গল্প: বাধন হারা বেনী পর্ব ১৬

 গল্প: বাধন হারা বেনী

লেখিকা: সানজিদা আহমেদ শাহারা

পর্ব: ১৬


পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।

ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।

আয়    আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।

মোরা   সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।

মোরা   ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়--

        বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।

হায়  মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়--

আবার  দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়॥


গান টা থামিয়ে মেহরাব বলে

- সময় কারো জন্য যেহেতু নিজের গতি পল্টায় না আমাদের ও উচিত না সময়ের পিছে ছুটে যা চলে গিয়েছে হারিয়ে গিয়েছে তার প্রতি আসক্ত হওয়া।বরং সময়কে ধন্যবাদ দিয়ে নতুন আমি কে উপভোগ করা।


তার কথার পিঠে তাহিয়ানা নামক মেয়েটি বলে ওঠে

- স্যার, আপনার কি মনে হয় না পুরনো সময়ই আমাদের জন্য সব থেকে বেশি স্মৃতিময়?


মেহরাব শান্ত স্বরে বলে

- যে সময় চলে যায় তা বহমান স্রোতের ন্যায় চায়লে ও আপনি ফিরে পাবেন না।


তাহিয়ানা বলে

- স্যার সেখানে আমাদের জীবনের সব থেকে মূল্যবান মানুষ আর তাদের সাথে কাটানো স্মৃতি আছে।


মেহরাব বলে

- মিস তাহিয়ানা সিদ্দিকা আপনি একটু ভুল বললেন আছে নয় ছিলো।

তো ক্লাস গুড বাই ফর টুডে।সি ইউ টুমরো।


মেহরাব চলে যায় ক্লাস রুম থেকে।তাহিয়ানা নামক মেয়েটা কিছুক্ষন সময় নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে।তারপর তার পাশে বসা বান্ধবী রিসাকে উদ্দ্যেশে করে বলে


-জানু'রে মেহরাব স্যার আমার সাথে এতক্ষন কথা বলল।


- এ পাগল এ, স্যার'কে প্রশ্ন করবি তা স্যার উত্তর দেবেন না?


- আহা তা না তুই বুঝবি না কুচ কুচ হোতা'হে।


- হাট,চুপ থাক।


- ইশশ,,,হায় হায়,,,


- আরে যন্ত্রনা চুপ থাক।


তাদের বাক-বিতন্ডিতার মধ্যে আরো একজন প্রফেসর চলে আসে তাদের ক্লাসে।মেহরাব তার সুবিশাল অফিস কক্ষে বসে আছে।এতো অল্প বয়সে সনামধন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন হওয়া চারটে খানি কথা নয়।প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে।তবে এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে এক চাপা অতীত এক দুঃসময়ের হাতছানী।হাত থেকে ঠিক এক মিনিটের দুরত্বে রাখা ফোন টা নিশ্বব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছে।মেহরাব ফোনের দিকে তাকিয়ে একটু বিরক্ত হয় তবু ও ফোন হাতে তুলে নেয়।

- কি'রে ফোন তুলিস না কেনো? মানুষ কি তোকে অপ্রয়োজনে ফোন দেয়?

- আমার তো তাই মনে হয়।

- এভাবে সত্য কথা বলে অপমান না করলে ও হবে।

- কাজের কথায় আয়।

- একটা নতুন কেস এসেছে যাবি?

- আবার?

- প্লিজ ভাই দু বছর ধরে পিছে পড়ে আছে।

- ওকে আই উইল ট্রাই।

- আরে কিসের চেষ্টা যেতেই হবে আমাদের ও একটা ট্যুর হয়ে যাবে।

- আচ্ছা।

সোহরাব এর কথা শেষে ফোন টা কেটে যায়।মেহরাব বসা থেকে উঠে দাড়ায়।সামনেই একটা ট্যুরে যেতে হবে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় এর কিছু বাচ্চাদের নিয়ে বাইরের দেশে।আজ সকালেই সিলেক্টেড বাচ্চাদের নাম এসেছে।তার মধ্যে এই কেস টায় জড়ানো কি ঠিক হলো?

প্লেস টা একই শুধু জায়গার দুরত্ব একটু বেশি।সে যায় হোক স্রোতের টানে এবার গা ভাসাতেই হবে।আর কত দিন নিজেকে আড়ালে রাখা যায়।হাতে একটা সিট নিয়ে প্রোফেসর'স দের রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো মেহেরাব তার হাটার ফোর্স সব সময় একটু বেশিই থাকে। সিলেক্টেড দের নাম গুলো আর একবার পড়ে দেখছিলো সে।এমন সময় তার বুকের সাথে কিছু একটার ধাক্কা লাগে ব্যাথা না পেলে ও চোখের পলকে মনে হলো ধাক্কা লাগা জিনিস টা দুরে ছিটকে গিয়ে পড়েছে।চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখে ক্লাসে তাকে প্রশ্ন করা মেয়েটা।কি যেনো নাম ছিলো? ও হ্যা মিস তাহিয়ানা সিদ্দিকা।আরে এই মেয়েটার নাম ও তো মনে হয় লিস্টে আছে। তাহিয়ানা বেশ ব্যাথা পেয়েছে সে আশা করে ছিলো মেহরাব স্যার তাকে সহানুভূতি দেখিয়ে টেনে তুলবে কিন্তু সে বরং উল্টো তাকে ননসেন্স বলে প্রফেসর'স দের রুমে ডুকে যায়।অপমানিত বোধ হওয়া উচিত হলে ও এখন কেনো জানি তাহিয়ানার মনে হচ্ছে সে ভীষন বড় অপরাধ করে ফেলেছে মেহরাবকে এভাবে ধাক্কা দিয়ে। আবার লজ্জা ও লাগছে এভাবে কিভাবে সে মেহরাব এর সাথে ধাক্কা খেতে পারে।ইশশ আজ কি যে হচ্ছে তার সাথে।এভাবে চললে সে তো খুশিতে পাগল হয়ে যাবে।তার পাশে থাকা রিসা তার দিকে অদ্ভুত নজরে চেয়ে আছে দেখে নিজেকে সংযত করে সামনের দিকে হাটা শুরু করে সে।

অন্য দিকে আলোরা আজ মেডিকেল এ যায়নি।তার ফ্লাট থেকে হাটা পথের দশ মিনিট দুরত্বে একটি খুন হয়েছে।অস্বাভাবিক খুন ফলে আজ রাস্তা ঘাট ব্লক করে দিয়েছে পুলিশ।তার ও বেশ ভালো হলো একটু নিজের শরির টাকে আরাম দেওয়া যাবে ভেবে সকাল চার টায় ওঠা মানুষ টা বেলা ১০ টায় ঘুম থেকে ওঠে।সকালের নস্তা খেয়ে একটা হরর মুভি চালিয়ে সাওয়ার নিতে চলে যায়।বেশ সময় সাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসে মুভি দেখতে শুরু করে।এই মুভিটা সে আরো সাতারো বার দেখেছে তবে তার বেশ ভালো লাগে তেমন হরর না হলে ও বর্তমানে রিলিজ পাওয়া মুভি গুলো থেকে শত গুনে হরর স্কিল আছে। এই মুভিতে কোন আজাইড়া চিপকাচিপকি মোমেন্ট নাই, কোন গান নাই তবে যা আছে তা একটু ভীতু মানুষের হাড় হিম করে দিতে সক্ষম মুভিটার নাম HORROR STORY।২০১৫ সালের দিকে রিলিজ পায়।আলোরা এক মনে সিনেমাটা উপভোগ করতে থাকে এমন সময় তার ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে পর পর আসে একটা ফোন কল।অনিহা সত্বে ও সে ফোন তুলে নেয় হাতে, কানে ফোন দিতেই জরুরি ভাবে ডাকা হয় তাকে হাসপাতালে।এই হাসপাতালের জব টা সে ছেড়ে দেবে অন্য হাসপাতালে জব নেবে রাতে এই হাসপাতাল টা যেনো কেমন।যদি ও বা হাসপাতালের মালিক একজন বাংলাদেশী এ জন্য আলোরা ফ্যাসিলিটি ও খুব একটা খারাপ পায় না তবু ও সে থাকতে চায় না সে তো প্যারা নরমাল ব্যাপার গুলো জানে,বোঝে এ জন্য রাতে তার হাসপাতাল টা একদমই সুবিধার লাগে না তবু ও ডাক্তারের ধর্মের কাছে সে ভয় কে তুচ্ছ করেছে।মুভি দেখতে দেখতে বেশ সময় গড়িয়ে গিয়েছে। যেহেতু ছুটি ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছে তাই সে রেডি হতে যায়।প্রায় ঘন্টা পার করে রেডি হয়ে দুপুরের  খাবার শেষ করে ফ্লাট লক করে নিয়ে বের হয় রাস্তায়।নিজের আইডি কার্ড ও প্রফেশন এর সুবাদে ইমারজেন্সির কথা বলে সে রাস্তায় চলাচলের অনুমতি পেয়ে যায় কর্মরত অফিসারদের থেকে।তার গাড়িটি চলতে থাকে নিরিবিলি রাস্তা বেয়ে।মাত্র আধা ঘন্টায় সে আজ হাসপাতালে পৌছে যায়।হাজিরা ম্যাশিনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে হাসপাতালে ডুকে পড়ে।তাকে দেখে দুজন নার্স এগিয়ে এসে বলে চার তলার আটারো নম্বর রুমের পেসেন্ট আপনাকে বার বার স্মরণ করছে।আলোরা কি একটা ভেবে সোজা লিফ্টে উঠে যায়।আলোরা রুমে যেতেই লোকটা জাপানিজ ভাষায় তাকে কিছু একটা বলে এরপর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।আলোরা অবাক হয় সাথে এই ভেবে ভয় পেয়ে যায় যদি এই লোকের কথা সত্যি হয় তাহলে তার এত বছরের কষ্ট মাটি হয়ে যাবে।তবে মানুষ মরার আগে মিথ্যা কথা কেনো বলবে?এরপর অবশ্য সে নথি পত্র থেকে জানতে পেরেছে লোকটি একজন স্যামন অর্থাৎ তান্ত্রিক গোছের একজন মানুষ।তার যৌবন থেকে অসুস্থ হওয়ার আগের সময় পর্যন্ত সে তন্ত্র সাধনা করে গেছেন।

আলোরা বিচলিত হয়ে পড়ে সামনের ভবিষ্যৎ নিয়ে।তার এতদুর পাড়ি দেওয়া কি তবে বিফলে চলে যাবে? মাননি কি তবে কথা রাখতে পারেনি? নাকি অন্য কোন বিপদ হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাদের।কিভাবে সে সবটা জানবে? তবে কি আবার ও মুখামুখি হতে হবে অতীতের?আলোরার ছোট্ট হৃদপিন্ড টা ধক ধক করছে।ভয় হচ্ছে তার।সময় কে সে কিভাবে হারাবে?

তার কানে বার বার স্যামন লোকটির কথা ভেসে ভেসে আসছে

-Kakugo shite kudasai, kono tatakai wa yōide wa arimasen. Karera wa anata yori mo sū ga ōidesu. Anata no jakuten wa karera no tsuyomidesu. Karera wa sono chikara ni oite bōryoku-tekidearu. Karera wa giman, dorama, kōkatsu-sa ni takete imasu. Imasara nigeru koto wa dekinai. Anata wa sore ni tachimukawanakereba narimasen.


(তৈরি হও এই মোকাবেলা সহজ হবে না।তারা সংখ্যায় অধীক তোমরা দুর্বল।তোমাদের দুর্বলতা তাদের শক্তি।তাদের শক্তিতে তারা হিংস্র।ছল-কপাট,নাটক,আর ধুর্ততায় তারা পটু।

এবার আর পালাতে পারবে না।মোকাবেলা করতেই হবে।)


চলবে....


[আপনাদের ডিমান্ড অনুযায়ী সাজাতে পারতে ছিলাম না এজন্য দিতে দেরি হলো আশা করি ভালো লাগবে ]

গল্প: বাধন হারা বেনী পর্ব ১৫

 গল্প: বাধন হারা বেনী

লেখনী: সানজিদা আহমেদ শাহারা

পর্ব: ১৫



দুর থেকে ভেসে আশা আজান এর শব্দে ঘুম ভাঙে আলোরার।এতক্ষন সে স্বপ্ন দেখছিলো?ভাবতেই তার লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে যায়।ফ্রেস হয়ে ঘরেই বসে আছে আলোরা নিচে যেতে মন চাচ্ছে না।কালকে ঐ ঘটনার পর তার ভীষন কান্না পাচ্ছে।বাড়ির সকলে তাকে নিয়ে কি ভাববে এসব ভেবেই তার মন খারাপ ।আপু, ভাইয়া,তনিমা অনিমা কেউ আসেনি তার কাছে কাল থেকে।ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যায় তার।এমন সময় দরজায় নক করে কেউ আলোরা উঠে দরজা খুলে দেয়।ফুফু আর দাদি এসেছে।কিছু টুকি টাকি কথা বলে তারা চলে যায়।আলোরা শুনতে পায় তাদের বিয়ের দিন পড়েছে আগামী পরশু সন্ধ্যায়।


খবরটা তাকে দিয়েছে তনিমা।তারা মুলত মানতে পারছে না তাদের কাজিন গুষ্টীতে শান্ত আর রাগী দুই ভাই-বোন তাদের নাকের নিচে দিয়ে প্রেম করেছে? তা তারা জানতে ও পারেনি।তারপর আলোরা সকলকে ডেকে সবটা বোঝায়।এরপর সকলে গালে হাত দিয়ে ভাবে এটা পরিস্থিতি নাকি সুযোগ এর সৎ ব্যাবহার।

বাড়িতে একটা বেশ বিয়ে বিয়ে আমেজ হয়ে উঠেছে।সকলেই হাতে হাতে কাজ করছে।


গায়ে হলুদ এর কেনা কাটা করতে বাড়ি শুদ্ধ সকলে চলে গিয়েছে শুধু বর বউই যায়নি।সকাল বেলা আলোরাকে একটা গাড়ো সবুজ রং এর শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে সোমেহরা।হাতে চিকন দুটো বালা।

সকালে অল্প কিছু খেয়েছিলো তাই বেলা বাড়তেই ক্ষুধা লাগছে।আচল কোমরে গুজে চুল গুলো খোপা করে দক্ষ হাতে নুডুলস রান্না করছে আলোরা।মেহরাব মাত্রই গোসল করে বাইরে এসেছে বের হবে একটু।পরনে একটা সাদা শার্ট নীল প্যান্ট।ফোন টিপতে টিপতে এসে রান্না ঘরে দাড়ায় এরপর কি জানি কি হলো হাতে থাকা ফোন টা সোফাতে ছুড়ে মেরে এক  বড় বড় পা ফেলে শ্বাস টানতে টানতে এগিয়ে যায় রান্না ঘরে।আলোরা তখন ব্যাস্ত ডিম গোলাতে।মেহরাব এসে এক টানে আলোরাকে তুলে বসায় কিচেনের বাড়তি দেওয়ালের অংশে।উন্মুক্ত কোমরের হাত রাখে শক্ত করে,কানের 

কাছে ফিস ফিস করে বলে


- তোমাকে আমার বউ মনে হচ্ছে বিয়ে তো হয়নি জান।এখনি আমায় জ্বালাচ্ছ?


- কি বলছেন?


- বলছি বউ যখন সাজলে আসো একটু সাজ নষ্ট করি?


- রান্না পুড়ে যাবে যান এখান থেকে।।


- উহু  আজ আর যাওয়া হবে না।


- বিয়ে হয়নি এখনো।


- হয়ে যাবে এখনি।


মেহরাব গ্যাসের চুলা টা বন্ধ করে আলোরার কপালে পুর পর কয়েকটা চুমু দেয়।এরপর তার চুল শক্ত করে মুঠো ধরে এবং কোমড় আকড়ে ধরে ওষ্ঠে ওষ্ঠ স্পর্শ করে।আলোরা মুহূর্তেই কেপে ওঠে।ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়।আলোরা শুনেছিলো আজ প্রমান পেলো।তার আত্মা কায়া ছেড়েছে।আলোরা স্বপ্নের থেকে ও বেশি হাসফাস করছে।দুই হাতে মেহরাব এর পিঠের শার্ট আর চুল খামচে ধরে আছে।মেহরাব তাকে যত্ন করে চুম্বন করে।এরপর দুজনে লম্বা শ্বাস নিতে থাকে।আলোরা এক অদৃশ্য বেদনা অনুভব করে তার ভেতরে।মেহরাব তাকে আরো কয়েকটা চুমু দিয়ে চলে যায়।


আলোরা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে।


-ওহে প্রিয় তুমি যদি আমার ভাগ্যে থাকতে তাহলে আমার আর কিছুই চাওয়ার থাকতো না।এজন্য আল্লাহ্ তোমায় আমার করে দিলো না।নসিব, ভাগ্য,কপাল সবার এক না তো এজন্য আমার শখের মানুষ আমার হয়ে ও আমার হলো না।


আলোরার চোখে আর বাধ মানলো না।কান্না তার গলা ছাপিয়ে বেরিয়ে এলো।অঝরে কান্না করতে থাকে সে।কান্নার দমকে বার বার তার শ্বাস আটকে আসছে।আর কিছুই খাওয়া হয় না তার।শরিরটা বড্ড ক্লান্ত।সন্ধ্যায় সকলে সপিং শেষ এ ফিরে আসে।চারপাশে এতো আলোক বাতি অথচ আলোরা দরজা আটকে অন্ধকারে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। যেনো এই কান্না টুকুই তার শেষ সম্বল। রাত পোহালেই তার গায়ে হলুদ।বাবা-মার জন্য বড্ড মন খারাপ তার।আজ তারা বেচে থাকলে হয়তো আলোরার জীবন টা অন্য রকম হতো।কিন্তু সবার কপালে তো আর সব সুখ সয় না।কান্না করতে করতে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে তা তার মনে নেয়।যখন ঘুম ভাঙে তখন বাহিরে আজান দিচ্ছে।আলোরা উঠে নামাজ পড়ে অনেক কান্না করে মোনাজাত এ।এরপর উঠে ব্যাগ গুছিয়ে নেয়।তারপর গুটি গুটি পায়ে যায় মেহরাব এর রুমে।মেহরাব তখন গভীর ঘুমে।আলোরা তার পায়ের কাছে বসে তারপর তার পা ধরে বলে


-আপনাকে আমি না পেয়েই এতো ভালো বাসি।না জানি আপনি আমার জন্য হালাল হলে কতটা ভালোবাসা উজাড় করে দিতে পারতাম। মেহরাব এর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আলোরা।তারপর তার কপালে কয়েকটা চুমো দেয়।মন চাচ্ছে বুকে জড়িয়ে ধরে হাও মাও করে কেঁদে নিজেকে হালকা করতে কিন্তু তা তো সম্ভব না।


আলোরা চলে যায় দুর আজানায়।যেখানে কেউ তাকে খুজে পাবে না।আর যোগাযোগ করনি কখনো মেহরাব এর সাথে বা তাদের কারো সাথে।আজ প্রায় ৭ টা বছর সে একা একা রয়েছে জাপানে।

এই সময়ে জাপানে প্রচুর চেরি ব্লাসম হয়।আলোরা একটি নামহীন নদীর পাড়ে সাকুরা গাছের নিচে বসে আছে। হাতে তার একটা পুরনো ডাইরি।ফুফু বাড়ি থাকা কালীন লিখতো সে।গাছের নিচে মাটিতে সে একটু পিঠ এলিয়ে শুয়ে পড়ে তখনি বাতাসের দমকে মাঝে মাঝেই সাকুরা ফুলগুলো তার উপর বৃষ্টির পানির ন্যায় এসে পড়ছে।কিভাবে কিভাবে যেনো নয়টা বছর পেরিয়ে গিয়েছে জীবন থেকে।হয়তো মেহরাব ভাই সেদিন সম্মান বাঁচাতে তোফাকে বিয়ে করেছিলো।দাদী হয়তো তার বংশ বাচাতে পেরেছিলেন। কোন অজাত কুজাত তার ঘরে বউ হয়ে আসেনি।চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে তার।আটকাতে আর মন চায় না।আঠারোর আলোরা এখন চব্বিশ বছরের নারী। ফোনে একটা ইমারজেন্সি কল আসে তার।ডাক্তারদের নিজেদের দুঃখ বলতে কিছু হয় না হাজারো ডিপ্রেশন নিয়ে ও তাদের মানুষের সেবা করতে হয়। এজন্য হয়তো এটাকে নোনেল প্রফেশন বলে।আলোরা উঠে গাড়ির কাছে যায় দ্রুত ড্রাইভ করে পৌছায় হাসপাতালে।

তাকে দেখে নার্সরা দ্রু দৌড়ে আসে।


-Kanja no yōdai wa yokunaku, hinpan ni hossa o okoshite iru.

(রোগীর অবস্থা ভালো না বার বার খিচুনি উঠছে।)


-Sugu ni sanso o tehai shite kudasai.

(অক্সিজেন এর ব্যাবস্থা করো দ্রুত)


প্রায় দুই ঘন্টা চেষ্টা করার পর রোগীর হার্ট বিট স্বাভাবিক রেসপন্স করতে শুরু করে।সকলে একটা শান্তির নিশ্বাস নেয়।আলোরা তার কেবিনে এসে বসে।নতুন রুগী উনি নাম Sora অর্থাৎ আকাশ।রোগীর স্ত্রী কে ডেকে পাঠায় আলোরা।সবটা বুঝিয়ে দিয়ার পর যখন সে চলে যেতে নিবে তখন ফিরে তাকিয়ে আলোরাকে মহিলা টি প্রশ্ন করে।


- আপনি মেহরাব ভাই এর বউ না? আমি তোফা মনে আছে আমাকে?


আলোরা থমকায় কিছুক্ষন।নির্বিকার তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে সেই আদুরে মায়াবী মুখে এখন গাড় বয়সের ছাপ,চোখের নিচে কালো দাগ মুখটা মলিন হয়ে আছে।আলোরা ভাবে পরিচয় কি দেবে? নাকি থাকবে?কি জানি ভেবে বলে


- আপনার ভুল হচ্ছে আমি ওনার বউ না বোন হই।


- আপনাদের তো বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তারপর? 


- তারপর আর বিয়ে হয় নি।


- ওহ আচ্ছা।


- আমি আপনাদের গায়ে হলুদ এর আগের রাতেই সোরার সংঙ্গে পালিয়ে জাপানে আসি।বড্ড ভালেবাসতো ছেলে টা আমায়।আপনাকে অনেক কটু কথা বলতাম আগে মাফ করে দেবেন।


- আচ্ছা দিলাম।এখন আপনি দ্রুত ওষুধ গুলো আনুন।

অনেক দিন পর কারো সাথে বাংলায় কথা বলতে পেরে 

ভালো লাগলো।


থ্রি পিচের ওড়না টা মাথায় টেনে গায়ের এপ্রোন টা ঠিক করে রাউন্ড দিতে বের হয় আলোরা।


চলবে।

গল্প: বাধন হারা বেনী পর্ব ১৪

 গল্প: বাধন হারা বেনী


লেখিকা: সানজিদা আহমেদ শাহারা


পর্ব: ১১


তোমার ভোলাভালা হাসি  

আমার বুকের ভেতর ঝড়  

তুমি চলতি ট্রেনের হাওয়া  

আমি কাপি থরথর  

তোমার নানান বাহানায়  

আমার জায়গাটা কোথায়?  

আমি কি এক ঘোরে থাকি  

ছিল কতো কথা বাকি  

তোমার গোপন সবই রয়  

আমার আপন মনে হয়  

আমি ভোরের ঝরা পাতা  

আমার মরার কিসের ভয়........


- মন খারাপ কেনো, আলু?


- যদি বলি মেঘ শূন্য আকাশে আশ্রয় চায়তে গিয়ে বাতাস আমাকে ভূপৃষ্ঠে আছড়ে ফেলেছে?


- এমন আশ্রয়ে তুই চায়বি কেনো?


- মেঘের গর্জনে আপনার বর্ষণ বাড়ে কেনো?


- তুই মাটি হয়ে যদি সূর্যের আদলে থাকা চন্দ্রের দিকে তাকাস, তোর পতন তো নিশ্চিত।


- তবে কেনো ভুমি থেকে চন্দ্রের দুরত্ব বহুদূর হওয়ার পরও তা এতোটা কাছে মনে হয় যেনো, এইতো হাত বাড়ালেই স্পর্শ পাবো।


- বড্ড বোকা তুই।


- ইশ, যদি চালাক হতাম।


- ফিরে যা, অলু, তুই না পেয়েই সব হারালি।


- হয়তো...


- হয়তো বা না।


# আলোরাও সব না পেয়েই হারায়।


হেমলপুর থেকে তারা ফিরেছে কয়েক দিন আগেই। সেখান থেকে ফিরেই সোহরাব আর মেহরাব মিলে কোথাও একটা উধাও হয়ে গিয়েছিলো। আজ সন্ধ্যায় অনজুমান বেগমের সাথে তার কথা কাটাকাটি হয়েছে। কারণটা অবশ্য সামান্য; সকলে মিলে যখন গল্প করছিলো, তখন অনজুমান বেগম এসে তাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়েই হাতে থাকা চায়ের ট্রেটা ফেলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা তিনি পারেননি বলে উল্টো আলোরাকে একটু বেশিই কথা বললেন। তাতে আলোরা ব্যাপারটা গায়ে মাখেননি, কিন্ত যখন ঘুরে ফিরে কথা বাবামায়ের দিকে এলো, তখন আর চুপ থাকতে পারলেন না। সে তো চাইতেই যাবে, আর মাত্র সপ্তাহ খানেক এ বাড়িতে সে আছে। তা ও এতো কিসের অসুবিধা, অনজুমান বেগমের তা সে বোঝে না। তাই চুপ-চাপ ছাদে এসে বসে ছিলো সে। চাঁদের দিকে চোখ পড়তেই মন ভাকো হয়ে গেলো তার। তাই আধভাঙা সুরে একটু গান গেয়ে উঠলো। এমন সময় পেছন থেকে এসে তাকে মন খারাপের কারণ জানতে চায়।


- আপনি কখন আসলেন?


- আমি এসেছি বহু কাল আগেই।


- ওহ!


- তাহলে চলে যাচ্ছিস?


- হ্যা।


- যাক বাবা, একটা রুম ফাঁকা হবে। হাওয়া বাতাস আসবে বাড়িতে।


- হ্যা, তা আসবে।


- অনেক রাত হয়েছে, যা রুমে যা।


- এখনি না। আজ পরিবেশটা সুন্দর।


- চটপটি খাবি?


- আপনার মনে আছে?


- নাহ।


- সত্যি মনে নেই?


- কি মনে থাকবে?


- সেদিন রাতের কথা।


- কোন রাত?


- নাহ, কিছু না।


মুখে কথাটা বললেও মেহরাব মনে মনে একবার হেসে নেয়। সে রাতের কথা সে কিভাবে ভুলবে। সচরাচর বাড়ির মেয়েরা সলিন ভাবেই গেঞ্জি, প্লাজু আর উড়না বাড়িতে ব্যবহার করে। ছোট বেলা থেকে তাদের এভাবে দেখে অভ্যস্ত সকলে। মেহরাব যখন ইন্টার পরীক্ষার্থী, তখন ছোট্ট আলোরা কেবল বারো বছরের নাদান বাচ্চা, অঙ্কে কম নম্বর পাওয়াতে কোচিং এ দেওয়া হলো তাকে বাসা থেকে বেশ দূরে। কিন্তু সেখানকার টিচার তাকে মারতো। এ কথা জানতে পেয়ে মেহরাব তাকে নিজে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে তার দাদি, ফুফুসহ দুই এক জন নাখোশ হয়। কিন্তু পরে দেখা যায় যে মেহরাবের কাছে পড়ে তার রিজাল্ট আসলেই অনেক ভালো হয়। এরপর থেকে সুদীর্ঘ সময় সে তার কাছেই পড়েছে। এক অবাধ চাল চলন তার মাঝে লক্ষ্য করা যায়। মেহরাব বুঝতো এ আচরণের মানে। ঠিক তেমনভাবে সে লুকিয়ে রেখেছিলো তার না বোঝা অনুভূতিকে, তেমনি আলোরা ও সাবধানী চলাচল করতো। আলোরা একদিন পড়তে বসে খুবই ইচ্ছা করে মেহরাবের কাছে একটা সন্ধ্যা উপহার চেয়েছিলো। মেহরাব তাকে সেই সন্ধ্যার পুরোটা সময় দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু তা আর দেওয়া হয় নি। সেদিন যখন মেহরাব আর আলোরা বের হবে বলে বিকাল থেকে লাল শাড়ি, সাদা কোড়ির গয়না, কোকড়া চুলগুলোকে গুছিয়ে বাঁধছিলো, তখন তার ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে।


"আজ যাওয়া হবে না, তোফা অসুস্থ।"


এই তোফা হলো মেহরাব ভাইদের খালাতো বোন। আগুন সুন্দরী। মেহরাব ভাই তাকে বেশ গুরুত্ব দেয়। সে যা আবদার করে, দ্রুতই মেনে নেয়। তাদের পাশাপাশি মানায় ও দারুণ। তোফা আপু অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে। সেদিন কেনো যেনো বড্ড কান্না পেয়ছিলো, তার একটা সন্ধ্যায়ই তো সে চেয়েছিলো। তা ও দেওয়া গেলো না? কান্না করলে তার মাথা ব্যাথা করে, প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে সব সাজ তুলে ফেলে, সে অগোছালে হয়ে পানিতে ভিজতে থাকে। এরপর তেমন কিছু তার মনে নেয়। তবে মেহরাব সে কথা মনে করে আজও অনুসূচনা আর হারানোর ভয় অনুভব করে।


তারা সদর দরজা পেরিয়ে অনেকটা পথ হেটে এসেছে। ল্যাম্প পোস্টের নিয়ন আলোয় বড় বড় জারুল, হেজল, আম, মেহগুনি গাছের ছায়াতে দুজন নর-নারী হেঁটে চলেছে পায়ে পা মিলিয়ে। তাড়া নেই, নিরব নিভৃতে হেঁটে যাচ্ছে।


- আপনার সঙ্গে এটা আমার প্রথম সন্ধ্যা দেখা।


- শেষ দেখা।


- ওহ হ্যা।


- সামনের মোড়ে চল, চটপটি আছে।


- খাবেন?


- না।


- ও, আপনি তো আবার ঝাল খান না।


- একদম না।


- আচ্ছা, তোফা আপু কেমন আছে?


- জানি না।


- সে কি? আপনারা তো বন্ধু আবার ভাই-বোন।


- সময় দূরত্ব এনে দেয়।


- সময় নয়, আমরা নিজেদের মাঝে দূরত্ব এনে দেয়।


- কি বলতে চায়ছিস?


- যা আপনি শুনতে চান না।


- তাহলে ভাবিসও না।


- ঠিক আছে।


- আয়....


- মামা, এক বাটি চটপটি দেন তো।


- না মামা, দু'বাটি।


- আমি খাবো না।


- আজ একটু খান।


(মেহরাব তাকায় আলোরার মুখের দিক, কি বিপর্যয় মায়া মেয়েটার মুখের মধ্যে।)


- আচ্ছা মামা, দু'বাটি দিন।


- আচ্ছা।


- কোন শহরে যাবি?


- ক্যালিফোর্নিয়া।


- এতো দূর?


- একটু দূর।


- এই ne ধর এই বাটি তোর।


(প্রসন্ন অধরে হাসে আলোরা, হাত বাড়িয়ে বাটিটা নেয়। অন্যটা মেহরাব নেয়।)


মিনিট পনের পরে খাওয়া শেষ হয় তাদের।


- চল বাসায় যাই।


- চলেন।


- ঐ তো একটা আইসক্রিমের ভ্যান, চল যাই।


- চলেন।


- মামা, দুটো আইসক্রিম দেন তো।


- দুটো নেই। গরম আজকে একটা আছে।


- তবে একটায় দেন।


- নে ধর, তুই খা। পিচ্চি।


- আমি পিচ্চি না।


- না, তুই তো পচা আলু।


- আপনি আমাকে রাগাচ্ছেন কেনো?


- তুই ঠোট চাবাচ্ছিস কেনো?


- ওই তো ঠান্ডা আইসক্রিম ঠোঁটে লাগায়, শিরশির করছে তাই।


- যন্ত্রণা, বন্ধ কর ঠোঁট চাবানো।


- আরে।


- আগে কর।


- ওকে।


মেহরাব হাপ ছেড়ে বাঁচে। আজ মেয়েটা কুর্তি আর সালোয়ার পরে এসেছে। খোলা চুল, কানে ছোট একদুল, কানের পাশে তিলটা তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। গোলাপি আভাযুক্ত ঠোঁটের নিচের পাশে বাম কোনায় তিলটা জ্বলজ্বল করে রয়েছে। উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁটে বাইট করলে তা আলো স্পর্শকাতরভাবে আবেদনীয় হয়ে উঠছে। মেহরাব ঘন শ্বাস ফেলে। তার পরে মনে পড়ে সেদিন রাতের কথা; এলোমেলো অবস্থায় বাথরুমের ফ্লোরে শাওয়ারের পানিতে লেপ্টে থাকা আলোরা শ্বাস নিতে অক্ষমতা প্রকাশ প্রায়। বাড়িতে তেমন কেউ ছিলো না, ফুফু বাড়িতে দাওয়াত থাকায় তখন সেখানে গিয়েছিলো সকলে। আলোরা গেলে একটা ঝামেলা হবে ভেবে সে এড়িয়ে যায়। বাহানা দিয়ে থেকে যায়। মেহরাব খাবার খেয়ে আগপই বাড়ি চলে আসে। তোফা তাকে মিথ্যা বলেছে অসুস্থতার কথা। প্রাঙ্ক করেছিলো তার সাথে আর সে না বুঝে আলোরার সন্ধ্যাটা মাটি করে দিয়েছিলো। অনুসূচনায় দগ্ধ হয়ে সে সরি বলতে এগিয়ে যায় আলোরার ঘরের দিকে। এরপর সেই দৃশ্য দেখে থমকে যায়। শ্বাস না নিতে পারা আলোরাকে সিপিয়ার দেওয়ার জন্য প্রথমবার তার ঠোঁটে ঠোঁট ছোয়ায়। জান বাঁচানো ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তখন। কিন্তু তিন-চারবারে না হলে ছয়বার দেওয়া লাগে তার। এতে প্রতিবারেই তার কাছে আলোরার ঠোঁট বহু গুণ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে আকাঙ্ক্ষা জাগতে থাকে এক অন্যরকম পিপাসায়, সে আসক্ত হয়ে পড়ে।


মেহরাব আবারো একবার পাশ ফিরে তাকায়। না, এই মেয়েকে নিয়ে সে পারবে না। অঘটন বোঝে, আজ একটা ঘটবে। আলোরা আইসক্রিম খেতে গিয়ে সমস্ত গালে লেপ্টে নিয়েছে। আর তা আবার জিহ্বা দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে। মেহরাব এক দম নেয় আর আলোরার লোমড় আকড়ে ধরে শক্ত করে। এক হাতে তার চুলের মুঠি আকড়ে ধরেছে, ঠোঁটের খুব কাছ থেকে জিহ্বা বুলিয়ে আইসক্রিমের টুকু খেতে থাকে। এমন অনিয়ন্ত্রিত, শক্ত, বলিষ্ঠ, পুরুষালী আচমকা স্পর্শে তার শরীর ভার ছাড়তে থাকে। ছোটাছুটি তো আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে।


চলবে।


দুঃখিত কোন এক সমস্যার জন্য ১১ পর্বটি ডিলিট হয়ে গিয়েছিলো পোস্ট হওয়ার পরপর।

গল্প: বাধন হারা বেনী পর্ব ১৩

 গল্প: বাধন হারা বেনী

লেখিকা: সানজিদা আহমেদ শাহারা

পর্ব: ১৩


যখন মন মস্তিষ্ক একই সাথে কাজ করা বন্ধ করে দেয় তখনই মানুষ ভুল করে বসে। দোটানা মানুষকে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগায়। মেহরাবের আগমনে আলোরা নিজেকে বারংবার ছাড়তে বাধ্য হয়। এই স্পর্শ, এই টান, এই মায়া তাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। সে কি করবে, এই যন্ত্রণা যে এক বুক সুখ হিসাবে গায়ে মেখে নেবে, সে উপায় তো তার নেই।


মেহরাব ধীর পায়ে এগিয়ে আসে আলোরার দিকে, পেছন থেকে কোমর আগলে উন্মুক্ত পেটে হাত রাখে। হালকা চাপ লাগে পেটে, আলোরার দু'কদম পিছিয়ে মেহরাবের গায়ে হেলে পড়ে সে। চোখের কোন বেয়ে এখনে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মেহরাব তার পিঠে ঠোঁট রেখে বলে:


- কান্না থামা, আমি কি তোকে মেরেছি? আমি তোর শরীর থেকে পাবেলের স্পর্শগুলো মুছে দিচ্ছি।


- আমার পাপা হবে।


- হবে না।


- আমায় ছেড়ে দিন, মেহরাব ভাই।


- কেনো?


- আপনাকে আমার ভয় লাগে।


- কেনো?


- আমি বলতে পারবো না।


- না বললে ছাড়বো না।


- আপনি কাছে এলে আমার শরীর, আমার মন, আমার মস্তিষ্ক, আমার আওতার বাইরে চলে যায়।


- কেনো?


- জানি না।


- আহ্, মেহরাব ভাই।


- কি হয়েছে?


- এভাবে কামড় দিয়েন না। আমি সহ্য করতে পারি না।


- ঐ দেখ, আকাশে একটা পূর্ণ চন্দ্র উঠেছে। আমি ওকে জ্বালাচ্ছি, তুমি জ্বলছিস কেনো?


মেহরাব তার হাত অনবরত আলোরার পেটের এপাশে ওপাশে বিচরণে ব্যস্ত, উন্মুক্ত গলায় ঠোঁট রেখেই সে প্রশ্ন করে:


- বিয়ে করবি আমায়?


আলোরা হতবিহ্বল হয়ে তাকাতে চায় তার পানে। কিন্ত ব্যর্থ হয়ে মেহরাব তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আলোরা হতবিহ্বল হয়েই প্রশ্ন করে:


- আমি আপনাকে কিভাবে প্রশ্ন করতে পারি? আপনি তো...


- আমি যাই হই, তোর ক্ষতির কারণ হবো না।


- আই নিড ই আলোরা।


- আমার যে কত কাজ বাকি।


- আমি তোকে চাইছি আর তুই কাজ খুঁজছিস?


- বাড়ির লোক?


- আমি কিছু জানি না, আমি এখন এই মুহূর্তে তোকে বিয়ে করবো।


- আমার ভয় করছে।


- আমি ভয় ভেঙে দেবো তো।


- কিন্তু আপনি যদি হারিয়ে যান।


- না, আমি সব সময় তোর আশে পাশেই থাকবো।


মেহরাব আলোরার হাত ধরে তাকে নিচে হলরুমে নিয়ে আসে। সকলের মোটামুটি খাওয়া শেষ, পাবেল লোকচক্ষুর আড়াল হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। আলোরা জানে না সে কেন কাঁদছে, কিন্তু তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়েই যাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো, বেণীটা বাধনহারা হয়ে আধখোলা অবস্থায়। শাড়িটার আয়রন নষ্ট হয়ে গিয়েছে, জায়গায় জায়গায় ভাঁজ ভেঙেছে। ওদের এভাবে নামতে দেখে সকলে এগিয়ে আসে। মেহরাব তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে:


- আমি আলুকে বিয়ে করবো।


তার বাবা একথায় বিষম খায়, কাশি উঠে যায় তার। সে জানে ছেলে একদিন এই আবদার তার কাছে করবে কিন্তু এভাবে? এখুনি? এটা সে কস্মিনকালেও ভাবেনি।


- কি হলো, এতে কাশি আসছে কেনো? পানি খাও আর কাজি ডাকো।


এবার তার বাবার সাথে বাকি সকলে ও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অমাবস্থায়, ছেলে কি আইসক্রিম চাচ্ছে যে বাবা যাবে আর এনে দেবে! তার দাদি হায়হয় করে ওঠে।


- আমি ছোট বউকে কইলাম, কি ও মাইয়া ঘরে আছে? কাল সাপ ফণা একদিন মেলবেই। দেখছো মিলছে কিনা?


তার ফুফুও মায়ের সাথে তাল মিলায়।


- ছোট ভাবী, দেখো, দেখো, ঘরের মেয়ে করে রেখেছিলে না? কি একটা অবস্থায় পড়তে হলো এখন! ছেলেটার মাথা চিবিয়ে খেলো?


তোফা পাশ থেকে টিটকিরি করে বলে,


- এই আলোরা তোমাকে কি এমন করলো যে একটা অনাথের দায় ঘাড়ে নিচ্ছো?


মেহরাবের মা ঠাস করে একটা চড় মারে তোফার মুখে আর বলে, বেয়াদব হয়েছো? অনাথ কাকে বলছো? এতো বড় একটা পরিবার আছে, ওর চোখে দেখতে পাও না? আমার ভাগ্নি, তুমি ভাবতেই আমার লজ্জা হচ্ছে। তোফা রেখে জ্বলজ্বলে করে তাকায় আলোরার দিকে।


মেহরাব আবারও বলে, আমি আলুকে এখন এই মুহূর্তে বিয়ে করতে চাই। মেহরাবের চাচা বদরুল সাহেব গম্ভীর স্বরে বলেন:


- বিয়ে কি ছেলে খেলা? বললে আর দিয়ে দিলাম, একটা ভাবনা চিন্তার ব্যাপার আছে।


মেহরাব বলে, আমি এই রাতেই আলুকে বিয়ে করতে চাই, কাকা।


- বেয়াদব হয়েছো?


- না।


- তাহলে বড়দের মুখে মুখে কথা বলছো কেনো? আলোরা, তুমি কি এই গর্ধবটাকে বিয়ে করতে চাও?


আলোরা একবার তালায় মেহরাবের দিকে দেখে, কি থেকে কি হয়ে গেলো, কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। সে কি স্বপ্ন দেখছে? নাকি সত্যি? মেহরাবের কাকা আবারও প্রশ্ন করে:


- কি ব্যাপার, তোমার কি মত নেই?


মেহরাব রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায় আলোরার দিকে। সে মেহরাবের এমন রাগ দেখে ভয় মাথা নাড়ায়, সে রাজি। মেহরাব মুচকি হাসে। মেহরাবের চাচা চিন্তিত হয়ে মেহরাবের বাবার দিকে তাকায়, সে চোখ দিয়ে ইশারা করে আশস্ত করে। তাদের মা রাজি হয় না এই বিয়েতে। আলোরা অনাথ, তার বাবা-মা নেই এজন্য তাকে মেনে নিতে চায় না দাদি। মেহরাবের বাবা বলেন:


- আমার ছেলের যেখানে আলো মাকে পছন্দ, সেখানে আমি কোন কথা শুনবো না। লারণ জন্ম-মৃত্যু কারো হাতে নেই। তার বাবা-মা বেঁচে নেই, এতে তার কি দোষ? আল্লাহ যা ভালো মনে করেছেন, করেছেন।


আজকে তোমাদের বিয়ে দেওয়া সম্ভব না। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ো। কালকে তোমাদের এই ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিবো।


চলবে।

গল্প: বাধন হারা বেনী পর্ব ১২

 গল্প: বাধন হারা বেনী

লেখিকা: সানজিদা আহমেদ শাহারা

পর্ব: ১২


সন্ধ্যার পর থেকে টানা তিনবার সোমেহরা এসে আলোরার ঘরের দরজা ধাক্কাধাক্কি করে গিয়েছে কিন্তু বান্দা দরজা খোলার নামও নিচ্ছে না। সোমেহরা অসন্তুষ্ট হয়ে নিচে চলে যায়, এভাবে কিভাবে হবে? তারা বাসায় এসেছে সেই কখন, তখন থেকে মেয়েটা ঘরে দরজা দিয়েছে। মেহরাব ভাই নও বাসায় নেই। থাকলে হয়তো দরজা লাগানোর সাহস পেতো না।


সোহরাব কি মনে করে যেন মেহরাবকে ফোন দেয়। কিন্তু মেহরাব ফোন তোলে না। এতো বড় একটা রহস্য তারা সমাধান করলো অথচ এখনো কেউ সে ব্যাপারটা সেলিব্রেটই করলো না, আবার আলোরা চলে যাবে তাই সকলের মন খারাপ। তাই ভাই-বোনেরা মিলে ঠিক করেছে তারা ঘুরতে যাবে। বড়রাও আর আপত্তি জানায়নি। যাক, তারা ঘুরে আসুক। সেই ব্যাপারেই আলোরার সাথে কথা বলতে চেয়েছে সবাই কিন্তু সে ঘরে খিল আটেছে।


অন্যদিকে মেহরাব বাগানে তার প্রিয় চেয়ারে বসে চাঁদের দিকে ক্রোধের নজরে তাকিয়ে আছে।


চাঁদের তাতে বয়ে গেলো। হয়তো মুচকি হেসে টিপ্পনী কাটছে।


- কি মেহরাব সাহেব, এতো দুরত্ব, এতো গম্ভীরতা ছাপিয়ে অষ্টাদশী তোমাকে হারিয়ে দিলো?


(মেহরাব যেনে তা ভেবে ও ক্ষীপ্ত হলো)


- সব তোমার দোষ, চাঁদ। আমি অভিশাপ দেব তোমার, গায়েলও কলঙ্ক লাগুক।


- আমার গায়ে কলঙ্ক বহু আগেই লেগেছে। আমি তোমার মতো সুদ্ধো নষ্ট নই, আমি নষ্টই।


- আমি কন্ট্রোল করেছিলাম, বেলাজ চাঁদ।


- তারপর কি হলো?


- তোমার অষ্টাদশী আমার জলন্ত হৃদয়ে আগুনের ঘি ঢেলে পালালো।


- মূর্খ তুমি, মেহরাব সাহেব।


- শোন, চাঁদ, আমার আগুনে যেদিন আমি তেমন অষ্টাদশীকে পোড়াবো, পুরো দুনিয়া গোপন থাকবে, শুধু তুমি সাক্ষী থাকবে।


- যাও যাও, ব্যর্থ পাপী।


মেহরাব চাদের দিক থেকে চোখ না নামিয়েই কন্ঠে সুর তোলে...


বড়ই ইচ্ছে করছে ডাকতে


তার গন্ধে মেখে থাকতে


কেনো সন্ধ্যে সন্ধ্যে নামলে সে পালায়


তাকে আটকে রাখার চেষ্টা


আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে তেষ্টা


আমি দাঁড়িয়ে দেখছি শেষটা জানালায়


বোঝেনা সে, বোঝেনা


বোঝেনা, বোঝেনা, বোঝেনা


সে বোঝেনা


বোঝেনা.....


সন্ধ্যার সেই নিদারুণ লজ্জার কথা মনে পড়ায় আলোরাও আর বাইরে বের হয়নি। লজ্জা যতটুকু না এই ব্যাপারটার যে মেহরাব তার কাছে এসেছিলো, তার তিন গুণ এই ব্যাপারে যে সে ও মেহরাবের অন্যায় আবদারসভায়ের সায় দিয়েছে। কেনো সে আবেগের বহু দুর্ভFear ছেড়ে সামনের দিকে এগোতে পারে? কেনো সে এভাবে নিজেকে হলাকা হওয়াতেই ভাসিয়ে দিলো? সে আর বেরই হবে না।


তখন মেহরাব তার কাছে এসে তাকে স্পর্শ করতেই সে নিজেকে হারাতে থাকে, যদিওবা মেহরাব তার ঠোঁটের নিকটে গিয়ে বারংবার ফিরে আসছিলো; কিন্তু এই ফিরে আসা তার মন-মস্তিষ্ক মেনে নিতে অক্ষম হয়েছিল। সে ও মেহরাবের বুকের কাছের শার্ট খামচে ধরে, শক্ত করে অন্য হাতে তার পিঠের শার্ট মিশে যেতে নিলে মেহরাবের বাহু দোড়োনে মেহরাব সংবৎ ফিটে পায়, ছেড়ে দেয় আলোরাকে। আলোরাও এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে। আবেগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠার পর তার পদক্ষেপগুলো মনে পড়ার নিজেকে গুটিয়ে নেয় সে। এই লজ্জার কি জবাব সে দেবে? মেহরাবের সামনে এভাবে গুড়িয়ে যাওয়া তার মোটেও ঠিক হয়নি। মেহরাব তার ঠোঁট স্পর্শ করেনি। নিজেকে ধাতস্ত করে সে এগিয়ে যেতে তাকে দুজনেই বাড়ির দিকে। বাড়ির কাছাকাছি এসে মেহরাব চলে যায় বাগানে। আজ রাতটা সে চাঁদের সাথে বোঝাপড়া করেই কাটাবে। আর আলোরা এক ছুটে নিজের ঘরে ফিরে দরজাটা লাগিয়ে দেয়।


অন্যদিকে মেহরাব তাকায় চাঁদের দিকে। এবার চাঁদ ত্যক্ত বিরক্ত বোধ হয়। তাই তো তুই তোকারি সম্মোধন চলছে তাদের মাঝে।


- তুই অষ্টাদশীর ডাকে অষ্টারম্ভ প্রমাণিত হয়েছিস, তাতে আমার কি দোষ?


- তুই কেনো আমায় এমন মুহূর্ত পড়তে দিলি?


- তোকে কে অষ্টাদশী ঠোঁটে নির্জের দুভরলা জানান দিতে বলেছিল?


- আর একটা কথা বললে তোকে আকাশ থেকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিবো।


- সত্যি কথা সবার গায়ে লাগে।


- এখনো সময় আছে, মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়।


- এখনো সময় আছে, চুপচাপ অষ্টাদশীকে নিজের করে নে।


- আমি অপারগ।


- ও সব বাহানা।


- তুই আমার কল্পনা।


- আমি তোর ভেতরের সত্তা।


- যা তোহ্।


- আমি ছিলাম।


- চুপ, বড্ড কথা তোর।


তাদের এই নিরব বাক্যালাপের মাঝে সোহরাব ও তনিমা আসে বাগানে। বাগানের ঢোকার ফটকে বাইরে দাঁড়িয়ে মেহরাবকে ডাকে। মেহরাব পেছনে তাকিয়ে তাদের থেকে হালকা হাসে, প্রশ্ন করে কি হয়েছে। তারা বলে তারা কোথাও ঘুরতে যেতে চায়। মেহরাব বলে, এখনি না। মাত্রই তো হেমলপুর থেকে এলাম, আলোরা চলে গেলে আবার পুবালীপুরে যেতে হবে। এমন সময় একটা ফোন আসে মেহরাবের কাছে। ফোনটা কেটে দিয়ে সে হাসে সোহরাবকে বলে, সোমেহরার জন্মদিন উপলক্ষে একটা ছোটখাটো পার্টির আয়োজন কর। বাকিরা ও আসছে। অর্থাৎ তাদের খালাতো মামাতো ভাইবোনেরা। সোহরাব আর তনিমাও খুশি হয়ে যায়। এরপর তারা চলে যায়। মেহরাব আবারও আকাশ পানে তাকায়।


অন্যদিকে আলোরা কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছে কারণ এভাবে দরজা আটকে রাখলে আসতে আসতে বাড়ির সকলে এসে হাজির হবে, তা আবার বিশেষ ভালো দেখায় না। অনিমা ডাকতে এসে দরজা খোলা দেখে নিচে গিয়ে সোমেহরা ও তনিমা সোহরাবকে ডেকে আনে।


এরপর শুরু হয় তাদের বিস্তার আলোচনা কে কি করবো, পড়বে, আলোচনা সবকিছু। পরের দিন সকালে সব আয়োজন শুরু হতে থাকে। বিকালের দিকে তোফা আর রবি আসে মেহরাবদের বাড়িতে। তোফা মেহরাবের খালাতো বোন আর রবি মামাতো ভাই। আলোরার মা একা ছিলেন আর অনিমাদের মায়ের দুই ভাই-বোন তা আলোরার বাবা তো মারা গিয়েছেন। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান, আলোরা আজ শাড়ি পরবে, মেয়েদের শাড়ি পরার প্ল্যান হয়েছে শুনেই মেহরাব একপাল চেচিয়ে গিয়েছে, কিন্তু কেউ সে কথা কানে তোলেনি। সন্ধ্যায় সকলে রেডি হয়ে নিচে আসে। ছেলেরা শার্টের সাথে পছন্দসই প্যান্ট আর মেয়েরা পছন্দের শাড়ি। সবাই একসাথে হয়ে ছবি তুলতে শুরু করে। বড়রাও তাদের মোটামুটি কথা বলতে থাকে। কেক কাটার পর ডিনারের আগে সকলে নিজেদের মতো গল্প-গুজব করতে থাকে। তোফা আলোরার শাড়িতে বেখালী হয়ে পানি ফেলে দিলে সে চেঞ্জ করতে রুমে যায়। রুমটা অন্ধকার, তাই লাইট জ্বালাতে সুইচবোর্ডের দিকে এগোতে গেলে পেছন থেকে কেউ তার পেট খামচে ধরে এবং মুখ চেপে ধরে আতঙ্কে কেঁদে ফেলে সে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। ছোটাছুটি করতে গিয়ে এক পর্যায়ে সে লোকটার হাতে কামড় দেয়। এমন সময় মেহরাব তার রুমে আসে। এই পরিস্থিতিতে তখন আলোরা লাইট জ্বালাতে সক্ষম হয়। মেহরাব লোকটার পেছন থেকে কলার ধরে বসে। এটা পাবেল, মেহরাবদের ফুফুর ছেলে। মেহরাব তাকে ইচ্ছামতো পিটাতে থাকে। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে গেলে সে ছাড়ে আর ওয়ার্নিং দেয় যেনো এই বাড়ির সীমার মধ্যে তাকে না দেখা যায়। আলোরার দিকে ঘুরতেই দেখে আলোরা কাপড় জাপটে ধরে কান্না করছে। কান্নার ধমকে তার নিশ্বাস নিতে ও কষ্ট হচ্ছে। মেহরাব তার কাছে এগিয়ে গেলে সে মেহরাবের কলার ধরে বলে।


- পাবেল ভাই, কেন আমাকে এভাবে স্পর্শ করলো?


মেহরাব মলিন মুখে তাকায় আলোরার দিকে। আলোরা মেহরাবের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে বলে:


- চলে যাচ্ছি। এত কিসের ক্ষোভ, মা-ছেলের আমার প্রতি। আমায় এভাবে কেন ছুয়ে দিলো। কেন এভাবে আমাকে ছুয়ে দেবে? কেনো?


- চুপ।


- না। আমার গা ঘিণ ঘিণ করছে।


- আমি যখন কাল তোকে ছুয়ে দিলাম, তখন তোর গা ঘিণ ঘিণ করেনি?


- না।


- কেনো?


- আপনার স্পর্শে ভালোবাসা ছিলো। তাঁর স্পর্শে লালসা ছিলো।


- আমি ছুয়ে দেবো?


- মুর্ছা যাবো।


- না।


- হ্যা।


- আমি ছুয়ে দিলে সতেজ হয়ে যাবি।


- পাপা হবে আমার।


- আমার পাপেই না হয় তুমি পাপী হলে।


- না, মেহরাব ভাই।


- তাহলে কান্না থামা।


- থামছে না। কষ্ট হচ্ছে এখানে (মেহরাবের বুকে হাত দিয়ে আলোরা দেখায়)।


মেহরাব আলোরার চোখের পানি মুছে দেয়। কান্নার ধমকে কাপতে থাকা ঠোঁটজোড়া টানে তাকে। সে এগিয়ে আসে আলোরার দিকে। আলোরা ভীতু চোখে তাকায়। মেহরাব তার চোখের ভাষায় এক আকাশ সমান আকুলতা প্রকাশ করে। আলোরা সরে যায়। মেহরাব এগিয়ে যেতে থাকে আলোরার দিকে।


চলবে।


#ghiblitrend

গল্প: বাধন হারা বেনী পর্ব ১১

 গল্প: বাধন হারা বেনী


লেখিকা: সানজিদা আহমেদ শাহারা


পর্ব: ১১


তোমার ভোলাভালা হাসি  

আমার বুকের ভেতর ঝড়  

তুমি চলতি ট্রেনের হাওয়া  

আমি কাপি থরথর  

তোমার নানান বাহানায়  

আমার জায়গাটা কোথায়?  

আমি কি এক ঘোরে থাকি  

ছিল কতো কথা বাকি  

তোমার গোপন সবই রয়  

আমার আপন মনে হয়  

আমি ভোরের ঝরা পাতা  

আমার মরার কিসের ভয়........


- মন খারাপ কেনো, আলু?


- যদি বলি মেঘ শূন্য আকাশে আশ্রয় চায়তে গিয়ে বাতাস আমাকে ভূপৃষ্ঠে আছড়ে ফেলেছে?


- এমন আশ্রয়ে তুই চায়বি কেনো?


- মেঘের গর্জনে আপনার বর্ষণ বাড়ে কেনো?


- তুই মাটি হয়ে যদি সূর্যের আদলে থাকা চন্দ্রের দিকে তাকাস, তোর পতন তো নিশ্চিত।


- তবে কেনো ভুমি থেকে চন্দ্রের দুরত্ব বহুদূর হওয়ার পরও তা এতোটা কাছে মনে হয় যেনো, এইতো হাত বাড়ালেই স্পর্শ পাবো।


- বড্ড বোকা তুই।


- ইশ, যদি চালাক হতাম।


- ফিরে যা, অলু, তুই না পেয়েই সব হারালি।


- হয়তো...


- হয়তো বা না।


# আলোরাও সব না পেয়েই হারায়।


হেমলপুর থেকে তারা ফিরেছে কয়েক দিন আগেই। সেখান থেকে ফিরেই সোহরাব আর মেহরাব মিলে কোথাও একটা উধাও হয়ে গিয়েছিলো। আজ সন্ধ্যায় অনজুমান বেগমের সাথে তার কথা কাটাকাটি হয়েছে। কারণটা অবশ্য সামান্য; সকলে মিলে যখন গল্প করছিলো, তখন অনজুমান বেগম এসে তাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়েই হাতে থাকা চায়ের ট্রেটা ফেলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা তিনি পারেননি বলে উল্টো আলোরাকে একটু বেশিই কথা বললেন। তাতে আলোরা ব্যাপারটা গায়ে মাখেননি, কিন্ত যখন ঘুরে ফিরে কথা বাবামায়ের দিকে এলো, তখন আর চুপ থাকতে পারলেন না। সে তো চাইতেই যাবে, আর মাত্র সপ্তাহ খানেক এ বাড়িতে সে আছে। তা ও এতো কিসের অসুবিধা, অনজুমান বেগমের তা সে বোঝে না। তাই চুপ-চাপ ছাদে এসে বসে ছিলো সে। চাঁদের দিকে চোখ পড়তেই মন ভাকো হয়ে গেলো তার। তাই আধভাঙা সুরে একটু গান গেয়ে উঠলো। এমন সময় পেছন থেকে এসে তাকে মন খারাপের কারণ জানতে চায়।


- আপনি কখন আসলেন?


- আমি এসেছি বহু কাল আগেই।


- ওহ!


- তাহলে চলে যাচ্ছিস?


- হ্যা।


- যাক বাবা, একটা রুম ফাঁকা হবে। হাওয়া বাতাস আসবে বাড়িতে।


- হ্যা, তা আসবে।


- অনেক রাত হয়েছে, যা রুমে যা।


- এখনি না। আজ পরিবেশটা সুন্দর।


- চটপটি খাবি?


- আপনার মনে আছে?


- নাহ।


- সত্যি মনে নেই?


- কি মনে থাকবে?


- সেদিন রাতের কথা।


- কোন রাত?


- নাহ, কিছু না।


মুখে কথাটা বললেও মেহরাব মনে মনে একবার হেসে নেয়। সে রাতের কথা সে কিভাবে ভুলবে। সচরাচর বাড়ির মেয়েরা সলিন ভাবেই গেঞ্জি, প্লাজু আর উড়না বাড়িতে ব্যবহার করে। ছোট বেলা থেকে তাদের এভাবে দেখে অভ্যস্ত সকলে। মেহরাব যখন ইন্টার পরীক্ষার্থী, তখন ছোট্ট আলোরা কেবল বারো বছরের নাদান বাচ্চা, অঙ্কে কম নম্বর পাওয়াতে কোচিং এ দেওয়া হলো তাকে বাসা থেকে বেশ দূরে। কিন্তু সেখানকার টিচার তাকে মারতো। এ কথা জানতে পেয়ে মেহরাব তাকে নিজে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে তার দাদি, ফুফুসহ দুই এক জন নাখোশ হয়। কিন্তু পরে দেখা যায় যে মেহরাবের কাছে পড়ে তার রিজাল্ট আসলেই অনেক ভালো হয়। এরপর থেকে সুদীর্ঘ সময় সে তার কাছেই পড়েছে। এক অবাধ চাল চলন তার মাঝে লক্ষ্য করা যায়। মেহরাব বুঝতো এ আচরণের মানে। ঠিক তেমনভাবে সে লুকিয়ে রেখেছিলো তার না বোঝা অনুভূতিকে, তেমনি আলোরা ও সাবধানী চলাচল করতো। আলোরা একদিন পড়তে বসে খুবই ইচ্ছা করে মেহরাবের কাছে একটা সন্ধ্যা উপহার চেয়েছিলো। মেহরাব তাকে সেই সন্ধ্যার পুরোটা সময় দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু তা আর দেওয়া হয় নি। সেদিন যখন মেহরাব আর আলোরা বের হবে বলে বিকাল থেকে লাল শাড়ি, সাদা কোড়ির গয়না, কোকড়া চুলগুলোকে গুছিয়ে বাঁধছিলো, তখন তার ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে।


"আজ যাওয়া হবে না, তোফা অসুস্থ।"


এই তোফা হলো মেহরাব ভাইদের খালাতো বোন। আগুন সুন্দরী। মেহরাব ভাই তাকে বেশ গুরুত্ব দেয়। সে যা আবদার করে, দ্রুতই মেনে নেয়। তাদের পাশাপাশি মানায় ও দারুণ। তোফা আপু অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে। সেদিন কেনো যেনো বড্ড কান্না পেয়ছিলো, তার একটা সন্ধ্যায়ই তো সে চেয়েছিলো। তা ও দেওয়া গেলো না? কান্না করলে তার মাথা ব্যাথা করে, প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে সব সাজ তুলে ফেলে, সে অগোছালে হয়ে পানিতে ভিজতে থাকে। এরপর তেমন কিছু তার মনে নেয়। তবে মেহরাব সে কথা মনে করে আজও অনুসূচনা আর হারানোর ভয় অনুভব করে।


তারা সদর দরজা পেরিয়ে অনেকটা পথ হেটে এসেছে। ল্যাম্প পোস্টের নিয়ন আলোয় বড় বড় জারুল, হেজল, আম, মেহগুনি গাছের ছায়াতে দুজন নর-নারী হেঁটে চলেছে পায়ে পা মিলিয়ে। তাড়া নেই, নিরব নিভৃতে হেঁটে যাচ্ছে।


- আপনার সঙ্গে এটা আমার প্রথম সন্ধ্যা দেখা।


- শেষ দেখা।


- ওহ হ্যা।


- সামনের মোড়ে চল, চটপটি আছে।


- খাবেন?


- না।


- ও, আপনি তো আবার ঝাল খান না।


- একদম না।


- আচ্ছা, তোফা আপু কেমন আছে?


- জানি না।


- সে কি? আপনারা তো বন্ধু আবার ভাই-বোন।


- সময় দূরত্ব এনে দেয়।


- সময় নয়, আমরা নিজেদের মাঝে দূরত্ব এনে দেয়।


- কি বলতে চায়ছিস?


- যা আপনি শুনতে চান না।


- তাহলে ভাবিসও না।


- ঠিক আছে।


- আয়....


- মামা, এক বাটি চটপটি দেন তো।


- না মামা, দু'বাটি।


- আমি খাবো না।


- আজ একটু খান।


(মেহরাব তাকায় আলোরার মুখের দিক, কি বিপর্যয় মায়া মেয়েটার মুখের মধ্যে।)


- আচ্ছা মামা, দু'বাটি দিন।


- আচ্ছা।


- কোন শহরে যাবি?


- ক্যালিফোর্নিয়া।


- এতো দূর?


- একটু দূর।


- এই ne ধর এই বাটি তোর।


(প্রসন্ন অধরে হাসে আলোরা, হাত বাড়িয়ে বাটিটা নেয়। অন্যটা মেহরাব নেয়।)


মিনিট পনের পরে খাওয়া শেষ হয় তাদের।


- চল বাসায় যাই।


- চলেন।


- ঐ তো একটা আইসক্রিমের ভ্যান, চল যাই।


- চলেন।


- মামা, দুটো আইসক্রিম দেন তো।


- দুটো নেই। গরম আজকে একটা আছে।


- তবে একটায় দেন।


- নে ধর, তুই খা। পিচ্চি।


- আমি পিচ্চি না।


- না, তুই তো পচা আলু।


- আপনি আমাকে রাগাচ্ছেন কেনো?


- তুই ঠোট চাবাচ্ছিস কেনো?


- ওই তো ঠান্ডা আইসক্রিম ঠোঁটে লাগায়, শিরশির করছে তাই।


- যন্ত্রণা, বন্ধ কর ঠোঁট চাবানো।


- আরে।


- আগে কর।


- ওকে।


মেহরাব হাপ ছেড়ে বাঁচে। আজ মেয়েটা কুর্তি আর সালোয়ার পরে এসেছে। খোলা চুল, কানে ছোট একদুল, কানের পাশে তিলটা তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। গোলাপি আভাযুক্ত ঠোঁটের নিচের পাশে বাম কোনায় তিলটা জ্বলজ্বল করে রয়েছে। উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁটে বাইট করলে তা আলো স্পর্শকাতরভাবে আবেদনীয় হয়ে উঠছে। মেহরাব ঘন শ্বাস ফেলে। তার পরে মনে পড়ে সেদিন রাতের কথা; এলোমেলো অবস্থায় বাথরুমের ফ্লোরে শাওয়ারের পানিতে লেপ্টে থাকা আলোরা শ্বাস নিতে অক্ষমতা প্রকাশ প্রায়। বাড়িতে তেমন কেউ ছিলো না, ফুফু বাড়িতে দাওয়াত থাকায় তখন সেখানে গিয়েছিলো সকলে। আলোরা গেলে একটা ঝামেলা হবে ভেবে সে এড়িয়ে যায়। বাহানা দিয়ে থেকে যায়। মেহরাব খাবার খেয়ে আগপই বাড়ি চলে আসে। তোফা তাকে মিথ্যা বলেছে অসুস্থতার কথা। প্রাঙ্ক করেছিলো তার সাথে আর সে না বুঝে আলোরার সন্ধ্যাটা মাটি করে দিয়েছিলো। অনুসূচনায় দগ্ধ হয়ে সে সরি বলতে এগিয়ে যায় আলোরার ঘরের দিকে। এরপর সেই দৃশ্য দেখে থমকে যায়। শ্বাস না নিতে পারা আলোরাকে সিপিয়ার দেওয়ার জন্য প্রথমবার তার ঠোঁটে ঠোঁট ছোয়ায়। জান বাঁচানো ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তখন। কিন্তু তিন-চারবারে না হলে ছয়বার দেওয়া লাগে তার। এতে প্রতিবারেই তার কাছে আলোরার ঠোঁট বহু গুণ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে আকাঙ্ক্ষা জাগতে থাকে এক অন্যরকম পিপাসায়, সে আসক্ত হয়ে পড়ে।


মেহরাব আবারো একবার পাশ ফিরে তাকায়। না, এই মেয়েকে নিয়ে সে পারবে না। অঘটন বোঝে, আজ একটা ঘটবে। আলোরা আইসক্রিম খেতে গিয়ে সমস্ত গালে লেপ্টে নিয়েছে। আর তা আবার জিহ্বা দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে। মেহরাব এক দম নেয় আর আলোরার লোমড় আকড়ে ধরে শক্ত করে। এক হাতে তার চুলের মুঠি আকড়ে ধরেছে, ঠোঁটের খুব কাছ থেকে জিহ্বা বুলিয়ে আইসক্রিমের টুকু খেতে থাকে। এমন অনিয়ন্ত্রিত, শক্ত, বলিষ্ঠ, পুরুষালী আচমকা স্পর্শে তার শরীর ভার ছাড়তে থাকে। ছোটাছুটি তো আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে।


চলবে।


দুঃখিত কোন এক সমস্যার জন্য ১১ পর্বটি ডিলিট হয়ে গিয়েছিলো পোস্ট হওয়ার পরপর।

গল্প: বাধন হারা বেনী পর্ব ১০

 **গল্প: বাধন হারা বেনী**  

**লেখিকা: সানজিদা আহমেদ শাহারা**  

**পর্ব: ১০**


সেদিন এর পর তারা একটি ফাঁদ পেতে ছিলো। সেই ফাঁদে যে আটকে পড়েছিলো, সে আর কেউ না, স্বয়ং রাহিলা বেগমের বোন তাসলিমা বেগম। তিনি জীবিত ছিলেন এবং বেঁচে ছিলেন। উনি এবং রাহিলা বেগম মিলে গ্রামের মানুষদের পরিকল্পনা করে ভয় দেখাতেন; এখানে সাহায্য করত রাহিলা বেগমের ছেলে। ঐ যে টেপরেকর্ডারটা সেদিন পেয়েছিলো, তার উপর থেকে পরিষ্কার করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে ল্যাব টেস্টে পাঠানো হলো। এখানে দুজন নয় বরং চারজন মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়। মেহরূব তার একটি বিশেষ পাওয়ার খাটিয়ে সরকারি ডেটাবেজ থেকে সেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিং করায়। এখানে সাফ সাফ প্রমাণ হয় এই চারটি ফিঙ্গারপ্রিন্টের; এর দুটি মেহীাব ও আলোরার আর দুটি রাহিলা বেগম এবং উনার ছেলে জসিমের। এখন রাহিলা বেগমের প্রথম জবানবন্দি অর্থাৎ প্রথমবার অফিসে এসে যা যা বলেছেন, তা অ্যানালাইজ করে দেখা গেলো যে উনি সন্দেহজনক। সেই মোতাবেক ওনাকে জানানো হলো যে আমরা একটি বিশেষ জিনিসের জন্য পাচ্ছি জমিদার বাড়িতে, হয়তো আপনার বোনের জন্য গায়েব হয়ে গিয়েছিলো। উনি মিনিট পনেরো’র মধ্যে ছেলেকে নিয়ে হাজির। তিনি ফাঁদে পা বাড়ান।


উনাকে জেরা করা শুরু হয়। দারুণ সুচতুর ব্যক্তি তিনি, সহজে হাতে আসার মতো নন। এরপর যখন মেহরাব সবটা সামনে তুলে ধরে, তখন তিনি তাঁর আসল রূপে ফিরে আসেন।


নিজের বাবা-মায়ের নামে কঠিন সব কথা শুনে হয়তো সহ্য হয়নি তাঁর; এজন্যই কঠোর খোলস থেকে বেরিয়ে এসে সত্য শিকার করেন।


রাজতরঙ্গীনি ও সাধু কামরূপ কামাক্ষায় অগ্নি সাক্ষী রেখে বিবাহ করেন। আর দেশে ফিরে সেই ভালোবাসার পরিণতি স্বরূপ তাঁর গর্ভে আসেন তাসলিমা বেগম ও রাহিলা বেগম। যাদের প্রকৃত নাম কেউ রাখেননি। রাজা এই খবর বাইরে যেতে দেননি। এক বিশস্ত দাসের মাধ্যমে কন্যা দুটি হত্যা করার জন্য মহল থেকে বের করে দেন। তরঙ্গীনিকে বলা হয়, তার মৃত বাচ্চা হয়েছে। এরপর থেকে কালো যাদুর প্রভাবে সে সাজা নিতে শুরু করে। কিন্তু সেই দাস নিঃসন্তান থাকায়, তার স্ত্রী সেই সন্তানদের অন্য গ্রামে এসে মানুষ করতে শুরু করে। তারা প্রাণে বেঁচে যায়, হিন্দুর ঘরে জন্ম নিয়ে ও মুসলমানের ঘরে বড় হলো তারা। নাম পরিচয়, আদর স্নেহ সবই পেলো। তবে জমজ হলেও তাদের চেহারায় খুব একটা মিল ছিল না। তবে তাদের প্রকৃত বাবা-মায়ের সঙ্গে বেশ মিল ছিলো বলে জানায় তার পালিত মা। মরার আগে তিনি এ সম্পর্কে বিশদ সব বলে যান। এবং তাদের প্রমাণ স্বরূপ জন্মের সময়ের গয়নাগুলো ও বাকি সব তথ্যে দিয়ে যান। কিন্তু তা তাদের জমিদার বাড়ির সন্তান প্রমাণিত করতে বসার্থ হয়। সেখান থেকে শুরু হয় দুই বোনের নিজেদের অস্তিত্ব ফিরে পাওয়ার লড়াই। কিন্তু তারা যে কখন ভুল পথে পা বাড়িয়ে ফেলেছে, তা তারা বুঝতে পারেনি। সম্পত্তির লোভ, জমিদার নাতনীর পরিচয় এবং একটু ভালো থাকার আশায় তারা মত্ত হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, পুরো গ্রামে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে।


তবে তারা রহস্যময় সেই জমিদার বাড়ির রহস্যের বেড়া জালে আটকা পড়েছিলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো নিজের বাবার সমাধিটা খুঁজে বের করা। পালিত মায়ের থেকে জেনেছিলো, সকলে মারা যাওয়ার পূর্বে তাদের প্রিয় ও মূল্যবান গয়না কোনো এক গোপন জায়গায় রাখা। তা খুঁজে বের করার জন্য এই জায়টা জনমানব শূন্য হওয়া প্রয়োজন ছিলো। তাই প্রথমে এত সেনসিটিভ ইস্যু নিয়ে নাটক করে মনোযোগ ও ভয় সৃষ্টি করেন তাসলিমা বেগম। এরপর মাঝে মাঝে এখানে ওখানে বা জেলেদের দেখা দিয়ে ভয়টাকে মনে টিকিয়ে রাখেন। যদি কোন পথচারি ঐ পথ দিয়ে রাতে যেতেন; তবে ঐ নিদিষ্ট সময়ে বাঁধা পড়লে সেই আওয়াজ শুনতেন এবং ভয় পেতেন। মাঝে মাঝে ভয় অনুযায়ী লেজার লাইটের ছায়া ভয় প্রদর্শন করা হতো, তাতে ভৌতিকতার মাত্রা আরো বেড়ে যেতো। যেমন ভয় পেয়েছিলো আলোরা ও অনিমা।


ঐ পাজেল সমাধান প্রথম করেন রাহিলা বেগম। তিনি দরজা খুলে প্রথম চাবি বের করেন; এরপর তা দিয়ে দরজা খুলে ঐ অন্ধকার ঘরের নিচের বেসমেন্টে তার জন্মদাতা পিতার জীবন্ত সমাধি দেখেন এবং তাদের এই করুন পরিস্থিতির জন্য কষ্ট পান। এরপর গুপ্তধনের খোঁজে পড়েন কিন্তু তা পাওয়ার সম্ভাবনা আসতীত হলে তিনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি ভেবেছিলেন, আমরা হয়তো তার ফাঁদে পা দিয়ে তাসলিমা বেগমকে খুঁজে বের করবো এবং এক সময় আমাদের মাথা খাটিয়ে তা গুপ্তধন খুঁজে বের করবে, এবং আমাদের বিপদে ফেলে পালানোর একটা সম্ভাবনা আছে। কারণ রাজেন্দ্র জানতেন, অপুত্রক তিনি মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণের পর পরই তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে এবং তার সব ধন সম্পত্তি আত্মীয়রা লুটে নিবে। যেহেতু শেষ সময়ে তার কোনো وارিস নেই, তাই তিনি তার সঙ্গে এই জমিদার বাড়ির জমিদারিত্ব শেষ করে যান। সে সব সম্পত্তির কাগজ আর বাকি ধন-সম্পত্তি পাহারায় আছে প্রায় সাড়ে চার শতাধিক সরীসৃপ জ্বীনের কাছে। আর এই তথ্য মেহরাব জানতে পারে, সেই বৃদ্ধা মহিলা জৃবীন সাপের কাছ থেকে, যিনি প্রথম দিন সোহরাবকে ফিরে দিতে বলেছিলেন ঐ জমিদার বাড়ির।


নিজেদের আমলনামা সামনে আসার পর রাহিলা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন, নিজেদের অস্তিত্ব ফিরে পেতে চাওয়ার অনশায়। কিন্তু তারা যে পথ অবলম্বন করেছে, তা ভুল ও অন্যায় পথ। এরপর রাহিলা বেগম আড়াল থেকে তাসলিমা বেগমকে সামনে নিয়ে আসেন এবং সে সময় তাদের ছলে ছলে চোখের দৃষ্টিতে মায়া হয় সবার। এদের ভুল সুধরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। বৃদ্ধা দুজনকে গ্রামে রেখে তার ছেলে জসিমকে নিয়ে যায় শহরে এবং চাকরি দেয় তাকে।


এর সাথে শেষ হয় #দর্পনে_ছায়া টিমের আর একটি রোমাঞ্চকর একটা যাত্রা। তারা রওনা দেয় শহরের সেই কোলাহল পূর্ণ শরগমে জায়গায়। যাওয়ার সময় সকলে এই সবুজ গাছপালা, জমিদার বাড়ি, এই মায়াময় গ্রাম এবং জমিদার বাড়ির সকলের করুন পরিণতির কথা ভেবে অন্যরকম এক কষ্টের অনুভব হতে থাকে তাদের। তবে যে কাজে এসেছিলো তারা, তা সম্পন্ন করতে পেরে সকলের মনে একটা আলাদা শান্তি বিরাজ করছে।


**চলবে.....