গল্প আমার_রুদ্রাণী পর্ব ৩০

 #আমার_রুদ্রাণী

#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা

#part: 30


🍂🍂🍂


ফুলে সজ্জিত খাটে বসে আছে মেহের। কিছু সময়ের ব্যবধানেই যেনো ঘরটাকে এক নতুন রূপে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। হৃৎপিণ্ড এর বেগ ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। রুদ্রর কথা ভাবতেই বারবার গলা শুকিয়ে আসছে তার, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। রুদ্র কি তার ওপর এখনো রেগে আছে? সে কি মেহেরের পালিয়ে যাওয়া নিয়ে মেহেরকে শাস্তি দিবে? মারবে না তো? এসব ভেবেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে মেহেরের। মেহেরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে রুদ্র কখনোই তাকে গভীর ভাবে ছুবে না তা জানে মেহের। কয়েকদিনের মধ্যেই এই বিশ্বাসটা নিজের অজান্তেই তৈরি হয়ে গেছে মেহেরের মনে। মেহেরের ভাবনার মাঝেই রুদ্র ঘরে প্রবেশ করে। রুদ্র স্থির দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে চেয়ে আছে আর মেহের দৃষ্টি নত করে বসে আছে। রুদ্র মেহেরের কাছে এসে বসতেই মেহের একটু নড়েচড়ে বসে। রুদ্র এখনও মৌনতা বজায় রেখে মেহেরের দিকে চেয়ে আছে। রুদ্র এই মুহুর্তে তাকে কষিয়ে এক চর মারবে তা ভেবে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় মেহের। রুদ্র মৌনতা ভেঙে শান্ত কণ্ঠে বলে,

ফ্রেশ হয়ে অজু করে এসো। নফল নামাজ পড়ে আল্লাহ এর কাছে শুকরিয়া আদায় করবো।

মেহেরকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতে দেখে রুদ্র পুনরায় যেতে বললে মেহের দ্রুত একটা আকাশী রঙের শাড়ি নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে ঘরে এলে দেখে রুদ্র মাথায় হাত চেপে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মেহেরের আসার আওয়াজ শুনে রুদ্র মাথা তুলে মেহেরের দিকে তাকায়। মিহি স্বরে বলে উঠে,

মাশাল্লাহ

রুদ্রর বলা কথা মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছায় না। রুদ্র আরো কিছুক্ষণ মেহেরের দিকে চেয়ে থাকে। এরপর উঠে দাড়িয়ে বলে,

আলমারিতে জায়নামাজ আছে। আমি অজু করে আসছি।

মেহের মাথা নেড়ে সায় জানাতেই রুদ্র নিজের জামা নিয়ে চলে যায়।

.

নামাজ পড়ে উঠে মেহের বুঝতে পারে না যে এই মুহূর্তে রুদ্র এর সাথে কথা বলা ঠিক হবে কি না। মেহের কিছু বলার আগেই রুদ্র বলে,

সার্ভেন্ট এসে খাবার দিয়ে গেছে। সারাদিনের ধকলে ঠিক মত গলা দিয়ে খাবার নেমেছে কিনা সন্দেহ। খেয়ে নাও যাও।

বলেই বিছানায় যেয়ে আধশোয়া হয়ে মাথা হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে রুদ্র। মেহের এক নজর খাবারের দিকে চেয়ে আবার রুদ্রর দিকে তাকায়। সাহস জোগিয়ে জিজ্ঞেস করে,

আপনি খেয়েছেন?

~ইচ্ছা নেই।

~কেনো?

রুদ্র জবাব দেয় না। মেহের জবাবের আশায় কিছুক্ষণ রুদ্রর দিকে চেয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এক প্লেট এ খাবার বেড়ে রুদ্রর সামনে যেয়ে দাড়ায়। ডাক দিবে কি দিবে না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে সে। মেহের এর দ্বিধাদ্বন্দ্ব শেষ হওয়ার আগেই রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকায় মেহেরের দিকে। মেহের অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে রুদ্রর দিকে চেয়ে থাকে।

কি সমস্যা? কিছু বলবে?

মেহের একবার মাথা নেড়ে না বুঝায় আবার দ্রুত হ্যাঁ বোঝায়। রুদ্র আগের মতোই শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

কি?

~সোজা হয়ে বসুন।

~কেনো?

~খাবার খাবেন তাই।

~ইচ্ছে নেই বললাম তো!

~আমি খাইয়ে দেই?

রুদ্র আবারো জবাব দেয় না। উঠে বসতেই মেহের বুঝে যায়। রুদ্র কে খাবার খাইয়ে দেওয়ার সময় রুদ্র এক ধ্যান এ মেহেরের দিকে চেয়ে ছিল। মেহের এর কিছুটা অস্বস্তি হলেও কিছুই বলেনি। রুদ্রকে খাওয়ানো শেষে নিজের জন্য খাবার বাড়লে রুদ্র দ্রুত পায়ে এসে হুট করেই মেহেরের হাত থেকে প্লেট টা কেড়ে নেয়। মেহের কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে পরমুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে বলে,

নিলেন কেনো?

~আমার ইচ্ছা। 

সোফায় বসতে বসতে বলে রুদ্র। রুদ্রর সোজাসাপ্টা জবাবটা যেনো মেহেরের পছন্দ হলো না। মন খারাপ করে "ও আচ্ছা" বলে উঠে যেতে নিলেই রুদ্র হাত টেনে পুনরায় বসিয়ে দিয়ে বলে,

কই যাও? খাবার খাবে না?

~আপনি ই তো প্লেট নিয়ে নিলেন।

~হ্যাঁ তো?

~তো মানে! খাবার কি মাথায় নিয়ে খাবো নাকি আজব!

রুদ্র চুপ করে এক লোকমা ভাত মুখের সামনে ধরতেই মেহের অবাক হয়ে রুদ্রর দিকে চেয়ে থাকে। রুদ্র বিরক্ত হয়ে বলে,

চেয়ে আছো কেনো? জলদি খাও।

মেহের দ্রুত খাবার মুখে পুড়ে নেয়। খাবার খাওয়াতে খাওয়াতেই রুদ্র বলে,

আজ থেকে রোজ রাতে তুমি আমাকে খাইয়ে দিবে। বুঝলে?

মেহের ঘাড় কাত করে "আচ্ছা" বুঝায়। খাবার শেষে মেহের উঠে বারান্দায় চলে যায়। রুদ্র একজন সার্ভেন্ট কে ডাকলে সে এসে প্লেট এসব নিয়ে যায়। সার্ভেন্ট যাওয়ার পর দরজা লাগিয়ে সেও বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়।

.

বারান্দায় দাড়িয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়ে আছে মেহের। গোসল করার কারণে চুল ভেজা তাই চুল খুলে দাড়িয়ে আছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, মেঘদের আনাগোনা তেমন নেই, আজ যেনো চাঁদ জিদ করে বসেছে যে সে কিছুতেই মেঘেদের আড়ালে লুকাবে না, অসংখ্য তারায় আকাশ পরিপূর্ণ। ছোট বেলায় ভাবতো মানুষ মরে গেলে তারা হয়ে যায় আর তার বাবাও আকাশের তারা। বড় হয়ে বুঝলো এটা শুধু একটা ভ্রম মাত্র। মাঝে মাঝে এই ভ্রমে থাকতেই মেহেরের বেশ ভালো লাগে। আকাশের দিকে চেয়ে নিজের মনে চলা সব কথা, অভিমান, অভিযোগ বলে মন হালকা করে মেহের। থেমে থেমেই গায়ে হিম ধরানোর মত ঠান্ডা বাতাস এসে মেহেরকে কাপিয়ে তুলছে, মাথার চুল গুলো এতক্ষণে শুকিয়ে গেছে, বাতাসের কারণে থেমে থেমে উড়ছে অবাধ্য চুলগুলো। এই মৌসুমটা মেহেরের বরাবরই প্রিয়। চোখ বন্ধ করে লম্বা এক শ্বাস নেয় মেহের। পেট কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেতেই ফট করে চোখ খুলে মেহের। এমন ছোঁয়ার সাথে এই প্রথম পরিচয় তার, রুদ্র ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে  ঘাড়ে থুতনি রেখে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

কি করো এখানে?

মেহের ধীর গলায় জবাব দেয়,

কিছু না। এমনি আকাশ দেখছিলাম।

~ওহ

এরপর কিছুক্ষণ চারদিকে থমথমে নিরবতা। রুদ্র মেহেরের হাত টেনে নিয়ে বারান্দায় থাকা দোলনায় বসিয়ে নিজেও মেহেরের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। কিছুমুহূর্ত শুয়ে থেকে অস্পষ্ট স্বরে বলে,

তোমাকে রুদ্রাণী কেনো বলি বলোতো! কারণ তুমি নিজের মনে যা আসে তা করতে বা বলতে ভয় পাও না। কিন্তু... আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছিলে বউ? এতো নিষ্ঠুর কেনো তুমি?

মেহের কি বলবে ভেবে পায় না। তাই চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। পেটের কাছটা হটাৎ ভেজা অনুভব হতেই আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রুদ্রর দিকে তাকায় মেহের। রুদ্রকে হটাৎ ফুঁপিয়ে উঠতে দেখলে অবাকের শীর্ষে চলে যায় মেহের। হতভম্ব হয়ে রুদ্রর দিকে চেয়ে থাকে। উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

আপনি কাদছেন? কি হয়েছে? জবাব দিচ্ছেন না কেন? উঠুন দেখি!

রুদ্র জবাব দেয় না। মেহেরকে আরো শক্ত করে আকড়ে ধরে বাচ্চাদের মত ফুপিয়ে কাদতে থাকে। মেহের কি করবো ভেবে পায় না। ছেলেরা নাকি সহজে কাদে না কিন্তু মেহের রুদ্রকে তার সামনে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কান্না করতে দেখলো। মেহের জোর করে রুদ্রকে কোল থেকে তুলে উঠে বসায়। রুদ্র দৃষ্টি নত করে এখনও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। মেহের রুদ্রর দিকে দৃষ্টি বুলায়। কান্নার কারণে ইতিমধ্যে তার নাক, কান লাল হয়ে আছে, মাথার চুল এলো মেলো, ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে সে। মেহের কাপা কাপা হাতে রুদ্রর চোখের পানি মুছে দিয়ে গালে হাত রাখে। রুদ্র মেহেরের হাত শক্ত করে চেপে ধরে তাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। কান্না ভেজা গলায় মেহেরের উদ্দেশ্যে বলে,

~আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছিলে তুমি মেহেরজান! আমি তোমাকে ছাড়া কি নিয়ে থাকতাম? কেনো তুমি আমাকে বুঝার চেষ্টা করো না? আমি কি এতই খারাপ?

মেহের এমন পরিস্থিতির সাথে অপরিচিত। এই মুহূর্তে কি বলা উচিত তার মাথায় আসছে না। অন্যদিকে রুদ্রর কান্নাও তার সহ্য হচ্ছে না। মেহের দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,

আপনি মোটেও খারাপ না। আমি... আমি সরি। আমি আর কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথায় আনবো না।

~সত্যি?

মেহের মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালে রুদ্র অশ্রুসিক্ত চোখেই মেহেরের দিকে চেয়ে থাকে। মেহের রুদ্রর দিকে করুন দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে জবাব দেয়,

আপনার সাথে এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি আমি। যার থেকে চাইলেও আমি মুক্ত হতে পারবো না। আমি আর কখনও আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথায় আনবো না। সত্যি বলছি।

রুদ্র হটাৎ মেহেরকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,

আপনাতেই মুগ্ধ আমি, 

আপনাতেই আসক্ত, 

বিচ্ছেদের বিষাদ কভু না আসুক, 

ওহে হৃদহরণী! এই প্রণয় যে বিষের চেয়েও বিষাক্ত...।

~~~

চলবে~

গল্প আমার_রুদ্রাণী পর্ব ২৯

 #আমার_রুদ্রাণী

#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা

#part: 29


🍂🍂🍂


বিয়ের সাজে আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে মেহের। গায়ে সাদা আর গোল্ডেন রঙের কম্বিনেশন এর লেহেঙ্গা, বাম কাধে লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং ওড়না, মাথায় সাদা আর গোল্ডেন এর কম্বিনেশন এর ওড়না, গা ভর্তি গহনা, চেহারায় মেকআপ। অশ্রুসিক্ত নয়নে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে মেহের। স্নেহা আর দিয়াও রেডী হয়ে সোফায় বসে আছে। কারো মুখে কোন কথা নেই, একদম পিন পতন নিরবতা। পার্লার এর মেয়েগুলো ওদের সাজিয়ে চলে গেছে অনেকক্ষণ হলো। স্নেহা মাথা তুলে মেহেরের দিকে তাকায় যে কিনা এখনও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে চেয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। স্নেহা ধীর পায়ে হেঁটে যায় মেহেরের কাছে। মেহেরের গালে হাত রাখতেই মেহেরের ধ্যান ভাঙে, অশ্রুসিক্ত নয়নে স্নেহার দিকে তাকায়। স্নেহা মেহেরকে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে তার পাশে বসে। মেহেরের দু হাত ধরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মৌনতা ভেঙে এবার স্নেহা বলতে শুরু করে,

বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন মেহের। জন্ম, মৃত্য, বিয়ে এই তিনটাই আল্লাহর হাতে। যদি সুফিয়ান ভাইয়ার সাথেই তোর বিয়ে হয় তবে তাই সই। ভাইয়া খারাপ না মেহের, এটা তুই আমি সকলেই জানি। ভাইয়া যে কারণে মাফিয়া জগতে গেছে তাও আমাদের অজানা নয়। ভাইয়া যে তোকে কোনো মূল্যেই ছাড়বে না এটা এতক্ষণে সবার জানা হয়ে গেছে। আন্টি ঠিক বলেছে। ভাইয়া তোকে সব থেকে ভালো রাখবে। তোকে অনেক ভালোবাসে। (স্নেহা)

~তবে তুই আমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করছিলি কেনো? (মেহের)

~সবার আগে তুই আমার বান্ধবী মেহের। আমার বোন তুই। তোর জন্য যে কোনো কিছু করতে আমি রাজি। তুই তাকে বিয়ে করতে চাসনি তাই তোকে পালাতে সাহায্য করছিলাম। কিন্তু এখন ভেবে বুঝলাম আমরা ভুল করছি। তোর ক্ষেত্রে অনেক পসেসিভ ভাইয়া। ভাইয়াকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখ মেহের। আমার বিশ্বাস সে তোকে নিরাশ করবে না। (স্নেহা)

~তুই তীব্র ভাইয়াকে মাফ করেছিস? (মেহের)

স্নেহা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্নেহা আবার বলে,

ভালোবাসার মানুষ থেকে চাইলেও বেশিক্ষণ রাগ করে দূরে থাকা যায় না। তাদের প্রতি এক প্রকার মায়া তৈরি হয়ে যায়। যেই মায়া থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। মায়া কাটিয়ে উঠতে অনেকের সারা জীবনও লেগে যায়। তীব্র আমার এমনই এক মায়া মেহের। তার প্রতি চাইলেও আমার মনে রাগ ক্ষোভ জমে না। তোর মনে যে সুফিয়ান ভাইয়ার জন্য সুক্ষ্ম এক অনুভূতির জন্ম নিয়েছে তা কারো দৃষ্টিগোচর হয়নি মেহের। হয়তো আন্টিও বুঝতে পেরেছে তাই হয়তো সে চায় তোর বিয়েটা ভাইয়ার সাথেই হোক।

স্নেহার কথায় বিস্মিত চোখে তাকায় মেহের। মেহেরের চাহনী দেখে স্নেহা আলতো হাসে।

~ভাইয়াকে একটা সুযোগ দে মেহের। সে কোনো ভুল করেনি। নিজের পরিবার, নিজের প্রিয়জনদের বাঁচানোর জন্য যা করা ঠিক মনে হয়েছে সে তাই করছে। (দিয়া)

মেহের দিয়ার দিকে তাকালে দিয়া মাথা দুলিয়ে আশ্বাস দেয়। মেহের বুঝতে পারে ওদের কথা। তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করে বলে,

দেবো তবে। তাকে একটা সুযোগ দিবো।

মেহেরের কথা শুনে খুশির রেখা দেখা দেয় স্নেহা আর দিয়ার চোখে মুখে। শুধু দিয়া আর স্নেহার ই নয় বরং আরো একজনের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে। রুদ্র... সে এতক্ষণ ল্যাপটপে তাদের কথোপকথন শুনছিল। মেহের রাজি হয়েছে শুনে তার মনে হচ্ছে যেনো হৃদয়ের ওপর থেকে এক বিশাল পাথর নামানো হয়েছে।


🍂🍂🍂


সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে চারদিকে চোখ বুলায় মেহের। সকলেই হাসি হাসি মুখে মেহেরের দিকে চেয়ে আছে। মেহের চোখ নামিয়ে স্টেজ এ যেয়ে বসতেই মেহরিশ আর তিথি এগিয়ে আসে ওদের দিকে।

~আমার মেয়েটা কে তো মাশাল্লাহ খুব সুন্দর লাগছে। সুখে থাক মা এটাই দোয়া করি।

মায়ের কথার প্রতিউত্তরে মেহের কিছুই বলে না। মুখ গম্ভীর করে অন্যদিকে চেয়ে থাকে। মেহরিশ বুঝতে পারে যে মেহেরের অভিমান হয়েছে তার প্রতি। এখন মেহেরের সাথে বেশি কথা বললে পরে হিতে বিপরীত হবে। তাই তিনি চুপ হয়ে যান। তিথি, মেহেরের নানা, নানি আর রেদোয়ান এসে দুজন এর প্রশংসা করেন এবং অনেক কথা বলেন। মেহের তাদের সাথে যথাসম্ভব স্বাভাবিক আচরণ করে। আহিল আর কাব্য মেহেরের কাছে এলে মেহের এক নজর ওদের দিকে চেয়ে আবারো মাথা নুয়ে বসে থাকে যেনো তার সামনে এখন কেউই নেই। আহিল আর কাব্য মেহেরের পাশে বসতে বসতে বলে,

রেগে আছিস আমাদের প্রতি? রাগ করে থাকিস না বোন।

মেহের মৌনতা বজায় রেখেই বসে থাকে।

~আমাদের সাথে রাগ করে থাকতে পারবি মেহের? (কাব্য)

~চলে যাবো? (আহিল)

কাব্য আর আহিল উঠে চলে যেতে নিলে মেহের ওদের হাত ধরে আটকায়। কাব্য আর আহিল একে ওপরের দিকে চেয়ে নিঃশব্দে হাসে। মেহেরের পাশে পুনরায় বসে আহিল বলে,

আটকালি কেনো? চলে যাই?

আহিলের প্রশ্নের জবাব দেয় না মেহের। কাব্যর গালে হাত রেখে বলে,

মায়ের থাপ্পড়ে ব্যাথা পেয়েছিস ভাই?

কাব্য হেসে মাথা নেড়ে না বুঝায়। মেহের আবার বলে,

আমার জন্য শুধু শুধু চর খেতে গেলি কেনো? বেক্কল একটা।

~তো কি করতাম? বোনকে মার খেতে দেখতাম তবে?

মেহের ছলছল নয়নে তাকায় কাব্যর দিকে। কাব্য মেহেরের হাত ধরে এদিক এদিক চোখ ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,

ছোট থেকে এক সাথে ছিলাম আমরা। আজ যে তোর বিয়ে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে জানিস!

মেহের বুঝতে পারে কাব্য কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। মুচকি হেসে বলে,

কাদছিস নাকি?

বলতেই কাব্য মেহেরকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত শব্দ করে কেঁদে উঠে। সাথে দিয়া, আহিল আর স্নেহাও কেঁদে দেয়। মেহের হাসে। এই মুহূর্তে তার কাদতে ইচ্ছে করছে না। কান্না করলে চোখে জলের কারণে ঝাপসা দেখা যায় সব। সে আজ সবার কান্না দেখতে চায়। কাব্যর পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,

ইশ! কাব্য ভাই দেখি এখনও বাচ্চা রয়ে গেলো রে আহি! দেখ কেমন ছিচকাদুনে। ওর বিয়ের জন্য তো মেয়ে পাওয়া যাবে না রে।

মেহের এর কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই কাব্য মেহেরকে ছেড়ে চোখ ডলতে ডলতে বলে,

আমি কাদছি না তো! চোখ থেকে এমনি একটু পানি বেরিয়েছে।

আহিল, দিয়া, স্নেহা আর মেহের এক সাথে হেসে উঠে। হাসতে হাসতেই মেহের সামনের দিকে দৃষ্টি দেয়। তার সামনে ফিনফিনে সাদা পর্দা টাঙানো, পর্দার ওপাশে রুদ্র, তীব্র আর আয়মানরা বসে ওদের দিকেই চেয়ে আছে। স্পষ্ট না দেখা গেলেও পর্দার ওপারের সবই দেখা যাচ্ছে। মেহের আবারো একবার চারদিকে চোখ বুলায়। সারা বাড়ি ফুলে ফুলে সজ্জিত, সব ছেলেরা হালকা নীল রঙের পাঞ্জাবি আর সব মেয়েরা হালকা নীল রঙের শাড়ি পড়েছে, অনুষ্ঠানের প্রায় সব কিছুই সাদা আর গোল্ডেন রঙের জিনিস দিয়ে সাজানো দেখে মেহেরের ভ্রু কুঁচকে আসে। মেহের ভাবতে থাকে,

বিয়ের কাপড় সবসময় লাল কিংবা গোলাপী দেখেছি আমি। সাদা রঙের বিয়ের পোশাক এই প্রথম দেখলাম। এই রঙের বিয়ের পোশাক কেনো? চারদিকের সাজসজ্জাও বেশিরভাগ সাদা রঙের আশ্চর্য!

 .

বিয়ে পড়ানো শেষ হলে সকলে মিলে রুদ্র আর মেহের এর সামনে আয়না রাখে। আয়নায় একে অপরকে দেখানোর পর যখন সবাই রুদ্রকে জিজ্ঞেস করে যে সে আয়নায় কাকে দেখতে পাচ্ছে। তখন রুদ্র মেহেরের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে জবাব দেয়,

আমার মায়াবতী, আমার প্রাণভোমরা।

মেহেরকে যখন একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয় তখন মেহের আনমনেই জবাব দেয়,

মায়াবতীর প্রেমিক পুরুষ।

সকলের হৈহুল্লোড় এর শব্দে ধ্যান ভাঙে মেহেরের। কিছু মুহূর্ত আগে সে কি বলেছে তা মন, মস্তিষ্কে পুনরায় বিচরণ করতেই গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে যায়। আয়নায় রুদ্রর প্রতিবিম্বর দিকে তাকাতেই নজরে আসে রুদ্রর বিস্মিত চাহনী আর ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি। রুদ্রর চোখে চোখ পড়তেই মেহের যেনো লজ্জায় আরো আড়ষ্ট হয়ে যায়। এই মুহূর্তে পারলে সে এক দৌড়ে এখন থেকে পলায়ন করতো।

~~~

চলবে~

(সবাই ভালো মানুষের মতো সালামি দিয়ে যাবেন। নাহলে কিন্তু বিয়েতে খাবার দেওয়া হবে না। আর হ্যাঁ! মোটেও নেক্সট নেক্সট করবেন না। অবশ্যই গঠনমূলক কমেন্টস করবেন। হ্যাপি রিডিং~)

গল্প আমার_রুদ্রাণী পর্ব ২৮

 #আমার_রুদ্রাণী

#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা

#part: 28


🍂🍂🍂


~যা যা আনতে বলা হয়েছে সব এনেছেন?

ফারাজ এর হাত থেকে ব্যাগ নিতে নিতে জিজ্ঞেস করে দিয়া।

~হ্যাঁ। ইভান আর আমি বেশ কয়েকবার লিস্ট এর সাথে মিলিয়ে দেখেছি। সব ঠিক আছে। তবুও তুমি আরেকবার চেক করে দেখে নাও। কোনো কিছু কম থাকলে আমি এনে দিচ্ছি।

~আচ্ছা

ডানে বামে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার চোখ বুলিয়ে ব্যাগ এ থাকা সামগ্রীগুলো দেখতে থাকে দিয়া। সামনে দাড়ানো ছেলেটি যে তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তা সে বেশ বুঝতে পারছে। কিন্তু এখন সে মোটেও কিছু বলার মত মুডে নেই।

~দিয়া...

ফারাজের ডাক শুনে চোখ তুলে ফারাজের দিকে তাকায় দিয়া। পুনরায় ভ্রু কুঁচকে ব্যাগ এর দিকে চোখ রেখে জবাব দেয়,

হ্যাঁ বলুন।

~তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।

ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত করে বলে ফারাজ। কিছুটা দূরে আয়মানকে দেখে কিছু বলতে যেয়েও চুপ হয়ে যায় দিয়া। এত দূর থেকে এদিকে বলা কথা শোনা সম্ভব না বুঝতে পারে দিয়া। ফারাজ এর হাত ধরে তাড়া দিয়ে মিহি স্বরে বলে,

আপনি এখন যান ফারাজ ভাই। কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা হয়ে যাবে।

ফারাজ যেতেই দিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে নিলেই আয়মান দিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। দিয়া ভ্রু কুঁচকে আয়মান এর দিকে তাকাতেই আয়মান প্রশ্ন করে,

ছেলেটা কে ছিল?

~কেনো?

~তুমি ওর হাত ধরেছিলে কেনো?

~আমি কার হাত ধরি না ধরি তার কৈফিয়ত কি এখন আপনাকে দেওয়া লাগবে নাকি আমার?

~অবশ্যই দেওয়া লাগবে।

~কেনো? কি হন আপনি আমার? বাবা, ভাই নাকি স্বামী? একটাও না। তবে? সামনের থেকে সরুন!

বলেই আয়মান কে ধাক্কা দিয়ে হাটা ধরে।

~ও কি তোমার বয়ফ্রেন্ড? আমার জানা মতে তুমি সিঙ্গেল। আজ অব্দি কোনো ছেলের সাথে কোনো সম্পর্কে জড়াওনি তুমি।

যেতে নিয়েও আয়মান এর কথা শুনে থেমে যায় দিয়া। ঘুরে আয়মান এর দিকে তাকায়।

~জড়াইনি কিন্তু জড়াতে কতক্ষন? ভালোবাসে সে আমাকে। খুব শীঘ্রই তাকে একসেপ্ট করবো ভেবেছি।

~সাহস থাকলে একসেপ্ট করে দেখিও। খুন করে ফেলবো দিয়া।

~এ ছাড়া আপনি আর রুদ্র ভাইয়া পারেন টা কি?

তাচ্ছিল্য হেসে চলে যায় দিয়া। আয়মান রেগে দিয়ার যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে।


🍂🍂🍂


~কি রে ভাই! এত সময় লাগে একটা জিনিস আনতে! ফারাজ ভাই কি আবার ওরে তুলে নিয়ে গেলো নাকি! সন্দেহ হইতেছে এখন।

বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠে কাব্য। কাব্যর কথা শুনে স্নেহা কাব্যর মাথায় এক চাপড় মেরে বলে,

তোর যত্তসব আজাইরা কথা। ফারাজ ভাই ওকে তুলে নিয়ে যাবে কোন দুঃখে?

~হ্যাঁ!তুই জানস না? ফারাজ ভাই যে ওরে পছন্দ করে। কতবার প্রপোজও করছে।

~জানি কিন্তু তুলে নিয়ে যাবে কেন! এইসব চিন্তা তোর মত বেক্কল দ্বারাই করা সম্ভব।

কাব্য চোখ মুখ কুচকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই দিয়া দ্রুত পায়ে ঘরে প্রবেশ করে দরজা আটকে দেয়। আহিল এগিয়ে যেতেই দিয়া তার হাতের ব্যাগটি এগিয়ে দেয়। 

~সব ঠিক আছে। চেক করে এনেছি। (দিয়া)

~তুই কি সত্যিই যেতে চাইছিস মেহের? সুফিয়ান ভাই জানতে পারলে কি হবে জানিস তো! (স্নেহা)

~জানতে পারলেও সে আমাকে কোনোভাবে আঘাত করবে না এতে সিওর আমি। কিন্তু তোদের যদি কোনো ক্ষতি করে? (মেহের)

~তখনের টা তখন দেখা যাবে। তুই তৈরি হয়ে নে। (আহিল)

হাতে থাকা ব্যাগটি এগিয়ে দিতেই মেহের রেডী হতে শুরু করে।

.

কালো বোরকা আর হিজাব পড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিকে চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মেহের। এগুলোই সে ফারাজ আর ইভানকে দিয়ে আনিয়েছিল। মেহেরের সাথেই আছে আহিল, দিয়া, স্নেহা আর কাব্য। হার্টবিট এর গতি তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে, চোখ দিয়ে অজস্র অশ্রুধারা বেয়ে যাচ্ছে। আহিল এর ধরে রাখা হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরতেই আহিল ঘাড় ঘুরিয়ে মেহেরের দিকে তাকায়। হাঁটতে হাঁটতেই আশ্বাস দিয়ে বলে,

চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

বাড়ি ভর্তি গার্ড এর চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া এতটাও সহজ নয়। কোনো রকমে বাড়ির পেছনের গেট এর বাইরে পা রাখতে নিতেই কেউ একজন মেহেরের হাত টেনে পিছনে ঘুরিয়েই গালে চর বসিয়ে দেয়। সামনে নিজের মাকে দেখে বুকটা ধক করে উঠে মেহেরের। মেহরিশ অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে আছে মেহেরদের দিকে। মেহেরকে জিজ্ঞেস করে,

পালিয়ে যাচ্ছিলি? 

মেহের জবাব দেয় না। মেহরিশ গর্জে উঠে,

জবাব দিচ্ছিস না কেনো! পালিয়ে যাচ্ছিলি! এই দিন দেখার জন্যই এত আদর যত্ন করে বড় করে ছিলাম তোকে!

~আন্টি প্লীজ আপনি শান্ত হোন। (স্নেহা)

~তোদের কি বলেছিলাম আমি! ওর ভালো তোরা বুঝিস। ওকে বুঝাতে বলেছিলাম। কিন্তু তোরাই ওকে পালাতে সাহায্য করছিস! (চিৎকার করে বলে মেহরিশ)

~মা শোনো...

মেহের কিছু বলতে নিতেই মেহেরের মা এগিয়ে এসে আরো এক চর বসিয়ে দেয়। মেহের মাথা নিচু করে চোখ চেপে দাড়িয়ে থাকে। কিন্তু নিজের গালে আঘাত না পেয়ে চর এর ধ্বনি অন্য দিক থেকে শুনতেই চোখ তুলে তাকায় মেহের। চরটা মেহেরের গালে নয় বরং কাব্যর গালে পড়েছে দেখে সকলেই হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে। মেহের এর সামনে এসে কাব্য দাড়িয়ে পড়ায় চরটা কাব্যর গালেই পড়েছে। মেহের কাব্যকে সরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।

~সমস্যা কি তোমার? বুঝতে চাইছো না কেন যে আমি এই বিয়ে করতে চাই না। ওনাকে আমি বিয়ে করবো না।

~তুই বুঝতে চাইছিস না কেন! রুদ্র ভালো ছেলে। তোকে ভালো রাখবে।

~একজন মাফিয়ার সাথে আমি কখনোই ভালো থাকবো না। কিছুতেই না। বুঝার চেষ্টা করো প্লিজ!!!

কিছুক্ষণ থেমে আবারো বলে,

আমাকে ক্ষমা করো মা।

বলেই মেহরিশ এর পাশ কেটে চলে যেতে নিতেই কয়েকজন গার্ড এসে মেহেরের সামনে দাঁড়ায়। মেহের তাদের দেখে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়।

~আমাকে একা রেখে চলে যাচ্ছো রুদ্রাণী? এতই সোজা?

রুদ্রর শান্ত কণ্ঠস্বর শুনে পেছনে ঘুরে তাকায় মেহেরসহ সকলেই। মেহের ভয় পেয়ে স্নেহার হাত শক্ত করে ধরে। রুদ্র এগিয়ে এসে মেহেরের সামনে দাঁড়াতেই মেহের স্নেহার পেছনে যেয়ে লুকায়। রুদ্র ঘাড় কাত করে মেহেরের দিকে চেয়ে নিঃশব্দে হাসে।

~এখন ভয় পাচ্ছো কেন? সামনে এসো।

রুদ্রর কথা শুনে মেহের আরো যেনো গুটিয়ে যায়।

~ওকে যেতে দিন ভাইয়া। ও বিয়ে করতে চাইছে না আপনাকে। কেনো জোর করছেন ওকে? (স্নেহা)

~সরি বউমনি। ওকে ছাড়া সম্ভব না। ও আমার অস্তিত্বে মিশে গেছে একদম।

বলেই রুদ্র মেহেরের হাত ধরে টেনে সামনে এনে দাড় করায়।

~যার সাথে সারাজীবন থাকতে হবে তাকে ভয় পাচ্ছো? নট ফেয়ার রুদ্রাণী।

মেহের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে,

আমি এখানে থাকবো না। যেতে দিন আমাকে।

~সম্ভব না।

বলেই হাত ধরে টেনে নিয়ে বাড়ির দিকে যেতে নিলে আহিল মেহেরের অন্য হাত ধরে আটকায়। রুদ্র শান্ত দৃষ্টিতে মেহেরের হাতের দিকে একবার চেয়ে আবার আহিলের দিকে তাকায়। থমথমে গলায় বলে,

আমার অবর্তমানে তুমি আর কাব্য ওর সাথে থেকে ওকে প্রোটেক্ট করেছো তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এখন বাধা দিয়ে এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বাধ্য করো না যা আমি করতে চাইছি না।

~ও এই বিয়ে করতে চাইছে না ভাইয়া। ও কষ্ট পাচ্ছে। (কাব্য)

~আজকের পর আর কষ্টের কান্না কাদতেঁ দিবো না। এইটুকু ভরসা রাখতে পারো।

আহিল মেহেরের হাত ছেড়ে দিতেই মেহের টলমল দৃষ্টিতে আহিলের দিকে তাকায়। রুদ্র মেহেরের হাত ধরে টান দিতেই মেহেরের যেনো ঘোর ভাঙে। চিৎকার করে বলতে থাকে,

~আমি যাবো না ওনার সাথে। ভাই কিছু কর! দিয়া, স্নেহা আমি এই বিয়ে করবো না। প্লীজ তোরা কিছু কর!

আহিল আর কাব্য দাতে দাঁত চেপে, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে, মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকে। এই মুহূর্তে মেহেরের আর্তনাদ যেনো ভোঁতা ছুরি দ্বারা আঘাত করছে সকলের হৃদয়ে। রুদ্র আসতেই মেহরিশ বেগম ঘরে চলে গেছেন। কাব্য মেহেরের কাছে যেতে নিতেই আহিল কাব্যর হাত ধরে আটকায়। স্নেহা আর দিয়া রুদ্র আর মেহেরের পিছু পিছু যায়।


🍂🍂🍂


মেহেরকে ঘরে এনেই বিছানায় ছুড়ে মারে রুদ্র। এতে হাতে কিছুটা ব্যাথা পেলেও ঠোঁট কামড়ে চুপ করে থাকে মেহের। মেহের ধীরে ধীরে উঠে বসে রুদ্র দিকে তাকায়। রুদ্র মাথা চেপে ধরে সারা ঘর পায়চারি করছে। মেহের বুঝতে পারে যে সে এখন রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় আছে। দ্রুত পায়ে মেহেরের কাছে এসে বসতেই মেহের কিছুটা পিছিয়ে যায়। রুদ্র এগিয়ে যেয়ে মেহেরের দু বাহু শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

পালিয়ে যাচ্ছিলে রুদ্রাণী? আমাকে ছেড়ে যাচ্ছিলে? এতই সোজা? আমাকে ছাড়ার কথা মাথায় আনো কি করে তুমি?

~আপনি প্লীজ আমাকে যেতে দিন। আমি... আমি বিয়ে করবো না।

~কেনো? (শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে রুদ্র)

~আপনি... আপনি মাফিয়া। (ভীতু স্বরে জবাব দেয় মেহের)

~তুমি তো জানো আমি কেনো এই পথে গিয়েছি। জানো না?

মেহেরকে চুপ করে থাকতে দেখে রুদ্র জোরে এক ধমক দেয়।

~কি হলো? জানো না তুমি?

রুদ্রর ধমকে কেপে উঠে মেহের। মাথা নেড়ে বুঝায় যে সে জানে।

~তবে? কেনো আমার থেকে দূরে যেতে চাইছো? (করুন স্বরে জিজ্ঞেস করে রুদ্র)

~আপনি মাফিয়া। আমার আপনাকে ভয় লাগে। যদি কখনো আমাকেও মেরে দেন?

বলেই মাথা নিচু করে থাকে মেহের। রুদ্র অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় মেহেরের দিকে। ধরা গলায় বলে,

আমি আপনাকে মারবো? আপনার এমন কেনো মনে হয় মেহেরজান? আপনি আমার প্রাণভোমরা। নিজের প্রাণভোমরাকে কেউ কি করে মারতে পারে?

রুদ্রর কণ্ঠ শুনে চোখ তুলে তাকায় মেহের। রুদ্রর চোখে পানি টলমল করছে। মেহের কিছু বলার আগেই রুদ্র কাউকে কল করে বলে,

ওদের ঘরে আসতে বল।

ফোন রাখতেই স্নেহা, দিয়া আর তিনজন মেয়ে ঘরে প্রবেশ করে।মেহের ভ্রু কুঁচকে ওদের দিকে তাকায়। রুদ্র বলে,

পার্লার থেকে এসেছেন ওনারা। বিয়ের জন্য তৈরি হয়ে নাও। বিয়ের আগ পর্যন্ত এই ঘর থেকে তোমাদের বের হওয়া নিষেধ।

বলেই হন হন করে ঘরে থেকে বেরিয়ে যায় রুদ্র। মেহের করুন চোখে রুদ্রর যাওয়া দেখে।

~~~

চলবে~

(সবাই নেক্সট নেক্সট না বলে একটু গঠনমূলক কমেন্টও তো করতে পারেন নাকি! পরের পার্ট তো এমনিও দিবো।🙂)

গল্প আমার_রুদ্রাণী পর্ব ২৭

 #আমার_রুদ্রাণী

#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা

#part: 27


🍂🍂🍂


~আমাকে ছাড়ার কথা ভুলেও মাথায় এনো না মেহেরজান।

বলেই উঠে বসে রুদ্র। রুদ্রকে বিয়ে করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিলেও একজন মাফিয়ার সাথে সংসার করা মেহেরের পক্ষে সম্ভব না।

~আপনার মাফিয়া জগতে পা রাখার কারণ আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আপনার সাথে আমার পক্ষে সংসার করা সম্ভব না। আমি কখনোই চাইনি যে আমার বর কোনো মাফিয়া হোক। তাই আমি...আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।

এতক্ষণ শান্ত ভঙ্গিতে কথা বললেও রুদ্রর চোখে মুখে এখন রাগ ফুটে উঠে। মেহেরের দুই কাধ শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

বিয়ে করতে পারবেন না মানে কি? আমাকে কি রাস্তার গুন্ডা মনে হয়? একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নাও মেহেরজান। আমি ছাড়া আর কোনো পথ নেই তোমার কাছে।

এক বিন্দু অশ্রু মেহেরের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তেই রুদ্র টা স্বযত্নে মুছে দেয়। 

~কাদঁছো কেনো? একটু মন মতো বকাও দেওয়া যায় না দেখছি। বিয়ের কনে তো সত্যিই পিচ্চি।

~আমাকে যেতে দিন প্লীজ। আমি আপনাকে বিয়ে করবো না।

~দেখা যাক!

~আপনি প্লীজ!

~চুপ চাপ ঘুমাও। আমি পাশের রুমেই আছি। কিছু লাগলে আমাকে অবশ্যই জানাবে। 

বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় রুদ্র।


🍂🍂🍂


ফজরের আযান দিতেই অজু করে নামাজ পড়ে নেয় মেহের। আজ কি হবে জানা নেই মেহেরের। মনে মনে শুধু দোয়া করছে সব কিছু যেনো ঠিক হয়ে যায়। নামাজ শেষে বারান্দায় দাড়িয়ে সকাল হওয়া দেখতে থাকে। প্রায় অনেকক্ষণ বারান্দায় দাড়িয়ে থাকে মেহের। ঘরে এসে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে ৬:৪৫ বাজে। মেহের ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলে,

সময় কত জলদি অতিবাহিত হয়।

কিছুক্ষণ পরেই ঘরে স্নেহা আসে। স্নেহাকে দেখতেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে মেহেরের। মেহেরকে হাসতে দেখে স্নেহার মনেও কিছুটা শান্তি অনুভব হয়। মেহের পাশে বসতে ইশারা করতেই স্নেহা যেয়ে মেহেরের পাশে বসে। দীর্ঘসময় দুজন চুপচাপ বসে থাকে। মৌনতা ভেঙে স্নেহা বলে,

কি সিদ্ধান্ত নিলি মেহের? বিয়েটা করবি?

~বুঝতে পারছি না আমি। কালকের পর থেকে রুদ্রকে দেখতেই মনের মধ্যে ভয় জেগে ওঠে। এই ভয় নিয়ে আমি সংসার করতে পারবো না।

~ভাইয়া তোকে যেতে দেবে?

মাথা নেড়ে না বোঝায় মেহের। স্নেহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

~তুই তীব্র ভাইয়া সাথে কথা বলিস নি?

~না

~কেনো?

~আমার কাছে কেনো লুকালো এসব? আমি তার অর্ধাঙ্গিনী। সে আমার কাছেও বলতে যদি দ্বিধা করে তবে আমার থাকা না থাকা সমান নয় কি?

~ভাইয়া তোকে টেনশন দিতে চায়নি হয়তো।

~বাদ দে। এখন কি করবি?

~পালিয়ে যাই?

~পাগল হয়েছিস! ভাইয়া যে করেই হোক তোকে খুজে বের করবে।

~তো কি করবো? মাকে বুঝালে বিয়ে ভাঙতে রাজি হবে?

~চেষ্টা করে দেখবি?

~দেখি। বাসায় কখন যাবো? জানিস কিছু?

~কালকের ঘটনার পর রুদ্র ভাইয়া জানিয়েছে বিয়ে এই বাড়িতেই হবে। ও বাড়িতে কষ্ট করে যাওয়া আসা করা লাগবে না।

~মানে কি!

~মানে হলো তোর বরমশাই তোর পালানোর রাস্তা খুব কড়াভাবে বন্ধ করে দিয়েছে।

কথার মাঝেই দিয়া ঘুমু ঘুমু চোখে ঘরে প্রবেশ করে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে দিয়াও সারা রাত ঘুমায়নি। দিয়া এসে জোরপূর্বক হেসে বলে,

কেমন আছিস তোরা?

~আলহামদুলিল্লাহ্। তুই? (স্নেহা)

~হুঁ (দিয়া)

দিয়াকে দেখতেই রুদ্রর বলা আয়মান এর কথা মনে পড়ে মেহেরের। মেহের দিয়া কে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে,

তুই কি কেঁদেছিস?

~না (অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দেয় দিয়া)

~আয়মান ভাইয়া তোকে ভালোবাসে জানিস? (দাত কেলিয়ে বলে মেহের)

~এই আজাইরা কথা তোরে কোন আহাম্মক এ বললো? (তাচ্ছিল্য হেসে বলে দিয়া)

~স্নেহার দেবর। (খাটে গা এলিয়ে দিয়ে বলে মেহের)

~রুদ্র ভাইয়া বলেছে? (স্নেহা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে)

~হুঁ। (পাশে থাকা ছবির ফ্রেমটি হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলে মেহের)

~ফাজলামো করিস না মেহের। কাল রাত থেকে এমনিই মন মেজাজ ভালো না। (গম্ভীর কণ্ঠে বলে দিয়া)

~তুই কি আমার বিয়াইন লাগস যে তোর সাথে ফাজলামি করতে যাবো! স্নেহার দেবর যা বলেছে তাই তো বললাম। 

(চোখ ছোট ছোট করে বলে মেহের)

~কি বলেছে ভাইয়া তোকে? (স্নেহা)

আড়চোখে একবার স্নেহার দিকে চেয়ে সব বলে মেহের। মেহেরের কথায় প্রথমে অবাক হলেও পরে হাসে দিয়া।

~ভালোবাসা যাক জাহান্নামে। আমি তাকে কখনো বিয়ে করবো না। (দিয়া)

~কেনো কেনো? (মেহের)

~তুই যেই কারণে রুদ্র ভাইয়াকে বিয়ে করবি না। আমিও ঠিক একই কারণে করবো না। কেননা সে সব কাজে রুদ্র ভাইয়ার সাথে সাথে থাকে। মানে সে সমান দোষী। (দিয়া)

~কি কপাল তোদের! তিন বান্ধবীকে তিন ভাই পছন্দ করলো! তাদের দুটো বোন থাকলে আমাদেরও আজ কপাল খুলে যেতো। 

আফসোসের সুরে কথাটি বলে ধুপ করে খাটে এসে বসে কাব্য। পেছন পেছন আহিল ও ঘরে প্রবেশ করে। 

~তুই এত জলদি ঘুম থেকে উঠলি কেমনে? (দিয়া)

~ঘুমাইলে তো উঠমু। (কাব্য)

~সারা রাত বসে বসে টেনশন করেছি। ঠিক আছিস তোরা? (আহিল)

~হুঁ। (মেহের)

~৮ টা বাজে। এতক্ষণে নাস্তা রেডি হয়ে গেছে হয়তো। চল নাস্তা করে আসি। (স্নেহা)

~হ্যাঁ চল। (কাব্য)

সবাই এক সাথে নাস্তা করে আবার ঘরে ফিরে এসে ভাবতে থাকে যে কিভাবে মেহেরের মা কে রাজি করানো যায়।


🍂🍂🍂


ডাইনিং টেবিলে বসে আছে মেহেরের মা, নানা নানি আর রুদ্র, রুদ্রর মা, বাবা, তীব্র আর আয়মান। পাশেই দাড়িয়ে কাচুমাচু হয়ে দিয়া, স্নেহা, আহিল আর কাব্য একে অপরকে খোঁচাচ্ছে মেহরিশ বেগম কে ডাক দিতে। পাশের চেয়ারে রুদ্রকে বসা দেখতেই ওদের ভয়ে জান যায় যায় অবস্থা। কাব্য ধাক্কা দিয়ে দিয়াকে আগে বাড়িয়ে দিতেই সকলের দৃষ্টি দিয়ার দিকে একবার চেয়ে আবারো খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।

~আন্টি!

দিয়ার ডাকে এবার রুদ্র বাদে সকলেই দিয়ার দিকে তাকায়। দিয়া করুন দৃষ্টিতে কাব্যদের দিকে তাকায়। ওরা চোখ দিয়ে দিয়াকে বলতে ইশারা করছে। দিয়া একটা শুকনো ঢোক গিলে রুদ্রর দিকে তাকায়। রুদ্র বাম হাতে থাকা ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখেই খাবার খাচ্ছে।

~কিছু বলবি? (মেহরিশ)

দিয়া মাথা না বোধকে নেড়ে আবার মুখে হ্যাঁ বলতেই মেহরিশ চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।

~মেহের ডেকেছিল তোমাকে। একটু দরকার ছিল।

এখন যদি রুদ্র ওদের মতলব বুঝে তাকে যেতে মানা করেন? তাই ভেবে রুদ্রর দিকে চোখ পিটপিট করে তাকায় দিয়া। কিন্তু না রুদ্র স্বাভাবিক ভাবেই এক হাতে ফোন স্ক্রল করতে করতে খাবার খাচ্ছে। তার ভাবখানা দেখে মনেই হচ্ছে না সে এখানে এসে ব্যতীত অন্য কেউ আদৌ আছে।

~এইটুকু কথা বলতে এত ইতস্তত বোধ করার কি আছে?

~তুমি ব্যস্ত তো তাই বলতে হেজিট্যাট ফিল করছিলাম আর কি।(জোর পূর্বক হেসে বলে দিয়া)

~আচ্ছা যা আসছি।

মেহরিশ বেগমের কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই দ্রুত স্থান ত্যাগ করে মেহেরের বন্ধুরা।

.

সকলে ঘরে হুড়মুড় করে প্রবেশ করতেই মেহের কিছুটা হকচকিয়ে যায়। বুকে থুথু দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে ওদের জিজ্ঞেস করে,

এভাবে ঘরে ঢুকে কেউ! এই বয়সে মিনি হার্ট এ্যাটাক দিতে মারার ধান্দা!

~রাখ তোর মিনি হার্ট এ্যাটাক! তোর থেকেও বড় হার্ট এ্যাটাক হওয়ার থেকে বেঁচে ফিরেছি। (কাব্য)

মেহের কিছু বুঝতে না পেরে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে,

মানে?

~রুদ্র ভাইয়াও সেখানে ছিল। ভয়ে আমাদের অবস্থা খারাপ। (দিয়া)

~উনি কিছু বলেছে?

~না। (দিয়া)

ওদের কথার মাঝেই ঘরে প্রবেশ করে মেহরিশ। মেহরিশ কে আসতে দেখে সকলেই চুপ হয়ে যায়।

~কিরে এত দ্রুত আসতে বললি যে? কি হয়েছে? শরীর খারাপ করলো নাকি আবার? জ্বর এসেছে? 

অস্থির কণ্ঠে মেহেরের গালে কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে মেহরিশ। মেহের মায়ের দিকে কিছুক্ষন এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে গাল থেকে মায়ের হাত সরিয়ে তাকে বসতে বলে। মেয়ের কথা মত তিনিও সোফায় যেয়ে বসে। মেহেরের বন্ধুদের মেহের খাটে বসতে ইশারা করে। তারাও যেয়ে চুপচাপ বসে। মেহের যেয়ে মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। মিহি স্বরে বলে,

আমার কিছুই হয়নি মা। চিন্তা করো না।

~তবে?

~জীবনে যা চেয়েছি সব দিয়েছো। কখনো কোনো কিছুর কমতি রাখোনি। তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

মেহরিশ মেয়ের মাথায় ডান হাত রাখে। মেহের মায়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। শান্ত কণ্ঠে বলে,

আজ আমার একটা কথা রাখবে মা?

মেহেরের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই মেহের বলে,

আমি এই বিয়ে করতে পারব না মা। আমি রুদ্রকে কোনোমতেই বিয়ে করতে পারব না। তুমি বিয়ে টা ভেঙে দাও প্লীজ!

মায়ের চোখের নমনীয় ভাবটা মুহূর্তেই গম্ভিরতায় রূপ নিলো। শক্তহাতে ধরে রাখা মেহেরের হাতটি চোখের পলকেই আলগা হয়ে গেলো। মেহের একবার মায়ের হাতের দিকে চেয়ে আবারো তার মুখের দিকে তাকায়।

~তুই কি কাউকে পছন্দ করিস?

গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চায় মেহরিশ। মেহের মাথা নেড়ে না জানায়। মেহরিশ এর মুখটা যেনো আরো গম্ভীর হয়ে এলো।

~তবে কি সমস্যা?

~আমি তার সাথে সংসার করতে পারবো না।

~কেনো?

~তার মাফিয়া জগতে আনাগোনা আছে। তুমি জানো না মা।

কিছুটা চিল্লিয়ে বলে মেহের।

~জানি আমি।

মেহরিশ এর নির্লিপ্ত জবাবে থমকে যায় ঘরে উপস্থিত থাকা সকলে। মেহের বিস্ময়ের দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চেয়ে থেকেই উঠে দাড়ায়। ধরা গলায় বলে,

তুমি জানতে?

~হ্যাঁ

মায়ের ফের শান্ত জবাব।

~তুমি তবুও তার সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইছো? তুমি জানতে না আমার খুন খারাবি পছন্দ না?

~জানি

মায়ের এই ঠান্ডা ব্যবহারটা যেনো মেহের আর নিতে পারছে না। চিৎকার করে বলে,

জানো মানে কি! এমন এক মানুষের সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইছো তুমি যে কিনা মানুষ মারে!

~রুদ্র কেনো এসব করেছে সব ই তোর জানার কথা। ও কেনো এমন হয়েছে তাও তোর জানা। ও তো শুধু উপযুক্ত শাস্তি দিচ্ছে মেহের। তাছাড়া ও তোকে অনেক ভালোবাসে।

~তাকে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না। তুমি এই বিয়ে ভেঙে দাও মা।

~তোর কি মনে হয়? রুদ্র এই বিয়ে ভাঙতে দিবে? তোকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবে? তাছাড়া বিয়ের দিন কি করে বিয়েতে অমত পোষণ করিস তুই! সমাজে জানাজানি হলে আমাদের সম্মান এর কি হবে জানা আছে!

~মানুষের কথা আমি কেয়ার করি না মা। আমি তাকে বিয়ে করবো না।

~তুই না করলেও আমরা পরোয়া করি। যাই হোক না কেনো বিয়ে তোর রুদ্রকেই করতে হবে।

~আন্টি...

দিয়া কিছু বলতে নিতেই থামিয়ে দেয় মেহরিশ। ওদের উদ্দেশ্য করে বলে,

তোরা তো ওর বন্ধু। ওর ভালো খারাপ তোরা অবশ্যই ভালো বুঝিস। ওকে বুঝাচ্ছিস না কেনো? রুদ্র ওর জন্য কতটা পসেসিভ জানিস তো তোরা! আর স্নেহা! রুদ্র তো তোর দেবর। তবে মেহেরকে বুঝাচ্ছিস না কেন তুই!

একটু থেমে আবার বলে,

কিছুক্ষণের মধ্যেই পার্লার এর লোক আসবে সাজাতে। সবাই তৈরি হয়ে নিস। 

বলেই হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে যায় মেহরিশ। মেহের তার মায়ের যাওয়ার দিকে অপলকভাবে চেয়ে থাকে।

~~~

চলবে~

গল্প আমার_রুদ্রাণী পর্ব ২৬

 #আমার_রুদ্রাণী

#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা

#part: 26


🍂🍂🍂


মেহেরকে চেয়ে থাকতে দেখে রুদ্র এক লম্বা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে।

"বাবার কোম্পানির ম্যানেজার ছিল শরীফ মির্জা। শুধু ম্যানেজার বললে ভুল হবে। বাবার সাথে গলায় গলায় বন্ধুত্ত্ব ছিল বটে। বিজনেস যখন বড় হতে শুরু করলো তখন শরীফ মির্জার লোভ ও বাড়তে শুরু করলো। আমি তখন ভার্সিটিতে পড়ি। শরীফ মির্জার সাথে আমার সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। আয়মানকে তখন বাবার কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে দিয়েছিলাম। আয়মান একদিন জানতে পারে যে শরীফ মির্জা বাবার সব সম্পত্তি সহ সম্পূর্ণ ব্যবসা হাতিয়ে নেওয়ার চিন্তায় আছে। আমি জানতে পারার পর পরই সব প্রমাণ জমিয়ে বাবাকে জানাই। সে অলরেডী কোম্পানির অনেক টাকা মেরে খেয়েছিল। বাবা পুলিশের হাতে তাকে তুলে দেয়। চার বছর আগে আমি তোমাকে দেখি। ক্লাস টেন এর ছাত্রী ছিলে তুমি। স্কুল ড্রেস পরিহিত, দুই কাধে দুটো বেনি, চোখে হালকা কাজল। একদম পিচ্চি লাগছিল তোমায়।" 

বলেই হেসে দেয় রুদ্র। আবারও মেহেরের কোলে মাথা দিয়ে শোয়। রুদ্র আবার বলতে শুরু করে,

"তোমাকে রোজ দেখার একটা অভ্যাস হয়ে গেছিলো জানো! আয়মানকে দিয়ে তোমার খবর নিয়ে ছিলাম। তোমার চেহারা দেখে নয় বরং তোমার বাচ্চামো দেখে তোমার প্রতি এক প্রকার ঝোঁক সৃষ্টি হয়েছিল। ধীরে ধীরে ভালোবাসতে শুরু করলাম।  শরীফ মির্জার যে যে মাফিয়া ওয়ার্ল্ড এর সাথে কানেকশন ছিল তা জানা ছিল না আমাদের কারোই। অগত্যা সে জেল থেকে ছাড়া পেল। দেখতে দেখতে তুমিও স্কুল এর গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রাখলে। আমি দুর থেকেই তোমার প্রতি নজর রাখতাম। কোনো ছেলে যেনো তোমার কাছেও না ঘেঁষতে পারে তার জন্যও সুব্যবস্থা নিয়ে রাখা ছিল।"

বলেই বাঁকা হাসে রুদ্র। এবার বুঝতে পারে মেহের। ক্লাস টেনের শুরু দিকে অনেক প্রপোজাল পেলেও হুট করে সব ছেলেরাই মেহেরকে দেখলেই দৌড়ে পালাতো। তখন তার কারণ বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারছে মেহের। রুদ্র মেহেরের চোখের সামনে তুড়ি বাজাতেই মেহের কপাল কুঁচকে রুদ্রর দিকে তাকায়। রুদ্র ফের বলতে শুরু করে,

"আমি তো প্রথম প্রথম আহিল আর কাব্যকে দেখেও ইনসিকিউর ফিল করতাম। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তোমরা একে অপরকে আপন ভাই বোনের মতো ভাবো। যাই হোক, শরীফ মির্জা ছাড়া পাওয়ার পর বিভিন্ন ভাবে আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করতো। আল্লাহ এর রহমতে আমরা কোনো না কোনো ভাবে বেচেঁ যেতাম। আড়াই বছর আগে জানতে পারি আত্মগোপনে থেকে এসব কিছু শরীফ মির্জা করছে। এমনকি তার মাফিয়া ওয়ার্ল্ড এর সাথেও কানেকশন আছে। শরীফ মির্জা ২ বছর আগে কোনো এক ভাবে খবর পায় যে আমি কাউকে ভালোবাসি। আমার সূত্র ধরে তোমার ক্ষতি করতে পারে ভেবে ভাইয়া আমাকে মানা করে যেনো আপাতত তোমাকে দেখতে না যাই আমি। বাবা জোর করে বিদেশ পাঠাতে চাইলে আমি জিদ ধরে বসি যে আমি যাওয়ার আগে #আমার_রুদ্রাণীর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে রাখতে হবে। তবেই আমি যাবো। মা তো তোমাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে। আমার সাথে একদিন ভাইয়া তোমাকে দেখতে গিয়েছিল। তোমার সাথে বউমনি কে দেখে ভাইয়ার খুব পছন্দ হয়। যার ফলস্বরূপ আজ সে ভাইয়ার বউ। অথচ দেখো সবার আগে প্রেমে পড়লাম আমি কিন্তু আমারই এখনও বিয়ে হচ্ছে না।"

ঠোঁট উল্টে বলে রুদ্র। মেহের ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে রুদ্রর দিকে। মেহেরকে কেউ নজরে নজরে রাখছিল আর সে জানতোই না! কি অদ্ভুত! মেহেরের কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। মেহের জিজ্ঞেস করে,

তারপর কি হলো?

রুদ্র নিঃশব্দে হেসে বলে,

"তোমাকে পছন্দ করার পর আমার পাশাপাশি মা ও জিদ ধরলো যেনো আমি যাওয়ার আগেই বিয়ে পাকা করে যাই। মা ভাইয়ার কান টেনে আমাদের পক্ষে আনলো। বাবা আর কি করবে বেচারা। শেষ মেষ হার মেনে তোমাদের বাড়ি গেল। তোমার মা প্রথমে একটু নাকোচ করলেও পরবর্তীতে মায়ের কথায় রাজি হয়। ওহ তোমাকে তো বলতে ভুলেই গেছিলাম। তোমার মামনি আর আমার মা দুজন ছোট বেলার বেস্ট ফ্রেন্ড। যা আমিও জানতাম না। মাকে রাজি করানোর পর আমিও বিদেশ যেতে রাজি হই। মা কে বলে যাই যেনো তোমাকে এখন কিছু না জানায়। তাই তুমিও জানতে পারোনি। আমার সাথে আয়মানকেও বিদেশে নিয়ে যাই। ওর এই দুনিয়ায় আমরা ছাড়া কেউ নেই। ওকে একা ছাড়তে মন সায় দেয়নি। এই জানো! আয়মান কিন্তু দিয়ার ওপর ক্রাশড। একদম প্রথম থেকে। আমি একা কেনো দহনে পুড়তাম! ওকেও পুড়িয়েছি। আগে জানলে ভাইয়াকেও নিয়ে যেতাম। সে মীরজাফর এর মত পোল্টি নিয়ে কিভাবে তাড়াতাড়ি বিয়ে করলো! বিদেশে যাওয়ার পর একদিন জানতে পারলাম বাবার গুরুতর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। দেশে আসতে চাইলেও সবাই কড়া ভাবে মানা করে দেয়। সেদিন সিদ্ধান্ত নেই আমিও মাফিয়া ওয়ার্ল্ড এ ঢুকবো। ভাইয়া আর বাবা প্রথমে মানা করলেও, রাজি করিয়েছি। গত কয়েক বছরে অনেকভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে। আমার পরিবারের ওপর বেশ কয়েকবার প্রাণঘাতি হামলা চালিয়েছে। শরীফ মির্জাকে এবার উপযুক্ত শাস্তি দিবো। দু বছরে বিজনেসের পাশাপাশি মাফিয়া জগতেও বেশ নাম ডাক অর্জন করেছি। আমি বিনা কারণে কারো ক্ষতি করি না মেহেরজান। যারা আমার পরিবারের ক্ষতি করার চেষ্টা করে শুধু তাদেরই শাস্তি দেই। ভাইয়ার যে অ্যাকসিডেন্টটা হয়েছিল তাও শরীফ মির্জা করিয়েছে। খবর পেয়েছি সে বাংলাদেশে ফিরে এসেছে।"

মেহের প্রশ্ন করে,

সে যদি আপনার ক্ষতি করে?

~ "পারবে না। আমি এখন ওর থেকেও কয়েক ধাপ এগিয়ে আছি। আজকে যেই লোকটাকে মারলাম! তাকেও শরীফ মির্জা পাঠিয়ে ছিল"

~কারো কোনো ক্ষতি করেনি তো?

~করেনি কিন্তু আমি আসতে আরেকটু দেরি করলে অবশ্যই ক্ষতি হতো। সব থেকে বড় ক্ষতি হতো আমার।

~আপনাকে মারতে এসেছিলো?

~ন্যাহ্!

~তবে?

রুদ্র মেহেরের কানের পিঠে চুল গুজে দিয়ে বলে,

~আমার প্রাণভোমরার ক্ষতি করতে এসেছিল। যে হাত দিয়ে খুন করতে এসেছিল সেই হাত এতক্ষণে বাবা, আয়মান আর ভাইয়া হয়তো ভেঙ্গেও দিয়েছে।

রুদ্রর কথা শুনে মেহের অবাক হয়ে তাকায়।


🍂ফ্ল্যাশব্যাক🍂


ল্যাপটপ হাতে বসে আছে রুদ্র। ল্যাপটপের স্ক্রীনে বাড়ির বিভিন্ন জায়গার দৃশ্য ভেসে উঠছে। হটাৎ কিছু একটার দিকে নজর পড়তেই রুদ্র উঠে মেহেরের ঘরের দিকে যায়। যেতে যেতে আয়মানকে একটা মেসেজ করে। ঘরে ঢুকতেই দেখতে পায় ওই লোকটি ছুরি হাতে দাড়িয়ে আছে। আর মেহের বেঘোরে ঘুম। রুদ্রকে দেখতে পেয়ে লোকটি ঘাবড়ে যায়। রুদ্রর ওপর হামলা করতে নিলেই রুদ্র খুব সুক্ষ্ম ভাবে তার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে নেয়। লোকটি অবাক হয়ে তাকাতেই রুদ্র হাসে। লোকটির কাধে হাত রেখে বলে,

~তোকে গুন্ডার পদবী কোন গাধায় দিয়েছে রে? নির্ঘাত ওই শরীফ মির্জা? ওই বেটা আসলেই গাধা।

বলতে বলতেই আয়মান আর তীব্র কয়েকজন গার্ড নিজে ঘরে প্রবেশ করে। লোকটি ওদের দেখে কিছু করার আগেই রুদ্র লোকটির সামনে কিছু স্প্রে করতেই লোকটি জ্ঞান হারায়। এরপর গার্ডদের বলে যেনো নিঃশব্দে ওকে নিয়ে যায়। ওরা যাওয়ার সময় রুদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দরজার দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকে,

ভেবেছিলাম তোকে খুব সহজ মৃত্যু দিবো কিন্তু আজ আমার মেহেরজানের দিকে হাত বাড়িয়ে বড্ড ভুল করে ফেলেছিস শরীফ মির্জা।

 তখনই মেহের ঘুম থেকে উঠে রুদ্রকে দেখতে পায়।

~~~

চলবে~

গল্প আমার_রুদ্রাণী পর্ব ২৫

 #আমার_রুদ্রাণী

#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা

#part: 25


🍂🍂🍂


অজ্ঞান অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছে মেহের। খাটের পাশে চেয়ার টেনে বসে মেহের হাতের মেহেদি তুলে দিচ্ছে আহিল। আরেক পাশে কাব্য বসে মাথা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেহের এর পাশে কাছে দু পাশে স্নেহা আর দিয়া বসে আছে। স্নেহা বসে বসে আহিলের কার্যকলাপ দেখছে। মেহেরের হাতের মেহেদি ভীষণ গাঢ় রং ধারণ করেছে। মেহেরের মেহেদি দেখে স্নেহার মনে পড়ে আজ মেহেদি দেওয়ার সময় যখন মেহেদি আর্টিস্টরা বলছিলো "মেহেদির রং যত গাঢ় হয় স্বামীর ভালোবাসা তত গভীর" তখন তাদের কথা শুনে সেই কি হাসি। 

~মেহেদির রং আদৌ প্রকাশ করে নাকি! কি সব উদ্ভট কথা!

বলেই খিলখিল করে হাসছিল মেহের। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কি থেকে কি হয়ে গেল। তখনকার হাসি হাসি মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে আছে এখন ভাবতেই স্নেহার কান্না চলে আসে। দিয়া মাথা নিচু করে বসে আছে। বুক সেলফ এর কাছে দাঁড়িয়ে আয়মান দিয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। "দিয়া কি তবে তার কাছে আসার আগেই ভয়ে দূরে চলে যাবে?" কথাটা মাথায় আসতেই মুহূর্তেই যেনো রাজ্যের ভয় ঝেঁকে ধরে আয়মানকে। তখন মাটির দিকে চেয়ে থাকলেও আয়মান বুঝতে পেরেছে যে দিয়া অবাক আর ভয়ের দৃষ্টিতে আয়মানের দিকে চেয়ে আছে। তখন দিয়ার দিকে চোখ তুলে না তাকালেও এখন দিয়ার দিকে সর্বধ্যান দিয়ে চেয়ে আছে কিন্তু সেখান থেকে আসার পর থেকে দিয়া একবারও আয়মান এর দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। অন্যদিকে তীব্র গম্ভীর হয়ে রুদ্রর পাশে বসে আছে। স্নেহাকে কি বলে বুঝাতে পারবে সে জানে। রুদ্র কি জন্য ওই লোকটিকে মারছিল তা ইতিমধ্যে সবাইকে বলেছে আয়মান। কিন্তু মেহের যদি বুঝতে না চায়? যদি রুদ্রকে ছেড়ে চলে যেতে চায় তবে রুদ্র যে কি করবে তার চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে তীব্রর। মেহেরের জন্য করা রুদ্রর পাগলামি দেখেছে তীব্র। শুধু তীব্রই নয় বরং আহমেদ পরিবারের সবাই দেখেছে, স্নেহা বাদে। এবার যদি মেহেরের থেকে দূরে যাওয়ার বিন্দু মাত্র সম্ভাবনা থাকে তবে রুদ্র কি করবে জানা নেই। মেহেরের জ্ঞান ফিরতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। মেহেরের জ্ঞান ফিরতে দেখেই আহিল মেহেরকে উঠে বসতে সাহায্য করে। মেহের উঠে বসে মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। স্নেহা আর দিয়া এগিয়ে এসে মেহেরের আরো কাছ ঘেসে বসে। মেহের ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

মা এসেছিলো দেখতে? কিছু জিজ্ঞেস করেনি? কি বলেছিস তাকে?

~আন্টি আর মা এসেছিল। আমি বলে দিয়েছি তোমরা টায়ার্ড তাই তোমাদের রুদ্র ঘরে চলে আসতে বলেছে। তাই আর কেউ তোমাদের ডিস্টার্ব করেনি।

তীব্রর গলা শুনে কণ্ঠ অনুসরণ করে সেদিকে তাকায় মেহের। এতদিন এই মানুষটাকে নিজের বড় ভাই এর মত আর একটা ভরসার মত মানুষ ভাবলেও আজ যেনো তাকে দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নিতে মন চাইছে মেহেরের। না জানি আর কত কথা লুকিয়েছেন এনারা কথাটি মন, মস্তিষ্কে আসতেই আবারও চোখে পানি জমা হয় মেহেরের। তীব্রর পাশে বসে থাকা রুদ্রর দিকে এবার চোখ যায় মেহেরের। আগের সেই রক্ত মাখা পাঞ্জাবিটা রুদ্রর গায়ে নেই, গায়ে রক্তের বিন্দুমাত্র ছিটে ফোঁটা নেই। গায়ে কালো রঙের শার্ট ও প্যান্ট, মাথার ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে ছড়িয়ে আছে, চোখ মুখে রয়েছে এক রাশ স্নিগ্ধতার ছাপ। দেখে বুঝতে পারে একটু আগেই সে গোসল করেছে। এখন রুদ্রকে দেখলে বুঝার জো নেই যে কিছুক্ষণ আগে এই লোকটিই এখন মানুষকে নির্মমভাবে মারছিল। তখনকার দৃশ্য মস্তিষ্কে বিচরণ করতেই আঁতকে উঠে মেহের। আহিলের হাতটি শক্ত চেপে ধরে বলে,

~ভাই উনি...উনি এখানে কি করছে? উনি মেরে ফেলবে আমাকে। আমি এখানে এক মুহূর্তও থাকবো না। আমাকে এখন থেকে নিয়ে চল। আমি থাকবো না এখানে, বিয়ে করবো না ওনাকে।

আহিল করুন দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে তাকায়। যার জন্য সুপ্ত ভালোবাসা জন্ম নিতে দেখছিল এখন তার জন্যই ভয় দেখতে পাচ্ছে। এই মুহূর্তে কি করা বা বলা উচিত বুঝতে পারছে না সে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে রুদ্রর দিকে তাকায় আহিল। রুদ্র সে কখন থেকে একই ভঙ্গিতে বসে মেহেরের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে এখন তার মনে কি চলছে। আহিল চোখ বন্ধ করে লম্বা এক শ্বাস নেয়। এই মুহূর্তে মেহেরকে শান্ত করা জরুরি ভেবে মেহেরের মাথায় হাত রাখে। মেহের কাদতেঁ কাদতেঁ বলে,

আমি থাকবো না এখানে। উনি ভালো না। আমাকেও মেরে ফেলবে। আমার ওনাকে দেখে ভয় করছে। আমাকে বাড়ি নিয়ে যা প্লীজ।

দিয়া এগিয়ে এসে মেহেরকে বলে,

প্লীজ তুই কান্না করিস না মেহের। শান্ত হ।

~সবাই নিজ নিজ ঘরে যাও। আমার মেহেরজান এর সাথে কথা আছে।

রুদ্রর কণ্ঠ শুনে মেহেরের ভয়ের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। চিৎকার করে বলে,

না আমি আপনার সাথে কোনো কথা বলবো না। আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই। আহি, কাব্য তোরা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যা। আমি এখানে থাকবো না।

~কি বলেছি কানে যায়নি! নিজ নিজ ঘরে যাও সবাই!

রুদ্রর ধমকে সবার অন্তর আত্মা কেপে উঠে। তীব্র স্নেহাকে নিয়ে যেতে চাইলে স্নেহা হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। তীব্র শক্ত ভাবে স্নেহার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়।

~তুই তো বলিস সব ঝামেলা কথা বলে মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হয়। একবার রুদ্র ভাইয়ার সাথে কথা বল। এরপর যে সিদ্ধান্ত নিবি আমি তোর সাথে আছি। (আহিল)

~ভয় পাস না। আমরা তোর সাথেই আছি। (কাব্য)

মেহের করুন চোখে ওদের দিকে তাকায়। আহিল কাব্য আর দিয়াকে চোখ দিয়ে ইশারা করে চলে আসতে। দিয়া যেতে না চাইলেও আহিল এর কথায় যেতে হয়। দিয়ার পিছু পিছু আয়মান ও বের হয়। সবাই যেতেই রুদ্র শব্দ করে দরজা বন্ধ করে। মেহের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে খাটে বসে থাকে। রুদ্র যেয়ে মেহেরের সামনে বসতেই মেহের ভয়ে পিছিয়ে একদম কর্নার এর সাথে লেগে বসে। রুদ্রও আরেকটু এগিয়ে বসে।

রুদ্র নিশ্চুপ হয়ে মেহেরের দিকে চেয়ে আছে। মেহের বলে,

আমাকে যেতে দিন প্লীজ! আমি... আমি থাকবো না এখানে। আপনার মত মানুষের সাথে আমি থাকতে পারবো না। আমি মা কে বুঝিয়ে বলবো যে আমি বিয়ে করবো না।

রুদ্র এবার মৌনতা ভেঙে বলে,

কথা শেষ? নাকি আরো আছে?

মেহের ভ্রু কুঁচকে রুদ্রর দিকে তাকায়। রুদ্র মেহেরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। মেহের অবাক হয়ে রুদ্রকে সরাতে যাবে তার আগেই রুদ্র বলে,

খবরদার উঠানোর চেষ্টা করবে না। এর ফল মোটেও ভালো হবে না মেহেরজান।

রুদ্রর ধমকে মেহের দমে যায়। ফুপিয়ে কান্না করতে থাকে। রুদ্র শান্ত কণ্ঠে বলে,

তুমি আমার শুধুমাত্র পছন্দ না মেহেরজান। তুমি আমার ভালোবাসা, আমার আসক্তি, আমার ভালো থাকার একমাত্র কারণ।

আলতো হাসে রুদ্র। আবার বলে,

তোমার জান নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না মায়াবতী। তুমিই যে আমার প্রাণভোমরা। তুমি দুনিয়া ত্যাগ করলে আমি মরে যাবো এমন ফালতু ডায়ালগ আমি দেবো না। কিন্তু এটা সত্যি যে তুমি আমার কাছে থাকলে আমি আমার অন্ধকার জগতে কিছুটা আলোর রেখা পাই যা আমার মধ্যে বেচেঁ থাকার আশা যোগায়।

মেহের কান্না থামিয়ে রুদ্রর দিকে চেয়ে আছে এখন। রুদ্র এবার উঠে বসে। আলতো করে মেহের এর দু গালে হাত রেখে বলে,

আমি অকারণে কাউকে মারি না মেহেরজান। কিন্তু হ্যাঁ আমার প্রাণভোমরার দিকে হাত বাড়ালে আমি অবশ্যই ছেড়ে দিবো না।

রুদ্রর কথার মানে বুঝতে পারে না মেহের। প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে রুদ্রর দিকে। রুদ্র এক লম্বা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে...

~~~

চলবে~

গল্প আমার_রুদ্রাণী পর্ব ২৪

 #আমার_রুদ্রাণী

#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা

#part: 24


🍂🍂🍂


ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক চেয়ে এলোমেলোভাবে দৌড়াচ্ছে একজন। তার পেছনেই কয়েকজন গার্ড দৌড়াচ্ছে। বাড়িটির থেকে বেরিয়ে ঢোক গিলে আবারো পেছন দিকে দৃষ্টি রেখে পা চালিয়ে যেতেই কারো সাথে ধাক্কা খায় লোকটি। সামনে দাড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখেই শরীর ভয়ে কেপে উঠে। রুদ্র হেসে বলে,

হেই! পালিয়ে যাচ্ছিলে নাকি? আমি হেল্প করবো?

গার্ডরা এসে চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়ায়। তাদের মধ্যে একজন বলে,

~তানভীরকে (রুদ্রর বিশ্বস্ত গার্ডদের মধ্যে একজন) মাথার পেছনে আঘাত করে পালিয়ে যাচ্ছিল স্যার। আমরা দেখা মাত্রই ধরার জন্য পেছনে ছুটেছি।

মুহূর্তেই রুদ্রর চোখে মুখে রাগের অস্তিত্ব দেখা দেয়। গার্ডদের একজনকে ডেকে গম্ভীর স্বরে বলে,

ওকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠাও। ওর কিছু হলে তোমাদের একেকজনকে ডিরেক্ট শুট করে দিবো।

গার্ডটি ভয়ে মাথা নেড়ে চলে যেতেই রুদ্র আবারো ওই লোকটির দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,

~দ দয়া করে আমাকে যেতে দিন। আমার ভুল হয়ে গেছে। টাকার লোভে পরে আমি তাকে খুন করতে এসেছিলাম। মাফ করে দিন আমাকে। আর কখনো এমন ভুল করবো না।

কাদতে কাদতে বলে লোকটি। রুদ্র শান্ত কণ্ঠে বলে,

লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। জানিস তো? তোর সাহস কি করে হলো ওকে মারার চেষ্টা করার!

বলেই লোকটির বুকে এক লাত্থি দেয় রুদ্র। একজন গার্ডকে ইশারা করতেই সে এসে রুদ্রর হাতে একটি রড দেয়। রুদ্রর হাতে রড দেখেই অন্তর আত্মা কেপে উঠে লোকটির।


🍂🍂🍂


মনে মনে বিরক্ত হলেও জোরপূর্বক হেসে সকলের সাথে কথা বলছে মেহের আর তার বন্ধুরা। কে সম্পর্ক কি হয় তার হিসেব মিলাতেই মিলাতেই আজ হয়তো শহীদ হয়ে যাবে তা ইতিমধ্যে ভেবে নিয়েছে মেহের। সঙ্গীতের অনুষ্ঠান ইতিমধ্যে শেষ, সবাই মেহেদি লাগাতে ব্যস্ত। মেহেরের মেহেদি দেওয়া শেষ অনেক আগেই, মেহেদি শুকিয়েও গেছে অলরেডী। এখন দিয়া আর স্নেহা মেহেদি দিচ্ছে। সেদিকেই মনোযোগ দিয়ে বসে আছে ওরা।

~তোগো মাইয়া মাইনষের মধ্যে এত প্যাচ কেন! (বিরক্তমিশ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে কাব্য)

~মেয়ে মানুষ আবার তোরে কি করলো? (ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে দিয়া)

~সম্পর্কে মেহের আর স্নেহার কি লাগে তা না বইলা দেখস না কেমনে পরিচয় দেয়! হিসাব মিলাইয়া ই তো কুল পাই না যে কেডা কি লাগে। (কাব্য)

~আসলেই রে ভাই। আবার কেউ চেপে ধরার আগে চল এদিক থেকে সরে যাই। (আহিল)

~ভালো কথা মনে করিয়েছিস। চল ভাগি!!!

যেই না কাব্য আর আহিল উঠতে যাবে ওমনিই দুজন মধ্যবয়স্ক মহিলা হাজির। কি সুন্দর হেসে চেয়ে আছে ওদের দিকে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে পান খাওয়া তাদের অন্যতম প্রিয় অভ্যাস। কাব্য আর আহিলকে যেতে দেখেই তাদের মধ্যে একজন বলে উঠে,

আরে তোমরা কনের বন্ধু না? কোথায় যাও? বসো বসো।

~বসে থাকতে থাকতে কোমর বেকা হয়ে গেছে তাই একটু সোজা করতে যাচ্ছি। আপনি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন, আমরা ২ ঘণ্টায় আসছি। (কাব্য)

~কোমর পরে সোজা করলেও চলবে আপাতত আন্টিদের সাথে পরিচয় হই আয়। মুরব্বী মানুষ বসতে বললো আর তোরা চলে যাচ্ছিস! দেটস ব্যাড ম্যানার্স। (বিজ্ঞ ভাব নিয়ে বলে দিয়া)

~দিয়া ঠিকই বলেছে। বস বস। (দাত কেলিয়ে বলে স্নেহা)

কাব্য আর আহিল কটমট দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকাতেই ওরা যেনো চোখের ইশারায় জানিয়ে দিলো 'আমরা একা কেনো বসে বসে ওনাদের বকবকানি শুনবো? তোরাও শুন'। কাব্য আর আহিল আবারও নিজের জায়গায় বসতেই একজন মহিলা এগিয়ে এসে মেহেরের গালে হাত রেখে বলে,

~সুফিয়ানের পছন্দ আছে বলতে হবে। বউ দেখতে তো একদমই পুতুলের মত। (তাদের মধ্যে একজন বললো)

~ঠিক বলেছেন ভাবি। (পাশের দাড়িয়ে থাকা মহিলাটি)

দুজন একে ওপরের দিকে চেয়ে হেসে আবারো মেহেরকে উদ্দেশ্যে করে বললো,

আমাদের চিনো না নিশ্চয়। আমি রুদ্রর মায়ের মেঝ চাচার ছোট ছেলের বউ। আর ও (পাশের জনকে দেখিয়ে) রুদ্রর মায়ের ছোট চাচার একমাত্র ছেলের বউ।

বলেই ফের একবার একে ওপরের দিকে চেয়ে মুচকি হাসি দিল। মেহের ফ্যালফ্যাল করে দুজনের দিকে চেয়ে আছে। এমনি সম্পর্কের হিসেব মিলাতে কষ্ট হয় মেহেরের। আর আজকে প্রায় সবাই দেখি এভাবেই পরিচয় দিচ্ছে। কি এক ঝামেলা! ভুলে যদি ভাবির জায়গায় চাচী কিংবা চাচীর জায়গায় মামী ডেকেছে তাহলেই বাঁশ! মেহের করুন দৃষ্টিতে স্নেহার দিকে তাকায়। স্নেহাও তো এই পরিবারের ই বউ তাই ওর জানার কথা যে উনি সম্পর্কে কে হন। কিন্তু স্নেহাও বরাবরের মতোই উদাসীন চোখে মেহেরের দিকে চেয়ে আছে। মেহের ঘাড় ঘুরিয়ে দিয়া, আহিল আর কাব্যর দিয়ে তাকায়। ওরা বসে মিনমিন করে গবেষণা করে বের করার চেষ্টা করছে যে ওনারা সম্পর্কে কি হয়। মেহের এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মহিলা দুজনের দিকে তাকায়। তারা এখনও উৎসাহী দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে চেয়ে আছে। মেহের এমন ভাবে এক হাসি দিয়ে সালাম দিলো যেনো সে বুঝতে পেরেছে যে তারা সম্পর্কে কি হয়। মহিলা দুজন খুশিতে গদগদ হয়ে স্নেহার দিকে চেয়ে বললেন,

তুমি তো এই বাড়ির বড় ছেলে তীব্রর বউ। তাই না? তোমাদের বিয়েতে এসেছিলাম, মনে আছে?

তাদের প্রশ্নতে স্নেহা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বিয়ের দিন এমন এক দিন যাতে অনেক মানুষের ই দেখা মিলে। কে কার কি হয় তা মনে রাখা অসম্ভব এক কাজ বলে মনে করে স্নেহা। কিন্তু এখন কি জবাব দিবে ভেবে পায় না স্নেহা। অবশেষে সেও মেহেরের মত হেসে বললো,

আসসালামু আলাইকুম। হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই মনে আছে। তো? ভালো আছেন?

এবার যেনো তাদের চোখে আরো কয়েকগুণ খুশির ঝলক দেখা দিল। কাব্য, আহিল আর দিয়া জোরপূর্বক এক হাসি মুখে চেপে রেখেছে। মহিলা দুজন আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তিথি আহমেদ এর কাছে চলে গেলো। তাদের যেতে দেখে ওরা এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। মেহের স্নেহার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলো,

এই তুই না এই বাড়ির বউ?

~কোনও সন্দেহ আছে নাকি? (চোখ ছোট ছোট করে বলে স্নেহা)

~অবশ্যই সন্দেহ আছে। এই বাড়ির বউ হয়ে একটা মেহমান রেও চিনোস না তুই! বিয়ার দিন কি মেহমান রেখে খাবারের টেবিলের দিকে মনোযোগ দিয়া বইসা ছিলি নাকি তুই! (কাব্য)

কাব্যর কথায় স্নেহা চোখ মুখ কুচকে বলে,

আমি কি তোর মত বাকাশুর নাকি যে সারাক্ষণ খাবারের কথাই মাথায় ঘুরবে! তারা এখন যেমনভাবে পরিচয় দিয়ে গেলো তেমন ভাবেই আমার বিয়েতেও পরিচয় দিয়ে গেছে। আমি আজও মেলাতে পারি নি যে এরা আসলে সম্পর্কে কি হয়।

~থাক বাদ দে। এই ব্যাপারে তর্ক করে লাভ নেই। (আহিল)

সকলে এক সাথে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মেহের ফের চারদিকে নজর ঘুরায় রুদ্রকে খুজার উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষন আগেও রুদ্র মেহেরের পাশে বসে মেহমানদের সাথে কথা বলছিল। হটাৎ দাড়িয়ে বললো যে তার একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে সে কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে। আয়মানকে চোখ দিয়ে ইশারা করে নিজের সাথে দিয়ে গেলো। তাও মেহেরের দৃষ্টিগোচর হয়নি কিন্তু ইশারায় কি বলেছে বুঝতে পারেনি মেহের। টানা কয়েক ঘন্টা এভাবে বসে থাকায় কোমর ব্যাথা করছে মেহেরের। স্নেহাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

আমার বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। আমি একটু ঘুরে আসি?

~সারা বাড়িতেই মেহমান এর ছড়াছড়ি। যেদিকে যাবি সবাই ই ডেকে কথা জুড়ে বসবে। তাও যাবি?

~বাড়ি তো বিশাল বড়। বাড়িতে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মেহমান যাবে না?

~উম... ওই দিকটা হয়তো এখন খালি আছে। ঐদিকে এমনিও গার্ড ছাড়া কেউ তেমন একটা কেউ যায় না। ওই দিকের জায়গাটা সুন্দর। আমি মাঝে মাঝে তোর ভাইয়াকে নিয়ে হাঁটা হাটি করি।

~আমরাও আসি? (আহিল)

~উহু। একটু একা থাকতে মন চাইছে। আপাতত মানুষজনের কোলাহল ভালো লাগছে না। দিয়া আর স্নেহার মেহেদি দেওয়া হলেই তোরা সবাই আসিস। আমি আগে যাই। (মেহের)

~আচ্ছা। (আহিল)

উঠে দাড়ায় মেহের। স্নেহার দিক নির্দেশনা অনুযায়ী পা চালায় সেদিকে। এইদিকটায় আসলেই কেউ নেই। গার্ডগুলোও কেমন গম্ভীর, একদম মূর্তির মত দাড়িয়ে আছে। মেহের চুপচাপ হেটে যেতে থাকে। হটাৎ কারো আর্তনাদ শুনে সেদিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় মেহের। বাড়ির পেছন দিকটায় এসে এমন দৃশ্য দেখবে ভাবতেও পারেনি মেহের।

.

মেহেরের সাথে ম্যাচিং করে পড়া হালকা গোলাপী রঙের পাঞ্জাবি তে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ, চেহারায় ফুটে উঠেছে হিংস্রতা। তারই বাড়িতে এসে তার প্রিয় মানুষের জীবন শেষ করতে চাইছিল ভাবতেই রাগ যেনো শির শির করে বেড়ে উঠে রুদ্রর। দূরেই গম্ভীর ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে আয়মান আর গার্ডরা। রক্তাক্ত অবস্থায় লোকটি থেমে থেমেই বলছে যে তার ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু রুদ্র থামার পাত্র নয়। লোকটিকে পুনরায় রড দিয়ে আঘাত করতে নিতেই পেছন থেকে কারো চিৎকার শুনে ঘুরে দাঁড়ায় রুদ্র। চোখ বন্ধ করে কানে হাত চেপে দাড়িয়ে আছে মেহের। রুদ্র মেহেরকে দেখতেই হাতে থাকা রডটি ছুড়ে ফেলে দেয়। আয়মান গার্ডদের বলে লোকটিকে তাদের টর্চার হাউসে নিয়ে যেতে। মেহেদি পড়া হাতেই শক্ত হাতে নিজের লেহেঙ্গা চেপে ধরে মেহের। রুদ্র মেহেরের দিকে এগিয়ে আসতেই মেহের দ্রুত পায়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। রুদ্র মেহেরকে ধরতে গেলেই মেহের অশ্রুসিক্ত নয়নে রুদ্রর রক্ত রাঙ্গা হাতের দিকে তাকায়। 

~তার মানে আপ আপনি স-সত্যিই মা-মাফিয়া? আয়মান ভাইয়া আপনিও তার সাথে জড়িত?

কাপা কাপা গলায় বলে মেহের। রুদ্র শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই মেহের শব্দ করে কেঁদে উঠে।

~আমি-আমি আপনাকে বি-বিয়ে করবো না। কিছুতেই না। একজন গুন্ডার সাথে আমি কখনোই সংসার করতে পারবো না।

রুদ্রর মাথায় যেনো দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো মেহেরের কথা শুনে। হাতে রক্ত থাকায় মেহেরকে ছুঁতে পারছে না রুদ্র, নাহলে যে মুখে রুদ্রকে ছাড়ার কথা বলেছে এতক্ষণে নির্দ্বিধায় কয়েকটা চড় বসিয়ে দিত।

~বিয়ে তো এই আমাকেই করতে হবে মেহেরজান। মোটেও বিয়ে ভাঙার কথা মাথায় এনো না। তবে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।

মেহের মাথা না বোধকে নাড়িয়ে পেছনে ঘুরে দৌড় দিতে নিতেই কারো সাথে ধাক্কা খায়। কান্নার কারণে সব ঘোলা দেখছে মেহের। চোখ পিটপিট করে সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে যেনো ভরসার হাত দেখতে পায়। কান্নার পরিমাণও আরো দু গুন বেড়ে যায়। কান্না ভেজা গলায় বলে,

তী-ব্র ভাইয়া! আপনি জানেন উনি! উনি নাকি সত্যিই মাফিয়া। উনি... উনি খুব খারাপ। আমি মোটেও ওনাকে বিয়ে করবো না। আপনি বাবা আর মামনিকে বুঝিয়ে বলবেন? আমি ওনাকে বিয়ে করবো না।

ঠোঁট চেপে শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তীব্র। এমন একটা দিনের মুখোমুখি হতে হবে তা সে আগের থেকেই জানতো কিন্তু এতো জলদি এমন কিছু হবে তা তার ভাবনায়ও ছিল না। মৌনতা ভেঙে তীব্র জবাব দেয়,

আমি জানি মেহের। বোন আমার। তুমি প্লীজ রাগ করো না। রুদ্র খারাপ ছেলে নয়।

তীব্রর কথা শুনে মেহের যেনো আকাশ থেকে পড়লো। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তীব্রর দিকে চেয়ে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে রুদ্র আর আয়মান এর দিকে তাকায়। এই মানুষগুলোকে আজ বড্ড অপরিচিত লাগছে মেহেরের নিকট। কাছের মানুষ গুলোর এই রূপ যেনো মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে মেহেরের। মাথায় আর চাপ নিতে পারছে না মেহের। চোখ খুলে রাখা কষ্টকর হয়ে উঠছে। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিতেই তীব্র এগিয়ে মেহেরকে ধরতে যায়। কিন্তু তার আগেই কাব্য আর আহিল এসে মেহেরকে দু দিক থেকে আগলে ধরে। কাব্য আর আহিল আগেই বলেছিল যে রুদ্র মাফিয়া জগতের একজন কিন্তু সেদিন স্নেহা অমত পোষণ করায় ওরা আর কিছুই বলেনি। দিয়া অবাক দৃষ্টিতে আয়মান এর দিকে তাকায়। আয়মান চুপ করে মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চেয়ে আছে। অন্যদিকে স্নেহাও নিশ্চুপ ভাবে তীব্রর দিকে চেয়ে আছে। তীব্র কিছু বলার জন্য এগিয়ে আসতেই স্নেহা থম থমে গলায় আহিল আর কাব্যকে বলে,

পেছনের দরজা দিয়ে মেহেরকে নিয়ে ঘরে চল আহিল। 

রুদ্র এখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে নির্লিপ্তভাবে চেয়ে আছে মেহেরের দিকে। আহিল আর কাব্য রুদ্রর দিকে তাকাতেই রুদ্র মাথা নেড়ে সায় দেয়। আহিল দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে মেহেরকে কোলে তুলে দরজার দিকে পা বাড়ায়। আহিলের পিছু পিছু কাব্য, স্নেহা আর দিয়াও যায়।

~ডাক্তার কে ফোন করে দ্রুত আসতে বল মান। বাড়ির কাউকে এখন এই ব্যাপারে জানানোর প্রয়োজন নেই।

বলেই হন হন করে রুদ্র পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে।

~~~

চলবে~

(এই যা! নায়িকা তো বিয়ে করবে না বলে জানিয়ে দিলো। এখন উপায়?)