গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ৫

 #টক_ঝাল_মিষ্টি 

#তামান্না_আঁখি 

#পর্ব-৫


শাহাদ সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলো। কুহুদের বাসায় যেহেতু যেতে পারে নি তাই আরো কিছু কাজ এগিয়ে রেখে এসেছে যাতে বিয়ের সময় কাজের চাপ না থাকে। তার বাবা নামেই এমপি, বেশির ভাগ কাজ তাকেই কর‍তে হয়। বিশাল বড় খান বাড়িটা অনেকটা জায়গা জুড়ে অবস্থিত। বাড়ির চারপাশ জুড়ে বাগান,এক পাশে গ্যারেজ, বাড়ি থেকে দূরে বাগানের এক পাশে একটা আউটহাউজ আছে। বাড়ির চারপাশে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করা।


শাহাদ সদর দরজা দিয়ে রওনাককে সাথে নিয়ে ঢুকলো।রওনাকের হাতে এক গাদা ফাইল,আশফাক খানের সাইন নিতে হবে এগুলোতে।সদর দরজা পেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে আব্দুল গাফফার খানের সাথে সাক্ষাৎ হলো।উনি সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে চা পান করছে। শাহাদকে দেখে বড় করে একটা হাসি দিলেন। চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বললেন- 


"এসেছিস? আয় আয়, এদিকে এসে বোস।"


শাহাদ রওনাককে আশফাক খানের স্টাডি রুমে যাওয়ার জন্য বলে তার দাদার পাশে এসে বসলো। হাসিমুখে বললো- 

"এতো খুশি কেন দাদাজান?"


" দুদিন পর নাত বউ আসছে বাড়িতে খু্শি হওয়ারই তো সময় এখন।"


শাহাদ নিচের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো।আব্দুল গাফফার খানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো- 


"পছন্দ হয়েছে নাতবউ?"


"অবশ্যই হয়েছে। আমার সোনার টুকরা নাতির জন্য চাঁদের টুকরা নাতবউ।"


রাফা কিচেন থেকে এক বাটি নুডুলস নিয়ে নিজের ঘরে যাচ্ছিল শাহাদকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বললো- 

"ভাইয়া তুমি কিন্তু আজ অনেক বড় মিস করেছো। ভাবি আজ শাড়ি পড়ে এসেছিলো।কি সুন্দর যে লাগছিলো।"


শাহাদের চোখে মুখে মুগ্ধতা ছুয়ে গেলো।হয়ত কল্পনাতেই কুহুকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখে নিয়েছে। রাফার দিকে তাকিয়ে বলল- 


"তাই?"


"হুম।। আমি ছবি তুলে এনেছি। আমি স্টাডি শেষ করে তোমাকে ছবি দিয়ে আসব।"


শাহাদ মৃদু হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। রাফা নুডুলসের বাটি হাতে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। তারপর দাদাজানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো- 


"প্রেশার টা মেপেছেন দাদাজান?"


আব্দুল গাফফার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে উপর নীচ মাথা নাড়লেন,তিনি মেপেছেন।শাহাদ আবার প্রশ্ন করলো- 

"ডায়বেটিস? "


"হুম।এটা নিয়ে তোর দাদীর সাথে ঝগড়া হয়ে গেছে।তার ধারনা আমি লুকিয়ে মিষ্টি খাই। তাই ডায়বেটিস কমছে না।অথচ যেখানে আমি চিনি ছাড়া চা খাওয়ার অভ্যাস করলাম সেখানে মিষ্টি কেন খাব?"


দাদার এমন অসহায় অবস্থার কথা শুনে শাহাদ চায়ের কাপের দিকে তাকালো। চায়ের কাপের কিনারের এক পাশে কিছু চিনির দানা নজরে পড়লো।শাহাদ তর্জনী দিয়ে কাপের দানাগুলো মুছে দিয়ে বললো-

"চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা যদি না পড়ো ধরা।"


বলেই একটা মুচকি হাসি দিয়ে উঠে চলে গেলো। আব্দুল গাফফার নাতির যাওয়ার দিকে হকচকিয়ে তাকালেন। এহহে রে!ধরা পড়ে গেলেন। তার স্ত্রী তাকে কড়া নজরে রাখে, কিছুতেই মিষ্টি খেতে দেয় না।তিনি আবার চিনি ছাড়া চা খেতে পারেন না।তাই লুকিয়ে চুরিয়ে প্রায়ই এক চামচ চিনি চায়ে মিশান। কিন্তু আজ নাতির কাছে ঠিক ই ধরা পড়ে গেলেন। 


---------


রাতে ঘুমানোর আগে কুহু মোবাইল নিয়ে বসলো। অনেক্ষন তনয়ার সাথে ভিডিও কলে বিভিন্ন আলাপ আলোচনা করলো। তনয়ার সাথে কথা শেষ করে সে ফেসবুকে শাহাদের আইডি খোজাখুজি করতে লাগলো।শাহাদ খান লিখে সার্চ দিলে। শাহাদের ছবি প্রোফাইলে দেয়া অনেকগুলো ফেক আইডি আসলো।  কুহু প্রত্যেকটা আইডিতে ঢুকলো। ঢুকেই বুঝলো এইগুলো সব ফেক আইডি।তবে আইডি গুলোয় ঢুকে তার লাভ ই হলো। প্রত্যেকটা আইডির টাইমলাইনেই শাহাদের অনেক ছবি দেয়া। কুহু প্রতিটা ছবি ভালো করে দেখতে লাগলো।একটা গ্রুপ ছবি পেলো। শাহাদ আর তার বাবা সামনের সারিতে আর পিছনে অনেক মানুষ।ক্যাপশন পড়ে বুঝলো এটা নির্বাচনের সময় তোলা। ছবিতে শাহাদের পড়নে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা, তার উপর মুজিব কোট। কুহু জুম করলো শাহাদকে। ভালোই তো লাগছে নেতার গেটাপে। রাজনীতি পছন্দ না করলেও এই রাজনৈতিক নেতাকে তার বেশ লেগেছে। এর আগেও সে আশফাক খানের বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচারনা অনলাইনে দেখেছে। তখন এত মন দিয়ে দেখেনি বারবারই এড়িয়ে গেছে।এই জন্য হয়ত শাহাদকে চোখ পড়ে নি।


 কুহু আরো অনেক আইডি ঘাটলো। শাহাদের অনেকগুলো সিংগেল পিক সেভ করে রাখলো। একটা আইডিতে শাহাদকে নেতার গেটাপে ভাষন দেয়া অবস্থার ছবি পেলো। এটাও সেভ করে রাখলো। শাহাদের ছবির দিকে তাকিয়ে কুহুর আচমকাই কিছুটা অভিমান হলো।কি এমন হতো আজকে এলে? এত সুন্দর করে কয়েক ঘন্টা ধরে সেজেছে সে।অথচ যার জন্য সাজলো সে-ই দেখলো না।


কুহুর ভাবনার মাঝেই মোবাইলটা ভাইব্রেট করে উঠলো। স্ক্রিনে ভাসলো একটা অপরিচিত নাম্বার। কিন্তু নাম্বারটা দেখে কুহুর বুকের ভেতর হাতুড়ির বারি পড়লো। নাম্বারটা শাহাদের, গতকাল এই নাম্বার থেকেই কল করেছিলো শাহাদ। কুহু লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। গলা দিয়ে "আ আ" শব্দ করে গলার স্বর পরিক্ষা করলো। তারপর হালকা গলা ঝেড়ে কল ধরে মিষ্টি করে বলল-

"হ্যালো"


অপাশ থেকে ভেসে আসলো পুরুষালি ভারি আওয়াজ-

" কেমন আছেন কুহু?"


শাহাদের কন্ঠ শুনে কুহুর বুকের ভেতর আরো জোরে হাতুড়ি পেটাতে লাগলো।সে নিজেকে স্থির রেখে বলল-

"জী ভালো।"


" আজ আসতে পারি নি আপনাদের বাসায়৷ আমার কিছু কাজ ছিলো। রাফার কাছে শুনলাম আপনি আমায় খুঁজেছেন, আমি না যাওয়ায় নাকি অভিমান করেছেন?"


কুহু চমকে গেলো। সে রাফাকে কয়েকবার শাহাদের কথা জিজ্ঞেস করেছিলো। শাহাদ না আসায় কিছুটা মন খারাপও হয়ত প্রকাশ করে ফেলেছিলো। ইশশ!! এই মেয়েটা সব বলে দিয়েছে। কুহু ভাবলো অভিমান করেছে এটা বললে হয়ত শাহাদ ভাববে কুহু খুব নির্লজ্জ। তাই সে জোর দিয়ে বলল- 


"কই না তো!! অভিমান কেন করব? হোয়াই?আমি তো এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম।"


শাহাদ কফিতে চুমুক দিচ্ছিলো কুহু অভিমান করেনি শুনে কফিটা হঠাৎ তেতো মনে হলো তার কাছে। মুখের কফিটা গিলে নিয়ে কফির কাপটা নামিয়ে রাখলো সামনের টেবিলে। টেবিলে তার ল্যাপটপ টা অন করা। সেখানে ভাসছে কুহুর শাড়ি পড়া ছবি যেটা একটু আগে রাফা দিয়ে গেছে আর কুহু কি কি করেছে তা নিজ থেকেই বর্ণনা করে গেছে।শাহাদ কুহুর ছবিটা জুম করতে করতে বললো-


"হুম,বুঝলাম।"


কুহু মিনমিন করে প্রশ্ন করলো- 

"আজ আসেননি কেন?"


"কাজ ছিলো। রাজনৈতিক কাজ।"


কুহু মুখ ভেঙালো। এই পছন্দের ছেলেটা এই অপছন্দের কাজটা না করলে কি হত? থাক,মানুষটা যেহেতু ভালো বাকিটা সহ্য করে নেয়া যাবে। কুহু মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো। ছোট্ট করে বলল- 


"ওওও।"


"আজ তাহলে রাখি।রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ুন।গুড নাইট।"


"গুড নাইট।"


অপাশ থেকে কলটা কেটে গেলো। কুহুর মনটা একটু খারাপ লাগলো। কি নিরামিষ মানুষ!! আরেকটু কথা বললে কি হত? কুহু মেয়ে হয়ে কি করে নিজে থেকে কথা বলবে ছেলে হয়ে শাহাদেরই তো স্বেচ্ছায় কথা বলা উচিত। 


শাহাদ কান থেকে ফোন নামিয়ে টেবিলে রাখলো। সোফায় হেলান দিয়ে ল্যাপটপটা কোলের উপর নিলো। কুহুর বেশ কয়েকটা ছবি দিয়ে গেছে রাফা।ম্যাক্সিমাম ই ক্যান্ডিড। প্রতিটা ছবিতেই কুহুর চোখেমুখে লজ্জামিশ্রিত হাসি। দুটো ছবিতে হবু শ্বাশুড়ি আর মায়ের মাঝখানে বসে আছে সে। কুহুর একটা সিংগেল ছবি বের করে জুম করলো শাহাদ।বেশ সুন্দর করে সেজেছে কুহু, এখনকার মেয়েরা এইভাবে সাজে না। কুহুকে দেখতে শাবানার আমলের নায়িকাদের মতো লাগছে। শাহাদ মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো।যদিও বিয়েটা প্রথমে বাবার পছন্দে করতে চেয়েছিলো কিন্ত তার হবু বউকে তার বেশ পছন্দ  হয়েছে৷ 

 রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে হওয়ায় শিক্ষাজীবন রাজনীতি করেই পার করেছে। মেয়েদের সাথে তেমন মিশে নি। প্রেম করার তো প্রশ্নই আসে না। অনেক মেয়ের কাছ থেকে প্রেম নিবেদন পেয়েও প্রত্যাখ্যান করেছে।শত্রুরা মেয়েঘটিত কোনো ব্যাপার রটিয়ে পরিবারের সম্মান নষ্ট করতে পারে এই জন্য মেয়ে বন্ধুও তেমন বানায় নি। ধরতে গেলে কুহুই তার জীবনের প্রথম অনুভূতি। আর প্রথম অনুভূতির মেয়েটিকেই সে বউ হিসেবে পেতে চলেছে।


------------


রাহাত বেড রুমে ঢুকে বিছানার দিকে তাকিয়ে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে গেলো। আনিশা অন্যদিকে মুখ করে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। আনিশার এভাবে শুয়ে থাকার একটাই অর্থ, সে রাগ করে আছে। রাহাত আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। বিছানায় নিজের শোয়ার জায়গায় এসে বসলো। আলতো করে আনিশার কাঁধে হাত রেখে ডাকলো-


"অনি?... অনি?"


আনিশা সাড়া দিলো না।আগের মতোই নিশ্চল শুয়ে থাকলো। রাহাত উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলো আনিশা ঘুমাচ্ছে কিনা।আনিশা চোখ বন্ধ করে আছে কিন্তু ঘুমাচ্ছে কিনা বুঝা যাচ্ছে না।রাহাত ঢের বুঝতে পারছে আনিশা ঘুমায় নি।আনিশার শোয়ার ধরন বলে দিচ্ছে আনিশা অভিমান করে আছে। রাহাত এই শোয়ার নাম দিয়েছে "রেড সিগনাল" অর্থাৎ আনিশা এভাবে শুয়েছে মানেই আজ তার খবর আছে।রাহাত আনিশার গা ঘেষে শুয়ে পড়লো, কন্ঠে মধু ঢেলে বললো-


"গা টা এমন ম্যাজ ম্যাজ করছে কেন? কাল কি কাজকর্ম বন্ধ রাখব নাকি? ভাবছি কোথাও ঘুর‍তে গেলে কেমন হয়? বিয়ে যেহেতু করেছি একা তো যেতে পারব না বউকে নিয়ে যেতে হবে।তা বউ বলো তো কোথায় যাব।"


আনিশা গুলির বেগে শোয়া থেকে উঠে বসলো। রাহাতের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল- 


"হ্যা এখন তো বিয়ে করে গলার কাটা হয়ে গেছি,অথচ ভার্সিটিতে থাকতে বিনা নিমন্ত্রনে পিছে পিছে ঘুরতে।"


"এসব কি বলছো? আমি কখন বললাম গলার কাটা হয়ে গেছো।"


"হয়েছিই তো। আমার এখন কি আর দাম আছে? কোনো দাম নেই।"


"কে বলেছে দাম নেই।কোটি টাকা কাবিন দিয়ে বিয়ে করেছি। কত দাম ভাবো একবার!"


আনিশা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো। কিড়মিড় করে বলল- 

"মিথ্যা বলার জায়গা পাও না৷ কোটি টাকা কখন কাবিন দিলে তুমি?"


রাহাত উঠে বসলো। টুপ করে আনিশার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল- 

"এই যে এখন দিলাম। আমার একেকটা চুমু কোটি টাকার চেয়েও বেশি।"


আনিশা রেগে বিছানা ছেড়ে উঠে যেতে চাইলো কিন্ত রাহাত এক টানে আবারো বসিয়ে দিলো।আনিশার হাত আকড়ে ধরে বলল- 


"রাগ করছো কেন? বলেছি তো নিয়ে যাব। একটু কাজ গুলো গুছিয়ে নিই।"


"তোমার কাজ কোনোদিনই শেষ হবে না। সেই কবে বাপের বাড়ি গিয়েছি। আমার একমাত্র ভাইয়ের বউ দেখাদেখিতে পর্যন্ত যেতে পারলাম না তোমার জন্য। বিয়েতেও হয়ত যেতে পারব না।"


"কে বলেছে পারবে না।বিয়ের এক সপ্তাহ আগে গিয়ে বসে থাকব আমরা। "


"তাই না?? তাহলে কাল ই রওয়ানা দিতে হবে।শাহাদের বিয়ের ডেট এক সপ্তাহ পরে। "


শাহাদের বিয়ের ডেট না জেনেই বউকে মিথ্যা আশ্বাস দিতে গিয়ে রাহাত চিপায় পড়ে গেলো। আমতা আমতা করে বলল- 


"আসলে হয়েছে কি........"


"থাক আর মিথ্যা অযুহাত দিতে হবে না। তুমি তোমার কাজের সাথেই সংসার করো।"


বলেই আনিশা আবারো মুখ ঘুরিয়ে পাশ  ফিরে শুয়ে পড়লো। রাহাত বউ এর রাগ ভাংগানোর কোনো উপায় পেলোনা শেষমেশ পরাজিত হয়ে আনিশার বালিশে নিজেও মাথা রেখে শুয়ে বললো-


"ঠিক আছে কালই যাব শ্বশুরবাড়ি। কোনো কাজের দোহাই দিব না, প্রমিস।"


আনিশা রাহাতের দিকে ঘুরলো। সন্দীহান কন্ঠে বললো- 

"আবারো মিথ্যা বলছো।"


"না বউ,সত্যি কাল যাব৷ বিশ্বাস করো।এবার মাথাটা টিপে দাও তো। এখন না ঘুমালে কাল উঠে রওয়ানা দিতে পারব না।"


রাহাত আনিশার দিকে আরেকটু এগিয়ে আসলো তারপর চোখ বন্ধ করে ফেললো।আনিশা আর রাগ করে থাকতে পারলো না। সে আস্তে আস্তে রাহাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।


________


সকালে ঘুম থেকে উঠে কুহু প্রতিদিনের মতো রেডি হয়ে ভার্সিটি গেলো। ভার্সিটি গিয়ে তনয়ার সাথে মিলে সে শাহাদের ফেসবুক আইডি খুজতে লেগে গেলো। অনেক খুঁজে বিভিন্ন আইডিতে ঢুঁ মেরে শেষমেশ শাহাদের আইডি পাওয়া গেলো। আইডির নাম শাহরিয়ার খান শাহাদ।তনয়া শ্বাস ছেড়ে বললো-


"নিজের হবু বরের পুরো নামটাও জানিস না।পুরো নামটা জানলে এত কষ্ট করতে হতো না অনেক আগেই আইডি পেয়ে যেতাম।"


কুহু মাথা চুলকে বললো-

"আমি কি করে জানব পুরো নাম, আমি কি জিজ্ঞেস করেছি নাকি?"


তনয়া শাহাদের প্রোফাইল পিকে ক্লিক করলো। কুহুকে কমেন্টগুলো দেখিয়ে বলল- 


"দেখ দেখ, মেয়েরা কিসব কমেন্ট করেছে।"


কুহু কমেন্টগুলো দেখলো। সবাই ক্রাশ, ফিউচার হাব্বি এসব লিখে কমেন্ট করেছে,কেউ কেউ ফ্রেন্ডদেরকে ম্যানশন করে এনে শাহাদকে কে বিয়ে করবে সেটা নিয়ে ছোটখাটো তর্কও জুড়ে দিয়েছে। কুহুর খুব রাগ পেলো। মন চাইলো প্রত্যেকের কমেন্টে গিয়ে রিপ্লাই দিতে "শাকচুন্নিরা নজর দিবিনা, এটা আমার বর,নজর দিলে চোখে গেলে দিব।"


রাফা আর রিদি রেজিয়া সুলতানার পিছু ঘুরছে আর ঘ্যানঘ্যান করছে। রেজিয়া কিচেন থেকে ডালের বাটি নিয়ে ডায়নিং টেবিলের দিকে যাচ্ছেন। রাফা আগের মতোই নাকি সুরে বললো- 


"ও বড় মা, ব্যবস্থা করে দাও না।"


রেজিয়া বেগম সাবধানি কন্ঠে বললেন-


"দূরে সরে দাড়া, গরম ডাল গায়ে পড়বে।"


রাফা রিদি দুজনেই একটা দূরত্ব নিয়ে রেজিয়া সুলতানার পিছু পিছু ডায়নিং এ গেলো। জয়া বেগম টেবিলে খাবার দিচ্ছেলেন রাফা আর রিদিকে দেখে বললেন-

"আর কত ঘ্যানঘ্যান করবি তোরা? এবার চুপ কর।"


রিদি আবদারের সুরে বললো-

"তুমি বড়মাকে বলো না মা ভাবিকে কল দিয়ে আনতে।"


"আর কদিন পর মেয়েটার বিয়ে এখন  তার বাড়ির লোকজন তাকে এইভাবে তোদের সাথে ঘোরার পারমিশন দিবে না। এই বিষয়ে আর কোনো কথা না। খেতে বস।"


রাফা কাঁদো কাঁদো মুখ করে রেজিয়া সুলতানার দিকে তাকিয়ে বলল- 

"ও বড়মা!!!"


রেজিয়া সুলতানা একটা ছোট্ট শ্বাস ফেললেন। মেয়ে দুটো কুহুকে নিয়ে আগামীকাল পার্কে যাওয়ার আবদার করেছে। এই আবদার কি আর বললেই মেটানো যায়? বাড়ির কর্তাদের অবগত কর‍তে হবে, কুহুর বাবা মায়ের অনুমতি লাগবে তবেই না সম্ভব৷ সন্ধ্যার পর আশফাক খান বাড়ি ফিরলে রেজিয়া সুলতানা রাফা রিদির আবদারের কথা জানালেন। আশফাক খান প্রথমে কিছু একটা ভাবলেন তারপর জানালেন-


"আগে জেনে আসো তোমার ছেলে ওদেরকে সময় দিতে পারবে কিনা। ওদেরকে তো আর ড্রাইভার দিয়ে ছেড়ে দেয়া যাবে না।"


স্বামীর কথায় রেজিয়া সুলতানা শাহাদের ঘরে গেলেন। শাহাদ তার ঘরের সোফায় বসে ফাইল ঘাটছিল। রেজিয়া সুলতানা ঢুকতেই মুখ তুলে তাকালো। রেজিয়া সুলতানা কোনো ভূমিকা ছাড়াই বললেন-


"রাফা রিদি জেদ ধরেছে কাল কুহুকে নিয়ে পার্কে যাবে। তুই তাদেরকে সময় দিতে পারবি?"


শাহাদ সোজা হয়ে বসলো।জিজ্ঞেস করলো-


"দাদাজান আর বাবার অনুমতি আছে?"


"তোর বাবা অনুমতি দিয়েছে। আর তোর দাদাজানকে মা জানিয়েছেন।"


"কুহুর বাবা মায়ের অনুমতি?"


"সেটা তোর বাবা কল দিয়ে বলে নিবেন,তুই যেতে পারবি কিনা সেটা বল।"


"ঠিক আছে যাব, কাল বিকালে বের হব তাহলে।"


রেজিয়া বেগম ছেলের মত পেয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। শাহাদ হাতের ফাইলটা বন্ধ করে ফেললো। টেবিলের উপর থাকা কফির কাপটা নিয়ে বারান্দায় চলে এলো। রেলিঙে দুহাতের কনুই রেখে ভর দিয়ে দাঁড়ালো।ছোট্ট করে কফির কাপে চুমুক দিলো।বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আগামীকাল প্রথম কুহুর সাথে দেখা হবে। এর আগে দুবার দেখা হয়েছে আর দুবার ই কুহু কিছুনা কিছু করেছে। আগামীকাল নতুন কি করবে সেটা দেখার বেশ আগ্রহ হচ্ছে শাহাদের।


কুহু বইয়ের ভিতরে মোবাইল রেখে ফেসবুক চালাচ্ছিলো। আকস্মিক তার ঘরে আগমন ঘটলো শিরিনা বেগমের। মায়ের আগমনে সে জলদি ফোনটা লুকিয়ে ফেলে পড়ার ভান ধরলো। শিরিনা বেগম কুহুর টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে মেয়ের চুলে বিলি কেটে বললেন-

"কাল ভার্সিটি যাস না।সুন্দর করে সেজেগুজে বিকালে তৈরি হয়ে থাকবি।"


"কেন মা?"


"কাল শাহাদ আসবে তার সাথে ঘুরতে যাবি। সাথে তার দুজন কাজিনও থাকবে।রাফা রিদি।"


কুহু অবাক হলো। প্রশ্ন করলো- 

"কেন মা?"


"কেন আবার কি বোকা মেয়ে!! ঘুরতে যাবি। একটু আগেই শাহাদের বাবা তোর বাবার সাথে কথা বলেছে এই বিষয়ে। কাল বিকালে সুন্দর করে রেডি হয়ে থাকবি।বুঝেছিস?"


কুহু মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো। মেয়ের সম্মতি পেয়ে শিরিনা বেগম চলে গেলেন।শিরিনা বেগম  চলে যেতেই কুহু এক লাফে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লো। এক প্রকার উড়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে পড়লো। ডানে বামে মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে দেখলো। তারপর এক গাদা রূপচর্চার জিনিস বের করে সামনে রাখলে। এখন তার প্রধান কাজ হচ্ছে এগুলো একটার পর একটা মুখে দিয়ে বসে থাকা।


চলবে

গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ৪

 #টক_ঝাল_মিষ্টি 

#তামান্না_আঁখি 

#পর্ব-৪


কুহু আয়নার সামনে বসে সাজছে।তার সামনে বিভিন্ন মেকাপ আইটেম ছড়ানো ছিটানো। কুহুর পিছনে বিছানায় বসে তনয়া পায়েস খাচ্ছে আর আয়নায় কুহুর প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ কুহুকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে তাই সকাল সকাল কুহু তাকে কল করে ডেকে এনেছে শাড়ি পড়বে বলে। সেই কখন থেকে সে এসে বসে আছে কিন্তু কুহুর সাজ আর শেষ হচ্ছে না। এতক্ষন কিসব মুখে লাগিয়ে বসেছিলো তারপর গোসল করে এসে এখন মেকাপ করতে বসেছে। তনয়া এক চামচ পায়েস মুখে দিয়ে বলল- 


"রাজনীতিবিদ পছন্দ করিস না তাই বিয়ে করবি না বলে কত লাফঝাপ দিলি আর এখন নির্লজ্জের মতো ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলি।"


কুহু মেকাপ ব্রাশ টা নামিয়ে আয়না দিয়ে তনয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-

"বিয়েতে রাজী হওয়া অপরাধ নাকি?"


"না তা না। আগে যে বিয়ে করবি না বলে লাফালি।"


কুহু মেকাপ ব্রাশ ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে তনয়ার দিকে ফিরলো। চোখেমুখে দুঃখি দুঃখি ভাব করে ভেজা কন্ঠে বললো- 


"একটা মানুষকে ভালো লেগেছে,হোক না রাজনীতিবিদ ,তাতে কি ভালো লাগা কমে যাবে? আমি না হয় রাজনীতি একটু সহ্য করে নেব। তার উপর বাবা মায়ের খুব ইচ্ছা এখানে বিয়ে দিবে। এখন মেয়ে হয়ে তাদের ইচ্ছে পূরণ করা কি আমার অপরাধ?একটা মানুষকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চাওয়া কি অপরাধ? অপরাধ হলে আমাকে শাস্তি দে!! আমাকে ফাঁসি দে!!পানিশ মি!"


বলেই কুহু পড়নের ওডনা নাকে-মুখে চেপে ধরলো। গুনগুন করে কান্নার সুর ভেসে আসলো।থেমে থেমে হেচকিও তুললো। তনয়া হতভম্ব হয়ে গেলো এমন কান্ডে।তীব্র অপরাধবোধ ছেয়ে গেলো তার মনে। আসলেই তো মেয়েটা ওই ছেলেটাকে রাজনীতি করা স্বত্তেও পছন্দ করে ফেলেছে। বাবা মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী বিয়েও করতে রাজী হয়েছে। এটা তো তার অপরাধ না।তনয়া উঠে গিয়ে কুহুর সামনে ড্রেসিং টেবিলে বসলো। অপরাধী কন্ঠে বললো- 


"এ..এই কুহু,কাঁদছিস কেন? স্যরি দোস্ত, আমি বুঝতে পারি নি ।এইবারের মতো ক্ষমা করে দে না।এই কুহু?"


তনয়া অনেক অনুনয় করলো।আজকের এই শুভ দিনে মেয়েটা তার কথায় চোখের পানি ফেলছে,নিজেকে অনেক দোষী মনে হলো তার। কুহু আচমকা নাক থেকে ওড়না সরিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো- 

"আচ্ছা যা, ক্ষমা করে দিলাম।"


তনয়ার মুখটা হা হয়ে গেলো। কোথায় চোখের পানি? চোখ দুটো একদম মরুভুমির মতো শুকনো।তার মানে এতক্ষন এই মেয়ে অভিনয় করছিলো? এত নিঁখুত অভিনয়?  রাগে তনয়ার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেলো। কুহুর এসবে তেমন ভাবাবেগ হলো না।সে মেকাপ ব্রাশ টা নিয়ে গালে ব্লাশ দিতে ব্যস্ত। তনয়া গরম কন্ঠে বললো-


"অপরাধ তুইও করিস নি আমিও করি নি, অপরাধ করছে ওই ভদ্রলোক। তোকে বিয়ে করার অপরাধ। বিয়ের পর হাড়ে হাড়ে টের পাবে কি জিনিস ঘরে তুলেছে।"


------------

শাহাদ নির্বাচন অফিসে এসেছে। একটা খুব দরকারি কাজ আছে। তার বাবার পরিবর্তে সে এসেছে। নির্বাচন অফিসের বারান্দার একটা চেয়ারে বসে আছে। তার পড়নে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা,পাঞ্জাবির উপরে একটা কালো কটি।পাঞ্জাবির হাতা গুটানো। এখানকার কাজ শেষ করে কুহুদের বাড়িতে যাওয়ার কথা তার। ভিতর থেকে তার বাবার সেক্রেটারি রওনাক বেরিয়ে এলো। বয়সে শাহাদের সমবয়সীই। ২ বছর ধরে কাজ করছে সেক্রেটারি হিসেবে। রওনাক বের হয়ে শাহাদের কাছে এসে বললো- 


"ভাই চলুন ভিতরে।"


শাহাদ উঠে দাঁড়ালো। প্রবেশ করলো অফিসের ভিতর। আধা ঘন্টা পর কাজ শেষ করে বেরিয়ে আসলো। বাইরে এসে ঘড়ি দেখলো। এতক্ষনে ওর পরিবারের সবার কুহুর বাসায় চলে যাওয়ার কথা। শাহাদ বের হয়ে আসলো অফিস থেকে। অফিস চত্বরের এক পাশে তার গাড়ি আর তার সাথে আসা ছোট একটা ছেলেদের দল। শাহাদ সেদিকে যাওয়ার সময় গেট দিয়ে কয়েকটা বাইক ঢুকলো।বাইক গুলোর পিছনে আসলো একটা দামী কালো গাড়ি। শাহাদ আর রওনাক দুজনে দাঁড়িয়ে পড়লো জায়গায়।  বাইক সহ গাড়িগুলো একপাশে গিয়ে থামলো। গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো বিরোধী দলের নেতা হিশাম চৌধুরী। শাহাদের চেয়ে বয়সে ৫-৬ বছরের বড়। পড়নে পাঞ্জাবি পায়জামা। দেখতে বেশ সুপুরুষ। 


গাড়ি থেকে বের হয়ে হিশামের চোখচোখি হলো শাহাদের সাথে। শাহাদকে সে গেট দিয়ে ঢুকার সময়ই দেখেছে।তাকে সামনাসামনি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। পাশে দাঁড়ানো তার সেক্রেটারিকে বললো-


"এ এখানে কি করছে?"


"স্যার, আগামী নির্বাচনের জন্য কোনো কাজে এসেছিলো বোধহয়। "


"নির্বাচন কমিশনার আছে তো অফিসে?"


"আছে স্যার,আমি খবর নিয়ে জেনেছি।"


হিশামের মুখের কাঠিন্যতা দূর হলো না। সেক্রেটারিকে নিয়ে এগিয়ে গেলো অফিসের দিকে। শাহাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আরেকবার চোখাচোখি হলো দুজনের। শাহাদ শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। হিশাম চোখ সরিয়ে নিলো। সে ছোট থেকে শাহাদকে চিনে। বেশ শান্তশিষ্ট, ভদ্র টাইপের ছেলে। কিন্তু তারপরেও শাহাদকে তার ভালো লাগে না। এই যে তাকিয়ে আছে ওর দিকে চোখের দৃষ্টিতে কোনো উত্তাপ নেই,শান্ত দিঘির পানির মতো চাউনি। কিন্তু তারপরও হিশামের মনে হচ্ছে এক্ষনি শাহাদ তাকে গুলি করে দিবে। যেমনটা সে করেছিলো গত নির্বাচনে। 


শাহাদ নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকে হিশামের চলে যাওয়া দেখলো। রওনাক পাশ থেকে কানাকানি করার মতো করে গলা নামিয়ে বললো-


"এই সন্ত্রাস এখানে এসেছে নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে কোনো প্ল্যান করছে হয়ত।"


শাহাদ উত্তর দিলো না। সে মুখ ঘুরিয়ে গাড়ীর কাছে এগিয়ে গেলো। গাড়ির কাছে গিয়ে দেখলো তার দলের ছেলেগুলো অপর পাশে থাকা হিশাম চৌধুরির দলের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন আক্রমণাত্মক ইশারা ইংগিত করছে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো ওই পাশ থেকেও ওরা কম যাচ্ছে না। কেউ কেউ আবার শার্ট উপরে তুলে কোমড়ে গুজে রাখা রিভ*লবার দেখাচ্ছে। শাহাদ গাড়িতে উঠে বসলো। রওনাকও সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসলো। শাহাদের দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে বলল- 


"একটু আগেই খবর পেলাম স্যার পৌছে গেছেন ওইখানে।"


শাহাদ ঘড়ি দেখলো। রুওনাকের দিকে তাকিয়ে বলল- 

"তাহলে ওখানে যাওয়া যাক।"


"ভাই জর্জ কোর্টে যেতে হবে, কিছু মামলা মোকদ্দমা আছে।তারপর ওইখান থেকে পার্টি অফিস।সেখানে একটা মিটিং আছে।"


"ঠিক আছে। "


শাহাদ ছোট একটা শ্বাস ফেললো।আজ আর বোধহয়  কুহুর সাথে দেখা হবে না। মেয়েটা কি আশা নিয়ে বসে আছে?অপেক্ষা করবে তার জন্য?কিংবা না গেলে রাগ করবে? নাহ!!এরকম কিছু করবে না।এখনো তো তাদের ভালো করে কেমিস্ট্রিই জমলো না। শাহাদ অন্যদিকে চিন্তা সরাতে চাইলো। প্রথম দেখার পর থেকেই মেয়েটা তার মস্তিষ্কে জুড়ে বসেছে। মস্তিষ্ক থেকে তাকে সরানো বড্ড দায় হয়ে পড়েছে।


------------


কুহু খুব সুন্দর একটা বেগুনি কালার শাড়ি পড়েছে। তনয়া খুব যত্ন করে পড়িয়ে দিয়েছে তাকে। চুলগুলো মাঝখানে সিঁথি করে ছেড়ে দিয়েছে, কানের নিচে দুটো টকটকে লাল গোলাপ গুজে দিয়েছে। কানে টানা দুল পড়েছে, গলায় খুব সিম্পল একটা লকেটওয়ালা হার। আর হাতে বেগুনি কালার কাচের চুড়ি, চোখে কাজল টেনে দেয়া আর ঠোটে লিপস্টিক। আয়নার সামনে দাঁড়ানো কুহুকে জড়িয়ে ধরে তনয়া মুগ্ধ কন্ঠে বললো- 


"তোকে কি সুন্দর লাগছে রে কুহু!! মা শা আল্লাহ,কারো নজর না পড়ুক।আজ তোর রসগোল্লা তোকে দেখে রসমালাই হয়ে  যাবে। "


কুহু মাথা নীচ দিকে দিয়ে তনয়াকে হালকা ধাক্কা দিয়ে লাজুক হেসে বলল- 

"যাহ!! কি যে বলিস না।"


"সত্যি বলছি। তোকে একদম নব্বই দশকের নায়িকাদের মতো লাগছে।"


কুহু আবারো লাজুক হাসলো৷ তনয়া মুগ্ধ দৃষ্টিতে কুহুকে দেখলো। এই মেয়ে নায়িকাদের মতো করে সাজার জন্য কি জেদটাই না করলো। শিরিনা বেগমও তার কাছে হার মেনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এখন সাজ কমপ্লিট হওয়ার পর কুহুকে দেখতে আসলেই নব্বই দশকের নায়িকাদের মতোই লাগছে। কুহু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্নভাবে লজ্জা পাওয়ার ভংগি করতে লাগলো। তনয়া কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো- 


"এমন করছিস কেন?"


"কিভাবে ওদের সামনে গেলে দেখতে ভালো লাগবে সেটাই দেখছি।"


তারপর তনয়ার দিকে ফিরে বললো-

"দেখ না কিভাবে যাব এভাবে নাকি এভাবে।"


কুহু বিভিন্ন রকম লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে এদিক ওদিক মুখ বাকিয়ে দেখালো। তনয়া নাক কুচকে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। কুহু তাড়া দিয়ে বলল- 


"কি হলো বল?"


তনয়া কিছু বলার আগেই নিচ থেকে গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে এলো। কুহুর মুখে তৎক্ষনাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেলো। তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললো-

"ওরা চলে এসেছে। "


বলেই বারান্দার দিকে দৌড় দিলো।তনয়া হায় হায় করে উঠলো-

"এই তুই কোথায় যাচ্ছিস?তুই তো পাত্রী।"


তারপর ছুটে গেলো কুহুর পিছনে।কুহু বারান্দায় পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে রাস্তায় উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তনয়াও কুহুর ঘাড়ের উপর দিয়ে উঁকি দিলো রাস্তায়। তিনটে গাড়ি এসেছে। সামনে একটা মাইক্রো মাঝখানে একটা প্রাইভেট কার তার পিছনে আরেকটা মাইক্রো। সামনের মাইক্রোটা থেকে কয়েকজন লোক বের হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে প্রাইভেট কারের দরজা টা খুলে দিলো। বের হয়ে আসলো সাদা পাঞ্জাবি পড়া একজন বৃদ্ধ লোক। তাঁর এক হাতে একটা লাঠি। গাড়ির অপর পাশ থেকে আরেকজন মধ্য বয়স্ক পাঞ্জাবি পায়জামা পড়া লোক নামলো। তনয়া ব্যস্ত হয়ে কুহুকে বললো- 


"এই যে উনি হচ্ছেন এমপি আশফাক খান। আমি উনার ছবি পোস্টারে দেখেছি। অনলাইনেও উনার নির্বাচনী প্রচারনা দেখেছি অনেকবার।"


কুহু আশফাক খানকে চিনতে পেরেছে। তবে আশফাক খান যে তার বাবার বন্ধু তা সে জানতো না। গেটের সামনে কুহুর বাবা মোয়াজ্জেম সাহেবকে দেখা গেলো।পাশে দাঁড়িয়ে আছে যিয়াদ।মোয়াজ্জেম সাহেব

  হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আশফাক খানকে। আশফাক খানও হাসলেন। দুই বন্ধু কুশল বিনিময় করলো। আশফাক খানকে ছেড়ে তাঁর পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধকে সালাম জানালো মোয়াজ্জেম হাসান।পিছনের মাইক্রোটা থেকে আস্তে আস্তে মহিলারা নেমে এলো। এই পর্যায়ে তনয়া তড়িঘড়ি করে কুহুকে টেনে ঘরে নিয়ে আসলো। কুহু বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলো- 

"টানছিস কেন?"


"দেখছিস না সবাই নেমে গেছে।হঠাৎ করে কেউ উপরে তাকিয়ে তোকে দেখে ফেললে কেলেংকারী হয়ে যাবে।"


কুহু ব্যাপারটা বুঝলো কিন্তু তার মন টা উশখুশ করতে লাগলো শাহাদকে দেখার জন্য। শাহাদ এখনো নামলো না কেন গাড়ি থেকে? তনয়া কুহুকে তাড়া দিয়ে বলল- 

"তাড়াতাড়ি চল নিচের ঘরে। উনারা চলে আসবে এক্ষুনি।"


কুহু নিজের কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নিচের ঘরের দিকে রওয়ানা করলো। তনয়ার সাহায্যে শাড়ি সামলে সিড়ি দিয়ে নিচে নামলো। তারপর নিচের গেস্ট রুমটায় ঢুকে গেলো।


খান পরিবারের সবাইকে আপ্যায়ন করে ড্রয়িং রুমে বসানো হলো। তনয়া দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কে কে এসেছে। কিন্তু এখান থেকে ড্রয়িং রুমের সবটা দেখা যায় না বলে তার দেখতে অসুবিধা হলো। কুহু গেস্ট রুমের বিছানার উপরে বসে ছিলো। চাপা গলায় তনয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল- 


"কে কে এসেছে?"


"সবাইকে দেখা যাচ্ছে না তো। শুধু দুজন মহিলাকে দেখা যাচ্ছে।"


শিরিনা বেগম সবার সাথে কুশল বিনিময় করে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।খানিক্ষন বাদে কুহুর কাছে আসলেন। কুহুর সাজগোজের পর উনি আর কুহুকে দেখেননি।মেয়েকে এরকম সাজে দেখে উনার চোখে পানি এসে গেলো।সেদিনের সেই ছোট্ট কুহু কিভাবে এত বড় হয়ে গেলো? তনয়া শিরিনা বেগমকে হাসিমুখে বললো-


"আন্টি, শাড়ি কিন্তু আমি পড়িয়ে দিয়েছি কুহুকে।কেমন হয়েছে?"


"খুব সুন্দর হয়েছে।"


তারপর এগিয়ে এসে বিছানায় বসে থাকা কুহুর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন- 

"মা শা আল্লাহ!!আমার মেয়ের গায়ে কারো নজর না লাগুক।"


কুহু ভয়ার্ত কন্ঠে বললো- 

"আমার ভয় করছে মা। আই এম নার্ভাস।"


"কোনো ভয় নেই মা। তোর বাবা আছে আমি আছি, ভয় কিসের?"


তারপর তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন-

"ওকে নিয়ে বাইরে আসো।"


শিরিনা বেগম যেতে উদ্ধত হলে কুহু হাত আকড়ে ধরলো।অনুনয় করে বলল- 

"তুমি আমার সাথে থাকো মা। আমি তোমার সাথে যাব।"


"বোকা মেয়ে,আমার কাজ আছে। সবাইকে আপ্যায়ন করতে হবে তো।"


শিরিনা বেগম মেয়ের হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।কুহু সূরা পড়ে বুকে ফু দিলো। এক গ্লাস পানি ঢক ঢক করে পুরোটা খেয়ে ফেললো। তনয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো-

"দেখ হাত কাঁপছে।মনে হয় সুগার ফল হচ্ছে।একটু মিষ্টি খেলে ভালো লাগতো।"


তনয়া দুষ্টু হেসে বলল-

"বসার ঘরে তোর রসগোল্লা আছে।গিয়ে দুটো কামড় দে। সুগার ফল  বাপ বাপ করে পালাবে।"


এত নার্ভাসন্যাসের মাঝেও লজ্জায় কুহুর গাল দুটো রক্তিম বর্ন ধারন করলো। তনয়া কুহুকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। আস্তে আস্তে ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ড্রয়িং রুমে ওরা ঢুকতেই সকলের মনোযোগ ওদের দিকে ঘুরে গেলো। তনয়া কুহুকে নিয়ে এক পাশের সোফায় বসিয়ে দিলো। কুহু লাজুক ভংগিতে জড়োসড়ো হয়ে বসলো।মৃদু কন্ঠে সবাইকে সালাম দিলো।মোয়াজ্জেম সাহেব মেয়ের আচরনে খুশি হলেন খুব।। একটা মহিলা উঠে এসে কুহুর পাশে বসে চিবুকে হাত দিয়ে মুখটা তুললো।হাসি দিয়ে বলল- 


"বাহ!কি সুন্দর দেখতে হয়েছো!! সেই ছোট বেলায় তোমায় দেখেছিলাম।"


কুহু মহিলাটার দিকে তাকালো। গোলগাল মায়া মায়া মুখ। মহিলাটি হেসে বলল- 


"আমি তোমার শ্বাশুড়ি হব। আমাকে মা বলে ডাকবে।ঠিক আছে?"


কুহু হালকা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।অপাশ থেকে আশফাক খান গলা উচিয়ে বললেন-


"আর আমাকে ডাকবে বাবা।"


তারপর পাশে বসে থাকা মোয়াজ্জেম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন-

"বুঝেছিস মোয়াজ মেয়েকে বিয়ে দিয়ে অন্যের বাড়ি পাঠিয়েছি এখন ছেলেকে বিয়ে করিয়ে আরেকটা মেয়ে পাব। শূন্য ঘরটা আবারো পূর্নতা পাবে।"


মোয়াজ্জেম সাহেব বন্ধুর কথায় হাসলেন। সাথে আসা বৃদ্ধ লোকটি কুহুকে প্রশ্ন করলো- 

"আমার নাতিকে তোমার পছন্দ হয়েছে তো? আমার নাতি কিন্তু লাখে একটা।"


কুহু এক পলক শাহাদের দাদা আব্দুল গাফফার খানকে দেখলো। সাদা চুল সাদা দাড়ি,হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কুহু মাথা নাড়িয়ে বুঝালো তার পছন্দ হয়েছে। গাফফার খান উপদেশ দেয়ার মতো করে বললেন-

"আমার নাতি খান পরিবারের উত্তরাধিকারী। ভবিষ্যৎ এমপি। তোমাকে কিন্তু শক্ত হাতে তার হাত ধরতে হবে, সাপোর্ট দিতে হবে।অনেক ঝড়-ঝাপ্টা আসবে কিন্তু হাত ছাড়া যাবে না।"


আশফাক খান বাধা দিয়ে বলল- 

"বাবা আপনি মেয়েটাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন এসব বলে। আস্তে আস্তে ও নিজেই সব বুঝে যাবে।"


আরো কিছু কথাবার্তা চললো।কুহু এক ফাকে সবাইকে একটু দেখে নিলো। আরো একটা মহিলা এসেছে। তার দুই পাশে দুটো মেয়ে,একটা মেয়ে যিয়াদের বয়সী ।কুহু তাকাতেই মেয়ে দুটো মিষ্টি করে হাসলো। কুহুও হাসলো। কিন্তু তার মন টা কিছুটা খারাপ হলো শাহাদকে না দেখতে পেয়ে। শাহাদের মা তাকে সুন্দর একটা হার উপহার দিলেন।অপর পাশে থাকা মহিলাটা উঠে  এসে এক জোড়া বালা হাতে পড়িয়ে দিয়ে বলল- 


"আমি শাহাদের চাচী হই। আমাকে কাকিমনি বলে ডাকবে।"


কুহু হেসে দিয়ে মাথা নাড়লো। আগের নার্ভাসন্যাস টা আর নেই এখন।সবার ব্যবহারে অনেকটাই সহজ হয়েছে সে। কিছুক্ষন পর কুহুকে গেস্ট রুমে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সংগে এলো সাথে আসা দুটো মেয়ে।কুহুকে একা ঘরে পেয়ে একটা মেয়ে  বললো-

"ভাইয়ার কাছে তোমার দেখেছিলাম। কিন্ত তুমি ছবির থেকেও সুন্দর।"


তনয়া জিজ্ঞেস করলো- 

"তোমরা কি হও শাহাদ ভাইয়ার?"


বড় মেয়েটা বললো-

"আমরা কাজিন হই।আমার নাম রাফা ওর নাম রিদি।আমি ক্লাস টেনে পড়ি আর ও পড়ে ক্লাস সেভেনে।"


কুহু রিদির গাল টেনে দিলো।খানিক পরেই ঘরে আসলো শিরিনা বেগম সাথে আসলো শাহাদের মা আর চাচী। সব মহিলারা একসাথে হয় কিছুক্ষন গল্প করলেন।এক পর্যায়ে শিরিনা বেগম আক্ষেপ করে বললেন-


"মেয়েটা ঘরের কোনো কাজ ই করতে চায় না আপা। হাজার বকাবকি করেও তাকে দিয়ে কিছু করাতে পারি না। সারাদিন মুভি দেখে।সংসার যে কিভাবে করবে।"


শাহাদের মা রেজিয়া সুলতানা হেসে বললেন-

"সেসব আপনাকে ভাবতে হবে না আপা।আমার ছেলের বউকে আমি ঠিক সব শিখিয়ে পড়িয়ে নিব।"


শিরিনা বেগম রেজিয়া সুলতানার হাত ধরে কৃতজ্ঞ হয়ে বললেন-

"তাহলে তো আমার আর চিন্তাই রইলো না।"


আরো কিছুক্ষন আলোচনা চললো। আলোচনা করে ঠিক হলো আর এক সপ্তাহ পড়েই বিয়ে।প্রথমে মোয়াজ্জেম সাহেব একটু দ্বিমত পোষণ করলেও আশফাক খানের বিভিন্ন যুক্তির কাছে হেরে গেলেন।এক সপ্তাহ পরে বিয়ে হবে এতেই মত দিলেন তিনি।  তারপর দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে সবাই বিদায় নিলো। 


সবাই বিদায় নিতেই কুহু নিজের ঘরে এসে শাড়ি খুলে টিশার্ট পড়ে চার হাত পা মেলে বিছানায় শুয়ে পড়লো। এতক্ষন সে নিচে ওদের সাথে ছিলো। খুব কষ্টে সে নিজেকে শান্ত শিষ্ট রেখেছে। ভুলভাল কাজ না করার চেষ্টা করেছে। অবশ্য শিরিনা বেগম তাকে কোনো কাজই করতে দেয় নি তাই ভুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না।সে শুধু নিজ দায়িত্বে মুখটা বন্ধ রেখেছে। 


তনয়া তার হ্যান্ডব্যাগটা কাধে নিয়ে বললো-

"এবার আমি গেলাম৷ "


কুহু বিছানায় উঠে বসে বললো-

"না খেয়ে চলে যাচ্ছিস কেন?"


"মাত্রই না তোর সাথে খেয়ে উপরে আসলাম।ভুলে গেলি?"


কুহু নাক মুখ কুচকে হাত দিয়ে নিজের মাথায় বারি দিলো। তনয়ার দিকে তাকিয়ে বলল- 

"ভুলে গিয়েছিলাম।"


তনয়া ঘড়ি দেখে বলল- 

"বেশি দেরি হলে মা বকা দিবে।এবার যাই। রাতে ভিডিও কল দিব।এখন গেলাম।তোকে আর নিচে আসতে হবে না। "


কুহু হাত নেড়ে তনয়াকে বাই জানালো।তারপর আবারো বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়লো।ছাদের দিকে তাকিয়ে ভাবলো আজ একটু আগে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। দুদিন পর তার বিয়ে হবে।বিয়ের পর সংসার,তারপর বাচ্চাকাচ্চা। কুহু জিভ কাটলো। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো।কিসব ভাবছে সে।কি লজ্জার ব্যাপার!


_________


পার্টি অফিসের কাজ শেষ করতে শাহাদের অনেক্ষন লেগে গেলো। সে বারবার ঘড়ি দেখছে।এতটা সময় লাগবে জানলে সে আজকের মিটিং ক্যানসেল করে দিত। অবশেষে মিটিংটা যখন শেষ হলো তখন সে এক প্রকার দৌড়েই বের হলো অফিস থেকে। রওনাককে উদ্দেশ্য করে বলল- 

"গাড়ি বের কর,কুইক। কুহুদের বাসায় যাব। "


"কিন্তু ভাই স্যাররা তো সবাই চলে এসেছেন।"


"চলে এসেছেন?"


"হ্যা ভাই,একটু আগেই খবর পেলাম তারা সবাই খান বাড়িতে ফিরে এসেছেন।আপনার বিয়ের ডেটও ঠিক হয়ে গেছে।"


"কবে?"


"এক সপ্তাহ পর।"


চলবে

গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ৩

 #টক_ঝাল_মিষ্টি

#তামান্না_আঁখি 

#পর্ব-৩


শাহাদ চোখ খুলে কুহুর দিকে তাকালো। কুহু বড় বড় চোখে অপরাধী মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শাহাদ হাত দিয়ে তার মুখে ছিটকে আসা খাবারের অংশগুলো ঝেড়ে ফেলতে লাগলো। শাহাদের সাথে থাকা ছেলেগুলো এই ঘটনায় হা হয়ে তাকিয়ে ছিলো। এমনকি ভাজা পোড়ার দোকানিও এই ঘটনায় অবাক হয়ে গেলো। একটা ছেলে এগিয়ে এসে  পকেট থেকে রুমাল বের করে শাহাদের হাতে দিয়ে কুহুকে বললো-


"আপা,এইটা কি করলেন? মানুষ টানুষ খেয়াল করবেন না?"

 

কুহু কাচুমাচু মুখ করে বলো-

"আই এম সরি। আমি খুব ই দুঃখিত। আই ডিডন্ট মীন ইট।ইচ্ছা করে করি নি।ট্রাস্ট মি।"


তনয়া এই ঘটনায় আক্কেল গুড়ুম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো কুহুর এমন বাংলা ইংরেজি ট্রান্সলেশন মার্কা কথা শুনে তার কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হলো। সে কুহুর কানের কাছে মুখ নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো- 


"ইংরেজী মারা বন্ধ কর, গিদর কোথাকার।"


তনয়ার ঝাড়িতে কুহু আরো চুপসে গেলো। ইচ্ছে হলো মাটি ফুঁড়ে পাতালে চলে যেতে। শাহাদ রুমাল দিয়ে ভালো করে মুখ টা মুছে নিলো। শার্টের উপরেও কিছু পড়েছে কিন্তু সে আপাতত সেদিকে মনোযোগ দিলো না।রুমালটা ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়ে ইশারা করে দূরে গিয়ে দাঁড়াতে বললো। তারপর কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল- 


"আপনি কি খাবার টা গিলেছেন?"


কুহু প্রবল বেগে উপর নীচ মাথা নাড়িয়ে বুঝালো সে খাবার গিলেছে। শাহাদ আশ্বস্ত হয়ে বললো- 


"এখানে কি করছেন?"


"একটু খাওয়া দাওয়া করতে এসেছিলাম।"


শাহাদ কুহুর হাতে থাকা আধ খাওয়া ভাজা চিংড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে প্রশ্ন করলো- 

"খাওয়া হয়েছে?"


"জী হয়েছে।"


পাশ থেকে তনয়া ব্যস্ত হয়ে বললো-

"না ভাইয়া হয় নি। ও বলেছিলো ও পিৎজা বার্গারও খাবে।"


কুহু তনয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালো।বিনিময়ে তনয়া মিষ্টি করে হাসলো। শাহাদ একটা ছেলেকে ডাক দিলো। ছেলেটা কাছে এলে বললো-


"উনাদের দুজনের সাথে যা। যা যা কিনতে চাইবে কিনে পার্সেল করে দিবি। "


ছেলেটা "জী ভাই" বলে মাথা নাড়ালো। শাহাদ কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল- 

"ওর সাথে যান। আর এখানে বেশিক্ষন না থাকাই ভালো। দলবল নিয়ে এসেছি তো যেকোনো সময় ছেলেরা ঝামেলায় জড়িয়ে যেতে পারে।"


"আমাদের কিছু লাগবে না। আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে। আমি এখন যাই।বাই।"


বলেই কুহু তনয়ার হাত ধরে চলে যেতে চাইলো। শাহাদ কুহুর সামনে তার এক হাত মেলে দিয়ে আটকে দিলো কুহুকে। বললো-


" খেতে ইচ্ছে হয়েছে যেহেতু এখানে খেতে না পারলেও পার্সেল নিয়ে যান।"


তারপর ডেকে আনা ছেলেটাকে হাত উঁচু করে তুড়ি বাজিয়ে ইশারা দিয়ে কুহুর সাথে যেতে বললো।শেষবার কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল- 


" আমি নিজে নিয়ে যেতে পারলাম না বলে দুঃখিত কুহু।"


একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে শাহাদ তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের ভীড়টায় গিয়ে শরীক হলো। ছেলেগুলোকে সাথে নিয়ে অন্য একটা দোকানে গেলো। কুহু সেদিকে তাকিয়ে রইলো অনেক্ষন। পাশ থেকে তনয়া দুষ্টু কন্ঠে বললো- 

"ওয়ে হয়ে!!দুলাভাই তো একদম কড়া জিনিস। হাতছাড়া করিস না। বিয়েটা করে ফেল। "


কুহু কিছু বলবে তার আগেই ছেলেটা এসে বললো- 

"আপু কোথায় যাবেন চলুন।"


কুহু একবার ঘাড় ঘুরিয়ে শাহাদের দিকে তাকালো। শাহাদ ছেলেপেলে নিয়ে একটা রিক্সাওয়ালার সামনে দাঁড়ানো। শান্তমুখে রিক্সাওয়ালার অভিযোগ শুনছে। কুহু চোখ সরিয়ে তনয়াকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। তনয়া নিজেই এইটা ওইটা অর্ডার করে ফেললো। ছেলেটা কাউন্টারে বলে দিলো প্রতিটা জিনিস কুহু তনয়ার জন্য আলাদা ব্যাগে করে পার্সেল করতে। পার্সেল চলে এলে কুহু দাম দিতে গেলে ছেলেটা বাধা দিয়ে বলল-


"পে করতে হবে না আপু।"

"কেন?"

"উনি বিলটা ভাই কে পাঠিয়ে দিবে। ভাই-ই পেমেন্ট করে দিবে। আপনি আসুন, আপনাদেরকে রিক্সায় তুলে দেই।"


কুহু আর কথা বাড়ালো না। সে ছেলেটির সাথে বাইরে বেরিয়ে এলো। একবার এদিক ওদিক দেখলো শাহাদকে দেখার আশায় কিন্তু শাহাদ কোথাও নেই।দূরে শাহাদের গাড়ি আর সাথে আসা বাইক গুলো পার্ক করা। সাথের ছেলেটি রিক্সা ঠিক করে ভাড়া দিয়ে দিলো। কুহুকে বললো- 


"উঠুন আপু।"


তনয়া আগে উঠে বসলো রিক্সায়। কুহু উঠতে গিয়ে থেমে গেলো ছেলেটিকে প্রশ্ন করলো- 

" আপনার ভাই মানে উনি এখন কোথায়?"

"ভাই আজ বাজারে এসেছেন লোকজনের সুবিধা অসুবিধা দেখতে।এখন হয়ত বাজারের অন্যদিকে গেছেন।"


কুহু রিক্সায় উঠে বসলো। যেতে যেতে প্রতিটা রাস্তায় সে শাহাদকে দেখার আশায় তাকালো,কিন্তু পেলো না। তনয়া এতগুলো পার্সেল পেয়ে বেশ খুশি। কুহুকে উদ্দেশ্য করে বলল- 

"তোর রসগোল্লা কত ভালো রে! কি কেয়ারিং! উনাকে বিয়ে করে ফেল। "


"তোর মন চাইলে তুই বিয়ে করে ফেল।"


"সত্যি বলছিস? তাহলে বাসায় গিয়ে মা কে বলব।"


"বেহায়া মেয়ে,বান্ধবির হবু বরের দিকে নজর দিস। লজ্জা করে না।"


"তুই না বললি বিয়ে করবি না।"


কুহু ইতস্তত করে বলল- 

"তাতে কি!! বাবা তো আমাকে জোর করে বিয়ে দিবে বলেছে।তাই আমাকে না পেরেই বিয়ে করতে হবে রে।আমার কিছু করার নেই। আই হ্যাভ নাথিং টু ডু।"


শেষের কথাটা কুহু অসহায়ের মতো ভান করে বললো।তনয়া মুখে "হুউউউউ" জাতীয় শব্দ করে বললো-


" বাবা জোর করে বিয়ে দিবে না? নিজের মনে যে বিয়ের জন্য লাড্ডু ফুটছে তা স্বীকার করছিস না কেন?"


কুহু কপট রাগ দেখিয়ে বলল-

"কে বলেছে আমি বিয়ে করতে চাই। জানিস ই তো আমার রাজনীতি পছন্দ না।নেহাত বাবা-মায়ের মনে দুঃখ দিতে পারব না তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে বিয়েটা করেই ফেলি।"


"সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিস?তা সিদ্ধান্তটা কখন নিলি?"


"এখন নিলাম।তোর সমস্যা?"


"আমার কি সমস্যা হবে, হবে তো ওই ভদ্রলোকের। আহারে! বেচারা তোর মতো মেয়ের সাথে এক ছাদের নিচে থাকবে কি করে!"


"তুই একটা ডাইনী। ইউ আর এ উইচ। বান্ধবীর সাথে এমন করিস। হুহ।"


তনয়াও একটা মুখ ভেংচি দিলো। সারা রাস্তা দুজনে এইভাবে তর্কাতর্কি করতে করতে গেলো। বাড়িতে এসে কুহু খাবারের প্যাকেট গুলো ডায়নিং টেবিলের উপর রেখে দিলো। গলা ছেড়ে ডাকলো-


"মা,ও মা।"


শিরিনা বেগম নিজের ঘরে ছিলেন মেয়ের চিৎকারে বের হয়ে এলেন।কুহুকে উদ্দেশ্য করে বললেন- 

"চেচাচ্ছিস কেন?"


কুহু টেবিলের উপর থাকা খাবারের প্যাকেট গুলোর দিকে আঙুল উচিয়ে  বলল- 

"ওই রাজনীতিওয়ালা দিয়েছে এসব।"


"কি ওয়ালা?"


কুহু তাড়াতাড়ি সংশোধন করে বলল- 

"মানে শাহাদ খান দিয়েছে এসব।"


শিরিনা বেগম বিস্মিত হলেন।প্যাকেট গুলো থেকে খাবারগুলো বের করে আরো বিস্মিত হলেন।কুহুর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন-


"ওকে কোথায় পেলি?"


"বাজারে গিয়েছিলাম খেতে সেখানে পেয়েছি।দলবল নিয়ে দোকানে দোকানে গিয়ে কিসব করছে।"


" ও দিলো আর তুই নিয়ে নিলি?"


"এমনভাবে বললো না নিয়ে উপায় ছিলো না মা।"


শিরিনা বেগম বিস্ময় ভাব কাটাতে পারলেন না। নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি আপাতত খাবার গুলো খুলে রাখলেন।কুহু এক স্লাইস পিৎজা তুলে কামড় দিয়ে বলল- 

"ইনি মনে হয় ছোটখাট নেতা তাই না মা।"


"ওর পরিবারের সবাই নেতা। ওর বাবা এমপি।"


কুহুর খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো- 

"এমপি?"


শিরিনা বেগম টেবিলে খাবার গুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললেন-

"হুমম। তোর বাবার এমপি বন্ধুর কথা শুনিস নি?তার ছেলে।"


কুহু হা হয়ে গেলো। সে জানতো না এই কথা, রাজনীতি পছন্দ করে না বলে মায়ের কাছ থেকে শাহাদ সম্পর্কে জানার আগ্রহও দেখায় নি। কুহু আস্তে করে সিড়ি বেয়ে উঠে ঘরে চলে এলো।। একটু আগেই সে এমপির ছেলের মুখে খাবার ছুড়ে ফেলেছে।এই অভদ্রতার কথা বাবার কানে গেলে তার খবর আছে। দাত দিয়ে ওড়নার কোণা কামড়ালো কুহু। ইশশ!! যত অঘটন সব তার জীবনেই।


__________


শাহাদ বাজারের কাজ শেষ করে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি ছাড়ার পর তার নজর পড়লো শার্টে লেগে থাকা খাবারের কিছু অংশের দিকে। ড্রাইভারকে বলে টিস্যু বক্সটা নিলো।তারপর টিস্যু দিয়ে ঝেড়ে ফেললো সব। আনমনে একটু হাসলো কুহুর কথা মনে করে। দুইদিন আগেও সে মেয়েটাকে ভালো করে চিনতো না আর এখন কত কিছু হয়ে গেলো।  এক সপ্তাহ আগে তার বাবা একটা মেয়ের ছবি দেখিয়ে বলল "এই মেয়েকে আমার পছন্দ হয়েছে ছেলের বউ হিসেবে, এখন তুই গিয়ে দেখে করে আয়"। ব্যস,বাবার কথা মতো সেও চলে গিয়েছিলো দেখা করতে৷ তার বাবা তাকে  কুহুর কয়েকডজন ছবি পাঠিয়েছিলো এর আগে। সবগুলো ছবিই দেখেছে শাহাদ। ছবি দেখে কুহুকে পছন্দ হয়েছে তার। এর আগে একটা অনুষ্ঠানে কুহুকে দেখেছিলো শাহাদ।বাবা-মায়ের সাথে এসেছিলো।তখন কুহু বোধ হয় হাই স্কুলে পড়তো। তবে এখন বড় হওয়ার পর দেখা করে মেয়েটার উলটা পালটা কাজে তার বেশ মজাই লেগেছে। 


শাহাদ পকেট থেকে ফোন বের করে কুহুর ছবি বের করলো। প্রত্যেকটা ছবিতেই কুহু অদ্ভুত সব পোজ দিয়েছে,অন্তত শাহাদের কাছে পোজগুলো অদ্ভুতই মনে হচ্ছে। একটা ছবিতে আইস্ক্রিম নিয়ে খাওয়ার ভান করে হা করে আছে। অন্য আরেকটায় বাচ্চাদের দোলনায় গিয়ে দোলনার দুদিকের শিকল ধরে দোলনায় উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। শাহাদের বড্ড জানতে ইচ্ছে হলো এই ছবি তোলার বুদ্ধি কুহুকে কে দিলো? আর এমন ছবি পাত্রী দেখার জন্যই বা কেন পাঠালো। অন্য ছবি গুলো মোটামুটি ভালোই। কোনোটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে নয়তো দাঁত বের করে হাসি। ছবিতে কুহুর হাসি দেখে শাহাদের হাসি আরো বিস্তৃত হলো।খুব ই হাসে মেয়েটা। চঞ্চলও বটে। শাহাদ কুহুর ছবিটা জুম করে কিছুক্ষন দেখলো তারপর প্রসন্নচিত্তে হাসি হাসি মুখে চলন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। মনে হচ্ছে তার স্থির, নিশ্চল জীবনে দখিনা হাওয়ার আগমন ঘটতে চলেছে।


___________


সন্ধ্যার দিকে কুহুর ডাক পড়লো মোয়াজ্জেম সাহেবের ঘরে। কুহু কিছুক্ষন ঘর জুড়ে পায়চারি করলো। বাবাকে সে বেশ ভয় পায়। কি বলতে কি বলে ফেলবে তাই নিজেকে একটু গুছিয়ে নিচ্ছে। সে এদিক ওদিক চার হাত পা ছুড়ে একটু ওয়ার্ম আপ করলো নিজেকে। তারপর রওয়ানা করলো মোয়াজ্জেম সাহেবের ঘরের দিকে। মোয়াজ্জেম সাহেবের ঘর নিচে। সিড়ি বেয়ে নামতে হবে। যাওয়ার সময় যিয়াদের ঘরের দিকে চোখ পড়লো। দরজা খোলা রেখে টেবিলে বসে পড়ছে। কুহু দরজায় দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে ডাকলো- 

"এই,পড়ছিস?"


যিয়াদ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে কুহুকে দেখে আবার পড়ায় মনোযোগ দিয়ে বলল- 

"না, মাটি কাটছি।"


কুহুর দাঁত কিড়মিড় করে উঠলো রাগে। ভাইয়ের কাছে এসেছিলো একটু কথা বলে সহজ হতে।তা তো হলোই না উলটো মেজাজটা বিগড়ে দিলো। কুহু আর সময় নষ্ট না করে সিড়ি বেয়ে মোয়াজ্জেম সাহেবের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজায় টোকা দিয়ে বলল- 

"বাবা আসব?"


ক্ষনকাল পর আওয়াজ আসলো-"এসো।"


কুহু দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখলো মোয়াজ্জেম সাহেব চা খাচ্ছেন। তার সামনের টেবিলে অনেক গুলো বই পাতা উলটে রাখা। মোয়াজ্জেম সাহেবের ঘরে অনেক গুলো বইয়ের আলমারি। সব গুলো বই দিয়ে ভর্তি। কুহু যতটা পারলো শব্দহীন হেটে মোয়াজ্জেম সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালো। মোয়াজ্জেম সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন -


"ছেলেটিকে কেমন লেগেছে?"


কুহু বুঝতে পারলো শাহাদের কথা জিজ্ঞেস করছে।সে একদিকে মাথা হেলিয়ে উত্তর দিলো- 

"ভালো।"


"তুমি আমার একমাত্র মেয়ে। যেখানে সেখানে আমি তোমাকে বিয়ে দিতে পারি না। সে জন্য বিশ্বস্ত একটা জায়গার দরকার।আমার বন্ধুর বাড়িতে তোমাকে রেখে আমি নিশ্চিন্তে থাকব। অনেক ভেবে আমি এই প্রস্তাবে রাজী হয়েছি। এখন তুমি রাজি হলেই পাকা কথা হবে।"


কুহুর খুব লজ্জা লাগলো। এইভাবে সরাসরি কেউ একটা মেয়েকে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে নাকি? অন্য কেউ হলে নিশ্চয় মা-চাচী কাউকে দিয়ে মেয়ের মতামত জানতে চাইতো। কিন্তু তার স্ট্রেট ফরোয়ার্ড বাবা সেসবের ধার ধারেন নি। সোজা নিজেই সরাসরি জানতে চাচ্ছেন। 

মোয়াজ্জেম সাহেব প্রশ্ন করলেন-

"তোমার কি ছেলেটিকে পছন্দ হয় নি? পছন্দ না হলে বলতে পারো। তোমার অমতে কিছুই হবে না।"


কুহু শোনা যায় না এমন করে বলল- 

"পছন্দ হয়েছে বাবা।"


মোয়াজ্জেম সাহেব এমন মিনমিন উত্তর পছন্দ করলেন না। তিনি মেয়েকে বললেন-

"জোরে বল।"


কুহুর অবস্থা হলো দেখার মতো। বাবার সামনে তীব্র লজ্জা আর অস্বস্তিতে তার বারটা বেজে তেরটা হওয়ার জোগাড়। সে তারপরও কষ্ট করে গলার স্বর কিছুটা বাড়িয়ে বললো-

"পছন্দ হয়েছে বাবা।"


মোয়াজ্জেম সাহেব সন্তষ্ট হলেন মেয়ের উত্তরে। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে মেয়েকে বললেন-

"যাও।"


তারপর আয়েশ করে চুমুক দিলেন। ছাড়া পাওয়া মাত্র কুহুর ইচ্ছা হলো ছুটে বেরিয়ে যেতে কিন্তু সেরকম কিছু সে করলো না। সে শব্দহীন পায়ে হেটে হেটে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ঘরের বাইরে এসে ওড়নার কোনা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো।তারপর সিনেমার নায়িকারা লজ্জা পেলে যেভাবে দৌড় দেয় ঠিক সেভাবে দৌড় দিলো সে।


শিরিনা বেগম হালকা নাস্তা বানিয়ে ট্রে তে করে যিয়াদের জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন। আচমকা কুহু দৌড়ে এসে তার সামনে পড়লো। উনি "এই,এই" বলে মৃদু চিৎকার করে দূরে সরলেন। কুহু কিছুক্ষন থেমে মায়ের দিকে তাকিয়ে একটা লাজুক হাসি দিলো তারপর মুখে ওড়না চেপে ধরে সিনেমার স্টাইলে সিড়ি বেয়ে দৌড়ে উপরে উঠে গেলো। শিরিনা বেগম কিছুক্ষন বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলেন কুহুর দিকে।  তারপর হতাশ হয়ে মাথা নাড়লেন। এই ড্রামাবাজ মেয়েকে কে বিয়ে করবে?


কুহু ঘরে এসে বিছানায় বসে পড়লো। পাশ থেকে বালিশ নিয়ে বুকে চেপে ধরলো। সত্যি সত্যি এই রসগোল্লা টাইপ ছেলেটার সাথে তার বিয়ে হয়ে যাবে? ইশশ কি লজ্জা!! হোক না রাজনীতিবিদ তাতে কি। তার সাথে তো আর নেতাগিরি দেখাবে না, যা দেখাবে সব বাইরে। তার সাথে তো অনেক রোমান্টিক হয়ে থাকবে।তবে কুহুও কম যাবে না সেও অনেক রোমান্টিকতা করবে। সেজেগুজে থাকবে,নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াবে........ রান্না-বান্না সহ সংসারের কাজকর্মের কথা মনে হতেই কুহুর মুখ থেকে হাসি সরে গেলো। বির বির করে বলল- 

"এই যা!!বিয়ে করলে তো কাজকর্ম করতে হবে। ওহ মাই গড।"


________


রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুমানোর আগে কুহু স্কিন কেয়ার করতে বসলো। একটা প্লাস্টিকের ছোট বাটিতে ফেস প্যাক বানালো। আচ্ছামত নেড়েছেড়ে সব মিক্সড করলো। এরপর একটা ফেসিয়াল হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে চুলগুলো আটকে নিলো। এবার মুখে ফেসপ্যাক দেয়ার পালা। মোবাইলের কর্কশ রিংটোনে কুহুর ফেসপ্যাক দেয়া ব্যহত হলো। সে বিরক্তি নিয়ে উঠে এসে কল রিসিভ করে কানে ধরে কর্কশ কন্ঠে বললো- 

"হ্যালো,কে?"


"কুহু বলছেন?"


"হ্যা বলছি।"


"আমি শাহাদ।"


কুহুর ঠোঁট দুটি হা হয়ে গেলো। শাহাদ তাকে কল দিবে সে ভাবে নি। সে কন্ঠ কোকিলের মতো চিকন করে বলল- 

"জী বলুন।"


"বাবার কাছ থেকে আপনার নাম্বারটা নিয়েছি। শুনলাম আপনি বিয়েতে রাজি। "


"জী।"


"আমাকে আপনার পছন্দ না হলে আমার কাছে স্বীকার করতে পারেন।"


কুহু কিছু বললো না।সে চুপ করে রইলো। শাহাদ কুহুর উত্তরের জন্য কিছুক্ষন অপেক্ষা করে বলল-

"আমি আসলে এই ব্যাপারে শিউর হয়ে আগাতে চাই।কোনো দ্বিধা থাকুক তা চাই না। কুহু?আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন?"


কুহু উত্তর দিলো- 

"জী বুঝতে পারছি।"


"তাহলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।"


কুহুর হাসফাস লাগলো। বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না অবস্থা হলো তার। সে চোখ খিচে বন্ধ করে বলে দিলো-

"আপনাকে আমার পছন্দ। আই লাইক ইউ।"


কুহুর উত্তর শুনে শাহাদের হাসি পেলো। হালকা হাসলো সে। কুহুকে বললো- 

"ধন্যবাদ। আমার বাড়ি থেকে কাল আপনাকে পাকা দেখা দেখতে যাবে। আপনার অসুবিধা নেই ত?"


"না নেই।"


"উমমম...আরেকটা কথা।ওদের সামনে নিজেকে  "হুকু" বলবেন না। রিলাক্স থাকবেন, ঠিক আছে?"


কুহু হতভম্ব হয়ে গেলো এমন কথা শুনে। সে স্পষ্ট শুনতে পেলো শাহাদ অল্প হাসছে। শাহাদ একটু থেমে বললো-

"গুড নাইট কুহু। সি ইউ সূন।"


কলটা কেটে গেলো। কুহু মোবাইল নামিয়ে হাতে নিয়ে থম মেরে বসে থাকলো। তার বানানো ফেসপ্যাক মুখে আর দেওয়া হলো না।


চলবে

গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ২

 #টক_ঝাল_মিষ্টি

#তামান্না_আঁখি

#পর্ব-২


"হোয়াট দ্য হেল ইজ ইট?"


টেবিলের উপর আধ খাওয়া রুটি-ডিম ভাজির রোল দেখে কুহুও অবাক হয়ে গেলো। সে এটা আশা করে নি। শাহাদ কৌতুহলবশত জিনিসটা কি সেটা দেখার জন্য হাত বাড়ালো ধরতে। ধরার আগেই কুহু ছো মেরে নিয়ে গেলো রোলটা।নিয়ে একদম ব্যাগে ভরে ফেললো। শাহাদ এই কান্ডে বিস্মিত হলো।কুহুকে প্রশ্ন করলো- 

"কি এটা?"


কুহুর ঝটপট উত্তর-

"কই, কিছু না তো।"


"রুটি মনে হলো। টিস্যুতে মোড়ানো।"


কুহুর বেশ রাগ হলো। আরে ভাই রুটি থাকুক আর পরোটা থাকুক,তাতে তোর কি। মেয়ে দেখতে এসেছিস মেয়ে দেখ। চতুর্দিকে এত কিসের নজর?কুহু কিছুটা কঠিন স্বরে বলল- 


"রুটিই।"


"আপনি ব্যাগের ভেতর অর্ধেক খাওয়া রুটি নিয়ে ঘুরছেন কেন?"


"এম্নিই।মাই লাইফ মাই রুলস।"


কুহুর উত্তর শুনে শাহাদ স্থির চোখে কুহুর দিকে তাকালো। অর্ধেক খাওয়া রুটি ব্যাগে নিয়ে ঘুরাফিরা করা যে কোনো মেয়ের লাইফের রুলস হতে পারে এটা তার জানা ছিলো না।ওয়েটার এসে টিস্যু বক্স দিয়ে গেলো। কয়েকটা টিস্যু নিয়ে কুহুকে দিলো শাহাদ। আর কয়েকটা টিস্যু বের করে কুহুর কফির কাপটা তুলে নিচে পড়া কফিটা ভাল করে মুছল।


হাত মুছতে মুছতে কুহু শাহাদের কাজ কর্ম লক্ষ্য করলো। কি সুন্দর করে টেবিলে থাকা কফিটা মুছলো। কারো কফি মুছার দৃশ্যও যে এত সুন্দর হতে পারে তা কুহুর আগে জানা ছিলো না।কুহু শাহাদের হাত লক্ষ্য করলো।শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটানো, হাতে সিলভার কালারের একটা বেশ দামি ঘড়ি। খুব সুন্দর করে টিস্যু দিয়ে চেপে চেপে টেবিল পরিষ্কার করছে।দেখতে বেশ লাগছে।


শাহাদ টেবিলটা মুছে কুহুর দিকে হাত বাড়ালো।কিন্তু কুহু ভাবুক হয়ে টিস্যু হাতে নিয়ে কচলাচ্ছে।শাহাদ টেবিলে টোকা দিলো। কুহু ধ্যান ভেঙে তাকালো। শাহাদ কুহুর দিকে হাত মেলে দিয়ে বললো-


"কাজ শেষ হলে টিস্যু দিন,ফেলে দেই।"


কুহু হাতের টিস্যুর দিকে একবার তাকালো।তারপর শাহাদের হাতের তালুতে রাখলো। শাহাদ পাশে থাকা ময়লার বিনে টিস্যু গুলো ছুড়ে ফেললো। কুহু এই ছোট ব্যাপারটাতেও অভিভূত হয়ে গেলো। কি ডিসেন্ট!!কি দায়িত্বশীল!! আহা,খালি যদি রাজনীতিটা না করতো তাহলেই ষোলো কলা পূর্ন হতো।


শাহাদ কুহুর দিকে তাকিয়ে কফি খেতে ইশারা করলো। তারপর নিজের কাপে চুমুক দিয়ে বলল- 


"আমি অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছি।এখন আমার বয়স ২৮ চলছে। পারিবারিক ব্যাবসা আছে আমাদের।সেখানে আমি জয়েন করেছি। আর এর বাইরে রাজনীতিতে আমি অনেক এক্টিভ। ভবিষ্যতে এটাকেই পেশা হিসেবে নিব।"


কুহু মনে মনে হিসাব কষলো। ওর বয়স ২১ আর এই ছেলের বয়স ২৮। ৭ বছরের গ্যাপ।ইশশ! এজ গ্যাপটাও তো বেশি৷ ওর তো ৪-৫ বছরের গ্যাপ পছন্দ। আবার বলছে রাজনীতি মেইন পেশা হিসেবে নিবে। এই রসগোল্লার মতো ছেলেটা এভাবে হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে কেন? কুহু মনে মনে দুঃখ অনুভব করলো। 


শাহাদ একটু থেমে আবার বললো -

"আমরা জয়েন ফ্যামিলি। আমি সবসময় জয়েন ফ্যামিলিতেই থাকার ইচ্ছা পোষণ করি,এমনকি বিয়ের পরও। "


কুহু সব বুঝতে পেরেছে এমন করে উপর নীচ মাথা নাড়লো। সে নিজে কি বলবে কিছু ভেবে পেলো না। শাহাদ কফির কাপ নামিয়ে বললো -


"আপনার কিছু বলার থাকলে বলুন।যদি অন্য কাউকে পছন্দ করে থাকেন তবে নির্দ্বিধায় বলুন আমি নিজে থেকে বিয়ে আটকাব।"


কুহু দুপাশে মাথা নেড়ে বললো- 

"না না আমার কোনো পছন্দ নেই।"


"তাহলে কোনো প্রশ্ন থাকলে করুন, আমাকে একটা মিটিং এটেন্ড করতে হবে। "


"আমার কোনো প্রশ্ন নেই।"


"ওয়েল,তাহলে উঠা যাক।চলুন।"


কুহু উঠে দাঁড়ালো। শাহাদও উঠে লিফটের দিকে চললো। কুহু শাহাদের পিছু পিছু হাটতে লাগলো।পিছন থেকে সে শাহাদের হাটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলো। এক হাত পকেটে পুরে হাটছে।হাটায় কোনো তাড়াহুড়ো নেই। কুহু কিছুটা পিছিয়ে পড়লো।হঠাৎ তার মনে পড়লো কফির বিল দেয়া হয় নি। সে অল্প দৌড়ে শাহাদের পাশাপাশি গিয়ে হাটতে হাটতে বললো-


"কফির বিল দেয়া হয় নি তো।"


শাহাদ ততক্ষনে লিফটের কাছে এসে বোতাম চেপে দিয়েছে।কুহুর কথায় কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল- 


"এটা আমার রেস্টুরেন্ট।"


কুহুর ভ্রু দুটো আপনাআপনিই উপরে উঠে গেলো। শাহাদ লিফটের ভেতরে ঢুকে পড়লো।পিছুপিছু ঢুকলো কুহুও। লিফটের ভেতর পিনপতন নীরবতা।কুহুর এত অস্বস্তি হলো যে ও শ্বাসটাও ঠিকমতো ফেলতে পারছে না।নিজের শ্বাসের শব্দই নিজের কাছে অস্বস্তিকর ঠেকছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো শাহাদ পকেটে হাত রেখে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কুহু শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।ওর এভাবে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাস নেই। ওর দাতগুলো নিসপিস করছে নখ কাটার জন্য, সে খুব কষ্ট করে দমিয়ে রেখেছে। 


লিফট এসে থামলো সোজা গ্যারেজে।শাহাদ আগে কুহুকে বের হতে দিয়ে তারপর নিজে বের হলো। পকেট থেকে গাড়ির চাবি বের করে বলল- 


"এদিকে আসুন। "


"বের হওয়ার রাস্তা তো ওদিক দিয়ে।"


"আমি আপনাকে বাসায় ড্রপ করে দিব।আমার গাড়ি এইপাশে রাখা।"


"না না, আমি একাই চলে যেতে পারব। আপনার কষ্ট করতে হবে না।"


শাহাদ হাটা থামিয়ে কুহুর দিকে পিছন ফিরলো। শান্ত কন্ঠে বললো- 

"মিস কুহু,আমার সত্যিই অনেক তাড়া আছে।প্লিজ সময় নষ্ট করবেন না।আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আমি কাজে যাব।"


শাহাদ এমন ভাবে বললো যে কুহুর আর কোনো কিছু বলার থাকলো না।সে পায়ে পায়ে শাহাদের গাড়ির সামনে এলো। শাহাদ প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা খুলে দিলো কুহুর জন্য।কুহু উঠে বসলো। শাহাদ দরজা লাগাতে গিয়ে দেখলো কুহুর আনারকলির একটু অংশসহ ওড়না বের হয়ে আছে। কুহুর সেদিকে খবর নেই, সে আপনমনে  তার ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে ব্যস্ত। শাহাদ নিজেই ঝুঁকে ওড়না আর আনারকলির অংশ টুকু নিজের হাতে ভিতরের দিকে দিয়ে দিলো। তারপর দরজা লাগিয়ে নিজেও উঠে বসলো গাড়িতে। নিজের সিটবেল্ট বেধে কুহুকে বললো-


"আপনার সিটবেল্ট বাঁধুন।"


কুহু মোবাইল টিপছিলো সিটবেল্টের কথা শুনে ভারি বিরক্ত হলো। এই এক জিনিস তার ভালো লাগে না। বাড়ির গাড়িতে বাবার ভয়ে সিটবেল্ট বাধতে হয়। সে শাহাদকে মিথ্যা বললো-

"আমি আসলে সিটবেল্ট বাঁধতে পারি না। "


শাহাদ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো কুহুর দিকে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে এই মেয়ে মিথ্যে বলছে। সে সিটবেল্ট বাধতে পারে কিন্তু কোনো অজানা কারনে সে বাধবে না। শাহাদ কিছু বলে সময় নষ্ট করল না।সে নিজেই হাত এগিয়ে সিটবেল্ট টেনে এনে কুহুর সিটের পাশে আটকে দিলো। 


এরকম কান্ডে কুহু আবারো স্তম্ভিত হলো। সে সিনেমায় দেখেছে নায়ক নায়িকার সিটবেল্ট বেধে দেয়।বেধে দেয়ার সময় কাছাকাছি আসে। কিন্তু এই ছেলে এত দূরে থেকে বাধলো কিভাবে।এর হাত কত লম্বা? কুহু শাহাদের  হাতের দিকে তাকালো। শাহাদ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। গ্যারেজ থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামিয়ে দিলো গাড়ি। কুহু ভালো করে খেয়াল করলো শাহাদকে। শান্ত শিষ্ট মুখশ্রী, কোনো আলগা গাম্ভীর্য নেই একদম সরলতায় পূর্ন। কুহু আচমকা প্রশ্ন করে বসলো-


"আপনি কি বিয়েতে রাজী?"


শাহাদ এক পলক কুহুর দিকে তাকালো। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে চমৎকার করে হাসলো। কুহু হা করে সেই হাসি দেখলো। মনে মনে ভাবলো "রসগোল্লা আবার সুন্দর করে হাসেও।এ তো দেখি পুরাই রসে টুইটুম্বুর অবস্থা!!" শাহাদ হেসে উত্তর দিলো-

"আপনি রাজি থাকলে আমার অসুবিধা নেই।"


আয় হায়!! এমন করে বললে কুহুর যে বিয়ে করা ছাড়া আর উপায় থাকবে না। কুহু মুখ ফিরিয়ে অন্যপাশে তাকালো। নাক মুখ খিচে বসে রইলো। এইভাবে কিছুক্ষনের দেখায় সে তার হৃদয়কে বেদখল হতে দিবে না । কিছুতেই না।


কুহুকে নামিয়ে দিয়ে শাহাদ চলে গেলো। কুহু তার ঘরে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। শিরিনা বেগম একবার এসে কুহুকে দেখে গেছেন কিন্ত কিছু বলেন নি। এর মধ্যে উঁকি দিলো যিয়াদ। কুহুকে এভাবে বসে থাকতে দেখে সেখান থেকেই ডাক দিলো-


"কিরে হুকু! দেখাদেখি কেমন হলো? "


কুহু অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো যিয়াদের দিকে। যিয়াদ এই দৃষ্টি দেখে একটা জ্বালাময়ী হাসি দিলো। হেলে দুলে ঘরে ঢুকলো। কুহুর স্টাডি টেবিলের চেয়ার টেনে বসলো।কুহু রাগান্বিত কন্ঠে বললো- 

"হুকু ডাকছিস কেন বেয়াদব?"


"তুমিই তো নিজের নাম হুকু দিয়েছো, আমি ডাকলে দোষ কি!"


কুহু দাত কিড়মিড় করলো। মাঝে মাঝে অতিরিক্ত উত্তেজনায় নিজের নাম হুকু বলে ফেলে তাই বলে কি এটা বলে ক্ষ্যাপাতে হবে? কুহু নিজেকে শান্ত রেখে বলল- 

"যা এইখান থেকে।"


"আগে বলো কেমন লাগলো ভবিষ্যৎ দুলাভাইকে।"


"ভবিষ্যৎ দুলাভাই মানে?আমি কি বলেছি আমি বিয়ে করব?"


"করবে না?"


"না, জীবনেও করব না।"


"ওও তাহলে যাও বাবাকে গিয়ে এটা বলো।"


কুহু ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। বাবার কথা মনে পড়তেই মুখটা এতটুকু হয়ে গেলো। যিয়াদ কুহুর অবস্থা দেখে বেশ মজা পেলো। কুহুকে খোচানোর জন্য ঘর ছেড়ে যেতে যেতে বললো-


" শুনলাম আর কয়দিনের মাঝেই নাকি তোমাকে ওই বাড়ির বড়রা দেখতে আসবে।কি যে মজা হবে!! "


কুহুর শুকনো মুখটা আরো শুকিয়ে গেলো। হায় আল্লাহ!! এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিবে? রান্নাবান্না, ঘর গুছানো সব করতে হবে? তার উপর আবার রাজনৈতিক পরিবারে বিয়ে? কুহু  ঝড়ের বেগে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। বিছানায় হাত দিয়ে কিল দিয়ে বলল- 

"এরকম একটা ছেলেকে কেন রাজনীতি করতে হলো। Why the কেন?"


----------


সকালে কুহু যত তাড়াতাড়ি পারে খেয়ে বের হয়ে গেলো ভার্সিটির জন্য। ব্রেকফাস্ট টেবিলে সে তার বাবার মুখোমুখি হতে চায় না। মুখোমুখি হলেই শাহাদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে তার বাবা।গত রাতেও সে তার বাবাকে এড়িয়ে গেছে। ভার্সিটি এসে তনয়াকে দেখলো পিছনের বেঞ্চে বসে আছে। কুহুকে দেখে আজকেও  হাত উড়িয়ে ডাকলো। কুহু ধপ করে গিয়ে বসে পড়লো বেঞ্চে। তনয়া আগ্রহ নিয়ে  জিজ্ঞেস করলো- 


"কাল যে দেখা করতে গেলি কেমন দেখলি? কি কি খুত বের করলি?"


কুহু হতাশ কন্ঠে বললো- 

"কোনো খুত নেই রে, ছেলে একদম রসগোল্লার মতো।"


"ইয়া আল্লাহ! অসভ্যের মতো এইসব কি বলিস।"


"এরকম একটা ছেলে রাজনীতি করে কেন রে?হোয়াই? মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।"


"রাজনীতি খারাপ কি, পছন্দ হলে বিয়ে করে ফেল।"


"তুই বুঝবি না।চল ক্লাস পালাই।মন টা ভালো না। চল একটু খাওয়া দাওয়া করি।"


"করব যদি তুই ট্রিট দিস।"


কুহু ট্রিট দিতে রাজি হলো। ক্লাস মিস দিয়ে তারা শহরের সবচেয়ে ব্যস্তততম এলাকায় এলো। এখানেই বেশিরভাগ রেস্টুরেন্ট আছে সাথে শপিংমল ও আছে।কুহু আর তনয়া ফুটপাতে একটা স্ট্রিট ফুডের দোকানে দাঁড়িয়ে গলদা চিংড়ী ভাজা খাচ্ছে।এমন সময় বেশ কয়েকটা বাইক হই হল্লা করতে করতে রাস্তার অপর পাশে থামলো। সাথে থামলো একটা গাড়ি। গাড়ি থেকে বের হলো শাহাদ সহ আরো কয়েকজন। শাহাদকে দেখে কুহুর খাওয়া থেমে গেলো। তনয়া কুহুর কাধে ধাক্কা দিয়ে বলল- 

"খাচ্ছিস না কেন?না খেলে আমায় দে।"


কুহু সামনে দেখিয়ে বলল-

"ওই দেখ, ওই লোকের সাথেই গতকাল দেখা করতে গিয়েছিলাম।"


তনয়া সামনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো- 

"কোন লোকটা?"


"ওই স্কাই ব্লু কালার শার্ট আর কালো প্যান্টের ছেলেটা।"


তনয়া এতজনের ভীড়ে কুহুর বর্ননা অনুযায়ী শাহাদকে খুজে পেলো। শাহাদ শান্ত মুখে দোকানীদের অভিযোগ শুনছে। তনয়া সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল-

"আসলেই তো রসগোল্লার মতো রে।"


কুহু উদাস হয়ে বললো-

"হুমমম। এমন ছেলে গান গাইবে, ক্যানভাস নিয়ে ছবি আঁকবে,তা না দলবল নিয়ে মিছিল করছে।"


"তুই যা না একটু গিয়ে কথা বলে আয়। "


"পাগল নাকি। জীবনেও যাব না "


কুহুর যাওয়ার দরকার পড়লো না শাহাদ ই তার দলবল নিয়ে রাস্তার এই পাড়ে চলে এলো। রাস্তা থেকে ফুটপাতে উঠতে গিয়ে কুহুকে দেখে চমকে গেলো। দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। কুহু এমন চোখাচোখিতে ভ্যাবাচেকা খেয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। শাহাদের দলের একটা ছেলে শাহাদকে ফুটপাতের ভাজাপোড়ার দোকান দেখিয়ে বলল-


"ভাই এই দোকানিটাকে বলে যান।"


শাহাদ কুহুর দিক থেকে চোখ সরিয়ে কুহু যেই দোকানে খাচ্ছিল সেখানে দাঁড়ালো। ফুটপাতে দোকান না দেয়ার কথা খুব সুন্দর ভাবে দোকানিকে বুঝিয়ে বলল। কুহু আর তনয়া দুজনেই হা করে তাকিয়ে রইলো শাহাদের দিকে। কুহু মুখে থাকা খাবারটা গিলতেও ভুলে গেলো। 


কথা শেষ করে যাওয়ার আগে শাহাদ একবার ভাবলো কুহুর সাথে কুশল বিনিময় করা উচিত।সে কুহুর দিকে হেটে এগিয়ে গেলো। শাহাদকে এগিয়ে আসতে দেখে কুহুর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। গালে থাকা খাবার তাড়াতাড়ি গিলতে চাইলো কিন্তু তা আটকে গেলো গলায়। ততক্ষনে শাহাদ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে কুহুকে যেই বললো "মিস কুহু" অমনি কুহু জোরেশোরে একটা বিষম খেলো। মুখের খাবার ছিটকে পড়লো শাহাদের চোখেমুখে। সহজাত প্রবৃত্তির দরুন শাহাদ চোখ বন্ধ করে ফেললো। 


চলবে

গল্প-টক_ঝাল_মিষ্টি পর্ব ১

 "এসব রাজনীতি ফাজনীতি করা ছেলে আমি বিয়ে করব না মা, কিছুতেই না।"


শিরিনা বেগম বিরক্ত চোখে পড়ার টেবিলের সামনে দাঁড়ানো মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।মেয়েটা গাল ফুলিয়ে ওড়নার কোণা হাতে পেচাচ্ছে আর বার বার এক ই কথা বলছে। তিনি মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন-


"এরকম বললে তো হবে না কুহু। তোর বাবা এ ছেলেকে পছন্দ করেছেন। তুই অন্তত গিয়ে দেখাটা করে আয়। না গেলে তোর বাবার সম্মান যাবে যে।"


কুহু একবার মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকালো। পরক্ষনেই দুহাত কানে চেপে চোখ বন্ধ করে মৃদু চিৎকার করলো "নায়ায়ায়া এ হতে পারে না"। তারপর শাবানা স্টাইলে দৌড়ে গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে গেলো। বালিশে মুখ গুজে মিথ্যা কান্নার ভং ধরলো। 


শিরিনা বেগম হতাশ চোখে তার সিনেমাবাজ মেয়ের কান্ড কারখানা দেখলেন। এই মেয়ে সারাদিন বাংলা সিনেমা দেখে  আর আশির দশকের নায়িকাদের মতো ঢং করে।।তিনি মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন-

" ভালো করে সেজেগুজে রেডি হয়ে ভার্সিটি যাবি।ক্লাস শেষ করে সোজা ছেলের সাথে দেখে করতে যাবি।বুঝেছিস?"


কুহু প্রতিউত্তরে গুনগুন করে কান্নার সুর তুললো। শিরিনা বেগম মেয়ের ঢং আর সহ্য কর‍তে পারলেন না তিনি মুখ ঘুরিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। 

মায়ের চলে যাওয়ার আভাস পেয়ে কুহু বিছানায় উঠে বসলো। কোমড়ে হাত দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুক্ষন ভাবলো। তার প্রফেসর বাবা কি করে একজন রাজনীতিবিদের সাথে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগতে পারে এই কথা কিছুতেই তার বোধগম্য হচ্ছে না।  দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ৮ টার উপর বাজে। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে গেলো সে।তাকে রেডি হয়ে ভার্সিটি যেতে হবে।


মোয়াজ্জেম সাহেব ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। শিরিনা বেগম ডায়নিং টেবিলে ব্রেকফাস্ট রেডি করছেন। বার বার তাকাচ্ছেন সিড়ির দিকে, কুহু নামলো কিনা দেখছেন। কুহু নামলো না, কুহুর পরিবর্তে নামলো  যিয়াদ। তার কাধে একটা স্কুল ব্যাগ।ধুপধাপ শব্দ করে নামছে। সিড়ির শেষ ধাপে এসে বাবাকে দেখে থেমে গেলো সে। শব্দ কমিয়ে খুব ধীরে ধীরে নামতে লাগলো। ডায়নিং টেবিলের চেয়ারটা খুব আস্তে করে টান দিয়ে সরাল।তারপর ব্যাগ টা নিচে নামিয়ে রেখে বসে পড়লো। মোয়াজ্জেম সাহেব পেপার পড়া শেষ করে কাগজ ভাজ করে রেখে  উঠে আসলেন। তিনি এসে যিয়াদের সামনাসামনি একটা চেয়ার টেনে বসলেন। 


যিয়াদ গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে একবার তার পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর বাবাকে দেখে নিলো। পড়নে ফর্মাল ড্রেস,কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছেন। ইন করা শার্ট সাথে কালো প্যান্ট,কাচাপাকা চুল। চোখের দৃষ্টি এখনো অনেক ভালো তাই চশমা ব্যবহার করেন না। যিয়াদ ঢকঢক করে পানি খেলো।এবার তার প্রফেসর বাবা তাকে কঠিন কঠিন কিছু প্রশ্ন করবে সেটারই পূর্ব প্রস্তুতি স্বরূপ সে গলাটা ভিজিয়ে নিলো।


মোয়াজ্জেম সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন পরখ করলেন। মুখটা শুকনো লাগছে বোধহয় রাতে কম ঘুমাচ্ছে। তিনি সরাসরি প্রশ্ন করলেন-


"মুখটা শুকনো কেন?রাতে ঘুমোও নি?"


"দেরিতে ঘুমিয়েছি বাবা।পদার্থবিজ্ঞানের একটা অংক সলভ করতে দেরি হয়ে গিয়েছে।"


মোয়াজ্জেম সাহেবকে খুব প্রসন্ন দেখা গেলো। ছেলে পদার্থবিজ্ঞানের জন্য ঘুম বিসর্জন দিয়েছে শুনে তিনি বেশ খুশি হলেন।তিনি পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করার জন্য তৈরি হলেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন-


"নিউটনের সেকেন্ড ল সম্পর্কে সবথেকে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা কি বলো তো।"


যিয়াদের প্লেটে শিরিনা বেগম পরোটা দিলেন। যিয়াদের বেশ ক্ষুধা লেগেছে। কিন্তু বাবার প্রশ্ন শুনে তার জিহবা আটকে গেছে। সে নিউটনের তিনটা সূত্রের আগামাথা সব ই জানে কিন্তু বাবার সামনে আসলেই সব গুলিয়ে ফেলে।সে মনে মনে উত্তর রেডি করতে চেষ্টা করলো কিন্তু অস্থিরতায় পারলো না।

 মোয়াজ্জেম সাহেব ভ্রু কুচকে ছেলেকে দেখলেন। তার এই অসম্ভব মেধাবি ছেলেটা কোনো এক কারনে তার সামনে এলেই ভড়কে যায়। তিনি ছেলের ভয় ভাঙানোর জন্য প্রতিনিয়তই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।খাবার টেবিলে তিনি বিভিন্ন প্রশ্ন করে ছেলেকে সহজ করতে চাচ্ছেন কিন্তু এতে কোনো কাজ হচ্ছে না বরং তার ছেলে খাবার টেবিলটাকেই ভয় পেতে শুরু করেছে। তিনি ছেলেকে আশ্বাস দিয়ে বললেন-


"অস্থির না হয়ে মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করো।"


শিরিনা বেগম স্বামীর প্লেটে নাস্তা দিতে দিতে বললেন-


"ছেলেটা গত রাতে ভালো করে ঘুমোয় নি।দিন রাত পড়েই যাচ্ছে। খাবার টেবিলে অন্তত ছেলেটাকে রেহাই দাও।"


মোয়াজ্জেম হোসেন স্ত্রীর কথায় একমত হলেন। তিনি স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন-

"কুহু কোথায়?"


"রেডি হয়ে একবারে নামবে।"


কিছুক্ষন পর ই কুহু নেমে এলো। শিরিনা বেগম সিড়ির দিকে তাকিয়ে মেয়েকে দেখলেন।একটা ল্যাভেন্ডার কালারের আনারকলি পড়েছে কুহু।চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে পিছন দিকে নিয়ে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিয়েছে। বেশ পরিপাটি করেই সেজেছে। কুহু তার বাবাকে দেখে খুব ভদ্রভাবে যিয়াদের পাশের চেয়ার টেনে ভার্সিটির ব্যাগটা পাশে রেখে বসলো।মৃদু স্বরে বলল- 

"গুড মর্নিং বাবা।"


মোয়াজ্জেম সাহেব পরোটা ছিড়তে ছিড়তে উত্তর দিলেন-

"গুড মর্নিং। এত দেরি করে খেতে এসেছো কেন?তোমার ভার্সিটি কয়টায়?"


কুহু মিন মিন করে বললো-

"রেডি হতে দেরি হয়েছে বাবা।"


"সময়জ্ঞান জীবনে খুব ই গুরত্বপূর্ণ। এটা মেইনটেইন করে চলবে।"


কুহু একপাশে মাথা হেলিয়ে বুঝালো এবার থেকে সে মেইনটেইন করবে সময়। শিরিনা বেগমও খেতে বসলেন। খাওয়ার এক পর্যায়ে মোয়াজ্জেম সাহেব কুহুকে উদ্দেশ্য করে বললেন-


"আজ ভার্সিটির পর তুমি আমার বন্ধুর ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যাবে।তোমার মা নিশ্চয়ই তোমাকে তার সব ডিটেইল বলেছে। "


কুহু একবার অসহায় চোখে তার মায়ের দিকে তাকালো। শিরিনা বেগম মেয়ের দিকে তাকালেন না।তিনি খাবার খেতে ব্যস্ত।মোয়াজ্জেম সাহেব আবারো বললেন-

"ভদ্রভাবে কথা বার্তা বলবে। ছেলেটি খুব ভদ্র এবং চুপচাপ।তাকে কোনো রকম অস্বস্তিতে ফেলবে না।"


কুহু তার বাবার সামনে কিছু বলার সাহস পেলো না।কিন্তু তার খুব বলতে ইচ্ছে হলো "রাজনীতি ফাজনীতি করা ছেলে আমি বিয়ে করব না বাবা"। কিন্তু সে বলতে পারলো না। চেয়ারে শক্ত হয়ে বসে রইলো। মোয়াজ্জেম সাহেব খাওয়ার ফাকে একবার মেয়েকে দেখে নিয়ে বললেন-

" কি বলেছি বুঝতে পেরেছো?"

"জী বাবা।"

 

যিয়াদ খাওয়ার ফাঁকে বড় বোনকে আড়চোখে একবার দেখে নিলো। তার বোন যে চিপায় পড়েছে তা তার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছে। কিন্তু করার কিছু নেই। 


--------------


কুহু ভার্সিটির গেটের সামনে এসে রিক্সা থেকে নামলো। গেটের সামনে ফুচকা দেখে তার জিভে পানি এসে গেলো। সকালে খাবার টেবিলে সে ভাল করে খেতে পারে নি তাই ফুচকা দেখে ক্ষিধেটা বেড়ে গেছে। কিন্ত এখন ফুচকা খেলে চলবে না তার ক্লাসের দেরি হয়ে যাবে। সে শুকনো মুখে ভার্সিটিতে ঢুকলো। ক্লাসে ঢুকে পিছনের দিকে সিটে তনয়াকে দেখতে পেলো। কুহুকে দেখেই হাত উচিয়ে ডাকলো তনয়া। কুহু হেটে গিয়ে ধপ করে তনয়ার পাশে বসে পড়লো। তনয়া ভ্রু কুচকে কুহুকে পরখ করলো। প্রশ্ন করলো- 

"মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছিস কেন?"


কুহু উদাস হয়ে উত্তর দিলো- 

"দ্বীন দুনিয়া কিছু ভাল্লাগে না রে।"


"কেন?"


"বাবা কোথাকার কোন রাজনীতিবিদের সাথে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছে।আজ ক্লাসের পর আমাকে দেখা করতে যেতে বলেছে।"


তনয়া বড় বড় চোখে কুহুকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললো- 

"এ জন্যই  সেজেগুজে ভদ্র হয়ে এসেছিস?"


কুহু মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললো-

"হুম্মম্মম।"


"তো অসুবিধা কোথায় যা দেখা করে আয়।"


"আমার রাজনীতিবিদ পছন্দ না।"


"তাহলে এভাবে গেলে তো তোকে দেখে পছন্দ করে ফেলবে। তার চেয়ে বরং একটু বিশ্রি করে সেজে যা, তাহলে পছন্দ করবে না। আয় তোর কাজলটা লেপ্টে দিই।"


কুহু ছিটকে দূরে সরে গেলো। তনয়ার দিকে তাকিয়ে বলল- 

"পাগল হয়েছিস!! এত সুন্দর করে ববিতার মতো করে কাজল দিলাম আর তুই লেপ্টে দিবি!"


"দুনিয়ায় এত নায়িকা থাকতে তুই আশির দশকের নায়িকাদের পিছনে পড়ে আছিস কেন বুঝিনা।"


কুহু লাজুক মুখে হেসে বলল- 

"ওদেরকে আমার ভালো লাগে। ওদের মতো অভিনয় করতে ভালো লাগে।"


বলেই সে ওড়নার কোণা টেনে মুখে চেপে নায়িকাদের মতো করে হাসলো। কুহুর এসব ঢং দেখে তনয়া মুখ সরিয়ে নিলো। আজ সারাদিনের জন্য সে যথেষ্ট ঢং দেখে ফেলেছে। আর দেখতে চায় না। প্রতিদিন ই কুহুর এসব দেখে দেখে সে রীতিমতো অতিষ্ট। এম্নিতে ভাব ধরছে মানা যায় কিন্তু মাঝে মাঝে কুহু আশির দশকের বাংলা ছবির নায়িকাদের মতো সেজেগুজে ভার্সিটি আসে। এরকম সুন্দরি একটা মেয়েকে এই গেটাপে দেখে ছেলেরা তখন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কেউ কেউ তো বিভিন্ন নামে ডেকে ওঠে। 


কুহু তনয়ার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল- 

"একটা বুদ্ধি দে না কিভাবে কি করব।"


তনয়া কুহুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল-

"আগে গিয়ে দেখা কর। পরে বাসায় গিয়ে বলে দে যে পছন্দ হয় নি। রাজনীতি যেহেতু করে নিশ্চয়ই বয়স বেশি,ভুড়ি-টুড়িও থাকতে পারে।যেকোনো একটা খুঁত বের করে না করে দিবি।"


কুহুর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেলো।বুদ্ধিটা বেশ লেগেছে তার কাছে। তার মনটা খুশি হয়ে গেলো।সে খুশি মনে ব্যাগ থেকে টিস্যুতে মোড়ানো একটা পরোটা আর ডিম ভাজি বের করলো। তনয়া চোখ কপালে তুলে বললো-

"একি!!এসব কি এনেছিস?"


কুহু ডিম ভাজিটা পরোটার ভিতর রেখে রোল করতে করতে বললো -

"টেনশনে খেতে পারি নি বুঝলি। এখন বুদ্ধি পেয়ে টেনশন কিছুটা কমেছে। তাই এখন খাব।"


তনয়া সামনে তাকিয়ে দেখলো স্যার এসে ঢুকেছে ক্লাসে।এদিকে ক্লাসের এইদিকটা পরোটা আর ডিম ভাজির গন্ধে ম ম করছে। কয়েকজন পিছন ফিরে অলরেডি তাকিয়ে দেখেও নিয়েছে। তনয়া অবিশ্বাস্য চোখে কুহুর দিকে তাকিয়ে বললো-

"তুই কি মানুষ?"


কুহু উত্তর দিতে পারলো না। সে বড় করে একটা কামড় দিলো পরোটা আর ডিম ভাজির রোলটাতে।তারপর মুখ ভর্তি খাবার চিবাতে চিবাতে তনয়ার দিকে তাকিয়ে গা জ্বালা হাসি দিলো।


__________


একটা ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টের লিফটে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে কুহু। তার গন্তব্য ছাদ। ছাদে একটা ক্যাফে আছে। ক্যাফেটা এই রেস্টুরেন্টের ই একটা অংশ।এই ক্যাফেটার বিশেষত্ব হচ্ছে এইখান থেকে শহরটা খুব সুন্দর করে দেখা যায়।দারুণ ভিউ! প্রি বুকিং ছাড়া এই ক্যাফেতে টেবিল পাওয়া যায় না।ভি আই পি রাই কেবল আসতে পারে এখানে। চারপাশে নিরিবিলি ভাব রাখার জন্য অধিকাংশ টেবিলের বুকিং নেয়া হয় না। ইচ্ছে করে খালি করে রাখে কর্তৃপক্ষ। 


লিফট চলে এলো ছাদে। লিফটের দরজা খুলতেই সামনে বিশাল ছাদ নজরে এলো। ছাদের এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটানো টেবিল চেয়ার।বেশিরভাগ ই খালি। কুহু লিফট থেকে বেরিয়ে খোপার ক্লিপটা খুলে দিলো। পিঠ পর্যন্ত চুল গুলো ঝর ঝর করে নেমে গেলো। নিজের সব কিছু ঠিকঠাক করলো।সে বিয়ের করতে চায় না তাই বলে নিজেকে কি একটু পরিপাটি দেখাবে না? সব ঠিকঠাক করে কুহু এক সাইডে থাকা কাউন্টার টার কাছে গেলো। যেতে যেতে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো পাঞ্জাবি পড়া কোনো লোক বসে আছে কিনা।তার জানামতে রাজনীতিবিদরা বেশির ভাগ পাঞ্জাবিই পড়ে।কিন্তু এমন কাউকে সে পেলো না। সে কাউন্টারে থাকা লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো- 


"এক্সকিউজ মি,আমার একটা টেবিল বুক করা ছিলো । "


"কি নামে বুক করা ছিলো ম্যাম?"


"শাহাদ খান।"


"ওহ ম্যাম,আসুন।স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।"


কুহু লোকটির পিছু পিছু গেলো। লোকটি তাকে ছাদের অন্যপাশে নিয়ে গেলো। হাত দিয়ে কোনার দিকে একটা টেবিল দেখিয়ে বলল- 

"এই যে আপনার টেবিল ম্যাম।"


কুহু তাকিয়ে দেখলো কাচ ঘেরা রেলিঙের কাছে একটা টেবিল।সেখানের একটা চেয়ারে এশ কালার শার্ট আর কালো প্যান্ট পরিহিত একটা ছেলে বসে আছে। পায়ের উপর পা তুলে মোবাইল টিপছে। কুহু মনে মনে ভাবলো এটাই কি সেই রাজনীতিবিদ ছেলে? একে দেখতে তো রাজনীতিবিদ মনেই হয় না।কুহু হেটে গিয়ে টেবিলটার সামনে দাঁড়ালো। এতক্ষন মোবাইল টিপতে থাকা ছেলেটা তার আসার আভাস পেয়ে মুখ তুলে তাকালো। কুহু এক নজর সামনে থাকা ছেলেটাকে দেখে বোকা বনে গেলো।এর কি খুত বের করবে সে? এ তো পুরাই রসগোল্লা।


 ছেলেটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কুহুর দিকে তাকালো। কুহু মুখ ফসকে বলে ফেললো-

"আমি হুকু।আপনার সাথে দেখা করতে......"


বলেই কুহু থেমে গেলো। এ কিসব বলছে সে? সামনে থাকা ছেলেটা কিছু বুঝতে না পেরে বললো-

"হোয়াট?"


কুহু মনে মনে নিজেকে গালি দিলো। তারপর কোনোমতে বললো -

"আমি আসলে কুহু। আমি দেখা করতে এসেছি।"


সামনে থাকা ছেলেটি কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো।তারপর  চেয়ার দেখিয়ে বলল- 

"বসুন।"


কুহু বসলো। একটু ভদ্রতাসূচক হাসলোও।কিন্তু ছেলেটা সেই হাসিতে যোগ দিলো না বরং সে কুহুকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করলো। তারপর টেবিলে থাকা মেন্যুটা এগিয়ে দিয়ে বলল- 

"কি নিবেন অর্ডার করুন।"


"আমি কিছু নিব না। আপনি নিন।"


"কফি?"


কুহু ঘাড় বাকিয়ে সম্মতি দিয়ে বলল- 

"ওকে।"


শাহাদ দূরে দাঁড়ানো ওয়েটারকে ইশারা করে দুটো কফি আনতে বললো।তারপর তাকালো কুহুর দিকে। মেয়েটাকে বেশ চঞ্চল মনে হচ্ছে,অস্থির স্বভাব।এসেই নাম ভুল করেছে। অস্থিরতার দরুন বলেছে "হুকু"।এখনো ব্যাগের কোণা নখ দিয়ে খুটছে। চোখের মনি স্থির নেই বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। শাহাদ চিন্তা করলো এভাবে বসে না থেকে কিছু কথাবার্তা বললে হয়ত মেয়েটা সহজ হবে।সে প্রশ্ন করলো- 


" কিসে পড়ছেন?"


"অনার্স সেকেন্ড ইয়ার।ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট। দ্য রয়াল ডিপার্টমেন্ট। "


শাহাদ দম ধরে গেলো।একটা প্রশ্নতে এতগুলো ইনফরমেশন দিয়ে দিলো।এই মেয়ে তো কথাও বেশি বলে। পরের প্রশ্ন আর শাহাদকে করতে হলো না কুহু নিজে থেকেই প্রশ্ন করলো- 

"আপনি কি আসলেই রাজনীতি করেন?"


শাহাদ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো কুহুর দিকে। তারপর উত্তর দিলো-

"হ্যা।"


এই কথা শুনে কুহুর মন ভেংগে গেলো।হ্যান্ডসাম দেখতে ছেলেটা রাজনীতি করে? রাজনীতি না করে অন্য কিছু করলে তো এক নিমিষে বিয়ে করে ফেলত কুহু।সে হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করলো- 


"হোয়াই?কেন করেন?"


শাহাদ কুহুকে ভালো করে দেখলো। মেয়েটি কি হতাশ হলো নাকি তার রাজনীতি করা নিয়ে?সে উত্তর দিলো-

"এটা আমার ফ্যামিলি ট্রাডিশন।"


কুহুর মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো।পুরো ফ্যামিলি রাজনীতি করে। আহারে!! এই ছেলে ভুল ফ্যামিলিতে জন্মেছে। তার ইচ্ছে হলো দুই কানে দুই হাত চেপে "নায়ায়া" বলে একটা চিৎকার দিতে। কিন্তু তা সম্ভব না।


কফি চলে এলো। কফির ট্রে থেকে দুটো কফির কাপ দুজনের সামনে রেখে ওয়েটার বিদায় নিলো। শাহাদ ট্রে তে থাকা পাত্র থেকে একটা সুগার কিউব তুলে তার কফিতে ছেড়ে দিয়ে হালকা নাড়তে লাগলো। কুহুও শাহাদের দেখাদেখি একটা সুগার কিউব নিলো। ভালো করে নেড়ে এক চুমুক মুখে দিয়ে মুখ কুচকে ফেললো। এত তিতা? সে আরো দুটো সুগার কিউব নিয়ে কাপে ফেললো।শাহাদের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে  অনায়াসে এই তিতা কফি খাচ্ছে। শাহাদের দিকে তাকিয়ে কফি নাড়তে গিয়ে কুহু কাপ থেকে কফি ফেলে দিলো। গরম কফি ছিটকে পড়লো তার হাতে। "আহ" করে মৃদু শব্দ করে উঠলো।


শাহাদ তৎক্ষনাৎ ব্যস্ত হয়ে নিজের কাপ নামিয়ে রাখলো। টেবিলে টিস্যু খুজে না পেয়ে হাত দিয়েই কুহুর হাতে থাকা কফি মুছতে লাগলো।কুহুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো- 

"বেশি গরম?"


কুহু যতটা না গরম কফি পড়ায় চমকে গেলো তার চেয়ে বেশি স্তম্ভিত হয়ে গেলো শাহাদের কাজে।সে শাহাদের দিকে তাকিয়ে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে জানাল বেশি গরম না। শাহাদ তার হাত সরিয়ে ওয়েটারকে ডেকে বললো টিস্যু দিতে। কুহু অস্বস্তি কাটাতে বললো-


"আরেহ টিস্যু আমার কাছেই আছে।"


বলে সে ভার্সিটির ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে টিস্যু বের করলো। কিন্তু টিস্যুর পরিবর্তে বের হয়ে এলো টিস্যুতে মোড়ানো কুহুর আধ খাওয়া পরোটা আর ডিম ভাজির রোলটা। যেটাকে কুহু টিস্যু ভেবে বের করেছে। শাহাদ ভ্রু কুচকে টেবিলে থাকা আধ খাওয়া পরোটা ডিম ভাজির রোলটার দিকে তাকিয়ে কুহুকে জিজ্ঞেস করলো- 


"হোয়াট দ্য হেল ইজ ইট?"


চলবে

#পর্ব-১

#টক_ঝাল_মিষ্টি

#তামান্না_আঁখি

গল্প কন্ট্রোললেস পর্ব ৩৬ সমাপ্ত

 #কন্ট্রোললেস

#অনুপ্রভা_মেহেরিন

[পর্ব  ৩৬ শেষ পর্ব ]


ভীষণ জ্বরে ভুগছে উজ্জ্বল।জ্বরের দাপটে শরীর কাঁপছে,নাক দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে জিহ্বা কেমন জঘন্য তিতকুটে হয়ে আছে।রুমু অবিশ্রান্ত জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছে জ্বর কমার নাম নেই।ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা থাকলেও উজ্জ্বল ত্যাড়ামি করে যায়নি।ছেলের চিন্তায় নার্গিসের মুখটা শুকিয়ে গেছে কি খাবে না খাবে ভেবে অস্থির তিনি।


" জ্বর বাঁধিয়ে এবার শান্তি লেগেছে?বারবার বলেছি বৃষ্টিতে ভিজবেন না কেন ভিজলেন?"


" আমার মনে সুখ বেশি তাই বৃষ্টির সাথে ভাগাভাগি করতে গেছি।"


" খবরদার তর্ক করবেন না।"


" রেগে যাচ্ছিস কেন?"


রুমু প্রত্যুত্তর করে না হঠাৎ উজ্জ্বলের ফোন বেজে উঠলো রেস্টুরেন্টের দায়িত্বে থাকা ছেলেটা ফোন দিয়েছে ছেলেটার সাথে কথা শেষ করে ফোনটা ছুড়ে ফেলে বালিশের পাশে।


" একবার রেস্টুরেন্টে যাবি সব চেক করে আসবি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না।তোর মাথায় রাখতে হবে আমার অবর্তমানে সব তোর।"


" আপনার অবর্তমানে মানে?এই কথা হঠাৎ আসছে কেন?"


" কারণ তুই আমাকে চুমু দিচ্ছিস না তোর চুমুর অভাবে আমি জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছি দেখছিস না?"


" চুপ করুন।একটু ঘুমান।"


" চুপ করব না।তোকে দেখলে চুপ করে থাকা যায়?তোকে দেখলে আমার আবেগ অনুভূতি ছলকে উঠে মনে হয় প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাসর..."


উজ্জ্বল কথা শেষ করার আগে রুমু জলপট্টিটা উজ্জ্বলের মুখে চেপে ধরে।জ্বরের ঘোরে কিসব আবল তাবল বকছে এই লোকটা লাজ লজ্জা কি সব ড্রেনে ফেলে এসেছে?রুমু জলপট্টি সরিয়ে উজ্জ্বলের পানে চোখ রাঙায়।উজ্জ্বল ঠোঁট উলটে বলে,


"এভাবে থামাতে নেই প্রিয় চুমু দিয়ে চুপ করাতে হয়।"


"দিন দিন অসভ্যতা বেড়ে যাচ্ছে।"


" সভ্য আমি কোনো কালেই ছিলাম না।"


রুমু প্রত্যুত্তর করে না উজ্জ্বল সেই সুযোগে চুপচাপ তাকিয়ে রয় রুমুর পানে মেয়েটা দিন দিন আরো সুন্দর হয়ে উঠছে।আজকাল উজ্জ্বলের ভয় হচ্ছে এই সুন্দরীকে বাড়ির বাইরে একা যেতে দেওয়া ঠিক নয়।উজ্জ্বল ঘুমানোর চেষ্টা চালায় ঘুমের ঘোরে আচমকা চেচিয়ে বলে,


" রুমু দেখ দেখ মাছ আকাশে উড়ছে।রুমু এসব কি হচ্ছে!"


বিয়ের পর প্রথমবার উজ্জ্বলের যখন গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে সেবারেও উজ্জ্বল এমন পাগলামি করেছিল তখন রুমু বেশ ভয় পেয়েছে এর মাঝেও যতবার গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে ততবারি উজ্জ্বল এসব পাগলামি করেছে তাই রুমু এই বেলায় আর ভয় পেল না।চুপচাপ উজ্জ্বলের আবোলতাবোল বকবক ভিডিও করতে লাগল।


" উজ্জ্বল।"


" হু.."


" আকাশে কী মাছ উড়ছে?"


" চিল..."


" চিল কোনো মাছ হলো?"


" না না চিতল।"


কথার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ল উজ্জ্বল।রাত দশটা ছুঁই ছুঁই নার্গিস রুমুকে ডাকলেন রাতের খাওয়ার খেতে।খাওয়া দাওয়া শেষ করে টুকটাক কাজ সেরে রুমে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় বারোটা বেজে গেল।উজ্জ্বল তখন জেগেই ছিল ঝাপসা চোখে কয়েক পল তাকাল রুমুর পানে।বাইরে থেকে আসা বাতাসে গায়ে কাটা তুলছে উজ্জ্বলের ছেলেটা কাঁথা জড়িয়ে কেমন গুটিয়ে আছে।


" উজ্জ্বল আপনার কি বেশি খারাপ লাগছে?"


" না।"


" কিছু খাবেন?"


" হুহ।"


" কি খাবেন?বলুন বানিয়ে দিচ্ছি।"


" কাছে আয়।"


রুমু কাছে গেল ভেবেছিল উজ্জ্বল কিছু বলবে কিন্তু তার ভাবনা মিথ্যা হলো তপ্ত দেহে রুমুকে আগলে ধরল রুমু নিজেকে ছাড়াতে চাইল উজ্জ্বলের শরীরের তাপে তার কেমন উষ্কখুষ্ক লাগছে অথচ উজ্জ্বল তো তা চায় না উজ্জ্বল চায় রুমুর শরীরটা তার আয়ত্তে থাক।অন্তঃকরণে শান্তির স্রোত বয়ে যায়।উজ্জ্বল তার শুষ্ক ঠোঁট মিশিয়ে দিল রুমুর ঠোঁটে রুমু নিজেকে ছাড়াতে চাইল অদ্ভুত অনুভূতিতে নিংড়ে যাচ্ছে ।জ্বরের তোঁপে উজ্জ্বল বেসামাল রুমুর ওড়নাটা টেনে হাতের মুঠোয় পুরে সরিয়ে ফেলল।রুমু বুঝতে পারে উজ্জ্বল নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে কি থেকে কি করছে ছেলেটার মাথায় নেই।


" উজ্জ্বল প্লিজ আপনি অসুস্থ..."


"শিসস কথা বলে না।"


" কন্ট্রোল হারাবেন না।প্লিজ উজ্জ্ব..."


কথা শেষ করার আগেই রুমুর ঠোঁটে কামড় বসাল উজ্জ্বল।মুহূর্তে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল সে সময়ের তালে তালে দুজনেই কন্ট্রোল হারাল।উজ্জ্বলের দেহের উষ্ণতা মিশে গেল রুমুর দেহে।সারারাত উজ্জ্বলের কোন পরিবর্তন হলো না,

 না রুমুকে ঘুমাতে দিল না তার জ্বর কমলো।ভোরের আলো যখন ফুটতে শুরু করেছে তখনি রুমু ঘুমের কোলে ঢোলে পড়ল।উজ্জ্বলের চোখে তখনো ঘুম নেই রুমুর অনাবৃত দেহে কাঁথা টেনে আগলে ধরল বুকের মাঝে।তখনি চোখে পড়ল রুমুর পিঠে ঘাড়ে কামড়ের দাগ গুলো লাল হয়ে আছে।উজ্জ্বল কিঞ্চিৎ হেসে কামড়ের স্থানে চুমু খায়।রুমুকে জ্বালাতে ফিসফিসিয়ে বলে,


" বেয়াদব মেয়ে আমাকে রাতে একটুও ঘুমাতে দেয় না।"

.

দুপুর সময়টাতে উজ্জ্বলের জ্বর ছেড়ে এলো।দুজনে তখন কথায় ব্যস্ত তখনি উপস্থিত হয় আনিকা।


" আসতে পারি?"


" আরে ভা..আপা এসো।"


'ভাবি' শব্দটা বলতে গিয়েও থেমে গেল রুমু।রাবেয়ার মৃত্যুর দেড় বছর পেরিয়ে গেছে এই দেড় বছর সময়টা খুব অল্প হলেও পালটে গেছে অনেক কিছু।যেমনটা পালটে গেছে আনিকা জীবন তেমনি নিজেকে পালটে নিয়েছেন সৈয়দ ইসমাইল।আনিকার হাতের খাবারে বাটিটা রাখল টেবিলে এবং উজ্জ্বলের পানে তাকিয়ে বলে,


" জ্বর আছে নাকি গেছে?"


" মাঝ পথে।"


স্মিথ হেসে বলল উজ্জ্বল।আনিকার পানে একপলক তাকাল রুমু।মেয়েটাকে যত দেখে ততই অবাক হয় সে, এই মেয়েকে দেখে কেউ বলবে না সে বিবাহিত এই মেয়েটাই একটা সময় কোমড়ে আঁচল গুজে সংসার সামলেছে।তার চলায় ফেরা এসেছে বেশ পরিবর্তন আগের মতো সাধাসিধা চলা ফেরা এখন আর তার নেই এখন সে বেশ স্টাইলিশ একটা মেয়ে।

রাশেদের সাথে আনিকার ডিভোর্স সম্পূর্ণ হয়েছে অনেক আগেই। 

আনিকা নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেছে তার এই পরিবর্তন সবাই বেশ সাপোর্ট করেছে।একবার ভালোবেসে সব ছেড়ে ঠকে গেল মেয়েটা, ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটার বাকি জীবন নষ্ট হোক কেউ চায় না।আনিকা বাঁচুক নিজের মতো করে বেঁচে থাকুক।পেছনে ফেলে আসা দেড় বছরে আনিকা একবারো রাশেদের সাথে জেলে দেখা করেনি শুধু সে নয় সৈয়দ ইসমাইল নিজেও দেখা করেননি।উজ্জ্বল মাঝে মাঝে দেখা করে আসে কিন্তু রুমু?রুমুও গাঢ় অভিমান বুকে চেপে ভুলে গেছে তার কোন ভাই আছে।

রাশেদকে নিয়ে চলা মামলা এখনো চলমান তার জামিনে কেউ এগিয়ে এলো না পরিস্থিতি সময় সবকিছুই তা বিরুদ্ধে।


রুমু হাসি মুখে বলে,

" আজ ক্লাসে যাওনি আপা?"


" না।আজ শরীরটা ভালো লাগছে না।আব্বা বলল হালিম খাবে ভাবলাম যাইনি যখন বানিয়ে ফেলি।তোমাদের জন্যও এনেছি খেয়ে বলো কেমন হয়েছে।"


" তোমার হাতের হালিম বেস্ট এই কথা তো আমি জানি।"


" এই শুনো উজ্জ্বলের জ্বর কমলে বাড়ি যাবে আমার সাথে দুইদিন থাকবে একা একা বাড়িতে ভালো লাগে না।আব্বা কাজ শেষ করে এসেই ঘুমিয়ে যান মিথ্যা বলবো না আব্বা আমাকে যথেষ্ট সময় দেন।"


উজ্জ্বল তাকাল আনিকার পানে বেশ সাহস নিয়ে বলেই ফেলল,


" আপা একটা কথা বলি?কিছু মনে নিবেন না তো।"


" বলো কি বলবে?"


" এভাবে আর কতদিন?বিয়ে করে স্যাটেল হয়ে যান।আগে যা হয়েছে সেসব বাদ দিলাম এখন আমরা সবাই দেখে শুনে আপনাকে বিয়ে দিব ইনশাআল্লাহ আপনি যোগ্য কাউকে পাবেন।"


" আমাকে বিয়ে দেওয়ার আগে আব্বার বিয়ের কথা ভাবো।মানুষটা আর কত বছর একা থাকবে?পুরুষ মানুষ বাইরের দখল সামলে বাড়ি ফিরলে বউয়ের প্রয়োজন হয় একটা আপন মানুষের প্রয়োজন হয়।"


আনিকার কথায় সহমত করে রুমু বলে,


" আব্বাকে সাহস করে অনেকবার বলেছি কিন্তু আব্বা ধমক দিয়ে আমাকে থামিয়ে দিলেন।আপা তুমি বিয়ে করো দেখবে আব্বা একা না থেকে নিজেও বিয়েতে মত দিবেন।"


" শুনো আমার জীবনে এই ব্যাপারটা স্কিপ করতে চাই বিয়ে শাদী ভালোবাসা এসব এখন হাস্যকর বিষয়।আমি ভালোবেসে ঠকে গেছি, রুমু বুঝতে পারছো?তবে আমার আফসোস নেই আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে ভালোবেসেছি তার হজম হয়নি।"


" আপা আরেকটা বার নিজেকে সুযোগ দিন।"


" শুনো এক কথা বারবার বলবে না আমার অসহ্য লাগে বিরক্ত লাগে দম বন্ধ হয়ে আসে ভালোবাসা শব্দটা মনে বিতৃষ্ণা জাগিয়ে দিয়েছে।"


" আমাকে দেখো উজ্জ্বল আমাকে ভালোবেসে ঠিক কি কি করেছে।"


" সবার ভাগ্য তোমার মতো নয় রুমু।


আনিকা আর বসলো না চলে গেল।এই শহরে থাকতে তার ইদানীং বড্ড কষ্ট হচ্ছে শহর বললে অবশ্য ভুল হবে এই পাড়ায় বা এলাকায় যে দেখছে সেই তার করুন কাহিনীর কথা তুলে আফসোস করছে বিয়ের কথা বলছে।আচ্ছা মানুষ কি বুঝে না তার ক্ষত বিক্ষত মনের কথা এসব কথায় তার ক্ষত জায়গায় জ্বালাপোড়া বাড়ায়।

.

দুঃখ কষ্ট হাসি কান্না সব মিলিয়ে মানুষের জীবন এই সব মিলিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়।এর মাঝেই কেটে গেল কয়েকটা বছর আচ্ছা এই কয়েকটা বছরে উজ্জ্বল রুমু আনিকা কিংবা বাকিদের জীবনে কি কি পরিবর্তন এসেছে আপনাদের জানতে ইচ্ছে হয় না?

কেমন আছে তারা?কেমন চলছে তাদের জীবন?


হাতে ডাইপার নিয়ে বসে আছে উজ্জ্বল ডাইপার কিভাবে পড়াতে হয় তার জানা নেই।রুমু অনেকবার বলেছে শিখে নাও কাজে আসবে কিন্তু উজ্জ্বল সে তো এসব ব্যাপারে যথেষ্ট খুঁতখুঁতে।ডাইপার হাতে নিয়ে অনেকবার পড়াতে চেষ্টা করেও উজ্জ্বল বুঝতে পারলো না কোন পাশ সামনে অথবা পেছনে।হঠাৎ উজ্জ্বলের ছেলে রুজান কেঁদে উঠলো নার্গিস নাতির কান্না শুনে ছুটে এলেন।


" আমার নানুভাই কাঁদছে কেন?একি তুই এখনো ডাইপার নিয়ে বসে আছিস!"


উজ্জ্বলের পিঠে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিল নার্গিস।ইদানিং রুজানের জন্য উজ্জ্বলকে সবার তোপের মুখে পড়তে হয়।বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে উজ্জ্বলের তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই তাই হুটহাট কোন ভুল করে ফেললে সবাই তাকে নিয়ে পড়ে।নার্গিস রুজানের ডাইপার পড়িয়ে কোলে তুলে চলে গেলেন।রুমু মাত্রই গোসল সেরে রুমে ফিরল উজ্জ্বলকে গোমড়া মুখে বসে থাকতে দেখে বলে,


" কি হয়েছে?"


" আম্মা মেরেছে।"


রুমু খিলখিলিয়ে হেসে উঠল এসব নতুন নয় বর্তমানে ঘরের একমাত্র রাজত্বকারী রুজান তাকে কেউ অনাদর করলেই হলো বাকিটা ইতিহাস।


" ডাইপার পরিয়ে ছিলেন?"


" হু।"


" মিথ্যা কথা রুমু এই মিথ্যুকে কথা বিশ্বাস করিস না।ডাইপার আমি এসে পরিয়ে গেছি।"


নার্গিসের হঠাৎ আগমনে রুমু উজ্জ্বল দুজনেই ভড়কে গেল।নার্গিস রুজানকে রুমুর কোলে দিয়ে উজ্জ্বলের কান টেনে ধরলেন,


" খবরদার মিথ্যা কথা বললে তোর খবর আছে।"


" আরে মা লাগছে ছাড়ো তো।"


নার্গিস কান ছেড়ে চলে গেলেন যাওয়ার আগেও বকতে ভুললেন না।

রুজানের এক বছর বয়স ছোট ছোট দাঁত উঠেছে সেই দাঁত বের করে কেমন হাসছে তা দেখে উজ্জ্বল দ্রুত কোলে তুলে নেয়।ফোলা ফোলা গালটায় দেদারসে চুমু খায়।রুজান দেখতে তার দাদার মতো হয়েছে গোলগাল সুন্দর ছেলেটাকে দেখে যে কেউ আদর করতে বাধ্য।

রুজান যখন খিলখিলিয়ে হাসছিল তখনি উজ্জ্বল রুজানের গালে গাল মিশিয়ে দিতে উজ্জ্বলের খোঁচা খোঁচা দাড়ি রুজানের গালে খোঁচা দিতে ছেলে মুহূর্তে কেঁদে উঠে।রুমু মুহূর্তে রেগে বলে,


" আপনাকে আমি বারণ করেছিলাম আমার কথা শুনেন না কেন?ও ব্যথা পায়।"


" আরে পায় না আমি কি জোরেদি?"


" দিন রুজানকে দিন।"


" চুল শুকিয়ে আয় রুজানকে খাওয়াতে হবে।"


উজ্জ্বল রুজানকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটাল।রুজানকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিতে ছোট ছোট দাঁতের সাহায্যে কাঁমড়ে দিল মুহূর্তে চেচিয়ে উঠল উজ্জ্বল।রুমু দ্রুত রুজানকে সরিয়ে উজ্জ্বলের বুকে হাত রাখল।


" মা যেমন কামড়ায় ছেলেও কামড়ায়।"


" ছেলের বাবা কি কামড়ায় না?"


" দেখ দাগ বসে গেছে।"


" আসুন চুমু দিয়ে দি সেরে যাবে।"


রুমু হাসতে হাসতে কথাটি বললেও উজ্জ্বল কথাটা বিফলে যেতে দিল না তৎক্ষনাৎ জড়িয়ে ধরে রুমুর ঠোঁটে ঠোঁট মেশাল।রুমু নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায় কিন্তু উজ্জ্বল কিছুতেই ছাড়বে না।


" উজ্জ্বল কি হচ্ছে কি আপনি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলবেন।"


" হারাতে দে।আমি তোর কন্ট্রোললেস বর।"


" রুজানকে দিয়ে আসি তার দাদির কাছে?"


" এই তো আমার কন্ট্রোললেস বউ।"


" যাহ দুষ্টু।"


রুমু ঠোঁট বাঁকিয়ে চলে যায় রুজানকে রাখতে।


পরিশেষ... আনিকা নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলল পড়াশোনায়,সৈয়দ ইসমাইল বাকি জীবনটা আনিকার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে পড়ে রইলেন।তিনি বিয়ের চিন্তা আপাতত করছেন না এই সময়টাতে তার একমাত্র চিন্তা আনিকার সুখ আনিকার চাওয়া পাওয়া মেয়েটার একটা নির্ভেজাল জীবন হোক।

সৈয়দ শামসুল,নার্গিস,উজ্জ্বল, রুমু তারা এখন রুজানকে নিয়েই ব্যস্ত।উজ্জ্বলের রেস্টুরেন্টের ব্যবসা বেশ ভালোই হচ্ছে সবার সাথে দেনা পাওনার হিসাব অনেক আগেই চুকিয়ে ফেলেছে।উর্মি আর তামিমের সংসারে নতুন সদস্য এসেছে তাদের একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে।

একসময়ে দাপটে চলা রাশেদ এখন ঝিমিয়ে পড়েছে তার ফাঁসির আদেশ এখনো না এলেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে তা সে নিশ্চিত। এই পর্যন্ত কেউ তার জামিনের চেষ্টা করেনি সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আজকাল নিজেকে নর্দমার কীট মনে হয়।

সবশেষে ময়নার কথা না বললেই নয় একটা মেয়ের সংসার ভাঙার কারিগর সেই ময়নার বিয়ে হয়েছে কোন এক ধনির ঘরে যদিও তার স্বামী একটু বয়স্ক তাতে অবশ্য যায় আসে না ময়নার।কি ভেবেছেন ময়না নিশ্চয়ই দুঃখে আছে?মোটেও না ময়না বেশ সুখী সময়ের সাথে সাথে রাশেদের কথা ভুলতেও বসেছে।


আমরা সবাই ভালোবাসতে চাই ভালোবাসতে জানি কিন্তু উজ্জ্বলের মতো আগলে রাখার চেষ্টা কয়জনে করি?


____ সমাপ্ত___

গল্প আজকে শেষ কাল থেকে আপনাদেরো ছুটি আমারো ছুটি।নিয়ম করে আপনাদের আর অপেক্ষা করতে হবে না।আমি আবার ফিরব ইনশাআল্লাহ। এবার একটা সাইকো থ্রিলার গল্প নিয়ে ফিরবো।যারা কন্ট্রোললেস গল্পটা পড়েছেন অবশ্যই জানিয়ে যাবেন গল্পটা আপনাদের কেমন লেগেছে।যারা মন থেকে গল্পটাকে পছন্দ করেন ছোট্ট করে আমার গ্রুপে আপনাদের অনুভূতি জানিয়ে যাবেন।যারা গল্পটা ধৈর্য নিয়ে শুরু থেকে পড়েছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

অনেকেই আশায় আছেন আনিকার জন্য ভালো কেউ আসবে তাদেরকে বলছি আনিকা চরিত্রটা নিয়ে আমি আবার নতুন করে গল্প লিখবো।এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনাদের সাড়া থেকেই।গ্রুপে পোস্ট করেছি বেশিভাগ পাঠক চেয়েছেন আনিকাকে নিয়ে নতুন গল্প।

আরেকটা কথা,যারা "মাই ফ্লুজি" কিনতে চেয়েছেন বইটইয়ে ২০ তারিখে প্রকাশ হবে।২৫% ছাড়ে বইটা পেয়ে যাচ্ছেন মাত্র ৩৭ টাকায়।


গল্প কন্ট্রোললেস পর্ব ৩৫

 #কন্ট্রোললেস

#অনুপ্রভা_মেহেরিন

[পর্ব ৩৫]


নিজ শরীরের ভারটা নিজেই নিতে হিমশিমে পড়তে হচ্ছে।শরীরটা বড্ড ভারী লাগছে কেন?হঠাৎ সবকিছু ধোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে কেন?পাপ পুণ্যের হিসাব হঠাৎ মাথা চড়া দিয়েছে কেন?হঠাৎ বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগছে কেন?আকাঙ্ক্ষা জাগছে মায়ের ভালোবাসা পেতে,আনিকাকে জড়িয়ে ধরে শান্তির ঘুম দিতে।হঠাৎ এসব কি হচ্ছে!

রাশেদ মুখ থুবড়ে পড়লো যেন হাত পা গুটিয়ে বসে আছে মেঝেতে।দরজা বাইরে থেকে বন্ধ রক্তাক্ত দা টা মেঝেতে পড়ে।সাদা মেঝেতে রক্তের ফোটায় কি বীভৎস লাগছে।

রাশেদ নির্বাক নিরুত্তর ভেতরের সত্তাটা বারবার ধমক দিচ্ছে শাসিয়ে যাচ্ছে তার কৃতকর্মে।রাশেদ বাক্যহারা মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই গলাটা কেউ যেন অদৃশ্য হাতে চেপে ধরেছে।ভেতরের সত্তা কি তা মানে?সে তার উত্তরের আশায় বসে।রাশেদ আপন মনে ভেতরের সত্তার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত হয়।


" কেন করলি এমন?তোর মাকে কেন মারলি?তুই ইতোমধ্যে যা করেছিস তা কি খুব ভালো?"


" আমি আম্মাকে মারতে চাইনি।আম্মাকে মারার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা আমি আনিকাকে..."


" আনিকাকে মারতে গিয়েছিস?মেয়েটা তোকে ভালোবাসেনি?নিঃস্বার্থ ভালোবেসেছিল তোর জন্য কি না করেছে বলতো।"


" আমি আমি আসলেই ভুল করে ফেললাম।আমি নিজের অহংকারে এতটাই ডুবে ছিলাম ঠিক বেঠিক কিছুই বুঝতে পারিনি।"


" তোর সুখের দিন শেষ হলো বলে।আগে যতটা ঘৃণার পাত্র ছিলি এখন তার থেকে বহুগুনে তোকে সবাই ঘৃণা করবে।"


" আম্মা সুস্থ হোক আমি মাফ চাইব।আমি ভালো হয়ে যাব,হ্যাঁ আমি ভালো হয়ে যাব।"


" তোর আম্মা ফিরবে তো?"


" আম্মা ফিরবে না মানে?বাজে কথা বলছো কেন?"


" ফিরে আসার রাস্তা বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে।"


রাশেদের কলিজা কেঁপে উঠলো প্রতিবাদ জানিয়ে কিছু বলার আগেই ভেতরের সত্তা কোথায় উধাও হয়ে গেল তার হদিস নেই।


তখন ঘটনাটা এতটাই তাড়াতাড়ি ঘটেছিল কেউ বুঝে উঠতে পারিনি কি করবে।রাবেয়া মাথায় হাত রেখে ছিটকে পড়লেন মেঝেতে রক্তে ভেসে যায় তার সমস্ত দেহ।ইসমাইল স্ত্রীর এরূপ অবস্থায় কেঁদেই ফেললেন এতটা মর্মান্তিক ঘটনা তিনি এর আগে দেখেননি।আনিকা ছুটে গিয়ে ডাকল রুমুকে উজ্জ্বল তখন বাড়িতেই ছিল।আনিকার আহাজারি বিলাপে এলাকার সকল মানুষ এসে ভীড় জমায়।উজ্জ্বল দেরি করে না মাথা থেকে দা সরিয়ে রাবেয়াকে কোলে তুলে ছুটে চলে যায় রাস্তার দিকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে যেতে হবে।তার পেছন পেছন ছুটতে থাকে রুমু ইসমাইল সহ অন্যরা।আনিকা বেরিয়ে যাওয়ার আগে থেমে যায় পেছন ঘুরে একবার তাকায় রাশেদের পানে।রাশেদের ভীতু মুখখানিতে থুথু ছুড়ে দেয়, রাশেদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত বাইরে থেকে দরজা লাগায়।যাওয়ার আগে উঠনে দাঁড়িয়ে থাকা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে দরজা যেন কেউ না খুলে রাশেদকে পুলিশে দেওয়া হবে।


রাবেয়ার নিথর শরীরটা টেনে হসপিটালে এসে থামল উজ্জ্বল।রাস্তায় যানজটের কারনে পাঁচ মিনিটের রাস্তায় তার বিশ মিনিটের উপরে লেগেছে।রিক্সায় থাকা কালিন রাবেয়ার শরীর দুইবার ঝাঁকুনি দেয় তার পরেই কেমন নিস্তেজ হয়ে যান তিনি তখনি প্রচন্ড ভয় পেয়েছে উজ্জ্বল চাচি আম্মার কিছু হয়নি তো?


ইমার্জেন্সিতে রাবেয়াকে নেওয়া হলে তার পালস চেক করে ডাক্তার জানান রুগি তো বেঁচে নেই।বেঁচে নেই এই শব্দটা এতটা ভার যা একজন মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া ভীষণ কঠিন।


এম্বুলেন্সের সাইরেনে আশেপাশে সকলে এগিয়ে আসে সৈয়দ বাড়ির নিকট।সবাই এতক্ষণে নিশ্চিত নিশ্চয়ই মারা গেসে তাই তো এম্বুলেন্সে করে লাশ এনেছে।রাশেদ শুনতে পেল এম্বুলেন্সের শব্দ তবে বাইরে কি হচ্ছে কিছুই দেখতে পেল না জানলা থেকে উঠনের দিকটা একটুও দেখা যায় না।

রুমুর গায়ে রক্তে আর রক্ত 

সেই সাথে উজ্জ্বলের শাটটা রক্তে ভিজে জবুথবু যেন রক্তের সাগরে গা ভাসিয়েছে।

যে উজ্জ্বলকে নিয়ে রাবেয়ার এত অভিযোগ এত হিংসা সেই উজ্জ্বল আজ তাকে বাঁচাতে হসপিটালে ছুটেছে। 

এম্বুলেন্সের গাড়ির পেছনেই পুলিশ এসে উপস্থিত হয় নিরিবিলি সৈয়দ বাড়িটা আজ লোক সমাগমে জমজমাট।

হসপিটাল থেকে ফেরার পথে আনিকা এবং ইসমাইল রাশেদের জন্য মামলার উদ্দেশ্যে থানায় যান থানায় মামলা করার পর পুলিশের সাথে সাথে তারাও এসে বাড়িতে উপস্থিত হয়।


দরজা খোলার শব্দে চমকে তাকায় রাশেদ।পুলিশ এসেছে দরজা খুলেই প্রথমে তার দিকে দৃষ্টি ফেলল তারা ভেবেছিল রাশেদ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে কিন্তু তাদের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে অতি ঠান্ডা মাথায় রাশেদ এগিয়ে আসে এবং বলে,


" আমার আম্মা কি বেঁচে আছে?"


পুলিশ ভ্রু কুচকায় আসামি এত স্বাভাবিক কেন?পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করছে না অদ্ভুত!


" না আপনার আম্মা বেঁচে নেই।তাকে হাসপাতাল নেওয়ার পথেই মারা যান।"


"ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।"


রাশেদ ঢোক গিলে।নিজের কৃতকর্মে নিজেই আজ লজ্জিত।ইসমাইল এগিয়ে এসে কষে চড় লাগান ছেলের গালে তাতেও হেলদোল হলো না রাশেদের।

ইসমাইল কাঁদতে কাঁদতে বলেন,


" তোর এমন অবস্থা করব তোর ফাঁসির আদেশ হবে।ফাঁসি না হোক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে।আপনারা জানোয়ারটাকে নিয়ে যাচ্ছেন না কেন?"


পুলিশ রুমটা পর্যবেক্ষণ করছিল রাশেদ কিঞ্চিৎ হেসে হাত তুলে দাঁড়ায় এবং পুলিশের উদ্দেশ্যে বলে,


" আমি আমার আম্মাকে খু ন করেছি সেচ্ছায় নয় হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে আমি এমন কাজ করেছি।যা করেছি তাতে আমি অনুতপ্ত তবে লাভ নেই জানি।এর আগেও আমি বেশকিছু ক্রিমিনাল মাইন্ডের কাজ করেছি আমার বোনকে বন্দী করে অত্যাচার চালিয়েছি তার সংসার ভাঙতে চেয়েছি।নিজের স্ত্রীর উপর শারিরীক মানসিক নির্যাতন চালিয়েছি।স্ত্রীর ভালোবাসাকে মর্যাদা না দিয়ে পরকীয়ায় জড়িয়েছি।"


রাশেদ থামলো পুলিশ অতিদ্রুত তার হাতে হ্যান্ডকাফ পড়াল।তাকে যখন নিয়ে যাচ্ছিল তখনি এম্বুলেন্সের গাড়িটা ধরে বিলাপ দিয়ে কাঁদলো সে।রাশেদের স্বভাবের জন্য সবাই তাকে অপছন্দ করলেও রাবেয়া ভীষণ ভালোবাসতো তার একমাত্র ছেলেকে এক কথায় মাথায় তুলে রাখতো।প্রতিটা কাজে প্রতিটা ক্ষেত্রে রাশেদ রাশেদ বলে তার মুখে ফেনা ওঠার অবস্থা হতো।রাশেদের কখন কি চাই কি খাবে পরবে সব নিয়ে রাবেয়ার ছিল অত্যাধিক ব্যস্ততা।যার জন্য এত আয়োজন এত সময় ব্যয় সেই রাশেদের হাতে খু ন  হলেন রাবেয়া এ যেনো স্বপ্নেও ভাবতে পারে না কেউ।পুলিশের তো এত সময় নেই রাশেদকে যখনি টেনে নিয়ে যেতে চাইল তখনি সে উঠনের মাটি আঁকড়ে ধরল।তার কান্নায় ভারি হলো সৈয়দ বাড়ি।


" একবার উঠেন আম্মা শুধু একবার উঠেন।আমি ভালো হয়ে যাব সবার কথা শুনব।আনিকাকে নিয়ে সংসার করব বিশ্বাস করেন আনিকাকে ছাড়ব না।উঠেন না আম্মা ও আম্মা উঠেন।"


রাশেদের এত কান্না এত আহাজারি রুমুর কাছে নাটক মনে হলো সে ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল রাশেদের পানে।


" এত কাঁদছিস কেন?শান্তি লাগছে না তোর?শান্তি লাগার কথা।যা এবার বিয়ে কর এই সব সম্পত্ত নিয়ে যা আমার কিচ্ছু চাই না।"


" আমারো আর কিছু চাওয়ার নাই।"


রাশেদের আর সত্যিই কিছু চাওয়ার নেই।তাকে পুলিশ নিয়ে গেল সেই সাথে নেওয়া হলো রাবেয়ার লাশ।লাশকে পোস্টমর্টেম করা হবে সেই সাথে আইনি বেশকিছু নিয়ম রয়েছে।

.

সৈয়দ বাড়ির বড় ছেলে মাকে খু ন করছে ছেলে এখন জেলে এই একটা কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।কেউ কেউ তো বলেছে মাথা নাকি শরীর থেকে আলাদা করে দিয়েছে।এলাকা সহ চারিদিকে শুরু হয়েছে চাঞ্চল্য সবাই ভীড় জমাচ্ছে সৈয়দ বাড়িতে।এই সংবাদ ময়নার কাছেও এসেছে সংবাদটি পাওয়া মাত্র ময়নার দাদির শরীরে কাটা দেয়, কত বড় জা নো য়ার এই ছেলেটা মানুষ খু ন করার সাহস রাখে!এই ছেলের কি ভয় ডর নাই?ময়না বিষণ্ণ মুখে বসে আছে দুচোখ তার ঝাপসা শরীর থেকে এখনো যেন রাশেদের গন্ধ আসছে।এই তো রাতেই মানুষটার সাথে থেকেছে সে এখন এসব কি শুনছে!ময়নার বিষণ্ণ মুখখানি দেখে দাদি সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,


" ময়না তোরে আল্লাহ বাঁচাইছে।শুকরিয়া কর।"


" সৈয়দ বাড়ির বউ হওয়ার স্বপ্ন রয়েই গেল দাদি।আমি কি আর বড়লোক হব না?বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন কি স্বপ্নই রইল।"


" চুপ কর মাতারি সবার আগে জীবন যদি বাইচা না থাকস বড়লোক হয়ে কি করবি?কষাইডারে বিয়া করতে কানতেছোস?"


" বাদ দাও দাদি আমার কপালটাই খারাপ।"


" মোটেই না।তোর বিয়া হইব বড় ঘরেই তোর বিয়া হইব।"


ময়না প্রত্যুত্তর করে না।চুপচাপ তাকিয়ে রয় আকাশ পানে।


রাতে জেলখানার বাইরে দাড়িয়ে আছে ময়না একবার রাশেদের সাথে দেখা করার ইচ্ছা জেগেছে তার কিন্তু কি করে দেখা করবে?দেখা করার কি অনুমতি পাবে?যত দ্রুত সম্ভব তাকে কোটে তোলা হবে রাশেদের জামিন কখনোই হবে না তা সে জানে কেননা যে আপনজনরা রাশেদকে জেল থেকে মুক্তি করার কথা যারা লড়াই করার কথা তারাই আজ রাশেদের ফাঁসি চাইছে।হঠাৎ ময়নার চোখ পড়ল সিএনজি করে আনিকা এসেছে তার সাথে এসেছে অচেনা একজন ছেলে এবং মেয়ে।ময়নার নিকট ছেলে এবং মেয়েটাকে অচেনা মনে হতেই পারে কেননা সে আগে তো উর্মি আর তামিমকে দেখেনি কিন্তু আনিকাকে দেখেছে বহুবার রাশেদের ফোনে তাই তো চিনতে মোটেও সময় লাগল না।


আনিকাকে হঠাৎ দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ে সে ভেবেছিল তাকে হয়তো আনিকা চিনে ফেলবে তাই দ্রুত নিজেকে আড়াল করতে গিয়ে ছুটে পালিয়ে যায় তখনি ইটের সাহায্যে হোঁচট খেয়ে আনিকার সামনেই পড়ল ময়না।আনিকা সঙ্গে সঙ্গে তুলে দাড় করায় মেয়েটার বৃদ্ধা আঙুলের চামড়া ছিলে রক্ত ঝরছে আনিকার মায়া লাগলো দ্রুত হাতে থাকা টিস্যুটি চেপে ধরল ময়নার পায়ে।


" এত ছুটাছুটি করলে কেন?ইসস কত রক্ত ঝরছে।টিস্যুটা ধরে রাখো সামনে ফার্মেসি আছে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে নিও।"


ময়না কোন মতে ধন্যবাদ দিয়ে ছুটে পালাল।আনিকা কি তাকে চিনতে পারলো না!মেয়েটার চোখে মুখে এত মায়া অথচ রাশেদ এই মেয়েকে ঠকাল!ময়না ভীষণ অবাক হলো সেই সাথে অবজ্ঞায় হাসলো।


আনিকা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাশেদের সাথে আজকে এই মুহূর্তে শেষ দেখা করবে।দুজন দাঁড়িয়ে মুখোমুখি তবে সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে জেলের শিকগুলো।শুরুতে কথা তুললো রাশেদ।


" আমাকে মাফ করে দাও আনিকা।আমি যা করেছি তাতে অনুতপ্ত।আম্মা আমার হাতে.... আমি ভাবতে পারছি না।"


রাশেদ কেঁদে ফেলল পুনরায় গলা ঝেরে বলে,


" বিশ্বাস করো আরেকবার যদি সুযোগ পাই নিজেকে পালটে ফেলবো।সংসারে মন দেব আম্মার সকল স্বপ্ন পূরণ করব।আব্বার মনের মতো ছেলে হব।তোমার চোখে দেখা সেরা স্বামী হব।"


আনিকা তাচ্ছিল্য হাসল।তার হাসিতে রাশেদ ঢোক গিলল এমনটা নিশ্চয়ই হওয়ার কথা ছিল।আনিকা দাঁত মুখ শক্ত করে বলে,


" নারী লোভী পুরুষ কখনো এক নারীতে তৃপ্তি পায়না।"


চলবে...


গল্প যারা পড়েন একটু রেসপন্স করবেন।