গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ৪

 প্রিয় বেলা


৪.

মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা পরে আছে। শীতল বাতাসের আগমন বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। কাকেরা কারেন্টের তারে বসে আবহাওয়ার এই পরিণতি দেখে অভিযোগ করে যাচ্ছে অবিরাম। আদ্রর ঠান্ডা হাত এখনো স্থীর হয়ে ছুঁয়ে আছে বেলার রক্তিম গাল। তার দৃষ্টি অস্বাভাবিক শান্ত। নরম গালদুটোয় আলতো চাপ দিয়ে বেলার মুখশ্রী নিজের মুখোমুখি আনলো সে। রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, "আমাকে আপনার খারাপ মনে হয় বেলা?"


বেলার হুট করেই ভীষণ শীত, শীত লাগছে। পরনের মোটা চাদরেও শরীরের কম্পন বন্ধ হচ্ছে না। তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট জোড়া। আদ্রর চোখ মুহুর্তেই বেহায়া হয়ে উঠলো। নিমগ্ন হয়ে সে চেয়েই রইলো সেই কাঁপা কাঁপা অধরের পানে। বেলা থেমে থেমে বললো,

---"আমার শীত লাগছে---। আমি ঘরে যাবো।"


আদ্রর ঘোর কাটল। মুচকি হেসে সরে দাঁড়ালো সে। প্রশ্ন করলো,

---"আপনার ফুল পছন্দ বেলা?"

---"হ্যাঁ, খুব।"

---"কোন ফুল পছন্দ?"

---"পদ্ম।"


বেলার কালো, ধূসর মিশেলের চুলগুলো অত বড় না। পিঠ অব্দি। তবে বেশ ঘন, মোটা আর লতানো। খোপা করে সেগুলো ঘোমটার আড়াল করে রেখেছে সে। পাতলা ওড়নার ভেতরে ক্ষীন দৃশ্যমান সেই খোপার দিকে চেয়ে আদ্র নিষ্প্রভ স্বরে বললো,

---"মাথা থেকে ওড়না সরিয়ে চুলগুলো ছেড়ে দিন তো বেলা।"

বেলা যেন বুঝলো না। জিজ্ঞেস করলো, "জি?"

আদ্র ভ্রু কুঁচকালো। এগিয়ে এসে নিজেই সরিয়ে দিলো ঘোমটা। একটানে ক্লিপ খুলে ফেলতেই অনাবৃত হলো চুলগুলো। শোভা পেল পিঠজুড়ে। আদ্র অভিযোগের সুরে বললো,

---"আপনি বেশি কথা বলেন বেলা। কথা শুনেন না।"


এহেন আচরণে বেলা ভীষণ ভাবে ভড়কালো। বিমূঢ় হয়ে পিটপিট করলো তার নেত্রপল্লব। সিঁড়ি ঘরের ওপাশে যেতে যেতে আদ্র আদেশী কণ্ঠে সাবধান করে উঠলো, "জায়গা থেকে এক পাও নড়বেন না বেলা। আমি এক্ষুণি আসছি। আর খবরদার, চুল বাঁধবেন না।"


বেলা তৎক্ষণাৎ বলতে চাইলো,

---"কিন্তু আমার ক্লিপটা তো দিয়ে যান!"

কিন্তু ততক্ষণে আদ্র চলে গেছে ওপাশে। ক্ষুদ্র কণ্ঠে বলা বেলার কথাটি কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি তার। যাওয়ার প্রায় দু'মিনিটের মাথায় আদ্র আবারও এলো বেলার সম্মুখে। হাতে টকটকে লাল রঙের দু'টো পদ্ম। পদ্মগুলোর দিকে প্রফুল্ল চোখে চেয়ে বেলা জিজ্ঞেস করলো,

---"পদ্মগুলো কোথায় পেলেন আপনি? কি সুন্দর এগুলো!"


বেলার আনন্দ দেখে দূর্বোধ্য হাসলো আদ্র। সরব বেলার চুল গলিয়ে ঘাড়ের কাছে হাত নিয়ে গেল সে। দূরত্ব কমিয়ে নিজের খুব কাছে নিয়ে এলো। বেলার হাসি উবে গেছে। বিমূঢ়তায় আঁখিদুটি বিশাল আকার ধারণ করেছে। হৃদযন্ত্রের ধকধক শব্দ আদ্রও শুনতে পাচ্ছে বোধহয়। বেলা ভীতু স্বরে বললো,

---"কি করছেন আপ---?"


বাক্যটি শেষ হওয়ার পূর্বেই হাতের একটি পদ্ম বেলার কানে অতি যত্নে গুঁজে দিলো আদ্র। পরক্ষণেই সরে এলো সে। অন্য পদ্মটি বেলার হাতে ধরিয়ে হাসতে হাসতে বললো,

---"ভয় পেলে আপনাকে দারুণ লাগে বেলা।"


বেলা হতবাক, চমকিত। কিছুপলক আদ্রের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রুষ্ট কণ্ঠে বললো,

---"আপনি আধপাগল।"

---"একদম না। আমি পুরোপাগল।"


__________


বেলার ফুফা আইয়ুব এহতেশাম। বেলার বাবা সায়েদ থেকে চারগুণ ভালো অবস্থাপূর্ণ তিনি। তার ছেলে আমেরিকার কোন ব্যাংকে চাকরি করে। তাদের টাকার যেমন অভাব নেই, অহংকারেরও তেমনি ঘাটতি নেই। বিকালের প্রথম ভাগে হঠাৎই তার আগমন ঘটে সায়েদ সাবেহের বাড়িতে। এসেই তুমুল ঝগড়া শুরু করে দেন তিনি। চিল্লাচিল্লির আওয়াজ শুনে বেলা দৌঁড়ে ড্রইংরুমের কাছে আসে। আইয়ুব এহতেশাম তখন চেঁচিয়ে বলছিলেন,

---"আর অপেক্ষা করা সম্ভব না আমার পক্ষে। আমার টাকা কখন দিবি তুই? নেওয়ার সময় তো ঠিকই ড্যাংড্যাং করে নিয়েছিলি।"


সায়েদ সাহেব লজ্জায়, অপমানে মাথা হেট করে বসে আছেন। নম্র স্বরে তিনি অনুরোধ করলেন,

---"আর কয়টা দিন সময় দেয় আমায়। আমি জলদিই দিয়ে দিব।"

আইয়ুব এহতেশাম এবার দ্বিগুণ চেঁচিয়ে উঠলেন,

---"কিসের কয়টা দিন? বাড়ি বানাবি বলে টাকা নিয়েছিলি তিন লাখ। দেড় বছর হচ্ছে, এখনও টাকা দেওয়ার নাম নেই। তুই কি চাস আমি পুলিশ ডাকি? অথবা তোর এই সাধের বাড়ি নিজের নামে লিখে নেই?"


বেলা তার বাবার অসহায় মুখখানা দেখে আর চুপ থাকতে পারলো না। আইয়ুন এহতেশামের দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো,

---"বাবা বলেছে না টাকা দিয়ে দিবে? তবুও এত চেঁচাচ্ছেন কেন? ভুলে যাবেন না, আপনার দূঃসময়ে আমারই কিন্তু সাহায্য করেছিলাম আপনাকে। আর রইলো তুই-তুকারির কথা। আমার বাবা আপনার চেয়ে অনেক বড়। সম্মান দিয়ে কথা বলবেন।"


আইয়ুব এহতেশাম তেঁতে উঠলেন,

---"এত পাকনামি করবা না বেলা। টাকা দিতে পারো না আবার এত তেজ আসে কোথা থেকে তোমাদের? আমার ছেলে তোমারে পছন্দ করতো। একমাত্র হৃদের কথায় তোমাদের দয়া করে টাকা দিছিলাম আমি। ভাবছিলাম তোমার বাবা আমার ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দিবে। কিন্তু এ পল্টিবাজ তো নিজের মেয়ের মতামতের বিরুদ্ধেই যাবে না। মেয়েরে পড়ালেখা কইরা বেয়াদব বানাবে।"


বেলা উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,

---"আপনি যান এখান থেকে। আপনাকে যেন এ বাসায় দ্বিতীয় বার আর না দেখি। যখন সময় হবে আমরা টাকা দিয়ে দেব।"

আইয়ুব এহতেশাম আর বসলেন না। চলে যেতে যেতে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,

---"কাজটা ভালো করলা না বেলা।"


আইয়ুব এহতেশাম চলে যেতেই সায়েদ সাহেবের দিকে তাকালো সে। তিনি মলিন মুখে মাথা নিচু করে আছেন। তা দেখে সূদীর্ঘশ্বাস ফেললো বেলা।


__________ 


আকাশে আজ রোদ উঠেছে। রাস্তায় রিকশার আনাগোনাও বেশি। তবুও রিকশায় চড়তে ইচ্ছে করছে না বেলার। ফুটপাতে হাঁটার মজাই আলাদা। চারপাশ দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। একটু অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটার মাঝেই হঠাৎ ভরাট কণ্ঠের ডাক শুনতে পেল সে, "বেলা।"


বেলা দাঁড়িয়ে গেল। নিমিষেই ভরাট কণ্ঠের মালিককে চিনে ফেললো সে। ব্যক্তিটি তার অতি পরিচিত একজন। পেছনে ফিরে আদ্রকে দেখে তার ধারণা যেন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মিলে গেল। আদ্র দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে তার পাশাপাশি দাঁড়ালো। বেলার অনাদৃত হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে প্রশ্ন করলো,

---"কোথায় যাচ্ছেন?"

বেলা তার হাত ছাড়াতে চাইলে ছাড়লো না আদ্র। স্বাভাবিক স্বরে বললো,

---"থাকুক।"

তারপর আবার একই প্রশ্ন করতেই বেলা মৃদু স্বরে বললো,

---"টিউশনে।"

---"এভাবে হেঁটে হেঁটে?"

---"হ্যাঁ।"


আদ্র বেলাকে টেনে হাঁটতে হাঁটতে বললো,

---"তবে চলুন। আপনাকে পৌঁছে দেই।"

---"তার প্রয়োজন নেই। আমি যেতে পারবো।"

আদ্রের একরোখা উত্তর, "কিন্তু আমার প্রয়োজন আছে।"

---"আপনি শুধু শুধু কষ্ট করছেন।"


আদ্র দাঁড়িয়ে গেল। তার গভীর চোখ দুটো বেলার মুখপানে স্থির করলো। মাথার ঘোমটাটি টেনে চোখ, নাক ঢেকে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,

---"আমারটা আমি বুঝে নেব। আপনার বুঝতে হবে না।"


__________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

0 Comments:

Post a Comment