গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ২৬

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


পর্বঃ ছাব্বিশ


(৭১)


বাহার ভাই বিহীন আজ তিন তিনটে দিন কেটে গেলো। কেমন নীল বিষাদ সমুদ্রে কূল কিনারা বিহীন দিন গুলো। সকাল, দুপুর,রাত নিজেদের মতন মুগ্ধতা ছড়াতে যেন ব্যর্থ হলো তিনটে দিনে। চিত্রার মনে যেই গভীর অমাবস্যা নেমেছে, সেই অমাবস্যার আঁধার ছাপিয়ে সূর্য উঠতে পারে নি। রাত গুলো কেমন ডুকরে কেঁদে উঠে হাহাকার করে অভিযোগ করে যায় অনাকাঙ্খিত বিচ্ছেদের। চিত্রা কেবল ফ্যালফ্যাল করে দেখে সেই আর্তনাদ। এরচেয়ে বেশি কিছুই যে তার করার নেই। তন্মধ্যেই কলেজ থেকে আবারও মডেল টেস্টের তারিখ ধার্য করা হলো। খুব শীগ্রই পরীক্ষা। চিত্রা বিষাদ তুললো বন্দী খানায়। চেয়ার টেনে মুখ ডুবালো বইয়ের পাতায়, কিন্তু কী অদ্ভুত! বইয়ের লিখা কেমন ঝাপসা! চোখের জল গুলোও কী বাহার ভাইয়ের মতন বে*ঈমা*নী করছে? অশ্রু তার অথচ ঝরছে বাহার ভাইয়ের নামে। এমন শোক বিধাতা কেনো আমাদের দেয়? 


তীর্যক রোদের তপ্ত দুপুর। জানালা গলিয়ে রোদ এসে পড়ছে চিত্রার পড়ার টেবিলে। ঘরের ফ্যান বন্ধ, কারেন্ট নেই। চিত্রা ছাড়া পুরো ফ্লাটে আর কোনো জনমানসের চিহ্ন নেই। মা নিজের কলেজ গিয়েছে, ভাইজানও গিয়েছে ভার্সিটি। পুরো ফ্লাটে চিত্রা একা। শোক পালনের মহোৎসব তাই ঝেঁকে ধরেছে তাকে। চিত্রা খুব চেষ্টা করলো পৃথিবীর সকল ধ্যান সে বইয়ের উপর দিতে। বারংবার তার চেষ্টা বিফলে গেলো। হাজার চেষ্টা করেও সে ধ্যান দিতে পারলো না বইয়ের পাতায়। কী বিরক্তিকর ব্যাপার স্যাপার! চিত্রা সশব্দে চেয়ার টা পিছে ঠেলে উঠে দাঁড়ালো। না চাইতেও বার বার বাহার ভাইয়ের সেই এলোমেলো চুলের ঢেউ গুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। লোকটা কী জাদু করলো?


ঘেমে-নেয়ে একাকার চিত্রার শরীর। সেই ঘর্মাক্ত মুখখানা নিয়েই সে বারান্দায় দাঁড়ালো। আশেপাশের রাস্তা বেশ নীরব। মাঝে মাঝে রিকশার টুং টাং শব্দ ভেসে আসে এরপর আবার নিশ্চুপ হয়ে যায়। নিশ্চুপ রাস্তার দিকে নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে রইলো চিত্রা মিনিট পাঁচ। চোখের সামনে ভেসে উঠলো চিলেকোঠার ঘরটা। বাহার ভাইয়ের গিটারের মোহনীয় সেই টুং টাং সুর। ঠোঁটের ভাঁজে রাখা সিগারেটের ধোঁয়া উড়ানোর দৃশ্য। চোখের বেকারত্বের হাহাকার। বাহার ভাই টা যে বড্ড একা তা এই এক বছরে বেশ ভালো করেই জানা হয়ে গেছে চিত্রার। সেই একা মানুষটাই কিনা চিত্রাকে একা করে দিয়ে গেল! চিত্রার মনে জেগেছে আরও একটা সংশয়। বাহার ভাই কেনো অহি আপার বিয়ের পরই চলে গেলেন? তবে কী বাহার ভাইয়ের মনের মনিকোঠায় অহি আপা যত্নে লুকানো ছিলো? নিজের ভাবনায় নিজেই কেঁপে উঠলো। না, না, বাহার ভাইয়ের মনে অন্য কারো ঠাঁই আছে ভাবলেই কেনো যেন বুক মোচড় দিয়ে উঠে, কেমন ব্যাথা ব্যাথা লাগে। অহি আপার মনে যে বাহার ভাই আছেন, সেটা কী চিত্রা জানতো না? অবশ্যই জানতো। কিন্তু জেনেও সে না জানার ভাব ধরে ছিলো কেবল নিজের স্বার্থে। বাহার ভাই যে কেবল তার। কিন্তু সে ভুল, বাহার ভাইরা হয়তো কারো হয়না। বাহার ভাইদের ভালোবেসে প্রতিটা নারী অহি হয়ে রয়ে যায়। বাহার ভাইরা বিশাল জীবনের অপ্রাপ্তি হিসেবেই হয়তো সদা থেকে যায়। চিত্রার এই আঠারো বছরের জীবনে, পর পর এত অপ্রাপ্তি কখনো মেলে নি। খুব সুন্দর, হাসি হাসিই তো কেটেছে গত হওয়া  বসন্ত গুলো। তবে এবার কেন বসন্ত কেবল চৈত্রমাসের খরা হয়ে রইলো? এবার কেনো বসন্ত এত বিবর্ণ। 


ভাবনার মাঝেই কলিংবেলের কৃত্রিম শব্দে ভাবনার রাজ্যে ভাঁটা পড়লো। চিত্রা বিষন্ন দেহটাকে টেনে দরজা অব্দি নিয়ে গেলো। কিন্তু দরজা খুলে সে অবাক। আশেপাশে কেউ নেই, তবে কলিংবেল বাজালো কে! বিরক্ত হয়ে যখন চিত্রা দরজা আটকাতে নিবে তখনই দরজার সামনে ইট দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা কাগজ চোখে পড়লো। চিত্রা ক্ষানিকটা কৌতূহল বশত কাগজটা কুড়িয়ে নিলো, আশপাশে বেশ ভালো করে চোখ বুলিয়েই দরজা টা আটকে দিলো। হাতের কাগজটা নিয়ে এসে আরাম করে বসলো নিজের খাটে। কাগজটা মূলত কেবল কাগজ না। চিঠিও বলা যায়। 


কাগজটা মেলে ধরতেই অসম্ভব মুগ্ধতা ভরা লিখা জ্বলজ্বল করে উঠলো। চিঠির শুরুতেই 'প্রিয় রঙ্গণা' শব্দটা দেখে সে বিমূঢ় হয়ে গেলো। দুই তিনবার চিঠির সম্বোধন করা শব্দটায় চোখ বুলালো। তার বাহার ভাই এসেছিল! এ চিঠি কী তবে বাহার ভাই দিয়ে গেলো? চিত্রা চিঠি হাতে নিয়েই আবার বারান্দার দিকে ছুটে গেলো বাহার ভাইয়ের দেখা পাওয়ার আশায়। কিন্তু চিত্রার এমন আশা পূরণ হলো না। হাজার ছটফট করা মন নিয়ে, আকাঙ্খা নিয়েও সে দেখতে পেলো না বাহার ভাইকে। মন খারাপ হলো তার। তুমুল মন খারাপ নিয়েই সে চিঠিটা পড়া শুরু করলো, 


প্রিয় রঙ্গণা, 

আমি জানি, চিঠির শুরুর সম্বোধনী টা দেখেই তুমি তুমুল আগ্রহে আমায় খুঁজে বেড়াবে। এই মুহূর্তে তুমি তাই করছো, তাই না? তুমি এত বো* কা কেন গো? যখন আমার অনুভূতিই তোমার হাতের মুঠে তখন আমার উপস্থিতি দিয়ে কী আসে যায়! তুমি অনুভব করলেই দেখতে তোমার হাতের মুঠোয় ঐ চিঠির ভাঁজে আমি আছি। অথচ তুমি তো তত চালাক না, চালাক হলে কী আর আমার অত কাঠখড় পোড়াতে হতো! তুমি নাকি পড়াশোনা শিকেয় তুলে মন খারাপের উৎসবে মেতেছো?  এমন হেলাফেলা করলে বাহার ভাইয়ের রিকশার খরচ দিবে কীভাবে? বাহার ভাইয়ের তো ভাগ্যে চাকরি নেই, এখন যদি রঙ্গণাও কিছু করতে না পারে তবে আমাদের সংসার হবে কী করে? বুঝলে রঙ্গণা, তুমি বড্ড বো* কা, তাই তো সংসার করার জন্য খুঁজে খুঁজে একমাত্র বাহার ভাইকেই পেলে। জেনেশুনে কেউ নিজের পায়ে কুড়াল মারে বলো তো? আমায় চেয়ে বড্ড ভুল করলে রঙ্গণা। আমায় চাইলে কেবল দুঃখের উৎসব পাবে, আমায় পাবে না। তুমি কী বিশ্বাস করো তোমার বাহার ভাই কোনো খারাপ কাজ করতে পারে? আমি জানি, তুমি তোমার বাহার ভাইকে এতটাই বিশ্বাস করো যে কখনোই তাকে ভুল বুঝবে না। কিন্তু খুব শীগ্রই হয়তো তোমার সেই বিশ্বাসের আয়না চূর্ণবিচূর্ণ হতে চলছে। তোমার চূর্ণবিচূর্ণ বিশ্বাসের ভাঙন আমি দেখতে পারবো না যে। তোমার হয়তো অনেক মানুষ আছে, আমার কেবল তুমিই আছো। তোমার জন্যই হয়তো আমি চাকরির সন্ধান করে ছিলাম। একটা ছোটো সংসারের সাধ করেছিলাম। সময় ও পরিস্থিতির কাছে আজ সব অসহায়। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত অব্দি আমি চাই তুমি আমায় বিশ্বাস করো। তোমার চোখে অবিশ্বাস আমায় যে বেঁচে থাকার পরও মেরে ফেলবে। খুব শীগ্রই আমাদের দেখা হবে রঙ্গণা। আমাদের সংসারও হবে। আমরা এ শহর ছেড়ে খুব দূরে চলে যাবো। যাবে তো?


ইতি

বাহার ভাই।"


চিঠিটা হাতের ভাঁজে রেখে চুপ করে রইলো চিত্রা। বাহার ভাইয়ের চিঠির মাঝে কেমন ধ্বংসের আভাস! খুব খারাপ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা। চিত্রার বুক কাঁপলো। বাহার ভাই কি তবে কোনো গোলকধাঁধায় আটকে গেলো! এধার ওধার হাতড়েও চিত্রা উত্তর পেলো না নিজের প্রশ্নের। তবে সে বাহার ভাইয়ের সাথে সংসার করবে, যে-কোনো মূল্যে। যেহেতু সংসার করার জন্য অনেকদূর যেতে হবে সেহেতু আগে নাহয় মহিনের মৃত্যুর রহস্য টা পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে। বেশখানিকটা প্রমাণ তো সে পেয়ে গেছেই। এখন কেবল মোক্ষম সময়ের অপেক্ষা। তারপর চিত্রা আর বাহার নাহয় শহর ছাড়বে। চিত্রা জানে, বাহার ভাইদের কোনো কলঙ্ক হয় না। 


(৭২)


রাত তখন এগারোটা। বাহারের চিঠিটা চিত্রা সারাদিনে বোধহয় শ'খানেক বার পড়ে ফেলেছে। এখনও পড়ছিল, তন্মধ্যেই কলিংবেলের শব্দে তার মনযোগে বিঘ্ন ঘটে। বুকের মাঝে আরও একবার ছলাৎ করে উঠে। আবারও দুপুরের মতন অনাকাঙ্খিত চিঠি আসতে পেরে ভেবেই সে ছুটে গেলো মেইন দরজার সামনে। মুনিয়া বেগম রাতের রান্না করছিলেন, দরজার শব্দ শুনে সেও হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো দরজার দিকে। 


চিত্রা মাকে দেখে নিজেকে সংযত করে ধীর গতিতে দরজা খুলতেই হতভম্ব চোখে সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মুনিয়া বেগমের চোখেও ভরা বিস্ময়। অবাক কণ্ঠে বললো, 

"তুমি এখানে যে! আকাশের চাঁদ মাটিতে কেন?"


শেষের কথাটায় তাচ্ছিল্যের ছোঁয়া। দরজার ওপাশে দাঁড়ানো নুরুল সওদাগর তেমন পাত্তা দিলো না বোধহয় সে তাচ্ছিল্যে। বরং বেশ কঠিন স্বরে চিত্রাকে শুধালো, 

"ঐ ল* ম্পট ছেলেটা কোথায়?"


চিত্রা ভ্রু কুঁচকালো, অবুঝ কণ্ঠে বললো, 

"জি?"


"তোমাদের পছন্দের ঐ ভবঘুরে নে* শাখোর ছেলেটা কোথায়?"


চিত্রা এবার বোধহয় বুঝলো বাবা কার কথা বলছে। বোঝার সাথে সাথেই তার চোখ মুখে বিরক্ত ছড়িয়ে পড়লো। রাগী কণ্ঠে সে তার বাবাকে বললো,

"উনার একটা নাম আছে, আব্বা। ভদ্র ভাবে বলতে পারলে বলুন নাহয় কথাই বলবেন না।"


নুরুল সওদাগর তাজ্জব বনে গেলেন। এতদিন তার মেয়ের চোখ-মুখে যে সম্মান দেখেছিল নিজের জন্য, আজ আর সেটা দেখতে পেলো না। লেবু অতিরিক্ত চিপলে সেটা তিতা হয়ে যায়। চিত্রাই তার বহিঃপ্রকাশ। 


নুরুল সওদাগর তবুও দমে গেলেন না, কঠোর হয়ে বললেন,

"তোমার বাহার ভাইকে পেলে অবশ্যই আমাকে কল দিবে। কারণ ওরে আমাদের পুরো পুলিশ টিম খুঁজছে।"


মুনিয়া বেগম অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললো, 

"ওরে খুঁজছে কেন তোমার পুলিশ টিম? মানুষের ভালো তোমাদের কী সহ্য হয় না?"


নুরুল সওদাগর উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। মুখ বাঁকিয়ে বললো, 

"ভালো! কার ভালোর কথা বলছো? ঐ খু* নিটার? জানো সে কী করেছে? তার দশম শ্রেণীর ছাত্রীকে ধ* র্ষণ করে খু* ন করেছে। তোমাদের আদরের বাহার। সে জন্যই তো পালিয়েছে বাসা থেকে।"


চিত্রা হতভম্ব চোখে বাবার পানে তাকালো। অনবরত তার পা কাঁপছে। বাহার ভাই অমন করেছে! 


#চলবে


[প্রথমেই রেগে যাবেন না, মনে করুন আমারা প্রায় শ্বাসরুদ্ধকর জায়গায় চলে এসেছি। এখন থেকে থাকবে টান টান উত্তেজনা। ভালোবাসা রইলো।]

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ২৫

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


পর্বঃ পঁচিশ 


(৬৮)


তুমুল বর্ষণ মাথায় নিয়ে, অনাকাঙ্খিত ভাবে হয়ে গেলো নওশাদ আর অহির বিয়ে। বেশ সাদামাটা এবং অপ্রত্যাশিত ছিলো মধ্যরাতের সেই বিয়েটা। আর সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় হলো, বাহার ভাই ছিল সে বিয়ের প্রধান সাক্ষী। নওশাদ যে এত দ্রুত সব ব্যবস্থা করতে পারবে তা অহির ধারণার বাহিরে ছিল কিন্তু তবুও সে নড়বড়ে অনুভূতি নিয়ে শক্ত করে সেই মানুষটার হাত ধরেছিল। যা হবে দেখা যাবে তার ভিতরে উপস্থিত। আর সবটা সম্পূর্ণ হওয়ার বড় ভূমিকা বাহার ভাইয়ের। 


অহি কাজী অফিসে বাহার ভাইকে সব প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেসও করেছিল "বাহার ভাই, আপনি সিউর কীভাবে ছিলেন যে বিয়েটা আমি করতামই?"


বাহার তখন মুচকি হেসে বলেছিল,"মানুষ বরাবরই ভালোবাসার কাঙালি। যখন কেউ সেই ভালোবাসা উজাড় করে দেয় তখন খুব কম সংখ্যক মানুষই তা ফেরাতে পারে। ঘৃণা দেখেও চুপ থাকা যায় কিন্তু ভালোবাসা দেখলে তার বিপরীতে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। আর আমি তোমাকে প্রথমে কেনো জিজ্ঞেস করেছিলাম আমায় ভালোবাসো কিনা বলো তো? আমি তোমাকে কিঞ্চিৎ ভাঙার চেষ্টা করেছি যেন তুমি খুঁটি শক্ত করে ধরো। আর আমি সক্ষম।"


বাহারের কথায় চুপ রইলো অহি। ভালোবাসবে না করেও আরো একবার ভালোবাসলো বাহারকে। এ-ই শেষ। এরপর আর মানুষটাকে ভালোবাসা হবে না। আর মুগ্ধ হওয়া হবে না মানুষটার উপর। মনে একজন রেখে আরেকজনের সাথে ঘর করা যে পাপ। আর অহি সে পাপ কখনো করবে না। মনের মানুষকে নাহয় মন থেকে চিরতরে বিতারিত করবে। 


এরপরেই খুব নীরব ভাবে হয়ে গেলো একপাক্ষিক ভালোবাসার বিচ্ছেদ, এবং আরেকটা একপাক্ষিক ভালোবাসার সন্ধি। প্রকৃতির নিয়মই এটা, কোথাও ভাঙবে সে আবার কোথাও জোড়া লাগবে।


(৬৯)


সওদাগর বাড়িতে মুখ থমথমে ভাব। সেই বাড়ির সকল সদস্য চিত্রা, তুহিনও সহ আজ সে বাড়িতে এসেছে। নওশাদের বাবা-মাও এসেছে। বাড়ির সবচেয়ে ঠান্ডা মেয়ে এমন একটা কাজ করতে পারে তা যেন কারো বিশ্বাস হচ্ছে না। সবাই কেবল বিস্মিত নয়নে তাদের দেখে যাচ্ছে ঘন্টাখানেক যাবত। 


প্রথম কথাটা আফজাল সওদাগরই বললেন। গম্ভীর কণ্ঠে সে অহির দিকে তাকিয়ে শুধালেন,

"তোমার যদি নওশাদকে এতই পছন্দ হয়েছে, আমাদের বললেই তো পারতে। আমরা তোমার পছন্দ কখনো অপূর্ণ রাখি নি।"


বড়চাচাকে বাড়ির বাচ্চারা বরাবরই বেশ পছন্দ করে। তাই এ মানুষটার কথার বিপরীতে অহি কোমল হয়েই বললো,

"আমার পছন্দের সব তোমরা পূরণ করেছো তা আমিও মানি। তাই বলে আমার ভালোবাসার সব পূরণ করবে তা তো না। সেই সংশয় থেকেই এমন কাজ করা।"


অহির উত্তরে আফজাল সওদাগর তপ্ত শ্বাস ফেললেন। কিন্তু পরের কথাটা উচ্চারণ করলেন অবনী বেগম। কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললেন, 

"তোমার ভালোবাসাও আমরা অপূর্ণ রাখতাম না।"


"ও তাই নাকি? সাইকোলজি পড়তে চেয়েছিলাম যেটা আমার ভালোবাসা ছিলো, তোমরা ভর্তি করিয়ে ছিলে বাংলায়। ছয়-সাত বছরের আমি আবদার করে ছিলাম তোমাদের সাথে থাকার, ঠাঁই হয়েছিল আমার হোস্টেলে। এভাবেই পূরণ করতে তাই না?"


মেয়ের তাচ্ছিল্য মাখা কণ্ঠে মাথা নত হয়ে আসে অবনী বেগমের। মেয়েকে সে যখন হোস্টেলে দেয় তখনও তার কাছে জীবনের মানে ভিন্ন ছিল। আজকের অবনীর আর তখনের অবনীর পার্থক্য অনেক। কিন্তু মানুষ তা আর জানলো কই? 


"অহি, তোমার মায়ের সাথে এভাবে কথা বলছো কেন?"


নুরুল সওদাগরের গম্ভীর কণ্ঠে অহির তাচ্ছিল্য ভাব আর বিস্তৃতি লাভ করলো। খুব করে মানুষটাকেও দুটো কথা শুনাতে ইচ্ছে হলো কিন্তু সে শুনালো না। যতই হোক, নওশাদ এবং তার বাবা-মা সওদাগর বাড়ির মেহমান। তাদের সামনে এমন আচরণ শোভনীয় না। 


নওশাদের বাবা-মা এতক্ষণ চুপই ছিলো। সওদাগর বাড়ির কথা কাটাকাটি থামার অপেক্ষায় ছিলেন হয়তো তারা। তাই তো সওদাগর বাড়ির মানুষদের কথা থামতেই মুখ খুললেন নওশাদের মা নওরিন। তুমুল আশ্চর্যের সাথে সে প্রশ্ন করলেন,

"নওশাদ, তুমি হুট করে এমন সিদ্ধান্ত কেনো নিলে?"


"হুট করে তো নেই নি, মা। তোমাদের তো জানিয়ে ছিলাম কিন্তু তোমরাই আমাকে কোনো পজিটিভ উত্তর দিতে পারো নি। তাই বাধ্য হলাম।"


"কেবল একবার জানিয়ে ছিলে। মানুষ দিনের পর দিন অপেক্ষা করে বাবা-মাকে মানায়। অধচ ইতিহাসে তুমিই একমাত্র ছেলে যে একবার মাত্র কথা কাটাকাটি করে বিয়ে করে ফেলছো। কী অদ্ভুত!"


"বিয়েই তো করবো মা, কোনো অপরাধ তো না। তো এত মানামানির কথা আসছে কোথা থেকে? আমি কিংবা অহি, দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক। তাই তোমাদের এমন অদ্ভুত আচরণ শোভা পাচ্ছে না।"


"দেখলে দেখলে, তোমার ছেলের কথা শুনলে? মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?"


নওরিন খাতুনের স্বামীর প্রতি অভিযোগ। ইলিয়াস খান মিনমিনে কণ্ঠে বললো, 

"যা হয়েছে তা কি বদলাতে পারবে? এরচেয়ে মেনেই নেও।"


স্বামীর জবাবে হতাশ নওরিন। তিনি ভেবেছেন তার স্বামী হয়তো তার পক্ষ থেকে একটু হলেও কিছু বলবে। তা আর হলো কই! হতাশার শ্বাস ফেলে তিনি বললেন,

"এমন হুটহাট বিয়ে আমি মেনে নিতে পারছি না।"


"এখন করণীয়! আলাদা থাকবো?"


ছেলের ঝটপট উত্তরে ব্যাথিত দৃষ্টি নিয়ে তাকান নওরিন খাতুন। দশমাস দশদিন যে ছেলেকে গর্ভে ধারণ করলো, ছেলে ভূমিষ্ট হওয়ার পর এত গুলো বছর যে মা বুকে আগলে রাখলো, একটা মেয়ের জন্য সে মায়ের মুখের উপর এমন প্রশ্ন হয়তো একটা সন্তানই করতে পারে। কি আর করার? যুগ বদলের খেলায় এসব হয়তো স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে কিছুটা রাগ এই মেয়েটার উপরও বর্তাচ্ছে। কিছুটা সময় মৌণ থেকে নওরিন খাতুন তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন,

"আমার কখনোই পছন্দ ছিলো না অহি। কিন্তু আমার ছেলের আবার ওকেই পছন্দ। যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমার পছন্দ অপছন্দে কিছু আটকাবে না। আমি না চাইলেও আমার ছেলে ওর সাথে সংসার করবে আমি জানি। আমার ছেলের হয়তো মায়ের প্রয়োজন নেই অথচ আমার কিন্তু ছেলের প্রয়োজন আছে। একান্তই আমার সেই স্বার্থে আমি বিয়েটা মেনে নিচ্ছি। তবে আমাদের বা আপনাদের পরিবারের একটা মান সম্মান আছে। সেই মান সম্মানের ভিত্তিতে আমি চাচ্ছি বিয়েটা আবার বড় করে দিতে।"


মায়ের কথায় নওশাদের মুখটা ছোটো হয়ে এলো। মা যে তার কষ্ট পেয়েছে তাও বুঝতে পারলো সে কিন্তু এমন জেদ না দেখালে হয়তো পরিস্থিতি ঘুরে যেতো। তাই এমন কঠিন হওয়া। 


নওরিন খাতুনের স্পষ্ট কথার ধাঁচ অহির বেশ ভালো লাগলো। মানুষটা হয়তো উপর উপর শক্ত কিন্তু ভেতর ভেতর খুব কোমল। নওরিন খাতুনের প্রস্তাবে রাজি হলেন আফজাল সওদাগর। মহিলজ যে বেশ বুদ্ধিমতী তা আর বুঝতে বাকি রইলো না কারো। 


বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো পঁচিশ দিন পরে। অহির মায়ের মতামতও নেওয়া হলো। বাড়িতে পরে গেলো আনন্দের ঢেউ। সব কিছুতে নিরেপক্ষ ভূমিকা পালন করলো রোজা সওদাগর এবং চাঁদনী। না আনন্দ হলেন না অন্য কিছু। ড্রয়িং রুমে উপস্থিত থাকার কড়া নির্দেশ দেওয়ায় তারা কেবল তা পালন করলো। এছাড়া কিছুই না। চিত্রা আর চেরি তো আনন্দে আত্মহারা কিন্তু চিত্রা চাইলেও সে আনন্দ দেখাতে পারছে না। এ বাড়িটা যে তাকে পর করেছে। পরের বাড়িতে শোক মানায় আনন্দ না। 


(৭০)


অনেকদিন পর নিজের বাড়িতে পা রেখে সংশয়ে কাঁপছে চিত্রা। যে বাড়িতে একসময় বিনা বাঁধায় ছুটে বেড়িয়েছে, সে বাড়ির দেয়াল ছুঁতেও যেন আজ করছে ভয়। কেমন পর পর লাগছে সবটা! 


বাড়ির সকলে যখন মিষ্টি ভাগাভাগি করতে ব্যস্ত চিত্রা এক ফাঁকে চলে গেলো চাঁদনী আপার কাছে। ছোটো থেকে এ অব্দি আপা তাকে কম আদর করে নি। আজ যদি আপা মুখ ফিরিয়ে থাকে তবে চিত্রার দায়িত্ব আপার কাছে ক্ষমা চাওয়া। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। 


চাঁদনী নিজের ঘরের কিছু জামাকাপড় গুছচ্ছিল। তন্মধ্যেই ঘরে দরজায় টোকার শব্দ, ক্ষীণ শব্দে চিত্রা বললো,

"আসবো?"


চাঁদনী একবার পলক ঝাপটিয়ে চিত্রার দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মনযোগ দিয়ে বললো,

"আয়।"


চিত্রা আসলো। ছোটো ছোটো পা ফেলে ঘরে থাকা চেয়ারটাতে বসলো। বুকে তখন তার তুমুল ঝড়। এত কাছের বড় আপার সাথে কথা বলতেই হাত-পা তার কাঁপছে। তবুও সে বললো, 

"কেমন আছে, আপা?"


"যেমন চেয়েছিলি।"


বড় আপার কাঠ কাঠ উত্তরে মনে মনে হোঁচট খেলো চিত্রা। কণ্ঠধ্বনি বার বার জড়িয়ে এলো তবুও সে ক্ষীণ স্বরে বললো, 

"আমি তো ভালোই চেয়েছিলাম আপা।"


"তাহলে আর কি, ভালোই আছি।"


চিত্রা আর কথা আগানোর শক্তি পেলো না। কত কথা সাজিয়ে এসেছিলো কিন্তু এখন সব অগোছালো হয়ে গেছে। ঘরে দু'জন মানবী চুপ হয়ে রইলো। কত কথা বলতে চেয়েও বলা হলো না। শেষমেশ চিত্রা মনের লুকিয়ে রাখা প্রশ্নটা করেই বসলো,

"আপা, দুলাভাইয়ের সাথে তোমার সব ঠিক আছে তো?"


চাঁদনীর হাত থেমে গেলো সাথে সাথে। কিন্তু উত্তরটা সাথে সাথে এলো না। এলো দুই তিন মিনিট পর। হৃদয় ছাড় খার করা উত্তর সেটা। চাঁদনী আপা অসহায় কণ্ঠে বললো,

"আমার মায়ের রাগ আমার উপর না মিটালেও পারতি।"


"আমি তোমায় ইচ্ছে করে কষ্ট দিতে চাই নি বড়আপা।"


চিত্রার মাথা নত হয়ে এলো। বড় আপা তাচ্ছিল্য করে বললো,

"এত জোরে ধাক্কা কী মানুষ অনিচ্ছাকৃত দেয়? আমার তো জানা ছিলো না।"


বড় আপার কথায় চিত্রার চক্ষুদ্বয় বড় বড় হয়ে গেলো। অবাক কণ্ঠে বললো, 

"আমি তো ধাক্কা দেই নি তোমায়, কেবল হাত ঝারা দিয়ে ছিলাম।"


"থাক সেসব কথা। আমি তবুও দোয়া করি, তুই যেন তোর স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকিস।"


বড় আপার দোয়ার আড়ালে কী গোপন অভিশাপের ছোঁয়া ছিলো! চিত্রার মনে কেমন খচখচ করলো বড় আপার কথা। সে তো আপাকে ধাক্কা দেয় নি, তাহলে! 


তন্মধ্যেই নিচ থেকে হৈচৈ ভেসে এলো। নুরুল সওদাগরের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে তুমুল ভাবে। চিত্রা এবং চাঁদনী অপেক্ষা না করেই ছুট লাগালো। 


(৭১)


বাহার ভাইয়ের ঘর ফাঁকা। তার অবহেলার বিছানা শূণ্য। পড়ার টেবিলে যত্নের বই গুলোও নেই। বাহার ভাইয়ের অস্তিত্ব চিলেকোঠার ঘরের কোথাও নেই। মূলত নুরুল সওদাগরের চেঁচামেচির কারণ এটা। 


চিত্রা কেবল ফ্যালফ্যাল করে শূণ্য ঘরটায় তাকিয়ে রইলো। শূণ্য ঘরটার রঙ মেটে হওয়া দেয়ালে বড় বড় করে লিখা, 

"স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার যার প্রতি অনীহা, মানুষ কীভাবে তাকে করবে দয়া!"


অবশেষে, অবশেষে বাহার ভাই নামক মানুষটা মায়া লাগিয়ে চলে গেলো! অবশেষে বাহার ভাই মানুষটা সত্যিই কঠিন হলো। অষ্টাদশী মানতে পারবে এই অনাকাঙ্খিত বিচ্ছেদ?


#চলবে


(চোখের অবস্থা খুব খারাপ স্বত্তেও লিখেছি, কেবল বা'চোখ খুলে রেখি লিখেছি। সুন্দর মন্তব্যের আশাবাদী)

বোনাস পর্ব

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


বোনাস পর্ব 


(৬৫)


তুমুল বৃষ্টির ছাঁটে বিরক্ত অহি। আর কিছু অপ্রয়োজনীয় মিথ্যে অজুহাতে বাহিরে এসে নওশাদের দেখা পাওয়ার পর হতভম্বও সে। লোকটার ফর্সা ফর্সা মুখ কেমন লাল হয়ে গিয়েছে! অনেকক্ষণ যাবত হয়তো ভিজছে! অহি দ্রুত গিয়ে নওশাদের মাথার উপর ছাতা ধরলো। বৃষ্টির অবাধ্যতায় কতখানি ভিজেও গেলো সে। বিরক্ত এবং অবাক কণ্ঠে সে প্রশ্ন করলো,

"আপনি এখানে কী করছেন!"


ঠান্ডায় নওশাদের নাক-মুখ বসে যাওয়ার উপক্রম। তবুও অনেক কষ্টে বললো,

"আপনাকে দেখতে এসেছি!"


"আপনি আমাকে দেখতে বনানী থেকে ধানমন্ডি এসেছেন! বনানী থেকে ধানমন্ডির দূরত্ব জানেন তো?"


"আপনি বনানী থেকে ধানমন্ডির দূরত্ব দেখছেন অথচ আমার ভালোবাসার গুরুত্ব দেখছেন না! এ কেমন অবিচার আপনার? দয়া করে নাহয় একটু দয়া করুন, আমায় নিয়ে ভাবুন, আমায় একটু নাহয় ভালোবাসুন।"


নওশাদের কণ্ঠে তুমুল আকুলতা। অহি বিরক্ত হলো। এমন পা* গলামো কিংবা বাচ্চামো তার কখনোই পছন্দ না। তবুও লোকটা এসব করছে! 


অহিকে চুপ থাকতে দেখে কথা বললো নওশাদ। আকুতি করে বললো,

"আমার প্রতি কী আপনার একটুও মায়া হয় না?"


"না, হয়না।"


প্রশ্নের জবাবে অহির কাঠকাঠ উত্তর। নওশাদ তপ্ত শ্বাস ফেললো। ভারিক্কী গলায় বললো,

"তাহলে এখনি এখান থেকে যান। আমার ভালোবাসার প্রতি যার দয়া নেই, তার যেন আমার প্রতিও কোনো করুণা নাহয়।"


নওশাদের কথার এই আকাশ-পাতাল পরিবর্তনে প্রায় থতমত খেয়ে গেলো অহি। স্তম্ভিত হয়ে বললো,

"কী করছেন? টিনএজারদের মতন আচরণ করবেন না।"


"ভালোবাসার আচরণের আবার পার্থক্য আছে নাকি? ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি গম্ভীর কিংবা টিনএজারও হতে রাজি।"


"আমার এসব পছন্দ না কিন্তু।"


"তাহলে চলুন, বিয়ে করি?"


নওশাদের হঠাৎ এমন প্রস্তাবে অহি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। কেমন হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো! অদ্ভুত কণ্ঠে বললো, 

"কী!"


"চলুন না, বিয়ে করে ফেলি।"


অহি গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলো। এই মুহূর্তে নওশাদ ফাজলামো করছে বলে তো মনে হয় না কিন্তু কথাটা যে সত্যি সত্যি বলছে তাও বিশ্বাস হচ্ছে না। বনানী থেকে এই রাতে ছুটে এসেছে কি কেবল এই কথাটা বলার জন্য? এত পা* গলাটে চিন্তা! অহি তপ্ত শ্বাস ফেললো, শীতল কণ্ঠে বললো, 

"যেখান থেকে আসছেন, সেখানে ফিরে যান। এসব করে আমার মনে বিরক্তের সৃষ্টি করছেন, তাছাড়া আর কিছুই না।"


"কোথায় ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন! যেখান থেকে এসেছি সেখানে ফিরে যেতে হলেও আমার আপনাকে চাই।"


"আমাকে চান? কেনো চাইবেন? ভালো লাগে বলে?"


"না, ভালোবাসি বলে।"


নওশাদের সহজ স্বাভাবিক উত্তরে অহির তেজের ভাঁটা পড়লো। হাল ছেড়ে দেওয়া ভাবে বললো, 

"আচ্ছা মানলাম ভালোবাসেন বলে। তা, ভালোবাসলেই কি পেতে হবে এমন কোনো কথা আছে? ইতিহাসে এমন কতই তো হয়েছে যে তুমুল ভালোবাসার পরও একজন আরেকজনকে পায় নি। তাহলে আপনারই কেন পেতে হবে?"


"ইতিহাসে বিচ্ছেদ ছিলো বলে আমিও অপ্রাপ্তি রাখবো তা ভাবছেন কেনো? বার বার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে হবে তারও কোনো মানে নেই। ইতিহাস যারা রটেছে তারাও মানুষ। তারা নাহয় রটেছে অপ্রাপ্তির ইতিহাস, আমরা নাহয় রটবো প্রাপ্তিরটা।"


"আমায় পেয়ে কি আর এমন হবে বলুন? আমাকে এখন হয়তো ভালো লাগছে কিন্তু একসাথে সংসার করার পর আর নাও ভালো লাগতে পারে।"


"আপনাকে পেলে তেমন কিছুই হবে না। কেবল পাওয়া না পাওয়ার এই পৃথিবীতে, আপনাকে পেয়ে গেলে আমার সব পাওয়া হয়ে যাবে।"


এমন একটা অনুভূতি মাখানো কথা শোনার পর আর কথা খুঁজে পেলো না অহি। বিরক্ত দেখাতে গিয়ে দেখলো কি আশ্চর্য! তার বিরক্ত লাগছে না। তবুও সে মিছে বিরক্তের ভাব ধরলো। নাক-মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো নিজের বিল্ডিং এ। নওশাদ পেছন থেকে চিল্লিয়ে বললো,

"আপনি বিয়ের জন্য রাজি না হলে আজই আমি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমার জান দিয়ে দিবো।"


অহি গোপন হাসলে। মুখ ভেংচি দিয়ে বললো, 

"বৃষ্টিতে ভিজলে কেউ ম* রে না। ভিজতে থাকুন।"


"বৃষ্টিতে না ম* রলেও আপনার ঐ হাসিতে ঠিকই ম* রেছি।"


অহি আর পিছু ফিরলো না। চলে গেলো নিজের ফ্লাটে। নওশাদের কথাটা সে নেহাৎই হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো। ভাবলো নওশাদ হয়তো মজা করেই বলেছে। কিন্তু অপরদিকে নওশাদ নাছোড়বান্দা তা যে জানা নেই রমণীর।  


(৬৬)


মন খারাপের আকাশে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো অভিমানেরাও। চিত্রা বাহারের তীক্ষ্ণ কথা হজম করে চুপ করে ছিলো। কিন্তু তার চেয়েও বেশি তাকে চুপ করিয়েছে বাহারের আনা অন্য কারো জন্য নূপুর আর চিঠি। চিঠিটা পড়তে পারে নি তবে যতটুকুই দেখেছে মুগ্ধতা ভরা ছিলো। কারো জন্য খুব যত্নে লিখেছিলো চিঠিটা। বাহার চিত্রাকে ছাড়াও অন্যকারো কথা চিন্তা করছে ভাবলেই অষ্টাদশীর বক্ষ মাঝে তুমুল তোলপাড় শুরু হয়। প্রিয় মানুষের ক্ষেত্রে আমি একটু বেশিই স্বার্থপর হই। সব ভাগ করা মানুষটাও প্রিয় মানুষের ভাগ সহ্য করতে পারে না। কিন্তু বাহার ভাইকে তা জানিয়ে লাভ নাই। মানুষটা তো এমনই, অনুভূতি বুঝলেও প্রকাশ্যে তার মূল্য দেই নি কভু। অথচ সেই বাহার ভাইয়ের জন্যই অষ্টাদশীর এত হাহাকার! 


ভরপেট খাওয়া দাওয়ার পর ড্রয়িং রুমে ছোটোখাটো একটা আড্ডার আসর বসলো। কিন্তু চিত্রার মন বসলো না সেই আসরে। সে কাজের নাম দিয়ে উঠে চলে গেলো। তখনও প্রকৃতিতে ভরা বর্ষণ। বারান্দার ছোটো ছোটো শিকের জানালা গলিয়ে হাত ভিজাতে পারছে না বলে চিত্রার মন আরও খারাপ হলো। কেবল দেখেই যেতে হলো নিবিড়ে সেই বর্ষণ ধারা। 


তন্মধ্যেই চিত্রা নিজের পেছনে কারো উপস্থিতি অনুভব করলো। মানুষটাকে দেখার আগেই মানুষটার গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো, 

"ভালোবাসা যখন মানসিক শান্তি নাহয়ে মাথা ব্যাথার কারণ হয়, তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় সে ভালোবাসার মানুষটি ভুল।"


চিত্রা কণ্ঠের মালিককে চিনলো কিন্তু এ মানুষ এমন কথা বলতে পারে ভেবেই তার অবাক লাগলো। অবাক কণ্ঠে বললো, 

"দুলাভাই, আপনি!"


চিত্রার বিস্মিত মুখ দেখে হাসলো মাহতাব। পকেটে হাত গুঁজে হেলতে দুলতে চিত্রার সামনে এসে দাঁড়ালো। ছোটো একটা শ্বাস ফেলে বললো,

"ভালোবাসার মানুষ ভুল হলে ভালোবাসা ফুল নাহয়ে কাঁটা হয়ে রবে কিন্তু শালীকা।"


চিত্রা কথা বললো না। দুলাভাই কিছু বুঝতে পারলো কিনা ভেবেই তার বুক কাঁপলো। ক্ষীণ স্বরে বললো, 

"কী বলছেন এসব?"


"তোমাদের বয়সই এমন যে এটা বলতে হচ্ছে। শোনো, কোনো সম্পর্ক যদি তোমায় ব্যাথা দেয়, তিল তিল করে মা* রে তবে তুমি বরং সে সম্পর্কটাই মে* রে ফেলো। মনে রেখো, ভুল কারণে নিজে মরার চেয়ে, ভুল কারণটার মৃত্যু হওয়া ভালো।"


চিত্রা কি বুঝলো কে জানে, কেবল অনবরত মাথা নাড়ালো। চিত্রাকে খুশি করতে হাস্যোজ্জ্বল মাহাতাব বলে উঠলো,

"চলে আজ রাতের রাস্তা ঘুরবো, বৃষ্টিতে ভিজে আইসক্রিম খাবো। যাবে?"


চিত্রা কতক্ষণ ভেবে রাজি হয়ে গেলো। এতক্ষণের মন খারাপ টা তার হুট করেই ভালো হয়ে গেলো। 


(৬৭)


তখন প্রায় মধ্যরাত। চিত্রাদের ফ্লাটে কেবল অহি আর মুনিয়া বেগম রয়েছে। চিত্রা, চেরি, মাহতাব, তুহিন তো কিছুক্ষণ আগেই বের হয়েছে রাতের রাস্তা ঘুরার জন্য। বাহার ভাইও তার পরপর বেরিয়ে গিয়েছে। অহি, মুনিয়া বেগম নিজেদের মতন ঘুমিয়ে পড়লো। 


রাত তিনটে, হুট করে সশব্দে বেজে উঠলো অহির ফোন। কড়া ঘুমটা হঠাৎই হালকা হয়ে এলো ফোনের শব্দে। অহি বিরক্ত হলো, চোখ-মুখ কুঁচকে ফোনটা রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে বাহার ভাইয়ের কণ্ঠ ভেসে এলো,

"আমায় ভালোবাসো অহি?"


অহির ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্কে হুট করে এমন কথাটা কেমন ভোঁতা ভোঁতা অনুভূতির সৃষ্টি করলো। ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্ক জেগে উঠলো সেকেন্ডের মাঝেই, অহি চুপ থেকে রয়েসয়ে উত্তর দিলো, 

"ভালোবাসতাম, এখন ভালোবাসা ছেড়ে দিয়েছি।"


উত্তর টা শুনে ফোনের অপর পাশের বাহার ভাই কি একটু হাসলো! হ্যাঁ হয়তো হাসলো। ক্ষীণ হেসে বললো, 

"এটা তোমার জীবনের সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত। আরেকটা উত্তম সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলো তো ঝটফট।"


অহি ভ্রু কুঁচকালো, প্রশ্নাত্মক কণ্ঠে বললো, 

"কী?"


"তোমাদের বাড়ির নিচে যে ছেলেটা বৃষ্টিতে ভিজেছে এই মাঝ রাত্তি অব্দি, তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফেলো। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তুমি অনবরত ছুটে চলা ঘড়ির কাটা, আমার মতন বেকার বাহারের জন্য থেমে থাকা তোমার মানায় না। আমরা তো বেকার মানুষ। আমরা হলাম অযত্নের কংক্রিট। 


মানুষ ভাবে পাথর মন, দিলাম নাহয় একটু ভেঙে, 

ক্রেংকিটের আড়ালেও হৃদয় নরম,মানুষ কি আর তা জানে?


একটা মৃত্যুর স্বাদ পেতে, বেকার মরে রোজ,, 

তাই তো সমাজ নিয়ম করে আমাদের স্বপ্ন করছে ভোজ।


ফ্যানের সাথে কি যেন ঝু* লে, ডাকে মোরে মুক্তি হেথায়,

বাঁচবার সাধ বেকারেরও আছে, সে কথা কি সমাজে বিকায়?


যোগ্যতার সার্টিফিকেট তাচ্ছিল্যে ভাসে, অযোগ্যদের কাছে,

একটা চাকরি না পেলে, বেকারদের প্রেমও মিছে।


তোমাদের অবশ্য সে পিছুটান নেই, প্রেম মিছে হওয়ার ভয় নেই। মধ্যরাতে তোমার দোরে ভালোবাসা চাওয়া মানুষটাকে আজ নাহয় একটা কিছু বলেই দেও। মুক্তি নাহয় প্রেমের মৃ* ত্যু।"


অহি চুপ করে বাহার ভাইয়ের কথা শুনলো। অপর পাশ থেকে কল টা কাটতেই সে ওরনা টা জড়িয়ে সাবধানে ফ্লাটের দরজা আটকে নিচে নেমে গেলো। তখনও বৃষ্টি পড়ছে বিরতিহীন ভাবে। 


বিল্ডিং ছেড়ে রাস্তায় নামতেই জুবুথুবু নওশাদকে চোখে পড়লো অহির। বেচারা শীতে কাঁপছে। অহি বেশ শক্তপোক্ত মুখ নিয়ে এগিয়ে গেলো নওশাদের কাছে। শক্ত কণ্ঠে বললো, 

"আপনি না গিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে ভিজছেন? এসব করে আপনি কী বুঝাতে চাচ্ছেন?"


"আমায় বিয়ে করে নিলেই তো পারেন। বাঁচিয়ে নিন না আমায়।"


অহির মুখে তুমুল কাঠিন্যতা। কর্কশ কণ্ঠে বললো, 

"আমার জন্য যে ছেলেটা মধ্যরাত অব্দি এমন পা* গলামো করতে পারে তাকে ফেরানোর সাধ্যি আমার নেই। এত রাতে কাজী অফিস খোলা থাকবে তো?"


নওশাদ ভেবেছিল এবারও বরাবরের মতন প্রত্যাখ্যান আসবে কিন্তু অহির কথায় সে হতভম্ব। নওশাদের হতভম্ব ভাব দেখে অহি ঠাট্টা করে বললো,

"বিয়ে কি করবেন না শহীদ হওয়ার ইচ্ছে এখনও আছে?"


#চলবে

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ২৪

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


পর্বঃ চব্বিশ


চিত্রার আধো রহস্য মাখা কথা আধা-ই রইলো। সে পুরোটা বিশ্লেষণ করলো না বাহারের কাছে, কেবল কতক্ষণ বিজ্ঞ ব্যাক্তিদের মতন ভাবুক হয়ে রইলো। যেন রাজ্যের ভাবনায় মত্ত সে! 


হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তা পেরিয়ে রিকশা নিলো বাহার। দু'জনই রিকশায় উঠে বসলো। নিস্তব্ধ রাস্তা, হুড়মুড় করে বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে আদুরে ভাবে। বাহার চুপ করে রইলো, সাথে চুপ রইলো চিত্রাও। আকাশে রূপোর থালার মতন চাঁদ। অক্টোবর এসেছে বিরাট জ্যোৎস্না নিয়ে। ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাসে শরীরে ক্লান্তিটাও ক্ষাণিক বিশ্রামে গেলো। কয়েকদিন পর তো আবার শীত আসবে। শীতকাল চিত্রার বেশ প্রিয়। কেমন মিষ্টি অলসতায় কাটে। চিত্রা আবার বেশ অলসতা প্রিয়। 


দু'জনের নিশ্চুপ ভাবনার মাঝে রিকশা এসে থেমেছে চিত্রাদের গলির মুখে। চিত্রা ঝটপট বাহার ভাই টাকা বের করার আগে নিজেই রিকশা ভাড়া দিয়ে দিলো। তা দেখে বাহার কিঞ্চিৎ হাসলো। পকেট থেকে সিগারেট বের করে তা দুই ঠোঁটের ভাঁজে চেপে লাইটার জ্বালাতে জ্বালাতে বললো,

"বেশ চালাক হচ্ছো যে!"


বাহারের বাক্যের মানে চিত্রার ঠিক বোধগম্য হলো। মুচকি হেসে সে বললো,

"আপনার সাথে থাকি, আর চালাক হবো না?"


"তা বেশ ভালো। চালাক হতে ক্ষতি কি! তবে চিন্তা নেই, চাকরি পেলে তোমার রিকশা ভাড়ার দায়িত্বটা আমি নিজের কাঁধে নাহয় নিয়ে নিবো।"


"আপনি চাকরি করবেন?"


হাঁটকে হাঁটতেই বাহারের দিকে তাকিয়ে চিত্রার প্রশ্ন। বাহার পায়ের কাছের খালি বোতলটা তে ছোটো লা* থি দিয়ে বললো,

"ভাবছি তো করবো। রিকশা ভাড়াটা দেওয়ার জন্য হলেও চাকরি করা জরুরী।"


"তারপর আমায় বিয়ে করবেন তো, বাহার ভাই?"


চিত্রার প্রশ্নে বাহার বিশেষ অবাক হলো না। কারণ সে জানে, বয়ঃসন্ধিরা আবেগ প্রকাশ করতে ভীষণ পছন্দ করে। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ তার প্রিয় মানুষের ক্ষেত্রে একটু বেশিই বেহায়া হয়ে যায়। চিত্রাও তার বাহিরে না। 


বাহারকে চুপ থাকতে দেখে চিত্রা আবার প্রশ্ন করলো, 

"আমি আপনার এতটাই অপছন্দ?"


"তুমি তো তোমার বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবে তাই না? ঐ যে ভদ্র সুশীল ছেলেটাকে।"


বাহারের ঠাট্টা মাখানো কথায় ছোটো হয়ে এলো চিত্রার মুখ। ক্ষীণ স্বরে সে বললো,

"আমার তো অ-ভদ্র আপনিটাকেই পছন্দ।"


"বয়ঃসন্ধির আবেগ দিয়ে ফাঁসাতে চাচ্ছো?"


"একদম না, অষ্টাদশীর ভালোবাসা দিয়ে ফাঁসাতে চাচ্ছি।"


বাহার আর উত্তর দিলো না। চিত্রা মন খারাপ করে বললো,

"চাকরি টা হবে তো?"


"তোমার সাথে সংসার করতে হলে, চাকরিটা হতেই হবে, তাছাড়া উপায় নেই। আচ্ছা, তোমার বাড়ির চিলেকোঠার ঘরের মতন একটা ঘরে কী কী আসবাবপত্র লাগবে বলো তো? সংসার সম্পর্কে ধারণা কম তো!"


বাহারের এমন অপ্রত্যাশিত কথায় হতভম্ব চিত্রা। চোখ-মুখে খুশির ঝিলিক দিয়ে উঠলো। সে চমকে যাওয়া কণ্ঠে বললো, 

"এ জন্যই কি চাকরির খোঁজ করছেন?"


"তোমার ভাই বেকারের কাছে তার বোনকে দিবে? যদি দেয় তাহলে নাহয় খোঁজ না করলাম।"


চিত্রা কিছুক্ষণের জন্য বাক্যহারা হয়ে গেলো। বাহার ভাই এত সহজে মেনে যাবে তা যেন তার ধারণার বাহিরে ছিলো। চিত্রা আর কিছু বলতে গেলেই থামিয়ে দিলো বাহার। ক্ষীণ কণ্ঠে বললো, 

"বাড়ি এসে পরেছে, ভিতরে যাও। সংসার করতে হলে ভালো রেজাল্ট চাই, নাহয় সেসব চিন্তা বাদ।"


চিত্রা এতক্ষণ এতটাই অবাক হয়ে ছিলো যে সে যে নিজের বাড়ির গেইটের সামনে চলে এসেছে তা তার খেয়ালই ছিলো না। বাহারের কথায় আশপাশ তাকিয়ে দেখলো সত্যিই সে তার বাড়ির সামনে। বাহার চিত্রাকে আর কিছু না বলে সোজা হাঁটা ধরলো। চিত্রা বেশ উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলো,

"বাহার ভাই, আপনি আমার পুরো জীবনের লাল কালির পূর্ণতা যা জ্বলজ্বল করবে আমার প্রাপ্তির খাতায়।"


বাহার অবশ্য কথাটা শুনেও ফিরে তাকালো না। চিত্রা কতক্ষণ বাহারের ফেরার অপেক্ষা করে বাড়ির ভেতর চলে গেলো। বাহার বুঝলো, তার পিছে যে অষ্টাদশীর ছায়া নেই। বাহার আকাশের দিকে তাকিয়ে বেশ বিষণ্ণ, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

"রঙ্গণা, তুমি আমি বিশাল অপ্রাপ্তির জীবনে হয়তো আরও একটা অপ্রাপ্তি। বাহারদের অনেক স্বপ্ন ঠিকই থাকে, কিন্তু তা ঝরে যায় রাতের আঁধারে। তুমি সকাল অব্দি থাকলেও পারো, রঙ্গণা। বাহার খারাপ, তবে তার স্বপ্ন না। আমাদের একটা ছোটো সংসার হলে খারাপ হয় না, আমি অপ্রাপ্তির জোয়ারে গা ভাসিয়ে কিঞ্চিৎ প্রাপ্তি পেয়ে যেতাম তোমায় পেয়ে। আফসোস! বাহারদের জীবনের স্বপ্ন গুলো ঐ দূর আকাশের চেয়েও দূরের। যা ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। তুমি নাহয় মেয়ে, বৃষ্টি হয়ে দিও ছুঁয়ে।"


বাহারের কথা গুলো কি শুনলো রঙ্গণা? হয়তো না। তাতে কি? একটা গোটা রাত তো দেখলো সংসার সাজানোর স্বপ্ন কত সুন্দর হয়! একটা গোটা আকাশ তো জানলো, অপ্রাপ্তিদের কত বেদনা হয়!


(৬১)


মহিনের কেইসটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আরও সপ্তাহখানেক আগে। একদম গোলকধাঁধায় মতন এটা একই জায়গায় কেমন ঘুরপাক খাচ্ছিলো, তাই তো বন্ধ করে দেওয়া হয়। মহিনের ভাই মাহতাবই বন্ধ করে দিতে বলে। এই গোলকধাঁধায় আর কতদিনই বা ঘুরপাক খাবে? এরচেয়ে থেমে যাক সব ঝামেলা। নুরুল সওদাগররা লাস্টে আরেকটা ক্লু পেয়েছিলো যে এ* সিড নিক্ষেপ করা ছেলেদেরকে অনবরত যে সিম থেকে ফোন দেওয়া হতো সেই সিমটা কার নামে। ইনভেস্টিগেশন করতে গিয়ে দেখা গেলো ঐ দুই ছেলের মাঝেই একজনের আইডি কার্ড দিয়ে সিমটা কেনা হয়েছিলো। কাকে ধরবে আসামি হিসেবে? ঐ ছেলে দু' টোকেও তো খু* ন করা হয়েছে। পরপর তিনজন মানুষকে একই ব্যাক্তি খু* ন করেছে কিন্তু সঠিক, স্বচ্ছ প্রমাণের অভাবে বন্ধ হয়ে গেলো ইনভেস্টিগেশন। 


তপ্ত দুপুরে বিরক্ত ভঙিতে মাহতাব এসে বসলো তার ঘরে। চাঁদনী নিচ থেকে ঠান্ডা শরবত নিয়ে এলো। আজকাল মাহতাব হুট করেই কেমন রেগে যায়। মেজাজ চরম খিটখিটে থাকে তার। চাঁদনী মাহতাবের হাতে লেবুর শরবতটা ধরিয়ে দিয়ে আঁচল দিয়ে মাহতাবের মুখের ঘাম মুছিয়ে দিতে নিলেই তার হাত আটকে দেয় মাহতাব। চাঁদনী কিঞ্চিৎ অবাক হয়, উদগ্রীব হয়ে বলে,

"কী হয়েছে তোমার? অফিসে ঝামেলা হয়েছে?"


মাহতাব শরবত টুকু খেয়ে বেশ শব্দ করে টেবিলের উপর গ্লাসটা রাখে। তপ্ত শ্বাস ফেলে কর্কশ মেজাজে বলে,

"চাকরিটা চলে গিয়েছে।"


চাঁদনী বেশ অবাক হলো। মাহতাব সবসময়ই বেশ কর্মঠ লোক। তার চাকরী যাওয়ার তো কথা না। ব্যতিব্যস্ত হয়ে সে বললো,

"চাকরি চলে গিয়েছে মানে? কেনো?"


"মানুষ কি একজনের ভালো আরেকজন সহ্য করতে পারে? পারেনা। যেমন তোমার মা পারে নি চিত্রার ভালো সহ্য করতে তেমন অফিসের কিছু মানুষ আমার ভালো সহ্য করতে পারে নি। চিত্রার ঘর ছাড়তে হলো আর আমার চাকরি।"


চাঁদনী বেশ অবাক হলো তার স্বামীর কথায়, বেশ শক্ত কণ্ঠে ও বললো,

"তুমি কিসের সাথে কি মেলাচ্ছো, মাহতাব? আমার মা তোমার গুরুজন হয়, সম্মান দিয়ে কথা বলো।"


"যে নিজেই নিজের সম্মান রাখতে পারে না, তাকে আবার কিসের সম্মান দিবো হ্যাঁ? তোমার মা বলে তো আর সে অন্যায় করে পাড় পেয়ে যাবেনা তাই না?"


মাহতাবের কথায় তুমুল তাচ্ছিল্যের সুর। চাঁদনী হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো তার স্বামীর দিকে। অবশ হয়ে আসে তার অনুভূতিরা। সে বিধ্বস্ত কণ্ঠে কেবল বলে,

"মাহতাব!"


মাহতাব উত্তর দেয় না, গটগট পায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। চাঁদনী কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে সেই দৃশ্য দেখে।


(৬২)


বনানীর বিলাসবহুল এক ফ্লাটের ডাইনিং রুমে রাতের খাবারের আয়োজনে বেশ তৃপ্তি নিয়ে আহার করছে ছোটো এক সুখী ফ্যামিলি। এই পরিবারটা নওশাদের। মা-বাবা আর নওশাদকে নিয়েই তাদের ছোটো পরিবার। 


নওশাদ খেতে খেতে তার মা নওরিন খাতুনের দিকে তাকিয়ে বেশ আয়েশি ভঙিতে বললো,

"মা, তোমাদের কিছু বলার ছিলো।"


নওরিন খাতুন তখন মাছের কাঁটা বাছায় ব্যস্ত। ছেলের কথায় ছেলের দিকে তাকালে, হাস্যোজ্জ্বল মুখ মহিলার। মিষ্টি করে শুধালো,

"কী কথা?"


"তোমরা আমার বিয়ে নিয়ে উঠে পরে লেগেছো, সেই সম্বন্ধেই কথা।"


নওশাদের বাবা ইলিয়াস খান খাবার চিবুতে চিবুতে বললেন,

”ও হ্যাঁ ভালো কথা মনে করেছো, নুরুলদের বাড়ি থেকে তো আর কোনো খবর পেলাম না। আজই নাহয় একবার কল দিয়ে জিজ্ঞেস করবো।"


"জিজ্ঞেস পরে করো, আগে আমার কথা শুনো বাবা।"


"কী কথা?"


বাবার প্রশ্নের উত্তর দিতে সামান্য সময় নিলো নওশাদ। অতঃপর বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

"আমরা সেদিন যখন নুরুল আঙ্কেলের মেয়েকে দেখতে গেলাম, সেখানে গিয়ে আমার পাত্রীকে পছন্দ নাহয়ে তার বোনকে পছন্দ হয়ে গিয়েছে। নুরুল আঙ্কেলের ছোটো ভাইয়ের মেয়েকে। বিয়ে করলে আমি ওকেই করবো।"


নওশাদের কথা শুনতেই খাওয়া থামিয়ে দিলেন নওরিন খাতুন। সে বেশ জোরেই বলে উঠলেন, 

"অসম্ভব। অমন খাটো মেয়েকে তোমার কীভাবে পছন্দ হয়! কেমন বোকাসোকা হাবভাব! আমি রাজি না এই প্রস্তাবে।"


"আমি রাজি, মা। সেটাই কি যথেষ্ট না?"


ইলিয়াস খান নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালেন। নম্র কণ্ঠে বললেন,

"রাগছো কেন নওরিন? মেয়েটা তো সুন্দরই। আর নওশাদ যেহেতু পছন্দ করেছে সেহেতু,,, "


নওরিন খাতুন খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মুখে অগাধ গম্ভীরতা ঢেলে বললেন,

"অসম্ভব মানে অসম্ভব। মেয়েটার মাঝে কেমন সাদামাটা ভাব। কখনোই আমি ওরে মানবো না।"


"আমি তো মানছি তাহলে তোমার সমস্যা কোথায়?"


নওশাদও খাবার টেবিল থেকে উঠতে উঠতে মায়ের বিপরীতে কথা বলে উঠলো। ছোটোখাটো কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। বাহিরে তখন তুমুল বৃষ্টি। ইলিয়াস খান বার বার পিছু ডাকলেন ছেলের অথচ সে একটুও দাঁড়ালো না। ঠান্ডা মানুষ রেগে গেলে এই একটা ঝামেলা। নওরিন খাতুনও ফুসতে ফুসতে ঘরে গিয়ে দোর দিলেন।


(৬৩)


বৃষ্টির মৌসুম বলে রাতে চিত্রাদের বাসায় খিচুড়ির আয়োজন করা হয়েছে। চেরিকে নিয়ে অহিও এসেছে ওদের বাসায়। মাহতাব এসেছে। একটা হৈচৈ পরে গেছে ছোটো ফ্লাটটাতে। রান্নাঘরে ব্যস্ত মুনিয়া বেগম। তার হাতে হাতে সাহায্য করে দিচ্ছে চিত্রা ও অহি। তুহিন ও মাহতাব ড্রয়িং রুমে বসে হরেক রকমের গল্প জুড়ে দিয়েছে। 


বাহারকেও বেশ কয়েকবার আসতে বলার পর অবশেষে সে আসার জন্য রাজি হয়েছে। বাহিরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। অহির ফোনে টুংটাং ম্যাসেজের আনাগোনা। নওশাদের ম্যাসেজ দেখে অহি আর রিপ্লাই দেয় নি। উদ্দেশ্য হাতের কাজ শেষ করে রিপ্লাই দিবে। এমনেতে সে বিকালে কথার ছলে বলেছিলো আজ এ বাসায় আসবো, তবুও নওশাদের অত জরুরি তলবের মানে খুঁজে পেলো না সে। 


বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে বাহার যেই না চিত্রাদের বিল্ডিং এ প্রবেশ করতে নিবে, সেই মুহূর্তেই তার চোখে পরলো ফর্সা, সুন্দর পরিচিত পুরুষ দেহের প্রতিচ্ছবি। বাহারের কপালে ভাঁজ পড়লো। অবাক কণ্ঠে বললো, 

"আপনি নওশাদ না?"


নওশাদ এতক্ষণ ভিজে একাকার। সামনের পুরুষটির মুখে হুট করে নিজের নাম শুনে সে বেশ চমকালো। থতমত খেয়ে বললো,

"হ্যাঁ, আমি নওশাদ। আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?"


বাহার ফিচলে হাসলো। রহস্য করে বললো,

"চেনার কথাও না। তা এতরাতে এইখানে কী?"


বাহারের প্রশ্নে কিছুটা হোঁচট খেলো নওশাদ। কি বলবে ভেবে না পেয়ে কতক্ষণ আমতা-আমতা করলো। অতঃপর কোনো উছিলা খুঁজে না পেয়ে বোকা বোকা কণ্ঠে বললো, 

"অনেক বৃষ্টি তো, তাই এখানে দাঁড়িয়েছি।"


"বনানীতে বুঝি দাঁড়ানোর জায়গা নেই? সোজা ধানমন্ডি এসে পড়েছেন দাঁড়ানোর জন্য!"


নওশাদ অবাক হলেন। সামনের ছেলেটা যে তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার। মাথা এপাশ ওপাশ ঘুরাতে ঘুরাতে সে কথা খুঁজে বেড়ালো। বাহারও ঠাঁই দাঁড়িয়ে দেখলো নওশাদের কান্ড। নওশাদকে এখানে দেখে যতটা বিস্মিত হওয়ার কথা ছিলো সে ততটা বিস্মিত হলো না কারণ এর আগে অহির সাথে প্রায় কয়েকবারই সে নওশাদকে দেখেছে। তাই হয়তো নওশাদের এখানে আসার কারণও আঁচ করতে পেরেছে। বাহারের বরাবরই ষষ্ঠীয় ইন্দ্র বেশ প্রখর। বাহার তাই নওশাদকে স্বাভাবিক করার জন্য বললো,

"অহির সাথে দেখা করবেন? তাহলে উপরেই চলুন।"


নওশাদ আবারও থতমত খেলো। অবাক কণ্ঠে বললো, 

"আপনি অহিকেও চিনেন?"


"চিনবো না? বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে সে। আপনি ভীষণ ভাগ্যবান বলা চলে।"


বাহারের চেয়ে নওশাদও বোধহয় কিছুটা কম চতুর না। তাই তো সে কায়দা করে বলে ফেললো,

"আপনি তাহলে অমন ভাগ্য ফেরালেন কেনো?"


এবারও যেন বাহার অবাক হলো না কারণ সে জানে, বাহারের প্রতি অহির যে মুগ্ধতা সে মুগ্ধতা অহি প্রকাশ না করে থাকতে পারবে না। আমরা যখন একটা মানুষকে ভালোবাসি, তখন চাই মানুষটাকে আগলে রাখতে, গোপনে রাখতে। আর আমরা যখন একটা মানুষের উপর মুগ্ধ হই তখন চাই সেই মুগ্ধতা প্রকাশ্যে আনতে। ছড়িয়ে দিতে আরও একটা মানুষের সামনে। অহি দুটোই করেছে। ভালোও বেসেছে, মুগ্ধও হয়েছে। তাই সে সব জায়গায় মুগ্ধতা না ছড়ালেও কিছু কিছু জায়গায় ঠিক প্রকাশ করেছে। 


নওশাদ আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে চুপ করে রইলো। অহির ভাষ্যমতে তার ভালোবাসার মানুষটা কিছুটা অগোছালো, এলোমেলো, গা ছাড়া স্বভাবের। মেপে হাসে, ঠাট্টাও করতে জানে আর সামনের পুরুষটির কাছে সেই সব গুণই বিদ্যমান। ঢিলটা যে খুব ভুল দিকে ছুঁড়ে নি, তা বুঝতে বাকি রইলো না নওশাদের। 


তন্মধ্যেই বাহারের হা হা হাসি ভেসে এলো। হাসতে হাসতে সে বললো,

"ভাগ্যের সাথে মানানসই না হলে যত ভালো জিনিসই আসুক, ভাগ্য তা গ্রহন করে না। যেমন অহি ম্যাচুয়ার্ড, সে আমাকে যতটুকু বুঝে ততটুকুও আমায় কেউ বুঝে নি। তাতে কি? ভালোবাসার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় মনের শান্তি। অহি আমার চিন্তা ভাগ করতে পারলে মানসিক শান্তির কারণ হতে পারবে না কখনো।"


নওশাদ যে খুব ভুল আন্দাজ করে নি তা বাহারের কথায় বুঝা গেলো। বাহারের কথার গম্ভীরতা বেশ ভালো লাগলো নওশাদের। তাই তো সে মুচকি হেসে উত্তর দিলো,

"সে জন্য আপনি ধন্যবাদ প্রাপ্য। ভাগ্যিস সে আপনার মানসিক শান্তি হয় নি, তা হলে তো পরে আমাকেই অশান্তিতে কাটাতে হতো।"


বাহার আর নওশাদ সমস্বরে হেসে উঠলো। 


(৬৪)


ভেজা শরীর নিয়ে চিত্রাদের ফ্লাটে প্রবেশ করলো বাহার। কিছু কুশলাদি বিনিময় করেই চলে গেলো তুহিনের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে। বৃষ্টির পানিতে ভেজার পর একটু গোসল না করলে কেমন কেমন যেন লাগে। বাহার ঘরে যাওয়ার আগে অহিকে একটু ইশারা করে তার সাথে যেতে। অহি অবশ্য এতে অবাক হয়। বাহার ভাই কখনো আকারে ইঙ্গিতে কথা বলার মানুষ না। 


অহি গরে ঢুকতেই বাহার গলা পরিষ্কার করলো, ঠাট্টার স্বরে বললো, 

"তোমার জন্য কে যেন অপেক্ষা করছে নিচে।"


অহি অবাক হলো। অবাক কণ্ঠে বললো, 

"কে!"


"বনানী থেকে ধানমন্ডি আসার গল্প।"


বাহারের হেয়ালি কথায় কপাল কুঁচকালো অহি। আর প্রশ্ন না করেই সে দ্রুত প্রস্থান করলো রুম থেকে। বাহারও নিজের পকেট থেকে টুকটাক জিনিসপত্র বের করে গোসল করতে চলে গেলো। এর আগও এ বাড়িতে সে দু একবার গোসল করেছে, তাই তার টি-শার্ট এখানে আছেই। 


দীর্ঘ পনেরো মিনিট পর প্রশান্তিকর গোসল দিয়ে বের হলো বাহার। চোখে-মুখে তৃপ্তি। কিন্তু বের হয়েই চিত্রার টলমলে চক্ষু যুগল দেখে সে থেমে গেলো। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে প্রশ্ন করলো, 

"কী হয়েছে?"


চিত্রা উত্তর দিলো না, তবে মাথা নিচু করে আগের জায়গায় ই দাঁড়িয়ে রইলো। বাহার এতে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। কপাল কুঁচকে বললো,

"এখানে দাঁড়িয়ে কোন জামাই মরার শোকে কাঁদছো? কাঁদার জন্য কি বাহিরে জায়গার টান পড়েছে?"


বাহারের দিকে অভিমানীনি চোখ মেলে তাকালো চিত্রা। হাতের ভাঁজে চেপে রাখা কাঁঠালী রাঙা খামটা মেলে ধরে তাচ্ছিল্য করে বললো,

"আপনি তবে আমায় ভালোবাসেন না, বাহার ভাই?"


চিত্রার হাতে নিজের অতিব মূল্যবান খামটা দেখেই সাথে সাথে ছিনিয়ে নিলো বাহার। ধমক দিয়ে বললো,

"কারো জিনিস জিজ্ঞেস না করে ধরেছো কেন?"


"দুঃখীত বাহার ভাই।"


বাহার মাথায় তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। সে জানে চিত্রা জেনে বুঝে ধরে নি, তবুও তার রাগ কমলো না। 


চিত্রা কেবল এই অপরিচিত বাহার ভাইকে দেখলো। যার খামের মাঝে ছিলো ভালোবাসার বার্তাসহ চিঠি আর একটা নুপুর আর চোখে ক্রোধ। 


#চলবে

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ২৩

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


পর্বঃ তেইশ



(৫৯)


নিবিড়, নিশ্চুপ স্বচ্ছ জলে পরিপূর্ণ ছোট্টো একটা পুকুরের পাশের বেঞ্চিতে বসে আছে অহি এবং নওশাদ। রোদ ঝিমিয়ে বিকেল প্রায়। প্রকৃতিও বেশ চুপচাপ। নওশাদ তাকিয়ে আছে অহির দিকে, চোখেমুখে তার প্রশ্নের ছড়াছড়ি। ভেতরের অনুভূতিরা অধৈর্য্য, উৎকণ্ঠিত। কিন্তু সে অহিকে সময় দিলো, নিজেকেও প্রস্তুত করলো অপ্রস্তুত কিছু শোনার জন্য। অহি দীর্ঘক্ষণ সময় নিলো। কিছু কথা যখন বলা হয় না পরিস্থতির চাপে তখন তা যুগ যুগ ধরে স্মৃতির পাতায় থাকতে থাকতে চাপা পরে যায়। চাইলেও তখন আর তা খুব সহজে মেলে ধরা যায় না। অহির অবস্থাও ঠিক তা-ই। খুব বাজে অভিজ্ঞতা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা চালাতে চালাতে আজ তা ধূলো পড়ে ধোঁয়াশা হয়ে গেছে। সেই ধূলো পরিষ্কার করতে কিঞ্চিৎ সময় তো লাগবেই। 


প্রায় মিনিট দশ পর অহি মুখ খুললো, কণ্ঠ ধ্বনিরা প্রস্তুত হলো বিভীষিকা ময় কথা গুলো বলার জন্য। ভীষণ বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলা শুরু করলো,

"ছোটোবেলা থেকেই আমার মা আমার ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন ছিলো, সেই উদাসীনতার জন্য ছোটো বয়সে আমার সাথে ঘটে গিয়েছে বড় বিপর্যয়। আমার বয়স তখন সাত কিংবা আট হবে। বাবা-মায়ের একদিন তুমুল কথা কাটাকাটি, অবশেষে কথা কাটাকাটির অবসান ঘটলো আমাকে গৃহান্তর করার মাধ্যমে। মায়ের জেদের কারণে আমার এত বড় বাড়ি, এত সুন্দর পরিবার থাকতেও আমাকে পাঠানো হয় হোস্টেল। জীবন বোঝার আগেই যৌ* নতার লালসার শিকার হবো তা হয়তো কারোই জানা ছিলো না। হোস্টেলের পর্যবেক্ষণ করতো এক মামা ছিলো যে সব বাচ্চাদের আদর করতো। আমাদের চকলেট দিতো, কোলে নিয়ে ঘুরতো। আমি খুব কমই মামার সান্নিধ্যে যেতাম। ছোটোবেলা থেকে খুব চুপচাপ থাকার কারণেই মানুষের সাথে কম মিশতাম। তখন সময়টা শীতকাল, ডিসেম্বর বা জানুয়ারীর দিকে। হোস্টেলের বেশিরভাগ দায়িত্বরত সদস্য ছুটিতে। আমি বিকেলে হোস্টেলের পেছনের দিকে বাগানে খেলছিলাম। ফুল আমার প্রিয় ছিলো বিধায় সেটা নিয়েই নিজের আপন মনে হাবিজাবি এঁকে খেলায় মত্ত ছিলাম। এর মাঝেই সেই লোকটা এলো যে সব বাচ্চাদের আদর করতো। তথাকথিত নিয়মে সে আমার মাথায় গালে হাত বুলিয়ে দিলো, চকলেট দিলো অথচ আমি নিলাম না। বাচ্চা হলেও বুঝতাম অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু নেওয়া উচিৎ না। মামা তখন একটা সূর্যমুখী ফুল এনে আমার হাতে দিলো, আমি তো খুশিতে আত্মহারা। আমাকে হাসি-খুশি দেখে মামা কোলে নিলেন। আমিও বেশ আনন্দে কোলে উঠে গেলাম। যখন আমি ফুল নিয়ে ব্যস্ত তখন অনুভব করলাম আমার... আমার বুকে প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে। ব্যাথার চোটে চোখে টলমলে অশ্রুদেরও ভীড় জমে গেলো। আমি উফ্ করে শব্দ করে উঠলাম। মামার দিকে তাকিয়ে বললাম 'মামা, ব্যাথা'। মামা বিদঘুটে হেসে বললো, 'আদর করলে একটু ব্যাথা লাগবেই, মামা তো তোমাকে আদর করছি।' আমি তবুও কিছুটা মোচড়ামুচড়ি করছিলাম, অস্বস্তিতে ভরে গেছে আমার শরীর। আমার ছোটো নাজুক শরীরটা তখন মামার হাতের মুঠোয়, সে যেভাবে পেরেছে সেভাবে ছুঁয়ে দিয়েছে। তারপর বাগানের মালি কাকাকে আসতে দেখে সে আমায় ছেঁড়ে দিলো। তারপর আমি ফুলটা ছুড়ে ফেলে নিজের ঘরে চলে গেলাম।"


দীর্ঘ বক্তব্যের পর থামলো অহি। অদ্ভুত ভাবে নওশাদের চোখে অশ্রু থাকলেও অশ্রু নেই অহির চোখে অথচ তার কণ্ঠনালী কাঁপছিলো। অহি মাথা নিচু করলো, ডান হাত দিয়ে অনবরত নিজের বাম হাত মুচড়োচ্ছিলো। তার যে সেসব অতীত মনে করে খুব কষ্ঠ হচ্ছে তা বুঝতে বাকি রইলো না নওশাদের। তাই তো সে গলা পরিষ্কার করে বিবশ কণ্ঠে বললো, 

"আজ নাহয় থাক। অতীত নাহয় অতীতই থাকুক।"


অহি হাসলো, তাচ্ছিল্য করে বললো,

"ঘৃণা হচ্ছে তাই না আমার উপর! হওয়াটাই স্বাভাবিক।"


অহির কথার ধরণে হতবিহ্বল নওশাদ। তাজ্জব হয়ে বললো,

"কী বলছেন? আপনার খারাপ লাগছে বিধায় না করেছি।"


অহি হাসলো, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

"এখন আর খারাপ লাগে না। এত বছর নিজের মাকেও বলতে পারি নি এসব কথা। কেবল আমি আর আমার ঐ আল্লাহ জানতো আমি যে কি লুকিয়ে বেঁচে ছিলাম। আজ যেহেতু বলা শুরু করেছি, তাহলে বলি?"


'তাহলে বলি' কথাটাই যেন কেমন নিবিড় আর্তনাদ ছিলো। বিদঘুটে অতীত বের করে মন হালকা করার একটা হাহাকার ছিলো যা ছুঁতে পারলো নওশাদকে। সে ধীর কণ্ঠে বললো, 

"আমি শুনছি তবে, আপনি বলুন।"


অহি পুকুরের ঝলমলে, স্বচ্ছ জলরাশির দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করলো,

"সেইদিন আমার সাথে ঘটা বিদঘুটে ঘটনা টা কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে দিয়েছিল আমাকে। কই, বাবা-চাচা সবাই তো আমাকে আদর করতো কিন্তু কখনো এমন ব্যাথা দেওয়া আদর তো করতো না। সন্ধ্যার দিকে যখন সব নিরিবিলি মালি কাকা এলেন আমার ঘরে। আমি তখন পড়ার টেবিলে বই নিয়ে বসেছি। কাকা এসেই আমার পাশে হাঁটু ভেঙে বসলেন, তার চোখেমুখে কি যেন একটা হাবভাব। সে আমাকে কেমন ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন 'তোমার সাথে ফজলু কিছু করছে?' আমি এক ঝটকায় বুঝে ফেললাম কাকা বিকেলের সেই ঘটনার কথা বলছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, অনবরত ডানে-বামে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললাম 'না'। মালি কাকা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন তখনই। আমার ছোটো মনে তখন অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়েরা হানা দিলো। সেই ঘটনার তিনদিন পরের কাহিনী। আমি রাতে খাবারের পর দাঁত ব্রাশ করতে করতে হোস্টেলের পিছনের বারান্দায় গেলাম যেটা আমার অভ্যাস ছিলো। সেখানেই হোস্টেলের কর্মচারীদের কোয়াটার ছিলো। আমি হঠাৎ ভীষণ হাসাহাসির শব্দ শুনলাম ঐ মামার ঘর থেকে। তার দরজাটাও হালকা খোলা ছিলো। আমি ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম সেই ঘরটাতে। কিন্তু দরজা পুরোটা হাত দিয়ে খুলে দিতেই আমি হতভম্ব। ভেতরের দেখা দৃশ্যটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। এত অপ্রত্যাশিত কিছু ছিলো। আমাদের খাবার সার্ভ করা খালা আর মামা ছিলেন সে ঘরে। আমি ভয় পেয়ে ছুটে আসতে নিলেই খালা দৌড়ে এসে ধরে ফেললেন আমায়। মামার চোখে তখন উপচে পড়া লালসা। মামার লালসাকে সাঁই দিলেন খালাও। সে আমাকে জোর করে ধরে আমার জামার পেছনের চেইনটা খুলে দিলেন। একজন মহিলা, যার কন্যার বয়সী হয়তো ছিলাম আমি, সে কিনা মামাকে খুশি করতে আমায় বলিদান করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলো। মামার এলোমেলো, নোংরা ছোঁয়ায় আমি নেতিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর...."


কথা থেমে গেলো অহির। তুমুল কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। নওশাদও আবিষ্কার করলো তার হৃৎপিণ্ড প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বিট করছে। অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে তার শরীর। ঘৃণায় ভরে উঠেছে অনুভূতিরা। ছোটো একটা মেয়েকেও কিনা ছাড় দেয় নি! সে চাইলো,অহির কাঁধে ভরসার হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিতে, কিন্তু সে তা করলো না। কারণ অহির মনে এখন অতীতের নোংরা ছোঁয়ার স্মৃতি কিলবিল করছে, নওশাদের সঠিক ছোঁয়াও হয়তো আরেকটা ভিন্ন ঘৃণার সৃষ্টি করতে পারে। তাই নওশাদ নিজেকে সংযত করলো। কাঁদতে দিলো অহিকে। 


অহি কাঁদলো, পাহাড়ের মতন অটল অহি নিমিষেই গলে জল। কাঁদতে কাঁদতে যখন চোখের জল ফুরালো সে ভেজা কণ্ঠে বললো, 

"নওশাদ, জানেন সেদিন আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। আমার সাথে খারাপ ঘটতে গিয়েও ঘটে নি। আমার চিৎকারে মালি কাকা ছুটে এসেছিলো, হৈচৈ শুনে ছুটে এসেছিলো আমাদের হোস্টেলের কয়েকজন মেডাম। আমি ততক্ষণে নেতিয়ে পড়ে গিয়েছি। কাকার কারণে শেষ মুহূর্তে আমি বেঁচে যাই। অতঃপর মেমরা আমাকে বলে এসব নাকি খারাপ কথা, মানুষ জানলে আমায় নোংরা বলবে তাই যেন কাউকে না জানাই। আমিও তাই লুকিয়ে গেলাম সবটা। ওদের কি হয়েছিল পরে আমার জানা নেই, কেবল আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল বাড়িতে। মিছে অযুহাত দেখিয়ে বলে ছিলো আমি নাকি থাকতে চাচ্ছি না আর সেখানে। তারপর থেকে সে ঘটনা আমাকে মানুষ থেকে মানসিক রোগীতে রূপান্তরিত করলো। কাউকে বলতে না পারার কারণে খুব বাজে ভাবে পোকায় খেয়ে ফেললো আমার ভেতর টা। এরপর থেকে আমি ফুল সহ্য করতে পারতাম না। মাঝে সাঝে ঐ মানুষ গুলোকে খু* ন করার তৃষ্ণাও জাগতো। এটা ধীরে ধীরে মানসিক সমস্যা হয়ে গেলো।"


নওশাদ চুপ, নিরুত্তর। অহির ক্ষণে ক্ষণে নাক টানার শব্দ পাওয়া গেলো। কিছুটা ক্ষণ দু'জনে চুপ থাকার পর উঠে দাঁড়ালো অহি। ক্ষীণ স্বরে বললো, 

"বুঝলেন তো নওশাদ, মনের মাঝে যেই ঘৃণা আছে তা নিয়ে আমি আরও একজনকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমি জানি মানুষটা আমার না। আর আমিও তো পবিত্র না।"


"আমার কাছে কারো বিদঘুটে ছোঁয়া আপনার অপবিত্রতা হতে পারে না। আর ভালোবাসার কথা তো আপনিই বললেন, সে মানুষ যেহেতু আপনার না তবে যে মানুষ আপনাকে ভালোবাসছে তাকে নাহয় আগলে নিন।"


"হয়তো পারবো না। আমার এমন কলুষিত জীবনের সাথে আপনাকে জড়াতে চাইছি না। আপনার ভালোর জন্য বলছি, ভুলে যান ভালোলাগাকে।"


কথা শেষ করেই অহি পা বাড়ালো নিজ গন্তব্যে, নওশাদ কেমন অদ্ভুত কণ্ঠে বললো, 

"কী আশ্চর্য! আপনি আমার ভালো চাইলেন, অথচ আমায় চাইলেন না!"


কথার মাঝে কি যেন একটা ছিলো যা থামিয়ে দিলো অহির পা। পিছুটান তো অহির জন্য না, তবে আজ কেন থামিয়ে দিলো তাকে সে পিছুটান! 


(৬০)


চিত্রার কোচিং শেষ হতে হতে সন্ধ্যা নামলো প্রকৃতিতে। সোডিয়ামের আলোয় রাস্তাঘাট উজ্জ্বল। চিত্রা খুশি মনে এক প্যাকেট ঝালমুড়ি কিনলো আর হেলতে দুলতে হাঁটা ধরলো নিজের বাড়ির পথে। কিছুদূর যেতেই তার চোখ আটকালো পরিচিত মানুষটার দিকে, অথচ মানুষটার এখানে থাকার কথা না। যেই মুহূর্তে চিত্রা তাকে ডাক দিতে নিবে মানুষটা তখনই হাঁটতে হাঁটতে পাশের একটা আঁধার গলিতে ঢুকলো। চিত্রারও কি যেন মনে হলো, সেও ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মানুষটার পিছে পিছে আঁধার গলিতে প্রবেশ করলো। বেশ কত গুলো নোংরা গলি, ভূতুড়ে প্রকৃতি পাড় হয়ে রঙিন এক দুনিয়ায় প্রবেশ করলো চিত্রা। কেমন অদ্ভুত এক দুনিয়া। চিত্রা হতভম্ব আশপাশের মানুষ গুলোর দিকে তাকিয়ে। সভ্য সমাজে অসভ্যের স্থান দখল করা প* তিতালয়ে এসে পড়েছে সে। ধানমন্ডির রাস্তা পার হয়ে অনেকটা দূরেই যে চলে এসেছে সে, তা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার। চিত্রা বেশ অবাক হয়েছে অমন মানুষকে এইরকম একটা জায়গায় আসতে দেখে। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে তার শরীর। মৃদু কম্পন দেখা দিয়েছে তার শরীরের শিরায়-উপশিরায়। তন্মধ্যে কেমন বিদঘুটে হাসি দিয়ে একটা লোক বলল,

"কি সুন্দরী, দাম কত তোর?"


কিশোরী চিত্রা আরও ক্ষাণিকটা ভয় পেয়ে যায়। সে আর কোনো কথা না বলে যে রাস্তা দিয়ে এসেছে, সে রাস্তাতেই ছুট লাগায়। পেছন থেকে ম* দ খেয়ে নেশায় বিভোর হওয়া লোকটার বিদঘুটে হাসির শব্দ ভেসে এলো। চিত্রা চোখ-মুখ বন্ধ রেখেই যেন ছুটে চললো। কতটা দৌড়িয়েছে তার জানা নেই, তার দৌড়ানোর সমাপ্তি হলো একটা শক্ত সামর্থ্য দেহের সাথে ধাক্কা খাওয়ার পর। 


"কি ব্যাপার, দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে নাকি? এভাবে চোখ-মুখ বন্ধ রেখে কোথায় যাচ্ছো!"


সামনের পুরুষটির কথায় চোখ মেলে তাকালো চিত্রা। গলা শুকিয়ে কাঠ প্রায়। তবুও বেশ কষ্টে সে উচ্চারণ করলো, 

"একটু পানি দেন, বাহার ভাই।"


চিত্রার এমন উত্তেজিত মুখমন্ডল দেখে অবাক হলো বাহার। দ্রুত পাশের দোকানটা থেকে পানির বোতল কিনে আনলো। চিত্রার দিকে বাড়িয়ে দিলো সে পানির বোতল। চিত্রা ডান-বামে না দেখেই ঢকঢক করে বেশ খানিকটা পানি পান করলো। অতঃপর জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। 


বাহার ভ্রু কুঁচকালো, অবাক কণ্ঠে বললো, 

"কোথায় গিয়েছিলে? হাঁপাচ্ছো কেনো?"


চিত্রা বেশ কতক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে ধাতস্থ করলো। তারপর বেশ ভাবুক স্বরে বললো, 

"বাহার ভাই, সব রহস্যের সমাধান হচ্ছে না কেনো জানেন? ধূলো পড়েছে চেহারায় আর আমরা মুছছি আয়না। আসলে আমরা রহস্যের সঠিক রাস্তায় এখনো হাঁটাই ধরি নি।"


#চলবে

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ২২

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


পর্বঃ বাইশ


মায়ের বুকের মাঝে যত্নে লেপ্টে থাকা চিত্রার লতার মতন দেহখানি, চোখো অশ্রুদের সমাহার, কণ্ঠে অভিযোগের তুমুল মি* ছিল। মুনিয়া বেগম হাসলেন, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

"কে বলেছিস শুনতে পাই নি, আবার বল।"


"ওরা আমায় ভালোবাসে নি, আম্মু। তোমার মতন কেউ ভালোবাসতে পারে না।"


"ভালোবাসবে কী করে? সবাই তো আর মা না।"


চিত্রা মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকালো। যেন কত সহস্র বছর পর দেখতে পেলো মায়ের মুখখানা! কি ভীষণ মিষ্টি! 


বাহার তখনও পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে লেপ্টানো মিষ্টি হাসি। চিত্রা মায়ের দিকে তাকিয়ে আদুরে স্বরে বললো, 

"তুমি কেনো গেলে আম্মু? তুমি যাওয়ার সাথে সাথে সুখ গুলোও তো আমায় ছেড়েছে।"


"কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ হারানো উত্তম, মানুষ হারালে বাস্তবতা বুঝা যায়। তাই গিয়েছিলাম। তোমার বাহার ভাইকে তো রেখে গিয়েছিলাম, যেন তোমায় আগলে রাখে তুহিন ভাইজানসহ। কিন্তু ভাবি নি তোমার বাস্তবতা এতটা নিষ্ঠুর।"


"বাহার ভাই জানতো তুমি কোথায়!"


চিত্রার চোখে-মুখে তুমুল বিষ্ময়। মুনিয়া বেগম মাথা নাড়ালেন। কোমল কণ্ঠে বললেন, 

"হ্যাঁ, জানতো। আমি প্রশিক্ষণের জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম, কাউকে বলে যাই নি কেবল তোমার মাথার ভূ* ত ছাড়ানোর জন্য। কে জানতো, সুখও তোমায় ছেড়ে যাবে!"


শেষের কথাটায় দীর্ঘশ্বাসের ছোঁয়া। চিত্রা বাহার ভাইয়ের দিকে তাকালো। অভিমানীনির অক্ষি দ্বয়ের ভাষা যেন বুঝলো বাহার ভাই, তাই তো দু'কম এগিয়ে এলো, চিত্রার সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে ছোট্টো কণ্ঠে বললো, 

"আন্টিকে বুদ্ধিটা দেওয়ার জন্য আমি কোনোরকমের গিল্টি ফিল করছি না। তোমার বিয়ের সাধ ছাড়ানোর জন্য ই বুদ্ধি।"


চিত্রা মুখ ভেংচি দিলো। বাহার হাসতে হাসতে ফিসফিস করে বললো, 

"চিন্তা কিসের মেয়ে? মনে রেখো, আমি তোমায় আলো দেবো, সূর্য ডোবার পরেও।"


চিত্রা তৃপ্তির শ্বাস ফেললো। বাহার তাদের রিক্সায় উঠিয়ে পাঠিয়ে দিলো গন্তব্যে। রিক্সার বিপরীতে হাঁটা ধরলো সেও, গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো, 

"ভুলভাল ভালবাসি,

কান্নায় কাছে আসি

ঘৃণা হয়ে চলে যাই থাকি না

কথা বলি একা একা,

সেধে এসে খেয়ে ছ্যাঁকা

কেনো গাল দাও আবার বুঝি না।"


(৫৭)


আফজাল সওদাগর যখন বাড়ি ফিরলেন, বাড়ির এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে সে প্রায় হতভম্ব। ছোটোবেলা থেকেই পরিবারকে আগলে রাখার এক অদম্য শখ তার মনে ছিলো। ভাই-বোনদের সে খুব ভালোবাসতেন তাই তাদের আগলিয়ে রাখার নিখুঁত এক চেষ্টা চলতো তার ভেতর। আর তার চেষ্টাকে সবসময় সাহায্য আর সম্মান করেছে তার অর্ধাঙ্গিনী। একমাত্র এ পরিবারটাকে এক রাখার জন্য কত কিছু সে মনের মাঝে দাফন করেছেন, আর আজ সেই রোজা সওদাগর কিনা কারো ভেঙে যাওয়ার কারণ! 


ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে আফজাল সওদাগর বসে আছেন তার রুমের আরাম কেদারায়। চোখেমুখে তার ভেসে উঠেছে কালো অতীতের কিছু স্মৃতি। জীবনে উপরে উঠার জন্য, নিজের স্বার্থের জন্য কম পাপ করেন নি। ক্ষমতার কারণে সে ধামাচাপা দিয়েছে কত পাপ! বাহিরের দুনিয়ার সাথে সে যতটা শক্ত, পরিবারের জন্য ঠিক ততটাই কোমল। কিন্তু আজ! কি হলো অবশেষে? পাপ তো বাপকেও ছাড়ে না। 


আফজাল সওদাগরের সামনে ঠান্ডা লেবুর শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রোজা সওদাগর। মুখে তার কথা নেই। গম্ভীরতা পুরো মুখ জুড়ে। 


আফজাল সওদাগর লেবুর শরবত টা নিলেন না, বরং অদ্ভুত কণ্ঠে বললেন,

"আমার যুবক বয়সের পাপের শাস্তি কি তুমি, এখন দিচ্ছো?"


স্বামীর গম্ভীর কণ্ঠে কাঁপলেন রোজা সওদাগর। কিন্তু কথা বললেন না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ। 


আফজাল সওদাগর অনেক বছর পুরোনো প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গেলেন এক নিমিষেই। স্ত্রীর হাতের শরবতের গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেললেন মেঝেতে। ঝনঝন শব্দে ভেঙে টুকরো টুকরো হলো গ্লাসটা। সাথে ভীত হলো রোজা সওদাগরও। মিনিট ব্যবধানে সশব্দে চ* ড় পড়লো তার গালে। সে তাজ্জব,হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রইলো স্বামীর পানে। আজ থেকে তেইশ-চব্বিশ বছর আগে দেওয়া কথাটা ভেঙে ফেলেছে তার স্বামী, তা যেন সে মানতে পারলো না। 


আফজাল সওদাগরের তখন চোখ দিয়ে ঝরছে অগ্নি। সেই আগুনে সে যেন জ্বালিয়ে দিবে তার অর্ধাঙ্গিনীকে। কণ্ঠে তার তুমুল ক্ষোভ, চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,

"তোমার সাহস হলে কীভাবে, আমার অবর্তমানে আমার পরিবারটাকে এক ছিন্ন বিছিন্ন করার? ফকিন্নির বাচ্চা।"


রোজা সওদাগর নিরুত্তর। অনেক দিন পর স্বামীর পুরোনো রূপ দেখে প্রায় সে নিশ্চুপ হয়ে গেছে। মানতে কষ্ট হচ্ছে তার যে এটাই তার স্বামী। আফজাল সওদাগরের মুখের ভাষা বিশ্রী থেকে বিশ্রী হলো। ক্রোধ ঝরে পড়লো সারা শরীর উপচে। টিকতে না পেরে রোজা সওদাগরের চুলের মুঠি টেনে ধরলেন। বা'গালে আরও একটা চ* ড় বসিয়ে বললেন,

"ফকিন্নির মেয়ে হুট করে রাজার আসনে বসলে তো এমনই হবে। তুই আবার আমার ভাইয়ের মেয়ের গায়ে হাত তুলিস। তোর সাহস দেখে আমি অবাক।"


"আপনার সাহস দেখেও আমি অবাক। ভুলে যাচ্ছেন, আমার কাছে আপনার ইজ্জত আমানত আছে? এমন কিছু করবেন না যে আমার সবটা মেলে দিতে হয় সবার সামনে।"


রোজা সওদাগর যে খুব নিবিড় একটা হুমকি দিলো তা বুঝতে বাকি রইলো না আফজাল সওদাগরের। তার রাগ তখন সীমা পেরিয়ে গেলো। অনবরত আঘাত করতে থাকলো তার স্ত্রীকে। 


তাদের ঘরের এমন হৈচৈ শুনে অবনী বেগম, অহি, চাঁদনী সহ সবাই ছুটে আসে। এমন বিরল ঘটনা ঘটতে দেখে তারা রীতিমতো অবাকে হা হয়ে রইলো। লতা বেগম আর অবনী বেগম এসে হাত ছুটানোর চেষ্টা করলো কিন্তু আফজাল সওদাগরের পুরুষ শক্তির কাছে তাদের জোড়াজুড়িটা খুবই স্বল্প। চাঁদনীর শরীর তখনও দুর্বল, কণ্ঠে অসুস্থতার ছোঁয়া, তবুও সে এই ক্ষীণ কণ্ঠে বললো, 

"আব্বু, কি করছো? আম্মুকে ছাড়ো।"


মেয়ের দুর্বল কণ্ঠ কর্ণদ্বয়ে পৌঁছাতেই হাতের চাপ ঢিলে করে দিলো আফজাল সওদাগর। ছেড়ে দিলেন অর্ধাঙ্গিনীকে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে সে স্তব্ধ হয়ে যায়। তাকে নিয়ে সবার মনে যে সম্মানের জায়গা ছিলো, আজ সে জায়গাটা কেমন যেন হালকা হয়ে গেলো। রোজা সওদাগরও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। সেও চায় নি তার স্বামীর সম্মান কিঞ্চিৎ কমুক। তাই তো ঘটনা ধামাচাপা দিতে ক্ষীণ স্বরে বললো, 

"সবাই বের হও, উনি মাত্র এসেছেন তো তাই মাথা গরম। তোমরা যাও এখন।"


সাথে সাথে সবাই বেরও হয়ে গেলো বিনা প্রতিবাদে। অহি চাঁদনীকে ধরে নিয়ে গেলো। আফজাল সওদাগরও আবার বসে পড়লেন আরামকেদারা খানায়। সে তার জীবনে ভাই, ভাইদের ছেলে-মেয়ে,বোন, বোনের ছেলেকে অনেক বেশিই ভালোবেসেছে। আর চিত্রাকে বোধহয় একটু বেশিই ভালোবেসেছে কারণ সে চিত্রার মাঝে তার অতীতের খুব গোপনের মায়া-মায়া, আদুরে সেই কন্যার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়। যার প্রতি দায়িত্বহীন হয়েছিল বিধায় তার অগোচরে সে কন্যা ঢলে পড়েছিল মৃত্যুর মুখে। সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারে নি। না প্রায়শ্চিত্ত করতে পেরেছে সে পাপের, তন্মধ্যেই রোজা সওদাগরের এহেন আচরণ তাকে আরও ভেঙে দিয়েছে, তাই তো সে হারিয়ে ফেললো নিজের এতদিনের ব্যাক্তিত্ব কিংবা বলা যায় খোলশ। 


(৫৮)


তপ্ত দুপুরে ঘামে ভিজে একাকার অহির শরীরখানা। কি মারাত্মক রোদ উঠেছে পহেলা অক্টোবরের আকাশে!বিরক্তের আকাশে হুট করে মুগ্ধতা নিয়ে হাজির হলো নওশাদ। সাদা শার্ট, গলায় টাই, কালো প্যান্টে মারাত্মক সুন্দর লাগছে লোকটাকে। অহি যখন নওশাদের এমন রূপ দেখলো, সে বেশ অবাক হয়েই তাকিয়ে রইলো নওশাদের পানে। 


অহিকে দেখেই হাসি খুশি নওশাদ হেলেদুলে চলে এলো অহির পাশে। মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে বললো,

"কি হে মিস, আজ রোদ বোধহয় আপনাকে বেশিই উত্যক্ত করেছে!"


অহি ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম টুকু মুছলো, বিরক্তের স্বরে বললো, 

"হ্যাঁ বেশিই উত্যক্ত করেছে, আর এখন আপনি নিশ্চিত তার চেয়েও বেশি করবেন।"


নওশাদ হেসে দিলেন। মাথার পেছনে চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে বললেন,

"তা আপনি মিছে বলেন নি। হুট করে আপনার কথা মনে হলো, তাই চলে এলাম উত্যক্ত করতে।"


"আপনি নাকি কাজ করেন? তা সারাদিন মেয়েদের পিছনে ঘোরা ছাড়া তো কোনো কাজ আপনার নেই দেখছি।"


"মেয়ের পিছনে ঘুরি ঠিক তবে মেয়েদের পিছে না। আর এখন লাঞ্চ ব্রেক চলছে মিস।"


নিজের ঝাঁঝালো কথার বিপরীতে নওশাদের হাসি খুশি উত্তরে কিঞ্চিৎ খারাপ লাগলো অহির। তাই সে আর কিছু না বলেই হাঁটা ধরলো। নওশাদও সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে বললো, 

"আপনার জন্য একটা জিনিস এনেছি মিস।"


অহি ভ্রু কুঁচকালো। চোখ মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

"কি জিনিস?"


নওশাদ তার পকেট থেকে তৎক্ষনাৎ কালো গোলাপ টা অহির সামনে ধরলো। চোখের মাঝে আনন্দের চিলিক খেলিয়ে বললো,

"কালো গোলাপ, ভালোবাসার বিষাদময় প্রতীক। পছন্দ তো আপনার?"


অহি মিনিট দুই ফুলটার দিকে তাকিয়ে রইলো। হুট করে তুমুল মাথা ব্যাথায় তার চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। কেমন যেন শিরা-উপশিরায় আ* ন্দোলন চালালো রাগ। নওশাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো গোলাপটা এবং ভীষণ নিষ্ঠুরভাবে কয়েক টুকরো করে ছুঁড়ে মারলো তা দূরে। নওশাদ কেবল ফ্যালফ্যাল করে দেখলো সবটা। সে যেন কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না। অহির কাছে এমন একটা আচরণ সে ঠিক আশা করে নি বলা যায়। 


অহি তুমুল রাগে হেঁটে চলে গেলো কয়েক পা। নওশাদ তখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে। এই গোলাপটা কেনার জন্য সে অফিস ছুটি নিয়েছে, ফুলের দোকানের কর্মচারীটার সাথে কথা কাটাকাটি করেছে, অথচ যার জন্য এটা কেনা হলো, সে কি করলো! 


অহি কয়েক পা এগিয়ে আবার থেমে গেলো। ফিরে তাকালো নওশাদের থমথমে মুখটার দিকে। খারাপ লাগায় ছেয়ে গেলো তার মনের আঙিনা। সে আবার পিছু ফিরলো, পিছুটান টেনে নিয়ে গেলো তাকে নওশাদ অব্দি। অহি ক্ষীণ স্বরে মাথা নত করে বললো,

"মন খারাপ করবেন না। আমি আসলে ফুল পছন্দ করি না। ফুল দেখলেই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। বলা যায় এটা আমার একটা মানসিক রোগ যা কেউ জানেনা। খুব ছোটোবেলার বিদঘুটে ঘটনার প্রভাবে আমার এই মানসিক রোগ, যা মাঝে মাঝে মানুষ খু* ন করার ইচ্ছে জাগাতেও সাহায্য করে।"


#চলবে

বোনাস পর্ব

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


বোনাস পর্ব


(৫৪)


জীবন ধারার স্রোত কখন কোথায় গিয়ে বিরতি নেয় তা জানে না কেউ। শৈবালের মতন কেবল ভেসে ভেসে চলতে হয় সেই স্রোতের তালে। দিন যায়, ক্ষণ যায় কেবল যায় না স্মৃতিরা। কেমন বুক ভার ভার কষ্টের পাহাড় আঁকে রোজ নিয়ম করে মন মন্দিরে। কখনো স্মৃতিরা খিলখিল হাসি হাসে, কখনো বা তারা করে নিরব আর্তনাদ। আমরা মানুষেরা কেবল চেয়ে চেয়ে দেখি নিজেদের স্মৃতির সেই ভয়ঙ্কর আহাজারি। স্মৃতি বদলানোর সাধ্য থাকলে, মানুষ সবার আগে নিজের খারাপ স্মৃতি বদলাতো। কারণ দিনশেষে স্মৃতিরা ভালো থাকতে দেয় না আমাদের। 


সেপ্টেম্বরের উনত্রিশ তারিখ। বৃহস্পতিবার। চিত্রা নিজের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার আজ পনেরো দিন হলো। কই, একটা সময় যে বাড়িটাকে নিজের পায়ের নিচের ভিত্তি, বেঁচে থাকার অবলম্বন মনে হয়েছিল, আজ সে বাড়ি বিহীন তো ভালোই কেটে গেলো পনেরোটা দিন। তাহলে আগে কেন মনে হতো, সে মানুষ গুলো ছাড়া নিজের কোনো অস্তিত্ব নেই? সময় মানুষকে বাঁচতে শেখায়। কখনো অনেক প্রাপ্তির মাঝে বাঁচতে হয়, কখনো বা বাঁচতে হয় তুমুল অপ্রাপ্তিতে। চিত্রারও সেই অপ্রাপ্তির জীবন শুরু হয়তো। অনেক তো হলো প্রাপ্তির ডানা ঝাপ্টানো। 


ধানমন্ডি লেকের পাশের বড় রাস্তার কোণ ঘেষে যাওয়া গলিটার ভেতরের দিকের রঙচটা হলুদ রঙের বাড়িটার দু'তলার দুইরুমের নির্জন ফ্লাট টাতে ঠাঁই হয়েছে চিত্রার। নির্বাসন বলা চলে। চাঁদনীর অনাকাঙ্খিত ক্ষতির শাস্তি স্বরূপ চিত্রার দীর্ঘ নির্বাসন ঘোষণা করা হয়েছে। খারাপ কি! নিরব বেঁচে থাকাটা মৃত্যুর জীবন্ত স্বাদ। চঞ্চল চিত্রাকেও সে স্বাদ নিতে হলো প্রিয় মানুষদের কাঠিন্যতায়। 


প্রকৃতিতে তুমুল ঝড় উঠলো। চিত্রা শুয়ে ছিলো খাটে। বারান্দায় ফুলের টব পড়ে যাওয়ার শব্দে তার গম্ভীর ধ্যান নষ্ট হলো। চোখে মেলে তাকাতেই দেখে দুপুরের ঠাঠা রোদ শূন্যে মিলিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন ভর সন্ধ্যে বেলা এটা! হুট করে প্রকৃতির এমন অসন্তুষ্ট অবস্থা দেখে বারান্দায় ছুটে গেলো চিত্রা। বারান্দায় কতগুলো জামাকাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছে, সে গুলোই আনার জন্য এত ব্যস্ততা। 


জামাকাপড় আলগোছে সরিয়ে আনতেই আকাশ ভেঙে ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামলো ধরার বুকে। চিত্রা ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিলো। মানুষের সঙ্গ পছন্দ করা চিত্রা আজ নিরবতায় আচ্ছন্ন। ভাগ্যের চাকাটা খুব দ্রুতই ঘুরেছে বোধহয়। 


বারান্দার দরজা আটকাতে গিয়ে বৃষ্টির ছাঁট কিছুটা গায়ে লাগলো চিত্রার। দরজার সাথে ডান হাতটার একটু জোরে ঘর্ষণ লাগতেই ডান হাতের তালুর উপর পরা বড় ফোসকা টা গলে গেলো। মৃদু স্বরে 'আহ্' করে উঠলো চিত্রা। একটু আগে ভাতের মাড় গালতে গিয়েই এই অঘটন টা ঘটেছে। অতিরিক্ত জ্বালায় চোখ টলমল করে উঠলো। অথচ চিত্রা ফিক করে হেসে দিলো নিজের ব্যাথা দেখে। হাসতে হাসতে হাঁটু মুড়ে বসলো বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে। ফোসকা পড়া জায়গাটার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন ভীষণ রকমের আহাজারি করা সুর অথচ তাচ্ছিল্য নিয়ে বললো,

"তোর আজও ব্যাথা লাগে, চিত্রা? ব্যাথারা তবে এত আঘাত পাওয়ার পরও ম* রে নি!"


নিজের করা প্রশ্নের ধ্বনি কানে বাজতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে। যখন বাড়ি ছাড়লো, তখনও তো এমনই বৃষ্টি ছিলো তাই না? এমন তান্ডবই তো চলে ছিলো প্রকৃতিতে! এমন ধ্বংসই তো হয়েছিলো চিত্রার নরম, কোমল হৃদয়টা তাই না?


চোখ বুঝে চিত্রা। চোখের পাতায় ভেসে উঠে সেদিন তার র* ক্তা* ক্ত মুখের দৃশ্য টা। 


চিত্রার নাক-মুখ দিয়ে অনবরত র* ক্তের স্রোত বেরিয়ে আসতে দেখে ভয় পেয়ে যায় তুহিন। তার ভীত কণ্ঠে বাড়ির বাকি সদস্যদেরও দৃষ্টি পরে চিত্রার উপর। মেয়েটার শরীর নিস্তেজ প্রায়। অবনী বেগম ছুটে আসে, পাগলের মতন চিত্রার চোখ-মুখে পানি ছিটাতে থাকেন। তুহিন হতভম্ব। সাথে হতভম্ব বাড়ির অন্যান্য মানুষেরাও। রোজা সওদাগরও আকষ্মিক ঘটনায় তাজ্জব বনে যায়। 


বোনের এই নাজেহাল অবস্থাতেও বাবাকে অটল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয় তুহিন। বাবার প্রতি ঘৃণায় রি রি করে উঠে তার শরীর। চিত্রা ততক্ষণে প্রায় বেহুশ অবস্থা। তুহিন বোনের হেলে যাওয়া শরীরটা দু'হাতে আঁকড়ে ধরে বাবার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে, 

"আপনি সত্যিই মানুষ তো, আব্বু?"


নুরুল সওদাগর তেমন উৎকণ্ঠা দেখালেন না। বরং বেশ ধীরে বললেন,

"ওকে ঘরে নিয়ে যাও, ডাক্তারকে কল করো।"


তুহিন তাচ্ছিল্য করে উঠে। জীবনের প্রথম তার কোনো মানুষকে ঘৃণা হলো। সে মুখ ঝামটি মেরে বাবাকে বললো,

"আপনার সেটা না ভাবলেও হবে, আব্বু। আমার বোন তো, সামলে নিবো নাহয় আমি। আপনি বরং আপনার সংসার সামলান।"


তুহিনের কথায় এবার একটু চিন্তার ভাঁজ পড়লো নুরুল সওদাগরের মুখে। কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললো,

"তুমি ব্যবস্থা করবে মানে?"


"যে মেয়েটা আপনাদের চক্ষুশূল, সে নাহয় আর আপনাদের চোখের সামনে না রইলো।"


তুহিনের এমন পরিস্থিতিতে এমন কথা হয়তো আশাকরি নি কেউ। তাই তো ফুপি ধমকে উঠে বললো,

"তুহিন, কি বলছিস বাবু তুই? মেয়েটার এ অবস্থাতেও এসব বলা লাগে? আপাতত কোনো ব্যবস্থা কর ওর। খারাপ কিছু হয়ে গেলে পরে!"


"ভালোই তো হবে, ফুপি। আপনাদের ঘরে থাকার চেয়ে আমার মনে হয় ওর ম* রে যাওয়াটা ওর জন্য সুখের, তাই না চিত্রার বড় চাচীম্মা?"


বাহারের হুট করে আগমন এবং এমন অপ্রাসঙ্গিক কথায় সবার মুখটা ছোটো হয়ে এলো। নুরুল সওদাগর ধমক দিলেন বাহারকে। আঙ্গুল উঁচিয়ে বললেন,

"তোমাকে কেউ আমার মেয়ের ব্যাপারে বা আমার সংসারের ব্যাপারে কথা বলতে বলেছে?"


"আপনার মেয়ে! হাসালেন তো। সুন্দর কৌতুক। তা আমি মনে করি, এমন বাবার মেয়ের এমন দুর্ভাগ্যই প্রাপ্য। এই যে র* ক্তা* ক্ত হয়ে পরে থাকাটাই তার প্রাপ্য। শুনেছি বাবারা সন্তানের বটগাছ হয়, একমাত্র আপনাদের পরিবারেই দেখলাম, বাবারা সন্তানের চরম সর্বনাশের কারণ।"


"তোমাকে দু'টো চ* ড় বসানো উচিৎ । বেয়া* দব ছেলে।"


"আরে স্যার, আগে নিজে তো আদবটা রপ্ত করুন। তারপর নাহয় অন্যকে বে* য়াদব বলবেন।"


নুরুল সওদাগরের কথা সেখানেই থেমে গেলো। বাহারের সাথে তর্কে জড়ানোটা নেহাৎই বোকামি ছাড়া কিছু না। বাহার এগিয়ে আসলো চিত্রার কাছে। অহির দিকে তাকিয়ে বরফ আনার নির্দেশ দিলো। অহি তৎক্ষণাৎ বরফ নিয়ে চলে এলো। চিত্রার নাকের কাছটাকে কিছুক্ষণ বরফ ধরে রাখতেই বন্ধ হয়ে গেলো র* ক্তের স্রোত। চিত্রার নিভু নিভু চোখে তখনও জল গড়িয়ে পড়ছে। ভেজা ভেজা কণ্ঠে অস্ফুটস্বরে সে বললো,

"আমি সত্যিই চাঁদনী আপার ক্ষতি চাই নি, বাহার ভাই।"


"আমি জানি।"


বাহারের ছোট্টো উত্তরটার পরে জ্ঞান হারালো চিত্রা। মেয়েটার বেহাল অবস্থা দেখে বুক কাঁপলো বাহারের। সে তুহিনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো, 

"তুহিন, মেয়েটাকে বাঁচতে চাইলো নিরাপত্তা দিতে হবে। অথচ তোমার পুরো বাড়িটাই বর্তমানে তার জন্য অনিরাপদ জায়গা। যা করবে, ভেবে করো।"


বাহারের ইঙ্গিতের কথাবার্তা হয়তো তুহিন ঠিক বুঝলো। বোনের মাথাটা চেপে ধরে বড়চাচীর হতভম্ব মুখটার দিকে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, 

"আপনি কী চান?"


"আমি তোমাদের ভালোবাসি। তার চেয়ে বেশি ভালোবাসি আমি আমার সন্তানদের। চিত্রাকে সামনে দেখলেই আমার সন্তানের সর্বনাশের কথা মাথায় চলে আসে। বাকিটা তোমরা জানো।"


চাচীর উত্তর শোনার পর তুহিন বাবার মুখের দিকে তাকালো। তার এতটুকু বিশ্বাস ছিলো বাবা হয়তো এবার কিছু বলবে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বাবা কিছুই বললেন না আশানুরূপ। বরং নিবিড় কণ্ঠে বললেন,

"ভাবী আমাদের সংসারের কত্রী। তার কথাই শেষ কথা।"


অতঃপর তুহিন আর কারো পিছুডাক শুনলো না। বোনকে নিয়ে এক কাপড়েই বেরিয়ে গেলো। ছোটো চাচী, ফুপি, অহি সবাই ই পিছু ডাকলো, কেবল যার ডাকার কথা ছিলো সে-ই মানুষটাই নীরব রইলো। 


সওদাগর বাড়ির বহু পুরোনো ভিত্তিটা কেঁপে উঠলো। ভাঙনের সুরে ইট-পাথর গুলোও যেন কেঁপে উঠলো। এই বাড়িটাকে এক সূত্রে বেঁধে রাখার জন্য যেই নারী জীবনের সবচেয়ে বড় ত্যাগ করেছিলো, আজ সেই নারীর হাত ধরে ভাঙন শুরু। 


হঠাৎ বজ্রপাতে কেঁপে উঠলো চিত্রা। শরীরও প্রায় কিছুটা ভিজে গিয়েছে। চোখের কোণে সরল গতিতে বেয়ে পড়লো অশ্রুররেখা। কেমন ছাড় খাঁড় করা দুপুর এটা! কেমন নিস্তব্ধ করা বেলা! 


বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে চিত্রার ডাক ভেসে এলো যেন ভয়াবহ বাতাস ভেদ করে। চিত্রা মনে মনে ভাবলো হয়তো ভুল শুনেছে। পর পর আবারও ডাক ভেসে এলো। বারান্দা দিয়ে তাকাতেই ভেজা শার্ট লেপটে থাকা শরীরে বাহার ভাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সে। বাহার ভাইয়ের সাথে গত সপ্তাহে দেখা হয়েছিলো। এরপর আর লোকটার খোঁজ নেই। আজ হুট করে কোথা থেকে উদয় হলো সে! 


চিত্রাকে ধ্যানে মগ্ন থাকতে দেখে বাহার তৃতীয় বারের মতন নাম ধরে ডাকলো এবং নিচে আসার ইঙ্গিত দিলো। চিত্রা মাথা দুলালো, প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

"নিচে আসবো কেনো? আপনি উপরে আসুন।"


বাহার বৃষ্টির জন্য ভালো করে চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না। তবুও বারান্দার জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসা চিত্রার মুখমন্ডলের দিকে তাকিয়ে বললো, 

"তাড়াতাড়ি আসলে আসো নাহয় বসে থাকো। এত কৈফিয়ত দিতে পারছি না।"


চিত্রা অধৈর্য হয়ে বললো,

"দাঁড়ান দাঁড়ান, আসছি।"


বাহারের মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপলো। সে মিটমিটিয়ে হেসে বললো, 

"তাড়াতাড়ি আসো মেয়ে। বৃষ্টি যে আমাকে ভিজিয়ে নাজেহাল করে দিচ্ছে। অথচ আমার ভেজার কথা ছিলো তোমার প্রেম বৃষ্টিতে।"


এমন খোলামেলা, অস্ফুটে বাহারের লাগামহীন কথাতে তাজ্জব বনে গেলো চিত্রা। সে দ্রুত মাথা ভিতরে ঢুকিয়ে ফেললো। লজ্জায় ক্ষাণিকটা সময় চুপও ছিলো। অতঃপর ফ্লাটের দরজা আটকে ছুটে গেলো নিচে। 


(৫৫)


তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে, শীতে জুবুথুবু চিত্রার শরীর। হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে অনেকটা দূর। বাহার ভাইয়ের নাকি আজ ভেজা শহর দেখার শখ জেগেছে। সেই শখ পূরণ করতেই তার ছুটে আসা। 


চিত্রাকে শীতে কাঁপতে দেখে আড়চোখে তাকালো বাহার। ঠাট্টার স্বরে বললো, 

"অত কাঁপা-কাঁপি করে লাভ নেই মেয়ে, টিভির হিরোদের মতন গায়ের জামা খুলে দিতে পারবো না। আমারও তো লজ্জা-টজ্জা আছে নাকি।"


বাহারের কথায় গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে রইলো চিত্রা। ভাষাহারা তার কণ্ঠ। বিস্মিত কণ্ঠে সে বললো,

"বাহার ভাই, আজ কথার লাগাম ছেড়েছেন নাকি?"


"না না ছাড়ি নি। কেবল বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেছে বেড়িবাঁধ। ও তুমি চিন্তা করো না, বৃষ্টি চলে গেলে অনুভূতিরাও আবার লুকিয়ে যাবে।"


"বাহার ভাই জানেন? আপনি আমার বিশাল পূর্ণতা।"


"অথচ আমি মানুষটা গোটা এক শূণ্যতা।"


"আপনিও কী তবে আমায় ছেড়ে যাবেন?"


"ছাড়তে যদি হয়, তাইতো ধরতে করছি ভয়।"


"আপনি আমার বৃষ্টির দিনে এক কাপ চা।"


"তুমি আমার বৃষ্টির দিনে গরম গরম খিচুড়ির মাঝে, তেলতেলে ইলিশ মাছ ভাজা। 


মিষ্টি মিষ্টি কথাকে শেষমুহুর্তে এসে ঠাট্টায় উড়িয়ে দিলো বাহার ভাই। আবার নিজেই হা হা করে হেসে দিলো। চিত্রা প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলেও পরক্ষণেই সেও হেসে দিলো বাঁধন ছাড়া হাসি। ভেজা রাস্তায়,তুমুল বর্ষণে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্য বোধহয় এটা। দু'জন মানুষ দু'জনের দিক থেকে তুমুল ভেঙে যাওয়া অথচ দু'জনই দু'জনের সান্নিধ্যে চরম সুখী। অপ্রাপ্তির মাঝে সবাই হাসতে জানেনা, সবাই হাসাতে জানেনা, যারা জানে, তারা প্রত্যেকে একেক জন দারুণ মানুষ। 


(৫৬)


ভেজা শরীরে গরম গরম খিচুড়ি সাথে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে পেট পুরে খেয়ে নিলো দুজনেই। চিত্রা মাছ বাছতে পারে না বলে খুব যত্নে সে কাজটা করে দিলো বাহার ভাই। ভাবা যায়, একজন অগোছালো মানুষ কোনো একটা মানুষের কাছে এসে নিপাট ভালো মানুষ হয়ে যায়! ভালোবাসা সব পারে, তাই তো ভালোবাসা সুন্দর। 


খিচুড়ি খেয়ে বেরুতেই চিত্রাকে থামিয়ে দিলো বাহার। চিত্রা অবাক হলো, অবাক কণ্ঠে বললো, 

" বাসায় যাবেন না? অনেকক্ষণ তো হলো।"


বাহার হাসলো। মিষ্টি কণ্ঠে বললো, 

"তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।"


"কি সারপ্রাইজ?"


বাহার চিত্রাকে ইশারা করলো পিছে তাকাতে। তখনও প্রকৃতিতে বর্ষণ অবস্থানরত। চিত্রা পিছু ফিরেই বৃষ্টির মাঝে ঝাপসা ঝাপসা ভাবে মানুষটার মুখ দেখতেই অবাক হয়ে গেলো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে একবার বাহার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছুটে গেলো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে। নিসঙ্কোচে জড়িয়ে ধরলো সে মানুষটাকে। চোখের মাঝে তখন তুমুল খুশির অশ্রুরা। শক্ত করে মানুষটাকে জাপ্টে ধরে ক্রন্দনরত সুরে সে বললো, 

"তোমার মতন কেউ আমাকে ভালোবাসতে পারে নি। ওরা আমায় ভালোবাসে নি।"


#চলবে