#আমার_রুদ্রাণী
#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা
#part: 30
🍂🍂🍂
ফুলে সজ্জিত খাটে বসে আছে মেহের। কিছু সময়ের ব্যবধানেই যেনো ঘরটাকে এক নতুন রূপে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। হৃৎপিণ্ড এর বেগ ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। রুদ্রর কথা ভাবতেই বারবার গলা শুকিয়ে আসছে তার, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। রুদ্র কি তার ওপর এখনো রেগে আছে? সে কি মেহেরের পালিয়ে যাওয়া নিয়ে মেহেরকে শাস্তি দিবে? মারবে না তো? এসব ভেবেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে মেহেরের। মেহেরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে রুদ্র কখনোই তাকে গভীর ভাবে ছুবে না তা জানে মেহের। কয়েকদিনের মধ্যেই এই বিশ্বাসটা নিজের অজান্তেই তৈরি হয়ে গেছে মেহেরের মনে। মেহেরের ভাবনার মাঝেই রুদ্র ঘরে প্রবেশ করে। রুদ্র স্থির দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে চেয়ে আছে আর মেহের দৃষ্টি নত করে বসে আছে। রুদ্র মেহেরের কাছে এসে বসতেই মেহের একটু নড়েচড়ে বসে। রুদ্র এখনও মৌনতা বজায় রেখে মেহেরের দিকে চেয়ে আছে। রুদ্র এই মুহুর্তে তাকে কষিয়ে এক চর মারবে তা ভেবে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় মেহের। রুদ্র মৌনতা ভেঙে শান্ত কণ্ঠে বলে,
ফ্রেশ হয়ে অজু করে এসো। নফল নামাজ পড়ে আল্লাহ এর কাছে শুকরিয়া আদায় করবো।
মেহেরকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতে দেখে রুদ্র পুনরায় যেতে বললে মেহের দ্রুত একটা আকাশী রঙের শাড়ি নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে ঘরে এলে দেখে রুদ্র মাথায় হাত চেপে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মেহেরের আসার আওয়াজ শুনে রুদ্র মাথা তুলে মেহেরের দিকে তাকায়। মিহি স্বরে বলে উঠে,
মাশাল্লাহ
রুদ্রর বলা কথা মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছায় না। রুদ্র আরো কিছুক্ষণ মেহেরের দিকে চেয়ে থাকে। এরপর উঠে দাড়িয়ে বলে,
আলমারিতে জায়নামাজ আছে। আমি অজু করে আসছি।
মেহের মাথা নেড়ে সায় জানাতেই রুদ্র নিজের জামা নিয়ে চলে যায়।
.
নামাজ পড়ে উঠে মেহের বুঝতে পারে না যে এই মুহূর্তে রুদ্র এর সাথে কথা বলা ঠিক হবে কি না। মেহের কিছু বলার আগেই রুদ্র বলে,
সার্ভেন্ট এসে খাবার দিয়ে গেছে। সারাদিনের ধকলে ঠিক মত গলা দিয়ে খাবার নেমেছে কিনা সন্দেহ। খেয়ে নাও যাও।
বলেই বিছানায় যেয়ে আধশোয়া হয়ে মাথা হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে রুদ্র। মেহের এক নজর খাবারের দিকে চেয়ে আবার রুদ্রর দিকে তাকায়। সাহস জোগিয়ে জিজ্ঞেস করে,
আপনি খেয়েছেন?
~ইচ্ছা নেই।
~কেনো?
রুদ্র জবাব দেয় না। মেহের জবাবের আশায় কিছুক্ষণ রুদ্রর দিকে চেয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এক প্লেট এ খাবার বেড়ে রুদ্রর সামনে যেয়ে দাড়ায়। ডাক দিবে কি দিবে না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে সে। মেহের এর দ্বিধাদ্বন্দ্ব শেষ হওয়ার আগেই রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকায় মেহেরের দিকে। মেহের অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে রুদ্রর দিকে চেয়ে থাকে।
কি সমস্যা? কিছু বলবে?
মেহের একবার মাথা নেড়ে না বুঝায় আবার দ্রুত হ্যাঁ বোঝায়। রুদ্র আগের মতোই শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
কি?
~সোজা হয়ে বসুন।
~কেনো?
~খাবার খাবেন তাই।
~ইচ্ছে নেই বললাম তো!
~আমি খাইয়ে দেই?
রুদ্র আবারো জবাব দেয় না। উঠে বসতেই মেহের বুঝে যায়। রুদ্র কে খাবার খাইয়ে দেওয়ার সময় রুদ্র এক ধ্যান এ মেহেরের দিকে চেয়ে ছিল। মেহের এর কিছুটা অস্বস্তি হলেও কিছুই বলেনি। রুদ্রকে খাওয়ানো শেষে নিজের জন্য খাবার বাড়লে রুদ্র দ্রুত পায়ে এসে হুট করেই মেহেরের হাত থেকে প্লেট টা কেড়ে নেয়। মেহের কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে পরমুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে বলে,
নিলেন কেনো?
~আমার ইচ্ছা।
সোফায় বসতে বসতে বলে রুদ্র। রুদ্রর সোজাসাপ্টা জবাবটা যেনো মেহেরের পছন্দ হলো না। মন খারাপ করে "ও আচ্ছা" বলে উঠে যেতে নিলেই রুদ্র হাত টেনে পুনরায় বসিয়ে দিয়ে বলে,
কই যাও? খাবার খাবে না?
~আপনি ই তো প্লেট নিয়ে নিলেন।
~হ্যাঁ তো?
~তো মানে! খাবার কি মাথায় নিয়ে খাবো নাকি আজব!
রুদ্র চুপ করে এক লোকমা ভাত মুখের সামনে ধরতেই মেহের অবাক হয়ে রুদ্রর দিকে চেয়ে থাকে। রুদ্র বিরক্ত হয়ে বলে,
চেয়ে আছো কেনো? জলদি খাও।
মেহের দ্রুত খাবার মুখে পুড়ে নেয়। খাবার খাওয়াতে খাওয়াতেই রুদ্র বলে,
আজ থেকে রোজ রাতে তুমি আমাকে খাইয়ে দিবে। বুঝলে?
মেহের ঘাড় কাত করে "আচ্ছা" বুঝায়। খাবার শেষে মেহের উঠে বারান্দায় চলে যায়। রুদ্র একজন সার্ভেন্ট কে ডাকলে সে এসে প্লেট এসব নিয়ে যায়। সার্ভেন্ট যাওয়ার পর দরজা লাগিয়ে সেও বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়।
.
বারান্দায় দাড়িয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়ে আছে মেহের। গোসল করার কারণে চুল ভেজা তাই চুল খুলে দাড়িয়ে আছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, মেঘদের আনাগোনা তেমন নেই, আজ যেনো চাঁদ জিদ করে বসেছে যে সে কিছুতেই মেঘেদের আড়ালে লুকাবে না, অসংখ্য তারায় আকাশ পরিপূর্ণ। ছোট বেলায় ভাবতো মানুষ মরে গেলে তারা হয়ে যায় আর তার বাবাও আকাশের তারা। বড় হয়ে বুঝলো এটা শুধু একটা ভ্রম মাত্র। মাঝে মাঝে এই ভ্রমে থাকতেই মেহেরের বেশ ভালো লাগে। আকাশের দিকে চেয়ে নিজের মনে চলা সব কথা, অভিমান, অভিযোগ বলে মন হালকা করে মেহের। থেমে থেমেই গায়ে হিম ধরানোর মত ঠান্ডা বাতাস এসে মেহেরকে কাপিয়ে তুলছে, মাথার চুল গুলো এতক্ষণে শুকিয়ে গেছে, বাতাসের কারণে থেমে থেমে উড়ছে অবাধ্য চুলগুলো। এই মৌসুমটা মেহেরের বরাবরই প্রিয়। চোখ বন্ধ করে লম্বা এক শ্বাস নেয় মেহের। পেট কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেতেই ফট করে চোখ খুলে মেহের। এমন ছোঁয়ার সাথে এই প্রথম পরিচয় তার, রুদ্র ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে ঘাড়ে থুতনি রেখে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
কি করো এখানে?
মেহের ধীর গলায় জবাব দেয়,
কিছু না। এমনি আকাশ দেখছিলাম।
~ওহ
এরপর কিছুক্ষণ চারদিকে থমথমে নিরবতা। রুদ্র মেহেরের হাত টেনে নিয়ে বারান্দায় থাকা দোলনায় বসিয়ে নিজেও মেহেরের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। কিছুমুহূর্ত শুয়ে থেকে অস্পষ্ট স্বরে বলে,
তোমাকে রুদ্রাণী কেনো বলি বলোতো! কারণ তুমি নিজের মনে যা আসে তা করতে বা বলতে ভয় পাও না। কিন্তু... আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছিলে বউ? এতো নিষ্ঠুর কেনো তুমি?
মেহের কি বলবে ভেবে পায় না। তাই চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। পেটের কাছটা হটাৎ ভেজা অনুভব হতেই আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রুদ্রর দিকে তাকায় মেহের। রুদ্রকে হটাৎ ফুঁপিয়ে উঠতে দেখলে অবাকের শীর্ষে চলে যায় মেহের। হতভম্ব হয়ে রুদ্রর দিকে চেয়ে থাকে। উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
আপনি কাদছেন? কি হয়েছে? জবাব দিচ্ছেন না কেন? উঠুন দেখি!
রুদ্র জবাব দেয় না। মেহেরকে আরো শক্ত করে আকড়ে ধরে বাচ্চাদের মত ফুপিয়ে কাদতে থাকে। মেহের কি করবো ভেবে পায় না। ছেলেরা নাকি সহজে কাদে না কিন্তু মেহের রুদ্রকে তার সামনে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কান্না করতে দেখলো। মেহের জোর করে রুদ্রকে কোল থেকে তুলে উঠে বসায়। রুদ্র দৃষ্টি নত করে এখনও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। মেহের রুদ্রর দিকে দৃষ্টি বুলায়। কান্নার কারণে ইতিমধ্যে তার নাক, কান লাল হয়ে আছে, মাথার চুল এলো মেলো, ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে সে। মেহের কাপা কাপা হাতে রুদ্রর চোখের পানি মুছে দিয়ে গালে হাত রাখে। রুদ্র মেহেরের হাত শক্ত করে চেপে ধরে তাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। কান্না ভেজা গলায় মেহেরের উদ্দেশ্যে বলে,
~আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছিলে তুমি মেহেরজান! আমি তোমাকে ছাড়া কি নিয়ে থাকতাম? কেনো তুমি আমাকে বুঝার চেষ্টা করো না? আমি কি এতই খারাপ?
মেহের এমন পরিস্থিতির সাথে অপরিচিত। এই মুহূর্তে কি বলা উচিত তার মাথায় আসছে না। অন্যদিকে রুদ্রর কান্নাও তার সহ্য হচ্ছে না। মেহের দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,
আপনি মোটেও খারাপ না। আমি... আমি সরি। আমি আর কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথায় আনবো না।
~সত্যি?
মেহের মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালে রুদ্র অশ্রুসিক্ত চোখেই মেহেরের দিকে চেয়ে থাকে। মেহের রুদ্রর দিকে করুন দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে জবাব দেয়,
আপনার সাথে এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি আমি। যার থেকে চাইলেও আমি মুক্ত হতে পারবো না। আমি আর কখনও আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথায় আনবো না। সত্যি বলছি।
রুদ্র হটাৎ মেহেরকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,
আপনাতেই মুগ্ধ আমি,
আপনাতেই আসক্ত,
বিচ্ছেদের বিষাদ কভু না আসুক,
ওহে হৃদহরণী! এই প্রণয় যে বিষের চেয়েও বিষাক্ত...।
~~~
চলবে~