গল্প কন্ট্রোললেস পর্ব ৮

 #কন্ট্রোললেস

#অনুপ্রভা_মেহেরিন

[পর্ব ৮]


উজ্জ্বলের পিঠে মুখ লুকিয়ে বসে আছে রুমু।মেয়েটার ভেজা চোখ উজ্জ্বলের শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে।এক অদ্ভুত অনুভূতির সাক্ষী হচ্ছে  উজ্জ্বল কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না সে।ইচ্ছে হচ্ছে এই আদুরে মেয়েটাকে বুকের কোনে লুকিয়ে রাখতে চোখ মুছে বলতে ইচ্ছে হয় কেঁদো না কান্না তোমায় মানায় না মেয়ে।অথচ অনুভূতি শূন্য ভাব ধরে বাইক চালাচ্ছে সে।বাস স্ট্যান্ড পেরিয়ে ছুটছে উজ্জ্বলের বাইক বাসের হর্নের শব্দে মাথা তুলে তাকায় রুমু,


" উজ্জ্বল ভাই বাস স্ট্যান্ড তো পেরিয়ে যাচ্ছি গাড়ি থামাচ্ছেন না কেন?"


" অনেক ভেবেছি তোর ভাই তোকে বাস থেকে ধরে ফেলতে পারবে।তোকে বরং ট্রেনে তুলে দিব ট্রেনে নিরাপদ।"


" গাড়ি থামান।থামান বলছি আমি বাসেই যাব।"


" জেদ করিস না রুমু।"


" কোথায় আপনার ট্রেন?যেতে কতক্ষণ লাগবে?"


" চুপচাপ বসে থাক কথা বলবি না।"


" কথা বলবো না কেন?আশ্চর্য কেন কথা বলবো না?"


" আরে তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?বাড়াবাড়ি করলে একদম রাশেদের কাছে দিয়ে আসবো।"


" বিপদে পড়েছি তো তাই এখন বিপদের সুযোগ নিবেন।"


" যদি সুযোগ নিতাম তাহলে তুই এতক্ষনে কোন গোপন কক্ষের চার দেয়ালে থাকতি বুঝলি?"


" ছিহ আপনার মুখে কি কিছুই আটকায় না?"


" না আটকায় না।তুই যে ভাবে বলছিস আমি সুযোগ নিচ্ছি যদি সুযোগ নেওয়ার হতো এর থেকে ভালো সুযোগ আমি নিতাম না।"


" আপনার কোন কথা শুনতে চাইনা তাড়াতাড়ি আমাকে বাসে ট্রেনে লঞ্চে যেখানে পারেন তুলে দিন।"


" চুপ চাপ বসে থাক বেশি বাড়াবাড়ি করলে জমের মুখে তুলে দিব।"


রুমু চুপসে গেল।কান্না পেল বহুগুন।পুনরায় উজ্জ্বলে পিঠে মুখ গুজে কাঁদতে থাকলো সে।সময় পেরিয়ে গেল আরো আধা ঘণ্টা অথচ কোথায় রেল স্টেশন কোথায় কী?রুমু আঁচ করলো স্থানটা তার আচেনা।এটা তো তার শহর নয় এটা আরেক শহর ব্যস্ত জনজীবন।হাইওয়ের রোডে স্প্রিডে ছুটছে উজ্জ্বল।উজ্জ্বলের পেট ছেড়ে বসলেই যেন উড়ে যাবে রুমু।ভোরের আলো পূর্ণ হয়েছে চারিদিকে পাখিদের কিচিরমিচির মুগ্ধ হয়ে শুনছে রুমু।আশেপাশে বিল বোর্ড খুঁজলো রুমু কিন্তু কোথাও জ্যাম লাগেনি যে পড়তে পারবে কোথায় আছে সে।


" উজ্জ্বল ভাই রেল স্টেশন কোথায়?"


" আর অল্প ডার্লিং।"


" আপনার মুখে এসব শুনতে আমার জঘন্য লাগে বেয়াদব লোক একটা।"


উজ্জ্বল হাসে।সেই হাসি অবশ্য রুমুর অগোচরে।

 

" এই জঘন্য লোককে বিয়ে করতে চাইছিলি?"


রুমু প্রত্যুত্তর করার আগে উজ্জ্বল বাইক থামায় একটি দশ তলা বিল্ডিং এর সামনে।রুমু মাথা তুলে তাকায় বেশ সুন্দর একটি ভবন।আলিশান গেটের আড়ালে একজন দারোয়ানের পা দেখা যাচ্ছে।


" উজ্জ্বল ভাই এখানে এলাম কেন?"


"  কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ আয়।"


" না যাব না আপনার সাথে।বেয়াদব বদ লোক।"


" বাড়াবাড়ি করিস না।"


" করবো বাড়াবাড়ি।যখনি বিয়ের কথা তুললাম তখনি তো আসল রুপটা দেখিয়ে দিলেন।

উজ্জ্বল ভাই আল্লার কাছে বিচার দিলাম  ভালোবাসার নামে যে আপনি আমার সাথে নাটক করলেন আপনার বংশের বাত্তি নিভে যাবে।মানে বুঝতে পারছেন?উজ্জ্বলের উজ্জ্বলতা কমে যাবে।"


" এই আমার বংশের বাত্তি নিভে যাবে মানে?তুই এই উজ্জ্বলকে চিনিস না।একবার বিয়েটা হোক ঘরে বউ আসুক বছরে একটা করে ছক্কা পড়বে দেখেনিবি।"


"আমার দেখার দরকার নাই।উজ্জ্বল ভাই আপনি যদি সত্যি ভালোবাসার নামে নাটক করে থাকেন তাহলে অভিশাপ দিলাম, বিয়ের পর আপনার বউকে খুশি করতে কলিকাতা হারবাল খেতে হবে।"


কলিকাতা হারবাল!এত বড় অভিশাপ!উজ্জ্বল তজ্জব বনে তাকিয়ে রইল রুমুর পানে।ভেতরে ভেতরে রাগে ফুলে ফেঁপে উঠলো সে।


" তুই কাকে কি অভিশাপ দিলি নিজেও জানিস না।"


উজ্জ্বল খপ করে রুমুর হাত টা ধরলো দ্রুত তাকে টেনে নামালো বাইক থেকে।


" চল তোকে প্রেক্টিক্যালি বুঝাতে চাই কলিকাতা হারবালের প্রয়োজন আছে কি নেই।"


রুমু ভড়কে গেলো।উজ্জ্বলকে রাগিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি।গেটের দারোয়ান উজ্জ্বলকে দেখে ঠিকি চিনতে পারলো এই ছেলে মাঝে মাঝেই আসে কিন্তু উজ্জ্বলের পাশে মেয়েটা কে?দারোয়ানের সন্দিহান দৃষ্টিতে উজ্জ্বল বাঁকা হেসে বলে,


" ইয়াং ছেলে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন অন্যের বউয়ের দিকে?বিয়ে করেছো?"


" জি স্যার।"


" তোমারো কি কলিকাতা হারবালের প্রয়োজন হয়েছে?"


" ম..মানে?"


" বোঝাতে চাইছি কলিতাকা হারবাল চেনো?তোমার কি প্রয়োজন হয়েছে?"


" এসব প্রশ্ন কেন করছেন?"


" মানে ওষুধটা কতটা কার্যকর জানতে চাইছি।যদি কার্যকর না হয় অন্য প্রডাক্টের খোঁজ নিতে হবে।"


উজ্জ্বল রুমুকে টেনে নিয়ে গেল।লিফটে উঠে রুমুর হাত ছাড়লো সে।দুজনেই তখন হাঁপাচ্ছে।


" এখানে কেন এনেছি জানিস?এটা উর্মি আপুর বাসা ভেবেছিলাম আপুর সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব বিয়েটা কি এখন করবো নাকি পরে।নাকি তুই এখানে কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকবি।তুই যেহেতু আমার ভালোবাসার প্রশ্ন তুললি আবার আমাকে সাংঘাতিক অভিশাপ দিলি তখন আজকেই তোকে বিয়ে করবো প্রেক্টিক্যালি বুঝাবো হারবালের প্রয়োজন আছে কি নেই।"


" উজ্জ্বল ভাই আমি মজা করেছি।"


" তুই আমার মেন পয়েন্টে আঘাত দিয়েছিস।এবার আর রিডিং ফিডিং পড়ে কাজ নেই যা হবে প্রেক্টিক্যালি হবে।"


রুমু ভয় পেল কোনঠাসা হয়ে মেয়েটা হুহু করে কেঁদে উঠলো।উজ্জ্বল তার কান্নায় পাত্তা দিল না চোখ রাঙিয়ে বলে,


" এই কাঁদবি না।এমন একটা ভাব করছিস যেন তোকে তুলে নিয়ে এসেছি।অথচ তুই নিজে আমাকে তুলে এনেছিস।"


রুমু হতভম্ব হয়ে গেল।কান্না থামিয়ে বলে,


" আমি তুলে আনলাম!কখন?"


" তুই বলায় আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছি।সেখান থেকে তোকে নিয়ে এখানে চলে এসেছি মানে তুই আমাকে তুলে এনেছিস।"


" আপনার কথায় কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না উজ্জ্বল ভাই।"


" আমার লজিকে যুক্তি আছে তুই এসব বুঝবি না চুপ থাক।"


তর্কাতর্কির মাঝে লিফট থামলো আট তলায়।দুজনে গিয়ে দাঁড়ালো একটি দরজার সামনে বেশ কয়েকবার বেল বাজাতে দরজা খুললো একটি ছেলে।ছেলেটা চোখ কচলে তাকালো উজ্জ্বলের পানে,


" উজ্জ্বল সাত সকালে তুমি?"


" তাড়াতাড়ি এসেছি বলে কি আপনার আফসোস হচ্ছে দুলাভাই?সকালের নাস্তা খাওয়াতে হবে বলে কি টাস্কি খেয়ে গেছেন?"


" আশ্চর্য তুমি আমাকে সবসময় এমন ভাবে ট্রিট করো যেন আমি এ জগৎ এর মহান কঞ্জুস।"


" তা নয় তো কি দুলাভাই?বিয়ের ঘটনা আমি ভুলি নাই তাই খোটা দেওয়া ছাড়ি নাই।যাই হোক আসসালামু আলাইকুম।"


" এতক্ষণে সালাম!আচ্ছা আমিও না হয় জবাবটা আরো কিছুক্ষণ বাদে দেব।তা পাশের মেয়েটা কে?"


" আমার বউ। চাচাতো বউ।"


" চাচাতো বউ মানে?"


" চাচাতো বোন ছিল এখন চাচাতো বউ হয়ে গেছে।"


তামিম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে উজ্জ্বলের কথা তার মাথায় ঢুকছে না।অপরদিকে উজ্জ্বল তামিমকে পাশ কাটিয়ে ঘরে প্রবেশ করে।উজ্জ্বলের ভাই বোন বলতে শুধু একমাত্র বোন বড় বোন আছে তার নাম উর্মি।

অপ্রত্যাশিত ভাইয়ের কণ্ঠ শুনতে পেয়ে ছুটে আসে উর্মি।তার অবাকটা আরো বহুগুনে বেড়ে গেল যখন পাশে দেখতে পেলো রুমুকে।রুমুর হালচাল দেখে আতঙ্কিত হয়ে উর্মি বলে,


" রুমু তোকে কে মারলো?তোর সারা শরীরে মারের দাগ!"


উজ্জ্বলের চাপা রাগটা বাড়লো দাঁতে দাঁত 

পিষে বলে,


" ওর জানোয়ার ভাই আছে জানো না?আর ওর মায়ের কথা আশা করি বলতে হবে না।"


" কিন্তু মারলো কেন?"


" সব কথা বলবো আগে এক গ্লাস পানি দাও রুমুকে ফ্রেশ হতে দাও।"


" ভাই তুই কি ওঁকে হলুদের আসর থেকে তুলে এনেছিস?"


" অদ্ভুত এমন কেন মনে হলো তোমার?"


" না মানে এই সাজ পোশাকে।"


" তুলে আনার হলে আগেই আনতাম।যাই হোক কথা না বাড়িয়ে যা বললাম তা করো।"


উর্মির এক সেট জামা দিয়ে রুমুকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো গোসল করতে।অপরদিকে উজ্জ্বল রুমুর ব্যপারে সবটা খুলে বললো।বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতে বাদ সাধলো উর্মি সে চায় না একমাত্র ভাইয়ের বিয়েটা বাবা মা ছাড়া হোক।প্রায় আধা ঘন্টা যাবৎ ভাই বোনের বাকবিতন্ডায় চললো।উজ্জ্বল আপোষ মানতে নারাজ আজকেই বিয়ে হবে যে করে হোক তবে মা বাবাকে এই মুহূর্তে জানানো যাবে না।বিয়েরপর জানানো হবে।উজ্জ্বলের জোরাজোরির কাছে হেরে উর্মি রাজি হলো বিয়েটা হোক।রুমুকে নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই কিন্তু তার পরিবার!একবার জানতে পারলে তান্ডব শুরু করবে।

সকাল বাজে প্রায় সাড়ে সাতটা উজ্জ্বল তার দুই বন্ধুকে আসতে বললো।কাউকে কিছু না জানিয়ে তারাও রওনা হলো।তামিম আজ অফিসে যায়নি মূলত উজ্জ্বল তাকে যেতে দেয়নি।তার দায়িত্ব যে করে হোক কাজী খুঁজে বের করতে হবে সে যে করেই হোক বের করতেই হবে।হঠাৎ বিয়ের তোড়জোড় দেখে ভয় লাগলো রুমুর।ঘোরে পড়ে সে বিয়েতে রাজি হয়েছে কিন্তু  এরপর!এরপর কী হবে?বাংলা সিনেমার মতো উজ্জ্বল ভাই বিয়ের পর যদি মুখোশ পালটে ফেলে!তিনি যদি বলেন বিয়েটা প্রতিশোধ সরূপ করেছেন তখন কী হবে!এসব ভাবতে ভাবতে নাকে এলো ঘি দিয়ে পরোটা ভাজার সুঘ্রাণ।রুমু ভেজা চুল থেকে গামছা সরিয়ে উর্মিকে বলে,


" তোমার ভাই ইদানীং বাড়াবাড়ি করছিল তাই..."


" আমার ভাই ইদানীং না আগে থেকেই বাড়াবাড়ি করছিল তোর হয়তো চোখে পড়েনি।আজ তোর হাতে দিব তুলে আমার ভাইকে দেখবো কতটা সামলে রাখতে পারিস।"


" উজ্জ্বল ভাইকে সামলানো যায়!"


" এই ভাই ডাকা একদম বন্ধ।তবে জানিস আমার ভয় হচ্ছে বিয়ের কথা শুনে চাচা চাচি কি যে করবে।"


কলিং বেলের শব্দে ছুটে গিয়ে দরজা খুললো উর্মি।উজ্জ্বল এসেছে হাতে কিছু প্যাকেট বোঝাই যাচ্ছে টুকটাক শপিং করেছে।মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উজ্জ্বলের বন্ধু সিয়াম এবং দিপু।উর্মি সবাইকে বসতে দিয়ে রান্না ঘরে যায়।

উজ্জ্বল রুমুকে রান্না ঘরে দেখতে পেয়ে আদেশ সুরে বলে, 


" এই হারবাল আমার পেছন পেছন আয় কথা আছে।"


হারবাল!এই নামে কেউ কাউকে ডাকে?


গেস্ট রুমে প্রবেশ করতে দ্রুত দরজা বন্ধ করলো উজ্জ্বল।রুমু প্রতিবাদ জানিয়ে বলে,


" হারবাল কোন নাম হলো?"


" বকবক করে না ডার্লিং।শুনো আমার সামর্থ অনুযায়ী তোমার বিয়ের শাড়ি কিনলাম আর আমার জন্য পাঞ্জাবি।শাড়িটা খুব বেশি দামি না মাত্র ২৭০০ টাকা নিলো।"


এত সুন্দর করে উজ্জ্বল বুঝিয়ে বললো রুমু মুগ্ধ হয়ে শুনছিল।খুব সুন্দর একটি লাল শাড়ি আর উজ্জ্বলের সাদা পাঞ্জাবি।শিরায় উপশিরায় অনুভূতিরা কানায় কানায় পূর্ণ হলো।উজ্জ্বল শাড়িটা জড়িয়ে দিল রুমুর মাথায়।


" এই তো লাগছে আমার বউ।"


উজ্জ্বল যখন বিয়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত তখন তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে রাশেদ।সে জানে উজ্জ্বল ছাড়া রুমুকে নিয়ে যাওয়ার মতো সাহস আর কারো নেই।রাশেদের সন্দেহের তীর যখন সঠিক স্থানে পড়েছে তখন এই বিয়ে আদৌ হয় কি না কে জানে।

চলবে....


[গল্প দিতে পারিনি বলে দুঃখিত এক্সাম চলছে ব্যস্ত সময় পার করছি।

গল্প কন্ট্রোললেস পর্ব ৭

 #কন্ট্রোললেস

#অনুপ্রভা_মেহেরিন

[পর্ব ৭]


সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়।সময়ের কথা সময়ে বলতে হয়।সময়টা পেরিয়ে গেলে অসময়ে সবটাই ফিকে এই যে রুমুর সাথেও একই কান্ড ঘটেছে।হিমেলের কথা অতীতে কাউকে না জানালেও মেয়েটা আজ জানাতে বাধ্য হয়েছে।রুমুর রাশেদ মন দিয়ে সবটা শুনলো কিন্তু হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেললো সে।রাশেদ ভেবেই নিল বিয়ে ভাঙার উদ্দেশ্যে রুমু এসব বলছে।কেউ শুনলো না তার কথা কেউ গুরুত্ব দিল না।হিমেল সবার চোখের মনি।

হলুদের আয়োজন শেষে সবাই যে যার কাজ শেষে ঘুমিয়ে পড়লো।গায়ের হলুদ শাড়ি জড়িয়ে হাত পা গুটিয়ে মেঝেতে বসে আছে রুমু।সারা শরীরে যন্ত্রণা করছে অবশ্য এই যন্ত্রণার কাছে মনের যন্ত্রণা কিছুই না।মনে মনে উজ্জ্বলকে কতবার যে চেয়েছে তার হিসাব নেই।এই ঘোর বিপদে একমাত্র উজ্জ্বল তাকে স্বশরীরে সাহায্য করতে পারে।যদি নিজের ফোনটা আজ থাকতো সবার আগে সে উজ্জ্বল ভাইকে ফোন করতো কিন্তু ফোনটা নিয়ে গেল রাশেদ।তার ফোন এখন রাশেদের জিম্মায়।


খালা হালিমা আজ তার কক্ষে ঘুমিয়েছে মেয়েটাকে কত বোঝালেন তিনি কিন্তু রুমু তার জেদেই অনড়।এই বেয়াদবকে বিয়ে করার চাইলে উজ্জ্বল ভাইয়কে গলায় ঝুলানো ঢের ভালো।

ছোট থেকে দেখে আসছে উজ্জ্বল ভাই রুমু রুমু করে কতটা পাগল।উজ্জ্বলের ভালোবাসা বুঝতে পেরেও রুমু কখনো সাড়া দেয়নি।কেন দেয়নি?মেয়েদের এই এক বদ অভ্যস যে ভালোবাসে তাকে পাত্তা না দিয়ে ঘুরাতে বেশ আনন্দ পায়।


দেয়াল ঘড়িতে জানান দিচ্ছে এই রাত শেষ হতে চলেছে।ভোর চারাটার কাটা ছুঁয়েছে।হঠাৎ দরজা খুলতে রুমু ভয় পেয় গেল।অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে দু'চোখ ঝাপসা হলো তার।মাথায় যখন খোলা আকাশ তখনি ভরসার একটি হাত তার মাথা ছুঁয়ে দিল সাহায্য করলো দেমাগে ভরা সৈয়দ বাড়ি ছেড়ে পালাতে।রুমু পালাতে পেরে যতটা না খুশি হয়েছে নিজের ফোন ফিরে পেয়ে ততটাই খুশি হয়েছে এখন অন্তত উজ্জ্বল ভাইকে সবটা জানানো যাবে।এই ছাড়া আর কাকে জানাবে?পরিবারের বাইরে কেউ নেই তাকে সাহায্য করার।


উদ্দেশ্যহীন  অনেকটা রাস্তা গিয়ে থামলো রুমু।নিরিবিলি পথে হাটতে তার বুক কাঁপছে।ভয়ে বিবশ হচ্ছে সারা শরীর।একটি দোকানের বেঞ্চিতে বসে ফোন করলো উজ্জ্বল ভাইকে।উজ্জ্বল তখনো ঘুমায়নি রুমুর চিন্তায় তার ঘুম আসছে না।কই এমন তো আগে হয়নি হঠাৎ মেয়েটা নিরুদ্দেশ কেন?

উজ্জ্বলের ফোন বাজতে সাথে সাথে ফোন তুললো সে।রুমু ফোন করেছে!তাও অসময়ে!ভারি আশ্চর্যের বিষয়!


" রুমু ঠিক আছিস?"


গলা ধরে এলো মেয়েটার কিন্তু কাঁদলো না।নিজেকে শক্ত রেখে বলে,


" উজ্জ্বল ভাই আপনি আসতে পারবেন?"


" কোথায়?"


" সুরাইয়াদের বাড়ির পাশে যে দোকানটা আছে আমি সেখানে বসে।"


" কি!তুই এত রাতে সেখানে কি করছিস।মাথা ঠিক আছে? "


" তাই তো বললাম আসুন।প্লিজ কাউকে জানাবেন না।"


" কি হয়েছে বলবি আমায়?"


" বলবো বলেই তো ডাকছি।আপনার বাইকটা নিয়ে আসেন সাথে টাকাপয়সা যা আছে নিয়ে আসেন আমি কিন্তু খালি হাতে।"


" রুমু তুই সাবধানে থাক আমি আসছি।"


" উজ্জ্বল ভাই আপনি যে বের হবেন টু শব্দ যেন না হয়।কেউ যেন আওয়াজ না পায়।বাইক স্টাট দিয়ে বের হবেন না।আমার এই রিকুয়েষ্ট গুলো রাখুন।আপনি তাড়াতাড়ি আসুন হাতে সময় কম।"


উজ্জ্বল তাড়াহুড়োর মাঝে বেশ কৌশলে বাড়ি থেকে বের হলো।চারিদিকে ফজরের আযানের ধ্বনিতে মুখোরিত।কিছুটা দূরে গিয়ে বাইক স্টাট করলো সে।প্রায় তিন মিনিটে পৌঁছে গেল কাঙ্খিত স্থানে।উজ্জ্বল ভাইকে দেখা মাত্র রুমু বাইকে চড়ে বসলো।কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলে,


" উজ্জ্বল ভাই এমন কোথাও নিয়ে যান যেখানে আমার ভাই আমাকে খুঁজে পাবে না।"


" কি হয়েছে বলবি তো।"


" বলবো সব বলবো চলুন আগে।"


উজ্জ্বল রুমুকে নিয়ে গেল বেশ দূরে একটি পার্কে।এটি লোকাল পার্ক আশেপাশে অনেকে ভিক্ষুক কাথা জড়িয়ে শুয়ে আছে।ঘন আঁধার কেটে আঁধারের বুক চিড়ে আলোর দেখা মিলছে।উজ্জ্বল পরিপূর্ণ দৃষ্টি রাখলো রুমুর পানে।মেয়েটা হলুদ শাড়ি পড়েছে আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে তার গালে থাকা আঁচড়।


" রুমু শাড়ি পড়লি কেন?তোর গালে এসব কিসের দাগ?"


রুমু কেঁদে ফেললো।কান্নার মাঝেই শুরু থেকে শেষ সবটা বললো উজ্জ্বল ভাইকে।কান্নার গতিক বাড়তে বাড়তে কখন যে উজ্জ্বলের বুকে মাথা রেখেছে তার হুশ নেই।উজ্জ্বল স্তব্ধ,বাকরুদ্ধ তবে ভেতরে জমে থাকা নিয়ন্ত্রণহীন রাগ ক্ষোভ ধীরে ধীরে বাড়লো।মস্তিষ্ক টগবগ করছে রক্ত চলাচল অতি সত্বর বাড়ছে।উজ্জ্বল রুমুর গালে হাত রাখলো ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,


" আর কোথায় মেরেছে?"


" স..সারা শরীরে।"


ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করলো উজ্জ্বল।দাঁতে দাঁত পিষে জড়িয়ে ধরলো রুমুকে এতটাই জোরে ধরলো আঘাত প্রাপ্ত পিঠে চাপ পড়তে মেয়েটা কুঁকিয়ে উঠলো।


" আমি জানতাম তোর মা তোর ভাই জানোয়ার,জঘন্য,লোভী।নিজের বোনের ভালো বোঝেনা কেমন ভাই?"


" বিশ্বাস করুন, হিমেল ভাই সবার সামনে ভদ্রতার মুখোশ ধরে থাকে।আপনি কখনো ভেবেছিলেন উনি এমন?"


উজ্জ্বলের শ্বাস প্রশ্বাস ক্রমাগত বাড়লো।সত্যি তো ভদ্র শিক্ষিত ছেলে সে কখনো ভাবেনি হিমেল এতটা নোংরা মস্তিষ্কের লোক।


" ছোট বেলায় এতবার হেনস্তা হলি একবার আমাকে জানালি না।তোর উজ্জ্বল ভাই কখনো তোর খারাপ চেয়েছে?হ্যাঁ আমি পাগলামি করি সেটা তোর জন্য তোর ছোট বড় সব বিপদে পাশে ছিলাম এইটুকু আমাকে জানালি না!"


" আমি ভ...ভয়ে ছিলাম।এই ছোঁয়া গুলো কতটা যন্ত্রণা দেয় আপনি ভাবতেও পারবেন না।"


" আমি এখন এসব ভাবতে চাই না।সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়।বাসা থেকে পালিয়েছিস তার জন্য ধন্যবাদ।এখন কি করবি?"


রুমু ছটফট করলো।সত্যিতো সে কি করবে?যেখানে যাক রাশেদ তাকে ধরে ফেলবে জেদের হেতু নিয়ে হলেও হিমেলের সাথে বিয়ে দেবে।কার কাছে যাবে?কোথায় যাবে?এমন কোন অদৃশ্য বন্ধন দরকার যার মাধ্যমে রুমুকে পরিবারের কেউ আর জোর খাটিয়ে কিছু বলার অধিকার থাকবে না।শ্বাস প্রশ্বাসের আন্দোলন বাড়লো মেয়েটার।আড় চোখে তাকালো উজ্জ্বলের পানে, উজ্জ্বল ছটফট করছে বোঝাই যাচ্ছে রাগটাকে সংবরন করছে ছেলেটা।দুদিকের নিরবতা কাটিয়ে নিঃসংকোচে আবদার করে বসলো রুমু। 


" আমাকে বিয়ে করবেন উজ্জ্বল ভাই?"


প্রশ্নটা অদ্ভুত শোনালো উজ্জ্বলের কাছে।এমন কোন প্রশ্ন যে সে শুনতে পাবে আদৌ প্রস্তুত ছিল না।রুমুকে বিয়ে করতে শতভাত রাজি হলেও কিছু প্রশ্ন তো থেকেই যায় মনে।রুমু ঘোরের মাঝে বিয়ে করতে চায় পরবর্তীতে যদি মেয়েটা মত পালটায়?তাছাড়া রুমু কি তাকে ভালোবাসে?উজ্জ্বল চেয়েছে সুস্থ স্বাভাবিক বিয়ে কিন্তু জল ঘোলা করে বিয়েটা হলে দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব কমবে না বরং বাড়বে।


" তুই আমাকে ভালোবাসিস না তাহলে বিয়ে করতে চাইছিস কেন?বেঁচে যেতে?"


" আপনি আমাকে খুব বাঁচিয়ে রাখবেন বুঝি?"


উজ্জ্বল ভাইকে পছন্দ করে রুমু কিন্তু এই কথা মুখ ফুটে বলার ইচ্ছে নেই তার।এই বিপদেও চিকন বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে চলছে সে।একবার যদি উজ্জ্বল ভাই জানে সে তাকে পছন্দ করে তবে মাথায় নুন মরিচের কৌটা রেখে বরই খাবে।


বিয়ে কি বললেই হয়ে গেল?নিজের ভরণপোষণের ভার যে ছেলে সামলাতে পারে না সেই ছেলে আবার আরেকটা মেয়ের দায়িত্ব নেবে!

এই সমাজে বেকার ছেলেদের বিয়ে করা অপরাধ।শুধু অপরাধ নয় ঘোর অপরাধ কেউ কখনো সরল চোখে ব্যপারটা দেখতে নারাজ।


উজ্জ্বল কিয়ৎক্ষণ পায়চার করলো।উজ্জ্বলের দ্বিধাদ্বন্দ্ব  মুখখানি দেখে রুমু বলে,


"উজ্জ্বল ভাই আপনি কি বিয়েতে রাজি না?"


" এমন মনে হলো কেন?"


" বিয়ে করবেন কি না বলে দিন।আর না হয় আমাকে তাড়াতাড়ি বাসে তুলে দিন আমি রাজশাহী মামার কাছে যাব।"


" পারবি যেতে?"


" হুম।"


" ওকে উঠে বস তোকে বাসে তুলে দিচ্ছি।সাথে কিছু টাকাও দিয়ে দিব চিন্তা করিস না।"


হতভম্ব হয়ে গেল রুমু।সে তো এসেছিল উজ্জ্বলের ভরসায় অথচ উজ্জ্বল তীরে এসে তরী ডুবিয়ে দিল!উজ্জ্বলের এসব নাটক ছিল!সে ভালোবাসেনি রুমুকে!

রুমুর দু'চোখ ঝাপসা হলো মনে মনে উজ্জ্বলকে দিল অভিশাপ।


" উজ্জ্বল ভাই আপনি যদি সত্যি ভালোবাসার নামে নাটক করে থাকেন তাহলে অভিশাপ দিলাম, বিয়ের পর আপনার বউকে খুশি করতে কলিকাতা হারবাল খেতে হবে।"

চলবে../?

গল্প কন্ট্রোললেস পর্ব ৬

#কন্ট্রোললেস

#অনুপ্রভা_মেহেরিন

[পর্ব ৬]


গরমে দিশাহীন জনজীবন।উত্তপ্ত রোদে রুদ্বশ্বাস অবস্থা।রাতের দুইটা বাজতে চললো।উজ্জ্বলের চোখে ঘুম নেই।এই গরমে বউয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।এই যে একটা বউ থাকলে হাত পাখার বাতাস করতো,বউকে দেখলেই উত্তপ্ত চামড়া শীতল হতো এসব কি বাবা মা বুঝেনা?আশ্চর্য তারা চায় কি?রুমে ফ্যানের বাতাসে যেন আগুনের গোলা ছুটছে।গরম বাতাসে অতিষ্ঠ হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো ছেলেটা।ছাদে বসে শীতল হাওয়া উপভোগ করতে মন্দ লাগছে না।ছাদের জলচৌকিতে বসে গলা ছেড়ে অনেকক্ষণ যাবৎ গান গাইলো।ছোট বেলায় উজ্জ্বলের গানের হাতেখড়ি হয় এলাকার এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে।নিঃসন্দেহে ছেলেটার গলার স্বর ভীষণ সুন্দর।এই গুনের ভাটা পড়ে সৈয়দ শামসুল হকের কাছে।তিনি চান না ছেলে গানে মনোনিবেশ করুক।বাবার অনাগ্রহে গান ছাড়লো উজ্জ্বল পরে অবশ্য এলাকার সেই বড় ভাই অন্য জেলায় চলে যান।আর বিশেষ ভাবে গান গাওয়া হয়নি উজ্জ্বলের।মাঝে মাঝে নিজের প্রশান্তির জন্য গায় তবে খুব কম।আজকের চাঁদটা তার পূর্ণ সৌন্দর্য ঢেলে আকাশের বুকে উঠে বসেছে।তার সৌন্দর্যে ঝলসে যাচ্ছে উজ্জ্বল।চাঁদের আলোয় আলোকিত ছাদটা।কি এক অপরূপ দৃশ্য!উজ্জ্বল আচমকা উঠে বসে।দ্রুত ফোন নিয়ে ভিডিও কল করলো রুমুকে।রাত জেগে সিরিজ দেখছিলো রুমু তাই উজ্জ্বল ভাইয়ের ফোন ধর‍তে তার সময় লাগলো না।তবে উজ্জ্বল ভাইকে বোকা বানাতে ঘুমের ভান ধরে বলে,


" উজ্জ্বল ভাই কোন সমস্যা?"


" বিরাট সমস্যা।বিশাল সমস্যা।"


"কি হয়েছে?"


" এত জ্বালিয়ে আবার বলছিস কি হয়েছে?"


" আমি আবার কি করলাম?"


" তুই ঘুমাচ্ছিস না কেন?"


" মাত্র চোখ লেগে এলো আপনিই তো ফোন করে তুলে দিলেন।"


" ফাইজলামি করছিস?বেয়াদব বেডি।"


" খবরদার বেডি বলবেন না।আমার একটা নাম আছে রুমু।"


" ওকে চুমু।"


" আশ্চর্য আমার নাম রুমু।"


" তুই দে একটা চুমু।"


" উফফ।এবার বলুন তো উজ্জ্বল ভাই রাত জেগে কি করছেন?আজ কার বাড়িতে চুরি করতে গেলেন?"


" তুই রাত জেগে আছিস কেন?সবচেয়ে বড় কথা তুই বাইরে কি করছিস?"


" বাইরে!"


" হ্যাঁ বাইরে।তোর সাহস দেখে অবাক হচ্ছি রুমু।"


" আমি আমার রুমে আছি।কি বলেন আমি বাইরে গেলাম কখন!"


" এখনো তুই বাইরে।এক্ষুনি যা আমাকে জ্বালানো বন্ধ কর।"


" উজ্জ্বল ভাই আমি আমার রুমে।"


" চালাকি করিস?তুই যে বাইরে আমার কাছে প্রমান আছে।"


"সত্যি করে বলুন, শুকনাটা খেয়েছেন নাকি ভেজাটা?"


উজ্জ্বলের ভ্রু কুচকে গেল।সন্দিহান স্বরে বলে,


" ভেজা শুকনো মানে?"


" বুঝতে পারছেন না?"


" একদমি না।"


" উজ্জ্বল ভাই গাজা আপনাকে খেয়েছে নাকি আপনি গাজাকে খেয়েছেন?"


"তুই কথা ঘুরাচ্ছিস কেন?ফাজিল মেয়ে তুই বাইরে কি করিস?"

 

রুমু বিরক্তে মুখ কুচকে ফেললো।উজ্জ্বল ভাই এবার বাড়াবাড়ি করছেন।আজকাল কি তিনি নেশাপানি খান?রুমু নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে বলে,


" উজ্জ্বল ভাই আমি নিজের রুমে আছি। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না আমি অন্ধকারে।রুমের লাইট অফ।"


" কিন্তু এই যে তুই অন্ধকার আকাশে এক টুকরো আলো হয়ে জ্বলছিস।"


উজ্জ্বল ফোনের ক্যামেরাটা ঘুরিয়ে চাঁদের দিকে ধরলো।রুমুর কুচকে থাকা ঠোঁটটা এক চিলতে হাসিতে প্রসারিত হলো।সেই সাথে হাসলো উজ্জ্বল নিজেও।


" আমার চাঁদ তুই।চাঁদকে দেখে বারবার তোর কথা মাথায় আসছে।"


উজ্জ্বল ভাইয়ের গলার স্বরটা দমে গেল।মিহিয়ে গেল মুহূর্তে।আবহাওয়াটা কেমন যেন প্রেম প্রেম ঠেকলো রুমুর কাছে।ফোনটা ওড়নায় চেপে দ্রুত জানলা খুললো সে।অন্ধকার আকাশে মস্ত বড় চাঁদটা দেখে নিঃশব্দে হাসলো।


" রুমু উঠ জানলা খুলে চাঁদটা দেখ।"


" পাগলের প্রলাপ বকবেন না উজ্জ্বল ভাই এই রাতে জানলা খুলে চাঁদ দেখবো!আমি পাগল নাকি।আপনার মতো চোরেরা যদি আমার জানলার শিক কেটে চলে আসে।"


" তুই আমার কথা রাখবি না?"


" একদম না।"


উজ্জ্বল চুপসে গেল।বেচারা উজ্জ্বল ভাই জানলোই না রুমু জানলা খুলে চাঁদটাকে দেখছে।দুজন দু'দিকে অথচ একটা চাঁদকে অবলোকন করছে মুগ্ধতা নিয়ে।নিরবতা ছিন্ন করে উজ্জ্বল ভাই বলেন,


" রুমু গান ছেড়ে দিয়েছি কাউকে তো শুনাই না।তুই আমার গান শুনবি?তোকে গান শোনাতে ইচ্ছে করছে।"


উজ্জ্বল ভাইয়ের নিঃসংকোচ আবদার।রুমু এই আবদার ফেলবে কি করে?তাছাড়া উজ্জ্বল ভাইয়ের গান শোনা হয়নি  অনেকটা মাস কেটেছে।


" উজ্জ্বল ভাই শুরু করুন আমার ঘুম পাচ্ছে।"


" আচ্ছা গানটা শুনে ঘুমিয়ে যা।বিয়ের পর তোর ঘুম হারাম করতে আমি আছি।"


" কেন কি করবেন রাত জেগে?আমাকে সঙ্গে নিয়ে চুরি করতে যাবেন?"


" হুহ যাব অন্য কোথাও।এখন এসব বলতে ইচ্ছে করছে না।রাতে এসব বলা ঠিক নয়।আমি আবার তার ছেঁড়া কন্ট্রোললেস।কন্ট্রোল হারিয়ে বলা তো যায় না তোকে এক্ষুনি বিয়ে করে ফেলবো।"


রুমু ঠোঁট চেপে হাসে।উজ্জ্বল কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে গান ধরে,


"অবাক চাঁদের আলোয় দেখো

ভেসে যায় আমাদের পৃথিবী

আড়াল হতে দেখেছি তোমার

নিষ্পাপ মুখখানি।

ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়..."


" উজ্জ্বল ভাই আপনি তো সাতার পারেন না প্লিজ ডুবে যাবেন না ডুবে গেলে আপনার মতো হাতি আকৃতির দেহটাকে তুলবে কে?প্লিজ ঘুমিয়ে যান আমাকে ঘুমাতে দিন।"


আবেগে জল ঢেলে রুমু ফোনটা কেটে দিল।বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো উজ্জ্বলের।এভাবে তার ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করছে!মেজাজটা প্রচন্ড গরম হলো উজ্জ্বলের।এই মেয়ের কি ভালো কথা সহ্য হয় না?এভাবে চললে প্রেম হবে কি করে?প্রেম না হলে বিয়ে হবে না।বিয়ে না হলে রোমান্স হবে না।রোমান্স না হলে বাচ্চা হবে না।বাচ্চা না হলে উজ্জ্বল বাপ হবে না।বাপ না হলে... বাপ না হলে..আর কিছু মাথায় এলো না উজ্জ্বলের।প্রচন্ড জেদ নিয়ে পাইচারি শুরু করলো সে।বেচারা বিড়বিড় করে বলে,


" একে তো গরম,তার উপর আমার মাথা গরম।"

.

আজ কলেজে গেল না রুমু।ভাবীর সাথে টুকটাক কাজ সামলে নিজের কক্ষে ফিরলো সে।এখনো সকালের নাস্তা খাওয়া বাকি।কাজের লোক রহিমা আজ আসতে পারিনি।তার নাকি ভীষণ জ্বর সব মিলিয়ে সংসারের বাড়তি কাজ পড়েছে পরিবারের সবার ভাগে।প্রচন্ড গরমে রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে থেকে ঘেমে একাকার রুমু দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে ফোনটা হাতে নিল সে।আচমকা পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরতে কেঁপে উঠে মেয়েটা।শরীর ঘুরানোর আগে দুহাত পেচিয়ে ধরে তার পেট।অচেনা পুরুষালি হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠে রুমুর সর্বাঙ্গ।কিছু বুঝে উঠার আগে তার ঘাড়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিটি থুতনি রাখে।


" কেমন আছো কিউটি?"


হিমল ভাই!সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো মেয়েটার।দ্রুত নিজেকে ছাড়াতে নিলে হিমেলের ছোঁয়া ক্রমশ গভীর হয়।


" ছোটাছুটি করছো কেন?কতদিন পর তোমার দেখা পেলাম।অনেক চেঞ্জ হয়েছে ,যতটা ভেবেছিলাম তার থেকেও বেশি আকর্ষনীয় হয়ে গেছো।"


দেহের সর্ব শক্তি দিয়ে হিমেলকে ধাক্কা দিল রুমু।মেয়েটার শরীর থরথর করে কাঁপছে।ধরধর ঘাম ঝরছে জুলফি বেয়ে।তীব্র ঝাঝালো গলায় রুমু বলে,


" আপনি অনুমতি ছাড়া আমার রুমে কি করছেন?"


" আর কিছুটা সময় এরপর এটা আমারো রুম হবে।"


" মানে?"


" তুমি জান না?"


" কি জানবো?"


রুমুর অবাক হয়।সে কি জানবে?হিমেল কি বলছে?


" আপনি কথা বলছেন না কেন?কি জানবো আমি?"


" তোমার আমার বিয়ে ঠিক তুমি জান না?"কালকেই তো বিয়ে।"


বিয়ে!কই সে তো জানে না।কবে ঠিক হলো বিয়ে?এত তাড়াতাড়ি বাবা মা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো!অথচ তাকে কিছুই জানালো না।তার বিয়ে তাকেই জানালো না!প্রচন্ড রাগ হলো রুমুর।হিমেলের দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,


" আপনার মতো ছেলেকে বিয়ে করার চাইতে অবিবাহিত থাকা অনেক ভালো।"


" তাই নাকি?তা আছে নাকি কেউ?"


" কে থাকবে?"


" প্রেমিক।"


" সরুন সামনে থেকে।আপনার মুখ দেখতেও আমার বিরক্ত লাগে।"


" শুনো এই যুগে বিয়ের আগে ওসব একটু আধটু হয় ব্যপার না।রুম ডেট পর্যন্ত না গড়ালেই চলবে।"


বিতৃষ্ণায় ভরে গেল রুমুর মন।দ্রুত কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে দেখা পেল রাবেয়ার।মেয়েটা রাগ সামলাতে না পেরে চেচিয়ে বলে,


" আম্মা কোন সাহসে তুমি আমাকে না জানিয়ে আমার বিয়ে ঠিক করেছো?"


" সাহস!তোর বিয়ে ঠিক করতেও আমার সাহস লাগবে?"


" আমার জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত নেবে অথচ আমাকে জানাবে না?"


রুমুর চিৎকারে রাশেদ এগিয়ে গেল।কড়া গলায় শাসন সুরে সে বলে,


" রুমু আম্মার সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন?"


" তোমরা আমার বিয়ে ঠিক করলে অথচ আমার মতামত নিলে না?"


" আম্মা সেদিন বলেই দিয়েছিল তোর বিয়ে হিমেলের সাথেই হবে।"


" আমি এই বিয়ে করবো না যা ইচ্ছা তাই করো।"


" এমন মার মারবো গলা তুলে কথা বলার সাহস পাবি না।হিমেলের মতো একটা ছেলেকে রিজেক্ট করার সাহস তোর হয় কি করে?তোর কোন যোগ্যতা আছে?বেয়াদবি করার জন্য আগের বিয়ের সম্বন্ধ ভেস্তে গেল এখন...."


হিমেল রাশেদকে থামিয়ে বলে,


" ভাইয়া রুমু বাচ্চা মেয়ে।না বুঝে সিনক্রিয়েট করছে।বিয়েটা হয়ে গেলে সব মেনে নিবে।আপনারা ওকে বকাবকি করবেন না।"


রুমু বুঝতে পারলো এই বাড়িতে কেউ তার কথা শুনবে না।সাহস করে চলে গেল তার বাবা কাছে।সৈয়দ ইসমাইল তখন কপালে হাত ঠেকিয়ে শুয়ে আছেন।রুমের বাইরে যে মেয়ের চিৎকার চেচামেচি করছিল সবটাই শুনেছেন তিনি।রুমু চটজলদি বাবার মুখোমুখি দাঁড়ালো।বাবাকে ভীষণ ভয় পায় সে বাবার সাথে সম্পর্কটা খুব বেশি সহজ নয়।মেয়েটা সাহস নিয়ে বলে,


" আমি এই বিয়ে করবো না আব্বা।"


"জানি।"


" তুমি কিছু বলছো না কেন?"


" বলার মতো মুখ নেই।তোর মা সেদিন গলায় দড়ি দিয়েছিল জানিস?তুই তো কলেজে ছিলি।তোর বিয়েতে রাজি হইনি বলেই এমনটা করেছে।তোর ভাই রাজি মা  রাজি আমি আর কি বলবো?কিচ্ছু বলার নেই আমার কথায় কারো গুরুত্ব নেই।"


সৈয়দ ইসমাইল কিয়ৎক্ষণ থামলেন।বড় শ্বাস ছেড়ে বলেন,


" হিমেল শিক্ষিত ভদ্র ছেলে।ভালো জব করছে তুই তাকে কেন বিয়ে করবি না?"


গলা ধরে এলো রুমুর।সে বাবাকে কি করে বলবে হিমেল ভালো ছেলে নয়।সৈয়দ ইসমাইল মেয়ের নিরবতা দেখে বলেন,


" তুই কি কাউকে পছন্দ করিস?"


" না আব্বা বিষয়টা তা নয়।ছোট বেলা থেকে দেখছি হিমেল ভাইয়ের স্প...."


" বাপের কাছে কেন গেলি?আমার নামে বিচার নিয়ে?তোর বাপের সাধ্য নেই এই বিয়ে ভাঙার।"


রুমু কথা শেষ করার আগে রাবেয়ার ঝাঁঝালো ধমকে কেঁপে উঠলো সে।এখনি সুযোগ ছিল বাবাকে সত্যটা জানানোর কিন্তু রাবেয়ার ধমকে চুপসে গেল মেয়েটা।

রুমু মিনমিনিয়ে বলে,


 " আম্মা তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো আমি এই বিয়ে করবো না।"


" তুইও বাড়াবাড়ি করছিস।এই বিয়ে তোকে করতেই হবে।আমার বোনের ছেলের মতো ছেলে হয় না লাখে একটা।তুই সেই ছেলেকে বিয়ে করবি না?নিশ্চয়ই বাইরে তোর চক্কর চলছে।"


রুমু রাগ দেখালো কাউকে কিছু না বলে চলে গেল নিজের কক্ষে।ওয়ারড্রপ থেকে সব জামা কাপড় নিয়ে একটা ব্যাগে ঢুকাতে শুরু করে।ভাবি আনিকা চুপচাপ সব দেখছিল রুমু এমন কেন করছে?হিমেল ভীষণ ভালো ছেলে অথচ এই মেয়েটা কি না বোকার মতো কাজ করছে।মেয়েকে ব্যাগ গুছাতে দেখে পুনরায় ঝগড়া বিবাদে লেগে যায় রাবেয়া।রুমুর এতটা জেদ দেখে মারতে শুরু করেন তিনি।চোখের পলকে সবটা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়।

.


গায়ে হলুদ শাড়ি জড়িয়ে বসে আছে রুমু।মেয়েটার সারা শরীরে মারের দাগ।গালটা কেমন ফুলে আছে।সৈয়দ ইসমাইল ঘরোয়া এই বিয়ের আয়োজনে ঘুরেও তাকালেন না।তিনি নিজেকে রুমে বন্দি করলেন।আশেপাশের কেউ জানলো না আজ রুমুর হলুদ সন্ধ্যা।মূলত রাশেদ চায় না কেউ জানুক।আগের বার যে উজ্জ্বল বিয়েটা পণ্ড করেছে সে বেশ ভালো করেই জানে এবারো নিশ্চয়ই বিয়েটা ভাঙতে উঠে পড়ে লাগবে।

আগামীকাল রুমুর কাবিন।রুমুর খালা হালিমার পরিবারের কেউ আজ বাড়ি ফিরলো না সবাই রুমুদের বাড়িতেই রইলো।ঘরোয়া আয়োজনে রুমুর গায়ে হলুদের ব্যবস্থা হলো।


রক্তের জমাট বাঁধা মুখে হলুদের ছোঁয়া বেমানান।কাঁদতে কাঁদতে রুমুর চোখ মুখ ফুলে বীভৎস অবস্থা।

ভবিত্যবে যা আছে তাই হবে না চাইতেও মানতে প্রস্তুত হলো রুমু।

.

সারাটা দিন রুমুর ফোন অফ ছিল।অপরদিকে রহিমা আজ কাজে না যাওয়ায় রুমুর খোঁজ দিতে পারলো না উজ্জ্বল।রুমুর বাড়িতে এই মুহূর্ত যাওয়াও সম্ভব নয়।উজ্জ্বলের সারাটা দিন কাটলো হতাশায়।গভীর রাতেও ছেলেটার চোখে ঘুম ধরা দিল না।বিছানার এপাশ ওপাশ ছটফট করতে করতে অশান্ত হয় মন।অপন মনে সে বলে,


" বুকটা খাখা করছে কেন?"


চলবে..

গল্প কন্ট্রোললেস পর্ব ৫

 #কন্ট্রোললেস

#অনুপ্রভা_মেহেরিন

[পর্ব ৫]


এলাকায় উজ্জ্বলের অন্ধভক্তের অভাব নেই।ছোট ছোট ছেলেরা উজ্জ্বলের ভীষণ ভক্ত।মুরব্বিরা তাকে পছন্দ করলেও মারপিটের স্বভাবটা ঠিক কারো পছন্দ নয় অথচ উজ্জ্বলের এক সিটির ইশারায় একটা দল এসে উপস্থিত হবে।সবাই মার খেতে নয় বরং মারতে ভালোবাসে।মারামারি যেখানে উজ্জ্বলের দল সেখানে।এসব নিয়ে যে থানা পুলিশের গণ্ডি টপকাতে হয়নি তা কিন্তু নয়।সৈয়দ শামসুল এলাকার সম্মানীয় ব্যক্তি কিন্তু তার ছেলের অসংলগ্ন কার্যক্রম তার সম্মানে বহুবার আঘাত হেনেছে।থানা পুলিশের ব্যপারটা তিনি টাকার উপর মিটিয়ে দেন।যদিও উজ্জ্বল বিনা কারণে মারামারিতে জড়ায় না।একটা হেতু দাঁড় করিয়ে যখনি তার মেজাজ বিগড়ে যাবে তখনি শুরু হট্টগোল গন্ডোগোল।


যেমন আজ একটা ছেলে তার ফোন চুরি করে পালাচ্ছিলো।ভাগ্যক্রমে উজ্জ্বল তাকে ধরেও ফেলে দেখতে বেশ ভদ্র কিন্তু ছেলেটা মস্তবড় চোর।এলাকায় ইদানীং চুরি বাড়ছে তার পেছনে যে এই ছেলেটার হাত তা ইতোমধ্যে স্বীকার করে নিয়েছে উজ্জ্বল।ছেলেটাকে শাস্তি সরূপ দেওয়া হলো দুইশত বার কানে ধরা।এলাকার ছেলেরা মহা আনন্দ নিয়ে চোরের কানে ধরার উঠবস গুনছে অপরদিকে উজ্জ্বল দোকানের চেয়ারে বসে গরম গরম দুধ চায়ে চুমুক দিচ্ছে।সিয়াম এবং দিপু তার পাশেই বসে।হঠাৎ দোকানের সামনে বাইক থেকে নামলো রাশেদ এবং রুমু দুজনে দোকানের ভেতরেই গেল।


আজ আর ভার্সিটি যাবে না ভেবেই রেখেছিল উজ্জ্বল কিন্তু রুমু যাচ্ছে সে যাবে না তা কি হয়?তাছাড়া কলেজে উঠার পর এক বছর যাবৎ অনেক বাদরামো সহ্য করেছে মেয়েটার।এখন আর নয় এখন সময় এসেছে উজ্জ্বলের নিজের জিনিস নিজে বুঝে নেওয়ার।রাশেদ দোকান থেকে বেশ কয়েকটি জিনিস কিনলো রুমু আড় চোখে তাকিয়ে দেখলো উজ্জ্বলকে।উজ্জ্বল সেই চাহনির পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখালো ইশারায় চুমু দিয়ে।নিজের ভদ্রতার খোলসটা রেখে গলা ছেড়ে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে,


" বুঝলি এলাকায় চোর বেড়েছে।মালামাল চুরি হচ্ছে আমার মন চুরি হচ্ছে কখন আবার আমার বউটা চুরি হয়ে যায়।বউ চুরি হলে এই এলাকায় তান্ডব চলবে আগেই বলে দিলাম।"


তরুন ছেলে দোকানি উজ্জ্বলের কথা শুনে মুচকি হাসে।রাশেদ সেই হাসিটায় অবজ্ঞা নিয়ে বলে,


" তোমার দোকানে বখাটেরা আড্ডা দিচ্ছে কিচ্ছু বলো না কেন?এলাকায় বখাটেদের উৎপাত ক্রমাগত বাড়ছে।এদের মোটেও আশকারা দিবে না।"


উজ্জ্বল বুঝতে পারলো রাশেদ তাকে ফোঁড়ন কেটে কথাটা বলেছে।উজ্জ্বল পুনরায় চায়ে চুমুক বসিয়ে বন্ধুকে বলে,


" বুঝলি সিয়াম এলাকায় কিছু ভদ্র বেশী পরনিন্দা কমিটি খুলে বসেছে।তারা যেখানে সেখানে গিয়ে অন্যের নামে নিন্দা ছড়াচ্ছে।এসব কমিটির লোককে ধরে ধরে চিলি সসের থেরাপি দিতে হবে।এই পরনিন্দার কমিটির হেড হয়তো জানেই না এটা আমার দোকান।"


রাশেদ কিংকর্তব্যবিমূঢ়।ছোট চাচার এই দোকান সে তো জানতোই না।উজ্জ্বল শার্টের কলার তুলে বসে কালো চশমাটা চোখে দিল।প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেল রাশেদ।এখানে তার গলাবাজি করা বেমানান।

.

রুমু ক্লাস রুমে প্রবেশ করতে দেখা হলো সুরাইয়ার সাথে।সুরাইয়া রুমুকে দেখেও না দেখার ভান ধরলো।রুমু কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,


" ভাব ধরছিস কেন রে?"


" তুই নিজেই তো ভাবের গোডাউন।"


" উজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে?আমায় নিয়ে কিছু বলেছে?"


" তোর উজ্জ্বল ভাইকে দেখলেও আমি দশ হাত দূরে থাকি।"


রুমু প্রত্যুত্তর করার আগে ক্লাসে আসে রুমুর বন্ধু, ছেলেটা রুমুকে দেখেই  বলে,


" খালা ভালো আছেন?"


" খালা!"


" উজ্জ্বল ভাইয়ের কড়া আদেশ তোকে খালা ডাকতে হবে।"


" কোথায় তোদের উজ্জ্বল ভাই?খালা ডাক আমি বের করছি।"


রুমু রেগে মেগে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।মাঠের শেষ প্রান্তে দেখা গেল উজ্জ্বলকে।ছেলেটা বাইকে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।রুমু গিয়েই উজ্জ্বলের পিঠে থাবা দিল।সহসা ব্যথায় চমকে গেল উজ্জ্বল।রুমুকে দেখে নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলে,


" আস্তে বউ লাগছে তো।"


" কে বউ?এই খালা কে হুম?আমার বন্ধুরা আমাকে খালা ডাকছে কেন?"


" একবার বিয়েটা করি তারপর ভাবী ডাকবে।"


" উজ্জ্বল ভাই এসব কিন্তু ভালো হচ্ছে না।আমিও সবাইকে বলে দিব আপনি একটা চোর, আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন চুরি করতে।"


"যা গিয়ে বল।আমি কি চুরি করেছি বলতো? আমি শুধু তোর মন চুরি করেছি।"


" আপনাকে লাগেও চোরের মতো।"


উজ্জ্বল ভাইকে গাজাব বেজ্জতি করে চলে গেল রুমু।বেচারা হতভম্ব নয়নে তাকিয়ে রইলো।পাশে থেকে বন্ধুরা সবাই হট্ট হাসিতে ফেটে পড়লো।

.

কেটে গেল প্রায় এক সাপ্তাহ।এই কয়েকটা দিন বিয়ে নিয়ে রুমুর পরিবারের কোন আলাপচারিতা ছিল না।তাই তো মেয়েটা ভেবেই নিলো বিয়ের ভূত হয়তো সবার মাথা থেকে নেমে গেছে কিন্তু তাকে ভুল প্রমান করে দিয়ে অবশেষে পাত্র পক্ষ তাকে দেখতে এসেছে।পাত্র পক্ষের সামনে বসা রুমুর জীবনে এই প্রথমবার।দেখতে আসবে শোনার পর থেকে মেয়েটার কান্না কিছুতেই থামছে না।রুমুর ভাবি আনিকা শাড়ি পড়াতে গিয়ে পড়লো চরম বিপাকে।রুমু কিছুতেই শাড়ি পড়বে না।অবশেষে মায়ের ধমকে শাড়ি পড়তে বাধ্য হলো।একটি নীল জামদানি শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বসে আছে রুমু।মেয়েটার কান্নারত ফোলা মুখখানি দেখে আনিকা মিষ্টি হাসে।


" এই জানিস, কাঁদলে মেয়েদের সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়ে।তোকে কি যে সুন্দর লাগছে।"


" ভাইয়ার বাড়াবাড়িতে এসব হলো।ভাবি তুমি অন্তত আমার পক্ষ নিতে।"


" আজ পর্যন্ত আমাকে দেখেছো এই বাড়িতে গলা তুলে কথা বলতে?বড়রা যা বলেছেন তাতেই সামিল হয়েছি।"


কথার মাঝে রাশেদ কক্ষে এলো।আনিকাকে তাড়া দিল পাত্র পক্ষের সামনে রুমুকে নিয়ে যেতে।মেয়েটা ছোট ছোট পা ফেলে ভীত চাহনিতে এগিয়ে গেল বসার ঘরে।

পাত্র মূলত রাশেদের বন্ধুর কাজিন।ছেলের বাবা ভীষণ ধার্মিক।রুমুকে তাদের আগে থেকে পছন্দ করাই ছিল শুধু ছেলে দেশে আসলে বাকি কথা হবে।রুমুকে দেখে উপস্থিত সবার হাসি চওড়া হলো।ছেলেরা এক দেখায় পছন্দ করলো রুমুকে।পাত্রপক্ষের টুকটাক প্রশ্নের মাঝে উপস্থিত হয় উজ্জ্বল।ছেলেটা শার্টের হাতা গুটিয়ে বসলো সোফায়।ভীষণ ব্যস্ততা দেখিয়ে হাসি চওড়া করে বলে,


" সরি দেরি হয়ে গেল।আমি আগেই আসতাম কিন্তু একটু ব্যস্ত সময় পার করছি।"


উজ্জ্বলকে দেখে রুমুর বাড়ির সবাই হতবাক হতভম্ব।পাত্রপক্ষ প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তার পানে।উজ্জ্বল হেসে বলে,


" আমি রুমুর একমাত্র চাচার একমাত্র ছেলে।আমি উজ্জ্বল আর পাত্র কে?"


প্রশ্নটা করেই উজ্জ্বল তাকালো পাত্রের বড় মামার পানে।উজ্জ্বল মুখটা কুচকে বলে,


" আপনি পাত্র!বয়স কত?বুড়ো বয়সে ভীমরতি? আপনার মতো বুড়োরা কচি কচি মেয়েগুলো বিয়ে করে নেয় বলে আমার মতো অবলা ইয়াং ছেলেগুলো পাত্রী পেতে হিমশিমে পড়তে হয়।"


পাত্রের মামা ভীষণ লজ্জায় পড়লো এই আধাপাগল ছেলে কাকে কি বলছে!পাত্র গুরুগম্ভীর গলায় শুধায়,


" এই যে কোথাও ভুল হচ্ছে আমি পাত্র।"


উজ্জ্বল ভীষণ লজ্জা পাওয়ার ভান করে বলে,


" সরি সরি।আসলে উনি ঝাকানাকা পাঞ্জাবি পড়ে এসেছেন তো আমি আবার ভেবে বসলাম উনি পাত্র।"


রুমু না চাইতেও ঠোঁট টিপে হাসলো।উজ্জ্বল যে এই বিয়ে পণ্ড করতে এসেছে সে বেশ ভালো ভাবেই যানে।রুমু উজ্জ্বলের পানে সরু চোখে তাকালো।রুমুর সাথে মিল রেখে এই ছেলে আজ নীল শার্ট পড়েছে।যে কেউ দেখলে ভাববে এরা নিশ্চয়ই কাপল।উজ্জ্বলের উপস্থিতি মোটেও পছন্দ করলো না রাশেদ কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু বলাও যাবে না।সে চায় না এত ভালো জায়গায় বোনের বিয়েটা ভেঙে যাক তাই তো চুপচাপ সবটা হজম করছে সে।বুদ্ধি খাটিয়ে রাশেদ তাড়া দিল পাত্রপক্ষকে।


"আপনারা নাস্তা সেরে নিন।রুমু বরং ভেতরে যাক।"


রুমু চলে গেল তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষলো উজ্জ্বল।রাশেদ একে একে নাস্তার সব ট্রে আনতে ব্যস্ত।এর মাঝে উজ্জ্বল উঠে গিয়ে দাঁড়ালো বড় চাচা সৈয়দ ইসমাইলের পাশে।ছেলেটা চাপা স্বরে বলে,


" চাচাজান কথা দিয়ে কথার খেলাপ করার মানুষ আপনি নন।আমার সাথে কিন্তু প্রতারণা হচ্ছে।ছোট বেলা থেকে বলে আসলেন আমি আপনার জামাই অথচ ঠিকি সুযোগ বুঝে অন্য পাত্রের কাছে মেয়েকে দিচ্ছেন।"


" আমার মেয়েকে বিয়ে করার মতো কি যোগ্যতা আছে তোমার?"


" আপনার মেয়েকে বিয়ে করার মতো যোগ্যতা বলতে টিকটকে নাচতে হবে এই তো?সরি আমার সেই যোগ্যতা নেই।"


অপমানে থমথমে হয়ে গেল ইসমাইলের মুখ।সত্যি তো তার মেয়ের কি এমন অর্জন আছে?যার জন্য যোগ্যতা খুঁজছেন তিনি।উজ্জ্বল সবাইকে নাস্তা সার্ভ করছে এর মাঝে সে নিজেও খাচ্ছে।পাত্রের বাবা মেয়েদের আপ্যায়ন এবং মেয়ে দেখে ভীষণ খুশি তিনি আজকেই কাবিনের তারিখ নির্ধারণ করবেন।খাবার শেষে পাত্রের পরিবার তাদের মাঝে আলাপ আলোচনা করছিল তখন মেয়ের বাড়ির কেউ উপস্থিত নেই।উজ্জ্বল ভেতরের কক্ষে ডাইনিং টেবিলে বসে একেরপর একেকটা পদ সাবাড় করছে তার খাওয়ার স্প্রিড দেখে তাজ্জব বনে গেল রুমু।উজ্জ্বলকে দেখে তার চাচি আর চাচাতো ভাই রাশেদ যে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে এতেই তার বড্ড শান্তি লাগছে।খাওয়ার শেষে উজ্জ্বল ওয়াশরুমে গেল তখনি ওয়াশরুম থেকে বের হতে দেখা গেল পাত্রের বাবাকে।


" আঙ্কেল মেয়ে আপনার পছন্দ হয়েছে?"


" মাশাল্লাহ মেয়ে তো আমার আগেই পছন্দ করা ছিল।"


" জি মেয়েটা পছন্দ করার মতো।তবে মেয়েটা যে টিকটকে নাচানাচি করে জানেন আপনি?"


পাত্রের বাবা যেহেতু ধার্মিক এমন কথা শুনে তাজ্জব বনে গেলেন।মুখ দিয়ে কয়েক বার শুধালেন আস্তগফিরুল্লাহ। উজ্জ্বল দ্রুত পকেট থেকে ফোন নিয়ে রুমুর নাচের টিকটক ভিডিও দেখালো।ব্যস পাত্রের বাবা মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পালটালেন এই মেয়ের সাথে কিছুতেই তিনি ছেলের বিয়ে দেবেন না।


উজ্জ্বলের পরিকল্পনা মোতাবেক রুমুর বিয়েটা ভেঙে গেল।এত ভালো ঘরে বিয়েটা হলো না তা যে কিছুতেই মানতে পারলো না রাশেদ।এই বিয়ে ভাঙার পেছনে যে উজ্জ্বলের হাত আছে তা সে বেশ ভালো করেই যানে কিন্তু উজ্জ্বলকে খবর দিল কে?রাশেদের সন্দেহ হলো তার বাবার উপর।না চাইতেও আজ বাবা ছেলের কয়েক দফা ঝামেলা গড়ালো।এর মাঝে রাবেয়া ঘোষণা দিয়ে বসলেন রুমুর বিয়ে তার বোনের ছেলের সাথেই হবে।এবং খুব শীঘ্রই এই ব্যপারে তিনি কারো মতামত চান না।

.

রাতের খাওয়া শেষে সৈয়দ শামসুল একটা বাঙ্গি ফল নিজ হাতে কাটলেন।ঘরের কেউ এই ফল পছন্দ না করলেও তিনি বেশ পছন্দ করেন।বাঙ্গির সিজনে এই ঘরে এক প্রকার বাঙ্গির অত্যাচার চালান তিনি।উজ্জ্বল খাওয়া শেষ করে নিজের কক্ষে ফিরে যায় কিন্তু শামসুল তাকে আবার ডেকে পাঠায়।ছেলেটা ডাইনিং টেবিলের সামনে আসতেই নজরে আসে থালা ভরতি বাঙ্গির ছোট ছোট টুকরো।মুহূর্তে তার মুখটা পাংশুটে বর্ন ধারণ করে,


" আব্বা খবরদার এই বাঙ্গি নিয়ে জোরাজোরি  করবা না।"


" অবশ্যই করবো।সিজনের ফল খাওয়া কতটা ভালো তুই জানিস?"


" আব্বা আমার বিয়ের সিজন আসবে কবে?বিয়েও কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।"


" বাঙ্গি খা তারপর বলবো।"


বাবা ছেলের বাকবিতন্ডায় মুচকি হাসলেন নার্গিস।স্বামীর মন রক্ষার্থে না চাইতেও তিনি বাঙ্গি খাচ্ছেন।উজ্জ্বল ভোঁতা মুখে দাঁড়িয়ে আছে খাবে কি খাবে না ভাবতে ভাবতে শামসুল কড়া ধমক দিলেন।বাবার ধমকে উজ্জ্বল বাঙ্গি মুখে তুললো। কয়েকবার দাঁতের তলায় পিষতেই বিদঘুটে স্বাদে গাল ভরতি সব ফেলে দিল। 

বিস্বাদে উজ্জ্বল আহাজারি করে বলে,


" আব্বা বাঙ্গির নিজস্ব কোনো স্বাদ নাই, চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নাই,এই উজ্জ্বলের নিজস্ব কোন বউ নাই।"


#চলবে....


গল্প কন্ট্রোললেস পর্ব ৪

 #কন্ট্রোললেস

#অনুপ্রভা_মেহেরিন

[পর্ব ৪]


" উজ্জ্বল ভাই তুলে নেওয়ার আগে অবশ্যই আমাকে জানিয়ে রাখবেন আমি সেজেগুজে বসে থাকবো একটা সিনেমাটিক ব্যপার আছে না।"


" তোর কি মনে হচ্ছে আমি ফাইজলামি করছি?"


" একদমি না।"


" মেজাজটা খারাপ করিস না।আমি সিরিয়াস।


" আমিও সিরিয়াস।"


" এই তুই ফোন কাট তুই আমার মেজাজ খারাপ করছিস।"


" আমি কেন ফোন কাটবো?আপনি দিয়েছেন আপনি কাটবেন।"


" তুই আমার মেজাজ খারাপ করেছিস তুই কাটবি।"


" না আপনি কাটবেন।"


" তুই কাটবি।"


" আপনি কাটবেন।"


"যা বলেছি তাই কর।"


"যা বলেছি তাই করুন।"


"এক্ষুনি  ফোন কাট রুমু।"


" এক্ষুনি  ফোন কাটেন উজ্জ্বল ভাই।"


" মুখে মুখে কথা বলছিস কেন?


" মুখে মুখে কথা বলছেন কেন?"


" বেয়াদবি করছিস কেন রুমু?"


" বেয়াদবি করছেন কেন উজ্জ্বল ভাই?"


" ইচ্ছে করছে তোকে চুমু খেতে।"


" ইচ্ছে করছে আপনাকে চুমু খেতে।"


" খাবে তো ডার্লিং বিয়েটা হোক।"


চট করে থেমে গেল রুমু।উজ্জ্বলকে বোকা বানাতে গিয়ে সে নিজেই বোকা বনে গেল!কি লজ্জা!কি লজ্জা!ইস কি বলে ফেললো সে।কয়েক সেকেন্ডের ঝগড়ার সমাপ্তি জানিয়ে রুমু নিজেই ফোন কাটলো।বুকের ভেতর বাড়লো ধুকপুক ধুকপুক।

.

উজ্জ্বলের মেজাজ আজ হাই ভোল্টেজে দাপাদাপি করছে।কি করছে কি করবে সে নিজেও জানে না।রাগারাগি দেখাতে গিয়ে আজ দুপুরের খাওয়াও হয়নি।সন্ধ্যায় টেবিলে বসে মাকে ডাকলো বেশ কয়েকবার।উজ্জ্বলের মা নার্গিস তখন টিভিতে পছন্দের সিরিয়াল দেখতে বসেছেন।এই মুহূর্তে ছেলের ডাকাডাকি মোটেও পছন্দ হলো না।


" কি হচ্ছে এভাবে ষাড়ের মতো ডাকছিস কেন?"


" পেটটা কাঁদছে আম্মা খেতে দাও।"


" দুপুরে খাসনি কেন?এখন নিজে বেড়ে খাবি।"


" আম্মা তুমি অন্তত আমার বাকি মেজাজটা খারাপ করো না।প্লিজ খেতে দাও।"


নার্গিস মৃদু হেসে খাবার বাড়লেন।ছেলেকে খাবার দিয়ে বসলেন টেবিলে।উজ্জ্বল খাবার পেয়ে এক এক মুহূর্ত দেরি করলো না গপাগপ পেট পুরে খেতে শুরু করলো।


" আম্মা তরকারিটা দারুন হয়েছে।আর কত কাল তুমি রেধে খাওয়াবে এবার অন্ত...."


" তোর কি লজ্জা নেই রে?জানিস তোর বাপ আমাকে আজকেও কথা শুনিয়েছে আমি নাকি তোকে আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছি।ব্যবসায় হাত লাগানোর জন্য তোকে জোরাজোরি করছি না।"


" সারাক্ষণ এক ক্যাচাল আমার ভালো লাগে না আম্মা।আমি আগেই বলেছি যখন আমার মন বলবে উজ্জ্বল যা গিয়ে বাবার ব্যবসায় বস তখনি আমি বসবো এর আগে নয়।"


"তোর মন কখন চাইবে বলতো।সারাদিন টইটই করে ঘুরছিস।না করিস পড়াশোনা না করিস কাজ।"


" আমি পড়তে চাইনি?তোমাদের অতি চালাকির কারণে আমার আজ এই দশা।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে দেখিয়েছি অথচ তোমরা আমাকে পড়তেই দিলে না।"


" তোর যা মেজাজ ঢাকায় গিয়ে তুই যে কি করবি আমরা কি জানিনা ভেবেছিস?খারাপ ছেলেদের সঙ্গ পেয়ে আরো খারাপ হবি।"


" তোমাদের বারবার এক কথা।ঢাকায় গিয়ে আমি বিগড়ে যাব!যে খারাপ হওয়ার সে এমনি হয়।বাদ দাও তোমাকে বুঝিয়ে লাভ নেই।জরুরি কথা শুনো যেকোন সময় বউ নিয়ে হাজির হব।"


" সেকি কথা!কে সে হতভাগিনি মেয়ে যে কি না তোকে বিয়ে করবে!"


" এভাবে বলছো কেন আম্মা?অপমান করতে একটু রয়ে সয়ে করো।যাকে করবো বলেছি তাকেই করবো।"


নার্গিস বুঝতে পারলেন উজ্জ্বল কার কথা বুঝিয়েছেন।রুমুকে নিয়ে উজ্জ্বলের পাগলামির শেষ নেই কিন্তু এই পাগলামি বিয়ে পর্যন্ত গড়ালে পুনরায় সৈয়দ বাড়িতে তান্ডব চলবে।নার্গিস সতর্ক হয়ে বলেন,


" খবরদার উজ্জ্বল ঝামেলা বাড়বে এসব করিস না বাপ।রুমুকে ছাড়া যাকে ইচ্ছে বিয়ে কর আমি বাদ সাধবো না।"


" কিন্তু আমার যে রুমুকেই লাগবে।"

.

রাতে পারিবারিক ভাবে একটি বৈঠক বসলো।রুমুর বিয়ের কথা তুলতে রুমুর মা তার খালা হালিমাকে জানিয়ে এই বাড়িতে আনেন।তার উদ্দেশ্য যে করে হোক বোনের ছেলের কাছেই একমাত্র মেয়ে বিয়ে দিবেন।যদিও এতে রাশেদ অল্পস্বল্প রাজি।বাকিটা সিদ্ধান্ত সৈয়দ ইসমাইল নেবেন।হালিমা অনেকক্ষণ যাবৎ ইসমাইলকে বোঝালেন,তার ছেলে হিমেল শিক্ষিত দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ।একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে বেশ ভালো বেতনে চাকরি করছে এমন ছেলে হাত ছাড়া করা কী উচিত?তাছাড়া অপরিচিত কারো ঘরে মেয়ে না পাঠিয়ে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে সম্পর্ক গড়লে ভালো হয়।এত এত প্রশংসার বাক্যে পাশ থেকে মশলা ঢেলেছেন রাবেয়া।অথচ সৈয়দ ইসমাইল মুখটা পানসে করে তাকিয়ে আছেন টিভি স্কিনে।রাশেদ বাবার এমন হেয়ালিটা পছন্দ করলো না।


" আব্বা কিছু তো বলেন।"


" বলতে ইচ্ছে করছে না তাই বলবো না।"


" ইচ্ছে করছে না মানে?যত দ্রুত সম্ভব রুমুকে একটা কুলে দিন আব্বা।এই মেয়ে বখে গেছে।"


" তোর বন্ধুর যে কাজিনরা প্রস্তাব দিয়েছিল তাদের কি খবর?"


" আগামী সাপ্তাহে তারা আসবে ছেলেটা নাকি এবার বিয়ে করেই যাবে।শুনলাম বিয়ের পর বউকে নেওয়ার সকল প্রসেস শুরু করে দেবে।"


" ওদের সাথে যোগাযোগ কর।"


রাবেয়ার মুখটা পাংশুটে হয়ে গেল।আশাহত গলায় বলেন,


" আমার বোন যে আবদার নিয়ে এলো তোমার কি গায়ে লাগলো না?"


" আমি আগেই বলেছিলাম মেয়ের বিয়ে আমি যেখানে চাই সেখানেই হবে।"


রাবেয়া রেগে গেলেন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বলেন,


" শুনুন রাশেদের আব্বা, আমি আমার বোনকে কথা দিয়েছি তার ঘরে মেয়ে পাঠাবো।এই কথার খেলাপ আমি করতে পারিনা"


" আমিও তো আমার ভাইকে কথা দিয়েছিলাম উজ্জ্বলের সাথেই রুমুর বিয়ে হবে।ওরা যখন ছোট ছিল সেই ছোট থেকে এমনটাই বলে এসেছি সে কথা তুমিও জানো।"


" কি বললে তুমি?ওই লোভীদের ঘরে তুমি মেয়ে বিয়ে দিতে চাইছো?এত ঝামেলার পরেও তোমার শিক্ষা হয়নি?"


" খবরদার চেচিয়ে কথা বলবে না।তোমার মেয়েয়ালি ঝগড়ার জন্য আজ সৈয়দ বাড়ি ভাগ হয়েছে।"


" আমার দোষ!আমি..."


রাবেয়া হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।বোনকে শান্ত করতে হালিমা এগিয়ে গেলেও লাভের লাভ কিছুই হলো না।হাতের কাছে যা পেলেন ছুড়ে ফেলে দিলেন রাবেয়া।কাঁচের জিনিসপত্র ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো দিকবেদিক।রাশেদ উঠে গিয়ে মাকে শান্ত করলো রাবেয়া স্বামীর দিকে ছুড়ে দিলেন গাদা গাদা অভিযোগ।


পর্দার আড়াল থেকে হাসলো রুমু।আর যাই হোক সে কখনো হিমেল নামক বেয়াদবটাকে বিয়ে করবে না।এই তো ছোট বেলার কথা সবে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে সে।হিমেল ভাইয়ের অসৎ ছোঁয়াগুলো একটুআধটু বুঝতে পারলেও সে কিছুই কাউকে বলতে পারতো না।সবাই ভাবতো হিমেল তাকে কত্ত আদর করে।সেবার হিমেল তাকে মোবাইলে গেম খেলতে দিয়ে আচমকা তার বুকে হাত দেয়।হিমেলের দানবীয় হাতের ছোঁয়ায় রুমুর সারা দেহ আচমকা কেঁপে উঠে।দ্রুত ফোন ছুড়ে ফেলে প্রস্থান নেয় মেয়েটা।না এটা প্রথম কিংবা শেষ নয়।এভাবে কতবার হেনস্তার শিকার সে হয়েছে গুনে শেষ করা যাবে না।ভয়ে কাউকে কিছু বলতেও পারে না।কাকে বলবে?মা হিমেলের অন্ধভক্ত বাবা আর ভাইয়ের সাথে খুব বেশি মনখোলা নয় সে সব মিলিয়ে নিজের কাছে আড়াল রেখেছে।তবে রুমু একা নয় তার খেলার সাথী রিয়া যখন খেলতে বাড়িতে আসে মেয়েটাকে চকলেট কেনার কথা বলে বাজে ভাবে ছুঁইয়ে দেয় হিমেল।সেদিনের পর যতবার হিমেল রুমুদের বাড়ি এসেছে ততবার খেলতে আসেনি রিয়া।


হাতের ফোনটা শব্দ করতে ধ্যান ভাঙে মেয়েটার।উজ্জ্বল ভাই ফোন করেছেন।রুমু দ্রুত ফোন কেটে নিজ কক্ষে ফিরলো।রাত বারোটা বাজতে চললো উজ্জ্বল ভাই এত রাতে কেন ফোন করলেন?রুমু কালবিলম্ব না করে ফোনটা ধরলো অত্যান্ত দুঃখী দুঃখী গলায় শুধালো, 


" উজ্জ্বল ভাই।"


" তোর রুমের লাইট জ্বলছে কেন?ঘুমাসনি কেন?"


" আমার তো বিয়ে উজ্জ্বল ভাই।"


" কি!তুই এই কথা আমাকে এখন বলছিস?চোরের মতো রাত ১২ টায় কে বিয়ে করে?"


" আপনাকে বলবো কেন?এমনিতেও আপনাকে দাওয়াত করা হবে না।"


" কানের নিচে দুটো দিয়ে ব্রেনের ব্রাইটনেস বাড়িয়ে দেব ফাজিল মেয়ে।দাঁড়া আমি আসছি তোর বিয়ের ব্যান্ড বাজাতে।"


রুমু কিছু বলার আগেই ফোন কাটলো উজ্জ্বল।বেচারার মেজাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে অপরদিকে রুমু এতবার করে ফোন করেও পেল না উজ্জ্বলকে।বেচারা ফোনটা রেখেই বেরিয়ে গেছে বউ উদ্ধার কাজে।


সৈয়দ বাড়ির দানবীয় দেয়ালটা টপকে গাছ বেয়ে নিচে নামলো উজ্জ্বল।আজ যা হওয়ার হবে বউ নিয়ে যে করে হোক নিজ বাড়িতে ফিরবে।শুকনো পাতার মড়মড় শব্দে ধীরে ধীরে পা ফেলতে হলো তাকে।দ্রুত হেটে গিয়ে দাঁড়ালো রুমুর জানলার পাশে বেশ কয়েকবার টোকা দিলেও রুমু জানলা খুললো না।যদিও মেয়েটা শুনতে পায়নি।এখন বড্ড বেশি আফসোস হচ্ছে কেন ফোনটা ফেলে আসলো।


উজ্জ্বল চারদিকে পা টিপে টিপে এগিয়ে যেতে দেখতে পেল সৈয়দ ইসমাইলের জানলা খোলা।রাবেয়ার সাথে তুমুল ঝগড়া চলছে তার।এটা যে বিয়ে বাড়ি বিন্দুমাত্র বোঝা যাচ্ছেনা।তাদের ঝগড়াটা ঠিক কি নিয়ে বোঝার চেষ্টা চালালো উজ্জ্বল।দরজায় দাঁড়িয়ে আছে রুমুর খালা হালিমা।খোলা জানলায় মানব অস্তিত্ব টের পেয়ে আচমকা চিৎকার চেচামেচি শুরু করলেন। 


" আল্লাহগো ওরে রাবেয়া চোর চোর তোর বাড়িতে ডাকাত পড়েছে রে। ওরে কে কোথায় আছিস চোর ডাকাত চোর!"


হালিমার এক চিৎকারে সতর্ক হয়ে যায় বাড়ির সকলে।এমন পরিস্থির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না উজ্জ্বল।বেচারা বুদ্ধি খাটিয়ে দ্রুত দরজার সামনে গিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়।তার উদ্দেশ্য কেউ যেন ঘর থেকে বের হতে না পারে।এই বাড়িতে রাশেদ যদি একবার তাকে দেখে ফেলে তবে কুরুক্ষেত্র হবে।এক সাথে সকলে চিৎকার করা শুরু করলো মুহূর্তে বাড়ির পরিবেশ গরম হয়ে যায়।রাশেদ দা নিয়ে ছুটে আসে কিন্তু বের হতে গিয়ে বুঝতে পারলো দরজা বাইরে থেকে আটকানো।উজ্জ্বল দ্রুত গাছে উঠে গেল দেয়াল টপকে নিচে নামার চেষ্টা চালালো।এখনো সবার চিৎকার শোনা যাচ্ছে,


" চোর চোর চোর কে কোথায় আছেরে বাড়িতে চোর এসেছে।"


উজ্জ্বল মুখ বাকিয়ে আপনাআপনি বলে,


" হুহ আমি চোর।বউ চোর।সৈয়দ ইসমাইল আপনার বাড়ির মূল্যবান জিনিসটা কিন্তু এই উজ্জ্বল চুরি করবে কথা দিলাম।"

.

ঘুমন্ত এলাকাবাসী মুহূর্তে জেগে গেল।সবাই টচ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো চোর খুঁজতে সেই সাথে উজ্জ্বল নিজেও বের হয়েছে।শার্টের হাতা কনুইতে গুটিয়ে সবার সামনে গলা তুলে বলে, " এই এলাকায় চোর!আমার এলাকায় চোর তাও কি না সৈয়দ বাড়িতে!শালার ব্যাটা তোকে পেলে মা র তে  মা র তে সৈয়দ বাড়ির মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতাম।"


উজ্জ্বলের কথাটা সবাই না বুঝলেও  ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো উজ্জ্বলের বাবা সৈয়দ শামসুল।মনের সন্দেহ থেকে তিনি ভাবেন তবে কি সেই চোরটা উজ্জ্বল!সৈয়দ বাড়ির অবিবাহিত মেয়ে রুমু আর রুমুকে বিয়ে করতে উঠে পড়ে লেগেছে উজ্জ্বল।


চোরের হদিস না পেয়ে সবাই যে যার মতো বাড়ি ফিরলো।রুমু জানে এই চোরটা কে।উজ্জ্বল ভাই ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।

উজ্জ্বল তখন বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে।দৌড় ঝাপে বেশ হয়রান হয়েছে সে।তাড়াতাড়ি গাছ বেয়ে উঠতে গিয়ে বাম পা'টা ছিলে গেছে।অসময়ে রুমুর ফোন পেয়ে ধরলো সে,


" উজ্জ্বল ভাই চোরটা কি আপনি ছিলেন?"


" না।কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিল।"


" মজা করছেন কেন?"


" তুই মজা করলি কেন?তোর না বিয়ে?"


" আমি বলেছি বিয়ে তবে কবে তা তো বলিনি।আপনি কেন এলেন এত দৌড়ঝাঁপ করে।"


" এই শুন তোর মাথায় বুদ্ধি কম সব গোবর।একবার বিয়েটা করতে দে, তোর কপালে আমার একেকটা চুমু তোর ব্রেনে বুলেটের মতো বাঁধবে।দেখবি আমার চুমুর পাওয়ারে কেমন বুদ্ধির রানী হয়ে যাস।"

#চলবে.....


উজ্জ্বল হবে কন্ট্রোললেস  নায়ক।তার রাগ জেদ ভালোবাসা কোন কিছুর নিয়ন্ত্রণ নেই।অনেকেই হয়তো তার এই স্বভাবটা মানতে পারবেন না তাই আগেই বলে দিলাম এমন চরিত্র যদি আপনার পছন্দ না হয় তবে গল্পটা আপনার জন্য নয়।

উজ্জ্বলের কন্ট্রোললেস স্বভাবটা কে কে দেখতে চান?পড়বেন তো?🧐


গল্প কন্ট্রোললেস পর্ব ৩

 #কন্ট্রোললেস

#অনুপ্রভা_মেহেরিন

[পর্ব ৩]


" বউ অন্য ছেলেদের দিকে চোখ দিচ্ছিস কেন?"


" সুন্দর জিনিস দেখতে হয় উজ্জ্বল ভাই।আপনিও দেখুন বারণ করেছে কে?"


" আমি তো বছরের পর বছর দেখেই যাচ্ছি এখনো দেখছি।"


রুমু চোখ সরিয়ে তাকালো উজ্জ্বলের পানে।ছেলেটাকে ভেঙচি কেটে বলে,


" কে সে শুনি?"


" যে প্রশ্নটা ছুড়েছে সে।"


রুমু প্রত্যুত্তর করলো না।পুনরায় তাকালো পাশের টেবিলে থাকা ছেলেটির দিকে।বুকের ভেতরটা মুহূর্তে ছ্যাত করে উঠলো উজ্জ্বলের।নিয়ন্ত্রণহীন ছেলেটা কি করে যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখছে তা তো সেও বুঝতে পারছে না।কলেজের পাশে একটি সাধারণ হোটেলে বসে আছে তারা।এখানে কম দামে পেট ভরে খাওয়া যায় বিধায় সকল স্টুডেন্টদের ঢল নামে।গরম গরম সিঙারা,সমুচা,পুরি,খিচুড়ি,পরোটা সহ ইত্যাদি বেশ কম দামেই পাওয়া যায়।


" রুমু কি খাবি?"


" খিচুড়ি সাথে ডিম ভাজা।"


উজ্জ্বল খাবার অর্ডার করে পুনরায় তাকালো রুমুর পানে অথচ মেয়েটা এখনো সেই ছেলেকে পরখ করছে।


" উজ্জ্বল ভাই জানেন এই ছেলেটা অনার্স ফাস্ট ইয়ারের।ইন্টারের মেয়েরা তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।একটা ছেলে কি করে পারে এতটা কিউট হতে পারে!পুরা মাখন।"


উজ্জ্বল ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো।হাক ছেড়ে ডাকলো ছেলেটাকে।উজ্জ্বলের ডাক পেয়ে দ্রুত উঠে আসলো ছেলেটা।সৌজন্যের হাসি দিয়ে বলে,


" উজ্জ্বল ভাইয়া ভালো আছেন?ভাবিও এসেছে দেখছি।"


ভাবি!এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর শব্দ বলে মনে হচ্ছে রুমুর সুন্দর ছেলেটা তাকে ভাবি ডাকছে!রুমু কটমট চোখে তাকালো উজ্জ্বলের পানে।অথচ উজ্জ্বলের সেদিকে পাত্তা নেই সে ছেলেটার সহিত কথা বলতে ব্যস্ত।


সময় পেরিয়ে গেল আরো কিছুক্ষণ।গরম গরম খিচুড়ি গপাগপ মুখে পুরছে মেয়েটা।উজ্জ্বল সেদিকে তাকিয়ে চোখের তৃপ্তি মেটাচ্ছে।আচমকা পিঠে দানবীয় থাবায় চোখ কুচকে নেয় রুমু।ঘাড় ঘুরিয়ে বন্ধু ফাহিমকে দেখে দাঁতে দাঁত পিষে।গা ঝারা দিয়ে বলে,


"এভাবে কেউ মারে?ব্যথা পেয়েছি ফাহিম।"


" তুলোর বস্তা আবার ব্যথা পায়?"


ফাহিম কথাটা বলে দ্বিতীয়বার রুমুর ঘাড়ে হাত রাখলো।যারপরনাই এই ব্যপারটা মোটেও পছন্দ হলো না উজ্জ্বলের।চট করে রাগটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফিরে এলো তার মুখোশে।চোখের পলকে ফাহিমের হাত মুচড়ে ধরলো সে।টনটন ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো ফাহিম।হাতটা যেন এক্ষুনি ভেঙে গুড়িয়ে যাবে।


" এই হাত আমি রাখবো না।এই হাত আস্ত থাকবে না..."


দ্বিতীয় বার ফাহিমের হাত উলটে মোচড় দিল উজ্জ্বল।তার রাগান্বিত মুখটা দেখে দিক-বেদিক সব গুলিয়ে গেল রুমুর।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উজ্জ্বলের হাত টানতে উজ্জ্বল তাকে এক ধমকে স্থির করে ছাড়ে।হোটেলে সকলে জড়ো হয়ে যায়।উজ্জ্বলের অনেক পরিচিত ছোটভাই ক্লাসমেট বড়ভাইরা এগিয়ে আসে।হোটেলের ক্যাশে বসা লোকটির সাথে উজ্জ্বলের বেশ ভালো সম্পর্ক।তিনি চাইলেন উজ্জ্বলকে থামাতে কিন্তু বেপরোয়া উজ্জ্বল কাউকে কি মানে?পাত্তা দেয়?ফাহিমের পিঠে তিন চারটে ঘুসি দিয়ে স্থির হয় সে।তার অগ্নিশর্মা মুখখানি দেখে রুমু তাকে থামানোর সাহস করে না।উজ্জ্বল হাত টেনে এগিয়ে আনে রুমুকে এবং মুখোমুখি করায় ফাহিমের সহিত।


" কিরে বন্ধু পাতিয়েছিস বলে এই ছেলে তোর গায়ে হাত দেবে?এতটা অনুমতি দিয়ে দিয়েছিস?"


" আ...আমি বুঝতে পারিনি উজ্জ্বল ভাই।ফাহিম এমন ছেলে নয়।"


" কেমন ছেলে?বল বল,বল আমায় সে কেমন ছেলে।আমি দেখলাম তো আমার চোখ কি ভুল দেখেছে।"


 " উজ্জ্বল ভাই..."


" কে ভাই?কে ভাই?এমন থাপ্পড় দেবো জীবনে গালে আর ব্লাশন লাগাতে হবে না।"


রুমু চুপসে যায়।ফাহিম উজ্জ্বলের পা ছুঁয়ে বসে যায় সে যানে এই ছেলে মারপিটে কতটা ওস্তাদ।ফাহিম নিজের জান বাঁচাতে বলে,


" উজ্জ্বল ভাই আমাকে এবারের মতো ছেড়ে দিন আর কোন দিন এমন ভুল হবে না।"


" ছাড়বো।রুমুকে আগে খালাম্মা ডাক।ডাক খালাম্মা.."


শেষোক্ত বাক্যটি বেশ জোরেই বললো উজ্জ্বল।খালাম্মা!শেষ পর্যন্ত তাকে খালাম্মা বানিয়ে ছাড়লো!রুমু চোখ মুখ খিঁচে উজ্জ্বলের পানে তাকাতে উজ্জ্বল চোখ রাঙায়।ফাহিম নিজেকে ছাড়াতে রুমুকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,


" খা..খালাম্মা।"


উজ্জ্বল ঠোঁট বাকিয়ে হাসে।শীতল হয় উত্তপ্ত রক্তকণা।টগবগে মস্তিষ্ক স্থির হয় মুহূর্তে।


" শুধু রুমু নয় কোন মেয়ের গায়ে যদি এভাবে হাত দিস হাতটা ভেঙে দেব জানোয়ার।"


দশ মিনিটে যেমন হোটেলের পরিবেশ পালটে যায় ঠিক তেমনি দশ সেকেন্ডে পুনরায় পালটে যায় যে যার কাজে ব্যস্ত হয়।রুমুর গলা দিয়ে খাবার নামার পরিস্থিতি নেই অথচ উজ্জ্বল জেদ ধরে বসে আছে যে করে হোক তাকে খাবারটা শেষ করতেই হবে।


" কি হলো এতটুকু খিচুড়ি শেষ করতে কতক্ষণ লাগে?"


" খাব না।প্লিজ এখান থেকে চলুন।"


" আবার কথা বলে।আদর করে খাওয়াতে হবে?আয় কোলে বস গাল চটকে আদর করে খাইয়ে দেব।না থাক ওসব বিয়ের পর করা যাবে এখন বরং নিজ হাতে খা।"


" আপনার কি লজ্জা শরম নেই?ছোট বোন হই বুঝলেন?"


" তুই আমার হবু বউ বুঝলি?"


" আপনার মতো ছেলের কাছে কে মেয়ে বিয়ে দেবে?"


" তাই নাকি?টেস্টোস্টেরন হরমোন আমার শরীরে লাফালাফি করার আগেই তোর বাপ আমাকে মেয়ে জামাই হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে আর তুই বলছিস কে মেয়ে দেবে?"


" আমার ভাইর চক্ষুশূল আপনি বুঝলেন?"


" তোর ভাইকে গুনছে কে?তুমি রাজি জামাই সাজি কেয়া কারে গা কাজি?বিয়ের পর দুজন মিলে ভাজবো ডিম ভাজি।"


" শুধু ডিম ভাজি দিয়ে আমি ভাত খেতে পারি না উজ্জ্বল ভাই।"


" দূর গানটাতো শেষ করতে দিবি।"


রুমু চুপচাপ খাওয়ায় মনোনিবেশ করে।তার সামনে বসে থাকা যুবকটি তাকে না পেলে ঠিক কি কি করতে পারে তার যুত সামান্য টের পাচ্ছে সে।

.

রুমু বাড়ি ফিরলো ভরদুপুরে।উজ্জ্বল ভাইয়ের কত শখ রুমুকে বাইকে চড়িয়ে এই শহর ঘুরবে অথচ সেই সুযোগ আর কই?উজ্জ্বলের ত্রিসীমানায় রুমুকে পেলে তান্ডব চালাবে রাশেদ।


বাড়িতে প্রবেশ করতে একমাত্র খালা হালিমাকে দেখে রুমুর কলিজা কেঁপে উঠে।গত রাতে সবাই তাকে বিয়ের হুমকি দিয়েছিল আর আজ খালামনি এসে হাজির!নিশ্চয়ই মামতো ভাইও এসেছে।এই বেয়াদবটার মুখোমুখি হতে চায় না সে।রুমু নিশব্দে প্রবেশ করলো ঘরে কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয় বসার ঘর পার হতেই হালিমার নজরে আসে রুমু।মেয়েটাকে পেয়ে আনন্দিত হয়ে ছুটে এলেন তিনি।


" রুমু আম্মু কেমন আছো?"


" ভালো খালামনি।তুমি কেমন আছো?"


" তোকে দেখে ভীষণ ভালো লাগছেরে মা।"


" তুমি বসো আমি জামা পাল্টে আসি।"


" এই দাঁড়া।তোর গালে চড়ের দাগ?কে মেরেছে তোকে?কোন জানোয়ার তোর গায়ে হাত তুলেছে?"


হালিমা রেগে গেলেন।গলা ছেড়ে বকতে শুরু করলেন।রুমু মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন চড় খেয়েছে সেই কথা শুনলে নিশ্চয়ই উনিও আরেকটা চড় বসিয়ে দেবেন।

বকাবকির মাঝে হালিমা বলেন, " আমার ছেলের বউয়ের গায়ে কে হাত দিল আমিও দেখতে চাই তাকে।আমার ছেলে জানলে সেই হাত আস্ত রাখবে না।"


ব্যস দম আটকে আসলো রুমুর।ছেলের বউ মানে!ওই কুলাঙ্গারটাকে জীবনে বিয়ে করবে না রুমু।মুহূর্তে মাথার মধ্যে দপাদপ আগুন জ্বলে উঠলো।কাধের ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে চলে গেল নিজ কক্ষে।


এতক্ষণ হালিমার কথাগুলো গিলছিলেন রুমুদের বাড়ির কাজের মহিলা রহিমা।এক বাড়িতে কাজ করে মাসে যত টাকা ইনকাম করেন তার থেকেও ডাবল ইনকাম করেন রুমুদের বাড়ির সব কথা উজ্জ্বলকে সাপ্লাই করে।উজ্জ্বলের বেশ ভক্ত তিনি।ভক্ত হবেন না কেন?রুমুদের বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য প্রদানের মাধ্যমে উজ্জ্বল আর্থিক ভাব উনাকে বেশ সাহায্য করে।

.

ঘামাক্ত শরীরে রাগে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বাড়ি ফিরলো উজ্জ্বল।সৈয়দ শামসুল ছেলের রাগটাকে মূল্যায়ন না করে কড়া গলায় ডাকলেন,


 " এই আলালের ঘরের দুলাল।"


" আমি দুলাল নই বাবা।শামসুইল্লারর ঘরের উজ্জ্বইল্লা।"


" চুপ কর।ইদানীং তোকে সময় মতো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথায় থাকিস?আমার ব্যবসায় একটু সময় দিতে পারিস।"


" শুরু হলো তোমার এক ক্যাচাল।"


" হ্যাঁ শুরু হলো।এই যে পড়াশোনা করছো এসব কোন কাজের নয় যতটুকু শিক্ষা নেওয়ার নিয়েছো যথেষ্ট হয়েছে এখন তোমাকে শিখতে হবে কিভাবে রুজিরোজগার করতে হয়।আমার ভাইয়ের ছেলেকে দেখো না?তোমার লজ্জা হয় না?রাশেদ নিজের বাবার ব্যবসা সামলাচ্ছে কিভাবে আরো উন্নত করা যায় সেই চেষ্টায় আর আমার ছেলে..বাইক একটা নিয়ে সারাদিন এদিক থেকে সেদিক,সেদিক থেকে এদিক।"


" উফফ বাবা রাশেদের সাথে আমার উদাহরণ দিবে না।রাশেদ কেন বাবার ব্যবসায় বসেছে তুমি জানো না?মাত্র একুশ বছরে পালিয়ে বিয়ে করে বাড়িতে উঠেছে।সে পড়াশোনা গোল্লায় নিয়ে প্রেমে পিএইচডি করেছে।"


"চুপ কর।সে যা ইচ্ছা করুক তুই তো তার মতো হতে পারবি না।আমি কোমড় ভেঙে পড়লে আমার ব্যবসা নিশ্চয়ই সাত আসমানে উঠে যাবে।আমার অতিব্যস্ত পুত্র এসব ছুঁয়েও দেখবেন না।"


" দেখবো আব্বা দেখবো।বয়স তো  আমার জন্য অপেক্ষা করছে না লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।আমাকেও ওই রাশেদের মতো বিয়ে করিয়ে দাও কথা দিচ্ছি তোমার ব্যবসায় সবুজ বাত্তির ছড়াছড়ি থাকবে।"


" তোর নিতম্বদেশে লাথি  না  মারতে  এখান থেকে সর।রাস্তার পাগলেও তোকে মেয়ে দেবে না।"


উজ্জ্বল দাঁড়ালো না।বাবার এসব অপমান গায়ে মাখলে শুধু শুধু সময় অপচয়।তার এখন অনেক কাজ রুমুকে শাসাতে হবে।

.

বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদছিল রুমু।হালিমার মুখে এমন কথা শুনে তার মন মরে গেছে।উজ্জ্বল অনেক্ষণ যাবৎ দেদারসে ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু উজ্জ্বলের ফোন ধরার মতো ইচ্ছা কিংবা আগ্রহ কোনটাই খুঁজে পাচ্ছে না সে।তার এই অনাগ্রহকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উজ্জ্বল পাঠিয়ে দিল হুমকির বাক্য।


" ফোন না ধরলে তোর বাসায় এসে হাজির হবো।ব্যপারটা কি খুব ভালো হবে?"


ব্যস ফোন না ধরার আর সাহস পেল না মেয়েটা।প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে ফোন তুললো সে।


" উজ্জ্বল ভাই বলুন।"


"রুমু ডার্লিং গলা এমন লাগছে কেন?কাঁদছিস?"


" ক..কই।"


" ন্যাকামি করে মিথ্যা বলবি না আমার সাথে।তোর নাকি বিয়ে ঠিক তোর খালতো ভাইয়ের সাথে?"


" আপনাকে কে বললো?"


অবাক চুইয়ে চুইয়ে পড়লো রুমুর কণ্ঠে।তার এই অবাক হওয়াটাকে পাত্তা দিল না উজ্জ্বল বরং চেচিয়ে বললো,


" কিরে কথা কি সত্যি?"


" জানি না আমি।"


" তবে কি জানিস?"


"  এই বিয়ে হোক আম্মা এটাই চান।"


" তুই কি চাস?"


" যদি বলি আমিও তাই চাই।তবে কি করবেন আপনি?"


"তোকে তুলে নিয়ে আসবো।"

#চলবে..


গল্প কন্ট্রোললেস পর্ব ২

 #কন্ট্রোললেস

#অনুপ্রভা_মেহেরিন

[পর্ব ২]


বলিষ্ঠ দেহের আদলে ক্রমশ গুটিয়ে যাচ্ছিল রুমু।অনেকক্ষণ যাবৎ মোচড়ামুচড়ি করেও নিজেকে ছাড়াতে ব্যর্থ।পুরুষালি শক্ত হাতটা মুখ চেপে রাখতে দমটাও আজ নিমিষে ফুরিয়ে যাবে যেন।রুমুর মোচড়ামুচড়ি সহ্য করতে পারলো না অজ্ঞাত ব্যক্তিটি।পেট চেপে শূন্যে তুলতে ভয় দ্বিগুন বাড়লো রুমুর।মেয়েটা এবার নিজেকে বাঁচাতে দেহের সব শক্তি দিয়ে কামড় বসালো অজ্ঞাত ব্যক্তির হাতে।তীব্র ব্যথায় মুহূর্তে বিবশ করে দিল অজ্ঞাত ব্যক্তির হাত,ব্যথার দাপটে হাত ঝাঁকি দিতে কোল থেকে ধপাস করে নিচে পড়লো রুমু।


" কিরে এগুলো তোর দাঁত নাকি ব্লেড!"


পরিচিত কণ্ঠে চমকে মাথা তুলে  তাকালো রুমু।আরে এত তো উজ্জ্বল ভাই।উনি এখানে কী করছেন?এতটা দুঃসাহস দেখিয়ে এখানে কেন আসলেন?মেয়েটা অবাক চাহনি নিক্ষেপ করে বলে,


" উজ্জ্বল ভাই আপনি?"


" আগে বল তোর দাঁতের এত ধার কেন?আর একটু হলে আমার হাতের মাংসপিণ্ড তোর মুখে চলে যেত।বুঝতে পেরেছি বেশ ভালো করে বুঝতে পেরেছি, বিয়ের পর আমার হসপিটালের বেডেই রোমান্স করতে হবে।বলা তো যায় না কখন কি হয়।"


চোখ পাকিয়ে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো রুমু।এই লোকটা অসভ্য বেয়াদব মেয়াদহীন মস্তিষ্কের লোক।কি বলে কি করে নিজেও জানে না।


" আপনি এই ছাদে কি করছেন?আব্বা,ভাইয়া দেখলে আপনার সাথে ঠিক কি হবে আপনি ভাবতেও পারছেন না।"


" ভাবতেও চাইছি না ডার্লিং।"


" আমি এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি চাচ্চুর কাছে গিয়ে আপনার নামে বিচার দিব এসব আর মানা যাচ্ছে না।"


" তোর চাচ্চুকে আমি ভয় পাই?"


" তাহলে বলুন আপনি কাকে ভয় পান আমি তার কাছে যাব।"


উজ্জ্বল শব্দ করে হাসতে গিয়েও থেমে গেলো।হাটু ভেঙে বসলো রুমুর মুখোমুখি। মেয়েটার হাত পা পরখ করে বলে,


" কোথায় ব্যথা পেয়েছিস?"


" বলবো না।আপনার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।"


" বলে ফেল।"


" মাহমুদকে মে রে ছে ন কেন?"


" এসব কথা এখানে বলতে আসিনি আমি।"


" উজ্জ্বল ভাই এবার কিন্তু একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়েছে।ছেলেটাকে একদম হসপিটালে শুইয়ে দিলেন।ওর শার্ট দেখে আতঁকে উঠেছি আমি।আপনি কি মানুষ?"


"ওর ডিম দুটো ভেঙে দিলে বেশি শান্তি পেতাম।"


" ডিম! কিসের ডিম?মাহমুদের ডিম মানে?"


উজ্জ্বল নিশব্দে হাসে।রুমুর প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি তাকে বেশ মজা দিচ্ছে।


" তোকে বলেছিনা প্রেম করিস না।তুই তো আমার বউ হবি তাহলে কেন এ পাতে ও পাতে মুখ দিচ্ছিস?"


" আগের দিন বাঘে খাইছে আপনি জানেন না?"


" জানতে চাই না।সৈয়দ উজ্জ্বল আনিস এক কথার ছেলে।তোর আব্বাকে যখন শ্বশুর ডেকেছি তখন পার্মানেন্ট শ্বশুর বানিয়েই ছাড়বো।এই আমি বলে দিলাম।"


" আপনার কথা আপনার কাছে রাখুন।এখানে কী করে আসলেন উজ্জ্বল ভাই?"


" তোর বাড়ির আমগাছ আর আমার বাড়ির আমগাছ যে প্রেম করছে জানিস?তারা দুইজন দুজনের মাঝে ঢাল পালা ছড়িয়ে দিব্বি প্রেম করছে।সেই গাছ বেয়ে এসেছি"


" ভাইয়া বলেছে আপনাদের গাছের ঢাল কেটে দেবে।আপনাদের গাছ কেন এলো আমাদের সীমানায়।"


" তোর ভাই আর তোর মা দুইজনের মনে হিংসায় ভরা বুঝলি?না হলে গাছের সাথে কেউ এমন করে!অবলা গাছের কি দোষ?"


রুমু চুপসে যায়।এ কথা মিথ্যে নয় তবুও আপন বলে সত্যটা সে দিব্যি হজম করে নেয়।উজ্জ্বল রুমুকে টেনে দাড় করায়।মুখভঙ্গিমা পালটে আদেশ সুরে বলে,


"এখান থেকে গিয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে যাবি।তোর ভাইয়ের অপেক্ষায় থাকবি না।আর হ্যাঁ রুমের দরজা আটকে দিবি।"


" কেন?"


" কেন বলেছি সেটা তোর না বুঝলেও চলবে তবে যা বলছি তাই করবি।"


" যদি না করি?"


" তবে একটাও চড় এদিক সেদিক হবে না একদম গালের উপর দিয়ে যাবে।"


" কিহ!উজ্জ্বল ভাই আপনি আমাকে মারবেন!"


" আমি কেন মারবো?তোকে মারার লোকের অভাব আছে?যে গালে এখনো চুমু খেতে পারিনি সেই গালে মারবো?এতো আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা।"


" খালি আপনার বাজে কথা।"


" বাজে কথা নয় সত্যি।যেদিন বিয়ে করে নিয়ে যাব সেদিন বুঝবি।কত বছর হয়ে গেল তুই আমাদের ঘরে যাস না তোর ছোট দুই পায়ের দৌড় ঝাপ আমরা সবাই মিস করি।আমার রুমে ঢুকে যে বই ছিড়তি মনে আছে?কতবার মারতে গিয়েও মারিনি তোকে মারলে আমি নিজেই শান্তি পাব না।"


অতীতের ধূলো জমা স্মৃতি আবার স্মরণে আসতে মুখটা গোমড়া হয় রুমুর।কত সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো।সৈয়দ বাড়ি জুড়ে ছিল হাসি আনন্দ মাতামাতি।সেই সময়টাতে সুখের পাশাপাশি দুঃখটাও ভাগ করে নিতো সকলে অথচ কালবৈশাখির ন্যায় মানুষ্য ঝড়ে সৈয়দ বাড়ির মাঝ উঠানে দেয়াল গড়ে তোলে।আর সেচ্ছায় মুখ দেখাদেখি করেনি দুইভাই মানে সৈয়দ বাড়ির কর্তারা।এত বছরের ঝামেলাকে স্মরণে রেখেও উজ্জ্বল রুমুকে পাওয়ার অদম্য মনোবলে দিনগুনে।


এক ছটাক শীতল বাতাসে ভাবনার দুয়ার থেকে বেরিয়ে আসে রুমু।উজ্জ্বল তার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে।যতদিন যাচ্ছে ততই উজ্জ্বলের পাগলামো বাড়ছে।


" রুমু কাল থেকে মাহমুদের সাথে কোন যোগাযোগ করবি না।এবার শুধু মে রে রক্তাক্ত করেছি পরেরবার হাত পা ভাঙবো কথা দিলাম।"


" আপনি এসব করে কী হবে?ঠিকি আমি আব্বার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবো।"


" তোর বাপের পছন্দের ছেলে আমি জানিস না?ছোট বেলায় আমাকে মেয়ে জামাই বলে ডাকতো।সেই ডাক আমি কিছুতেই বিফলে যেতে দিব না।"


" দেখা যাবে।"


ছাদে অন্ধকার মাড়িয়ে বিদ্যুৎ এর দেখা মিললো।চারদিকে আলোকিত হতে সতর্ক হলো রুমু।


" উজ্জ্বল ভাই এখান থেকে জান।কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।ভাইয়া ওঁৎ পেতে আছে কখন সুযোগ পাবে আর আপনাকে মা র বে।"


" এই উজ্জ্বলকে মারার মতো সাহস তোর ভাইয়ের হয়নি।চলে যাব একটা চুমু দে।"


"অসভ্য।"


" অসভ্যের বউ।"


" উফ।"


"উফফ।"


" উজ্জ্বল ভাই।"


" রুমু বউ।"


উজ্জ্বলের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রয় মেয়েটা।এই ছেলে দিন দিন একটু বেশি জ্বালাচ্ছে।


" এভাবে তাকায় না ডার্লিং বুকে লাগে।"


" যাবেন আপনি?"


" রুমু দে একটা চুমু।"


" আমার নামের মান সম্মান ঘেটে ঘ করে দিচ্ছেন আপনি।"


রুমুর রাগান্বিত মুখটা দেখতে উজ্জ্বল হাসে।দ্রুত রুমুকে হেঁচকা টেনে কপালে একটা চুমু খায়।মেয়েটা অবাক হয় রাগ দেখিয়ে কিছু বলার আগে উজ্জ্বল ছাদ পেরিয়ে গাছে উঠে যায়।

.

উজ্জ্বলের কথায় আজ পাত্তা দিল না রুমু।তাকে বলেছিল রুমের দরজা বন্ধ করে যেন ঘুমিয়ে থাকে অথচ মেয়েটা বসার ঘরে ভাবিকে নিয়ে টিভি দেখছে।এখন রাত প্রায় এগারোটা।কলিং বেল বাজতে দরজা খুলে দেয় রুমুর ভাবি আনিকা।রুমুরা ভাই বোন দুইজন।বড় ভাই রাশেদ।বয়স ত্রিশের কোঠায় পৌঁছে গেছে।বাবার ব্যবসা দেখাশোনা এবং কীভাবে আরো উন্নত করা যায় সেই প্রয়াসে মত্ত থাকে ছেলেটা।


বসার ঘরে এসে রুমুকে দেখতে পেয়ে সরু চোখে তাকালো রাশেদ।হাতের সিলভার রঙের ঘড়িটা খুলে দিল আনিকার হাতে।

রিমোটের সাহায্যে টিভি অফ করে রুমুর মুখোমুখি বসলো সে। 


" তোর পড়া নেই রুমু?"


"পড়া শেষ।"


ডাহা মিথ্যা কথা অনায়াসে বলে ফেললো মেয়েটা।সন্ধ্যার পর সে আজ পড়তে বসেনি।আনিকা আড়চোখে তাকালো, সে জানে রুমু আজকে পড়তে বসেনি এই সত্য কথা রাশেদ জানলে বেজায় রেগে যাবে।


" রুমু তোর ফোনটা কোথায়?"


কলিজায় মোচড় দিল মেয়েটার।ভাইয়া কখনো ফোন এভাবে চায় না তবে আজ কেন?


" ক..কেন ভাইয়া?"


" কৈফিয়ত দেওয়া লাগবে তোকে?তুই যে কি কি করিস কি ভেবেছিস আমি খবর পাব না?"


আচমকা রেগে গেল রাশেদ।প্যান্টের বেল্ড খুলে হাতে তুলে তেড়ে যায় রুমুর দিকে।ঘটনাটা এতটাই তাড়াতাড়ি ঘটে যায় রুমু হতবাক স্তম্ভিত।

রাশেদকে দ্রুত বাধা দেয় আনিকা।রাশের মেজাজ সর্বদা একটু বেশি গরমে থাকলেও কখনো মারামারির দিকে যায়নি।বিয়ের এত বছরেও স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেনি।তাহলে আজ একমাত্র বোনকে এভাবে মারতে আসার কারণ কী?রাশেদের গলার আওয়াজে ছুটে আসেন তার মা রাবেয়া এবং বাবা সৈয়দ ইসমাইল।আনিকাকে সরিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো রাশেদ।একটি ভিডিও অন করে ফোন বাড়িয়ে দিল ইসমাইলের দিকে।

ভিডিওটি দেখে কপালে ভাজ পড়ে যায় রাবেয়া এবং ইসমাইলের।রাশেদ আচমকা রুমুর গালে চড় বসালো।মুহূর্তে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সকলে। 


" এই চড়টার কথা যেন আজীবন তোর মনে থাকে।তুই সৈয়দ বাড়ির মেয়ে হয়ে এসব করিস!টিকটকে নাচানাচি করিস!তুই আমার বোন আমার বোন হয়ে এতটা লিমিটক্রস করার সাহস তুই কি করে পেলি?তোর বুক কাঁপলো না? এই রাশেদ যদি জানে তোর কি হবে বেয়াদব মেয়ে তোর ভাবনায় এলো না?তুই এক্ষুনি এই টিকটক একাউন্ট ডিলেট করবি।"


ইসমাইল ছেলেকে টেনে সরিয়ে আনলেন।


" ব্যপারটা ঠান্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করা যায়।এতটা চড়াও হচ্ছো কেন?"


" বাবা তোমার আশকারায় ও এতটা সাহস পেয়েছে।আগেই বলেছিলাম ফোন কিনে দিও না।পাড়ার একটা ছেলে আজ আমাকে ভিডিওটা দেখালো বিশ্বাস করবে না আমার মাথায় সাথে সাথে আগুন জ্বলছিল।তোমার মেয়ে শুধু কি এসব করছে?সে প্রেমও করছে।একটা না একেরপর এক তার ক্রমাগত চলছে।আজ কলেজে যায়নি কেন জিজ্ঞেস করো।আমি আজ ওর কলেজে গিয়েছি ওর নামে খোঁজ নিয়েছি গত এক্সামেও তিন সাবজেক্ট ফেল করেছে সে বাসায় জানিয়েছে?বাসার স্যার কি করেন এসব দেখেন না?তার প্রত্যেকটা ক্লাসমেট থেকে আমি খোঁজ নিয়েছি সে আর ঠিক কি কি করে।"


রাশেদ থামলো।ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হেঁচকি উঠে গেছে রুমুর।বাম গালে কেউ যেন বড় পাথর নিক্ষেপ করেছে।নিজেকে সামলে নেওয়ার আগে এবার ক্ষেপে গেলেন রাবেয়া।বাম গালে পালটা চড় পড়লে ছিটকে পড়লো সোফায়।আনিকা দ্রুত শাশুড়ীকে বাঁধা দিল।রাবেয়া রাগান্বিত স্বরে বলেন,


" বলেছিলাম বিয়ে দিয়ে দাও শুনলে না কেউ আমার কথা।


রাশেদ সহমত জানিয়ে বলে,


"ভেবেছিলাম ইন্টার শেষ করুক কিন্তু আর নয় আমার বন্ধুর সেই কাজিনরা তাড়া দিচ্ছে আমি তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে রেখেছি।আজকেই তাদের জানাবো আমরা রাজি যতদ্রুত সম্ভব এই অসভ্যটাকে নিয়ে বন্দি করুক।"


" তারা বিদেশ থেকে কবে না কবে আসবে।তার থেকে ভালো তোর খালতো ভাই নিরবের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দে।তোর খালা আমাকে.... "


রাবেয়ার কথা শেষ হওয়ার আগে খেপে যায় রুমু।রক্তিম চোখ মুখে হিসহিসিয়ে বলে,


" তোমার বোনের ছেলেকে আমি বিয়ে করবো না।গলায় ছুরি ধরে হুমকি দিলেও করবো না।ওই ইতরকে বিয়ে করার চাইতেও ফাঁ সি দেওয়া অনেক ভালো।"


রাবেয়া কিছু বলার আগেই রাগ দেখিয়ে প্রস্থান করে মেয়েটা।রাগে জেদে ভয়ে তার শরীর কাঁপছে।

সাথের বন্ধুদের টিকটক করতে দেখে সেও করছে বলা যায় নেশা তৈরি হয়েছে।যদিও এর আগে তিনটা একাউন্ট উজ্জ্বল উড়িয়ে দিয়েছে।উজ্জ্বল কখনো চায় না রুমু এসবে জড়িয়ে যাক।কিন্তু উজ্জ্বলকে সর্বদা রাগিয়ে দিতে বেশ মজা পায় মেয়েটা তাইতো এসব দিকে আরো এক ধাপ এগিয়েছে সে।


এত এত প্রেম করা ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব করা এসব করার মূল উদ্দেশ্য উজ্জ্বলকে রাগিয়ে দেওয়া।উজ্জ্বলের সেই রাগান্বিত, হিংসাত্মক মুখটা দেখতে রুমুর যে বেশ শান্তি লাগে।ছোট বেলা থেকে উজ্জ্বলের যারপরনাই পাগলামো গুলোতে সে অভ্যস্ত এই পাগলটাকে ক্ষেপিয়ে যে বেশ মজা পায় সে।

.

রুমুর নাম্বার বন্ধ পেয়ে চিন্তায় মাথা ধরে এলো উজ্জ্বলের।মেয়েটার উপর দিয়ে জানি কোন ঝড় গেল।রাশেদ যে রুমুর টিকটকের ব্যপারে শাসন করবে এটা উজ্জ্বল আগেই জানতো তাই অগ্রিম কিছুই জানায়নি রুমুকে।এই মেয়ের একবার শিক্ষা হওয়া উচিত অতি বাড় বেড়েছে।


উজ্জ্বল মাঠের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রুমুর অপেক্ষায়।উজ্জ্বল অর্নাস ৩য় বর্ষের ছাত্র।একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে সে।অপরদিকে রুমু একই প্রতিষ্ঠানের ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে।মাঠের একপ্রান্তে ভার্সিটি ভবন অপরপ্রান্তে কলেজের ভবনগুলো।তাই রুমুর সাথে উজ্জ্বলের দেখা হওয়া কঠিন কিছু নয়।


গেট দিয়ে মাক্স পড়া রুমুকে দেখে ভ্রু কুচকে যায় উজ্জ্বলের।এই মেয়েতো মাক্স পড়ে আসে না তবে আজ কেন?উজ্জ্বল এগিয়ে যায় রুমুর হাত টেনে নিয়ে যায় এক কোনে।


" কিরে মাক্স পড়লি কেন?"


" কাল আপনি সবটা জেনেও আমাকে বললেন না কেন উজ্জ্বল ভাই?"


" সতর্ক করেছিলাম তো।আমার কথা শুনিসনি।"


" এভাবে কেউ সতর্ক করে?আমাকে জানিয়ে রাখলে কি হতো?"


উজ্জ্বল প্রত্যুত্তর না করে রুমুর মাক্স নামিয়ে দিল।মেয়েটার বাম গালে দু'আঙুলের ছাপ স্পষ্ট ঠোটের কোন কেটেছে।উজ্জ্বলের বুকটা কেঁপে উঠলো।রুমুর গাল ছুঁইয়ে ধমক সুরে বলে,


" সবকিছুতে তোর পাকনামো।বলেছিলাম তো ঘুমিয়ে যাবি তাহলে এমন হতো না।আর এই শিক্ষাটা তোর দরকার ছিল অতি বাড় বেড়েছিলি।"


" এবার আপনিও মারুন।মে রে ফেলুন আমায় সকলে মিলে।"


রুমুর চোখ ঝাপসা হয়।কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে।


" খেয়ে এসেছিস?"


" যে মা র টা খেয়েছি আর কিছু খাওয়ার প্রয়োজন নেই।"


" চল আমার সাথে।আগে পেট পুরে খাবি তারপর ক্লাসে যাবি।"


" খাব না আমি।ছাড়ুন আমার হাত।"


" চুপ কর।"


উজ্জ্বল টেনে নিয়ে গেল রুমুকে।ছেলেটার শক্ত হাতের সাথে কিছুতেই পেরে উঠছে না সে।


" উজ্জ্বল ভাই ছাড়ুন।এবার আপনিও কি মা র বে ন?কি খাওয়াবেন মা র?"


উজ্জ্বল চুপচাপ হাটতে থাকে।রুমু পুনরায় হাত ঝাকি দিয়ে বলে,


" কি হলো বলুন কি খাওয়াবেন?"


" আমাকে খাওয়াবো।খাবি?"


#চলবে...


আসসালামু আলাইকুম পাঠক।গল্পের ছোট্ট গ্রুপে আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ..