গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ১৩

 #টক_ঝাল_মিষ্টি 

#তামান্না_আঁখি 

#পর্ব-১৩


শাহাদ তার সামনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। লোকটার মুখ সাদা একটা কাপড় দিয়ে প্যাঁচানো শুধু চোখ দুটো দৃশ্যমান।শাহাদ লোকটার চোখের দিকে তাকালো। এই দৃষ্টি তার অবচেতন মনকে সচেতন হওয়ার ইংগিত দিচ্ছে। হঠাৎ লোকটা তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে রি*ভলবার বের করে শাহাদের দিকে তাক করলো।শাহাদ চমকে গেলো। তাকে আরো চমকে দিয়ে লোকটা ট্রিগার টিপে দিলো। ট্রিগারে আঙুল দেয়া মাত্রই শাহাদ লোকটার কবজি ধরে হাতটা উপরে তুলে ফেললো।যার ফলে গু*লিটা হলো আকাশের দিকে। গু*লির শব্দে চারপাশের সব থেমে গেলো। লোকটা গু*লি মিস হতেই অপর হাত দিয়ে ঘুষি দিলো শাহাদকে।শাহাদ কিছুটা টলে গেলো, রিভলবার ধরে রাখা হাত টা আরো চেপে ধরে পা দিয়ে প্রবল গতিতে লোকটার হাঁটু বরাবর আঘাত করলো। পায়ে আঘাত পেয়ে লোকটা হাঁটু ভেঙে  কিছুটা নিচু হয়ে গেলো।নিচু হয়ে প্রবল আক্রোশে সে আবারো শাহাদকে গু*লি করতে চাইলো তবে রি*ভলবার ধরে রাখা হাতটা শাহাদের আয়ত্ত্বে  থাকায় এবারের গু*লিও মিস হলো। শাহাদ এইবার ঘুষি দিলো লোকটার মুখে। পায়ের আ*ঘাতে আগে থেকেই ধরাশায়ী ছিলো এইবার মুখে আ*ঘাত পেয়ে মাটিতে ছিটকে পড়লো।হাত থেকে রি*ভলবার টা ফসকে গেল। 

পুরো এরিয়াতে গন্ডগোল লেগে গেছে।ছেলেরা সব চিৎকার করছে, কোথা থেকে গু*লিটা এসেছে সবাই তা নির্ধারন করে সেদিকে ছুটতে ব্যস্ত।গার্ডরা কয়েকদফা ব্রাশ ফা*য়ার করলো। সব গেস্টরা যেন ঘটনাস্থলে না যেতে পারে তাই তাদেরকে নিরাপদ দূরত্বে আটকে রাখা হলো।


মাটিতে পড়ে গিয়ে লোকটা আরো ক্ষেপে গেলো।শাহাদ লোকটার দিকে হাটু ভেংগে বসলো।হাত দিয়ে মুখের কাপড়টা সরাতে নিলে পাশে পড়ে থাকা একটা ভাঙা ইট তুলে শাহাদকে আঘাত করলো। শাহাদ "আহ" শব্দ করে কপালে হাত দিয়ে বসে পড়লো। গার্ডগুলো ততক্ষনে চলে এসেছে। দূর থেকে শাহাদকে আঘাত করতে দেখে লোকটার আশেপাশে গু*লি করলো তারা। আগন্তুক লোকটা পালানোর জন্য উঠার চেষ্টা করে দাঁড়ালো কিন্তু হাঁটুতে শাহাদের করা আঘাতের জন্য তার পক্ষে দাঁড়ানোই কঠিন হয়ে গেছে দৌড়ানো তো অনেক পরের ব্যাপার।গার্ডগুলো এসে লোকটাকে ঘিরে ব*ন্দুক তাক করে চারপাশে দাঁড়ালো। কয়েকজন গিয়ে শাহাদকে তুললো।জিজ্ঞেস করলো-

"স্যার,আর ইউ ওকে?"


শাহাদ এক হাত কপালে চেপে অন্য হাত উঠিয়ে যন্ত্রনাজড়িত কন্ঠে বললো-

"ইয়াহ আ'ম ওকে।"


তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল- 

"এর মুখের কাপড় সরাও।"


একটা গার্ড কাপড় সরালো। বাইশ -তেইশ বছরের একটা ছেলে, তার চোখেমুখে হতাশার ছাপ।হয়তো শাহাদকে খু*ন করতে পারেনি বলদ হতাশ।শাহাদ ছেলেটির চোখের দিকে তাকালো। চোখে পানি টলমল করছে। মুখে আক্রোশ থাকলেও চোখ দুটোতে গভীর বিষাদ লুকিয়ে আছে।তমালসহ অন্য সব ছেলেরা হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এলো।তারা একদম বাড়ির কোনার দিকের বাগানে বসে মজামাস্তি করছিলো তাই আসতে সময় লেগেছে।তমাল দৌড়ে এসে চোখ বড় বড় করে বলল-


"ভাই তোমার কপাল থেকে র*ক্ত পড়ছে।"


তারপর ছেলেটির দিকে তেড়ে গিয়ে ছেলেটির কলার চেপে বললো-

"কু**ত্তার বাচ্চা তোরে কে পাঠাইছে বল?"


একটা ছেলে এসে শাহাদকে রুমাল দিলো।শাহাদ রুমাল কপালে চেপে ধরে বললো-

"তমাল ছাড় ওকে।"

  

তমাল ছেড়ে দিলো লোকটাকে।ছেড়ে দিয়ে শাহাদের কাছে এলো। শাহাদ গার্ডগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলল- 

"ওর মুখটা ঢেকে নিয়ে যাও, আউটহাউজে আটকে রাখো। কেউ যেন ওর খবর না জানে।"


রেজিয়া সুলতানার কন্ঠ শোনা যাচ্ছে, উনি শাহাদের নাম ধরে ডেকে ডেকে এদিকেই আসছেন।শাহাদ গার্ডগুলোকে ইশারা দিয়ে চলে যেতে বললো। গার্ডগুলো লোকটার মুখ ঢেকে নিয়ে চলে গেলো আউটহাউজের দিকে। রেজিয়া সুলতানার সাথে আশফাক খান আর আব্দুল গাফফার খানকেও দেখা গেলো। সবাই চিন্তিত ভঙ্গিতে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসছে।বাড়ির এই দিকে হলুদের স্টেজ হওয়ায় দূর থেকে এই দিকটা দেখা যায় না।হলুদের স্টেজটার পিছন দিক দিয়ে এদিকে আসতে হয়। রেজিয়া সুলতানা শাহাদকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে আসলেন। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন-


"কি করেছে তোকে? র*ক্ত কেন? কোথায় গু*লি লেগেছে?"


শাহাদ কপাল থেকে রুমালটা সরিয়ে দেখিয়ে হাসিমুখে বললো- 

"কপালটা একটু কেটেছে মা।গু*লি লাগেনি।"


রেজিয়া সুলতানার চোখ টলমল করছে।গু*লাগু*লির শব্দ শুনে এখানে আসার পথে শাহাদের ক্ষতি হয়েছে এমন কুচিন্তাই মাথায় এসেছে  শুধু।এখন নিজ চোখে শাহাদকে ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি দম ফেললেন। শাহাদের হাসি দেখে শাহাদের গালে একটা আস্তে করে চড় মেরে বললেন-

"হাসছিস কেন? এইভাবে এই নীরব জায়গায় আসতে কে বলেছে? এদিকটাই মানুষ কম দেখিস নি?"


মায়ের চড় আর বকুনি খেয়ে শাহাদের হাসি আরো বিস্তৃত হলো।আশফাক খান ধমকে বললেন-

"হাসি বন্ধ করো।তোমাকে আমি অনেকবার বলেছি সাবধানে থাকতে। এখন থেকে তুমি গার্ড ছাড়া কোথাও যাবে না।"


আব্দুল গাফফার বিরক্ত হয়ে বললেন-

"তোরা দুজন বাবা মা মিলে আ*হত ছেলেটাকে বকছিস কেন?"


আশফাক খান বাবার কথায় থেমে গেলেন। প্রশ্ন করলেন-

"হামলাকারী কোথায়?"

"ওকে আউটহাউজে আটকে রাখা হয়েছে বাবা।"

"চিনতে পেরেছিস?"

"না"।


রেজিয়া সুলতানা ভালো করে শাহাদের ক্ষত পরিক্ষা করে বললেন-

" ঘরে চল,তোর ট্রিটমেন্ট নিতে হবে।"

" গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ করে যাই।"


রেজিয়া সুলতানা চোখ কপালে তুলে বললেন-

"এই অবস্থায় তুই গায়ে হলুদ করবি?"

"অনেকেই আমাকে হলুদ দেয় নি মা। একবারই যেহেতু বিয়ে করছি, তাদেরকে হলুদ দেয়া থেকে বঞ্চিত করা উচিত হবে না।"


রেজিয়া সুলতানা বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন ছেলের দিকে। আশফাক খান ছেলের এমন খাম খেয়ালিপনায় বেশ বিরক্ত হলেন।খুশি হলেন আব্দুল গাফফার খান।নাতির কাঁধ চাপড়ে নাতিকে এই বিষয়ে পূর্ন সাপোর্ট দিলেন তিনি।দাদার সাপোর্ট শাহাদ তার হতভম্ব বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে চমৎকার করে হাসলো।


-----------


কুহুদের বাড়িতে বেশ জমজমাট ভাব। রাতের অন্ধকারে কুহুদের বাড়িটা লাল নীল লাইটের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। বাড়ির ভিতর মেহমান দের আনাগোনায় মুখরিত। মোয়াজ্জেম হোসেন তার ঘরে সোফায় বসে চিন্তিত মুখে ফোন কানে ধরে কথা বলছেন, তার সামনে বসে আছেন শিরিনা বেগম। কিছুক্ষন পর ফোন কান থেকে নামিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন বললেন-

" আশফাক বললো তেমন কিছু হয় নি। শাহাদ আ*হত হয়েছে শুধু।"


"গু*লি লেগেছে শাহাদের?"


"নাহ, গু*লি লাগেনি।"


শিরিনা বেগম চিন্তিত মুখে তাকালেন স্বামীর দিকে।প্রশ্ন করলেন-

"মেয়েটাকে এসবের মাঝে না জড়ালে হতো না? ও তো এমনিতেও রাজনীতি পছন্দ করে না।তোমার কথায় বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।"


"আশফাক আমার বন্ধু।ওর ছেলে আমার দেখা অন্য সব ছেলের থেকে দায়িত্বশীল। নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও আমার মেয়েকে রক্ষা করবে। অন্য পরিবারে বিয়ে দিলে যে মেয়ের ওখানে অযত্ন হবে না তা কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছ? এখানে আমার মেয়ের অযত্ন হবে না।এক মাত্র মেয়েকে আমি জেনে বুঝেই বিয়ে দিচ্ছি।"


"মেয়েটা এসব সহ্য করতে পারবে তো? জীবনে এসব দেখেনি। বিয়ের আগের দিন হবু স্বামীর এমন খবর সহ্য কর‍তে পারবে?"


"ওকে জানাবে না এসব।বিয়ে বাড়ির কোনো লোকই যেন না জানে।যদি লোকমুখে জেনেও যায় তবে গুজব বলে উড়িয়ে দেবে।"

  

শিরিনা বেগম চিন্তিত মুখে মাথা নাড়লেন। এই ঘরের বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে কুহু সব শুনলো

 সব কিছু পেরিয়ে সিড়ি দিয়ে নিজের ঘরে যেতে লাগলো।মাঝ সিড়িতে আসতেই তার মেঝ খালার সাথে দেখা হলো।তিনি পায়েস বানানোর জন্য চাল ডালায়  করে নিয়ে নিচে যাচ্ছিলেন। কুহুকে আটকে বললো-

"কিরে মুখটা শুকিয়ে আছে কেন?খাস নি?"


কুহু উত্তর দিলো না। মেঝ খালা আবার বললেন-

"ঘরে যা, আমি তোর জন্য পরোটা মাংস পাঠাচ্ছি।"


কুহু ঘরে আসলো।তার ঘরের বিছানায় তনয়া সহ তার সব কাজিনরা শুয়ে বসে যে যার মতো আড্ডা দিচ্ছে। ঘরের এদিক ওদিক ফুলসহ শাড়ি গয়না ছড়ানো ছিটানো।কুহু চার্জ থেকে মোবাইলটা নিয়ে বারান্দায় চলে এলো। বারানদার দরজা লক করে দিয়ে কল করলো শাহাদকে। দুবার রিং হতেই রিসিভ হলো।ওপাশ থেকে ভেসে আসলো ভারী পুরুষালি কন্ঠ-

"কুহু।"


গম্ভীর রসকষহীন কন্ঠ অথচ কত দরদ দিয়ে " কুহু" নামটা উচ্চারন করলো।এমন ডাকে কুহুর সারা অঙ্গ হালকা কাঁপুনি দিয়ে উঠলো।সে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো- 

"আপনাকে নাকি গু*লি করা হয়েছে?"


ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ এলো না।কিছুক্ষন পর হালকা হাসি ভেসে আসলো।জিজ্ঞেস করলো-

"কে বলেছে?"


"আমি শুনেছি।"


"মানুষ গুজব ছড়াচ্ছে।"


"আমি শুনেছি আপনি আ*হত হয়েছেন।এটাও গুজব?"


"নাহ এটা গুজব না। ডেকোরেশনের একটা পিলারে লোহার সাথে লেগে কপাল লেগে কেটে গেছে। এই আর কি।"


"মিথ্যে বলছেন?"


পুরুষালি কন্ঠের হাসি ভেসে আসলো। হো হো করে হাসছে যেন কুহু খুব মজার কিছু বলেছে। চাপা অভিমানে কুহুর চোখে পানি এলো এলো ভাব। হাসি থামিয়ে ওপাশ থেকে বললো-

"আপনার কি চিন্তা হচ্ছে কুহু? চিন্তা করবেন না।সত্যি বলছি আমাকে কেউ গু*লি করেনি।"


শাহাদের সরল কন্ঠে বলা কথাটা কুহুর বিশ্বাস হলো। তার চিন্তা দূর হয়ে মুখটা উজ্জ্বল হলো। জিজ্ঞেস করলো- 

"এখন কেমন আছেন?"


"ভালো।তবে বিয়ের দিন ভালো থাকব কিনা বলা যাচ্ছে না।শরীর খারাপ থাকলে বিয়ে করতে আসব না,আমার বদলে অন্য কাউকে পাঠাব,প্রক্সি হিসেবে।"


কুহু চিৎকার করে বলল- 

"কিহ?"


আবার হাসির শব্দ শোনা গেলো। হাসি থামিয়ে বললো-

"আই ওয়াজ কিডিং কুহু। আমি আসব। এখন তাহলে রাখি কাল দেখা হচ্ছে।গুড নাইট।"


কলটা কেটে গেলো। কুহুর মুখ জুড়ে এক অভিমান মিশ্রিত হাসি ছড়িয়ে পড়লো। শাহাদের উপর রাগও হচ্ছে আবার অন্যরকম এক অনুভূতিতে শরীর মন আন্দোলিতও হচ্ছে। 


-------------


শাহাদ কল কেটে জানালার কাছ থেকে সরে এলো। ফোনটা পকেটে রেখে ঘরের মাঝখানে রাখা চেয়ারটায় বসলো। তার সামনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে আসিফকে, তার হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা।শাহাদ আর আসিফকে ঘিরে কয়েকজন গার্ড আর দলের ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। আসিফকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলো শাহাদ, কুহুর কল আসায় তাকে বিরতি দিতে হয়েছে। শাহাদ চেয়ারে আরাম করে বসলো।তার কপালে সাদা ব্যান্ডেজ প্যাচানো, ক্ষতের জায়গাটায় ব্যান্ডেজটা কিছুটা লাল হয়ে আছে। শাহাদ আসিফকে প্রশ্ন করলো- 


"তো নাইমুর তোমাকে পাঠিয়েছে আমাকে মা*রতে?"


আসিফ মাথা নাড়লো। শাহাদ প্রশ্ন করলো- 

"নাইমুরকে এই কাজের আদেশ কে দিয়েছে?"


"আমি জানি না।"


আসিফের উত্তরে তমাল গর্জে উঠলো।তেড়ে এসে বললো- 

"এই কু*র বাচ্চা, সত্যি করে বল।নয়ত তোকে পুঁতে দেব।"


শাহাদ তমালকে থামিয়ে বললো- 

"তমাল থাম, ওকে আঘাত করবি না।তুমি আমাকে সব বল আমি তোমাকে ছেড়ে দিব।"


আসিফ ধরা গলায় বলল- 

"আমি ছাড়া পেতে চাই না,আমায় মে*রে ফেলুন।"


উপস্থিত সবাই বিস্মিত হলো।শাহাদের ভ্রু কুচকে গেলো। প্রশ্ন করলো- 

"কেন?"


"এখান থেকে বেঁচে ফিরলে নাইমুর আমাকে সহ আমার বউ বাচ্চাকেও মে*রে ফেলবে।এর চেয়ে ভালো শুধু আমাকে মে*রে ফেলুন।"


শাহাদ কিছুক্ষন আসিফের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর আসিফের দিকে ঝুঁকে আসিফের কাঁধে হাত রেখে বলল- 

"আমাকে সব খুলে বল আমি তোমাকে সাহায্য করব।"


আসিফ হঠাৎ ভেঙে পড়লো। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ভেজা গলায় বলল- 

"আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না, আপনিও না।আমি চাঁদা বাজি, ছিনতাই করি। ইলেকশনের সময় টাকা খেয়ে দুই দলের মধ্যে ক্যাচাল লাগাই,মাঝে মাঝে দুই একজনকে গু*লি করে দা*ঙ্গা সৃষ্টি করি।নাইমুরের সাথেও কয়েকটা কাজ করেছি।একসময় ভালোবেসে বিয়ে করলাম।সন্তানের বাবা হলাম। তখন বউ বাচ্চার কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম এই রাস্তা থেকে সরে আসব। আস্তে আস্তে নাইমুরের সাথে দূরত্ব বাড়ালাম। কিন্তু নাইমুর আমাকে শেষ একটা কাজ করার কথা বলে ডাকলো। অনেক টাকার কাজ।বউ বাচ্চাকে ভালো রাখার জন্য লোভে পড়ে গেলাম। যখন শুনলাম এই কাজ তখনি আমি বুঝে গেছিলাম এখান থেকে বেচে ফিরা সম্ভব না, আর বেচে ফিরলেও নাইমুর আমাকে বাচতে দিবে না।"


"তাহলে তুমি নাইমুরকে না করে দিতে পারতে যে তুমি কাজ করবে না।"


"না করার সুযোগ নেই।নাইমুর কাউকে কাজ অফার করেছে মানে হয় তা গ্রহন করো নয়ত আজ নাহয় কাল লা*শ হও।কাজ পাওয়ার পর থেকে আমি আমার বউ বাচ্চার সাথেও যোগাযোগ করি নি, যাতে নাইমুর আমার বউ বাচ্চাকে ছাড় দেয়। যেহেতু আমি এই রাস্তা ছেড়ে দিতে চাই তাই সে প্রমান রাখবে না। প্রমান না রাখার জন্য আমাকে সহ আমার বউ বাচ্চাকেও মেরে ফেলবে। "


আসিফ কান্নায় ভেঙে পড়লো। শাহাদ চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসলো।নাকের ডগা তর্জনি দিয়ে ঘষতে ঘষতে আসিফের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো।তমাল একবার শাহাদের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। শাহাদের এইভাবে শান্ত হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা তার অস্বস্তিকর লাগে। মনে হয় শাহাদ যেন ভিতরের সব পড়ে ফেলছে। তবে অপর ব্যক্তি অস্বস্তিতে ম*রে গেলেও শাহাদের কিছু যায় আসে না,সে তাকিয়েই থাকবে।এভাবে তাকিয়ে থাকার দায়িত্ব নিয়েই যেন সে জন্মেছে।


শাহাদ উঠে দাঁড়ালো চেয়ার থেকে।একজনকে উদ্দেশ্য করে বলল- 

"ওর হাত খুলে দে।"


তারপর আসিফকে বললো-

"আমার কয়েকটা লোককে দিচ্ছি তোমার সাথে।গিয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে এসো। কাল। আমার বিয়ে।এঞ্জয় করো পরিবার নিয়ে।"


আসিফ বললো-

"আমাকে সাহায্য করার কারন কি?"


"দুনিয়ায় কোনো কিছুই ফ্রি না।আমি তোমাকে সাহায্য করছি বিনিময়ে তুমি আমাকে সাহায্য করবে। দ্যাটস ইট।"


তমাল এগিয়ে এসে বললো- 

"ভাই ওকে ছেড়ে দিলে যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে।"


"করবে না।ও এতদিন নাইমুরের দলে থেকেছে। বিশ্বাসঘাতকদের নাইমুর কি শাস্তি দেয় তা তুমি জানো আসিফ, তাই না?এরকম শাস্তি আমিও দিতে পারব।"


আসিফ কিছু বললো না।সে তাকিয়ে রইলো।শাহাদ আউটহাউজ থেকে বের হয়ে গেলো। বাড়িতে ঢুকে ড্রয়িং রুমে দেখা হলো রাহাতের সাথে।সে ফোনে কথা বলছিলো।শাহাদকে ইশারায় থামতে বলে ফোনে কথা বলা শেষ করলো। ফোন পকেটে রেখে জিজ্ঞেস করলো- 

"কিছু বের করতে পারলে।"

"পেরেছি।"

"গুড।বাবা কল দিয়েছিলো। বাবারও একই মত,বিরোধী দলের কেউই তোমার উপর হামলা করিয়েছে।"


শাহাদ সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়লো।জিজ্ঞেস করলো-

"আংকেল আন্টি কখন আসবেন।"


"আর আধা ঘন্টার মাঝেই চলে আসবেন।বাবার একটা সেমিনারে যোগ দেয়ায় দেরি হয়ে গেছে।চল যাই,শ্বশুর আব্বা আমাদের ডেকেছেন।"


রাহাত আর শাহাদ আশফাক খানের স্টাডিতে ঢুকলো।সেখানে দলীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত।সবাই সোফায় বসে আলোচনায় ব্যস্ত।শাহাদ আর রাহাত এক পাশে হাত সামনে এনে বিনয়ের সাথে দাঁড়ালো। একজন বয়স্ক নেতা শাহাদকে জিজ্ঞেস করলো- 

"ওই ছেলেটাকে পুলিশে দিচ্ছ না কেন?"


শাহাদের উত্তর-

"ছোটখাটো ব্যাপারে পুলিশ জড়াতে চাই না।"


আশফাক খান খেঁকিয়ে উঠলেন-

"এইটা ছোটখাটো ব্যাপার? এমপির বাড়িতে ঢুকে তার ছেলের উপর গু*লি চালানো হয়েছে, এটা ছোটখাটো ব্যাপার?"


"বাবা শান্ত হোন।থানা পুলিশ করলে ব্যাপারটা আরো ছড়াবে,ঝামেলা বাড়বে।সামনে নির্বাচন।এখন থানা পুলিশে না জড়ানোই ভালো। ঘটনাস্থলে কেউ ছিলো না,কেউ ছবি বা ভিডিও ও করেনি তাই আমরা এটাকে গুজব বলে চালিয়ে দেব।তারপরেও যদি মানুষ বিশ্বাস করে তাহলে ভালো, আমরা তাদের সহানুভূতি পাব।"


কয়েকজন সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লেন।একজন মধ্যবয়স্ক নেতা জিজ্ঞেস করলেন -

"তাহলে ওই হামলাকারীর কি করবে?"


"ওকে আমার উপর ছেড়ে দিন। আমি সামলাব।"


চলবে

গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ১২

 #টক_ঝাল_মিষ্টি 

#তামান্না_আঁখি 

#পর্ব-১২


আজ কুহুর গাঁয়ে হলুদ। গাঁয়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে ছাদে। ছেলেরা সবাই হলুদ পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পড়েছে আর মেয়েরা পড়েছে হলুদ শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ।মেয়েরা মাথায় ফুল গুঁজেছে অনেকেই। ছাদের এক পাশে স্টেজ, এখানে কুহুকে এনে বসানো হবে। স্টেজের সামনেই অনেক চেয়ার রাখা অতিথিদের জন্য। রেলিং ঘেঁষেও অনেক চেয়ার রাখা হয়েছে।একপাশের টেবিলে খাবার দাবারের ব্যবস্থা। 

কুহুকে এখনো সাজানো হচ্ছে। তার মেয়ে কাজিনরা সব ঘিরে আছে তাকে। তনয়া লেহেঙ্গার ওড়না পিন দিয়ে আটকে দিলো। কুহুর চুলগুলো বেনি করে এক পাশে ফেলে রাখা হয়েছে।বেনির ভাঁজে ভাঁজে ছোট ছোট হলুদ ফুল। সারা শরীরে হলুদ ফুলের গয়না।সাজানোর সময় মেয়েরা বিভিন্ন কথা বলে কুহুকে উত্ত্যক্ত করলো। কুহুর কানে কানে বিভিন্ন নিষিদ্ধ বাক্য উচ্চারন করলো। কুহু নাক সিটকে বললো "ছি!অসভ্য তোরা"। এই কথায় যেন তাদের উৎসাহ আরো বাড়লো। গলা ফাটিয়ে সবাই হেসে আবারো ওই এক ই কাজ করলো। 


কুহুকে স্টেজে তোলা হলো মধ্য দুপুরে। প্রথমে হলুদ দিলো শিরিনা বেগম। চারদিক থেকে ফটোগ্রাফারের ফ্ল্যাশ পড়লো তাদের উপর। তারপর এলেন মোয়াজ্জেম হোসেন।বাবাকে দেখে কুহু নড়েচড়ে বসলো। বাবার সাথে তার তেমন সখ্যতা নেই।বাবা মেয়ের মাঝে এক অন্যরকম দূরত্ব। কিন্তু সেই দূরত্বে ভালোবাসার কমতি নেই। মোয়াজ্জেম সাহেব এসে মেয়েকে হলুদ দিলেন,মিষ্টিমুখ করালেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে চলে এলেন। স্টেজ থেকে নেমে সিড়ির গোড়ায় এসে সবার আড়ালে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন। একমাত্র মেয়েকে কাল বিদায় দিতে হবে এই কথা চিন্তা করে তাঁর বুকের ভিতর মোচড় দিচ্ছে। মেয়েকে আরো পরে বিয়ে দিলেও পারতেন কিন্তু শাহাদের বাবার জোড়াজুড়িতে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হলো তাঁকে।


শিরিনা বেগম স্বামীর কাঁধে হাত রাখলেন। মোয়াজ্জেম হোসেন স্ত্রীকে দেখে তাড়াতাড়ি রুমাল পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলো।নিজেকে স্বাভাবিক করে হাসলো।শিরিনা বেগম বললেন-

"শুরুতেই বলেছিলাম মেয়েটাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিও না।এমনিতেই এই মেয়ের বুদ্ধিসুদ্ধি কম। আরেকটু বয়স হলে হয়ত সংসারটা আরো ভালো বুঝতো।"


"ওসব তুমি ভেবো না।আমার মেয়ে ও। ভুলভাল কাজ যাই করুক না কেন ওর বুক ভর্তি ভালোবাসা রয়েছে। এই ভালোবাসা দিয়ে ও ঠিক শ্বশুড় বাড়িতে সবার মন জয় করে নিবে।"


শিরিনা বেগম পিছন ফিরে একবার মেয়ের দিকে তাকালেন। তার চোখ দুটোও ভিজে গেলো। তিনি আর দাঁড়ালেন না, নিচে নেমে গেলেন।


যিয়াদ এসে কুহুকে হলুদ লাগালো। বিভিন্ন পোজ দিয়ে দুই ভাই বোন ছবি তুললো। নিচ থেকে ভেসে এলো গাড়ির হর্নের শব্দ৷ বরের বাড়ি থেকে হলুদের ডালা নিয়ে এসেছে বরের বাড়ির লোকজন। মেয়েরা দৌড়ে গেলো রেলিঙের কাছে। যিয়াদ ছাদে থাকা ছেলেদেরকে নিয়ে নিচে গেলো সবাইকে আপ্যায়ন করে নিয়ে আসতে।


খানিক বাদেই ছাদে ঢুকলো বরের বাড়ির সবাই,হলুদের ডালা নিচে রেখে এসেছে তারা। রাফা দূর থেকে কুহুকে দেখে হাত নাড়ালো। এক প্রকার দৌড়ে এলো স্টেজের দিকে।এসেই কুহুর সাথে বসে পড়লো। ফোন উঁচিয়ে বললো-

"ভাবিমনি পোজ দাও।"


অনেক ছবি তুললো রাফা কুহুকে নিয়ে। যিয়াদ অতিথিদের আপ্যায়ন করে বসালো। তাদের সবাইকে খাবার সার্ভ করলো। 


"শালিকা উঠো, আমাকে একটু আমার শালার বউ এর সাথে পরিচিত হতে দাও।"


রাহাতের কথায় রাফা উঠে গেলো। রাহাত কুহুর  পাশে বসে বললো-

"আমি তোমার হবু বরের বোনজামাই।আর তুমি আমার শালার বউ। এখন থেকে সেই সম্পর্ক বাদ।এখন থেকে তুমি আমার শালী। আর দুলাভাইরা সবসময় শালীর দলে থাকে।'


রাফা ফোড়ন কেটে বললো-

" একটু আগে ভাইয়াকে বলে আসলেন আপনি ভাইয়ার দলে।এক ঘন্টার ব্যবধানে দল চেঞ্জ করে ফেললেন?"


"তুমি শালী বেশি কথা বল।দুলাভাইদের বেলায় প্রয়োজনে দল চেঞ্জ করা জায়েয আছে।"


রাফা নাক সিটকালো রাহাতের কথায়। রাহাত একটা মিষ্টি তুলে খাওয়াল কুহুকে। কুহু একটুখানি খাওয়ায় অসন্তুষ্ট হয়ে মাথা নেড়ে বললো-

"উহুম উহুম! এতো কম মিষ্টি খেলে কিভাবে হবে। তুমি হলে মধু মিয়ার বউ। তোমার তো সারাবছর মিষ্টি খেতে হবে।"


তনয়া পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো- 

"মধু মিয়া কে দুলাভাই।"


"আমার শালা। শাহাদ নামের অর্থ মধু। মিষ্টি খেতে না জানলে মধু হ্যান্ডেল করবে কিভাবে?"


কুহুর লজ্জায় প্রাণ যায় যায় অবস্থা।সে মুখে কুলুপ এটে বসে থাকলো।রাহাত বিভিন্ন পোজ দিয়ে ছবি তুলে উঠে চলে গেলো,যাওয়ার আগে মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস কর‍তে বললো। তনয়া কুহুর কানের কাছে মুখ এনে বললো-

"একটু মধু এনে দেই? এখন থেকেই খেয়ে প্র‍্যাক্টিস কর।"


কুহু কটমট করে তাকালো। তনয়া দুষ্টু হেসে চোখ মারলো। রাফা হুট করে মোবাইল কুহুর সামনে ধরে বলল- 

"ভাবিমনি দেখো।"


কুহু মোবাইলের দিকে তাকালো।মোবাইলে ভিডিও কল হচ্ছে। সেখানে শাহাদকে দেখা যাচ্ছে,সে হলুদের স্টেজে বসে আছে।হলুদ পাঞ্জাবির উপর ডিজাইনার গোল্ডেন কটি আর সাদা পায়জামা।গালের দুপাশে হলুদ, কপালে আর নাকেও হালকা আছে। বরাবরের মতো পাঞ্জাবির হাতা গুটানো আর হাতে ঘড়ি। তার আশেপাশে অনেক ছেলে সবাই পোজ দিয়ে ছবি তুলছে। স্টেজের এদিক ওদিক অনেক মেয়েরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারাও এসে যে যার মতো সেলফি তুলে যাচ্ছে। মেয়েদের সাথে ছবি তোলা দেখে কুহুর হালকা জ্বলুনি অনুভব হলো। রাফা গলা উঁচিয়ে  বললো-

"রিদি ফোনটা ভাইয়ার কাছে নিয়ে যা।"


অপর পাশে ভিডিও কলে থাকা রিদি ফোনটা শাহাদের হাতে ধরিয়ে দিলো। আচমকা ফোন হাতে পেয়ে শাহাদ তাকিয়ে দেখলো ফোনে কুহুকে দেখা যাচ্ছে। শাহাদ কিছুক্ষনের জন্য ভড়কে গেলো।সে বসা থেকে উঠে স্টেজ থেকে নেমে এলো। একটা কোনায় এসে ফোন সামনে ধরে বলল- 

"কেমন আছেন কুহু?'


রাফা কুহুর হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে ইশারা করে তনয়াকে নিয়ে এখান থেকে নেমে গেলো,আর কাউকে স্টেজে উঠতে দিলো না।কুহু জবাব দিলো-

" ভালো, আপনি?"


শাহাদ একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে বসলো।বললো-

"একটু খারাপ আছি। মা চাচীরা নিয়মের নামে আমাকে রীতিমতো হলুদে চুবাচ্ছে।"


কুহু ফিক করে হেসে দিলো। শাহাদ শান্ত চোখে সেই হাসি দেখলো।তারপর নিজেও ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল- 

"ইউ আর লূকিং প্রিটি,মিস কুহু।"


কুহুর চোখেমুখে লজ্জা উপচে পড়লো। সে শাহাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না, এদিক ওদিক চোখ ঘুরালো। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো শাহাদ তার দিকে তাকিয়ে আছে এখনো। সে গলা পরিষ্কার করে বলল- 

"এখন তাহলে রাখি।"


"কেন?লজ্জা পাচ্ছেন?"


"না পাচ্ছিনা। "


বলেই কুহু ফোন কেটে দিলো। তার পক্ষে এই পরিস্থিতিতে থাকা আর সম্ভব না।


-------------

কুহু ফোন কেটে দেয়ায় শাহাদ হাসলো।কাল দিন পর সারাজীবন একসাথে থাকা হবে আর এই মেয়ে এখন লজ্জা পাচ্ছে।সে ফোন হাত উঠে দাঁড়ালো। স্টেজে গিয়ে এই হলুদের ঝামেলা তাড়াতাড়ি শেষ করে ঘরে যেতে চায় সে। বাড়ির চারপাশের পুরো বাগান জুড়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন। এদিক ওদিক চেয়ার টেবিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেখানে গেস্টরা বসে আছে।অনেক ভিআইপি গেস্টরা এসেছে। আশফাক খান আর আব্দুল গাফফার খান তাদের সময় দিচ্ছেন। শাহাদ তার চাচ্চুর অভাব অনুভব করলো। তার চাচ্চু থাকলে প্রোগ্রামটা আরো জম জমাট হতো।শাহাদ আবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে স্টেজের দিকে হাঁটা দিলো। পথিমধ্যে হঠাৎ পাঞ্জাবি পায়জামা পড়া একটা লোক সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। লোকটার মুখে একটা সাদা কাপড় প্যাঁচানো,শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে।লোকটার চোখের দৃষ্টি  দেখে শাহাদের অবচেতন মন সচেতন হয়ে গেলো।শাহাদকে কিছু ভাবার সময় না দিয়ে লোকটা হঠাৎ রিভল*বার বের করে গুলি করলো শাহাদের বুক বরাবর। 


_________


 নাইমুর একটা ফ্যাক্টরির ছাদে হাত দুটো রেলিঙের উপর ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বাম হাতে জ্বলন্ত  সিগারেট। তার দৃষ্টি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িটার দিকে। চারদিকে সবুজ বাগান তার ঠিক মাঝখানে সাদা ধবধবে বাড়িটা।বাড়ির বাগানে আজ হলুদের প্রোগ্রাম।দূর থেকে শোরগোল, গান বাজনা ভেসে আসছে।নাইমুর কান পেতে আছে একটা নির্দিষ্ট শব্দের জন্য।শব্দ টা পেয়ে গেলেই কিছুটা নিশ্চিন্ত হতো। বাকিটা নিশ্চিন্ত হতো খবর পাওয়ার পর। মিজান দৌড়ে এসে নাইমুরের পাশে দাঁড়িয়ে বললো-


"ভাই আসিফ বাড়ির ভিতর ঢুকে গেছে।"


নাইমুর ভারী ভাঙা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-

"এত গার্ড ফাঁকি দিলো কিভাবে?"


" বাড়ির পিছনে প্রাচীরের বাইরের গার্ডগুলোকে টাকা খাওয়াতে হয়েছে ।"


"শা*লার সব জায়গায় গা*দ্দারে ভরা। যার নূন খাচ্ছে তাকেই মা*রার জন্য টাকা নিয়ে সাহায্য করছে। কাজ শেষ হলে এদেরকেও সরিয়ে দিবি।গা*দ্দারদের দুনিয়ায় থাকার কোনো অধিকার নেই।"


মিজান মাথা নাড়ালো,সে বুঝেছে।নাইমুর কান পেতে থাকলো শব্দ শোনার জন্য। অনেক্ষন কান পেতে থাকার পর আনন্দ করতে থাকা বাড়িটা থেকে ভেসে আসলো গুলির শব্দ। মুহুর্তেই থেমে গেলো সব গানবাজনা।শোনা গেলো মেয়েদের চিৎকার। কিছুক্ষন যেতেই ভেসে এলো আরো একটা গুলির শব্দ।এবার মেয়েদের সাথে ছেলের হাঁক ডাকের চিৎকারও যোগ হলো। গার্ডদের ব*ন্দুক গুলো থেকে বেশ কয়েকবার ব্রাশ ফা*য়ার করা হলো। ভেসে আসলো আরো কতগুলো গু*লির শব্দ। নাইমুর ঠোঁট কামড়ালো। কাজ হয়ে গেছে তার। প্রথম দুটো গু*লির শব্দ আসিফের রিভ*লবারের,যেটা সে আসিফকে দিয়েছে। পরের গুলো গার্ডগুলোর। মিজান চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো- 

"আসিফ বোধ হয় শেষ।"


"শেষ হলেই ভালো, ঝামেলা কমলো।নয়ত বেঁচে ফিরে এলে আমার একটা গু*লি নষ্ট করতে হতো।"


নাইমুর সিগারেটের ছাইটা ফেলে দিয়ে টান দিলো।তারপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ছাদের দরজার দিকে পা বাড়ালো। মিজান আস্তে করে ঢোক গিললো।নাইমুরের সাথে কাজ করতে তার বুক কাঁপে।কাজের স্বার্থে নাইমুর যেকোনো সময় যেকোনো কাউকে মে*রে ফেলে। মিজান বহুবার চেষ্টা করেছে নাইমুরের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে, এসব কাজ না করতে কিন্তু এসব কাজে একবার ঢুকলে ফেরার আর উপায় নেই।মিজান দেরি না করে নাইমুরের পিছু পিছু গেলো। দেরি করলে নেক্সট মিশনে তাকেও যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারে।


চলবে

গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ১১

 #টক_ঝাল_মিষ্টি 

#তামান্না_আঁখি 

#পর্ব-১১


শাহাদ একটা ৭ তলা বিল্ডিংয়ের ছাদের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পড়নে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা।পাঞ্জাবির হাতা দুটো কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা।হাতে মেটালের ঘড়ি আর চোখে সানগ্লাস। শান্ত মুখে সে স্টেশনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই বিল্ডিং টা থেকে স্টেশন এরিয়াটা বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। বিল্ডিংটার সামনের রাস্তা ধরে বেশ কিছুক্ষন হাঁটলেই স্টেশন। এরিয়াটা লোকসমাগমে পূর্ন, ছাদে দাঁড়িয়ে গাড়ি চলাচলের আওয়াজ পাওয়া যায়। শাহাদ ঘড়ি দেখলো।পাশে সরিয়ে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারটা টেনে এনে রেলিং বরাবর রাখলো।তারপর সেখানে বসে দুপা তুলে দিলো রেলিঙের উপর।চেয়ারে হেলান দিয়ে বুক বরাবর দুহাত ভাঁজ করে চোখ বন্ধ করে আধশোয়া হয়ে রইলো। তমাল শাহাদের জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসলো।সানগ্লাস চোখে থাকায় শাহাদ ঘুমাচ্ছে কিনা বুঝতে পারলো না।সে মৃদু স্বরে ডাকলো-

"ভাই,ভাই।"


শাহাদ চোখ খুলে তাকালো। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিলো। ওভাবেই বসে থেকে চুমুক দিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার ছাদের দিকে তাকালো। তার সাথে আসা ছেলেগুলো ক্রিকেট খেলছে। সময়টা দুপুর পেরিয়ে বিকাল হওয়ার কাছাকাছি। রোদের তেজ কমে এসেছে। এমন সময় ক্রিকেট খেলা মন্দ নয়। শাহাদ ছোট্ট করে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। একটা ছেলে ব্যাটে বলে লাগিয়ে ছক্কা হাঁকালো। বল ছুটে এলো শাহাদ বরাবর। শাহাদ এক হাত উচিয়ে খপ করে বল ক্যাচ ধরলো। তারপর সোজা হয়ে বসে ছুঁড়ে দিলো খেলারত ছেলেগুলোর দিকে।তমাল হাঁক ছেড়ে বললো-

"ওই আস্তে খেল।"


মানুষের হট্টগোলের শব্দ শোনা গেলো। তমাল রেলিং ধরে স্টেশন চত্বরের দিকে তাকালো। শাহাদ চেয়ারে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনোযোগ দিয়ে তাকালো। স্টেশন চত্বরে কতগুলো ছেলেকে আরো কতগুলো ছেলে মা*রতে মা*রতে স্টেশনের কাউন্টার থেকে বাইরে বের করলো। তারপর হঠাৎ করেই মাটিতে ফেলে বিনা নোটিশে এলোপাথাড়ি মা*রতে লাগলো। পাশে একটা লাকড়ি বোঝাই ভ্যান ছিলো।একটা ছেলে দৌড়ে কতগুলো লাকড়ি নিয়ে এসে মা*রতে থাকা কয়েকজনের হাতে তুলে দিলো। এবার শুরু হলো লাকড়ি দিয়ে পিটানো। সবাই ভীড় করে দাঁড়িয়ে মা*রামা*রি দেখছে কিন্তু কেউ থামাতে আসছে না ভয়ে। শাহাদ তমাল কে ইশারা করলো। তমাল ফোন বের করে পুলিশ স্টেশনে কল করলো। মিনিট পাঁচেকের মাঝেই পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেলো দূর থেকে। তমাল জিজ্ঞেস করলো- 


"ভাই এখন সিগন্যাল দিব?"


শাহাদ ঘাড় ঘুরিয়ে তার পিছনে থাকা রাস্তাটার দিকে তাকালো। পুলিশের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। সে গাড়িটাকে আরেকটু  এগিয়ে আসার সুযোগ দিলো। তারপর বললো-

"এখন দে।"


তমাল ফোন করলো একটা নাম্বারে। ফোন ধরলো স্টেশনে ভীড়ের মাঝে থাকা একটা ছেলে। ফোনে কথা বলে কল কেটে ভীড় ঠেলে মা*র দিতে থাকা ছেলেগুলোর কাছে গেলো। একজনকে থামিয়ে কানে কানে কিছু বললো। ছেলেটা মা*র থামিয়ে গলা উঁচু করে রাস্তার দিকে তাকালো। পুলিশের গাড়ি দৃশ্যমান হয়েছে। সে তাড়াতাড়ি বাকি ছেলেগুলোকে বিষয়টা জানালো, মুহূর্তের মাঝে সবাই পালিয়ে গেলো। মাটিতে পড়ে থাকলো ৭-৮ টা ছেলে। সবাই র*ক্তাক্ত হয়ে আছে। পুলিশ এসে ভীড়ের মাঝে  কিছুক্ষন এদিক ওদিক দৌড়ালো। সাধারণ মানুষ  ভয়ে যে যার মতো চলে গেলো। শাহাদ ঘড়ি দেখলো। এখানকার কাজ শেষ করে চলে  যাওয়া প্রয়োজন। আজ বিয়ের শপিং করার ডেট। তাকে কাজ শেষ করে শপিং মলে যেতে হবে। সে তমালকে জিজ্ঞেস করলো- 

"ওদের আপডেট কি?"


তমাল আবারো কল দিলো। কথা শেষ করে বলল- 

"ভাই সবাই -ই নিরাপদ দূরত্বে পালিয়ে গেছে।পুলিশ কাউকে ধরতে পারে নি।"


"গুড।"


শাহাদ উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের দরজার দিকে হাঁটা দিলো। ছাদে ক্রিকেট খেলতে থাকা ছেলেগুলো খেলার ইতি টানলো। শাহাদ আর তমালের পিছু পিছু তারাও নেমে এলো বিল্ডিং থেকে।দূরে স্টেশন থেকে চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে।এতে তাদের তেমন আগ্রহী মনে হলো না,তারা হারহামেশাই এসব দেখে অভ্যস্ত।


_________


কুহু শহরের সবচেয়ে বড় শপিং মলটার সামনে এসে গাড়ি থেকে নামলো। তার সাথে নামলো যিয়াদ। বিয়ের শপিং করার জন্য কুহুকে ডেকে আনা হয়েছে। শপিং মলের সামনে দাঁড়ানো একটা ছেলে এগিয়ে এসে বললো- 

"ভাবি আমার সাথে আসুন।আপ্পনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে।"


কুহু আর যিয়াদ দুজনেই ছেলেটার পিছু পিছু আসলো। ছেলেটা একটা শাড়ীর দোকানের সামনে এসে দোকানের দরজা খুলে দিয়ে বললো- 

"ভিতরে যান।"


কুহু আর যিয়াদ দুজনেই ভিতরে ঢুকলো।রাফা কুহুকে দেখেই হাত নাড়িয়ে ডাকলো-

"ভাবিমনি এইদিকে।"


খান পরিবারের সবার দৃষ্টি ঘুরে গেলো কুহু আর যিয়াদের দিকে। কুহু বেশ বিব্র‍ত অনুভব করলো। লজ্জামিশ্রিত অস্বস্তি নিয়ে হেঁটে গেলো ওদের কাছে।একটা সুন্দরমতো মেয়ে উঠে এসে বললো- 

"তুমি কুহু না? বাহ!বেশ দেখতে তো তুমি!! আমি শাহাদের বড় বোন।"


কুহু ব্যস্ত হয়ে সালাম দিলো আনিশাকে।দোকানে বসে থাকা রেজিয়া সুলতানা আর জয়া বেগমকেও বিনয়ের সাথে সালাম দিলো।রেজিয়া সুলতানা ছেলের বউকে দেখে মুগ্ধ হলেন। মেয়েটাকে বেশ লাগে উনার কাছে। বড়দের সামনে শান্তশিষ্ট হয়ে থাকার চেষ্টা করে কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে বেশ চঞ্চল তা বুঝাই যায়।আনিশা কুহুকে টেনে তার পাশে বসালো। যিয়াদ বড়দের সাথে কুশল বিনিময় করে একপাশে গিয়ে বসলো। চোখাচোখি হলো রাফার সাথে।রাফা একটা মুখ ভেংচি দিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।আচমকা এমন ব্যবহারে যিয়াদ হকচকিয়ে গেলো। সে অবাক চোখে রাফার দিকে তাকিয়ে রইলো।রাফা যিয়াদকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাত দিয়ে ইশারা করলো। যে ইশারার অর্থ "দু চোখ উপড়ে ফেলব"। যিয়াদের অবাক হওয়া সীমা পেরিয়ে গেলো। সে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সিদ্ধান্ত নিলো এমন অকালপক্ব মেয়ের দিকে আর তাকাবে না।


শাড়ি দেখার ফাঁকে কুহু এদিক ওদিক তাকালো। শাহাদকে খুঁজছে সে।কিন্তু পেলো না। শাড়ি সহ সব কেনা হয়ে গেলো তাও শাহাদের দেখা পাওয়া গেলো না। শেষে যখন গয়নার দোকানে কুহু গা ভর্তি গয়না পড়ে ট্রায়াল দিচ্ছে তখন কোথা থেকে শাহাদ এসে উদয় হলো। এসেই তার চোখ পড়লো গয়নার ভারে নুইয়ে পড়া কুহুর দিকে। আশেপাশে দেখলো তার মা চাচী বোন কুহুকে ঘিরে আছে।তাদের যার যেই গয়নাটা পছন্দ হচ্ছে তাই কুহুকে পড়িয়ে ট্রায়াল দিচ্ছে। শাহাদের বেশ মায়া হলো কুহুর কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে। সে এগিয়ে এসে গয়নার দোকানের একটা টুলে বসে পড়লো। দোকানের ম্যানেজার হাসিমুখে এসে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো। কুহু শাহাদের দিকে একবার তাকালো।চোখাচোখি হলো। আনিশা শাহাদকে ডেকে বললো- 

" দেখ তো তোর বউকে কেমন লাগছে। "


শাহাদ স্থির দৃষ্টিতে কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল- 

"ভালো।


" শুধু ভালো।আরো কিছু বল।"


"এত গয়না পড়িয়েছো কেন? বিয়েতে এত গয়না পড়ে ও হাঁটবে কি করে?ওর তো এখনি কষ্ট হচ্ছে।এক্ষুনি সব খোলো।"


মহিলারা সবাই মুচকি হাসলো।রাফা গলা বাড়িয়ে বললো-

"তাহলে তুমি ভাবিমনিকে কোলে নিও, তাহলেই তো আর ভাবিমনির কষ্ট করে হাঁটতে হয় না।"


কুহুর গাল দুটো গরম হয়ে গেলো লজ্জায়।চোখ মুখ খিচে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।আনিশা হাসতে হাসতে বললো -

"আহা! আমার ভাইয়ের কত চিন্তা। সব গয়না তোর বউকে বিয়ের দিন ই পড়তে হবে না। এগুলো সব একসাথে কিনে দেয়া হচ্ছে,যখন যখন পড়তে ইচ্ছে করবে তখন পড়বে।বুঝেছিস বউ পাগল!"


শাহাদ হালকা গলা ঝাড়লো।সিদ্ধান্ত নিলো আর কোনো কথা বলবে না। এই মহিলা সমাজের সামনে আর কথা বলা তার উচিত হবে না।যিয়াদকে ইশারা দিয়ে এখানে এসে বসতে বললো।আপাতত সে তার শালার সাথে আড্ডা দিবে।


শপিং করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। তাও সব কেনা হলো না। শাহাদসহ পুরুষদের সবকিছুই বাকি রইলো। তার জন্য আবার আসতে হবে। রেজিয়া সুলতানা ক্লান্ত কন্ঠে বললেন- 

"তোদের ছেলেদের কেনাকাটায় আমি আর আসতে পারব না।নিজেদেরটা নিজেরা এসে কিনে নিস।"


রাফা ঠোঁট ফুলিয়ে বললো- 

"আমার ম্যাচিং টিকলি তো কিনা হলো না।আর রিদি যদি ওর জিনিস পছন্দ না করে তাহলে তো আবার আসতে হবে।"


জয়া বেগম বলেন -

"পছন্দ না করলে চড়িয়ে পছন্দ করানো হবে। আর তোর যা লাগবে অনলাইনে অর্ডার দিবি।বিয়ে বাড়িতে হাজারটা কাজ আছে এসবের মধ্যে আর শপিং এ আসার ঝামেলা নিতে পারব না।"


রেজিয়া সুলতানা কুহুকে জিজ্ঞেস করলেন-

"কুহু গাড়ি নিয়ে এসেছো তো?"


"জী। যিয়াদের কোচিং এ ক্লাস আছে।ওখানে ওকে নামিয়ে দিয়ে তারপর আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসবে।"


"তাহলে যিয়াদ গাড়ি নিয়ে যাক, নয়ত ওর ক্লাসের দেরি হয়ে যাবে। তোমায় বরং আমার  ছেলে পৌঁছে দিয়ে আসবে।এই শাহাদ এদিকে আয়।"


শাহাদ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো,রেজিয়া সুলতানার ডাকে ফোনে কানে নিয়েই এগিয়ে আসলো।ইশারায় জানতো চাইলো কেন ডেকেছে? রেজিয়া সুলতানা বললেন- 


"কুহুকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবি।"


শাহাদ ফোনে হুম হাম করতে করতেই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আবার আগের জায়গায় ফিরে গেলো। যাওয়ার আগে কুহুর দিকে আঁড়চোখে তাকালো। ড্রাইভার সহ সাথে আসা গার্ড এসে শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে গাড়িতে রাখলো।সবাই বেরিয়ে আসলো শপিং মল থেকে,গ্যারেজে এসে দাঁড়ালো। শাহাদের কানে এখনো ফোন। রেজিয়া সুলতানা কুহুকে বললেন -

"আমরা তাহলে যাই।শাহাদের সাথে চলে যেও কেমন?"


কুহু মাথা হেলিয়ে সায় দিলো। সবাই কুহুকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। যিয়াদ এসে বললো- 

"ভাইয়ার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকো।আমি গেলাম।আমার ক্লাসে দেরি হয়ে যাবে।"


যিয়াদও চলে গেলো।পুরো আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে সারি সারি গাড়ির মাঝখানে এখন শুধু কুহু আর শাহাদ৷ শাহাদ ঘাড় ঘুরিয়ে কুহুর দিকে তাকালো। ফোনে কথা বলতে বলতেই কুহুকে হাত দিয়ে ইশারা করলো ওর সাথে আসতে। কুহু পিছু পিছু গেলো। চকোলেট কালার একটা গাড়ির কাছে এসে গাড়ির ডোর খুলে দিলো শাহাদ।কুহু তাতে চড়ে বসলে ডোর লাগিয়ে দিলো।


 কুহু জানালার কাচ ভেদ করে তাকিয়ে দেখলো শাহাদ এখনো ফোনেই কথা বলছে। সে তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে ছোট আয়নাটা বের করলো। মুখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখলো। তারপর লিপ্সটিক বের করে ঠোঁটে ঘষলো।তাড়াতাড়ি করে দিতে গিয়ে লিপ্সটিকের পরিমান বেশি হয়ে গেলো। গাড়ির সামনের টিস্যুবক্স থেকে দুটো টিস্যু নিয়ে ঘষে ঘষে লিপস্টিকটা মুছলো।উঁকি মেরে দেখলো শাহাদ আসছে কিনা। তারপর এইবার খুব সাবধানে সময় নিয়ে  হালকা করে দিলো।লিপস্টিকটা ব্যাগে রেখে গাল দুটোতে হাত দিয়ে দুটো চড় দিলো। ব্যথা পেয়ে মৃদু "আহহ" করে উঠলো।একটু থেমে আবারো চড় দিলো। আয়না দিয়ে দেখলো মুখটা।হুম!! গাল দুটোতে একটু গোলাপি আভা এসেছে।ব্যথা পাওয়া স্বার্থক হয়েছে।শাহাদকে আসতে দেখে সব পরিপাটি করে নড়েচড়ে ভদ্র হয়ে বসলো। সিটবেল্টটা ইচ্ছে করে আটকালো না,শাহাদ এসে আটকে দিবে এই আশায়।


শাহাদ গাড়িতে উঠে বসলো। নিজের সিটবেল্ট বেঁধে কুহুকে বাঁধতে বললো। কুহু তার পুরো মুখটা শাহাদের দিকে ঘুরিয়ে বললো-

"সিটবেল্ট না বাঁধলে হবে না?"


শাহাদ না তাকিয়েই বললো -"না হবে না"।


কুহুর মুখটা  ভোঁতা  হয়ে গেলো। মুখের দিকে তাকালো না কেন? এত চড় দিলো মুখে, এইগুলা কি সব বৃথা যাবে? সে আবার বললো-

"আমি বাঁধতে পারিনা।"


এইবার শাহাদ তাকালো। কুহু ওর দিকে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে।এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে বুঝলো না শাহাদ।সে হাত বাড়িয়ে বেল্টটা টেনে বেঁধে দিলো। বেঁধে দেয়ার পর তার চোখ পড়লো কুহুর সিটের পাশের জায়গাটায়। টিস্যুতে লাল রঙ দেখে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো- 

"এগুলো কি? র*ক্ত নাকি?"


একটা হাতে নিলো। ভালো করে দেখে বুঝলো রক্ত না কোনো রঙ হবে। কুহু ছোঁ মেরে শাহাদের হাত থেকে টিস্যুটা নিয়ে ব্যাগে ভরে ফেললো সাথে পড়ে থাকা টিস্যুটাও।শাহাদের চোখে মুখে বিস্ময় ছড়িয়ে গেলো। বিস্ময় কাটিয়ে বললো-


"লেবু চিপার জিনিস নিয়ে ঘুরেন ভালো কথা তাই বলে ইউসড টিস্যু ব্যাগে ঢুকাচ্ছেন কেন?"


কুহু ইতস্তত করর জবাব দিলো-

"এইগুলো আমার ইউস করা টিস্যু। "


শাহাদ কিছু একটা বলতে নিয়েও বললো না। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বিরবির করে বলল- 

"শী ইজ আনপ্রেডিক্টেবল।"


খুব ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে যেতে লাগলো শাহাদ।রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো জ্বেলে দেয়া হয়েছে। শাহাদ বাজারের রাস্তা না ধরে বেছে বেছে নীরব রাস্তাগুলো দিয়েই যেতে লাগলো। গলাটা হালকা ঝেড়ে কুহুকে উদ্দেশ্য করে বলল- 

"এখানে একটা পার্ক আছে। পার্কের পাশেই নদী। সন্ধায় ভিউটা সুন্দর হয়। এর আগে এসেছেন কখনো?"


কুহু কি বলবে ভেবে পেলো না।এই পার্কে সে হাজারবার না লক্ষ বার এসেছে বান্ধবীদের সাথে। ক্লাস মিস দিয়ে এই পার্কের নদীর পাড়ে বসেই সবাই মিলে আড্ডা দেয়। কলেজে থাকতে  কলেজ মিস দিয়ে পার্কে আসায় পুলিশের দৌড়ানিও খেয়েছে। সে সুন্দরমতো বললো -

"কয়েকবার এসেছি। এছাড়া তেমন আসা হয় নি। "


"বাসা থেকে পারমিশন থাকলে নিয়ে যেতে পারি এখন।"


কুহুর চোখ দুটো চকচক করে উঠলো৷সে একবাক্যে বলে দিলো-

"বাসায় কিছু বলবে না।"


শাহাদ ডান পাশের রাস্তায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিলো।স্পিড তুলে দশ মিনিটের ব্যবধানে পার্কের গেটের সামনে এসে গাড়ি পার্ক করলো। পার্কে মোটামুটি অনেক ভীড়।সন্ধায় সবাই ঘুরতে বেড়িয়েছে।পাবলিক পার্ক হওয়ায় টিকিট লাগেনা,সবার জন্য উন্মুক্ত।শাহাদ কুহুকে নিয়ে পার্কে ঢুকলো। পথিমধ্যে অনেক জনের সাথেই তাকে কুশল বিনিময় করতে হলো।কেউ কেউ এসে কোলাকুলি করলো, কেউ হ্যান্ডশেক করলো। শাহাদ কুহুকে পার্কের শেষ মাথায় একটা চায়ের দোকানে নিয়ে গেলো। চায়ের দোকানদার সালাম দিলো। দোকানের ভিতর কয়েকটা ছেলে বসা ছিলো তারা উঠে "ভাই" ডেকে সালাম দিলো। শাহাদ কিছুক্ষন  তাদের সাথে কথা বলে দোকানের পিছনে এসে কুহুকে নিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসলো।কুহুকে উদ্দেশ্য করে বললো-

"সামনে তাকান।"


কুহু তাকালো কিন্তু কিছু দেখতে পেলো না।শাহাদ আঙুল তুলে তাক করলো একদিকে।এবারো কুহু দেখতে পেলো না।শাহাদ কুহুর কাছাকাছি এসে কুহুর একটা হাত নিজের হাতে নিলো। পুরুষালি হাতের গভীর স্পর্শ পেয়ে কুহু ঘাবড়ে গিয়ে শাহাদের দিকে তাকালো।শাহাদ কুহুর চোখে চোখে রেখে চমৎকার করে হাসলো। চোখ দিয়ে ইশারা করে বুঝালো সামনে তাকাতে।কুহু সামনে তাকালো। শাহাদ কুহুর হাতটা নিজের হাত দিয়ে ধরে একদিকে তাক করলো।ধীর স্বরে বলল- 

"হাত বরাবর তাকান।"


কুহু তাকালো। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে দেখতে পেলো জিনিসটা।নদীর ওপারে একটা রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টার সামনের জায়গাটায় নদীর পাড় ঘেষে লম্বা কয়েকটা স্ট্যান্ডে উলটো করে কতগুলো স্টিলের ইংরেজী অক্ষর বসানো। সেগুলো লাইটিং করা। সেই লাইটিং করা অক্ষরগুলোর প্রতিবিম্ব পড়েছে নদীর পানিতে। সেখানে উলটো অক্ষর গুলো একটা বাক্য তৈরি করেছে।সেটা হলো "I Love U"। লেখাটার পাশে একটা লাল রঙের লাভ।শাহাদ কুহুর হাত ছেড়ে দিলো৷ প্রশ্ন করলো- 

" দেখেছেন?"


কুহু মাথা নাড়লো,সে দেখেছে।শাহাদ সেদিকে তাকিয়ে বলল- 

"রেস্টুরেন্টের এই ব্যাপারটা খুব এক্সেপশনাল। ভাবলাম আপ্পনার ভালো লাগবে,তাই দেখাতে আনলাম।"


কুহু কিছু বললো না।শাহাদ হাত ধরায় তার অনুভূতিরা সব ওলট পালট হয়ে গেছে। এর মধ্যে চা নিয়ে এলো। শাহাদ দুটো কাপ নিজের হাতে নিলো।একটা কুহুর দিকে বাড়িয়ে বললো- 

"এখানকার চা টা অনেক ভালো। খেয়ে দেখুন।"


_________


হিশাম বাড়িতে ঢুকে হাঁক ছেড়ে স্ত্রীকে ডাকলো।তৃপ্তি ছুটে এলো স্বামীর ডাকে। হিশাম এক গ্লাস পানি নিয়ে আসতে বলল।তৃপ্তি দৌড়ে গিয়ে পানি এনে হিশামকে দিলো।হিশাম সোফায় বসে সবটুকু পানি শেষ করলো।তৃপ্তি কিছু বলবে তার আগেই হিশামের কল এলো।হিশাম কলটা কানে ধরে কিছু শুনলো।তারপর হিং*স্র হয়ে চিৎকার করে উঠলো-

"তোরা কি করছিলি?? আমার ছেলেদের রাস্তায় ফেলে মা*রলো আর তোরা একটা টোকাও দিতে পারলি না?"


আবার ওপাশ থেকে কিছু বললো।হিশাম আবারো গর্জে উঠলো-

"সংখ্যায় বেশি থাকলে অন্তত একটাকে তো আটকে রাখতে পারতি।তাহলে পুলিশ ধরতে পারতো। কয়েকটা ঘা মা*রলেই এসবের পিছনের আসল লোক বেরিয়ে আসতো।বাস্ট*র্ড!! টাকা দিয়ে তোদেরকে পুষে লাভ কি আমার?কাজে তো আসিসই না উলটো আমার নাম খারাপ করছিস।"


হিশাম কলটা কেটে ফোনটা ছুড়ে দিলো সোফায়।হিশামের মা মঞ্জুরা বেগম বেরিয়ে এসেছেন চিৎকার শুনে।জিজ্ঞেস করলেন-

"আবার কি হয়েছে?"


"শাহাদ আমার লোককে মে*রেছে।"


মঞ্জুরা বেগম কিড়মিড় করে বললেন-

"তাহলে পুলিশে গিয়ে মামলা করছিস না কেন?"


"শাহাদের কোনো লোক ছিলো না।যারা মে*রেছে সবাই লোকাল বস্তির।কিন্তু আমি শিউর এতে ওই শাহাদেরই হাত আছে। আমি ওকে খু*ন করব।"


তৃপ্তি বললো -

"খু*নোখু*নি ছাড়া কি তোমার মাথায় আর কিছু আসে না?"


মঞ্জুরা বেগম খেকিয়ে উঠলেন-

"কেন? তোমার এত লাগছে কেন? ওই শাহাদ তোমার কি হয়?"


"আহ মা,থামো। তৃপ্তি তুমি যাও। রিশাম কোথায়? ঘুমিয়ে পড়েছে?"


স্বামীর প্রশ্নে তৃপ্তি উত্তর দিলো- 

"হুমমম।অন্তত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে এসব বাদ দাও।ছেলেটাকে অন্তত এতিম করো না।"


"আর আমি যে পিতৃহারা হলাম তার বেলায়?"


"শাহাদ তোমার বাবাকে খু*ন করে নি।ছেলেটা বারবার এই কথা বলেছে।বাড়ি বয়ে এসে তোমাকে অনুরোধ করেছে ভুল না বুঝতে।শত্রুতা সৃষ্টি করতে কেউ ভুল বুঝাচ্ছে তোমায়।"


মঞ্জুরা বেগম বললেন-

"ওদের সাথে বন্ধুত্ব কবে ছিলো যে নতুন করে শত্রুতা হবে।আমার ছেলে নিজ চোখে শাহাদকে তার বাবাকে গু*লি করতে দেখেছে। এর চেয়ে বড় প্রমান আর কি,?"


মঞ্জুরা বেগম হিশামের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন-

"শোন বাবা, এই বদলা তোকে নিতে হবে।র*ক্তের বদলে র*ক্ত। আমি বিধবা হয়েছি।ওই খান বাড়ির অন্তত একটা মেয়ের গায়ে হলেও বিধবা তকমা লাগাতে হবে।তবেই আমার মন জুড়াবে।"


"হবে মা, সব হবে। শাহাদকে আমি ছাড়ব না।খান বাড়ির বংশ শাহাদ পর্যন্তই শেষ।এরপর আর কোনো বংশধর আসবে না।"


চলবে

গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ১০

 #টক_ঝাল_মিষ্টি 

#তামান্না_আঁখি 

#পর্ব-১০


আনিশার কান্না শুনে কুলসুমা বেগম আর জয়াও বের হয়ে আসলো। জয়া বেগম শ্বাশুড়ির পায়ে তেল মালিশ করছিলো, মালার  চিৎকার শুনে তৎক্ষনাৎ শ্বাশুড়ির পায়ের তেল মুছে তাঁকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। ড্রয়িং রুমে পা দিয়ে আনিশা আর রেজিয়া সুলতানাকে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থেকে কাঁদতে দেখলেন। আদরের নাতনীকে এত দিন পর দেখে কুলসুমা বেগমও আবেগী হয়ে গেলেন।জয়ার হাত ধরে আনিশার কাছে এলেন। আনিশা তার দাদীকে দেখে তাকেও জড়িয়ে ধরলো। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাহাত এতক্ষনে সুযোগ পেলো শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলার। সে শ্বাশুড়ির কাছে এসে সালাম দিলো। রেজিয়া সুলতানা শাড়ির আঁচল  দিয়ে চোখ মুছে রাহাতের সালাম জবাব দিলো।জিজ্ঞেস করলো-


"তোমার মা-বাবা ভালো আছে তো বাবা?"


"জী মা,আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো। বাবা কোথায়?শাহাদ,দাদাজান সবাই কোথায়?"


"ওরা তিনজন ই অফিসে গেছেন,আর তোমার চাচ্চু ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে আছে।কাল পরশু চলে আসবে।"


রাহাত একে একে বাকি সবার সাথেই কুশল বিনিময় করলো। রেজিয়া সুলতানা দুজনকেই ঘরে পাঠালেন রেস্ট নেয়ার জন্য।তারপর জয়াকে সাথে করে নিজে গেলেন রান্না ঘরে। কাজের লোকদের সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিলেন। এতদিন পর মেয়ে আর মেয়ে জামাই এসেছে তাদের জন্য দুপুরে ভালো মন্দ রান্না করতে হবে। কুলসুমা বেগম রান্নাঘরে একটা চেয়ার নিয়ে আরাম করে বসলেন।মালা পাশে বসে তাকে পান বানিয়ে দিলো।পান মুখে দিয়ে তিনি রান্নার তদারকি করতে লাগলেন। দুই পুত্রবধূকে বিভিন্ন উপদেশ দিলেন।নাতনী আর নাতজামাই এর যত্নের কোনো কমতি রাখবেন না তিনি।


রাহাত ঘরে এসেই হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। আনিশা ব্যাগ থেকে রাহাতের টি শার্ট ট্রাউজার বের করে দিয়ে বলল- 

"ফ্রেশ হয়ে এগুলো পড়ো।"


রাহাত বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো- 

"এগুলো কই থেকে বের করলে? নতুন কিনে এনেছো?"


"না এসব আগেরই ছিলো। আলমারিতেই ছিলো এতদিন।গতকাল লুকিয়ে রেখেছিলাম বলে দেখতে পাও নি।"


রাহাতের বিস্ময়ের পরিমান বেড়ে গেলো। এইগুলো কবে কিনেছে তা মনে করতে পারলো না। আনিশা নিজের জন্য জামাকাপড় বের করতে করতে বললো -


"বাবা আসলে ভদ্র ছেলের মতো গিয়ে দেখা করে আসবে। কোনো ধানাই পানাই করবে না,বুঝেছো।"


আনিশা জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। রাহাতের ফ্যাকাশে মুখ করে শুয়ে রইলো। আনিশার বাবার জন্যই সে এই বাড়ি আসতে ভয় পায়। ভদ্রলোক তার সাথে আনিশার বিয়ে দিতে চান নি।একবার তো দেখা করতে এসে উনার ব*ন্দুকের নলের সামনে পড়েছিলো। বিয়ের দিন থেকে আজ পর্যন্ত আনিশার বাবার সাথে সহজ আর হতে পারে নি।সামনে গেলেই একটা ভয় ভয় ব্যাপার কাজ করে।


কুহু রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ঘামছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে শিরিনা বেগম। তিনি গরম চোখে তাকিয়ে আছেন।কুহু অপরাধী কন্ঠে বললো-


"আরেকবার ট্রাই করে দেখি তাহলে মা?"


"আমি তোকে তিন জাতের মসলার প্রতিটা থেকে এক চামচ করে মোট তিন চামচ মসলা তরকারিতে দিতে বলেছি।আর তুই বাকি মসলা বাদ দিয়ে তিন চামচ হলুদ দিয়ে বসে আছিস।"


"মনে ছিলো না মা।"


"মন কই থাকে তোর।আবার কর। এরপর চিকেন আর বিফ রাঁধবি।"


শিরিনা বেগম সরে গিয়ে ডায়নিং এ বসে তরকারি কুটতে লাগলেন। কুহু চুলা বন্ধ করে পাতিলটা নামালো।পাতিলের ঝোলে কিছু সবজি ভাসছে, ঝোলের রঙ হলুদ। কুহু পাতিল নামিয়ে আরেকটা পাতিল বসালো। তারপর চুলা অন করে দিলো।শিরিনা বেগম তাকে রান্না শেখানোর ব্রত নিয়েছেন। কুহু যে একবারে রান্না পারে না তা না।টুকটাক নুডুলস রান্না চা কফি করা সে পারে। কিন্তু তরকারি সে এর আগে রাঁধে নি। তাই শিরিনা বেগম অল্প কিছু সবজি দিয়ে তাকে রান্না শেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।কুহুকে নিজহাতে সব সবজিসহ পেয়াজ মরিচ কাটতে হয়েছে৷ সে পাতিলে তেল ঢাললো, তেল গরম হতেই পেঁয়াজ মরিচ ছেড়ে দিলো।মনে মনে রেসিপিটা আরেকটু সাজিয়ে নিলো।অন্যমনস্ক হলে চলবে না,এইবার সে আর কোনো ভুল করবে না।


শিরিনা বেগম তরকারি কুটতে কুটতে হতাশ চোখে কুহুকে দেখলেন। মাথা চুলকে চুলায় চাপানো পাতিলে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আগে থেকেই কোনো কাজ না শিখানোর জন্য মনে মনে আফসোস করলেন। তিনি ভাবেন নি এত তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে, জানলে এই ভুল করতেন না।


সন্ধ্যার পর কুহু ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়লো। আজ দিনের বেশির ভাগ সময়ই সে রান্নাঘরে কাটিয়েছে, এখন সন্ধ্যার নাস্তার সময়ও শিরিনা বেগম তাকে দিয়ে কাজ করিয়েছে। কুহু মনে মনে চিন্তা করলো শিরিনা বেগমের কথা। তার মা বাড়ির সব কাজ করে,বাড়ির সবার দেখভাল করে, যে যখন যা খেতে চায় তাই-ই বানিয়ে দেয়, কখনো ক্লান্ত হওয়ার দোহাই দেয় না।অথচ সে একদিনেই কাহিল হয়ে গেছে। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়লো।কুহু উঠে বসলো। গলা উঁচিয়ে বললো-


"দরজা খোলা।"


দরজা হালকা ফাঁক করে যিয়াদ উঁকি দিলো। কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল- 

"আপু তোমাকে বাবা ডাকছে।"


যিয়াদ চলে গেলো। কুহু কিছুক্ষন বসে থাকলো।নিজেকে একটু পরিপাটি করে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো। মোয়াজ্জেম হোসেনের দরজায় নক করলো।ভিতর থেকে ভেসে আসলো-" দরজা খোলা আছে।"


কুহু ভিতরে ঢুকলো।দেখতে পেলো তার বাবা মা দুজনেই সোফায় বসে সামনের টেবিলে ঝুঁকে কিছু একটা দেখছে। শিরিনা বেগম ডাকলেন-

"এদিকে এসে বস।"


কুহু মায়ের পাশে গিয়ে বসলো।দেখলো টেবিলের উপর অনেকগুলো বিয়ের কার্ড। মোয়াজ্জেম হোসেন বিয়ের কার্ডগুলো কুহুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন-


"দেখো তো তোমার কোনটা পছন্দ হয়।তোমার যেটা পছন্দ হয় সেটাই ফাইনাল।"


কুহু উল্টেপাল্টে কয়েকটা কার্ড দেখে একটা সিলেক্ট করলো।হাতে নিয়ে সম্মতির আশায় শিরিনা বেগমের দিকে তাকালো। শিরিনা বেগম হাতে নিয়ে দেখলেন।মুখে বললেন-

"বাহ! সুন্দর তো!এটাই ফাইনাল করে দাও।"


মোয়াজ্জেম হোসেন চায়ে চুমুক দিয়ে উপর নীচ মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ এটাই ফাইনাল।


খান বাড়িতে ড্রয়িং রুমে বাড়ির সবাই এক হয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডার মধ্যমনি রাহাত। তার দুই পাশে রাফা আর রিদি বসে আছে। সে বিভিন্ন কথা বার্তা বলে তাদের দুজনকে হাসাচ্ছে। বাড়ির মহিলারাও পাশে আরেকটা সোফায় বসে চা খাচ্ছে আর শুনছে সব। রাহাত বেগুনিতে কামড় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো- 

"ওরা এখনো আসছে না কেন মা?"


জয়া বেগম চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বললেন- 

"ফোনে কথা হয়েছে শাহাদের সাথে। কাজে আটকে পড়েছে তারা।ব্যবসার কাজ শেষ করে সবাই পার্টি অফিসে গেছে।"


কুলসুমা বেগম রাহাতকে জিজ্ঞেস করলেন -

"তোমার বাবার খবর কি?সামনের নির্বাচনেও কি এমপি পদে দাঁড়াবে?"


রাহাত হেসে বিনয়ের সাথে বললো-

"জী ইন শা আল্লাহ।"


কুলসুমা বেগমের পাশে বসা মালা ফোঁড়ন কেটে বললো-

"আমরার এলাকায় সামনের নির্বাচনে ভাইজান দাঁড়াইব,তাই না চাচীআম্মা?"


রেজিয়া সুলতানা বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলেন-

"তোকে এই কথা কে বলেছে?"


মালা মুড়িমাখা চাবাতে চাবাতে বললো-

"চাচাজান রে চা দিতে যাইয়া শুনছি।মোবাইলে কার লগে জানি আলাপ করতাছিলো।"


বসার ঘরের সবাই থ হয়ে গেলো। তারা কেউই এই ব্যাপারে জানলো না অথচ মালা জেনে বসে আছে।রাহাত জিজ্ঞেস করলো- 

"শাহাদ নির্বাচন করবে?"


রেজিয়া সুলতানা বললেন-

"না এমন কোনো কথা হয় নি তো।ও কি শুনতে কি শুনেছে।"


শাহাদরা সবাই বাড়ি ফিরায় কথা আর আগালো না। তাদের আগে আগে দুজন লোক এসে হাত ভর্তি কিছু শপিং ব্যাগ আর কাঁচাবাজারের ব্যাগ এক পাশে রেখে গেলো। আব্দুল গাফফার খান বাড়িতে ঢুকেই হাঁক ছেড়ে আনিশাকে ডাকলেন।আনিশা আব্দুল গাফফার খানের গলা শুনে "দাদাজান" বলে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। আব্দুল গাফফার খান নাতনীর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। আশফাক খান মেয়েকে এত দিন পর দেখে মেয়ের কপালে চুমু খেলেন। শাহাদ জিজ্ঞেস করলো- 

"কেমন আছিস আপু?"


আনিশা শাহাদের চুল এলোমেলো করে বলল- 

"তোদেরকে দেখে এখন অনেক ভালো আছি।"


আনিশার দেখাদেখি রাহাত উঠে এসে সালাম দিলো আব্দুল গাফফার খানকে।আশফাক খানকে ভয়ে ভয়ে সালাম দিলো রাহাত।তিনি সালামের জবাব দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-

"অনেক দিন পর এসেছো। এইবার বেশ কয়েকটা দিন থেকে তারপর যাবে।কোনো ব্যস্ততার দোহাই দিবে না। আমার মেয়ে এত ঘন ঘন দূরের জার্নি করতে পারে না।"


রাহাত নীরবে মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিলো,না করার সাধ্য তার নেই।তাহলে আবার ব*ন্দুক নিয়ে তাড়া করবে।রাহাত সেই রিস্ক নিলো না সে আরো অনেকদিন থাকবে।একবার আড়চোখে তাকিয়ে শ্বশুড়ের চলে যাওয়া দেখলো। শাহাদ রাহাতের কাঁধে হাত রেখে বলল- 

"কি খবর ভাই? অবস্থা কিছুটা টাইট মনে হচ্ছে।"


"বিয়ে তো করো নি অবস্থা টাইটের কি বুঝবে। বিয়েটা আগে করো পরে বুঝবে কত ধানে কত চাল।"


শাহাদ চোখ মেরে বললো-

"আমার বউ এর বাবা নিজে থেকে আমাকে পছন্দ করেছে, তাই অবস্থা টাইট হওয়ার ভয় নেই।ধান চালও গুণতে হবে না।।"


রাহাত আসল জায়গায় খোঁচা খেয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলল- 

"বিয়ের আগেই বউ?হা? মনে তো হচ্ছে তোমার অবস্থা টাইট করবে তোমার বউ।"


শাহাদ ঠোঁট কামড়ে হাসলো।গলার স্বর নিচু করে রাহাতকে বললো-

" শ্বশুরের বদলে বউ এর হাতে অবস্থা টাইট হলে মন্দ হয় না।আই হোপ ব্যাপারটা সুইট হবে।"


রাহাত নাক কুচকে শাহাদের দিকে তাকালো।শাহাদের হাসি দেখে তার গা জ্বলে যাচ্ছে।এই শালা জাতির "শালাগিরি" না করলে চলে না? ঠিক ই সুযোগ বুঝে একটা খোঁচা মে*রে দিলো। রাহাতের ইচ্ছে হচ্ছে শাহাদের হবু বউ এর কাছে গিয়ে শাহাদকে নাকানি চুবানি খাওয়ানোর বুদ্ধি দিয়ে আসতে।


চলবে


[আজকের পার্টটা অনেক ছোট হয়ে গেছে।ব্যস্ততার কারনে গল্পটা গুছিয়ে লিখতে পারছি না। একে তো ব্যস্ততা তার উপর হাড় কাঁপানো ঠান্ডা, সব কিছু মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা। অনেকে প্রতিদিন গল্প দিতে বলছেন।কাল থেকে ইন শা আল্লাহ চেষ্টা করব প্রতিদিন দেয়ার😊।]

গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ৯

 #টক_ঝাল_মিষ্টি 

#তামান্না_আঁখি 

#পর্ব-৯


শাহাদের ভ্রুদ্বয় কুচকে গেলো। হাতে থাকা জিনিসটা একটু এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখলো।এটা দিয়ে লেবু চিপে? ভালো কথা লেবু চিপে কিন্তু কুহু এটা নিয়ে ঘুরছে কেন? সে কৌতুহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো- 

"লেবু চিপার জিনিস আপনি নিয়ে ঘুরছেন কেন?"


এই প্রশ্নের জবাবে কুহু কি বলবে ভেবে পেলো না।আসলেই তো লেবু চিপার জিনিস তো তার নিয়ে ঘোরার কথা না। কেন যে মিথ্যা বলতে গেলো, এর চেয়ে সত্যি বলে দিলেই হত যে এটা সাজগোজের জিনিস।কোনো এক ফাঁকে ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে গিয়ে হয়তো গাড়িতে পড়ে গেছে । কুহু আমতা আমতা করে বলল- 


"ব্যাগে ছিলো আর কি। মায়ের জন্য কিনেছিলাম, পরে বের কর‍তে মনে নেই।"


কুহু মনে মনে নিজেকে গালি দিলো।একটা মিথ্যা বললে তা যে অনেকগুলো মিথ্যা নিয়ে আসে হাতেনাতে তার প্রমান পেলো।অনন্ত জলিলের মতো বলতে ইচ্ছে করলো "একটা মিথ্যা বললে সেটা অনেকগুলো আরো মিথ্যা বলে ঢাকার চেষ্টা করলে সেটা মিথ্যাই থেকে যাবে"।


শাহাদ এই জিনিসটা গাড়িতে পেয়ে যতটা না অবাক হয়েছে তার চেয়েও বেশি অবাক হলো কুহুর কথা শুনে। প্রথমদিন দেখেছে আধ খাওয়া রুটি নিয়ে ঘুরতে আর আজ জানলো লেবু চিপার জিনিস নিয়েও ঘুরে। আর কি কি নিয়ে ঘুরে এই মেয়ে? সে জিনিসটা গাড়ির সিটে রেখে দিলো৷ বললো-


" আপাতত আমার কাছেই রাখলাম কাল কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিব কেমন?"


কুহু ব্যস্ত হয়ে বললো-

"না না পাঠাতে হবে না আপনার কাছেই রেখে দিন?'


" আমি লেবু চিপার জিনিস দিয়ে কি করব?"


খুবই যুক্তিপূর্ন প্রশ্ন।আসলেই তো লেবু চিপার জিনিস হোক আর সাজগোজের জিনিস হোক তা রেখে শাহাদ কি করবে?ওর তো কোনো কাজে আসবে না। কুহু নিজের মাথায় একটা চড় দিলো। সব ভুলভাল কথা বলছে। শাহাদকে এটা কোন দুঃখে রাখতে বললো সে। কুহু মিনমিন করে বলল- 


"তাহলে পাঠিয়ে দিন।"


"ঠিক আছে।আপনি ক্ষতটা ক্লীন করেছেন?"


কুহু পায়ের বুড়ো আংগুলের দিকে তাকালো। সেখানে একটা ব্যান্ডেজ লাগানো। বললো-

"হ্যা করেছি।"


"গূড। এখন তাহলে রাখছি।"


খট করে কলটা কেটে গেলো। কুহু মাত্র "গূড নাইট" বলার জন্য মুখ খুলেছিলো কিন্তু তা আর বলতে পারলো না। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল- 

"কি ভেবে রসগোল্লা নাম দিলাম? এর তো রসকষ কোনোটাই নেই।"


-----


শাহাদ বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যা ৭ টার পর। বাড়িতে ঢুকলো কুহুর আইল্যাশ কার্লার হাতে নিয়ে। বাড়িতে ঢুকে কুলসুম বেগমের গলা শুনতে পেলো।তিনি সোফায় বসে পান চাবাচ্ছেন আর সামনে ফ্লোরে বসে থাকা মালাকে ধমকাচ্ছেন। শাহাদ হাতের জিনিসটা সোফায় রেখে কুলসুমা বেগমের পাশে বসে পড়লো।জিজ্ঞেস করলো-


"মেজাজ খারাপ নাকি আমার দাদীজানের?"


কুলসুমা বেগম সামনে মালাকে দেখিয়ে বললেন-

"দেখিস না একটা কাজও করতে পারে না।এতদিন আমার কাছে থেকে কিচ্ছু শিখলো না।"


শাহাদ মালার দিকে তাকিয়ে দেখলো মালা ফ্লোরে বসে টি টেবিলের উপরে একটা ডালায় চাল নাড়াচাড়া করছে। কুলসুমা বেগম রাগী স্বরে বললেন-


"আর কদিন পর বাড়িতে বিয়ে এখনো চালগুলো বেছে রাখা হলো না। তোর মা-চাচীদের কি কোনো হুঁশ আছে এই বিষয়ে? তারা শাড়ীর আঁচল দুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।"


"চাল তো কিনেই আনা যাবে। ওইসব চাল বাছতে হয় না।"


কুলসুমা বেগম নাতির দিকে তাকিয়ে খ্যাক করে উঠলেন-

"তুইও তো তোর মা-চাচীদের মতো হয়েছিস। নতুন বউ এসে বাজারের চাল খাবে? এইগুলো আমাদের জমির ধান থেকে করা চাল। এরকম চাল বাজারে পাবি?'


শাহাদ মুচকি হেসে মাথা নেড়ে জানালো সে পাবে না। কুলসুমা বেগম আরো একবার সামনে বসে চাল খুটতে থাকা মালাকে তাড়া দিলেন। মালা বেজার মুখে বাছতে লাগলো। জয়া বেগম শ্বাশুড়ির জন্য চা নিয়ে এলেন। শব্দ যেন না হয় এমনভাবে টেবিলের উপর রাখলেন চায়ের কাপ। মুখে বল্লেন-


" মা,চা।"


কুলসুমা বেগম ছোট পুত্রবধূর দিকে একবার নজর দিলেন। গোলগাল সুশ্রী মুখশ্রীতে ঘাম দেখে তার হৃদয় ভরে গেলো। বাড়ির বউ রান্নাঘরে থেকে নিজের হাতে সবার জন্য রান্না করছে, সবাইকে আদর করে খাওয়াচ্ছে এইটা আল্লাহর রহমত নিয়ে আসে। তাঁর দুই পুত্রবধূরই এই গুণ আছে।বাড়িতে এত কাজের লোক থাকার পরও তারা নিজের হাতে সব কিছু সামলায়।পুত্রবধূর থেকে চোখ সরিয়ে বললেন-


"এতক্ষনে চা দেয়ার সময় হলো তোমাদের। দাও, হাতে তুলে দাও।টেবিলে রেখেছো কোন বুদ্ধিতে।"


জয়া বেগম জলদি হাতে চা নিয়ে বিনয়ের সাথে শ্বাশুড়ির হাতে চায়ের কাপ টা প্লেট সহ দিলেন। কুলসুমা বেগম চা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

"তোমরা দুজন চা আর নাস্তা নিয়ে এখানে এসে বসো। হালকা নাস্তা করে তারপর রাতের রান্না করো।"


"আপা আর আমি ডায়নিং এ নাস্তা করছি মা।আপনি খান।"


জয়া বেগম এক প্রকার পালিয়ে গেলো শ্বাশুড়ির সামনে থেকে। তার শ্বাশুড়ি অনেক ভালো মানুষ। বাড়ির বউদের তিনি আদরে রাখেন কিন্তু বউ দের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে ব্যাঘাত ঘটলে তিনি এক চুল ছাড় দেন না।কুলসুমা বেগম চায়ে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। বেশ ভালো চা বানায় তার ছোট পুত্রবধূ। তাকে চা খাওয়ার সময় দিয়ে শাহাদ জিজ্ঞেস করলো- 

"দাদাজান কোথায়?"


"ঘরের ভিতর বই পড়ছে।"


"দাদাজানকে চা দাও নি।"


"দিয়েছি। খাবে বলে মনে হয় না।আজ চায়ে চিনি পড়েনি কিনা!"


শেষের কথাটা বলার সময় মালার দিকে একবার তাকালো কুলসুমা বেগম।মালা চোরের মতো কাচুমাচু মুখে এদিক ওদিক তাকালো। শাহাদ বুঝতে পারলো তার মিষ্টিপ্রিয় দাদা ধরা পড়ে গেছে দাদীর হাতে। কুলসুমা বেগম মালার দিকে ইশারা করে বল্লেন-


"এই হচ্ছে তোর দাদাজানকে চিনি দেয়ার মূল কারিগর।প্রতিবার চিনি দেয়ার বিনিময়ে ৫০০ টাকা করে নেয়।এই জন্য আজ শাস্তি হিসেবে চাল বাছার কাজ দিয়েছি।"


মালা নড়েচড়ে বসলো। আজ দাদাজানের চায়ে চিনি দিতে গিয়ে যে ধরা পড়ে যাবে তা ভাবে নি। এখন দাদীর রোষানলে পড়েছে সে। শাহাদ হেসে জিজ্ঞেস করলো- 

"আর দাদাজানকে কি শাস্তি দিলে?"


"তার ভাত খাওয়া বন্ধ।শুধু রুটি খাবে।আর সকালে এক ঘন্টা পার্কে হেঁটে আসবে।"


শাহাদ হেসে দুপাশে মাথা নাড়লো।আব্দুল গাফফার খান যা একবেলা অল্প ভাত খেত এখন সেটাও বন্ধ করে দিলো কুলসুমা বেগম।এইবার আব্দুল গাফফার খানকে তিনবেলাই রুটি খেতে হবে। শাহাদ পাশ থেকে আইল্যাশ কার্লারটা নিয়ে উঠে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিলো।সিদ্ধান্ত নিলো ফ্রেশ হয়ে তার দাদাজানের ঘরে যাবে। নিশ্চয়ই বেচারা বউ এর চাপে কোণঠাসা হয়ে আছে। সিড়ি দিয়ে উঠে দুতলায় এসে রাফার সাথে দেখা। সে নিচে যাচ্ছিল, শাহাদকে দেখে ডেকে বললো- 


"ভাইয়া তোমাকে চাচাজান খুঁজেছিলো।"


"বাবা এখন কোথায়?"


"স্টাডিরুমে।"


"আচ্ছা।"


শাহাদ যেতে নিলে রাফার নজর পড়লো শাহাদের হাতের দিকে। জিজ্ঞেস করলো- 

"তোমার হাতে এটা কি?"


শাহাদ হাতে থাকা জিনিসটার দিকে তাকিয়ে বলল- 

"এটা কুহুর,গাড়িতে ফেলে গেছে।লেবু চিপে এটা দিয়ে।"


"লেবু চিপে?"


"হুম।"


শাহাদ কুহুর কথিত "লেবু চিপার জিনিস" নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো। রাফা বিস্ময়ে হা হয়ে তাকিয়ে থাকলো শাহাদের যাওয়ার দিকে।


শাহাদ ফ্রেশ হয়ে আশফাক খানের স্টাডিরুমের সামনে এলো। দরজায় টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো- 

"বাবা আসব?"


ভিতর থেকে ভেসে এলো গুরুগম্ভীর স্বর-

"এসো।"


শাহাদ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো।আশফাক খান সিংগেল সোফায় বসে পেপার পড়ছেন। সামনের টেবিলে চায়ের কাপ রাখা। সোফার অপর পাশে একটা বড় টেবিল আর আরামদায়ক চেয়ার রাখা।টেবিলের উপর ফাইল আর বইয়ের স্তূপ। ঘরে কয়েকটা আলমারি আছে।কয়েকটায় বই রাখা আর বাকিগুলায় সব ফাইল। রুমটাকে স্টাডি রুম না বলে বরং আশফাক খানের অফিসই বলা যায়।এখানে বসেই উনি সব কাজ সারেন। কাজের প্রয়োজনে বাইরের লোকের সমাগম আছে বলে এই রুমটা বাড়ির এক পাশে রেখেছেন যেন বাড়ির প্রাইভেসি নষ্ট না হয়।


শাহাদ পাশের সোফাটায় বসে পড়লো। আশফাক খান পেপার পড়ছে। শাহাদ তাঁকে পেপার পড়ার সময়  দিলো।সে শান্তভাবে বসে রইলো। আশফাক খান পেপার পড়া শেষ করে পেপারটা ভাঁজ করে একপাশে রাখলেন তারপর শাহাদকে জিজ্ঞেস করলেন-

"শুনলাম ছেলেদের উপর হাম*লা হয়েছে?"

"জী বাবা।তবে এতটা চিন্তিত হওয়ার মতো কিছু হয় নি।আমি সামলে নেব।"

"কিভাবে সামলাবে শুনি।"


শাহাদ একটু চুপ করে থেকে বললো-

"মা*রের বদলে মা*র দেব।"


"এতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে না?এমপির লোকজন সাধারন মানুষের উপর হাম*লা করছে সাথে এমপির ছেলেও আছে। এই ব্যাপারটা খুব চটকদার নিউজ হয়ে যাবে।"


"দলের কারো কোনো সংযোগ থাকবে না এই ঘটনায়।ইভেন মা*রামা*রির কারনটাও এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যে দলের উপর কেউ আঙুল তুলবে না।"


আশফাক খান নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে সোফায় হেলান দিলেন। ছেলে রাজনীতি শিখছে। প্রয়োজনে যে  হাত নোংরা করতে হয় তা বুঝতে পারছে। পারিবারিক এই প্রথা আরেক পুরুষ টিকিয়ে রাখতে পারবে এই ছেলে। 

শাহাদ নির্বিকার ভাবে বসে রইলো কিন্তু মনে মনে কিছুটা নার্ভাস ফিল করছে সে। তার এই কাজ আশফাক খানের মনঃপূত হলো কিনা তা নিয়ে সামান্য চিন্তিত হলো। আশফাক খান চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বললেন-

"ঠিক আছে তাহলে। শুধু খেয়াল রেখো বাড়াবাড়ি যেন না হয়।যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ রাখবে।"


বাবার অনুমোদন পেয়ে শাহাদ ভিতরে ভিতরে চিন্তামুক্ত হলো।সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লো। এই পুরো ঘটনায় সবকিছু সীমার মাঝেই রাখবে সে।

_______


সকাল সকাল খটখট শব্দে ঘুম ভাঙলো আনিশার। বিছানায় উঠেবসে শব্দের উৎস খুঁজতে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। দেখতে পেলো টাওয়াল পড়া রাহাতকে।সে লাগেজের চেন ধরে টানাটানি করছে। আনিশা প্রশ্ন করলো- 

"কি করছো তুমি?"


রাহাত আনিশার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল- 

"আমি তোমার জামাকাপড় গুছিয়ে দিয়েছি লাগেজে। উঠে ফ্রেশ হও তো। ব্রেকফাস্ট করে আমরা রওয়ানা দিব।"


"কোথায় রওয়ানা দিব?"


আনিশার প্রশ্নে রাহাত মুখ তুলে অবাক হওয়ার ভান করে বলল- 

"কোথায় আবার!! আমার শ্বশুর বাড়ি। আমার একমাত্র শালার বিয়ে না?"


আনিশার মন চাইলো দৈত্যের মতো "মুহুহুহাহাহা" করে একটা হাসি দিতে।পুরুষ মানুষ আয়ত্তে আনা তেমন কঠিন কিছু না শুধু জায়গামতো টাইট দিতে হয়। আনিশা জিজ্ঞেস করলো- 

"চেন টানাটানি করছো কেন?"


"চেনটা লাগছে না। তোমার অনেক জামাকাপড় নিয়েছি তো তাই। "


আনিশা উঠে গিয়ে লাগেজের চেনটা টেনে খুললো।লাগেজ খুলে ভেতরের অবস্থা দেখে সে হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। তার ইস্ত্রি করা সব জামাকাপড় এক প্রকার দলা পাকিয়ে রাখা হয়েছে।সবকটারই ইস্ত্রি নষ্ট হয়ে গেছে। রাহাত গর্বে বুক ফুলিয়ে বললো-

"দেখেছো কি সুন্দর করে তোমার লাগেজ গুছিয়ে দিলাম।তোমার কাজ কমিয়ে দিয়েছি।"


আনিশার মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না।কাজ কমিয়ে দিতে গিয়ে আরো বাড়িয়ে ফেলেছে এই লোক।আবার গর্ব করে বলছে।সে অবিশ্বাসী চোখে জামাকাপড় গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। রাহাত গাইগুই করে বলল- 


"এখন তাহলে আমার জামাকাপড় বের করে দাও।এসব পরে কি শালার বিয়েতে যাওয়া যাবে?"


আনিশা উঠে রাহাত যে পাশে বিছানায় শোয় সেই পাশের তোষক তুলে কয়েকটা প্যান্ট শার্ট বের করে বিছানায় রেখে ওয়াশরুমে চলে গেলো। রাহাত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। নিজের জামাকাপড়ের উপরেই সে টাওয়েল পড়ে ঘুমিয়েছে? এজন্যই সকালে সারা ঘর খুঁজেও সে জামাকাপড় পায় নি। কারন আনিশা রেখেছে তোষকের নিচে।নিজের। নিজের চেয়ে বুদ্ধিমতি স্ত্রী পেলে পুরুষ মানুষের পদে পদে বিপদ।

_________


কুহু বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টি উদাস। যেন দুনিয়ার কোনো কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না। যেই জিনিসকে সে লেবু চিপার জিনিস নাম দিয়েছে সেই জিনিস শাহাদ নাকি আবার তাকে ফেরত পাঠাবে! কি কান্ড!!হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না।আর সেও বা কেমন,এই জিনিস শাহাদের গাড়িতেই ফেলতে হলো কেন?


 কুহুর ঘরের দরজা খোলাই ছিলো। যিয়াদ মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিলো। কুহুকে এভাবে ম*রা মানুষের মতো শুয়ে থাকতে দেখে গলা উঁচিয়ে বললো-


"এই হুকু,তোমার বান্ধবী এসেছে।উঠে নিচে আসো।"


কুহু তড়াক করে বিছানায় উঠে বসলো।বিছানায় থাকা একটা কুশন নিয়ে রাগের চোটে ঢিল দিলো যিয়াদকে লক্ষ্য করে। যিয়াদ সাথে সাথে দরজা থেকে সরে গেলো। ফলাফলস্বরূপ কুশনটা পড়লো ফ্লোরে। যিয়াদ পুনরায় দরজায় উঁকি দিয়ে বলল- 


"শাহাদ ভাইয়াকে যদি এই " হুকু" নাম আমি না বলেছি তাহলে আমার নাম যিয়াদ না।"


বলেই একটা শয়তানি হাসি দিয়ে দরজা থেকে সরে গেলো যিয়াদ। কুহু কিছুক্ষন বিরক্ত চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বিড়বিড় করে বলল-


"তোর বলতে হবে না৷ এই কাজ আমি অনেক আগেই সেরে ফেলেছি।"


___________


টানা সাড়ে তিন ঘন্টা জার্নি করে খান বাড়ির গ্যারেজে রাহাতের গাড়ি এসে থামলো। এতদিন পর বাপের বাড়ি আশায় গাড়ি থামতেই দরজা খুলে লাফিয়ে নেমে পড়লো আনিশা। রাহাতও নামলো পাশ থেকে। সামনে দাঁড়ানো বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আনিশার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে রাহাতকে ফেলেই ছুটে গেলো সদর দরজার দিকে। পেছন থেকে রাহাত আস্তে যেতে বললেও শুনলো না।রাহাত ড্রাইভারকে ব্যাগগুলো নিয়ে আসতে বলে সেও বড় বড় পা ফেলে আনিশার পিছু নিলো। 


আনিশাকে প্রথম দেখতে পেলো মালা।সে বাড়ির সদর দরজার সামনের গাছের টবে পানি দিচ্ছিলো।আনিশাকে  ছুটে আসতে দেখে হাতে থাকা পানি দেয়ার ঝাঁঝরি ফেলে দিয়ে বাড়ির ভেতর দৌড় দিলো। ড্রয়িং রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললো-


"ও চাচীআম্মা,ও দাদীজান,বড় আপা আইছে। সাথে দুলাভাইও আছে।"


এই কথা বলে পিছন ফিরে দৌড় দিলো সদর দরজার দিকে। আনিশা ততক্ষনে সদর দরজা দিকে ঢুকে পড়েছে। মালা আনিশার দিকে ছুটে গেলো। "ও বড় আপা গো" বলে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। আনিশাও জড়িয়ে ধরলো মালাকে।তারপর মালাকে ছাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো- 

"কেমন আছিস?বাকিরা সব কোথায়?"


মালা গাল বেয়ে নেমে আসা চোখের পানি মুছে বললো-

"তুমি এতদিন পর আইসো আপা,এইবার আমি তোমারে যাইতে দিতাম না।"


ভর দুপুরে মালার চিৎকার চেঁচামেচিতে রেজিয়া সুলতানা নেমে এলেন। আনিশাকে দেখে বিস্ময়ে থ হয়ে গেলেন। আনিশা দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। এতদিন পর মেয়েকে দেখে রেজিয়া সুলতানা বিশ্বাস কর‍তে পারলেন না নিজের চোখকে। আনিশা কেঁদে দিলো মা কে জড়িয়ে ধরে। ততক্ষণে রাহাতও চলে এসেছে। আনিশাকে বাপের বাড়ি এসে এত আবেগপ্রবণ হতে দেখে তার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হলো। এত দিন মেয়েটা কত বায়না করেছে,,

 রাগ করেছে  অভিমান করেছে কিন্তু তাও সে বাপের বাড়ি নিয়ে আসতে পারে নি।সে চেষ্টা করেছে কিন্তু সময় সুযোগ হয় নি। নিজের উপর বেশ রাগ হলো রাহাতের। আনিশার কান্না দেখে সে সিদ্ধান্ত নিলো এরপর যখনই আনিশা আসতে চাইবে তখনি নিয়ে আসবে, বাকিসব গোল্লায় যাক।তার বউ এর ইচ্ছা সব কিছুর উর্ধ্বে তার কাছে।শুধু সিদ্ধান্তই নিলো না মনে মনে কঠিন প্রতিজ্ঞাও করলো।কিন্তু তখন তার মনে হলো কে জানি মাথায় একটা বাড়ি দিয়েছে সাথে মাথার ভিতর কে একটা বললো-

"যে প্রতিজ্ঞা কস্মিনকালেও রাখতে পারবি না তা করছিস কেন? বাটপার কোথাকার!!"


রাহাত মিইয়ে গেলো। বুঝতে পারলো ভুলভাল প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে সে। ক্রন্দনরত আনিশার দিকে  তাকিয়ে মিনমিন করে বলল- 

"মাফ করে দাও বউ।তোমার স্বামী একটা বাটপার।বাটপার স্বামীর প্রতিজ্ঞা ধরে বসে থাকতে নেই।"


পাশ থেকে মালা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো- 

"দুলাভাই বিরবিরাইয়া কি কন?"


চলবে

গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ৮

 #টক_ঝাল_মিষ্টি 

#তামান্না_আঁখি 

#পর্ব-৮


শাহাদ পার্টি অফিসের সামনে এসে গাড়ি থেকে নামলো। গেট থেকেই দেখতে পেলো অফিসের পরিস্থিতি বেশ গরম। অল্প বয়স্ক কয়েকটা ছেলের হাতে লাঠি,চোখেমুখে উত্তেজনা। শাহাদ গাড়ি লক করে চাবি পকেটে ঢুকিয়ে গেট দিয়ে ঢুকলো। অফিসের চারদিকেই দেয়াল দেয়া,অফিসের সামনে গাড়ি পার্ক করার জন্য কিছুটা খোলা জায়গা রাখা হয়েছে। খালি জায়গাটায় দেয়ালের পাশে অনেকগুলো বাইক।সেগুলোর আশেপাশেও উত্তেজিত অবস্থায় কয়েকজনকে দেখা গেলো। শাহাদকে দেখে সবাই বাইক থেকে নেমে এলো। "ভাই" ডেকে কিছু বলতে চাইলো। শাহাদ হাত উচিয়ে চুপ করতে বললো সবাইকে। শাহাদের সাথে সাথে ছেলেগুলোও পার্টি অফিসের ভিতরে ঢুকলো। 


অফিসের সামনের ঘরটায় অনেকগুলো প্লাস্টিকের চেয়ার দেয়ালের সাথে রাখা। সেগুলোতে অনেকেই বসে আছে, অনেকে ঘরের মাঝখানে ভীড় করে আছে। শাহাদকে দেখে তারাও আলোচনা থামিয়ে দিলো।শাহাদ এই ঘর পেরিয়ে মিটিং ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকে দেখতে পেলো তমালকে। সে কানে ফোন নিয়ে গালিগালাজ করছে। মিটিং রুম টা বেশ বড়।লম্বা একটা টেবিল, তার দুই পাশে নেতাকর্মীদের জন্য রাখা আরামদায়ক চেয়ার। টেবিলের এক দিকে একটা বেশ দামি কাঠের চেয়ার। এটাতে দলের সভাপতি বসে। 


শাহাদ সব চেয়ার পেরিয়ে সভাপতির চেয়ারের কাছের চেয়ারটায় বসে পড়লো। লম্বা শ্বাস টেনে পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসলো। সবাই এসে টেবিলের আশেপাশে ভীড় জমালো। তমাল দ্রুত কল শেষ করে দৌড়ে শাহাদের এক পাশে দাঁড়ালো। শাহাদ প্রশ্ন করলো- 


"ওরা কোথায়?"


"এখুনি নিয়ে আসছি ভাই।"


তমাল ভীড়ের মাঝের কয়েকজনকে ইশারা করে কিছু একটা বুঝালো। কিছুক্ষন পর ধরাধরি করে কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে আসা হলো।সবারই শরীরের এখানে ওখানে ব্যান্ডেজ।কারো হাত ভাঙা,কারো মাথা ফেটে গেছে, কারো আবার মুখের এখানে সেখানে ব্যান্ডেজ।। একজনের পা ভেঙে যাওয়ায় তাকে দুজন দুদিক থেকে ধরে কোলে করে নিয়ে এসে টেবিলের অপর পাশে একটা চেয়ার টেনে বসিয়ে দিলো। শাহাদ বাকিদেরকেও বসার জন্য ইশারা করলো। সবাই বসলে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো।মোট ছয়জন আহত হয়েছে।খুব ভালো ভাবেই আহত হয়েছে। শাহাদ প্রশ্ন করলো- 

"কিভাবে হয়েছে?"


তমাল শাহাদের দিকে ঝুঁকে বললো-

"ভাই বললাম না ওই মিজান আর তার দল......"


শাহাদ বাধা দিয়ে বলল- 

"ওদের কাছ থেকে শুনব। তোরা বল কিভাবে হয়েছে?"


ছয়জনের একজন অসুস্থ কন্ঠে বললো-

"ভাই, আমরা ছয়জন স্টেশন রোড গেছিলাম ক্যারাম খেলতে। স্টেশনে বইসা ক্যারাম খেলতাছি। তখন বিকালের ট্রেন আসার সময় হইছে। এমন সময় দেখলাম একজম যাত্রী টিকিট কাউন্টারে চিল্লাপাল্লা করতাছে। আমরা দুই জন গেলাম। গিয়া দেখি মিজানের গ্যাং এর এক ছেলের সাথে এক মধ্যবয়স্ক লোকের ঝামেলা হইছে। ঘটনা শুইনা বুঝলাম কাউন্টারে টিকিট না থাকায় ওই লোক  জরুরি প্রয়োজনে ব্ল্যাক-এ টিকিট কাটতে চাইতাছে। কিন্তু টিকিটের দাম চাইতাছে তিনগুন বেশি।এইটা নিয়ে তাদের ঝামেলা। ঝামেলার এক পর্যায়ে ব্ল্যাক-এ টিকিট বিক্রি করা ছেলেটা ওই ভদ্রলোকরে ধাক্কা মারলো। তখন আমরা প্রতিবাদ করলাম। তখন ওই ছেলে আমাদেরকেও ধাক্কা মারলো।"


তমাল রাগী কন্ঠে বললো- 

"দেখছেন ভাই,ওদের সাহস কতটুক বাড়ছে।"


"আহ!ওদের বলতে দে।"


শাহাদের কথায় তমাল থেমে গেলো। ছেলেটা আবার বলতে শুরু করলো-

"আমাদের ধাক্কা দেয়ার পর আমরাও ধাক্কা দেই। এতে ওই ছেলেটা ইচ্ছে করে আমাদের উপর এলোপাথাড়ি ঘুষি মারতে থাকে।


তারপর পাশে বসা আহত হওয়া বাকিদের দিকে দেখিয়ে বলল- 

" গন্ডগোল বুঝতে পেরে ওরাও ছুটে আসে। ওরা এসে আমাদেরকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়৷ কিন্তু ওই ছেলেটা সহ আরো কয়েকজন মিলিত হয়ে আমাদেরকে গালাগাল দেয়,তেড়ে আসতে চায়। ওদের সাথের একজন ফোন করে আরো কয়েকটা ছেলে নিয়া আসে। আমরা ওইখান থাইকা সইরা আসতে চাইলে ১০-১২ জন এক হয়ে আমাদেরকে ঠেলতে ঠেলতে স্টেশনের বাইরে ফাঁকা জায়গাটায় নিয়া যায়। তারপর লাঠি দিয়া যে যেভাবে পারে আমাদেরকে মারতে থাকে। এক পর্যায়ে স্টেশনে থাকা পুলিশ আসলে ওরা পালিয়ে যায়।"


শাহাদ সবটা শুনলো।এক হাত টেবিলে রেখে তর্জনি দিয়ে কয়েকটা টোকা দিলো। তমালকে জিজ্ঞেস করলো- 

"এই দলের সবাইকে একসাথে কোথায় পাওয়া যাবে?"


"ভাই ওরা ইদানীং স্টেশন রোডেই বেশি আড্ডা দেয়। ওইখানে ব্ল্যাক এ টিকিট ব্যবসা শুরু করছে।"


তমালের কথায় শাহাদ ঠোঁট ঘষলো। প্রশ্ন করলো- 

"কবে থেকে?"


"বেশিদিন না ভাই। এই কয়েকমাস হবে। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে এরা ততই মাথা ছাড়া দিয়ে উঠছে।"


"আগে যেই গ্রুপ ব্ল্যাকে টিকিট দিত তারা এখন কোথায়?"


"তারা তো স্টেশনের বস্তিতেই থাকে।আপনি নিষেধ করায় ব্যবসা বন্ধ করে দিছিলো।এখন মিজানের গ্যাং এই ব্যবসা দখল করছে।"


"এক কাজ কর ওদেরকে ব্যবসায় ফিরতে বল। ওদের যে লিডার ছিলো তাকে লোকজন জোগাড় করে দল ভারী করে ব্যবসায় নামতে বল।"


সাব্বির নামের একটা ছেলে বিস্মিত কন্ঠে বললো- 

"ভাই ব্ল্যাকের ব্যবসার অনুমোদন দিয়ে দিবেন?"


"হুম। সব ব্যবসারই দরকার আছে। ওরা ট্রেনপ্রতি ৫০ টা টিকিট ব্ল্যাকে পাবে।প্রতি টিকিটে ৫০ টাকা লাভ। ব্ল্যাক টিকিট ছাড়বে ট্রেন ছাড়ার দশ মিনিট আগে।যাদের খুব প্রয়োজন তারা কিনবে।"


তমাল বললো-

"কিন্তু ভাই এটা তো বেআইনি।থানা পুলিশ জানলে...."


"এই কাজ আমি বন্ধ রাখলেও বন্ধ থাকবে না কেউ না কেউ চালু করবে,ঝামেলা করবে।এর থেকে এই ব্যবসা টা আমাদের আন্ডারে থাকবে, ঝামেলা কম হবে।সাধারন জনগন পর্যাপ্ত পরিমান টিকিট ব্ল্যাক ছাড়াই পাবে। বাকি যারা থাকবে তারা ব্ল্যাকে কাটবে।"


"ঠিক আছে ভাই আমি কথা বলে দেখছি।"


"সাথে এটাও বলবি এই ব্যবসা চালু করে দেয়ার বিনিময়ে ওরা আমার একটা কাজ করে দিবে।"


"কি কাজ ভাই?"


"এই মারামারির সাথে যারা যারা জড়িত ছিল তাদের প্রত্যেককেই একই রকমভাবে এই মারের উত্তর দিতে হবে। এবং এই ঘটনায় আমার দলের কেউ যাবে না। ওরা বস্তি থেকে ছেলে নিয়ে এই কাজ সারবে। ব্যাপারটা যেন এরকম হয় যে ব্ল্যাকে টিকিট ব্যবসা নিয়ে দুই দলের মারামারি। ঠিক আছে?"


সামনে বসে থাকা মার খাওয়া ছেলেগুলো খুশিতে টেবিলে দিলো। শাহাদ সামনে দাঁড়ানো দলের বাকি ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলল- 


"ইট মারলে পাটকেল খেতে হবে। ছাড় দিলে এর পরের বার লাশ ফেলবে। তাই ক্ষমা করার প্রশ্নই আসে না।আমি এখানে রাজনীতি করতে বসেছি, চ্যারিটি কর‍তে নয়।"


_________


রাত আনুমানিক ৮ টা বাজে। রাহাত বিরস মুখে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার পড়নে টাওয়াল আর স্যান্ডো গেঞ্জি।বাইরে থেকে এসে বাইরের জামাকাপড় পড়ে রাখার অভ্যাস নেই তার। হাত মুখ ধুয়ে নরমাল জামাকাপড় পড়লে তবেই তার শান্তি। কিন্তু আনিশা তার সকল জামাকাপড় এমনভাবে কেটেছে যে গায়ে দেয়ার উপায় নেই।এক্টা পুরাতন লুংগি পর্যন্ত ছাড় দেয় নি। রাহাত খুলে রাখা শার্ট আর প্যান্টটা আনিশার ভয়ে নিজের কাছে রেখেছে। বলা তো যায় না কখন এই দুটোকেও কেটে ফেলে। ঘাড় ঘুরিয়ে ডিভানে বসে থাকা আনিশার দিকে একবার  তাকালো।আনিশা কোলের উপর বালিশ নিয়ে আয়েশ করে বসে রসমালাই খাচ্ছে। সামনের টেবিলে রাখা ল্যাপটপটায় বোধ হয় খুব ইন্টারেস্টিং কিছু চলছে, কারন আনিশা সেদিকে তাকিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছে।রাহাত চাইলেই জামা কাপড় অর্ডার দিয়ে নিয়ে আসতে পারে।কিন্তু এতে আনিশার রাগ দ্বিগুন বেড়ে যাওয়ার আশংকায় তা করলো না।বরং সিদ্ধান্ত নিলো আনিশাকে মিষ্টি কথায় ভুলি ভালিয়ে যদি এইবারের মতো মাফ পাওয়া যায়। রাহাত একটু ভেবে আনিশাকে ডাক দিলো- 


"অনি..অনি"


আনিশা তাকালো না। তার মনোযোগ ল্যাপটপের দিকে। রাহাত গলাটা পরিষ্কার করে মধুর কন্ঠে ডাক দিলো-

"বউ, ও বউ, সোনা বউ।"


এই ডাকে কাজ হলো।আনিশা কঠিন চোখে তাকালো। আনিশার দৃষ্টি দেখে রাহাত খুব কষ্ট পেলো। স্ত্রীদের  কোমল চোখে তাকানো উচিত স্বামীর দিকে। অথচ তার বউ এমন দৃষ্টি দিয়েছে, যে দৃষ্টিতে একজনকে ভষ্ম করে দেয়া সম্ভব। আনিশা কোনো সাধু সন্যাসী হলে রাহাত নিশ্চিত ভষ্ম হয়ে যেত। আনিশা খেকিয়ে উঠলো-


"ডাকছো কেন?"


রাহাত হেসে বলল- 

"তুমি তো আমার লক্ষী বউ। স্বামীর কষ্ট কস্মিনকালেও তোমার সহ্য হবার কথা নয়।নিশ্চয়ই তুমি কোথাও আমার টি শার্ট ট্রাউজার লুকিয়ে রেখেছো। তাই না? দাও না বের করে।।টাওয়াল পড়ে কতক্ষন থাকব।"


আনিশা ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বললো-

"তাহলে টাওয়াল খুলে ফেলো। অসুবিধা কি।"


রাহাত অবশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকালো। নিজের স্বামীকে ন্যাংটো করে রাখতে চায়, জামাকাপড় পড়তে দিতে চায় না।এটা কোন প্রজাতির বউ? রাহাতের ভিতরে তার বিপ্লবী সত্তা জেগে উঠলো।তড়াক করে দাঁড়িয়ে গিয়ে রাগী স্বরে আনিশাকে শাসিয়ে বলল- 

"এক্ষনি আমাকে জামাকাপড় বের করে দাও।এক্ষনি।নাহলে......"


"নাহলে কি?"


আনিশার কঠিন স্বরে করা প্রশ্নে রাহাতের ভেতরের বিল্পবের প্রদীপ নিভু নিভু হয়ে গেলো।সে তাড়াতাড়ি মনে মনে অংক কষলো। রাহাতের নিজের বাপ এমপি। প্রেম করে বিয়ে করেছে আরেক এমপির মেয়েকে। এখন যা পরিস্থিতি তাতে কিছু বললে এই মেয়ে রাগ করে ব্যাগপত্র নিয়ে বাপের বাড়ি রওয়ানা দিবে।একমাত্র মেয়ের চোখে পানি দেখে তার এমপি বাপ রাগে গর্জে উঠবে।সাথে তার জল্লাদ ভাই শাহাদ বোনের চোখে পানি দেখে সৈন্য সামন্ত নিয়ে রওয়ানা দিবে রাহাতকে শিক্ষা দিতে।।এদিকে রাহাতের এমপি বাবা ছেলেকে রক্ষা করতে নিজের সৈন্য নিয়ে রওয়ানা দিবে আক্রমণ প্রতিহত করতে। খোলা প্রান্তরে দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হবে। প্রান্তরের দুই পাশে দাঁড়িয়ে রাহাত আর আনিশা তখন একজন আরেকজনের প্রতি সকল অভিমান ভুলে কাছে আসতে চাইবে। কিন্তু যুদ্ধ পেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না।ফলাফলস্বরূপ তারা দুজনেই কপাল চাপড়ে কান্না করবে।


"কি হলো কথা বলছো না কেন?"


আনিশার চিৎকারে রাহাত চমকে গিয়ে বাস্তবে ফিরে এলো। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখলো তার বউ তার কাছেই আছে, আর কোনো যুদ্ধও বাঁধে নি। আনিশা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল- 


"কি হয়েছে তোমার?"


রাহাত আমতা আমতা করে বলল- 

"কই না তো, কি হবে? জামা কাপড় গুলো বের করে দাও কাল বাপের বাড়ি নিয়ে যাব।কসম।"


আনিশা ক্ষেপে গিয়ে বললো-

"এই, একদম কসম কাটবে না।মিথ্যাবাদী কোথাকার।"


দরজায় টোকা পড়লো। সাহারা বেগমের কন্ঠ শোনা গেলো।রাতে খেতে যাওয়ার জন্য ডাকছে। আনিশা রসমালাইএর বাটিটা কোল থেকে নামিয়ে বললো-


"খেতে চল।'


" এইভাবে? টাওয়েল পড়ে?"


"হুম।"


"নিচে এতগুলো বুয়া।"


"এইটা তোমার শাস্তি।"


অগত্যা রাহাতকে টাওয়াল পড়েই নিচে নামতে হলো। তবে আসার সময় সে আরেকটা টাওয়াল কোমড়ে পেচিয়ে এসেছে।সাথে শার্টটাও গায়ে দিয়েছে।শুধু সারাদিনে ময়লা হওয়া প্যান্টটা পড়তে পারলো না। হাত মুখ ধোয়ার পর ঘামে ভিজা প্যান্ট পড়লে তার আবার গোসল করতে হবে। রাহাতকে এইভাবে দেখে সাহারা বেগম চোখ কপালে তুলে বললেন-


"একি!! তুই এইভাবে নেমেছিস কেন?"


রাহাত একবার সামনের চেয়ারে বসে রুটি ছিড়তে থাকা আনিশাকে দেখলো। বউ এর দোষ ঢাকতে মিথ্যা করে বলল- 

" এটা নতুন স্টাইল বের হয়েছে মা।বাসায় সবাই এসবই পড়ছে এখন।"


"তুই নিজে পাগল নাকি আমাকে পাগল পেয়েছিস। ঘরভর্তি বুয়াগুলোকে তোর চোখে পড়ে না।এভাবে এসেছিস।নির্লজ্জ!! একদম বাপের মতো হয়েছিস।"


রাহাত টু শব্দ না করে খাবার গিলতে লাগলো।চাবানোরও চেষ্টা করলো না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উপরে চলে গেলেই মঙ্গল।


________


কুহু বিছানায় বসে একটা একটা করে কাপড় ভাজ করছে।বিকালে বের হওয়ার সময় যেগুলো আলমারি থেকে নামিয়েছিলো তাই এখন ভাঁজ করে রাখছে। শিরিনা বেগম জোর গলায় ঘোষনা দিয়েছেন এখন থেকে কুহুকে সংসারের সব কাজকর্ম শিখতে হবে।ওড়না দুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো আর চলবে না। কুহু ভীষন অসহায় অনুভব করলো। এই কদিনে এত কাজ কিভাবে শিখবে। বিয়ে যদি দেয়ারই ছিলো তাহলে আরো আগে থেকে এসব শিখানোতে জোর দিলে কি এমন হতো। কুহুর মোবাইলটা বেজে উঠলো। বালিশের কাছ থেকে মোবাইলটা নিয়ে সামনে ধরলো।স্ক্রিনে ভাসলো শাহাদের নাম্বার। কুহু গলাটা একটু পরিষ্কার করে কল টা রিসিভ করলো। 


"হ্যালো।"


অপাশ থেকে ভেসে এলো শাহাদের ভারী কন্ঠ-

"আপনি আপনার একটা জিনিস ফেলে গেছেন আমার গাড়িতে।"


কুহু সোজা হয়ে বসলো। শাহাদের গাড়িতে আবার কি ফেলে আসবে সে? কুহু মনে করার চেষ্টা করলো কিন্তু তেমন কিছু পেলো না। সে প্রশ্ন করলো- 

"কি ফেলে এসেছি?"


"আই ডোন্ট নো।এটা মেটালের।দেখতে কাঁচির মতো।এখানে আপনার নাম লেখা।"


কুহু জিভে কামড় দিলো।এটা তো তার আইল্যাশ কার্লার। সাজগোজের কয়েকটা জিনিস ব্যাগে রাখা তার অভ্যাস তার মধ্যে এটা একটা।তনয়ার সাথে এটা নিয়ে ঝগড়া লেগে সে তারটায় নেল পলিশ দিয়ে নাম লিখে রেখেছিলো। শাহাদ প্রশ্ন করলো- 


"এটা দিয়ে কি করেন?কাঁচির মতো দেখতে হলেও কোনো ব্লেড তো নেই।"


কুহু তড়িঘড়ি করে বলল- 

"লেবু চিপি।"


চলবে


গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ৭

 #টক_ঝাল_মিষ্টি 

#তামান্না_আঁখি 

#পর্ব -৭


শাহাদ কুহুকে নিয়ে পার্কের এক পাশে একটা কফিশপে আসলো। কফিশপের সামনে ছাতা টাঙিয়ে তার নিচে চেয়ার টেবিল রাখা হয়েছে। কুহুকে একটা ছাতার নিচে এনে চেয়ার দেখিয়ে বললো-


"এখানে বসুন।"


কুহু চুপচাপ বসে পড়লো।শাহাদ কফিশপের ভিতরে চলে গেলো।কুহু দাঁত দিয়ে ওড়না কামড়ে ধরলো। লজ্জায় তার মরে যাওয়ার জোগাড়। কেন করতে গেলো এমন? বাসা থেকে যে এতো প্রতিজ্ঞা করে আসলো তার কি হলো? কুহু এক হাত কপালে দিয়ে বসে রইলো।এই বয়সে এসে এমন কান্ড কি মানা যায়? কি চলছিলো ওর মনে তখন যে দোলনায় দাঁড়িয়ে গেলো? শাহাদ কি ভাবছে তাকে নিয়ে? নিশ্চয়ই তাকে লাজ লজ্জাহীন ভাবছে? কুহু নিজের দুই গালে দুটো চড় দিলো। টেবিলের উপর দুইহাত রেখে সেখানে মুখ গুজে দিলো। চোখে ভাসলো একটু আগে করা তার ঘটনার কথা।এই মুখ আর শাহাদকে দেখাতে পারবে না সে।


শাহাদ কফিশপের ভিতর থেকে একটা পানির বোতল আর টিস্যুর প্যাকেট নিয়ে এলো। কুহুকে এভাবে টেবিলে মাথা রেখে বসে থাকতে দেখে ডাকলো-


"কুহু?"


কুহু মাথা তুলে তাকালো।শাহাদের চোখে চোখ পড়তেউ দ্রুত সরিয়ে নিলো।শাহাদ পানির বোতলের ক্যাপটা খুলতে খুলতে বললো-


"বাম পায়ের জুতোটা খুলুন?"


কুহু বিস্ময় নিয়ে তাকালো।প্রশ্ন করলো-"কেন?"


"আগে খুলুন।"


শাহাদের কথায় কুহু আর দ্বিরুক্তি করলো না।সে তার বাম পায়ের জুতোটা খুললো।জুতোটা খুলে তার চোখ পড়লো বুড়ো আংগুলের দিকে।অনেকটা চামড়া চড়ে গেছে,কিছুটা রক্তও বের হয়েছে। এত কিছুর মাঝে সে টের পায় নি। শাহাদ দাঁড়িয়ে থেকে কুহুর বাম পায়ের বুড়ো আংগুলে পানি ঢেলে দিলো। কুহু হালকা জ্বলুনি অনুভব করলো।শাহাদ পানি ঢালা থামিয়ে টিস্যুর প্যাকেটটা কুহুর হাতে দিয়ে বলল-


"ক্ষতটা ভালো করে মুছুন।নয়ত ইনফেকশন হবে।এখানে ফার্স্ট এইডের কিছু নেই তাই আপাতত টিস্যু দিয়েই কাজ সারতে হবে। "


কুহু বিনাবাক্য ব্যয়ে টিস্যু দিয়ে ক্ষতটা মুছলো।শাহাদ আরেকবার পানি ঢেলে দিলো। তারপর বললো-

"আবার মুছুন।"


টিস্যুর প্যাকেট থেকে আরেকটা টিস্যু নিয়ে ভালো করে মুছলো কুহু।শাহাদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো। তারপর সন্তুষ্ট হয়ে চেয়ারে বসে পড়লো।পানির বোতলটার ক্যাপ লাগিয়ে টেবিলে রেখে দিলো। কুহু শাহাদের দিকে আড়চোখে তাকালো। শান্তমুখে বসে ফোন টিপছে। কোনো অস্থিরতা নেই, একদম দিঘির পানির মতো শান্ত।কুহু ইতস্তত করে বলল- 


"আগে যা হয়েছে এইজন্য সরি। আসলে এর আগে যতবার এসেছি ততবারই এরকম করেছি তো......অতিরিক্ত অস্থিরতায় আসলে হুশ ছিলোনা। আই এম সরি।"


শাহাদ ফোনের দিকে চোখ রেখে এক হাতে থুতনি ঘষে জিজ্ঞেস করলো- 

"এর আগে কার সাথে এসেছেন?"


"বন্ধুদের সাথে।"


শাহাদ ফোন থেকে মুখ তুলে কুহুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো- 

"ছেলে বন্ধু?"


কুহু দুহাত নেড়ে বললো- 

"না না,মেয়ে বন্ধু। একজনকে আপনি দেখেছেন।ওই যে ওই দিন বাজারে আমার সাথে ছিলো,ওর নাম তনয়া। "


শাহাদ মাথা নাড়লো। সে চিনেছে। জিজ্ঞেস করলো- 

"তো বন্ধুদের নিয়ে এসেও এসব করেন?"


কুহু লজ্জিত ভংগিতে বললো-

"আমি একা করি না ওরাও করে।আমাকে এটা তনয়া শিখিয়েছে।"


শাহাদ কৌতুকপূর্ন দৃষ্টিতে তাকালো। আজকালকার মেয়েরা কিসব জিনিস আবিষ্কার করে বেড়াচ্ছে। দোলনায় দাঁড়িয়ে দোল খাওয়াও কোনো কাজ হতে পারে?কফিশপে কাজ করা ছেলেটা এসে দুকাপ কফি দিয়ে গেলো। কুহু কফিটা নিয়ে ছোট একটা চুমুক দিলো। গরম কফি তার জিভ পুড়িয়ে দিলো। দাঁত চেপে যন্ত্রনা টা সহ্য করে কফির কাপটা নামিয়ে রাখলো। খানিক বাদেই কফি শপের মালিক ছুটে এলো। বয়স তেমন বেশি না শাহাদের বয়েসিই হবে।শাহাদের কাছে এসে হাত কচলাতে কচলাতে বললো-


"আমার কি সৌভাগ্য আপনি আমার দোকানে আসছেন ভাই। দোকানের কাজ করা ছেলেটা আপনারে চিনে নাই তাই পানি আর টিস্যুর দাম রাখছে।"


শাহাদ হাত তুলে থামিয়ে বললো-

"এটা আপনার ব্যবসা, দাম তো রাখবেই সে।"


দোকানের মালিক লোকটা কুহুকে  এক পলক দেখে শাহাদকে জিজ্ঞেস করলো- 

"ভাই, উনি কি....."


শাহাদ কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বলল- 

"আমার হবু বউ।"


কুহু কফির কাপের দিকে তাকিয়ে ছিলো এই কথা শুনে শাহাদের দিকে তাকালো। টেবিলের অপর প্রান্তে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। এক হাত টেবিলের উপর রাখা অন্য হাত উরুর উপর। কেমন নেতা নেতা ভাব!! শাহাদের বলা সহজ কথাটায় কুহুর বুকের ভেতর ঢিপঢিপ আওয়াজ হলো। নিজের আশেপাশের সবকিছুকে রঙিন মনে হলো।প্রথম প্রেমের অনুভূতিতে তার মন প্রাণ নেচে উঠলো। 


দোকানের লোকটা শাহাদের কথা শুনে কুহুর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো- 

"আসসালামু আলাইকুম ভাবি।"


বিনিময়ে কুহু সালামের জবাব দিলো।লোকটা কুহুর দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বললো- 

"ভাবি কি খাবেন বলেন? ফাস্টফুডের মাঝে বার্গার আর চিকেন ফ্রাই এর ব্যবস্থা আছে।"


কুহু শাহাদের দিকে তাকালো। শাহাদ কুহুর দিকেই তাকিয়ে ছিলো কুহুকে তাকাতে দেখে ভ্রু নাচিয়ে বুঝালো কুহু কি খাবে তা বলতে। কুহু দোকানের লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল- 

"আমি কিছু খাব না।"


"না ভাবি আপনাকে খেতেই হবে। ভাই আপনাকে নিয়ে এই প্রথম আমার দোকানে আসছে শুধু কফি খেলে হবে না।"


কুহু আরেকবার তাকালো শাহাদের দিকে। শাহাদের কোনো নড়চড় নেই সে আগের মতোই তাকিয়ে আছে।কুহু না পেরে বললো-


"বার্গার খাব।"


লোকটা খুশি হয়ে শাহাদকে জিজ্ঞেস করলো- 

"ভাই আপনার জন্য?"


"আমার কিছু লাগবে না। আমার দুজন বোন আছে সাথে তাদের জন্য বার্গার চিকেন ফ্রাই দুটোই।আর আমার দলের ছেলেরা এসেছে। তাদের জন্য কফির ব্যবস্থা করে দিন।"


লোকটা অর্ডার পেয়ে চলে গেলো।শাহাদ তৎক্ষনাৎ ফোন বের করে তমালকে কল দিয়ে রাফা রিদিকে নিয়ে আসতে বললো,দলের বাকিদেরও আসতে বললো। তারপর কুহুর দিকে তাকিয়ে বললো-


"কফিটা খান ঠান্ডা হচ্ছে।"


কুহু কফির কাপে চুমুক দিলো। আসলেই ঠান্ডা হয়ে গেছে। তারপরেও সে পুরোটা কফি শেষ করলো। কিছুক্ষন পরে রাফা রিদিকে নিয়ে চলে আসলো তমাল।আস্তে আস্তে বাকি ছেলেরাও এসে অন্য একটা টেবিলে বসে পড়লো। ওদেরকে কফি দেয়া হলো। রাফা রিদি আর কুহুকে বার্গার আর চিকেন ফ্রাই সার্ভ করা হলো। রাফা রিদি এক প্রকার লাফিয়ে উঠলো খাবার দেখে। শাহাদের কল আসায় শাহাদ উঠে গিয়ে কল রিসিভ করলো। রাফা খাবারসহ তাদের তিনজনের অনেক গুলো সেল্ফি তুলে রাখলো। তারপর খেতে খেতে কুহুকে বললো- 


"জানো ভাবিমনি, ওইদিন ভাইয়াকে তোমার শাড়ি পড়া ছবি দিয়েছিলাম। তারপর ভাইয়াকে কফি দিতে গিয়ে দেখি ভাইয়া তোমার ছবি জুম করে দেখছে।বেচারা ভাই আমার তোমাকে ওইদিন দেখতে যেতে পারে নি,তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটু দেখা করিয়ে দেই। এজন্যই এত কাঠখড় পুড়িয়ে তোমাকে এখানে এনেছি।"


কথাটা বলে রাফা কিটকিট করে হাসলো। রিদিও যোগ দিলো সেই হাসিতে। কুহু বার্গারে কামড় দিয়েছিলো এই কথা শুনে গালভর্তি খাবার সহ তার মুখে লাজুক একটা হাসি ফুটলো।সে তাড়াতাড়ি মুখে হাত চেপে ধরে হাসি আড়াল করলো। একবার আড়চোখে তাকালো দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলা শাহাদের দিকে। ততক্ষনে শাহাদের কথা বলা শেষ হয়ে গিয়েছে। কথা শেষ করে চেয়ারে এসে বসলো। ওদের সবাইকে হাসতে দেখে জিজ্ঞেস করলো- 


"কি নিয়ে হাসছিস?"


রিদি মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললো-

"আসার সময় গাড়িতে ভাবিমনি তোমাকে খুঁজে না পেয়ে অনেক মন খারাপ করেছে।অনেক মিস করেছে তোমাকে। তাই না ভাবিমনি?"


কুহু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।একবার তাকালো রিদির দিকে আরেকবার শাহাদের দিকে।শাহাদ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।যে দৃষ্টির অর্থ "তাই নাকি?"। সে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলো।এই মেয়ে দুটো তো মারাত্নক!! এভাবে ফাঁকা ময়দানে কেউ এসব বলে?রাফা আফসোস করে বলল-

"ভাবি মনিকে আনতে না গিয়ে তুমি অন্যায় করেছো ভাইয়া।তোমার শাস্তি পাওয়া উচিত।"


শাহাদ রম্য কন্ঠে বললো-

"হুমমম... আসলেই পাওয়া উচিত। ঠিক আছে, শাস্তি হিসেবে তোদের ভাবিমনিকে যাওয়ার সময় না হয় আমি বাড়িতে পৌঁছে দিব।ওকে?"


তারপর কুহুর দিকে তাকিয়ে চমৎকার করে হাসলো। কুহুর গাল দুটো গরম হয়ে গেলো।আর তাকালো না শাহাদের দিকে। তিন ভাই বোন মিলে কিসব শুরু করেছে!! ওকে লজ্জায় মেরে ফেলবে নাকি?


খাওয়া শেষে শাহাদ তমালকে ডেকে কয়েকটা নোট হাতে দিয়ে বলল-

"বিলটা দিয়ে দে, বাকিটা তোরা খরচ কর।"


বিল দেয়ার সময় দোকানের মালিক কিছুতেই বিল নিতে চাইলো না।শাহাদকে ডেকে বিল না দেয়ার অনুরোধ করলো। শাহাদ সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো পিছন ফিরে হাত উচিয়ে বিলটা নিয়ে নিতে বললো।


পার্ক থেকে বের হয়ে তমালকে দিয়ে রিদি আর রাফাকে বাড়ির গাড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দিলো। তারপর কুহুকে বললো- 

"আসুন।"


গাড়ির কাছে গিয়ে প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা খুলে দিয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।কুহু ধীরে ধীরে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসলো। হাঁটার সময় কয়েকবার শাহাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়েছে। শাহাদ সেই যে স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়েছিলো আর চোখ সরায় নি। হাঁসফাঁস করতে করতে কুহু দ্রুত গাড়িতে উঠে বসেছে। উঠে বসে নিজেই নিজের সিটবেল্ট বেঁধে নিয়েছে।শাহাদ গাড়িতে উঠে নিজের সিটবেল্ট বেঁধে কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল- 


"আপনার সিটবেল্ট....."


কুহুকে সিটবেল্ট বাঁধা অবস্থায় দেখে থেমে গেলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এক টানে রাস্তায় উঠে গেলো। গাড়ি চালানোর এক পর্যায়ে শাহাদ জিজ্ঞেস করলো- 

"বিয়েতে কি কি করতে চান?"


"হু?"


" অনেক মেয়েদের বিয়ে নিয়ে অনেক ইচ্ছা থাকে,শখ থাকে। আমার বড় বোনের ছিলো। তার ইচ্ছা পূরন করতে গিয়ে আমার বোন জামাইয়ের ঘাম ছুটে গিয়েছিলো। আপনার আছে এমন কোনো ইচ্ছে?"


কুহু কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো। তার এত তাড়াতাড়ি বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে এটাই সে কোনোদিন আশা করে নি, তাই বিয়ে নিয়ে কোনো কল্পনা সে তেমন একটা করে নি। কিন্তু ওর খুব ইচ্ছে পালকি চড়ে শ্বশুর বাড়ি যাবে। কুহু বলবে কি বলবে না এটা নিয়ে দোনামোনা করে শেষে বলার জন্য উদ্যত হলো-


"আমার আসলে........"


কর্কশ শব্দে শাহাদের ফোনটা বেজে উঠায় কুহু আর বলতে পারলো না।শাহাদ এক হাতে গাড়ি চালাতে চালাতে ফোনটা কানে ধরলো। কথা না বলে যাস্ট শুনলো। তারপর শেষে গিয়ে বললো-


"ওদের আটকে রাখ আমি আসছি।"


ফোন কেটে দিয়ে আচমকাই গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো। ২০ মিনিটের রাস্তা ১০ মিনিটে চলে এলো। কুহুদের বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি থামালো। কুহু দরজা খুলে নামতে উদ্যত হলে কুহুকে ডেকে বললো-


"শুনুন।"


কুহু শাহাদের দিকে ফিরে তাকালো। শাহাদ সরাসরি কুহুর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো- 


"রাজনীতি করার কারনে আমাকে অনেক সময় নোংরা কাজ করতে হয়, কাঁদায় না নামলেও কাঁদার ছিটে এসে আমার গায়ে লাগে। আশা করব আমার সহধর্মিণী হয়ে আমি ঘরে ফিরার পর সেই কাঁদা মুছে দেয়ার দায়িত্বটুকু নিবেন। "


কুহু বিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। কি বলবে সে বুঝতে পারলো না।সে তো রাজনীতি পছন্দই করতো না।কি থেকে যে কি হয়ে গেলো, সে রাজী হয়ে গেলো বিয়েতে। কুহুকে চুপ করে থাকতে দেখে শাহাদ প্রশ্ন করলো- 


"দায়িত্ব নিতে পারবেন না? বিয়ে ভেঙে দিব?"


কুহু দুহাত নেড়ে বললো- 

"না না, নিব না বলিনি তো।অবশ্যই নিব।মানে চেষ্টা করব আর কি।"


"ব্যস,ওইটুকুতেই হবে।আমার জন্য এটাই এনাফ।এখন তাহলে যাই,কাজ আছে।"


কুহু মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। শাহাদ গাড়ি স্টার্ট দেয়ার আগে ঝুঁকে গাড়ির জানালা দিয়ে কুহুকে একবার দেখলো। কুহু মনের অজান্তেই হাত উঁচিয়ে নাড়লো। শাহাদ ডান দিকে ঠোঁটের কোণ বাঁকিয়ে মৃদু হাসলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলো। শাহাদের গাড়ি যতক্ষন দেখা গেলো কুহু ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো সেদিকে। গাড়িতে থাকা শাহাদের প্রতি অন্যরকম এক অনুভূতির শিহরণ জাগলো মনে। পেটের ভিতর কয়েকটা প্রজাপতি ডিগবাজি খেলো। এটা বোধহয় প্রেম। এরপর ভালোবাসা। আর তারপর?...... কাছে আসা? ইশশশ!!!!!!


----------


রাহাত হাত ভর্তি গোলাপ নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো,সাথে এক বাটি রসমালাই। রসমালাই আনিশার খুব প্রিয়। বাড়িতে ঢুকে নিচে দু একজন কাজের লোকজন ছাড়া অন্য কাউকে দেখতে পেলো না। এখন সময়টা সন্ধ্যার কাছাকাছি, নিশ্চয়ই সাহারা বেগম আর আনিশা দুজনেই যার যার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। রাহাত বড় বড় পা ফেলে সিড়ি বেয়ে দুতলায় চলে এলো।দুতলায় এসেই সাহারা বেগমের মুখোমুখি হয়ে গেলো।


সাহারা বেগম আসরের নামাজ পড়ে আনিশার খবর নিতে বের হয়েছিলেন। মেয়েটার মন খারাপ দেখার পর তার নিজেরও মন ভালো নেই।ঘর থেকে বের হয়ে রাহাতকে দেখে তিনি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন। মায়ের মুখোমুখি হয়ে রাহাত তাড়াতাড়ি ফুলগুলো পিছনে লুকিয়ে ফেললো।জোর করে হাসলো কিন্ত সাহারা বেগমের অগ্নিদৃষ্টির সামনে তা বেশিক্ষন স্থায়ী হল না। হাসি থামিয়ে হাতের প্যাকেটে থাকা রসমালাইয়ের বাটিটা উচিয়ে বললো- 


"অনির জন্য এনেছি।রসমালাই খাবে বলে ওইদিন বায়না করলো।"


সাহারা বেগম কঠিন স্বরে বললেন-

"দূর হ আমার সামনে থেকে। মেয়েটাকে মিথ্যা আশা দিয়ে বসিয়ে রেখেছিস।"


"ইয়ে....  আসলে মা, কাজ ছিলো। জানোই তো বাবা বাড়িতে নেই। সব কাজ আমার উপর।আর তাছাড়া তোমাকে একা রেখে যাই কি করে।"


"তোকে আমার সামনে থেকে দূর হতে বললাম না?"


মায়ের আগুনের মতো রাগ দেখে রাহাত মানে মানে কেটে পড়লো।নিজের ঘরের সামনে এসে বড় একটা শ্বাস ফেলে সাহস সঞ্চয় করলো। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে আদুরে কন্ঠে "অনি,অনি" ডাকতে ডাকতে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকে চমকে গেলো। ফ্লোর থেকে বিছানা সব জায়গায় জামা কাপড় ছড়ানো ছিটানো। একটু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো জামা কাপড় গুলো আসলে তার।আরেকটু ভালো করে দেখে বুঝতে পারলো সব গুলোই ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দেয়া হয়েছে । শার্ট প্যান্ট, গেঞ্জি,টিশার্ট ব্লেজার কোনো কিছুই বাদ নেই। রাহাত চোখ সরিয়ে আনিশার খুঁজে সামনে তাকালো। আনিশা ডিভানে আধশোয়া হয়ে সামনের টেবিলে ল্যাপটপ রেখে মুভি দেখছে আর ফল খাচ্ছে। রাহাত যে বাড়ি ফিরেছে এতে তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। রাহাত রসমালাইয়ের বাটিটা বিছানার উপর রেখে ব্যস্ত পায়ে আনিশার সামনে দাঁড়িয়ে বললো-


"এসব কি অনি? কে করেছে এসব?"


আপেলের স্লাইস মুখে দিতে দিতে আনিশা উত্তর দিলো- 

"আমি করেছি। ওই যে ওইখানে কাঁচিটা দেখছো ওটা দিয়ে করেছি।"


রাহাত আনিশার দেখানো জায়গায় তাকিয়ে কাঁচিটার দিকে এক পলক দেখে অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করলো- 

"কেন?"


" তোমাকে তো কাঁচি দিয়ে কাটতে পারব না তাই তোমার জামা কাপড় কেটেছি।"


রাহাত আলমারির দিকে তাকালো।আলমারিটা খোলা পড়ে আছে। ওখানে শুধু আনিশার কাপড় রাখা। রাহাত আহত কন্ঠে বললো-  

"এমনটা করতে পারলে? এবার আমি কি পড়ে বাইরে যাব?"


"যেটা পড়ে আছো সেটা পড়ে যাবে।"


"ঘরের ভিতর কি পড়ব?"


"কিছু পড়তে হবে না,ন্যাংটো থাকবে। আমি তোমাকে দু চোখ ভরে দেখব।যতদিন বাপের বাড়ি না নিয়ে যাচ্ছ ততদিন তোমার জামাকাপড় পড়া বন্ধ।"


রাহাত বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।তার মুখের ভাষা হারিয়ে গেলো এসব শুনে। মাথায় যেন ছোটখাটো একটা বাজ পড়লো। 


চলবে


[অনেকেই গল্প দেয়ার সঠিক সময় জানতে চেয়েছেন।আমি এক দিন পর পর রাত ১০ টায় গল্প দেই। সময় পেলে প্রতিদিন দিব ইন শা আল্লাহ।😊]