গল্প তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল পর্ব ১২

 তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল

পর্ব_১২

সারিকা_হোসাইন


চারপাশে  লাইটস ক্যামেরার ঝলকানি,সাধারণ মানুষের চাইতে যেনো রিপোর্টাস এর সংখ্যাই বেশি।

আহিয়ান কে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে  শেল্টার এর সাথে  ঢাকা এয়ার পোর্ট থেকে আর্মিদের স্পেশাল গাড়িতে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।


কিন্তু চারপাশে ক্রুদ্ধ জনতা।


কেউ পাথর ছুঁড়ে মারছে,কেউ স্যান্ডেল ছুড়ে মারছে কেউবা আবার ডিম।


টিভিতে নিজের ছেলের এমন দুর্দশা দেখে টিভি বরাবর  রিমোট ছুড়ে মারলেন আশরাফ চৌধুরী।রিমোটের আঘাতে নিমিষেই ডিসপ্লে নষ্ট হয়ে গেলো বিদেশ থেকে আনা ব্র্যান্ডেড টিভি টার।


তার তিলেতিলে গড়া সম্মান,ভালমানুষির মুখোস,প্রতিপত্তি,এই জানোয়ার নিমিষেই নষ্ট করে দিলো।স্কাউনড্রেল টা কে আগেই খুন করে দিলে আজকে আর এই দিন দেখতে হতো   না।


মানুষের সামনে সম্মান হানী,  ছেলে সম্পর্কে  বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের জবাব এসব এড়াতে মিথ্যে নাটকের ভান ধরা ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই।বজ্জাত রিপোর্টার দের কথা না বললেই নয়।


প্রথম প্রশ্নই করে বসবে 

―আপনার ছেলে এতো অপকর্ম করেছে ,আপনি একজন বাবা হিসেবে কিছুই জানেন না?

শুধু কি তাই?

মিথ্যে গুজব জুড়ে দিয়ে বিভিন্ন হেডলাইন বানিয়ে খবর প্রচার করবে।

শেষে দেখা যাবে কেঁচু খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে গেছে।


―――――――

নিউজ পোর্টাল গুলো তে সাংবাদিক রা একে একে বিভিন্ন খবর বিভিন্ন ভাবে বলে যাচ্ছে_


বিশিষ্ট  সমাজ সেবী আশরাফ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে আহিয়ান চৌধুরী আহির ধুর্ততার সহিত মেজের জেনারেল নাফিজ মাহমুদ এর মেয়েকে  রাশিয়াতে পাচার করে দেবার জন্য অপহরণ করেছে।

টানা পঁয়তাল্লিশ দিনের আর্মি অভিযানে   রাশিয়ান আর্মির সহায়তায় সি,এম,এইচ এর এই নব্য মেডিকেল অফিসার কে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।


মুহিতের রেকর্ড করা রাশিয়ান ছেলে গুলোর জবানবন্দি গুলো কে মিডিয়া আরো রসিয়ে রসিয়ে প্রচার করলো।

আরো বললো―

ছেলের এহেন কুকীর্তি সহ্য করতে না পেরে বাবা আশরাফ চৌধুরী  হার্ট এট্যাক করে  ঢাকার একটি স্বনামধন্য হাসপাতালে আই সি ইউ তে  ভর্তি আছেন।

অবস্থা আশংকাজনক।


********

বিভিন্ন জবানবন্দি, মেডিকেল টেস্ট করার পর স্বর্গকে বাসায় আনা হয়েছে।

মেয়েকে জড়িয়ে ধরে তনুজা আকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে মেয়ের চোখে মুখে চুমু খাচ্ছেন।

মুহিত কে জড়িয়ে ধরে নাফিজ শুধু পিঠ হাতিয়েই যাচ্ছেন।


মুহিত আজ তার প্রাণ তার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে।এই বিনিময়ে মুহিত যা চাইবে নিজের জীবন বাজি রেখে হলেও মামা হিসেবে নাফিজ মাহমুদ মুহিতকে সেটাই দিবে দেবে।


মিসেস তারিন  অবুঝের মতো শুধু চেয়েই রইলেন।কিছুই তার বোধগম্য হলো না।


সুখ দৌড়ে এসে স্বর্গকে জড়িয়ে ধরলো।

কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করলো 

―মাফ করে দে আপু।আর কখনো তোর পিছনে লাগবো না।গুড বয় হয়ে লেখাপড়া করবো আর তোকে দেখেশুনে রাখবো।


পরিবারের মানুষের এহেন সূচনীয় অবস্থা দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো স্বর্গ।


বাবা মা,ভাইকে ছাড়া সেও অনেক কষ্ট পেয়েছে অজানা,অচেনা পরিস্থিতি তে।


সে আবার নতুন জীবন পেয়েছে মুহিতের জন্য।

স্বর্গ মনে মনে নিজের সমস্তটা মুহিতের জন্য উৎসর্গ করলো।


________

পিউকে চমকে দিতে সৌম্য নিজেই এসেছে পিউ এর ক্যাবিনে।


পিউ কোনো এক ভাবনায় ডুবে রয়েছে।


সৌম্য গলা খাকরি দিলো


―পিউ আনমনে জিজ্ঞেস করলো কি সমস্যা ?খুলে বলুন।


―সমস্যা তো অনেক ম্যাডাম।আপনি কয়টার মেডিসিন প্রেসক্রাইব করবেন?


পরিচিত কন্ঠস্বর কানে পৌঁছুতেই বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো পিউ।


সামনে দাঁড়ানো নিজের  একান্ত ব্যাক্তিগত পুরুষ টিকে দেখে চেয়ার রেখে দৌড়ে সৌম্যের বুকে আছড়ে পড়লো।

এতো দিনের জমিয়ে রাখা কষ্ট বাঁধ ভাঙা অশ্রুতে ধুয়ে মুছে গেলো।


সৌম্যকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে  জানালো নানান অভিযোগ

―আপনি খুব খারাপ ক্যাপ্টেন, খুব খারাপ।

আপনি আমাকে এতগুলো দিন অনেক কষ্ট দিয়েছেন।


―একটা ফোন কল ও কি আমার প্রাপ্য ছিলো না?


আদুরে কন্ঠে সৌম্য বলে উঠলো―


―আপনি বড্ডো নরম মনের মানুষ পিউ,এতো নরম হলে কিভাবে চলবে?মানুষ তো আপনাকে সহজেই ভেঙে দিয়ে চলে যাবে।


―পিউ সৌম্যকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে,পিউ এর মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই সৌম্য আবার পালিয়ে যাবে।


পিউকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সৌম্য বলে উঠলো―

""আপনি জানেন না দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়??


―না আমি জানিনা,জানতেও চাইনা।

পিউয়ের সাবলীল উত্তর।

মুচকি হেসে পিউএর কপালে গাঢ় চুমুর পরশ আঁকে সৌম্য।


*****----


যতো দুপুর গড়াচ্ছে সূর্যের তেজ হুহু করে বাড়ছে,বাইরে এক দন্ড টেকা যাচ্ছে না।সূর্যের উত্তাপে মাটি সহ মরুভূমির বালুর মতো উত্তপ্ত হয়ে আছে।কোনো ফাঁকফোকর গলিয়েও ধরনীতে কোনো হাওয়া বইছে না।পাখপাখালী পর্যন্ত গাছের পাতার চিপায় ঘাপটি মেরে বসে আছে।মাঝে মাঝে দু একটা কাকের কা কা ডাক শোনা যাচ্ছে।


একদিকে প্রচুর গরমের ভেতর জার্নি করে এসেছে তন্মধ্যে

খাবারের অনিয়ম, ভয়ভীতি,অনুপযোগী পরিবেশ,সব মিলিয়ে স্বর্গের অবস্থা নাজুক।


বাসায় এসেই সে হড়হড় করে বমি করে দিলো।


মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে বার বার।


তনুজা ধরে ধরে দূতলায় স্বর্গের বেড রুমে স্বর্গকে এনে শুইয়ে দিলেন।


আর নিজে চলে  গেলেন স্যুপ বানাতে।


শরীরে শক্তি পাচ্ছে না স্বর্গ।


এই মুহূর্তে ভিটামিন স্যালাইন পুশ করা জরুরি।

নিজের ফোন ওয়ালেট,ব্যাগ সব কিছু হারিয়ে গেছে স্বর্গের।


আহিয়ানের দুধর্ষতার কথা মনে পড়তেই শরীর শিউরে উঠলো স্বর্গের।


হঠাতই স্বর্গের শয়ন কক্ষের দরজা খুট করে খুলে গেলো।

রুমে প্রবেশ করলো মুহিত।


মুহিত কে দেখে বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গেলো স্বর্গের।মনে হচ্ছে এখনই লাভ এট্যাক এসে যাবে।


মুহিতের আর্মি ইউনিফর্মের আকর্ষণীয় রূপে স্বর্গ ভুলে গেলো চোখের পলক ফেলতে।


উফ,কে বলেছে এই ব্যাটাকে এতো সুন্দর হতে?


এই ব্যাটা রাস্তায় চলাফেরা করে কিভাবে?


মেয়েরা কি তাকে নজর দিয়ে গিলে খায় না??


শোয়া থেকে উঠে বসতে চাইলো স্বর্গ,কিন্তু শরীর সায় দিলোনা।

বসা মাত্র মাথা ঘুরে উঠলো।

আউচ্ বলে মৃদু শব্দ করে আবার ধপ করে শুয়ে পড়লো স্বর্গ।


মুহিত বিচলিত হলো।দৌড়ে স্বর্গের কাছে এসে দুটো বালিশ উঁচু করে  দুই বাহু ধরে স্বর্গকে শুইয়ে দিলো।


মুহিত এতটাই স্বর্গের কাছে চলে এলো যে,

দুজন দুজনের হার্টবিট  শুনতে পাচ্ছে।


মুহূর্তেই চোখাচোখি হলো দুজনের।এতটা কাছে তার প্রেয়সী।বুকের ভেতর অবাধ্য ইচ্ছে আন্দোলন করে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

নিজেকে কন্ট্রোল করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে ।

নিজেকে ভয়াবহ শাসিয়ে সরে আসতে চাইলো মুহিত।


অমনি খপ করে শার্টের কলার ধরে ফেললো স্বর্গ।

―প্লিজ নড়বেন না মেজর।আপনার হৃদ স্পদন শুনতে আমার ভালো লাগছে।

―আপনি আমার কাছে থাকলে আমার ভালো লাগে।নিজেকে সেইফ মনে হয়।

বলতে বলতে স্বর্গ মুহিতের গালে আঙুল ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে ঠোঁটের কাছে আনলো।

দুই আঙুলের সহায়তায় মুহিতের টকটকে লাল ঠোঁটে টিপে ধরলো স্বর্গ।

আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো মুহিত।


কন্ঠ খাদে ফেলে বলে উঠলো

―নিজেকে কন্ট্রোললেস লাগছে স্বর্গ।আমি অনেক ক্ষণ ধরে সব কিছু আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছি।প্লিজ আমাকে সীমানা পার হতে বাধ্য করবেন না।

―আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবেন মেজর?

স্বর্গের আকুল নিবেদন।


কিভাবে মানা করবে নিজের মোহিনীর এমন আবদার?


মুহিত পারলো না স্বর্গের আকুতি ফিরিয়ে দিতে।দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে চেপে ধরলো বুকের সাথে।স্বর্গও মুহিত কে এমন ভাবে ঝাপটে ধরলো যেনো কেউ চাইলেও   আর তাদের আলাদা করতে না পারে।

মুহিতের মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে স্বর্গ কে সে যদি বুকের ভেতর পুরে ফেলতো পারতো তাহলে বুকের ভেতর যেই উত্তাল দাবানলের সৃষ্টি হয়েছে সেটা নিভে যেতো।


―আপনাকে ভালোবাসি মুহিত।আপনি ই আমার ভালো থাকার একমাত্র ঔষধ।

আপনি কাছে আসার পর থেকে আমার সকল ক্লান্তি,খারাপ লাগা,উধাও হয়ে গেছে।

আপনি কি সব সময় এভাবে আমার পাশে থাকবেন মেজর?


দুই হাতের তালুতে স্বর্গের মুখের আদল ধরে নাকে ছোট করে একটি চুমু দিয়ে মুহিত আদুরে স্বরে বলে উঠলো―


যেভাবে চাইবেন সে ভাবেই আমি আপনার পাশে থাকবো স্বর্গ।


চলবে।

0 Comments:

Post a Comment