গল্প তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল পর্ব ৩৪ সমাপ্ত

 তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল

অন্তিম_পাতা

সারিকা_হোসাইন


********

চারিদিকে পাখির কিচিরমিচির ডাকে মুখরিত হচ্ছে,পুব আকাশের সূর্য টা লাল বর্ণের আভা ছড়িয়ে আকাশ কে লালিমা লেপন করে দিয়ে জানান দিচ্ছে এখন ভোর হয়েছে।বাইরে মৃদুমন্দ  বাতাস  প্রবাহিত হচ্ছে।টুপটুপ করে কুয়াশা পড়ে গাছের পাতা,ঘাসের ডগা গুলো কে ভিজিয়ে দিচ্ছে।


মুহিতের উদোম লোমহীন বুকে শান্তির নিদ্রা যাপন করছে স্বর্গ।

মুহিতের কক্ষের দক্ষিণের জানালা খোলা থাকায় ভোরের  শিরশিরে ঠান্ডা বাতাসে শীতে কেঁপে শরীর কাটা দিয়ে উঠলো স্বর্গের।

একটু উমের আশায় বিড়াল ছানার মতো মুহিতের বাহুডোরে লুকালো।


স্বর্গের কাঁপুনিতে মুহিতের ঘুম ছুটে গেলো।চোখ মেলেই স্বর্গের ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখশ্রী দেখে এক অনিন্দ্য সুখ পেলো মুহিত।

সরে যাওয়া পাতলা ব্ল্যাঙকেট জড়িয়ে দিলো স্বর্গের নগ্ন পিঠে।

আরাম পেয়ে মুহিত কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো স্বর্গ।


রাতের সুখময় স্মৃতি মনে পড়তেই নিমিষেই মুহিতের রক্ত গরম হয়ে উঠলো।


স্বর্গের কপালে,গালে ,ঠোঁটে ভালোবাসার পরশ একে নিজের সাথে চেপে ধরলো স্বর্গকে।

ঘুমের মধ্যেই ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো স্বর্গ।


হাতের বাধন আলগা করে গত রাতের কথা ভাবলো মুহিত।


বহুদিন পর নিজের শ্রেয়সী কে কাছে পেয়ে একটু বেশি ই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে।


মুহূর্তেই নিজের প্রতি নিজের রাগ হলো।


"এতো হিংস্র কি করে হতে পারলো সে?"


"মেয়েটা তো আর তার থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলো না।"


স্বর্গের আবেদনময়ী রূপ দেখে মুহিত নিজেকে কোনোভাবেই কন্ট্রোল করতে পারেনি।খুব বেশি ই বেসামাল হয়ে গেছিলো সে।


স্বর্গের তুলার মতো নরম শরীর  নিমিষেই দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে মুহিত।


মুহিত তো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো যে,সে কখনো স্বর্গকে তার তরফ থেকে  কোনো কষ্ট পেতে দিবেনা।

তাহলে একরাত্রের ব্যবধানেই কি করে প্রতিজ্ঞা ভাঙলো মুহিত?

হঠাৎই মুহিতের ভাবনার ছেদন হলো স্বর্গের ঘুম ঘুম কন্ঠে 

"লাভ ইউ জান" 

কথাটি শুনে।


স্মিত হেসে কপালে চুমু খেয়ে মুহিত বলে উঠলো

"লাভ ইউ টু"


স্বর্গের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মুহিত অপরাধীর ন্যায় বলে উঠলো

"কাল রাত্রের জন্য আম রিয়েলি সরি"

"আমি নিজেকে আয়ত্তে আনতে পারিনি।

"প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও আর কখনো এমন ভুল হবে না"


স্বর্গ মুহিতের নাকে হালকা স্লাইড  বুকে আঁকিবুকি করতে করতে   আবেশ মেশানো ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললো

" তুমি যতো বার কন্ট্রোললেস হবে আমি ততো বার তোমাকে কন্ট্রোলে আনতে প্রস্তুত।


মুহিত স্বর্গের কাঁধে মুখ ডুবিয়ে জিজ্ঞেস করলো―

"সত্যি?

স্বর্গ দুই হাতে মুহিতের পিঠ জড়িয়ে বলে উঠলো

―তিন সত্যি।


এরপর নিজেকে সরিয়ে বিছানায় বসে মুহিত স্বর্গকে বললো

"তোমার জন্য দুটো সারপ্রাইজ আছে।কবে দেখতে চাও সেগুলো?


"স্বর্গ দুম করে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো কেমন সারপ্রাইজ??

"গেলেই দেখতে পাবে "হেসে বলে উঠলো মুহিত।


"তাহলেই আজকেই যেতে  চাই"


"অনেক লম্বা জার্নি করতে হবে ,পারবে??


"আলবাত পারবো।


"আচ্ছা ঠিক আছে কাল নিয়ে যাবো।


"না আমি আজকেই যেতে চাই"


"আজকে তোমাদের বাড়িতে যেতে হবে ভুলে গেছো পাগলী?


"স্বর্গ মিন মিন করে "হুম" বলে মুহিতের কোমর জড়িয়ে আরেকটু ঘুমানোর চেষ্টা করলো।


―――――

স্বর্গ ,মুহিত,সুখ,নামিরা আর সোহাগ যখন নাফিজ মাহমুদ এর বাংলোতে এসে পৌঁছায় তখন দুপুর বারোটা বাজে।

মিসেস তনুজা আর হেল্পিং হ্যান্ড ফতেমা মিলে স্বর্গ আর মুহিতের পছন্দ সই বিভিন্ন পদ রান্না করছেন।

নাফিজ মাহমুদ জরুরি কাজে বাইরে গিয়েছিলেন।যখন মুহিত জানালো তারা বাসা থেকে বের হচ্ছে তখনই নাফিজ মাহমুদ দ্রুত কাজ সেরে বাসার দিকে রওনা দেন।


এসেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষন বসে থাকলেন নাফিজ মাহমুদ।

মেয়ে যখন বাড়িতে ছিলো তখন সারাদিন দেখা না হলেও কিছুই অনুভব হতোনা।

কিন্তু মেয়েটা যেই দূরে চলে গিয়েছে তখনই বুকটা খাঁ খাঁ করতে শুরু করেছে।

আসলেই দূরত্ব ভালোবাসার কদর বোঝায়।


স্বর্গ নাফিজ মাহমুদ এর পিঠ হাতড়াতে হাতড়াতে বলে উঠলো

"বাপী আমি কিন্তু এখন কেঁদে দেবো।


অমনি নাফিজ মাহমুদ স্বর্গকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

"না মামনি কেঁদোনা, তোমার কান্নার সুর শুনে মুহিত ভয় পাবে।


ইচ্ছে করেই বিকৃত শব্দে খিক খিক করে হেসে উঠলো" সুখ।"


পরিবারের সকলের খুনসুটিতে নিমিষেই সকল মন খারাপ দৌড়ে পালালো।


খেতে খেতে ডাইনিং টেবিলে নাফিজ মাহমুদ মুহিতকে জিজ্ঞেস করলেন


"তা কোথায় ঘুরতে যাচ্ছ?


"স্যার এটা সিক্রেট আছে,স্বর্গের জন্য সারপ্রাইজ হিসেবে রেখেছি।


"সেকি বাবা এখনো স্যার স্যার করে যাচ্ছ?

"হয় বাবা বলো না হয় মামা বলো,এরম স্যার স্যার বলে আমাদের দূরে ঠেলে দিও না 

অনুযোগের সুরে বলে উঠলো তনুজা।


"নেক্সট টাইম প্র্যাকটিস করে তারপর বলবো ম্যাডাম"

বলেই স্বর্গের দিকে তাকালো মুহিত।


স্বর্গ চোখ গরম করে বলে উঠলো 

"এখনই বলতে হবে তোমাকে ,ফুপিকে তো সকালে উঠেই আমি মা বলেছি।

তোমার এতো আজাইরা লজ্জার কারন তো দেখছি না।

মামীর" মী, কেটে দিয়ে মা বলবে আর বাপিকে বাবা বলবে শেষ।


স্যার ,ম্যাডাম ডাকলে আমিও তোমাকে ভাইয়া ডাকবো।


খুক খুক করে কেশে উঠলো মুহিত।

একগ্লাস পানি নিয়ে খেতে খেতে ভাবলো


নিজের প্রানপ্রিয় বউয়ের মুখে ভাইয়া ডাক শোনার মতো হরিবল আর কিছুই হয়না।


স্বর্গকে বিশ্বাস নেই ডেকেও ফেলতে পারে।তার আগেই শুধরে যাই।


ঠিকাছে বলছি 

ম্যাডাম সরি মা,বাবা আমি আজকেই স্বর্গকে নিয়ে চলে যেতে চাই।যদি আপনাদের কোনো আপত্তি না থাকে।

অনেক দিন আমাদের কারোর ই ঘুরাঘুরি হয়নি।

আমি যখন মিশনে ছিলাম তখন স্বর্গ  ডিউটি আর বাসা করেই সময় কাটিয়েছে।

আর মিশন থেকে এসেই বিয়েটা হয়ে গেলো।


তাই আমি কিছুদিন একান্তে ওর সাথে টাইম স্পেন্ড করতে চাচ্ছি।


নাফিজ মাহমুদ আর তনুজা সম্মতি জানালো।


রাতের খাবার খেয়ে মুহিতরা বেরিয়ে গেলো।

পিছনে ফেলে গেলো তিনজন বিমর্ষ প্রিয়জনকে।


*********

আজ ডিসেম্বর মাসের পনেরো তারিখ।মোটামুটি ভালোই শীত পড়তে শুরু করেছে।দিনে শীতের প্রকোপ এতোটা বোঝা না গেলেও রাতে ঠিকই বোঝা যায়।

ভোর পাঁচটা বাজেতেই কর্কশ স্বরে মুহিতের ফোনের এলার্ম বেজে উঠলো।

স্বর্গ কম্বল দিয়ে চোখ মুখ ঢেকে  বিরক্তি প্রকাশ করলো।

সারা রাত ঘুম হোক বা না হোক এই ভোর রাতে শান্তির ঘুম যেনো চোখের পাতায় এসে জেঁকে বসে।


তড়িৎ গতিতে এলার্ম বন্ধ করে উঠে বসলো মুহিত।

আজ স্বর্গকে সারপ্রাইজ দেবার প্রথম দিন।

দ্রুত ফ্রেস হয়ে এসে আদুরে স্বরে ডেকে উঠলো স্বর্গকে।


মুহিত খুব ভালো করেই জানে এই মেয়ে প্রচুর অলস।

ঘুমের আরামের জন্য দেখা যাবে বলে বসেছে"আজকে সারপ্রাইজ লাগবে না,অন্য দিন দিও"


স্বর্গকে হাড়ে হাড়ে চেনে মুহিত।

তাই এক টানে ব্ল্যাঙকেট সরিয়ে দুই হাত টেনে উঠে বসালো স্বর্গকে মুহিত।


স্বর্গ আবার শুয়ে পড়তে চাইলেই মুহিত জগে থাকা পানি অল্প হাতে নিয়ে স্বর্গের চোখে ছিটিয়ে দিলো।


শীতে ঠান্ডা পানির স্পর্শে চোখ মেলে তাকালো স্বর্গ।


ঘুম কাতুরে কন্ঠে বলে উঠলো

"এভাবে আমাকে কষ্ট দিচ্ছ কেনো মুহিত"


মুহিতের বুঝি মায়া হলো স্বর্গের এহেন অভিযোগে।

কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।একজনের কাছে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।তাকে যেতেই হবে।দায়িত্ব কর্তব্য  ফেলে এখানে ভাবলেশহীন দিন কাটানোর মানুষ মুহিত নয়।


মুহিত স্বর্গের গালে হাত দিয়ে বলে উঠলো


"তোমার বর একজনের কাছে খুব ঋণী।তার ঋন পরিশোধ না করলে মরেও যে শান্তি পাবোনা !


মুহিতের এমন সিরিয়াস কথা শুনে স্বর্গ দ্রুত ফ্রেস হতে চলে গেলো।

আধা ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মুহিতের জলপাই রঙা জিপে চেপে বসলো দুজনে।


হালকা আলো ফুটার আগেই হাইওয়ে ধরলো মুহিত আর স্বর্গ।


সকালের বাতাস টা খুব  গায়ে লাগছে।হালকা কুয়াশার ধুম্রজাল  বেষ্টন করেছে ধরণী।

 জিপ থামিয়ে গলার মাফলার দিয়ে নাক কান পেঁচিয়ে নিলো মুহিত সাথে স্বর্গকেও ভালো মতো পেঁচিয়ে দিয়ে আবার জিপ হাকালো।


চারপাশের সুন্দর মনোরম পরিবেশ স্বর্গকে মুগ্ধ, বিমোহিত করছে।গাছের পাতার ফাক গলিয়ে লাল সূর্যটা বেরিয়ে এলো।পাখি গুলো আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে।রাস্তায় দুই একজন মানুষের দেখা মিলছে মাঝে মধ্যে।

কিছু কিছু হোটেল,চায়ের স্টল এ আগুন জ্বালানো হচ্ছে।

ঘন্টা তিনেক পর শহর থেকে একটু দূরে একটি টং দোকানের কাছে ব্রেক কষলো মুহিত।


স্বর্গ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মুহিতের দিকে তাকালো।


মুহিত মুচকি হেসে বললো,"এখনো বহুদূরের পথ বাকী।

নেমে এসো চা খাবো।"


বড় বড় রেস্টুরেন্ট বা কফিশপের চায়ের থেকেও টং দোকানের চায়ের স্বাদ বেস্ট।

অল্প চুমুক আর  বড় নিশ্বাস,যেনো আত্মিক প্রশান্তি।


মুহিত কড়া লিকারের দু কাপ দুধ চা চাইলো।

দোকানী  দ্রুত চা বানিয়ে মুহিতের হাতে তুলে দিলো।


মুহিত স্বর্গের পানে চা এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো

" সকালের এই ঠান্ডা হাওয়ায় লম্বা একটা শ্বাস নেবে,এরপর চায়ে চোখ বন্ধ করে ছোট চুমুক দেবে।চা টা গিলে শ্বাস ছাড়বে।

দেখবে কতো প্রশান্তি !"


মুহিতের কথা মতো স্বর্গ চা পান করে যেনো এক অনন্য সুধা পান করলো।

মনে হলো চা আর প্রকৃতির মিষ্টি হাওয়া দুটোই পেটে নয় অন্তরে গিয়ে লাগলো।


স্বর্গ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো 

"তুমি এটা কিভাবে জানলে??


"পাপা শিখেয়েছিলো,আর আমি শীতকাল আসলে ইচ্ছে করেই গ্রাম সাইডের আর্মি  ক্যাম্পিং এ যাবার জন্য নাম লিখাতাম।


প্রকৃতির সাথে থাকলে তুমি কখনো কুটিল হতে পারবে না।

প্রকৃতি তোমাকে তারমতো উদার বানিয়ে দেবে।

বিশ্বাস না হলে জানুয়ারিতে আমার সাথে ক্যাম্পিং এ চলো।


স্বর্গ মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো,সে যাবে।


ফাঁকা রাস্তা,এবং মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ সব মিলিয়ে সাড়ে আট ঘণ্টা সময় লাগলো মুহিতদের কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছুতে।


দেড় বছরে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে।পাহাড় কেটে রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে।খাসিয়া পল্লীর সবচেয়ে শেষের ঘরটা ডিকো দের।

মুহিত নিমিষেই চিনে ফেললো সেই ঘর।

কিন্তু পাশে আরো দুটো নতুন ঘর হয়েছে।


স্বর্গ অবাক হয়ে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছে।কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না।


মুহিত গাড়িতে করে এক গাদা জিনিস এনেছে বাচ্চা মেয়েটির জন্য।


গাড়ি থেকে দুজনে মিলে সব নামিয়ে শেষ করতে পারলো না।কিছু জিনিস রেখে নেমে বাড়ির  সদর দরজায় টোকা দিলো।

মিনিট পাঁচেক পরেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো একটি মেয়ে।

এই দেড় বছরে সে অনেক খানি বড় হয়ে গিয়েছে।তার ছোট কোঁকড়ানো চুল গুলোও কাঁধ ছাপিয়ে নেমে এসেছে।


মেয়েটি মুহিতের দিকে তাকিয়েই চোখ বড় বড় করে ফেললো।


চিল্লিয়ে তার মা কে ডেকে উঠলো

"দেবতা আইসেছে"


মেয়েটির চিল্লানোর শব্দে মারুং আর তার স্ত্রী দৌড়ে এসে মুহিতের সামনে দাঁড়ালো।

তাদের রীতি অনুযায়ী মেহমান কে সম্মান জানালো।


প্রথমেই মুহিত ডিকোর হাতে তুলে দিলো লাল টকটকে একটা জামা।

মারুং কে গাড়ি নির্দেশ করে বলে উঠলো

"ওখানে যা কিছু আছে সব ডিকোর"


স্বর্গ এতোক্ষন চুপ থাকলেও সুযোগ পেতেই মুহিতকে জিজ্ঞেস করলো 

"এদের কিভাবে চেনো?"


"আজকে তুমি এদের জন্যই আমাকে পেয়েছো স্বর্গ"

বলেই সেই বিভীষিকা ময় ঘটনার বিস্তারিত ঘটনা খুলে বললো মুহিত।


পুনরায় সেই কুৎসিত স্মৃতি মনে পড়তেই চোখের কোনে জল জমা হলো স্বর্গের।


হঠাৎই হাতে কারো স্পর্শ অনুভব করলো স্বর্গ।হাতের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো ডিকো লাল ফ্রকটি পরে সেজে দাঁড়িয়ে আছে।


মেয়েটিকে গাল টিপে আদর করে দিলো স্বর্গ।

মুহিত মেয়েটিকে কোলে তুলে আদুরে স্বরে বলে উঠলো

"তুই আমার  অনেক সেবা করেছিস,এবার তোর সারা জীবনের সেবা করতে পারলে নিজেকে  হালকা লাগবে।


মেয়েটি মুহিতের কথার আগা মাথা কিছুই না বুঝে শুধু নীরবে তাকিয়ে রইলো।


মারুং এর থেকে মুহিত জানতে পারে মুহিতের দেয়া টাকাটা দিয়ে তারা একটা পানের বর দিয়েছে।সেখান থেকে ভালোই টাকা আসে।তারা তিনবেলা পেট ভরে খেয়ে পরে ভালোভাবেই বেঁচে আছে।

ডিকো স্কুলে যায়।সরকার থেকে ওদের জন্য একটা স্কুল করা হয়েছে,চিকিৎসা সেবাও ভালো এখন।


মুহিত মারুং কে অনুরোধ করে 

"ডিকো যতদূর পড়তে চায় মারুং যেনো বিনা বাধায় তাকে পড়তে দেয়।ডিকোর সকল খরচ মুহিত প্রদান করবে।

এবং সুযোগ পেতেই তাদের সাথে দেখা করতে আসবে।


সারাদিন সময় কাটিয়ে মুহিত আর স্বর্গ বেরিয়ে আসে মারুং দের বাড়ি থেকে।

ডিকো কেঁদে ভাষায়, মারুং আর তার স্ত্রী নীরবে চোখের অশ্রু মুছে।

কে বলেছে রক্তের সম্পর্ক না থাকলে মানুষ আত্মার আত্মীয় হয়না?


বরং রক্তের সম্পর্ক হীন মানুষ ই বেশি আত্মার আত্মীয় হয়।

মারুং আর তার পরিবার  জলন্ত প্রমান।


যেতে নাহি দিবো হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।

নিজেদের জীবিকার তাগিদে মানুষকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেই হয়।

ধরে বেঁধেও কেউ রেখে দিতে পারে না।

বিষন্ন মনে মুহিত আর স্বর্গ জিপে চেপে বসে,

স্বর্গ মুহিত চির কৃতজ্ঞ এই ছোট খাসিয়া পরিবারটির কাছে।


মুহিত জিপ হাঁকায়, যতো দূর দৃষ্টি সীমানায় মুহিতের জিপ দেখা যায় ডিকো, মারুং, আর তার স্ত্রী তাকিয়ে থাকে।

স্বর্গ মুহিত ও পিছন ফিরে বারবার তাদের বিদায় জানায়।


――――

মুহিত আর স্বর্গ বসে আছে  আছে  দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।

সাড়ে পাঁচ ঘন্টার নন স্টপ এমিরেটস ফ্লাইটে তারা এসে পৌঁছেছে।

দুবাই কেনো এসেছে মুহিত স্বর্গ কে নিয়ে তা অজানা স্বর্গের।


মুহিত তারজন্য কি সারপ্রাইজ রেখেছে সেটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে স্বর্গ।


একটু পরে একটি লোক হন্তদন্ত করে প্ল্যাকার্ড নিয়ে মেজর মুহিত ওয়াসীফ এর খুজ চালাচ্ছে।

এই ব্যাস্ত এয়ারপোর্ট এ কোথায় খুঁজবে সেই মেজর কে?ভাবতেই দুবাই ছামাদের ঘাম ছুটে গেলো।


মুহিত তার কালো চশমার ভেতর দিয়ে দুবাই ছামাদ কে দেখে  ফিচেল হাসলো।

কারন এই ব্যাক্তির চেহারা মুহিত আগেই দেখেছে ফোনে।


মুহিত ব্যাগপত্র নিয়ে স্বর্গের হাত ধরে দুবাই ছামাদের সামনে দাঁড়ালো। গমগমে কন্ঠে ছামাদ কে উদ্দেশ্য করে আরবি ভাষায়  বলে উঠলো


"মারহাবান"(হ্যালো)

মাসাউল খাইর"(শুভ সন্ধ্যা)


চমকে উঠলো ছামাদ।এই বহুরূপী দেশে কে তাকে এভাবে শুভ সন্ধ্যা জানাচ্ছে।

মুখের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো

"মা আন্ত?


মুহিত মেপে হাসলো।এর পর আরাবিক ভাষায় উত্তর দিলো

"ইসমী মেজর,,,,,


মুহিত কে কথা শেষ করতে না দিয়েই মুহিতের মুখের দিকে তাকিয়ে ছামাদ দিল খোলা হেসে মুহিত কে জড়িয়ে ধরলো।


কোলাকুলি করে বলে উঠলো

আম সরি  ব্রো

আম রিয়েলি সরি 


মুহিত বলে উঠলো

"দা "আ" হা তাদহাব,(আরে বাদ দাও)


ছামাদ হাতের প্ল্যাকার্ড উল্টিয়ে রাস্তা নির্দেশ করে মুহিত আর স্বর্গের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো

"দায়ানা নাদহাব, (চলো যাওয়া যাক)


এয়ারপোর্ট থেকে মুহিত আর স্বর্গ বেরিয়ে পার্কিং এরিয়াতে আসতেই ছামাদ কালো রঙের রেঞ্জ রোভার গাড়ি নির্দেশ করে তাদের উদ্দেশ্যে দরজা খুলে দিলো।


মুহিত স্বর্গকে নিয়ে গাড়িতে উঠতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো ছামাদ।


ত্রিশ কিলোমিটার পথ জার্নি করার পর  আবুধাবি শহরের একটি বিশাল বড় এপার্টমেন্ট এর সামনে এসে ছামাদ গাড়ি থামালো।


মুহিতকে প্রচুর উত্তেজিত দেখালো।

স্বর্গের হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে ছামাদ কে ব্যাগ নামানোর নির্দেশ দিলো।

একজন গার্ডের সহায়তায় তাদের লিফট পর্যন্ত নিয়ে ছত্রিশ তলার বাটন প্রেস করা হলো।


লিফটে দাঁড়িয়ে স্বর্গ মুহিত কে খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করলো এতো সম্মান প্রদর্শন করে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের?


মুহিত স্বর্গকে রিল্যাক্স থাকতে বলে আরাবিক ভাষায় গার্ড এর সাথে কিছু কথা বার্তা সারলো।


স্বর্গের কাছে এই মুহূর্তে মুহিতকে দুবাইয়ের শেখ মনে হচ্ছে।

যে কথায় কথায় আরবি ঝাড়ছে।


কাঙ্খিত ফ্লোরে আসতেই খুলে গেলো লিফটের দরজা।

গার্ড হাতের ইশারায় একটি বিশালাকার কারুকাজ খচিত দরজা নির্দেশ করলো।

সেখানে গিয়ে মুহিত কলিংবেল টিপতেই বেরিয়ে এলো সুদর্শন এক যুবক।

যার পড়নে কান্দুরা, মাথায় কেফায়া,লম্বা লম্বা দাড়ি,যেনো চেহারায় নূর ভাসছে।

স্বর্গ অভিভূত হয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকলো।

লোকটিকে তার বড্ড চেনা পরিচিত লাগছে।

লোকটির সাথে বোরকা পরা পর্দানশীন একজন অল্প বয়সের মেয়েও বেরিয়ে এলো।


মুহিত স্বর্গকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সকলেই তাদের সমাদর করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।

আল্লাহর বিভিন্ন নাম,মদিনার ছবি, বিভিন্ন সূরার ওয়ালম্যাট শোভা পেয়েছে ঘরের প্রত্যেকটি দেয়ালে।


যুবকটি তাদের সামনের সোফায় বসে দৃষ্টি সংযত করে জিজ্ঞেস করলো

"কেমন আছো স্বর্গ"


"স্বর্গের বুক ধক করে উঠলো,আরেহ এটা আহিয়ান।

আহিয়ান এর এতো আমূল পরিবর্তন দেখে খুশিতে বাক হারা হলো স্বর্গ।

মুহিতের সারপ্রাইজ এ সে সত্যি সারপ্রাইজড হয়ে ভাষা হারিয়েছে।


পাশে থাকা মেয়েটিকে নির্দেশ করে দেখিয়ে বললো 

"ও আমার স্ত্রী মারীয়ম।"

মাস ছয়েক হয়েছে তারা দাম্পত্য জীবন শুরু করেছে।

বাংলাদেশ থেকে ফিরেই আহিয়ান নিজেকে শুধরে নিয়েছে।

নিজের খারাপ অতীতকে ঘৃণা করে বেছে নিয়েছে রাব্বুল আলামিনের রাস্তা।

আহিয়ান অনেক সুখে আছে তার স্ত্রী কে নিয়ে।

মেয়েটা এখানকার নাগরিক।

আহিয়ান রাশিয়া থেকে চলে এসে এখানে স্থান গেড়েছে।


মুহিতের হাত ধরে আহিয়ান কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো

"আমার এই জীবন তোমার দেয়া।আল্লাহ তোমার উছিলায় আমাকে তওবা করার সুযোগ দিয়েছে মেজর।


"আমার মা প্রতিদিন আমার স্বপ্নে আসে।আমাকে অনেক দোয়া করে,আমার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে"


"আমি দীর্ঘ ত্রিশ বছর আমার মাকে স্বপ্ন দেখিনি মেজর।"


"এখন রোজ দেখি"

মায়ের সাথে গল্প করি"


"একজন সন্তান হিসেবে এর চাইতে বড় প্রাপ্তি আর কি আছে মুহিত?


আহিয়ান মায়ের জন্য কাঁদে,আল্লাহর ভয়ে কাঁদে।

সে হেদায়াত প্রাপ্ত হয়েছে এই খুশিতে কাঁদে।


আহিয়ানের খুশির কান্নায় ভিজে উঠে মারীয়ম সহ সকলের চোখ।


――――

সময় বহমান,পেরিয়ে গেছে চোখের পলকে দুটো বছর।

হসপিটাল এর ওটি রুমের সামনে সমানে পায়চারি করছে মুহিত,সুখ আর নাফিজ মাহমুদ।নামিরা,তনুজা মিসেস তারিন দোয়া পড়ে যাচ্ছেন সমানে।

স্বর্গের বেবি হবে,প্রেগন্যান্সি সময়ে তার অনেক জটিলতা গিয়েছে।


মুহিত ভয়ে থেকে থেকে অস্থির হয়ে উঠছে শুধু।


নামিরার সাড়ে তিন বছরের ছেলেটা সব কিছু প্রত্যক্ষ করছে।


হঠাৎই ভেসে উঠলো কান্নার আওয়াজ।ভয়ে কেঁদে ফেললো মুহিত ও।

আর কোনোভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছেনা মুহিত।

ডক্টর কেনো এখনো বের হচ্ছে না।

চিন্তায় প্রেসার ফল হবার উপক্রম।

একটু পর পিউ দুই হাতে দুটো বাচ্চা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।

পিউকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে গেলো মুহিত।

অসহায় চোখে পিউয়ের দিকে তাকাতেই পিউ চোখের ইশারায় ভেতরে যাবার অনুমতি দিলো।

মুহিত দৌড়ে স্বর্গের কাছে চলে গেলো।

লেবার পেইন আর নরমাল ডেলিভারির প্রেসারে একদম নেতিয়ে গিয়েছে মেয়েটা।

স্বর্গের হাত ধরে চুমু খেয়ে ফুঁপিয়ে বাচ্চাদের  কেঁদে ফেললো মুহিত।

স্বর্গ কাঁপা কাঁপা হাতে মুহিতের চোখের জল মুছে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।


কিছুক্ষন পর পিউ এসে মুহিতকে বললো 

"লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহিত ওকে কেবিনে শিফট করবো আমি। আপনি বাইরে গেলে ভালো হয়"

মুহিত বুঝতে পেরে মাথা দুলিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।

একটি পুত্র আর একটি কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছে মুহিত।


মেয়েটা হুবুহু মায়ের চেহারা পেয়েছে।

ছেলেটার দিকে নজর দিতেই কলিজা মুষড়ে উঠলো মুহিতের।

মুকিত ,নামিরার ছেলে আর মুহিতের ছেলে হুবুহু চেহারা।


ছেলেমেয়েদের কোলে নিয়ে চুমু খেলো মুহিত।

বাবা হবার যেই  অব্যাক্ত আনন্দ তা কাউকে বলে বোঝানো যাবেনা।


******

আদনান ওয়াসিফ এর বিশাল বাড়ির ড্রয়িং রুমে দৌড়ে হেটে খেলে বেড়াচ্ছে মুহিতের দুই ছেলে মেয়ে "লিও"আর "রেইন"


হঠাৎই খেলতে খেলতে পড়ে গেলো দেড় বছরের মুহিতের মেয়ে রেইন।

মুহিত,স্বর্গ দৌড়ে আসার আগেই শুদ্ধ এসে টেনে তুলে আদর করে চোখ মুছিয়ে বলে উঠলো

"কেঁদোনা তুমি।তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট লাগে।

কথাটা শুনেই চুপ করে হাসতে লাগলো রেইন।


বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পাঁচ বছরের শুদ্ধ দৌড়ে নামিরার কাছে গিয়ে আবদার করলো

"মাম্মা আমিও মামার মতো ওকে বিয়ে করবো।রেইন কে আমার অনেক ভালো লাগে।ও অনেক সুন্দর পুতুলের মতো।


সকলেই এই কথা শুনে হাসতে হাসতে ঢলে পড়লো।


মনে মনে মিসেস তারিন ভাবলেন

আজ যদি মুকিত আর মানুষটা বেঁচে থাকতো তাহলে কতো খুশি হতো মুহিত আর নামিরার খুশিতে।

সব খুশিতেই পরিপূর্ণতা থাকে না।কিছু কিছু খুশি অপূর্ণতাই থেকে যায়।বলেই গোপনে সুখের অশ্রু মুছলেন।


          ――――――   সমাপ্ত   ――――――

0 Comments:

Post a Comment