গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ১৯

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (১৯)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


- "তুই হঠাৎ করে এইসব জিজ্ঞেস করছিস কেন?"


শান্ত আবরারকে প্রশ্ন করল, আবরার নাজিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,

- "এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।"


কথাটা কেন যেন শান্তর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না, তবুও কিছু না বলে গল্প করতে লাগল।


- "এক্সকিউজ মি।"


ওরা তিনজন মাথা তুলে তাকাল। আবির দাঁড়িয়ে আছে, 


- "এখানে শান্ত কে?"

- "আমি কেন?"

- "আমি আবির তোমাকে কল করছিলাম।"

- "কিন্তু আমি তো আপনাকে কল করে বললাম আজকে মিট করতে পারব না।"


আবির বিজ্ঞদের মতো বলল,

- "শোন ছেলে কথা দিলে কথা রাখতে হয়। তুমি একজনকে কথা দিয়েছ আজ তার সাথে দেখা করব, কিন্তু দেখা করার কিছু মুহূর্ত আগে বলছ দেখা করতে পারবে না। এইটা কিন্তু ঠিক না।"


শান্ত মাথা নিচু করে নিল, আসলে অনেকদিন পর বন্ধুকে পেয়ে ভুলে গিয়েছিল বিষয়টা।


- "সরি। আপনি বসুন না, কি বলতে চান বলতে পারেন এরা আমার ফ্রেন্ড।"


আবির আয়েশ করে বসে কিছু বলতে যাবে তার আগে ওয়েটার কফি তিনটে দিয়ে গেল। আবির কোল্ড কফিটা নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল,

- "কফিটা দারুন টেস্টি।"


শান্ত বিরক্ত হলো আবিরের কাজে। লোকটা আসল কথা না বলে পেঁচিয়ে চলেছে, এর আসল উদ্দেশ্যে কি? কেন ডেকে পাঠিয়েছে?


আবির শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল,

- "জানি মনে মনে অনেক গালাগালি দিচ্ছিস, দে দে এখন তোদেরই বাজার।"


তুই' সম্বোধন'টা একদম আপন, সমবয়সী, বন্ধু, ছোট ভাইবোনকে বলা যায়। কিন্তু অচেনা মানুষকে বলা যায় এটা শান্ত জানত না! আবিরের মুখে তুই সম্বোধন'টাই প্রচন্ড রকমের অবাক হলো, কি রিয়াক্ট করা উচিত সেটাই বুঝতে পারল ষা। অচেনা একজন ব্যক্তি তুই বলেছে বলে তার সাথে ঝামেলা করবে! নাকি চুপচাপ সবটা দেখবে সেটাই বুঝল না।


শান্ত আবিরের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

 - "আপনি কি বলতে চাইছিলেন! কাইন্ডলি কথাটা বললে উপকৃত হতাম।"


আবির নড়েচড়ে বসল, আবরারের দিকে ইশারা করল বলার জন্য কিন্তু আবরার ওকে পাত্তা না দিয়ে বলল,

- "হ্যাঁ আপনার কি বলার আছে বলে ফেলুন, হেঁয়ালি না করে।"


আবির ওদের তিনজনের দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,

- "আমি শ্রেয়ার ব্যাপারে তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।"


শ্রেয়া! নামটা শুনে শান্ত চমকে উঠল। আবির শ্রেয়াকে চিনল কেমন করে?


- "আপনি শ্রেয়াকে চেনেন?"

- "হুমম, খুব ভালো করেই চিনি। তোমাকে আজকে কিছু জানানোর জন্য ডেকেছি, একটু ধৈর্য নিয়ে কথাগুলো শুনবে তারপর ঠিক -ভুল বিচার করবে।"


শান্ত থাকতে চাইলেই কি শান্ত থাকা যায়। আবিরের কথাগুলো শান্তর ভেতরে এলোমেলো করে দিচ্ছে, শ্রেয়ার ব্যাপারে লোকটা কি বলবে? খারাপ কিছু কি?


আবির আবরারের দিকে তাকাল, ওহ চোখের ইশারায় সবটা বলতে বলল। আবির নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলল,

- "একসপ্তাহ আগে শ্রেয়া সুই-সাইড করার চেষ্টা করেছিল।"


শান্ত চমকে উঠল, শ্রেয়া সুই-সাইড করার চেষ্টা করেছে বিষয়টা শোনার পর উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

- "এইসব আপনি কি বলছেন? শ্রেয়া ঠিক আছে তো!"

- "হুমম ঠিক আছে। তুমি শান্ত হও, এখনি ভেঙে পড়লে চলবে না এখনো অনেক ধাক্কা নিতে হবে।"

- "অনেক ধাক্কা মানে!"


আবির শান্তকে বিস্তারিত বলল। শান্ত নিরুত্তর ভাবে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

- "এইবার তোমার মতামত বলো।"


শান্ত সেই উত্তরটা না দিয়ে আবিরকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল,

- "আপনি শ্রেয়ার কে হন?" 

- "সেটা সময় হলেই জানবে, এখন উত্তরটা দাও।"

- "আমি আপনাকে কিভাবে বিশ্বাস করব, যে আপনি সত্যি কথা বলছেন? হতেই তো পারে আপনি মিথ্যা বলছেন!"


আবির‌ মাথা নাড়িয়ে বলল,

- "আমি তো মিথ্যা বলতেই পারি, কিন্তু তোমার মনে‌ কি প্রশ্ন জাগছে না শ্রেয়া হঠাৎ করে তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল কেন? কেন তোমাকে সবজায়গা থেকে ব্লক করে দিল?"

- "আপনি এইগুলো জানলেন কিভাবে?"

- "দেখছ তো‌ সবকিছুই জানি, তাহলে বিশ্বাস করতে পারছ না কেন? আর শ্রেয়ার নামে মিথ্যা বলে আমার লাভ কি!"

- "লাভ-লোকসন আমি জানি না। তবে শ্রেয়া যদি একটিবার আমাকে সবকিছু খুলে বলত, আমি নিজে ওকে হেল্প করতাম।"

- "তাহলে এখন করো। এখন করতে অসুবিধা আছে?"


শান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবতে লাগল, আবরার শান্তর দিকে দেখছে।ছেলেটার মধ্যে কি চলছে?


- "কি হলো? চুপ করে গেলে যে! ভালোবাসা বুঝি ফুরিয়ে গেল।"


আবিরের খোঁচা মারা কথা শুনে শান্ত মৃদু হেসে বলল,

- "আমার ভালোবাসা এতটাও তুচ্ছ নয় যে এই সামান্য কারনে ফুরিয়ে যাবে। আবার এতটাও সস্তা নয় যে কারোর অবহেলার পরেও তার কাছে বারবার ফিরে যাবো। আপনার কথাগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে আমি আমার সবটা দিয়ে শ্রেয়ার সম্মান রক্ষা করব তবে শ্রেয়া না চাইলে আমি আর ওর জীবনে আর‌ ফিরব না।যে হারাতে চাই, তাকে হারিয়ে যেতে দেওয়াটাই শ্রেয়। জোর করে আর যাইহোক ভালোবাসাটা হয় না।"


শান্তর কন্ঠে স্পস্ট অভিমান। শ্রেয়ার এড়িয়ে চলা, অকারনে ব্লক দেওয়া সবটাই বড্ড আঘাত পেয়েছে ছেলেটা। অভিমান করেছে ভালোবাসার মানুষটার উপর। অন্যদিকে, শ্রেয়া নিজের এলোমেলো জীবন নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে আসল মানুষটাকেই বড্ড আঘাত দিয়ে ফেলেছে, ফলে দুজনের মাঝে দুরত্ব তৈরি হয়েছে। আচ্ছা এই দূরত্ব কি মিটবে, নাকি অভিমানের পাল্লা ভারী হতে‌ হতে 'এক আকাশ দূরত্ব'তে পরিনত হবে!


- "তোর মাথায় কি ঘুরছে? কি করবি!"


আবরার এতক্ষনে মুখ খুলল। শান্ত আবরারের দিকে তাকিয়ে বলল,

- "আমার একজন ডিটেকটিভ ফ্রেন্ড আছে, আমি তাকে বলব ওই লোকটার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে। যদি সন্দেহজনক কিছু পায় তারপর সিদ্ধান্ত নেব।"

- "আমি কি কিছু হেল্প করব?"

- "প্রয়োজন পড়লে আমি নিজে চেয়ে নেব।"


সেদিনের কথাবার্তা এইখানেই শেষ হয়। আবির-আবরার, নাজিয়া বাড়ি ফিরে আসে, শান্ত তখনও জানে না ওদের আসল পরিচয়। শ্রেয়ার সাথে ওদের কি সম্পর্ক। অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিচ্ছে কিন্তু তার উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। শান্ত ডিটেকটিভ বন্ধুকে ফোন করে শ্রেয়ার অফিসের বসের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলল, ওই লোকটার চরিত্র জানলেই সবকিছু পরিস্কার হয়ে যাবে।


***


শান্ত একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে চলেছে, সাধারনত ওহ স্মোক করে না মাঝেমধ্যে বন্ধুদের তালে পড়ে একটান দিয়ে দেয়, কিন্তু শ্রেয়ার বিষয়টি জানার পর থেকে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা তার মাঝে পড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, আর ততই শ্রেয়ার উপরে রাগ-অভিমান তীব্রতর হয়ে উঠছে। মেয়েটা একটাবার ওকে সবকিছু খুলে বলতে তো‌ পারত, কিন্তু কেন বলল না!  কেন এইভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল!


শান্তর ফোন বেজে উঠল, স্কিনে আবরারের নামটা ভেসে উঠেছে। কফিশপে বসে দুজন দুজনের নম্বর আদানপ্রদান করেছিল।


- "হ্যালো বল।"

- "কি করছিস?"


শান্ত সিগারেটে একটান দিয়ে বলল,

- "সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছি।"

- "কবে থেকে ধরলি?"

- "আজ থেকে।"


আবরার শয়তানি করে বলল,

- "বউয়ের মার খাবার জন্য রেডি থাকিস। শ্রেয়া কিন্তু স্মোক করা ছেলেদের একদম পছন্দ করে না।"


প্রথম কথাতে শান্ত হেসে উঠলেও দ্বিতীয় কথাটাতে ভ্রু কুঁচকে বলল,

- "তুই কিভাবে জানলি শ্রেয়া স্মোক করা পছন্দ করে না।"


আবরার আমতা আমতা করে বলল,

- "আরে ভাই বেশিরভাগ মেয়েরা তো স্মোক করা পছন্দ করে না, তাই বললাম। আচ্ছা বল কি জানতে পারলি।"

- "আপাতত কিছু খবর পায়নি। খোঁজ চালাচ্ছে, দেখা যাক কি খবর পায়‌।"

- "একটা প্রশ্ন ছিল।"

- "কি বল।"

- "তুই তো চাইলেই বিষয়টা খতিয়ে না দেখে লোকটার কথা বিশ্বাস করে কোনো স্টেপ নিতে পারতিস? কিন্তু সেটা না‌ করে এইসব করছিস কেন?"


শান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

- "এযুগে দাঁড়িয়ে কাউকে বিশ্বাস করা মানেই বোকামি। আমি তো নিজেকেই নিজে বিশ্বাস করি না আর অন্য কাউকে তো দূর। ঘটনাটা যদি আমি সরাসরি শ্রেয়ার মুখ থেকে শুনতাম, তাহলে আমার এতটা খতিয়ে দেখার দরকার ছিল না। কিন্তু শুনেছি কোথা থেকে? একজন অচেনা মানুষের কাছ থেকে, যে আদৌও সত্যি বলছে কিনা সেটাও জানি না। এমনকি মানুষটা কে! শ্রেয়ার কে হয়, বিষয়টা কিভাবে জানল সেইসবের কিছুই জানি না। তার কথা বিশ্বাস করে, একজন প্রভাবশালী মানুষের সাথে ঝামেলা করতে যাওয়া মানে বোকামী।তাই আগে সবটা জানব, তারপর ভাবব কি করব।"


- "এখন শ্রেয়া যদি নিজের মুখে সবটা বলে আর তোকে বিয়ে করতে চায় তো?"


#চলবে....


ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।


গল্পে সবাইকে রেসপন্স করার অনুরোধ রইল, গল্পের রিচ আগের তুলনায় অনেকটা কমে গেছে, প্লিজ সবাই রেসপন্স করবেন।



গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ১৮

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (১৮)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


নাজিয়া আবরারকে সবকিছু খুলে বলল, সবটা শুনে আবরার প্রচন্ড রেগে যায়। শ্রেয়াকে সববসময়ে বোনের নজরে দেখেই বড়ো হয়েছে, শুধুমাত্র মাঝের কয়েকটা বছর বিয়ের কথা উঠাতে আবরার শ্রেয়াকে এড়িয়ে চলত। 


আবরারকে উত্তেজিত হয়ে পড়তে দেখে নাজিয়া বলল,

- "মাথা গরম করলে কিছুই হবে না। আমাদেরকে খুব শান্ত মাথাতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।"

- "কিন্তু আমি যে শান্ত হতে পারছি না। একটা মানুষ এতটা নীচ কিভাবে হয়?"

- "দুনিয়ার সবার মানসিকতা এক হলে তো‌ হয়েই যেত। বাদ দাও সে তার হিসাব দেবে, এখন আমাদেরকে ভাবতে হবে কিভাবে শ্রেয়া'দির ভিডিওটা ডিলিট করা যায়।"

- "দাদাকে সবটা বলি, তারপর সবাই মিলে একসাথে বসে আলোচনা করব।"

- "হুমম সেটাই ভালো হবে।আর শোন তোমাকে আর একটা কাজ করতে হবে।"

- "কি কাজ?"

- "শ্রেয়া'দির বয়ফ্রেন্ড শান্তের সাথে মিট করতে হবে, আমার মনে হয় ওর সবটা জানা জরুরী।"

- "হুমম, আমারও তাই মনে হয়। তবে সেইসব হবে তার আগে দাদাকে সবটা বলতে হবে।"

- "হুমম।"


***


নাজিয়া প্রানকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আবিরের রুমের দিকে পা বাড়াল। আবরার সেখানেই আছে, দুই ভাইয়ে আলোচনা করছে কিভাবে কি করা যায়। 


- "আসবো?"

- "আয়।" (আবির)

- "কি সিদ্ধান্ত হলো? কিভাবে অই করবে?"

- "সেটাই তো বুঝতে পারছি না, একজন এতবড়ো বিজনেসের সাথে আমরা সাধারন মানুষ পেরে উঠব কিভাবে?"

- "সবটা বুঝতে পারছি কিন্তু কিছু না করলে তো শ্রেয়া'দির জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।"


আবির -আবরার প্রচন্ড চিন্তিত। কিভাবে কি করা যায় সেটাই ভেবে পাচ্ছে না।আইনি ব্যবস্থা নিয়েও কোন লাভ নেয়, ওদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমানে কোনো প্রমান নেয় আর বিষয়টা জানাজানি হলে শ্রেয়ার নামে বদনাম রটে যাবে তাই বিষযটাকে কোনো ভাবেই আইনি আওতায় আনা যাবে না। নাজিয়া ওদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল,

- "আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে।"

- "কি প্ল্যান?"

- "শ্রেয়া'দি লোকটার সাথে ক্লোজড হয়ে যদি ভিডিওগুলো ডিলিট করে দেয় তো।ক্লোজড মানে বলতে চাইছি, রিলেশনশিপে গিয়ে।"

- "সেটা মনে‌ হয় না হবে, এমনিতেই শ্রেয়া যে পরিমান ভেঙে পড়েছে তাতে কিছুতেই এতটা নাটক করতে পারবে না। আর লোকটা শ্রেয়ার সাথে রুমডেট করতে চাইছে, শ্রেয়া ওর ক্লোজ হওয়া মানে সে রুমডেট করতে চাইবে।"


আবার সমস্যা! কিছুতেই মাথা থেকে বের হচ্ছে না উপায়গুলো। 


নাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

- "একটার পর একটা সমস্যা এসেই চলেছে, কিভাবে কি করব বলো তো! আচ্ছা শান্ত'দার সাথে যোগাযোগ করার কথা কি ভাবলে?"

- "নাজু তুই যেভাবেই হোক শ্রেয়ার ফোন থেকে শান্তর নম্বরটা জোগাড় কর, তারপর আমরা ওর সাথে বলছি।ওহ জানুক সবটা, তারপর কি করবে সেটা ওর ব্যাপার।"

- "ছেলেটা যদি সত্যি শ্রেয়াকে ভালোবেসে থাকে, তাহলে ওর‌ বিপদে হাতটা ঠিকই ধরবে।" (আবরার)


---


২দিন কেটে যায়, এখনো কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটার পর একটা প্ল্যান করছে কিন্তু সেখানে যেকোন একটা সমস্যা হাজির হয়ে যাচ্ছে। আজ শান্তের সাথে মিট করার কথা, নাজিয়া শপিং করতে যাবার নাম করে আবরারের সাথে বেরিয়েছে, আবির অফিস থেকে আসবে। আর প্রান বাড়িতেই আছে শ্রেয়ার কাছে। 


- "কি হলো এতো টেনশান করছ কেন?"

- "শান্ত বলে ছেলেটা যদি সবটা জানার পর শ্রেয়াকে ভুল বোঝে?"

- "এত টেনশান করার কিছু নেয়, এতে কিছু খারাপ হবে না উল্টো ভালো হবে। শ্রেয়ার জন্য ছেলেটা কতটুকু যোগ্য সেটা আমরা বুঝতে পারব,বুঝলে।"

- "হু।"


আবরার নাজিয়া কফিশপে এসে দেখল শান্ত অলরেডি চলে এসেছে। নাজিয়া শান্তকে না চিনলেও আবরার কোনো ভাবে চিনত, তাই ওর কোনো অসুবিধা হয়নি।


- "এক্সকিউজ মি।"


চেনা কন্ঠস্বর শুনে শান্ত মাথা তুলে তাকাল। সামনের মানুষটিকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না, বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরল।


- "হোয়াটস এ সারপ্রাইজ ব্রো। কতদিন পর তোর সাথে দেখা হলো, কেমন আছিস?"


আবরার হেসে ফেলল শান্তর উত্তেজনা দেখে।


- "আরে ভাই আসতে। এত তাড়াতাড়ি বললে উত্তর দেব কিভাবে?"

- "তোকে এতদিন পর দেখলাম, কি যে আনন্দ লাগছে বোঝাতে পারব না।"


আবরার শয়তানি হেসে বলল, 

- "মেয়েদের মতো আচরন করছিস কেন? আবার...


শান্ত আবরারের পিঠে দুটো কিল বসিয়ে দিল। তারপর দুই বন্ধু মিলে হেসে উঠল, নাজিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কান্ড দেখে চলেছে ছেলেটা কে সেটা এখনো বুঝতে পারছে না।


শান্তর চোখ পড়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাজিয়ার দিকে। বন্ধুকে খোঁচা দিয়ে বলল,

- "কিরে গার্লফ্রেন্ড নাকি?"


আবরার নাজিয়ার দিএক তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল,

- "নাহ আমার বিয়ে করা একমাত্র বউ নাজিয়া।

- "তুই বিয়েও করে নিলি?"

- "হুমম। তোর তো পাত্তাই নেয়, সেই যে উচ্চমাধ্যমিকের পর হারালি কত খুঁজলাম তবুও তোকে পেলাম না।"

- "বাবা বদলি হয়ে চলে গেলেন, সেখানে গিয়ে নতুন পরিবেশ, সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে নিতেই বছর কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।"

- "বাড়ির সব কেমন আছে?"

- "মা মোটামুটি ভালোই আছে, আর বাবা ২বছর আগে মারা গেছেন। এখন সব দায়িত্ব আমার উপরে, সবকিছুর মধ্যে পুরানো আমিটাকে আর খুঁজে পাইনা।"


বাবার মৃত্যুর খবর শুনে আবরারের মনটা খারাপ হয়ে যায়, 

- "সরি ভাই, আমি বুঝতে পারিনি।"

- "আরে কিছু না বাদ দে তো। তোর খবর বল কেমন আছে সব।"

- "চলছে আলহামদুলিল্লাহ ভালোই।"

- "আচ্ছা তোরা একটু বস, আমি একজনকে কল করে মিটিং-টা ক্যানসিল করে দিচ্ছি। তারপর তোদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেব।"

- "ওকে।"


শান্ত ফোনটা নিয়ে সাইডে চলে গেল, নাজিয়া আবরারকে জিজ্ঞেস করল,

- "কে ছেলেটা?"

- "শান্ত।"

- "কে শান্ত? 

হঠাৎ করেই নাজিয়ার মনে পড়ে যায় শ্রেয়ার বয়ফ্রেন্ডের নামও শান্ত তারমানে কি এই সে? নাজিয়া আবরারের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে ওহ ইশারা করে বোঝাল ওর আন্দাজটাই সঠিক।


- "তুমি আগে থেকে জানতে?"

- "আমাদের বিয়ের কিছুদিন আগেই জেনেছিলাম সবটা। শান্তর সাথে যোগাযোগ করার আগেই সবটা এলোমেলো হয়ে যায়।"


নাজিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগে শান্ত সেখানে চলে আসে। 


- "তো কি খাবি বল?"

- "কফি ঠিক আছে।"

- "আর কিছু!"

- "নাহ।"

- "আর ভাবি?"

- "আমার কোল্ড কফি।"

- "ওকে।"


শান্ত ওয়েটারকে ডেকে দুটো হট কফি আর একটা কোল্ড কফি অর্ডার দিল। নাজিয়া শান্তকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কিন্তু আবরার ইশারায় থামিয়ে দিল।


আবরার শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল,

- "তুই এখানে কি করছিস?"

- "আসলে বিষয়টা একটুখানি গন্ডগোলের।"

- "কেন?"

- "কালকে একজন হুট করে ফোন করে দেখা করতে চাইল, প্রথম আমি না করে দিয়েছিলাম পরে অনেক ভেবে রাজি হয়েছি।"

- "তা দেখা করবি না?"

- "পরে করব, তোর সাথে কতদিন পর দেখা হয়েছে আমার। এখন আড্ডা দেব শুধু।"


আবরার মৃদু হাসল, ছেলেটা এখনো বদলানো না।আবির আবরারকে ফোন করছে, শান্ত যে দেখা করাটা ক্যানসিল করে দিয়েছে এটাতে বেজায় ক্ষেপে গেছে আবির।


আবরার ফোনটা রিসিভ করে শুধুমাত্র একটা কথাই বলল,

- "কফিশপে চলে আসো, ফাস্ট।"


বিষয়টা আবির বুঝল না, কিন্তু যখন ডাকছে তখন তো যেতে হবে। আবির কফিশপের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।


আবরার শান্তকে ইচ্ছাকৃত খোঁচা দিয়ে বলল,

- "তাহলে তুই বিয়ে করবি কবে?"

- "আর বিয়ে!"


শান্তর কন্ঠে স্পষ্ট তাচ্ছিল্য। আবরার ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

- "কেন? কি হযেছে?"

- "একজনকে ভালোবাসলাম কিন্তু সে হঠাৎ করেই কিছু না বলে সবজায়গা থেকে আমাকে ব্লক করে দিয়েছে।"

- "মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজ নিসনি? জানতে চাসনি মেয়েটা কেন এইরকম করল?"

- "অনেকবার ফোনে ট্রাই করেছি, অন্য নম্বর দিয়েও কর করেছি। দেখা করার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু দেখা পায়নি। এই কয়েকটা দিন আমার যে কিভাবে কাটছে আমিই জানি।"

- "যদি শুনিস মেয়েটা আর এই পৃথিবীতে নেয় বা মৃ-ত্যুর পাথে লড়াই করছে তখন কি করবি?"


শান্ত আঁতকে উঠল, করুন কন্ঠে বলল,

- "ভাই প্লিজ এইসব বলিস না।ওর কোনো ক্ষতি আমি সহ্য করতে পারব না, সে আমার না হলেও ভালো থাকুক। প্রয়োজনে আমার আয়ু ওর হোক।"


আবরার মৃদু হেসে নাজিয়ার দিকে তাকাল, নাজিয়াও আবরারের দিকে তাকাল। দুজনে স্পষ্ট শান্তর চোখে খাঁটি ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু সবটা জানার পর ভালোবাসা'টা থাকবে তো?


#চলবে....


ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।



গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ১৭

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (১৭)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


- "আমি সে'ক্সুয়াল হ্যারাস-মেন্টের শিকার।"


নাজিয়া চমকে উঠল, শ্রেয়া এইসব কি বলছে? শ্রেয়ার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি গড়িয়ে পড়ছে, ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না কান্নার কারনে। 


- "কে করেছে এইসব? একটাবার তার নামটা বলো। তোমার বয়ফ্রেন্ড নয় তো?"


শ্রেয়া নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল,

- "শাহ শান্ত এইসবের কিছুই জানে না।"

- "তাহলে?"

- "আমার অফিসের বস।"


পড়াশোনা শেষ করার পর শ্রেয়া একটা কোম্পানিতে চাকরি করতে শুরু করে, প্রথম প্রথম পার্ট টাইম করলেও এখন ফুল-টাইম জব করে। আর বর্তমানে সেই অফিসেরই এমডির পার্সোনাল সেক্রেটারী হিসাবে জব করে।নাজিয়া কিছুই বুঝতে পারছে না, সবকিছু মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। অধৈর্য হয়ে শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করল,


- "শ্রেয়া'দি প্লিজ সবটা খুলে বলো।"

- "আমাদের যিনি এমডি স্যার উনি আমাকে পছন্দ করতেন, আমাকে প্রোপজও করছিলেন কিন্তু আমি সরাসরি না বলে দিই এমনিতেই আবরারের সাথে আমার বিয়ের কথাটা শোনার পর থেকে অস্থির ছিলাম শান্তর কথা বাড়িতে কিভাবে বলব সবকিছু নিয়ে ঝামেলার মধ্যে ছিলাম আর সেইদিন স্যার আবারো আমাকে প্রোপজ করেন এবং আমি না বলাতে অসভ্যতামি করার চেষ্টা করেন আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে একটা থাপ্পর দিয়ে দিই আর সেইটাই আমার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল।"

- "ঠিক করছ থাপ্পর দিয়েছ, আমি হলে আরো দু -চারটে দিয়ে দিতাম।"

- "মারতে পারলে তো আমিও অনেক আগেই দিতাম। কিন্তু আমি যে নিরুপমা, ওই শয়তান গোপনে আমার কিছু ভিডিও করেছে।"


শ্রেয়া আবারো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, নাজিয়ার মনে প্রশ্ন জাগল। ভিডিও! কিন্তু কিভাবে? 


- "শ্রেয়া'দি শান্ত হও, প্লিজ।"


শ্রেয়া নিজের কান্না থামানোর পর নাজিয়া বলল,

- "তোমার অফিসের বস তোমার ভিডিও করেছে? কিন্তু কিভাবে?"

- "একদিন আমাদের অফিসে একটা পার্টির আয়োজন করা হয়, সেইখানে আমরা সবাই ঠিক করি অফিস শেষ করার, অফিসের ওয়াশরুমেই চেঞ্জ করে রেডি হয়ে নেব। আর সেইদিনই আমার চেঞ্জের ভিডিও করে নেয় শয়তানটা।"

- "এইসব কবে হয়েছে?"

- "অনেকদিন আগে কিন্তু আমি এখান থেকে যাবার পর জানতে পারি বিষয়টা। ওই শয়তানটা আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে যদি ওর কথা শুনে ওর সাথে রাত না কাটায় তাহলে আমার ভিডিওটা ভাইরাল করে দেবে।আমাকে কয়েকবার বাজে ভাবে স্পর্শ করেছে, আমি ওর ভয়েই অফিস বন্ধ করে দিয়েছিলাম কিন্তু তারপরেও আমার পিছু ছাড়ছে না, ফোন মেসেজ করে রুমডেট করার কথা বলছে। আমি সবকিছু সহ্য করতে না পেরে সুই'সাইড করার চেষ্টা করি।"


শ্রেয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, একজন মেয়ের কাছে তার সম্মানটাই আগে। সেইখানে এইভাবে হ্যারাস-মেন্টের শিকার হতে এলে তার মন- মানসিকতার কি অবস্থা হয় সেটা একমাত্র সেই জানে। প্রতিটা ক্ষন নিজের সাথে লড়াই করছে, নিজেকে বড্ড তুচ্ছ মনে হচ্ছে।

 

অন্যদিকে, সবটা শোনার পর নাজিয়ার রাগে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে। একজন অফিসের মালিক যদি এইরকম কাজ করে তাহলে মহিলা কর্মী'রা কিভাবে কাজ করবে? এর একটা বিহিত করা দরকার।


- "শ্রেয়া'দি তুমি চিন্তা করো না, ওই শয়তানকে আমি উচিত শিক্ষা দেবোই।"

- "কিন্তু নাজিয়া তুমি কিভাবে লড়াই করবে ওই লোকটার সাথে? ওরা অনেক ধনী, সমাজ ওদের কেই বিশ্বাস করবে আমাদের মতো সাধারন মানুষকে কেউ পাত্তাই দেবে না।"


শ্রেয়ার কথাতে নাজিয়াও চিন্তিত হলো, সত্যি তো ওহ একজন সাধারন মেয়ে হয়ে কিভাবে এত ধনী একজন ব্যবসায়ীকে শাস্তি দেবে! আমাদের সমাজের বহু প্রভাবশালী মানুষ আছে, যারা অন্যায় করেও কোনোপ্রকার শাস্তি না পেয়েই রাজার হালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখনো বহু জায়গায়, বহু ক্ষেত্রে নারীদের সে'ক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে হয়। লড়াই ও ন্যায় চাইতে গেলেই হয় অকালে প্রা'ন হারাতে হয়, নাহয় আবারো নির্যাতিত হতে হয়।আমরা শুধুমাত্র মুখেই বলি আমরা উন্নত হয়েছি, সমাজ উন্নত হয়েছে। কিন্তু আদৌও কি সেইসব কিছু হয়েছে! বর্তমানে রাস্তা-ঘাট, অফিস-কলেজ কোথাও মেয়েরা সেফ না, সুযোগ পেলেই কিছু নোংরা মানসিকতার মানুষ ফায়দা লুটে নিতে চাই। 


শ্রেয়া হতাশ কন্ঠে বলল,


- "নাজিয়া আমরা কখনোই ওদের সাথে পারব না, ওরা ধনী, অর্থ আছে। ওরা হাজার একটা অন্যায় করলেও কেউ কিছু বলতে পারবে না, কেউ কিছু বলতে গেলেই হয় প্রা'ন হারাবে না হয় টাকার নিচে ন্যায় চাপা পড়ে যাবে।"

- "আমি সবটা বুঝতে পারছি। কিন্তু ওই লোকটার কাছ থেকে ভিডিওটা ডিলিট করা জরুরি।"

- "কিন্তু কিভাবে করবে?"

- "তুমি চিন্তা করো না, আমরা ঠিক একটা না একটা ব্যবস্থা করেই ফেলব।"


শ্রেয়া হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল, নাজিয়াকে বিশ্বাস করতে মন চাইছে কিন্তু মস্তিস্ক বলছে কিছু লাভ নেই।কি হবে? কিভাবে ভিডিওটা ডিলিট করাবে? কিভাবেই বা শ্রেয়া আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে?


নাজিয়া চলে যাবে বলে পা বাড়াচ্ছিল হঠাৎ একটা কথা মধে পড়ে যাওয়াতে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,

- "শ্রেয়া'দি শান্ত'দা কি সবটা জানে?"

- "নাহ। আমি চাই না আমার অভিশপ্ত জীবনের সাথে ওর জীবনটা জুড়ে যাক তাই ওকে সব জায়গা থেকে ব্লক দিয়েছি আর সম্পর্কটাও শেষ করে দিয়েছি।"


শ্রেয়া কথাগুলো শান্ত গলাতে বললেও কথাগুলোর মধ্যে অনেক চাঁপা কষ্ট লুকিয়ে আছে। নিজের জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে বলে ভালোবাসার মানুষটির হাতটাই ছেড়ে দিচ্ছে এইটা কি কম বড়ো ত্যাগ!


- "পাগল হয়ে গেছ তুমি? শুধুমাত্র ওই কারনে সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছ?"

- "তো কি করব? আমি ভালো করেই বুঝে গেছি ওই লোকটা আমাকে বাঁচতে দেবে না, এক আমাকে যেভাবেই হোক ভোগ করবে আর না হলে দুনিয়া থেকেই আমার নামটা মুছে দেবে। এই পরিস্থিতিতে আমি কিভাবে একটা সহজ সাধারন ছেলেকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে ছেলেটার জীবনটাকে শেষ করে দেব?"

- "শ্রেয়া'দি আবেগ দিয়ে বিচার করো না, এমনও তো হতে পারে সবটা শোনার পর সে তোমাকে হেল্প করছে?"

- "আমি কিভাবে শান্তকে কথাগুলো বলব বলতে পারো! সেইদিনের পর থেকে ওর সাথে কথা বলতে আমার লজ্জা লাগছে, নিজেকে বড্ড ছোট ছোট লাগছে। তাই সম্পর্কটা শেষ করে দিয়েছি।"


শ্রেয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়েই চলেছে। একদিকে নিজের ওহ নিজের পরিবারের মানসম্মান আর অন্যদিকে নিজের ভালোবাসা সবকিছু নিয়ে ডিপ্রশনে চলে যাচ্ছে শ্রেয়া আর তার ফলশ্রুতি সুই'সাইড করার চেষ্টা।


নাজিয়া কি বলে শ্রেয়াকে শান্তনা দেবে বুঝতে পারল না, শ্রেয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সবকিছু শোনার পর ওর নিজেরই অসহায় লাগছে, কিভাবে কি করবে সেটাই বুঝতে পারছে না আর সেখানে সবকিছুর শিকার হয়ে শ্রেয়ার কি অবস্থা!


আত্মহত্যা মানুষ এমনি এমনি করে নাহ, যখন সবকিছু হাতের বাইরে চলে যায়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, অসহায়ত্ব ঘিরে ধরে তখনই মানুষ আ'ত্মহ'ত্যা'কে বেছে নেয়। তবুও বলব, আ'ত্মহ'ত্যা কখনোই কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না।লড়াই করে বেঁচে থাকার নামই হলো জীবন, প্রতিটা মূহুর্তে লড়াই করতে হবে, সামনে এগিয়ে যেতে হবে।


নাজিয়া কি পারবে শ্রেয়াকে সঠিক বিচার পাইয়ে দিতে? অন্যায়-কারীকে শাস্তি দিতে!


#চলবে...


ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।



গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ১৬

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (১৬)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


শ্রেয়ার সুই-সাইড করার খবর তড়িৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েটা হঠাৎ করেই এইরকম সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছে, সেটাই কেউ বুঝতে পারছে না। 


আবির ও আবরার খবর পাওয়া মাত্রই রওনা দিয়েছে, নাজিয়াও যেতে চাইছিল কিন্তু প্রানকে নিয়ে এতটা পথ জার্নি করা সম্ভব না তাই যেতে পারেনি। আবিরের মা কান্নাকাটি করছেন, উনি শ্রেয়াকে নিজের মতো ভালোবাসেন তার এইরকম কথা শুনে প্রচন্ড ভেঙে পড়েছেন। নাজিয়া ওনাকে সামলাচ্ছে।


আবির ও আবরার শ্রেয়ার বাবা-ভাইয়ের সাথে কথা বলে জানতে পারল কিছুদিন থেকেই শ্রেয়ার মন খারাপ ছিল, সারাদিন মনমরা করে বসে থাকত কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলত না।কাল রাত্রিরে কিছু না খেয়েই নিজের ঘরে দরজা আটকে দিয়েছিল, পাশেই ওর ছোটভাইয়ের রুম। সে ঘর থেকে চাঁপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই সাথে কিছু একটা পড়ে যাবার আওয়াজ পেয়ে শ্রেয়ার ঘরের দরজায় টোকা মারে। অনেকক্ষণ হয়ে যাবার পরেও দরজা না খুললে সন্দেহ হয়, বাবা মাকে ডেকে দরজা ভাঙার পর দেখা যায় শ্রেয়া ঘুমের ওষুধ সাথে আরো অনেককিছুর ট্যাবলেট খেয়ে সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। তড়িঘড়ি করে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়, ডাক্তাররা ওয়াশ করে ওষুধ গুলো বার করে দিয়েছে এখন শ্রেয়া কিছুটা স্বাভাবিক।


শ্রেয়ার জ্ঞান ফিরেছে। আবরার ওর সাথে একা দেখা করতে চাই, সব কথা শুনে ও আন্দাজ করতে পারছে কেন শ্রেয়া এই কাজটা করেছে। 


আবরার শ্রেয়ার পাশে বসে বলল,

- "শ্রেয়া।"


শ্রেয়া কোনো উত্তর দিলো না, আবরার শ্রেয়ার কপালে হাত বুলিয়ে বলল,

- "কিরে কথা বলবি না আমার সাথে?" আচ্ছা তুই এতবড়ো সিদ্ধান্ত কিভাবে নিলি বল তো? একটাবার নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করলি না।"


শ্রেয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আবরার শ্রেয়ার মাথাতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

- "সুই-সাইড করতে গিয়েছিলিস! জানিস না আত্মহ'ত্যা মহা পা-প।"

- "তো কি করতাম আমি!"


শ্রেয়া কেঁদে উঠল। নিজের মনের কষ্টগুলোকে নিজের মধ্যে রাখতে রাখতে হাঁপিয়ে উঠেছে, আর পারছে না।

- "শ্রেয়া কি হয়েছে বোন আমার সবকিছু আমাকে বল।"


শ্রেয়া নিজেকে সামলে নিল, চোখের পানিটা মুছে নিয়ে বলল,

- "আমার কিছু হয়নি আমি ঠিক আছি। তুমি যাও।"


তারপরেও আবরার শ্রেয়াকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করল কিন্তু ওহ উত্তর দিল না। আবরার ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। কেবিনের বাইরে আসতেই আবির জিজ্ঞেস করল,

- "কিরে কিছু জানতে পারলি?"

আবরার ঘাড় নাড়িয়ে না বলল, আবির হতাশা হল। পরক্ষনেই কিছু একটা মনে পরতেই বলল,

- "একজনই পারবে শ্রেয়ার কাছ থেকে সত্যিটা জানতে।"

- "কে?"

- "নাজিয়া।"

- "কিন্তু ওহ কিভাবে আসবে?"

- "সেইসব চিন্তা তুই করিস না, আমি সবটা দেখছি।"


আবির কথাটা বলে চলে গেল, আবরার নাজিয়াকে ফোন করে এদিকের খবর দিল। বাড়িতে সবাই চিন্তা করছিল শ্রেয়াকে নিয়ে, শ্রেয়া ঠিক আছে এইটা জানার পর সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।


- "মামনি শ্রেয়ার জ্ঞান ফিরেছে, এখন ওহ ঠিক আছে।"

- "যাক আলহামদুলিল্লাহ ভালো। কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ করে এইরকম করল কেন বলত?"

- "জানি না, কিছুই বুঝতে পারছি না।"


সবার মনেই একটা প্রশ্ন শ্রেয়া ঠিক কি কারনে এতবড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল?


----


আবির ওর‌ মামাকে বুঝিয়ে শ্রেয়াকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য রাজি করিয়েছে। যদিও এইটার জন্য ওকে কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি, শ্রেয়ার বাবা এই অবস্থায় মেয়েকে অন্য কোথাও পাঠাতে রাজি নয় আর আবিরও কিছুতেই ছাড়বে না। ওহ শ্রেয়াকে নিয়ে তবেই যাবে, এই সময়ে শ্রেয়াকে একা থাকতে দেওয়া মানেই বিপদ। আর তার থেকেও বড়ো কথা, শ্রেয়ার হঠাৎ এইরকম কাজের কারন কি সেইটা জানতে হবে।


৩দিন পর, 

আজ আবির ও আবরার শ্রেয়াকে নিয়ে ওদের বাড়িতে ফিরছে। শ্রেয়ার বোন আসার কথা ছিল কিন্তু ওর‌ পরীক্ষা তাই আসতে পারেনি শ্রেয়া একাই যাচ্ছে।


শ্রেয়া আগের থেকে একদম চুপচাপ হয়ে গেছে, কারোর সাথেই কথা বলছে না। আবির আর আবরার ওকে হাসানোর অনেক চেষ্টা করে চলেছে, কিন্তু ওহ হাসছে না। 'যার মনেই সুখ নেই তার মুখে কি হাসি আসে?' 


শ্রেয়াকে দেখা মাত্রই আবিরের মা আদরে আদরে ভরিয়ে দিলেন, মেয়েটা সবেমাত্র মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে এটা কি কম বড়ো কথা। 


- "শ্রেয়া মা তুই ঠিক আছিস তো?"


শ্রেয়া মেকি হেসে বলল,

- "চলছে।"


নাজিয়া দাঁড়িয়ে শ্রেয়াকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে, মেয়েটার মুখে সেই আগের মতো চাঞ্চল্যতা, লাবন্য কোনটাই নেয়। কিরকম একটা শুকিয়ে গেছে, কিন্তু কেন?


শ্রেয়াকে রেস্ট নিতে বলে নাজিয়া নিজেদের ঘরে আসতেই আবরার পেছন দিক থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে নাক ঘষলো। 


- "ছাড়ো, ফ্রেশ হবে তো।"

- "হবো, কিন্তু আগে মাইন্ড ফ্রেশ করি।"

- "এইভাবে কে মাইন্ড ফ্রেশ করে?"

- "আমি করি। কারন তুমি আমার মানসিক শান্তি, তোমাকে জড়িয়ে ধরলে যে পরিমান শান্তি লাগে আর অন্য কিছুতে লাগে না। (নাজিয়ার কাধে হালকা দাঁত বসিয়ে বলল, 'বুঝলে বউ।"


- "আহ্, লাগল তো।"

আবরার শয়তানি হেসে বলল, 

- "এতেই লাগছে!!"

- "দিনকে দিন শয়তান হয়ে যাচ্ছো। যাও ফ্রেশ হমে আসো, আমি খাবারের ব্যবস্থা করি।"

- "শ্রেয়া কোথায়?"

- "রুমে আছে।"

- "ওর দিকে একটু খেয়াল রেখ, আর তোমাকেই কিন্তু ওর মুখ থেকে সত্যিটা জানতে হবে।"

- "কিন্তু আমি কি পারব!"

- "পারতে তোমাকে হবেই।একটা মানুষের কথাবার্তা, ব্যবহার দিয়ে অন্য মানুষের ভেতরকার সবকিছুই জানা যায়, তুমি ওর‌সাথে আগের মতো বন্ধুর মতো মেশো দেখবে ওহ ঠিক বলবে।"

- "শ্রেয়া 'দি আগের থেকে বদলে গেছে।"

- "হুমম, সময় ও পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়।"

- "হুম।"


---


আজ শ্রেয়ার এই বাড়িতে আসার দুইদিন, নাজিয়া সবসময়ে ওর কাছে কাছেই থাকে। গল্প করে কিন্তু এইসব বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারে না, মেয়েটা আবারো যদি ডিপ্রেশনে চলে গিয়ে কিছু করে ফেলে তো তখন হিতে-বিপরীত হয়ে যাবে। কিন্তু আর কতদিনই বা এইভাবে চলবে? নাজিয়া ঠিক করল আজকে যেভাবেই হোক শ্রেয়ার কাছ থেকে সত্যিটা জানবে।


নাজিয়া শ্রেয়ার রুমের দরজায় নক করল, শ্রেয়া বারান্দায় বসে আপন-মনে কি ভেবে চলেছে। দরজায় টোকা মারার শব্দ ওর কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি।নাজিয়া দরজাটা ঠেল দিয়ে দেখল খোলা আছে, ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকে দেখল শ্রেয়া বারান্দায় বসে আছে। নাজিয়া শ্রেয়ার পাশে‌ বসে বলল,

- "শ্রেয়া 'দি।"


আচমকা ডাকে শ্রেয়া থতমত খেয়ে যায়, পাশে তাকিয়ে দেখল নাজিয়া বসে আছে ওর পাশে।


শ্রেয়া মেকি হেসে বলল,

- "তুমি কখন আসলে?"


নাজিয়া শ্রেয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টে প্রশ্ন করল, - "কাঁদছ কেন?"


শ্রেয়া নিজের চোখে হাত দিয়ে দেখল পানি, পুরানো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের কোনে পানি জমা হয়েছে সেটা বুঝতে পারেনি। চোখটা ভালো করে মুছে নিয়ে বলল,

- "কই কাঁদি'নি তো। অনেকক্ষণ এইদিকে তাকিয়ে ছিলাম তাই হয়তো।"

- "আমার কাছে মিথ্যা বলে লাভ নেই, আযি জানি তোমার বড়ো কিছু একটা হয়েছে, নাহলে এতবড়ো একটা সিদ্ধান্ত তুমি নিতে না।"


শ্রেয়া চুপ করে আছে। নাজিয়া আবারো বলতে শুরু করল,

- "শ্রেয়া 'দি নিজের মনের কথাগুলো, কষ্টগুলো আমার সাথে শেয়ার করো দেখবে হালকা লাগবে।"


শ্রেয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরল। শ্রেয়া কেঁদেই চলেছে নাজিয়া ওকে শান্তনা দিচ্ছে নানান ভাবে, 


- "শ্রেয়া'দি বলো কে কি বলেছে, কি হয়েছে কেন তুমি সুই-সাইড করার মতো এতটা নিকৃ'ষ্ট কাজের সিদ্ধান্ত নিলে? বলো আমাকে...


শ্রেয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,

- "আমি সে'ক্সুয়াল হ্যারাস-মেন্টের‌ শিকার।"


#চলবে.....


ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।



গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ১৫

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (১৫)

#তানজিলা_খাতুন_তানু


"আমি এই বিয়ে মানি না।"


আবরারের কথাতে সবাই চমকে উঠল, কমবেশি সকলেই জেনে গেছে আবরার নাজিয়াকে ভালোবাসে তাই চমকানোর মাত্রাটা একটু বেশিই ছিল।


আবির আবরারকে ধমক দিয়ে বলল,

- "এখন ঝামেলা না করে সাইনটা করে দে।পরে বসে সবকিছু ঠিকঠাক করা হবে।"

- "কখনোই না"


আবির বিরক্ত হয়ে বলল,

- "বাচ্চাদের মতো কি শুরু করেছিস বল‌ তো! বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছে, ইসলাম মতে নাজু আর তুই স্বামী-স্ত্রী তাহলে সামাজিক বৈধতা দিতে এতটা নাটক করছিস কেন?"

- "এই বিয়েতে আমার অনুমতি নিয়েছ?"


সকলের মুখটা থমথমে হয়ে যায়। আবরার সকলের দিকে তাকিয়ে বলল,

- "তোমরা অই কেউ একটাবার আমার দিকটা ভেবে দেখছ! অন্য কারোর‌ সাথে বিয়ে হবে ভেবে আমার কি অনুভূতি হয়েছে, সেটা কি কেউ একটাবার ভেবেছ? এতটা নাটক আমার সাথে না করলেও পারতে।"


আবরার রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে দিয়ে চলে গেল, বসার ঘরের সকলের মুখ থমথমে হয়ে আছে। আবির মনে মনে অনুশোচনা করল, ছেলেটাকে এতটা ট্রেস না দিলেও হতো। আবির নাজিয়ার কাছে গিয়ে চাপা স্বরে  বলল,

- "যা রগচটা বর'টার রাগ ভাঙা।"


নাজিয়া উশখুশ করতে লাগল, এত মানুষের সামনে দিয়ে কিভাবে যাবে! আবির বিষয়টা বুঝতে পেরে শ্রেয়াকে ইশারা করল নাজিয়াকে নিয়ে যাবার জন্য, শ্রেয়া ওকে নিয়ে সকলের আড়ালে এসে বলল,

- "আবরার‌ প্রচন্ড রেগে গেছে সামলাও ওকে গিয়ে।"


নাজিয়া মৃদু হেসে বলল,

- "ওহ রাগ করেনি, অভিমান করেছে সবার উপরে। ওর মনে হয়েছে, সবাই ওর‌ সাথে মজা করেছে, ওকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পেয়েছে তাই রিয়াক্ট করে ফেলেছ।"


শ্রেয়া নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হেসে বলল,

- "বাবা বিয়ে না হতে হতেই কত দিকে খেয়াল। যাও বরের কাছে যাও।"


নাজিয়া মৃদু হেসে ছাদের দিকে পা বাড়াল, ওহ জানে এই মূহুর্তে আবরার ছাদে ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে পারে না। আর ওর সন্দেহটাই ঠিক হলো, আবরার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। নাজিয়া আবরারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

- "ভাগ্য কতই অদ্ভুত তাই না!"


আবরার উত্তর দিল না, এমনকি পাশ ফিরে দেখলেও না। নাজিয়া আবরারের দিকে আর একটু সরে এসে বলল,

- "আমিই মনে হয় প্রথম বউ, যে বাসর রাতে না গিয়ে নিজের পায়ে হেঁটে বরের রাগ ভাঙাতে ছাদে এসেছে।"

- "তোমাকে কে আসতে বলেছে? চলে যাও।"

- "কেউ বলেনি নিজেই এসেছি, একটা গুড নিউজ দেবার ছিল।"


আবরার গম্ভীর গলায় বলল,

- "কি?"

- "আমি তোমার বউ হয়ে গেছি।"


কথাটা বলার সময়ে নাজিয়ার কন্ঠে অন্যকিছুর আভাস পাওয়া গেল। কিছুটা লজ্জা, কিছুটা আনন্দের মিশ্রনে এই অনুভূতি। এতগুলো দিন, বছর একপ্রকার একতরফা ভালোবাসার পর অবশেষে তাকে পেল এর থেকে আনন্দের অনুভূতি আর‌ কি হতে পারে?


আবরার নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, হুট করে নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে।


- "আরে আসতে লাগছে তো।"


আবরার আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

- "আমারও লাগত এতদিন।"

- "আর এখন?"

- "অনেক.... শান্তি লাগছে।"


নাজিয়া ফিক করে হেসে দিল। আবরার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নাজিয়ার মাথায় ভালোবাসার পরশ দিল। এতদিনের অপেক্ষার পর ভালোবাসার মানুষটি আজ ওর একান্ত নিজের ব্যক্তিগত।‌উফ্ অনুভূতিটাই একদম আলাদা।


---


বর্তমানে শ্রেয়া আর আবরারের ঝগড়া চলছে, শ্রেয়া বলছে নাজিয়া ওর সাথে থাকবে আর আবরারের দাবি সে কিছুতেই তার বউকে অন্য কারোর কাছে দেবে না। আর এইদিকে ওদের ঝগড়া শুনে নাজিয়া লজ্জায় শেষ। আবির এতক্ষন এইখানে থাকলেও এদের ঝগড়া শুনে‌ পালিয়ে গেছে, যতই হোক বড়ো‌ দাদা তো। এরা যা ঠোঁট কাটা কখন কি বলে ফেলে কে জানে, তাই আগে- ভাগেই চলে গেছে। প্রান আজ ওর দাদু- দিদুনের কাছে থাকবে যদিও নাজিয়া বলেছিল ওর কাছে রাখার জন্য কিন্তু বড়োরা রাখতে দেয়নি অত্যন্ত আজকের দিনটা ওরা নিজেদের মতো করে কাটাক।


- "দ্যাখ শ্রেয়া এইটা কিন্তু ঠিক না, আমার বিয়ে করা বউ আর আমার কাছেই থাকবে না!"

- "আজকের দিনটা আমার কাছে থাকুক না।"

- "সারাদিন তোর‌ কাছেই ছিল, এখন আমার কাছে থাকবে পালা এইখান থেকে।"

- "ঠিকাছে যেতে পারি কিন্তু...

- "আবার কিন্তু কি?"

- "পাঁচ হাজার টাকা দাও।"

- "এ্যাঁ!!"

- "এ্যাঁ নয় হ্যাঁ। তোমার বউকে এত সুন্দর করে সাজিয়ে দিলাম ফ্রিতে, আবার এখন তোমাদের প্লেস করে দিচ্ছি তো পাওনা একটা তো থাকেই তাই না!"


আবরার বুঝল এই মেয়ে কিছু না ধিয়ে কিছুতেই যাবে না, তাই বলল,

- "দুই দিই?"

- "দুই তে কি হবে? আমার পাঁচ লাগবে আর না যদি দাও তাহলে আজকে সারারাত আমি এইখানেই থাকব।"


আবরার নড়েচড়ে দাঁড়াল, এই মেয়ে এইখানে থাকবে মানে‌ কি!


- "কি হলো? কি করবে বলবে তো!"


আবরার করুন চোখে নাজিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে, শ্রেয়ার হাতে তিনহাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বলল,

- "বইন প্লিজ মাফ কর। আমি আর পারব না।"


শ্রেয়া টাকাটা গুনে নিয়ে বলল,

- "এইবারের মতো ছাড় দিলাম, পরের বার..


আবরার পুরোটা বলতে না দিয়ে বলল,

- "আবার পরের বার কি! আমি কি বছর বছর বিয়ে করব নাকি?"

- "সে সময় হলে দেখা যাবে। এখন বাই, বেস্ট অফ লাক।"


শ্রেয়া একছুটে রুমের বাইরে চলে যায়। আবরার যেন দম ফেলে বাঁচে, ওই মেয়ে যদি সত্যি সত্যি এই ঘরে থাকত তো!


আবরার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে বলল,

- "এই ওযু করে আসো তো, একসাথে নামাজ পড়ব।"


দুজন নামাজ আদায় করে, নিজেদের নতুন জীবনের জন্য দোয়া করল। 


--


আবরার নাজিয়ার হাতটাকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

- "আমাদের জীবনে কতকিছুই হয় তাই না!"

- "হুম। জীবন খরস্রোতা নদীর মতো, কখনো জোয়ার আবার কখনো ভাটা।‌কখনো ওঠা আবার কখনো পরা দুইয়ের মিশ্রনেই জীবন।"

- "আজ থেকে আমি তোমাকে নাজি বলে ডাকব।"

- "নাজি!"

- "হুমম। আমার নাজি।"


নাজিয়া মৃদু হাসল। আবরার নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

- "তোমার পরিবর্তন আমাকে ভাবিয়েছিল, আমি অনেক ভেবেও তোমার বদলে যাবার কারন খুঁজে পাইনি। অবশেষে আমাদের মধ্যেকার "এক_আকাশ_দূরত্ব'টা" মিটল।


নাজিয়া মনে মনে বলল,

- "আর সেটা কখনো তুমি জানতেও পারবে না। আমি চাই না, আমার কারনে তোমাদের মা- ছেলের সম্পর্কে কোনো আঁচ আসুক। মা ছেলের সম্পর্ক সুন্দর সম্পর্ক, সেটা আজীবন সুন্দর থাকুক এইটুকুই চাই।"


আবরার নাজিয়াকে ডেকে বলল,

- "কি ভাবছ?"

- "কিছু না। বলছি ঘুমাবে না?"


আবরার শয়তানি হেসে বলল,

- "বাসর রাতে কে ঘুমায়? সবাই তো বলে বাসর রাতেই বিড়াল মারতে হয়।"


নাজিয়া লজ্জা পেয়ে আবরারের বুকে মুখ লোকায়। আবরার হেসে উঠে প্রিয়তমার কান্ডে। দুটি মন,প্রান ভালোবাসার সাগরে একে অপরের সাথে মিশে গেল। ভালো থাকুক ভালোবাসারা।


---


সময় বহমান। দেখতে দেখতে কেটে গেছে একটা মাস। নাজিয়া নিজের নতুন সংসারে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। আবিরের মা নিজের কথা রেখেছেন, নাজিয়ার বন্ধু হয়ে উঠেছেন। সংসারের কাজ সেরে একসাথে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা সবকিছুই চলে বউ-শাশুড়ির মধ্যে। প্রান ছোটমা আর দিদুনের আদর-যত্নে বেড়ে উঠছে। আবরার নিজের অফিস পরির্বতন করে নিয়েছে, সকালে বের হয় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় আবিরেরও সেম অবস্থা। বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে পরিবারের সকলে মিলে একটা আড্ডায় মেতে উঠে, হইহই করে সময় কেটে যায়। সবকিছুর মধ্যে আবিরের বারবার নিসার কথা মনে পড়ে, সে থাকলে সবকিছু পূর্ন হতো। 


দিনশেষে সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়লে আবির বড্ড একা হয়ে পড়ে। প্রানটাও খুব ছোট, ওকে একা সামলে রাখতে পারবে না বলে নিজের কাছে রাখা হয়না। আবির জানে নাজিয়া কোনো অযত্ন করবে না তার ছেলের তবুও..


আবির নিসার ছবির উপর হাত বুলিয়ে বলল,

- "জানো নিসা আমাদের পরিবারটা আগের মতো পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে কিন্তু আমি অসম্পূর্ণ। তোমাকে ছাড়া আমি বড্ড নিঃস্ব, একা। দিনশেষে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবার জন্য তুমি নেই, ক্লান্ত মনটাকে স্থির করার জন্য তোমার কাঁধটা নেই, মনখারাপের সময়ে আগলে রাখার জন্য তোমার বুক নেই, হাত নেই। আমি বড্ড একা হয়ে গেছি, তোমার আর আমার মাঝের দূরত্বটা এক আকাশ সমান হয়ে গেছে। আচ্ছা তুমি খুব ভালো আছো তাই না! আমি কষ্ট পাচ্ছি, সেইগুলো দেখতে তোমার খুব আনন্দ লাগছে তাই না!"


আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলল, দিনকে দিন একাকিত্ব আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। সারাদিনের ব্যস্ততা, দিনশেষে বাড়ি ফিরে সকলের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত থাকাতে কিছুই মনে হয় না কিন্তু রাত বাড়লেই স্মৃতিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। এই রুম, রুমের প্রত্যেকটা জিনিসে নিসার‌ স্মৃতি জড়িয়ে আছে, সেইগুলো কিভাবে ভুলবে!  


নিসার ছবি নিজের বুকে জড়িয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, সেইদিকে খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙে ফোনের রিংটোনের আওয়াজে। আবির ঘুমঘুম চোখে ফোনটা কানে ধরতেই চমকে উঠল,


- "আবির বাবা সর্বনাশ হয়ে গেছে। শ্রেয়া সুই-সাইড করার চেষ্টা করেছ, অবস্থা খুব খারাপ হসপিটালে ভর্তি করানো‌ হয়েছে।"


আবিরের ঘুম উড়ে যায়। শ্রেয়া সুই-সাইড করার চেষ্টা করেছে? কিন্তু কেন!!!


#চলবে...


ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।



গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ১৪

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (১৪)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


"আমি এই বিয়েতে রাজি হয়েছি কারন!


এতটুকু বলে আবিরের মা নাজিয়ার মুখের দিকে তাকালেন, ওর চোখেমুখে কৌতুহল সাথে চিন্তার ছাপ। আবিরের মায়ের এই প্রথম নাজিয়াকে দেখে মায়া হলো, ভালো করে নজর দিয়ে দেখলেন মেয়েটা দেখতে মাশাল্লাহ বেশ সুন্দর। এতদিন জেদ করে মেয়েটা ভালো করে খেয়াল করাই হয়নি, মনে মনে আফসোস করলেন। কয়েক বছর আগে যদি এই ভুলটা বুঝতে পারতেন তাহলে হয়তো এতকিছু হতো না।


নাজিয়াকে অবাক করে দিয়ে উনি এগিয়ে এসে নাজিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

- "এই কয়েকদিনে একটা কথা খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছি, এই পরিবার, আবরারের জন্য তোমার থেকে যোগ্য কেউ হতেই পারে না।"


নাজিয়া অবাক নয়নে ওনার দিকে তাকিয়ে আছে, বিশ্বাস করতে পারছে না। যে মানুষটা ওকে সব থেকে বেশি অপছন্দ করে আজকে সেই মানুষটা তার ছেলের জন্য যোগ্য মনে করেছে!!


- "জানি আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি, নিজের জেদ-ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি সাথে নিজের ছেলে'কেও। তোমার কাছে আমি মাফ চাইব না, শুধু অনুরোধ করব আমার বর্তমান ও অবর্তমানে আমার সংসার'টাকে আগলে রেখো।"


নাজিয়া হঠাৎ করেই ইমোশনাল হয়ে গেল, আবিরের মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এতদিন, এতটা বছর একটা জিনিসই চেয়েছে আবিরের‌ মা ওকে মেনে নিক কিন্তু সেটা হয়নি। আর আজ সেই ইচ্ছাটা পূরণ হয়েছে, এর থেকে আনন্দের আর‌ কি হতে পারে!!


আবিরের মা নাজিয়াকে আগলে নিলেন, এতদিন মেয়েটাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন আর দিতে চান না। মধ থেকে দোয়া করলেন, ছেলে আর ছেলের বউ যেন খুব ভালো থাকে।


আবিরের মা দুইদিন আগের ঘটনার স্মৃতিচারণ করলেন,


অতীত...


- "আবরার আর নাজিয়ার বিয়ে দিতে চাই।"


আবিরের মা চমকে উঠে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। 


- "তুই এইসব কি বলছিস আবির?"

- "হ্যাঁ মা। আবরার আর নাজিয়া একে অপরকে ভালোবাসে, শ্রেয়ার সাথে আবরারের বিয়ে হওয়া মানে একসাথে তিনটে জীবন নষ্ট করে দেওয়া।"

- "তুই সব জানিস?"

- "হ্যাঁ মা। আমি সবকিছু জানি, আর নাজিয়াকে এই বাড়িতে নিয়ে আসার পেছনে শুধু নিসাই একমাত্র কারন ছিল না। আমি আবরার আর নাজিয়াকে এক করতে চেয়েছিলাম।"


আবিরের মা একটার পর একটা চমক পাচ্ছেন। কি সিদ্ধান্ত নেবেন সেইটাই বুঝে উঠতে পারছেন না, আবির ওর মায়ের হাতটা ধরে বলল,


- "মা জোর করে সংসার করা যায় না, তুমি প্লিজ এই বিয়েতে রাজি হয়ে যাও।"


আবিরের মা কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন। তারপর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

- "কিন্তু আবির আমি যে তোর মামাকে কথা দিয়েছি শ্রেয়াকে এই বাড়ির বউ করব।"

- "মা যেখানে ছেলে-মেয়েদের মত নেই সেইখানে জোর করাটা কি উচিত হবে?"

- "শ্রেয়ার মত নেই?"

- "না মা। শ্রেয়াও অন্য একজনকে ভালোবাসে। এখন তুমিই বলো ওদের বিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?"


আবিরের মায়ের মুখ থেকে চিন্তার ভিড় সরে গেল, শ্রেয়ার কথা ভেবেই এতক্ষন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। এখন যেহেতু শ্রেয়ার মত নেই তাই বিষয়টা এইখানে থামিয়ে দেওয়াই ভালো। কখনো কখনো সন্তানদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হয়।


- "আচ্ছা আমার কোনো আপত্তি নেই। তোর বাবাকে বলেছিস?"

- "হুমম। বাবা অলরেডি নাজিয়ার বাবা মায়ের সাথে কথাও বলে নিয়েছেন ওনারাও রাজি আছেন। শুধুমাত্র তোমার মতের অপেক্ষায় ছিলাম।"


আবিরের মা অমত করার মতো আর কিছুই পেলেন না্ সবাই রাজি আর উনিও এই কয়েকদিনে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন তাই দুজন ভালোবাসার মানুষকে এক করে দিলে মন্দ হয় না। তারপর হঠাৎ করেই দুইদিন পর বিয়ে ঠিক করা হয়, সেইদিন রাতে আবিরের বাবা আবরারের উদ্দেশ্যে বললেন,


- "আগামী পরশু তোমার বিয়ে।"


আবরার সবেমাত্র ভাত গালে দিয়েছিল‌ বাবার কথা শুনে বিষম খেয়ে যায়। নাজিয়া পাশে দাঁড়িয়ে সবাইকে বেড়ে দিচ্ছিল, আবরারকে বিষম খেতে দেখে পানি এগিয়ে দিল তারপর পিঠে হাত বুলিয়ে লাগল। আবরারের প্রতি কেয়ার দেখে সবাই মৃদু হাসল। 


আবরার নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

- "আমার বিয়ে মানে?"

- "বিয়ে মানে বিয়ে। আগামীকাল শ্রেয়াকে নিয়ে গিয়ে বিয়ের কেনাকাটা করতে যাবে আর এইটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।"


বাবার মুখের উপর কিছু বলতে না পেরে আবরার খাবার রেখে দিয়ে চলে গেল। নাজিয়াও ঠিকমতো খেতে পারেনি সেইদিন।


---


নাজিয়ার ডাকে আবিরের মা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। উনি নাজিয়ার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন, 

- "আর কান্না নয়, অনেক কান্না করছ এইবার থেকে সবসময়ে হাসি-খুশি থাকবে। মনে থাকবে!"

- "হুমম।"

- "তুমি এইখানে ওয়েট করো, ওদের হয়ে গেলে তোমাকে নিয়ে যাবে।"

- "আন্টি প্রানকে খাওয়ানোর ছিল।"

- "সেটা তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, আমি প্রানকে খাইয়ে দিয়েছি। আর শোন মেয়ে, এইসব আন্টি-টান্টি বলা যাবে না আমাকে মামনি বলে ডাকবে আমাকে। আমি কখনোই তোমার মায়ের জায়গা নিতে পারব না, মা ডাকটা তোমার মায়ের জন্যই থাকুক। আমি না হয় বন্ধুর মতো শাশুড়ি হবো!"


নাজিয়া ওনাকে আবারো জড়িয়ে ধরল। মানুষটা খারাপ না, কিন্তু কিছু জেদ-অভিমানের ভীড়ে ভালো মানুষটা চাপা পড়ে গিয়েছিল যেটা পুনরায় প্রকাশিত হচ্ছে।


বিয়ে ইশার নামাজের পর পড়ানোর কথা থাকলেও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। মাগরিবের পর বিয়ে পড়ানো হবে, সেই কারনেই শ্রেয়া তাড়াতাড়ি নাজিয়াকে রেডি করিয়ে দিয়েছে। আবরার সাদা রঙের একটা পাঞ্জাবী-পায়জামা পড়ে সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে, একবারের জন্যও মাথা তুলে তাকাচ্ছে না। কাজি সাহেব আসতেই কনেকে নিয়ে আসার জন্য তাড়াতাড়ি করতে লাগল। শ্রেয়া নাজিয়াকে নিয়ে এসে আবরারের মুখোমুখি বসিয়ে দিল, আবরারের দৃষ্টি তখনও মাটিতে। আর নাজিয়া! সে তো ভয়েই শেষ, কি হবে! প্রচন্ড রকমের নার্ভাস লাগছে কি করবে?


কাজি সাহেব বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন, আবরার নিজের ধ্যানে এতটাই মগ্ন ছিল যে খেয়াল করতেই ভুলে গেছে পাত্রীর নাম কি বলল।‌ হয়তো খেয়াল করলে বুঝে যেত, অন্য কেউ নয় ওর প্রিয় মানুষটাই ওর সহধর্মিনী হতে চলেছে। 


আবরার আর নাজিয়ার বিয়ে সম্পন্ন হয়। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার সময়ে হঠাৎ করেই আবরারের চোখ আটকায় পাত্রীর নামের জায়গায়, চমকে ওঠে! নাজিয়া!! আবরার সাইন না করে সামনে তাকাতেই আরেকদফা চমক খেল। নাজিয়া বিয়ের সাজে বসে আছে আর শ্রেয়া নর্মাল ড্রেসাপে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আবরারের সবকিছু এলোমেলো লাগল, বিয়ের কথা শুনে কি পরিমান টেনশনে ছিল সেটা একমাত্র ওই জানে। আবির, শ্রেয়া উভয়ের কাছে বারবার গেছে কিন্তু ওরা প্রতিবারই ফিরিয়ে দিয়েছে নানান বাহানা দিয়েছে ‌ তারমানে সবকিছু সবার সাজানো প্ল্যান ছিল! ওর পরিবার - নাজিয়া ওর সাথে গেম খেলেছে কথাটা ভাবতেই মাথাটা গরম হমে উঠল। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন না করেই বলল, 

- "এইসবের মানে কি? শ্রেয়ার জায়গায় নাজিয়া কেন?"


আবির শান্ত কন্ঠে বলল,

- "কারন বিয়েটা তোর আর নাজুর তাই।"


আবরার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

- "আমি এই বিয়ে মানি না।"


উপস্থিত সকলের মাথাতে আকাশ ভেঙে পড়ল। আবরার বিয়ে মানে না মানেটা কি??


#চলবে...


নাজিয়ার একটু শিক্ষা হওয়া প্রয়োজন আপনারা কি বলেন? ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।


গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ১৩

 #এক_আকাশ_দূরত্ব  (১৩)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


আজ আবরার আর শ্রেয়ার বিয়ে। সকাল থেকে জোর কদমে আয়োজন চলছে, আত্মীয়রা ইতিমধ্যেই চলে এসেছেন। আত্মীয় বলতে আবাররের মামা বাড়ির লোকজন এবং নাজিয়ার বাবা মা। 


অনেকদিন পর মাকে দেখামাত্রই নাজিয়া আবেগী হয়ে পড়েছিল, জড়িয়ে ধরে দুজনের সেকি কান্না। সদ্য এক মেয়েকে হারিয়ে নাজিয়ার মাও বড্ড একা হয়ে গেছেন, মেয়ের শশুর বাড়িতে আসতেই কষ্টগুলো তাজা হয়ে উঠছে।মেয়ের সংসারের গল্পগুলো স্মৃতিচারণ করতে লাগলেন, আবিরের সাথে কথা বললেন কিছুক্ষণ তারপর প্রানকে মনভরে আদর করলেন। ছেলেটা তার মেয়ের শেষচিহৃ, তাদের সকলের প্রান।


সবাই সবার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঈশার নামাজ পর বিয়ে পড়ানো হবে ঠিক করা হয়েছে, তারপরে সবাই খাওয়া দাওয়া করবে তার জন্য দুপুরের খাবার পর থেকেই আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। দুপুরে খেতে বসে নাজিয়া আবরার কেউই ঠিকমতো খায়নি, গলা দিয়ে খাবার নামছে না আর কিভাবেই বা নামবে! নাজিয়ার বি'ষাক্ত কিছু অনুভূতি হচ্ছে, ইচ্ছা করছে‌ সবকিছুর বাঁধন খুলে আবরারের কাছে চলে যেতে কিন্তু সেটা যে আর সম্ভব না। 


আবরার মনখারাপ করে বসে আছে দেখে আবির ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, 

- "কিরে এইভাবে বসে আছিস কেন?"

- "তো! কি করব?"

- "জীবনে একবারই বিয়ে করবি, কোথায় আনন্দ করবি তা না এইভাবে মনখারাপ করে বসে আছিস?"

- "ভালোবাসার মানুষটাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব কথাটা ভাবতেই আমার বুক ফেঁটে যাচ্ছে, আর তুমি আনন্দের কথা বলছ!!" কথাটা নিজের মনে মনে বলল আবরার, আবিরের সামনে আর প্রকাশ করতে পারল না। 


আবির আবরারের কাঁধে হাত দিয়ে বলল, 

- "ভাই বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা নয়, এইটা একটা সম্পর্ক সাত জনমের বন্ধন। বিয়ের পর মানিয়ে নেওয়া ও মেনে নেওয়া জীবন সুন্দর হয়ে উঠে।"


আবরার বিরক্ত হয়ে বলল,

- "আমাকে এইসব বলছ কেন?"

- "কারন আজকে তোর বিয়ে।"


আবরার মেকি হেসে বলল, 

- "কিছু পারি আর না পারি মানিয়ে ও মেনে নিতে খুব ভালোই পারি।"


আবরার উঠে চলে যায়, ওর যাবার দিকে তাকিয়ে আবির মৃদু হাসল।


---


বিকাল ৩টের দিক করে, প্রানের জন্য দুধ গরম করতে গিয়ে নাজিয়ার চোখ পড়ে নিজের হাতের মেহেন্দির দিকে। কালকে রাতে শ্রেয়া একপ্রকার জোর করেই পড়িয়ে দিয়েছে। মেহেন্দির রং গাঢ় লাল হয়েছে দেখে নাজিয়া মেকি হেসে মনে মনে বলল,

- "মেহেন্দির লাল হয়েই বা কি হবে! ভালোবাসার মানুষটি আজ অন্য কারোর হতে চলেছে।"


কিছু অনুভূতি সকলের সামনে প্রকাশ করা যায় না, নিজের মধ্যে রেখে গুমড়ে মরতে হয়। নাজিয়াও আজ গুমড়ে মরছে, না পারছে কাউকে কিছু বলতে আর না পারছে সবকিছু সহ্য করে যেতে।'ভালোবাসার মানুষটিকে অন্য কারোর হয়ে যেতে দেখার সৌভাগ্য কারোর না হোক'  এর থেকে অসহনীয় যন্ত্রনা আর একটাও হয় না। তবুও নাজিয়া চাই আবরার আর শ্রেয়া ভালো থাকুক।


- 'নাজিয়া নাজিয়া।"


শ্রেয়ার ডাক শুনে নাজিয়া নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে, কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের কোনে পানি জমা হয়েছে সেই খেয়াল নেই। নাজিয়া নিজের চোখ মুছে, শ্রেয়ার কাছে যাবে বলে বের হচ্ছিল তখনি সেখানে শ্রেয়া চলে আসে।


- "তুমি এইখানে? আর আমি গোটা বাড়ি তোমাকে খুঁজে চলেছি।"

- "কেন কি হয়েছে?"

- "অনেক কিছু। চলো এইবার"

- "কোথায়? "

- "আহ্ গেলেই দেখতে পাবে চলো তো।"


শ্রেয়া নাজিয়াকে টেনে ওর‌ঘরে নিয়ে আসল। রুমের মধ্যে শাড়ি, গহনা ফুল এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে আছে, নাজিয়া প্রথমে ভাবল শ্রেয়া ওকে সাজিয়ে দিতে বলবে কিন্তু ওর ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমানিত করে শ্রেয়া বলল,

- "এইবার চুপ করে বসে পড়ো তো তোমাকে সাজিয়ে আবার নিজে সাজব।"

- "আমি কেন সাজব?"

- "আমি বলছি তাই, কি আমার কথা রাখবে না?"


নাজিয়া কিছু বলতে পারল না, মেয়েটা সত্যি ভালো মনের মানুষ। সবকিছুতেই মুখে হাসি লেগে থাকে।


বেশ অনেকটা সময় পর..

শ্রেয়া নাজিয়াকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে, নাজিয়া তো বসে বসে বোর হয়ে যাচ্ছিল। শ্রেয়া এত কি সাজাচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছে না।


শ্রেয়া নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

- "সব সাজ কমপ্লিট এইবার শুধু শাড়িটা পড়ানোর পালা।"

- "কি এতো সাজাচ্ছ আমাকে?প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও, আমার প্রচন্ড রকমের অস্বস্তি হচ্ছে।"

- "কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। আজকের দিনে একটু সাজবে না তো‌ কবে সাজবে?"


নাজিয়া মেকি হেসে বলল,

- "নিজের বিয়ের দিন সাজব।"


শ্রেয়া নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হেসে বলল,

- "আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে একবার দ্যাখো, বুঝে যাবে সবকিছু।"


নাজিয়ার কৌতুহল জাগল, গুটি গুটি পায়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই চমকে উঠল। সাজটা একেবারে ব্রাইডালদেল মতো, গায়ে বেনারসী থাকলে পুরো বউ বউ লাগবে। নাজিয়া পেছন ফিরে বলল,

- "এইসব কি শ্রেয়া 'দি?"

- "এখনো বুঝতে পারছ না?"

- "মানে? কি বুঝব!

- আমি জানি তুমি আর আবরার দুজন দুজনকে ভালোবাসো কিন্তু কোনো কারনে তুমি আবরারকে এক্সসেপ্ট করছিলে না। বড়ো দিদি হিসাবে একটা কথা বলছি তোমাকে,  ভালোবাসা আগলে রাখতে হয়, এইভাবে অবহেলা করতে নেয়। সবার কপালে সত্যিকারের ভালোবাসা জোটে না, তোযার কপালে এসেছে আবরার তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে আর তুমি কি করছ! বারবার ওকে ফিরিয়ে দিয়েছ, ওর জায়গায় অন্য কোনো ছেলে হলে কবেই তোমাকে ভুলে  অন্যকাউকে আপন করে নিত কিন্তু ওহ!  আজও তোমার অপেক্ষায় আছে, তুমি যদি এখন একবার বলো ওকে বিয়ে করতে চাও ওহ পরিবারের সবার বিপক্ষে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করবে" 


নাজিয়া মাথা নিচু করে নিল, শ্রেয়ার কথাগুলো একটাও মিথ্যা নয়। কিন্তু এইখানে নাজিয়ার দোষ কোথায়! ওহ তো দুই পরিবার ও নিসা -আবিরের সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য নিজের ভালোবাসাকে ত্যাগ করেছে।


শ্রেয়া নাজিয়ার গালে হাত দিয়ে বলল,

- "যাকে ভালোবাসো তাকে আগলে রাখতে শেখো, দেখবে জীবন সুন্দর হয়ে উঠবে।"


নাজিয়া আহত কন্ঠে শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

- "শ্রেয়া'দি তুমি এইসব কি বলছ? আজকে তোমাদের বিয়ে!"

- "হু, তোমাদের নয় বলো আমাদের।"

- "মানে?"

- "আজকে তোমার আর আবরারের বিয়ে নাজিয়া।"


নাজিয়া চমকে উঠল, ওর আর আবরারের বিয়ে মানে!! শ্রেয়ার কথা ওর কাছে মজা মনে হলো, কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, 


- "তুমি এইসব কি বলছ?"

- "ঠিকই বলছি। দুই পরিবারের সকলে মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তোমাদের জানানো হয়নি সারপ্রাইজ দেবার জন্য"


নাজিয়ার তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না কথাগুলো, সত্যি কি দুই পরিবার মিলে ওদের বিয়ে ঠিক করেছে!! নাকি শ্রেয়া ওর সাথে মজা করছে? কিন্তু এই বিষয়ে মজা করে লাভ কি!!


নাজিয়াকে আনমনা থাকতে দেখে শ্রেয়া বলল,

- "নাজিয়া এখন চলো শাড়িটা পড়িয়ে দিই।"

- "হু।"


নাজিয়ার মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, নিজেকে কিরকম একটা কাঠের পুতুলের মতো লাগছে কি রিয়াকশন দেওয়া উচিত সেটাই বুঝতে পারছে না। একদিকে ভালোবাসার মানুষটার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে শান্তি লাগছে আবার আবরারের মায়ের অমতের বিষয়টা ভেবে অস্বস্তি হচ্ছে। নাজিয়ার ভাবনার মাঝে শ্রেয়ার সাজানো কমপ্লিট। নাজিয়াকে খুব মিষ্টি লাগছে, শ্রেয়া শয়তানি করে বলল,

- "আজকে নাজিয়াকে দেখে আবরার শিওর হার্ট এ্যাটাক করবে।"


না চাইতেও লজ্জায় নাজিয়ার গাল দুটো রক্তিম আভা ধারন করল, ইচ্ছা করছে মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে।


শ্রেয়া নাজিয়ার সাথে টুকটাক মজা করছে, তখনি দরজায় টোকা মারার শব্দ হয়। শ্রেয়া দরজা খুলে দেখল আবিরের মা দাঁড়িয়ে আছেন।


- "মামনি তুমি? ভেতরে এসো না।"

- "সাজানো কমপ্লিট?"

- "হুমম।"

- "আচ্ছা তুই যা ওর সাথে আমার কিছু কথা আছে।"


শ্রেয়া রুম থেকে বের হয়ে যেতে আবিরের মা দরজাটা লক করে দিলেন। নাজিয়ার হঠাৎ করেই একটা ভীতি কাজ করছে, যে মানুষটা ওকে পছন্দই করেনা সে কেন এই বিয়েতে রাজি হয়েছে? নাকি তার এই বিয়েতে মত নেয়!!


- "এতক্ষনে নিশ্চয় জেনে গেছ, আবরার আর তোমার বিয়ের কথা।"

- "জ্বি।"


আবিরের মা গম্ভীর গলায় বললেন, 

- "আমি কেন এই বিয়েতে রাজি হয়েছি জানো?"


নাজিয়া মাথা তুলে ওনার দিকে তাকাল, ওনার এই বিয়েতে রাজি হবার কারন কি?


#চলবে...


ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।গল্পটা আপনাদের কাছে কেমন লাগছে জানাতে ভুলবেন না।

আসসালামু আলাইকুম।