গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ২১

 প্রিয় বেলা


২১.

বেলা ঘুমাচ্ছে। অবাধ্য চুলগুলো বাতাসের ঝাপটায় এলোমেলো হচ্ছে বারবার। হাত বাড়িয়ে তা কানের পেছনে গুঁজে দিলো আদ্র। আলতো করে বেলার মাথা বুকের মধ্যিখানে টেনে নিলো। শীতল আবহাওয়ায় একটুখানি উষ্ণ আলিঙ্গন পেয়ে নড়েচড়ে উঠলো বেলা। ঘনিষ্ট হলো। দূর্বল হাতে আদ্রর কোমড় জড়িয়ে বুকে গুটিয়ে গেল। তা দেখে দূর্বোধ্য হাসলো সে। কপালের সাদা ব্যান্ডেজের একপাশে দীর্ঘক্ষণ অধর ছুঁইয়ে রইলো। মোটা লম্বা করে একজন মহিলা ডাক্তার এগিয়ে এলেন তখন। ওদের দেখে মিষ্টি করে হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

---"উনি কি আপনার ওয়াইফ হন মিস্টার আদ্র?"


অধিক পাওয়ারি ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে বেলাকে। জোড়েসোড়ে হট্টগোল হলেও সে সহজে আর ঘুম থেকে উঠবে না। তবুও প্রেমিক পুরুষের এ নিয়ে বড্ড আশঙ্কা। ক্ষণে ক্ষণে আশপাশের কোলাহলে বিরক্ত হচ্ছে সে। প্রিয়তমার ঘুমে যদি ব্যাঘাত ঘটে? ঘুম থেকে উঠলেই তো ব্যথায় কাঁদবে মেয়েটা। ঘুমানোর আগেও কাঁদছিল। ঔষধ খেতে চাইছিল না। তিতা লাগে বলে। আদ্রর বুক ভারী হয়ে আসে। মেয়েটার এইটুকু কষ্ট তার সহ্য হয় না। বুকের চিনচিনে ব্যথায় নিজেরই অসহ্য লাগে।

মহিলা ডাক্তারটির দিকে না তাকিয়েই আদ্র রোষপূর্ণ গলায় বললো,

---"আস্তে কথা বলুন। ও উঠে যাবে।"


উনার ঠোঁট থেকে যেন হাসি সরছেই না। আগের থেকে এবার একটু ধীর গলায় বললেন,

---"ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে উনাকে। এত সহজে উঠবেন না।"

তারপর একটু থেমে আবার বললেন, "আপনি কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।"


ডাক্তারের দিকে একপলক তাকালো আদ্র। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো তৎক্ষণাৎ। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,

---"না, হবে। আপনি কি আমাকে চেনেন?"

---"আপনাকে কে চেনে না আদ্র ইয়ানিদ? টিভিতে অনেকবার দেখেছি। ইভেন আমার পরিবারও আপনাকেই ভোট দেবে বলে ভেবে রেখেছে। ভীষণ পছন্দ করে সবাই আপনাকে।"


আদ্র উত্তর দিলো না সেকথার। বেলা শীতে কাঁপছে। গা গরম লাগছে। জ্বর এলো নাকি? উদ্বিগ্ন হয়ে সে বললো,

---"ওর জ্বর আসছে কেন? দেখুন তো।"

ডাক্তার বেলার কপালের তাপমাত্রা চেক করলেন। বললেন,

---"ব্যথার কারণে জ্বর এসেছে। চলে যাবে। চিন্তার কিছু নেই।"


আদ্রর ভেতরটায় তবুও স্বস্তি এসে হানা দিলো না। নেতিয়ে পরা বেলাকে একহাতে সামলে প্রশ্ন করলো, "আমি কেবিন রেডি করতে বলেছিলাম আপনাদের। করেছেন?"

---"হ্যাঁ। আমি নার্সদের ডাকছি। ওরা হুইলচেয়ার নিয়ে আসবে।"


আদ্র কথা বাড়ালো না। চট করে কোলে তুলে নিলো বেলাকে। আদুরে ভাবে। খুব সাবধানে। সুপ্ত অধিকারবোধ নিয়ে। গম্ভীর স্বরে বললো,

---"তার প্রয়োজন নেই। আমি ওকে নিয়ে যেতে পারবো। কেবিনটা কোন দিকে?"


মহিলা ডাক্তারটি ক্ষীণ সময়ের জন্য হকচকালেন, ভড়কে গেলেন। পরক্ষণেই হেসে দিলেন তিনি। এমন বিশুদ্ধ, অকৃত্রিম ভালোবাসা নিজের ছত্রিশ বসন্তে খুব কমই দেখেছেন।


-


বাহিরে বৃষ্টি আর নেই। রাস্তা, গাছপালা সব পানির সংস্পর্শে এসে স্নিগ্ধ হয়ে আছে। নভস্থলে গাঢ় নিকষকৃষ্ণ। কেবিনের জানালা বন্ধ। তবুও যানবাহনের কড়া হর্ণের শব্দ কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে। বেলার তন্দ্রা কেটে গেল। চোখ মেলতেই তীব্র আলোর ঝলকে আবারও চোখ বুজলো সে। মাথাটা ভারী, ভারী লাগছে। শরীরে ক্ষীণ চিনচিনে ব্যথা বিরাজমান। হাতের ওপর ভারী কিছুর অস্তিত্ব টের পেল সে। ধীরস্থির ভাবে, সময় লাগিয়ে চোখ মেললো আবার। আদ্রর শার্ট শুকিয়ে গেছে। ঝাঁকড়া মাথার চুলগুলো আধভেঁজা। শুষ্ক ঠোঁটযুগল। বেলার ক্ষতহীন হাতটা ধরে কপাল ঠেকিয়ে আছে। নেত্রজোড়ার পাতা লাগানো। বেলার হঠাৎই পিপাসা পেল খুব। আধো আধো কণ্ঠস্বরে আদ্রকে ডাকলো,

---"আদ্র? আপনি কি ঘুমিয়ে গেছেন?"


এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ডের মাথায় মাথা তুলে তাকালো আদ্র। শরীর যেন অল্প দুলে উঠলো তার। ক্লান্ত দেখাচ্ছে খুব। চোখের শিরা-উপশিরা রক্তিম হয়ে আছে। মুদে আসতে চাইছে শুধু। আদ্র দু'হাতে চোখ কঁচলালো। জোড় করে তাকালো। থেমে থেমে ব্যগ্র হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, "কি হয়েছে বেলা? মাথা ব্যথা করছে? কষ্ট হচ্ছে কোথাও? পানি খাবে?"


উত্তর দিতে বেশ সময় নিলো বেলা। তাকিয়ে তাকিয়ে নিজের প্রেমিক পুরুষটাকে দেখল দীর্ঘক্ষণ। লোকটা ভীষণ অধৈর্য। একটুতেই ব্যস্ত হয়ে পরে। অথচ ঠিকভাবে তাকাতেও পারছে না ঘুমে। বেলার মায়া হলো। ক্লান্ত আদ্রকে দেখে খারাপ লাগলো প্রচন্ড। ঠোঁট কামড়ে কয়েকবার পলক ঝাপটালো বেলা। মৃদু স্বরে বললো,

---"আমি ঠিক আছি। আপনি শান্ত হন।"


আদ্র শুনলো। তবে শান্ত হলো কি-না বোঝা গেল না। তার দৃঢ় নিশ্বাসের শব্দ বেলা অতদূর থেকেও শুনতে পারছে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এলো আদ্রর মুখশ্রী। 

বেলা আগের মতোই বললো,

---"আমাকে উঠে বসান। পানি খাবো।"


সে দেড়ি করলো না। বেলাকে আলতো হাতে বুকে চেপে বালিশ ঠিক করলো। বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসিয়ে দিলো খুব সতর্কতার সঙ্গে। ভরা পানির গ্লাসটা বেলার অধরের নিকট ধরলো। অন্যহাত মেলে রাখলো তার থুতনির কাছে। বেলা বেশি পানি পান করতে পারলো না। চুকচুক করে অর্ধেক পানি পান করার চেয়ে ফেলেই দিলো বেশি। আদ্র বিরক্তহীন ভাবে গ্লাসটা নামিয়ে রাখলো। তার পুরুষালি শকপোক্ত হাতটা নমনীয় ভাবে বেলার ঠোঁটের আশপাশে থাকা পানি মুছে দিলো। কোমলস্বরে শুধাল, "আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? খাবে?"


বেলা মাথা দুলালো। অর্থ্যাৎ, খাবে না। আদ্র আবার কিছু বলবে, তার পূর্বেই বড়সড় থাক্কায় কেবিনের দরজা ঠেলে কে যেন ভেতরে প্রবেশ করলো। বেলা কেঁপে উঠলো। ভীতু চোখে তাকালো। হন্তদন্ত, এলোমেলো চুলে উদ্ভট পোশাক পরে আয়াজ দাঁড়িয়ে আছে। টি-শার্টের একটা হাতা ছেঁড়া। আদ্র ভ্রু কুঞ্চিত করে সরু চোখে তাকালো। দৃষ্টিতে প্রখর তীক্ষতা, দৃঢ়তা। আশ্চর্য ভাব কাটিয়ে থমথমে গলায় প্রশ্ন করলো,

---"তোর এমন পাগলের মতো অবস্থা কেন? আমি তো সবাইকে নিয়ে আসতে বলেছিলাম তোকে। বাকি সবাই কই?"


আয়াজ তখন দ্রুত পদে বেলার পায়ের কাছটায় বসলো। জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিলো। হড়বড় করে বললো,

---"ওরা নিচে। আমি আগেভাগে মিলখা হয়ে আসছি। তুই যে কেমন নির্লজ্জ, তা তো আমার জানা। ভাবীকে ছেঁড়ে এবার একটু দূরে গিয়ে বস তো। তোদের এই স্বাধীন প্রেম দেখে আমার মনে বিরহ সৃষ্টি হচ্ছে। শান্তি মতো প্রেমও করতে পারছি না চৈতির সঙ্গে।"


আদ্রর কোনোরুপ হেলদোল দেখা গেল না। সে তার মতোই বেলার এলোমেলো চুলগুলো প্রথমে ঠিক করে দিলো। কাঁথা ভালোভাবে টেনে দিলো। তারপর ধীরে ধীরে একটু দূরত্বে গিয়ে বসলো।

আয়াজ বেলার দিকে তাকিয়ে হাসলো এবার। ক্ষীণ হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো,

---"এখন কেমন আছো ভাবী?"


আয়াজ আজ হঠাৎ করেই বেলাকে ভাবী বলে সম্মোধন করছে। ব্যাপারটায় ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে বেলা। মাথা নুইয়ে সে মৃদু স্বরে উত্তর দিলো, "আগের চেয়ে অনেকটা ভালো আছি ভাইয়া।"


আয়াজ মিটিমিটি হাসলো শুধু। আদ্রকে বললো, "ভাই আমাকে কিন্তু নতুন টি-শার্ট কিনে দিবি তুই। তোর কথায় তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে দরজার সঙ্গে লেগে আমার নতুন টি-শার্ট ছিঁড়ে গেছে। আমার প্রিয় টি-শার্ট! চৈতি দিয়েছিল।"


আদ্র প্রতিউত্তরে তেমন কিছুই বললো না। একটু পরই বাকি সবাই চলে এলেন। প্রভা বেগম এসেই ঝাপটে ধরলে মেয়েকে। কপালে স্বস্নেহে চুমু খেলেন বিরতিহীন ভাবে। মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন। কেঁদে ফেললেন তরতর করে। প্রবল শাসনের কণ্ঠে বললেন,

---"তোকে আর বাসা থেকে বের হতে দেব না আমি। কোনো টিউশন, ফিউশন করতে হবে না।"


__________________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ২০

 প্রিয় বেলা


২০.

সরকারি হাসপাতালগুলোর মতোই অতি সাধারণ এই হাসপাতালটিও। নিয়ম-কানুন বাঁধা নেই। বৃষ্টির দরুণ স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। মস্তবড় রুমগুলোয় শত শত রোগীর অবস্থান। সেই রুমগুলোর একটিতে বেলাকে দেখতে পেল আদ্র। এককোণের এক বিছানায় ঘুমিয়ে আছে সে। পরনের ভেঁজা শাড়িটি পালটে হাসপাতালের সাদা পোষাক গায়ে জড়ানো। দৃশ্যমান কপাল, থুতনি, হাত, পায়ের গোড়ালি সবটাই যেন পাষাণ ব্যান্ডেজের দখলে। ডান গালটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ব্যান্ডেজ না থাকলেও নাজুক চামড়া ছিঁলে কি করুণ দেখাচ্ছে! রক্তিম হয়ে আছে পুরো মুখশ্রী। আদ্রর নিশ্বাস আটকে আসলো যেন। স্তব্ধ হয়ে থমকে দাঁড়ালো। নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়েই রইলো সে। কঠিন্যতার আবরণ উবে গেল। বিকালের সময়টাতেও তো মেয়েটা তাকে দেখে কিভাবে লজ্জা পাচ্ছিল। সুশ্রী শাড়িতে কি চোখ ধাঁধানো সুন্দর লাগছিল তাকে। তবে এখন কি হলো মেয়েটার? এমন নির্জীব হয়ে পরে আছে কেন?

পেছনে থেকে করিম চাচা একটু রয়েসয়ে কাঁদো গলায় বললেন,

---"এতক্কন অজ্ঞান ছিল। জাগন হওয়ার ফর থেইকা ব্যতায় কানছে। যহন কইলাম তুমি আইবা, তথন এট্টু শান্ত হইছে। এট্টু আগেই ঘুমাইলো মাইয়াডা।"


আদ্র প্রতিত্তরে কিছুই বললো না। তার কঠিন দৃষ্টি বেলাতেই স্থির। চোয়াল শক্ত। হাসপাতালে আসতে গিয়ে শার্টের কাঁধের অংশটুকু বাজেভাবে ভিঁজে গেছে। এলোমেলো চুলগুলো পানিতে আরও চুপসে আছে যেন। চোখের কোণ ঘেঁষে বিন্দু বিন্দু পানি গড়াচ্ছে। করিম চাচা আবারও বলতে চাইলেন,

---"তোমার লাইগা টুল আনমু? বসবা?"


আদ্র গম্ভীর স্বরে জবাব দিলো,

---"লাগবে না। আপনার দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। আপনি বাসায় চলে যান। রিকশার যা ক্ষতি হয়েছে সব আমি কালকে দেখব।"


কৃতজ্ঞতায় নেত্রজোড়া জলে ভরে গেল উনার। আবারও কেঁদে ফেলে বললেন,

---"তুমি অনেক ভালা বাজান। বেলা মায় তাত্তাড়ি ঠিক হইয়া যাইবো। তুমি চিন্তা কইরো না।"

করিম চাচা চলে গেলেন। আদ্র আস্তে ধীরে বেলার পাশে বসলো। ব্যান্ডেজ করা হাতটা আলতো করে নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো। এতক্ষণের আটকে রাখা দূর্বলতা নিমিষেই বেরিয়ে এলো যেন। বক্ষস্থল নিদারুণ সূক্ষ্ণ যন্ত্রণায় শিরশির করে উঠলো। চোখ ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসলো। ঢিমে যাওয়া গলায় সে খুব আস্তে করে বললো,

---"আমায় ক্ষমা করবে বেলা। আমি ঠিকমতো তোমার খেয়াল রাখতে পারিনি।"


আদ্র মাথা ঝুঁকালো। হাতের পিঠে কপাল ঠেকিয়ে অনেক্ষণ চুপ করে রইলো। বেলার বিছানা থেকে মাঝারি জানালাটা কিঞ্চিত দূরে অবস্থিত। বৃষ্টির ছিঁটে না আসলেও তেজি অনলের হিম শীতল স্পর্শ ছুঁয়ে দিচ্ছে ওদের। 

আদ্রর ঝাঁকড়া মাথার চুলগুলো আরও এলোমেলো হলো। ঠান্ডায় অল্প কেঁপে উঠলো বেলা। বন্ধ চোখজোড়া পিটপিট করলো। আস্তে আস্তে চোখ মেললো সে। মাথাটা ভারী লাগছে। টনটন করছে কপালের রগ। শরীরের ক্ষতগুলো যেন নতুন উদম্যে গা জ্বালানো ব্যথায় মেতে উঠেছে। চোখে কিছু দেখতে পারছে না। সব ঝাঁপসা। আধো, আধো। কয়েক সেকেন্ড গড়ালো। ঝাপসা জিনিসগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো হঠাৎ। নিজের সামনে আদ্রকে দেখে কয়েকদফা চমকালো বেলা। কিছুপলক চেয়ে থেকে দূর্বল গলায় কোনোমতে ডাকলো, "আদ্র।"


আদ্র শুনলো না যেন। কিছুক্ষণ ওভাবেই রইলো। তারপর ছট করে মাথা তুলে তাকালো তার পানে। বেলার চোখে তখন জলরাশিরা এসে ভীর জমাচ্ছিল। কিন্তু তা গাল অব্দি পৌঁছানো দুঃসাহস করতে পারেনি। খুব কঠিন হয়ে বেলা বললো,

---"কেন এসেছেন আপনি? চলে যান।"

আদ্র আহত নয়নে তাকালো। রদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বললো, "আমি সরি বেলা। তোমার কাছে পৌঁছাতে খুব দেড়ি করে ফেলেছি।"


ওমনি দুঃসাহসি হয়ে জলগুলো গাল ছুঁয়ে দিলো। ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে ফেললো বেলা। আটকে আসা কণ্ঠে প্রবল বিতৃষ্ণার সঙ্গে অভিযোগ করে উঠলো,

---"আপনি খুব খারাপ আদ্র। সত্যিই দেড়ি করে ফেলেছেন আসতে। আরও আগে আসেননি কেন? রাস্তায় পরেছিলাম আমি। কেউ এগিয়ে আসেনি সাহায্য করতে। আমার ভেঁজা শরীরটার দিকে বিশ্রীভাবে তাকাচ্ছিল। যন্ত্রণায় আমি কাতরাচ্ছিল। মনে মনে আপনাকে খুব করে চাইছিলাম। কিন্তু আপনি আসেননি। হাসপাতালের ব্যাডে যখন ঔষধ লাগাচ্ছিল, তখন খুব জ্বলছিল ব্যথাগুলো। আমি তখনো আপনাকে নিজের পাশে চাচ্ছিলাম। আপনি তবুও আসেননি। এখন কেন এসেছেন? আপনার সহানুভূতি চাই না আমার। চলে যান। যাচ্ছেন না কেন? চলে যান এখান থেকে।"


বেদনাদায়ক করুণ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো খুব সন্তপর্ণে। বুকটা খুব ভারী ভারী লাগছে। ছেলেরা কাঁদতে পারেনা কেন? আদ্রর খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। চেষ্টা করেও পারছেনা। অসহ্য লাগছে সব। গলায় যেন কাঁটা বিঁধে আছে। আদ্র ঝুঁকে বেলার কপালে কপাল ঠেকালো। ব্যথার কারণে তাকে সরাতে পারলো না বেলা। প্রবল প্রতিবাদী হয়ে বললো,

---"সরুন আমার কাছ থেকে। ছোঁবেন না আমায়। চলে যান। আর আসবেন না। কখনো আসবেন না।"

আদ্রর ধীর গলা, "হুশশ! কথা বলবে না বেলা।"


বেলা সত্যি সত্যি চুপ হয়ে গেল। আর একটা কথাও বললো না। চোখ বুজে নিলো। আদ্রর উষ্ণ নিশ্বাস তার পুরো মুখশ্রী জুড়ে ঘুরছে। প্রচন্ড হাহাকার করছে দু'জনের ভেতরটা। 

আদ্র নিষ্প্রভ স্বরে বললো, "আমার ভেতরের তোলপাড় কি তুমি শুনতে পারছো বেলা? বিশ্বাস করো, আমি আগে জানলে কখনোই তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরাতাম না। নিরুপায় ছিলাম। তোমার কাছে তাড়াতাড়ি আসতে পারছিলাম না। জ্যামের কারণে রাস্তা পালটে এসেছি কতবার! আমার নিশ্বাসের গতি বুঝতে পারছো? কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। আমার নিজেকে অসহায় লাগছে বেলা। এতটা অসহায় আমি কখনোই হয়নি। বিশ্বাস করো, কখনো না।"


আদ্র থামলো। নিশ্বাসের গতি আরও বেড়ে গেল। বেলা তার ক্ষতবিক্ষত হাতটা আদ্রর পিঠে বহুকষ্টে রাখলো। ক্রন্দনরত হয়ে কম্পয়মান গলায় বললো,

---"আপনার জন্য আমি ঘড়ি কিনেছিলাম আদ্র। ওটা আর দিতে পারলাম না।"

আদ্র মনে মনে তখন বললো, "আমিও তো একবুক ভালোবাসা এনেছিলাম বেলা। ওটাও আর দেওয়া হলো না।"


আদ্র সরে এসেছে। বেলা উঠে বসতে চাইলো। কিন্তু হাতে ভর দিয়ে উঠে বসার ক্ষমতা নেই। তা দেখে আদ্র সচকিত হয়ে প্রশ্ন করলো,

---"কি হয়েছে? ব্যথা পাচ্ছো? ডাক্তার ডাকবো?"

বেলা মাথা নাড়ালো। অর্থ্যাৎ না।

---"তাহলে কি হয়েছে?" ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান কণ্ঠে শুধালো আদ্র।

---"উঠে বসতে পারছি না।"


মুহুর্তেই বেলার অতি নিকটে এসে কাঁধে তার মাথাটা আলতো করে রাখলো আদ্র। বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। বালিশগুলো ঠিক করে বেলাকে হেলান দিয়ে বসালো। কিন্তু নিজে সরলো না। বেলার গালে বৃদ্ধাঙ্গুল বোলালো বেশ কয়েকবার। আশেপাশের রোগী, তাদের স্বজন সবাই বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এতক্ষণ খেয়াল না করলেও এবার ভীষণ অপ্রতিভ হলো বেলা। আদ্রকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে মিনমিনিয়ে বললো,

---"সরুন।"

আদ্রর পছন্দ হলো না কথাটি। চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো সে, "মানে?"

---"সবাই আমাদের দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে। আমার অস্বস্থি হচ্ছে। সরুন।"


আদ্র দৃষ্টি ঘোরালো। সবার নজর তাদের দিকেই স্থির। কেউ অবাক হচ্ছে, কেউ মিটিমিটি হাসছে। আদ্রর ভালো লাগলো না। রাগ হলো প্রচন্ড। এভাবে তাকিয়ে দেখার কি আছে? ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সে। কেবিন নিতে হবে। এই খোলামেলা রুমটিতে বেশিক্ষণ থাকাও যাবে না। বিপক্ষদলের কেউ দেখলে সমস্যায় পরতে হবে।

রুম থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যোগী হতেই হঠাৎ হাতে টান পরলো আদ্রর। অবিন্যস্ত ভাবে তার হাতের তিনটে আঙুল ধরে রেখেছে বেলা। আদ্র তাকাতেই ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

---"আপনি কি চলে যাচ্ছেন?"

আদ্র উত্তর দিতে পারলো না। তার আগেই বেলা আবার আগের মতোই বলে উঠলো, "যাবেন না দয়া করে। এখানে একটু বসুন না। আমার একা একা থাকতে ভালো লাগে না।"


প্রেমিকার সিক্ত অনুরোধের পিঠে কথা বাড়াবার সাহস পেল না প্রেমিক। বাধ্যের ন্যায় বসে পরলো। কোমলস্বরে বললো,

---"আচ্ছা, যাচ্ছি না। এইযে হাত ধরলাম। এখানেই থাকবো।"


_______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ১৯

 প্রিয় বেলা


১৯.

তিন বান্ধবীকে নিয়ে আজ শাড়ি পরেছিল বেলা। অনেকটা সখের বসেই। ভার্সিটির ক্লাস বাঙ্ক করে মেলায় ঘুরেছে অনেক্ষণ। এরপর বিকাল গড়ালে করিম চাচাকে ঠিকানা দিতেই তিনিও চলে এলেন তাকে নিতে। বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে বেলা রিকশায় উঠে বসে। শাড়ির আঁচল সামলে কোলে গুটিয়ে রাখে। আবহাওয়া আজ বেজায় করুণ। ঘন কালো মেদুর ঢাকা পরেছে সমগ্র অন্তরীক্ষে। সকাল থেকেই বৃষ্টি আসবে আসবে ভাব। কিন্তু আসছে না। অল্পসল্প উৎকট অনল বিদ্যমান। তবে ঝড়ো বাতাস নেই। রাস্তার অন্যধারে অচেনা গাছের ডগায় কিশলয় গজিয়েছে। নতুন পাতায় ভরে গেছে গাছটা। বেলা মোবাইলের পাওয়ার বাটন চেপে সময়টা দেখে নিলো। দেড়ি হয়নি। সময় মতো টিউশনে যেতে পারবে বলে ক্ষীণ শান্তি মেললো অন্তরস্থলে। হঠাৎ কে যেন একলাফে উঠে পরলো রিকশায়। বেলা চমকিত হলো। নেত্রপল্লব বিস্তর হয়ে বড় বড় হলো বাদামী রঙা চোখের মণি। করিম চাচাও একটু ভড়কে গেলেন। রিকশা থামালেন তক্ষুণি। তড়িৎ গতিতে পেছনে তাকিয়ে অচেনা, মাক্স পরিচিত সুঠাম দেহি আদ্রকে দেখে চিনতে পারলেন না। গলায় তেজ নিয়ে খ্যাঁক করে উঠলেন,

---"এ্যাঁই, এ্যাঁই, কেহ্ আফনে? রিশকায় উটছেন ক্যান? মাইর খাওনের সখ জাগছে নাকি? নামেন রিশকা থেইকা। নামতাছেন না ক্যান?"


মাক্সের আড়ালে আদ্রর মুখাবয়ব বোঝা গেল না। তবে দৃশ্যমান চোখজোড়া অল্প বিব্রত হলো। স্বাভাবিক গলায় বললো,

---"আমি আদ্র চাচা। আপনি রিকশা চালান।"


শুনে ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। অবাক স্বরে বললেন,

---"এইডা আফনি স্যার? আমারে ডাকতে পাইরলেন না? ডাকলেই তো রিশকা থামাইতাম আমি। কি ডর পাইছিলাম জানেন?"

আদ্র হাসলো যেন,

---"আপনাকে ভয় পাওয়ানোর জন্যই এমন করেছি চাচা।"


এবার করিম চাচাও একটু হাসলেন। রিকশা ধীর গতিতে চালাতে শুরু করলেন। বেলা কথা বলছে না। তখন ভীষণ ভয় পেয়েছিল সে। বুকের বা'পাশটা এখনো ধুকধুক করছে। আশঙ্কায় জড়জড়িত মুখ। ভীতুগ্রস্ত। আদ্র মনোযোগ দিয়ে কিছুক্ষণ বেলাকে দেখল। প্রশ্ন করলো,

---"ভয় পেয়েছ বেলা?"


বেলা জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে রইলো। রিকশার হুঢ উঠানো। স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। খোলামেলা হওয়ায় ভালোও লাগছে খুব। করিম চাচা একটু ফিরে জিজ্ঞেস করলেন,

---"হুঢ-টা কি নামাই দিমু স্যার?"

---"এখন তো রোদ নেই। পরিবেশটা ভালো লাগছে। নামাতে হবে না।"


করিম চাচা মাথা দোলালেন শুধু। আদ্র নিচু হয়ে বেলার কানের কাছে ঝুঁকলো। মৃদু স্বরে আবার প্রশ্ন করলো,

---"রাগ করে আছো?" 

বেলা মলিন কণ্ঠে বললো, "না।"

---"মিথ্যা বলা শিখে গেছ তুমি।"

প্রতিউত্তরে একটু গম্ভীর হয়ে কথাটা বললো সে। 

বেলার উষ্ণ বাম হাত আঁচলের আড়ালে নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো। মেয়েটাকে শাড়িতে দারুণ লাগছে। চুলগুলো এলোমেলো খোঁপা করা। কিছু চুল আদ্রর গলায় বারি খাচ্ছে। খোঁপায় ফুল নেই। ডান হাতে অনেকগুলো চুড়ি পড়া। লাল রঙের। আদ্রর দেওয়া। তা দেখে সে অবাক হলেও বোঝার উপায় হলো না। চমকে যাওয়ার রেশ মাত্র নেই। খুশি হয়েছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। চোখের ভাষা অস্পষ্ট। এই সাধারণ বেলা থেকেই দৃষ্টি সরাতে পারছে না আদ্র। অনিমেষ, অপলক হয়ে চেয়ে আছে বেহায়া চোখজোড়া নিয়ে। অবাধ্য হতে ইচ্ছে করছে খুব। প্রচন্ড অবাধ্য হয়ে ভুল কিছু করে ফেলতে তাড়া দিচ্ছে চতুর মন। আদ্র চোখ সরিয়ে নিলো দ্রুত। মেয়েটা তাকে এমন ভাবেই বুঝি মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে? শ্বাসকার্য অস্থিরতায় অবিন্যস্ত হয়ে গেছে সেই কবে। 

বেলা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বসে ছিল। আদ্র অন্যদিকে তাকাতেই বিষাদশান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

---"আপনাকে মানা করা সত্ত্বেও ওই ছেলেকে মেরেছেন কেন?"

প্রশ্ন শুনেও ওর দিকে তাকালো না আদ্র। কপালের চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেলে নির্বিকার স্বরে উত্তর দিলো, "বেয়াদবি করছিল। তাই মেরেছি।"

বেলা বিমূঢ় হয়ে তাকালো, "কি বেয়াদবি?"

---"তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরানোর বিশ্রীরকমের বেয়াদবি।" একটু চুপ করে আবার বললো, "তবে সময়ের অভাবে চড় ছাড়া কিছু করতে পারিনি। কাল থেকে তাই শান্তি পাচ্ছি না।"


কি নিঃসঙ্কোচ অকপটে বলা কথাটি। বেলা আশ্চর্য হয়ে পিটপিট করে তাকালো। কিছু বলতে পারলো না। সময় গড়ালো। স্টুডেন্টের বাসার প্রায় কাছাকাছি চলে এলো রিকশা। আদ্র হঠাৎ শীতল গলায় বললো,

---"তুমি আর শাড়ি পরবে না বেলা।"

বেলা বুঝে উঠতে পারলো না। অবাক হলো। কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলো, "কেন?"


আদ্র কিভাবে যেন তাকালো তখন। দুজনের নেত্রজোড়া মিলিত হলো। অনুরাগ স্বরে বললো,

---"আমি বেসামাল হয়ে যাবো।"


আদ্রর ধারালো চোখের তীক্ষ্ণতা আর পুরুষালি কণ্ঠের পিঠে নেতিয়ে গেল বেলা। শাড়ি খামচে ধরলো। দৃঢ় লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে তৎক্ষণাৎ চোখ বুজলো সে।


-


ছাত্রীকে পরাতে পরাতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মেঘে মেঘে গর্জন শোনা যাচ্ছে। কি ভয়াবহ তা! রিকশায় উঠতেই আকাশটা কেঁদে উঠলো খুব জোড়ে। করিম চাচা দ্রুত তাগাদা দিয়ে বললেন,

---"তাত্তাড়ি পলিথিনডা টাইনা লও মা। নাইলে ভিঁজ্জা যাইবা।"


বেলা শুনলো। হুঢের এককোণে চেপে রাখা পলিথিন জাতীয় পর্দাটা টেনে নিজের শরীর ঢেকে নিলো। শাড়ির কুঁচিগুলো একটু ঝাঁকিয়ে অবশিষ্ট পানির রেশ কাটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। করিম চাচাকে বললো,

---"আপনিও তো ভিঁজে যাচ্ছেন চাচা। এখানে কোথাও রিকশা একটু দাঁড় করান। বৃষ্টি কমলে নাহয় যাবো।"


ইতিমধ্যে কাক ভেঁজা হয়ে গেছেন করিম চাচা। পুরাতন শার্টের পিঠের দিকটা বাজেভাবে ভিঁজে গেছে। কপাল বেয়ে পরা পানিগুলো একহাতে মুছে তিনি বললেন,

---"ভিঁজ্জা তো গেছিই মা। অভ্যাস আছে। এহন দাঁড়াইলে তোমার দেড়ি হইবো।"


বেলা আর দিরুক্তি করলো না। পর্দার ফাঁক গলিয়ে বৃষ্টির ছিঁটে আসছে। কাপড়ের হ্যান্ডব্যাগটা ভিঁজে গেছে অনেকাংশ। তা কোলে নিয়ে সাবধানে রাখলো বেলা। মেলা থেকে আদ্রর জন্য একটা ঘড়ি কিনেছিল সে। হঠাৎ-ই চোখ পরে গিয়েছিল। আদ্রর হাতে মানাবে খুব। তবে তাকে দেওয়ার সাহস হয়নি তার। ব্যাগ থেকে ঘড়িটা বের করে আলতো হাত বোলালো সে। মনে দ্বিধা কাজ করলো। ঘড়িটা কি আদ্রর পছন্দ হবে?


দৈবাৎ তেজস্বী এক সিএনজির তান্ডবীয় ধাক্কায় উপর হয়ে পরলো রিকশা। করিম চাচা রিকশা থেকে পরে গেলেন। হাতে ব্যথা পেলেন একটু। বেলা ছিটকে উঠলো। কর্কশ, অসমতল রাস্তায় ঘঁষা খেল প্রচন্ড ভাবে। হাতে, পায়ে, উন্মুক্ত কোমড়ে আঁচড় পরে গেল শতসহস্র। আদ্রর দেওয়া লাল চুড়িগুলো ভেঙ্গে গেছে কয়েকটা। হাতে বিঁধলো তা। থুতনি, কপাল ফেটে রক্ত গড়ালো। ডান গালটার বুঝি চামড়া আর নেই। ছিঁলে একাকার। শাড়ি হাঁটুর নিচ অব্দি উঠে গেছে। আঁচল সরে গেছে ক্ষীণ। চোখে ঝাপসা দেখছে। হ্যান্ডব্যাগটা যে কোথায় পরে গেল! আদ্রর জন্য কেনা ঘড়িটা বোধহয় বৃষ্টির পানিতে নষ্টই হয়ে গেছে। কমদামি তো! বেলা খুব মিলিয়ে ঝুলিয়ে কিনেছিল।


আদ্র তখন ক্লাবে। আর মাত্র ছয়দিন আছে নির্বাচনের। বেশিদিন নেই। নির্বাচনের জন্য মোটা অংকের টাকা খরচ করতে হয়েছে। আদ্র সে নিয়েই কথা বলছিল। কথার মাঝে ফোনটা বেজে উঠে তার। করিম চাচা কল দিয়েছেন। আদ্র একবার দেখে ফোনটা সাইলেন্ট করে দিলো। আবারো কল দিতেই দায়সারা ভাবে ফোন উঠালো সে। রিসিভ করে বললো,

---"আমি একটু ব্যস্ত আছি চাচা। পরে কথা বলি?"


ওপাশ থেকে তীব্র কান্না ঝংকার তুললো। হাউমাউ করে কেঁদে করিম চাচা বললেন,

---"আমারে মাফ কইরো স্যার। আমি তুমার কতা রাইখতে ফারি নাই।"

এর মাঝে তন্ময় বলতে নিলো, "ভাই, আমার মনে হয় পাশের এলাকায় বেশি--।"

হাতের ইশারায় তন্ময়কে থামিয়ে দিলো আদ্র। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ এখন ফোনে। করিম চাচা আবারো বললেন, "রিশকার পিছন দিয়া কে জানি ধাক্কা দিছিলো। আমি ব্যথা না পাইলেও বেলা মার অবস্তা ভালা না। আমি হাসপাতালো নিয়া আইছি তারে। তুমিও চইলা আসো।"


আদ্র বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। অস্থির পায়ে কাউকে কিছু না বলেই বৃষ্টির মাঝে বেড়িয়ে পরলো ক্লাব থেকে। নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললো,

---"কোন হাসপাতাল চাচা? আমি আসছি। ওকে একটু দেখুন তো। ও কি কাঁদছে? কাঁদতে মানা করবেন।"


_________________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ১৮

 প্রিয় বেলা


১৮.

আদ্রর বুকের একদম মধ্যিখানে মাথা এলিয়ে রেখেছিল বেলা। কখন যে ঘুমিয়ে গেল! গভীর তন্দ্রার মাঝেও তার এক হাত আদ্রকে জড়িয়ে রেখেছে। অবাধ্য চুলগুলো ঢেকে আছে সম্পূর্ণ মুখশ্রী। ঠান্ডা বাতাসে বারবার কেঁপে উঠছে সে। আদ্র একটু ঝুঁকে সামনের জানালা দু'টো বন্ধ করে দিলো। বেলা অল্প নড়েচড়ে উঠলো। বুকে গাল ঘঁষে আরেকটু ঘনিষ্ট হলো। আদ্র মুচকি হাসলো। গভীর, নির্নিমেষ দৃষ্টে চেয়ে রইলো অনেক্ষণ। হাত বাড়িয়ে গালে পরে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো। অধর ছোঁয়ালো কপালে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত এখন। কিছুক্ষণ পরই ন'টা বাজবে। আদ্র মৃদু স্বরে বেলাকে ডাকলো,

---"বেলা, উঠো। রাত হয়ে যাচ্ছে। বাসায় যাবে না?"


বেলা নিশ্চুপ। কিঞ্চিত ঠোঁট নড়ে উঠলো মাত্র। আদ্র স্বস্নেহে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কোমল স্বরে আবারও ডেকে উঠলো,

---"উঠবে না বেলা?"


বেলার অভিব্যক্তি শূণ্যের কোঠায়। আদ্রর সঙ্গে লেপ্টে জড়োসড়ো হয়ে আছে সে। একদম বিড়াল ছানার মতো। উষ্ণ নিশ্বাসগুলো শার্ট ভেদ করে শরীরে বিঁধছে। আদ্র ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আলতো করে বেলার ক্ষীণ বাদামী পাঁপড়িগুচ্ছে হাত ছোঁয়ালো। দায়সারা ভাবে নিষ্প্রভ স্বরে বললো, "আমি কিন্তু তোমাকে ডেকেছি বেলা। তুমিই ওঠোনি।"


বেলার চুল থেকে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ এসে নাসিকারন্ধ্রে ঠেকছে। ভালো লাগছে। আদ্র বেশ কয়েকবার জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিলো। বেলাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিলো আরও নিবিড় ভাবে। মেয়েটা সাথে থাকলে তার মস্তিষ্ক আর কোনো কিছু ভাবতে চায় না। প্রশান্তিতে চোখ বুজে আসে। বাতাসেও যেন প্রেমময় বার্তা ছড়িয়ে যায়। সময়ের খেয়ালই থাকে না।


-


বেলার যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন রাত প্রায় দশটা বাজছে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে নিজের অতি নিকটে আদ্রকে দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠলো সে। দূরে সরতে নিলেই আদ্রর শক্ত পুরুষালি হাতের কঠিন বাঁধনে আটকা পরলো। আদ্র ক্ষীণ নড়েচড়ে উঠলো। বেলাকে নিজের কাছে টেনে এনে তন্দ্রাঘোরে বললো,

---"নড়ে না বেলা। ঘুমাচ্ছি।" 


আদ্রর চোখ তখনো বন্ধ। লোকটা তার দিকে না তাকালেও প্রচন্ড লজ্জা আষ্টেপৃষ্টে ধরছে তাকে। অস্থির লাগছে। কথার অবাধ্য হয়ে বেলা তবুও সড়তে চাইলো। মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো,

---"ক'টা বাজে?"

---"জানিনা। ঘুমাতে দাও।"

বেলা জোড় গলায় বললো,

---"বাসায় গিয়ে ঘুমাবেন। এখন ছাড়ুন। রাত অনেক হয়ে গেছে। বাসায় ফিরতে হবে।"


আদ্রর হাত ঢিলে হয়ে গেল। বেলা সরে বসলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে পাওয়ার বাটনে চাপ দিতেই স্ক্রীনে ভেসে উঠলো বড় বড় নম্বরগুলো। দশটা বেজে এক মিনিট। নোটিফিকেশনের আইকনে বাবার কল উঠে আছে। বেলার চিন্তা বেড়ে গেল। বাসায় গেলে নিশ্চিত বকা খেতে হবে। আড়চোখে আদ্রকে দেখলো সে। কাঁচা ঘুম থেকে উঠিয়ে দেওয়ায় চোখগুলো লাল হয়ে আছে। কপালে বলিরেখা ফেলে চোখ ছোট ছোট করে রাখা। ক্ষীণ কাঁপছে হাতগুলো। শার্ট কুঁচকে আছে। বেলা জিজ্ঞেস করলো,

---"আপনি আমাকে ডাকেন নি কেন?"

আদ্রর নির্লিপ্ত উত্তর, "ডেকেছি। তুমি ওঠোনি।"

বেলা চুপ হয়ে যায়। মনে মনে আওড়ায়, "কখন ডাকলো? আমি শুনিনি কেন?"


গাড়ির ইনার লাইটটা বন্ধ ছিলো। আদ্র জ্বালিয়ে দিলো তা। এসি ছাড়লো। গরমে কপাল, গলা, ঘাড় খুব বাজে ভাবে ভিঁজে গেছে তার। চোখে এখনো ঘুম লেগে আছে। গাড়ির স্টেয়ারিং এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করে বেলার দিকে হঠাৎ ঝুঁকে পারলো সে। বেলা বড় বড় চোখে তাকালো। তার কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই সীটবেল্ট লাগিয়ে সরে এলো আদ্র। সামনের রাস্তাগুলো ভাঙ্গা। বেলা ধাক্কা খেতে পারে। ব্যথা পেলে আবার?

গম্ভীর স্বরে বললো,

---"তুমি এখনো ছেলেটার নাম বলোনি বেলা।"


বেলা ওড়নার কোণা মুচড়ামুচড়ি করছে। ধীর কণ্ঠে বললো,

---"বলবো না।"

---"কেন?"

---"আপনি মারপিট করবেন।"

আদ্র ভ্রু কুঁচকালো, "সেটা তো আমি এমনিতেই করবো।"

---"এমন কিছুই করবেন না আপনি। পরে আপনার ক্ষতি হলে?" বেলা উৎকণ্ঠা হয়ে বলে উঠলো। 

রেগে গিয়ে মুখ থমথমে করে ফেললো আদ্র। লোকটা অল্পতেই রেগে যায়। 


-


নাস্তা খেতে খেতে ফোনে কথা বলছিল আদ্র। কথা শেষ হতেই রেখা বেশ আগ্রহী কণ্ঠে বললেন,

---"আদ্র জানিস কি হয়েছে?"


কথাটা বলার সময় চোখ বড় বড় করে রেখেছিলেন রেখা। আয়াজ পরোটা মুখে পুরে ঠাট্টার স্বরে বললো, "না বললে কিভাবে জানবে মা?"


রেখা চোখ পাকিয়ে তাকালেন। ধমক দিয়ে বললেন, "তুই চুপ থাক।"

তারপর আবার আদ্রর দিকে চেয়ে বললেন,

---"আদ্র, ফোন রাখ। আমার কথা কি শুনছিস তুই?"

আদ্র ফোন রেখে দিলো। পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো মায়ের দিকে। জিজ্ঞেস করলো, "শুনছি, বলো।"

রেখা উৎসাহিত হলেন। চোখ জ্বলজ্বল করে উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন,

---"বেলাকে পরশু যারা দেখতে এসেছিল, তাকে কে যেন থাপ্পড় মেরে মেরে গাল থেকে রক্ত বের করে দিয়েছে। ছেলের তো বেলাকে অনেক পছন্দ হয়েছিল। সায়েদ ভাই মানা করা সত্ত্বেও বিয়ের জন্য জোড় দিচ্ছিলো নাকি! এখন গালের ব্যথায় নড়তে পারছে না। বিয়ের জন্য মানাও করে দিয়েছে। এটা কে করতে পারে বলতো! তবে ভালোই হলো। ছেলেটাকে আমার একটুও ভালো লাগেনি।"


আয়াজের গলার খাবার আটকে গেল যেন। বিষম খেতে খেতে দ্রুত গ্লাস থেকে পানি পান করলো। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো সে। আদ্রর মুখাবয়ব পর্যবেক্ষণ করলো। আদ্র তখন শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে উত্তর দিলো, "ওহ্! জানতাম না তো।"


______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ১৭

 প্রিয় বেলা


১৭.

কথাটা মস্তিষ্কের স্নায়ুতে পৌঁছাতে বেশ সময় নিলো। আদ্র স্থির ভঙ্গিতে তখনো সোফায় মাথা হেলিয়ে রেখেছে। সে কি শুনেনি তার কথা? নাকি বুঝতে পারে নি? জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেঁজালো আয়াজ। আদ্রর ক্লান্ত, কঠিন মুখপানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। মনে মনে সাহস জুগিয়ে আবার বললো,

---"ভাই শুনছিস আমার কথা? বেলাকে পাত্র দেখতে এসেছিল আজকে।"


আদ্র শুনলো এবার। চোখ মেললো। সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসা রক্তিম নেত্রজোড়া দৃশ্যমান হলো। কি ভয়ংকর সেই লাল শিরাগুলো। চোখের মণি ঘিরে রেখেছে। আদ্র আয়াজের মুখোমুখি বসল। খুব শীতল চাহনি নিক্ষেপ করে শান্ত গলায় সাবধান করলো,

---"ক্লান্ত লাগছে আমার। মাথাও ঠিক নেই। চটে আছি। তুই কি চাচ্ছিস আমার মেজাজটা আমি তোর ওপর দেখাই?"


আয়াজ চোখ বড়সড় করে তাকালো। দ্রুত মাথা নাড়িয়ে না করলো। তারপর সর্তক কণ্ঠে বললো,

---"সত্যি বলছি ভাই। সন্ধ্যায় এসেছিল ওরা। মাও গিয়েছিল। পাত্রর নাকি বেলাকে খুব পছন্দ হয়েছে। সায়েদ আঙ্কেল এখনো কিছু জানান নি। তোর বিশ্বাস না হলে সকালে মাকে জিজ্ঞেস করিস। আমি মিথ্যা বলছি না।"


আদ্রর চোয়াল শক্ত। নিদারুণ কঠিন্যতায় ভরপুর মুখশ্রী। কোনোরকম রাগ আটকে রেখেছে সে। আয়াজের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে একবার তাকিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে পরলো আদ্র। আয়াজ তাড়াতাড়ি করে বললো, "মা তো এখন ঘুমাচ্ছে ভাই। সকালে জিজ্ঞেস করিস। তোর কি আমার কথায় বিশ্বাস নেই?"

আদ্র উঁচু গলায় সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়, "নেই।"

আয়াজের চোয়াল যেন হা হয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে, "একেই বলে মীরজাফর। নিজের প্রাণপ্রিয় ঘুম ধ্বংস করে তার কলিজা, ফুসফুসের সব খবরাখবর রাখছি আমি! অথচ আমারই দাম নেই। এইজন্যই ভালো মানুষগুলো দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত আজ। কি একটা অবস্থা!"

আপন মনে কথাগুলো বলে সটান হয়ে সোফায় শুয়ে পরলো আয়াজ। রুমে যাওয়ার শক্তি নেই। ঘুমে শরীর ভেঙ্গে আসছে তার।


রুমে যেতে যেতে দুইতিনবার বেলাকে কলও করে ফেললো আদ্র। অস্থির হয়ে শরীর থেকে শার্ট খুলে নিলো। উষ্কখুষ্ক চুলগুলোয় হাত চালালো বারংবার। হাতের ব্যান্ডেজ, বুকের ব্যান্ডেজ অসহ্য লাগছে খুব। ঠিকমতো হাত নাড়ানো যাচ্ছে না। একটানে তা খুলে ফেলতেই ক্ষীণ রক্ত বেড়িয়ে এলো বুকের ক্ষত হতে। ক্ষত স্থানটা তখনো শুকায়নি। বিরক্ত হয়ে টিস্যু দিয়ে রক্তগুলো মুছে নিলো আদ্র। বিছানায় বসে আবারও কল লাগালো বেলাকে। একবার, দু'বার, তিনবার, অনেকবার। মেয়েটা তবুও ফোন ধরলো না। অসহ্য অবহেলায় তন্দ্রা কাটিয়ে দিলো তার। চাপা রাগে মাথার যন্ত্রণা দ্বিগুণ বেড়ে গেল যেন। হাতের ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরলো আদ্র। হাতে ব্যথা পেল। তবে তা হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হতে খুব কমই বটে।


-


টিউশন শেষে ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে এদিক-ওদিক একবার তাকালো বেলা। ওইযে, একটু দূরে করিম চাচার রিকশা। রিকশায় বসে আরাম করে লাল চা খাচ্ছেন তিনি। বেলা কাছাকাছি হতেই বিস্তর হাসলেন। মিটমিটে কণ্ঠে আগেভাগেই বললেন, "তোমারে আইজকা নিয়া যাউতে পারুম না মা। স্যারে মানা কইরছে।"

বেলা যারপর নাই অবাক হলো। জানতে চাইলো, "কেন? কেন মানা করেছে?"

---"তা জানি না মা। তোমারে কইছে এইহানে দাঁড়াইতে। স্যারই তোমারে নিয়া যাইবো কইছে। আইতাছে।"


বেলা আর প্রশ্ন করলো না। বিশাল বিস্ময় নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। করিম চাচা অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলেন তাকে, চা খাবে কিনা। সে মানা করে দিয়েছে।

আদ্র এলো মিনিট খানেক পর। সাঁ করে কালো রঙের গাড়িটা থামলো বেলার ঠিক সামনে। আকস্মিক হওয়ায় বেলা ভয় পেয়ে দুকদম পিছু হটে দাঁড়ালো। কোনোরুপ প্রতিক্রিয়া দেখানোর পূর্বেই গাড়ির দরজা খুলে আদ্র গম্ভীর আওয়াজে বললো, "উঠো।"


আদ্র আজকে ড্রাইভার আনেনি। নিজেই ড্রাইভ করছে। তার পাশের সীটের দরজা খুলে দিলো এইমাত্র। বেলা ধীরস্থির ভাবে বসতেই তৎক্ষণাৎ গাড়ি চলতে শুরু করলো। নিষ্ঠুর চোখেজোড়া মেলে বেলার পানে একবার তাকাচ্ছেও না আদ্র। শুধু গম্ভীর, ক্রোধপূর্ণ স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

---"আজকাল দেখছি বিয়ের খুব সখ জেগেছে। পাত্রদের সামনে সেজেগুজে বসে যাচ্ছে। নিজের রুপ দেখাচ্ছে। এত সাহস কোথায় পাচ্ছে এরা? ভয় লাগে না? বুক কাঁপে না একটুও?"


বেলা ভয়ে ঢোক গিললো। কি বলবে বুঝে পেল না। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো ক্রমশই। লোকটাকে তো সে ভয় পায় না৷ আজকে পাচ্ছে কেন? কাঁপা স্বরে কিছু বলতে নিলেই আদ্র আবার প্রশ্ন করলো,

---"ফোন কোথায় থাকে আপনার? কাল রাত থেকে কতবার কল করেছি। দেখেন নি?"

বেলা ঠোঁট কামড়ে চারপাশটায় এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। ক্ষীণ স্বরে বললো, "দেখেছি।"


আকস্মিক জোড়ে ধমক দিয়ে উঠলো আদ্র, "তাহলে কলব্যাক পাইনি কেন আমি? আমাকে কি মানুষ বলে মনে হয়না? বলুন! হয়না?"

বেলা কেঁপে উঠলো। ভীতু চোখে তাকালো। লোকটাকে সে চিনতে পারছে না। এমনটা তো করেনি কখনো। আজকে এভাবে রাগ দেখাচ্ছে কেন? ধমকাচ্ছে কেন? বেলা মাথা নুয়ালো। কাঁপা গলায় থেমে থেমে বললো,

---"সকালে দেখেছিলাম। পরে কলব্যাকও করতাম। কিন্তু মনে ছিল না আর। সরি।"


আদ্র সশব্দে স্টেয়ারিংয়ে ধাক্কা মারলো। হকচকিয়ে তাকালো বেলা। আড়চোখে আদ্রকে দেখল। সে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। নিশ্বাসের গাঢ় শব্দ শোনা যাচ্ছে খুব প্রখর ভাবে। দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছে। কপালের রগগুলো ফুলে ভয়ংকর অবস্থা। গৌর বর্ণের মুখশ্রী কি রুঢ়, দাম্ভিক! সাহস নিয়ে কম্পয়মান হাতটা আদ্রর হাতের পিঠে রাখলো বেলা। কোমল স্বরে বললো, "এত রেগে যাচ্ছেন কেন? শান্ত হন। আমার তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।"

আদ্র প্রবল ক্রোধ নিয়ে আবারও ধমকের রেশ নিয়ে বললো,

---"আপনার এই হয়ে যাচ্ছে না নিয়ে বসে থাকবো আমি? যদি হয়ে যেত? তখন আমি কি করতাম?"

থামাথামি ছাড়া আদ্র আবারও বললো, "তোমাকে আমি আর আপনি করে বলবো না। সাহস বেড়ে গেছে তোমার। আপনি, আপনি বলে ডাকি বলে দাম দিচ্ছো না। অধিকার নেই নাকি আমার? দেখেছো কি এখনো?"


বেলা চুপ হয়ে গেল। এ কথার পিঠে কি বলা উচিত? জোড় গলায় কি বলবে, 'আপনার কোনো অধিকার নেই। আমাকে তুমি করে বলতে পারবেন না। আপনি করে বলুন।'

কিন্তু লোকটার মুখে তাকে তুমি সম্বোধন করাটা তো তার খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগায় সিক্ত করে তুলছে ভেতরটা। কি প্রাণনাশক ডাকটা। কি গম্ভীর সুন্দর! বেলা আর মানা করলো না। কিচ্ছুটি বললো না এনিয়ে।

আদ্র ড্রাইভ করছে। নিজ থেকে বেলার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। বেলা একবার বাহিরে তাকালো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সূর্য ডুবে গেছে সেই কবে। বেলা মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো, "বাসায় ফিরবেন না?"


আদ্রর উত্তর নেই। কপাল খানিক কুঁচকে গেছে। দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ ভাব। বেলা ইতস্তত করলো। আধো গলায় বললো,

---"আমি তো বিয়ে করতাম না।"

---"কেন করতে না?" তৎক্ষণাৎ উত্তর এলো ওপাশ থেকে। 

বেলা আদ্রর দিকে তাকালো। লোকটা এতক্ষণে শান্ত হয়েছে। কপালের ভাঁজগুলো মিলিয়ে গেছে। তবে গম্ভীর ভাব এখনো বিরাজমান। বেলা সময় নিয়ে, আমতা স্বরে আগের মতোই বললো,

---"আপনাকে রেখে কিভাবে করবো?"


শুনে ক্ষীণ থমকালো আদ্র। এরপরই নিঃশব্দে হেসে ফেললো সে। বেলা দেখতে পেল না। গাড়ি থেমে গেল কড়া ব্রেকে। উজ্জ্বল চোখে তাকালো। নিষ্প্রভ স্বরে বললো, "দেখি, বুকে আসো। অনেক জ্বালিয়েছ।"


বেলা পিটপিট করে তাকালো। মানা করার জন্য উদ্যোগী হলেও সুযোগ দিলো না আদ্র। টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো তাকে। খুব প্রগাঢ় ভাবে, ঘনিষ্ট হয়ে। বেলা লজ্জিত ভঙ্গিতে একটু জড়োসড়ো হলো। আদ্র কি ভেবে হঠাৎ বললো, "ছেলেটার নাম কি?"


বেলা বুঝলো না যেন। জিজ্ঞেস করলো,

---"কোন ছেলে?"

---"তোমাকে যে দেখতে এসেছিল।"

---"কেন?"

---"লাগবে আমার।"


বেলা আতঙ্কিত হয়ে তাকালো। উৎকণ্ঠ হয়ে বললো, "আপনি কি মারপিট করতে চাইছেন?"

আদ্র ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। উত্তর দিলো,

---"হ্যাঁ।"


________________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ১৬

 প্রিয় বেলা


১৬.

নতুন টিউশন পেয়েছে বেলা। বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে। ম্যানরোডের কাছকাছি। ভার্সিটি শেষে রাস্তার ওপারে করিম চাচাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল সে। রিকশায় উঠে বসলো। নতুন স্টুডেন্টের বাসার ঠিকানা বলতেই করিম চাচা ভ্রু কুঞ্চিত করে বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,

---"এত টিইউশন-ফিউশন কইরা কোনু লাভ আছে মা? এক ফড়াশোনা কইরাই কেলান্ত হইয়া পরেন। আদ্র স্যার তো এইজন্যই আফনার লাইগা আমারে রাখছে।"


প্রতিউত্তরে হালকা হাসলো বেলা। আজ সত্যিই বড্ড ক্লান্ত হয়ে পরেছে সে। বাসা থেকে দেড়িতে বের হওয়ায় ক্লাস টেস্টে খুব দ্রুত হাত চালিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে প্রশ্ন শেষ করতে হয়েছে। হাতটা টনটন করছে। ক্ষীণ যন্ত্রণা হওয়ায় সহ্য করা যাচ্ছে। রিকশা চালক আবার বললেন,

---"আফনার কাছে ফানি আছে মা? আইজ যা গরম পরছে! গলা শুকাই গেছি এক্কেবারে।"


ব্যাগ থেকে ছোট্ট পানির বোতলটা বের করলো বেলা। করিম চাচার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

---"আমি আপনার মেয়ের মতো চাচা। আমাকে তুমি করে ডাকবেন। আর এইযে, পানির বোতল।"

করিম চাচা যেন খুশি হলেন খুব। স্নিগ্ধ হাসি ভীর জমালো ঠোঁটের কোণে। চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো। মাথা দুলিয়ে পানির বোতলটা নিলেন তিনি। একহাতে রিকশার হেন্ডেল ধরে, অন্যহাত দিয়ে একটু করে পানি পান করলেন। উনার পা দু'টো তখনো অবিশ্রান্ত রিকশার পেন্ডেল ঘোরাচ্ছে। পানি পান করা শেষে তিনি বোতলটা আবার ফেরত দিয়ে রিকশা চালাতে মনোযোগী হলেন। বেলা চারপাশটায় একবার চোখ বুলালো। ম্যানরোডের প্রায় অধিকাংশ জায়গা জুড়ে আদ্রদের দলের পোস্টার টানানো। তবে আদ্রর ছবি দেখা যাচ্ছে না। বড় বড় অক্ষরে নাম উল্লেখ করা আছে মাত্র।


রিকশা ঘুরিয়ে একটু ফাঁকা রাস্তায় ঢুকতেই হঠাৎ কালো রঙা একটা গাড়ি এসে থামলো রিকশার একদম সামনে। আকস্মিক হওয়ায় নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে রিকশা থামালেন করিম চাচা। রিকশা দুলে উঠলো। ভয়ে হুটের হাতল শক্ত করে ধরল বেলা। চোখ খিঁচে বুজে নিলো। রিকশা চালক করিম চাচা মনে মনে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিতে উদ্যাগী হলেও পরক্ষণেই ফোনের রিংটোনের শব্দে থেমে গেলেন। পুরাতন গানের কিছু লাইন বেজে উঠছে। সাবানার গান। অত্যন্ত বিরক্তের সঙ্গে পকেট থেকে ফোন বের করে তা কানে রাখলেন তিনি। ওপাশ থেকে কিছু বলতেই থতমত গলায় বললেন,

---"আইচ্ছা। দিতাছি।"


তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে বেলার পানে তাকালেন। নিজের কিপেড ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,

---"আদ্র স্যার কথা কইব তোমার লগে। লও।"

ঘন পাঁপড়ির মিশ্রণে তৈরি নেত্রপল্লব পিটপিট করলো তার। অবাক হয়ে ফোনটা নিলো। কানে রাখলো। তাকে কিছু বলতে না দিয়ে আদ্র ভারি গলায় বললো,

---"রিকশা থেকে নেমে আসুন বেলা।"


বলে সে দুই সেকেন্ড থামলো। পরপরই কেটে গেল কল। সামনের কালো গাড়িটায় দৃষ্টি ফেলতেই আবছা ভাবে আদ্রর মুখশ্রী খেয়ালে এলো বেলার। কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে ইতস্তত ভঙ্গিতে নেমে পরলো রিকশা হতে। মাথার বিন্যস্ত ঘোমটা-টা প্রয়োজন ছাড়াই আবারও টেনে ঠিক করলো। করিম চাচা দাঁত বের করে হাসছেন। অস্বস্থিতে সেদিকে একবার চেয়ে বেলা মাথা নুয়ালো। আদ্র আগে থেকেই তার পাশের দরজা খুলে রেখেছে। বেলা গাড়িতে উঠে বসলে আর কালবিলম্ব করলো না সে। করিম চাচাকে ইশারা করে গাড়ি ঘোরালো। 

গাঢ় নিরবতায় ছেদ ঘটিয়ে বেলাই প্রথমে জিজ্ঞেস করলো, "আমরা কোথায় যাচ্ছি?"


আদ্র উত্তর দেয় না। কি দৃঢ় আকর্ষণ নিয়ে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত সে! এই গরমেও মুখে মাক্স তার। পরনে ছাই রঙের সাধারণ পাঞ্চাবী। বেলা আবার জিজ্ঞেস করলো,

---"উত্তর দিচ্ছেন না কেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?"

আদ্রর ত্যাড়া গলায় উত্তর,

---"কেন? আমি কোথাও নিয়ে গেলে সমস্যা আছে নাকি?"


আদ্রর হঠাৎ রাগের কারণ ঠিক ঠাওর করতে পারলো না বেলা। কপাল কুঁচকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,

---"এভাবে কথা বলছেন কেন? আমি কি করেছি?"

উত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদ্র। স্টেয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে বেলার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। গম্ভীর গলায় অভিযোগ করলো,

---"আপনি আমার শান্তি কেড়ে নিয়েছেন বেলা। কাজ শেষে আপনাকে পাওয়ার শান্তিটুকুও আমার ভাগ্যে মেলে না। এমন যন্ত্রণা দিচ্ছেন কেন?"


বেলা কাতর নয়নে একবার তাকালো। নুয়ানো মাথার থুতনি ঠেকে গেল গলার সঙ্গে। ধীর গতিতে হাত সরাতে চাইলেই জোড়ালো ধমক দিয়ে সাবধান করলো আদ্র, "খবরদার! হাত সরাবেন না।"


বেলা থেমে যায়। হাত সরানোর ক্ষীণ চেষ্টাও আর করে না। প্রকট নিরবতায় ছেয়ে যায় পুরো সময়টা। শুধু যানবাহনে কড়া হর্ণের শব্দ কানে আঘাত হানছে একটু পরপর।

মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে সরব দরজা খুলে বেরিয়ে যায় আদ্র। বেলাকেও নামিয়ে পেছনের সীটে বসিয়ে দেয় কোনো কথা ছাড়াই। বেলা হকচকিয়ে যায়, ভড়কায়, অবাক চোখে তাকায়। মিনমিন করে কিছু বলতে গিয়েও পারে না। আদ্র ভালোভাবে গাড়ি লক করে বেলার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরেছে। এই ছোট্ট জায়গাটিতেই। পা দু'টো ভাঁজ করে গুটানো। ঝাঁকড়া মাথার চুলগুলো বেলার উদরে কাতুকুতু সৃষ্টি করছে। শিরশির করছে স্থানটা। বেলা চাপা গলায় চিৎকার করে উঠে,

---"কি করছেন এসব? উঠুন।"


আদ্র চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায়ই কপাল কুঁচকায়। ললাটে তৈরি হয় অসংখ্য বলিরেখা। দাম্ভিক স্বরে বলে,

---"চুপ থাকুন। ঘুমাতে দিন।"

বেলা আমতা আমতা স্বরে বললো,

---"আমার টিউশন আছে।"

আদ্রর একরোখা উত্তর, "যেতে হবে না।"

---"আমার নতুন টিউশন এটা। না গেলে কিভাবে কি হবে? আমি যাবো। আপনি সরুন।"


সরার পরিবর্তে বেলার সঙ্গে আরও মিশে রইলো যেন সে। ঘুম ইতিমধ্যে চোখে এসে হানা দিয়েছে। পল্লবজোড়া মেলতে পারছে না আদ্র। ঘুমিয়ে যেতে যেতে লহু স্বরে বললো, "মাত্র আধঘণ্টা ঘুমাবো। তারপর পৌঁছে দিব। এখন বিরক্ত করবেন না। ঘুমাচ্ছি।"


আদ্র ঘুমিয়ে পরেছে। বেলার একহাত তার গলা পেরিয়ে নিজের হাতের ভাঁজে ভাঁজে আটকে রেখেছে। বেলা অনভ্যস্ত হাতে আদ্রর ঝাঁকড়া মাথার চুলগুলোয় কিছুক্ষণ হাত বুলালো। তারপর কপাল, গাল, নাক ছুঁয়ে দিলো একে একে। আদ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন। চোখের নিচটায় কালি পরে গেছে। ফর্সা ত্বকে তা বড্ড বেমানান। তার ঘুমন্ত মুখখানায় স্পষ্ট কান্তির ছাপ। বেলা সন্তপর্ণে আদ্রর মাক্সটা খুলে নিলো। ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। খুব আস্তে করে বললো,

---"রাজনীতি মানুষ থেকে কতকিছু কেড়ে নেয় আদ্র, আপনি কখন বুঝবেন?"


আদ্র কি শুনলো তার কথা? কি জানি! একটু নড়েচড়ে উঠলো সে। বেলার হাত আরও শক্ত করে ধরলো। হাতের পিঠে অধর ছোঁয়ালো হঠাৎ। বেলা চমকিত হলো। ধূলিসাৎ হলো সব। নিশ্বাসের গতি বাড়লো। এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকালো সে।


-


মাঝরাত। ধীর পায়ে বাড়িতে ঢুকছিল আদ্র। সোফায় আয়াজকে এবড়োখেবড়ো ভাবে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। প্রশ্ন করলো,

---"তুই এখানে কি করিস? ঘুমাস নি এখনো?"


আদ্রর তন্দ্রা কেটে গেল। ধড়ফড়িয়ে উঠলো সে। আদ্রকে দেখে অল্প হাসার চেষ্টা করলো। ঠিক হয়ে বসে বললো,

---"ভালো লাগছিল না। তাই টিভি দেখতে এসেছি।"

---"টিভি তো তোর রুমেও আছে। ওটা বাদ দিয়ে এখানে বসে টিভি দেখছিস কেন?" 

সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো আদ্র। আয়াজ মুখের সবকটি দাঁত বের করে হাসলো। একহাতে মাথার পেছনের চুল চুলকালো। ক্ষীণ তোতলিয়ে বললো, "আমার রুমেরটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আরকি।"


আদ্রর সন্দেহ কমলো না। তবুও সে এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করে না। টিভিতে আয়াজ তার ভাষণ শুনছে। নির্বাচনের জন্য কালকে সেখানে যেতে হয়েছিল তার। আদ্র আয়াজের পাশে বসে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। হাত ঘড়ি খুললো। শার্টের প্রথম তিনটে বোতাম খুলে হাতা গোটালো। বললো,

---"মা কোথায়? ঘুমিয়ে গেছে?"

---"হ্যাঁ। ঘুমাতে যেতে চাচ্ছিল না। তোর জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি কিছুক্ষণ আগেই ঠেলেঠুলে পাঠিয়েছি।"


শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদ্র। সোফায় মাথা হেলিয়ে চোখ বুঝলো। আয়াজ তার দিকে চিন্তিত নেত্রে তাকিয়ে আছে। টিভির সাউন্ড আস্তে করে কমিয়ে দিলো সে। ডাকলো,

---"ভাই। একটা কথা ছিল তোর সাথে।"

আদ্রর ক্লান্ত গলায় ছোট্ট সম্মতি, "বল।"


আয়াজ সময় নিলো। এলোমেলো গলায় বললো, "বেলাকে আজ সন্ধ্যায় ছেলে পক্ষ দেখতে এসেছিল।"


_______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ১৫

 প্রিয় বেলা


১৫.

আদ্রর ঘোরলাগা দৃষ্টি তখনো স্থির। ঠোঁটের কোণে বাঁকানো হাসির অস্তিত্ব খুব প্রখর ভাবেই আছে। বেলা এলোমেলো ভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ঘন ঘন পলক ফেলছে। আদ্রর চাহনির পরিবর্তন ঘটছে না। সে অনড়, ক্ষান্তহীন। প্রগাঢ়তায় ভরা সেই চাহনির বিপরীতে প্রচন্ড লজ্জায় আড়ষ্ট বেলা। ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,

---"অনেক রাত হয়ে গেছে। আপনার ঘুমানো প্রয়োজন।"


আদ্র শুনলো না বোধহয়। আশপাশটায় একটু তাকালো মাত্র। আরও একবার আপাদমস্তক দেখে নিলো বেলাকে। আদেশ সমেত বললো,

---"ছাদে আসুন।"


রাত্রি গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। কয়েক ঘণ্টা পরই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করবে। বেলার মাথায় ঘোমটা নেই। দিতে ভুলে গেছে সে। বিহান ঘুমের মাঝে নড়চড় করছে বারবার। বেলা সচকিত হলো। মানা করে বললো,

---"আপনি অসুস্থ। সকালও হবে কিছুক্ষণ পর। চলে যান। আমি আসব না।"

বলে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে উদ্যোগী হলো সে। আদ্র রেলিংয়ে দুহাত রেখে আরাম করে দাঁড়ালো। নভস্থলে গভীর দৃষ্টি মেলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো,

---"আমি তবুও অপেক্ষা করবো বেলা। কারণ আপনি আসবেন।"


বেলার পা থমকালো না। বারান্দা পেরিয়ে রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো হালকা শব্দে। দরজার কাঠে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো প্রায় অনেক্ষণ। মুখ থেকে আগত উষ্ণ নিশ্বাসগুলো অবিন্যস্ত হলো। চোখ বুজে এলো। হঠাৎ কি মনে করে জানালার পর্দা অল্প সরালো সে। আদ্র এখনো ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। একইভাবে আকাশপানে কি যেন দেখছে। লোকটা কি সত্যিই এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? বাহিরে শীত কম নয়। শিরশির করে কাঁপিয়ে তোলার মতো। তারওপর আদ্র অসুস্থ। বেলা আর রুমে থাকতে পারলো না। গুটিগুটি পায়ে রুম থেকে বের হলো, ড্রইংরুম পেরিয়ে সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে উঠলো। সর্বশেষে ছাদে এসেই দেখতে পেল আদ্রকে। তার আসার আভাস পেয়ে লোকটা তার দিকে তাকিয়েছে। ঠোঁটে এসে হানা দিয়েছে স্নিগ্ধ হাসি। কি সুন্দরই না লাগছে মানুষটাকে!

বেলা আরেকটু এগিয়ে আসতেই আদ্রর হাসি আরও গাঢ় হলো। অস্থির চোখজোড়া বেলার মুখশ্রী জুড়ে ঘুরতে লাগলো। সে বললো, "আমি জানতাম, আপনি আসবেন।"


আদ্রর পেশিবহুল ফোলা ফোলা হাতের বাহু অনাবৃত। গলা বড় হওয়ায় বুকের ব্যান্ডেজটার ক্ষীণ অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। কপালের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছে সে। চোখের ঠিক ওপরে, ভ্রুয়ের কাছ ঘেঁষে লম্বালম্বি দু'টো দাগ দেখা যাচ্ছে। এমন অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও লোকটা কেমন দিব্যি হাসছে। বেলা দৃষ্টি লুকালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

---"আমি এসেছি। এবার চলে যান।"

---"আপনাকে জড়িয়ে ধরা এখনো বাকি আমার।"


তৎক্ষণাৎ এক কদম পেছালো বেলা। গলা কাঁপিয়ে লহু চিৎকার করলো, "না।"

আদ্র হেসে ফেললো। মেয়েটাকে ভয় পেলেও দারুণ লাগে। দৃঢ় গলায় বললো,

---"এখানে আসুন বেলা। দূরে দূরে দাঁড়াচ্ছেন কেন?"

বেলা এবার একটু রাগ নিয়েই বললো,

---"এক্সিডেন্ট করে আপনার মাথা গেছে একদম।"


বিনিময়ে আদ্র আবারও হাসলো। গুরুগম্ভীর নেত্রজোড়াও চঞ্চল হলো। হিমেল হওয়া হঠাৎই থেমে গেল। নিস্তব্ধ হলো পরিবেশ, তারা দু'জন। আদ্র ঠোঁটের হাসি ধূলিস্যাৎ করে ধারালো কণ্ঠে সূক্ষ্ণতা নিয়ে বললো,

---"আপনাকে আমার কাঁদাতে ইচ্ছে করছে বেলা। আপনার কান্নারত মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে।"


বেলা চমকিত হয়। হকচকিয়ে তাকায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। এত ভয়ংকর কারো ইচ্ছে হয়?


-


ক্লাবে সব দামি দামি জিনিস। দরজা, জানালা সব বন্ধ করা। মাথার ওপর ফুলস্প্রীডে ফ্যান চলছে। সাদা বাতির আলোয় আলোকিত বড়সড় রুমটা। আদ্র টেবিলের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তার সামনেই দলের ছেলেগুলো দাঁড়ানো। তাদের মাঝে মধ্যিকানের তন্ময় নামের ছেলেটি ক্ষীপ্ত গলায় বললো,

---"ভাই, বিপক্ষের ছেলেগুলো এবার বেশি করছে। আমাদের পোস্টারগুলো ছিঁড়ে নিজেদেরগুলো লাগাচ্ছে। কিছু হলেই মারামারিতে এসে যাচ্ছে। আপনি শুধু আদেশ দেন আমরা--।"


তন্ময়কে থামিয়ে দিলো আদ্র। হাতের কিউবটা নাড়াতে নাড়াতে শান্ত স্বরে বললো, "নির্বাচনের বেশিদিন নেই। আর কয়েকদিন যাক। ব্যাপারটা দেখব আমি।"

তন্ময় অসহায় কণ্ঠে বললো,

---" ভাই, আমরা কিছু বলছি না দেখে ওদের সাহস বেড়ে গেছে। আপনার ওপর হামলা করলো। কালকে আবার আমাদের দুজন ছেলের হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। একজনের কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে। আপনি কি এখনও কিছু বলবেন?"


কিউবটা সশব্দে টেবিলে রাখলো আদ্র। তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে প্রকাণ্ড এক হুঙ্কার ছাড়লো,

---"আমাকে আগে জানানো হয়নি কেন?"

---"আপনাকে কল করছিলাম ভাই। আপনি ধরেন নাই।"

আদ্র তবুও রোষপূর্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো তন্ময়ের দিকে। রাগ আর প্রকাশ করলো না। শক্ত কণ্ঠে বললো,

---"আজ রাতেই যা করার করবি। দু'একজন ছুঁড়ি নিলেও প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করবি না। সবাই হকিস্টিক নিবি। যেভাবে পারিস একেকটার হাত-পা ভেঙ্গে দিবি। আর সাবধান। কেউ যেন তোদের চেহারা না দেখে।"


টেবিল থেকে নেমে দাঁড়ালো আদ্র। আকিব এগিয়ে আসলো দ্রুত। বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো,

---"এখন কোথায় যাবেন ভাই?"

---"বাসায়ই যাবো। আসো।"

আদ্র গাড়ির দিকে যেতে লাগলো। আকিবও পেছন পেছন আসলো।


জ্যামে আটকে পরেছে আদ্রর গাড়িটা। এসি চলছে। তবুও গরমে কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে তার। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে। চুল অগোছালো। বিরক্ত মনে জানালা গলিয়ে বাহিরে দৃষ্টি ফেলল সে। ফুটপাতে অল্পবয়সী একটা মেয়ে চুড়ি নিয়ে বসে আছে। কাঁচের চুড়ি। লাল, নীল, কালো, হলুদ, সবুজ। আরও কত রঙের! লাল রঙের চুড়িগুলোয় চোখ আটকে গেল আদ্রর। বেলার কথা মনে পরলো। পাশে বসা আকিবকে ডাকলো,

---"আকিব, শুনো।"

আকিব সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো, "জি ভাই বলেন।"

---"ওখানে চুড়ি দেখছো না? লাল রঙের সব চুড়ি নিয়ে আসো। টাকা নিয়ে যাও।"


আকিব মাথা দুলালো। দ্রুত রাস্তার গাড়ি, রিকশা পেরিয়ে ফুটপাতে বসা মেয়েটি থেকে চুড়ি নিতে লাগলো। আদ্র সেদিকে তাকিয়ে জোড়ালো নিশ্বাস ফেললো। সীটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। বেলার মুখশ্রী ভেসে উঠছে। রাতে না ঘুমানোয় তন্দ্রা এসে জেঁকে বসছে দৃঢ়তার সঙ্গে। আদ্র ঘুমিয়ে যেতে লাগলো। তার আগ অব্দি অস্পষ্ট ভাবে বিড়বিড়িয়ে অভিযোগ করে উঠলো, "আপনি আমার সঙ্গে এভাবে মিশে যাচ্ছেন কেন বেলা? পাগল করে দিচ্ছেন আমায়।"


-


১৮ই মাঘ, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। ঘড়ির কাটায় বিকাল পাঁচটা বাজছে। প্রভা বেগম পায়েস রান্না করেছেন আজ। বেলাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছেন একবাটি পায়েস যেন রেখাকে দিয়ে আসে। বেলা দিরুক্তি করলে শান্ত গলায় কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললেন,

---"ওরা কিছু বানালে আমাদেরকে দেয় নি এমন কখনো দেখেছিস? আমাদেরও তো দায়িত্বে পরে কিছু বানালে ওদেরকে দেওয়ার, তাই না? যা না মা। এমন অবাধ্য হচ্ছিস কেন?"


অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদ্রদের বাড়ি উপস্থির হলো বেলা। রেখা ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসে ছিলেন। টিভিতে সময় চ্যালেন চলছে। দলনেতা হয়ে স্টেজে স্পিচ দিচ্ছে আদ্র। পরনে মুজিব কোর্ট। সবসময়ের মতো ভ্রু কুঁচকে একের পর এক হাঁড় কাঁপানো বাক্য বলে যাচ্ছে সে। কণ্ঠে সে কি তেজ, কাঠিন্যতা, দাম্ভীকতা! সবাই হইহই করে তালি দিচ্ছে।

রেখা বেলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠিক হয়ে বসলেন। মুচকি হেসে বললেন,

---"ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন বেলা? এদিকে আসো। আমার পাশে বসো।"


টিভি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বেলা সোফায় বসলো। পায়েসের বাটিটা রেখাকে দিয়ে বললো,

---"এটা আপনাদের জন্য মা পাঠিয়েছে।"

এমনিতে হলে রেখা এতক্ষণে উৎফুল্লতায় ভরে উঠতেন। অথচ আজকে মুখটা মলিন। একটু করে হেসে বললেন,

---"তোমার মা ভালোই করেছে পায়েস পাঠিয়ে। খেতে ইচ্ছে করছিল।"


বলে পায়েসের বাটিটা টেবিলে রেখে দিলেন। বেলা জিজ্ঞেস করলো,

---"আপনি ঠিক আছেন আন্টি? না মানে, আপনাকে কেমন অসুস্থ লাগছে।"

---"হ্যাঁ। প্রেসার বেড়ে গেছে একটু।" হতাশার নিশ্বাস ফেলে বললেন তিনি।


এর পিঠে বেলা কি বলবে খুঁজে পেল না। ভেতরে ভেতরে চলে যাওয়ার জন্য মন স্থির করতেই হঠাৎ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো আরু। বেলাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো। বললো, "কেমন আছো আপু? আমি এখন তোমার বাসায়ই যাচ্ছিলাম। তোমাকে ডাকতে।"


বেলা অবাক নয়নে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো, "আমাকে ডাকতে? কোনো প্রয়োজন ছিল আরু?"

---"হ্যাঁ, তা তো ছিলই। চলো আমার সঙ্গে উপরে যাবে। আসো।"

বেলা একপলক রেখার দিকে তাকালো। উনি ইতিমধ্যে পায়েস খাচ্ছেন। এদিকে খেয়াল নেই অত। আরুর সাথে উপরে চলে গেল সে। আরু তাকে আয়াজের রুমে নিয়ে এসেছে। সাধারণ, অল্প অগোছালো রুম। স্বাভাবিক ভাবে ছেলেদের রুম যেমন হয়। আয়াজ আগে থেকে বিছানায় বসে ছিল। বেলা আসতেই উঠে দাঁড়ালো সে। বিস্তর হেসে বললো,

---"এসেছো? বসো। তোমার মূল্যবান জিনিসটা আগে দিয়ে দেই। নয়তো ভাই আমাকে আস্ত রাখবে না।"


বলতে বলতে সে আলমারি থেকে একটা প্যাকট বের করে ধরিয়ে দিলো বেলাকে। বেলা সেটা নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। আয়াজ মিটিমিটি হেসে বললো,

---"খুলে দেখো কি আছে।"


বেলার অস্বস্থি হচ্ছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে প্যাকেটটার দিকে তাকালো সে। খুললো। অনেকগুলো লালচুড়ি দেখে বিস্ময় যেন সীমা ছাড়িয়ে গেল। আয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো, 

---"এতগুলো চুড়ি-- কে দিয়েছে?"

উত্তরে আয়াজ আগের ন্যায়ই বললো,

---"ভেতরে একটা কাগজও আছে। বের করে পড়ো। তোমার উত্তর ওখানে আছে।"


বেলা কাঁপা হাতে চুড়িগুলো ক্ষীণ সরালো। হলুদ রঙের কাগজ বেরিয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে। বেলা কাগজটা বের করলো। কালো কালি দিয়ে খুব সুন্দর হাতের লিখা ভেসে উঠছে সেখানে,


---"আপনার হাতের মাপ আমার জানা নেই বেলা। তাই সবগুলোই নিলাম। একদিন এগুলো পরে আমাকে চমকে দেওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।

~আদ্র ইয়ানিদ।"


_________________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা