গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ২৮

 প্রিয় বেলা


২৮.

আদ্রর রুমে কখনো আসেনি বেলা। সুযোগই হয়নি। বিছানায় বসে পুরো রুমটা একবার পরখ করে নিলো সে। বড়োসড়ো একটা আয়তাকার রুম। একপাশে বিশাল বুকসেল্ফ, পড়ার টেবিল। বিভিন্ন রঙবেরঙের ফাইলের স্তুপে গোজামিল সেখানটা। দেওয়ালের একপাশে মাঝারি আকারের একটা পুরাতন কাঠের ফ্রেম টাঙ্গানো। পরিবারের সবার হাসোজ্জল মুখশ্রী ভেসে উঠছে ফ্রেমটিতে। আদ্রর বাবাও আছেন সাথে। তবে অনেকটা দূরে হওয়ায় ক্ষীণ অস্পষ্ট সবটা। কৌতূহলী বেলা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দেওয়ালের কাছাকাছি এসে আলতো করে ছুঁলো ফ্রেমটা। মুজিব কোর্ট গায়ে সম্মানের সহিত বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আদ্রর বাবা। চেহারা অনেকটা আরুর সঙ্গে মেলে। তিন ছেলেমেয়েকে কি ভীষণ আদুরে ভাবে আগলে ধরে রেখেছেন। প্রাণবন্ত হাসিগুলো বাস্তবিকই যেন তার সামনে জ্বলজ্বল করে হাসছে।


---"আদ্রর যখন বারো বছর, তখন বেশ সখ করে ছবিটা তুলেছিলেন ওদের বাবা। সেই থেকে ছবিটা আদ্রর রুমেই টাঙানো। ফ্রেম নষ্ট হওয়ার পরও ফ্রেমটা ও পাল্টাতে চায় না। ওখানে নাকি ওর বাবার ছোঁয়া লেগে আছে।"


বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রেখা। বেলা চমকে তাকালো। রেখার মুখশ্রী মলিন। কণ্ঠে হতাশ ভাব। একরাশ আফসোস, কষ্ট, যন্ত্রণা। বেলার কাছে এসে হাতের বাসন্তী রঙের শাড়িটা এগিয়ে দিলেন তিনি। কৃত্রিম হেসে বললেন,

---"তুমি নিশ্চই অনেক ক্লান্ত? এক শাড়ি পড়ে আর কতক্ষণ থাকবে? এটা পড়ে নিও। নাও।"

বেলা হাত বাড়িয়ে খুব সাবধানে নিলো। রেখা আবার বললেন,

---"মুখটা শুকনো লাগছে তোমার। ক্ষুধা লেগেছে? কিছু খাবে? নিয়ে আসবো?"

সে দ্রুত দিরুক্তি করলো, "না, না আন্টি। মা খাইয়েই দিয়েছিল। ক্ষুধা নেই এখন।"


রেখা শুনলেন। মুখের মলিন ভাব যেন আরও দ্বিগুণ বাড়লো। ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে ম্লান কণ্ঠে বললেন,

---"আমার তিন ছেলেমেয়ের মাঝে আদ্রই সবচেয়ে বেশি তার বাবাকে ভালোবাসত। ছেলেটা আমার বাবার মৃত্যু সহজে মেনে নিতে পারেনি। মনে মনে কষ্ট পুষে রেখেছে।"


রেখার দৃষ্টি অনুসরণ করে বেলাও তাকালো। বারো বছর বয়সী আদ্রকে চিনতে তেমন অসুবিধে হয়নি তার। নেত্রকোণের সূক্ষ্ণ দাগটা সহজেই চোখে পরছে।

রেখা আচমকা বেলার হাত ধরলেন। তাকে বিছানায় বসিয়ে নিজেও বসলেন পাশে। অত্যন্ত সর্তক কণ্ঠে কেমন কাতরতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমাকে কি আদ্র কোনো রকম জোড় করেছে বিয়ের জন্য? সত্যি করে বলবে বেলা। তুমি কি আদ্রকে পছন্দ করো? নাকি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছ?"


বেলা ভড়কে তাকায়। হতভম্ব হয়। চোখে বিস্ময়, বিমূঢ়তা। উত্তর দিতে পারে না। কণ্ঠনালিতে বিশ্রী শব্দজোট সৃষ্টি হয়। রেখার গভীর মুখপানে মায়া খুঁজে পায় সে। ছেলের চিন্তায় অস্থির হওয়া মায়ের কষ্ট দেখতে পায়। রেখা উত্তেজিত কণ্ঠে আবারও জিজ্ঞেস করেন,

---"উত্তর দিচ্ছো না কেন বেলা? ও কি সত্যিই জোড় করেছে তোমাকে?"

দমবন্ধকর অনুভূতি হলো বেলার। অস্বস্থি হলো ভেতরটা। মৃদু গলায় সে কোনোমতে উত্তর দিলো, "জোড় করেনি।"

---"তবে একা আদ্রই পাগলামি করতো না, তুমিও আগে থেকেই আমার ছেলেকে পছন্দ করতে?" বিহ্বল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন রেখা।

বেলা প্রতিউত্তর করতে পারলো না। চুপচাপ রইলো। তিনি আরেক দফা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখ ভেঙ্গে এলো যন্ত্রণায়। মেয়েটা সেধে সেধে কেন কষ্টের পেছনে ছুটছে? রাজনীতির বিশ্বে ভালো মানুষেরা আদৌ ঠিকেছে কখনো? তবুও থামলেন না তিনি। শেষ চেষ্টা করে গেলেন। খুব অনুরোধের সুরে বললেন,

---"আদ্র তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি কি ওকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে আনতে পারবে বেলা? ও তোমার কথা শুনবে। ওকে একবার বলবে?"


বেলা পলক ঝাপটালো। নেত্রের অদৃশ্য ফ্রেমবন্ধী আদ্রর কৃত্রিম ছবিগুলো ভেসে উঠলো সামনে। টেলিভিশনে দেখানো গর্বে ফুলে ওঠা দাম্ভিক নেতার উচ্ছ্বাসিত মুখশ্রী হানা দিলো মস্তিষ্কে। সে দেখল, আদ্রর ভাষণ দেওয়ার সময়কার আনন্দ। চোখের সেই গভীর প্রশান্তি। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বেলা নমনীয় কণ্ঠে বোঝালো,

---"আমি বললে উনি হয়তো রাজনীতি ছেড়ে দেবেন আন্টি। কিন্তু এতে কি উনি শান্তি পাবেন? বরং মনের কষ্ট আরও বাড়বে। রাজনীতি করে উনি আনন্দ পান। সেই আনন্দ ছিনিয়ে নিতে চাইলে হয়তো উনি আমার ওপরও বিরক্ত হতে পারেন। কি দরকার আন্টি? উনি যেভাবে আছেন সেভাবেই থাকনা। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তো আমরা কেউ জানিনা। উনার বাবার মতো উনার পরিণতি নাও তো হতে পারে, তাই না?"


বেলা তাকালো রেখার দিকে। রেখার ভাবগতি বোঝা যাচ্ছে না। তিনি কিছু বলবেন তার পূর্বেই আদ্র ঢুকলো রুমে। অনেকটা শব্দ করেই। পায়ের ধুপাধাপ আওয়াজ কানে লাগছে খুব। রেখা দ্রুত বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ছটপট কণ্ঠে বললেন,

---"এসেছিস? আয়াজ কোথায়? ক্ষুধা লাগলে নিচে চলে যাস। ফ্রিজে কেক আছে।"


ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আদ্র হাত ঘড়ি খুলে রাখলো। সেসবের উত্তর না দিয়ে অতি শান্ত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো, "তুমি প্রেশারের ঔষধ খেয়েছ?"

---"হ্যাঁ।"


চলে যাওয়ার আগে বেলার মাথায় স্বস্নেহে হাত বুলিয়ে দিলেন রেখা। দূর্বল হেসে বললেন,

---"পরের বার থেকে মা বলে ডাকবে, কেমন?"


প্রতিউত্তরে হালকা মাথা দুলালো বেলা। রেখা হন্তদন্ত পায়ে চলে গেলেন। মুখের মলিন ভাব ঢাকার ঢের চেষ্টা করলেন। অথচ বেলা ঠিকই বুঝতে পারলো উনার মনের অবস্থা।


-


ক্লান্তিতে বেলা একেবারে গোসল করেই বেরুলো। আদ্র বিছানায় আধ শুয়ে ফোন চাপছিল। পরনের লাল শার্টটি পালটে সাধারণ একটা টি-শার্ট পড়ে আছে সে। পেশিবহুল ফোলা বাহুগুলো যেন ইচ্ছে করেই দেখিয়ে রেখেছে। আকর্ষিত করতে চাইছে খুব। বেলা চোখ সরিয়ে নিলো। দক্ষিণের বড় জানালা গলিয়ে প্রবাহমান তেজি বাতাস আনাগোনা করছে। কি ভীষণ শীতল, ঠান্ডা। শরীর ছুঁতেই জায়গাটা শিরশির করে উঠলো যেন। দাঁতে দাঁত চেপে আসলো। আদ্র একপলক তাকালো সেদিকে। বললো,

---"ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন বেলা? এদিকে আসো।"


লজ্জায়, অস্বস্থিতে পা নড়ছে না তার। খুব ধীরস্থির ভাবে সে বিছানার এক কোণে পা উঠিয়ে বসলো। আদ্রর দিকে তাকাতেই দেখলো, লোকটা ভ্রু বাঁকিয়ে কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে তাকে। বিরক্তির স্পষ্ট ভাঁজ কপালে। বেলা দ্রুত অন্যদিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,

---"কি করেছি আমি। এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?"


আদ্র উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ অসন্তোষ চোখে দেখতে দেখতে হঠাৎই চোখের দৃষ্টি গাঢ় হয়ে উঠলো। দৃঢ়ভাবে প্রেয়সীর মাথা থেকে পা অব্দি খুব সময় দিয়ে দেখলো সে। কোমড়ের আশপাশটায় স্থির হতেই সূক্ষ্ণ যন্ত্রণা তৈরি হলো বক্ষে। অসহনীয়। স্নিগ্ধ বেলাকে ভীষণ পবিত্র মনে হলো তার। হাত টেনে নিজের পাশ ঘেঁষে বসালো। ব্যাঙ্কেট পুরো শরীরে সুন্দর করে ছড়িয়ে দিয়ে নির্বিকার সুরে বললো,

---"বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখনো তোমার দূরত্ব, দূরত্ব খেলা শেষ হয়নি? হলে বলবে, তোমাকে ছুঁয়ে দিব।"


বেসালাম অদ্ভুদ কথার পিঠে ভয়ংকর লজ্জায় জড়োসড়ো বেলা। কম্পয়মান সর্বাঙ্গ। মিনমিন করে সে বললো, "আপনি এত খারাপ কেন?"

---"তুমি খারাপ বানালে কেন?"


পালটা প্রশ্নে হকচকালো বেলা। ইতস্তত করলো। আড়নজরে দেখলো লোকটাকে। পকেট হাতড়ে কি যেন বের করছে সে। অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে বেলার হাত টেনে নিয়েছে। আঙুলের ভাঁজে খুব যতনে একটা আংটি পরিয়ে দিয়ে বললো,

---"এই রাতে নাকি স্ত্রীদের কিছু দিতে হয়। আয়াজ বলেছে। আমি জানতাম না। কিছু আনিও নি। ও-ই আংটিটা দিয়ে বলেছে তোমাকে যেন পরিয়ে দেই। এটা ওর পক্ষ থেকে তোমার জন্য উপহার।"


বেলা একপলক তাকালো আংটিটির দিকে। কারুকাজের নিপুণতা খুব সূক্ষ্ণ ভাবেই মন কেড়ে নিচ্ছে। অথচ বেলার অনুভূতি শূণ্য। আদ্র দেয়নি বলেই হয়তো। 

চোখ বুজে ছোট্ট হামি দিয়ে উঠলো বেলা। ক্লান্তিতে ঘুম আসছে। চোখের পাতা মিলিত হতে চাচ্ছে তীব্র ভাবে। একহাতে তার বাহু টেনে নিজের বুকের মধ্যিখানে মাথা চেপে ধরলো আদ্র। আলতো করে, আদুরে ভঙ্গিতে। শুধালো,

---"তোমার কি ঘুম আসছে? তাহলে ঘুমিয়ে যাও। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।"


বেলা যেন আরও লেপ্টে গেল প্রেমিক পুরুষটির মাঝে। বিনাবাক্যে চোখ বুজলো। নীরবতা রইলো প্রায় অনেক্ষণ। বাহিরে কোলাহল নেই। সূদুর কোত্থেকে যেন নাম না জানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। নভস্থলে তারাদের প্রখর মেলা।

বেশ কিছুক্ষণ পর আদ্র নিষ্প্রভ স্বরে বললো,

---"তোমার কাছে আমার একটা উপহার পাওনা রইলো বেলা।"


___________________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ২৭

 প্রিয় বেলা


২৭.

আয়নার প্রতিবিম্বে নিজেকে দেখছে বেলা। গায়ে মায়ের ভারী শাড়ি জড়ানো। লাল রঙের। হাতে আদ্রর দেওয়া চুড়িগুলো। আদ্রর নামে সেজেগুঁজে থাকা তার মুখশ্রী। কপালের পাশ ঘেঁষে এক্সিডেন্টের দাগ এখনো যায়নি। হাতের কনুয়ের ক্ষতদাগ শাড়ির আঁচলে ঢাকা পরে আছে। ঠোঁটে হাসি নেই। ভেতরকার দুর্বলতা, ভয়, জড়তা, সব একসাথে জড় হয়ে দলা পাকিয়ে আছে। অস্থির লাগছে। আয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালো বেলা। উঁকিঝুঁকি করলো আদ্রর বাড়ির ওদিকটায়। বাড়ির প্রবেশ পথে পাঁচ,ছটা দেহরক্ষী পাহারা দিচ্ছে। বাগানের ভেতরে আরও বেশকিছু আছে। হাতে বড় বড় বন্দুক সবার। মুখে কি তীব্র কাঠিন্যতা, রুঢ় ভাব। এদের দেখেই তো শিরশির করে উঠছে বেলার শরীর। আদ্রর অস্বস্থি হয় না?

ভাবনার মাঝেই প্রভা বেগম এলেন রুমে। এগিয়ে এসে বেলাকে খুব করে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,

---"ভীষণ সুন্দর লাগছে তো আমার মাটাকে।"


বলে কপালে চুমু খেলেন আবার। জিজ্ঞেস করলেন,

---"সকাল থেকে তো কিচ্ছু পেটে পরেনি। ক্ষুধা লেগেছে? খাবার আনবো?"

বেলা মাথা দুলালো। অর্থাৎ, খাবে না। প্রভা বেগম পরম স্নেহে মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন। চোখে পানি এসে ধরা দিলো উনার। কান্না আটকালেন। মমতাময়ী কণ্ঠে কাতর হয়ে বললেন,

---"দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেলি বেলা। এইতো, সেদিনই তো মাত্র আমার কোল জুড়ে এলি। এখন দেখ, আজকে নাকি তোর বিদায় বেলা।"


নেত্রকোণে জলরাশির অদৃশ্য অস্তিত্ব জানান দিতেই আঁচলের ঘঁষায় সেটুকু জল মুছে নিলেন প্রভা বেগম। বেলার দিকে একবার তাকিয়ে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, "আদ্রর পরিবার আসতে বেশি দেড়ি নেই। শাড়িটা ভালোভাবে সামলে তুই তৈরি হয়ে থাক।"


অভ্যন্তরীণ পীড়াদায়ক দীর্ঘশ্বাস খুব কষ্টে বেরিয়ে এলো যেন। বেলা বিছানায় গিয়ে বসলো। দোটানায় বাজে ভাবে ফেঁসে গেছে তার মন। একদিকে তার নেতা সাহেবকে নিজের করে পাওয়ার তীব্র উচ্ছাস আর অন্যদিকে বাবা, মা, ভাই, সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার বিক্ষিপ্ত বেদনা।


-


কলের ওপর কল আসছে আদ্রর। সব ইখতিয়ারের নম্বর থেকে। আদ্র ধরলো না একটাও। কেটে দিলো। ফোন বন্ধ করার পূর্বে শুধু ছোট্ট করে একটা বার্তা পাঠালো, "টাকা পেয়েছি। সকালে কথা হবে।"


ফোনটা আকিবের কাছে দিয়ে গাড়ি থেকে নামলো সে। আকিব মলিন মুখে পকেটে ভরে নিলো তা। আদ্রর পিছু নিয়ে হতাশ কণ্ঠে বললো,

---"আপনি কি সত্যিই ওই বেয়াদপটার সঙ্গ দিচ্ছেন ভাই?"

---"তোমার কি মনে হয়?"

পালটা প্রশ্নে ক্ষীণ ইতস্তত করলো আকিব। আগের চেয়েও অধিক মলিন গলায় বললো, "আমি কিছু বুঝতে পারছি না ভাই। আপনি খারাপ কিছুতে জড়াবেন না এটা আমার বিশ্বাস। কিন্তু চোখের সামনে যা হচ্ছে সেটাও তো অবিশ্বাস করতে পারছি না।"


প্রতিউত্তরে কেমন করে যেন হাসলো আদ্র। হালকা ঠোঁট বাঁকিয়ে। অদ্ভুদ ভাবে। নির্বিকার স্বরে বললো, "আজকে আমার বিয়ে হচ্ছে আকিব। এমন উদাস হয়ে থেকো না তো। এনজয় ইউর সেল্ফ।"

বলতে বলতে কলিংবেল চাপলো আদ্র। আকিব কথাটা শুনলো ঠিক, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে পারলো না। আদ্রকে বেশ রহস্যজনক লাগছে তার। বুঝে ওঠার বাহিরে।

ততক্ষণে দরজা খুলে গেছে। সামনে আদ্রকে দেখে সায়েদ সাহেব বিস্তর হাসলেন। প্রফুল্ল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, "এত দেড়ি করে আসলে যে বাবা? আমরা সবাই অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্য। কাজী এসে গেছেন। আসো।"


বিয়েটা হয়ে যায় একটু তাড়াহুড়ো করেই। আয়োজন ছাড়া। আত্মীয়-স্বজনহীন। খুব গোপনে। মিডিয়ার কেউ এখন অব্দি অবগত নন। কবুল বলার পূর্বেও বেলার বিশ্বাস হচ্ছিল না। প্রভা বেগমের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। পলক ফেলে আশপাশটা দেখছিল শুধু। সে কি স্বপ্ন দেখছে? নাকি বাস্তব? 


-


মাথার ওপর ভন ভন করে ফ্যান ঘুরছে। তবুও গরমে ঘর্মাক্ত হয়ে আছে আদ্রর কপাল, ঘাড়, গলা। ভ্রু বাঁকানো। ললাট বাজেভাবে কুঁচকানো। লাল রঙের শার্টটির প্রথম দু'টো বোতাম খুলে ফেললো সে। গলা উঁচিয়ে বললো,

---"ফ্যানের পাওয়ার আরেকটু বাড়িয়ে দাও তো বেলা।"


বিছানার কোণে বসে থাকা বেলা ক্ষীণ নড়েচড়ে উঠলো। নিঃশব্দে উঠে গিয়ে ফ্যানের গতি বাড়িয়ে দিলো। নিজ জায়গায় এসে বসতেই আদ্র আবারও আগের মতোই অলস গলায় বললো,

---"খুব পিপাসা পেয়েছে বেলা। পানি দাও।"


জগ থেকে পানি নিয়ে আদ্রর কাছাকাছি হলো বেলা। পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই তা নিলো সে। একনিশ্বাসে সম্পূর্ণ পানি পান করে খালি গ্লাসটা ছুঁড়ে রাখলো বিছানায়। অল্প পানির ছিঁটায় ভিজলো বিছানার চাদর। আদ্র পরোয়া করলো না। বেলার হাত টেনে পাশে বসালো। কোলে মাথা রাখলো খুব অধৈর্য ভাবে। প্রগাঢ় দৃষ্টি ফেললো বেলার মাত্র ধুঁয়ে আসা সাজহীন স্নিগ্ধ মুখপানে। আদ্রর ঠোঁটে হাসি নেই। একটু আগের আলস্য ভাবটাও নিখোঁজ। হাত উঁচিয়ে এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো সে। শুধালো, "মন খারাপ?"


বেলা উত্তর দিলো না। চুপ রইলো। আদ্র আরেকটু ঘনিষ্ট হলো যেন। বেলার এক হাত নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো। ধীরকণ্ঠে বললো,

---"বেশি খারাপ লাগলে তুমি আজকের দিনটা এখানে থাকো। আমি কাল সকালে এসে নিয়ে যাবো। ঠিকাছে?"


সঙ্গে সঙ্গে বেলা দিরুক্তি করে উঠলো, "আমি আপনার সঙ্গে যাবো।"


তার অকপটে বলা নিঃসঙ্কোচ কথার পিঠে সশব্দে হেসে ফেললো আদ্র। বিরতীহীন ভাবে, দীর্ঘক্ষণ। হাসতে হাসতে নেত্রপল্লব বুঝে এলো তার। বেলার লজ্জা বাড়লো। রক্তিম আভায় সিক্ত হলো গাল। অথচ বেহায়া দৃষ্টি ঠিকই একটু পর পর লোকটাকে দেখছে। কি বিশ্রী অবস্থা!

আদ্রর হাসি থামাতেই বেলা মিনমিন করে বললো,

---"একটা প্রশ্ন করি?"

আদ্র ভ্রু কুঁচকালো,

---"জিজ্ঞেস করতে হবে না।"

বেলা আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,

---"রাজনীতি বাবা একটুও পছন্দ করে না। আপনি রাজনীতিবিদ। আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বাবা কখনোই মেনে নিতো না। সেখানে এত সহজে আমাদের বিয়ে মেনে নিলো কিভাবে? আপনি কিছু করেছেন?"


কোল থেকে মাথা সরিয়ে উঠে বসলো আদ্র। দায়সারা ভাবে বললো,

---"আমাকে বলছো কেন? তোমার বাবাকেই জিজ্ঞেস করো। উনি বলবেন।"

বেলা গলায় জোড় দিলো, "আমি আপনার থেকে শুনতে চাইছি। বলুন না!"

---"তোমার বাবার পেছনে পুরো চারদিন ঘুরতে হয়েছে আমার।"


কথাটা প্রচন্ড অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললো আদ্র। তার মুখ দেখে নিমিষেই হেসে ফেললো বেলা। আদ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। হঠাৎ-ই ঝুঁকে এলো বেলার দিকে। বেলা থমকালো। কিছু বলার পূর্বেই আদ্র দৃঢ় গলায় বললো,

---"তবুও আমি আমার কথার নড়চড় করিনি।"

বেলা পলক ঝাপটালো। ক্ষীণ আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো,

---"কোন কথা?"


আদ্র গাঢ় চোখে তাকালো তখন৷ টেবিলে পরে থাকা গোলাপগুলোর দিকে ইশারা করে বললো,

---"গোলাপগুলোর পাঁপড়ি পরে যাওয়ার আগে তোমাকে ঘরে তুলবো বলেছিলাম। আমি আমার কথা রেখেছি।"


______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ২৬

 প্রিয় বেলা


২৬.

হাতের চিকন আঙুলগুলো অবিশ্রান্ত ঝাঁকড়া চুলগুলোর ভাঁজে ভাঁজে ঘুরিয়ে চলছে বেলা। লোকটা ঘুমিয়ে গেছে প্রায় অনেক্ষণ হলো। ঘন ঘন নিশ্বাসে বিস্তর বক্ষস্থল ওঠানামা করছে। বেলার একহাত খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে সে। খুব যতনে। চুল থেকে হাত নামিয়ে আদ্রর গালে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো বেলা। সেভ করা গালটায় সদ্য নতুন চাপদাঁড়ি গজিয়েছে। লোকটাকে আরও সুন্দর লাগছে এতে। বেশ কিছুপলক এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আদ্রর মাথা কোল থেকে নিচে নামিয়ে রাখতে চাইলো বেলা। ছাদের দরজা খোলা। সময় গড়াচ্ছে। মা, বাবা যদি হুট করে চলে আসেন? কিন্তু তার পূর্বেই হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে প্রবল শব্দে। বেলা উসখুস করলো। আওয়াজের উৎস খুঁজলো। পরে যখন বুঝলো আদ্রর কল এসেছে, উপায়ন্তর হয়ে মৃদু গলায় ডাকলো তাকে,

---"আদ্র। আদ্র শুনছেন? আপনার কল এসেছে। আদ্র?"


আদ্রর সাড়া শব্দ নেই। নড়চড়ও করছে না। বেলা আরও বেশ কয়েকবার ডাকতেই বিরক্তিতে চোখ, মুখ কুঁচকে ফেললো সে। নেত্রপল্লব বোজা অবস্থাতেই রোষপূর্ণ গলায় প্রশ্ন করলো,

---"কি হয়েছে? ডাকছো কেন?"


ততক্ষণে নতুন উদ্যমে ফোন আবারও বাজতে শুরু করেছে। বেলা মিনমিন করে বললো,

---"আপনার ফোন বাজছে। অনেকবার কল করেছে।"

আদ্র বিনাবাক্যে ট্রাউজারের পকেট হাতড়ে ফোন বের করলো। বেলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে অলস কণ্ঠে বললো,

---"ফোন রিসিভ করে কানে ধরো। এসব করতে এখন একদম ভালো লাগে না আমার।"


বেলা অবাক হয়ে পলক ঝাপটালো। আদ্র তখনো ঘুমে চোখ মেলতে পারছে না। তিক্ততায় বিকৃত করে রেখেছে সারা মুখশ্রী। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই কেমন থমথমে, গম্ভীর স্বরে বললো, "আদ্র ইয়ানিদ বলছি।"


ওপাশ থেকে কি যেন বললো। আদ্রর ভ্রুযুগল অস্বাভাবিক ভাবে কুঁচকে গেল। ঘুম উবে গেল পুরোপুরি। তড়িৎ গতিতে উঠে বসে ফোনটা বেলার কাছ থেকে টেনে নিলো সে। বড়োসড়ো ধমক লাগালো, 

---"আমাকে আগে জানানো হয়নি কেন?"

আবারও পিনপতন নীরবতা। আধো আধো কোনো পুরুষ কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল বেলা। চকিতে তাকালো। আদ্র আগের মতোই বললো, "আসছি আমি। যেভাবে আছিস সেভাবেই থাক।"


কান থেকে ফোন নামালো আদ্র। কপালে দু'টো আঙুল জোড়ালো ভাবে ঘঁষে তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। যথেষ্ট শান্ত থাকার চেষ্টা করে বেলার দিকে তাকালো। বললো,

---"আমার এখন যেতে হবে বেলা। আমি তোমাকে পরে কল করবো।"


বলে মাথা ঝুঁকিয়ে কাছাকাছি হলো সে। উষ্ণ নিশ্বাসের অস্থির ছোঁয়া ললাট রাঙিয়ে দিলো। বেলা বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

---"কি হয়েছে?"

---"বিপক্ষদল আক্রমণ করেছিল বেলা। আমার যেতে হবে।"


আদ্র চলে গেল। বেলা নিশ্চুপ হয়ে দেখল তার যাওয়া। পিছু ডাকলো না আর। কানে এলো, মা ডাকাডাকি করছেন।


-


আদ্র রাতে ফেরেনি বাসায়। দলবল নিয়ে ক্লাবেই ছিল। কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তন্ময়ের হাত গুরুতর ভাবে কেটে গেছে। বাহুর একদলা মাংস ছুড়ির আঘাতে কেটে ক্ষতবিক্ষত। মাথা ফেটে এলাহি কান্ড। বাকিদের অবস্থাও সমীচীন নয়। ক্লাব তচনচ করা। প্রয়োজনীয় ফাইল, বুকসেল্ফ, চেয়ার ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। 

আদ্রর মাথা ঝিমঝিম করছে। ফুলে টনটন করছে কপালের মোটা রগগুলো। স্পষ্ট দৃশ্যমান হয়ে আছে। মাথার দু'ধারে হাত চেপে ঘাড় ঝুঁকিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইলো সে। দরজা ঠেলে আকিব এলো তখন। যথেষ্ট নম্র গলায় ডাকলো,

---"ভাই?"


আদ্র শুনলো। চোখ তুলে তাকালো অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে। প্রশ্ন ছুঁড়লো,

---"পার্টি অফিসে যেতে হবে আমার। কাজ সব হয়েছে? বাসায় যাবো আমি।"

আকিব ইতস্তত করলো। ভীতু মনে এদিক-ওদিক তাকালো। আস্তে করে বললো,

---"বিরোধী দলের ইখতিয়ার এসেছে আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আমি কি পাঠাবো ভাই?"


আদ্রর চোখ ছোট ছোট হলো। খুবই সূক্ষ্ণ, দৃঢ়। তীক্ষ্ণতা প্রবাহমান। ওভাবেই চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো সে। বললো, "পাঠাও।"

আকিব মাথা দুলিয়ে চলে গেল। ইখতিয়ার এলো তার একটু পরেই। পরনে মুজিব কোর্ট, ধূসর রঙের জিন্সের জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। হাতে, গলায় বিভিন্ন ব্রেসলেট। মুখে বয়সের ছাপ পরতে শুরু করেছে এখন থেকেই। আদ্র থেকে বড়জোর সাত-আট বছরের বড় হবে। অনুমতি ছাড়াই সোজা আদ্রর সামনের চেয়ারে বসে পরলো সে। নোংরা দাঁত বের করে বিশ্রী হাসলো। হাত বাড়িয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো,

---"কেমন আছেন আদ্র সাহেব। নতুন পদ, ক্ষমতা পেয়ে কেমন লাগছে?"


আদ্রর চেহারায় কাঠিন্যতা। চোয়াল শক্ত। হাত মেলালো না সে। রাশভারি কণ্ঠে উত্তর দিলো, "রাতের আঁধারে চোরের মতো কাজ করে এখন আবার কি জন্যে এসেছেন? নিশ্চই পদ, ক্ষমতা পেয়ে কেমন আছি তা জানার জন্য না। কাজের কথা বলুন।"


হাত না বাড়ানোয় অপমানে শরীরে জ্বলুনি অনুভব করলো ইখতিয়ার। তবে পরক্ষণেই তা গা ঝাড়া দিয়ে ফেললো। এমন একটু আধটু অপমান সহ্য করতেই হয়। নইলে রাজনীতিতে টেকা যায় না। পরে নাহয় হিসাব সমান সমান করবে। পা ছড়িয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো সে। বিচ্ছিরি কণ্ঠটা আরেকটু বিচ্ছিরি করে বললো,

---"তোমার বুদ্ধীর প্রসংশা করতে হয় কিন্তু। এইজন্যই তোমাকে আমার ভালো লেগেছে অনেক। কিন্তু চোর তো রাতের বেলাই চুরি করে আদ্র সাহেব।"


হাতের পিঠে থুতনি ঠেকিয়ে বসলো আদ্র। ঠাট্টার সুরে বললো,

---"তাহলে আপনি মানছেন, আপনি চোর। একজন নিম্নমানের চোর।"

শুনে সশব্দে হেসে উঠলো ইখতিয়ার। কি বাজে শোনালো হাসিটা! মুহুর্তেই আবার হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে উঠলো সে। টেবিলের উপর দু'হাত রেখে বললো,

---"ঠাট্টা মজা করা শেষ। এবার কাজের কথায় আসছি। দেখ আদ্র, তুমি না থাকলে এমপি পদটা আমারই হতো। তুমি মরলেও পদটা আমারই হবে। কিন্তু আমি তোমাকে মারবো না। আমার দলের একজন প্রধান সদস্য বানাতে চাচ্ছি। আমার ড্রাগসের ব্যবসা আছে। মানে কলেজ, ভার্সিটির ছেলেমেয়েদের ড্রাগ এডিক্টেড করা আরকি। এতে ব্যবসা ভালো চলে। কিন্তু ইদানিং তোমার ছেলেপেলেরা ভীষণ সমস্যা করছে। ওদের সামলাও। মোটা অংকের টাকা পাবে।"


আদ্রর অভিব্যক্তি আগের মতোই কঠিন। শূণ্যের কোঠায়। কপালে গাঢ় ভাঁজের বলিরেখা। টেবিল থেকে কলম নিয়ে সে কিছু একটা ভাবলো। হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠলো, "কত টাকা?"

কথাটা যেন ঝংকার তুললো পুরো রুমে। নিস্তব্ধতা ডিঙ্গিয়ে ইখতিয়ার হো হো করে হেসে উঠলো। জবাব দিলো, "তুমি যত চাও।"

---"আমি এমাউন্ট আপনাকে মেসেজ করে দিব। এখন যেতে পারেন।"

মনে মনে আদ্রকে গালমন্দ করলো ইখতিয়ার। এত সহজে রাজী হওয়ায় খুশিও হলো সে। সাচ্ছন্দ্যে চলে গেল সেখান থেকে। 

আকিব অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে তখনো। আদ্রকে চিনতে পারছে না যেন। কণ্ঠস্বর থেকে কথা বেরোতে চাইছে না। ক্ষত মনে ক্ষীণ গলায় সে ডাকতে চাইলো, 

---"ভাই।"


-


পশ্চিম দিকে সূর্য ডুবেছে। আকাশে ঘোর সন্ধ্যার সমাপ্তি। মেদুর কালো রঙে আচ্ছাদিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীর বাসা থেকে বেরিয়ে বেলা করিম চাচার রিকশার দিকে এগোলো। রিকশায় উঠে বসতে নিলেই তিনি হন্তদন্ত হয়ে দিরুক্তি করে উঠলেন,

---"তুমি আমার রিকশায় আইজকে উঠতে পারবা না মা। আদ্র সার মানা কইরছে।"


বেলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কেন?"

পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের করে হাসলেন করিম চাচা। লাজুক কণ্ঠে বললেন,

---"ওই সামনে, গাছের পিছে আদ্র সারের গাড়ি খাড়াইয়া আছে। তোমারে যাইতে কইছে। যাও।"

বেলা তৎক্ষণাৎ সূদুর গাছের ওখানটায় দৃষ্টি ফেললো। কালো রঙের গাড়িটা ঠিক নজরে এলো তার। করিম চাচার দিকে তাকিয়ে বিনয়ী হাসি ফিরিয়ে সে গাড়ির দিকে এগোলো। কাছাকাছি আসতেই পেছনের দরজা আপনা-আপনি খুলে গেল। ঠোঁট কামড়ে একবার চারপাশটা দেখল বেলা। নিঃশব্দে আদ্রর পাশে গিয়ে বসলো। 


গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আদ্র নিশ্চুপ। একমনে, অনিমেষ দেখছে বেলাকে। চোখের পলক খুব কমই ফেলছে। বেলার দিকে একদম ফিরে বসে আছে সে। অথচ চেহারায় স্পষ্ট চিন্তা, ক্লান্তি। নত মস্তকে বেলা আড়নয়নে একবার তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,

---"কি হয়েছে?"

---"দেখছি তোমাকে।"


অকপটে বলা কথার পিঠে কিছু বলার সাহস হলো না বেলার। মিইয়ে গেল। লজ্জা পেল। কেঁপে উঠলো নেত্রপল্লব। ভারী হলো গাল। আদ্র দূর্বোধ্য হাসলো। হুট করে শুধালো, "আমাকে তোমার কেমন লাগে বেলা?"


বেলা হকচকালো। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ক্ষীণ সময় লাগিয়ে মৃদু কণ্ঠে খুব ছোট্ট করে বললো, "ভালো।"

---"শুধুই ভালো?"


বেলা জবাব দিলো না। লোকটা যে তাকে লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে, তা ঢের বুঝতে পেরে গেছে সে। 

আদ্র আবারও হাসলো। উঁচু গলায় ড্রাইভারকে বললো, "লাইট বন্ধ করে দাও ইমরান।"


বাতি নিভে যায়। অন্ধকার হয় আশপাশ। সেই অন্ধকার কাজে লাগিয়ে বেলার কাঁধে মাথা রেখে হেলে পরে আদ্র। বেলা চমকিত হয়ে কিছু বলার পূর্বেই বলে,

---"তোমার বাসায় কাল পরিবার নিয়ে আসছি আমি। তৈরি থেকো।"

---"কেন?"

বেলার কণ্ঠে বিস্ময়। আদ্র নিষ্প্রভ স্বরে বললো,

---"বিয়ে করতে।"


________________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ২৫

 প্রিয় বেলা


২৫.

বাতাসে কেমন পোড়া পোড়া গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। আদ্র একদমই সহ্য করতে পারে না এই গন্ধ। হাঁচি হয়, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। রুমাল নাকে চেপে ড্রাইভারকে গাড়ি গ্যারাজে রেখে আসতে বললো সে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আশপাশটা একবার দেখে নিলো। না! কাউকে তো কিছু পোড়াতে দেখা যাচ্ছে না। তবে ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারিদিক। বিরক্ত হয়ে আদ্র দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। গলা উঁচিয়ে ডেকে উঠলো,

---"রাহেলা আন্টি। কোথায় আপনারা? পোড়া গন্ধ কোথা থেকে আসছে? স্প্রে করেননি কেন এখনো?"


রাহেলা দিলদার দৌঁড়ে এলেন। মোটা শরীর নিয়ে দৌঁড়ঝাপ করা একটু বেশিই কষ্টকর। এসে ক্ষীণ সময় হাঁপিয়েই কুল পেলেন না। তাড়াতাড়ি মুখ চালিয়ে বললেন,

---"আপা পুরান জিনিস পুরাইছিলো ইকটু আগে। ওইটারই পুড়া গন্দ আইতেছে।"


তিক্ত মেজাজটা চড়া দিয়ে উঠলেও আদ্র কথা বাড়ালো না। কণ্ঠে কঠিনতা এনে বললো,

---"একটু আগে হলে এখনো রুমস্প্রে করেন নি কেন? এসিও বন্ধ। আমি যে পোড়া গন্ধ সহ্য করতে পারি না, তা জানেন না আপনি?"

রাহেলা মাথা নুয়ালো। মলিন কণ্ঠে বললো,

---"ছোরি, ছোরি। ভুইলা গেছিলাম। এহনই দিতাছি।"


রাহেলা আবারও ছুটলো। আদ্র সেদিকে একবার চেয়ে সোজা ঘরে চলে গেল। এসির তাপমাত্রা কমিয়ে শীতলতা বাড়িয়ে দিলো। ফ্রেশ হয়ে এসেই ল্যাপটপ নিয়ে বসলো সে। ই-মেল চেক করতে লাগলো একে একে। 

রেখা ছেলের দরজার সামনে জড়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অনেক্ষণ যাবত। ছেলে তার অনেকদিন হলো প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। হুটহাট পাশে বসে বলে না, "আজকের দিনটা অনেক ব্যস্ততায় কেটেছে মা। হাত ধুঁয়ে-টুয়ে ভাত খেতে পারবো না এখন। খাইয়ে দাও তো।"

কোলটা কেমন খালি খালি লাগছে। রেখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেড়ানো দরজায় আলতো ধাক্কা দিলেন। নিমিষেই খুলে গেল তা। ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। আদ্র মাত্র একবার তাকালো। দৃষ্টি ফেরাতে ফেরাতে বললো,

---"কোনো প্রয়োজন মা?"


রেখা আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নিঃশব্দে ছেলের পাশে গিয়ে বসলেন। হতাশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

---"আর কত আদ্র? আর কত শাস্তি দিবি?"


কি-বোর্ডে অনবরত টাইপ করতে থাকা আঙুলগুলো ক্ষণিকের জন্য থমকালো। পলক পরলো দু'বার। ফের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে নিষ্প্রাণ স্বরে বললো,

---"শাস্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো মা। আমি না।"

---"আমি কি শাস্তি দিচ্ছি তোকে? আমি শুধু মেয়েটার ভালো চাচ্ছি আদ্র। আমি চাই না আমার মতো কষ্ট কেউ করুক। তোর বাবা যখন মারা গেল তোরা তখন মাত্র পনেরো বছরের ছিলি। তোর দাদার ব্যবসা না থাকলে পথে নামতে হতো আমাদের। আব্বা কতবার তোদের রেখে দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চেয়েছিল আমাকে, জানিস? কতটা মানসিক যন্ত্রণা আমি সহ্য করেছি তার অনুমান কখনো করেছিস? কখনো বুঝতে চেয়েছিস আমার কষ্ট?"


আদ্র ল্যাপটপ পাশে রেখে দিলো। পূর্ণ দৃষ্টে শান্ত ভাবে তাকালো। গম্ভীর স্বরে বললো,

---"তুমি কি তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলে মা? দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম তোমাকে। তোমার কান্না দেখে আমরাও কাঁদতাম। তুমিও তো খেয়াল করো নি কখনো।"


রেখার ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না আসতে চাইলো। তবে কাঁদলেন না তিনি। ঝাপসা চোখে স্বামীর হাসোজ্জল মুখশ্রী মানস্পটে ভেসে উঠলো। দীর্ঘ নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেল কিছুক্ষণ। কঠোর হয়ে রেখা বললেন,

---"তুই রাজনীতি ছেড়ে দেয়। আমি বেলার সঙ্গেই তোর বিয়ে দেব।"

---"যা সম্ভব না, তা কেন বলছো?"

---"আমি চাই না তোর বাবার মতো তোরও সেই অবস্থা হোক। কথাটা বুঝতে চাচ্ছিস না কেন?"


আদ্র রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে উত্তর দিলো, "যদি বাবার মতো আমার অবস্থা না হয়? আমি যদি মারা না যাই? তখন তো আফসোস রয়ে যাবে মা। বেলাকে না পাওয়ার আফসোস।"

রেখা হাল ছাড়লেন না। আবারও বোঝাতে লাগলেন, "ভালোর দাম নেই আদ্র। দূর্নীতি ছাড়া রাজনীতিতে টেকা যায় না।"

---"জানি। দরকার পরলে আমিও দূর্নীতি করবো।"


রেখা চমকালেন খুব। অবাক চোখে ছেলের মুখপানে তাকালেন। থেমে থেমে জিজ্ঞেস করলেন,

---"তুই দূর্নীতি করবি আদ্র?"

---"যারা দূর্নীতির ভাষা বুঝে তাদের সেই ভাষাতেই বোঝাতে হয় মা। আমি বাবার মতো নই। খুব সম্ভবত সেই পরিণতি চাই না বলে দূর্নীতি করতেও পিছপা হবো না। বাবা ভালো মানুষ ছিলেন। সেই দাম ওরা দেই নি। চোখের সামনে এখনো ভাসে মা। এই এলাকার ডাস্টবিনে আমার বাবার লাশ পরে ছিল। পুরো একটা বছর আমাদের কাছ থেকে আলাদা ছিলেন তিনি। অত্যাচার সহ্য করেছেন, মৃত্যুর জন্য ছটপট করেছেন। আমরা টের পাইনি। ঘুণাক্ষরেও তার ভেতরের অবস্থা জানতে পারিনি।"


আদ্র থামলো। কণ্ঠস্বর ভেঙ্গে এলো যেন। রোধ হলো। তবে কান্নার ছিঁটেফোঁটাও এলো না। চোখ রোষাক্ত হলো। ওভাবেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল সে। রেখা বসে রইলেন। নিশ্চুপ ভাবে। চোখ থেকে পাষান জলরাশিগুলো বইতে থাকলো একাধারে।


-


বিহানকে পড়তে বসিয়ে বেলাও পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। ভাইব্রেশনে আটক ফোনটা ঝিরঝির আওয়াজ করতেই হাতে নিলো তা। নেতা সাহেব থেকে কল এসেছে। সে ধরলো কলটা। ওপাশ থেকে আদ্রর থমথমে কণ্ঠস্বর শোনা গেল,

---"তোমার কাছে পাঁচ মিনিট আছে বেলা। ছাদে আসো।"


পরক্ষণেই কল কেটে গেল। দাম্ভিক নেতার কথার পিঠে পালটা কিছু বলতে পারলো না বেলা। কান থেকে ফোন নামিয়ে একবার স্ক্রিনে তাকালো। ঝটপট ফোনটা টেবিলে রেখে দাঁড়িয়ে পরলো। বিহানকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে ধমকালো,

---"আমি একটু ছাদে যাচ্ছি। একদম পড়া বাদ দিয়ে অন্যকিছু করবি না। এসে পড়া ধরবো। না পারলে দেখিস, বাবাকে দিয়ে মার খাওয়াবো।"

বিহান বেজার মুখে বইয়ে মুখ গুঁজলো। তাকালোই না। যেন বইয়ের ভেতর আজ ঢুকেই উদ্ধার করবে সে।


আদ্রকে বেশি অপেক্ষা করালো না বেলা। সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে ছাদে প্রবেশ করতেই আদ্রকে দেখতে পেল সে। ছাদ টপকে তাদের ছাদের রেলিংয়ের ওপর বসে আছে সে। সিগারেট ফুঁকছে। বেলা এগিয়ে এসে কাছাকাছি হলো। নাক, মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করলো,

---"আপনার না পোড়া গন্ধে, ধোঁয়ায় এলার্জি? তবুও সিগারেট খাওয়া বাদ দেন না কেন? এতে সমস্যা হয় না?"


আদ্র পাশ ফিরে তাকালো। গম্ভীর, প্রাণহীন চোখে। হাতের সিগারেটে আরও একবার টান দিয়ে ফেলে দিলো সূদুরে। কোথায় যে গিয়ে পরলো সেটা। দৃষ্টি গোচর হলো না। আদ্র বললো,

---"আমি যেটা খাই, সেটায় পোড়া গন্ধ নেই। আর এটুকু ধোঁয়ায় কিচ্ছু হয় না আমার। অভ্যাস আছে।"

বেলা শুনলো না। জোড় গলায় বললো,

---"তাও। আর খাবেন না।"

---"আচ্ছা।"


আদ্রর দৃষ্টি বিস্তর আকাশে অনড় হয়ে আছে। তারাগুলো টিপটিপ করছে। আদ্র আগে বিশ্বাস করতো, ওই তারাগুলোর একটি আদ্রর বাবা। সম্মানিত এমপি। যাকে আটক করে রাখা হয়েছি পুরো এক বছর। তিল তিল করে প্রতিটা দিন মৃত্যু যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছিল। সবাই ভেবেছিল তিনি বুঝি আত্মগোপন করেছেন! কিংবা বেঁচে নেই আর। তারপর একদিন বড় ডাস্টবিনটার ওখানে, গন্ধ, পঁচা মায়লার স্তুপে বাবার লাশটা পরে থাকতে দেখেছিল সে। বুঝতে পারেনি ওটা তারই বাবা। চেহারা ঝলসানো ছিল তো! বাবার সেই একবছর পুরোনো ছেঁড়া শার্টটা না দেখলে সে তো বিশ্বাসই করতো না, এটা তার প্রাণপ্রিয় বাবা।

যন্ত্রণাদায়ক এক গাঢ় নিশ্বাস ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। খুব কষ্টে। বেলার হাত আলতো করে ধরলো সে। বললো,

---"বেলা, আমি কিন্তু রাজনীতি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য করছি না। আমি শুধু জানতে চাই কারা আমার বাবাকে মেরেছিল, কেন মেরেছিল। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই আমি। ওদের দেখাতে চাই, ওরা সবসময় আমাদের নিচে ছিল। নিচেই থাকবে।"


বেলা কিছুই বুঝলো না। অবাক নয়নে চেয়ে রইলো শুধু। ওই সুদর্শন মলিন মুখটার দিকে। তার প্রেমিক পুরুষের দিকে। আদ্র হঠাৎ নিচে বসে পরলো। বেলার হাত টেনে তাকেও বসিয়ে দিলো। সময় ব্যয় না করে মাথাটা বেলার কোলে রেখে শুয়ে পরলো সাবধানে। বেলা হকচকিয়ে উঠলো। ভড়কালো খুব। মৃদু চেঁচিয়ে বললো,

---"পাগল হয়েছেন নাকি? ময়লার মধ্যে শুয়েছেন কেন? দরজা খোলা তো। আদ্র? উঠুন।"


আদ্র উঠলো না। একটা অক্ষরও শুনলো না যেন। চুপ করে চোখ বুজে রইলো। আদ্রর ক্লান্ত, মায়াময় মুখ দেখে বেলাও আর কিছু বলতে পারলো না। নিয়ন্ত্রণহীন হাত আপনা-আপনি ঝাঁকড়া চুলগুলোর ভাঁজে ভাঁজে চলে গেল। আদ্র তখন ডাকলো, "বেলা।"

বেলা ঘোরলাগা কণ্ঠে মৃদু জবাব দিলো, "হু।"


আদ্র তখন ঘুমিয়ে যেতে যেতে প্রবল দৃঢ়তার সঙ্গে বললো,

---"আমি তোমাকে খুব জলদি বিয়ে করে ফেলবো বেলা।"


________________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ২৪

 প্রিয় বেলা


২৪.

দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ-ই হোঁচট খেয়ে পরে যেতে নিলো বেলা। বাম পায়ের বুড়ো আঙুল কেমন বেঁকে যাচ্ছিল। কোনোমতে নিজেকে সামলালো সে। বেখেয়ালি শরীরটা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলো। তড়িৎ গতিতে রুপাও অতি ভীতু মনে বেলার বাহু টেনে ধরলো। কটমটে গলায় ধমকের সুরে বললো,

---"এত হুলস্থুল কান্ড ঘটাচ্ছিস কেন বেলা? কোথাকার কোন ট্রেন ছুটে যাচ্ছে? আস্তে হাঁট!"


কাঁধের ব্যাগটা ঢিলে হয়ে পরে যাচ্ছিল। তা ঠিক করে এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজলো বেলা। অনভ্যস্ত কণ্ঠে মিথ্যা বললো,

---"বাড়িতে মেহমান আসবে। তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে।"

রুপা বড় বড় চোখে তাকালো,

---"মেহমান বলতে? তোকে আবার দেখতে আসবে নাকি?"

---"নাহ্। এমনিই আসবে।" ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিলো বেলা।


রুপা শুনলো। সামান্য 'ওহ্।' বলে চুপ হয়ে গেল। হাতে থাকা ফোন চালু করলো। ইউটিউবে ঢুকে কি যেন টাইপ করলো সে। উৎফুল্ল মনে একটা ভিডিও ছেড়ে বেলাকে দেখাতে দেখাতে বললো,

---"দেখ বেলা, আমাদের কুমিল্লার নতুন এমপি। আদ্র ইয়ানিদ। সুন্দর না দেখতে?"


বেলা শান্ত নেত্রে তাকালো। ফোনের স্ক্রীনে ঘর্মাক্ত আদ্রকে দেখা যাচ্ছে। চোখ-মুখ কুঁচকে ভাষণ দিচ্ছে সে। রোদে জ্বলজ্বল করছে মুখশ্রী। বরাবরের মতোই কঠিন তার কণ্ঠের তেজ, গা শিরশির করে কাঁপিয়ে তোলার মতো। বেলা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। রুপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলতেই রইলো,

---"উনাকে যে আমার কি ভালো লাগে! উনার একটা ভাইও আছে জানিস? আয়াজ মেহেরাব। একদম ওনার মতো দেখতে। টুইনস ওরা।"

বেলা আড়চোখে আরও একবার ভিডিওটির দিকে তাকালো। স্বাভাবিক স্বরে বললো,

---"জানি। উনারা আমাদের এলাকাতেই থাকেন।"


কথাটা রুপার কানে প্রবল ঝংকার তুললেও তা বিশেষ আমলে নিতে পারলো না সে। বিশ্বাস করলো না। মাছি তাড়ানোর মতো করে বললো, "ধুর! মিথ্যা বলছিস কেন?"


মনে মনে প্রশান্তির নিশ্বাস ফেললো বেলা। মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেছিল সে। ভাগ্যিস রুপা বিশ্বাস করেনি। নয়তো এ খবর পুরো ভার্সিটিতে রটিয়ে ছাড়তো সে।


-


ভার্সিটির পেছনের পিচঢালা রাস্তায় কালো গাড়িটি দাঁড় করানো। নির্জন জায়গা। ড্রাইভার আর আকিবকে ছাড়া কাউকে দেখতে পাচ্ছে না বেলা। আকিব বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে গাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল সে। বেলাকে দেখতে পেয়ে অল্প মুচকি হাসলো। নম্র স্বরে বললো,

---"কেমন আছেন ভাবী?"


প্রতিউত্তরে বেলাও লাজুক হেসে বললো, "ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?"

---"আছি আলহামদুলিল্লাহ। আপনার জন্যই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাই ভেতরে অপেক্ষা করছেন।"


বলে গাড়ির পেছনের সীটের দরজা খুলে দিলো আকিব। বেলা নিঃশব্দে ভেতরর গিয়ে বসতেই একদফা চমকালো। বড় মাপের ব্যস্ত নেতা তার সঙ্গে দেখা করতে এসে আরাম করে সীটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার নিশ্বাসের থেকে থেকে চলাচল বেলা তীব্র ভাবে শুনতে পারছে। এসির পাওয়ার অতিরিক্ত করে রাখা। কালো রঙের জানালার কাঁচগুলো উঠানো। বাহিরের কেউ ভেতরটা দেখার জো নেই। একহাত কপালে রেখে ঘুমাচ্ছে লোকটা। গায়ে ভিডিওর সেই সাদা পাঞ্চাবী। বুকের প্রথম তিনটে বোতাম খোলা। লোমশ বক্ষস্থল ক্ষীণ দৃশ্যমান। ঘাড় বেয়ে ঘামের সূক্ষ্ণ রেখা স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। 

বেলা হাঁসফাঁস করলো। কি করবে বুঝতে পারছে না। লোকটা কি উঠবে না? বাহিরে তাকিয়ে সবাইকে একবার পরখ করে নিলো সে। আকিব আর ড্রাইভার দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। বেলা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ইতস্তত হাতে আদ্রর চওড়া কাঁধে আলতো ধাক্কা দিলো। মৃদু স্বরে ডাকলো,

---"আদ্র। শুনছেন? আদ্র?"


আদ্র অল্প নড়েচড়ে উঠলো। তন্দ্রা কেটে গেল নিমিষেই। কপাল থেকে হাত সরালো। চোখ মেলল ধীরস্থির ভাবে। প্রচন্ড বাঁকানো ভ্রুযুগল নিয়ে কিছুক্ষণ গাঢ় নেত্রে চেয়ে রইলো অবুজ প্রেয়সীর দিকে। মুখশ্রী জুড়ে একরাশ ঘুমু ঘুমু ভাব তার। ভীষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে সে খুব গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,

---"কখন এসেছো?"


বেলা আড়চোখে সুদর্শন পুরুষটির দিকে একপলক তাকালো। জবাবে ছোট্ট করে বললো, "কিছুক্ষণ আগে।"


দু'হাতে চোখ কচলে ঠিক হয়ে বসলো আদ্র। বাহিরে দৃষ্টি ফেলে কি যেন দেখল। অনুমতি ছাড়াই বেলার ওড়নার একাংশ টেনে ঘর্মাক্ত ঘাড় মুছলো। গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়লো, 

---"ইমরান! এদিকে আসো।"


সঙ্গে সঙ্গে আকিব আর ড্রাইভার এগিয়ে এলো। আদ্রর দিকে উৎসুক চোখে চাইতেই সে বললো,

---"বাসায় যাবো। গাড়ি ছাড়ো।"

ড্রাইভার মাথা ঝাঁকালো। গাড়িতে বসে পরলো বিনা বাক্য ব্যয়ে। আকিব তখন জানালায় ক্ষীণ উঁকি মেরে বললো,

---"আমি তবে চলে যাচ্ছি ভাই? দরকার হলে ফোন করবেন। আমি আবার আসবো।"

আদ্র মুখে কিছু বললো না। হালকা মাথা কাত করলো মাত্র। 


গাড়ি চলতে শুরু করেছে। নিরবতার প্রখরতা খুব। আদ্র চুপচাপ, শব্দহীন ভাবে বেলার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি স্থির, অনড়। তীক্ষ্ণতায়, দৃঢ়তায় ভরপুর। বেলার গাল ভারী হয়ে আসছে। লজ্জায়, অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে আছে সে। এভাবে তাকানোর কি আছে? লোকটা কি বুঝতে পারছে না, তার যে খুব লজ্জা লাগছে। প্রেমিকের দৃষ্টির পিঠে সিক্ত বেলা আড়ষ্ট হচ্ছে বারবার। 

জোড়ালো গলায় বেলা বললো,

---"এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমার অস্বস্তি হচ্ছে। অন্যদিকে তাকান।"

আদ্র নিমগ্ন স্বরে উত্তর দিলো, "তুমি মিথ্যে বলছো বেলা। তোমার অস্বস্থি হচ্ছে না। একদমই হচ্ছে না।"

---"আপনার ধারণা ভুল। অন্যদিকে তাকান।"


আদ্র শুনলো না। দূর্বোধ্য হাসলো। বেলার লজ্জা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে শুধালো,

---"তোমাকে আজকে ভীষণ সুন্দর লাগছে বেলা।"


লজ্জায় সে আর কথাই বলতে পারলো না। তাকালোও না। আদ্র আবারও সীটে হেলান দিয়ে শুয়ে পরলো। চোখ বুজলো। হতাশ কণ্ঠে বললো,

---"তোমাকে শাড়ি পরিয়ে আমার রুমে বসিয়ে রাখার ইচ্ছেটা মাথা চড়া দিয়ে উঠছে বেলা। তোমাকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা বাজেভাবে আহত করছে। তুমি একটু বাজে হতে পারলে না? এত সুন্দর হতে কে বলেছিল তোমায়?"


প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেলো বেলা। পরক্ষণেই ড্রাইভারের কথা মস্তিষ্কে হানা দিতেই রেগে তাকালো সে। ঝাঁঝালো কণ্ঠের রেশ ধরে বিশাল নেত্রে পলক ঝাপটালো। বললো,

---"সমস্যা কি আপনার? ড্রাইভার সামনে না?"

আদ্র ঠাট্টার সুরে ড্রাইভারকে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করলো,

---"আমার কথা কি তুমি কিছু শুনেছো ইমরান?"

সে মিটিমিটি হেসে মাথা দুলালো, "না ভাই।"

আদ্র জয়ের হাসি এঁটে বেলাকে বললো, "দেখেছো? শুনেনি।"


-


সময় গড়ালো। গাড়ি থামলো এলাকা থেকে বেশ অনেকটা দূরে। গাছের আড়াল করে। বেলা ধীর পায়ে নেমে পরলো। আদ্রর দিকে একবার চেয়ে চলে যেতে নিলেই তার হাত শক্ত করে ধরে ফেললো আদ্র। কোত্থেকে গোলাপের একটা তোড়া বের করে ধরিয়ে দিলো তার হাতে। বেলা অবাক চোখে তাকালো। কিছু বলার পূর্বেই আদ্র কেমন অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠলো,

---"কথা দিচ্ছি বেলা, গোলাপগুলোর পাঁপড়ি পরে যাওয়ার আগেই তোমাকে আমার ঘরে তুলবো।"


_______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ২৩

 প্রিয় বেলা


২৩.

সকালটা যতটা কাঠফাটা রোদে মুখরিত ছিল, রাত্রির ক্ষণটা ঠিক ততটাই বরফ শীতল লাগলো বেলার। বিছানার সঙ্গে মিশে গিয়ে গলা অব্দি ব্ল্যাংকেট টেনে রেখেছে সে। ফ্যান বন্ধ। জানালা গলিয়ে সুরসুর করে ঠান্ডা বাতাস আসা যাওয়া করছে। শীত লাগছে খুব। দাঁতে দাঁত লেগে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে। আলসেমি ছুটিয়ে বেলা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ঠান্ডার দরুণ ক্ষতস্থানগুলো আরও বেশি টনটন করছে। ডান পায়ের গোড়ালি বাজেভাবে কেটে গিয়েছিল। ক্ষীণ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। জানালা লাগানোর পূর্বে একবার বারান্দার ওপাশটায় দৃষ্টি বুলালো বেলা। অবুজ মন আদ্রকে দেখবার জন্য তৃষ্ণাতুর হয়েছিল বোধহয়। তবে আদ্র নেই সেখানে। আশাহত হয়ে জানালা বন্ধ করে দিলো সে। পর্দা টেনে দিলো। বিছানায় শুলেও এবার আর তন্দ্রা এসে ধরা দিচ্ছে না। লোকটা তার সঙ্গে সেই কাল বিকালে দেখা করতে এসেছিল। তারপর আর বিন্দুমাত্র খোঁজখবর নেয়নি। হাসপাতাল থেকে চলে আসার পরও না। ওই যে, ড্রেসিংটেবিলের ওপর আদ্রর দেওয়া কালকের চুড়িগুলো পরে আছে। অন্ধকারেও স্পষ্ট ভাবে দেখতে পারছে বেলা।

বেলার মন নিমিষেই বিষণ্ণতায় তিক্ত হয়ে উঠলো। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো না। কিছুক্ষণ এমনিই গুটিশুটি হয়ে বসে রইলো সে। চেনা ঘরটা দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল। উঠে দাঁড়িয়ে এবার সোজা বারান্দায় চলে গেল বেলা। হিম করা দমকা হাওয়া ছুঁতেই গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। শিরশির করে উঠলো গালযুগল। চাদরখানা শরীরের সঙ্গে ভালো ভাবে আষ্টেপৃষ্টে নিলো। আদ্রর বারান্দার দিকে তাকালো আরও একবার। লোকটার দেখা এখনো পেল না। আদ্র কি তবে বাসায় আসেনি? বিষণ্ণতা বাড়লো। কাঠের চেয়ারটাতে নিঃশব্দে বসে পরলো বেলা। বিস্তৃত নভস্থলে অন্যমনস্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই পাশ থেকে কাঙ্ক্ষিত ডাকটা শুনতে পেল সে, 

---"বেলা।"


বেলা চমকিত হলো। কালবিলম্ব না করে চমকানো দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকালো। আদ্র থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। গাঢ় চাহনি বেলার মুখপানে স্থির। একদিনেই লোকটাকে কেমন মলিন দেখাচ্ছে। উজ্জ্বল গৌর বর্ণের ত্বক প্রতিদিনের চেয়ে একটু বেশিই জ্বলজ্বল করছে যেন। নেত্রকোণের কাটা দাগটা সুস্পষ্ট। পরনে টি-শার্ট, ট্রাউজার। 

আদ্র এগিয়ে এলো। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। কঠোর গলায় প্রশ্ন করলো,

---"তুমি না অসুস্থ? না ঘুমিয়ে এখানে কি করছো?"


বেলা এলোমেলো ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকালো। মৃদু স্বরে বললো,

---"ঘুম আসছিল না।"

---"কেন আসছিল না?"

বেলার আমতা আমতা কণ্ঠস্বর, "জানি না।"


আদ্র আর কিছু বললো না। নিভৃতে চেয়ে রইলো প্রেয়সীর পানে। দীর্ঘক্ষণ, অনিমেষ, পলকহীন। কালো কুচকুচে মণিজোড়ায় কেমন অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো তখন। নিষ্প্রাণ স্বরে সে দৃঢ়তা নিয়ে বললো, "তুমি কাছে থাকলে তোমাকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে বেলা। বুকের ভেতর চেপে ধরতে ইচ্ছে করে। তুমি আমার সামনে এসো না তো। নিষিদ্ধ জিনিসে ঝোঁক বাড়ছে আমার। যাও, ঘুমাতে যাও। আমি এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াবো।"


বেলা গেল না। হতবিহ্বল হলো। অবাক চোখে এই অচেনা আদ্রকে দেখতে লাগলো। চোখ-মুখে দারুণ মেজাজ নিয়ে রেখেছে লোকটা। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। তাকাচ্ছে না। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেঁজালো বেলা। অবিন্যস্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো,

---"কিছু কি হয়েছে? এভাবে কথা বলছেন কেন?"


আদ্র প্রথমেই জবান দিলো না। স্বাভাবিক হওয়ার প্রয়াস চালালো। ল্যাম্পপোস্টের বাতিটি ঝিরঝির করছে। একবার বন্ধ হচ্ছে, একবার জ্বলছে। রাস্তায় গাঢ় আঁধার স্থির হতে পারছে না। সেদিকে চেয়েই শান্ত গলায় আদ্র উত্তর দিলো,

---"কিছু হয়নি।"

তারপর একটু থেমে আবারও ঢিমে যাওয়া স্বরে প্রশ্ন করলো, "তোমার কি মনে হয় বেলা, আমি কি সত্যিই তোমার অযোগ্য? তোমাকে কি শুধুই কষ্ট দেই?"


বেলার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পরলো। আশ্চর্য কণ্ঠে বললো, "হঠাৎ এসব কথা কেন বলছেন?"

আদ্র থেমে নেই। শাহাদাত আঙুল উঁচিয়ে বাড়ির উঠানে তাক করলো। আগের মতোই বলতে লাগলো,

---"কয়েকদিন পর এখানটা গার্ডে ভরে থাকবে। আমার আপনজন কেউই পর্যাপ্ত সিকিউরিটি ছাড়া বের হতে পারবে না। স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকবে না। আমার প্রাণের নিশ্চয়তা থাকবে না। যেকোনো সময় মরে যাবো--।"


কড়া গলায় আদ্রকে থামিয়ে দিলো বেলা। আশপাশের খেয়াল করলো না। অনেকটা জোড়েই চেঁচিয়ে উঠলো,

---"চুপ করুন আদ্র। এসব কথা কেন বলছেন আমাকে? আমি শুনতে চেয়েছি আপনার কাছে?"

আদ্র হাসলো, দূর্বোধ্য ভাবে। ভাষাহীন নেত্রে তাকালো। নড়বড়ে দৃষ্টি বেলার মুখশ্রীতে একটু একটু করে ঘুরছে। তার আতঙ্কিত ভাবটা নজরে এতেই আদ্র আরেকদফা হাসলো। শুধালো,

---"আমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বেলা। এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতে কি তুমি জড়াতে চাও?"


নিষ্ঠুর জলরাশিগুলো ভীর জমালো। বক্ষস্থলের ধুকধুক ধ্বনির গতি প্রচন্ডভাবে বেড়ে গেল। মাথা হঠাৎ করেই যন্ত্রণা করছে। থেকে থেকে, অকপটে বেলা স্বীকারোক্তি করলো,

---"চাই।"


আদ্র নিগূঢ়ভাবে চাইলো। শান্ত হলো সবার্ঙ্গ। প্রতিউত্তরে সে স্বাভাবিক স্বরে বললো, "রুমে যাও। ঠান্ডায় কাঁপছো তুমি। ঘুমাও, যাও।"

বেলা একদমই গেল না। গলার জোড় বাড়িয়ে দিলো, "আমি আপনারই প্রিয় বেলা হবো আদ্র।"


আদ্র মুচকি হাসলো। সুদীর্ঘ, বিস্তর হাসি। উত্তর দিলো, "জানি।"


-


টিভির সব খবরে নেতা আদ্র ইয়ানিদকে দেখাচ্ছে। একশতরও অধিক ভোটে বিজয়ী হয়েছে সে। আনন্দে মেতে উঠেছে পুরো দল। বাদ্যযন্ত্র বাজছে। গান চলছে সর্বোচ্চ আওয়াজে। আদ্র বেশিক্ষণ সেখানে থাকলো না। মন টিকলো না তার। আকিবকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। আকিব মন খারাপ করে বললো তখন,

---"এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন কেন ভাই? আপনার এত বড় জয় হলো, একটু আনন্দ করতেন।"


আদ্র ঘাড় এদিক ওদিক নাড়িয়ে সীটে হেলান দিয়ে বসলো। পকেট থেকে ফোন বের করলো। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

---"আমার সব আনন্দ তো তোমার ভাবীর মাঝেই আটকে আছে আকিব।"

আকিব হাসলো,

---"তা ঠিক বলেছেন ভাই। গাড়ি কি এখন ভাবীর ভার্সিটির ওখানে নিয়ে যেতে বলবো?"

---"না। ফুলের দোকানে চলো আগে। কিছু গোলাপ কিনবো।"


কি ভেবে মিটিমিটি হেসে ফেললো আকিব। একটু শব্দ করেই। আদ্র ভ্রু কুঁঞ্চিত করে তাকাতেই বহুকষ্টে থামালো তা। ড্রাইভারকে ফুলের দোকানে নিয়ে যেতে বললো।

আদ্র ফোনের কী-বোর্ডে অনবরত চাপ দিয়ে বেলাকে বার্তা পাঠালো তখন, "বড় মাপের একজন নেতা আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছে বেলা। তৈরি থাকুন।"


______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ২২

 প্রিয় বেলা


২২.

সময় গড়াচ্ছে। রাত্রি গভীর। নিস্তব্ধ পরিবেশে মানুষের হাঁটার ধপধপ শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। থমথমে হয়ে আছে আশপাশ। বিছানার একপাশে বিহানকে আগলে রেখাও দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। প্রভা বেগম খুব করে আগলে রাখছেন মেয়েকে। পরম স্নেহে, মমতায় বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছেন। বেলাও চুপ করে লেপ্টে আছে মায়ের বক্ষস্থলে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। মায়েদের শরীরে কেমন একটা 'মা' 'মা' গন্ধ থাকে। সে কাছে থাকলে ব্যথা, বেদনা, চিন্তা সব কোথায় যে উবে যায়!

আদ্র দীর্ঘক্ষণ একমনে চেয়ে রইলো বেলার শুকনো, মলিন মুখশ্রীর পানে। সন্ধ্যায় সে কিছু না বলেই ক্লাব থেকে চলে এসেছিল। পরে আর সেখানকার খবর নেওয়া হয়নি। পকেট হাতড়ে ফোন বের করলো সে। পাওয়ার বাটন চাপতেই ইতিমধ্যে তন্ময়ের বেশ কয়েকটা মিসডকল দেখতে পেল। লাস্টে একটা মেসেজও ছিল। আদ্র আর দেড়ি করতে চাইলো না। বেলার সঙ্গে তো সবাই আছেই। ফোন ঢুকিয়ে চলে যাওয়ার জন্য টুল ছেড়ে ওঠার পূর্বেই সায়েদ সাহেদ ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। আদ্রর সামমাসামনি দাঁড়ালেন। খুব শান্ত ভাবে স্নেহের সঙ্গে বললেন,

---"তোমাকে আমি কিভাবে যে ধন্যবাদ জানাই বাবা। পরপর দু'টো বড় বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছ আমাদের। আজকে যদি তুমি আসার পথে আমার মেয়েটাকে না দেখতে, ও বোধহয় এখনো ওভাবেই রাস্তায় পরে থাকতো। তুমি আমাদের ঋণী করে তুললে বাবা।"


আদ্র একটু হাসার চেষ্টা করলো। নির্দ্বিধায় বললো,

---"এভাবে বলতে হবে না আঙ্কেল। এটা আমার দায়িত্বের মাঝেই পরে।"

তিনিও প্রতিউত্তরে প্রফুল্ল হাসলেন। কিছু একটা ভেবে আবারও বলে উঠলেন,

---"তুমি তো মনে হয় কিছু খাওনি এখনো। খাবে না? দাঁড়াও, আমি কিছু নিয়ে আসছি তোমার জন্য।"

আদ্র সঙ্গে সঙ্গে দিরুক্তি করলো, "তার প্রয়োজন নেই আঙ্কেল। আমি একটু বের হবো এখন। তখন খাওয়া যাবে। আপনাদের কিছু লাগলে আয়াজকে বলবেন। ও আর মা আজকের রাতটা এখানেই থাকবে।"


সায়েদ সাহেব কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বলতে পারলেন না। আদ্র একপলক বেলার দিকে দৃষ্টি ফেলে বেরিয়ে পরলো কেবিন থেকে।


-


বিকাল ৪টা বাজছে। বিছানায় বসে বসে বিশাল জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে বেলা। কাল থেকে এখন অব্দি একাধারে শুয়ে বসে থাকতে বিতৃষ্ণা চলে এসেছে খুব। আজকেই বাসায় চলে যেতে চেয়েছিল সে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে নাকি ডিসচার্জ দেবে না। কালকে ছাড়া বাসায় যেতে পারবে না সে।

কেবিনের ভেতর এখন শুধু বেলাই একা। সায়েদ সাহেব এখান থেকেই অফিসে চলে গেছেন। বিহান স্কুলে। আরু বাসায় একা থাকায় রেখাকে সকালেই দিয়ে এসেছে আয়াজ। এখন আবার প্রভা বেগমকে কোথায় যেন নিয়ে চলে গেছে। অনেকটা জোড় করেই। বেলা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে শুধু। মানা করেনি। কিন্তু এখন বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। ক্ষীণ চিনচিন করছে ক্ষতস্থান। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতগুলো চুলকাতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু তা করার সাহস নেই। পাছে আবার ব্যথা পেলে? রক্ত বের হলে? হঠাৎ খট শব্দে কেবিনের দরজা খুলে গেল। বেলা তাকালো না সেদিকে। একটু অভিমানী সুরে বললো,

---"এতক্ষণে আসার সময় হলো তোমার মা?"


ওপাশ থেকে সারাশব্দ এলো না। বেলা দৃষ্টি ঘোরালো। সামনে তাকাতেই আদ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষণ ভাবে চমকালো সে। হকচকিয়ে, অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো, "আপনি এখানে?"

আদ্র মুচকি হাসলো। উত্তর দিলো না। ধীরস্থির পায়ে এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসলো। কোনো কথা ছাড়াই কপালে, গালে হাত ছোঁয়ালো। ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন ছুঁড়লো, "জ্বর সেড়েছে কখন?"

বেলা মৃদু কণ্ঠে উত্তর দিলো, "সকালে।"


আদ্র সরে এলো। হাতে থাকা বড়সড় প্যাকেট থেকে অনেকগুলো লাল চুড়ি বের করলো। বেলার কাছে অনুমতি চাইলো,

---"তোমার হাতটা একটু দাও তো বেলা।"


বেলা শুনলো না যেন। হাত বাড়ালো না। চোখে বিস্ময় নিয়ে পলক ঝাপটালো পরপর দু,তিনবার। জিজ্ঞেস করলো, 

---"এতগুলো চুড়ি এনেছেন কেন?"

আদ্র ততক্ষণে বেলার হাত টেনে নিয়েছে। খুব সাবধানে, স্বযত্নে একটা একটা করে চুড়ি পরিয়ে দিচ্ছে তাকে। অকপটে, নিঃসঙ্কোচ ভাবেই বললো,

---"তোমার চুড়িগুলো ভেঙ্গে গিয়েছিল না? তাই নতুন এনেছি।"

বেলা রোষপূর্ণ হয়ে বললো,

---"আমার কাছে তো আরও অনেকগুলো চুড়ি ছিল। আপনি শুধু শুধু এখন আবার আনতে গেলেন কেন? তাছাড়া মা যদি এখন আমার হাতে চুড়ি দেখে তখন কি বলবো আমি?"


আদ্রর মাঝে বিশেষ পরিবর্তন দেখা গেল না। ভ্রুক্ষেপহীন সে। চুড়ি পড়ানো শেষ হতেই বেলা হাত টেনে নিলো। হাত নাড়াতে এখন অত অসুবিধে হচ্ছে না। চুড়িগুলো খুলে ফেলতে চাইলেই কঠিন গলায় ধমকে উঠলো আদ্র,

---"খবরদার বেলা! আমি চলে না যাওয়া অব্দি চুড়িগুলো তোমার হাত থেকে খুলবে না।"


বেলা আর খুলতে পারলো না। জড়োসড়ো হয়ে মাথা নুয়ালো। মিনমিন করে অভিযোগ করলো,

---"আমি অসুস্থ না? বকছেন কেন?"

আদ্র শুনলো। কিছুক্ষণ চুপ করে নিঃশব্দে তার অবুজ প্রেমিকাকে দেখল। তারপর হঠাৎ-ই হেসে দিলো সশব্দে। এগিয়ে এসে অধর ছোঁয়ালো প্রিয়তমার স্নিগ্ধ ললাটে। বেশ ক্ষণ লাগিয়ে, খুব সময় নিয়ে ওভাবেই রইলো। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ণ হাসির অস্তিত্ব বজার রেখে কোমলস্বরে বললো,

---"আচ্ছা। এখন বকবো না। তুমি সুস্থ হলে তারপর বকবো। ঠিকাছে?"


-


বাসায় ফিরে ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিলো আদ্র। এসির পাওয়ার বাড়ালো। চোখ বুজে উঁচু গলায় ডাকলো,

---"মা? ঠান্ডা পানি আনো।"


ডাকার দু'মিনিটের মাথায় পানি নিয়ে এলেন রেখা। ছেলের পাশে বসলেন। গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন, "নেয়।"

আদ্র নিলো। এক নিশ্বাসে পুরো পানি পান করে গ্লাস রেখে দিলো টেবিলে। রিমোটে আঙুলের একেকটা চাপ প্রয়োগে খবরের চ্যানেলগুলো পাল্টাতে লাগলো সে। রেখা হাঁসফাঁস করছেন। প্রবল জড়তা কাজ করছে মনে। একবার টিভির দিকে তাকিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন আবার। জিজ্ঞেস করলেন,

---"বেলার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলি আদ্র?"

আদ্রর কপালে ভাঁজ পরলো। ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল। সন্দিহান কণ্ঠে বললো, "হ্যাঁ। তুমি জানলে কিভাবে?"


রেখা একটু থেমে থেমে বললেন,

---"আয়াজ বললো।"

বলে ক্ষীণ থামলেন তিনি। জড়তায় কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। এরপর হঠাৎই এক উদ্ভট প্রশ্ন করে বসলেন,

---"তুই কি বেলাকে পছন্দ করিস আদ্র?"


আদ্রর সময় লাগলো কথা বুঝতে। তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারলো না। রেখা আবারও বলে উঠলেন,

---"দেখ, মিথ্যা বলবি না। আমার কেন যেন মনে হয়, তুই বেলাকে পছন্দ করিস। অনতত তোর আচরণে আমি সেটাই বুঝেছি। তুই কি সত্যিই পছন্দ করিস ওকে?"


বিমূঢ়তা কাটিয়ে নির্বিকার স্বরে আদ্র উত্তর দিলো, "হ্যাঁ, করি।"

রেখার ভেতরটা হাজার হাজার পাথরে ডেবে গেল যেন। বুক ভারী হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব কঠিন স্বরে তিনি বলতে লাগলেন,

---"পছন্দ করিস ঠিকাছে। আর বেশি এগোবি না। এখানেই থেমে যা।"

এতক্ষণে টিভি থেকে চোখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো আদ্র। চোখ-মুখ বিকৃত হলো। বিরক্তিতে তিক্ত হলো মেজাজ। 

---"তুমি কি বলছো বুঝেশুনে বলছো মা?"

রেখা আগের মতোই বললেন,

---"আমি বুঝেশুনেই বলছি। তোর মতো একটা ছেলের সঙ্গে জড়ালে মেয়েটা কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাবে না। যেমনটা তোর বাবার বেলায় আমি পেয়েছি। মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ আদ্র। আমি ইচ্ছে করে তো মেয়েটাকে কষ্টের পথে ঠেলে দিতে পারিনা।"


আদ্র শক্ত চোয়ালে তাকিয়ে রয়। কিচ্ছুটি বলে না। চোখে ভীর জমায় লাল লাল শিরাগুলো। রেখা এবার খুব করে অনুরোধের সুরে বলেন,

---"বেলা থেকে সরে আয় আদ্র। মেয়েটাকে একলা ছেড়ে দেয়।"


আদ্র প্রথমেই উত্তর দেয় না। সময় নেয়। রাগী সত্ত্বাটি স্বাভাবিক হতেই ভীষণ শান্ত স্বরে বলে, "এমন আবদার করো না মা, যা পূরণ করার সাধ্যি আমার নেই।"


_______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা 


[এলোমেলো হয়েছে কি? আমি পর্বটা একদমই গুছাতে পারছিলাম না। ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ।]