গল্প তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল পর্ব ৩২

 তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল

পর্ব_৩২

সারিকা_হোসাইন


★★★

ডিসেম্বর মাস,ঢাকায় একটু একটু শীত পড়তে শুরু করেছে।শীতের আমেজ চার পাশে পরিলক্ষিত।সন্ধ্যা নামতেই হালকা ধোয়ার মতো কুয়াশা জাল বিছিয়ে দিচ্ছে সর্বত্র।

আজ স্বর্গের  গায়ে হলুদ।বিয়ে নিয়ে প্রতিটা মেয়ের অনেক কল্পনা জল্পনা থাকে।স্বর্গ ও তার ব্যাতিক্রম নয়।গায়ে হলুদ থেকে শুরু করে রিশিপশন পর্যন্ত সব কিছু মন মতো হওয়া চাই।


নাফিজ মাহমুদ এর বাড়ী আত্মীয় স্বজনে গিজগিজ করছে।বড় বড় আর্মি অফিসারের ছোট ছোট বাচ্চাগুলো ঘরময় দৌড়ো দৌড়ি করে এই সন্ধাটাকে আরো চাঞ্চল্যকর করে তুলেছে।


ছোট বড় প্রত্যেকে আজ কাজে ব্যাস্ত।কেউবা ফল ডেকোরেশন করছে,কেউবা পায়েস এর থাল সাজাচ্ছে কেউবা আবার গার্ডেন এর পাশে হলুদের স্টেজ সাজাতে ব্যাস্ত।


আজকের এই মধুমাখা হলুদ  সন্ধ্যায় স্বর্গ গায়ে জড়িয়েছে কাঁচা হলুদ রঙের জামদানি সাথে গোলাপি রঙের জারবেরা  আর জুঁই ফুলের অধফোটা  কুঁড়ির তৈরি গহনা।

মুখমন্ডলে হালকা মেকআপের টাচ,তরতরে সোজা সিল্কি বাদামি চুলগুলো আজ সে কার্ল করেছে।ঠোঁটে গ্লোসি হালকা  গোলাপি রঙের লিপস্টিক।


পার্লার থেকে হেনা আর্টিস্ট এসে দুপুরেই খুব সুন্দর করে মেহেদী পরিয়ে দিয়ে গেছে

মুহিত পই পই করে বলেছে দুই হাতের তালুতেই ডিজাইনের  ভীড়ে তার নামের অক্ষর থাকা চাই ই চাই।

স্বর্গ হেনা আর্টিস্ট কে বার বার বলে দিয়েছে ডিজাইনের প্রত্যেকটা ফাঁকা জায়গায় যেনো সে "M" লিখে দেয়।


স্বর্গের এহেন পাগলামি কাণ্ডে হেনা আর্টিস্ট ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।


পিউ এসে স্বর্গকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে,কোথাও কোনো সাজে ভুল আছে কি না।

নাহ সেরকম কিছুই দৃষ্টিগত হলো না।


"তোকে আজ রূপকথার রাজকুমারী দের মতো লাগছে "

বলেই চোখের নিচে থেকে কাজল এনে স্বর্গের গ্রীবাদেশে লাগিয়ে দিলো পিউ।


"আজ মেজর মুহিত তোকে দেখে জ্ঞান হারাবে"

বলেই কুনুই দিয়ে স্বর্গের হাতে গুঁতো দিলো পিউ।


আচানক কোথায় থেকে যেনো সুখ এসে ঢুকে পড়লো স্বর্গের কক্ষে।

কোমরে হাত দিয়ে বিজ্ঞের ন্যায় ঠোঁট ফুলিয়ে কিছু ভাবলো।

এর পর গমগমে কণ্ঠে বলে উঠলো

একটা সত্যি কথা বলবো?


পিউ মনে মনে ভাবছে  এখনই লাগবে দুটোর ঝগড়া আর সেই ঝগড়ায় নষ্ট হবে সাজ।


কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুখ বলে উঠলো

"তোকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে"


"আচ্ছা থাক আমি চলি বলেই দরজার কাছে এসে দাড়ালো সুখ।

স্বর্গের পানে দৃষ্টি বুলিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো এর পর চিল্লিয়ে বলে উঠলো

"তোকে আস্ত একটা ডাইনি লাগছে,পিশাচিনি।জিজু দেখলে নির্ঘাত হার্ট এট্যাক করবে"

বলতেই পায়ের স্যান্ডেল ছুড়ে মারলো স্বর্গ।


হাসতে হাসতে সুখ দৌড়ে পালালো।


নাফিজ মাহমুদ এর  বাংলোর সামনের গার্ডেন এর পাশে বিশাল এক খোলা জায়গা।সেখানেই সুন্দর করে গায়ে হলুদের স্টেজ সাজানো হয়েছে।

হলুদ গোলাপ আর সাদা রজনী গন্ধ্যার মিশ্রনে তৈরি হয়েছে স্টেজ টি।রাখা হয়েছে সোফা আর সেন্টার টেবিল।

বিভিন্ন ধরনের সুসজ্জিত খাবারের পসরা সাজানো হয়েছে সেই টেবিলে।


একটু পর নামিরা আর সোহাগ এলো বিশাল বড়ো এক আকর্ষণীয় কেক নিয়ে।


নামিরা আজকে হলুদ লেহেঙ্গা আর জলপাই রঙের ওড়না পড়েছে সাথে হালকা মেকআপ।


সোহাগ মুগ্ধ নয়নে দেখে যাচ্ছে নামিরাকে।

এই দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর সোহাগ নামিরাকে কখনো সাজতে দেখেনি।হয়তো সাজার মতো কোনো অবস্থাই তৈরি হয়নি এই কয়েক  বছরে।


"কে বলবে এই মেয়ের একটা দেড় বছরের বাচ্চা আছে?."


নামিরার সৌন্দর্য সোহাগের মনে হিংসের সৃষ্টি করে।

আবার মনে মনে নিজেকে বুঝ দেয় 

"এই অতীব সুন্দরী রমণীটি তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে এবং তার সন্তানের মা ।

এসব ভাবনা ভাবতেই সোহাগের বুকে হিমশীতল বাতাস প্রবাহিত হয়।


"কি দেখছো এমন ছ্যাবলার মতো?

"কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি সারা দিচ্ছনা শুধু দেখেই যাচ্ছ!


নামিরার তেজ পূর্ন স্বরে ধ্যান ভাঙলো সোহাগের।নিজেকে ধাতস্থ করে মিনমিন করে বলে উঠলো

"তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে নামিরা।

বলেই তড়িঘড়ি করে অন্যকাজে লেগে গেলো।


সকল কাজ কমপ্লিট, এখনই স্বর্গকে স্টেজে আনা হবে।মৃদু শব্দে হলুদের গান বাজছে,ছোট ছোট বাচ্চারা বক্সের সামনে বিভিন্ন ভঙ্গিতে নেচে যাচ্ছে।

 লাল রঙের সামিয়ানা যা গোল্ডেন জরি সুতায় কারুকাজ খচিত ।সেই সামিয়ানার চারকোনা ধরেছে চারজন মেয়ে।

স্বর্গ আগে আগে যাচ্চে পিছনে তার বান্ধবীরা গানের তালে তালে নেচে চলছে।

নাচতে নাচতে তারা স্বর্গকে এনে স্টেজে পাতা সোফায় বসালো।

এবার হলুদ ছোয়ানোর পালা।


প্রথমে মিসেস তারিন একটু হলুদ ছুইয়ে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন।এরপর তনুজা,নাফিজ মাহমুদ হলুদ ছুঁইয়ে কপালে চুমু দিয়ে সোফায় এসে বসলেন।

ধীরে ধীরে নামিরা,পিউ,সুখ সবাই হলুদ ছোয়ালো।


হঠাৎই ক্যাপ্টেন সৌম্য এসে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলে উঠলো

"হ্যালো,চেক ,ওয়ান,টু,থ্রি।


"এবার আপনাদের সামনে একটা ধামাকা হতে যাচ্ছে,সেই ধামাকা না আগে কেউ দেখেছে না শুনেছে।"


এবার মেজর আদ্রিয়ান  মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়ে সৌম্যের গলাগলি ধরে বলে উঠলেন,

সবাই ধামাকা দেখার জন্য রেডি?


সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো 

"ইয়েস"


প্রত্যেকের সমর্থন পাবার সাথে সাথেই নিভে গেলো সকল লাইটস।জলে উঠলো ফোকাস লাইট।


একটি উঁচু টুলে গিটার হাতে একটি ছেলে বসে আছে।

অন্ধকারে তার মুখ অস্পষ্ট।


কিন্তু স্বর্গের একমুহূর্ত সময়ও লাগলো না ঠাহর করতে মানুষটা কে?


"মানুষটা তার একান্ত ব্যাক্তিগত সম্পত্তি।


ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো মুহিতের পুরা অবয়ব।

মুহিত পড়েছে সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা সাথে স্বর্গের শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে কাঁচা হলুদ কুটি।হাতে ব্রাউন ফিতার নেভিফোর্স ঘড়ি।


স্বর্গ মোহনীয় দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে মুহিত কে।

স্বর্গের কাছে মনে হচ্ছে মুহিত পরিবীর সবচেয়ে  স্নিগ্ধ আর শুদ্ধতম পুরুষ।

যেই পুরুষকে কেউ ছুঁয়ে দেখেনি, যেই পুরুষের প্রীতিময়  সান্নিধ্য একমাত্র স্বর্গ ছাড়া কেউ পায়নি।

নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে তার নিজের কাছে।


গিটারের টুংটাং শব্দে ধ্যান ভাঙলো স্বর্গের।


নামিরা দুই হাতের সহিত ঢেকে ফেললো তার মুখ।


কোনোভাবেই নামিরা তার কান্না চেপে রাখতে পারছে না।


"এটাই তো সেই আগের মুহিত,যেই মুহিত দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর ধরে হারিয়ে গিয়েছিলো।"


"এটাই তার আদরের সেই চঞ্চল হাসিখুশি ভাই"


মিসেস তারিন চশমা খুলে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জ্বল নীরবে মুছে নিলেন।

তনুজা মিসেস তারিন কে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলালেন।


"মুহিত গুনে গুনে আট বছর পর গিটার হাতে ধরলো"


মুহিতের গিটারের সুরের সাথে বেজে উঠলো মিউজিশিয়ান দের সফট মিউজিক।

মুহিত গাইতে শুরু করলো


"তোমার জন্য সিন্ধুর নীল

"আরো হবে সপ্নীল।

উদাস দুপুরে রাগ বসন্তে গাইবে সোনালী চিল

তোমার যতো ভুল সব

নিমিষেই হবে ফুল।

তবু ভালোবাসি শুধু তোমায়

নিশিদিন সারা বেলা,,,,,,

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল আরো হবে স্বপ্নীল।


মুহিত গান শেষ করতেই সকলের করতালিতে মুখরিত হলো চারপাশ।

গিটার ছেড়ে মুহিত এগিয়ে আসলো স্বর্গের কাছে।

হলুদের বাটি থেকে হলুদ নিয়ে নিজের গালে মেখে সেই গাল ছোয়ালো স্বর্গের গালে,নাকে।


সকলেই হাত তালি দিয়ে বলে উঠলো আমরা মুহিত আর স্বর্গের ডান্স পারফর্ম দেখতে চাই।

নিমিষেই সকলে এক যোগে বলা শুরু করলো 

"মুহিত,স্বর্গ।"মুহিত -স্বর্গ"


মুহিত মাথা নিচু করে  এক হাত বুকে রেখে আরেক হাত বাড়িয়ে দিলো স্বর্গের পানে।


স্বর্গ মুহিতের আহ্বানে সায় দিয়ে আলতো করে চেপে ধরলো মুহিতের হাত।

উঠে দাঁড়ালো স্বর্গ।

ফাঁকা করা হলো স্টেজ।


বক্সে বেজে উঠলো সিলেক্টেড গান।


প্রথমে ছেলেদের দল উঠে গেলো স্টেজে।


সালামে ইস্ক সালামে ইস্ক  গানে নাচবে সবাই।


গানের মিউউজিক এর তালে তালে নেচে উঠলো 

মুহিত সৌম্য আর আদ্রিয়ান এর দল।

এক ঝাঁক তরুণ আর্মি অফিসার নিখুঁত ভাবে নেচে যাচ্ছে

সবাই হাত তালি দিয়ে উৎসাহ প্রদান করছে আর নাচছে।


মেয়েরাও উঠে গেলো স্টেজে।

কেউ কারো থেকে কম যাচ্ছে না।


পারফরম্যান্স শেষ হতেই সকলেই করতালিতে তাদের প্রশংসা জানালো।


সকল আচার অনুষ্ঠান মেনে আনন্দ ফুর্তিতে শেষ হলো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান।


――――

রাত প্রায় একটার কাছাকাছি।

স্বর্গ নিজ রুমে এসে শাড়ি গহনা খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।


হঠাৎ করেই কক্ষে মুহিত প্রবেশ করে দুম করে দরজা আটকে দিলো।


স্বর্গ উঠে দাঁড়াতেই মুহিত শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো স্বর্গকে।


"অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছি বউ।

"এমন ঘায়েল করা রূপ দিয়ে মেরে ফেলতে চাও নাকি আমাকে?


"এই দেখো বুকের এই জায়গাটায় চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে বলে আঙ্গুলি দিয়ে নির্দেশ করলো।


ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্বর্গ জিজ্ঞেস করলো 

"তার জন্য কি করতে আমাকে ফটাফট বলে কেটে পড়ো।

আমার ঘুম পেয়েছে।

কালকে বিয়ে অনেক ধকল যাবে।


ঠোঁটে একটা মিষ্টি দিয়ে দাও চলে যাচ্ছি বউ।


কন্ঠে সিরিয়াস ভাব এনে বলে উঠলো মুহিত―


"আমাকেও ঘুমুতে হবে  বউ কাল থেকে তো আর ঘুমানো যাবে না।


স্বর্গ টুপ করে চুমু খেয়ে সরে দাঁড়ালো।

"হয়েছে দিয়েছি যাও এখন!


মুহিত আহত স্বরে জিজ্ঞেস করলো


"এটা কি দিলি বউ?


"কি আবার? চুমুই তো চাইলে"


"আমি কি ফকির ?চুমু ভিক্ষে চাইতে এসেছি?


ভালো করে দেহ!


"মেজর মুহিত কালকে মজা বোঝাবো তোমাকে তুমি এখন ভাগো এখান থেকে।

বলে বেলকনিতে টেনে এনে পাইপ নির্দেশ করে বলে উঠলো নেমে যাও।


অসহায় মুহিতকে বারান্দায় ফেলে মুখ টিপে হেসে বেলকনির দরজা আটকে দিলো স্বর্গ।


মুহিত সহসাই মেসেজ পাঠালো স্বর্গের ফোনে


"আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া?

কালকে এর শোধ তুলবো 

রেডি থাকবেন মিসেস ওয়াসিফ।


চলবে

গল্প তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল পর্ব ৩১

 তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল

পর্ব_৩১

সারিকা_হোসাইন


*********

সময় বহমান,নদীর স্রোত যেমন ধীরে ধীরে বয়ে চলে ঠিক সেভাবেই সময় চলে যায় সকলের অলক্ষে।বিভিন্ন ব্যাস্ততায় মানুষ তা ঠাহর করতে পারেনা।যে সময় একবার চলে যায় তাকে আর কখনো ফিরিয়ে আনা যায় না শুধু থেকে যায় আফসোস।


ঠিক সেভাবেই প্রত্যেকের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে দীর্ঘ একটি বছর।

এই এক বছরে মুহিত তার জীবনের সকল ঝামেলা উৎপাটন করতে সক্ষম হয়েছে।শুধু তাই নয় তার বাবার তৈরি পুরাতন বাসটাকে সু সজ্জিত করে দিয়েছে নতুন রূপ।


স্বর্গ এখন একজন মিলিটারি ফিজিসিয়ান ক্যাপ্টেন,নিজের দায়িত্ব কর্তব্যে এক চুল গাফিলতি তার পছন্দ নয়।


নামিরার ছেলেটা এখন সাড়ে চৌদ্দ মাসে পা দিয়েছে।আধো আধো বুলিতে নানান ধরনের শব্দ আওড়ায় সে আর থপ থপ করে ঘুরে বেড়ায় সারা বাড়ি।


সোহাগ তার পূর্বের ভার্সিটিতে আবার ইংলিশ প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছে।


ধরতে গেলে মিসেস তারিনের পরিবার অনেকাংশেই সুখী সমৃদ্ধি পরিবার।

সব কিছুই আছে মিসেস তারিনের সংসারে শুধু নেই আদরের ছোট পুত্র মুকিত আর ভালোবাসার মানুষ টা।


――――――

মিসেস  তারিন ,মুহিত,সোহাগ আর নামিরা বসে আছে নাফিজ মাহমুদ এর ড্রয়িং রুমে।

একটু আগে বিভিন্ন নাস্তার পসরা সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছেন বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ড  ফতেমা।

মুহিত চোরের মতো গোপনে গোপনে খুঁজে চলেছে তার মনের রাজ্যের রাজকুমারী কে।কিন্তু কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছে না।

মুহিতের ধৈর্য্যের বাঁধ যেনো ভেঙে যাচ্ছে,বুক ধুকপুক করছে।

দীর্ঘ ছয়মাস ধরে সে তার প্রিয়তমা কে দেখতে পারছে না।


মুহিত,সৌম্য আর আদ্রিয়ান  নিজেদের পদমর্যাদা বাড়াতে কঙ্গো তে  গিয়েছিলো ছয়মাসের একটা মিশনে ।

সেখানে মুহিতের কাজ ছিলো বিভিন্ন ডিভাইস এর উপর।সারাক্ষন স্ক্রিনে নজর রাখতে হতো।

যার জন্য মুহিত বাসার কারো সাথেই খুব একটা যোগাযোগ রাখতে পারেনি।

মাঝে মাঝে দুই তিন মিনিটের জন্য কথা বলার সুযোগ পেতো।আর নেটওয়ার্ক এর অবস্থা এতো বাজে, ভিডিও কলে কথা বলার সৌভাগ্য হয়নি কারো সাথেই মুহিতের।


এজন্য মিশন থেকে ফিরেই পরিবার নিয়ে এসেছে নাফিজ মাহমুদ এর বাড়িতে।

আজই সে আংটি পরিয়ে রাখবে এবং মিশনের সকল কাজ অফিসিয়াল সাবমিট করে এক সপ্তাহের মধ্যে স্বর্গকে নিজের ঘরে তুলবে।


স্বর্গ অবশ্য জানেনা আজ মুহিত আসবে,তনুজাও জানতেন না হুট করে মুহিত তার ফ্যামিলি নিয়ে চলে আসবে।


মুহিত কিছুক্ষন উশখুশ করে নামিরাকে চিমটি কাটলো।

নামিরা চোখ গরম করে মুহিতের দিকে তাকাতেই অসহায় এর মত ফেস করে মুহিত বলে উঠলো

―মামী কে জিজ্ঞেস কর না আমার বউটা কোথায়?


নামিরা কটমট করে বললো এতো নির্লজ্জ কেনো তুই?বিয়েটা আগে হতে দে, পরে না হয় সারাক্ষন বউ বউ করিস।


মুহিত দাঁত পিষে বললো 


"যেটা করতে বলেছি সেটা কর না হলে তোর ছেলের কান মলে দিব আমি।"


ছেলের কান মলার কথা শুনতেই ছেলের দিকে তাকালো নামিরা,দেখতে পেলো মুহিত অলরেডি তার ছেলে 'শুদ্ধর " কান ধরে আছে।


বাসায় গিয়ে তোকে দেখছি বলেই  নামিরা ইতস্তত করে বলে উঠলো 

―মামী স্বর্গকে কোথাও দেখছি না,


তনুজা স্মিত হেসে বললেন 


"আসলে তোমরা আসবে এটা স্বর্গ জানতো না,ও সিএমএইচ এ গেছ। ইমারজেন্সি কল করেছে ওখান থেকে"


মিসেস তারিন বলে উঠলো  


"আসলে আজ শুক্রবার এজন্য আমরা ভেবেছি ও হয়তো বাসাতেই আছে!তাই সারপ্রাইজ দিতে এলাম!


"সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম "

মিনমিন করে বলে উঠলো মুহিত।


একটু পর হন্তদন্ত হয়ে নাফিজ মাহমুদ বাসায় ফিরে মিসেস তারিনের সাথে কুশল বিনিময় করে মুহিত কে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেলেন।


"তা বাবা মুহিত ওখানে কি অনেক পরিশ্রম হয়েছিল নাকি?একদম শুকিয়ে কালো হয়ে গেছো!"


""আসলে স্যার প্রচুর ঘুম কামাই করতে হয়েছে,দিনে রাতে মিলিয়ে আমি সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো সময় পেয়েছি ঘুমানোর জন্য।"


"আর তাছাড়া পার্সোনাল কিছু দুশ্চিন্তা ও ছিলো।এজন্য নিজের ঠিকঠাক যত্ন নিতে পারিনি"


হঠাৎই নাফিজ মাহমুদ তনুজাকে ডেকে স্বর্গ কোথায় জানতে চাইলেন।


"বাপী আমি এখানে"

ক্লান্ত স্বরে জবাব দিলো স্বর্গ।


স্বর্গের আকস্মিক জবাবে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো মুহিত।বুকে তার তোলপাড় শুরু হয়েছে।শূন্য বুক খাঁখাঁ করছে।হৃদয়ের অলিন্দ বারবার আন্দোলন করে যাচ্ছে স্বর্গকে জড়িয়ে ধরার জন্য।


ড্রয়িং রুমে মুহিতকে দেখে থমকে দাঁড়ালো স্বর্গ।

শ্বাস রোধ হয়ে আসছে এমন অনুভূতি হচ্ছে থেকে থেকে।বুকের ছাতিতে কে যেনো জোরে জোরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে শুধু।


এতোগুলো দিন মুহিতকে না দেখে কিভাবে থেকেছে  স্বর্গ এই কথা সে ছাড়া আর কেউ জানে না।

মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়েছে পাখি হয়ে মুহিতের কাছে চলে যেতে।কিন্তু তা কি আর সম্ভব?


মুহিতের বুকে হামলে পরে শান্তির শ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে স্বর্গের।কিন্তু বাবা আর ফুপির সামনে সম্মান বিসর্জন দিবে কিভাবে?


"ফুপি তুমি বসো আমি ফ্রেস হয়ে আসছি"

বলেই এক প্রকার দৌড়ে নিজের কক্ষে চলে আসলো স্বর্গ।


এই মুহিত টা তাকে ভীষন ভাবে কাবু করেছে তার প্রতি ।ভালোবাসা হীন এক দন্ড তার সামনে দাঁড়ানো যায়না।সারাক্ষন মাথায় চুমু,হাগ,কামড় দেয়া এসব ঘুরে বেড়ায়।

"এ কেমন অসভ্য ইচ্ছে??


মুহিত তার বুকের তোলপাড়ের কারনে বসে থাকতে পারছি না।"


"এখনই স্বর্গের কাছে যাওয়া চাই"


হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেলো মুহিত,অনুরোধের স্বরে নাফিজ মাহমুদ কে উদ্দেশ্য করে বললো

"স্যার আমি কি একবার একান্তে ওর সাথে কথা বলতে পারি"?


প্রাণ খুলে হেসে উঠলেন নাফিজ মাহমুদ।মুহিত কে তিনি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন।যেমন ভদ্র তেমন শান্তশিষ্ট ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন একটি ছেলে ।ঠিক যেনো বাপের কার্বন কপি।

চোখ বন্ধ করে এই ছেলেকে বিশ্বাস করা যায়।

আর যাই হোক কারো কোনো ক্ষতি এই ছেলের দ্বারা সম্ভব নয়।


মাথা ঝাকিয়ে নাফিজ মাহমুদ বলে উঠলেন

"হপ ব্যাটা,এটা আবার অনুমতি নেবার কি আছে?তোমার ই তো হবু বউ,যাও কথা বলে এসো।আমরা অপেক্ষা করছি"


মুহিত দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।


স্বর্গ ঝটপট শাওয়ার নিয়ে কোনো রকমে এলোমেলো করে একটা বেগুনি রঙের জামদানি পরে টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো।


মুহিত আস্তে করে দরজায় নক করলো।

স্বর্গ ভেবেছে তনুজা এসেছে বোধ হয় তাই গলার আওয়াজ উঁচু করে বলে উঠলো

"দরজা খোলাই আছে ,ভেতরে এসো"


মুহিত দুই হাতের ধাক্কায় সপাটে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা ভিড়িয়ে দিলো।


আয়নার দিকে তাকিয়ে চুল মুছতে মুছতে হঠাৎ ই আয়নার প্রতিবিম্বে মুহিতের অবয়ব দেখে ঈষৎ কেঁপে উঠে স্বর্গ।


মুহিত  দ্রুত পায়ে পেছন থেকে কোমর জাপ্টে ধরে থুতনি গুঁজে দেয় স্বর্গের কাঁধে।


আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে স্বর্গ।হাত থেকে পরে গেলো ভেজা টাওয়েল।

শক্ত পুরুষালী হাতের সহায়তায় স্বর্গকে নিজের দিকে ফেরালো মুহিত।


এলোমেলো শাড়ি,ভেজা  চুল, স্নিগ্ধ মুখ সব মিলিয়ে মুহিত কে বেসামাল করে দিচ্ছে।ধবধবে সাদা অঙ্গে বেগুনি পাতলা জামদানি টি জলজল করছে।

মুহিতের মনে হচ্ছে এই শাড়িটি স্বর্গের জন্যই আলাদাভাবে তৈরি মরা হয়েছে।


স্বর্গের এহেন আগুন ঝরা রূপে ঝলসে গেলো মুহিত।মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো তার।

এসেছিলো অনেক কথাই বলতে,কিন্তু এখন  কিছুই মনে নেই তার।


নিজের একান্ত ব্যাক্তিগত মানুষের এমন রূপ কোনো প্রেমিক পুরুষ সহ্য করতে পারবে?


মনের সাথে মুহিতের কিছুক্ষণ নীরব যুদ্ধ চললো।এর পর করে ফেললো এক পাগলামি।


শাড়ির ফাক গলিয়ে স্বর্গের  মেদহীন তলপেট মুচড়ে ধরলো মুহিত,


স্বর্গ নিজেকে সামলাতে না পেরে খামচে ধরলো মুহিতের চুল।


নেশাতুর চোখে স্বর্গের পানে তাকিয়ে স্বর্গের লাল ঠোঁট দুটো দুই আঙুলের সহিত টেনে টিপে ধরলো।


হঠাৎই দরজায় করাঘাত এর আওয়াজ পাওয়া গেলো।

স্বর্গ ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো মুহিত পাশে থাকা চেয়ারে ঝিম মেরে বসে গেলো।


রুমে প্রবেশ করে উৎসুক হয়ে নামিরা জানতে চাইলো

"কি করছিস তুই?স্বর্গ কোথায়?

আর এই শীতের মধ্যে  এভাবে এতো ঘামছিস কেনো ?


মুহিত আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই ঠিকঠাক ভাবে নিজেকে পরিপাটি করে  বেরিয়ে এলো স্বর্গ।


নামিরা স্বর্গের হাত ধরে টেনে নিয়ে বললো 

"এসো সবাই অপেক্ষা করছে"


নামিরা চলে যেতেই  কিছুক্ষণ চুপ করে  থেকে চোখ বন্ধ করে ফুঁস করে নিশ্বাস নিলো মুহিত।এরপর নিজেকে স্বাভাবিক করে বাইরে বেরিয়ে এলো।


ড্রয়িংরুমে সকলেই বসে আছেন,গল্প গুজব করছেন।একটু পর মুহিত এসে সেই আড্ডায় সামিল হলো।

সকলের মাঝে হঠাৎই মিসেস তারিন বলে উঠলো


"আমি যদি আজকে আমার আম্মাকে আংটি পরিয়ে যাই কারো কোনো আপত্তি আছে?"


নাফিজ আর তনুজা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বলে উঠলেন

"কি বলিস আপা আপত্তি কেনো থাকবে?"


মিসেস তারিন খুশি মুখে আবার বলে উঠলেন


""আজকে আম্মাকে আংটি প্রিয় যাবো,আগামী সপ্তাহে বিয়ের ডেট ফেলতে চাচ্ছি"


"তোরা কি তোদের মেয়েকে আগামী সপ্তাহে আমার ঘরে দিবি নাকি আরো কিছুদিন তোদের কাছে রাখতে চাস?"


মায়ের মুখের এমন কথায় ধক করে উঠলো মুহিতের বুক।কি পরিয়ে নিয়ে এলো আর এই মহিলা বলছে কি?

"এখন যদি মামা মশাই বলে ফেলে আরো কয়েকদিন যাক?


"তাহলে তো কচু গাছের সাথে ফাঁস নেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবেনা মুহিতের।

বিয়ে করা বউকে কাছে পাওয়া যাচ্ছে না সময় মতো এর চাইতে বড় কষ্ট আর কি আছে এই নশ্বর দুনিয়াতে??""


"মুহিত মনে মনে আল্লাহ মাবুদ জপতে থাকলো।


একটু পর নাফিজ মাহমুদ বলে উঠলো মেয়েকে কাছে রাখার কিছুই নেই আপা, তোর বাসা আমার বাসা থেকে দশ মিনিটের রাস্তা।চাইলেই যখন তখন মেয়েকে দেখতে পাবো,আর মেয়েতো অন্য কারো ঘরে যাচ্ছে না।

নিজের ফুপুর কাছে যাচ্ছে।


""যেখানে তুই আছিস,মুহিত নামিরা আছে সেখানে আমার চিন্তা করা বা দুঃখ পাবার কিছুই নেই।


মুহিতের ও বিয়ের  বয়স হয়ে গেছে অনেক আগেই,আর ওদের বিয়েটাও অনেক দিন ই হলো ঠিক হয়েছে।


আমার মনে হয় এখন বিয়েটা হয়ে যাওয়াই ভালো

"কি বলো তনুজা??


তনুজা মধুর হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলো


"আপনার ভাই ঠিকই বলেছে আপা, আগামী সপ্তাহেই আমরা বিয়ের তারিখ ফেলতে চাই।


আলহামদুলিল্লাহ বলে  হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটি বক্স বের করলেন মিসেস তারিন।


স্বর্গকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো

"আম্মা আমার পাশে এসে বসো তো দেখি"


স্বর্গ লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে মিসেস তারিনের পাশে বসলেন।


একটি ডায়মন্ড এর আংটি মুহিতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন

"এটা তোমার পাপা ভালোবেসে আমাকে দিয়েছিলো, ব্যাবহার করলে নষ্ট হবে ভেবে আমি কোনদিন হাতে তুলিনি এই আংটি।


মানুষটা আজ নেই,দুদিন পরে আমিও থাকবো না,

"তোমার পাপা বেঁচে থাকলে হয়তো আরো সুন্দর সুন্দর জিনিস তোমার বউয়ের জন্য খুশি হয়ে কিনতো।

মানুষটা কতো সৌখিন ছিলো এটা তোমাদের কারোর ই অজানা নয়।


কিন্তু আল্লাহ তাকে নিয়ে গিয়েছে।মনকে সবর দেয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।


তোমার পাপার পক্ষ থেকে বাড়ির প্রথম ছেলের বউ হিসেবে স্বর্গের জন্য এই ছোট উপহার।


পরে তুমি তোমার মন মতো যা খুশি কিনে দিও।

বলেই মুহিতের দিকে আংটি টি বাড়িয়ে দিলেন।


সকলের চোখ ভিজে উঠলো মিসেস তারিনের আক্ষেপে।


মুহিত বারবার পলক ঝাপটে অশ্রু লুকিয়ে মায়ের হাত থেকে আংটি নিয়ে স্বর্গের হাতে পরিয়ে দিলো।


মিসেস তারিন মুহিত  আর স্বর্গের মাথায় হাত বুলালেন।

স্বর্গের নরম হাত  তুলে নিয়ে অনামিকা আঙুলে চুমু খেয়ে বললেন

"আম্মা আংটি সুন্দর মানিয়েছে তোমার সুন্দর হতে।

বিয়ের যা যা কেনাকাটা দুজন মিলে করে নিও,ফুপি আর ডিস্টার্ব করবো না।


স্বর্গ আহ্লাদী হয়ে মিসেস তারিনের হাত জড়িয়ে ধরে বললো

আংটি অনেক পছন্দ হয়েছে আমার,এটা আর জীবনেও ফেরত পাবে না তুমি।আর তোমার পছন্দ অনেক সুন্দর।

আমার বিয়ের সব কেনাকাটা তুমি আমার সাথে  গিয়ে কিনবে।

বলেই মিসেস তারিনের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঝলো স্বর্গ।


মিসেস তারিন স্বর্গের গালে মমতার হাত বুলালেন।


নাফিজ মাহমুদ ক্যালেন্ডার দেখে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন

আগামী শুক্রবার বিয়ে।সকলেই প্রস্তুতি নাও।কেনাকাটা তে লেগে যাও।

আমি উঠলাম আজ আমার অনেক কাজ আছে।একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা।


চলবে।

গল্প তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল পর্ব ৩০

 তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল

পর্ব_৩০

সারিকা_হোসাইন


এক লহমায় কেটে গিয়েছে পনেরটি দিন।সোহাগ নামিরা দের নিয়ে দেশে ফিরে এসেছে।

মিসেস তারিন কোনোভাবেই আর নাফিজ মাহমুদ এর বাংলো তে থাকতে রাজি নন।তিনি তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে তার স্বামীর পুরাতন বাড়িটা তে বাকী যে কদিন বাঁচবেন সে কদিন কাটাতে চান।

পুরাতন যেই ক্ষত দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছরে কিছুটা সেরে উঠেছে মুহিতের ফোন কল পাবার পর থেকে পুরোনো সেই ক্ষত থেকে চুয়ে চুয়ে যেনো গড়িয়ে পড়ছে লাল টকটকে রক্তের ধারা।


বাংলাদেশ আর্মি হেডকোয়ার্টার মুহিতের বাবা আর ভাইয়ের লাশ বাংলাদেশে আনার সকল ব্যাবস্থা করে দিয়েছে।

আগামীকাল ভোরের ফ্লাইটে তারা বাংলাদেশে পৌঁছুবে।


নামিরা থেকে থেকে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে।নামিরার কোলের আড়াই মাসের বাচ্চাটা থেকে থেকে করুন সুরে কেঁদে উঠছে।হয়তো মায়ের কান্না অবুঝ শিশুটিও সহ্য করতে পারছে না।

স্বর্গ বাচ্চাটাকে নামিরার কোল থেকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।একদিকে ভ্যাপসা গরম তার মধ্যে কান্নাকাটি।বাচ্চাটা একদম নেতিয়ে যাচ্ছে।


কিন্তু এতকিছুর ভিড়ে মিসেস তারিন নির্বিকার।দীর্ঘ বছরের শোক সইতে সইতে পাথরে পরিণত হয়েছেন।

তনুজার  কাছে এই মুহূর্তে তারিন কে রোবট মনে হচ্ছে।অবশ্য জন্ত্র মানবী বলাই চলে।

যার হৃদ ক্রিয়া চালানোর জন্য একটা আস্ত মেশিন বুকের ভেতর বসানো হয়েছে সে কি আর নরম দিলের মানুষ আছেন?


কিছু লোক লাগিয়ে বাড়ির পাশের জঙ্গল গুলো পরিস্কার করানো হচ্ছে।কাজের লোকেরা বাড়ি ঘর ধুয়ে মুছে সাফ করছেন।মনে হচ্ছে বিশেষ কোনো অতিথি এই বাড়িতে আসবেন।তার জন্য এতো এতো আয়োজন।


――――――

শুক্রবার,১২ ই  আগস্ট 

আজকের আবহাওয়া টা মনোরম।আকাশে তীক্ষ্ণ রোদের তেজ নেই।ধরনীতে স্বর্গের হাওয়া বিরাজ করছে সর্বত্র।বাতাসে মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে যেনো সারাক্ষন।এতো এতো কাজ কর্ম করেও কেউ হাপাচ্ছে না।


মুহিত বিমানে উঠার আগে ফোন করে জানিয়েছে যে,তারা আসছে।

মুহিতের দাদা বাড়ির কিছু নিকট আত্মীয় বাসায় ভিড় করেছে।কেউ কেউ কোরআন তেলাওয়াত, তসবিহ পাঠে ব্যাস্ত।

নামিরার কান্না যেনো শেষ ই হচ্ছে না।

যেই ব্যাথা নতুন অতিথি পেয়ে ভুলতে বসেছিলো সেই ব্যাথা আবার কিভাবে ফিরে এলো?

―ওরে আল্লাহ তুমি কেনো এতো নিষ্ঠুর হলে আমাদের প্রতি?


সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়াতেই পু পু সাইরেন এর আওয়াজ পাওয়া গেলো।

আদনান ওয়াসিফ এর বিশাল তিন  তলা বাড়ির খোলা প্রাঙ্গণে প্রথমে একটি পুলিশের গাড়ি প্রবেশ করলো।এর পর দুটো আর্মি জিপ।এরপর মুহিত দের এম্বুলেন্স।

পিছে পিছে এলো মন্ত্রী মহোদয় এর গাড়ি।

নিমিষেই মানুষে গিজগিজ করে উঠলো আদনান ওয়াসিফ এর পরিত্যক্ত খালি বাড়িটি।

কান্নার আওয়াজ বাড়ালো নামিরা।বাইরে বের হবার জন্য পাগল হয়ে গেছে সে।স্বর্গ আর তনুজা কেঁদে চলেছে নামিরাকে জড়িয়ে।

সোহাগ ছোট বাচ্চাটা কে নিয়ে পায়চারি করছে আর চোখের জল মুছছে।

অপরাধীর ন্যায় মুহিত ঘরে প্রবেশ করলো।

তার সারা শরীর ছোট ছোট জখমে ভর্তি ।মুহিতের রোগা মলিন চেহারা দেখে স্বর্গের বুক ধক করে উঠলো।

কিন্তু পরিস্থিতি এখন অন্য ধাঁচের।

মুহিতের কাছে এখন গিয়ে এসব নিয়ে কথা বলার প্রশ্নই আসে না।


মুহিত ড্রয়িং রুমে এসে জোরে ডেকে উঠলো

―মা!

মিসেস তারিন আজ নিজেকে সজ্জিত  করেছেন।

গায়ে জড়িয়েছেন ধবধবে সাদা শাড়ি।মধ্যে খানে সিঁথি করে শক্ত করে হাত খোঁপা করে বেঁধে নিলেন।চোখের চশমাটা ঠিক করে  মাথায় কাপড় দিয়ে দূতলার আদনান ওয়াসিফ এর ঘর থেকে ধীরপায়ে বেরিয়ে এলেন।


মুহিত তার মায়ের এমন নির্বিকার রূপ দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো।তার মা কি পাগল হয়ে গেলো অধিক শোকে?

মা কি আবার হারিয়ে যাবে তাদের জীবন থেকে?


নামিরা সহসাই এসে ঝাপটে ধরলো মুহিত কে।কেঁদে ভাসালো মুহিতের বুক।


নাফিজ মাহমুদ নিজেই কাউকে শান্তনা দেবার অবস্থায় নেই।নিমিষেই পুরো বাড়িটি শোকের মাতমে ছেয়ে গেলো।


মুহিত আজ তার শক্ত খোলস থেকে বেরিয়ে বোনের সাথে মিলে কাঁদছে।ছোট বাচ্চার মতো কাঁদছে মুহিত।

মুহিতের কান্না দেখে স্বর্গ নিজেকে সামলাতে পারছে না।

মেজর আদ্রিয়ান আর সৌম্য এসে মুহিত কে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করলো।


মিসেস তারিন এসে মুহিতের সামনে দাঁড়ালেন।

মুহিত অসহায় ভাবে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো

―পাপাকে নিয়ে এসেছি মাম্মা!


মিসেস তারিন আজ একটুও কাঁদলেন না।মুহিত কে কঠিন সুরে আদেশ দিলেন

―যাও তোমার পাপার লাশ গাড়ি থেকে বের করে আনো।তাকে ধোঁয়ানোর ব্যাবস্থা করো।দ্রুত জানাজা যে দিতে হবে মুহিত।


মায়ের আদেশ পেয়ে মুহিত দৌড়ে ফ্রিজিং কারের নিকট আসে।

লাশ গাড়ি থেকে নামানোর আগে পুলিশ আর রিপোর্টার এসে মুহিত কে বিভিন্ন জেরা শুরু করে।


আর্মি জেনারেল এটা দেখে রেগে গিয়ে পুলিশকে ধমকে উঠেন।

পুলিশ সরতেই তিনি আরো কয়েকজন সোলজার ডেকে কফিন গুলো নামাতে আদেশ দেন।


বিশাল বড় ড্রয়িং রুমের  ফাঁকা জায়গায় পরপর দুটো খয়েরি রঙের কফিন সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

মুহিতের মা আদেশ দিলেন কফিনের ঢাকনা খুলতে।


আদ্রিয়ান আর সৌম্য ঢাকনা খুলতেই নামিরা একবার বাবার কাছে একবার মুকিতের কাছে গিয়ে পাগলের মতো বিলাপ করতে শুরু করে।


মুকিতের ফ্যাকাশে মায়াবী মুখখানা প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয় কে মুষড়ে দিলো।কেউ কেউ কষ্টে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

মুকিতের কফিনের কাছে গিয়ে মিসেস তারিন হাটু ভেঙে বসে পড়লেন।


নরম সুরে ডেকে উঠলেন

―মুকিত!মানিক আমার,এই দেখ মাম্মা বসে আছি,চোখ খুলবি না?


কিন্তু হায় আদরের মুকিত।সে তো চোখ খুলে না।

এবার মিসেস তারিন আদনান ওয়াসিফ এর কফিনের কাছে এলেন।

―আদনান,এই আদনান উঠবে না?

কথা বলবে না আমার সাথে?

অনেক দিন তোমার সাথে মন খুলে কথা হয়না।

আমাকে নিঃস করে দিয়ে বাবা ছেলে কী সুন্দর ঘুমাচ্ছ নাহ?


নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিলেন মিসেস তারিন।হাউমাউ করে কাঁদার ক্ষমতাও হারিয়েছেন বহু আগেই।

একটু কাঁদলেই বুকে অসহনীয় ব্যাথা অনুভূত হয়।দম আটকে আসে।


মুহিত এসে তার মা কে জড়িয়ে ধরলো।সোহাগ কারো কাছে বাচ্চাটা গছিয়ে দিয়ে কফিনের কাছে এসে  বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

যেই মানুষটা তাকে এতো বড় করলো,বিপদ থেকে  উদ্ধার করলো।অথচ সোহাগ সেই মানুষটির কোনো উপকারেই আসলো না।

এর চাইতে নির্মম কিছু কি ধরনীতে আর কিছু আছে?


নিজেকে স্বাভাবিক করে নাফিজ মাহমুদ কে ডাকলেন মিসেস তারিন।

―তোর দোলাভাই এর গোসল এর ব্যাবস্থা কর।


যেহেতু লাশ গুলো দীর্ঘদিন প্রিজারভেটিং করা ছিলো তাই দীর্ঘ সময় এগুলো এভাবে না ফেলে রাখাই ভালো।

রোগ জীবাণু বা ভাইরাস ছড়াতে পারে যখন তখন।


নাফিজ মাহমুদের হুকুমে কয়েকজন লোক এসে গোসলের কাজ শুরু করে দিলো।

একে একে আদনান ওয়াসিফ আর মুকিতের গোসল শেষে তাদের সাদা কাফনের কাপড় পরিয়ে খাটিয়ায় তোলা হলো।


তাদের জানাজা পড়তে দলে দলে মানুষ আসতে শুরু করলো।

আদনান ওয়াসিফ এর সহকর্মীরা এলেন।

হাজার লোকের সমাগমে শেষ হলো জানাজা।


মিসেস তারিন কবর কোথায় হবে সেটা আগেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

জানাজা শেষে দ্রুত তাদের দাফনের ব্যাবস্থা করা হলো।

সমস্ত কাজ শেষ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে রাত নামলো।

 

কিছু পুলিশ আর আর্মির বড় বড়  অফিসাররা ভিড় করেছে মুহিতের বাসায়।

তাদের একটাই প্রশ্ন লাশ ওখানে কিভাবে গেলো?


মুহিত মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বসে আছে।বাবা আর ভাইয়ের করুন চেহারা মনে পড়তেই চোখ থেকে খসে পড়লো মোটা মোটা দু ফোটা জল।

প্রশ্নবিদ্ধ নজরে প্রত্যেকে মুহিতের দিকে তাকিয়ে আছে।


নীরবতা ভেঙে মুহিত বলতে শুরু করলো

―যখন সবাই জানাজানি হতে শুরু করে যে নির্বাহী অফিসার আর তার ছেলেকে কেউ খুন করে দিয়েছে,ঠিক সেই মুহূর্তই  পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদলে গিয়েছিলো।রিপোর্টের কোথাও লিখা ছিলো না যে পাপা আর মুকিত কে কুপিয়ে ,শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে।

পাপা আর মুকিতের লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছিলো  আর আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিলো।


মুহূর্তেই খবরের কাগজে আর সংবাদ শিরোনামে হেডলাইন বের হয় যে সৎ নির্বাহী অফিসার আদনান ওয়াসিফ আর তার পরিবার আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছে।তাদের দেহাবশেষ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আমি আর মামা অনেক মর্গ অনেক হসপিটাল তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি।কিন্তু কেউ সেই লাশের হদিস দিতে পারেনি।


আর্মি জেনারেল প্রশ্ন করলেন

―কোথায় তোমার সেই মামা মুহিত?

মুহিত আঙ্গুলি দিয়ে নাফিজ মাহমুদ এর দিকে নির্দেশ করলো।

সকলেই মুহিতের আঙ্গুল বরাবর তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো।


এক যোগে সবাই প্রশ্ন করলেন

―মেজর জেনারেল নাফিজ মাহমুদ তোমার মামা?


মুহিত মাথা নিচু করে জবাব দিলো জি স্যার।


তুমি একথা কেনো এতোদিন আমাদের বলো নি মুহিত? অবাকের স্বরে জানতে চাইলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।


―আমি চাইনি আমার বাবা আর আর ভাইয়ের মতো মামাও হারিয়ে যাক।আশরাফ চৌধুরী পাপা কে বলেছিলো আমাদের যে হেল্প করবে তাকেই মেরে ফেলবে।


মুহিত কিছু স্থির চিত্র আর পেনড্রাইভ বের করে নিয়ে আসলো তার কক্ষ থেকে।


 সেগুলো পুলিশের  ডিআইজির হাতে তুলে দিয়ে মুহিত আহত সুরে বললো  এখানে আশরাফ চৌধুরীর বিভিন্ন খারাপ কাজের সামিল হওয়া কিছু পুলিশ অফিসার  এর তথ্য আছে।যারা মোটা অংকের ঘুষ খায় আর অপরাধ করে বেড়ায়।এখানে তাদের সকল বায়োডাটা আর কি কি অপরাধ করে তার সকল বিবরণ রয়েছে।পাপা নিজে এদের শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু উনাকেই চিরতরে শেষ করে দেয়া হয়েছে।

আমি চাই আপনারা সকল প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের এরেস্ট করুন।দেশকে কলুষিত মুক্ত করুন।


এর পর মুহিত আবার বলতে শুরু করলো―


মা যে  বেঁচে ছিলো এটা আশরাফ চৌধুরী জানতেন না।

তিনি কৌশল খাটিয়ে লাশ গুলো থাইল্যান্ড নিয়ে যান।

সেখানে এগুলো এতোগুলো বছর  প্রিজারভেটিং করা ছিলো।

উনি কেন এতদিন পর্যন্ত লাশ গুলো রেখেছিলেন তা আমার  কাছে অজানা।

হয়তো পাপার মৃত্যুতে দেশে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিলো এজন্য তিনি নিজে বাঁচার জন্য লাশ পাচার করে গুম করে ছিলেন।


আশরাফ চৌধুরী এখন কোথায় আছেন?

জিজ্ঞেস করলেন এক পুলিশ অফিসার।


মুহিত সাবলীল কন্ঠে উত্তর দিলো

বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছেন তিনি।

আর্মি অফিসার রা পুলিশ  গুলোকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

নাফিজ মাহমুদ বোনকে বিভিন্ন শান্তনা  দিলেন।স্বর্গ এখনো ফুপিয়েই যাচ্ছে।

নামিরা জ্ঞান হারিয়ে পরে রয়েছে।

ইতোমধ্যে বাড়ি খালি হতে শুরু করেছে।ধীরে ধীরে আত্মীয় স্বজন ফিরে যাচ্ছে নিজ নিজ আবাসস্থলে।


মুহিত কে উদ্দেশ্য করে মিসেস তারিন বলে উঠলেন

―তুমি আমার মনের এতদিনের দাউদাউ করে জ্বলা আগুন নিভিয়ে দিয়েছো মুহিত।

তোমার বাবা সত্যি ই আমাদের জন্য তার অবর্তমানে একজন যোগ্য গার্ডিয়ান রেখে গিয়েছে।

এভাবেই আমাদের আগলে রেখো মুহিত ।

বলেই মুহিতের গালে মমতার হাত ছোয়ালেন মিসেস তারিন।


মায়ের আদুরে হাতের পরশে চোখ বন্ধ করে ফেললো মুহিত।টুপ করে গড়িয়ে পড়লো উষ্ণ দুফোটা জল।


মুহিতের আজকে সত্যি ই পিতার যোগ্য পুত্র মনে হচ্ছে।

মুহিত পেরেছে তার বাবা,ভাইয়ের লাশের জানাজা করে কবর দিতে এবং অপরাধীদের শাস্তি দিতে।

তার বাবা ভাইকে বেওয়ারিশ লাশ হতে হয়নি।


************-***********

সমস্ত ঝুট ঝামেলায় পেরিয়ে গেছে একটি মাস।


ধীরে ধীরে ক্ষত গুলো শুকিয়ে যাচ্ছে।

নিজের স্বামী সন্তানের কবরের দিকে তাকিয়েই শান্তিতে বুক ভরে নিঃশাস নেন মিসেস তারিন।

তিনি তার পাশেই পুত্র স্বামীর উপস্থিতি অনুধাবন করতে পারেন।

সবাই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাপন এ অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।

আশরাফ চৌধুরী নামক মানুষের অস্তিত্ব ও ভুলতে বসেছে সবাই।


কেটে গিয়েছে আরো পনেরো দিন।

আজ সৌম্য আর পিউ এর রিশিপশন এর অনুষ্ঠান।

পিউ একটি  লাল খয়েরি রঙের ভারী লেহেঙ্গা পড়েছে,সাথে ভারী ভারী ম্যাচিং করা পাথরের গহনা,ভারী মেকআপ।

সৌম্যের কাছে পিউকে অপ্সরা লাগছে।

বহু কষ্টে বেচারা নিজেকে ধরে রেখেছে।না হলে মন বার বার বলছে 

―যা ব্যাটা জড়িয়ে ধরে চুমু খা।ঐটা তোর ই বউ।


সৌম্যের রিশিপশন এর আয়োজন করা হয়েছে সেনাকুঞ্জে।বড় বড় সকল আর্মি অফিসার এসেছেন নিমন্ত্রণ খেতে।


সৌম্য অলরেডি কোয়ার্টার এর জন্য আবেদন করেছে।আজকে আপাতত ভাড়া বাসায় উঠবে।বাসাটা অবশ্য পিউ এর পছন্দতেই নিয়েছে সৌম্য।

বিশাল ড্রয়িং রুম আর খোলা বারান্দা পিউ এর খুব পছন্দ।পিউ এর সকল চাওয়া পাওয়া অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে সৌম্য।


বিশাল জাকজমক ভাবে শেষ হয়ে গেলো সৌম্য আর পিউ এর বিয়ের অনুষ্ঠান।


মুহিত কে টেনে কমিউনিটি সেন্টার এর  একটি চিপায় নিয়ে এসেছে স্বর্গ।

মুহিতের গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে স্বরে  জানতে চাইলো

―আমাদের টা কবে হবে?


মুহিত স্বর্গের ঠোঁটে চুমু দিয়ে আদর মিশ্রিত কন্ঠে বলে  উঠলো আরেকটু গুছিয়ে নেই সবকিছু?

স্বর্গ মন খারাপ করে দৃষ্টি অবনত করে সম্মতি জানালো।


স্বর্গের মুখের দিকে তাকিয়ে মুহিত মনে মনে অনেক কষ্টে পেলো।ভাষায় প্রকাশ না করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো

―বাসায় চলো।


চলবে।

গল্প তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল পর্ব ২৯

 তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল

পর্ব_২৯

সারিকা_হোসাইন


রাত বারোটা বাজতে আর দু মিনিট বাকী।তৈরি হচ্ছে সৌম্য আর আদ্রিয়ান।মুহিত আগেই চলে গিয়েছে সেই জায়গায়।চারপাশে খুজ লাগানো ভীষন জরুরী।

এতোটা রাত হবার পরেও চারিপাশে অন্ধকার রাতের পরিবর্তে আলোর রোশনাইয়ে ঝা চকচক করছে সব কিছু।

কালো শার্ট,কালো প্যান্ট কালো বুটস আর কালো ক্যাপে নিজেদের আবৃত করেছে আজকে তিন জন যুবক।

মুহিতের পাঠানো লোকেশন গুগল ম্যাপ এ সার্চ দিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো সৌম্য আর আদ্রিয়ান।


মুহিত বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।বারের ফ্রন্ট এরিয়াতে তেমন লোক সমাগম নেই।সন্ধ্যার দিকে এই জায়গাটা লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে।ব্লুটুথ ডিভাইসে ক্লিক করে সৌম্য আর আদ্রিয়ান এর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো

―অল ওকে।


মুহিত ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলো।চার পাশে মানুষ নেশায় বুদ হয়ে পড়ে আছে।কিছু মানুষ ফ্লোরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে।হুশ নেই বললেই চলে।

মুহিত কোনো রকমে তাদের পাশ কাটিয়ে কটেজের রাস্তা ধরলো।

সামনেই টহল রত সিকিউরিটি দেখে একটি বড় পিলারের পেছনে লুকিয়ে পড়লো মুহিত।সিকিউরিটি সরে যেতেই হনহন করে হাঁটা ধরলো মুহিত।

কাঙ্ক্ষিত রুমের সামনে এসেই কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবার বের করে পজিশন নিলো।

এরপর দরজা তে নক করলো।দরজা কেউ খুলছে না এদিকে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার মতো সময় মুহিতের কাছে নেই।সপাটে লাথি দিতেই খুলে গেলো দরজা।কক্ষে প্রবেশ করলো মুহিত।

ঘুটঘুটে অন্ধকার কক্ষ,কিছুই দেখা যাচ্ছে না।ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে সুইচ বোর্ড খুঁজে লাইট জ্বালাতেই চোখ চড়ক গাছ।


কক্ষ পুরো খালি।ছোট একটা কক্ষ যার একপাশে একটা বেড পাতা আর কর্নারে দুটো সোফা বসানো।আর কিছুই নেই।

লাইটস নিভিয়ে ধীরে ধীরে মুহিত কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে এলো।

এর পর সৌম্য আর আদ্রিয়ান কে নিয়ে চলে গেলো ফোর জিরো ফোর এর সামনে।

তিনজনেই বন্দুক তাক করে অতর্কিত ভাবে ঢুকে পড়লো কক্ষে।

সেটাও খালি।

কারোর ই বোধগম্য হলো না ঘটনা টা।

রুমের বাইরে এসে মুহিত দৌড়ে সেই ফুলদানির কাছে গিয়ে দেখতে পেলো ক্যামেরাটা সেখানে নেই।

ক্যামেরার পরিবর্তে সেখানে একটা চিরকুট রাখা হয়েছে।


দ্রুত চিরকুট পকেটে ঢুকিয়ে বার থেকে বেরিয়ে এলো ওরা তিনজন।


বার থেকে একটু নিরাপদ জায়গায় বসে চিরকুট টি পকেট থেকে বের করলো মুহিত।

গোটা গোটা অক্ষরে লিখা

―এতো সহজেই ধরে ফেলবি ভেবেছিলি?

দিলাম তো ডজ।কেমন লাগলো মেজর?

আমি জানতাম আমার নিমকহারাম ছেলে তোকে সব বলে দিবে।

আর তুই ও ঈগলের মতো চলে আসবি শিকার খুঁজতে।

এরকম হাইড এন্ড সিক আর ভালো লাগছে না।

চল সামনা সামনি বসে তোর সাথে কথা বলি।

নিম্নলিখিত ঠিকানায় কাল বিকেল পাঁচটায় চলে আয়।

আর হ্যা নিজের সাঙ্গপাঙ্গ দের রেখে আসবি।

জানিস ই তো ক্যাপ্টেন সৌম্যের বউ টা এতিম!


রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো মুহিতের।চিঠিটা একে একে প্রত্যেকে উল্টে পাল্টে পড়লো।

সৌম্য আর আদ্রিয়ান এর এক জেদ তারা মুহিত কে একা ছাড়বে না।


কিছুক্ষন মৌন রইলো মুহিত।এরপর তিনজন মিলে এক দুর্দান্ত ফন্দি আটলো।

ক্রুর হাসলো মুহিত ।

অপেক্ষা আগামী দিনের সূর্য ওঠার।


――――

আশরাফ চৌধুরী  একটি আরাম কেদারায় পায়ের উপর পা তুলে ভ্যাপ এর ধোয়া ফুকছেন আর রাগে ফুঁসছেন।

ওই মেজর এখান পর্যন্ত চলে এসেছে এতো দ্রুত?

তার এখানের খবর আহিয়ান ছাড়া কেউ জানবার কথা নয়।তার মানে জানোয়ারটা এতদিন ভং ধরে ছিলো?আহমেদ কসাই এর নাকের ডগায় বসে এতো নিখুঁত অভিনয় করে গেলো যে  সে ধরতেই পারলো না?

কতোবার মন চেয়েছে হাজতের ভেতরই ঝুলিয়ে দিতে।কেন যে দিলো না তখন ভাবতেই ছুড়ে মারলো ভ্যাপারের পাইপ খানা।


কোথাও গিয়ে দুদন্ড শান্তিতে থাকা যাচ্ছে না,কি মুসিবত।

কাল দেখিয়ে দেবো মেজর কে আমার সাথে লাগতে আসার ফল।বাপ  ভাইয়ের পরিণতি দেখেও যার শিক্ষা হয়নি তাকে আর কিভাবে শিক্ষা দেবে আশরাফ চৌধুরী?


ভাবনা ফেলে দুই হাতের সহায়তায় জোরে তালি দিতেই বাধ্য দাসের ন্যায় আটজন ছেলে সারি বদ্ধ ভাবে আশরাফ চৌধুরীর দুই পাশে দাঁড়ালো।


মুহিতের বর্ননা দিয়ে আশরাফ চৌধুরী ছেলে গুলোকে উদ্দেশ্য করে থাই ভাষায়  বলে উঠলো

―দেখা মাত্র হাত পা ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে।

ছেলেগুলো দুই হাত বুকে ভাঁজ করে মাথা নিচু করে এক যোগে বলে উঠলো

-ওকে।


চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আশরাফ চৌধুরী।কাল তার অনেক কাজ।ওই মেজর কে একটা চূড়ান্ত সত্য জানানো বাকি আছে এখনো।ওই সত্যের ধাক্কাটা আগে দিয়ে একদম কাবু করে ফেলবে।বলেই কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো এবং হনহন করে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।


*****

আজ সেই অপেক্ষাকৃত দিন।

ঘড়ির ঘন্টা কাটা চারের ঘরে ঠেকতেই ঢং ঢং করে আওয়াজ তুলে জানান দিলো এখন চারটা বাজে।

মুহিত দ্রুত তৈরি হয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো।

এখান থেকে গুগল ম্যাপ  লোকেশন আধা ঘন্টার রাস্তা দেখাচ্ছে।


মুহিত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা বাইক রাইড  বুক করে ড্রাইভার কে লোকেশন সেন্ড করলো।


একক ভাবে প্রভাবশালী কোনো পরিবহনের প্রচলন না থাকায় এবং রাস্তায় বহু ক্যাটাগরির যানবাহনের জন্য জ্যামে পরিপূর্ণ এই শহর।

মুহিত ঘড়িতে বার বার শুধু সময় দেখে যাচ্ছে আর বিরক্তিতে মুখে চ সূচক শব্দ করছে।

দীর্ঘ পঞ্চান্ন মিনিটের যাত্রা শেষ করে মুহিত এখন উপস্থিত হয়েছে ফুকেট ফাইট ক্লাব এর সামনে।

জায়গাটা মেইন শহর থেকে একটু দূরে জনমানব সংখ্যা খুবই কম এমন একটি জায়গায়।


নিজেকে স্বাভাবিক করে মুহিত ভেতরে ঢোকার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

দরজা তে নক করতেই একটি ছোট বাচ্চা ছেলে দরজা খুলে দিয়ে মাথা নিচু করে স্বাগত জানালো।

কাঠের বড় পাল্লার দরজা পার হতেই ছেলেটি হাতের ইশারায় বাম পাশের রাস্তা নির্দেশ করলো।

মুহিত ছেলেটির দেখানো পথে চারপাশে চোখ বুলিয়ে হাটতে লাগলো।


জায়গা টা বাহির থেকে দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই যে ,ভিতরে বিশাল খোলা জায়গা আছে।

ক্লাবের ভিতরে ফাইটিং এর সকল জিনসে পরিপূর্ণ।

মুহিত মনে মনে ভাবছে এমন জায়গায় তাকে ডাকার কি কারন থাকতে পারে আশরাফ চৌধুরীর?


চলতে চলতে একটি বড় দরজা দেখতে পেলো মুহিত।কিছুক্ষন ভেবে হাতের মুঠের সাহায্যে ঠক ঠক শব্দ করলো।

নিমিষেই দুই পাশ থেকে দুজন ব্যাক্তি দরজার পাল্লা সরিয়ে মুহিত কে ভেতরে ঢুকতে দিলো।


মুহিত ভেতরে প্রবেশ করতেই আশরাফ চৌধুরী খুশিতে গদ গদ হয়ে বললো

― এসো মেজর এসো।

―স্বাগতম তোমাকে আমার মেহমান খানায়।


আশরাফ চৌধুরীর এতো সমাদর মুহিতের কাছে ভালো ঠেকছে না।

কথায় বলে অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।


মুহিত চুপ করে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে শুধু।

নীরবতা ভেঙে আবারো আশরাফ চৌধুরী বলে উঠলো

―তোমার জন্য কোথাও তো শান্তিতে টেকা যাচ্ছে না মেজর।নিজেও শান্তিতে থাকছো না অন্যকেউ দিচ্ছ না।

―তারচেয়ে বরং চলো আজকে তোমাকে শান্ত করে দেই।

বলেই হাত তালি দিয়ে উঠলো আশরাফ চৌধুরী।


মুহূর্তেই ছেলেগুলো দৌড়ে আশরাফ চৌধুরীর সামনে এসে দাড়ালো ।

একটি ছেলেকে উদ্দেশ্য করে আশরাফ চৌধুরী বলে উঠলো

―ড্যানিয়েল চেক হিম!


ড্যানিয়েল নামের ছেলেটি দৌড়ে এসে মুহিত কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সার্চ করে কিছুই পেলো না।

ছেলেটি ফিরে যেতেই বাঁকা হাসলো মুহিত।


মুহিতের ভাবভঙ্গি কিছুই আশরাফ চৌধুরীর ভালো লাগছে না।

যতো দ্রুত এই মেজরের থেকে নিস্তার পাওয়া যায় ততোই মঙ্গল।

আশরাফ চৌধুরী মুহিতের দিকে এগিয়ে এসে গলা খাকরি দিয়ে বলে উঠলো

―তা মেজর বাপ ভাইয়ের লাশ গুলো জানাজা করে দাফন করতে পেরেছিলে?


লাশ দাফনের কথা শুনেই মুহিত মুষড়ে উঠলো।অজানা নীল ব্যাথায় সর্বাঙ্গ দুর্বল হলো।বুকে তোলপাড় শুরু হলো।


মুহিত কোথাও খুঁজে পায়নি তার বাবা আর মাসুম ভাইয়ের লাশ।

কতো মর্গ কতো জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছে।

লাভের ফল বরাবরই শূন্যের কোঠায় ছিলো।


মুহিতের নীরবতা দেখে আশরাফ চৌধুরী বলে উঠলো

―চলো মেজর একটা ম্যাজিক দেখাই তোমাকে।


বলতেই দুটো ছেলে ধরাধরি করে একটা কফিন আনলো।

মুহিতের সামনে কফিনটা রাখার নির্দেশ দিলেন আশরাফ চৌধুরী।


ছেলে গুলো কফিন রেখে সোজা হয়ে মুহিতের পেছনে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো।

আশরাফ চৌধুরী হাটু ভাঁজ করে বসে কফিনের ঢাকনা খোলতে তৎপর হলেন।


মুহিত যেনো কিছু বলার ভাষাই খুঁজে পাচ্ছে না।

এতোগুলো বছর পর আশরাফ চৌধুরী লাশ দাফনের কথা বলে এভাবে কেনো ব্যাথিত করবে মুহিত কে?


একজন সন্তানের কাছে পিতার লাশ দাফনের কার্য  সম্পন্ন করতে না পারার যে কষ্ট বা ব্যার্থতা।এটা কি আশরাফ চৌধুরী বুঝবে?


নিমিষেই খুট করে খুলে গেলো কফিনের দরজা।ধ্যান ভাঙলো মুহিতের।

কফিনের দিকে দৃষ্টি দিতেই হাটু গেড়ে বসে গেলো মুহিত।


লাশটি আর কারো নয় তার বাবা আদনান ওয়াসিফ এর লাশ।


লাশটি দেখেই আশরাফ চৌধুরী হুহু করে হেসে উঠলো।


মুহিত কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো

―দেখ মেজর তোর বাপ কে কতো যত্ন করে রেখে দিয়েছি আমি।অনেক ভুগিয়েছিলো আমাকে।যখন কোনো কারণ খুঁজে না ই রাগ 

করার জন্য!তখন তোর বাবার লাশ টা বের করে দেখি।

খুব  রাগ হয় তখন জানিস?

তখন রাগের চোটে মনে চায় সব জ্বালিয়ে দেই।


তোর ভাইয়ের লাশ ও আছে রে মেজর ।

ওটাও রেখেছি।ফেলতে পারিনি,মায়া লেগেছে ছেলেটার জন্য বলেই ছেলে দুটোকে নির্দেশ দিলো ছোট কফিনটা নিয়ে আসতে।

ছেলে দুটো কফিন নিয়ে এসে মুহিতের সামনে রাখতেই মুহিত কফিন খোলার জন্য উন্মাদ হয়ে গেলো।

মুহিতের এমন অস্বাভাবিক আচরণে আশরাফ চৌধুরী হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।

তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে এমন হাস্যকর দৃশ্য পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর হয় না।


মুকিতের কফিনটা মুহূর্তেই খুলে ফেললো মুহিত।


একপাশে বাবার আরেক পাশে প্রানপ্রিয় আদরের ভাইয়ের মেডিসিন মিশ্রিত ফ্যাকাশে লাশ দেখে মুহিতের বুকে ব্যাথা শুরু হলো।

টপটপ করে শুধু মুহিতের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।মুহিত মুখে কিছুই বলতে পারছে না।


লাশ গুলোর মেডিসিনের ঝাঁঝালো গন্ধে প্রত্যেকে নাকে রুমাল গুজলো।

মুহিত সেভাবেই ঠাঁয় বসে রয়েছে।

কিছুক্ষন বাদে আশরাফ চৌধুরী হুংকার দিলেন কফিন দুটো নিয়ে যেতে।

ছেলে গুলো কফিন নিয়ে যেতেই আশরাফ চৌধুরী ড্যানিয়েল নামের ছেলেটিকে বললেন

―কিল হিম।


আশরাফ চৌধুরীর নির্দেশ পাওয়া মাত্র ছেলেগুলো মুহিত কে ঘিরে ফেললো চার পাশ থেকে।

মুহিত মাটির দিকে দৃষ্টি দিয়ে এক ধ্যানে বসে রয়েছে।

ছেলে গুলোর মধ্য থেকে "তায়ও" নামের ছেলেটি মুহিত কে শার্টের কলারে ধরে টেনে দাঁড় করালো।

মুহিতের আজকে নিজেকে ভারসাম্য হীন মানুষ বলে মনে হচ্ছে,যার পায়ে বল নেই,মনে জোড় নেই,মাথা বুদ্ধিশুণ্য।


মুহিতের মা এই লাশ গুলো দেখে আবার জীবন্মৃত হয়ে যাবে?

আবার এই বেদনায় ভরা অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে?


মুহিতের ভাবনার মাঝেই মুহিতের মুখ বরাবর একটা পাঞ্চ মেরে দিলো বডিবিল্ডার দের মতো দেখতে একটি ছেলে।


টাল সামলাতে না পেরে পরে গেলো মুহিত।সে এখনো নির্বিকার।ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরছে সেদিকে  তার কোনো খেয়াল নেই।জড়বস্তু লাগছে তার নিজের কাছেই।


হঠাৎ ই মুকিতের   স্বপ্নে বলা কথা গুলো মনে পড়লো মুহিতের।

―ভাইয়া তুমি কাপুরুষ, পাপা তোমাকে তার যোগ্য পুত্র ভেবে অনেক দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলো।

তুমি কিছুই পালন করো নি।তুমি চলে যাও আমাদের দরজার সামনে থেকে।পাপা  কোনোদিন আর তোমার সাথে কথা বলবে না।

চলে যাও,চলে যাও ভাইয়া,চলে যাও।


চোখ খুলে উঠে দাঁড়ালো মুহিত।

সে এখান থেকে জ্যান্ত ফিরবে সাথে বাপ ভাইয়ের লাশ নিয়েই ফিরবে।

পিছন মুড়ে সব গুলো ছেলেকে দেখে নিলো মুহিত।


প্রত্যেক টা ছেলের শরীরের গঠন,উচ্চতা,গায়ের রঙ এক।শুধু চেহারা আলাদা।এরা সবাই যে ভালো ফাইট জানে তা তাদের শরীর আর আশেপাশের ইকুইপমেন্ট দেখেই বোঝা যাচ্ছে।


ছেলে গুলো খালি গা,সবার পরনে কালো প্যান্ট আর বুটস।

ধবধবে ফর্সা শরীরে মাসেল গুলো চকচক করছে।

মুহিত এদের সাথে শক্তিতে পারবে কিনা জানেনা।

কিন্তু মনোবল হারাবে না সে।পারতে তাকে হবেই।


নিজের গায়ের শার্ট খুলে ছুড়ে মারলো মুহিত।

শার্টের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো মুহিতের  মাসেল যুক্ত জিম করা  শক্ত বডি।

ঘাড় ঘুরিয়ে কটকট শব্দে হাড়ের গিট ফুটিয়ে নিজেকে রিল্যাক্স করলো মুহিত।


ছেলেগুলো কারাতে পোজে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেলো মুহিতের চার পাশে।

বাঁকা হাসলো মুহিত।

মুহিত নিজেও একজন কারাতে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া চ্যাম্পিয়ন।কিন্তু ভাবে কিছুই প্রকাশ করলো না।

আস্তে ধীরে কোমরে হাত দিয়ে খুলে ফেললো  বেল্ট এর বকলেস এর পিন।

ছেলে গুলো এগিয়ে আসতেই সহসাই বেল্ট খুলে হাতে পেঁচিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়ি দিতে লাগলো।

ছেলে গুলো সামান্য আহত হয়ে ছিটকে পড়ে গেলো।

আহত বাঘের ন্যায় ফুসফুস করতে করতে ছেলে গুলো উঠে দাঁড়ালো।একটা ছেলে দৌড়ে এসে মুহিতের পেট বরাবর পাঞ্চ মারার ট্রাই করলো।

মুহিত তার বুদ্ধি আর শক্তির সাহায্যে ছেলেটির পাঞ্চ ব্লক করে নিজের হাটু দিয়ে ছেলেটিকে তলপেট বরাবর আঘাত করলো।এর পর কুনুই দিয়ে বুকে আঘাত করতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ছেলেটা।


দৌড়ে এলো আরো দুটো ছেলে।পেছন থেকে দুজনেই মুহিত কে ঝাপটে ধরলো।

মুহিত কুনুই এর সহায়তায় তাদের দুজনকেই বুকের খাঁচা বরাবর আঘাত করলো ছেলে গুলো ছিটকে না পড়ে মুহিত কে আরো ভালো করে চেপে ধরলো।

মুহিত তার সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলো ছেলে দুটো কে।

এর পর দৌড়ে একটা ওয়ালের অর্ধেক পর্যন্ত উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লো ছেলে গুলোর উপর।

দুই পাশ থেকে দুটো ছেলের হাত মুচড়ে ধরে উল্টিয়ে ভেঙে দিলো মুহিত।


হঠাৎ ই একটা ছেলে চাইনিজ চপার আর কুড়াল নিয়ে আক্রমন করতে এলো।

হঠাৎই সৌম্য আর আদ্রিয়ান দৌড়ে এসে প্রটেক্ট করলো মুহিত কে।

শুরু হলো ফাইট।

কেউ কারো থেকে কম যাচ্ছে না।

দুই পাশের মানুষেরই রক্ত ঝরে যাচ্ছে সমানে।

বিভিন্ন মিলিটারি কায়দায় ,শক্তি বলে আর বুদ্ধির জোড়ে সব গুলো ছেলেকে কাবু করে ফেললো তারা তিন জনে।


হঠাৎ ই পেছন থেকে একটা চাইনিজ চপার ছুড়ে মারলো মুহিতের দিকে।সৌম্য চিৎকার করতেই মুহিত সাইড হয়ে সরে যায়।

ধারালো সেই চপার মুহিতের সামনের দেয়ালে লেগে অর্ধেক ঢুকে গেলো।

এবার মুহিতের মাথায় খুন চেপে গেলো।

রক্ত চক্ষু নিয়ে হাত মুষ্টি বদ্ধ করে এগিয়ে গেলো চপার এর দিকে।


শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনে বের করলো চপার টা।

এরপর সেটা নিয়ে দৌড়ে আশরাফ চৌধুরীর দিকে এগুতে থাকলো।

আশরাফ চৌধুরী যেনো নড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো এই মুহূর্তে।

মুহিত দৌড়ে এসে সেই চপার দিয়ে কোপ বসিয়ে দিলো আশরাফ চৌধুরীর বুক বরাবর।

বুকের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে ফেললেন আশরাফ চৌধুরী।

গল গল করে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে সমানে।

একের পর এক এলোপাতাড়ি কুপিয়ে যাচ্ছে মুহিত।

এক সময় আশরাফ চৌধুরী লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।

হাটু মুড়ে বসে আশরাফ চৌধুরীর চুল টেনে বসালো মুহিত।

এর পর দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো

তুই মোটেও কোপানোর উস্তাদ নস।এক্সপার্ট হলে আমাকে মারতে সক্ষম হতি।বলেই তাচ্ছিল্য পূর্ণ হেসে উঠলো মুহিত।

― আর শোন, তোর ছেলেই তোর মৃত্যুর কাল হলো রে  আহমেদ।আমি চির কৃতজ্ঞ তোর ছেলের কাছে।এজন্য তাকে আমি জেল থেকে পালাতে সাহায্য করেছি।

এবার তুই শান্তিতে মর বলেই গলা বরাবর চালিয়ে দিলো চপার টা।

আশরাফ চৌধুরী চোখ বড় করে হা করে শেষ নিঃশ্বাস নিলেন।


মুহিত দৌড়ে চলে গেলো কফিন দুটোর কাছে।

মেজর আদ্রিয়ান আর সৌম্যকে ধরতে বললো তার বাবার কফিন

আর নিজে কাঁধে তুলে নিলো আদরের ছোট ভাইয়ের ছোট কফিন টি।।


ফাইটিং ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেলো মুহিতরা,পরে রইলো মৃত আশরাফ চৌধুরীর ক্ষতবিক্ষত লাশ।যা এই অজানা শহরে ধরার কেউ নেই,কবর ,জানাজা এসব করার ও কেউ নেই।


মেজর আদ্রিয়ান আর্মি হেডকোয়ার্টার এ মুহিতের বাবা আর ভাইয়ের লাশের কথা জানালেন।

ওখান থেকেই লাশ নেবার সমস্ত কিছু রেডি করে দিবেন।

থাইল্যান্ডের কর্পস প্রিজারভেটিং ফ্রিজে কফিন দুটো রেখে চলে এলো মুহিত।


হোটেলে এসে লম্বা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে ফোন হাতে তুললো মুহিত।

ডায়াল করলো নির্দিষ্ট নম্বরে।

রিং হতেই ফোন তুললো ওপাশের ব্যাক্তি


―সোহাগ ভাই !


চলবে

গল্প তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল পর্ব ২৮

 তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল

পর্ব_২৮

সারিকা_হোসাইন


ব্যাঙ্কক,ফুকেট


 থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্কক এর ফুকেটের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।কিন্ত এই ফুকেট  দিনের বেলায়  যতোটা সুন্দর মোহনীয়  রাতের বেলায় ততোটাই ভয়ংকর।একটু এদিক সেদিক হলেই ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা।

চুরি,ডাকাতি,স্মাগলিং,সে*ক্স ক্লাব,ক্যাসিনো  সবকিছু গড়ে উঠেছে ফুকেট এর বাংলা রোডে।এই রোডে সন্ধ্যার পর যে কোনো ক্রাইম ঘটার চান্স থাকে আশি শতাংশের উপরে।বিদেশী পর্যটকদের জন্য বাংলা রোড কে রাতের বেলা রেড এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।


টানা সাড়ে তিন ঘন্টা জার্নি করে ব্যাঙ্কক সুবর্ণ ভূমি এয়ারপোর্ট এসে পৌঁছেছে আদ্রিয়ান,সৌম্য আর মুহিত।


ইকোনোমিক টিকিটের ব্যাবস্থা না থাকায় বিজনেস ক্লাসে আসার জন্য একেকজন কে গুনতে হয়েছে সত্তর হাজার টাকা।

তাদের কে ওয়েলকাম করার জন্য প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছেন তাদের গাইড  থাই আব্বাস।

লোকটির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি।থাইল্যান্ড সম্পর্কে এতোই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন যে, নামের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে" থাই"


আব্বাসের সহায়তায় তারা তাদের লাগেজ নিয়ে ফুকেট এর পশ একটি হোটেল নভোটেল ফুকেট সিটি তে উঠে।

মূলত তারা এসেছে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে।রথ দেখা কলা বেঁচা যাকে বলে।

এর মাঝে সুন্দরী মেয়েদের দিয়ে  বডি ম্যাসাজ করাতে পারলে মন্দ  হয় না!


হোটেলে ঢুকে ফ্রি ওয়াইফাই কানেক্ট হতে না হতেই সৌম্য আর মুহিতের ফোনে ভিডিও কলের নোটিফিকেশন আসতে শুরু করলো।

বিভিন্ন ধরনের মেসেজ দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে পিউ আর স্বর্গ।

একটাই সতর্ক বাণী

―সাদা রঙের মেয়ে মানুষ থেকে একশত হাত দূরে।


মেজর আদ্রিয়ান বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে হো হো করে হাসতে লাগলো।কারন সে স্বাধীন।তাকে বলার মতো কেউ নেই।

তার মতে

― সিঙ্গেল লাইফ ইজ বেস্ট।

―মিঙেল হলেই যতো প্যারা।


মুহিত আর সৌম্যকে উদ্দেশ্য করে চোখ টিপে আদ্রিয়ান বলে উঠলো

―আমি বডি ম্যাসাজ ও নিবো, নাইট ক্লাবেও যাবো,আর বিচেও হাফপ্যান্ট পরে শুয়ে থাকবো।

বলেই মাথার পিছে দুই হাত ভাঁজ  করে দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে থাকলো।


আদ্রিয়ান এর কথা শুনে মুহিত আর সৌম্য চোখ চাওয়া চাওয়ি করলো।কারন তারা অসহায়।তারা  বউয়ের বন্দী কারাগারে।


মুহূর্তেই  মুহিতের ফোন ভো ভো শব্দে কেঁপে উঠলো।

স্ক্রিনে দৃষ্টি ফেলতেই নিজের আদুরে বউয়ের নম্বর দেখে ঠোঁটের হাসি মিইয়ে গেলো।

এখনই শুরু হবে একশ একটা প্রশ্নের জবাব উত্তর।


হলোও তাই।মুহিত ফোন তুলে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে স্বর্গ

বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো সাথে একশত বার শাশালো যাতে ছোট পোশাক পরিহিত মেয়েদের দিকে চোখ না দেয় মুহিত।

তাহলে স্বর্গ মুহিতের চোখ উপরে ফেলবে।


মুহিত শুধু আচ্ছা,আচ্ছা বলে বাধ্য বাচ্চার ন্যায় ফোন কেটে দিলো।


স্বর্গ ফোন কাটার সাথে সাথেই পিউ ফোন করলো সৌম্যের ফোনে।

ঐ একই হুমকি ধামকি।

―শালার আসামি ধরতে এসেও শান্তি নেই দেখা যাচ্ছে বলে বালিশ দিয়ে মাথা চেপে ধরলো সৌম্য।

কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে দুপুরের খাবার খেতে হোটেলের রুফটপ রেস্টুরেন্টে গেলো তারা।

এটাই প্রথম থাইল্যান্ড ভ্রমন তাদের।এখানকার খাওয়াদাওয়া, কৃষ্টি,কালচার কিছুই জানে না তারা।আর কতো রকম দেশে যে তাদের ভ্রমন করতে হবে সেটাও তারা জানেনা।


মেনু কার্ড নিয়ে খাবারের নাম দেখতে থাকলো।

সৌম্য তো ভয়েই শেষ যদি পর্ক দিয়ে রান্না করে দেয়?

ভাবতেই চোখ মুখ কুঁচকে জিভ বের করে আস্তাগফিরুল্লাহ বলে উঠলো।

সৌম্যের এমন অবস্থা দেখে মুহিত জিজ্ঞেস করলো

―উজবুকের মতো আচরণ করছো কেনো ক্যাপ্টেন?

সৌম্যের উত্তর না শুনেই ওয়াইটার ডাকলো মুহিত।

মুহিত সবাইকে বোঝালো কোনটা কি খাবার আর তারা কোনটা খাবে?

সকলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুহিত ওর্ডার দিলো থাই স্টীম বোট,সৌম্য ভাত প্রিয় মানুষ সে ওর্ডার দিলো খাও ক্লুখ ক্রবি আর আদ্রিয়ান ওর্ডার দিলো চিকেন সাতায়।

গুগল ঘেঁটে খাবার সম্পর্কে আইডিয়া নিয়ে নিয়েছে তারা।এবার টেস্ট করার পালা।


কিছুক্ষণ পরেই তাদের অর্ডারকৃত খাবার চলে এলো।

সৌম্য ভয়ে ভয়ে খাবার মুখে তুললো।খাবার খেয়ে সে তার মন্তব্য ব্যাক্ত করলো।

―এতো কঠিন নামের কি দরকার ছিলো?চিংড়ি ভর্তা দিয়ে ভাত মাখানো বললেই তো সহজ হতো।


―বেশি কথা না বলে খাও ক্যাপ্টেন বলেই ফুটন্ত ভেজিটেবল আর চিকেন স্টক এ পাতলা স্লাইস করে কাটা মুরগির মাংস চুবালো মুহিত।


সৌম্য খেতে খেতে প্রশ্ন করলো

মেজর আপনি এখানে কোথায় খুঁজে পাবেন আপনার কাঙ্ক্ষিত আশরাফ চৌধুরী কে?

―সন্ধ্যে নামলেই দেখতে পাবে বলেই চপ স্টিক দিয়ে  ডুবানো মাংস টা তুলে মুখে পুড়লো মুহিত।

খাবার সময় বেশি কথা মুহিতের পছন্দ নয়।এজন্য সৌম্য আর ঘাটালো না বেশি।


――――

পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন আশরাফ চৌধুরী।পেছনে দুজন মেয়ে গরম তেল মালিসের মাধ্যমে তাকে ম্যাসাজ দিয়ে যাচ্ছে।মেয়ে গুলোকে কক্ষে নিয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে আশরাফ চৌধুরীর।কিন্তু মুখে কিছুই প্রকাশ করলেন না।

মুহিতের কথা মনে পড়তেই বিদঘুটে হেসে উঠলেন।

তার হাসিতে মেয়ে গুলো ম্যাসাজ বন্ধ করে দূরে সরে দাঁড়ালো।


―আর কিভাবে আমায় খুঁজে পাবি মেজর?

অনেক দৌড় করিয়েছিস আমাকে।এবার তোকে কি করি আমি তুই শুধু দেখ।

লাশ ধরে কাঁদার জন্য ও কোনো মানুষ পাবি না বলেই হাতে থাকা বিয়ারের ক্যান ছুড়ে মারলেন ।


মুহিত যদি কোনোভাবে এখানেও চলে আসে তবে জ্যান্ত পুতে দেবেন থাইল্যান্ডের মাটিতে।

বাংলাদেশের চাইতেও আশরাফ চৌধুরীর জন্য নির্ভরযোগ্য স্থান থাইল্যান্ড।

এখান থেকেই তার ব্যাবসা জীবনের হাতে খড়ি।

ঘুরতে আসা কতো নারী পর্যটক কে অপহরণ করে পতিতালয়ে দিয়ে দিয়েছে আশরাফ চৌধুরী তার কোনো ইয়াত্তা নেই।

বিনিময়ে হাতিয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা।

ধীরে ধীরে পোক্ত আবাস গড়েছেন এখানে।

ছেলেটার জন্য এতোদিন দেশে ফিরে গিয়েছিলেন।

কিন্তু হারামিটা তার সব শেষ করে দিলো।


হঠাৎই আশরাফ চৌধুরীর কক্ষে আট জন্য থাই ছেলে প্রবেশ করলো।প্রত্যেকের উচ্চতা ছয় ফিট।সাথে মাসেল যুক্ত বডি।প্রত্যেকেই কারাতে স্পেশাল।

এবার আর শুকনো মাটিতে বসে থাকবেন না আশরাফ চৌধুরী।ওই লাফাঙ্গা মেজর কে একদম ভরসা নেই।যখন তখন তাকে পাকড়াও করতে চলে আসবে।

সেই জন্যই তো এতো আয়োজন।

গেট কিপার খলিল,মোশতাক আহমেদ এর মৃত্যু কিভাবে হয়েছে তা একটু হলেও আঁচ করতে পেরেছেন আশরাফ চৌধুরী।

পুলিশকে ঘোল খাওয়ানো গেলেও তাকে ভুলানো এতো সহজ নয়।

মাথার চুল বাতাসে পাকেনি তার।


এবার মুহিত কে হাতের কাছে পেলে এই ছেলে গুলোকে দিয়ে টাইট দেয়াবেন আর তিনি বসে বসে উপভোগ করবেন আর হাত তালি দিবেন।

মুহিতের চাটনী বানানো হচ্ছে ভাবতেই খুশিতে চোখ বন্ধ হয়ে এলো আশরাফ চৌধুরীর।


―――――

পৃথিবীতে মানুষের কাছ থেকে কঠিন কোনো সত্য বের করার প্রধান উপায় হচ্ছে ইমোশনাল ব্ল্যাক মিল।

মুহিত এটাই ট্রাই করেছে আহিয়ান এর উপর।

মুহিত জানতো আহিয়ানের মা নেই।তাই বলে তার মা কে আশরাফ চৌধুরী খুন করে দিয়েছে এটা মুহিত স্বপ্নেও ভাবেনি।


সহধর্মিণী হয় আত্মার আত্মা,সব চেয়ে কাছের বন্ধু,ভালো থাকার মেডিসিন।যাকে একটু রুষ্ট স্বরে কথা বললে কীয়তক্ষন বাদে নিজেরই বুকে কষ্ট অনুভূত হয়।

তাকেই কিভাবে কেউ হত্যা করতে পারে?

কতোটা জঘন্য এই আশরাফ চৌধুরী?

ভেবে উত্তর খুজে পায়না মুহিত।


ধীরে ধীরে থাইল্যান্ডের আকাশের সূর্য দিগন্তে হারাচ্ছে।সময়টা এখন গোধূলী।একটু পরেই নেমে আসবে অন্ধকার।কিন্তু বাঙলা রোড সেজে উঠবে ঝকঝকে আলোতে,চলবে দেহ ব্যাবসায়ী দের হাঁকডাক।সাথে ক্যাসিনো,বিভিন্ন ড্রাগস এর আসর আর ডাকাতি ছিনতাই।

মুহিত তৈরি হয়ে নিচ্ছে দ্রুত।

আদ্রিয়ান আর সৌম্য অসময়ে ঘুমুচ্ছে।

মুহিত আজ যাবে আহিয়ানের কথা অনুযায়ী লন্ডন বার নামক জায়গাটি তে।

আহিয়ান আশরাফ চৌধুরী সম্পর্কে সকল তথ্য হাতে কলমে মুহিতের কাছে দিয়ে গিয়েছে।

কোথায় কোথায় পাপের সাম্রাজ্য গড়েছে আশরাফ চৌধুরী সব এখন মুহিতের নখদর্পণে।

মুহিতের হাত থেকে এবার কোনো ভাবেই নিস্তার পাবেনা আশরাফ চৌধুরী।

মুহিত আজকেই এট্যাক করবে না।আজকে সে ওই জায়গায় নাম মাত্র খুঁজ লাগাতে যাবে।


কালো জিন্স প্যান্টের সাথে হাফ হাতার লোজ একটি হোয়াইট টি শার্ট পড়লো মুহিত।মুখে কালো মাস্ক লাগাতেই তাকে দেখে সে কোন দেশের মানুষ তা বোঝার উপায় থাকলো না।


মাথায় একটা ক্যাপ পরে নিলো।পায়ে কালো বুটস।

ঠিকানা অনুযায়ী গুগল ম্যাপে পনেরো মিনিটের রাস্তা দেখাচ্ছে।

ম্যাপের রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে মুহিত বিশ মিনিট পর পৌঁছে গেলো সেখানে। মুহিতকে  ছোট ছোট পোশাক ধারী মেয়ে গুলো  ম্যাসাজ ম্যাসাজ করে ডাকছে আর চোখ দিয়ে বিভিন্ন ইশারা করছে।

মাঝে মাঝে টেনে ধরার চেষ্টা করছে।

মুহিতের আর বোঝার অপেক্ষা থাকলো না যে,কিসের জন্য মেয়েগুলো ডেকে যাচ্ছে।

হাটতে হাটতে মুহিত এসে দাড়ালো একটি বার এর সামনে।যার সাইনবোর্ড এ লাইটিং এ জ্বলজ্বল করছে" লন্ডন বার ফুকেট লেখাটি।"

মুহিত কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে আশেপাশের ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করলো।এরপর বারের ভেতরে প্রবেশের জন্য পা চালালো।


বারটি তে আসতেই কোকেন এর গন্ধে পেট গুলিয়ে উঠলো মুহিতের।

বহু কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে বারের ভেতর ঢুকে গেলো।


বারের ভেতর প্রবেশ করতে মুহিতের মনে হলো সে জাহান্নামে এসে পৌঁছেছে।চার পাশে মানুষ নেশায় বুদ হয়ে আছে।ছোট ছোট কক্ষ গুলো থেকে ভেসে আসছে মেয়েদের শীৎকার আর বিশ্রী হাসির  আওয়াজ।ইয়ং ছেলে গুলো সমানে নাক দিয়ে হেরোইন টেনে চলেছে।

মুহিত সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতেই দেখতে পেলো দুটো ছেলে তাকে ঘুরে ঘুরে দেখছে শুধু।

মুহিত তাদের কিছুই বুঝতে না দিয়ে একটা উঁচু বার স্টুল এ  গিয়ে বসলো।

কি ওর্ডার করবে সেটাই বুঝতে পারছে না।এদিকে ছেলে গুলো মুহিতকে বার বার নজরে রাখছে।

মুহিত এতটুকু বুঝতে পেরেছে যে,মুহিতের চালচলন ওদের কাছে ভালো ঠেকছে না বলেই ওরা মুহিতকে নজরে রেখে বোঝার চেষ্টা করছে।


মুহিত একটা ককটেল শট ওর্ডার দিলো যা বিভিন্ন সফট ড্রিংকস এর মিশ্রনে তৈরি।

জুস সার্ভ করতেই মুহিত জুসটা হাতে নিয়ে প্রথম চুমুক দিতেই ছেলে  দুটো দুপাশ থেকে এসে মুহিতের পাশে বসে গেলো।

এমন ভাবে মুহিত কে চেপে বসেছে যেনো মুহিত পালিয়ে যাচ্ছে।


হঠাৎই মুহিত টের পেলো তার পেটের কাছে শক্ত কিছু ধরেছে ডান পাশে থাকা ছেলেটি।

ছেলেটির মুখের দিকে তাকাতেই অস্পষ্ট ইংরেজি তে বলে উঠলো

―হেই দোন্ত মুভ।

―গিভ আস এভরিথিং ইউ হ্যাভ ,


ফিচেল হাসলো মুহিত।এমনিতেই একজন সারাক্ষন হয়রানি করে যাচ্ছে তার মধ্যে আবার এই দুজন।

মুহূর্তেই রাগে কান গরম হয়ে গেলো মুহিতের ।

রক্ত চক্ষু করে ডান পাশের ছেলেটির দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলো

―মুভ ইউও গান নাও এট ডিজ মোমেন্ট।

―আদার ওয়াইজ আ উইল কিল ইউ ব্লাডি বিচ।

মুহিতের ধমকে কেঁপে উঠলো ছেলে গুলো,সাথে আশেপাশের মানুষ তাদের তাকিয়ে দেখতে লাগলো।


ছেলেটি আরো শক্ত করে বন্দুক চেপে ধরলো মুহিতের পেটে।

তারা এতটুকু বুঝে গেছে ছেলেটা অন্য দেশের।আর এখানে কোনো ওকারেন্স ঘটালে কেউ বাঁচাতে আসবে না তাকে।

আর একা একটা মানুষ দুজনের সাথে পারবে নাকি?


ছেলেটির ত্যাড়ামো দেখে মুহিতের পায়ের রক্ত মাথায় উঠলো।জুসের গ্লাস টা টেবিলে রেখে খপ করে ডান পাশের ছেলের হাতের কব্জি ধরে ফেলল এবং ছেলেটির হাত  মুচড়ে ভেঙে বন্দুক ওই ছেলের পেটেই তাক করলো।

এরপর গমগমে কন্ঠে বলে উঠলো

―আম বেটার এট গানস শুটিং দ্যান ইউ।

―নাউ মুভ ফ্রম হেয়ার।

আচানক আক্রমণে ছেলে দুটো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো, আর ডান পাশের ছেলেটি হাতের ব্যাথায় রীতিমতো চিৎকার শুরু করেছে।


এর পর মুহিত তার কোমরে গুঁজে রাখা 500 S&w magnam রিভলবার টি বের করে  ছেলেদের দিকে তাক করে বলে উঠলো

―মাই রিভলবার ইজ মোর পাওয়ারফুল দ্যান ইয়ু।

ছেলে দুটি ভয়ে ভয়ে দ্রুত সরে গেলো।


মুহিত নির্বিকার ভাবে আবারো বসে রইলো।অপেক্ষা বার খালি হবার।

বার কি আর কখনো খালি হবে?

লোক সমাগম কমতে থাকার অপেক্ষা করতে লাগলো মুহিত।

 দীর্ঘ অপেক্ষার পর মুহিত বারের পেছনের কক্ষে যাবার রাস্তা ফাঁকা পেলো।আশেপাশে নেশায় কাতর লোকজন।

সুযোগ বুঝে মুহিত কাঙ্খিত কক্ষের দিকে হাঁটা দিলো।


নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে মুহিত খুঁজতে লাগলো কক্ষের নম্বর।কারণ ছোট ছোট কটেজে টাইপের অনেক গুলো রুম আছে এখানে।


রুম নম্বর ফোর জিরো ফোর।

বন্ধ রুম অবশ্যই ভেতর থেকে আটকানো ।এই রুমে যে আশরাফ চৌধুরী আছে তারই বা নিশ্চয়তা কি?

কিছুক্ষন পায়চারি করলো মুহিত।

এরপর করিডোরে রাখা একটি বড় ফুলদানির ভেতরে পকেট থেকে বের করে মিনি ক্যামেরা সেট করে দ্রুত বের হয়ে এলো।


দৌড়ে বের হতেই মুহিত দুজন সিকিউরিটির সাথে ধাক্কা খেলো

তারা এই এরিয়াতে মুহিতকে দেখে অবাকের স্বরে জিজ্ঞেস করলো

―হোয়াটস ইউর রুম নম্বর?

―শো মি ইউর কার্ড।


মুহিত কি করবে ভাবতে লাগলো।আচমকাই নেশাক্ত মানুষের মতো হেলেদুলে অস্পট করে বলে উঠলো

―আম লুকিং ফ----র আ ওয়াশরুম হেয়ার।

লোক গুলো মুহিতের কথা বিশ্বাস করলো কারন প্রায়ই নেশায় বুদ হয়ে মানুষ এই রেস্ট্রিক্ট্রেড এরিয়াতে ঢুকে পড়ে।

সিকিউরিটি মুহিত কে আর না ঘাটিয়ে ওয়াশরুম যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিলো।

মুহিত তাদের থ্যাঙ্কস জানিয়ে দ্রুত সরে আসলো ওই জায়গা থেকে।


বারের বাইরে বেরিয়ে মুহিত আশেপাশে দৃষ্টি বোলালো।

সন্দেহ জনক কিছুই চোখে পড়লো না।এর পর সাবধানে হোটেলের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো মুহিত।


―――――

ঘরে বসে থেকে ভালো লাগছে না আশরাফ চৌধুরীর।নিজের প্রিয় হুইস্কিও নেই সেই কক্ষে।

উশখুশ করে উঠে দাঁড়ালেন আশরাফ চৌধুরী।দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বারের অভিমুখে।


*****

রুমে আসতেই সৌম্য আর আদ্রিয়ান চেপে ধরলো মুহিতকে।তাদের না জানিয়ে কোথায় গিয়েছিলো সে?

এখানে একা একা রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না।কারন আগের বার আশরাফ চৌধুরী মুহিতকে বড় ধরনের ক্ষতি পৌঁছিয়ে ছিলো।

সকল কে থামিয়ে মুহিত বলে উঠলো

―জাল ফেলে এলাম যাতে সময় করে মাছ টা তুলে নিতে পারি।

এর পর হাতের ফোন বের করে ক্যামেরার অপশন ঠিক করতে স্ক্রিনে প্রদর্শিত হলো কটেজের করিডোর।


তিন জনেই স্ক্রিনের উপর হামলে পড়লো।

কীয়তক্ষন বাদেই দেখা গেলো অতিকাঙ্খিত সেই ব্যাক্তিকে।

চকচকে হলো সৌম্য আর আদ্রিয়ান এর চোখ।

কপাল কুচকালো মুহিত।

―ইটজ নট ফোর জিরো ফোর?

ইটজ  ফোর জিরো জিরো!


চলবে।

গল্প তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল পর্ব ২৭

 তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল

পর্ব_২৭

সারিকা_হোসাইন


~~~~~~


তাহলে ধরেই ফেললে আমাকে মেজর মুহিত ওয়াসিফ?


কথাটা বলে আয়েশ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো আহিয়ান।

এর পর চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ মৌন রইলো।

এরপর দুই হাত ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে তাতে থুতনির ভর দিয়ে মুহিত কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো―


আমি যে পাগল নই এটা কিভাবে তুমি প্রমান করবে মেজর মুহির ওয়াসিফ?


―আমি তোমাকে প্রমান করতে আসিনি।

এসেছি বাম্পার এক অফার নিয়ে। সাবলীল উত্তর মুহিতের।


ভ্রু কুঁচকে মুহিতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো আহিয়ান।

কি এমন অফার নিয়ে হাজির হয়েছে সে?


গলা খাকরি দিয়ে  স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো মুহিত

তোমাকে জেল থেকে বের হবার সকল ব্যাবস্থা আমি নিজে করে দেবো আহিয়ান।বিনিময়ে আশরাফ চৌধুরী কে আমার হাতে তুলে দেবে তুমি!তার সাথে বহু হিসেব নিকেশ বাকী পরে আছে আমার।


তুমি আমাকে কেনো পালাতে সাহায্য করবে?আমিও তো তোমার ক্ষতি করতে চেয়েছি।

―তোমার সাথে আমার  সেরকম কোনো শত্রুতা নেই প্লাস তোমাকে ভালো হবার একটা চান্স দিলাম।আর তুমি যেই ভুলটা করেছিলে সেটা ভালোবেসে পাগলামি করেছিলে।

আর কোথাও না কোথাও তোমার জন্য আমার মনে একটা সফট কর্ণার রয়েছে।

কারন পিতৃহীন থেকে মাতৃহীন হয়ে দুনিয়াতে বেঁচে থাকা সবচাইতে কষ্টের।হয়তো তোমার মা বেঁচে থাকলে  আজকে তোমার লাইফের মোড় অন্য কোথাও ঘুরে যেতো।


মায়ের কথা শুনতেই আহিয়ান এর চোখে জ্বালা করতে শুরু করলো।

দেখতে কতো মিষ্টি ছিলো তার মা।মায়ের পুরাতন স্মৃতি তে নিমিষেই ডুবে গেলো আহিয়ান।


আহিয়ান এর সকল দুস্টুমি মেনে আহিয়ানের পিছে পিছে সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়াতো মিসেস অহনা।আহিয়ান ছিলো চঞ্চল প্রকৃতির দুষ্ট ছেলে।বহুবার ঘরের দামি জিনিস ভেঙে ফেলেছে,মা কে ইচ্ছে করে ব্যাথা দিয়েছে,খাবার নিয়ে ঝামেলা করেছে।কোনো দিনও মিসেস অহনা আহিয়ান কে একটা মার তো দূরে থাক ধমক পর্যন্ত দেন নি।সারা রাত মাথায় বিলি কেটে গল্প শোনাতো।মায়ের বুকের ওম বহুদিন ধরে পায়না আহিয়ান।


বাবার সকল কুকীর্তি থেকে সবসময় বুকের মাঝে আগলে দূরে দূরে রেখেছেন।

কিন্তু আহিয়ান?

সে তো  পারেনি তার মা কে আগলে রাখতে।রাক্ষস টা ঠিক তার মাকে কব্জা করে খেয়ে ফেলেছে।আহিয়ান লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু  দেখেছে,কিন্তু কারো কাছে আজ পর্যন্ত প্রকাশ টুকু করতে পারেনি।


আচ্ছা আহিয়ানের এই কুকর্মের জন্য তার মা কি ওপারে অনেক কষ্ট পাচ্ছে?


মুহিতের গমগমে কন্ঠে আহিয়ানের ধ্যান ছুটলো।


―তোমাকে আমার প্রয়োজন আহিয়ান!

আমার কথায় রাজি হয়ে যাও আহিয়ান।

ধরে নিতে পারো

―এ গোল্ডেন অপুরচুনিটি ফর ইয়ু।

কিছুক্ষন ভেবে আহিয়ান বলে উঠলো―


 আমি তো দাগী আসামিতে পরিণত হয়েছি, যতো সহজে তুমি আমাকে পালাতে হেল্প করবে  ভাবছো  বিষয় টা আসলে অতোটা সহজ নয়।


মুহিত ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

তুমি কি জেল থেকে বের হতে চাও নাকি আজীবন এখানেই পঁচে মরতে চাও সেটা তোমার ব্যাপার।

মনে হচ্ছে তুমি এখানেই কমফোর্ট ফিল করছো।থাকো তাহলে আমি উঠি।আমার শিকার আমি নিজেই ঠিক খুঁজে নেবো বলেই কলার ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো মুহিত।


আহিয়ান তোষামোদ এর সুরে বললো 

আরে মেজর এতো অল্পতেই রেগে গেলে কিভাবে হবে?

ভাবার সময় টাতো দিবে!

তুমি পাপার সাথে ঐরকম কিছুই করছে চাচ্ছ যা মোশতাকের সাথে করেছো তাইনা?

বলেই চোখ টিপলো আহিয়ান।


মুহিতের ভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটলো না।

আহিয়ান আবার বলে উঠলো

তোমার দম আছে বলতে হবে মেজর।

আম প্রাউড অফ ইউ।

―আম রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ বলেই হাত তালি দিলো আহিয়ান।


আমি অবশ্যই তোমাকে হেল্প করবো,সে শুধু তোমার বাপ ভাইয়ের খুনি নয়,আমার সহজ সরল অবলা মায়ের খুনিও ওই কসাই টা বলেই রক্তচক্ষু নিয়ে মুহিতের দিকে তাকিয়ে হাত পাঞ্চ করে মুহিতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো

ডিল?

মুহিত আহিয়ানের পাঞ্চে হিট করে বললো

ডিল!


――――

নিস্তব্ধ কক্ষের মাঝে হঠাৎই ঘড়ির  টিকটিক শব্দে লাফিয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসলেন তন্দ্রাচ্ছন্ন আশরাফ চৌধুরী।বসে থাকতে থাকতে কখন যে দুই চোখ লেগে গিয়েছিলো বুঝতেই পারেন নি তিনি।

কতো দিন ধরে এভাবে বসে বসে সময় পার করছেন তার হিসেব অক্ষরে অক্ষরে  করে রেখেছেন তিনি।ওই মেজর কে এর থেকেও জাহান্নাম আজাব ভোগ করাবেন তিনি।


পরিবেশ শুনশান,কোনো মানুষের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না।মাঝে মাঝে দূর রাস্তা থেকে বড় বড় ট্রাকের শব্দ ভেসে আসছে।আর দুই একটা নেড়ি কুকুরের মৃদু শব্দে ঘেউ ঘেউ শব্দ শোনা যাচ্ছে।

হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আশরাফ চৌধুরী।পা টিপে টিপে বের হলেন তার গোপন কুঠুরি থেকে।

তিন তলায় নিজের  শয়ন কক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারলেই অর্ধেক কাজ কমপ্লিট হয়ে যাবে।শুধু অপেক্ষা আলমারি থেকে গোপন ফোনটা বের করার।


অন্ধকার হাতড়ে সিঁড়ির রেলিং বেয়ে বেয়ে দূতলা পর্যন্ত উঠলেন।হঠাৎই সিঁড়ি ঘরের  কর্নারে থাকা শোপিস রেকের সাথে বেঁধে রেক সমেত  পড়ে গেলেন।

নিমিষেই  ঝনঝন শব্দে আলোড়িত হয়ে গেলো নির্জন বাসটা।


ভয়ে সিঁড়ির চিপায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন আশরাফ চৌধুরী।মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি এখন হার্ট এট্যাক এসে যাবে।

বুকের ব্যাথায় দম বের হবার উপক্রম হলো তার।

কিছুক্ষন ওভাবেই শুয়ে থেকে  নিজেকে স্বাভাবিক করে মেজর মুহিতের গুষ্টির পিন্ডি চটকে উঠে দাঁড়ালেন।

আবার রেলিং ধরে ধরে ধীর পায়ে হাঁটা ধরলেন।

এবার সুযোগ পেলে চামড়া তুলে নেবেন তিনি ওই মেজরের।


হাতড়ে হাতড়ে নিজের কক্ষের সামনে এসে দেখলেন দরজা খোলা।

খোলা দরজা দেখে অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকালেন।পরে মুহূর্তেই মনে পড়লো মানুষ সুযোগ বুঝে তার বাড়িতে চুরির অভিযান ও চালায় মানুষ।আমাকে তো খুঁজতে আসে না,আসে কোথা থেকে কি চুরি করা যাবে সেটা দেখতে।

দামি দামি সব নিয়ে যাচ্ছে এক এক করে।যেনো দান বাক্স খুলে বসেছি।

তাচ্ছিল্য হাসলেন আশরাফ চৌধুরী।

সালা সবাই চোর দোষ খালি আমার একার।

সকল ভাবনা ফেলে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলেন।যতো যাই হোকনা কেনো অতো সহজে তিনি ওই হাঁটুর বয়সী মেজরের হাতে ধরা দিবেন না।


বিনা শব্দে রুমে প্রবেশ করে আলমারি খুলে বের করলেন নিজের গোপন ফোন।

সুইচ অন করে ডায়াল করলেন কাঙ্খিত নম্বর।

একবার রিং হয়ে কেটে গেলো।

রাগে ঠোঁট কামড়ে চোখ উল্টালেন আশরাফ চৌধুরী।

বিশ্রী গালাগাল দিয়ে আবার ফোন কানে তুললেন।

রিং হতে হতে কেটে যাবে এমন মুহূর্তে ফোনটি রিসিভ করলো ওপাশের ব্যাক্তি।

খুশিতে ঠোঁট গলিয়ে বেরিয়ে এলো দুপাটি চকচকে দাঁত।

―সোয়াদদী (হ্যালো)

―নি আহমেদ (আমি আহমেদ)

―ছুঁওয়াই ডুওয়াই (আমাকে সাহায্য করো)


ওপাশের ব্যাক্তির কথায় প্রশস্ত হলো আশরাফ চৌধুরীর হাসি।আরো কিছু কথা বলে ফোন কেটে দিয়ে আবার গুপ্ত কুঠুরির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।


রাত টা কোনো ভাবে কাটলেই হলো।মেজর মুহিত তুই আমার ছায়ার ও কোনো খুঁজ পাবি না।বলেই হো হো করে হেসে উঠলো।


*******

―তুমি কি বলছো মুহিত এসব?

তোমার মাথা ঠিক আছে?

এই কাজ আমি কিভাবে করবো?


―স্যার আমি আজ পর্যন্ত আপনার কাছে কোনো দিন সাহায্য চাইনি।প্লিজ স্যার আমাকে এই হেল্প টুকু করুন।


ছেলেটা দাগী আসামি মুহিত তোমাকে এটা বুঝতে হবে!


কেউ যদি তার ভুল বুঝতে পেরে ভালো পথে ফিরে আসতে চায় তাহলে তাকে সেই সুযোগ দেয়া উচিত স্যার।


যেখানে সৃষ্টিকর্তা আমাদের এতো এতো ভুল ক্ষমা করে তওবা করে তার কাছে ফিরে আসার সুযোগ দেয়,সেখানে আমরা তো নগন্য মানুষ স্যার।


মুহিত সবই বুঝতে পারছি তোমার কথা।কিন্তু কেউ যদি জানতে পারে আর্মি জেনারেল স্বয়ং এর সাথে জড়িত আছে আমার উপর কেমন ঝড় ঝাপটা আসবে তুমি বুঝতে পারছো?


স্যার আপনি সেসব কিছুই ভাববেন না।আমার টিম নিয়ে ঠিক আমি সব হ্যান্ডেল করবো।আপনি শুধু  পুলিশ সুপার কে ম্যানেজ করবেন।

প্লিজ স্যার।


আর্মি জেনারেল মুহিতের পিঠ চাপড়ে মাথা নিচু করে প্রস্থান নিলেন।

মুহিত প্রশস্ত হেসে বলে উঠলো 

থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।


―――――

আজকে আহিয়ানের শুনানি।তার মেন্টাল হেলথ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আদালতে নেয়া হবে।তারিখের পর তারিখ বেড়েই যাচ্ছে কিন্তু আহিয়ানের সুস্থ হবার কোনো নাম নেই।

ডাক্তাররাও সমস্যাটা কোথায় সেটা ধরতে পারছেন না।


ক্রিমিনাল ভ্যানে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আহিয়ান কে তোলা হলো।সাথে দুটো কনস্টেবল।

গাড়ি ছুটে চলেছে হসপিটাল এর দিকে।

সামনে পুলিশের ডিউটিরত এস আই এর গাড়ি মাঝখানে আহিয়ানের গাড়ি,পিছনে মটর সাইকেল এ দুজন কালো পোশাকে আবৃত কারী ব্যাক্তি।


গাড়ি চলতে চলতে হঠাৎ ই নির্জন একটি রাস্তায় এসে ব্রেক কষলো।

সামনে কেউ তুমুল মারামারি লাগিয়েছে রাস্তা বন্ধ করে।

দুই পাশ থেকেই রাস্তা বন্ধ করেছে ছেলে গুলো।

কি নিয়ে তাদের মারামারি এটাই কেউ বুঝতে পারছে না।

এস আই কনস্টেবল দুটোকে নির্দেশ দিলেন গাড়ি থেকে নামতে।


ছেলে গুলো নিজেদের গাড়ি গুলো রাস্তায় এমন ভাবে পার্কিং করেছে কোনো পাশ থেকেই অন্য গাড়ি গুলো ঢুকতে পারছে না।।


কনস্টেবল নামতেই কালো পোশাকের লোক গুলো পুলিশ ভ্যান এর সাটার এর হ্যাজবল খুলে সুনিপুণ কৌশলে  আহিয়ান কে বের করে তাদের বাইকে বসালো।

উল্টো দিকের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে বাইক জোরে টান দিয়ে ধুলো উড়িয়ে নিমিষেই হারিয়ে গেল অজানা গন্তব্যে।


কিছুক্ষণ বাদে মারামারি থামিয়ে কনস্টেবল দুটো পুলিশ ভ্যানে এসেই চোখ বড় বড় করে ফেললো।

এটা কিভাবে সম্ভব।

তারা তো আহিয়ান কে হ্যান্ডকাফ সমেত গাড়ির সিটের সাথে শিকল দিয়ে তালা দিয়ে গেছিলো।

নিমিষেই খবর পৌঁছে গেলো উপর মহল পর্যন্ত।

এস আই দৌড়ে এসে পড়ে থাকা হ্যান্ডকাফ দেখে  বলে উঠলেন

―ওহ শীট।


শো কজ কি করবেন সেটা ভেবেই ঘাম ছুটে গেলো প্রত্যেকের।


মানুষ তো অবশ্যই প্রশাসনের অক্ষমতার দিকে আঙ্গুল তুলবে।

বিষয়টা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো হয়ে গেলো।

দ্রুত মর্গ থেকে এক্সিডেন্ট এ মারা যাওয়া চেহারা বিকৃত বেনামি একটি লাশ নিয়ে মিডিয়া ডেকে  পুলিশ সুপার জানিয়ে দিলেন


আদালতে নেবার পথে গাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে আহিয়ান।

একদিকে পুলিশের ধাওয়া অন্যদিকে ব্যাস্ত রাস্তা ।

হঠাৎই সিলিন্ডার ভর্তি একটা ট্রাক এসে আহিয়ান কে পিষে দেয়।

সাথে সাথেই স্পট ডেট হয়ে যায় আহিয়ানের।


কু কথা বাতাসে ছড়ায় বেশি।

ঠিক তেমন ভাবেই নিমিষের মধ্যেই আহিয়ানের এক্সিডেন্ট করে মৃত্যুর খবর পুরো শহর ছড়িয়ে গেলো।

কেউ কেউ খুব খুশি হলো আবার কেউ কেউ দুঃখ পেলো।


――――

পেরিয়ে গেছে দুটো দিন।আহিয়ানের সেই জাহাজে আহিয়ান কে তুলে দিতে এসেছে মুহিত আর মেজর আদ্রিয়ান।

মুহিত কে জড়িয়ে ধরে আহিয়ান বলে উঠলো

―যেই উপহার তুমি আমাকে দিয়েছো মেজর এর এহসান একদিন ঠিক চুকাবো ব্রো।

বলেই চোখ মুছে দ্রুত জাহাজে উঠে গেলো।

মুহূর্তেই ভো ভো শব্দ করে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে পতেঙ্গা বন্দরের ছোট ছোট  ঢেউ চিড়ে ধীরে ধীরে চলতে লাগলো ডেড সৌল।

এর পর স্পিড বাড়তে থাকলো।ধীরে তা মিলিয়ে গেলো সমুদ্রের ঘোর অন্ধকারে।


আহিয়ান যাবার আগে মুহিত কে অনেক ক্লু দিয়ে গেছে।সেই হিসেবেই মুহিত তার পরবর্তী কাজ শুরু করবে।


রাতটা কোনো ভাবে কাটাবে তারা এখানে।সকালে নোভোএয়ারে তাদের ডমেস্টিক ফ্লাইট আছে।


★★★

চট্রগ্রাম শাহ আমানত বিমান বন্দর এ এসে পৌঁছালো মুহিত আর আদ্রিয়ান।

ইমারজেন্সি টিকিট কাটা আছে তাদের।

বিমানবন্দরে ঢুকতেই এক বিদেশি পর্যটক এর সাথে ধাক্কা খায় আহিয়ান।পর্যটক তার আপন ভাষায় কিছু কথা বলে উঠে।

আহিয়ান ইংরেজিতে প্রশ্ন করলে দৌড়ে আসে পর্যটকের গাইড।

সরি স্যার,সে থাইল্যান্ডের নাগরিক।এখানে ঘুরতে এসেছে।তারা ইংরেজি বলতে পারেনা।

মুহিত আর আদ্রিয়ান ভদ্রতাসূচক আরো কিছু আলাপ করে ডমেস্টিটিক এরিয়াতে এসে নিজেদের টিকিটের সব কিছু ঠিক করে বিমানে উঠে বসে।


মুহিতের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কেনো ওই বিল্ডিং এ বার বার  গিয়েও টাইলস গুলো চেক করে দেখলো না।কেনো তার মাথায় এই বুদ্ধি আগে এলো না।

বিমান ছাড়বে সেই অনাউন্স বেজে উঠলো।

সিট বেল্ট বেঁধে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিলো মুহিত।

অল্প সময়ের জার্নি।

একটু পরেই প্লেন ল্যান্ড করবে।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই সে আদ্রিয়ান কে নিয়ে চৌধুরী ম্যানশন এ যাবে।


*****

সকল ঝামেলা পেরিয়ে এক ঘন্টার একটু বেশি সময় লাগলো মুহিত আর আদ্রিয়ান এর এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে।

ঢাকা বিমানবন্দরের পার্কিং এরিয়াতে আসতেই সৌম্যের দেখা পাওয়া গেলো।গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।

তাদেরকে দেখেই গাড়ি স্টার্ট দিলো।

গাড়িতে উঠে বসতেই মুহিত বলে উঠলো আশরাফ চৌধুরীর বাড়িতে চলো ক্যাপ্টেন।


রাস্তায় জ্যাম ঠেলে আসতে আসতে চল্লিশ মিনিট সময় লাগলো চৌধুরী ম্যানশনে পৌঁছাতে।

গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়ে ভেতরে প্রবেশ করলো তিনজনে।

গ্রাউন্ড ফ্লোরে দক্ষিণ পাশের প্রত্যেকটি টাইলসে হাত দিয়ে বাড়ি দিতে দিতে এক জায়গায় গিয়ে ফাঁপা মনে হলো।

পাশেই একটা টাইলস এ ছোট হ্যান্ডেল এর মতো দেখা গেলো।

সেটা ধরে টান দিতেই কূপের মুখের মতো গর্ত দেখা গেলো সাথে স্টিলের মই যা নিচের ওয়ালের সাথে ফিটিং করা।

মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে নেমে পড়লো তিন জনই।


ভেতরে ঢুকতেই তাদের চোখ ছানাবড়া।

ঝকঝকে পরিপাটি গুছানো  কক্ষ।দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে কেউ অবস্থান করছে নিয়মিত।

প্যাকেট জাত খাবারের খোসা ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।

তন্ন তন্ন করে সারা কক্ষ খুঁজেও আশরাফ চৌধুরী কে পাওয়া গেলো না।

দৌড়ে উপরে উঠলো তিন জনেই।

চার তলা থেকে চারটি মিনি রেকর্ডার ডিভাইস বের করে আনলো মুহিত।

সেগুলোর মেমরি খুলে প্রত্যেকেই নিজেদের ফোনে লাগালো।


প্রথম টা থেকে কোনো সাউন্ড পাওয়া গেলো না।দ্বিতীয় টা থেকে ঝনঝন শব্দে তারা সজাগ হলো।

আর কোনো শব্দ নেই সেটাতে।


তৃতীয় টা থেকে অনেকক্ষন বাদে অদ্ভুত কিছু ভাষা শুনতে পাওয়া গেলো।

ভ্রু কুঁচকে এলো প্রত্যেকের।

আদ্রিয়ান বলে উঠলো

কমরেড ভাষা গুলো খুব পরিচিত লাগছে।

মাথায় জোর দিতেই  মনে পড়লো কোথায় শুনেছে সেই ভাষা।


সেই থাইল্যান্ডের পর্যটকের কাছে।


রেকর্ডেড কথা গুলো গুগল ট্রান্সলেট করে অর্থ বুঝতেই মুহিতের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো।

সজোরে দেয়ালে এক ঘুষি বসিয়ে দিলো।


মুহূর্তেই বাঁকা হাসলো মুহিত।

চলুন মেজর আদ্রিয়ান থাইল্যান্ড যাওয়া যাক।


চলবে।

গল্প তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল পর্ব ২৬

 তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল

পর্ব_২৬

সারিকা_হোসাইন®


★★★★

মেঘলা আকাশ সাথে শিরশিরে বাতাস,সব মিলিয়ে যেনো ঘুরতে যাবার উপযুক্ত সময় এটা।

মানুষ সামাজিক জীব,সমাজে বেঁচে থাকার অদম্য লড়াই করতে গিয়ে মানুষ পরিণত হয়েছে যন্ত্র চালিত রোবটে।

টাকার পিছে,একটু সুখে থাকার আশায়,ভালো খাবারের জন্য মানুষ তার সকল চাওয়া পাওয়া ইচ্ছে, অনিচ্ছা সব কিছু যেনো মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছে।সকল দায়িত্ব পূরণ করতে গিয়ে নিজের জন্য সময় বের করাই যেনো দুষ্কর।


যান্ত্রিক এই জীবন কে ছুটি দিয়ে মুহিত আর স্বর্গ একটু ভালো ভাবে নিজেদের জন্য সময় কাটাতে এসেছে ফ্যান্টাসি কিংডম এ।

আজ তারা তাদের সকল ক্লান্তি ভুলে,ডিউটি ভুলে,কারো অর্ডার এর তোয়াক্কা না করে বাঁধাহীন একটি দিন উপভোগ করবে।


বড় হবার সাথে সাথে মানুষ শৈশবের সবকিছু ভুলে যায়,বা শৈশবের জিনিস গুলো করতে গেলে অনেকে নাক ছিটকিয়ে বলবে ―বুড়ো বয়সে ঢং!

কিন্তু যেই আনন্দঘন শৈশব একবার হারিয়ে গিয়েছে তা কি আর ফিরে পাওয়া যাবে কোনো দিন?


স্বর্গের আজ বাচ্চা হতে ইচ্ছে হয়েছে।আজকের দিন সে তার ছোটবেলায় যেভাবে হেসে খেলে কাটিয়েছে সেভাবে কাটাবে।সাথী হিসেবে মুহিত রয়েছে।


প্রথমে তারা দুটো টিকিট নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।

টিকিটের সাথে যেই রাইড গুলো আছে তারা প্রথমে ওগুলো ট্রাই করবে।

প্রথমে মুহিত ডিসাইড করলো তারা  রোলার কোস্টার এ উঠবে।

স্বর্গকে যতোটা উচ্ছসিত দেখা গিয়েছিলো প্রথমে, রোলার কোস্টার এর নাম শুনেই মুখ চুপসে গেলো তার।

কিন্তু মুহিত খুব এক্সাইটেড।স্বর্গকে বগল দাবা করে মুহিত ছুটলো রোলার কোস্টার এর দিকে।

একদম সামনের সিটে বসে পড়লো মুহিত।

স্বর্গ নিজেকে মুহিতের সামনে দুর্বল প্রমান করতে নারাজ।নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু হাত পা কাঁপছে।

কিছুক্ষন পর ব্যারিকেড হ্যান্ডেল গায়ের সাথে সেটে গেলো।

স্বর্গ বুঝতে পারলো এখন এটা চালু হবে।

সাথে সাথেই মুহিত কে খামচে ধরলো।

হোহো করে হেসে কুটিকুটি হলো মুহিত।

স্বর্গকে জিজ্ঞেস করলো 

""ভয় লাগছে মনা?""

স্বর্গ কিছু উত্তর করার আগেই  ছুটে চললো রোলার কোস্টার,ধীরে ধীরে স্পিড বাড়তে থাকলো।

স্বর্গ প্রথমে যেই ভয়টা পেয়েছিলো নিমিষেই সেটা আনন্দে পরিণত হলো।

খুশিতে চিল্লাতে চিল্লাতে চোখ দিয়ে পানি বের করে ফেললো সে।


এর পর বড় যেই নৌকা স্যান্টা মারিয়া আছে ঐটাতে উঠলো।

এবারো মুহিত একদম লাস্টের মাথায় গিয়ে বসবে।

তার মতে যতো উপরে উঠে দোল খাওয়া যাবে ততো মজা।

স্বর্গ এবার কিছুতেই উপরে উঠবে না।

মুহিত টেনে হিচড়ে জোর করে স্বর্গকে নিয়ে বসিয়ে দিলো একদম লাস্ট মাথায়।

শুরু হলো দোল।

স্বর্গ ভয়ে চোখ বন্ধ করে হ্যান্ডেল চেপে ধরে খিচে  বসে রইলো।

তার মনে হচ্ছে সে হাওয়ায় ভাসছে।তার পায়ের নীচে সব ফাঁকা।পেটের ভেতর থেকে সব বেরিয়ে যাচ্ছে।

পুরো সময় সে চোখ বন্ধ করেই কাটালো।

এর পর বাম্পার কার খেলায় স্বর্গ মুহিত কে চোখ ইশারায় বুঝিয়ে দিলো

―দেখে নেবো তোকে।

মুহিত ফিচেল হাসলো।

শুরু হলো দুজনের টক্কর,স্বর্গ মুহিত কে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে এসে মেরে দিচ্ছে ।বিজয়ীর হাসি স্বর্গের চোখে মুখে।

মুহিত ইচ্ছে করেই স্বর্গকে জিতিয়ে দিয়ে মনে মনে হাসলো আর বললো

―বাচ্চাটা আমার।


একে একে সব গুলো রাইড শেষ করে বেরিয়ে আসে তারা।

হাসতে হাসতে গাল ব্যাথা হয়ে গেছে স্বর্গের।

মুহিত আদুরে স্বরে জিজ্ঞেস করে

―ম্যাডাম  আপনার নেক্সট প্ল্যান কি ?

এক বাক্যে স্বর্গ পেটে হাত দিয়ে বলে উঠলো

―খাবো।

খুব খিদে পেয়েছে।

দুজনেই জিপে উঠে বসলো,মুহিত গাড়ি হাকালো ভালো রেস্টুরেন্টের দিকে ।

আধঘণ্টা বাদে তারা রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেলো।

 রেস্টুরেন্টে ঢুকে ওয়েটার ডেকে ইচ্ছে মতো অর্ডার দিলো স্বর্গ।

ওর্ডার দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেস হতে।

মিনিট পাঁচেক পরে ফিরে এসে খাবার এখনো দেয়নি কেনো ?

সেটা নিয়ে মুহিত কে খুঁচিয়ে যাচ্ছে।


মুহিত ভাবছে  অন্য কথা!

―এই ছোট পেটে এতো খাবারের জায়গা হবে কি করে?

তবুও মুখে কিছুই বললো না,পরে দেখা যাবে রেগে মেগে খাবারই খাবে না।

অযথা ঝামেলার দরকার কি বাবা?

শুধু  মাথা ঝাকিয়ে আসবে, আসবে, বলে অপেক্ষা করতে বললো।


কিছুক্ষন পর তিন জন ছেলে ধীরে ধীরে খাবার গুলো  নিয়ে টেবিলে পরিবেশন শুরু করলো।

খাবার রেখে চলে যেতেই স্বর্গ দুই হাতে দুটো স্পুন নিয়ে উচ্ছসিত হয়ে  মুহিতের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো

―লেটস ডিগ ইট!


একের পর এক খাবার মুহূর্তেই সাবাড় করে দিচ্ছে স্বর্গ।

মুহিতের মনে হচ্ছে খাবার গুলো বোধ হয় বেশি স্বাদ।

নিজেও টেস্ট করে দেখলো।

উহু আহামরি কিছুই না।

মুহিত যেনো আজ অন্য আরেক স্বর্গ কে দেখছে।

যেই মেয়ে এতো ডায়েট মেইনটেইন করতে করতে শুকিয়ে শুঁটকি মাছ হয়ে আছে,সেই মেয়ের ডায়েট ফায়েট আজ কোথায় তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালালো?


মুহিত ভেবেছিলো অর্ধেকের বেশি খাবার নষ্ট হবে,কিন্তু মুহিতকে ভুল প্রমাণ করে স্বর্গ সব খেয়ে ফেলেছে।

মুহিত  একটা ড্রিংকস এর বোতলে স্ট্র ঢুকিয়ে স্বর্গের পানে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো

―আরো কিছু খাবে সোনা?

স্বর্গ মাথা নেড়ে  অর্ডার দেয়ার ভঙ্গিতে বললো

―নো, এখন শপিংয়ে যাবো।


রেস্টুরেন্টের বিল মিটিয়ে মুহিত আবার গাড়ি হাকালো।গন্তব্য স্বর্গের পরিচিত শপিংমল।

কেনাকাটা শেষ করতে করতে রাত আটটা বেজে গেলো।এদিকে নাফিজ মাহমুদ সমানে ফোন দিয়ে যাচ্ছে তারা কোথায়?

সৌম্যের বাবা মা এসেছে।

স্বর্গকে নিয়ে দ্রুত জিপে বসলো মুহিত।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে স্পিড বাড়িয়ে দিলো।

রাত  সাড়ে নয়টার মধ্যে পৌঁছে গেলো নাফিজ মাহমুদ এর বাংলো তে।


শপিং ব্যাগ গুলো দুই হাতে জাপ্টে ধরে বহু কষ্টে হেলেদুলে উপরে উঠে গেলো স্বর্গ।

মুহিত সৌম্যের বাবা মায়ের সাথে কুশল বিনিময় করে ফ্রেস হতে গেলো।


সৌম্যের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল মধুপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।সেখান থেকে আসতে তাদের একটু দেরি হয়ে গেছে।ঠিক সময়ে গাড়ি ধরতে না পারায় দুপুরে পৌঁছনোর কথা থাকলেও সন্ধে গড়িয়ে গেছে।

সৌম্যের বড় একটা বোন আছে,তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।

সৌম্যের বাবা মা দুজনেই খুবই সাধাসিধে আর মিশুক প্রকৃতির।

পিউকে তারা খুবই পছন্দ করেছে।

সৌম্য আর পিউ চাইলে তারা আজকেই আংটি পড়িয়ে আকদ করে রাখবে।।


সৌম্যের বাবা মায়ের আরো কয়েকদিন পরে আসার কথা ছিলো।পিউ এর কথা চিন্তা করে সৌম্য আজই তাদের ফোন করে নিয়ে এসেছে।

মুহিত সৌম্যকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো কি করতে চায় সে?

সৌম্য সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো 

―স্যার আমি আজকেই আকদ করাতে চাই,আগামী সপ্তাহে ওকে তুলে নেবো।পিউ ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছে।ওর এখন আমাকে  বিশেষ প্রয়োজন।মুখে না বললেও আমি বুঝতে পারি।

বলেই মাথা নিচু করলো সৌম্য।


মুহিত সৌম্যের কাঁধ চাপড়ে ড্রয়িং রুমে এসে বসলো।

পকেট থেকে ফোন বের করে মেজর আদ্রিয়ান এর নম্বর ডায়াল করলো।

―কাজী নিয়ে আসুন মেজর আদ্রিয়ান।

সকলের মুখে হাসি ফুটলো,পিউ নার্ভাস হয়ে গেলো।


পিউকে গোসল করিয়ে বিছানায় বসালো স্বর্গ।

এরপর মুহিতের শপিং করে দেয়া ব্যাগ হাতড়ে একটা মেরুন রঙের সোনালী পাড়ের জামদানি শাড়ি  বের করলো।

সাথে কিছু নতুন সিম্পল গহনা।

পিউকে দেখিয়ে বললো এগুলো তোর জন্য এনেছি।

পছন্দ হয়েছে?


পিউ নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিলো।স্বর্গ পিউকে জড়িয়ে ধরে বললো

―কিচ্ছু হয়নি,মনে কর আমি তোর বোন।মাম্মা,বাপী তোর ও মাম্মা বাপী।

এখান থেকেই তোর বিয়ে হবে,বিয়ের পর তোর নাইয়র ও এখানেই করবি।

কি করবি তো?

শাসিয়ে জিজ্ঞেস করলো স্বর্গ।

পিউ চোখের জল মুছে মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকালো

সে অবশ্যই আসবে!


খুবই সিম্পল ভাবে, ঘরোয়া পরিবেশে আংটি বদল আর আকদ হয়ে গেলো।

আগামী সপ্তাহে সেনা কুঞ্জে বড় অনুষ্ঠান করে সৌম্য পিউকে ঘরে তুলবে।

বিয়ে নিয়ে পিউ এর অনেক ফ্যান্টাসি ছিলো।

সৌম্য সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।

বাবা মা পাশে নেই তো কি হয়েছে?সৌম্য তো মরে যায়নি।এখনো অক্ষত অবস্থায় পিউ এর সামনে শ্বাস নিচ্ছে।


যদিও বিয়ের পর কিছু ঝামেলা আছে,সৌম্য এখনো ব্যাচেলর অফিসার্স কোয়ার্টার এ থাকে,বিয়ের পর কোয়ার্টার এর জন্য আবেদন করলে সেটাও সাবমিট হতে একটু সময় লাগবে।

তবুও সৌম্য সব ভেবে রেখেছে।

বাইরে বাসা নেবে সৌম্য দরকার পড়লে।তবুও পিউকে একা ছাড়বে না।

রাত বারোটা নাগাদ সকল কাজ শেষ করে সৌম্য আর মুহিত চলে যায় তাদের কোয়ার্টার এ,সৌম্যের বাবা মা থেকে যায়।

তারা ভোরে গ্রামে ফিরে যাবে।

তিন কুলে তেমন নিকট আত্মীয় না থাকায় কাউকে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করার ও ভেজাল নেই।

অনুষ্ঠানের আগের দিন তারা চলে আসবে বড় মেয়েকে নিয়ে।


――――

রাত একটা বেজে দশ মিনিট।কোনোভাবেই মুহিতের ঘুম আসছে না।কাল দুপুরে আহিয়ান এর সাথে ভিজিটিং আছে।

দুইয়ে দুইয়ে চার  কিছুতেই যেনো মিলছে না।

আশরাফ চৌধুরী গেলো টা কোথায়?


সহসাই লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো মুহিত।

সেনা নিবাস থেকে আশরাফ চৌধুরীর বাসা বিশ মিনিটের রাস্তা।

দুস্টু বুদ্ধি খেলে গেলো মুহিতের মাথায়।


কালো একটা শার্ট পরে মাথায় নরমাল ক্যাপ পরে মুখে মাস্ক লাগিয়ে চোরের মতো পা টিপে অন্ধকার হাতড়ে বেরিয়ে এলো গেটের কাছে।

আসতেই নাইট গার্ড কে গেটের কাছে আসতে দেখে একটা ঝাউ গাছের পিছনে লুকিয়ে গেলো।

লোকটি সরতেই দ্রুত গতিতে গেট বেয়ে লাফিয়ে রাস্তায় চলে এলো।

নাইট গার্ড শব্দ পেয়ে দৌড়ে গেটের কাছে এসে কিছুই দেখতে পেলো না।


প্রথমে ধীরে পরে জোরে হেটে একসময় দৌড়াতে শুরু করলো মুহিত।

দৌড়াতে দৌড়াতে চৌধুরী ম্যানশন এর সামনে এসে হাঁটুতে হাত দিয়ে হাপাতে লাগলো।

কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রেস্ট নিয়ে ছোট টর্চ বের করে আবার গেট টপকে ভেতরে ঢুকলো মুহিত।

কোমরে রাখা রিভলবার হাতে পজিশন করে ধরে ধীরে ধীরে আগাতে থাকলো।

মানুষজন ধাক্কাধাক্কি করে,ঢিল ছুড়ে বাড়ির অবস্থা ঝকরমকর করে ফেলেছে।

মেইন গেটের লক পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলেছে।

মুহিত বিনা শব্দে প্রত্যেকটি তলায় ঘুরে ঘুরে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলো।সন্দেহ জনক কিছুই পেলো না।তবুও হাল ছাড়ার পাত্র সে নয়।


 সুযোগ বুঝে প্রত্যেক টি তলায় একটি করে স্পাই মিনি ভয়েস রেকর্ডার সেট করে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।

মুহিত শতভাগ নিশ্চিত আশরাফ  চৌধুরী বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে।


হাটতে হাটতে ফেরার পথে নাফিজ মাহমুদ এর বাংলো দেখে সুপ্ত ইচ্ছে জেগে উঠলো মুহিতের মনে।

রাত তিনটে বাজে তবুও তার পা এই রাস্তা থেকে সরছে না।

ফোন বের করে স্বর্গের নম্বরে কল করতেই রিসিভ করলো স্বর্গ।

ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো 

হ্যালো মুহু!

মুহিত যেনো এই রোমাঞ্চকর কন্ঠ শুনে আরো পাগল হয়ে গেলো।

নিজেকে সামলে বলে উঠলো

―পাঁচিল টপকে যদি তোমাদের দরজার সামনে যাই আমাকে তোমার সাথে ঘুমুতে দেবে?

মুহিতের কথায় নিমিষেই স্বর্গের ঘুম ছুটে গেলো।


""ছেলে বলে কি!"


দ্রুত বেলকনির দরজা খুলে আশেপাশে তাকিয়ে বললো

―কোথায় তুমি?তোমাকে তো দেখছি না।

মুহিত ফিসফিস করে বলে উঠলো

―আলোতে দাঁড়িয়ে দাঁত ক্যালাবো যাতে চোর মনে করে গার্ড ধরে ফেলে?

স্বর্গ আঙ্গুল কামড়ে ভাবতে লাগলো কি করবে।

পিউ আজ গেস্ট রুমে ঘুমিয়েছে। সৌম্যের বাবা মা ও নীচে ঘুমুচ্ছে।


মুহিত কে মেইন গেট দিয়ে আসার সময় হঠাৎ কেউ যদি দেখে ফেলে?


মুহিত আবার বলে উঠলো 

""কি ব্যাপার কথা বলছো না কেনো?

― ফিরে যাবো?

তড়িঘড়ি করে স্বর্গ বলে উঠলো 

এমা, না না,যেও না।

– শুনো,আমার রুমের পিছনের বেলকনি দিয়ে উঠতে পারবে?

পাইপ বেয়ে কিন্তু উঠতে হবে!

মুহিত সিচুয়েশন বুঝলো,তবুও মনের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হবে কার সাধ্য?


ফোন কেটে সুযোগ বুঝে পাঁচিল টপকে স্বর্গের পিছনের বেলকনির দিকে অগ্রসর হলো।দুটো বেলকনি ই খোলা,গ্রিল হীন।আকাশের চাঁদ হাতে পেলো মুহিত।

লম্বা মানুষ চাইলেই অসাধ্য সাধন করতে পারে।

একটু পাইপ বেয়ে উঠতেই প্রথম বেলকনিতে উঠতে পারলো।

এর পর কোমড় সমান ইটের গাঁথুনি তে পাড়া দিয়ে স্বর্গের বেলকনিতে উঠে পড়লো।এদিকে হাত ছিলে গেলো সামান্য।সেসব গায়ে মাখলো না মুহিত।


বেলকনির দরজা আটকে স্বর্গ মুহিতকে বিছানায় বসতে দিলো।এর পর পানির বোতল এগিয়ে দিলো।

ঢকঢক করে পুরো বোতলের পানি সাবাড় করলো মুহিত।

হঠাৎ ই ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান চোখে জিজ্ঞেস করলো স্বর্গ

―এমন ভুত সেজে কোথায় গিয়েছিলে?

কেনো আমাকে দেখে খুশি হওনি?পাল্টা প্রশ্ন করলো মুহিত।

আচ্ছা তাহলে চলে যাই বলেই উঠে দাঁড়ালো।

কুনুই বরাবর টেনে ধরলো স্বর্গ

―কখন বললাম খুশি হইনি?

ঘুম পাচ্ছে শুয়ে পড়লাম বলেই মুহিত বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে গেলো।

স্বর্গ বেয়াক্কেল এর মতো দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করল

―এহ?তুমি ঘুমুতে এসেছো এখানে?

―গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে মুহিত রসিয়ে রসিয়ে বললো

―অনেক কিছুই করতে এসেছি।শুয়ে পড়ো  বেশি কথা না বলে।


লাইট অফ করে নীল রঙা ডিম লাইট জ্বালিয়ে দুরুদুরু বুক নিয়ে মুহিতের পাশে শুয়ে পড়লো স্বর্গ।

হঠাৎ ই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মুহিত স্বর্গ কে।


এর পর ফিসফিস করে স্বর্গের কানের কাছে মুখ এনে বললো

―আগামী মাসেই বিয়ে করে তুলে নিয়ে যাবো তোমাকে,এভাবে আর থাকা যাচ্ছে না।

মুহিতের গরম নিঃশ্বাসে শিহরণ বয়ে গেলো স্বর্গের সারা শরীরে।

শক্ত করে  মুহিত কে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

স্বর্গের চোখে মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো মুহিত।

মুহিতের চুল খামচে ধরলো স্বর্গ।

নিজেকে আর কন্ট্রোলে রাখা গেলো না।

নিমিষেই উন্মাদনায় দুজন দুজনের মাঝে হারিয়ে গেলো।


★★★★

আজ নয় তারিখ,কাঙ্ক্ষিত সেই সময় একটু পরেই ঘনিয়ে আসবে।

সৌম্যকে না নিয়ে সিভিল ড্রেসে নিজের কালো রঙের কে টি এম বাইক স্টার্ট দিলো মুহিত।মাথায় কালো হ্যালমেট লাগিয়ে ছুটে চললো হাজতে।

নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘন্টা আগে এসে দাঁড়িয়ে আছে মুহিত।আজ তার অনেক কাজ।

সকল কাজের দ্রুত সমাধা না করলে সমস্যা ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকবে।

একদিকে মা বোন,অন্যদিকে বউ।

সবাই চুম্বকের মতো টানছে কিন্তু কারো কাছেই যাওয়া যাচ্ছে না।

আশরাফ চৌধুরী কে নির্মূল করে তবেই ধুমধাম করে স্বর্গ কে ঘরে তুলবে মুহিত।

শত্রু বাঁচিয়ে রেখে আনন্দ উল্লাস করতে মন সায় দিচ্ছেনা এবার।

এদিকে অপেক্ষা করতেও কষ্ট হচ্ছে।

অপেক্ষার সময় সবচেয়ে দীর্ঘ।


হঠাৎই এলার্ম বেজে উঠলো ফোনে।ধ্যান ছুটে গেলো মুহিতের।

দুটো বেজে চল্লিশ মিনিট।আর মাত্র পাঁচ মিনিট পরেই শুরু হবে দর কষাকষি।

কতদিন চালাতে হবে আর এই তামাশা?

ভিজিটিং রুমে বসে পায়ের উপর পা তুললো মুহিত।

চোখ বন্ধ করে গুনলো

―ওয়ান,টু,থ্রি!

আহিয়ান এসেছে।

আহিয়ান কে দেখেই মুখের হাসি প্রশস্ত হলো মুহিতের।


মুহিতকে দেখেই আবোল তাবোল বলতে শুরু করলো আহিয়ান।

মুহিত চোখ দিয়ে ইশারা করতেই কারারক্ষী বাইরে চলে গেলো।


সোজা হয়ে বসলো মুহিত।

এক ভ্রু বাঁকা করে ফিচেল হেসে আহিয়ান কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো

―নিজের ফর্মে এসো আহিয়ান।

―ইউ আর আন এবল টু ডজ মুহিত ওয়াসিফস আইজ!


চলবে।