গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ১৬

 প্রিয় বেলা


১৬.

নতুন টিউশন পেয়েছে বেলা। বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে। ম্যানরোডের কাছকাছি। ভার্সিটি শেষে রাস্তার ওপারে করিম চাচাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল সে। রিকশায় উঠে বসলো। নতুন স্টুডেন্টের বাসার ঠিকানা বলতেই করিম চাচা ভ্রু কুঞ্চিত করে বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,

---"এত টিইউশন-ফিউশন কইরা কোনু লাভ আছে মা? এক ফড়াশোনা কইরাই কেলান্ত হইয়া পরেন। আদ্র স্যার তো এইজন্যই আফনার লাইগা আমারে রাখছে।"


প্রতিউত্তরে হালকা হাসলো বেলা। আজ সত্যিই বড্ড ক্লান্ত হয়ে পরেছে সে। বাসা থেকে দেড়িতে বের হওয়ায় ক্লাস টেস্টে খুব দ্রুত হাত চালিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে প্রশ্ন শেষ করতে হয়েছে। হাতটা টনটন করছে। ক্ষীণ যন্ত্রণা হওয়ায় সহ্য করা যাচ্ছে। রিকশা চালক আবার বললেন,

---"আফনার কাছে ফানি আছে মা? আইজ যা গরম পরছে! গলা শুকাই গেছি এক্কেবারে।"


ব্যাগ থেকে ছোট্ট পানির বোতলটা বের করলো বেলা। করিম চাচার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

---"আমি আপনার মেয়ের মতো চাচা। আমাকে তুমি করে ডাকবেন। আর এইযে, পানির বোতল।"

করিম চাচা যেন খুশি হলেন খুব। স্নিগ্ধ হাসি ভীর জমালো ঠোঁটের কোণে। চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো। মাথা দুলিয়ে পানির বোতলটা নিলেন তিনি। একহাতে রিকশার হেন্ডেল ধরে, অন্যহাত দিয়ে একটু করে পানি পান করলেন। উনার পা দু'টো তখনো অবিশ্রান্ত রিকশার পেন্ডেল ঘোরাচ্ছে। পানি পান করা শেষে তিনি বোতলটা আবার ফেরত দিয়ে রিকশা চালাতে মনোযোগী হলেন। বেলা চারপাশটায় একবার চোখ বুলালো। ম্যানরোডের প্রায় অধিকাংশ জায়গা জুড়ে আদ্রদের দলের পোস্টার টানানো। তবে আদ্রর ছবি দেখা যাচ্ছে না। বড় বড় অক্ষরে নাম উল্লেখ করা আছে মাত্র।


রিকশা ঘুরিয়ে একটু ফাঁকা রাস্তায় ঢুকতেই হঠাৎ কালো রঙা একটা গাড়ি এসে থামলো রিকশার একদম সামনে। আকস্মিক হওয়ায় নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে রিকশা থামালেন করিম চাচা। রিকশা দুলে উঠলো। ভয়ে হুটের হাতল শক্ত করে ধরল বেলা। চোখ খিঁচে বুজে নিলো। রিকশা চালক করিম চাচা মনে মনে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিতে উদ্যাগী হলেও পরক্ষণেই ফোনের রিংটোনের শব্দে থেমে গেলেন। পুরাতন গানের কিছু লাইন বেজে উঠছে। সাবানার গান। অত্যন্ত বিরক্তের সঙ্গে পকেট থেকে ফোন বের করে তা কানে রাখলেন তিনি। ওপাশ থেকে কিছু বলতেই থতমত গলায় বললেন,

---"আইচ্ছা। দিতাছি।"


তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে বেলার পানে তাকালেন। নিজের কিপেড ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,

---"আদ্র স্যার কথা কইব তোমার লগে। লও।"

ঘন পাঁপড়ির মিশ্রণে তৈরি নেত্রপল্লব পিটপিট করলো তার। অবাক হয়ে ফোনটা নিলো। কানে রাখলো। তাকে কিছু বলতে না দিয়ে আদ্র ভারি গলায় বললো,

---"রিকশা থেকে নেমে আসুন বেলা।"


বলে সে দুই সেকেন্ড থামলো। পরপরই কেটে গেল কল। সামনের কালো গাড়িটায় দৃষ্টি ফেলতেই আবছা ভাবে আদ্রর মুখশ্রী খেয়ালে এলো বেলার। কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে ইতস্তত ভঙ্গিতে নেমে পরলো রিকশা হতে। মাথার বিন্যস্ত ঘোমটা-টা প্রয়োজন ছাড়াই আবারও টেনে ঠিক করলো। করিম চাচা দাঁত বের করে হাসছেন। অস্বস্থিতে সেদিকে একবার চেয়ে বেলা মাথা নুয়ালো। আদ্র আগে থেকেই তার পাশের দরজা খুলে রেখেছে। বেলা গাড়িতে উঠে বসলে আর কালবিলম্ব করলো না সে। করিম চাচাকে ইশারা করে গাড়ি ঘোরালো। 

গাঢ় নিরবতায় ছেদ ঘটিয়ে বেলাই প্রথমে জিজ্ঞেস করলো, "আমরা কোথায় যাচ্ছি?"


আদ্র উত্তর দেয় না। কি দৃঢ় আকর্ষণ নিয়ে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত সে! এই গরমেও মুখে মাক্স তার। পরনে ছাই রঙের সাধারণ পাঞ্চাবী। বেলা আবার জিজ্ঞেস করলো,

---"উত্তর দিচ্ছেন না কেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?"

আদ্রর ত্যাড়া গলায় উত্তর,

---"কেন? আমি কোথাও নিয়ে গেলে সমস্যা আছে নাকি?"


আদ্রর হঠাৎ রাগের কারণ ঠিক ঠাওর করতে পারলো না বেলা। কপাল কুঁচকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,

---"এভাবে কথা বলছেন কেন? আমি কি করেছি?"

উত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদ্র। স্টেয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে বেলার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। গম্ভীর গলায় অভিযোগ করলো,

---"আপনি আমার শান্তি কেড়ে নিয়েছেন বেলা। কাজ শেষে আপনাকে পাওয়ার শান্তিটুকুও আমার ভাগ্যে মেলে না। এমন যন্ত্রণা দিচ্ছেন কেন?"


বেলা কাতর নয়নে একবার তাকালো। নুয়ানো মাথার থুতনি ঠেকে গেল গলার সঙ্গে। ধীর গতিতে হাত সরাতে চাইলেই জোড়ালো ধমক দিয়ে সাবধান করলো আদ্র, "খবরদার! হাত সরাবেন না।"


বেলা থেমে যায়। হাত সরানোর ক্ষীণ চেষ্টাও আর করে না। প্রকট নিরবতায় ছেয়ে যায় পুরো সময়টা। শুধু যানবাহনে কড়া হর্ণের শব্দ কানে আঘাত হানছে একটু পরপর।

মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে সরব দরজা খুলে বেরিয়ে যায় আদ্র। বেলাকেও নামিয়ে পেছনের সীটে বসিয়ে দেয় কোনো কথা ছাড়াই। বেলা হকচকিয়ে যায়, ভড়কায়, অবাক চোখে তাকায়। মিনমিন করে কিছু বলতে গিয়েও পারে না। আদ্র ভালোভাবে গাড়ি লক করে বেলার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরেছে। এই ছোট্ট জায়গাটিতেই। পা দু'টো ভাঁজ করে গুটানো। ঝাঁকড়া মাথার চুলগুলো বেলার উদরে কাতুকুতু সৃষ্টি করছে। শিরশির করছে স্থানটা। বেলা চাপা গলায় চিৎকার করে উঠে,

---"কি করছেন এসব? উঠুন।"


আদ্র চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায়ই কপাল কুঁচকায়। ললাটে তৈরি হয় অসংখ্য বলিরেখা। দাম্ভিক স্বরে বলে,

---"চুপ থাকুন। ঘুমাতে দিন।"

বেলা আমতা আমতা স্বরে বললো,

---"আমার টিউশন আছে।"

আদ্রর একরোখা উত্তর, "যেতে হবে না।"

---"আমার নতুন টিউশন এটা। না গেলে কিভাবে কি হবে? আমি যাবো। আপনি সরুন।"


সরার পরিবর্তে বেলার সঙ্গে আরও মিশে রইলো যেন সে। ঘুম ইতিমধ্যে চোখে এসে হানা দিয়েছে। পল্লবজোড়া মেলতে পারছে না আদ্র। ঘুমিয়ে যেতে যেতে লহু স্বরে বললো, "মাত্র আধঘণ্টা ঘুমাবো। তারপর পৌঁছে দিব। এখন বিরক্ত করবেন না। ঘুমাচ্ছি।"


আদ্র ঘুমিয়ে পরেছে। বেলার একহাত তার গলা পেরিয়ে নিজের হাতের ভাঁজে ভাঁজে আটকে রেখেছে। বেলা অনভ্যস্ত হাতে আদ্রর ঝাঁকড়া মাথার চুলগুলোয় কিছুক্ষণ হাত বুলালো। তারপর কপাল, গাল, নাক ছুঁয়ে দিলো একে একে। আদ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন। চোখের নিচটায় কালি পরে গেছে। ফর্সা ত্বকে তা বড্ড বেমানান। তার ঘুমন্ত মুখখানায় স্পষ্ট কান্তির ছাপ। বেলা সন্তপর্ণে আদ্রর মাক্সটা খুলে নিলো। ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। খুব আস্তে করে বললো,

---"রাজনীতি মানুষ থেকে কতকিছু কেড়ে নেয় আদ্র, আপনি কখন বুঝবেন?"


আদ্র কি শুনলো তার কথা? কি জানি! একটু নড়েচড়ে উঠলো সে। বেলার হাত আরও শক্ত করে ধরলো। হাতের পিঠে অধর ছোঁয়ালো হঠাৎ। বেলা চমকিত হলো। ধূলিসাৎ হলো সব। নিশ্বাসের গতি বাড়লো। এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকালো সে।


-


মাঝরাত। ধীর পায়ে বাড়িতে ঢুকছিল আদ্র। সোফায় আয়াজকে এবড়োখেবড়ো ভাবে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। প্রশ্ন করলো,

---"তুই এখানে কি করিস? ঘুমাস নি এখনো?"


আদ্রর তন্দ্রা কেটে গেল। ধড়ফড়িয়ে উঠলো সে। আদ্রকে দেখে অল্প হাসার চেষ্টা করলো। ঠিক হয়ে বসে বললো,

---"ভালো লাগছিল না। তাই টিভি দেখতে এসেছি।"

---"টিভি তো তোর রুমেও আছে। ওটা বাদ দিয়ে এখানে বসে টিভি দেখছিস কেন?" 

সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো আদ্র। আয়াজ মুখের সবকটি দাঁত বের করে হাসলো। একহাতে মাথার পেছনের চুল চুলকালো। ক্ষীণ তোতলিয়ে বললো, "আমার রুমেরটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আরকি।"


আদ্রর সন্দেহ কমলো না। তবুও সে এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করে না। টিভিতে আয়াজ তার ভাষণ শুনছে। নির্বাচনের জন্য কালকে সেখানে যেতে হয়েছিল তার। আদ্র আয়াজের পাশে বসে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। হাত ঘড়ি খুললো। শার্টের প্রথম তিনটে বোতাম খুলে হাতা গোটালো। বললো,

---"মা কোথায়? ঘুমিয়ে গেছে?"

---"হ্যাঁ। ঘুমাতে যেতে চাচ্ছিল না। তোর জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি কিছুক্ষণ আগেই ঠেলেঠুলে পাঠিয়েছি।"


শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদ্র। সোফায় মাথা হেলিয়ে চোখ বুঝলো। আয়াজ তার দিকে চিন্তিত নেত্রে তাকিয়ে আছে। টিভির সাউন্ড আস্তে করে কমিয়ে দিলো সে। ডাকলো,

---"ভাই। একটা কথা ছিল তোর সাথে।"

আদ্রর ক্লান্ত গলায় ছোট্ট সম্মতি, "বল।"


আয়াজ সময় নিলো। এলোমেলো গলায় বললো, "বেলাকে আজ সন্ধ্যায় ছেলে পক্ষ দেখতে এসেছিল।"


_______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ১৫

 প্রিয় বেলা


১৫.

আদ্রর ঘোরলাগা দৃষ্টি তখনো স্থির। ঠোঁটের কোণে বাঁকানো হাসির অস্তিত্ব খুব প্রখর ভাবেই আছে। বেলা এলোমেলো ভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ঘন ঘন পলক ফেলছে। আদ্রর চাহনির পরিবর্তন ঘটছে না। সে অনড়, ক্ষান্তহীন। প্রগাঢ়তায় ভরা সেই চাহনির বিপরীতে প্রচন্ড লজ্জায় আড়ষ্ট বেলা। ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,

---"অনেক রাত হয়ে গেছে। আপনার ঘুমানো প্রয়োজন।"


আদ্র শুনলো না বোধহয়। আশপাশটায় একটু তাকালো মাত্র। আরও একবার আপাদমস্তক দেখে নিলো বেলাকে। আদেশ সমেত বললো,

---"ছাদে আসুন।"


রাত্রি গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। কয়েক ঘণ্টা পরই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করবে। বেলার মাথায় ঘোমটা নেই। দিতে ভুলে গেছে সে। বিহান ঘুমের মাঝে নড়চড় করছে বারবার। বেলা সচকিত হলো। মানা করে বললো,

---"আপনি অসুস্থ। সকালও হবে কিছুক্ষণ পর। চলে যান। আমি আসব না।"

বলে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে উদ্যোগী হলো সে। আদ্র রেলিংয়ে দুহাত রেখে আরাম করে দাঁড়ালো। নভস্থলে গভীর দৃষ্টি মেলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো,

---"আমি তবুও অপেক্ষা করবো বেলা। কারণ আপনি আসবেন।"


বেলার পা থমকালো না। বারান্দা পেরিয়ে রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো হালকা শব্দে। দরজার কাঠে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো প্রায় অনেক্ষণ। মুখ থেকে আগত উষ্ণ নিশ্বাসগুলো অবিন্যস্ত হলো। চোখ বুজে এলো। হঠাৎ কি মনে করে জানালার পর্দা অল্প সরালো সে। আদ্র এখনো ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। একইভাবে আকাশপানে কি যেন দেখছে। লোকটা কি সত্যিই এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? বাহিরে শীত কম নয়। শিরশির করে কাঁপিয়ে তোলার মতো। তারওপর আদ্র অসুস্থ। বেলা আর রুমে থাকতে পারলো না। গুটিগুটি পায়ে রুম থেকে বের হলো, ড্রইংরুম পেরিয়ে সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে উঠলো। সর্বশেষে ছাদে এসেই দেখতে পেল আদ্রকে। তার আসার আভাস পেয়ে লোকটা তার দিকে তাকিয়েছে। ঠোঁটে এসে হানা দিয়েছে স্নিগ্ধ হাসি। কি সুন্দরই না লাগছে মানুষটাকে!

বেলা আরেকটু এগিয়ে আসতেই আদ্রর হাসি আরও গাঢ় হলো। অস্থির চোখজোড়া বেলার মুখশ্রী জুড়ে ঘুরতে লাগলো। সে বললো, "আমি জানতাম, আপনি আসবেন।"


আদ্রর পেশিবহুল ফোলা ফোলা হাতের বাহু অনাবৃত। গলা বড় হওয়ায় বুকের ব্যান্ডেজটার ক্ষীণ অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। কপালের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছে সে। চোখের ঠিক ওপরে, ভ্রুয়ের কাছ ঘেঁষে লম্বালম্বি দু'টো দাগ দেখা যাচ্ছে। এমন অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও লোকটা কেমন দিব্যি হাসছে। বেলা দৃষ্টি লুকালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

---"আমি এসেছি। এবার চলে যান।"

---"আপনাকে জড়িয়ে ধরা এখনো বাকি আমার।"


তৎক্ষণাৎ এক কদম পেছালো বেলা। গলা কাঁপিয়ে লহু চিৎকার করলো, "না।"

আদ্র হেসে ফেললো। মেয়েটাকে ভয় পেলেও দারুণ লাগে। দৃঢ় গলায় বললো,

---"এখানে আসুন বেলা। দূরে দূরে দাঁড়াচ্ছেন কেন?"

বেলা এবার একটু রাগ নিয়েই বললো,

---"এক্সিডেন্ট করে আপনার মাথা গেছে একদম।"


বিনিময়ে আদ্র আবারও হাসলো। গুরুগম্ভীর নেত্রজোড়াও চঞ্চল হলো। হিমেল হওয়া হঠাৎই থেমে গেল। নিস্তব্ধ হলো পরিবেশ, তারা দু'জন। আদ্র ঠোঁটের হাসি ধূলিস্যাৎ করে ধারালো কণ্ঠে সূক্ষ্ণতা নিয়ে বললো,

---"আপনাকে আমার কাঁদাতে ইচ্ছে করছে বেলা। আপনার কান্নারত মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে।"


বেলা চমকিত হয়। হকচকিয়ে তাকায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। এত ভয়ংকর কারো ইচ্ছে হয়?


-


ক্লাবে সব দামি দামি জিনিস। দরজা, জানালা সব বন্ধ করা। মাথার ওপর ফুলস্প্রীডে ফ্যান চলছে। সাদা বাতির আলোয় আলোকিত বড়সড় রুমটা। আদ্র টেবিলের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তার সামনেই দলের ছেলেগুলো দাঁড়ানো। তাদের মাঝে মধ্যিকানের তন্ময় নামের ছেলেটি ক্ষীপ্ত গলায় বললো,

---"ভাই, বিপক্ষের ছেলেগুলো এবার বেশি করছে। আমাদের পোস্টারগুলো ছিঁড়ে নিজেদেরগুলো লাগাচ্ছে। কিছু হলেই মারামারিতে এসে যাচ্ছে। আপনি শুধু আদেশ দেন আমরা--।"


তন্ময়কে থামিয়ে দিলো আদ্র। হাতের কিউবটা নাড়াতে নাড়াতে শান্ত স্বরে বললো, "নির্বাচনের বেশিদিন নেই। আর কয়েকদিন যাক। ব্যাপারটা দেখব আমি।"

তন্ময় অসহায় কণ্ঠে বললো,

---" ভাই, আমরা কিছু বলছি না দেখে ওদের সাহস বেড়ে গেছে। আপনার ওপর হামলা করলো। কালকে আবার আমাদের দুজন ছেলের হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। একজনের কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে। আপনি কি এখনও কিছু বলবেন?"


কিউবটা সশব্দে টেবিলে রাখলো আদ্র। তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে প্রকাণ্ড এক হুঙ্কার ছাড়লো,

---"আমাকে আগে জানানো হয়নি কেন?"

---"আপনাকে কল করছিলাম ভাই। আপনি ধরেন নাই।"

আদ্র তবুও রোষপূর্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো তন্ময়ের দিকে। রাগ আর প্রকাশ করলো না। শক্ত কণ্ঠে বললো,

---"আজ রাতেই যা করার করবি। দু'একজন ছুঁড়ি নিলেও প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করবি না। সবাই হকিস্টিক নিবি। যেভাবে পারিস একেকটার হাত-পা ভেঙ্গে দিবি। আর সাবধান। কেউ যেন তোদের চেহারা না দেখে।"


টেবিল থেকে নেমে দাঁড়ালো আদ্র। আকিব এগিয়ে আসলো দ্রুত। বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো,

---"এখন কোথায় যাবেন ভাই?"

---"বাসায়ই যাবো। আসো।"

আদ্র গাড়ির দিকে যেতে লাগলো। আকিবও পেছন পেছন আসলো।


জ্যামে আটকে পরেছে আদ্রর গাড়িটা। এসি চলছে। তবুও গরমে কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে তার। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে। চুল অগোছালো। বিরক্ত মনে জানালা গলিয়ে বাহিরে দৃষ্টি ফেলল সে। ফুটপাতে অল্পবয়সী একটা মেয়ে চুড়ি নিয়ে বসে আছে। কাঁচের চুড়ি। লাল, নীল, কালো, হলুদ, সবুজ। আরও কত রঙের! লাল রঙের চুড়িগুলোয় চোখ আটকে গেল আদ্রর। বেলার কথা মনে পরলো। পাশে বসা আকিবকে ডাকলো,

---"আকিব, শুনো।"

আকিব সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো, "জি ভাই বলেন।"

---"ওখানে চুড়ি দেখছো না? লাল রঙের সব চুড়ি নিয়ে আসো। টাকা নিয়ে যাও।"


আকিব মাথা দুলালো। দ্রুত রাস্তার গাড়ি, রিকশা পেরিয়ে ফুটপাতে বসা মেয়েটি থেকে চুড়ি নিতে লাগলো। আদ্র সেদিকে তাকিয়ে জোড়ালো নিশ্বাস ফেললো। সীটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। বেলার মুখশ্রী ভেসে উঠছে। রাতে না ঘুমানোয় তন্দ্রা এসে জেঁকে বসছে দৃঢ়তার সঙ্গে। আদ্র ঘুমিয়ে যেতে লাগলো। তার আগ অব্দি অস্পষ্ট ভাবে বিড়বিড়িয়ে অভিযোগ করে উঠলো, "আপনি আমার সঙ্গে এভাবে মিশে যাচ্ছেন কেন বেলা? পাগল করে দিচ্ছেন আমায়।"


-


১৮ই মাঘ, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। ঘড়ির কাটায় বিকাল পাঁচটা বাজছে। প্রভা বেগম পায়েস রান্না করেছেন আজ। বেলাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছেন একবাটি পায়েস যেন রেখাকে দিয়ে আসে। বেলা দিরুক্তি করলে শান্ত গলায় কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললেন,

---"ওরা কিছু বানালে আমাদেরকে দেয় নি এমন কখনো দেখেছিস? আমাদেরও তো দায়িত্বে পরে কিছু বানালে ওদেরকে দেওয়ার, তাই না? যা না মা। এমন অবাধ্য হচ্ছিস কেন?"


অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদ্রদের বাড়ি উপস্থির হলো বেলা। রেখা ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসে ছিলেন। টিভিতে সময় চ্যালেন চলছে। দলনেতা হয়ে স্টেজে স্পিচ দিচ্ছে আদ্র। পরনে মুজিব কোর্ট। সবসময়ের মতো ভ্রু কুঁচকে একের পর এক হাঁড় কাঁপানো বাক্য বলে যাচ্ছে সে। কণ্ঠে সে কি তেজ, কাঠিন্যতা, দাম্ভীকতা! সবাই হইহই করে তালি দিচ্ছে।

রেখা বেলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠিক হয়ে বসলেন। মুচকি হেসে বললেন,

---"ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন বেলা? এদিকে আসো। আমার পাশে বসো।"


টিভি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বেলা সোফায় বসলো। পায়েসের বাটিটা রেখাকে দিয়ে বললো,

---"এটা আপনাদের জন্য মা পাঠিয়েছে।"

এমনিতে হলে রেখা এতক্ষণে উৎফুল্লতায় ভরে উঠতেন। অথচ আজকে মুখটা মলিন। একটু করে হেসে বললেন,

---"তোমার মা ভালোই করেছে পায়েস পাঠিয়ে। খেতে ইচ্ছে করছিল।"


বলে পায়েসের বাটিটা টেবিলে রেখে দিলেন। বেলা জিজ্ঞেস করলো,

---"আপনি ঠিক আছেন আন্টি? না মানে, আপনাকে কেমন অসুস্থ লাগছে।"

---"হ্যাঁ। প্রেসার বেড়ে গেছে একটু।" হতাশার নিশ্বাস ফেলে বললেন তিনি।


এর পিঠে বেলা কি বলবে খুঁজে পেল না। ভেতরে ভেতরে চলে যাওয়ার জন্য মন স্থির করতেই হঠাৎ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো আরু। বেলাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো। বললো, "কেমন আছো আপু? আমি এখন তোমার বাসায়ই যাচ্ছিলাম। তোমাকে ডাকতে।"


বেলা অবাক নয়নে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো, "আমাকে ডাকতে? কোনো প্রয়োজন ছিল আরু?"

---"হ্যাঁ, তা তো ছিলই। চলো আমার সঙ্গে উপরে যাবে। আসো।"

বেলা একপলক রেখার দিকে তাকালো। উনি ইতিমধ্যে পায়েস খাচ্ছেন। এদিকে খেয়াল নেই অত। আরুর সাথে উপরে চলে গেল সে। আরু তাকে আয়াজের রুমে নিয়ে এসেছে। সাধারণ, অল্প অগোছালো রুম। স্বাভাবিক ভাবে ছেলেদের রুম যেমন হয়। আয়াজ আগে থেকে বিছানায় বসে ছিল। বেলা আসতেই উঠে দাঁড়ালো সে। বিস্তর হেসে বললো,

---"এসেছো? বসো। তোমার মূল্যবান জিনিসটা আগে দিয়ে দেই। নয়তো ভাই আমাকে আস্ত রাখবে না।"


বলতে বলতে সে আলমারি থেকে একটা প্যাকট বের করে ধরিয়ে দিলো বেলাকে। বেলা সেটা নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। আয়াজ মিটিমিটি হেসে বললো,

---"খুলে দেখো কি আছে।"


বেলার অস্বস্থি হচ্ছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে প্যাকেটটার দিকে তাকালো সে। খুললো। অনেকগুলো লালচুড়ি দেখে বিস্ময় যেন সীমা ছাড়িয়ে গেল। আয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো, 

---"এতগুলো চুড়ি-- কে দিয়েছে?"

উত্তরে আয়াজ আগের ন্যায়ই বললো,

---"ভেতরে একটা কাগজও আছে। বের করে পড়ো। তোমার উত্তর ওখানে আছে।"


বেলা কাঁপা হাতে চুড়িগুলো ক্ষীণ সরালো। হলুদ রঙের কাগজ বেরিয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে। বেলা কাগজটা বের করলো। কালো কালি দিয়ে খুব সুন্দর হাতের লিখা ভেসে উঠছে সেখানে,


---"আপনার হাতের মাপ আমার জানা নেই বেলা। তাই সবগুলোই নিলাম। একদিন এগুলো পরে আমাকে চমকে দেওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।

~আদ্র ইয়ানিদ।"


_________________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ১৪

 প্রিয় বেলা


১৪.

আদ্রর বক্ষস্থলে নিবিড়ভাবে লেপ্টে আছে বেলা। কান্না থেমেছে ক্ষীণ। ডুকরে ওঠার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। গাঢ় নিশ্বাসগুলো আদ্রর শার্ট ভেদ করে শরীরে উষ্ণতা ছুঁয়ে দিচ্ছে যেন। আদ্রর পুরুষালী শক্ত ডান হাতটি মোলায়েম ভাবে বেলার চুলের ভাঁজে রাখা। আলতো করে হাত বোলাচ্ছে সে। লহু স্বরে বলে,

---"শান্ত হন বেলা। শার্ট ভিঁজিয়ে দিয়েছেন আমার। চোখের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে না?"


বেলা সরে এলো তৎক্ষণাৎ। সময় নিলো না। ভীষণ অভিমানী হয়ে অন্যদিকে তাকালো। আদ্র হাসলো। নিঃশব্দে, প্রাণ ভরে, দীর্ঘক্ষণ। ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করলো,

---"আমি আপনার কে হই বেলা? এই পাষাণ নেতার জন্য কাঁদছেন কেন?"


ক্রদনের দরুণ নাকের ডগা রক্তিম হয়ে আছে তার। ফুলে আছে অল্প। নেত্রে পানির অস্তিত্ব না থাকলেও পাঁপড়িগুচ্ছ এখনো ভেঁজা। গালে দাগ বসে গেছে নিষ্ঠুর পানির রেখায়। বেলা অন্যদিকেই চেয়ে রইলো। অভিমান ভুলে বেশ কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিলো,

---"কেউ হন না।"

আদ্র তার রেশ ধরেই বললো,

---"কেউই হই না?"

বেলা জবাব দিতে পারে না। তার আবারও কান্না পাচ্ছে। চিৎকার করে যদি কান্না করা যেত, খুব শান্তি পেত সে। আদ্রর কপালের ব্যান্ডেজটা অস্পষ্ট হয়ে বারবার ভাসছে চোখে। কি করুণ সেই দৃশ্য! কি ভরাবহ! বেলা চোখ বুজে ফেলে। নিশ্বাস নিতে থাকে ধীরস্থির ভাবে।


তার জন্য চিন্তিত, আতঙ্কিত মুখটির দিকে তাকিয়ে এক আলাদা প্রশান্তি অনুভব করলো আদ্র। অধরে হাসি এসে হানা দিলো আরও একবার। মেয়েটা কিভাবে যেন তার সর্বত্র দখল করে নিয়েছে৷ যার কারণ অবশ্য আদ্রর জানা নেই। জানার ইচ্ছেও হয়নি কখনো। কিছু জিনিস না জানাই শ্রেয়। সংগোপনে থাকা কারণটা বুড়ো বয়সে বেলাকে নিয়েই ভাববে সে। পুরোনো দিনের কথা ভেবে দু'জন দু'জনকে জড়িয়ে ধরে হাসবে, উল্লাস করবে। ভাবতেই তো সুখময় আনন্দে মৌ মৌ করছে পরিবেশটা।

বেলার কব্জি জোড় করে টেনে নিজের বুকে আবারও মিশিয়ে নিলো আদ্র। বেলা সরতে চাইলো। বাঁধন শক্ত হলো, গভীরতা বাড়লো। আদ্র থমথমে আওয়াজে সাবধান করলো,

---"নড়বেন না বেলা। হাতে ব্যথা পাচ্ছি কিন্তু।"


বেলা থেমে যায়। ভুলেও আর নড়চড় করে না। লোকটা পাশে থাকলে নিজেকে দূর্বল লাগে তার। শরীরের সব শক্তি রোধ হয়ে কেমন নেতিয়ে পরে। আদ্রর বুকের বা'দিকটায় মাথা রেখে হেলে পরলো বেলা। শার্ট ভেদ করে গলার কাছে নজর যেতেই সাদা রঙের আরও একটি ব্যান্ডেজ দেখতে পেল। বেশ দীর্ঘ ব্যান্ডেজ। দেখা মাত্র সরে আসতে চাইলো বেলা। আদ্র দিলো না। বাধ্য হয়ে ওভাবেই জিজ্ঞেস করলো,

---"আপনার বুকে ওটা কিসের ব্যান্ডেজ?" ক্ষীণ ব্যগ্র শোনালো তার কণ্ঠ। আদ্র নির্বিকার স্বরে উত্তর দিলো,

---"আঁচড় লেগেছে বোধহয়।"

---"সামান্য আঁচড়ে কেউ এত বড় ব্যান্ডেজ করে? আপনার আমাকে বোকা মনে হয়?"


আদ্রর কপালে দৃঢ় ভাঁজের দেখা দিলো, "একদম না।"

বেলা সেকথা কানেই তুললো না। কণ্ঠে নমনীয়তা এনে কাতর গলায় জিজ্ঞেস করলো,

---"মিথ্যে বলছেন কেন আদ্র? এসব কিভাবে হয়েছে? হাত, বুক, কপাল এগুলো ছাড়াও কি আরো ক্ষত আছে?"

---"আছে।"


যতটা শান্ত আর নির্লিপ্ত ভাবে আদ্র কথাটা বললো, তার থেকেও দ্বিগুণ অশান্ত হলো বেলার মন। চোখে দারুণ জ্বালা হচ্ছে। তবে না কাঁদার অসহ্য প্র‍য়ার চালিয়ে যাচ্ছে সে। ধারালো নখ গিয়ে খামচে ধরলো আদ্রর বুকের শার্ট। আদ্র ব্যথা পেলেও কিছু বললো না। বেলা শুকনো গলায় আওড়ালো,

---"আপনি আমাকে এখনো বলছেন না, কিভাবে হয়েছে এসব?"


বেলার কেশবহুল মাথায় নিজের গাল ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো আদ্র। ওয়ানওয়ে রোড দিয়ে মাঝে মাঝে ট্রাক, গাড়ি সাঁ সাঁ করে চলে যাচ্ছে। বাতাসের গতি একটুর জন্যে বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। সেসময় একটা ট্রাক আদ্রদের গাড়ি অতিক্রম করতেই অনলের ভীষণ তেজি ঝাপটা এসে ছুঁয়ে দিলো তাদের। বেলার চুল আবারও এলোমেলো হলো। আদ্র হাত বাড়িয়ে তা সযত্নে গুঁজে দিলো কানের পেছনে। গম্ভীর গলায় খুব কঠিন করে বললো,

---"এভাবে ভেঙ্গে পড়বেন না বেলা। রাজনীতিবিদদের প্রাণের নিশ্চয়তা থাকে না। আমি তো তাও বেঁচে ফিরেছি। ইনশাল্লাহ এই নির্বাচনে আমারই জয় হবে।"


নখের সাহায্যে খামচে ধরা হাতটা দৃঢ় করলো বেলা। বলতে চাইলো, "রাজনীতি ভীষণ খারাপ আদ্র। ছেড়ে দিননা এসব। নিজের প্রিয়জন থেকেও কি এই পেশা আপনার কাছে বেশি প্রিয়?"


তবে বলা হয় না তা। অতি সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে শুধু। হৃৎপিণ্ডে হাহাকার তৈরি হয়।


-


বেলাকে এলাকার মূখ্য গেটে নামিয়ে গাড়ি ঘোরায় আদ্র। বাসায় এখন যাওয়া যাবে না। নির্বাচনের কিছু কাজও বাকি আছে। আপাতত দলের ক্লাবের উদ্দেশ্যে গাড়ি চালাচ্ছে সে। জানালার কাছে স্থির থাকা ফোনটায় আয়াজের কল আসছে বারবার। আদ্র ধরেনি একবারও। উলটো ফোন সাইলেন্ট করে দিয়েছে। কিন্তু যখন দেখল অনবরত কল দিয়েই যাচ্ছে, তখন সপ্তমবারের কলটি রিসিভ করলো সে। সঙ্গে সঙ্গে আয়াজ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো,

---"এই তোর ফোন কোথায় থাকে? কতবার কল দিয়েছি খেয়াল আছে? কই তুই?"


আদ্র জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকালো একবার। আয়াজের চিৎকার পরোয়া না করে স্বাভাবিক স্বরেই উত্তর দিলো,

---"রাস্তায়। ক্লাবে যাচ্ছি।"

---"তুই অসুস্থ ভাই। এখন অনতত এসব কাজ বাদ দেয়। তোর চিন্তায় কান্না করছে মা। মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।"


আদ্র ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,

---"কয়েকদিন পরই নির্বাচন আয়াজ। এখন কোনোভাবেই কাজে ফাঁকি দেওয়া যাবে না।"

আদ্রর নাছোড়বান্দা ব্যবহারে বেশ বিরক্ত আয়াজ। অনেকটা রাগ নিয়েই বললো,

---"আমার তোকে নিয়ে সবসময় ভয় হয় ভাই। বাবার মতো তোকেও হারানোর ইচ্ছে নেই আমার। তবুও আমি তোর স্বপ্নকে সম্মান করি। প্রাধান্য দেই। কখনো তোকে বাঁধা দেই না। আজ যখন বাঁধা দিচ্ছি তখন তার পেছনে নিশ্চই কারণ আছে। আর কারণটা তুই ভালোভাবেই জানিস। আমি একা মায়ের কান্না থামাতে পারছি না। মা তোকে খুঁজছে বারবার। তুই কি আসবি?"


শুনে আদ্র অনেক্ষণ চুপ রইলো। হাতে ব্যথা পাচ্ছে সে। অবশ হয়ে আসছে যেন। আয়াজ আবারও ডাকতেই গাড়ি বাড়ির পথে ঘোরালো সে। মুখে বললো, "আসছি।"


এরপর বাড়ি আসার পর রেখা এক মুহুর্তের জন্যও কাছ ছাড়া করলেন না আদ্রকে। জড়িয়ে ধরে রইলেন। কাতর কণ্ঠে আহাজারি করে উঠছিলেন,

---"তুই রাজনীতি ছেড়ে দেয় বাবা। আমরা এমনিতেই তো ভালো আছি। ছেড়ে দে না বাবা। রাজনীতিতে কি আছে?"

আদ্র তখন শুধু এটুকুই বলেছিল, "রাজনীতি আমার স্বপ্ন মা।"


-


গভীর রাত। বিছানার এপাশ ওপাশ করছে বেলা। ঘুম আসছে না। কতক্ষণ যে সে এমনিই চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল তার ইয়ত্তা নেই। তবুও চোখে ঘুম ধরছে না। তন্দ্রা যেন তুখর শত্রুতা করেছে তার সঙ্গে। সূদুর হতে এক নাম না জানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘুম না আসার কারণ হিসেবে বেলা সেই পাখিটিকেই দোষারোপ করলো। বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। রাস্তায় মানুষজন নেই। দোকানপাট বন্ধ। যতদূর চোখ যায় সবার বাড়ির বাতি নেভানো। শুধু বাহিরের ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে। ঘুমের অতলে ভাসমান সবাই। একা কি তবে সে-ই শুধু জেগে আছে? প্রশ্নের চাক্ষুষ উত্তর হিসেবে হঠাৎ আদ্রকে ছাদে দেখতে পেল বেলা। আদ্রর বারান্দা দিয়ে যেমন তাদের ছাদ দেখা যায়, তেমনি বেলার বারান্দা দিয়েও আদ্রদের ছাদ দৃশ্যমান।

রেলিংয়ের ওপর স্থির হয়ে বসে আছে আদ্র। হাতাকাটা গেঞ্জি পড়ায় শরীরের ক্ষত গুলো সুস্পষ্ট। বিশেষ করে হাতের ক্ষতটি। রেলিংয়ের ওপাশে পা দু'টো ঝুলিয়ে রেখেছে সে। বেলা আঁতকে উঠলো। লোকটার কি সাহস! ওখানে বসে থাকতে ভয় করছে না? কি নিশ্চিন্তে সিগারেট ফুঁকছে! বেলা না চাইতেই চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,

---"ওখানে বসে আছেন কেন? পরে যাবেন তো। নামুন!"


আদ্র অল্প চমকালেও তা নজরে এলো না। ঘাড় বেঁকিয়ে বেলার দিকে তাকালো সে। বেলাকে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,

---"এখনো ঘুমাননি কেন? বারান্দায় কি?"


বেলা জবাব দেয় না। উলটো আবারও চেঁচিয়ে বলে, "নামছেন না কেন? এমনিতেই আপনি অসুস্থ। এখান থেকে পরলে কি হবে জানেন?"

কথাটা বলে একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায় বেলা। খুব জোড়েই কথা বলে ফেলেছে সে। বিহান বিরক্ত হয়ে ওদিক ফিরে শুয়েছে। বলছে, "এভাবে চিল্লাচ্ছো কেন বুবু? ঘুমাচ্ছি তো!"

বেলা দমে গেল। ছাদের দিকে আড়চোখে তাকাতেই দেখল, আদ্র হাসতে হাসতে রেলিং থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। সিগারেট নেই হাতে। নত বেলার দিকে চক্ষুদ্বয়ের বেহায়া চাহনি স্থির করে প্রশ্ন করলো,

---"আপনাকে কখন বেশি সুন্দর লাগে তা জানেন?"


বেলার জানতে ইচ্ছে করলো খুব। লজ্জায়, জড়তায় মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারলো না। চুপ রইলো। আদ্রর দিকে তাকালোও না। আদ্র বেলার দিকে চেয়েই রইলো। ঘোর লেগে গেছে যেন। আবিষ্ট কণ্ঠে বললো,

---"আপনার কান্না দেখার জন্য হলেও আপনাকে আমার লাগবে বেলা।"


______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ১৩

 প্রিয় বেলা


১৩.

পরিবেশ থমথমে। সেই থমথমে ভাবটা নিমিষেই কাটিয়ে আয়াজ মিটিমিটি হেসে উঠলো। তবুও রেখার তীক্ষ্ণতা কমলো না। তিনি জহুরি দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,

---"এমন মেয়ে কোথায় খুঁজবো আমি, যার সবকিছুতে তুই মুগ্ধ হবি। পছন্দ কি আগে থেকেই করে রেখেছিস নাকি? কে মেয়েটা?"


আদ্র ফোনের স্ক্রীনে মনোযোগ দিলো। গম্ভীর স্বরে বললো, "পরে সময় হলে বলবো। আপাতত জেনে রাখো, তুমি তাকে চেনো।"

ভ্রু কুঞ্চিত হলো রেখার। তিনি মেয়েটাকে চেনেন? তার জানামতে বেশ কিছু মেয়েই আদ্রকে পছন্দ করে। কিন্তু আদ্র কখনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি সেখানে। তাদের সঙ্গে কথা বলতেও কখনো দেখেনি রেখা। তবে কে হতে পারে? মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করলেন তিনি। কৌতূহলী মন উতলা হয়ে উঠলো ভীষণ। মায়ের হাবভাব বুঝে আদ্র আগেই জানিয়ে রাখলো,

---"আমি কিন্তু এখন কিছুই বলতে পারবো না তোমাকে। সময় আসুক। এমনিতেই জেনে যাবে।"


রেখা দমলেন না। চিন্তিত মুখে রাজ্যের ভাবনা জুড়ে দিলেন। আয়াজ তখন বেলাকে জিজ্ঞেস করলো,

---"তুমি বলো তো বেলা, তুমি আদ্র ভাইয়ের পছন্দের মানুষকে চেন?"

আয়াজের ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি খেলা করছে। বেলা হকচকিয়ে যায়। মিনমিন করে উত্তর দেয়,

---"আমি কিভাবে জানবো?"

রেখাও সায় দিলেন। বিরক্ত কণ্ঠে আয়াজকে বললেন,

---"আরে ও জানবে কিভাবে? হাঁদার মতো কথা বলিস কেন?"

আয়াজ নাক কুঁচকে বিড়বিড়ালো, "ও-ই তো জানবে মা। ভাই তো ওকেই জান, প্রাণ সব দিয়ে দিয়েছে।"


__________


রোদ্দুরে বেজায় বিরক্ত নিকষকৃষ্ণ কাকগুলি। কা, কা শব্দে বিশাল তোড়জোড় করছে তারা। অনেকে পাশের ঝিল থেকে স্নান করে কারেন্টের তারে এসে বসেছে। শরীর ঝাকিয়ে গায়ের পানিগুলো ঝেড়ে ফেলছে বারবার। চোখ,মুখ কুঁচকে একবার সেদিকে তাকালো বেলা। কাঁধের ব্যাগটা আরেকটু চেপে নিলো। কলেজ শেষ হয়েছে আরও আধঘণ্টা আগে। কিন্তু রিকশা চালক করিম এখনো আসছেন না। ঘেমে পরনের কামিজ শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গেছে যেন। সরব ফোনে কল এলো তার। ফোন হাতেই ছিল। স্ক্রীনে আদ্রর নামটা ইংরেজী গুটিগুটি অক্ষরে ভেসে উঠছে। বেলা একটু অবাকই হলো। তিনদিন ধরে আদ্রর সঙ্গে দেখা নেই তার। আজ হঠাৎ কল দিলো কেন? পরক্ষণেই বিস্ময় ভাব কাটিয়ে কল রিসিভ করলো সে। কিছু বলার পূর্বেই আদ্র ওপাশ থেকে ডাকলো,

---"বেলা।"


বেলা ক্ষীণ থমকালো। আদ্রর কণ্ঠস্বরে ভাঙ্গা, ভাঙ্গা ভাব। দূর্বলতার স্বতঃস্ফূর্ত আভাস। বেলা নিঃশব্দে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো। ছোট্ট করে জবাব দিলো, "হু।"

---"আপনার ডান দিকে তাকান বেলা।"


বেলা কালবিলম্ব করলো না। তৎক্ষণাৎ তাকালো ডান পাশটায়। কালো রঙের একটা গাড়ি দাঁড় করানো। জানালা দিয়ে অস্পষ্ট আদ্রর মুখশ্রী দেখা যাচ্ছে। বেলা যেন আরও একদফা থমকালো। ভড়কালো, চমকালো, বিমূঢ় হলো ভীষণ। আদ্রর শুভ্র কপাল জুড়ে সাদা রঙের ব্যান্ডেজ বিরাজমান। নিষ্পলক দৃষ্টি বেলার দিকেই। সে চেয়েই রইলো। ওপাশ থেকে আদ্র দূর্বল কণ্ঠে আবার বললো,

---"আমি অপেক্ষা করছি বেলা। এদিকে আসুন।"


ফোন কেটে গেল। আড়ষ্ট, জোড়োসড়ো বেলা ধীরে ধীরে এগোলো গাড়িটির দিকে। গাড়ির কাছাকাছি আসতেই দরজা খুলে দিলো আদ্র। বেলা উঠে বসলো। নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে রইলো ক্ষতবিক্ষত আদ্রর মুখপানে। আদ্র হাসলো ক্ষীণ। ঢিমে আসা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

---"কেমন আছেন?"


বেলা সেকথার উত্তর দিলো না। তার নিশ্বাস আটকে আটকে আসছে। কণ্ঠনালিতে শব্দজোট। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে অধরযুগল। হাত এগিয়ে আলতো করে কপালের ব্যান্ডেজ ছুঁলো সে। ছোট্ট করে শুধু বললো,

---"এসব-- এসব কিভাবে হয়েছে?"


প্রতিউত্তরে আদ্র মুচকি হাসলো। উত্তর দিলো না। গাড়ি স্টার্ট করে ধীর গতিতে চালাতে লাগলো। বেলার অস্থিরতা বেড়ে দ্বিগুণ। চোখে পানি টলমল। আদ্রর হাত ঝাঁকিয়ে বেলা আবার জিজ্ঞেস করলো,

---"বলছেন না কেন? কিভাবে হয়েছে এসব?"

---"আমি এহাতে ইঞ্জুর্ড বেলা। ঝাঁকাবেন না। ব্যথা পাচ্ছি।"


বেলা সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিলো। কিছু বলতে নিলেই তাকে থামিয়ে আদ্র বললো,

---"এখন কিছু জিজ্ঞেস করবেন না বেলা। আমি সব বলব। একটু অপেক্ষা করুন। ড্রাইভ করতে কষ্ট হচ্ছে আমার। একটু নিরিবিলি জায়গায় যেতে চাচ্ছি।"


বেলা নিশ্চুপ হয়ে যায়। নত হলো তার মস্তক। আঁখিজোড়া বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে তার। প্রচন্ড যন্ত্রণা। গাড়ির সামনের কাঁচে ফোন ফিট করে রাখা। যান্ত্রিক শহর পেরিয়ে নিরিবিলি রাস্তায় ঢুকতেই বেজে উঠলো তা। স্ক্রীনে মা নামটা ভাসমান। আদ্র সেদিকে একপলক তাকালো। বেলাকে বললো কল রিসিভ করতে। বেলাও তাই করলো। তৎক্ষণাৎ গমগমে গলায় রেখা বলে উঠলেন,

---"কোথায় তুই?"

আদ্র স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলো,

---"ক্লাবে আছি।"

মুহুর্তেই তেঁতে উঠলেন তিনি,

---"এই তোর লজ্জা করে না? আবারও ওখানে গিয়েছিস কেন? তুই কি আমাকে মেরে ফেলতে চাস আদ্র? প্রথমে তোর বাবা রাজনীতির কারণে মারা গেল। এখন তুইও মরার জন্য এসব করছিস? আমার সুখ কি তোদের সহ্য হচ্ছে না?"


এটুকু বলে থামলেন রেখা। উগ্র মেজাজটা অল্প শান্ত হলো। নমনীয় কণ্ঠে অনুরোধ করলেন,

---"রাজনীতি ছেড়ে দেয় বাবা। কি লাভ এসব করে? তুইও কষ্ট পাচ্ছিস, আমরাও কষ্ট পাচ্ছি। আমাদের কথা অনতত ভাব। ছেড়ে দেয় বাবা।"


আদ্রর জবাব না পেয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলেন রেখা। কাতর স্বরে ডাকতে লাগলেন, "আদ্র শুনছিস বাবা? আদ্র?"


আদ্র জোড়ালো নিশ্বাস ফেললো। প্রতুত্তরে শুধু বললো, "আমার আসতে রাত হবে মা। রাখছি।"

ওপাশ থেকে রেখার কান্নার আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা গেল না।


গাড়ি থামলো তার একটু দূরেই। নির্জন স্থান। রাশি রাশি গাছপালা আর কিছু ট্রাকের আনাগোনা মাত্র।

গাড়ির সব জানালা খুলে দিলো আদ্র। বাঁধা না পেয়ে বাতাসগুলি মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পরলো গাড়ির ভেতর। এলোমেলো হলো বেলার ললাটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কেশ, মাথার ঘোমটা। ক্লান্ত শরীর সীটে এলিয়ে দিলো আদ্র। নির্নিমেষ চোখে তাকালো বেলার নত মুখে। দু'হাত বাড়িয়ে দিলো। নিষ্প্রভ স্বরে আবদার করলো,

---"একটু বুকে আসবেন বেলা?"


বেলা সময় নিলো না। দূরত্ব কমালো। মিশে গেল আদ্রর বক্ষস্থলে।


______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা 


[আজ পর্ব অনেক ছোট হয়েছে। দু'দিন পর দেওয়ায় বড় করে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাসায় মেহমান। কোনোভাবেই গল্প লিখার সময় হয়ে উঠছিল না। যেমন-তেমন করে লিখেছি। আজ একটু মানিয়ে নেওয়ার অনুরোধ। এবং আজ একটু বেশি বেশি মন্তব্য করবেন প্লিজ? পড়তে ইচ্ছে করছে।]

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ১২

 প্রিয় বেলা


১২.

অনলের তীব্রতা বাড়ছে। প্রচন্ড ঝড়ে ওলোটপালোট হচ্ছে সবকিছু। বৃষ্টির সে কি ঝাপটা, শব্দ! অশান্ত বক্ষস্থলে গাঢ় যন্ত্রণা। আদ্রের জড়িয়ে ধরার ধরণ পাল্টেছে। বাঁধন হয়েছে আরও প্রগাঢ়। কাঁধে আগের মতোই কপাল ঠেকিয়ে অনবরত নিশ্বাস নিচ্ছে সে। বেলা একপলক আদ্রকে দেখতে চাইলো। কিন্তু তার কাটা দাগযুক্ত গাল ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না তার। ধীর স্থির বেলা পিঠে থাকা হাতটা আলতো বোলালো। মৃদু স্বরে বললো,

---"শান্ত হন আদ্র। ছাড়ুন।"


আদ্র নিজ জায়গা হতে বিন্দু মাত্র সরলো না। ওভাবেই রইলো। বেলা নিজেকে ছাঁড়ানোর চেষ্টা করে বললো,

---"ছাড়ছেন না কেন? কেউ দেখে ফেলবে।"


আদ্র সরে এলো মুহুর্তেই। তার চোখ এখনো রক্তলাল। কপালে অসংখ্য বলিরেখার ভাঁজ। অনিমেষ চোখে একবার বেলার দিকে তাকালো সে। তার সঙ্গে সঙ্গে বেলাও বৃষ্টিতে কাকভেঁজা হয়ে গেছে। লাল রঙের কামিজটা ভিঁজে একাকার। নিকষকৃষ্ণ কেশ বেয়ে অবিরাম পানি ঝরছে। আদ্র তৎক্ষণাৎ অন্যদিকে তাকালো। প্রশ্ন করলো, "ছাতা এনেছেন?"

বেলা ছোট্ট করে জবাব দেয়,

---"না।"

---"ওদিকটায় গাড়ি রেখে এসেছি আমি। আসুন।"


আদ্র নিজের হাতের মুঠোয় বেলার হাত গুঁজে নিলো প্রবল অধিকার বোধ নিয়ে। বেলা নিশ্চুপ ভাবে তার সঙ্গে হাঁটছে। মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছে তাকে। সুদূরে গাড়ি পার্ক করা। বৃষ্টির দরুণ জনমানবহীন এলাকাটা আরও নিস্তব্ধ লাগছে। গাড়ির দরজা খুলে বেলাকে ঢুকতে ইশারা করলো আদ্র। বেলা বিনা বাক্য ব্যয়ে ভেতরে ঢুকে পরলো। আদ্রও ড্রাইভিং সীটে বসে গাড়ির জানালাগুলো লাগিয়ে দিলো এক এক করে। এসি আগে থেকেই বন্ধ।

পেছনের সীট থেকে একটা কালো রঙা জ্যাকেট নিলো আদ্র। বেলার পানে এগিয়ে দিয়ে বললো,

---"জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে নিন বেলা।"


বেলা বাহিরের তাকিয়ে ছিল। শরীর ভিঁজে থাকার কারণে হঠাৎ হঠাৎ কেঁপে উঠছিল সে। চোখ মুদে আসছিল ক্লান্তিতে। আদ্রর কথায় ঘোর কাটলো তার। চমকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "জি?"

---"আপনার জামাটা একটু বেশিই পাতলা বেলা। জ্যাকেটটা পড়ে নিন।"


বেলা অপ্রস্তুত হলো ভীষণ। অপ্রতিভ ভাবে জ্যাকেটটা নিলো। গায়ে জড়িয়ে নিলো পরক্ষণেই। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আদ্র গম্ভীর স্বরে আবার বললো,

---"আমি করিম আঙ্কেলকে বলে দেব আরও সাবধান হতে। উনার থেকে উনার নাম্বারটা মনে করে নিয়ে নিবেন।"

---"তার আর প্রয়োজন নেই।"

---"কেন?" ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন ছুঁড়লো আদ্র। বেলা মলিন কণ্ঠে বললো,

---"আমি আসলে টিউশনটা ছেড়ে দিয়েছি। নতুন টিউশন না পাওয়া অব্দি এটার ঝামেলা কয়েকদিন নেই।"

---"তাতে কি? আপনার ভার্সিটি নেই? করিম আঙ্কেল ভার্সিটি পৌঁছে দেবেন আপনাকে।"


বেলা কথা বাড়াতে গিয়েও আবার চুপ হয়ে গেল। সে বৃষ্টিতে বেশিক্ষণ ভিঁজতে পারে না। জ্বর, সর্দি, মাথা ব্যথায় নাজেহাল অবস্থা হয়। এখনো মাথা ব্যথার অসহনীয় যন্ত্রণায় চোখ খুলে রাখা দায় হয়ে পরেছে। আস্তে আস্তে শরীরের সম্পূর্ণ ভর সীটে ছেড়ে দিলো বেলা। আধখোলা চোখে অস্পষ্ট দেখতে পেল, গম্ভীর মুখো আদ্র ভ্রু কুঁচকে ড্রাইভ করছে। বেলার দিকে তাকাচ্ছে না। অথচ ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ অব্দি বেলা আদ্রর দিকেই তাকিয়ে ছিল। একমনে, নির্নিমেষ ভাবে।


বৃষ্টি এখনো কমে নি। নির্জন রাস্তার একপাশে গাড়ি দাঁড় করানো। হেডলাইটের আলোয় যা একটু রাস্তা দেখা যাচ্ছে। গাড়ির ছোট বাতিগুলো আদ্র নিভিয়ে দিয়েছে। আবছা আলোয় বেলার ঘুমন্ত মুখখানায় নিষ্পলক চেয়ে আছে সে। গভীর, তৃষ্ণাতুর দৃষ্টিতে। প্রিয়তমাকে মনভরে দেখার তৃষ্ণা। ঘুমিয়ে থাকলেও শীতে মেয়েটার শরীর থেকে থেকে কাঁপছে। নাক লাল হয়ে আছে। আদ্রর ঠোঁটে অকারণেই ক্ষীণ হাসি বিদ্যমান। হাত বাড়িয়ে বেলাকে নিজের বুকে টেনে নিলো সে। একহাতে বেলাকে আঁকড়ে অন্যহাত দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে ঠেলে দিলো অতি সন্তপর্ণে। অধর ছোঁয়ালো তার কপালে। এরপর বেলার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো,

---"শুনছেন বেলা? আপনি পাশে থাকলে আমার ক্লান্তি আসে না।"


__________


সায়েদ সাহেব আজ অফিসে যাননি। বাসা থেকেই জমি বেঁচার কাজগুলো সেরে ফেলছেন। সকালেই একজন লোক নগত দশ লক্ষ্য টাকা দিয়ে গেছেন সায়েদ সাহেবকে। বিনিময়ে নিজের প্রাণপ্রিয় জমিটি লোকটির নামে লিখে দিতে হয়েছে তার। সে থেকে এখন পর্যন্ত সোফায় বসে আছেন তিনি। টেবিলে থাকা এত এত টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন একটু পরপরই। প্রভা বেগম মন খারাপ করে কাজ করছেন। স্বামীর কষ্টে তার ভেতরটাও সূক্ষ্ণ ব্যথায় কাতরাচ্ছে। বিহানও আজ ভদ্র ছেলের মতো চুপচাপ টেবিলে বসে পড়ছে। বাড়িটা কেমন ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে গেছে। শব্দহীন, বিষণ্ণ প্রত্যেকটা মানুষ। বেলা আস্তে করে বাবার পাশে বসলো। মৃদু কণ্ঠে ডাকলো, "বাবা?"


সায়েদ সাহেব যেন শুনতে পেলেন না। বেলা আরও একবার ডাকতেই সম্বিৎ ফিরলো উনার। হকচকিয়ে বললে,

---"কি-- কি হয়েছে?"

বেলা আগের মতোই বললো,

---"এত চুপচাপ বসে আছো কেন? নাস্তা খাবে না?"

---"হ্যাঁ, খাবো। আসলে ক্ষুধার কথা টের পাই নি। বিহানকে ডেকে নিয়ে আয়, যা।"


বলতে বলতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন তিনি। বেশ কয়েকবার প্রভা বেগমকে ডাকলেন জলদি খাবার আনার জন্য। স্বামীর ডাকে প্রভা বেগম হন্তদন্ত পায়ে খাবার নিয়ে এলেন তক্ষুণি। বেলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল সব। পরিবারের এই তীব্র জটিলতা ভেতরে ভেতরে হতাশায় ভরিয়ে দিলো তাকে।


-


টিউশন না থাকায় ভার্সিটির পর বাসায়ই থাকা হয় বেলার। হাতে অত কাজ থাকে না। বাসায় বসে বসে টিভি দেখে নতুবা ঘুমায়। বলা যায়, অনেকটা অলস সময় কাটছে তার। এরমধ্যে বেলাকে একদিন ডেকে নিয়ে এলেন রেখা। সোফায় সামনাসামনি বসিয়ে কিছু মেয়েদের ছবি ধরিয়ে দিলেন। চিন্তিত হয়ে বললেন,

---"দেখো তো বেলা, কোন মেয়েটাকে তোমার বেশি পছন্দ হয়। আমি আসলে বুঝতে পারছি না।"


বেলা হাতে থাকা ছবিগুলোর দিকে তাকালো। খুঁজে খুঁজে সবার শেষে যে ছবিটা ছিল, সেই মেয়েটাকে পছন্দ হলো তার। গায়ের রঙ খুব ফর্সা মেয়েটার। হলুদ শাড়ি যেন জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠেছে। মিষ্টি মুখশ্রী, মায়াময়। রেখাকে ছবিটা দিয়ে বেলা বললো,

---"এই মেয়েটা দেখতে সুন্দর আন্টি।"

রেখা যেন নিমিষেই প্রচন্ড উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন,

---"আমারও এই মেয়েটাকেই খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু ওই যে নীল শাড়ি পড়া একটা মেয়ে আছে না? ওকেও আমার ভালো লেগেছিল। তাই বুঝতে পারছিলাম না কাকে ফাইনাল করবো। তুমি আমাকে চিন্তা মুক্ত করে দিলে।"


বেলা কৃজ্ঞতা সমেত হাসলো। আয়াজ এবার মিটিমিটি হেসে বললো,

---"বেলা, মাকে জিজ্ঞেস করো মা কেন এত মেয়ের ছবি যোগার করেছে।"

আয়াজের কথা শুনে বেলা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো রেখার দিকে। রেখা তখন কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,

---"এত জিজ্ঞাসের কি আছে? বেলাকে আমি এমনিই বলতাম।"

তারপর বেলাকে বললেন,

---"বেলা, এই মেয়েকে আমি আমার ছেলেদের জন্য ঠিক করেছি। আমারও তো ইচ্ছা করে ছেলের বিয়ে দিতে, তাই না? আরুর বিয়েটাও তো হয়ে ফেল। এখন এদের মধ্যে কেউ একজন মেয়েটাকে বিয়ে করলেই শান্তি!"


বেলা আড়চোখে একবার আদ্রর দিকে তাকালো। যে আপাতত ফোন চালাতে মশগুল। আয়াজ দায়সারা ভাবে প্রতিউত্তর করলো,

---"ভাইয়ের টা জানি না। কিন্তু আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না। চৈতি এখনো ছোট। ওর অনার্স শেষ হলেই তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে।"

বেলা বিহ্বল হয়ে প্রশ্ন করলো, 

---"এই চৈতি কে?"

আয়াজ মুচকি হাসলো। ফিসফিসিয়ে বললো, "আমার গার্লফ্রেন্ড।"

ওমনি ছবিগুলো টেবিলে রাখতে রাখতে রেখা বললেন, "এমন চুপিচুপি বলার কি আছে? সব আকাম তো আমার সামনেই করিস। ফাজিল ছেলে। গাঁধা।"


বেলা অবাক হয়ে রেখা আর আয়াজের দিকে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই খুব হাসি পেল তার। নিশব্দে হাসতে লাগলো। রেখা টেবিলের সবগুলো ছবি পাশে রেখে হলুদ রঙের শাড়ি পড়া মেয়েটির ছবি আদ্রর দিকে এগিয়ে দিলেন। প্রবল আগ্রহ নিয়ে বললেন,

---"দেখ তো আদ্র, তোর এই মেয়েটাকে কেমন লাগে?"


আদ্র নেত্রজোড়া ফোনের মাঝেই নিবদ্ধ রাখলো। নির্লিপ্ত স্বরে বললো,

---"ভালো লাগে নি।"

---"তুই দেখেছিস ছবিটা? ফোন রাখ। রেখে টেবিলে থাকা ছবিটার দিকে তাকা।"

আদ্র তবুও তাকালো না। বললো,

---"দেখে লাভ নেই। এদের ভালো লাগবে না আমার।"

রেখা রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন,

---"কেন? মেয়েটা তো সুন্দরই।"


আদ্র বেলার মলিন মুখশ্রীতে গভীর দৃষ্টি ফেলল। অকপটে বললো,

---"আমি এমন মেয়েকে বিয়ে করবো মা, যার সাধারণতায় আমি বারবার মুগ্ধ হবো।"


______________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা


গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ১১

 প্রিয় বেলা


১১.

সূদুর হতে কোয়েল পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। পাষাণ সূর্যটির আজ একটু দয়া হয়েছে বোধহয়। তেজ নেই অত। বেলা রিকশায় উঠে ওড়নাটা কোলে গুটিয়ে বসল। রিকশা চালক তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

---"কেমন আছেন মা? আইজকা এত দেড়ি কইরা আইলেন যে? শরীর সুস্থ আছে?"


বিনিময়ে হাসলো বেলাও, "জি চাচা। ঠিক আছি। আসলে ঘুমাচ্ছিলাম তো। আসতে সত্যিই দেড়ি করে ফেলেছি।"

---"ওহ্! আমি আরও ভাবছিলাম আফনি আর আইবেনই না। যাত্রী একখান উঠাইতেও নিছিলাম। শুধু দামে পটে নাই।"


বেলা বিনয়ী ভঙ্গিতে বললো,

---"আপনার আমার জন্য শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন নেই চাচা। আমি কোন সময় টিউশন করি না করি, তার ঠিকঠিকানা আমার নিজেরও জানা নেই। আপনি কষ্ট করে আর দাঁড়িয়ে থাকবেন না।"

এ কথার পিঠে শব্দ করে হাসলো রিকশা চালক করিম। বললো,

---"আরে কি কন মা? কষ্ট কিসের? আদ্র স্যার আমারে বিশ্বাস কইরা কাজখান দিসে, এইডাই আমার জন্যে অনেক। উনি না থাইকলে এই রিশকাডাও চালাইতে পারতাম না। পরিবার নিয়া না খাইয়া মরতে হইতো।"


বেলা শুনলো। তবে কিছু বললো না। ট্রাফিকের লালবাতি জ্বলে উঠতেই থেমে গেল সব গাড়ি। সেই সঙ্গে তাদের রিকশাও থেমে গেছে। বেলা বিরক্ত হলো খুব। এমনিতেও আজ বের হতে দেড়ি করে ফেলেছে সে। তার ওপর এই জ্যাম! বিরক্তিতে বারকয়েক তপ্ত নিশ্বাস ফেললো সে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যান্ত্রিক শহরটাকে দেখতে লাগলো। জ্যাম ছাড়তে এখনো ক্ষীণ দেড়ি। যানবাহনের ভীড় খুব।

এদিক-ওদিক নজর ঘুরাতে ঘুরাতে হঠাৎ ডান পাশের ফুটপাতে দৃষ্টি স্থির হলো বেলার। আদ্র ইয়ানিদ তার দলবল নিয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে। পরনে সাদা পাঞ্চাবী। ফর্সা মুখটা ঘেমে রক্তিম রঙ ধারণ করেছে। চোখে কি ভয়ংকর তীক্ষ্ণতা। যেন কোনো বিষয়ে ভীষণ বিরক্ত সে। নাকমুখ কুঁচকে পাশের ছেলেটাকে ধমক দিচ্ছে একটু পরপর। সবার হাতেই অনেকগুলো কাগজ, কার্ড। বেলা চেয়েই রইলো। আঁখিজোড়া দৃষ্টি ফেরাতে নারাজ। রিকশা চালক আদ্রকে দেখতে পেলেন। উৎফুল্ল মনে হেসে বললেন,

---"মা, ওইটা আদ্র স্যার না? সাইমনে তো ভোট হইবো। ওইটার লাইগাই বাইর হইছে মনে অয়। খাঁড়ান, উনারে ডাকি।"

বেলা সঙ্গে সঙ্গে মানা করে উঠলো,

---"দরকার নেই চাচা। উনি হয়তো ব্যস্ত।"


রিকশা চালক হতাশ হলো। তবুও বেলার মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে বললো, "আইচ্ছা। আফনি যা ভালো মনে করেন।"


আদ্র বেলাকে দেখতে পায় নি। ব্যস্ত পায়ে চলে গিয়েছে সেখান থেকে। বেলা অন্যমনস্ক হয়ে পরে। ভাবে, কি কঠিন লোককে নিজের মন দিতে বসেছে সে। যার সাথে স্বাধীন ভাবে দেখা করা নিষেধ, কথা বলা নিষেধ। এই নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই মানুষের ঝোঁক থাকে বেশি। বেলারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। একে একে চলতে শুরু করেছে সকল যানবাহন।


__________


সন্ধ্যা সাতটা বেজে পয়তাল্লিশ। রাত হয়ে গেছে প্রায়। চিন্তিত বেলা বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বাহিরের অবস্থাও ভালো নয়। বৃষ্টি হচ্ছে। মুষলধারে বৃষ্টি। বেলা একবার নূপুরের দিকে তাকালো। মেয়েটির লেখা শেষ প্রায়। একটু পর খাতাটা তাকে দিতেই বেলা দ্রুত দেখে নিলো লেখাটি। কিছু বানান শুধরে দিলো। শেষে পড়া দাগিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতে নিলেই নূপুরের মা ঢুকলেন রুমে। বেশ কাঠখোট্টা মহিলা তিনি। খুঁতখুঁতে স্বভাবের। বেলা তাকে দেখে মৃদু কণ্ঠে সালাম দিলো। মহিলা সালামের উত্তর নিলো না। গমগমে স্বরে বললো,

---"তুমি এমন করলে তো হচ্ছে না বেলা। এত গাফলতি করলে আমার মেয়েকে পড়ানোর দরকার নেই। প্রতিদিন, প্রতিদিন দেড়ি করে আসলে আমার মেয়ে বাকি পড়া পড়বে কখন?"


বেলা একপলক নূপুরের দিকে তাকালো। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে খাতা দাগাচ্ছে। অত্যন্ত নম্র স্বরে বেলা বললো,

---"আমিও মানুষ আন্টি। মাঝে মাঝে দেড়ি হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে আমি তো ইরেগুলার নই। পারলে শুক্রবারও পড়িয়ে যাই ওকে।"


উনার ভালো লাগলো না বেলার কথাগুলো। মুখ কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললেন,

---"এতসব আমি জানি না। তুমি যদি টাইম মতো না আসতে পারো তাহলে আমার মেয়ের জন্য অন্য টিচার খুঁজতে বাধ্য হবো আমি।" 


বেলার এবার প্রচন্ড রাগ হলো। তবে তা প্রকাশ করলো না সে। খুব শান্ত ভাবে হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,

---"তবে নতুন টিচার খোঁজা শুরু করে দিন আন্টি। আমি আর নূপুরকে পড়াতে পারছি না।"


নূপুরের মা চোখ বড় বড় করে তাকালেন। বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললেন,

---"মানে? কি বলছো এসব? কয়েকদিন পর আমার মেয়ের পরীক্ষা। আমি এখন নতুন টিচার পাবো কোথায়?"


বেলা মুচকি হেসে প্রতিউত্তর করলো,

---"তা আপনার আগে ভাবা উচিত ছিল আন্টি। আসি। ভালো থাকবেন।"


বেলা বেড়িয়ে পরলো ঠিকই কিন্তু ভেতরে ভেতরে চিন্তায় ভীতুগ্রস্ত সে। বাহিরের অবস্থা আশংকাজনক। এদিকটায় রিকশা, সিএনজির দেখা মেলা মানে মূল্যবান কিছু পাওয়া। তারওপর ছাতাও আনেনি সে। জবুথবু হয়ে নূপুরদের বাড়ির সদরের দিকটায় দাঁড়ালো বেলা। ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো। ডায়াললিস্ট থেকে আদ্রর নম্বর বের করলেও কল দিতে ভীষণ দ্বিধাবোধ করছে সে। সামনে তাকিয়ে একবার বৃষ্টি পরখ করে নিলো বেলা। এরপর অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কল লাগালো আদ্রকে।


একবার রিং হলো, দু'বার রিং হলো, তৃতীয় বারের সময় কল ধরলো আদ্র। তবে কিছু বললো না। বেলা মিনমিনে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

---"হ্যালো। শুনছেন আপনি?"

আদ্রর গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন,

---"কোথায় আপনি? বাসায় পৌঁছেছেন?"

---"না। বৃষ্টির কারণে বের হতে পারছি না।"

---"করিম আঙ্কেল নিতে আসেন নি আপনাকে?"

---"আসেন নি বোধহয়। আমি দেখছি না উনাকে। এখানে গাড়িঘোড়াও নেই। আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে যাবো।"

সে কোমলস্বরে বললো,

---"আপনি এখন কোথায়?"

---"স্টুডেন্টের বাসায়ই আছি।"


আদ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো, "ওখানেই থাকুন। আসছি আমি।"


-


আধঘণ্টা পার হয়ে গেল। আদ্রর দেখা নেই। ক্ষীণ ভয়টা এবার মারাত্বক হলো যেন। শীতও লাগছে প্রচন্ড। বেলা বাসার একটু ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালো। সিঁড়ির কাছে। 

আদ্র এলো তার কিয়ৎক্ষণ পরই। বাসার কোথাও বেলাকে না দেখতে পেয়ে নিমিষেই বুক ভারী হলো তার। অস্থির চিত্বে আশপাশটায় আবারও চোখ বুলালো। নিশ্বাসের গতি এলোমেলো। হৃদযন্ত্রের আওয়াজ অস্বাভাবিক দ্রুত। বেহিসাবি হয়ে উঁচু কণ্ঠে ডাকতে লাগলো বেলাকে। প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে সেই ডাকটি অস্পষ্ট হলেও শুনতে পেল বেলা। সে দ্রুত পদে বেড়িয়ে এলো বাসা থেকে। আদ্রর পরনে এখনো সেই সাদা পাঞ্চাবী। যা বৃষ্টিতে ভিঁজে তার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। চোখের শিরা-উপশিরা লাল আভায় সিক্ত। হাঁপাচ্ছে সে। স্থির দৃষ্টি বেলার মুখপানে। বেলা আলতো করে ডাকতে চাইলো, "আদ্র---।"


আদ্র সময় নিলো না। এগিয়ে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। কাঁধে কপাল ঠেকিতে চুপ করে রইলো অনেক্ষণ। বেলা তার কাঁপা হাতটি আদ্রর পিঠে রাখলো। আশ্বস্ত করে বললো,

---"অস্থির হবেন না। আমি ঠিক আছি।"


আদ্র শুনলো না। ওভাবেই রইলো। তারপর একটু শান্ত হতেই নিষ্প্রাণ স্বরে আওড়ালো,

---"আমি আপনাকে অনেক খুঁজেছি বেলা।"


_____________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

গল্প প্রিয়_বেলা পর্ব ১০

 প্রিয় বেলা


১০.

নির্জন, নিস্তব্ধ চারিপাশ। আকাশে জ্বলজ্বল করছে অসংখ্য তারা। দূর থেকে মৃদু আলোর ক্ষীণ ছটা পরছে বেলার মুখশ্রী জুঁড়ে। বাতাসে প্রেমময় ঘ্রাণ। অথচ মলিন তার আঁখিজোড়া। মাথা নত করা। ধীরে ধীরে চোখ তুলে আদ্রর দিকে তাকালো সে। খুব আস্তে করে বললো,

---"আপনি সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন। কি বলছেন আপনি নিজে জানেন?"


আদ্র ভ্রু কুঁচকালো, "জানবো না কেন?"

---"আপনি দয়া করে এসব কথা আর বলবেন না। আমার কাছ থেকে দূরে থাকুন।"

আদ্র পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। স্বাভাবিক স্বরে বললো,

---"নিজের অস্তিত্ব থেকে দূরে সরে যেতে বলছেন বেলা?"


যেন কোথাও খুব জোড়ে বাজ পরলো। সেই শব্দে কেঁপে উঠলো বেলার সর্বাঙ্গ। শিরা-উপশিরায় তৈরি হলো অস্থির কম্পন, শিরশির অনুভূতি। আদ্রর চোখে না পাওয়া আকুলতা। দৃষ্টি গভীর সমুদ্রের ন্যায়। কতগুলো অব্যক্ত কথার অভিব্যক্তি। বেলার মন যেন নিমিষেই পাথরে পরিণত হলো। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে সে শক্ত কণ্ঠে বললো,

---"আপনি ভুল করছেন।"

---"একদম না।"

---"রাজনীতিবিদরা খারাপ হয়।"

---"কে বলেছে?"

---"বাবা।"

---"আপনারও তাই মনে হয়?" অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো আদ্র। 

বেলা সময় নিলো না। আদ্রর চোখে চোখ রেখে আগের ন্যায়ই জবাব দিলো, "হ্যাঁ।"


আদ্র থমকালো। চেহারায় এক মুহুর্তের জন্য বিস্ময় ভাব বাড়লেও পরক্ষণেই তা ফিকে পরে গেল। মুখশ্রী হলো গম্ভীর, দাম্ভিকতায় পূর্ণ। ঠোঁটে হাসির রেশ মাত্র নেই। চোয়ালে শক্ত দার। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে সে ভীষণ কঠিন গলায় বললো,

---"তবে পছন্দ করা শুরু করে দিন বেলা আহসান। এই রাজনীতিবিদেরই হবেন আপনি।"


বেলা বেশিক্ষণ আদ্রর পানে তাকিয়ে থাকতে পারে না। চোখ জ্বালা করছে তার। কণ্ঠ কাঁপছে। আদ্র থেকে দূরে সরতে চাইলে সে স্বেচ্ছায় সরে যায়। একপলক বেলার দিকে অনিমেষ চাহনি নিক্ষেপ করে রেলিং টপকে চলে যায় ওই ছাদে।

বেলা এতক্ষণ ঘোরে ছিল। এইমাত্র সম্বিৎ ফিরলো তার। দ্রুত ছাদের মেঝে থেকে কাপড়গুলো উঠিয়ে ছাদ থেকে যাওয়ার জন্য উদ্যাগী হলো। পেছন থেকে আদ্রর থমথমে গলা শোনা গেল,

---"আমি কিন্তু আমার কথার অমান্য করি না বেলা। আপনি শুধু আমারই হবেন।"


বেলা দাঁড়ায় না। ব্যগ্র হয়ে সামনের দিকে একেকটা পা ফেলে।


__________


আলমারি থেকে একটা অল্প কাজ করা শাড়ি বের করে তা পরে নিলো বেলা। তার শাড়ি পড়া হয় না অত। তাই আলমারিতে শাড়ির সংখ্যাও খুবই নগন্য। মায়ের শাড়িগুলো অতিরিক্ত ভারী। ওসব পড়তে ভালো লাগে না তার। নিজেকে কেমন একশত কেজি ওজনের মহিলা মনে হয়।

শাড়ির কুঁচি অল্পসল্প ঠিক করে চুলগুলো খোঁপা করে নিলো সে। সাজ বলতে একটু কাজল। পাশের বাসায়ই তো যাবে সে। সেখানে এত সাজগোজ করতে হবে কেন? আয়নার দিকে একপলক তাকালো বেলা। নিজের প্রতিচ্ছবিতে এক সাধারণ রমণীকে দেখা যাচ্ছে। যার কেশগুলো খোঁপা করা সত্ত্বেও খুব এলোমেলো, অগোছালো, নিয়ন্ত্রণহীন। দু'হাত উঁচিয়ে কোনোভাবে আবারও খোঁপা করে নিলো সে। একহাতে কুঁচি সামলে রুম থেকে বের হয়ে ড্রইংরুমে আসলো। প্রভা বেগম বিহানের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলেন। বিহানও বেলার রঙয়েরই একটা পাঞ্চাবী পরে আছে।

বেলাকে ভীষণ সাদাসিধে পোশাকে থেকে একটু রেগেই গেলেন তিনি। কপাল কুঁচকে মৃদু ধমক দিয়ে বললেন,

---"এটা কি ধরণের শাড়ি পরেছিস বেলা? মুখে তো কিচ্ছু লাগাসই নি মনে হয়। তুই কি আমার নাক কাটাতে চাচ্ছিস সবার সামনে? বিয়ে বাড়িতে কেউ এভাবে যায়?"

বেলা বিরক্ত হয়ে বললো,

---"পাশের বাড়িতেই তো যাবো মা। সেখানে এত সাজার কি আছে? শাড়ি পরতে বলেছ পরেছি। তাছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান তো আর হচ্ছে না। আরুর আক্ত হবে শুধু।"

মেয়ের কথায় অসন্তুষ্ট হলেও প্রকাশ করলেন না প্রভা বেগম। ক্ষীণ রয়েসয়ে বললেন,

---"আচ্ছা, না সাজলি। অনতত শাড়িটা তো পালটা! আলমারির একদম সামনেই আমার নীল শাড়িটা আছে। ওটা পর গিয়ে, যা।"


বেলা এবার তীব্র প্রতিবাদ জানালো, "মা, আজকে আরুর বিয়ে। আমার না। নীল শাড়িটা কত কাজ করা তুমি জানো না? ছোটখাটো একটা কাঁচের লাইট লাগবে আমাকে।"

বলে প্রভা বেগমকে সুযোগ না দিয়ে আবার বিহানকে বললো,

---"তোর কি রেডি হওয়া হয়েছে? হলে আয়। আমি এখনই বের হবো।"

বিহান তড়িৎ গতিতে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বেলার কাছে আসতে আসতে বললো,

---"আমি রেডি। চলো।"

যাওয়ার আগে একবার মায়ের দিকে তাকালো বেলা। তিনি মুখ ফুলিয়ে বসে আছেন। তা দেখে সে হাসলো একটু। জিজ্ঞেস করলো, "তোমরা কখন ওখানে যাবে মা?"


প্রভা বেগম হতাশ গলায় বললেন,

---"তোর বাবা অফিস থেকে আসলেই যাবো।"


__________


নিস্তব্ধ বাড়িটা হুট করেই মানুষে ভরে গেছে। তাদের কাউকেই চেনে না বেলা। কয়েক হাত দূরে এখনো কিছু লোক গাঁদাফুল দিয়ে বাড়ি সাজাতে ব্যস্ত। বিহানের হাত ধরে এদিক-ওদিক তাকালো সে। ভীষণ অস্বস্থি হচ্ছে তার। রেখাকেও কোথাও দেখছে না। এরমধ্যে বিহানও হাত ছাঁড়ার জন্য বারবার বলছে। রেগে গিয়ে বেলা চোখ রাঙিয়ে তাকালো,

---"এমন শুরু করেছিস কেন বিহান? চুপচাপ দাঁড়াতে পারিস না? কি হয়েছে?"


বিহান তখন নাকমুখ কুঁচকে উত্তর দিলো, "ওইযে, ওখানে মনেহয় আয়াজ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। চলো উনার কাছে যাই।"


বিহানের ইশারাকৃত স্থানে বেলাও তাকালো। দূর থেকে আদ্রর চোখের দাগটা নজরে এলো না তার। সুতরাং আদ্রকে আয়াজ ভেবেই সেদিকে এগোলো সে। আদ্র তখন ফোনে কি যেন করছিল। বেলা মৃদু স্বরে ডেকে বললো,

---"আয়াজ ভাইয়া, রেখা আন্টি কোথায় জানেন?"


আদ্র ফোন থেকে চোখ সরালো। আপাদমস্তক দেখে নিলো বেলাকে। তারপর প্রচন্ড অনীহা প্রকাশ করে ফোনের স্ক্রীনে দৃষ্টি স্থির করলো আবার। বেলা আদ্রর সূক্ষ্ণ দাগটা দেখতেই চুপসে গেল। নেত্রজোড়া হলো অস্থির। আদ্র এখনো গালে ব্যান্ডেজ করে নি। সে মনে মনে ভাবলো, এত বেপরোয়া কেন লোকটা?

তক্ষুণি আদ্র গম্ভীর স্বরে বললো, "উপরের প্রথম রুমটায় আম্মু আছে। আরুর কাছে।"

এরপর আর কিছু বলে নি আদ্র। বেলাকে 'ধন্যবাদ' বলার সময়টুকুও দেয় নি। চোখ ধাধানো উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে মাত্র। আদ্রর এহেন উদ্ভট আচরণে কিংকর্তব্যবিমুঢ় বেলা। কাল সন্ধ্যায়ও এমনই উপেক্ষা করেছিল আদ্র। বেলা বুঝতে পারছে না, আদ্র এমন ব্যবহার করছেই বা কেন?


ভাবনার অকুল পাথারেই হাত ছেড়ে দৌঁড়ে অন্যদিকে চলে গেল বিহান। সবার সম্মুখে বেলা ধমক দিতে পারলো না। বিহানকে রেখেই উপরে চলে গেল। সিঁড়ির কাছের রুমটায় একবার উঁকি দিতেই রেখাকে দেখতে পেল। আরুকে গহনা পরিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। উৎফুল্লতায় মুখশ্রী জ্বলজ্বল করছে উনার। ঠোঁটে অমায়িক হাসি। রুমের দরজায় চোখ পরতেই বেলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে উঠলেন রেখা,

---"ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন বেলা? এদিকে আসো।"


বেলা আস্তেধীরে উনার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রেখা প্রফুল্ল মনে আবারো বলে উঠলেন,

---"দেখো তো বেলা, আমার মেয়েটাকে সুন্দর লাগছে না?"

বেলা আরুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, "জি আন্টি। আরুকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।" 

আরু মাথা নিচু করে লাজুক হাসলো। একপলক বেলার দিকে তাকিয়ে বললো, "আপনাকেও খুব সুন্দর লাগছে আপু।"


-


বরপক্ষ এসে পরেছেন। তা নিয়ে তোড়জোড় একটু বেশিই শুরু হয়ে গেছে চারপাশটায়। বেলা সবার সঙ্গে ড্রইংরুমের পাশটায় যাচ্ছিল। হঠাৎ কেউ তার হাত ধরে আঁটকে দিলো। টেনে নিয়ে যেতে লাগলো সামনের দিকে। বেলা ভীতু নয়নে হাতটির মালিকের দিকে তাকালো। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। পরনে কালো রঙের পাঞ্চাবী। চুল ভেঁজা। এইমাত্র গোসল করে এসেছে বোধহয়। বেলা তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেললো এটা আদ্র। সে তাকে বাড়ির পেছনের দিকটায় নিয়ে এসেছে। লম্বালম্বি বারান্দায়। 

বেলার হাত ছেড়ে দিলো সে। কপালের ভেঁজা চুলগুলো একহাতে ঠেলে বললো, "এত সাধারণ ভাবে না আসলেও পারতেন বেলা। এভাবে আমাকে অশান্ত না করলেও পারতেন।"


বেলা ঠোঁট কামড়ালো। অপ্রস্তুত হলো খুব। ভড়কালো। বলতে চাইলো, "আপনি তখন ওভাবে কথা বলছিলেন কেন?"

---"আপনিই তো বলেছেন দূরে থাকতে।"

---"কিন্তু আমি---" থেমে গেল বেলার কণ্ঠ। আদ্র এগিয়ে এলো। ছুঁয়ে দিলো বেলার নেত্রপল্লব। বেলা চমকিত হয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। পাঁপড়িগুচ্ছে বৃদ্ধাঙ্গুল চালাতে চালাতে আদ্র অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে বললো,

---"সামনে ইলেকশন বেলা। আমি যখন-তখন, যে কারো সামনে আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারবো না। শত্রুরা ওত পেতে থাকে আমার ক্ষতি করার জন্য। আপনাকে আমার সঙ্গে দেখলে আপনারও ক্ষতি করতে চাইবে। আমি সেটা অবশ্যই চাইবো না বেলা।"


আদ্র থামলো। বেলা তখনো চোখ মেলে নি। শক্ত মনে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রর খুব নিকটে। অতি ঘনিষ্ঠে। আদ্র বেলার বন্ধ চোখে চেয়ে থেকে ঢিমে যাওয়া স্বরে আবার বললো,

---"বেলা, আপনি আমার দূর্বলতা নন, শক্তি হবেন। অপ্রিয় নন, প্রিয় বেলা হবেন।"


___________


চলবে~

ঈশানুর তাসমিয়া মীরা