গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ৭

 প্রিয় বেলা


৭.

আজ আবারও বৃষ্টি হয়েছে ধরণীতে। রাতের আঁধারে কালো মেঘেদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। আদ্রর ঘুম আসছে না। বিছানায় কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে উঠে দাঁড়ালো সে। বৃষ্টির পানিতে বারান্দার মেঝে পিচ্ছিল হয়ে আছে। সেখানে যেতে ইচ্ছে করছে না। মাথা ব্যথা করছে ক্ষীণ। এখন একটু কফি খেলে মন্দ হয় না। দরজা ঠেলে রুম হতে বেরিয়ে পরলো আদ্র। সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতেই রান্নাঘরে আলো জ্বালানো দেখতে পেল। অস্পষ্ট খুটুরখাটুর শব্দও হচ্ছে। নিমিষেই কপালে গাঢ় ভাঁজ সৃষ্টি হলো তার। এসময় রান্নাঘরে কে এসেছে? আদ্র এগিয়ে গেল সেদিকে।


চুলা জ্বালিয়ে কেতলিতে পানি গরম করছিল আয়াজ। কারো আসার শব্দে চোখ তুলে সামনে তাকালো। আদ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিমিষেই জিজ্ঞেস করে উঠলো,

---"ভাই চা পাতা কোথায় রেখেছে জানিস? খুঁজে পাচ্ছি না আমি।"

বলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সে আবারও চা-পাতা খুঁজতে লাগলো। আদ্র চুলার কাছে এগিয়ে বললো,

---"জানি না। তুই না ঘুমিয়ে চা বানাচ্ছিস কেন?"

উপরের ক্যাবিনেটের একটু ভেতরে হাত দিতেই চা-পাতা পেয়ে গেল আয়াজ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। বললো, "ঘুম আসছে না। তুই কি করছিস এখানে?"

---"আমারো ঘুম আসছে না। আমাকে একটু কফি বানিয়ে দেয় তো।"


আয়াজ ঘোর আপত্তি করে বললো,

---"এখন আমি কফির পাউডার খুঁজবো কোথায়? চা খেলে বল, ঢালি।"

আদ্র উত্তর দিলো না। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে আয়াজও কিছু বললো না। কেতলিতে চা ওৎরাচ্ছে। দুই কাপে চাটুকু ঢেলে নিলো সে। আদ্র চায়ের কাপ নিয়ে সেখানে আলতো চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করলো,

---"বেলা যাওয়ার পর ওই ঘরে তালা দিয়েছিলি আয়াজ?"

আয়াজের যেন হঠাৎ কথাটা মনে পরলো। দাঁত দিয়ে জিহ্বা চেপে হাসার চেষ্টা করে বললো,

---"একদম ভুলে গিয়েছি ভাই। চল এখন যাই। চা খেতে খেতে লাগিয়ে আসব। বৃষ্টি তো মনে হয় কমে গেছে এতক্ষণে।"


আয়াজ আর দাঁড়ালো না। কাপ নিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল সদর দরজার দিকে। আদ্র একটু বিরক্ত হলেও কিছু বললো না আর। বাহিরে বৃষ্টি এখনো আছে। তবে আগের মতো না। ঝিরিঝিরি। গায়ে তেমন লাগছে না। তালা লাগাতে গিয়ে দুই ভাই কিছুক্ষণ ওই ঘরটাতেই বসলো। আয়াজ চায়ে চুমুক দিয়ে অনেকটা আগ্রহী গলায় বললো,

---"ভাই, এপর্যন্ত তুই মারাত্বক ভাবে মেরেছিস কাকে, কাকে?"

প্রশ্নটা শুনে আদ্রর ভ্রু কুঞ্চিত হলো। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থেকে সে নির্বিকার ভাবে উত্তর দিলো,

---"একজনকেই মেরেছি। পাশের এলাকার একটা ছেলের হাত ভেঙ্গে দিয়েছিলাম কয়েকদিন আগে।"

---"খুবই ভালো কাজ করেছিস। তা সে বান্দা কি দোষ করেছিল?"

চা খাওয়া শেষ। টেবিলে চায়ের কাপ রাখতে রাখতে আদ্র জবাব দিলো,

---"ঠিক মনে নেই। রাজনৈতিক কাজে কিছু উলটাপালটা করেছিল বোধহয়।"


আয়াজ আবারও চায়ে চুমুক দিলো। তার কাছে চা একটু রয়েসয়েই খেতে ভালো লাগে। মুখটাকে একটু গম্ভীর করার প্রয়াস করে সে অকস্মাৎ বললো,

---"ভাই, তোর আর বেলার মাঝে কি চলছে বলতো। শরম-লজ্জা খেয়ে আমার সামনেই কপালে চুমু-টুমু খেলি। আবার কত আদর-যত্ন! সত্যি করে বলতো, কি চলছে তোর আর ওর মাঝে?"


চোখের তীক্ষ্ণতা বেড়ে গেল আদ্রর। ভ্রু যুগল আরও কুণ্ঠিত হলো। স্বাভাবিক স্বরে বললো,

---"ওর সাথে আমার কি হবে?"

আয়াজ ঠোঁট বাঁকালো, "আমিও প্রেম করি ভাই। সত্যি কথাটা বলে ফেল এবার।"


আদ্র সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলো না। ঘর থেকে বের হতে উদ্যোগী হয়ে বললো,

---"থাকবি নাকি যাবি? আমি তালা লাগিয়ে দেব এখন।"


শুনে তার পেছন পেছন আয়াজও উঠে এলো। কণ্ঠের জোড় বাড়িয়ে প্রখর আন্দোলন করে উঠলো,

---"তুই কিন্তু উত্তর দিচ্ছিস না।"

আদ্রর সহজ স্বীকারোক্তি,

---"পছন্দ করি আমি।"


__________


টিভি চলছে। সময় সংবাদে দূর্নীতিবিদ এক নেতাকে দেখানো হচ্ছে। তিনি আজ সকালে ভাষণ দিয়েছেন পাশের শহরে। টেলিভিশনের সাউন্ড আরেকটু বাড়িয়ে সায়েদ সাহেব ভীষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছেন সেই ভাষণ। পাশেই বেলা লাল চায়ে পরোটা ডুবিয়ে খাচ্ছে। বিহান খেলছে ওই দূরে। ভাষণ শুনতে শুনতে সায়েদ সাহেব বেশ আক্রোশ নিয়ে বলে উঠলেন,

---"সব রাজনীতিবিদই এক। প্রচন্ড খারাপ। বুঝলি বেলা? এই ব্যাটা আগে চাদা তুলতো। কিভাবে যে নেতা হলো! এখনকার সব নেতাই গণ্ডমূর্খ। আমার চক্ষূশুল।"


বেলার খাবার গলায় আটকে গেল যেন। মস্তিষ্কে আদ্রর কথা হানা দিলো। আদ্রও তো রাজনীতিবিদ। বাবার মতো সেও তো ভাবতো তারা খারাপ। তাহলে তো আদ্রও খারাপ হয়। কিন্তু পরক্ষণেই বেলার মন খুব গোপনে প্রতিবাদ করে উঠলো,

---"সব রাজনীতিবিদ খারাপ হয় না বেলা। কিছু কিছু রাজনীতিবিদ ভালোও হয়।"


বহুকষ্টে গলায় আটকে যাওয়া খাবারটুকু গিলে নিলো বেলা। সরব, দরজায় কারাঘাত হলো তীব্র শব্দে। বেলা উঠতে নিলে তাকে থামিয়ে দিয়ে সায়েদ সাহেব বললেন,

---"তুই বয়, আমি দেখছি।"


সায়েদ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। সদর দরজার কাছে গিয়ে তা খুলতেই চমকে গেলেন উনি। গাঢ় নীল রঙের ইউনিফর্ম পরা পাঁচ-ছয় জন পুলিশ সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সায়েদ সাহেব হতবাক গলায় কিছু বলবেন, তার পূর্বেই একজন সুঠাম দেহি পুলিশ গম্ভীর গলায় সরাসরি প্রশ্ন করলো,

---"আপনি সায়েদ সাহেব নিশ্চই। মিস্টার আইয়ুব এহতেশামকে কি আপনি চিনেন?"


সায়েদ সাহেব কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। চোখে হাজারো বিস্ময় নিয়ে বিহ্বল গলায় বললেন,

---"জি চিনি। আমার বোনের স্বামী হন।"

এবার পুলিশটি আরেকটু গম্ভীর হলো,

---"উনি আপনার নামে থানায় মামলা করেছেন। আপনি নাকি উনার প্রাপ্ত টাকা পরিশোধ করছেন না।"

সায়েদ সাহেব দিরুক্তি করে উঠলেন,

---"মিথ্যা কথা। আমি---।"


সায়েদ সাহেবকে সুযোগ না দিয়ে পুলিশটি জোড় গলায় বললো,

---"যা বলার থানায় গিয়ে বলবেন। করিম? উনাকে নিয়ে আসো।"


ইতোমধ্যে ছোটোখাটো হট্টগোল সৃষ্টি হয়ে গেছে বাহিরে। আওয়াজ শুনে বেলা খাওয়া ছেড়ে উঠে এসেছে। প্রভা বেগম রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। তিনিও ছুটে এলেন অচেনা পুরুষের চিৎকার শুনে।

বাহিরে এসে নিজ বাবাকে পুলিশদের কাছে টানাহেঁচড়া হতে দেখে অনেকটা চেঁচিয়ে বললো বেলা,

---"আমার বাবা-- আমার বাবাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? ছাড়ুন! ছাড়ুন আমার বাবাকে।"

দ্রুত আসতে গিয়ে বেলার মাথা থেকে ওড়না পরে গেছে। মুখশ্রী মুহুর্তেই ভয়ে কাতর, ভীতুগ্রস্ত। চোখ জ্বালা করছে। কান্না আটকে শক্ত গলায় বাবাকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে।


আশপাশের প্রতিবেশীগুলো উঁকিঝুঁকি দিয়ে তামাশা দেখছে। রাস্তার মানুষগুলোও বাদ যায়নি। অনেকে তো ভিডিও করছে। তাদেরই একজন রাহেলা দিলদার। আদ্রদের বাসায় কাজ করেন তিনি। মাত্রই বস্তি থেকে হেঁটে হেঁটে কাজে এসেছিলেন। সায়েদ সাহেবের এই পরিণতি দেখে দৌড়ে গেলেন রেখার কাছে। রেখা তখন স্বপরিবারে টেবিলে বসে নাস্তা খাচ্ছিলেন। রাহেলাকে দেখে তিনি বললেন,

---"বাহিরে এত আওয়াজ কিসের রাহেলা? কিছু কি হয়েছে?"


রাহেলা যেন আরও আগ্রহ পেয়ে গেলেন। রসিয়ে রসিয়ে বললেন,

---"ওই আপনাগো পাশের বাড়ি আছে না? সায়েদ মিয়ার বাড়ি। ওইহানে পুলিশ আইছে। সায়েদ মিয়ারে দেখলাম টাইনা টাইনা নিয়া যাইতেছে। উনার মাইয়া বেলা আটকাইতে চেশতা করতাছে। মাইয়ার সে কি কান্না, ইস! আমার এহনই মায়া লাগতাছে।"


আয়াজ সঙ্গে সঙ্গে আদ্রর মুখপানে তাকালো। তার খাওয়া থেমে গেছে। স্থির হয়ে বসে আছে সে। চোয়াল শক্ত। হাত মুঠো করা। রেখা চমকে কিছু বলতে গিয়ে আবারও থমকালেন। আদ্র সশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হনহনিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে বাড়ি হতে। আয়াজও আদ্রর পিছু নিলো। যেতে যেতে রেখাকে আশ্বস্ত করে বললো,

---"তুমি এখানেই থাকো মা। আমরা দেখি কি হয়েছে।"


জবাবে রেখা মৃদু কণ্ঠে বললেন,

---"তা-ই দেখ। একয়দিন ওদের ওপর কি যে যাচ্ছে!"


__________


বেলার আহাজারি কেউ শুনছে না। পুলিশগুলো কি পাষাণ ভাবে তার বাবাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ধস্তাধস্তিতে বেলার ওড়না এলোমেলো। নেত্রজোড়া জল আটকাতে অক্ষম। তরতর করে গাল জোড়া ভিঁজিয়ে দিচ্ছে। বেলা আবারো চিৎকার করে উঠলো,

---"আমার বাবাকে ছেড়ে দিতে বলেছিনা আপনাদের? তবুও কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? বলেছিনা টাকা দিয়ে দিবো।"

কন্সটেবল করিম বিরক্ত হয়ে এবার ঝাড়ি দিয়ে উঠলো,

---"এই মেয়ে, যা এইখান থেকে।"


বলার মাঝে হঠাৎ করিমের শার্টের কলার শক্ত করে ধরলো আদ্র। হুংকার ছেড়ে উঠলো, "ছাড় উনাকে।"


পুলিশগুলোর হ্যাড রেগে তাকালো। কঠিন গলায় ধমক দিলো,

---"এই ছেলে, এই! কলার ছাড়ো। একজন পুলিশের গায়ে হাত দেওয়ার সাহস হলো কিভাবে তোমার?"


আদ্র উত্তর দেওয়া তো দূর! পুলিশ অফিসারের দিকে তাকালোও না। রক্তলাল চোখে করিমের দিকে চেয়ে আবারো হুঙ্কার ছাড়লো,

---"আয়াজ।"

সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলো আয়াজ। পুলিশ অফিসারটির দিকে ফোন এগিয়ে দিলো। পুলিশটি ভ্রু কুঁচকে ফোন কানে রাখলো। ওপাশ থেকে কিছু বলতেই দমে গেল সে। আমতা আমতা করতে লাগলো। কথা শেষে আয়াজকে ফোন ফেরত দিয়ে আদ্রর দিকে ভীতু চোখে তাকালো। মাথা নুইয়ে মিনমিনিয়ে বললো,

---"ক্ষমা করবেন স্যার। আমি আপনাকে চিনতে পারিনি। এই করিম, সায়েদ সাহেবের কলার ছাড়ো।"


করিম বিস্ময়ে হাত ছেড়ে দিলো। আদ্রও কলার ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। পুলিশ আইয়ুব এহতেশামের অভিযোগ বলতেই রাশভারি গলায় সে বললো,

---"আপনারা সবাই চলে যান। আংকেলের যখন সময় হবে তিনি টাকা পরিশোধ করে দেবেন।"


একে একে সবাই চলে গেল। প্রতিবেশীগুলোও এখন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে না। রাস্তা আবারও নীরব। প্রভা বেগম সায়েদ সাহেবকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেছেন। বেলা আদ্রর পাশে দাঁড়িয়ে ডুকরে কাঁদছে। যন্ত্রণায় বুকটা ভীষণ ভারি লাগছে তার। বেলার দিকে ক্ষীণ এগিয়ে এলো আদ্র। গালে আলতো স্পর্শ করে দৃশমান মুক্তোর দানাগুলো বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মুছে দিলো। থমথমে গলায় আয়াজকে ডাকলো,

---"আয়াজ।"

আয়াজ তৎক্ষণাৎ সারা দিলো,

---"হু, বল ভাই।"

---"আঙ্কেলের ভিডিও যেন সোশ্যাল মিডিয়াতে না বের হয়। সবাইকে ওয়ার্ন করবি এবং নিজে থেকে ভিডিওটা ডিলিট করবি। নয়তো তোকে আস্ত রাখবো না আমি।"


আয়াজ মাথা দুলিয়ে সরে গেল সেখান থেকে। রেখা হয়তো বাড়িতে দুশ্চিন্তা করে প্রেশার বাড়াচ্ছেন। আপাতত উনাকে শান্ত করতে হবে।

আয়াজ চলে গেল। আদ্র বাকি দূরত্বটুকুও ঘুচালো। আবারও ভিঁজে যাওয়া গাল অতি সন্তপর্ণে মুছে দিলো। বেলার ভেঁজা পাঁপড়িগুচ্ছে একদফা হাত বুলালো। বেলা যেন খুব আহ্লাদী হয়ে উঠলো। কান্নার আওয়াজ বাড়িয়ে দিলো হঠাৎ। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিজের দিকে ফেরালো আদ্র। কোমলস্বরে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,

---"হুশ! আর কাঁদবেন না বেলা। চোখ ফুলে গেছে আপনার। বেশি কাঁদলে মাথা ব্যথা করবে। দেখি, আমার দিকে তাকান।"


__________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ৬

 প্রিয় বেলা


৬.

রোদে সত্যিই তাকাতে পারছিল না বেলা। কিন্তু তাই বলে জড়িয়ে ধরার মানে কি? আদ্রর কথার অবাধ্য হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো বেলা। কণ্ঠে কঠোরতা নিয়ে বললো,

---"আমি ঠিক আছি। আপনি ছাড়ুন আমায়।"

আদ্র শুনলো না। বড়সড় ধমক দিয়ে বললো, "যা বলছি তা করুন। অবাধ্য হচ্ছেন কেন?"


বেলা তবুও কথার অমান্য করলো। ভীষণ জেদি হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। যেন এই লোকের একটা কথাও না শোনার ঘোর পণ করেছে সে। আদ্র এবার আর কথা বাড়ালো না। কয়েক সেকেণ্ড অতৃপ্ত চোখে চেয়ে রইলো। কপালে রুষ্ট বলিরেখার অসংখ্য ভাঁজ। ভ্রু কুঁচকানো। নিজেই হাত বাড়িয়ে ওড়না নাক অব্দি টেনে নিলো। বেলাকে বক্ষের সঙ্গে প্রগাঢ় ভাবে জড়িয়ে এক পা এগোতেই পায়ে টান পরলো বেলার। ক্ষতস্থান টনটন করে উঠলো। কণ্ঠনালি গলিয়ে অস্পষ্ট ভাবে বেড়িয়ে এলো, "আহ! ব্যথা।"


আদ্র চকিতে তাকালো। অস্থির হলো খুব। ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

---"কি হয়েছে বেলা?"

ব্যথায় কাতর বেলা চোখ-মুখ কুঁচকে বললো,

---"এভাবে হাঁটতে পারবো না আমি। পায়ে অনেক জ্বালা করছে।"


কোমড় থেকে হাত সরালো আদ্র। এক আঙুলে কপাল ঘোষে এদিক-ওদিক তাকালো কয়েকবার। এখানটায় মানুষজন নেই। সুদূরে ঝাড়ু দিচ্ছে সেই মহিলা। কিন্তু একটু সামনে যেতেই হয়তো জনমানবের দেখা মিলবে। দৃষ্টি ফিরিয়ে বেলার ব্যথাতুর মুখপানে স্থির হলো আদ্র। গম্ভীর গলায় আয়াজকে বললো,

---"নতুন মাক্সগুলো থেকে একটা আমাকে দে আয়াজ।"


অতি বিস্ময়ে এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে ওদের দিকে চেয়ে ছিলো আয়াজ। আদ্রর কথায় সম্বিৎ ফিরতেই পকেট থেকে মাক্সগুলো বের করলো সে। সেখান থেকে নতুন একটা নিয়ে এগিয়ে দিলো আদ্রের দিকে। ডাকলো, "ভাই? নে।"

আদ্র না তাকিয়েই নিলো। বেলা থেকে ক্ষীণ দূরত্ব তৈরি করে স্বযত্নে মাক্সটি পরিয়ে দিলো তাকে। নাক অব্দি ওড়না টানা, এখন আবার নাক থেকে থুতনির নিচ পর্যন্ত নীল রঙা মাক্স! বেলার মুখটা ছোটখাটো একটা প্যাকেট হয়ে গেছে। চেনার উপায় নেই। ব্যথা আর গরমে অতিষ্ঠ বেলা মুখ বুঝে সহ্য করে নিলেও আয়াজ প্রতিবাদ করে উঠলো,

---"মেয়েটাকে আবার মাক্স পরালি কেন ভাই? এমনিতেই গরমে মুখ ঘেমে আছে ওর। মাক্স পরলে আরও গরম লাগবে না?"


জবাব দিতে একটু সময় নিলো আদ্র। দূরত্ব ঘুচিয়ে হঠাৎ কোলে তুলে নিলো বেলাকে। বেলা অধিক চমকে ভড়কালো, হকচকালো। ভীতু চোখ জোড়া বড় বড় করে তাকালো। আদ্র সেদিকে মোটেও পাত্তা দিলো না। সামনে এগোতে এগোতে আগের চেয়েও বেশি গাম্ভীর্য নিয়ে দাম্ভিক, ভরাট গলায় উত্তর দিলো,

---"আমাকে এলাকায় এমনিতেও খারাপ জানে সবাই। আমি চাই না আমার জন্য ওকেও কেউ খারাপ জানুক। আমি সহ্য করবো না সেটা।"


এই ঠাঠা পরা রোদেও তিরতির করে হাত, পা ঠান্ডা হয়ে গেল বেলার। শরীর মৃদু, মৃদু কাঁপতে লাগলো।


__________


আসার পথে আদ্র আর বেলার দিকে অনেকেই চোখা দৃষ্টির তীর ছুঁড়ে মেরেছে অতি ক্রুদ্ধভাবে। যদিও বেলাকে কেউ চিনতে পারেনি। কিন্তু তবুও লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাথা নিচু করে ছিল সে। মনে মনে ভেবে নিয়েছে, জীবন থাকতে এ জামা পরে আর কখনোই বাহিরে বের হবে না সে।

ভাবনার মাঝেই চোখ উঠিয়ে সামনে তাকালো বেলা। অবাক হলো। আদ্র তার বাড়িতে না গিয়ে এদিকে কোথায় যাচ্ছে? প্রশ্ন চাপিয়ে না রেখে বিহ্বল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো সে,

---"আপনি আমাকে এদিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আদ্র ভাইয়া? আমাদের বাড়ি তো সামনেরটা।"


আদ্র উত্তর দিলো না। তাকালো না পর্যন্ত। বেলা গলার জোড় বাড়িয়ে আবার বললো,

---"আশ্চর্য! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি? বলছেন না কেন?"


আদ্র এবারো নিশ্চুপ। আদ্রদের বাড়ির পেছনের দিকটায় আধভাঙ্গা একটা ছোট্ট ঘর আছে। ছাদ থেকে একবার দেখেছিল বেলা। ঘরটির দেওয়ালগুলো কাঠের আর ছাদ টিনের। সেই ঘরটিতেই বেলাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো আদ্র। আলতো করে সোফায় বসিয়ে দিলো তাকে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,

---"এত হালকা কেন আপনি? খাবার খান না?"

বেলা বিদ্রুপ করতে চাইলো, "আমি মোটেও হালকা নই। ঠিকই আছি। আপনার চোখে সমস্যা।"


কিন্তু তা আর করা হলো না। সে আপাতত আশপাশটা দেখতে ব্যস্ত। বাহির থেকে ঘরটা যতটা ভাঙ্গা মনে হয়, তার থেকেও বেশি পরিপাটি এর ভেতরটা। মাঝারি আকারের একটা রুম। যার দেওয়াল জুড়ে বিভিন্ন যান্ত্রিক সরঞ্জাম। বুকসেল্ফে অনেকগুলো ফাইলের স্তুপ আর বই। ডান পাশের দেওয়ালে ছোটোখাটো একটা রান্নাঘর। আর রয়েছে একটা সোফা। যেখানে এখন বেলা বসে আছে।

একটু পর আয়াজও ঢুকলো সেই ঘরে। বেলাকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে বললো,

---"ঘরটা সুন্দর না বেলা? ভাই এখানেই থাকে বেশিরভাগ। মাঝে মাঝে রান্নাও করে।"


বেলা শুনলো। তবে কিছু বললো না। সরব আদ্র কোথা থেকে ফাস্টএইড বক্স নিয়ে তার পায়ের কাছে এসে বসলো। আঁতকে উঠে বাঁধা দিতে চাইলে মৃদু ধমক দিয়ে উঠলো সে,

---"চুপ করে বসুন বেলা।"


বেলা চুপ হয়ে গেল। অসন্তুষ্ট চাহনিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। পায়ে প্রাথমিকভাবে ব্যান্ডেজ করে তক্ষুণি উঠে দাঁড়িয়েছে আদ্র। পকেটের ভেতর থেকে লাইট জ্বলে উঠছে। কলের শব্দ কানে ঝংকার তুলছে তীব্রভাবে। অথচ ফোনটা বের করে কল রিসিভ করার প্রয়োজন বোধ করছে না আদ্র। বরং আয়াজকে বললো,

---"আমার একটু কাজ আছে। তুই ওকে ওর বাসায় দিয়ে আসিস। আর ওর বাসার কেউ ব্যান্ডেজের কথা জিজ্ঞেস করলে কিছু একটা বানিয়ে বলিস। এখন চোখ বন্ধ কর।"

সঙ্গে সঙ্গে নাক কুঁচকে ফেললো আয়াজ, "কি?"

---"চোখ বন্ধ করতে বলেছি তোকে।"


তারপর আবার বেলার দিকে তাকিয়ে আদেশের সুরে বললো,

---"আপনিও চোখ বন্ধ করুন।"


বেলা থতমত খেয়ে চোখ বুজলো। তার কিছুক্ষণের মাঝেই হঠাৎ কপালের উষ্ণ স্পর্শ কাঁপিয়ে তুললো তাকে। নিশ্বাস গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো। তৎক্ষণাৎ চোখ মেলে তাকালো বেলা। কিন্তু তার সামনে আদ্র নেই। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আয়াজ মিটিমিটি হাসছে। দরজা ঠেলে এইমাত্র বেড়িয়ে গেছে আদ্র।


__________


চলবে~ 

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ৫

 প্রিয় বেলা


৫.

ল্যাপটপে টানা কয়েক ঘণ্টা কাজ করে আদ্রর ঘাড়টা ব্যথায় টনটন করে উঠলো যেন। পরনের হালকা পাওয়ারি চশমা খুলে ঘাড় এদিক-ওদিক নাড়ালো সে। শেষের ই-মেলগুলোয় একদফা চোখ বুলিয়ে ল্যাপটপটা সশব্দে বন্ধ করে দিলো। টেবিলে এখনো কফির মগ থেকে ধোঁয়া উঠছে। যাক! ঠান্ডা হয় নি এখনো। টেবিল থেকে কফি নিয়ে বারান্দায় পা বাড়ালো আদ্র। আজকে একটু রোদ উঠেছে। বৃষ্টির দেখা নেই সকাল থেকে। আশপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে হঠাৎ পাশের ছাদে চোখ আটকে গেল তার। আদ্রর বারান্দা থেকে ছাদটি সরাসরি দেখা যায়। রেলিংয়ে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে, বেলা উদাস মনে চেয়ে আছে আকাশ পানে। আঁখিজোড়ায় একরাশ বিষণ্ণতা কিংবা যন্ত্রণা। আদ্র চেয়েই রইলো। কফি ঠান্ডা হয়ে গেল এ ফাঁকে। খাওয়া আর হলো না। 


আয়াজ তখন আদ্রের রুমে ঢুকতে ঢুকতে চেঁচানো গলায় বললো,

---"ভাই তোর ল্যাপটপ একটু নিচ্ছি। আমারটায় চার্জ নেই।"

আদ্র শুনলো। ঘোর কেটে গেল তার। জবাব দিলো,

---"টেবিলে আছে। নেয়।"

ওমনি আগের ন্যায়ই আয়াজের কণ্ঠ ভেসে আসলো, "পেয়েছি।"


আদ্র ভাবলো আয়াজ চলে গেছে। বেলার দিকে আবারও আচ্ছন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কফির মগে চুমুক দিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ, মুখ কুঁচকে ফেললো। কফি না, এ যেন ঠান্ডা পানসে পানীয়। বিচ্ছিরি স্বাদ। কোনোমতে মুখেরটুকু গিলে ছোট্ট টেবিলটায় কফির মগটা রেখে দিলো সে। সরব পেছন থেকে আয়াজ বলে উঠলো,

---"ভাই, ওটা বেলা না?"


আদ্র ফিরে তাকালো। ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন ছুঁড়লো, "তুই যাস নি?"

আদ্রর পাশে দাঁড়িয়ে আয়াজ উত্তর দিলো,

---"না। তুই কি করছিস দেখতে এলাম। এখন আবার বেলার সাথেও দেখা হয়ে গেল। কিন্তু মেয়েটাকে এত আপসেট দেখাচ্ছে কেন? দাঁড়া ডাক দেই।"


বলে ডাক দিতে নিলেই তৎক্ষণাৎ ধমক দিয়ে উঠলো আদ্র, "সমস্যা কি? নিজের কাজে যা।"

আয়াজ অবাক হলো খুব, "সমস্যা মানে? আর তুই আমাকে এভাবে ধমকাচ্ছিস কেন ভাই? ভুলে যাস না, তুই আমার মাত্র তিন মিনিটের বড়।"

আদ্র বিরক্ত গলায় বললো,

---"তোর নটাংকি শেষ হয়েছে? নাকি যাবি?"

---"শেষ হয় নি। আমি এখন বেলাকে ডাকবো এবং তোর সামনেই ওর সাথে কথা বলবো।"

---"মার খেতে না চাইলে এখান থেকে যা আয়াজ।"


কথা বলার মাঝে বেলার দিকে না চাইতেও চোখ চলে গেল আদ্রর। বেলা তখন কেন যেন হাসছিল। মলিন হাসি। তবুও কি অপরুপ লাগছিল! আদ্র তার দৃষ্টি ফেরাতে পারলো না। বেলায় স্থির হয়ে গেল। আটকে গেল খুব বাজে ভাবে। বুঝে পেল না, মেয়েটাকে তার এত কেন ভালো লাগে? মেয়েটা তো স্বাধারণ। খুবই সাধারণ। ভাবনার অকুল পাথারেই আয়াজ নাক কুঁচকে ঠাট্টার স্বরে বললো,

---"এই তুই বেলার দিকে এমন কুদৃষ্টি দিচ্ছিস কেন? মেয়েটাকে তো অসুস্থ বানিয়ে দিবি। তাড়াতাড়ি নজর সরা। সরাচ্ছিস না কেন?"


আদ্র মোটেও বিরক্ত হলো না এবার। বরং শান্ত চাহনিতে আয়াজের দিকে তাকালো। স্বাভাবিক গলায় বললো,

---"কেন বিরক্ত করছিস?"

আয়াজ উত্তর দিলো না। আড়মোড়া ভাঙ্গার ভঙ্গিতে হাত দুটো মেলে চলে গেল সেখান থেকে।


__________


রাস্তার একপাশে এক আধবয়সী মহিলা ঝাঁড়ু দিচ্ছে। অনলে ধূলোবালির সংমিশ্রণ। রোদের তেজ প্রখর। নিজ এলাকায় ঢুকতেই মহিলাটির দিকে নজর পরলো বেলার। সেমুহুর্তে উনিও তাকালেন। অমায়িক হেসে বললেন,

---"ক্যান আসো বেলা মা? টিউশনের থেইকা আসছো নাকি?"

বেলাও হেসে জবাব দিলো,

---"জি খালা। কিন্তু আপনি এসময় ঝাড়ু দিচ্ছেন যে? ঝাড়ু তো সবসময় সকালে দিতে দেখেছি আপনাকে।"

---"কি আর কমু মা। আমার বউ পোয়াতি ছিল। কাল রাইতে পোলা হইছে একখান। ওইহানে ছিলাম কাল রাইত থেইকা। মালিকরে ফোন কইরা কইছিলাম আইজকা আইতে পারুম না। হেয় কয়, তাইলে টাকা কাইটা নিবো। দিতো না। তাই আইতে হইছে এই বিহালে। আমরা গরিব মানুষ। কি আর করমু।"


বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। উনার গায়ের শাড়িটি বেলা কালকেও পরে আসতে দেখেছে, আজও একই শাড়ি পরে এসেছেন তিনি। মুখটা শুকিয়ে কাঠ। শরীরের একেকটা হাড্ডি গোনা যাবে। বেশ জীর্ণশীর্ণ। বেলার খুব মায়া হলো। মলিন গলায় সে জিজ্ঞেস করলো, "আপনি কিছু খেয়ে এসেছেন খালা?"

তিনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলেন যেন। ঝাড়ু দিতে মনোযোগী হয়ে বললেন, "আর খানা! বউয়ের পিছেই সব টাকা চইলা যাইতেছে। খাওয়ানের টাকা পামু কই।"


বেলার ব্যাগে দুই'টা কলা ছিল। টাকা অত নেই। ব্যাগ থেকে কলা দু'টো নিয়ে মহিলাটির দিকে এগিয়ে গেল সে। হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। ডান পায়ে চাপ দিতে পারছে না। পাটা আলগা করে হাঁটতে হচ্ছে। তা দেখে খালা অবাক হয়ে বলে উঠলেন,

---"এভাবে হাঁটতাছো ক্যান বেলা? তোমার পাও থেইকাও তো অনেক রত্ত পরতাছে। ছিলছে কিভাবে?"

বেলা একটু করে হাসলো,

---"রিকশা থেকে নামার সময় আঁচড় কেটে গেছে খালা। ঠিক হয়ে যাবে। আপনি এ কলা দু'টো রাখুন। কাজ শেষে খেয়ে নিবেন। নিন।"


খালা কলাগুলো নিলেন। কৃতজ্ঞতায় চোখে জল টলমল করে উঠলো উনার। মুখ ভরে হেসে মাথা দুলালেন।


__________


পায়ের ব্যথা বাড়ছে। হাঁটতে ভীষণ বেগ পেতে হচ্ছে বেলার। এই বিপদের মুহুর্তে পথটাও যেন শেষ হচ্ছে না। একটু দূরেই আয়াজকে দেখতে পেল সে। আদ্রও ছিল। সে গাছের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগী মুখশ্রীতে ফোনে কথা বলছে খুব উচ্চস্বরে। যা বেলা অতদূরে থেকেও ক্ষীণ স্পষ্ট শুনতে পারছে। 

আয়াজ একদম সামনে পরে যাওয়ায় তাকে না দেখার ভান করে পাশ কাটাতে পারলো না বেলা। ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি নিয়ে বললো,

---"কেমন আছেন আয়াজ ভাইয়া?"


আয়াজ মিষ্টি হেসে বললো,

---"ভালো আছি। কিন্তু তুমি কিভাবে চিনলে আমি আয়াজ?"


বেলা অপ্রস্তুত হলো। চোখ পিটপিটালো বেশ কয়েকবার। থেমে থেমে বললো,

---"আপনি আদ্র ভাইয়া থেকে চিকন। ওভাবেই চিনেছি।"

আয়াজ দুষ্টু হাসলো। ভ্রু নাঁচিয়ে বললো,

---"কিন্তু তা তো আমরা একসাথে থাকলে বুঝবে। অত দূরে দাঁড়ানো আদ্র ভাইকে আমার সঙ্গে পার্থক্য করা, আমার মতে একদেখায় অসম্ভব। কেউই এ পর্যন্ত করতে পারেনি। তাই--- আমাকে আসলে কিভাবে চিনলে তা সত্যি সত্যি বলে দাও তো বেলা।"


বেলা ভড়কালো, হকচকালো। ভীষণ বাজে ভাবে ফেঁসে গেল যেন। লজ্জায় গাল রক্তিম হচ্ছে। তার আভাস তীব্র ভাবে পাচ্ছে সে। জবাবে কিছুই বলতে পারলো না বেলা। শুধু হাসফাস করতে লাগলো। আয়াজ ঠোঁট চেপে হেসে আবার বললো,

---"বলছো না যে? তাড়াতাড়ি বলো বেলা। কুইক!"


বেলা আড়চোখে একবার আদ্রর দিকে তাকালো। ফোন কানে সে ওরদিকেই তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। বেলার অস্বস্থি হতে লাগলো। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আয়াজ আবারও তাগাদা দিতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে বেলা একনিশ্বাসে বলে ফেললো,

---"আদ্র ভাইয়ার বাম চোখের পাশে একটা কাটা লাগ আছে। ওটা আপনার নেই।"


হাসির প্রবল আওয়াজ কানে ঝংকার তুলতেই চোখ মেলে তাকালো বেলা। লজ্জায় এবার মাথা একদম নিচু করে ফেললো। আয়াজ নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে সশব্দে হাসছে। বেলা তার অস্বস্থি বাড়তে দিলো না। চলে যাওয়ার জন্য বেশ কয়েক কদম আগাতেই পেছন থেকে আদ্রের ভরাট কণ্ঠ আটকে দিলো তাকে।


---"দাঁড়ান। ব্যথা পেয়েছেন কিভাবে বেলা?"


বেলা দাঁড়াতে চাইলো না। কোনোমতে উত্তর দিলো,

---"রিকশা দিয়ে নামতে গিয়ে।"

এরপর আবারো হাঁটতে নিলে ধমক দিয়ে উঠলো আদ্র,

---"আপনাকে দাঁড়াতে বলেছি বেলা।"

বেলা মৃদু কেঁপে উঠলো। পেছনে ফিরার আগেই আদ্র তার পাশাপাশি এসে হঠাৎ বুকে আগলে নিলো তাকে। একহাতে কোমড় আঁকড়ে ধরলো। অন্যহাতে মাথা চেপে ধরলো বক্ষস্থলের ঠিক বা'পাশটায়। আকস্মিক হওয়ায় বেলা ভয় পেল খুব। বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে বলতে চাইলো,

---"কি করছেন আদ্র ভাইয়া?"


কিন্তু আদ্র বলতে দিলো না সেকথা। আরও শক্ত করে ধরে কোমলস্বরে বললো,

---"ওড়না দিয়ে মুখ ভালোভাবে ঢেকে নিন বেলা। রোদে তাকাতে পারছেন না আপনি।"


__________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ৪

 প্রিয় বেলা


৪.

মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা পরে আছে। শীতল বাতাসের আগমন বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। কাকেরা কারেন্টের তারে বসে আবহাওয়ার এই পরিণতি দেখে অভিযোগ করে যাচ্ছে অবিরাম। আদ্রর ঠান্ডা হাত এখনো স্থীর হয়ে ছুঁয়ে আছে বেলার রক্তিম গাল। তার দৃষ্টি অস্বাভাবিক শান্ত। নরম গালদুটোয় আলতো চাপ দিয়ে বেলার মুখশ্রী নিজের মুখোমুখি আনলো সে। রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, "আমাকে আপনার খারাপ মনে হয় বেলা?"


বেলার হুট করেই ভীষণ শীত, শীত লাগছে। পরনের মোটা চাদরেও শরীরের কম্পন বন্ধ হচ্ছে না। তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট জোড়া। আদ্রর চোখ মুহুর্তেই বেহায়া হয়ে উঠলো। নিমগ্ন হয়ে সে চেয়েই রইলো সেই কাঁপা কাঁপা অধরের পানে। বেলা থেমে থেমে বললো,

---"আমার শীত লাগছে---। আমি ঘরে যাবো।"


আদ্রর ঘোর কাটল। মুচকি হেসে সরে দাঁড়ালো সে। প্রশ্ন করলো,

---"আপনার ফুল পছন্দ বেলা?"

---"হ্যাঁ, খুব।"

---"কোন ফুল পছন্দ?"

---"পদ্ম।"


বেলার কালো, ধূসর মিশেলের চুলগুলো অত বড় না। পিঠ অব্দি। তবে বেশ ঘন, মোটা আর লতানো। খোপা করে সেগুলো ঘোমটার আড়াল করে রেখেছে সে। পাতলা ওড়নার ভেতরে ক্ষীন দৃশ্যমান সেই খোপার দিকে চেয়ে আদ্র নিষ্প্রভ স্বরে বললো,

---"মাথা থেকে ওড়না সরিয়ে চুলগুলো ছেড়ে দিন তো বেলা।"

বেলা যেন বুঝলো না। জিজ্ঞেস করলো, "জি?"

আদ্র ভ্রু কুঁচকালো। এগিয়ে এসে নিজেই সরিয়ে দিলো ঘোমটা। একটানে ক্লিপ খুলে ফেলতেই অনাবৃত হলো চুলগুলো। শোভা পেল পিঠজুড়ে। আদ্র অভিযোগের সুরে বললো,

---"আপনি বেশি কথা বলেন বেলা। কথা শুনেন না।"


এহেন আচরণে বেলা ভীষণ ভাবে ভড়কালো। বিমূঢ় হয়ে পিটপিট করলো তার নেত্রপল্লব। সিঁড়ি ঘরের ওপাশে যেতে যেতে আদ্র আদেশী কণ্ঠে সাবধান করে উঠলো, "জায়গা থেকে এক পাও নড়বেন না বেলা। আমি এক্ষুণি আসছি। আর খবরদার, চুল বাঁধবেন না।"


বেলা তৎক্ষণাৎ বলতে চাইলো,

---"কিন্তু আমার ক্লিপটা তো দিয়ে যান!"

কিন্তু ততক্ষণে আদ্র চলে গেছে ওপাশে। ক্ষুদ্র কণ্ঠে বলা বেলার কথাটি কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি তার। যাওয়ার প্রায় দু'মিনিটের মাথায় আদ্র আবারও এলো বেলার সম্মুখে। হাতে টকটকে লাল রঙের দু'টো পদ্ম। পদ্মগুলোর দিকে প্রফুল্ল চোখে চেয়ে বেলা জিজ্ঞেস করলো,

---"পদ্মগুলো কোথায় পেলেন আপনি? কি সুন্দর এগুলো!"


বেলার আনন্দ দেখে দূর্বোধ্য হাসলো আদ্র। সরব বেলার চুল গলিয়ে ঘাড়ের কাছে হাত নিয়ে গেল সে। দূরত্ব কমিয়ে নিজের খুব কাছে নিয়ে এলো। বেলার হাসি উবে গেছে। বিমূঢ়তায় আঁখিদুটি বিশাল আকার ধারণ করেছে। হৃদযন্ত্রের ধকধক শব্দ আদ্রও শুনতে পাচ্ছে বোধহয়। বেলা ভীতু স্বরে বললো,

---"কি করছেন আপ---?"


বাক্যটি শেষ হওয়ার পূর্বেই হাতের একটি পদ্ম বেলার কানে অতি যত্নে গুঁজে দিলো আদ্র। পরক্ষণেই সরে এলো সে। অন্য পদ্মটি বেলার হাতে ধরিয়ে হাসতে হাসতে বললো,

---"ভয় পেলে আপনাকে দারুণ লাগে বেলা।"


বেলা হতবাক, চমকিত। কিছুপলক আদ্রের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রুষ্ট কণ্ঠে বললো,

---"আপনি আধপাগল।"

---"একদম না। আমি পুরোপাগল।"


__________


বেলার ফুফা আইয়ুব এহতেশাম। বেলার বাবা সায়েদ থেকে চারগুণ ভালো অবস্থাপূর্ণ তিনি। তার ছেলে আমেরিকার কোন ব্যাংকে চাকরি করে। তাদের টাকার যেমন অভাব নেই, অহংকারেরও তেমনি ঘাটতি নেই। বিকালের প্রথম ভাগে হঠাৎই তার আগমন ঘটে সায়েদ সাবেহের বাড়িতে। এসেই তুমুল ঝগড়া শুরু করে দেন তিনি। চিল্লাচিল্লির আওয়াজ শুনে বেলা দৌঁড়ে ড্রইংরুমের কাছে আসে। আইয়ুব এহতেশাম তখন চেঁচিয়ে বলছিলেন,

---"আর অপেক্ষা করা সম্ভব না আমার পক্ষে। আমার টাকা কখন দিবি তুই? নেওয়ার সময় তো ঠিকই ড্যাংড্যাং করে নিয়েছিলি।"


সায়েদ সাহেব লজ্জায়, অপমানে মাথা হেট করে বসে আছেন। নম্র স্বরে তিনি অনুরোধ করলেন,

---"আর কয়টা দিন সময় দেয় আমায়। আমি জলদিই দিয়ে দিব।"

আইয়ুব এহতেশাম এবার দ্বিগুণ চেঁচিয়ে উঠলেন,

---"কিসের কয়টা দিন? বাড়ি বানাবি বলে টাকা নিয়েছিলি তিন লাখ। দেড় বছর হচ্ছে, এখনও টাকা দেওয়ার নাম নেই। তুই কি চাস আমি পুলিশ ডাকি? অথবা তোর এই সাধের বাড়ি নিজের নামে লিখে নেই?"


বেলা তার বাবার অসহায় মুখখানা দেখে আর চুপ থাকতে পারলো না। আইয়ুন এহতেশামের দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো,

---"বাবা বলেছে না টাকা দিয়ে দিবে? তবুও এত চেঁচাচ্ছেন কেন? ভুলে যাবেন না, আপনার দূঃসময়ে আমারই কিন্তু সাহায্য করেছিলাম আপনাকে। আর রইলো তুই-তুকারির কথা। আমার বাবা আপনার চেয়ে অনেক বড়। সম্মান দিয়ে কথা বলবেন।"


আইয়ুব এহতেশাম তেঁতে উঠলেন,

---"এত পাকনামি করবা না বেলা। টাকা দিতে পারো না আবার এত তেজ আসে কোথা থেকে তোমাদের? আমার ছেলে তোমারে পছন্দ করতো। একমাত্র হৃদের কথায় তোমাদের দয়া করে টাকা দিছিলাম আমি। ভাবছিলাম তোমার বাবা আমার ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দিবে। কিন্তু এ পল্টিবাজ তো নিজের মেয়ের মতামতের বিরুদ্ধেই যাবে না। মেয়েরে পড়ালেখা কইরা বেয়াদব বানাবে।"


বেলা উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,

---"আপনি যান এখান থেকে। আপনাকে যেন এ বাসায় দ্বিতীয় বার আর না দেখি। যখন সময় হবে আমরা টাকা দিয়ে দেব।"

আইয়ুব এহতেশাম আর বসলেন না। চলে যেতে যেতে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,

---"কাজটা ভালো করলা না বেলা।"


আইয়ুব এহতেশাম চলে যেতেই সায়েদ সাহেবের দিকে তাকালো সে। তিনি মলিন মুখে মাথা নিচু করে আছেন। তা দেখে সূদীর্ঘশ্বাস ফেললো বেলা।


__________ 


আকাশে আজ রোদ উঠেছে। রাস্তায় রিকশার আনাগোনাও বেশি। তবুও রিকশায় চড়তে ইচ্ছে করছে না বেলার। ফুটপাতে হাঁটার মজাই আলাদা। চারপাশ দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। একটু অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটার মাঝেই হঠাৎ ভরাট কণ্ঠের ডাক শুনতে পেল সে, "বেলা।"


বেলা দাঁড়িয়ে গেল। নিমিষেই ভরাট কণ্ঠের মালিককে চিনে ফেললো সে। ব্যক্তিটি তার অতি পরিচিত একজন। পেছনে ফিরে আদ্রকে দেখে তার ধারণা যেন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মিলে গেল। আদ্র দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে তার পাশাপাশি দাঁড়ালো। বেলার অনাদৃত হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে প্রশ্ন করলো,

---"কোথায় যাচ্ছেন?"

বেলা তার হাত ছাড়াতে চাইলে ছাড়লো না আদ্র। স্বাভাবিক স্বরে বললো,

---"থাকুক।"

তারপর আবার একই প্রশ্ন করতেই বেলা মৃদু স্বরে বললো,

---"টিউশনে।"

---"এভাবে হেঁটে হেঁটে?"

---"হ্যাঁ।"


আদ্র বেলাকে টেনে হাঁটতে হাঁটতে বললো,

---"তবে চলুন। আপনাকে পৌঁছে দেই।"

---"তার প্রয়োজন নেই। আমি যেতে পারবো।"

আদ্রের একরোখা উত্তর, "কিন্তু আমার প্রয়োজন আছে।"

---"আপনি শুধু শুধু কষ্ট করছেন।"


আদ্র দাঁড়িয়ে গেল। তার গভীর চোখ দুটো বেলার মুখপানে স্থির করলো। মাথার ঘোমটাটি টেনে চোখ, নাক ঢেকে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,

---"আমারটা আমি বুঝে নেব। আপনার বুঝতে হবে না।"


__________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ৩

 প্রিয় বেলা


৩.

বেলা আঁটসাঁট হয়ে বাসের জানালা ঘেঁষে বসে আছে। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগেই। আবহাওয়া শীতল, ঠান্ডা বাতাস বহমান। এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজার ব্যর্থ চেষ্টা চালালো বেলা। ঠোঁট কামড়ে একবার আড়চোখে আদ্রকে দেখে হ্যান্ডব্যাগটা চেপে ধরলো। আদ্র কপালের চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেলে প্রশ্ন করলো, "আপনি এখন কোথায় যাবেন? বাসায় নাকি অন্য কোথাও?"


বেলা মিনমিনে স্বরে উত্তর দিলো,

---"বাসাতেই যাবো।"

তারপর একটু থেমে আবার বললো,

---"আপনি আমাকে একটু আগে তুমি বলে সম্মোধন করছিলেন। এখন আবার আপনি বলছেন কেন?"


আদ্র কপালে দৃঢ় ভাঁজ ফেলে তাকালো। মনে করার ভান করে বললো,

---"বলেছিলাম কি? মনে পরছে না তো!"

বেলা কথা বাড়ালো না। তার অস্বস্থি হচ্ছে। আদ্রের লম্বা হাতের সঙ্গে তার ছোট্ট কাঁধটা ক্ষীণ বারি খাচ্ছে বারবার। বাতাসের ঝাপটায় শিরশির করে উঠছে অনাবৃত হাত আর মুখশ্রী। আদ্রের তীক্ষ্ণ চোখ তা এড়াতে পারলো না। অনেকটা আদেশী স্বরে সে বললো,

---"জানালাটা বন্ধ করে দিন বেলা।"


বেলা অবাধ্য হতে পারলো না। হাত বাড়িয়ে জানালা শক্ত করে ধরলো। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগে জানালা আটকানোর চেষ্টা করতেই অসফল হলো সে। বার দু'য়েক চেষ্টার পরও জানালা আটকাতে পারল না। শেষে করুণ চোখে আদ্রের দিকে তাকালো। আদ্র কপাল কুঁচকে তাকেই দেখছিল। বেলা আমতা আমতা কণ্ঠে বললো,

---"জানালাটা আটকে গেছে। আমি লাগাতে পারছি না।"

তবুও আদ্রের দৃষ্টি পরিবর্তন হলো না। হঠাৎ বেলার অতি নিকটে ঝুঁকে এলো সে। বেলা ভড়কে গেল। তৎক্ষণাৎ তটস্থ হয়ে চোখ খিঁচে নেত্রপল্লব বুজলো। নাসিকারন্ধ্রে আঘাত হানলো এক কড়া পুরুষালী পারফিউমের ঘ্রাণ। বেলার অস্থিরতা বাড়ার আগেই সরে এলো আদ্র। পরমুহুর্তে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

---"কি হয়েছে? এভাবে চোখ বন্ধ করে আছেন কেন?"


শুনে তাড়াতাড়ি চোখ মেলে তাকালো বেলা। আদ্র জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। আগের থেকে কম ঠান্ডা লাগছে এখন। তবে কম্পয়মান দেহটা আগে শীতের কারনে কাঁপলেও এখন আদ্রের কারনে মৃদু মৃদু কাঁপছে। ঢোক গিলে নিজেকে দ্রুত স্বাভাবিক করার প্রয়াস করলো বেলা। বললো,

---"কিছু হয়নি।"


আদ্রের সন্দেহ কমেনি। চেহারার গাঢ় ভাবটাই তা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে। বেলা অপ্রস্তুত ভাবে আবার বললো,

---"এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?"

আদ্র দৃষ্টি সরালো। অল্প হাসলো যেন। অদৃশ্য সেই হাসি বেলা চেয়ে থেকেও দেখল না। ফোনের স্ক্রীনে লাগাতার চাপ দিতে দিতে আদ্র বললো,

---"টাক মাথার, ভুড়ি ওয়ালা লোকটা আপনার বাবা না?"


হঠাৎ এহেন প্রশ্নে চোখ বড় বড় করে তাকালো বেলা। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

---"জি?"

---"আমি কাল আপনার বাবাকে দেখেছিলাম। রোদে নিজের টাক মাথা আরও উজ্জ্বল করছিলেন।"


বেলা মুহুর্তেই রেগে গেল। এই লোক কি বলছে এসব? তার সামনে তার বাবাকেই কেমন অপমান করছে! কঠিন গলায় সে ঘোর দিরুক্তি করলো,

---"আমার বাবার মোটেও টাক মাথা না।"


প্রতিউত্তরে আদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো মাত্র। জবাব দিলো না। পরের স্টপেই বাস থেমে গেল। বেলা অনেকটা তড়িঘড়ি করে হ্যান্ডব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে পরলো। অতি ক্ষুদ্র কণ্ঠে আদ্রকে বললো, "সরুন।"

আদ্র নিজেও দাঁড়িয়ে গেল। বেলা বাস থেকে নামতেই সেও পিছু পিছু নামলো। বেলা পাশে তাকালো একবার। আদ্র তার সাথে সাথেই হাঁটছে। ঠোঁট কামড়ে সে প্রশ্ন করলো,

---"আপনি কি আমার সাথে যাচ্ছেন?"


আদ্র কিছু বলবে তার আগেই তার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রীনের দিকে একবার তাকিয়ে ফোন কানে রাখলো সে। গম্ভীর গলায় বললো,

---"আসছি আমি। এতবার ফোন করার কি আছে?"

ওপাশ থেকে কিছু বলতেই আদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, "আসছি।"

তারপর বেলার দিকে তাকালো শান্ত চাহনিতে। বেলার কথার উত্তর না দিয়ে বললো,

---"দাঁড়াও এখানে। আমি রিকশা ডেকে দিচ্ছি।"

বেলা মাথা নাড়ালো,

---"না, না। তার দরকার নেই। আর একটুই তো। আমি হেঁটে যেতে পারবো।"


আদ্র অসীম অসন্তুষ্টি নিয়ে তাকালো। গাম্ভীর্যে ভরপুর গলায় শীতলতা নিয়ে শুধু এটুকু বললো, "বেশি কথা পছন্দ না।"


দু'তিনবার ডাক দিতেই রিকশা এসে থামলো বেলার সামনে। সে বিনা উচ্চবাক্যে উঠে বসলো রিকশায়। আদ্র পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ বের করলো। রিকশা চালককে ভাড়া দিতে চাইলে বাঁধা দিতে নিলো বেলা। কিন্তু আদ্রের কড়া চাহনির নিষেধাজ্ঞায় আবার চুপ হয়ে গেল সে। ভাড়া মিটিয়ে রিকশা চালকের দিকে এবার ঘুরে দাঁড়ালো আদ্র। বললো,

---"চাচা, উনাকে সাবধানে পৌঁছে দেবেন। কিছুক্ষণের জন্য উনার দায়িত্ব আপনাকে দিচ্ছি কিন্তু!"


মধ্যবয়স্ক রিকশা চালক তার পান খাওয়া ফোকলা দাঁতগুলো বের করে মুখ ভরে হাসলো। মাথা দুলিয়ে সায় দিতে লাগলো অনবরত।


__________


বাসায় ঢোকার আগ-মুহুর্তে আয়াজের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বেলার। তাকে দেখেই আয়াজ প্রসন্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

---"কেমন আছো বেলা? কালকে যে আমাকে আর ভাইকে ভয় পেয়ে বাসা থেকে বের হলে! তারপর তো আর দেখাই দিলে না।"


বেলা মনে মনে বিরক্ত খুব। এ দু'ভাই পেয়েছে কি তাকে? কালকের ঘটনার জন্য জায়গা নেই, স্থান নেই, যেখানে ইচ্ছে সেখানে অপমান করে যাচ্ছে। বেলা মুখটা একটুখানি করে জবাব দিলো,

---"ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?"

---"খুব ভালো আছি। ইনফেক্ট একটু বেশিই ভালো আছি আজকে। তুমি বলো, এই বৃষ্টির মাঝে কোথা থেকে আসলে?"

---"ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম একটা কাজে।"


বলতে বলতে তার খেয়ালে এলো, আয়াজকে আজকে একটু বেশিই পরিপাটি লাগছে। চেহেরায়ও দারুণ খুশি খুশি ভাব! সেদিকে কয়েক পলক তাকিয়ে বেলা প্রশ্ন করলো,

---"আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন আয়াজ ভাইয়া?"

আয়াজ যেন একটু লাজুক হাসলো,

---"হ্যাঁ।"

বেলা জিজ্ঞেস করলো,

---"আচ্ছা, আপনার আর আদ্র ভাইয়ার মাঝে কে বড়? আপনি?"

---"না। আদ্র ভাই বড়। তিন মিনিটের।"


বলে আরও একটু হাসলো আয়াজ। বেলা হাসফাস করতে লাগলো। আয়াজের সঙ্গে এখন দেখা হওয়ার পর থেকেই একটা প্রশ্ন খুব করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে তার। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভীষণ ইতস্তত করে বেলা বললো,

---"ভাইয়া, আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।"

---"বলো।"

---"আসলে, আমি আদ্র ভাইয়াকে কাল মারপিট করতে দেখেছিলাম। তাই-- মানে, উনি কি সবসময় এভাবে মারপিট করেন?"


আয়াজের মুখাবয়ব মুহুর্তেই অল্প গম্ভীর দেখালো। গম্ভীর কণ্ঠে সে বললো,

---"আমরা দু'জনেই পড়ালেখায় খুব ভালো বেলা। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেও কেউ-ই ওই পেশায় যাই নি। এই যেমন, পড়ালেখা শেষ করে আমি এখন বাবার ব্যবসা সামলাচ্ছি। আর ভাই রাজনীতি। আর রাজনীতিতে একটু আধটু মারপিট তো হয়ই। এটা স্বাভাবিক।"


বেলা বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল যেন। আদ্র রাজনীতি করে? কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না তার। তার বিস্ময়কে আরেক দফা বাড়িয়ে আয়াজ হাসি-মুখে বললো,

---"তাহলে আবার পরে দেখা হবে তোমার সাথে। আমার গার্লফ্রেন্ড আসলে অপেক্ষা করছে তো! পরে দেড়ি হলে রাগ করবে।"

বেলা পিটপিট করে তাকালো। অবাক স্বরে বললো,

---"আপনার গার্লফ্রেন্ডও আছে?"


জবাবে বিস্তর হাসলো আয়াজ। কিছু বললো না। সে চলে যেতেই বেলাও পা বাড়ালো নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে।


__________


গতকালের বৃষ্টির দরুণ রাত থেকে ভীষণ জ্বর বেলার। ১০২ ডিগ্রি। রবিবার জ্বর হওয়ার পর সোমবার এবং মঙ্গলবার রুম থেকে আর বের হয় নি বেলা। আজ জ্বরটা একটু সেরেছে। তবুও শরীরটা ক্ষীণ দূর্বল। আজ পরিবেশটাও মনোমুগ্ধকর। ছাদে দাঁড়িয়ে দক্ষিণা বাতাসের ছোঁয়া উপভোগ করতেও দারুণ লাগছে। হঠাৎ পাশের ছাদে নজর যেতেই আদ্রকে দেখতে পেল বেলা। তাদের বাড়ি থেকে আদ্রদের বাড়ির দূরত্ব খুবই কম। এক ছাদ থেকে অন্য ছাদ সহজেই ডিঙিয়ে আসা যাওয়া করা যায়।

আদ্রকে দেখে মনে হচ্ছে, সে জোড় করেই ঘুম থেকে জেগে এসেছে। পা দু'টো অল্প নড়বড়ে। ঝাঁকড়া মাথার চুলগুলো এলোমেলো, চেহারায় ঘুমু ঘুমু ভাব থাকায় কি আদুরে দেখাচ্ছে! চোখ দুটোর সাদা অংশ লাল শিরায় ভরে গেছে। বেলা আদ্রকে দেখে আর ছাদে দাঁড়াতে চাইলো না। পাছে সে যদি তাকে আবারও অপমান করে?


যাওয়ার জন্য দু'কদম সামনে এগোতেই পেছন থেকে আদ্রের উচ্চকণ্ঠের ধমক শোনা গেল, "এই মেয়ে, দাঁড়ান।"

বেলা থমকে গেল। পেছন ফিরে আদ্রের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আদ্র তাকে আপাদমস্তক দেখে আবারও বললো,

---"এদিকে আসুন।"

না চাইতেও কয়েক পা এগোলো বেলা। আদ্র কড়া চোখে তাকালো, "আপনাকে এদিকে আসতে বলেছি বেলা। রেলিংয়ের কাছে আসুন।"


বেলা মুখ ফুলিয়ে রেলিংয়ের কাছেই দাঁড়ালো। আদ্র হুট করে কোনো কথা ছাড়া তার হাতের উলটো পিঠ ছুঁয়ে দিলো বেলার কপালে। পরক্ষণেই আবার ধমকে উঠলো,

---"জ্বর তো কমেনি। ঠান্ডার মধ্যে এখানে কি করছেন?"

বেলা ভাঙ্গা গলায় বললো, "ঠিক আছি আমি।"

আদ্র বেলার চোখের দিকে চাইলো। কুঁচকানো ভ্রুযুগল আরেকটু কুঁচকে গম্ভীর স্বরে বললো,

---"আপনি মিথ্যে বলছেন বেলা। আপনার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। আর বেলা কখনো ফ্যাকাশে হয় না। তাদের সতেজ-ই মানায়।"


বেলা ভারী নেত্রপল্লবে পিটপিট করে তাকালো। আদ্রর থুতনির দিকে দৃষ্টি আটকে গেল তার। থুতনিতে সদ্য ছোট্ট কাটা দাগ। দাগটা কেমন উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে আদ্রর গৌরবর্ণের মুখশ্রীতে। সৌন্দর্যের ঘাটতি এতটুকুও হয় নি। বরং আরও বেড়ে গেছে যেন। থুতনিতে চেয়ে থেকেই বেলা প্রশ্ন করলো,

---"আপনি কি রাজনীতিবিদ?"

---"হ্যাঁ, কেন?"


বেলা কিছু না বলে চোখ নামিয়ে নেয়। ছোট বেলা থেকেই শুনে এসেছে রাজনীতিবিদরা খারাপ হয়। আদ্রও কি তাদের মতো খারাপ? হতেও পারে। রাজনীতিবিদদের বাহিরে কিছু আর ভেতরে অন্য কিছু। তাদের সহজে বিশ্বাস করতে নেই।

আদ্রর হাত এখনো বেলার কপাল ছুঁয়ে আছে। হাতটা আস্তে আস্তে কপাল থেকে গালে এনে রাখলো সে। বেলার চোখের ঠিক নিচে একটা পাঁপড়ি পড়ে আছে। বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্যে সেই নিকষকৃষ্ণ পাঁপড়িটি ফেলে দিলো আদ্র। তার চোখের চাহনি গভীর হলো। হলো মাদকতাপূর্ণ। কোমলস্বরে সে  বললো,

---"আমি রাজনীতিবিদ হলেও খারাপ নই বেলা।"


___________________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ২

 প্রিয় বেলা

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা 


২.

চোখে ঠান্ডা পানির স্পর্শ অনুভব করতেই চোখ মেলে তাকালো বেলা। তবে আশপাশটা কেমন ঝাপসা দেখছে সে। আঁখিজোড়া বড্ড জ্বালা করছে। মাথার সূক্ষ্ণ যন্ত্রণায় উঠে বসার জো নেই। ধীরেধীরে চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হলো। চারিদিকের অচেনা, অপরিচিত দেওয়াল, সিলিং আর মানুষগুলোকে দেখে বেলা প্রথমেই বুঝলো না সে কোথায় আছে। পরে যখন নিজের মাথার কাছে রেখাকে বসে থাকতে দেখল, তখনই যেন আস্তে আস্তে সব মনে পরতে লাগলো তার। জ্ঞান হারানোর মতো বিশ্রী কাণ্ড ঘটিয়ে ভীষণ লজ্জা নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল বেলা। রেখা উদগ্রীব হয়ে তার মাথায় হাত বুলালেন। মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

---"এখন কেমন লাগছে বেলা? তুমি ঠিক আছো?"


বেলা ক্ষীণ মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। আড়চোখে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলো আশপাশটা। অনুষ্ঠানের সবাই কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন সবার কেন্দ্রবিন্দু একমাত্র বেলাই। বেলার লজ্জা বাড়লো। গলার সঙ্গে থুতনি ঠেকিয়ে দৃষ্টি পুরোপুরি ঝুঁকিয়ে বসে রইলো সে। রেখা আবার বললেন,

---"ক্ষুধা লেগেছে বেলা? কিছু খাবে?"

বেলা অতি মৃদুস্বরে জবাব দিলো,

---"খেতে ইচ্ছে করছে না আন্টি---। আমি এখানে কতক্ষণ ধরে আছি?"


এ কথায় আয়াজ হাসতে হাসতে উত্তর দিলো,

---"বেশিক্ষণ হয় নি। আধঘণ্টা। তুমি যে আমাদের দুই ভাইকে দেখে এভাবে ভয় পেয়ে জ্ঞান হারাবে, আমরা তো কল্পনাও করিনি। আর কিছুক্ষণ জ্ঞানহীন থাকলেই তো তোমার মাকে ডাকতে যেতে হতো আমার।"


বেলা আরেকদফা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। আয়াজের কথার প্রতিউত্তরে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলো না। তবে চোরা দৃষ্টিতে আদ্রের দিকে তাকালো একবার। আয়াজ আর আদ্র দুজন পাশাপাশিই বসে আছে। তাদের মধ্যিখানে নিশ্চিন্তে বসে বসে আপেল খাচ্ছে বিহান।

বেলা দৃষ্টি সরাতে গিয়েও সরালো না। ক্ষীণ পর্যবেক্ষণ করলো ওদের দুই ভাইকে। আয়াজ থেকে আদ্র একটু স্বাস্থ্যবান। হাতগুলো পেশিবহুল। আয়াজের মতো অত বেশি চিকন না। ওদের গায়ের রঙেও ক্ষীণ ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। দুজনেই ফর্সা হলেও আদ্র উজ্জ্বল গৌর বর্ণের অধিকারী। বেলা এবার সরাসরি আদ্রর মুখপানে তাকানো চেষ্টা করলো। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাকালো আদ্রও। বেলা হকচকালো, অপ্রস্তুত হলো। দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো আবার। গাল দু'টো গরম হয়ে যাচ্ছে তার। ভারী ভারী লাগছে। সেই রক্তিম গালদু'টোর দিকেই একমনে চেয়ে রইলো আদ্র। মেয়েটার চেহারা ভীষণ মায়াবী। পানির ছটায় পাঁপড়িগুচ্ছ ভিঁজে একে অপরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। সুন্দর দেখাচ্ছে। আদ্রর চোখ সরাতে ইচ্ছে করছে না। মনের খুব গোপনে সে আনমনেই আওড়ালো,

---"শুনো মেয়ে, তোমার চোখ দু'টো অদ্ভুদ সুন্দর। আমার চেয়ে চেয়ে দেখতে ক্লান্তি আসছে না।"


_____


পরেরদিন থেকে ভীষণ বৃষ্টি। কিছুক্ষণ পরপরই সুদূর হতে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম ডাক শোনা যাচ্ছে। স্বচ্ছ পানিতে রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গ্রাম বাংলায় এ দিনে কাঁচা মাটির ঘ্রাণে চারদিক মৌ মৌ করে। আকাশে কাক, পক্ষীর সাক্ষাত একেবারেই নেই। বেলা বিরক্ত ভঙ্গিতে ছাতাটা শক্ত করে ধরলো। সকালে বৃষ্টি কম থাকায় ভার্সিটির কাজে বের হয়েছিল সে। এখন মারাত্ত্বক বিপদে পরে গেছে। প্রবল বর্ষণের তেজে রাস্তা পুরো ফাঁকা। রিকশা, সিএনজি যাত্রীতে ভরপুর। মাঝে মাঝে বাস-স্টেশনের ছাউনিতে কিছু মানুষকে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে। তাদের সঙ্গ দিতেই বেলাও দ্রুত পদে ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। 


পরনের কামিজের নিচের অংশ ভিঁজে গেছে তার। ছাতা বন্ধ করে সেটা একটু ঝেরে নিলো বেলা। হঠাৎ চেনা এক ভরাট কণ্ঠ কানে এলো,

---"হ্যাঁ, আমি আসছি একটু পর। ওকে বেঁধে রাখ। একটু উত্তম-মধ্যম না খেলে ও সোজা হবে না।"


এটুকু শুনেই চটজলদি পাশ ফিরে তাকালো বেলা। নিজের পাশে আদ্রকে দেখে চমকে উঠলো খুব। কিন্তু বুঝতে পারছে না, এটা কি আদ্রই? নাকি আয়াজ? দ্বিধান্বিত চাহনিতে কিছুপলক সেদিকে চেয়ে রইলো সে। আনমনেই মুখ ফঁসকে প্রশ্ন করলো,

---"আপনি আয়াজ ভাইয়া নাকি আদ্র?"


আদ্র তখনো খেয়াল করেনি বেলাকে। প্রশ্ন শুনে বেলার দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে এলো তার। ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে 'আসছি' বলে কান থেকে ফোন নামালো। গম্ভীর স্বরে বললো,

---"আদ্র।"

---"ওহ্! আমি বেলা। আপনার সঙ্গে কাল দেখা হয়েছিল আমার। চিনতে পেরেছেন?"


পকেটে ফোন ভরে আদ্র ঠাট্টার সুরে বললো,

---"চিনেছি। আমাকে দেখে যে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল, আপনি সেই বেলা না?"

প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না বেলা। লজ্জাবোধে তৎক্ষনাৎ মাথা নুয়ালো। পরিচিত বিধায় এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাটা সমীচীন বলে মনে হয় নি তার। তাই কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে এই লোক কি-না তাকেই অপমান করে দিলো! মনে মনে খুব রাগ হলো বেলার। আদ্রকে অসভ্য উপাধিতে ভূষিত করতে দু'বার ভাবলো না সে।


পরিবেশ তখন অল্প কোলাহল আর অল্প নিস্তব্ধতায় সম্মিলিত। তখনের অপমানের পর বেলা আর একটা কথাও বলেনি। চুপ করে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছে। আদ্র পকেট থেকে ফোন বের করে তা আবার চাপতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছে বেলাকে। সরব খেয়ালে এলো, বেলা হাঁচি দিচ্ছে বারবার। একটু কেঁশে আদ্র প্রশ্ন করলো,

---"বৃষ্টি যখন সহ্য হয় না, তখন বাহিরে বের হয়েছেন কেন?"


বেলা উত্তর দেবে না, দেবে না করেও শেষে ছোট্ট করে উত্তর দিলো,"কাজ ছিল একটু।"

বলতে বলতে আবারও হাঁচি দিলো সে। হুট করে হাসি পেয়ে গেল আদ্রর। ঠোঁট বাঁকিয়ে অল্প হাসলোও সে। তবে তা বেলার অজান্তে। বেলাকে বললো,

---"সেদিন তুমি বারান্দায় কি করছিলে?"


আদ্রের হঠাৎ তুমি বলা খেয়ালে আসেনি বেলার। সে অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করলো,

---"কোন দিন?"

---"পরশু।"

বেলার চোখে একরাশ বিস্ময় এসে হাজিরা দিলো এবার। পিটপিট করে তাকিয়ে সে আবারও জিজ্ঞেস করলো,

---"তার মানে, সেটা আপনি ছিলেন?"

---"অবশ্যই। আমি ছাড়া আর কে হবে?"


আদ্র এমন ভাবে বললো, বেলা না হেসে পারলো না। খিলখিল শব্দে বিস্তর হাসলো। আদ্র চেয়ে, চেয়ে দেখলো সে হাসি। নির্নিমেষভাবে, নিভৃতে। তার কেমন গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো। মুগ্ধ হলো নেত্র। শান্ত কণ্ঠে আদ্র বললো,

---"বেলা, শুনছো? চোখের পাশাপাশি তোমার হাসিটাও ভীষণ সুন্দর।"


___________________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ১

 ---"বুবু জানিস কি হয়েছে? পাশের বাসার ভাইয়াটা এলাকার ছেলেপেলেদের নিয়ে একটা ছেলেকে খুব মারছে। আধমরা করে ফেলেছে একদম।"

কথাটা শুনে আঁতকে উঠলো বেলা। এক ছুটে বারান্দার কাছে যেতেই আয়াজ নামক ছেলেটিকে পাশের এলাকার একটা ছেলেকে খুব বাজে ভাবে মারতে দেখলো। সঙ্গে ১৮, ২০ বছরের কিছু ছেলেও দাঁড়িয়ে আছে। আয়াজকে ভাই ডাকে সম্মোধন করছে বারংবার। বেলা অবাক হয়ে বিষয়টা দেখলো। তারা এ এলাকায় নতুন। বাবার ঢাকা থেকে ট্রান্সফার হওয়ায় কুমিল্লায় নিজস্ব বাড়িতে এসেছে কিছুদিন হলো। আয়াজ তাদের পাশের বাড়িতেই থাকে। বেলা কয়েকদিন আগে গিয়েছিল সেখানে। আয়াজের সাথেও ক্ষীণ সময়ের জন্য দেখা হয়েছিল তার। তখন এ ছেলেটির আচরণ কতইনা ভদ্র-সভ্য ছিল। অথচ এখন! কিভাবে রাস্তায় মারপিট করে গুন্ডামি করছে! বিশ্বাসই হচ্ছে না, এই ভদ্র, শান্ত ব্যক্তিটি ভেতরে ভেতরে কি দারুণ উগ্র মেজাজি। 

বিহানের কথায় সম্বিৎ ফিরলো বেলার, "আয়াজ ভাইয়াকে কত ভদ্র ভেবেছিলাম, তাই না বুবু? কিন্তু উনি যে এমন, আমি কল্পনাও করিনি।"


বেলা একবার বিহানের দিকে তাকালো। তারপর আবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে আয়াজের মুখপানে স্থির চাহনি নিক্ষেপ করলো। আয়াজ তখন ঘাড় এদিক ওদিক নাড়িয়ে নিজেকে শান্ত করছিল। রাস্তায় জ্ঞানহারা ছেলেটার উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলে পাশের ছেলেটির দিকে হাত বাড়ালো সে। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আয়াজের হাতে তা ধরিয়ে দিলো ছেলেটি। সিগারেট জ্বালিয়ে আয়াজ আশেপাশে তাকাতে লাগলো। সুদূরে দাঁড়ানোরত বেলা দৃষ্টিগোচর হতেই ভ্রু কুঁচকালো সে। তীক্ষ্ণ, ভয়ংকর লাল চোখ জোড়ার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ভড়লে গেল বেলা। হকচকালো, থমকালো। ভীতু কণ্ঠে বিহানকে তাড়া দিয়ে বললো,

---"ভেতরে চল বিহান। এখানে থাকা নিরাপদ হবে না।"


অতঃপর বেলা বিহানকে নিয়ে ব্যস্ত পায়ে চলে গেল রুমের ভেতর। অথচ আয়াজ তার দৃষ্টি সরালো না। তার ঈগল চোখের সূক্ষ্মতা ওই খালি বারান্দাটাতেই এঁটে রইলো।


_____


বেলার মা প্রভা বেগম বেশ শান্তশিষ্ট মহিলা। কারো সঙ্গে ঝামেলা বিশেষ পছন্দ না উনার। প্রয়োজন হলে তিনি নিজে অপর জনের দোষ মাথা পেতে নিবেন, কিন্তু সে বিষয় নিয়ে বাড়তি দু'কথা বাড়ানো তার স্বভাবে নেই। আবার প্রচন্ড মিশুকও তিনি। কুমিল্লা আসার কয়েকদিনের মাথায়ই পাশের বাড়ির সদস্যদের সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে উনার। আয়াজের মা রেখাও বড্ড মিশুক স্বভাবের। বিহান আর বেলাকে নিজের মেয়েছেলের মতোই আপ্যায়ন করেন তিনি।


দুপুরের খাবার শেষে প্রভা বেগম টেবিল গোছাচ্ছিলেন। বেলা আর বিহান তার ঠিক উল্টো দিকেই সোফায় বসে টেলিভিশন দেখছে। কাজ করতে করতে প্রভা বেগম ডাকলেন,

---"বেলা, শুন। একটা কথা আছে।"

বেলা টিভির পর্দায় চোখ রেখেই উত্তর দিলো,

---"বলো মা।"

---"ওই যে পাশের বাড়ির ভাবী আছে না? পরশু যার বাসায় গেলি?"

---"হ্যাঁ, কি হয়েছে সেখানে?"


মেয়ের জিজ্ঞাসাবাদে প্রবল আগ্রহী হয়ে উঠলেন প্রভা বেগম। কাজ ছেড়ে বেলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। বললেন,

---"উনার মেয়েকে নাকি ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে আজ বিকালে। তোকে যেতে বললো। বিহানকে নিয়ে যাবি?"

বেলার বিরক্ত কণ্ঠ,

---"ওখানে যেয়ে আমি কি করব?"

---"কি করবি মানে? ভাবী কত অনুরোধ করলো। তোকে উনি মেয়ের মতোই দেখে। আমি উনার অনুরোধ কিভাবে ফেলি?"


টিভি দেখে চোখ সরালো বেলা। কণ্ঠে বিরক্তির রেশ আরও বাড়িয়ে বললো,

---"উনার মেয়েকে দেখতে আসছে মা। উনার মেয়ে থাকলেই তো হলো। আমার দরকার কি সেখানে? তাছাড়া যদি উনার মেয়ের জায়গায় ছেলে আমাকে পছন্দ করে ফেলে, তখন কি করবে?"


প্রভা বেগম খুশি হয়ে বললেন,

---"তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ। এ ফাঁকে তোর বিয়েটাও হয়ে যাবে।"

বেলার বিরক্তি আরও এক কদম চড়ে গেল। মাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বললো,

---"তুমি তোমার আজগুবি কথা বন্ধ করবে? পাত্রপক্ষ যাওয়ার পর আমি যাবো, যাও।"


প্রভা বেগম তবুও দিরুক্তি করলেন। কিন্তু বেলা শুনলো না। ঠিকই বিকালের পর অর্থাৎ সন্ধ্যা হওয়ার একটু আগে গেল ও বাড়ি। বাড়িটিকে অল্পস্বল্প বিয়ে বাড়িই মনে হচ্ছিল। বেলা দুরুদুরু বুকে বিহানকে নিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করলো। এখানে আসার তার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে ছিল না। বিশেষ করে ওই আয়াজ নামক ছেলেটির জন্য। মনে মনে প্রার্থনা করলো, আয়াজের সাথে যেন তার দেখা না হয়।


রেখা বেলাকে দেখে এগিয়ে এলেন। বিহানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

---"তোমরা এখন এলে যে? বিকালে এলে না কেন? আমি তো ভাবলাম আর আসবেই না।"

বেলা মিথ্যে বললো,

---"আসলে একটু কাজ ছিল তো আন্টি।"

রেখা অতটা গুরুত্ব দিলেন না সেকথায়। বেলাকে সোফায় বসিয়ে উৎফুল্ল মনে বললেন,

---"আমার আরুকে ছেলেপক্ষ পছন্দ করেছে বুঝলে? কয়েকদিন পর আকদ ওর। এরপর আরুর পরীক্ষা শেষে অনুষ্ঠান করে উঠিয়ে নিবেন। তুমি তো ছেলেকে দেখো নি, তাই না? দাঁড়াও আমি ছবি দেখাচ্ছি।"


বলে তিনি ফোন থেকে ছবি বের করতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। বেলা মৃদু হাসার চেষ্টা করলো। মনে মনে ভাবলো, রেখা আন্টি অনেকটা তার মায়ের মতোই। অত্যাধিক মিশুক। বেলা এবার আরুর দিকে তাকালো। রেখার ছোট মেয়ে। চাচাতো, মামাতো ভাই-বোনেরা ঘিরে ধরেছে তাকে। আরুও বেশ হেসে হেসে কথা বলছে তাদের সঙ্গে। আরু হতে নজর ফিরিয়ে বেলা বিহানকে খুঁজতে লাগলো। এখানে আসার পরপরই ছেলেটা তার বয়সী ছোট্ট সৈন্যদের পেয়ে কোথায় যে চলে গেছে! বেলা দেখতেও পায় নি। বাম দিকের জায়গাটাতে একটু খোঁজাখুঁজির অভিযান চালাতেই হঠাৎ আয়াজকে দেখতে পেল বেলা। হৃদযন্ত্র যেন সেখানেই ক্ষণিকের জন্য থমকালো। আঁখিজোড়া বিরক্ত হলো ভীষণ। আয়াজ এদিকেই আসছে। বেলার কাছাকাছি আসতেই মুচকি হেসে বেলাকে জিজ্ঞেস করলো,

---"কেমন আছো বেলা? তোমার পিচ্চি ভাইটা কোথায়?"


বেলা আয়াজের এত সুন্দর ব্যবহার দেখে আবারও অবাক হলো। এ ছেলে আসলে কি? বাড়ির সামনে মারপিট করে এখন আবার সাধুসন্ন্যাসী সেজে ঘোরাফেরা করছে। রাগ হলেও বেলা আয়াজের মতো হেসেই অকপটে বললো,

---"ভালো আছি ভাইয়া। বিহান বোধহয় ওদিকটায় খেলছে।"


জবান শুনে হালকা মাথা দোলালো আয়াজ। ফের রেখাকে বললো,

---"ভাইকে দেখেছ মা? বাগানে তো দেখছি না।"

রেখা ফোন ঘাটতে ঘাটতে জবাব দিলেন,

---"এই তোর কাছে আরুর হবু বরের ছবি আছে না? ওকে একটু দেখা তো। আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আর আদ্র তো দোকানে গেছে মনে হয়।"


বলে একটু থামলেন তিনি। সামনের দিকে তাকাতেই আবার বলে উঠলেন,

---"ওই তো, আদ্র এসে গেছে।"


রেখার ইশারাকৃত জায়গায় আয়াজের পাশাপাশি বেলাও তাকালো। এবার যেন আগের চেয়েও বেশি চমকালো সে। বিস্ফোরিত নয়নে চেয়েই রইলো। হৃদযন্ত্রের আওয়াজ বাড়ছে, ধুকধুক শব্দের গতি নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গেছে। আয়াজের মতো দেখতে আরও একটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। মুখে বিরক্তিভাব। দৃষ্টি বেলার আতঙ্কিত মুখশ্রীর পানে।

বেলার শরীর ঘামছে। নিশ্বাস ভারী হচ্ছে। আটকে আসা কণ্ঠে বহুকষ্টে রেখাকে সে জিজ্ঞেস করলো,

---"আমি এসব কি দেখছি আন্টি? আয়াজ ভাইয়া তো আমার পাশে। উনি ওখানে গেলেন কিভাবে?"


রেখা একটু থতমত খেয়ে বললেন,

---"ওটা আয়াজ না বেলা। ও তো আমার আরেক ছেলে আদ্র।"


বেলার অস্থিরতা কমলো না। আস্তে আস্তে চোখ বুজে এলো।


________________


চলবে~


প্রিয় বেলা

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

সূচনা পর্ব