তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
পর্ব_৩২
সারিকা_হোসাইন
★★★
ডিসেম্বর মাস,ঢাকায় একটু একটু শীত পড়তে শুরু করেছে।শীতের আমেজ চার পাশে পরিলক্ষিত।সন্ধ্যা নামতেই হালকা ধোয়ার মতো কুয়াশা জাল বিছিয়ে দিচ্ছে সর্বত্র।
আজ স্বর্গের গায়ে হলুদ।বিয়ে নিয়ে প্রতিটা মেয়ের অনেক কল্পনা জল্পনা থাকে।স্বর্গ ও তার ব্যাতিক্রম নয়।গায়ে হলুদ থেকে শুরু করে রিশিপশন পর্যন্ত সব কিছু মন মতো হওয়া চাই।
নাফিজ মাহমুদ এর বাড়ী আত্মীয় স্বজনে গিজগিজ করছে।বড় বড় আর্মি অফিসারের ছোট ছোট বাচ্চাগুলো ঘরময় দৌড়ো দৌড়ি করে এই সন্ধাটাকে আরো চাঞ্চল্যকর করে তুলেছে।
ছোট বড় প্রত্যেকে আজ কাজে ব্যাস্ত।কেউবা ফল ডেকোরেশন করছে,কেউবা পায়েস এর থাল সাজাচ্ছে কেউবা আবার গার্ডেন এর পাশে হলুদের স্টেজ সাজাতে ব্যাস্ত।
আজকের এই মধুমাখা হলুদ সন্ধ্যায় স্বর্গ গায়ে জড়িয়েছে কাঁচা হলুদ রঙের জামদানি সাথে গোলাপি রঙের জারবেরা আর জুঁই ফুলের অধফোটা কুঁড়ির তৈরি গহনা।
মুখমন্ডলে হালকা মেকআপের টাচ,তরতরে সোজা সিল্কি বাদামি চুলগুলো আজ সে কার্ল করেছে।ঠোঁটে গ্লোসি হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক।
পার্লার থেকে হেনা আর্টিস্ট এসে দুপুরেই খুব সুন্দর করে মেহেদী পরিয়ে দিয়ে গেছে
মুহিত পই পই করে বলেছে দুই হাতের তালুতেই ডিজাইনের ভীড়ে তার নামের অক্ষর থাকা চাই ই চাই।
স্বর্গ হেনা আর্টিস্ট কে বার বার বলে দিয়েছে ডিজাইনের প্রত্যেকটা ফাঁকা জায়গায় যেনো সে "M" লিখে দেয়।
স্বর্গের এহেন পাগলামি কাণ্ডে হেনা আর্টিস্ট ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।
পিউ এসে স্বর্গকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে,কোথাও কোনো সাজে ভুল আছে কি না।
নাহ সেরকম কিছুই দৃষ্টিগত হলো না।
"তোকে আজ রূপকথার রাজকুমারী দের মতো লাগছে "
বলেই চোখের নিচে থেকে কাজল এনে স্বর্গের গ্রীবাদেশে লাগিয়ে দিলো পিউ।
"আজ মেজর মুহিত তোকে দেখে জ্ঞান হারাবে"
বলেই কুনুই দিয়ে স্বর্গের হাতে গুঁতো দিলো পিউ।
আচানক কোথায় থেকে যেনো সুখ এসে ঢুকে পড়লো স্বর্গের কক্ষে।
কোমরে হাত দিয়ে বিজ্ঞের ন্যায় ঠোঁট ফুলিয়ে কিছু ভাবলো।
এর পর গমগমে কণ্ঠে বলে উঠলো
একটা সত্যি কথা বলবো?
পিউ মনে মনে ভাবছে এখনই লাগবে দুটোর ঝগড়া আর সেই ঝগড়ায় নষ্ট হবে সাজ।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুখ বলে উঠলো
"তোকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে"
"আচ্ছা থাক আমি চলি বলেই দরজার কাছে এসে দাড়ালো সুখ।
স্বর্গের পানে দৃষ্টি বুলিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো এর পর চিল্লিয়ে বলে উঠলো
"তোকে আস্ত একটা ডাইনি লাগছে,পিশাচিনি।জিজু দেখলে নির্ঘাত হার্ট এট্যাক করবে"
বলতেই পায়ের স্যান্ডেল ছুড়ে মারলো স্বর্গ।
হাসতে হাসতে সুখ দৌড়ে পালালো।
নাফিজ মাহমুদ এর বাংলোর সামনের গার্ডেন এর পাশে বিশাল এক খোলা জায়গা।সেখানেই সুন্দর করে গায়ে হলুদের স্টেজ সাজানো হয়েছে।
হলুদ গোলাপ আর সাদা রজনী গন্ধ্যার মিশ্রনে তৈরি হয়েছে স্টেজ টি।রাখা হয়েছে সোফা আর সেন্টার টেবিল।
বিভিন্ন ধরনের সুসজ্জিত খাবারের পসরা সাজানো হয়েছে সেই টেবিলে।
একটু পর নামিরা আর সোহাগ এলো বিশাল বড়ো এক আকর্ষণীয় কেক নিয়ে।
নামিরা আজকে হলুদ লেহেঙ্গা আর জলপাই রঙের ওড়না পড়েছে সাথে হালকা মেকআপ।
সোহাগ মুগ্ধ নয়নে দেখে যাচ্ছে নামিরাকে।
এই দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর সোহাগ নামিরাকে কখনো সাজতে দেখেনি।হয়তো সাজার মতো কোনো অবস্থাই তৈরি হয়নি এই কয়েক বছরে।
"কে বলবে এই মেয়ের একটা দেড় বছরের বাচ্চা আছে?."
নামিরার সৌন্দর্য সোহাগের মনে হিংসের সৃষ্টি করে।
আবার মনে মনে নিজেকে বুঝ দেয়
"এই অতীব সুন্দরী রমণীটি তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে এবং তার সন্তানের মা ।
এসব ভাবনা ভাবতেই সোহাগের বুকে হিমশীতল বাতাস প্রবাহিত হয়।
"কি দেখছো এমন ছ্যাবলার মতো?
"কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি সারা দিচ্ছনা শুধু দেখেই যাচ্ছ!
নামিরার তেজ পূর্ন স্বরে ধ্যান ভাঙলো সোহাগের।নিজেকে ধাতস্থ করে মিনমিন করে বলে উঠলো
"তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে নামিরা।
বলেই তড়িঘড়ি করে অন্যকাজে লেগে গেলো।
সকল কাজ কমপ্লিট, এখনই স্বর্গকে স্টেজে আনা হবে।মৃদু শব্দে হলুদের গান বাজছে,ছোট ছোট বাচ্চারা বক্সের সামনে বিভিন্ন ভঙ্গিতে নেচে যাচ্ছে।
লাল রঙের সামিয়ানা যা গোল্ডেন জরি সুতায় কারুকাজ খচিত ।সেই সামিয়ানার চারকোনা ধরেছে চারজন মেয়ে।
স্বর্গ আগে আগে যাচ্চে পিছনে তার বান্ধবীরা গানের তালে তালে নেচে চলছে।
নাচতে নাচতে তারা স্বর্গকে এনে স্টেজে পাতা সোফায় বসালো।
এবার হলুদ ছোয়ানোর পালা।
প্রথমে মিসেস তারিন একটু হলুদ ছুইয়ে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন।এরপর তনুজা,নাফিজ মাহমুদ হলুদ ছুঁইয়ে কপালে চুমু দিয়ে সোফায় এসে বসলেন।
ধীরে ধীরে নামিরা,পিউ,সুখ সবাই হলুদ ছোয়ালো।
হঠাৎই ক্যাপ্টেন সৌম্য এসে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলে উঠলো
"হ্যালো,চেক ,ওয়ান,টু,থ্রি।
"এবার আপনাদের সামনে একটা ধামাকা হতে যাচ্ছে,সেই ধামাকা না আগে কেউ দেখেছে না শুনেছে।"
এবার মেজর আদ্রিয়ান মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়ে সৌম্যের গলাগলি ধরে বলে উঠলেন,
সবাই ধামাকা দেখার জন্য রেডি?
সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো
"ইয়েস"
প্রত্যেকের সমর্থন পাবার সাথে সাথেই নিভে গেলো সকল লাইটস।জলে উঠলো ফোকাস লাইট।
একটি উঁচু টুলে গিটার হাতে একটি ছেলে বসে আছে।
অন্ধকারে তার মুখ অস্পষ্ট।
কিন্তু স্বর্গের একমুহূর্ত সময়ও লাগলো না ঠাহর করতে মানুষটা কে?
"মানুষটা তার একান্ত ব্যাক্তিগত সম্পত্তি।
ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো মুহিতের পুরা অবয়ব।
মুহিত পড়েছে সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা সাথে স্বর্গের শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে কাঁচা হলুদ কুটি।হাতে ব্রাউন ফিতার নেভিফোর্স ঘড়ি।
স্বর্গ মোহনীয় দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে মুহিত কে।
স্বর্গের কাছে মনে হচ্ছে মুহিত পরিবীর সবচেয়ে স্নিগ্ধ আর শুদ্ধতম পুরুষ।
যেই পুরুষকে কেউ ছুঁয়ে দেখেনি, যেই পুরুষের প্রীতিময় সান্নিধ্য একমাত্র স্বর্গ ছাড়া কেউ পায়নি।
নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে তার নিজের কাছে।
গিটারের টুংটাং শব্দে ধ্যান ভাঙলো স্বর্গের।
নামিরা দুই হাতের সহিত ঢেকে ফেললো তার মুখ।
কোনোভাবেই নামিরা তার কান্না চেপে রাখতে পারছে না।
"এটাই তো সেই আগের মুহিত,যেই মুহিত দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর ধরে হারিয়ে গিয়েছিলো।"
"এটাই তার আদরের সেই চঞ্চল হাসিখুশি ভাই"
মিসেস তারিন চশমা খুলে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জ্বল নীরবে মুছে নিলেন।
তনুজা মিসেস তারিন কে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলালেন।
"মুহিত গুনে গুনে আট বছর পর গিটার হাতে ধরলো"
মুহিতের গিটারের সুরের সাথে বেজে উঠলো মিউজিশিয়ান দের সফট মিউজিক।
মুহিত গাইতে শুরু করলো
"তোমার জন্য সিন্ধুর নীল
"আরো হবে সপ্নীল।
উদাস দুপুরে রাগ বসন্তে গাইবে সোনালী চিল
তোমার যতো ভুল সব
নিমিষেই হবে ফুল।
তবু ভালোবাসি শুধু তোমায়
নিশিদিন সারা বেলা,,,,,,
তোমার জন্য সিন্ধুর নীল আরো হবে স্বপ্নীল।
মুহিত গান শেষ করতেই সকলের করতালিতে মুখরিত হলো চারপাশ।
গিটার ছেড়ে মুহিত এগিয়ে আসলো স্বর্গের কাছে।
হলুদের বাটি থেকে হলুদ নিয়ে নিজের গালে মেখে সেই গাল ছোয়ালো স্বর্গের গালে,নাকে।
সকলেই হাত তালি দিয়ে বলে উঠলো আমরা মুহিত আর স্বর্গের ডান্স পারফর্ম দেখতে চাই।
নিমিষেই সকলে এক যোগে বলা শুরু করলো
"মুহিত,স্বর্গ।"মুহিত -স্বর্গ"
মুহিত মাথা নিচু করে এক হাত বুকে রেখে আরেক হাত বাড়িয়ে দিলো স্বর্গের পানে।
স্বর্গ মুহিতের আহ্বানে সায় দিয়ে আলতো করে চেপে ধরলো মুহিতের হাত।
উঠে দাঁড়ালো স্বর্গ।
ফাঁকা করা হলো স্টেজ।
বক্সে বেজে উঠলো সিলেক্টেড গান।
প্রথমে ছেলেদের দল উঠে গেলো স্টেজে।
সালামে ইস্ক সালামে ইস্ক গানে নাচবে সবাই।
গানের মিউউজিক এর তালে তালে নেচে উঠলো
মুহিত সৌম্য আর আদ্রিয়ান এর দল।
এক ঝাঁক তরুণ আর্মি অফিসার নিখুঁত ভাবে নেচে যাচ্ছে
সবাই হাত তালি দিয়ে উৎসাহ প্রদান করছে আর নাচছে।
মেয়েরাও উঠে গেলো স্টেজে।
কেউ কারো থেকে কম যাচ্ছে না।
পারফরম্যান্স শেষ হতেই সকলেই করতালিতে তাদের প্রশংসা জানালো।
সকল আচার অনুষ্ঠান মেনে আনন্দ ফুর্তিতে শেষ হলো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান।
――――
রাত প্রায় একটার কাছাকাছি।
স্বর্গ নিজ রুমে এসে শাড়ি গহনা খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
হঠাৎ করেই কক্ষে মুহিত প্রবেশ করে দুম করে দরজা আটকে দিলো।
স্বর্গ উঠে দাঁড়াতেই মুহিত শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো স্বর্গকে।
"অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছি বউ।
"এমন ঘায়েল করা রূপ দিয়ে মেরে ফেলতে চাও নাকি আমাকে?
"এই দেখো বুকের এই জায়গাটায় চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে বলে আঙ্গুলি দিয়ে নির্দেশ করলো।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্বর্গ জিজ্ঞেস করলো
"তার জন্য কি করতে আমাকে ফটাফট বলে কেটে পড়ো।
আমার ঘুম পেয়েছে।
কালকে বিয়ে অনেক ধকল যাবে।
ঠোঁটে একটা মিষ্টি দিয়ে দাও চলে যাচ্ছি বউ।
কন্ঠে সিরিয়াস ভাব এনে বলে উঠলো মুহিত―
"আমাকেও ঘুমুতে হবে বউ কাল থেকে তো আর ঘুমানো যাবে না।
স্বর্গ টুপ করে চুমু খেয়ে সরে দাঁড়ালো।
"হয়েছে দিয়েছি যাও এখন!
মুহিত আহত স্বরে জিজ্ঞেস করলো
"এটা কি দিলি বউ?
"কি আবার? চুমুই তো চাইলে"
"আমি কি ফকির ?চুমু ভিক্ষে চাইতে এসেছি?
ভালো করে দেহ!
"মেজর মুহিত কালকে মজা বোঝাবো তোমাকে তুমি এখন ভাগো এখান থেকে।
বলে বেলকনিতে টেনে এনে পাইপ নির্দেশ করে বলে উঠলো নেমে যাও।
অসহায় মুহিতকে বারান্দায় ফেলে মুখ টিপে হেসে বেলকনির দরজা আটকে দিলো স্বর্গ।
মুহিত সহসাই মেসেজ পাঠালো স্বর্গের ফোনে
"আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া?
কালকে এর শোধ তুলবো
রেডি থাকবেন মিসেস ওয়াসিফ।
চলবে
0 Comments:
Post a Comment