে এমন কোনো কথা হয়তো ও আশা করেনি । করবেই বা কিভাবে ? দুইদিন আগে আসা একটা ছেলে , যে কিনা আসাদের ছায়ার তলে পড়ে থাকতো সে নিজেকে মাস্টার পরিচয় দিচ্ছে । সেই মাস্টার , যার নামে সম্পূর্ণ আন্ডারওয়ার্ল্ড চলে । যাকে কেউ কখনো চোখে দেখেনি । হঠাৎ কেউ এসে নিজেকে মস্টার বলে দাবি করলে , চকমকানোটা তো স্বাভাবিক । প্রাপ্তি ক্ষানিক অট্টহাসি হেসে বলে , "তোর কি মনে হয় ? আমি এখন মজা করার মুডে আছি ? তোর কমেডি তুই সার্কাসে গিয়ে শোনাবি । অনেক ইনকাম হবে । তবে আমাকে নয় !"


মুখে একটা মুচকি হাসির রেখা টেনে বলে , "ইফ ইউ থিংক , ইউ আর গুড এট পলিটিক্স । দেন ইউ শুড নো ওয়ান থিং , আই এম দ্যা মেকার অফ রোস্ট পলিটিশিয়ানস্ ।"


সিফাত বসা থেকে উঠে পকেট থেকে একটা সুইচ গিয়ার বের করে বলে , "দিস ইজ ফর ইউ । আই ডোন্ট থিংক দ্যাট , আই শুড ওয়েস্ট এ বুলেট অন ইউ । টু এন আনগ্রেটফুল পারসন !"


ব্লেডের ধারটা অতিরিক্ত ছিলো । প্রাপ্তির গলায় ছোঁয়ানোর সাথে সাথেই রক্ত বের হতে শুরু করে চুয়িয়ে চুয়িয়ে । সিফাত একটানে ব্লেডটা সড়িয়ে ফেলে প্রাপ্তির গলা থেকে । ছটফট করতে করতে প্রাণ হারায় প্রাপ্তি ।


রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে সিফাত মামাকে বলে , "মামা !"


- "হ , ভাইগনা কও !"


- "লাশের সাথে কি করতে হবে আশা করি জানো তুমি !"


- "হেইয়া আবার কইতে ? লাশটারে কুঁচি কুঁচি কইরা মুই তোমারে ছবি পাডাই দিমু আনে । তুমি যাও !"


সিফাত কোনো উত্তর না দিয়ে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে গেলো ।  


-------------------------------------------------------------------------------------


ন্যাশনাল পর্কের একটা বেঞ্চিতে বসে আছে আসাদ এবং সিফাত । আসাদ সিফাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে , "আমাকে এখানে আনলি কেনো ?"


- "কিছু কথা বলার জন্য !"


- "সেটা তো বাসায়ও বলা যেতো , এতদূর আসার কি দরকার ছিলো ?"


- "দরকার আছে বলেই তো আসলাম !"


- "আচ্ছা বল , কি কথা ?"


- "তোর রাজনীতিতে আসার কারন জানতে চাই আমি !"


- "শুনবি ?"


- "হুম , বল !"


- "আমার বাবা একজন সনামধন্য এমপি ছিলেন । আমি তখন অনেক ছোট । আমার পরিবারে , আমি , আমার একটা বড় ভাই , আব্বু আর আম্মু ছিলাম । ছোট হওয়ার সুবিধার্থে আদর অনেকটা বেশি'ই পেতাম বড় ভাইয়ের তুলনায় । তো একদিন সকালে আমি বায়না ধরি ঘুরতে যবো বলে । বাবাও উপয়ান্তর রাজি হয়ে যায় , কারন সেদিন ওনার কোনো কাজ ছিলো না । তাই আমরা চারজন মিলে চলে আসি গাজিপুর ন্যাশনাল পার্কে । ঠিক এইখান-টাতেই বসেছিলাম আমরা । অপজিশন পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন আসলাম সিকদার । পরপর দুইবার বাবার কাছে হেরে যাওয়া গ্লানিটা সে মেনে নিতে পারেনি । তাই সুযোগ পেয়ে ঐদিন হামলা করে আমাদের উপরে । বাবা-মা তো মারা গিয়েছিলেন , তবে আমি আর ভাই বেঁচে গিয়েছিলাম । আমাদের তাড়া করার এক পর্যায়ে আমি আর ভাই আলাদা হয়ে যাই । আমি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলাম । তবে ভাইয়ের সাথে আর কখনো দেখা হয়নি । আমি তো এটাও জানি না , ও বেঁচে আছে কিনা । এটাই আমার জীবনের ছোট্ট একটা গল্প । আর এই গল্পটাকে সমাপ্ত করতেই আমার রাজনীতিতে আসা । আসলাম সিকদারকে মারাই আমার মূল লক্ষ্য । হ্যাঁ , মারতে তো আমি এখন'ই পারি যদি চাই । তবে না , ও'কে আমি পাওয়ার দিয়েই মারবো । কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা । মজার বিষয় হলো , আমি যাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতাম । সেই রাফি'ই আমাকে সিকদারের সাথে হাত মিলিয়ে মারতে চেয়েছিলো !"


- "রাজনীতি বিষয়টা কি জানিস ? মনে কর আমার এক হাতে এক কাপ চা , আর অন্য হাতে একটা বিস্কুট । এক কাপ চায়ের আমি একটু খেলাম আর বিস্কুটটাকে একটু খাওয়ালাম । এটা হলো মানবতা । এবার সেই বিস্কুটটাকেই আমি খেয়ে ফেললাম , এটা হলো রাজনীতি । রাজনীতিতে নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করতে নেই ।"


- "হুম , সেটা হারে হারে টের পাচ্ছি ।"


- "এবার আসি তোর প্রশ্নের উত্তরে । আমি কেনো তোকে সাহায্য করি বা আমি এতকিছু কিভাবে জানি । হ্যাঁ , তোর কাছে সেই পার্সেল আসা থেকে শুরু করে সবকিছু'ই আমার করা । মাস্টারের নাম তো শুনেছিস ?"


- "হুম , সবাই'ই তো চেনে । তবে শুধু নামে , চেহারায় নয় । চেহারা কেউ দেখেনি ।"


- "আমি'ই সেই মাস্টার , আর তোর বড় ভাই !"


- "দেখ সিফাত , এখন আমি মজা করার মুডে নেই !"


- "তোর বড় ভাইয়ের বাম হাতে একটা জন্মদাগ ছিলো , নিশ্চয়ই তোর মনে আছে ?"


- "হুম , তুই জানলি কিভাবে ?"


সিফাত নিজের বাম হাতটা আসাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে , "দেখতো , এটা সেই দাগ কিনা ?"


আসাদ অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে সিফাতের দিকে । আসাদের অবাক চাহনি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি , নিজের হারানো ভাইকে খুঁজে পাবার আনন্দ । সিফাত জড়িয়ে ধরে কান্নারত অবস্থায় বলে , "তুই এতদিন আমার সাথে ছিলি অথচ আমি চিনতে পারিনি ।"


সিফাত আসাদকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে , "থাক , আর কান্না করতে হবেনা । চল অসমাপ্ত কাজটা সেরে ফেলি ।"


হাত দিয়ে চোখের জল মুছে , "কি কাজ ?"


- "সিকদারের প্রাণ নেয়া !"


- "তার আগে প্রাপ্তির সাথে আমার বোঝাপড়া আছে !"


- "প্রাপ্তি তো নেই !"


- "কোথায় গেছে ?"


- "হাওয়ায় মিলিয়ে দিয়েছি ।"


- "তাহলে চল , বাকি কাজটার জন্য আর সময় নষ্ট করে কি হবে ? নামের খোঁজে বেনামি !"


*****সমাপ্ত*****


[ গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি । আর গল্পটা অনেক সময় নিয়ে লিখেছি , অনেক অপেক্ষা করিয়েছি । তার জন্য দুঃখিত । এতদিন পাশে থাকার জন্য , অন্তরের অন্তস্তল থেকে ধন্যবাদ । আমার পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ রইলো ]

গল্প রাজনীতি পর্ব ১৫

 #রাজনীতি

#পর্ব_১৫

#রাসমিক_আরিফিন_আসিফ


-------------------------------------------------------------------------------------


- "না , তা ঠিক না । তোমাকে দেখে তো ভালোই মনে হচ্ছে । যাওয়া যায় তোমার সাথে !"


- "চলো তাহলে !"


মেয়েটি আসাদের হাত আকড়ে ধরে বলে , "হুম , চলো !"


-------------------------------------------------------------------------------------


রাফি ক্রিকেট খেলার বেশ বড় একজন ভক্ত । খেলা চলাকালীন সময়ে দুনিয়া ওলট-পালট হয়ে গেলেও রাফির কোনো হুশ থাকেনা । 


- "ভাইয়া !"


একটা পরিচিত মেয়েলি কন্ঠস্বরের আওয়াজে রাফি চমকে উঠলো । পাশে তাকিয়ে দেখে তুলি দাঁড়িয়ে । মুখে বিরল হাসি । সোফা থেকে নেমে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে বলে , "তুলি ? তুই এখানে কিভাবে এলি ?"


- "অবাক হলি ?"


আসাদ রাফির সামনে এসে দাঁড়িয়ে ধীর গলায় বললো কথাটা । রাফি বসা থেকে উঠে আমতা আমতা করে বলে , "আসাদ তুই ?"


- "এক্সপেক্ট করিসনি , তাই নাহ ? অবশ্য না করার'ই কথা ।"


- "আসলে...!"


- "ভাবিসনি কখনো এমন হতে পারে , কি তাই তো ? ঠিক'ই ভাবতি , তবে আজকে ভাগ্যটা হয়তো তোর সাথে ছিলো না । সেজন্যই আমার তুলির সাথে দেখা হয়ে গেলো । তুলিকে আমি অনেকদিন দেখতে চেয়েছি , এমনকি তোর গ্রামেও যেতে চেয়েছি । কিন্তু তুই আমাকে দেখাস নি , এমমনকি তোর বাড়িতেও নিয়ে যাসনি । কেনো করেছিলি সেগুলো ? যাতে নিজের বোনকে নিয়ে ব্যবসা করতে পারিস ?"


রাফি উচ্চ গলায় বলে , "কি সব যা-তা বলছিস ? ব্যবসা মানে কি , হ্যাঁ ?"


- "ব্যবসা নয়তো কি ? যে বয়সে মেয়েটা স্কুলে যাবে , খেলাধুলা লরবে । তা না করে ও কি করছে ? রেস্টুরেন্টে মানুষকে ফুল বিলাচ্ছে । বাহ , কি অসাধারন চিন্তা ভাবনা তোর ! এতই যখন টাকার দরকার ছিলো , তো আমাকে বলতি । আমি দিতাম , নিজের বোনকে দিয়ে এসব না করালেও পারতি ।"


- "আমার পাঁচ-দশ হাজার টাকার দরকার ছিলো না , যে তোকে বলবো । আমার দরকার লাখ টাকার । নাহলে আমার মা'কে আমি হারিয়ে ফেলবো !"


- "কি হয়ছে আম্মুর ?"


- "দু'টো কিডনি'ই নষ্ট হয়ে গেছে । ডাক্তার বলেছেন , প্রতিস্থাপন করা নাকি সম্ভব না । বাঁচিয়ে রখার একমাত্র উপায় হলো ডায়ালাইসিস । যেটা প্রতি মাসে দুই বার করে করতে হবে । এতো টাকা আমি কোথায় পাবো ?"


- "হাসালি রে রাফি । যাকে আমি মা বলে ডেকেছি , তার এতো বড় একটা অসুখ হয়েছে আর সেটা তুই আমাকে একবার বললি না পর্যন্ত । তোর তো শুধু টাকার দরকার ? আমি জীবন দিতেও ভাবতাম না । তোকে একটা কথা'ই বলবো , তুই সত্যি'ই আমার যোগ্য একজন বন্ধু । তোর মতো বন্ধু পেয়ে আমি ধন্য ।"


রাফি নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারছে না । আসাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে , "মাফ করে দে আমাকে । সত্যি'ই আমি বুঝতে পারিনি । জানিস , আমি না বুঝে কতো বড় একটা অন্যায় করতে যাচ্ছিলাম ।"


আসাদ রাফিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে , "কিসের অন্যায় ?"


- "আমি সিকদারের সাথে হাত মিলিয়েছিলাম । সিকদার বলেছিলো , তোকে মারতে পারলে আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দেবে । আমার মাথা ঠিক ছিলো না রে , আমি ওর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই । তখন আমার মাথায় শুধু টাকার চিন্তাই ছিলো , অন্য কিছু ভাবার অবস্থায় আমি ছিলাম না ।"


আসাদ মুচকি হেসে জবাব দিলো , "সিফাত একটা কথা প্রায়'ই বলে , শুনেছিস তো ? আমি নাকি রাজনীতির 'র'ও বুঝি না । এখন মনে হচ্ছে , হি ইজ রাইট । আমি বোকা , আসলেই বুঝি না কিছু । রাজনীতি আমার জন্য না । আজকে সেটা তুই বুঝিয়ে দিলি । শুকরিয়া , আমাকে রাজনীতি শেখানোর জন্য । আমি কৃতজ্ঞ !"


- "আসাদ , শোন..!"


রাফির সম্পূর্ণ কথা না শুনেই আসাদ তুলিকে নিয়ে বেড়িয়ে যায় । 


-------------------------------------------------------------------------------------


আসাদ বাইক চালাচ্ছে , আর তুলি পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে আসাদকে । এক পর্যায়ে আসাদ প্রশ্ন করে , "আম্মু কোন হাসপাতালে ভর্তি আছে , জানো আপু ?"


- "হুম , জানি তো ! আনোয়ার মেডিকেলের তিন তালার তিনশো বার নাম্বার রুমে !"


- "বাহ , তুমি দেখি সব জানো !"


- "জানবোই তো , আমি কি আর ছোট আছি নাকি ? আমি বড় হয়ে গেছি না ?"


- "হুম , অনেক বড় হয়েছো !"


- "আচ্ছা , তুমি আর ভাইয়া তখন রেগে রেগে কথা বলছিলে কেনো ? ভাইয়া কি কোনো ভুল করেছে ?"


- "নাহ , তোমার ভাইয়া কোনো ভুল করেনি । ভুল আমি করেছি !"


- "কি ভুল করেছো তুমি ?"


- "তোমার আম্মুকে আমি নিজের আম্মু ভেবেছি , এটাই আমার ভুল !"


- "এটা ভুল কিভাবে ? এটা তো ভালো , আমার এখন দুইটা বড় ভাইয়া আছে !"


আসাদ তুলির কথায় কোনো জবার না দিয়ে নিরবে একটা মুচকি হাসি দিলো । 


-------------------------------------------------------------------------------------


- "আম্মু , আম্মু দেখো কে এসেছে !"


তুলির ডাকে ঘুম ভাঙে সেলিনা বেগমের । মিটমিট করে তাকিয়ে দেখেন , তুলি ওনাকে ডাকছে । আর পাশে আসাদ দাঁড়িয়ে । আসাদকে দেখেই ওনার মুখ জুড়ে হাসি খিলখিল করে ওঠে । একটা হাত আসাদের দিকে বাড়িয়ে দিলে , আসাদ হাতটা আকড়ে ধরে । উনি কর্কশ গলায় বলেন , "জানো , আমি রাফিকে কতবার বললাম আসাদকে নিয়ে আসিস । আসাদকে নিয়ে আসিস । ও শুধু বলে , তুমি নাকি অনেক ব্যস্ত । আসতে পারবে না । তুমি'ই বলো , মায়ের সাথে দেখা করতে এলে কি ব্যস্ততা থাকে !"


- "আসলে আমি দেশের বাহিরে ছিলাম , তাই আসতে পারিনি । কিন্তু এখন থেকে প্রতিদিন এসে তোমার সাথে গল্প করে যাবো ।"


আসাদের কথা শুনে সেলিনা বেগম আনন্দের হাসি হাসলেন । সে কি হাসি । মায়ের মুখের হাসির কাছে হয়তো দুনিয়ার সব সুখ তুচ্ছ ।


-------------------------------------------------------------------------------------


অন্যদিকে...!!


চলবে...!!

গল্প রাজনীতি পর্ব ১৪

 #রাজনীতি

#পর্ব_১৪

#রাসমিক_আরিফিন_আসিফ


-------------------------------------------------------------------------------------


আসাদ হা হয়ে তাকিয়ে আছে সিফাতের মুখের দিকে । একটা রহস্যময়ী হাসি বিরাজ করছে সিফাতের মুখে । আসাদ ঐ হাসির কারনটা বুঝতে চেষ্টা করছে , কিন্তু পারছে না । এমতাবস্থায় সিফাত বলে , "আচ্ছা শোন , তোকে একটা কথা বলি । কয়দিন পরেই তো ভার্সিটি ইলেকশন , তাই না ? আর ভার্সিটি ইলেকশন শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যে কিন্তু তোর পালাও এসে পরবে । আমি জানি তোর মনে আমাকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে । আমার কাজকর্ম নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে । বা তোকে আমি এতকিছু বলি , কিভাবে বলি ? কেনো বলি ? সবকিছু নিয়েই অনেকগুলো প্রশ্ন জমা হয়েছে তোর মাঝে । তো তুই যদি সামনের ইলেকশনে জয়লাভ করিস তাহলে তোকে বলবো সবকিছু । তাই বলছি , এখন এসব নিয়ে মাথা ঘামাস না । সামনে যেটা আসতে চলেছে সেটা নিয়ে ভাব , বাকিটা আমি সামলে নেব ।"


আসাদের ঘোর এখনো কাটেনি । এতক্ষণ যেন সিফাতের কথা গুলো ও গিলে গিলে খেয়েছে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারেনি । তাই , সিফাতের কথাই মেনে নিল আসাদ । সিফাতের হ্যাঁ এর সাথে হ্যাঁ মিলালো । সিফাত মুচকি হেসে নিজের রুমে চলে যায় । রুমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সিফাতের ফোনটা বেজে ওঠে । নাম্বারটা পরিচিত দেখে বিলম্ব না করে কলটা রিসিভ করে , 


- "হ্যালো , মাস্টার !"


- "হুম , বল !"


- "প্রাপ্তির খোঁজ পেয়েছি ।"


- "মামা তোর সাথে আছে !"


- "হ্যাঁ মামা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন !" 


- "মামাকে ফোনটা দে !"


- "আচ্ছা !"


- "হ , ভাইগনা কও !"


- "প্রাপ্তিকে নিয়ে আমার পার্সোনাল রুমে রাখো । আমি রাতে আসবো ।"


- "ভাইগনা , তুমি কি করতে চাইতে আছো । মুই কিন্তু বুইজ্জা হালাইছি ।"


- "ধুর , উল্টা পাল্টা কথা বইলো না তো !"


- "আচ্ছা , মুই দেখতাছি । এখন রাখি তাইলে ।"


- "হুম !"


-------------------------------------------------------------------------------------


রাফি মাত্র ঘুম থেকে উঠলো । দূর্বলতাটা কাটেনি এখনো । বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হবার জন্য । ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় নিজের তাসরিফ জমিয়ে টিভিটা অন করলো । বেশ মনোযোগ দিয়ে টম এন্ড জেরি দেখছিল রাফি , হাসছিলোও বটে । মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে ফোনের শব্দ শুনে । বেশ বিরক্তি নিয়ে কলটা রিসিভ করে ফোনটা নিজের কানে ধরলো , "হ্যালো , কে ?"


- "আমি সিকদার !"


- "জ্বী , ভাই বলেন !"


- "ইলেকশনের তো আর বেশিদিন নেই রাফি । কিন্তু এখন পর্যন্ত একটা ভালো খবর তুমি আমাকে দিতে পারলে না ।"


- "ভাই , বাসায় তো এখন আসাদ আছে । আমি বরং আপনার সাথে দেখা করে কথা বলি ?"


- "আচ্ছা , ঠিক আছে । আমি অপেক্ষায় থাকবো তোমার কোনো ভালো খবরের । আর যদি সেটা না হয় তাহলে বাকিটা তো তুমি জানো'ই ।"


- "চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখিনি আমি । কিন্তু সময় এবং সুযোগ কোনটাই মিলছে না , সেজন্য একটু দেরি হচ্ছে । তবে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন , আপনাকে আমি হতাশ করবো না ।"


- "তাই যেন হয় । নাহলে কিন্তু আমিও আমার কথা রাখতে পারব না ।"


-------------------------------------------------------------------------------------


সময়ের টানে অনেকগুলো দিন অতিবাহিত হয়েছে । ভার্সিটি ইলেকশনও শেষ । আসাদের ইলেকশন আসতেও বেশি দিন বাকি নেই । নবাবী ভোজের রুফ টপে বসে সেই কথাগুলি'ই ভাবছিল আসাদ । হঠাৎ একটা বাচ্চা মেয়ে এসে ওর দিকে একটা গোলাপ বাড়িয়ে দিল । আসাদ প্রথমে কিছুটা অবাক হলো । পরক্ষণেই গোলাপটা নিজের হাতে নিয়ে মেয়েটিকে বলে , "এটা আমাকে কেনো দিলে আপু ?"


মেয়েটা হুট করে ক্ষানিকটা হেসে দিয়ে বলে , "আমার কাজ'ই তো এটা !"


হাসিটা বড়'ই মলিন । বোঝাই যাচ্ছে , মেয়েটি নিজের অবস্থাতে বেশ ভালো'ই আছে । আসাদ মেয়েটিকে নিজের কোলে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে , "কিন্তু এটা তো তোমার স্কুলে যাওয়ার সময় , খেলাধুলা করার সময় আপু । সেটা না করে তুমি এখানে মানুষকে ফুল দিয়ে বেড়াচ্ছো ।"


মেয়েটি বিষন্ন গলায় উত্তর দিল , "আমার কাছে তো টাকা নেই , যে আমি স্কুলে যাব । এই কাজ করে যতটুকু টাকা পাই সেটা দিয়েই আম্মুর চিকিৎসা করাচ্ছি । এখন আমি যদি সেটা না করে স্কুলে যাই , তাহলে আমার মা যে মারা যাবে । তখন আমি কার কাছে থাকবো ?"


- "কি হয়েছে তোমার মায়ের ?"


- "ডাক্তার আংকেল বলেছে , আমার মায়ের নাকি খুব কঠিন একটা রোগ হয়েছে । যেটার চিকিৎসা করতে অনেক টাকার প্রয়োজন । আমি তো ছোট , কেউ আমাকে বড় কোনো কাজে দেয়না । তাই এই কাজটাই করি ।"


- "এই কাজ করে যে টাকা পাও সেটা থেকে তোমার মায়ের চিকিৎসা হবে ?"


- "আমি তো বলতে পারব না , কিন্তু আমার একটা বড় ভাই আছে । যার কাছে আমি টাকাগুলো নিয়ে দেই ও'ই সবকিছু জানে ।"


- "তোমার ভাইয়ের সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দেবে ?"


- "দাঁড়াও আমার ভাইয়ের একটা ছবি আছে আমার কাছে , তোমাকে দেখাচ্ছি ।"


মেয়েটি আসাদের কোল থেকে নেমে দৌড়ে ভিতরে চলে গেলো । কিছুক্ষণ পরে হাতে একটা ছোট্ট ছবি নিয়ে এসে ছবিটা আসাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে , "এই দেখো , এটা আমার ভাইয়া ।"


তবে ছবিটা যার ছিল সেটা দেখার জন্য আসাদ হয়তো মোটেই প্রস্তুত ছিল না । নিজের চোখকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না । তবে বিষয়টাতে কোনো রিয়েক্ট না করে একটা মুচকি হাসি দিয়ে মেয়েটিকে বলে , "তুমি সিওর , এটাই তোমার ভাইয়া ?"


- "এখানে শিওর হওয়ার কি আছে ? আমার ভাইয়ের ছবি আমার কাছে থাকবে , এটাই তো স্বাভাবিক । তুমি কি বোকা গো ।"


কথাটা বলে খিল খিল করে হাসতে থাকে মেয়েটি । আসাদ আপন মনে বলে , "সত্যি'ই আমি অনেক বোকা ! সিফাত ঠিক'ই বলে , আমি মানুষ চিনতে পারিনি ।"


মেয়েটির মৃদু ধাক্কায় ধ্যান ভাঙে আসাদের । মেয়েটি বলে , "কি হলো , কথা বলছো না কেনো ?"


- "নাহ , কিছুনা ! তুমি যাবে আমার সাথে ?"


- "কিন্তু কোথায় ?"


- "তোমার ভাইয়ার কাছে !"


- "তুমি আমার ভাইয়াকে চেনো ?"


- "চিনি তো , আমার খুব ভালো বন্ধু ।"


- "না বাবা আমি তোমার সাথে যাব না । আমি শুনেছি , খারাপ লোকেরা আমাদের মতো ছোট ছোট বাচ্চাদের তুলে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয় । তুমিও যদি তাই করো , তখন ?"


- "আমাকে দেখে কি এমন মনে হচ্ছে তোমার ?"


- "না , তা ঠিক না । তোমাকে দেখে তো ভালোই মনে হচ্ছে । যাওয়া যায় তোমার সাথে !"


- "চলো তাহলে !"


মেয়েটি আসাদের হাত আকড়ে ধরে বলে , "হুম , চলো !"


চলবে...!!

গল্প রাজনীতি পর্ব ১৩

 #রাজনীতি

#পর্ব_১৩

#রাসমিক_আরিফিন_আসিফ


-------------------------------------------------------------------------------------


রাফি নিজের চোখ খুলে দেখে , সামনে মস্ত বড় একটা কেক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন ছেলে । রাফি কেকটা কাঁটতে যাবে তখনি বাহির থেকে কয়েকজন ছেলে এসে প্রাপ্তির মুখ চেপে ধরল । রাফি কিছু করতে গেলে ওদের মধ্যে থেকে একজন হকি স্টিক দিয়ে সজোরে আঘাত করে রাফির মাথায় । 


------------------------------------------------------------------------------------


- "এরপর আমার আর কিছু মনে নেই । আমার মাথায় কিভাবে ব্যান্ডেজ এলো , কে আমাকে হসপিটালে নিয়ে গেছিলো কিছুই না । শুধু একটু আগে কেউ একজন যখন আমাকে ডেকে তুলল , তখন চোখ খুলে দেখি একটা গাড়িতে বসে আছি । আর গাড়িটা ঠিক আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । তবে মজার বিষয় কি জানিস ? গাড়িতে যে ছেলেগুলো ছিল ওরা'ই আমাদেরকে বাঁচিয়ে ছিল । যেদিন আমরা রেজওয়ানের ম্যাসেজ মোতাবেক গোডাউনে দেখা করতে গিয়েছিলাম এবং আমাদের উপর হামলা হয় সেদিন ।"


আসাদ বুঝতে পারছে না কী বলবে । পুরনো চিন্তাগুলো এসে জেঁকে বসেছে , "যদি আমি প্রাপ্তির ছবির পেছনের লেখাগুলোর কথা চিন্তা করি , তাহলে তো প্রাপ্তি'ই দোষী । কিন্তু রাফি তো অন্য কথা বলছে । আর রাফির কথার সাথে আমার চিন্তা-ভাবনা গুলো মিলছে না । কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ।"


এদিকে সিফাতের মুখে মুচকি মুচকি হাসি , যেটা আসাদের চোখ এড়ালো না । আসাদ এই হাসির কারণ খুঁজে পাচ্ছে না । ক্ষানিক কৌতূহলের সাথে সিফাতকে জিজ্ঞেস করে , "কিরে তুই এভাবে হাসছিস কেনো ?"


সিফাত নিজের মুখের হাসি বজায় রেখে বলে , "হাসছি রাফির কথা শুনে ।"


- "রাফি কী এতক্ষণ হাসির কথা বলল নাকি ?"


- "আহ্হারে আসাদ , এখনও কিছু বুঝতে শিখলি না । নিজের মাথাটাকে একটু কাজে লাগা ভাই । এই মাথা নিয়ে তো রাজনীতি করতে পারবি না ।"


- "সব সময় এতো প্যাঁচানো কথা বলবি না তো , যা বলার খোলাখুলি স্পষ্ট ভাবে বলবি ।"


- "না , আমি সব কিছু বলতে পারবো না । যদি আমি'ই সবটা বলে দেই তাহলে তোর কি কাজ ? আমার পক্ষে যতটুকু বলা সম্ভব ছিল , বা যতটুকু করা সম্ভব ছিলো আমি করেছি । বাকিটা তুই নিজেই করে নে । হ্যাঁ যদি তোর সাহায্য লাগে তবে আমি আছি , কিন্তু তোকে তোর লক্ষ্যে পৌঁছে দেবো ? সরি রে , আমি পারবো না । নিজের লক্ষ্যে তুই নিজেই পৌছাবি ।"


- "যতটুকু করা সম্ভব বলতে ? বুঝলাম না ঠিক !"


- "কিছুনা , আচ্ছা তোরা থাক । আর রাফি এক কাজ কর , একটু ঘুমিয়ে নে । তাহলে ভালো লাগবে । শরীরের দুর্বলতাটা কেটে যাবে । আমি একটু বাহির থেকে আসছি , ছোট্ট একটা কাজ আছে ।"


- "হুম , যা !"


রাফি বেরিয়ে গেলে অনন্যা বলে , 


- "আসাদ , আমিও বরং যাই । অনেকটা দেরি হয়ে গেছে , মামা-মামী আবার চিন্তা করবে ।"


- "আমি পৌঁছে দিয়ে আসবো ?"


- "না তার দরকার হবেনা , আমি সিএনজি নিয়ে চলে যেতে পারবো । তুমি রাফির কাছে থাকো । যদি ওর কোনো কিছুর দরকার হয় । আর হ্যাঁ , যেকোন প্রয়োজনে সবার আগে ফোনটা যেন আমার কাছে আসে , কথাটা মাথায় রেখো ।"


- "যথাআজ্ঞা মহারানী , মাথায় থাকবে ।"


অনন্যা বেরিয়ে গেলে আসাদ গেট লক করে রাফিকে নিয়ে রুমে চলে যায় । 


------------------------------------------------------------------------------------


রুমটা বেশ গোছানো । তবে রুমটাতে আলোর বড্ড অভাব আছে । এত বড় রুমে মাত্র একটি লাইট । রুমের মাঝখানে একটি ইজি চেয়ার রাখা । যেখানে একটা মধ্যবয়স্ক ছেলে বসে আছে । আর ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরো অনেকগুলো ছেলে । ইজি চেয়ারে বসে থাকা ছেলেটি বলে , "এবার বল সম্পূর্ণ কাহিনী , কিভাবে কি করলি ?"


সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলে গুলোর মাঝে একটা ছেলে বলতে আরম্ভ করে , "ভাই রাফিকে আমরা একটা পুরাতন গোডাউন থেকে উদ্ধার করি । ও সেখান অজ্ঞান অবস্থায় ছিল , এরপর ও'কে আমরা হসপিটালে নিয়ে যাই । এবং প্রাথমিক চিকিৎসা করে বাসায় রেখে আসি । এতটুকুই , তবে গোডাউনে আমরা অন্য কাউকে খুঁজে পাইনি ।"


- "কিন্তু রাফি যে বলল , প্রাপ্তিকেও ওর সাথে নেওয়া হয়েছে । তাহলে তো গোডাউনে প্রাপ্তিরও থাকার কথা ।"


- "পুরো গোডাউনের রাফি ছাড়া একটা কাকপক্ষীও ছিল না ।"


ছেলেটার কথা শুনে ইজি চেয়ারে বসে থাকা ছেলেটি উঠে দাঁড়ায় । এবং কোনো কথা না বলে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে যায় । 


------------------------------------------------------------------------------------


সিফাত রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর আসাদকে ফোন দিচ্ছে । কিন্তু আসাদ ফোন তুলছে না । উপায়ান্তর ফোনটা পকেটে রেখে সিফাত বাসার দিকে হাঁটতে আরম্ভ করে । 


বাসার সামনে গিয়ে কলিং বেল প্রেস করলে , কিছুক্ষণ পর আসাদ এসে দরজা খুলে দেয় । আসাদের চোখের ঘুম ঘুম ভাবটা কাটেনি । হাত দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে বলে , "কিরে এত দেরী করে এলি যে ? তুই না বললি একটু পরে'ই চলে আসবি ?"


- "আমার কথা রাখ , তোকে যে এতগুলো ফোন দিলাম । ধরলি না কেনো ?"


- "কখন ফোন দিলি তুই ?"


- "এই তো কিছুক্ষণ আগে !"


- "তাহলে হয়তো ঘুমোনো ছিলাম , তাই শুনতে পাইনি !"


- "আচ্ছা তোর সাথে আমার কথা আছে , যা ফ্রেশ হয়ে ড্রইং রুমে আয় !"


- "আচ্ছা তুই বস , আমি চোখে মুখে পানি দিয়ে আসছি ।"


সিফাতকে ড্রইংরুমে বসিয়ে আসাদ ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে সিফাতের পাশে এসে বসে এবং বলে ,


- "বল কি কথা ?"


- "প্রাপ্তির কোনো খোঁজ পেলি ?"


- "নাহ প্রাপ্তির ফোন তো বন্ধ বলছে । এখন তো আমারও চিন্তা হচ্ছে , রাফির কথা মোতাবেক যদি ওরা প্রাপ্তিকেও তুলে নিয়ে যায় তাহলে তো প্রাপ্তির সামনে বিপদ । আমাদের উচিত প্রাপ্তিকে খুঁজে বের করা , তুই কি বলিস ? আমরা শুধু শুধু মেয়েটাকে ভুল বুঝলাম ।"


সিফাত মুখে একগাল হাসি নিয়ে বলে , "তুই এখনো বাচ্চাই রয়ে গেলি আসাদ । মানুষ তোকে যেটা দেখায় ,যেটা বোঝায় তুই ঠিক সেটাই বুঝে বসে থাকিস । নিজে থেকে কখনো কোনো রহস্যের উদঘাটন করার চেষ্টা করিস না । তোর এই একটাই সমস্যা । আর এই জিনিসটা তোকে মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দিতে পারে । কথাটা মাথায় রাখিস ।"


আসাদ হা হয়ে তাকিয়ে আছে সিফাতের মুখের দিকে । একটা রহস্যময়ী হাসি বিরাজ করছে সিফাতের মুখে । আসাদ ঐ হাসির কারনটা বুঝতে চেষ্টা করছে , কিন্তু পারছে না । এমতাবস্থায়...!! 


চলবে...!!

গল্প রাজনীতি পর্ব ১২

 #রাজনীতি

#পর্ব_১২

#রাসমিক_আরিফিন_আসিফ


-------------------------------------------------------------------------------------


- "রাফির কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না । খোঁজ লাগাও , আজকের মধ্যে ও'কে আমার চাই !"


- "আচ্ছা , মুই দেখতে আছি । তুই চিন্তা করিস না !"


কথা বলা শেষ করে লোকটা নিজের কল লিস্ট থেকে একটা নাম্বার বের করে কল লাগায় , 


- "এ তুই কোম্মে আছো আয় ?"


- "মামা আমিতো অফিসে আছি !"


- "তুই তায় অপিসেই থাক , মুই আইতাছি !"


- "হঠাৎ অফিসে আসবে কোনো কাজ ছিলো নাকি ?"


- "আইয়া কমু আনে !"


- "আচ্ছা !"


কল কেটে পুনরায় রওনা দেয় মগবাজের উদ্দেশ্যে । 


অফিসে পৌঁছে লোকটা ভিতরে গিয়ে দেখে সবাই তাস খেলা এবং হাসি ঠাট্টায় ব্যস্ত । টেবিলের উপরে চাপড় মেরে কর্কশ গলায় বলে , "তোগো কি এইগুলা করার লইগ্গা রাকছি নাকি ? কোন জাগা কি অয় , হেয়ার খবর তো রাহো না । খালি মজমা নিয়া থাহো না ?"


একজন বসা থেকে উঠে কিছুটা আগ্রহ নিয়ে বলে , "মজমা কি মামা ?"


- "নাটক করো মোর লগে ? জানা না তোরা ?"


- "জানলে কি আর জিজ্ঞেস করতাম বলো ?"


- "মজমা মানে , মদ-জুয়া-মাইয়া মানুষ ।"


ছেলেটা দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরে বলে , "তোমার এই কথা শোনার আগে আমি বধির হয়ে গেলাম না কেনো ?"


- "অভিনয় এট্টু কোম কর বোজ্জো ? নাইলে উস্টা মাইরা দাঁত কয়োডা ভাইঙ্গালামু ।"


- "ওকে মামু !"


- "ভেটকি মাইরো না । যে কামের লইগ্গা আইছি , হেইয়া হোন ।"


- "হুম , বলো না !"


- "রাফি নাকি নিখোঁজ । ভাইগনা মোরে ফোন দেছেলে । তোগো উফার নাকি দায়িত্ব আছেলে ওগো দেইক্কা হুইন্না রাহার ?"


- "মামা , ভাই তো আমাদের বলছিলো আসাদের উপরে নজর রাখতে । রাফির ব্যাপরে তো কিছু বলেনি ।"


- "তোমাগো কয় নাই , হেইর পানে তোমরা করও নায় । হাত তালি দিমু মুই ?"


কেউ কিছু বলছে না । নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রয়েছে । মামা আবার বলে , "হোন , সবাইরে কামে লাইগ্গা যাইতে ক । যতো তাড়াতাড়ি পারো রাফিরে খুইজ্জা বাইর কর । নাইলে ভাইগনা যে কি করবে হেয়া কিন্তু মুই কইতে পারি না ।"


- "আচ্ছা মামা , তুমি নিশ্চিন্ত থাকো । আমরা দেখছি কি করা যায় ।"


- "তোগো জ্বালায় আর নিশ্চিন্ত থাহার কোনো কায়দা আছে নাকি আয় ? গেছেলাম দুই প্যাগ মারমু বইল্লা কিন্তু ভাইগনা ফোনডা দেছে এমন সময় , আহ্হারে ।"


- "তুমি তাহলে যাও খাইতে , আমরা কাজে গেলাম ।"


ছেলেগুলো রুম থেকে বেড়িয়ে গেলে । মামা একটা চেয়োর টেনে বসে পড়লেন । কপালে হাত দিয়ে বলেন , "এক্কালে ঘাইম্মা গেছি রে । বুড়া অইছি , এতো কাম করা যায় ?"


আচমকাই নিজের জীভ দাঁত দিয়ে কেটে বলেন , "ওমা , এয়া মুই কি কই ? মুই তো এহনো জুয়ান , বুড়া ক্যামনে অইলাম । এহনো তো ভাইগনার লইগ্গা এট্টা মামি আনতে অইবে । মোর বা দোষ কোতায় । এতো প্রেসার দেলে কি মাতা ঠিক থাহে নাকি ?"


মামা নিজেই নিজের সাথে বক বক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । 


-------------------------------------------------------------------------------------


আসাদ ড্রয়িং রুমে পাইচারি করছে । সিফাত এবং অনন্যাও আছে অবশ্য । অনন্যা আসাদকে শান্ত করতে না পেরে নিজেই চুপটি মেরে বসে আছে সোফার উপরে । সিফাত বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছে যে , "রাফি ফিরে আসবে , ওর কিছু হবেনা ।"


কিন্তু আসাদ মানতে নারাজ । সচক্ষে রাফিকে দেখা না অবধি আসাদের মনে শান্তি মেলবেনা ।


দুপুরেও কিছু খায়নি ছেলেটা । আসাদ না খাওয়ায় সিফাত এবং অনন্যার পেটেও কিছু পড়েনি । মুখটা শুকিয়ে গেছে চিন্তায় চিন্তায় । আসাদের লোকজনও কোনো খোঁজ পাচ্ছে না । 


কিছুক্ষন পরে ডোর বেল বাজলে আসাদ গিয়ে গেট খুলে দেখে রাফি দাঁড়ানো । মাথায় ব্যান্ডেজ পেঁচানো আছে । ব্যান্ডেজের কোনা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে চুয়িয়ে চুয়িয়ে । রাফিকে আসাদ নিজের বুকের সাথে মিলিয়ে নিয়ে বলে , "তুই ঠিক আছিস তো ভাই ? কতটা চিন্তায় ফেলেছিলি জানিস ? দম বন্ধ হয়ে আসছিলো ।"


রাফি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে , "আরে আমার কিছু হয়নি । জাস্ট মাথায় একটু চোট লেগেছে ।"


- "কিভাবে হলো এসব ? নিশ্চয়ই প্রাপ্তির কাজ তাই না ?"


- "ভিতরে চল বলছি সব । দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না । মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা ।"


- "হুম , চল । চল !"


আসাদ রাফিকে ধরে ভিতরে সোফায় নিয়ে বসালো । অতঃপর বলে , "একটু ঘুমিয়ে নিবি নাকি ? তাহলে মনে হয় আরাম লাগবে ।"


- "নাহ , লাগবে না । আমি ঠিক আছি ।"


- "তোর এই অবস্থা হলো কিভাবে ? প্রাপ্তি করেছে তাই না ? ও'কে তো আমি মেরেই ফেলবো ।"


আসাদ উত্তেজিত হলে রাফি শান্ত গলায় বলে , "আরে না , প্রাপ্তি কিছু করেনি ।"


- "প্রাপ্তি'ই তো তোকে ক্যান্টিনের পিছনের গেটে নিয়ে গেছিলো ।"


- "পুরো কথাটা তো শুনবি নাকি ?"


- "বল , শুনছি ।"


- "আজকে যে আমার জন্মদিন ছিলো সেটা তোর মাথায় আছে ?"


- "আজকে তোর জন্মদিন ?"


- "হুম , জানি হয়তো কাজের চাপে ভুলে গেছিস । তবে প্রাপ্তির মনে ছিলো । আর ও আমাকে ক্যান্টিনের পিছনের গেটে নিয়ে গিয়ে , 


-------------------------------------------------------------------------------------


-"কি ব্যাপার এখানে আসলে কেনো ? ওখানে সবার সামনেই তো বলতে পারতা !"


- "হুম , পারতাম তবে সারপ্রাইজটা আর থাকতো না ।"


- "কিসের সারপ্রাইজ ?"


- "নিজেই নিজের বার্থডে মনে রাখতে পারো না , আর বলছো কিসের সারপ্রাইজ ?"


- "আজকে আমার বার্থডে ছিল ?"


- "নাগো আমার ছিল !"


- "কিন্তু আমার বার্থডে হলে আসাদ নিশ্চয়ই উইশ করতো ওর তো ভুলে যাওয়ার কথা না ।"


- "সে তো এখন অনন্যাকে নিয়ে ব্যস্ত । তোমার বার্থডে মনে রাখার সময় কি তার কাছে আছে নাকি ?"


- "এভাবে বলোনা , ছেলেটার মনটা খারাপ ছিল । তারপর তুমি ওর উপরে রাগ করছো , কথা বলো না । সেজন্য হয়তো অনন্যার সাথে একটু সময় কাটিয়ে নিজের মনটা ভালো করতে চেয়েছিল ।"


- "বাহ আমি রাগ করছি বলে অন্য মেয়ের সাথে ঘুরে নিজের মন ভালো করতে হবে তাই না ? আমাকে মানিয়ে নেয়া যায়না । তার উপরে তুমি জানো , ও আমাকে কি বলছে ? আমি নাকি ও'কে মারতে চাই , ও আমাকে নাকি কতকিছু শিখাইছে । এগুলো কেনো বলল , কি জন্য বলল কিছুই বুঝলাম না ।"


- "ধুর , বাদ দাও তো ওর কথা । মন ভালো হলে ঠিক'ই ফিরে আসবে । এখন বলো আমার জন্য কি সারপ্রাইজ আছে ?"


- "চোখ বন্ধ করো ।"


রাফি নিজের চোখ বন্ধ করে বলে , "এই নাও করলাম ।"


- "ওয়ান টু থ্রি , সারপ্রাইজ !"


রাফি নিজের চোখ খুলে দেখে , সামনে মস্ত বড় একটা কেক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন ছেলে । রাফি কেকটা কাঁটতে যাবে তখনি বাহির থেকে কয়েকজন ছেলে এসে প্রাপ্তির মুখ চেপে ধরল । রাফি কিছু করতে গেলে ওদের মধ্যে থেকে একজন হকি স্টিক দিয়ে সজোরে আঘাত করে রাফির মাথায় ।  


চলবে...!!