গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ৩৫

 প্রিয় বেলা


৩৫.

এলোমেলো, অবিন্যস্ত ঘরের আশপাশে চোখ বুলাতেই গাল ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো বেলা। সকালে রুম গোছানো হয়নি। সে তো ঘুম থেকে উঠেই পালিয়ে, পালিয়ে বেড়িয়েছে। লজ্জার অসহনীয় যন্ত্রণায় আদ্রর সামনে আসতে পারেনি। কিন্তু শেষে তো পাষাণ নেতার হাত থেকে রক্ষা মেললো না! ধরা দিতেই হলো। সোফায় অযত্নে পরে থাকা সাদা পাঞ্চাবীটা সযত্নে হাতে নিলো বেলা। বুকে চেপে ধরলো। পাঞ্চাবীতে আদ্র, আদ্র ঘ্রাণ আছে। মোহনীয়, স্নিগ্ধ ঘ্রাণ। যেন সে তার একদম কাছেই আছে। খুব কাছে। দেওয়ালে টাঙানো গুটিকয়েক ছবিগুলোর মাঝে হঠাৎ-ই একটা অচেনা, অপরিচিত ফ্রেম দৃষ্টি গোচর হলো বেলার। তারই ঘুমন্ত মুখশ্রী স্পষ্ট করে তোলা। আদ্রর প্রশস্ত বুকের একাংশ দেখা যাচ্ছে। পাঞ্চাবীটা ভাঁজ করে সোফায় রাখলো সে। এগিয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে আলতো করে ছুঁলো ফ্রেমটা। কাল রাত্রিবেলাও দেওয়ালের ক্ষীণ জায়গাটা ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা। তার স্পষ্ট মনে আছে। তবে কোত্থেকে এলো ছবিটা? আদ্র লাগিয়েছে? কখন? সে যখন রুমে ছিল না? ভাবনা শেষ হলো না। তীব্র ছেদে সম্বিৎ ফিরলো। আয়াজের গলা শোনা যাচ্ছে। দরজার ওপাশ থেকে সে ডাকছে,

---"ভাবী? আসতে পারি?"


চমকিত বেলা দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো ফ্রেম থেকে। চারিদিকে চোখ বুলালো। কমবেশি লাগছে। অতটাও অগোছালো নয়। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো,

---"আসুন ভাইয়া।"

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো আয়াজ। ঠোঁটে কিঞ্চিত পরিমাণ বিস্তর হাসি। সরাসরি সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলো,

---"কাজ করছিলে? ডিস্টার্ব করলাম?"

---"না, না। এমনিই ঘর গোছাচ্ছিলাম। আপনি কিছু বলবেন ভাইয়া?"


আয়াজ আড়মোড়া ভাঙ্গলো। হামি দিলো দু'তিনবার। কথা বলতে সময় লাগালো। ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে শুধালো,

---"ভাই কাজ দিয়েছিলো একটা। আমি করতে ভুলে গিয়েছিলাম। তোমার যেন কোন কোন বই লাগবে? আমাকে লিস্ট করে দিও। আমি এনে দেব।"


বলতে বলতে ঘুমে ঝিমিয়ে উঠলো সে। তন্দ্রায় নেত্রজোড়া খুলে রাখা যাচ্ছে না। মাথা ঝিমঝিম করছে। দু'হাতে চোখ কচলে বিরক্তি প্রকাশ করলো আয়াজ। অসন্তোষ ভাব ফুঁটে উঠলো। বিকৃত হলো চেহারা। বেলা অবাক নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখলো তাকে। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

---"আপনি কি সারারাত ঘুমাননি?"

আয়াজের সহজ স্বীকারোক্তি, "নাহ্। চৈতির সঙ্গে কথা বলেছি। মেয়েটাকে আজকাল সময় দিতে পারছিলাম না তো। তাই কাল সারারাত ওর অভিযোগ শুনতে শুনতে আর ঘুমানো হয়নি।"


আবারও হামি দিয়ে উঠলো আয়াজ। নেত্রকোণে ক্ষীণ জলেরা ভীড় জমালো। কথা অসমাপ্ত হয়ে থেমে গেল। বেলা মুচকি হেসে বললো,

---"আপনারা বিয়ে করছেন না কেন ভাইয়া? তবেই তো সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।"

আয়াজের মুখশ্রীতে দুঃখী, দুঃখী ভাব ফুটে উঠলো। হতাশায় নিমজ্জিত হলো মন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অত্যাধিক অসহায়ত্ব নিয়ে কাতর গলায় বললো,

---"চাইলেই তো বিয়ে করতে পারছি না ভাবী। চৈতির অনার্স শেষ হতে আরও দুই তিন বছর লাগবে। এর আগে ওর বাবা রাজি হবেন না। এ কয়যুগ ছ্যাঁকা কবি রুদ্র না হওয়া ছাড়া তো আর উপায় নেই।"

একটু থেমে আয়াজ আবার বললো, "আমি দেখি, একটু পর ঢাকা যাবো ওর সঙ্গে দেখা করতে। তখন তোমার বইও নিয়ে আসবো।"

বেলা পলক ঝাপটালো। বিমূঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, "চৈতি আপু ঢাকায় থাকেন?"

---"হ্যাঁ। তুমি জানতে না?"


বেলা মাথা নাড়ালো। সে জানতো না। ততক্ষণে আয়াজের ঘুম মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে। আস্তে ধীরে উঠে রুমে চলে গেল সে। অনেকটা ঢুলুঢুলু, নড়বড়ে পায়ে।


-


পাশের বাড়িতে ঝগড়া হচ্ছে। তীব্র থেকে তীব্রতর। কানে হর্তাল লেগে যাচ্ছে। শব্দরোধের আন্দোলন করছে প্রতিটা জীবের শ্রবণযন্ত্র। রেখা রান্না করছিলেন। বেলা ঠিক তার পাশেই দাঁড়ানো। হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিচ্ছে। চুলার আঁচ অল্প কমিয়ে তরকারিতে আলু ঢেলে দিলেন রেখা। কি ভেবে মুচকি হেসে বললেন,

---"জানো বেলা, আদ্রর বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কোথাও যেতে দিতেন না। খুব খেয়াল রাখতেন। আমাদের কখনো বড়োসড়ো ঝগড়া হতো না। যারই দোষ থাকুক না কেন, তিনিই আগেভাগে ক্ষমা চেয়ে ঝামেলা মিটিয়ে নিতেন। কিন্তু রাজনীতির কারণে আস্তে আস্তে কেমন যেন পালটে গেলেন। ব্যস্ত থাকতেন। ব্যবসায় মন দিতে পারতেন না। আমাদের জন্য সময়ও ছিল না তার। কষ্ট করে, সবার বিরুদ্ধে গিয়ে এমপি হলেন। সেদিন কি খুশিই-না ছিলেন তিনি! চেহারা থেকে চোখই ফেরানো যাচ্ছিল না। 

উনার ব্যস্ততা বাড়লো। বাহিরের থাকা শুরু করলেন। বাসায় তেমন আসতেন না। সে যে কবে আমাদের সঙ্গে অনেক্ষণ সময় কাটিয়েছেন, আমার মনে নেই। সবসময় চিন্তায় থাকতেন। আমাকে কিছু খুলেও বলতেন না। এরপর তো এক বছর বাসায়ই আসলেন না। আমার পরিবার ভাবলো, উনি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আর আসবেন না। সেসময়টা যে কি কষ্টের ছিল! সবাইকে ভুল প্রমাণ করে আদ্রর বাবা এলেন একদিন। ওটাকে আসলে আসা বলে না। চিরদিনের জন্য চলে যাওয়া বলে। ময়লার ডাস্টবিনে ওনার ছিন্ন শরীরটা পরে ছিল। পঁচে গিয়েছিল উনার প্রতিটা চামড়া। চেহারার মাংসগুলো গলে কেমন যে দেখাচ্ছিল! গন্ধে টেকা যাচ্ছিল না এলাকায়। এ কারণে কেউ লাশ গোসল করাতে চাচ্ছিল না। ছোট্ট আদ্র তখন কি বলেছিলো জানো? 'মা, আমাদের কাউকে লাগবে না। আমি, আয়াজ, আরু আর তুমি মিলে বাবাকে গোসল করাবো। কিভাবে করাতে হয় সেটা তো আমি জানি না। তুমি আমাকে বলে দিও, ঠিকাছে?' 

আমি কান্নায় অজ্ঞান হচ্ছিলাম বারবার। অথচ আমার ছেলেটা কতটা সাহসের সঙ্গে কথাটা বলেছিল। আমার চোখে এখনো ভাসে সেই সময়টা।"


থামলেন রেখা। নেত্রযুগল অশ্রুসিক্ত হয়ে আছে। আঁচল দিয়ে পানিটুকু মুছলেন। কৃত্রিম হেসে বললেন, "তুমি একটু তরকারিটা দেখো তো বেলা। গরম লাগছে। আমি একটু ফ্যানের নিচে গিয়ে বসি।"


রেখা চলে গেলেন। বেলা সেদিকে ম্লান চোখে চেয়ে রইলো শুধু। বুক ভারী হলো খুব। অজানা আতঙ্কে কম্পিত হলো সর্বাঙ্গ। আদ্রকে নিয়ে ভয় হলো। ভীষণ ভয়।


-


আকাশে চাঁদ নেই। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে শত্রুতা করে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্পষ্ট হয়ে আছে পিচ ঢালা রাস্তা। দু'তিনটে কুকুর আধো আধো ভাবে দেখা যাচ্ছে। নিজেদের মাঝে রেশারেশি করে প্রচন্ড চেঁচাচ্ছে তারা। ঘেউ ঘেউ করছে বিরতিহীন। বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। ঝিঝিপোকার ঝি, ঝি শব্দও কানে বাজছে। হঠাৎ শক্ত, পুরুষালি এক জোড়া হাত এসে বেলার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। ঘর্মাক্ত বুকে ঠেকে গেল পিঠ। চমকিত হয়ে পাশ ফিরবার আগেই কাঁধে থুতনি ঠেকালো সুদর্শন লোকটা। ক্লান্ত মুখ দৃশ্যমান হলো। ঘেমে একাকার কপাল। ফর্সা ত্বকে রক্ত জমে লাল আবরণ। ললাটে লেপ্টে আছে ঝাঁকড়া চুলগুলো। বেলা টের পেল, আদ্রর শরীরে শার্ট, পাঞ্চাবী কিছুই নেই। উন্মুক্ত বলিষ্ঠ দেহ। লাজুকলতা লজ্জায় সিক্ত হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। ইতস্তত কণ্ঠে মিনমিন করলো,

---"কখন এলেন?"

---"এইমাত্র।"

---"খেয়েছেন?"

---"হ্যাঁ। তুমি খেয়েছো?"

---"জি, মা খাইয়ে দিয়েছিলেন।"


কথার পিঠে আর কিছু বললো না আদ্র। বেলাও কথা বাড়ালো না। আস্তে আস্তে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ বেড়িয়ে এলো। অর্ধ চাঁদ। আদ্র দূরত্ব ঘুচালো। প্রগাঢ় হলো স্পর্শ। বেলা হকচকায়। বড় বড় হয় চোখ। কড়া কণ্ঠে বলতে চায়,

---"কি করছেন আদ্র? দূরে সরুন।"


আদ্র দূর্বোধ্য হাসলো। অবাধ্য হলো খুব। প্রতিউত্তরে কিছুই বললো না। বেলা আবারও অনুরোধ করলো, "সরছেন না কেন? বারান্দায় এলেই আপনি এমন কেন করেন?"

আদ্রর দৃঢ় দৃষ্টি, গাঢ় উত্তর, "তুমি লজ্জা পাওয়া বন্ধ করে দাও। আমি আর এমন করবো না।"


বেলা গাল ফুলালো। লোকটা সবসময় কথার জালে ফাঁসিয়ে দেয় তাকে। অসম্ভব শর্ত জুড়ে দেয়। কোমল, নরম হাতজোড়া দিয়ে আদ্রর কঠিন হাতটা সরিয়ে দিতে চাইলো বেলা। পারছে না। আবারও চেষ্টা করতেই সরব আদ্রর হাতে কামড়ের দাগ দেখতে পেল সে। সুগভীর দাঁতের দাগ। চামড়া ভেদ করে গেছে ক্ষতটি। রক্ত শুকিয়ে লেগে আছে। আটটা দাঁতের ছাপ সুস্পষ্ট। 

বেলা উৎকণ্ঠা হলো। ক্ষতের পাশ ঘেঁষে সাবধানে হাত বুলালো। ব্যগ্রতা নিয়ে কম্পয়মান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, "আপনার হাতে এমন কামড়ের দাগ কেন?"


আদ্র ক্ষতস্থানে তাকালো। মনে পরলো, আজ বিকালে ইখতিয়ার তার হাত কামড়ে দিয়েছিল। পরে ব্যস্ততায় হাতটা ব্যান্ডেজ করার সুযোগ হয়নি। তপ্ত নিশ্বাস ফেললো সে। কথা পালটে প্রশ্ন করলো,

---"আজ সারাদিন কি করলে? আয়াজ বই এনেছে তোমার?"


বেলা শুনলো কি আদ্রর কথা? শুনলো না বোধহয়। ব্যথাতুর নয়নে তাকিয়ে রইলো। টলমল করলো চোখ। দমবন্ধকর কণ্ঠে বললো, "কিভাবে হলো এটা? রক্ত কেমন শুকিয়ে জমে গেছে দেখেছেন? আসুন, আমি ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।"


আদ্র থমকে দাঁড়ানো। চোয়াল শক্ত। নেত্র অনিমেষ, পলকহীন, অনড়। সর্বত্রে গম্ভীরতা খুব ভাবে ফুটে উঠেছে। বেলার ক্রন্দনরত মুখশ্রী অদ্ভুদ দাম্ভিক শান্তি দিচ্ছে ভেতরটায়। দৃষ্টি নড়বড়ে হলো হঠাৎ। বেসামাল হলো নিষিদ্ধ ইচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ হারা হলো। বেলাকে কাছে টেনে নিলো সে। শূণ্য মস্তিষ্কে অধরে অধর ছুঁইয়ে দিলো অধৈর্য ভঙ্গিতে।


______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ৩৪

 প্রিয় বেলা


৩৪.

জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকছে বেলা। শরীরের উষ্ণতা দ্বিগুণ বেড়ে তেজস্বী হয়ে উঠছে। আদ্রর সঙ্গে লেপ্টে আছে খুব গভীর ভাবে। গায়ে দু'টো কম্বল জড়ানো। এসির তাপমাত্রা কমিয়ে দেওয়া। উত্তপ্ত বেলার সংস্পর্শে এসে ঘাড়, গলা, কপাল ঘেমে একাকার হয়ে আছে আদ্রর। বাহিরে তখনো বৃষ্টি চলমান। বজ্রপাত হতেই তীব্র আলোয় আকাশ ঝলসে উঠছে সেকেন্ড কয়েকের জন্যে। গুড়ুম, গুড়ুম আওয়াজে মুখরিত হয়ে আছে আশপাশ। প্রকট ভাবে শোনা যাচ্ছে এর তীব্রতা। দৈবাৎ ক্ষীন নড়েচড়ে উঠলো বেলা। গাল ঘঁষলো বিস্তর শক্ত পুরুষালি বুকে। দূর্বল হাতে শার্ট খামচে ধরলো। বিড়বিড় করে কি যেন বললো। বুঝতে পারলো না আদ্র। আদুরে ভাবে আগলে ধরলো তাকে। চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

---"কি হয়েছে বেলা? খারাপ লাগছে? বেলা? আমার দিকে তাকাও।"


বেলা তাকালো না। হাঁসফাঁস করতে লাগলো। নেত্রপল্লব খিঁচে বুজে রাখা। মুখশ্রী রক্তশূণ্য হয়ে ভীষণ ফর্সা দেখাচ্ছে। ফ্যাকাসে হয়ে আছে অধরযুগল। কম্পিত কণ্ঠে খুব অস্পষ্ট ভাবে থেকে থেকে সে কোনোমতে বললো,

---"আমার মাথা ব্যথা করছে আদ্র। আমি সহ্য করতে পারছি না।"


বক্ষস্থলে যেন হঠাৎই পাথরের আবির্ভাব ঘটলো। প্রচন্ড ভারী হয়ে উঠলো নিমিষেই। আপনা-আপনি ডান হাতের পাতা বেলার ললাট স্পর্শ করলো। আগের চেয়ে গরম লাগছে। ক্ষীণ কম্পয়মান শরীর খুব ভাবে কাঁপিয়ে তুলছে তার ভেতরটা। অশান্ত, অস্থির কণ্ঠ শান্ত, স্বাভাবিক করে আদ্র শুধালো,

---"বেশি খারাপ লাগছে? দেখি, আমাকে ছাড়ো। আমি ঔষধ খুঁজে আনছি।"

বেলা বিন্দুমাত্র সরলো না। অবাধ্য হলো। খামচে ধরা হাতটার শক্তি আরও বাড়িয়ে আহাজারি করে উঠলো,

---"আপনি যাবেন না। কোথাও যাবেন না।"

---"ঔষধ খেতে হবে তো বেলা। ব্যথা বেড়ে যাবে না?"

---"বেড়ে যাক। তবুও যাবেন না।"


প্রেমিকার নাছোরবান্দা স্বভাবে মুহুর্তেই পরাজিত হলো প্রেমিক পুরুষ। পরাস্ত নয়নে বেলার কাতর মুখশ্রীর পানে চেয়ে রইলো খুব করে, অনেক্ষণ লাগিয়ে। সিক্ত নেত্রজোড়া পরখ করলো। মায়াবী মুখখানায় আরও একবার আহত হলো খুব বাজেভাবে। ক্ষতবিক্ষত হলো হৃদযন্ত্র। কোমলস্বরে বললো,

---"আচ্ছা, যাচ্ছি না। এই তো আছি। কাঁদে না।"

নিষ্ঠুর অশ্রুকণা কি শুনলো তা? একদমই না। প্রিয় মানুষটার আরেকটু আহ্লাদ পেতেই তরতর করে গতিপথ বাড়িয়ে দিলো। শার্ট ভিঁজিয়ে দিলো অতি সন্তপর্ণে।


সময় গড়িয়েছে। বৃষ্টি থেমেছে কিছুক্ষণ হলো। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। রবির শেষ কিরণ জানালা গলিয়ে আদ্রর সারা মুখে ছড়িয়ে আছে। একটু আগেও চোখের পাতা তন্দ্রার কারণে মেলতে না পারলেও এখন সে পালিয়েছে। কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না। বেলার কান্নার আভাস নেই। তার বুকে গুটিয়ে শুয়ে আছে সে। নিশ্বাস নিচ্ছে ঘন ঘন। চুল এলোমেলো হয়ে গেছে আবার। আদ্র চুলগুলো এলোমেলোই রাখলো। ঠিক করলো না। অবিন্যস্ত বেলার খুব গভীরে ডুবলো। আঁচলের ভাঁজে ভাঁজে দৃষ্টি ঘুরালো। অন্যরকম গলায় ডাকলো,

---"বেলা।"


ক্ষীণ কন্ঠস্বরে উত্তর দিলো বেলা,

---"জি।"

---"ব্যথা কমেছে?"

বেলা মাথা ঝাকালো। তবুও আবার প্রশ্ন করলো আদ্র, "সত্যি কমেছে?"

---"হ্যাঁ।"

---"তবে আমি যদি একটু বেহায়া হই?"

নিঃসঙ্কোচ আবদারের পিঠে বেলা চমকালো, ভড়কালো, বিহ্বল হলো। তৎক্ষণাৎ নজর তুলে তাকালো। বিমূঢ়তায় কি বলবে ভেবে পেল না। পলক ঝাপটালো। লাজুক রাঙা হলো গাল। চোখ দু'টো নুইয়ে গেল। নীরবে সম্মতি পেতেই দূর্বোধ্য হাসলো আদ্র। আদুরে ভাবে কাছে টেনে নিলো বেলাকে।


-


সকাল থেকে বেলা রান্নাঘরে কাজ করছে। আদ্রর সামনে আসছে না। গলা উঁচিয়ে কয়েকবার ডাকার পরও মেয়েটার আসার নাম নেই। এতে মারাত্ত্বক বিরক্ত আদ্র। চোখ, মুখ ভীষণ কুঁচকানো। ভ্রঁ বাঁকানো। ধপধপ পায়ে ড্রইংরুমে এসে সোফায় বসলো সে। রান্নাঘরে আড়নজরে তাকালো। কিন্তু বেলার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। যেন অদৃশ্য হওয়ায় প্রাণপণ প্রতিজ্ঞা করেছে মেয়েটা। আয়াজ বসে বসে আদ্রকে পর্যবেক্ষণ করছিল। আদ্রর দেখাদেখি সেও রান্নাঘরে একবার উঁকি দিলো। জিজ্ঞেস করলো,

---"বেলাকে খুঁজছিস ভাই?"


আদ্রর গম্ভীর কণ্ঠ, "না।"

আয়াজ মুচকি হাসলো,

---"ঝগড়া করেছিস?"

---"না।"

---"তাহলে?"

---"লজ্জা পাচ্ছে। সামনে আসতে চাইছে না।"


গম্ভীর কণ্ঠের হাস্যকর অভিযোগ। আয়াজ নিজেকে আটকাতে পারলো না। জোরে জোরে হেসে ফেললো। হো হো করে। শব্দ হলো খুব। ঠাট্টা করে বললো,

---"তুই লজ্জা দিয়েছিস কেন? মেয়েটা তো আর তোর মতো নির্লজ্জ না।"

আদ্র তীক্ষ্ণ নেত্রে তাকালো। দৃঢ়তা নিয়ে প্রশ্ন করলো,

---"আমি নির্লজ্জ?"


আয়াজ জবাব দিলো না। আগের মতোই হাসতে লাগলো। তবে এবার নিঃশব্দে। হঠাৎ-ই জোরে জোরে বেলাকে ডেকে উঠলো সে। বেলা একটু অবাক হলো। হাতের কাজ রেখে ইতস্তত পায়ে ছুটে আসলো। আদ্র তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো শুধু, বেলার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা। মেয়েটাকে সে অনেক্ষণ ধরে ডাকছে। আসা তো দূর জবাব পর্যন্ত দেয় নি। অথচ আয়াজের এক ডাকেই সামনে হাজির। বাহ্!


আদ্রর গাম্ভীর্য ভাব বাড়লো। তিক্ত হলো মন, মস্তিষ্ক, বিগড়ানো মেজাজ। তাকে দেখে বেলা চুপসে গেল। লাজুকপাতার মতো জড়োসড়ো ভাবে দাঁড়ালো। আড়ষ্ট কণ্ঠে আয়াজকে বললো, "কিছু বলবেন না ভাইয়া?"

আয়াজ দাঁত বের করে হাসলো,

---"হ্যাঁ, ভাইয়া তোমাকে ডাকছিল।"


পলক ঝাপটে বেলা নমনীয় চোখে আদ্রর দিকে তাকালো। অথচ লোকটা অন্যদিকে চেয়ে আছে। খুব কি রেগে আছে তার ওপর? গলা নামিয়ে বেলা জিজ্ঞেস করলো,

---"কিছু বলবেন?"

---"আলমারি থেকে আমার পিস্তল নিয়ে আসো।"

---"জি?"


বেলার মতো অবাক হলো আয়াজও। চোখের বিস্তরতা বাড়লো। বেলা কথা বাড়ালো না। রাশভারি আদ্র ইয়ানিদকে একপলক দেখে ধীর পায়ে রুমে চলে গেল। নকশা করা কাঠের আলমারি খুললো। একটু ঘাটাঘাটি করতেই কাপড়ের আড়ালে সিলভার রঙের বন্দুকটি পেয়ে গেল। হাতে নিলো। কি ভীষণ ভারী সেটা। দেখে বুঝা যায় না। একটুখানি দেখতেই তো!

আলমারি বন্ধ করতে নিলেই পেছনে পরিচিত মানুষটার অস্তিত্ব থমকে দিলো তাকে। ভরাট কণ্ঠের গাঢ় স্বর শুনতে পেল,

---"বন্দুকের গুলিতে নিজের লজ্জাকে মারতে পারবেন বেলা? তবে পালাতে পারবেন৷ নয়তো ছেড়ে দিচ্ছি না।"


______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ৩৩

 প্রিয় বেলা


৩৩.

আদ্রর বেহিসাব জয়ে অপমান, ক্রোধ আর আক্রশে ফেঁটে যাচ্ছে ইখতিয়ার। একদন্ড শান্তি মিলছে না অন্তরে। দূষিত ইগো জ্বালিয়ে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে ভেতরটা। মস্তিষ্ক ফাঁকা। প্রচন্ড রাগে থরথর করে কাঁপছে শরীর। আজ তিনদিন হতে চলেছে সে কারাগারে বন্দী। কালকে সকালে তার ব্যক্তিগত উকিল আসার কথা ছিল। আসেনি। আজকেও আসছে না। যোগাযোগের সব মাধ্যমও বন্ধ করে দিয়েছে আদ্র। ধমকাধমকি, গালিগালাজ কিংবা ক্ষমতার দাপট দেখিয়েও পার পাওয়া যাচ্ছে না। ময়লা গেঞ্জিটা দু'হাতে ঝেড়ে মেঝেতে সশব্দে বসলো সে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে, পা দু'টো দুদিকে ছড়িয়ে। কানে কনিষ্ঠ আঙুল ঢুকিয়ে গুতালো কিছুক্ষণ। মুখ বাঁকালো। কি যেন ভাবলো মনে মনে। বিড়বিড় করে আদ্রকে বিশ্রী ভাবে গালমন্দ করলো। পরক্ষণেই অশ্রাব্য ভাষায় কন্সটেবলের উদ্দেশ্যে খশখশে কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো,

---"ম***** কতগুলো! একটু কল করতে দিলে কি তোর জাত যাইতো রে? শালা ****। ছাড়া পাইতে দেয় একবার। তোদের শরীরের হাড্ডিগুলা যদি আমি গুঁড়াগুঁড়া না করি!"


কন্সটেবল আসরাফ বিরক্ত হলো খুব। প্রতিদিন এক জ্বালা সহ্য করা যাচ্ছে না। ভেতরটা বিষিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে আটকাতে পারলো না সে। ইখতিয়ারের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। কড়া কণ্ঠে সাবধান করলো,

---"ছাড়া তো তুই এমনেও পাবি না। সেই আশা বাদ দে। এভাবেই পঁচে মরবি। সামনে দেখ তোর সাথে কি কি হয়। তারপর দেখমু তুই আমার কি ব*** করতে পারিস।"


ইখতিয়ার দ্বিগুণ রেগে গেল। বয়সের অল্প ছাপ যেন নিমিষেই পরে গেল নেত্রপল্লবের একদম কোণ ঘেঁষে। খেঁকিয়ে উঠলো,

---"বেশি জবান চলতাছে না? জিহ্বা কাইট্টা ফেলবো। চোখ নামায়া কথা বলবি আমার সাথে। চাকর তোরা। পায়ের তলানিতে ঘর কইরা থাকোস। ওই হিসাবেই নত হইয়া চলবি। দ্বিতীয়বার যেন এই সাহস আর না দেখি।"

আসরাফ উত্তর দিলো না এবার। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে কটমটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। চোখে ভয়ংকর ভস্ম করে দেওয়ার উদ্যোম ইচ্ছে। শুধু ক্ষমতাটাই নেই তার।

মাথার ওপর ছোট্ট জানালাটির দিকে নজর পরলো ইখতিয়ারের। অনেক ছোট হওয়ায় ফাঁকফোকর দিয়ে একটু একটু করে আলো আসছে। সেই আলো পরখ করলো সে। ভেবে নিলো, এখন দুপুর নেমে এসেছে ভূ-স্থলে। পেটে মোচড় দিলো ক্ষুধায়। প্রতিবারের মতো এবারও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো,

---"ওই ****। কইটা বাজে? খাবার কই আমার? এখনো আনোস নাই কেন? যা, নিয়া আয়। যাস না কেন?"

কন্সটেবল আসরাফ এবারও জবাব দিলো না। শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো মাত্র। তাকালোও না। ইখতিয়ার আবারও চেঁচামেচি শুরু করলে অন্য একজন কন্সটেবল এগিয়ে এলেন সেখানে। বেজায় বিরক্ত হয়ে বললেন,

---"এহনো খানা দেওনের সময় অয় নাই। তোমারেও দেওয়া যাইবো না। স্যারের নিষেধ আছে। চুপ কইরা বইয়া থাহো। সময় হইলে দিয়া যাইবো।"

ইখতিয়ারের তেজি উত্তর, "আমি এখন খাবো। আমার জন্য এখন নিয়ে আয়।"

---"বলছি না এহন দেওয়া যাইবো না? বেশি উড়লে খানাই বন্ধ কইরা দিমু।"

---"আমাকে থ্রেড দিচ্ছিস? এর পরিমাণ কি হবে জানোস?"


প্রবল ধমকের সুরে বলে উঠলো ইখতিয়ার। কন্সটেবল ভয় পেল না। মুচকি হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি। নির্ভয় কণ্ঠে বললো,

---"আমার পরিমাণ কি হইবো আমার জানা আছে। তোমার কি হইবো সেইটাও জানি। ইকটু পরে বাঁচবা নাকি মরবা তারও ঠিক নাই। চুপচাপ বইয়া থাহো। পারলে ক্ষমা চাও আল্লাহর কাছে। পরকালে ক্ষমা পাইলেও পাইতে পারো।"


ইখতিয়ার মনে মনে খুব ভাবলো। সবাই একই কথা বলছে কেন? একটু পর কি হবে তার? আদ্র কোনো নতুন ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছে না তো? ঘটাতেও পারে। তার দ্বারা বিশ্বাস নেই। ভেতরটা আরও উদগ্রীব হলো ইখতিয়ারের। অস্থির হলো। একবার ভাবলো, আসরাফকে জিজ্ঞেস করবে। পরপরই অহংকারের প্রচুরতায় টু শব্দটিও করতে পারলো না। কণ্ঠনালি থেমে রইলো। উকিল এইতো এসে যাবে। তারপরই ছাড়া পাবে সে।--- এতটুকু বার বার আঁওড়িয়ে নিজেকে নিজেই শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেল ইখতিয়ার।


-


সময় গড়িয়ে দুপুর থেকে বিকাল হলো। ধোঁয়াধুঁয়ি ছাড়া নোংরা হাতে ভাত খাওয়া শেষ করে মাত্রই আরাম করে বসেছে ইখতিয়ার। সাচ্ছন্দ্যে ঢেকুর তুলছে সেকেন্ড গড়াতে না গড়াতেই। এসময় হঠাৎ জেলখানার রডের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলো কন্সটেবল আসরাফ। ভীষণ অনিচ্ছা নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

---"আপনার জামিন হয়ে গেছে। ভেতরে ওসি সাহেব আর আপনার উকিল বসে আছেন। আসুন।"


ইখতিয়ার চোখ তুলে তাকালো। ক্রুর হাসলো। হাসতে হাসতে উপহাস করে উঠলো, "আপনি? এত সম্মান? জামিন পেতে না পেতেই নিজের অবস্থান বুঝে ফেলেছিস তাই না? কিন্তু লাভ নেই। আজ রাতে আর বাসায় ফেরা হচ্ছে না তোর।"

আসরাফ ভাবান্তরহীন। কোনোরুপ প্রভাব পরলো না তার মাঝে। অস্পষ্ট হাসলো। ওসির কেবিনের বদলে কারাগারের কোনো এক নিচের ঘরে নিয়ে গেল। ইখতিয়ার উৎফুল্ল মনে আশপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। অবিশুদ্ধ মস্তিষ্কে চলছিল আদ্রকে জব্দ করার ফন্দি, নিষ্ঠুর পরিকল্পনা।

আচমকা কিছু কন্সটেবল ঘিরে ধরলো তাকে। টেনেটুনে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। কৌশলে চেয়ারের শক্ত কাঠের সঙ্গে হাত, পা দঁড়ি দিয়ে বেঁধে দিলো। সহসা প্রচন্ড ভয়ে রক্ত শূণ্য হলো ইখতিয়ারের চোখ,মুখ। চুপসে গেল সে। তবুও দমলো না যেন। সর্বোচ্চ কণ্ঠে চেঁচালো, "এই ****। এভাবে বাঁধছিস কেন আমাকে? খুল, সব খুল এখনি। নাইলে কিন্তু সবাইরে মাটিতে পুতে ফেলবো। ছাড়!"


ইখতিয়ারের ছটফট, আকুলতা সব মিলিয়ে মুহুর্তটাকে প্রচন্ড উপভোগ করলো আসরাফ। দাঁত বের করে হাসতে লাগলো। আদ্র, ওসি আর আকিব এলো এর একটু পরই। ইখতিয়ার তখনো ছেড়ে দেবার জন্য চেঁচাচ্ছিল। আদ্রকে দেখে থমকালো ক্ষীণ। পরক্ষণেই এরচেয়েও অধিক আক্রোশ নিয়ে বললো,

---"এগুলা সব তোর কাজ না? ভালো করিস নাই তুই। একদম ভালো করিস নাই। এখন আমি তোদের কি করবো সেটা তুই কল্পনাও করতে পারবি না। তোর পরিবারের একেকটারে তোর বাপের মতো যন্ত্রণা দিয়ে মারবো। রক্ষিতা বানাবো তোর প্রেমিকারে। ****বাচ্চা সময় থাকতে ছাড় আমারে। নাইলে কিন্তু---"


ইখতিয়ারের কথা শেষ হলো না। মুখশ্রী শক্ত করে ভয়াবহ কণ্ঠে আদেশ দিয়ে উঠলো আদ্র,

---"মেশিন বের করো।"


তাড়া জাগলো সবার মাঝে। রুমের এককোণ থেকে মাঝারি আকারের মেশিনটা আলগে ইখতিয়ারের কাছাকাছি রাখলো। গেঞ্জি ছিঁড়ে ফেললো। উন্মুক্ত বুক, হাত আর কপালে তাড় জাতীয় কি যেন লাগিয়ে দিলো। ইখতিয়ারের চোখ বড় বড়। ইতিমধ্যে যা বোঝার বুঝে ফেলেছে সে। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে কাঠ। জোড় গলায় তোতলে উঠলো,

---"তুই কিন্তু ভালো করছিস না আদ্র। ওদের বল আমার কাছে থেকে সরতে। বল!"


কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই মাত্রারিক্ত বৈদ্যুতিক শক কপালে, হাতে, বুকে প্রচন্ড ভাবে ঝটকা দিতেই শরীর ঝাঁকিয়ে উঠলো তার। চোখ মুদলো, খিঁচে এলো বাজেভাবে। চার'পাঁচ সেকেন্ড এ যন্ত্রণাময় মুহুর্তটি চললো। পরপরই হাঁফ ছাড়লো ইখতিয়ার। সামান্য ব্যবধানে ঘেমে গেল শরীর। মাথা টনটন করে উঠলো অসহনীয় কষ্টে। সহ্য করতে পারছে না। দেহের সঞ্চার কমছে। দূর্বল হয়ে আসছে ক্রমশই। আরও একবার বৈদ্যুতিক শক দিতে চাইলেই দূর্বল গলায় চিৎকার করে উঠলো ইখতিয়ার,

---"আমাকে ছেড়ে দেয় আদ্র। আমি আমার সব দোষ মেনে নিবো। তোকে কিচ্ছু করবো না। ছেড়ে দেয় আমাকে, ছেড়ে দেয়।"

কণ্ঠ থামলো। নতুন উদ্যোমে শরীরের শিরা-উপশিরায় বিদ্যুৎ খেলে যেতেই শক্ত হয়ে খিঁচে রইলো ইখতিয়ার।


আদ্রর চোখে,মুখে একরাশ আনন্দের দাম্ভিকতা। ঠোঁটে লেগে আছে ভয়ংকর ক্রুর হাসি। জ্বলজ্বল করছে কালো নেত্রজোড়া। রক্তিম হয়ে আছে সাদা অংশ। ইখতিয়ারের শোচনীয়তা দেখে বিদ্রুপ করে উঠলো সে,

---"আমার বাবাও একদিন বাঁচার জন্য অনুরোধ করেছিল ইখতিয়ার। তোরা শুনিস নি। মেরে ফেলেছিস। কিন্তু আমি তোকে মারবো না। পার্থক্যটা এখানেই।"


তৃপ্ত নিশ্বাস ফেলে আকিবকে আবার বললো, "তোমার ভাবীকে কল করো আকিব। বলো, তার নেতা আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে।"


-


ঝলমলে আকাশ। রোদ্দুরে ভীষণ আদুরে আদুরে ভাব। পাখিরা ডাকছে। কিচিরমিচির। ক্ষুধার্ত বেলা আদ্রর অপেক্ষায় ঘুমিয়েই গিয়েছিল প্রায়। গালে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেতেই তন্দ্রা কাটলো। পিটপিট করে তাকালো। ঝাপসা চোখ স্পষ্ট হলো ধীরে ধীরে। প্রেমিক পুরুষের মুখশ্রী ভেসে উঠলো একদম সামনে। অধরে ঈষৎ হাসি তার। চোখের তীক্ষ্ণ, দৃঢ় চাহনি যেন গাঢ় ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে। লাজুকরাঙা গালে আলতো হাসলো বেলাও। মন চাইলো, আদ্রর সদ্য ভেঁজা ঝাঁকড়া চুলগুলো খুব করে ছুঁয়ে দিতে। ধারালো দাঁড়ির ভাঁজে হাত বুলাতে। নিজেকে সংযত করলো সে। ঘুমকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

---"কখন এসেছেন?"


আদ্র হাসোজ্জল মুখেই উত্তর দিলো, "আধঘণ্টা হয়েছে।"

---"কিছু খেয়েছেন?"


আদ্র মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ, না। তৎক্ষণাৎ উঠে বসলো বেলা। এলোমেলো শাড়ির আঁচল সামলালো। হাত উঁচিয়ে চুল খোঁপা করলো। এরপর ব্যস্ত হয়ে বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো,

---"আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। একটু বসুন। আমি খাবার আনছি।"


কিন্তু তা আর করা হলো না। বাঁধা দিয়ে হাত টেনে ধরেছে আদ্র। বুকের সঙ্গে প্রগাঢ় ভাবে মিশিয়ে নিয়ে বললো,

---"আমি নিয়ে এসেছে। ওই যে, টেবিলে প্লেট রাখা। আসো, খাইয়ে দিচ্ছি।"


বলতে বলতে টি-টেবিল থেকে প্লেটটা নিলো আদ্র। অনভ্যস্ত হাতে একলোকমা ভাত বেলার ঠোঁটের কাছে ধরলো। বেলা পলক ঝাপটালো বিমূঢ়তা নিয়ে। ভাতটুকু কোনোমতে মুখে নিতেই বিশ্রী তিক্ত স্বাদ টের পেল সে। তবুও নজর বিন্দু মাত্র সরালো না। অবাক নয়নে চেয়েই রইলো। আদ্র ভ্রু কুঁচকে ফেলেছে। আরেক লোকমা ভাত এগিয়ে সে গম্ভীর গলায় বললো,

---"এভাবে তাকিয়ে থাকবে না বেলা। তুমি বিরক্ত করছো আমায়।"

বেলার কি যেন হলো। সে তবুও চেয়ে রইলো। লজ্জা ভীড় জমালো না। প্রশ্ন ছুঁড়লো, "আপনি খাচ্ছেন না কেন?"

তার আগের মতোই উত্তর, "খাচ্ছি।"


খাওয়ানো শেষ। হাত ধুঁয়ে বেলাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পরলো আদ্র। এক কম্বলের নিচে। একে অন্যের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে। বেলা তখনোও আদ্রর পানে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। আদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কোমড় জড়িয়ে রাখা হাতটা শক্ত করে লহু স্বরে বললো,

---"ঘুমাও বেলা। এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না।"


বেলা ঠোঁট কামড়ালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে দৃষ্টি সরালো। খুব আস্তে করে বলবো,

---"আমার ঘুম আসছে না তো।"

আদ্র ভ্রু কুঁচকালো, "কেন?"

---"একটু আগেই তো ঘুমিয়েছি।"

---"তবুও ঘুমানোর চেষ্টা করো। আমার ঘুম আসছে।"


বেলা হাঁসফাঁস করছে। ঘুম আসছে না কিছুতেই। চোখ তুলে বারবার দেখছে সুদর্শন লোকটাকে। আনমনে জিজ্ঞেস করলো, "আপনি এত সুন্দর কেন আদ্র?"


আদ্র চমকালো। বন্ধ চোখ তক্ষুণি মেললো। কিছু বলার পূর্বেই অনুভব করলো, বেলার শরীরের তাপমাত্রা আস্তে আস্তে অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। উষ্ণতা বাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তার অল্প খাওয়ার রহস্যটাও পরিষ্কার হয়ে এলো আদ্রর কাছে। ধমকের সুরে সে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করলো,

---"বেলা? তোমার জ্বর এসেছে? বলোনি কেন?"


বেলার হঠাৎ কেন যেন খুব কান্না পেল। তীব্র কান্না। অভিমান হলো সামনের পুরুষটির ওপর। আদ্রর শুকনো শার্ট চোখের লবণাক্ত পানিতে ভিঁজিয়ে দিতে উঠে পরে লাগলো সে। আদ্র হেসে ফেললো। নিশব্দে, মাথা ঝুঁকিয়ে। কপালে অধরের ছোঁয়া স্থির রেখে বললো,

---"আমি আদ্র ইয়ানিদ কথা দিচ্ছি বেলা। তোমাকে আজীবন সুখের কান্না কাঁদিয়েই যাবো।"


_________________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা 

[অনেকদিন মন মতো মন্তব্য পাইনা। আজকে একটু সবাই প্রাণখোলা মন্তব্য পাঠাবেন কি?]

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ৩২

 প্রিয় বেলা


৩২.

শরীরের ওপর চাদরের অস্তিত্ব টের পেতেই নড়েচড়ে উঠলো বেলা। জড়োসড়ো হয়ে বুকের মধ্যিখানে একেবারে মিশে যেতে চাইলো যেন। আদ্র একহাতে আগলে ধরলো তাকে। খুব সাবধানে, ভীষণ যত্নের সাথে। অন্যহাতে কপালের অবিন্যস্ত চুলগুলো গুছিয়ে পেছনে ঠেলে দিলো। পলক না ফেলে একমনে দেখতে লাগলো ঘুমন্ত বেলাকে। একটু আগেও তার জন্য কিরকম কাঁদছিল মেয়েটা! তাকে কাছে পেয়ে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল। ছাড়ছিল না। ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল বারংবার। বিরতীহীন কান্নায় ভিঁজিয়ে দিয়েছিল পরনের শার্টটি। আদ্র তার গালে হাত বুলালো আলতো করে। ক্রন্দনরত মুখশ্রীর নিস্তব্ধতায় লাল হয়ে যাওয়া নাক, গাল, কান, খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো। নজর গিয়ে ঠেকলো ফুলিয়ে রাখা ওষ্ঠের খুব গভীরে। আদ্র থমকালো। দৃষ্টি সরাতে অক্ষম হলো। ঘোর লেগে গেল যেন। গাল থেকে হাত নামিয়ে তা ছোঁয়ার পূর্বেই হঠাৎ তীব্র বজ্রপাতের শব্দে হুঁশ ফিরলো তার। আদুরে ওষ্ঠজোড়া আর ছোঁয়া হলো না। বেলাকে জ্বালানোর মোক্ষম সুযোগটা নিমিষেই হাত ছাড়া হয়ে গেল। নিজেকে বহু কষ্টে সংযত করলো আদ্র। তপ্ত নিশ্বাস ফেললো অনেকটা রয়েসয়ে। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক দিন পর। বিস্তর নভস্থলে কালো ঘন মেঘেদের দেখা নেই। তবুও দন্দের রেশ ধরে ঠিকই চেঁচামেচি করছে তারা। এক, দু সেকেন্ডের মাঝেই পুরো ঘরে কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব চলে এসেছে। বেলার শরীর মৃদু কাঁপছে। উষ্ণতার খোঁজে নিরবে অভিযোগ জারি করছে সে। আদ্র উঠে বসলো। বেলার গলা অব্দি কম্বল টেনে নিজেও শুয়ে পরলো আবার। পুরুষালি শক্ত দেহের সঙ্গে বেলার ছোট্ট, নরম দেহখানি প্রগাঢ় ভাবে জড়িয়ে নিলো।

বেশকিছুক্ষণ পর তন্দ্রা কাটলো বেলার। তবে তক্ষুণি চোখ মেললো না সে। মাথার টনটন যন্ত্রণায় দূর্বল লাগলো নিজেকে। কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো। আদ্র কোমল স্বরে ডাকলো তখন,

---"বেলা? উঠবে না?"


বেলা নিরুত্তর। নখের ধারালো আঘাতে হঠাৎ-ই খামচে ধরলো আদ্রর বুকের একটুখানি অংশ। শার্ট ভেদ করে উন্মুক্ত ত্বক ক্ষতবিক্ষত হলো। আদ্র কোনোরুপ শব্দ করলো না। নড়লোও না। সহ্য করে নিলো চিনচিনে সূক্ষ্ণ ব্যথা। মৃদু স্বরে প্রচন্ড কাতরতা নিয়ে বেলা জিজ্ঞেস করলো,

---"নেতা সাহেব, আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না তো কখনো?"


যেন বুকে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ তান্ডব করছিলো। হুট করেই প্রবল ঝড়ে তান্ডবটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হলো। এলোমেলো হলো সব। ছুটাছুটি করলো। অস্থির হলো ভেতরটা। মনে মনে হাজারবার বললো,

---"কক্ষনো না। কক্ষনো না।"

জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেঁজালো আদ্র। নিষ্প্রভ স্বরে অকপটে বললো,

---"তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার কোনো কালেই আসবে না বেলা। আমি ফিঁকে পরে যাবো।"


বেলা শুনলো। তবুও শান্ত হলো না তার নিষ্ঠুর মন। স্বান্তনা অব্দি পৌঁছালো না গহীন ডাকঘরে। আবারও ডুকরে উঠলো হালকা শব্দে। তৎক্ষণাৎ কড়া নজরে তাকালো আদ্র, "কাঁদতে মানা করেছিলাম বেলা। তবুও কাঁদছো না? আমার কথা কি তুমি শুনবে না বলে পণ করেছ? এত জ্বালাচ্ছো কেন?"


বেলা থামলো না। আওয়াজ ক্ষীণ বাড়ালো। আদ্রর সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে খুব জোড় লাগিয়ে বলতে লাগলো,

---"আমার ভিষণ ভয় হয় আদ্র। ইদানিং সেই ভয়টা আরও বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনাকে কোথাও যেতে দিতে ইচ্ছে করে না। নিজের কাছে রাখতে ইচ্ছে করে। সবসময় অজানা আতঙ্কে বুক কাঁপে। যদি আপনার কিছু হয়? এমন কঠিন পেশায় জড়ালেন কেন আদ্র? সহজ কোনো পেশা ছিল না? আমাকে এভাবে কাঁদান কেন? আমি সহ্য করতে পারি না।"


নিশ্বাস ফুরিয়ে এলো। কথা থামলো। জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিলো সে। আবারও কিছু বলতে নিলেই নিজের সঙ্গে শক্তভাবে চেপে ধরলো আদ্র। কপালে অধর ছোঁয়ালো দীর্ঘক্ষণ, বহুক্ষণ, খুবক্ষণ। গাঢ় স্পর্শে মাতোয়ারা হলো পবন, দৃঢ় হলো অনুভূতি। 

জোড়ালো কণ্ঠে আদ্র আশ্বাস দিলো,

---"আমার কিচ্ছু হবে না বেলা। আমি সবসময় তোমার সঙ্গেই থাকবো।"

অভিমানি প্রিয়তমা নিমিষেই বিশ্বাস করে নিলো যেন। পলক ঝাপটাতেই অশ্রুসিক্ত নেত্র বেয়ে একবিন্দু মুক্তদানা গড়ালো। মোলায়েম স্পর্শে পানিটুকু মুছে দিলো আদ্র। প্রশ্ন ছুঁড়লো,

---"ও বাড়ি যাবে না? বিকাল হয়ে আসছে। পরে কিন্তু আমি আর যেতে দেবো না।"

বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে থাকা বেলার ছোট্ট উত্তর, "যাবো না।"

---"আচ্ছা। আমি কিন্তু আর পাঠাচ্ছি না। আমার কাছেই রাখবো। যেতে দিবো না। তুমি কাঁদলেও না।"


বৃষ্টি প্রবলই বাড়ছে। আওয়াজ হচ্ছে, ঝরঝর! ঝরঝর! স্পষ্ট শুনতে পারছে বেলা। এই বৃষ্টির মাঝে আদ্র কখনোই তাকে ও বাড়ি যেতে দিতো না। সে জানে। ধীরস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, "ক'টা বাজে?"

বেলার কারণে কাপড় পাল্টাতে পারেনি আদ্র। ঘড়িও খোলা হয়নি। হাত উঁচিয়ে সময়টা দেখলো সে। উত্তর দিলো, "৩টা।"


দুপুর তিনটা! অনেক বাজছে। এতক্ষণ শুয়ে থাকা ঠিক হবে না। আদ্র এখনো না খেয়ে আছে। পরনের শার্ট অব্দি পালটায় নি। বেলা আর শুয়ে থাকতে চাইলো না। নিশ্চয়ই লোকটা খুব ক্ষুধার্ত। মুখ ফুটে বলছে না হয়তো। পিটিপিট করে তাকালো সে। একদফা সময় নিয়ে সুদর্শন পুরুষটিকে দেখলো। উঠে যেতে নিলেই আবারও চেপে ধরলো আদ্র। বেলা চমকালো। ভড়কালো কণ্ঠে বললো,

---"কি করছেন? উঠতে দিন।"

---"আরও কিছুক্ষণ থাকো। এখন উঠতে হবে না।"

---"কিন্তু আপনি তো এখনো খাননি। সবার বোধহয় এতক্ষণে খাওয়াও শেষ! খাবার গরম করতে হবে। গোছাতে হবে। কত কাজ!"


একরোখা আদ্র একদমই পাত্তা দিলো না সেকথায়। বেলা আবারও দিরুক্তি করতে চাইলেই সে তার শক্ত, ভারি হাত-পাগুলো বেলার একটুখানি শরীরের ওপর উঠিয়ে দিলো। কেমন দমবন্ধ হয়ে আসলো। ছটপট করলো বেলা। পরক্ষণেই আবার শান্ত হয়ে গেল। ধাতস্ত হলো এহেন অপরিচিত কান্ডে। আদ্র ততক্ষণে তার গলার মাঝে মুখ গুঁজে দিব্যি আছে। 

বেলা ডাকলো, "শুনুন।"

অস্ফুট স্বরে উত্তর দিলো আদ্র, "হু।"

---"আপনি সবসময় নিজের আশেপাশে গার্ড রাখবেন। সাবধানে থাকবেন। খারাপ লোকদের সঙ্গে একদমই মিশবেন না।"

যেন ছোট্ট একটা বাচ্চাকে নিয়ম শিখাচ্ছে বেলা। আদ্রর হাসি পেল। নিঃশব্দে হাসলোও। টের পেল না বেলা।

---"আচ্ছা।"

---"টিভিতে আপনার কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো আপনি---"


কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলো না সে। আদ্রর ফোন বাজছে। স্ক্রীনে আকিবের নাম জ্বলজ্বল করছে। বেলা বেশি ভাবলো না। রিসিভ করে আদ্রর কানে রাখলো। খুব অল্প করে, আবছাভাবে আকিবকে কি যেন বলতে শুনলো সে। বুঝতে পারলো না। অথচ কথাটা শোনা মাত্র আদ্র উঠে বসেছে। বেলা একটু অবাকই হলো। তাকালো আদ্রর মুখশ্রীপানে। গম্ভীর চিত্তে সে তখন ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে বলছিল, "পাশের এলাকার মেন্টাল হস্পিটালটা চেনো না? নতুন হয়েছে যেটা? ইমার্জেন্সি একটা কেবিন বুক করো। বাকিটা আমি দেখছি।"


বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়েছে আদ্র। বেলা তখনো অভিনব চোখে তাকিয়ে ছিল। প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছে না। আদ্র অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে বললো,

---"আলমারি থেকে শার্ট বের করো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।"

---"কোনটা বের করবো?"


জিজ্ঞেস করলো বেলা। আদ্র একপলক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, "তোমার যেটা পছন্দ।"


___________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ৩১

 প্রিয় বেলা


৩১.

এসির তাপমাত্রা অতিরিক্ত কমিয়ে কী-বোর্ডের ইংরেজী অক্ষরগুলোয় অতি দক্ষতার সঙ্গে আঙুল চালাচ্ছে আদ্র। ব্ল্যাঙ্কেট গায়ে পাশেই জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে বেলা। বলিষ্ঠ দেহের পেশিবহুল বাহুর সঙ্গে প্রগাঢ় ভাবে লেপ্টে আছে। ভীষণ আদুরতা নিয়ে। ঘড়িতে বারোটা বেজে বিশ মিনিট তখন। তন্দ্রা যেন খুব তাড়াতাড়িই চলে এসেছে আজ। আষ্টেপৃষ্টে নেত্রপল্লবে এঁটে আছে। চোখ মেলে থাকা দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অথচ আদ্রর কাজ শেষ হতেই চাচ্ছে না। চোখ বুজে আবারও হামি দিয়ে উঠলো বেলা। পিটপিট করে একবার জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকালো। ঘন কালো আঁধার ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ক্ষীণ বিরক্তিতে লহু ভাঁজ পরলো কপালের মাঝ বরাবর। হালকা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

---"আপনার কাজ কখন শেষ হবে? ঘুমাবেন না?"


ব্যস্ত আদ্র একপলক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। মুচকি হাসলো। ঝুঁকে গিয়ে অধরের উষ্ণ, গাঢ় স্পর্শ দৃঢ় ভাবে এঁকে দিলো ললাটের একপাশে। পরক্ষণেই তীব্র আলোয় ভরা ল্যাপটপের স্ক্রীনে স্থির দৃষ্টি ফেলে বললো,

---"তোমার কি ঘুম এসেছে? এলে ঘুমিয়ে যাও। কাজটা শেষ করতে আরও এক-আধ ঘণ্টা লাগবে আমার। জেগে থেকো না। ঘুমাও।"


বেলা একদমই শুনলো না যেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ আদ্রর কাজ করা দেখলো। কাজ করার সময়ও লোকটা ভ্রু কুঁচকে রেখেছে। চোয়াল শক্ত, চোখে তীক্ষ্ণ ভাব। একটু আগের নমনীয়তার ছিঁটে ফোঁটাও নেই। নেত্রকোণের কাঁটা দাগটা স্ক্রিনের সরাসরি আলোয় জ্বলজ্বল করছে যেন। আদ্র চুল কেটেছে। আগের থেকে অনেকটা ছোট দেখাচ্ছে ঝাঁকড়া চুলগুলো। মসৃণ গালকে অমসৃণ করা খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো হালকা ঘন হয়ে গজিয়েছে। ওষ্ঠযুগল মৃদু নড়ছে। বেলা চেয়ে রইলো। আনমনে বললো,

---"আপনি চুল কেটেছেন কেন?"

---"ভালো লাগছিল না। বেশি বড় হয়ে গিয়েছিল। এখন পার্ফেক্ট আছে।"

---"একদমই না। বরং তখন বেশি ভালো লাগতো।"


আদ্র বাঁকা চোখে তাকালো। ঠোঁটে দীপ্ত হাসি রেখে শুধালো,

---"এখন ভালো লাগে না?"

আমতা আমতা করলো বেলা। উত্তর দিতে পারলো না। দৃষ্টি এলোমেলো হলো। অস্থির হলো বক্ষস্থল। নিজের ওপর খুন রাগ হলো তার। সে এত লজ্জা পায় কেন? এই যে, লোকটার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে না। তার আগেই অসভ্য গালদু'টো গরম হয়ে উঠছে, প্রচন্ড ভারি লাগছে। উফফ! এ কেমন অসহ্য যন্ত্রণা?

আদ্র বেলার কেশবহুল মাথায় আলতো হাত বুলালো। কোমলস্বরে বললো,

---"শুধু শুধু জেগে আছো কেন? ঘুমিয়ে যাও বেলা।"

বেলা অবুঝ মেয়ের ন্যায় বললো তখন, "আপনার বুকে মাথা না রাখলে আমার ঘুম আসে না।"


ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা অল্প হাসিটা বিস্তর হলো। ল্যাপটপটা ছোট্ট টি-টেবিলে নিঃশব্দে রাখলো সে। বিছানায় শুয়ে বেলাকে নিজের বুকে চেপে ধরলো। অদৃশ্য ক্ষমতাবোধ নিয়ে। দূর্বল চিত্তে। কানের পেছনে গোছানো চুলগুলো আবারও গুঁজে দিয়ে নরম সুরে আওড়ালো,

---"এবার ঘুমাও। চোখ বন্ধ করো।"


বেলা চোখ বুজলো না। চোখের পাতা ঝাপটালো দু'তিনবার। বেশি করে তাকিয়ে অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো,

---"আপনার কাজ শেষ হয়ে গেছে?"

---"না। পরে করবো।"


বেলা খানিক্ষণ নিশ্চুপ রইলো। কি যেন ভাবলো মনে মনে। মুহুর্তেই উত্তেজিত হয়ে বললো, "বিয়ের পর না মেয়েদের বাবার বাড়িতে যেতে হয়? আমি কালকে যাই?"

কথাটা খুব একটা ভালো লাগলো না আদ্রর। চেহায়ায় অসন্তোষ ভাব ফুটে উঠলো খুব স্পষ্ট ভাবে। রোষপূর্ণ গলায় ভীষণ বিরক্তি নিয়ে সে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

---"কেন যাবা?"

---"বিয়ের পর সবাই যায়।"

---"তুমি যাবা না।"


বেলার ভ্রু কুঁঞ্চিত হলো। হতবিহ্বল হয়ে প্রফুল্লহীন কণ্ঠে বললো, "এভাবে বলছেন কেন? বাবার বাড়ি তো পাশেই। গেলে কি হয়?"

আরেকটু কুঁচকালো তার সুর্দশন, গৌড়বর্ণ মুখশ্রী। দিশেহারা চোখজোড়া গম্ভীর হলো। থমথনে হলো কণ্ঠ,

---"পাশে হলে যেতে হবে কেন? বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলো। দরকার হলে বাবা, মাকে এখানে নিয়ে আসো। ওখানে যাওয়ার কি দরকার?"

হতবুদ্ধী বেলা কি বলবে ভেবে পেল না। নেত্রেজোড়ায় একরাশ বিস্ময় সৃষ্টি হলো। জিজ্ঞাসু অভিব্যক্তিতে তাকিয়ে রইলো সে। 

আদ্র তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। বেলার স্নিগ্ধ মুখপানে তাকিয়ে কোনোরুপ জোড় করতে পারলো না। ভীষণ অনিচ্ছা নিয়ে হার মানলো, "কতক্ষণের জন্য যেতে চাও?"

---"এখনো ঠিক করিনি।"

---"আমি আসার আগে চলে আসবে, কেমন?"


চিন্তিত, বেকুল কণ্ঠের অসীম পাগলামোর পিঠে বেলা আলতো মাথা দুলালো মাত্র। অতি সন্তপর্ণে মুখ লুকালো বিস্তর বুকে। মোলায়েম স্বরে আদ্র আবারও বললো,

---"আমি চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি বেলা। জেগে থেকো না। ঘুমাও।"


ঘড়ির কাটা টিকটিক করে ঘুরে গেল। সময়ের গভীরতা বাড়লো। বেলা ঘুমিয়ে গেছে। দৃঢ় নিশ্বাসের ছোঁয়া বুকে উত্তাল উষ্ণ উম্মাদনা তৈরি করছে। আদ্র তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো তার প্রিয় বেলাকে। দীর্ঘক্ষণ, অনিমেষ, একমনে। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হলো তার। মোহিত হলো তৃষ্ণায় কাতর চক্ষুদ্বয়। গলা শুকালো। আলিঙ্গন আরেকটু ঘনিষ্ট করতে গিয়েও আবার থেমে গেল সে। অনেকগুলো কাজ এখনো বাকি আছে। কিছু ডকুমেন্ট রেডি করা হয়নি। খুব সাবধানে বুক থেকে মাথা সরিয়ে বেলাকে বালিশে ওপর শুইয়ে দিলো আদ্র। ল্যাপটপের কী-বোর্ডে আবারও গুতোগুতি শুরু করলো।


-


গুলাগুলির আওয়াজে ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে জনগণ। নিস্তব্ধ পরিবেশে বৃষ্টিহীনই বাজ পরছে যেন। প্রচন্ড শব্দ কানে আঘাত করছে। পাখিদের হাহাকারে ভরা ছোটাছুটি একগাছ থেকে অন্যগাছে যাওয়া অব্দিই সীমিত। যে যেভাবে পারছে কলেজ ছেড়ে ছুটে পালাচ্ছে। আশপাশ ঘেঁষছে না একদমই।

গাড়ি থেকে বের হতে হতে প্যান্টের পেছন থেকে সিলভার রঙের ভারি বন্দুকটি হাতে নিলো আদ্র। দ্রুত পায়ে কলেজের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,

---"কলেজের পেছন দিক দিয়ে সবার বের হওয়ার ব্যবস্থা করো আকিব। তন্ময়কে বলো ছেলেদের নিয়ে ওখানে যেতে। দাঁড়িয়ে থেকো না। দ্রুত যাও।"


হন্তদন্ত পায়ে আকিব তন্ময়ের কাছে দৌঁড় লাগালো। পুলিশরা আগেই এসে গেছেন। ড্রাগসসহ ইখতিয়ারকে হাতে নাতে ধরলেও হঠাৎ গুলাগুলির কারণে আহত হয়ে মাটিতে পরে ছিলেন প্রায় তিনচার জন। আদ্র বন্দুক তাক করলো ক্যাম্পাসের দিকটায়। অভ্যস্ত হাতে ট্রিগার চাপতেই সূক্ষ্ণ সোনালী রঙের গুলিটি বেরিয়ে এলো। কালবিলম্ব না করে প্রচন্ড তীব্র গতিতে এলাকার বখাটে ছেলেটির ডান হাতের মধ্যিখানে গিয়ে বিঁধলো। হাত থেকে ধারালো দা পরে গেল তার। অসহনীয় যন্ত্রণায় অন্যহাত দিয়ে বাহু চেপে কুকিয়ে উঠলো। নিচে ধপ করে শুয়ে পরলো। বিশুদ্ধ মাটি দূষিত রক্তে নোংরা হলো মুহুর্তেই।

আকিব চলে এসেছে। গাছের পেছনে লুকিয়ে থাকা ইখতিয়ারকে দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুঁড়লো সে। নিমিষেই কানের পাশ গলিয়ে চলে গেল তা। কানের লতি টনটন করে উঠলো। ভয়ে একমুহুর্তের জন্য জড়োসড়ো হয়ে গেলেও পরক্ষণেই লাফিয়ে গাছের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলো ইখতিয়ার। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তাকে দু'জন পুলিশ অফিসার ধরে ফেললেন। হাঁটু গেড়ে বসিয়ে বন্দুক ছিনিয়ে নিলেন। আচমকা সব ঘটায় কিছুই করতে পারলো না সে। প্রবল ক্রোধে চেঁচিয়ে উঠলো শুধু। ধমকাধমকি করতে লাগলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য।


এরপর সবটা শান্ত। বিপক্ষদলের অন্য ছেলেদেরও ধরে ফেলা হয়েছে ততক্ষণে। কিছুসংখ্যক পালিয়েও গেছে। ফাঁকা মাঠটাতে এক এক করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ড্রাগসের বিশাল বিশাল কার্টন। সূদুরে সংবাদিকরা ভীর জমাচ্ছে। তাদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। 

হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ইখতিয়ারকে আদ্রর সামনে আনতেই রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো সে। বিশ্রী মুখটা আরও বিশ্রী ভাবে কুঁচকে ফেললো। প্রথমেই মন্দ কণ্ঠে গালিগালাজ করলো কিছুক্ষণ। গগনবিহারী চিৎকার দিয়ে উঠলো,

---"কাজটা তুই ভালো করিস নাই আদ্র। তোর বাপের মতো তোকেও যন্ত্রণা দিয়ে মরবো আমি।ছাড়বো না কাউকে। মাত্র দুইদিন! দুইদিন লাগবে আমার জেল থেকে বের হইতে। তারপর দেখব তুই কি করিস। তোর না একটা প্রেমিকা আছে? সাবধানে দেখে রাখিস। বলা তো যায় না, মন চাইলে তুলেও আনতে পারি।"


ইখতিয়ার থামলো। মুখ থেকে একদলা থুতু ফেললো মাটির সবুজ, সতেজ দুর্বাঘাসে। অনেকটা তাচ্ছিল্য করেই। বিকৃত হেসে। আকিব তৎক্ষণাৎ কনস্টেবলের উদ্দেশ্যে ধমক লাগালো,

---"সমস্যা কি আপনাদের? একে নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? তামাশা করাতে চাচ্ছেন নাকি দেখতে? তাড়াতাড়ি এই নোংরা লোককে নিয়ে গাড়িতে যান। যাচ্ছেন না কেন?"


ইখতিয়ার চলে গেল। গাড়িতে ওঠার পূর্বে আবারও তাকালো আদ্রর দিকে। সেই চালক-চতুর চোখে। ঠোঁটে অসহ্যকর হাসিটা। আদ্র কঠিন নেত্রে তাকিয়ে রইলো শুধু। কিছুই বললো না। আকিব একটু অবাকই হলো এতে। দৃষ্টি তুলে তাকালো। দেখলো, আদ্র চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সাদা শিরা-উপশিরাগুলো আস্তে আস্তে রক্তিম রঙ ধারণ করছে। গাম্ভীর্যের মাত্রা বেড়ে ভয়ানক রাগের পূর্বাভাস পাচ্ছে সে। কপালের রগ ফুলে বেরিয়ে এসেছে। আকিব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,

---"ভাবীকে এত কিছু বললো ওই জানোয়ারটা। আপনার বাবাকেও বলেছে। ওকে কি এভাবেই ছেড়ে দিবেন ভাই?"


আদ্র উত্তর দিলো না। দৃষ্টিও সরালো না শুণ্য মাঠ হতে। আকিব আবারও কিছু বলবে তার পূর্বেই ফোন বেজে উঠলো তার। স্ক্রীনে 'VABI' নামটা ভাসছে। আকিব দেড়ি করলো না। ফোন এগিয়ে ছটপট বললো, "ভাবী ফোন দিয়েছে ভাই।"


আদ্র তাকালো ফোনটির দিকে। নিলো। রিসিভ করে কানে রাখতেই ওপাশ থেকে অস্থির বেলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল,

---"হ্যালো, আকিব ভাইয়া? কোথায় আপনারা? উনাকে ফোন দিচ্ছি আমি। ধরছেন না। উনি কি ঠিক আছেন? উনাকে একটু দিন না। আমি কথা বলবো।"


আদ্র শুনলো শুধু। প্রতিউত্তর করলো না। ওপাশে থাকা বেলা জবাব না পেয়ে আরও অস্থির হয়ে উঠলো। অজানা ভয়ে বুক কাঁপলো। জোড় গলায় আবারও বললো সে,

---"হ্যালো? কথা বলছেন না কেন? উনি কি আপনার পাশে আছেন? ঠিক আছেন তো? হ্যালো?"


চোখ ভিঁজে এলো। কণ্ঠে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়ে ভেঙ্গে আসলো যেন। কান্নারত হয়ে উঠলো। এ পর্যায়ে গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো আদ্র,

---"আমি ঠিক আছি বেলা। কাঁদবে না। একটুখানি অপেক্ষা করো। আসছি।"


বেলার কান্না থামলো না। দীর্ঘ অভিমানে ডুকরে উঠলো। তপ্তশ্বাস ফেলে আদ্র ঢিমে যাওয়া কণ্ঠকে শক্ত করে বললো, "কাঁদতে মানা করেছি বেলা। আমার ভালো লাগছে না তো।"


______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ৩০

 প্রিয় বেলা


৩০.

আদ্র গোসল সেরে বের হয়েছে মাত্র। একহাতে চুল মুছতে মুছতে পুরো রুমে একবার চোখ বুলালো সে। ভ্রু কুঁচিত হলো। তিক্ত হলো মন, মস্তিষ্ক, মেজাজ। চুলের ডগা থেকে জলরাশির সূক্ষ্ণ রেখা কপাল ঘেঁষে গড়াতেই তা তোয়ালে দিয়ে মুছে ফেললো সে। তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। একরাশ হতাশা নিয়ে। বেলা রুমে নেই। চলে গেছে হয়তো। মেয়েটা একটা কথাও শোনে না তার। থেকে যেতে বলার পরও অবাধ্যতা করে চলে গেছে সুড়সুড় করে। বিছানার একপাশে গিয়ে বসলো আদ্র। কণ্ঠে ক্রোধের ক্ষীণ অস্তিত্ব নিয়ে উঁচুস্বরে ডাকলো,

---"বেলা।"


বেলা বারান্দায় ছিল। বিস্তর নভস্থলের দাগযুক্ত চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। আজকে চাঁদটা বেশ বড় করে উঠেছে। জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে আশপাশের কালো আঁধারি জায়গাগুলো। দৈবাৎ আদ্রর রাশভারি কণ্ঠের ডাক শুনে থমকালো সে। পিছু ফিরে তাকালো। আদ্র একমনে মাথা মুছতে মুছতে ঘাড় কাত করে রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখশ্রী অসম্ভব বিকৃত। অসন্তোষ ভাব। বেলা সময় নিলো না। দ্রুত পায়ে রুমের ভেতর ঢুকলো। চোখ বড় বড় করে উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

---"কি হয়েছে? এভাবে ডাকছেন কেন?"

আদ্র একটু বিস্মিত হলেও তা চেহারায় বিন্দু মাত্র প্রকাশ পেল না। স্বাভাবিক ভাবে সে প্রশ্ন করলো,

---"তুমি এতক্ষণ বারান্দায় ছিলে?"

---"হ্যাঁ।"

---"তোমাকে আমি বিছানায় বসে থাকতে বলেছিলাম। বারান্দায় গেলে কেন?"


আদ্রর গম্ভীর প্রশ্নের পিঠে অবুজ চোখে চেয়ে রইলো বেলা। উত্তর দিতে পারলো না। ভেঁজা তোয়ালে বিছানায় ছুঁড়ে মেরে হঠাৎ-ই মাথা নিচু করে ঝুঁকলো আদ্র। ঘাড়ের পেছনে হাত বুলালো ব্যগ্র ভাবে। অধৈর্য কণ্ঠে ভীষণ অতৃপ্তি নিয়ে বললো,

---"তুমি আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছো বেলা। অধৈর্য করে ফেলছো।"


বেলার অবুঝ নেত্রজোড়ার পরিবর্তন ঘটলো। লাজুক গালগুলো ভারী হলো। নেত্রপল্লব লেগে আসতে চাইলো যেন। বার দুয়েক পলক ঝাপটে সে দৃষ্টি নুয়ালো। মৃদু স্বরে বললো, "আপনি দুপুর থেকে কিছু খাননি। খাবেন না? আমি নিয়ে আসবো?"

---"উহু! তোমার সঙ্গে থাকতে চাইছি এখন।" নিঃসঙ্কোচ, সুপ্ত বাসনা। বেলাকে আরও লজ্জায় মিইয়ে দিলো। আড়ষ্টতা জেঁকে ধরলো।

আদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। প্রগাঢ় গলায় শুধালো,

---"তুমি এত লজ্জা পাও কেন বেলা? আমার মতো লজ্জাহীনের মুখে সামান্য থেকে সামান্য কথাও আটকায় না। সহ্য করতে পারবে তুমি?"


বেলা আর বসে থাকতে চাইলো না। লোকটা পাগল হয়ে গেছে নিশ্চিত। কিসব বুলি আওড়াচ্ছে। ইতস্তত পায়ে বিছানা থেকে তোয়ালে নিয়ে আবারও বারান্দায় চলে গেল সে। কাঠের চেয়ারটাতে বিছিয়ে দিলো সুন্দর করে। আদ্রর বারান্দায় তার মতো রশি বা তাড় ঝুলানো নেই। একদম পরিষ্কার। তবে ফাঁকা পুরোটা। বেলা মনে মনে ভাবলো, বারান্দাটা সে ফুলগাছে ভরিয়ে দেবে।

ভাবনার অকূল পাথারেই আদ্রর শক্ত, শীতল পুরুষালি হাতটি আচমকা কোমড় জড়িয়ে ধরলো তার। হাতজোড়া শাড়ির ওপরে থাকা সত্ত্বেও তীব্র ঠান্ডার স্বতঃস্ফূর্ত আভাসে শিহরিত হলো সর্বাঙ্গ। বেলা চমকিত হলো। খুব ভড়কালো, ভয় পেল। ছোট্ট পিঠটা গিয়ে ঠেকলো প্রশস্ত বুকে। অস্থির নয়নে বাগানের দিকটায় চোখ ঘোরালো সে। দেহরক্ষীগুলো সব এখনো পাহারা দিচ্ছে বাড়িটা। চারিদিকে তাদের বিচক্ষণ দৃষ্টি অনবরত ঘুরছে। স্থির হচ্ছে না। আতঙ্কিত হয়ে হালকা চেঁচালো বেলা,

---"কি করছেন? ছাড়ুন! আপনার হাত অনেক ঠান্ডা।"


আদ্র শুনলো না যেন। হাতও সরালো না। হাসফাস করে বেলা অনুরোধের সুরে বললো,

---"নিচে গার্ডসরা আছেন। আমাদের এভাবে দেখলে কি ভাববে? ছাড়ুন না।"

---"উপরে তাকাবে না ওরা।"

বেলার সন্দিহান কণ্ঠ, "যদি তাকায়?"


প্রতিউত্তরে আদ্র কিছুই বললো না। নিজ গতিতে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো বেলাকে। আদুরে ভাবে। কাঁধে থুতনি ঠেকালো। আকাশের ওই বিশাল চাঁদটির দিকে একবার চেয়ে বেলার দিকে তাকালো আবার। আনমনে বললো,

---"তোমার এই জনপ্রিয় চাঁদটা থেকে আমার আকাশের অপরিচিত চাঁদটাই বেশি সুন্দর বেলা।"


-


হাসপাতালের কক্ষগুলোয় ফিনাইলের কড়া গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। রুমালটা নাকে চেপে আকিব বেশ চোখ-মুখ কুঁচকে আছে। বিরক্তও সে। কেবিনে লম্বালম্বিভাবে আহত টেক্সিচালক গুলোকে আলাদা, আলাদা বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। নিষ্ঠুর, খারাপ লোকগুলোকে দেখে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই আসছে না আকিবের। মূলত এজন্যই সে ভীষণ বিরক্ত। নাক কুঁচকে প্রচন্ড রোষপূর্ণ গলায় আদ্রকে জিজ্ঞেস করলো,

---"আমরা এখানে কেন এসেছি ভাই? চলুন, চলে যাই। এসব অমানুষদের সাথে কথা বললেও পাপ।"


আদ্র কিছু বলছে না। নিশ্চুপ ভাবে দেখছে টেক্সিচালকগুলোকে। ব্যথায় যখন তারা কাতরাচ্ছে, তখন অভ্যন্তরে সিক্ত আনন্দ দোলা দিয়ে উঠছে বারবার। প্রশান্তি কাজ করছে মনে, মস্তিষ্কে। এদের মাঝের জনকে আদ্র বেশ ভালো ভাবেই চেনে। পাঁচজন মেয়েকে ধর্ষণ করার মামলা আছে এর ওপর। শুধু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে স্বাধীন ভাবে ঘুরছে এই মানুষ রুপি হায়নাগুলো।

আদ্র থমথমে গলায় আকিবকে বললো, "তোমাকে কিছু রেকর্ডিং পাঠিয়েছিলাম আমি। বের করো।"


আকিব দেড়ি করলো না। একহাতে নাক চেপে অন্যহাত দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো। রেকর্ডিং-এর ফাইলটি বের করে বললো,

---"বের করেছি ভাই।"

---"প্রথমটা চালু করো।"


আকিব চালু করলো। সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করলো রেকর্ডারটি। যেখানে স্পষ্ট ইখতিয়ারের কণ্ঠ ভেসে উঠছে। সে বলছে,

---"ওদের না মেরে আমাকে একটা উটকো ঝামেলায় সত্যিই ফেলে দিয়েছো আদ্র সাহেব। এখন ওদের রিলিজের অপেক্ষা করতে হবে। তারপরই খেলা শেষ।"


বলে হো, হো করে হাসতে লাগলো সে। কর্কশ কণ্ঠের হাসিতে ভয়ে তটস্থ হলো সবার মুখ। চোখের দৃষ্টি ভীতু। হঠাৎ-ই শরীর গরম হতে শুরু করেছে যেন। কপাল ঘামছে। গলা শুকিয়ে পিপাসা পাচ্ছে প্রচন্ড। মাঝখানে পাতলা, কৃষ্ণবর্ণের লোকটি অনেকটা তোতলিয়ে বললো,

---"এখন আমগো কি করতে হইবো ভাই?"


আদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। অদৃশ্য হাসি। কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,

---"বেশি কিছু না। ইখতিয়ারের বিরুদ্ধে আদালতে স্বাক্ষী দিতে হবে।"

লোকগুলো একে অপরের মুখপানে একে একে চাইলো। পরক্ষণেই একসাথে হইহই করে উঠলো,

---"আমরা দিমু ভাই। সবাই স্বাক্ষী দিমু। শুধু আমগো ওই ইখতিয়ার থেইকা বাঁচাইয়েন।"


আদ্র কেবিন থেকে বেরিয়ে পরলো। এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আকিবও এলো পিছু পিছু। ধীরস্থির ভাবে অপরাধীর ন্যায় বললো,

---"আমাকে ক্ষমা করবেন ভাই। আমি শুধু শুধুই আপনাকে ভুল ভেবেছিলাম।"


আদ্র শুনলো। হাঁটতে হাঁটতে পালটা প্রশ্ন করলো,

---"মাক্স পরো মুখে। রুমাল চেপে আছো কেন?"

---"আনতে মনে নাই ভাই।"

লজ্জিত হেসে উত্তর দিলো আকিব।


-


সময় গড়াচ্ছে। সকাল পেরিয়ে পৃথিবীর আকাশে দুপুর নেমে এসেছে। মেঘেরা প্রবল ঝগড়া করে একে অপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দীর্ঘক্ষণ আগে। শুভ্রতা হারিয়ে কালো রূপ ধারণ করেছে মেদুরগুলো। তাদের রেশারেশির তীব্রতা বেড়ে গেল হুট করেই। কালো বিস্তর নভস্থলে সূর্যের দেখা মিললোই না আর। বৃষ্টি শুরু হলো। মুষলধারে বৃষ্টি। বেলার বেকুলতা বড্ড বেড়ে গেল। আদ্র দুপুরে খেতে আসবে বলেছিল। এখনো আসছে না কেন? ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় ৩টা বেজে এক মিনিট। অশান্ত মনে সে বিছানায় গিয়ে বসলো। এবাড়িতে কেউ কাজ করতে দেয় না তাকে। টুকটাক রেখা আর আরুর সঙ্গে কথা বলেই কেটে যায় কিছুটা সময়। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে বেলার ভালোলাগে না। আদ্রকে মনে পরে। ভীষণভাবে মনে পরে।


রাস্তা থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ এখান অব্দি শোনা যাচ্ছে। বেলার সম্বিৎ ফিরলো। বসে থাকতে থাকতে প্রায় ঘুমিয়েই গিয়েছিল সে। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দায় চলে গেল। বাহিরে উঁকি দিতেই দেখতে পেল আদ্রর কালো গাড়িটা। বেলা কালবিলম্ব করলো না। ব্যস্ত পায়ে দ্রুত ছুটে গেল নিচে। কলিংবেল বাজার পূর্বেই দরজা খুলে দিলো। আদ্র মাত্রই কলিংবেল চাপতে যাচ্ছিল। হঠাৎ দরজা খুলে যাওয়ায় অবাক হলো। প্রিয়তমার স্নিগ্ধ মুখশ্রী চোখে ভাসতেই ক্লান্তি উবে গেল যেন। সতেজ হয়ে উঠলো ভেতরটা। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা দেখা দিলো।

বেলা কিছুপলক তাকিয়ে সরে দাঁড়ালো। আলতো স্বরে বললো,

---"ভেতরে আসুন।"


আদ্র ঢুকলো। ড্রইংরুমে বসে থাকা আয়াজের দিকে তাকালো একবার। খুব আস্তে করে বললো,

---"রুমে আসো।"

---"আসছি।"


আয়াজ ফোন চাপছিল। আদ্রকে দেখে সরাসরি তাকালো। তাড়াতাড়ি ডাকলো,

---"ভাই শুন। কথা আছে তোর সঙ্গে।"


আদ্র তখন সিঁড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছিল প্রায়। আয়াজের কথায় দাঁড়ালো। ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, "কি?"

---"ব্যবসায় ইদানিং সমস্যা করছে একলোক। কোন ইখতিয়ার নাকি কি! অবৈধ কাজ করতে চাইছে। তোর বিপক্ষদলের মনে হয়। ওরে আউট কর তো!"

আদ্রর ছোট্ট উত্তর,

---"পারবো না।"

সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভট কণ্ঠে প্রতিবাদ জানালো আয়াজ,

---"কেন? কেন পারবি না? তোকে কি মাগনা মাগনা রাজনীতিতে ঢোকার জন্য সাপোর্ট করেছিলাম আমি? সময় এসেছে, আমি আমার সাপোর্টের মূল্য চাই।"

---"পরে দেখা যাবে।"


চলে যাওয়ার আগে আদ্র আবারও বেলাকে ইশারা করলো রুমে আসার জন্যে। তা দেখে আয়াজ পেছন থেকে খুব চেঁচালো, "ইশারায় কথা বলছিস কেন? আমি দেখব না মনে করেছিস? নিজে তো বিয়ে করেনিলি। আমার মতো নিরীহ মানুষটাকে এখন লোভ দেখাচ্ছিস। শুধু চৈতির সঙ্গে আমার বিয়েটা হতে দেয়। অসভ্য আমিও হতে জানি।"


আয়াজের কথা থামলো না। লাজুক বেলা কোনোমতে চলে এলো সেখান থেকে। রুমে পা রাখতেই আদ্রকে ক্ষীণ ভেঁজা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উৎকণ্ঠা হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। এগিয়ে এসে তাগাদা দিয়ে বললো,

---"আপনি এখনো ভেঁজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ফ্রেস হয়ে আসুন। যান।"

আদ্র গেল না। ঠায় দাঁড়িয়ে পকেট হাতড়ে কি যেন বের করলো। পরক্ষণেই অনেকটা কাছে টেনে নিলো বেলাকে। গলায় কিছু একটা পরিয়ে দিলো। বেলা তাকালো। পাথরের গলার চেইন। জ্বলজ্বল করছে। চোখ ধাঁধানো সুন্দর। বেলা মৃদু হাসলো। হাত বারিয়ে চেইনটা ছোঁয়ার আগেই তাকে নিজের বক্ষের মধ্যিখানে টেনে আনলো আদ্র। কানের পেছনে এলোমেলো চুলগুলো গুঁজে দিলো খুব যতনে। জিজ্ঞেস করলো,

---"আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে?"


বেলা মাথা দুলালো আস্তে আস্তে। সে অপেক্ষা করছিল। আদ্র বিস্তর হাসলো। আরেকটু ঘনিষ্ট হলো। নিবিড় হলো সবটা। প্রগাঢ় হলো স্পর্শ। বেলা মিনমিন কণ্ঠে বললো,

---"আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে। শার্ট পালটে আসুন। শার্ট বের করে দেব আমি?"

কণ্ঠে একরাশ বিরক্তি, সন্তুষ্টি ভাব নিয়ে আদ্র উত্তর দিলো,

---"শার্ট-টার্ট পাল্টাতে ইচ্ছে করছে না। এদিকে আসো। চুল মুছে দেবে।"


___________________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ২৯

 প্রিয় বেলা


২৯.

নিকষকৃষ্ণ আঁধার ডিঙ্গিয়ে সূর্যের তপ্তহীন কিরণ চারিদিকে ছড়িয়ে পরছে। পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ প্রবল কোলাহল সৃষ্টি করছে। এয়ারকন্ডিশনের তীব্র শীতল স্পর্শে প্রিয়তমের বুকের উষ্ণতায় জড়োসড়ো হয়ে লেপ্টে আছে বেলা। টেলিভিশন চলছে অনেকটা শব্দ বাড়িয়েই। সময় সংবাদে একজন ভদ্র মহিলা খবর পড়ছেন,

---"কুমিল্লায় কাল রাত্রিবেলা তিনজন টেক্সিচালক গুরুতর ভাবে আহত হয়ে পরে ছিলেন মাঝরাস্তায়। এলাকার কিছু ভদ্র লোকের সাহায্যে এখন আপাতত সিটি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি আছেন। ডাক্তাররা বলেছেন, বেঁচে ফিরবার সম্ভাবনা থাকলেও হাত, পা অকেজো হয়ে যেতে পারে তাদের। এছাড়া টেক্সিগুলোও বাজেভাবে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। শুনলেন শিরনাম। এবার বিস্তারিত।"


বেলার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তবে নেত্রপল্লব উন্মুক্ত হলো না। চোখ-মুখ কুঁচকে গেল তীব্র আলোর ছটায়। আদ্রর বক্ষস্থলে নিবিড়ভাবে মুখ লুকাতেই বিস্তর হাসলো সে। লহু কণ্ঠে ডাকলো,

---"বেলা? উঠবে না? ন'টা বেজে গেছে কিন্তু!"

বেলা ক্ষীণ নড়েচড়ে মাথা নাড়ালো। উঠবে না সে। তন্দ্রা ঘোর এখনো চোখের পাতায় দৃঢ় ভাবে এঁটে রয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠবার জো নেই। আদ্র আরও কয়েকবার ডাকলো। সারাশব্দ না পেয়ে পরক্ষণেই চুপ হয়ে গেল সে। টিভির ভলিউম একটু কমিয়ে দিলো। সেকেন্ড গড়ালো, এরপর মিনিট। তন্দ্রা ভাবটা যেন হঠাৎ-ই গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো বেলার। চোখ মেললো সে। নিজের অবস্থান আদ্রর অতি নিকটে আবিষ্কার করতেই চমকিত হলো। ভড়কালো প্রচন্ড লজ্জায়। আদ্রর কোমড়ে থাকা তার দৃঢ় হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে আসলো। সরে যেতে চাইলেই পুরুষালি শক্ত হাতটি গিয়ে ঠেকলো পিঠের একদম মধ্যিখানে। টেনে এনে বুকের মাঝে আবারও মাথা চেপে ধরলো। খুব সাবধানী গলায় সর্তক করলো,

---"খবরদার, উঠবে না। এভাবেই থাকো। আমার সঙ্গে খবর দেখবে।"


বেলার আমতা আমতা কন্ঠস্বর, 

---"খবর দেখে আমি কি করবো?"

---"তোমাকে লেডি রাজনীতিবিদ বানাবো আমি। তাই দেশের খুটিনাটি খবরাখবর রাখতে হলে তোমাকে খবর দেখতে হবে। একটু পর বাহিরে বের হবো। তখন রাজনৈতিক বইও নিয়ে আসবো কিছু। তুমি না বই পড়তে পছন্দ করো?"


বেলা পলক ঝাপটালো। সরে আসতে চাইলো। আদ্র এবারও অনড়ভাবে ধরে রইলো তাকে। চোখ, মুখ কুঁচকে অসম্ভব বিকৃতি করে প্রবল প্রতিবাদ জানালো বেলা, "ছাড়ুন আমাকে। এসব বই পড়বো না আমি। খবরও দেখবো না। আপনার রাজনীতি নিয়ে আপনিই থাকুন।"


প্রতিউত্তরে নিঃশব্দে হেসে দিলো আদ্র। বিরতিহীন, নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে। হাসতে হাসতে সে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

---"রাজনীতি পছন্দ না তোমার?"

---"একদম না।"

---"এই রাজনীতিবিদকেও পছন্দ না?"


প্রশ্ন শুনে একটু থতমত খেয়ে গেল বেলা। নজর তুলে তাকালো। আদ্র শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নির্মলভাবে। বেলা বুঝে উঠতে পারলো না। লোকটা কি রাগ করলো এভাবে বলায়? বলা উচিত হয়নি বোধহয়। নত হয়ে সে আদ্রর শার্টের এককোণা খুব আলতো করে ধরলো। না ধরার সমান। স্নিগ্ধ গলায় মিনমিন করে বললো, "পছন্দ।"


আদ্রর তূখর দৃষ্টি তখন ভীষণ গভীর। আলাদা মাদকতার পরশ সুস্পষ্ট। ঘোর লাগা, অন্যরকম। হাত উঁচিয়ে বেলার গাল ছুঁলো নিষ্প্রভ ভাবে। ধীরস্থির কণ্ঠে শুধালো,

---"অথচ আমার মতো পছন্দ তুমি কখনোই করতে পারবে না বেলা।"


থেকে থেকে নিশ্বাস নিচ্ছে বেলা। আদ্রর দিকে তাকানোর সাহস নেই। লোকটার চাহনি মারাত্বক। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। জাদুকরের মতো সম্মোহন করে ফেলে নিমিষেই। আড়নজরে একবার টিভির দিকে তাকালো সে। বিজ্ঞানপন শেষ হয়ে এখন আবারও ওই টেক্সিচালকগুলোর সংবাদ দেখাচ্ছে। কি বিভৎস ভাবে মেরেছে তাদেরকে! চেহারা চেনার উপায় নেই। ব্যান্ডেজে আবৃত পুরো মুখশ্রী।


-


ক্লাবের দরজা, জানালা বন্ধ। বড়োসড়ো রুমটায় এখন শুধু আদ্র, আকিব আর ইখতিয়ার। ইখতিয়ার বেশ অসন্তোষ চোখে আকিবকে দেখছে বারবার। যেন আকিবের উপস্থিতি ঠিক পছন্দ হয়নি তার। ইশারা-ইঙ্গিতে বারবার চলে যেতে চলছে তাকে। আকিব বুঝতে একটু সময় নিলো। পরক্ষণেই নিজ থেকে বললো,

---"আমি তাহলে আসছি ভাই? আপনারা কথা বলুন।"


খরখর শব্দে দরজা খুলে তা আবার বাহির থেকে আটকে চলে গেল আকিব। ইখতিয়ার এবার সরাসরি মুচকি হেসে তাকালো আদ্রর মুখপানে। অথচ তার ভেতরটা আদ্রর জন্য কালো বিষে ভরে আছে। নিজ স্বার্থ না থাকলে কবেই এই নেতার দাপট বের করে জঙ্গলে লাশ ফেলে আসতো, তার ইয়ত্তা নেই।

ক্ষীণ চাটুকারিতার রেশ ধরে ইখতিয়ার তার কর্কশ কণ্ঠটা মোলায়েম করার চেষ্টা করলো,

---"কেমন আছো আদ্র সাহেব? টাকা পেয়ে তো ভুলেই গেলে। কল ধরছো না, না মেসেজ। পাশের এলাকার কলেজটাতে তো কাল থেকে ড্রাগস বেচার কথা। ভেবেছ কিছু এ বিষয়ে? তোমার ছেলেদের আসতে বলেছিলাম। ওরা তো এলো না।"


আদ্রর নির্লিপ্ত সুর, "আসবে। কাল ঠিক সময়ে পাঠিয়ে দেব আমি।"

ইখতিয়ার টেবিলে জোড়ে থাবা মারলো। হো হো করে হাসলো বিশ্রী কণ্ঠে। বললো,

---"এই না হলে নেতা।"


ইখতিয়ার থামলো। চারিদিকে তার কটু দৃষ্টি ফেলে দেখলো সবটা। ধীর গলায় বললো,

---"তা, কাল রাতে আমার ছেলেদের মারলে কেন? মারলে তো মারলে, একেবারে মেরেই ফেললে না কেন? এমনিতেও ওরা আর আমার কোনো কাজে লাগবে না। উটকো ঝামেলা কতগুলো!"


বলতে বলতে উৎসুক চোখে তাকালো সে। আদ্র সময় নিলো। টেবিল থেকে কফির মগ নিয়ে একটু করে চুমুক দিলো। কপালে ভাঁজ ফেলে সূক্ষ্ণ গলায় বললো,

---"স্বার্থ ছাড়া আমি কিছু করিনা মিস্টার ইখতিয়ার। নয়তো মেরেই ফেলতাম।"


ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইখতিয়ার। জিজ্ঞেস করলো, "ওদেরকে মারার পেছনে তোমার কি স্বার্থ থাকতে পারে?"

---"আমার সঙ্গে একটা মেয়েকে প্রায়ই দেখতেন আপনি। আমার ক্ষতি করতে মেয়েটাকে মারার চেষ্টাও করেছিলেন। মারতে পারেন নি অবশ্য। সিনএনজির থাক্কায় মাঝরাস্তায় ফেলে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। আমি শুধু তার থেকে একটু বেশি করেছি। হাত, পা ভেঙ্গে জন্মের গুন্ডামি করার সখ মিটিয়ে দিয়েছি মাত্র।"


কৌশলে স্বার্থের ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল আদ্র। ইখতিয়ার খেয়াল করলো না। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ সে। চোখ অত্যাধিক বড় বড়। থুতনি ঝুলিয়ে বিমূঢ় কণ্ঠে সে বললো,

---"তুমি জানতে?"

আদ্র হাসলো। দূর্বোধ্য হাসি। উত্তর দিলো না।


-


আদ্র এলো সন্ধ্যার দিকটায়। রুমে এসে বেলাকে দেখতে না পেয়ে বিরক্ত হলো সে। তৎক্ষণাৎ জোড়ে জোড়ে ডাকতে লাগলো তাকে। বেলা তখন রেখার রুমে ছিল। আদ্রর ছোটবেলার বিভিন্ন ঘটনা বলছিলেন তিনি। বেলা মন দিয়ে শুনছিল। হঠাৎ আদ্রর উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে ডাকার শব্দে হকচকালো সে। অপ্রস্তুত ভাবে তাকালো রেখার দিকে। রেখা মুচকি হাসলেন। ক্ষীণ লজ্জায় মিইয়ে গেল বেলা। তিনি বললেন, "যাও, ডাকছে তোমাকে। পরে রেগে যাবে নয়তো।"


এসির তাপমাত্রা কমিয়ে শার্টের বোতাম খুলছিল আদ্র। পিপাসায় কাতর তার গলদেশ, চক্ষুদ্বয়। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকানো। ঘামে লেপ্টে বাজে অবস্থা। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে আদ্র আবারও ডেকে উঠলো বেলাকে। পরমুহুর্তেই দেখলো, ইতস্তত পায়ে রুমের ভেতর ঢুকছে বেলা। তার থেকে ভীষণ দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

---"ডেকেছিলেন?"

আদ্র উত্তর দিলো না। পালটা প্রশ্ন করলো, "কোথায় ছিলে?"

---"মায়ের রুমে।"

---"আমি বাসায় আসলে একটু আশেপাশে থাকবে। ঠিকাছে?"


এবারও মাথা দুলায় বেলা। আদ্র চেয়ে রয়, নিষ্পলক। মেয়েটা অতিরিক্ত লজ্জা পায়। তার লজ্জাবউ। কথা ঠিক ভাবে বলতে পারে না। জড়তা কাজ করে। তার দিকে ঠিকভাবে তাকাতেও পারেনা। সর্বদা দৃষ্টি নামিয়ে রাখে। এই সাধারণ মেয়েটার মাঝে আছে কি আসলে? ক্ষণে ক্ষণে আদ্র খুব বাজেভাবে আটকে যাচ্ছে। বের হওয়ার সাধ্যি নেই। একবার তাকালে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। শক্ত করে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করে সর্বক্ষণ।

আদ্র সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। বললো,

---"গোসল করতে যাচ্ছি। এসে যেন তোমাকে রুমে পাই।"

বেলা ছোট্ট করে উত্তর দিলো, "আচ্ছা"


বলে উঠে যেতে চাইলো সে। আদ্র যেতে দিলো না। হাত ধরলো জড়ালো ভাবে। কিছুক্ষণ আগের মতোই চেয়ে থেকে গাঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, "তোমার কি আমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না বেলা?"


বেলা কি বলবে ভেবে পায় না। হাসফাস করে। একরাশ ক্লেশে সিক্ত হয় গৌড় বর্ণের গালদু'টি। খুব করে বলতে চায়, "করবে না কেন? অবশ্যই করে।"

কিন্তু অকপটে সে বরাবরের মতোই নিশ্চুপ। আদ্র হাত ছেড়ে দেয়। উঠে দাঁড়ায়। বাথরুমে যেতে যেতে একরোখা কণ্ঠে বলে, 

---"সমস্যা নেই। আমি শিখিয়ে দেব।"


_______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা