গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ২১

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


পর্বঃ একুশ


(৫২)


হুড়মুড় করে কেমন অবসাদের বাতাস বয়ে গেলো প্রকৃতি নিবিড় করে। হা হুতাশ মাখানো অসুস্থ বাতাস। হাহাকার করা নিস্তব্ধ বাতাস। চিত্রা লোহার গেইট টার হাতল ধরে ভেজা চোখে যেন কার পথ চেয়ে রইলো। কার ফেরার আশায় যেন উতলা হলো তার দেহের ছোট্টো হৃৎপিণ্ড খানি। চিত্রা কেবল ঝাপসা চোখে অপেক্ষা করলো কিছু সুখবরের। শরীরে জড়ানো সুতির আকাশী রঙের জামাটায় তখনও র*ক্তের দাগ। হাতে লেগে আছে শুকনো র* ক্ত। 


"আম্মা, আপনে ঘরে গিয়া বহেন। রাত তিনটা বাজে এইহানে বইয়া আছেন, ঠান্ডা লাগবো তো। যান আম্মা, ঘরে যান।"


বাড়ির সবচেয়ে কমদামী মানুষ বৃদ্ধ দারোয়ান চাচার আদর মাখানো দুশ্চিন্তা চিত্রার কানে কয়েকবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে-ফিরে গেলো তার নীড়ে। চিত্রা অটল,স্থির হয়ে বসেই রইলো। বিশেষ হেলদোল দেখালো না সে। যেন তার অবহেলিত শরীরটায় অবহেলাটাই প্রাপ্য। তুখোর অবহেলায় অবহেলায় ঝল* সে যাওয়াটাই তার প্রাপ্য। 


দারোয়ান চাচা হতাশার শ্বাস ফেললো, নিবিড় কণ্ঠে বললো, 

"অন্তত আমার টুল টার উপরে উঠে বসেন, আম্মা।"


চিত্রা এবারও নিশ্চুপ। প্রাণহীন দৃষ্টিতে একবার তাকালো বৃদ্ধ দারোয়ানের দিকে। চোখে তখন অশ্রু কনারাও বিরতি নিয়েছে কিন্তু গাল তার তখনও ভেজা। বহু কষ্টে চিত্রা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে অপরাধী সুরে উচ্চারণ করলো, 

"আমি ইচ্ছে করে চাঁদনী বুবুকে ধাক্কা মারি নি, চাচা। তুমি তো আমায় বিশ্বাস করো তাই না?"


বৃদ্ধ মতিউর রহমান গোলগাল মেয়েটার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালেন। মেয়েটার দু'গালে তখনো নির্মম চ* ড়ের ছাপ স্পষ্ট। চুল গুলো বেজায় টানাটানিতে অগোছালো। বা'চোখের কোণাটাও কেমন ফুলে আছে! কি মা*রটাই না মেরেছে! 


চিত্রা এবার বাঁধ ভেঙে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। নিজের ধুলোমাখা দু'হাতের মাধ্যমে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে অস্ফুটেস্বরে বললো, 

"আমি ইচ্ছে করে করি নি, চাচা। আমি এত অ-মানুষ নই। চাচা গো, আপাটার কিছু হলে সে কলঙ্কের কালিতে যে আমি পু* ড়ে ছাই হয়ে যাবো। আমার সে পাপের কী হবে শাস্তি!"


বৃদ্ধ মতিউর স্বান্তনার ভাষা খুঁজে পেলো না। তার সীমাবদ্ধতা যে খুবই অল্প। সে অল্প সীমাবদ্ধতা দিয়ে দুঃখিনী চিত্রার দুঃখ মুছবার যে তার ক্ষমতা নেই। বড়জোর সে তার নিজের চক্ষুদ্বয়ের অনাকাঙ্খিত অশ্রু মুছতে পারবে। 


চিত্রা কাঁদতে কাঁদতেই গেটের সাথে হেলান দিলো। হুট করে সব অনাকাঙ্খিত ঘটনা যেন তার নামেই লিখে দিলো সৃষ্টিকর্তা। এমন না হলে, খুব বেশিই কী ক্ষতি হয়ে যেতো! চাঁদনী আপার র* ক্তা* ক্ত শরীরটা সবার প্রথমে সে-ই ছুঁয়ে ছিলো। তার পিছে পিছে ছুটে এসেছিল দুলাভাইও। বাড়ির প্রত্যেকে ততক্ষণও হতভম্ব। যখন সবার মস্তিষ্কে মি* সাইলের চেয়েও দ্রুত বেগে ছুটে গেলো এই অঘটনার খবর, পুরো সওদাগর বাড়ি যেন হুমড়ি খেয়ে পড়লো। কত আহাজারি, চেঁচামেচিতে কেমন ভয়ানক বিষাদপুরিতে রূপান্তরিত হয়েছিলো সওদাগর বাড়ি! 


যখন নিস্তেজ হওয়া চাঁদনী আপার প্রাণ আশঙ্কায় কলিজের পানি শুকিয়ে আসছিলো সবার, তখন রোজা সওদাগর করলেন আরেক কাজ। চিত্রার চুলের মুঠি টেনে অনবরত চার-পাঁচটা চ* ড় সে বিরতিহীন ভাবে বসিয়ে দিলেন চিত্রার কোমল, তুলতুলে গাল গুলোতে। সাথে নিম্ন পর্যায়ের ভাষা। যা শোভনীয় না মায়ের মতন চাচীর মুখে। কিন্তু এসব আচরণে ধ্যান নেই চিত্রার, সে কেবল আপাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য চিৎকার করছিলো। শেষ চ* ড়টা বসানোর সময় বাহার রুখে দাঁড়ায়। কেমন অদ্ভুত সাহসের সাথে বলে, "ওর গায়ে আরেকটা চ* ড় পরলে, সে হাত নাও থাকতে পারে।" ব্যাস থেমে গেলেন রোজা সওদাগর। অতঃপর কেঁদে উঠলো সে। সবাই ছুটলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে কেবল পুরো বাড়িতে একা পরে রইলো অপ্রয়োজনীয় সদস্য চিত্রা। অবশ্য তার ফুপি,অনয় এবং চেরি রয়ে গেছে কিন্তু চিত্রার প্রতি তাদের অনীহা। রোজা সওদাগর যেতে যেতে চিত্রার পেটে তুমুল ভাবে লা* থি দিতেও ভুললেন না। 


আবারও গেইটে মাথা ঠুকে কেঁদে উঠলো চিত্রা। কে জানে, তার আপাটা কেমন আছে! চিত্রার নিরাশায় পরিপূর্ণ ব্যাথার মরুভূমিতে আশার চাঁদ হয়ে এলো বাহার। বাহারের ক্লান্ত, পরিশ্রমে নেতিয়ে যাওয়া শরীরটাকে হেলদুলে আসতে দেখা গেলো। 


বাহার গেইটের দিকে এসে বিধ্বস্ত চিত্রাকে দেখে হতভম্ব। অনবরত কান্নার ফলে চোখ ফুলে নাজেহাল অবস্থা। বাহারের চোখে-মুখে বিস্ময়। সেই বিস্ময় ছড়িয়ে গেলো কণ্ঠধ্বনি অব্দি। সে বিস্মিত কণ্ঠে বললো, 

"রঙ্গনা, এখানে এ অবস্থায় কি করছো! তুমি এখনো রুমে যাও নি!"


চিত্রা কথার উত্তর দিলো না। মনের মাঝে প্রশ্নরা দানা বেঁধে আছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। যদি কোনো খারাপ খবর হয়, তবে চিত্রা নিজেকে কীভাবে ক্ষমা করবে? 


বাহারের প্রশ্নে উত্তর দিলো মতিউর রহমান, 

"না বাবা, আম্মা যে সেই সন্ধ্যা বেলা এখানে বসেছে, এখানেই আছে। আমি কতবার কইলাম ভেতরে যাইতে, উনি পথেই বসে আছে।"


বাহার ভাইয়ের ভ্রূদ্বয় কুঞ্চিত হলো। হাঁটু ভেঙে সে বসলো চিত্রার পাশে। চিন্তিত কণ্ঠে বললো, 

"এই মেয়ে, এখানে এভাবে বসে আছো কেনো? মাথায় কি সমস্যা তোমার? কি অবস্থা নিজের করেছো? উঠো দেখি।"


আহ্লাদ পেয়ে গেলো চিত্রার কান্না। সে বাহার ভাইয়ের ডান হাতটা আঁকড়ে ধরে অপরাধী কণ্ঠে অনবরত বলতে লাগলো,

"আমি ইচ্ছে করে করি নি এমন, বাহার ভাই। আপনি তো আমায় বিশ্বাস করেন তাই না?"


বাহার চিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো, 

"আমার বিশ্বাস করার আগে তোমার নিজেকে নিজের বিশ্বাস করা উচিৎ। তুমি কেনো ভয় পাচ্ছো, অপরাধী ভাবছো নিজেকে!"


"কিন্তু তখন আমিই আপার হাত ঝাড়া দিয়ে ছিলাম। এটা তো ঠিক।"


"যা হয়েছে সেটা দুর্ঘটনা, ইচ্ছেকৃত না। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না।"


"আমাকে কেউ বিশ্বাস করছে না, বাহার ভাই।"


"আমি তো করছি। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করছি। আমি জানি, তুমি কারো বিরাট ক্ষতির কারণ হবে না।"


চিত্রার তুমুল কান্নায় এই স্বান্তনার বাণী টুকু প্রয়োজন ছিলো। কান্নার ছাটও নিমিষেই কমে এলো। চিত্রা চোখ-মুখ মুছে উৎকণ্ঠিত হয়ে বললো,

"আচ্ছা বাহার ভাই, আপা কেমন আছে? আর বাবু? দশ মাস বাবুর জন্য কত অপেক্ষা করলাম, আর শেষ মুহূর্তে এসেই কিনা,,, "


কথা বলতে বলতে আবারও চিত্রার আকাশ ভেঙে কান্না এলো। বাহার তৎক্ষণাৎ মুখ চেপে ধরলো চিত্রার। আদুরে এক ধমক দিয়ে উঠলো। মিছে রাগী রাগী স্বরে বললো, 

"আরেকবার যদি কেঁদেছো, তবে এখুনি তোমাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসবো।"


বাহারের এমন অবিশ্বাস্যকর কথায় কান্নার মাঝেও হেসে দিলো চিত্রা। গোলগোল চোখে হাসতে হাসতেই বললো,

"আমাকে কি আপনার চেরি মনে হয় যে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছেন!"


"কেনো দেখাতে পারবো না ভয়? তুমি চেরি না হও চিত্রা তো।"


"হ্যাঁ, আমি চেরি না চিত্রা। কেউ বড় মানুষকে এগুলা বলে ভয় দেখায়?"


"তাহলে বড় মানুষ, তুমি কেন এমন অবুঝের মতন কাঁদছো! বড় মানুষের তো অবুঝ হওয়া সাজে না।"


বাহারের কথার জালে যে খুব বাজে ভেবে ফেঁসে গেছে চিত্রা তা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার। অতঃপর ছোটো একটা শ্বাস ফেলে, নিবিড় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, 

"আপার কী অবস্থা, বাহার ভাই? সুস্থ আছে তো?"


বাহার মাটি থেকে উঠে চিত্রাকে ডান হাত দিয়ে টেনে তুললো। চুল গুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বললো, 

"তোমার আপা ঠিক আছেন। এখন রুমে গিয়ে সুন্দর মতন গোসল করে, খেয়ে ঘুমাবে কেমন?"


অগোছালো বাহারের এমন গোছানো যত্নে চিত্রার কান্নারা নির্বাসনে গেলো। সে ভদ্র মেয়ের মতন বললো,

"আচ্ছা।"


সে ভদ্রমেয়ের মতন কথা রাখলো। শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বাহার তাকে হাত ধরে ঘর অব্দি পৌঁছে দিলো। 


(৫৩)


বাহার ভাই যে ভীষণ মিথ্যে কথা বলে চিত্রাকে সামলেছে তা জানা গেলো পরেরদিন হসপিটাল থেকে সবাই আসার পর। মুখ থমথমে অনুভূতি, তার প্রতি সকলের অসন্তুষ্ট চাহনি আর বড়চাচীর আক্রোশ দেখে। 


গতকাল রাতে চিত্রা বাহার ভাইয়ের কথা অনুযায়ী গোসল করে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুম ভাঙার পর দেখে ঘড়ির কাটায় সময় তখন দুপুর বারোটা। হুড়মুড় করে সে উঠে বসতেই নিচ থেকে কেমন ফুঁপানোর শব্দ এলো। কে যেন মিহি স্বরে কাঁদছে। চিত্রা হতবিহ্বল। গতকাল বাহার ভাইয়ের কথা অনুযায়ী তো আজ কান্না-কাটি করার কথা না। তাহলে! 


মনের কৌতূহল মিটানোর জন্য সে দ্রুত গতিতে নেমে গেলো বিছানা থেকে। তার চেয়েও দ্রুত সে বসার রুমে উপস্থিত হলো। বসার রুমে বড় চাচীর ক্রন্দনরত মুখটা দেখেই ছলাৎ করে উঠে বুক। সে চাচীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অবাক কণ্ঠে বললো, 

"চাচী, কী হয়েছে? কাঁদছো কেনো?"


রোজা সওদাগরের ঝিমিয়ে থাকা আক্রোশ তুমুল হলো। চিত্রাকে তুমুল এক লা* থি মেরে বসলো। চিত্রা দু'হাত দূরে ছিটকে পরলো। তুহিন সবে দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছে। বোনের এহেন অবস্থা দেখে সে ছুটে এলো। আ* হত চিত্রাকে আঁকড়ে নিলো। নির্ঘুম কাটানো রাত্রির কারণে চোখ-মুখ তার কেমন হলদেটে ভাব। বড় চাচীর মন মেজাজ খারাপ তবুও বোনের প্রতি এমন আচরণ সহ্য করতে পারলো না তুহিন। কর্কশ কণ্ঠে বললো, 

"আপনার হা-পা সামলে রাখবেন, চাচী। নাহয় আমার অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।"


ক্ষুধার্ত বাঘিনীর ন্যায় হিং* স্র হয়ে উঠলো রোজা সওদাগর। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চিত্রার গলা চেপে ধরে বলল,

"তোর জন্য আমার মেয়েটার আজ এ অবস্থা। তোর এত রা* গ না রে? খেয়ে দিলে আমার মেয়ের বাচ্চাটাকে? তোর এত খিদে?"


অবনী বেগম, অহি ছুটে এলো রোজা সওদাগরকে ছুটানোর জন্য। কেমন পৈচাশিক শক্তি যেন ধরলো তাকে। তুহিন অনেক কষ্টে হাত ছাড়ালো রোজা সওদাগরের। তুমুল পেট ব্যাথা সাথে গলা চেপে ধরায় চিত্রার মুখ নাক দিয়ে গলগল করে র* ক্ত বের হওয়া শুরু করলো। 


#চলবে


[সময় করতে পারলে রাতে একটা বোনাস পর্ব দিবো। সিউর বলতে পারছি না।]

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ২০

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


পর্বঃ বিশ


(৪৯)


আজ সূর্য তার উত্তপ্ততা দু'হাত ভরে উজাড় করেছে বেকার যুবকদের জ্বা*লিয়ে দেওয়ার নামে। পথে-ঘাটে চাকরির খোঁজে হন্তদন্ত হয়ে অনবরত ছুটে যাওয়া বেকারদের বেলা সূর্য মানুষের মতন কঠোর হয়েছে। উত্তাপে সে ঝলসে দিতে চাচ্ছে বেকারদের দূর দূরান্তে হেঁটে যাওয়ার শক্তিকে। তবে বেকাররা সূর্যের চেয়েও তেজী হয়। মাথায় বেকারত্বের যে বোঝা, এই বোঝার চেয়ে আরও বেশি কঠিন তাদের কাছে কিছুই মনে হয় না। পেটে ক্ষুধা, পকেটে বাবার ওষুধের লিস্ট, হাতে প্রেমিকার বিয়ের কার্ড, মাথায় দায়িত্বের ভারী বস্তা- এসবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না সূর্যের তেজ। 


চাকরির ছয় নাম্বার পরীক্ষা টাও আজ দিয়ে দিলো বাহার। মাঝে সে অনেক ছুটাছুটি করেছে একটা চাকরির জন্য, কত রাত ঘুমিয়েছে ফুটপাতে! রাতের রাস্তার ভয়ঙ্কর শীতলতায় বুকে বেঁধেছিলো নিউমোনিয়ার সংসার। তবুও সে থামে নি। এখানে ওখানে যোগ্যতার বটবৃক্ষ ঝাঁকিয়ে করেছিলো চাকরির সন্ধান। অথচ বাহার তখন জানতোই না 'টাকার তৈরী এই অযোগ্য শহরে, যোগ্যতা কেবল নিরেট নিশ্চুপ,মূল্যহীন,পরিত্যক্ত  কবর।' আজ বাহার তা জানে। তবে আজ তার একটা চাকরির জন্য তেমন হাহাকার নেই। বেকারত্ব তো সব কেড়েছে, এখন বেকারত্বের হাহাকার বাহারের ভেতর ছুঁতে পারে না। চাকরির চিন্তায় আজকাল তার আর রাত জাগতে হয় না। তবে আজ হুট করে মনে হলো চাকরি তার প্রয়োজন।  পায়ের নিচের একটা শক্ত ভিত্তি প্রয়োজন। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে বেকারত্বের অভিশাপে কুকুরবিড়াল হয়ে বেঁচে থাকাটা জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। আর একজন পুরুষের ব্যর্থতা সমাজের কাছে হাস্যকর। 


মাথার উপর রোদের প্রখরতা। ঘামে ভিজে গেছে শরীরের খুব সস্তার টি-শার্ট খানা। এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল লেপ্টে গেছে পরম অবহেলায় কপালের মধ্যিখানে। সিগারেটে ঝলসানো ঠোঁট গুলো আর গালে চাপদাড়ির অবাধ বিস্তারে বাহার ভাইকে কেমন অবহেলায় হারানো নিদারুণ কোনো সুন্দর নির্দেশন লাগছে। যাকে দেখতে দেখতে কাটানো যাবে শত সহস্র যুগ। 


হুট করেই প্রচন্ড পথচারীদের ভীড়ের মাঝে বাহারের মাথায় আর রোদ লাগছে না। সে হাঁটছে, তার তালে তাল মিলিয়ে একটা ছায়াও হাঁটছে। বিরাট ছায়া। বাহার অবাক হয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো কাঁধ সমান চুল গুলো ঝুঁটি করে খুব সাদামাটা পোশাকে কি সুন্দর হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা! কপালে অবস্থানরত ভ্রূদ্বয় আপনা-আপনি কুঁচকে গেলো বাহারের। অবাক কণ্ঠে সে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

"এই যে মেয়ে, এখানে কী?"


চিত্রা বাহারের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে ডান হাতে ধরে রাখা রঙিন ছাতাটা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো,

"রোদ্রের মাঝে ছায়া হতে এসেছি। এইযে গরম আপনাকে কেমন নাজেহাল করে দিয়েছে, তা তো আমার মোটেও ভালো লাগে না।"


"রোদ ভালো, রোদে শোক ভুলে যাওয়ার ঔষুধ থাকে। অতিরিক্ত রোদ মাথায় থাকলে শোক তখন মস্তিষ্কে বিচরণ করতে পারে না। কিন্তু আমরা বরাবরই শীত পছন্দ করি। অথচ শীতলায় শোক গাঢ় হয়। যারা অতিবও বিষণ্ণতায় ভুগে, তাদের উচিৎ সারাদিন রোদের দাবানল সহ্য করে পথ থেকে পথান্তরে ঘুরে বেড়ানো।"


"আচ্ছা বাহার ভাই, এত মানুষের ভীড়ে যে এমন হেলেদুলে হাঁটছেন, বিরক্ত লাগে না?"


"এই হাজার মানুষের ভীড়ে থাকলে একাকীত্ব অনুভব হয় কম। মনে হয় আমার মানুষ না থাক, অনেক মানুষ তো আমার আশেপাশে আছে। জীবনকে পজিটিভ অনুভব করাও, তবেই না বেঁচে থাকা স্বার্থক।"


চিত্রা একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো এই বেকার যুবকটার দিকে। কে বলেছে এ শহর কেবল অর্থের পূজারী? এই যে, কিছু কিছু কিশোরীর মনে বেকার বাহার ভাইরাই তো একরাশ প্রশান্তি। 


চিত্রাকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আড়চোখে তাকালো বাহার। ফিচলে কণ্ঠে বললো, 

"এভাবে তাকিয়ো না মেয়ে, দুর্বলতা হানা দেয়। আচ্ছা মেয়ে, তুমি আজকাল বুকের বা'পাশটায় উঁকিঝুঁকি দেও কেনো! হেতায় কেনো তব বিচরণ?"


বাহারের প্রশ্নে লজ্জায় লাল হলো চিত্রার মুখ। বাহার ভাই দারুণ অস্বস্তি দিতে জানে। 


হাঁটতে হাঁটতে পথিমধ্যে বাদামও খেলো দু'জন। ভাগাভাগি হলো আরও কিছু অনুভূতি। অষ্টাদশীর জন্য এই যেন ঢের। 


(৫০)


অবনী বেগম দেশে ফিরেছেন পাঁচদিন হতে চললো। স্বাভাবিক, সহজ-সরল জীবন যাত্রায় সে ফিরে এসেছেন। ভিনদেশে যা চোখ দেখেছে তা সে ভিনদেশেই যেন রেখে এসেছে। সে খবর কাউকে জানায় নি সে, কাউকেই না। 


বাড়িটাতে আবার কিছুটা গমগমে ভাব। কেবল মুনিয়া বেগমের শূণ্যতা টা হুটহাট বেশ অনুভব হচ্ছে। এত খোঁজখবর করেও মানুষটার কোনো খবর পাওয়া গেলো না। চৈত্রের গল্প যেমন বৈশাখে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, তেমন মিলিয়ে গেলো মানুষটা। কত গুলো দিন মানুষটা ছাড়া দিন কাটাচ্ছে সওদাগর বাড়ি! 


রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত অবনী বেগম। তাকে হাতে হাতে সাহায্য করে দিচ্ছে চিত্রা। অহি আপা ভার্সিটিতে গেছে, নাহয় সেও সাহায্য করতো। আজকাল রোজা সওদাগরকে রান্নাঘরে তেমন দেখা যায় না। বেশ অদৃশ্য এক ক্ষমতার দাপট যেন পেয়ে বসেছে তাকে। না চাইতেও সবটা কেবল তার ইশারায় হচ্ছে। আর এসবের সবচেয়ে ভুক্তভোগী মানুষটা হলো চিত্রা৷ হুট করেই চোখের বালি হয়ে গিয়েছে সে। 


রান্নাঘরের ভয়াবহ রকমের গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার চিত্রা। ছোটো মুখটা কেমন শুকিয়ে গেলো। মা হীনতার অভাব যেন তার পুরো মুখমন্ডলে বিস্তার করছে। বাড়ির সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় মানুষ দোয়েলের মায়া লাগলো চিত্রার জন্য। সেই কিশোরী দোয়েল বেশ মায়া মায়া কণ্ঠে বললো, 

"চিত্রা আপা,আপনে ঘরে গিয়া একটু গোসল করেন। কেমন ঘাইমা গেছেন! আমি তো আছি এইহানে, চাচীরে আমি আগায় পিছাই দিমু।"


অবনী বেগমও চুলায় খুন্তি নাড়তে নাড়তে চিত্রার দিকে তাকালো। শ্যামলা মুখটা গরমে কেমন লাল হয়ে গেছে মেয়েটার! অবনী বেগমও আদুরে স্বরে বললো, 

"হ্যাঁ চিত্রা, যাও তোমার ঘরে। গোসল করো। গরমে কি অবস্থা হয়েছে তোমার! রান্নাঘরে এ জন্য আসতে না বলি। যাও যাও।"


চিত্রা পেয়াজের শেষ টুকরোটা কাটতে কাটতে বললো,

"এইতো যাচ্ছি, আরেকটু।"


অবনী বেগম আর কিছু না বলে কেবল হতাশার শ্বাস ফেললেন। বাড়িতে আসার পর, বাড়ির নিবিড় পরিবর্তন টা সে বেশ সুক্ষ্ম ভাবে খেয়াল করেছে। আর বেশিরভাগ সদস্য কেমন যেন এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে নির্দ্বিধায়। একমাত্র তুহিনের জন্য পরিবর্তন গুলো ধারালো ভাবে করতে পারছে না রোজা সওদাগর। ক্ষমতার লোভ সবচেয়ে বড় লোভ। এই লোভে মানুষ চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে যায়। 


পেয়াল গুলো সুন্দর করে কেটে ছোটো চাচীর সামনে রাখলো চিত্রা। অবনী বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে ধীর কণ্ঠে বললো, 

"চিন্তা করো না, চিত্রা। তোমার আম্মু ফিরে আসবে। সে তোমাকে এক মিনিটও চোখের আড়াল রাখতে পারতো না, হয়তে অভিমান হয়েছে খুব তাই এতদিন যাবত তোমার থেকে দূরে।"


অনেক গুলো দিন পর কারো স্নেহের হাত পেতেই অষ্টাদশীর প্রগাঢ় অভিমান ঠোঁট ফুলিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। কিন্তু সে বের করতে দিলো না। বরং অমলিন একটা হাসি দিয়ে বললো,

"মা হয়তো দূরে আছে কিন্তু আমি সবসময় অনুভব করি তাকে। তুমি চিন্তা করো না চাচী। আমি ঠিক আছি।"


অবনী বেগম আর কিছু বলার আগেই চিত্রা রান্নাঘর থেকে প্রস্থান করলো। দীর্ঘশ্বাসে ভারী হলো পরিবেশ। হাসি-খুশি পরিবারটার আদলে থাকা মানুষ গুলোর নির্মমতা বেরিয়ে আসছে যেন ভদ্রতার মুখোশ ঠেলে। 


(৫১)


ঝিম ধরা ভারী সন্ধ্যা, বৈরী তার বিবর্ণ বাতাস। অহি কাঁধের ব্যাগটা মুঠোয় চেপে ধীর গতিতে হাঁটছে। আজকাল চিত্রাকে তাদের বাড়ির গাড়িটা দেওয়া হয় না যাতায়াতের সুবিধার জন্য। মেয়েটার হাতে টাকাও বোধহয় নেই। অহি দিতে চাইলেও নেয় না। হেঁটে হেঁটে, বাসে চেপে যাতায়াত করে সে। কলেজ বাসা থেকে কাছেই, রিক্সা দিয়ে আসা যাওয়া করা যায়, হেঁটেও আসা যায় কিন্তু কোচিং বেশ খানিকটা দূরে। গাড়ি ছাড়া উপায় নেই। চিত্রার আবার বাস ট্রাভেলিং সহ্য হতো না। বমি করে ভাসিয়ে দিতো। অথচ আজ এ মেয়েটা নির্দ্বিধায় আসা-যাওয়া করছে সে বাসেই। চিত্রার প্রতি এমন অন্যায়ের নিরব প্রতিবাদে অহিও বাড়ির গাড়ি ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছে। 


অহির দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। সারা রাত-দিন পড়াশোনা করেও তার তৃপ্তি মিলছে না। পরীক্ষার হলে গেলেই সে যেন সব ভুলে যায়। কি একটা অবস্থা! 


"এই যে মিস, শুনেন প্লিজ।"


পরিচিত কণ্ঠ নিরব রাস্তায় যেন ঝঙ্কার তুললো। অহির ঝিমিয়ে থাকা চিত্ত মিনিটেই চঞ্চল হয়ে উঠলো। কপাল কুঁচকে বিরক্ত ছড়িয়ে গেলো তার সারা মুখে। পায়ের গতি থেমে গিয়েছে ততক্ষণে। 


নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা সুদর্শন নওশাদ খুব দ্রুত এগিয়ে এলো, অহির পাশাপাশি এসে দাঁড়ালো। মুখে তার বিরামহীন সেই হাসিটা। কণ্ঠে মধুরতা। পাশে এসে দাঁড়িয়েই মিষ্টি হাসি বজায় রেখেই বলল,

"পরীক্ষা কেমন হলো শুনি?"


অহির চোখ-মুখে তখন আঁধার করা বিরক্ত। কণ্ঠ ঝাঁঝালো করে সে উত্তর দিলো, 

"আপনাকে বলতে হবে!"


"হ্যাঁ, বলতে হবে বলেই তো জিজ্ঞেস করা।"


নওশাদের স্বাভাবিক উত্তরে অহির চোখেমুখে ধরা দিলো বিষ্ময়। লোকটা পাগল টাগল নাকি? ঝাঁঝালো কণ্ঠ আর স্বাভাবিক কণ্ঠের পার্থক্যও বুঝে না নাকি!


বিরক্ত হয়ে আবার নিজ গন্তব্যে হাঁটা ধরলো সে। নওশাদও পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, 

"আপনি যেন কোন ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট?"


"সাইকোলজি।"


"বাহ্, তবে তো রীতিমতো মানুষের ভেতরের তথ্য বুঝার বিশেষ ক্ষমতা আপনার আছে তাই না?"


নওশাদের কথায় থামলো অহি। বুকে দু'হাত ভাঁজ করে বলল,

"হ্যাঁ আছে। বলেন আপনার কি বলে দিতে হবে?"


নওশাদ কতক্ষণ মিছে মিছে ভাবুক মানুষ হলো। অতঃপর বেশ জয়ী একটা হাসি দিয়ে বললো, 

"বলেন তো আমি আজ নীল রঙের পাঞ্জাবি কেনো পড়েছি?"


অহি নওশাদের মুখের দিকে তাকালো। তারপর পা থেকে মাথা অব্দি একবার চোখ বুলিয়ে কর্কশ কণ্ঠে জবাব দিলো,

"আপনি বিশেষ কোনো কারণ ভেবে নীল রঙটা পরেন নি। হুট করে মন চেয়েছিলো তাই পরেছেন। আর কিছু?"


নওশাদ বেশ অবাক হলো। বিষ্মিত কণ্ঠে বলল,

"বাহ্, বুঝলেন কীভাবে?"


"কারণ যখন কেউ শুনে আমরা সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করছি তখন তারা আমাদের অভিজ্ঞতা যাচাইয়ের জন্য হুট করেই একটা অহেতুক প্রশ্ন করে যে প্রশ্নের উত্তর হয়তো বিশেষ কিছু না অথবা তাদের জানা নেই এমন কিছু।"


অহির আড়চোখে তাকিয়ে উত্তর বলার ভঙ্গিমা টা বেশ উপভোগ করলো নওশাদ। হাসিরা আরও বিস্তৃতি লাভ করলো। সে কণ্ঠ খাদে নিয়ে বলল,

"আমার মায়ের আপনাকে পছন্দ হয়েছে, জানেন?"


নওশাদের কথায় হুট করেই হেসে উঠলো অহি। হাসতে হাসতে বলল,

"আহা, ভর সন্ধ্যে বেলা মিথ্যা বলছেন কেনো?"


নওশাদ বেশ অবাক হলো তবে কণ্ঠে গো ধরে রেখেই বলল,

"না সত্যিই এটা।"


"উহুম, মিথ্যে এটা।"


"কীভাবে বুঝলেন?"


নওশাদের বিস্মিত অবস্থা দেখে অহির হাসি স্রোত বাড়লো। হাসতে হাসতে সে বলল,

"সাইকোলজির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিসেব আমাদের জানা আছে। আপনি সচারাচর হাত দুলিয়ে কথা বলেন, মানে সত্যি কথা গুলো। অথচ এই কথা টা বলার সময় আপনার দু'হাত স্থির ছিলো আর চঞ্চল হাসিটা কেমন গুমোট ছিলো। খুব সম্ভবত আপনার মায়ের আমাকে পছন্দ হয় নি এমন কথা সে আপনাকে জানিয়েছেন যার দরুন আপনি আমাকে উল্টোটা বলে পরীক্ষা করছিলেন। নাহয় এমন একটা কথা আপনার মাথায় এত দ্রুত আসতো না।"


নওশাদ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো কেবল। মেয়েটা দারুণ বুদ্ধিমতী। সত্যিই নওশাদের মা আজ কথায় কথায় অহির উচ্চতার কথা বলেছে। ছোটো-খাটো অহির উচ্চতা মহিলার বেশ অপছন্দ হয়েছে সেটাই জানিয়েছেন। 


নওশাদকে চুপ মেরে যেতে দেখে অহি গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

"আর কিছু বলবেন, মিস্টার?"


"আপনাকে আমার ভালো লাগে, সেটা জানেন?"


অহি ভড়কালো না নওশাদের এমন কথায় বরং বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

"এটাও মিথ্যে।"


নওশাদ অবাক হলো। মাথা দুলিয়ে বললো, 

"না, এটা সত্যিই। নাহয় এভাবে আপনার পিছু নিতাম বলুন?"


"সে তো আপনি আমাকে জানার আকাঙ্খা থেকে পিছু নিয়েছেন, ভালো লাগা থেকে না৷"


নওশাদের চলন্ত পা আবার থেমে গেলো। হ্যাঁ এটা ঠিক যে অহিকে জানার ইচ্ছেটা তার ভেতর আছে। কিন্তু পরেরটাও তো সত্যি। কিন্তু অহি তা মানতে নারাজ। কয়েক প্রকার বাকবিতন্ডার পর নওশাদ মুখ ছোটো করে বলল,

"আপনার সাইকোলজি সব দিয়েছে, অনুভূতি বুঝার ক্ষমতা কি দেয় নি?"


চিত্রা হাসতে হাসতে বলল, 

"আমার সাইকোলজির মতে নওশাদ সাহেবের অনুভূতি বেশ স্বল্প। আর এত স্বল্প অনুভূতি জাহির করা বোকামি।"


"আপনি পাষণ্ড।"


কথা খানা বলেই উল্টো দিকে হাঁটা ধরলো নওশাদ। অহি হাসতে হাসতে নিজেকেই নিজে বলল,

"ভালোবাসার মানুষকে অব্দি ভালোবাসা ছেড়ে দিলাম, পাষণ্ড না হলে কি পারতাম! আপনি তো দু'দিনের অনুভূতি নিয়ে আসছেন।"


ছোটো শ্বাস ফেলে দু'কদম এগিয়ে যেতেই কেউ ছুটে এলো তার কাছে। অহি অবাক হয়ে পাশের মানুষটার দিকে তাকালো। ফর্সা নওশাদ সাহেবের মুখ লাল হয়ে গেছে দৌড়ানোর কারণে। সে বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে অথচ মুখে আগের হাসিটা। হাঁপাতে থাকা অস্থির কণ্ঠ নিয়েই সে বলল,

"আচ্ছা আপনার সাইকোলজি মতে আপনাকে পটানোর কিছু ট্রিকস দিবেন?"


অহি অদ্ভুত ভাবে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে হা হা করে হেসে উঠলো। সেই হাসির ঝঙ্কারে নওশাদের সাথে মুগ্ধ হলো নিশ্চুপ রাস্তাটাও। 


(৫২)


সন্ধ্যার নাস্তার আয়োজনে মুখরিত ড্রয়িংরুম। চিত্রা আর দোয়েল মিলেই আয়োজন করেছে। তুহিনও আজ বাসায়। সবাই ই সোফায় বসে আছে কেবল চাঁদনী আপা বাদে। আপা বোধহয় ঘরে। 


চিত্রা যখন নাস্তার প্লেট টা টেবিলের উপর রাখলো তখন তুহিনের গুরুগম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো, 

"চিত্রা, আর কিছুদিন বাদে না পরীক্ষা? তুই এসব কেনো করছিস?"


চিত্রা নাস্তার প্লেট টা টেবিলে রেখে বড় চাচীর দিকে তাকালো। বড় চাচীই তাকে পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠিয়ে এনেছেন বিকেলের নাস্তা তৈরী করার জন্য। এখন এটা ভাইজান জানলে হয়তো তুলকালাম হতে পারে তাই সে চুপ করে রইলো। তন্মধ্যেই পরিচিত কণ্ঠ ভেসে এলো, 

"ওমা তুহিন, তোমার মা নেই এখন বাড়িতে, এই সুযোগে চিত্রাকে একটু কাজ শিখাতে হবে না? বলো?"


দরজার কাছে বাহার ভাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠলো চিত্রা সাথে বাহার ভাইয়ের এহেন কথা। কিঞ্চিৎ ভড়কে গেলো উপস্থিত সবাই কেবল হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো তুহিন। অবাক কণ্ঠে বলল,

"কাজ শিখাতে হবে মানে? ওর আবার কিসের কাজ? পড়াশোনা আছে না!"


"পড়াশোনা আছে নাকি? আমি ভেবেছি তোমাদের মা যাওয়ার সাথে সাথে ওর পড়াশোনাটাও নিয়ে গেছে। নাহয় মানুষের হুকুমে এমন উঠ-বস করতো!"


বাহার ভাই সচারাচর আসে না বাড়ির ভেতরে। আজ এসেই এমন অদ্ভুত কথা বলছে যার দরুন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তুহিন। সে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। একবার বোনের দিকে আরেকবার বাহার ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে রোজা সওদাগর বোকা বোকা হেসে বলল,

"আরে কি যে বলো না, বাহার। তা তুমি এখানে যে! বিশেষ কাজে এসেছো?"


"আমি কি-যে বলি না আন্টি। যা সঠিক তা-ই বলি। চোখ থাকতে অন্ধ হওয়াটা তোমায় মানায় না, তুহিন। তোমার বোন কি করছে না করছে, কে কি করাচ্ছে খোঁজ রাখো। ভাই হয়েছো তো দায়িত্ব কেন অবহেলা করছো! মায়ের হারানো তে ব্যথিত হয়ে বোনের সুখ তো সব উড়িয়ে দিচ্ছো। অথচ মেয়েটা সুখ প্রিয়।"


বহুদিন পর কেউ চিত্রার হয়ে কথা বললো, এই অনাকাঙ্খিত আনন্দে চোখে অশ্রু জমলো। মাথা নত করে সে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা চালালো সে অশ্রু। তুহিন বুদ্ধিমান ছেলে, সে ততক্ষণে বাড়ির ভেতরের পরিবেশের কথা কিছুটা আন্দাজ করে ফেলেছে। চেয়ার ছেড়ে সে উঠে দাঁড়ালো। চিত্রার কাছে গিয়ে মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে শক্ত কণ্ঠে বললো,

"কিরে চিত্রা, তোকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে কে? বড় চাচী নাকি ছোটোচাচী? নাকি ফুপি? কে বল?"


চিত্রা ছোটো মানুষ, আদুরে ভাব তার শরীরে তো এখনও আছে। সে ভাইজানের বাহু আঁকড়ে কেঁদে দিলো। আপন মানুষের পরিবর্তনের নিরব অভিযোগ যেন জানালো ভাইকে। তুহিনের রাগ চড়ে বসলো মাথায়। বোনকে এক হাতে ধরে টেবিলের সব খাবারের প্লেট এক এক করে ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ভেঙে গেলো সেসব প্লেট। কাঁচের গ্লাসটা বড়োচাচীর পায়ের সামনে আছাড় মেরে আঙ্গুল উঁচিয়ে চিৎকার করে বলল,

"আপনাদের যদি কাজ করতে মন না চায় তবে নতুন কাজের লোক নিন। একজনের জায়গায় দু'জন নিন। আপনাদের সাহস কীভাবে হয় আমার বোনের উপর এসব হুকুম তালিম করার? কে আপনি? সাহস কি করে হলো আপনার চাচী?"


তুহিনের এমন রাগে উপস্থিত সবাই ভীত। কেবল স্থির রইলো বাহার। মাঝে মাঝে কিছু কথা সঠিক মানুষের কানে দিতে হয়। 


বড়ো চাচীরও ততক্ষণে অপমান আকাশ ছুঁয়েছে। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

"তুহিন, ভদ্রতা ভুলেছো? কাকে কি বলছো তুমি? আর তোমার বোনকে কাজ করাবো না কেনো? সে কোনো রাজপ্রাসাদ থেকে আসে নি। রাজপ্রাসাদের মেয়েরা তো অন্যদের বাড়িতে মানুষ হয় না, তাই না? সামান্য একটা ব্যাপারকে এ মেয়ে কি বিশ্রী করে তুললো? স্বার্থপর মেয়ে।"


টেবিলের কাঁচের উপর গ্লাস গুলো ফেলে ভেঙে চুরমার করে ফেললো সব এক নিমিষেই তুহিন। বড় চাচীকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বললো,

"আপনি তো কোনো রাজপ্রাসাদ থেকে আসেন নি। আপনার বাপেরও কোনো জমিদারি ছিলো না। কন্যার ভার সামলানোর ক্ষমতাও তার ছিলো না। বস্তিতে থাকতেন, এক রুমের খুপরিতে। ভুলে গেছেন অতীত? আবার আমার বোনকে নিয়ে আপনি বাজে কথা বলছেন। পেটে ঘি পরতেই পান্তা ভাতের কথা ভুলে ক্ষমতা দেখাচ্ছেন!"


অপমানে গা ঘিনঘিন করে উঠলো রোজা সওদাগরের। ছেলে-মেয়ে দুটোকে কি সে কম ভালোবাসা দিয়েছিল? অথচ আজ কি কথা বলছে তারা! 


তন্মধ্যেই নুরুল সওদাগর সশব্দে চড় বসালেন ছেলের গালে। এই প্রথম সে তার ছেলের গায়ে হাত তুললো। অফিস থেকে এসে ছেলের এমন রূপ দেখেই মূলত সে হতভম্ব। 


তুহিনের চোখ তখন ভয়ঙ্কর রকমের লাল। ফর্সা মুখে তখন তুমুল আক্রোশ। চিত্রা ছুটে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে চলে যেতে নিলেই সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা টলমলে চোখের চাঁদনী আপা তার হাত ধরে আটকে দিলো। চিত্রা হাত ঝারা দিয়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করার সময়ই ভারী কিছু পরে যাওয়ার শব্দ হলো। পিছু ফিরে তাকাতেই চিত্রার চক্ষু চড়কগাছ। বড় আপার শরীরটা নিচের সিঁড়িতে পরে আছে। ভারী পেটটা ধরে তার হৃদয় বিদারক চিৎকার। র* ক্তে রঞ্জিত হলো সাদা ফ্লোর। 


#চলবে

[২৪০০+শব্দ। এবার আর অভিযোগ থাকবে না আশাকরি]

বোনাস পর্ব

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


উনিশের বর্ধিতাংশ


এয়ারপোর্টের বিচ্ছিরি শোরগোল। একটু পর পর ফ্লাইট ছাড়ার ঘোষণা। অবনী বেগমের চোখে টলমল অশ্রু। আমজাদ সওদাগর ক্ষণে ক্ষণে উৎকণ্ঠিত হচ্ছে। অধৈর্য কণ্ঠে বললো, 

"কিন্তু কী বলবে তো? আর ঐ পুলিশ অফিসার কী মেজো ভাইসাহেব ছিলেন?"


তুমুল কান্নার বেগের মাঝেই হাসি এসে পরলো অবনী বেগমের। আহারে, তার আর্তনাদ ছুঁতে পারলো না কাউকে। বরং সন্দেহ পরিষ্কারের জন্য উন্মুখ মানুষ। বেশ বড়সড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবনী বেগম চোখ বন্ধ করলেন। অতঃপর বলা শুরু করলেন,

"তখন সময়টা বর্ষাকাল। হুট করে গ্রামে কেমন যেন একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। ছেলেমেয়ে নে*শায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছিলো। চু*রি,মারামারি,হা*নাহা*নি তে গ্রাম উত্ত্যক্ত। আমার সাথেরই কত বন্ধু এই নে*শায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছিলো। এক অরাজকতার সৃষ্টি হলো। এই নে*শা কে বা কারা প্রাচার করছে তা সন্ধান পাচ্ছিলো না কেউ। নতুন আরও পুলিশ অফিসারের আগমন ঘটলো। 


আমিও ততক্ষণে বাড়ন্ত শরীরে বেশ বড়সড় হয়ে গেলাম। কোনো বিয়ের সম্বন্ধ আসতো না, কারণ সবাই জানতো আমার সাথে পুলিশ বাবুরই সম্পর্ক। হয়তো বেশ গভীর, শারীরিক আরকি। কিন্তু তেমন কিছুই ছিলো না। সে আমার হাত ধরে ছিলো দু একবার, এর বেশি কিছুই না। কিন্তু মানুষ তো বরাবরই বেশি ভাবতে পছন্দ করে। 


বাবা তখন উনাকে বার বার চাপ দিতো। বিয়ে করার প্রস্তাব দিতো। উনি বলতো উনার শহরে গিয়ে পরিবারের সাথে কথা বলে প্রস্তাব নিয়ে আসবে। আমারও হুড়মুড় করে শরীর বাড়লো। কিশোরী থেকে নারীতে পরিবর্তন হচ্ছি। গ্রামের অবস্থা বেহাল থেকে বেহাল হওয়া শুরু করলো। রাস্তায় বের হওয়া বিপদ হয়ে গেলো। ঘরে সারাদিন পরে থাকতাম। দিন গুনতাম, সে বোধহয় আসবে। কিন্তু আশার আলো কেবল হতাশায় পরিণত হলো। 


বর্ষার এক মাঝামাঝি সময়ে হুট করে সে একবারে উধাও হয়ে গেলো। তার বন্ধুর কাছে ছুটে গেলাম, খোঁজ দিতে পারলো না সে। আমি কেঁদে কেটে একাকার। গ্রামের মানুষ ততদিনে আমাকে কলঙ্কের কালি লেপে দিয়েছে। আমাকে নাকি নষ্ট করে সে মানুষ চলে গিয়েছে। বাবার অবস্থাও করুণ হতে লাগলো। আমার হাসিখুশী বাবাটা নিরব হয়ে গেলো, আমি কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে দেখতাম সে নিরবতা। কাকে জানাবো সেই কষ্টের কথা, তখন আমার কেউ ছিলো না। অতঃপর তার বন্ধু আমাদের ভরসা দেয় খুঁজে নিয়ে আসবে জানায়। 


কত গুলো দিন পেরিয়ে গেলো হতাশায়, অতঃপর তার বন্ধু অনেক খোঁজখবর করে জানতে পারলো তার পরিবারের সবাইকে নাকি মে*রে ফেলা হয়েছে। পুলিশবাবু এরপর থেকেই নিরুদ্দেশ। আমার তখন হাউমাউ করে কান্না, লোকটা গেলো কোথায়। আল্লাহর দরজায় তিনবার করে মাথা ঠুকতাম যেন সে ফিরে আসে। অতঃপর বর্ষার শেষের দিকের এক দিনের কথা। আমি ভরদুপুরে ঘুমিয়ে ছিলাম। বাহিরে ঝরঝরে রোদ। গ্রামের এক ছেলে এসে খবর দিলো তার দেখা নাকি পাওয়া গেছে। আমার পুলিশ বাবু নাকি ফিরে আসছে। আমি সেই ভরদুপুরে এলোমেলো শরীর নিয়ে ছুটে গেলাম। 


গ্রামের মাঠে তখন তুমুল ভীড়। থানার সবচেয়ে বড় অফিসারও নাকি এসেছে। কত বড় বড় মানুষ। কত অফিসার! আমি আমার পুলিশ বাবুর দিকে তাকাতেই থমকে গেলাম। শরীরে কালো পোশাক, চেহারা একবারে ভেঙে গেছে। চোখ গুলো কেমন ভেতরে চলে গেছে, মুখ ভর্তি চাপদাড়ি। মানুষটাকে মাঠের মাঝখানে একটা গাছে বেঁধে রেখেছে। পরে জানতে পারলাম মানুষটা নাকি দেশ*দ্রোহী, পরিবার মারা যাওয়ার শোকে সে এই কালো দুনিয়ায় চলে গিয়েছে। সৎ থেকে তো পরিবার হারাতে হয়েছিলো, অসৎ হয়েছে তাই। গ্রামের নে*শার প্রবেশও সে করিয়েছে। আমি মানতে পারি নি মানুষটার বিধ্বস্ততা। ছুটে যেতে চেয়েছিলাম তার কাছে কিন্তু আমাকে যেতে দেওয়া হয় নি। মৃত্যুর আগে নাকি সকলের শেষ ইচ্ছে পূরণ করা হয়, কিন্তু মানুষটা আমাকে একবার ছুুঁতে চেয়েছিলো, সে ইচ্ছেটাও ওরা পূরণ করতে দেই নি। আমি কত কাঁদলাম, হাউমাউ করে কাঁদলাম, আমার কান্না ওদের হৃদয় অব্দি পৌঁছায় নি। আমি ভিক্ষে চেয়েছিলাম মানুষটার প্রাণ। বলেছিলাম আমরা অনেক দূর চলে যাবো, এ পাপে আর ডুবতে দিবো না মানুষটাকে। ওরা শুনে নি। আমার এত যত্নের ভালোবাসা, আহা কি নিদারুণ তার বিধ্বস্ততা! মানুষটাও আমাকে একবার ধরতে চেয়েছিলো কিন্তু তার আগেই তার শরীরে পর পর ছয়টা গু*লি মেরে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। র*ক্তে লাল হয় আমার প্রিয় সোজনবাদীর মাঠ। যে মাঠে মানুষটার হাত ধরে ছুটে বেরিয়ে ছিলাম, সে মাঠে পরে থাকে নির্লিপ্ত ভাবে আমার পুলিশবাবু। যার সুুনামে একদিন গ্রাম মুখরিত ছিলো, তার লা*শ সেদিন দেশ*দ্রোহীর লা*শ হিসেবে গন্য হয়েছিলো। আর তাকে গু*লি করেছিলো কে জানো? তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু, তোমার ভাই নুরুল সওদাগর। 


আমায় চোখ ভরে দেখতে দেই নি আমার পুলিশবাবুকে। ওরা পাষণ্ড! আমি হাউমাউ করে কেঁদেছি। কি ব্যাথা নিয়ে চিৎকার করেছি। মৃত্যুর পরও মানুষটা চোখ মেলে যেন অপলক চেয়ে ছিলো আমার দিকে। আমি শেষবার ছুঁতেও পারলাম। দেয় নি ছুঁতে আমায়। তোমার ভাই সেদিন বন্ধুত্ব ভুলে হয়তো কর্তব্য পালন করেছিলো কিন্তু আমি আজও ভুলি নি সেই ভয়াবহতা। আমার মানুষটার এ দশা আমি আজও ভুলি নি। 


প্রকৃতি আমার এসবটা নিয়েও ক্ষান্ত হয় নি। যখন আমি গুটিয়ে গেলাম শূণ্যতায়, আমার বাবা আমার বিধ্বস্ত অবস্থা সহ্য করতে না পেরে বি*ষ খেয়ে সেই মাঠেই আত্মহত্যা করে মানুষটা মারা যাওয়ার তিনদিনের মাথায়। সেদিন সন্ধ্যায় তুমুল ঝড়, আব্বা আমার ঘরে নাহি ফিরে। চিন্তায় চিন্তায় আমি মরিয়া। আব্বা টা ছাড়া যে আমার কেউ ছিলো এই দুনিয়ায়। অবশেষে পরের দিন সকালে মানুষ খোঁজ দিলো আব্বা আমার স্বার্থপর হয়েছে। আমায় এই গোটা দুনিয়ায় একা রেখে চলে গেছে। আমার আব্বা বেইমানি করেছে, আব্বা আমার বিশ্বাসঘাতক। ওরা কেউ কথা রাখলো না। কেউ আমার রইলো না। ওরা শেষ করে দিয়েছিলো আমায়। 


এই সবটা হারানো যন্ত্রণার রাগ গিয়ে পরেছিলো তোমার ভাইয়ের উপর। সেও তখন ট্রান্সফার হয়ে শহরে চলে এসেছিল। অতঃপর প্রতিহিংসার আগুনে দাউদাউ করে জ্বলে আমিও পা রাখলাম সওদাগর বাড়ি। এরপর আগুন আজ কেবল মায়া হয়ে রইলো।"


অবনী বেগমের চোখ অশ্রুর ঢেউ। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে সে কান্নার দাপটে। আমজাদ সওদাগরের চোখেও দেখা গেলো অশ্রু দের ভীড়। এতটা দুঃখ পুষে রেখে একজন মানুষ তার সাথে এত বছর ঘর করে গেলো, অথচ সে টেরই পেলো না! বরং মিছে ভ্রম নিয়ে করে ফেলেছে জীবনের চরম ভুল। এ ভুলের মাশুল আদৌও দেওয়া যাবে!


তন্মধ্যেই অবনী বেগমের প্লেন ছাড়ার সময় হলো৷ চোখের জল মুছে অবনী বেগম ব্যাগটা কাঁধে চরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আমজাদ সওদাগর আমতাআমতা করে কেবল ডাক দিলো, "অবনী..."। পথিমধ্যে থামিয়ে দিলো অবনী বেগম। মুচকি হেসে বললো, 

"তুমি হয়তো আজ যা বলতে চাও তা আমাকে দ্বিতীয় বারের মতন ভেঙে দিবে। প্রথম বার ভেঙে গিয়ে অনেক কষ্টে জোরা লেগেছি। দ্বিতীয় বার হয়তো আর পারবো না। তোমার আমাকে নিয়ে ভুল ধারণা ছিলো, আমিও ভাঙাতে চাই নি, ভেবেছিলাম একটা কলঙ্ক লাগুক তোমার ভাইয়ের গায়ে। আমি অভাগিনী তো চির কলঙ্কিনী ছিলামই। তাছাড়া তুমি যেভাবে ধোয়াশা আমিটাকে আঁকড়ে নিয়ে ভালোবেসে ছিলে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ভালোবাসাও যে রঙ বদলাতে পারে। আজ তাই আফসোস করলাম। তুমিও নাহয় একটু আফসোস করো, আমাকে সব খুলে বলতে না পারার আফসোস। আমাকে অনেক ভালোবেসেও কিছুটা কম ভালোবেসেছো সেই আফসোস। কিছু আফসোস থেকে যাক, অবসাদ জাগবে। আমায় এতদিনে ভুলে গিয়ে খুশি ছিলে আজ থেকে নাহয় প্রতিক্ষণ মনে রাখলে। আমি আজ একটু স্বার্থপর হলাম। কি সুন্দর তোমার মনে আফসোস জাগালাম! ভালো থেকো কেমন?"


আমজাদ সওদাগর কেবল তাকিয়ে রইলো অবনী বেগমের যাওয়ার পানে। সত্যিই হয়তো সে অনেক ভালোবেসেও কোথাও একটা ভালোবাসতে পারি নি। সত্যি বলতে এক জীবনে হয়তো অনেকটা ভালোবাসা কাউকেই দেওয়া যায় না। 


#চলবে


[গঠনমূলক মন্তব্যের আশাবাদী]

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ১৯

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা


পর্বঃ উনিশ


(৪৭)

রাতের কালো আকাশে যেন বিরহের ছাপ। তারাদের নিশ্চুপতা রাতকে করেছে আরও গম্ভীর। চিত্রা ছাঁদের গাছ গুলোতে সযত্নে পানি ঢালছে। সচারাচর রাতে গাছে কেউ পানি ঢালে না কিন্তু মন খারাপ দূর করার জন্য, সচারাচরের কাজ গুলো থেকে বেরিয়ে অন্য রকম কিছুই করা উচিৎ। 


চিলেকোঠার ঘর থেকে বাহার ভাইয়ের গুনগুনিয়ে গাওয়া গানের শব্দ আসছে। চিত্রা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হাসতে খেলতে থাকা জীবনটার কি নিদারুণ পরিবর্তন হয়ে গেলো এই এক মাসের মাঝে! সময় বদলাতে সত্যিই সময় লাগে না। 


"শুনলাম তোমার নাকি হক মেরে খাওয়ার সময় ফুরিয়েছে?"


শক্ত, গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে থমকালো চিত্রা। গম্ভীর কণ্ঠ হলেও কণ্ঠের মাঝে ঠাট্টার সুর। চিত্রা তপ্ত শ্বাস ফেললো, ক্লান্ত কণ্ঠে বললো, 

"বাহার ভাই, ভাঙা মানুষকে আর না ভাঙলেও তো পারেন। আমি ক্লান্ত।"


চিত্রার কথায় বাহারের তেমন পরিবর্তন দেখা দিলো না। তবে উচ্চস্বরে হাসির শব্দ ভেসে এলো। চিত্রা সেই শব্দ শুনে হতাশার এক শ্বাস ফেললো। এহেন সময়ে এমন উদ্ভট উচ্চারণ বাহারের থেকেই আশা করা যায়। মানুষটা তো বরাবরই এমন, রাগ করে আর লাভ কি! 


চিত্রাকে চুপ থাকতে দেখেও হেলদোল দেখালো না বাহার। বরং বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, 

"বুঝলে মেয়ে, এ জীবনে এত দ্রুত ক্লান্ত হলে চলবে না। তোমার তো সবে বাস্তবতা শুরু। যত্নে গড়া ননীর পুতুলের ন্যায় শরীরটাকে এখন বহু ঘাত-প্রতিঘাতের লড়াই চালাতে হবে। তৈরী তো!"


"এসিড তো কেবল হাত পুড়িয়ে ছিলো। বা'হাতটা এখন প্রায় অকেজো, কে জানতো বাস্তবতা নামক এসিড আমায় পু*ড়াবে!"


চিত্রার কথায় চরম বিধ্বস্ততার আভাস। দীর্ঘশ্বাসের হাহাকারে নিস্তব্ধতা ভয়ঙ্কর হলো। বাহার ছাঁদের রেলিঙের উপর উঠে বসলো। লোকটার কি কোনো ভয়ডর নেই! এমন গা-ছাড়া ভাব নিয়ে কীভাবে থাকতে পারে মানুষ? 


"তোমার আম্মু কোথায় যেতে পারে বলে মনে হয় তোমার?"


"আমি তো জানিনা। বুঝ হওয়ার পর আম্মুকে কোথাও যেতে দেখি নি তার কলেজ ছাড়া। কীভাবে বুঝবো বলুন?"


"চিন্তা করো না, ফিরে আসবে সে।"


"আপন মানুষের ভয়ঙ্কর পরিবর্তন দেখার আগেই ফিরুক সে। আমার বড্ড ভয় লাগছে, বাহার ভাই। মানুষের বদল কেমন ভয়ঙ্কর!"


চিত্রার কথায় বাহার হাসলো। স্বচ্ছ চোখের পাতায় দেখা দিলো অগাধ জলরাশির আনাগোনা। বাহার ভাইয়ের চোখে এই জলরাশিরা বড্ড বেমানান। বাহার ভাই হলো পাহাড়, যে পাহাড় মাথা উঁচু করে বাঁচে, সে পাহাড়ের বিধ্বস্ততা মানায় না। 


নিচ থেকে দোয়েল ছুটে এলো ছাঁদে। চিত্রা এবং বাহারের মাঝে তখন নিরবতা। কি যেন ভাবনা ওদের। সেই নিরবতার জালকে ছিঁড়ে দিয়ে আগমন ঘটালো দোয়েল। ধীর কণ্ঠে বললো, 

"চিত্রা আপা, বড় চাচী আপনারে নিচে যেতে বলছে। রাতের রান্নার আয়োজন আপনাকে করতে বলেছে। বড় চাচীর নাকি শরীর ভালো লাগছে না।"


চিত্রা তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে রইলো দোয়েলের পানে। দোয়েলের বলা কথা টা তার বিশ্বাস হলো না। মনে হলো সে ভুল শুনেছে হয়তো। যে মেয়ে এক গ্লাস পানি তুলে খায় না, সে কিনা এত গুলো মানুষের রান্না করবে! 


চিত্রা হতভম্ব অবস্থা দৃষ্টি এড়ায়নি বাহারের। সে পা ঝুলাতে ঝুলাতে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বললো,

"মেয়ে তুমি ঠিকই শুনেছো। এত অবাক হচ্ছো যে! এখন তোমার বড় চাচীর কোমড় ব্যাথা বাড়বে, মাথা ব্যাথা বাড়বে, শরীরের অসুস্থতা বাড়বে সাথে বাড়বে তোমার প্রতি তার অদৃশ্য, অকারণ হিংস্রতা। সাবধানে থেকো মেয়ে। পৃথিবীতে সকল মানুষই খারাপ। তবে কেউ কেউ প্রশংসা পাওয়ার লোভে, সুযোগের অভাবে তার খারাপ গুণটা দেখাতে পারে না। তোমার বড় চাচী সুযোগ পেয়েছে এখন, এবার খোলশ বদলানোর পালা।"


চিত্রা কেবল শুনে গেলো বাহার ভাইয়ের কঠিন থেকে কঠিন সত্যি কথা গুলো। সত্যিই মানুষ তবে খোলশ বদলায়! 


(৪৮)


সময়টা সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। ভ্যাটিকান সিটিতে আজ অবনী বেগমদের শেষ দিন। এইতো, একটু পর তারা নিজেদের গন্তব্যে রওনা দিবে। এরপর ভুলে যাবে সে এই ভ্যাটিকান সিটিকে। এই ভিনদেশ অবনী বেগমকে দান করেছে অগাধ বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণা। এই ভিনদেশকে সে আর মনে করবে। সে আর ফিরে চাইবে না এ দিকে। ভুলে যাবে সব, যা আছে মিছে কলরব। ভুলে গিয়ে যদি ভালো থাকা যায় তবে ভুলে যাওয়াই শ্রেয়। 


এয়ারপোর্টে অপেক্ষারত অবনী। অধীর আগ্রহ তার উড়ে যাবার। এ দেশে আর যে টিকছে না মন। অনুভূতিদের ভোঁতা যন্ত্রণায় দিবানিশি যে জ্বালাছে, তা আর সে নিতে পারছেন না। এ দেশ ছেড়ে চলে গিয়ে সমাপ্তি টানবে সে যন্ত্রণার। 


এয়ারপোর্টের ফর্মালিটি মিটিয়ে আমজাদ সওদাগর এসে বসলেন অবনী বেগমের সাথে। চেরিকে অন্য জায়গায় রাখা হয়েছে রেস্টের জন্য। প্লেন ছাড়তে এখনো প্রায় ঘন্টা দেড়েক দেরি আছে। 


অবনী বেগম তাকালো আমজাদ সওদাগরের দিকে। লোকটা কি নিয়ে যেন কয়েকদিন যাবৎ চিন্তিত। কেমন অস্বস্তি দেখা যায় মানুষটার মুখ জুড়ে। 


অবনী বেগমকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমজাদ সওদাগর বিব্রত বোধ করলো। কিঞ্চিৎ হেসে বললো, 

"কিছু বলবে?"


আমজাদ সওদাগরের প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন ছুঁড়লো অবনীও,

"তুমি কিছু বলতে চাও?"


অবনীর প্রশ্নে আমজাদ সওদাগরের অস্বস্তি বাড়লো। সে যে কিছু একটা বলতে চায় তা তার মুখ দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে। অথচ বলতে পারছে না। অবনী বেগম হয়তো আন্দাজ করতে পারলো আমজাদ সওদাগরের না বলা কথাটা। অতঃপর ক্ষীণ হাসলো। ভারী কণ্ঠে বললো, 

"আজ তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি, আমজাদ? অনেক বছরের পুষে রাখা মিছে এক আবরণ আজ ছিঁড়ে ফেলি?"


আমজাদ সওদাগর অবাক হলেন অবনী বেগমের কথায়। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,

"কি কথা?"


"এই যে, আমি তোমার মেজো ভাইয়ের প্রাক্তন এই কথাটার পিছের ইতিহাস জানাতে চাচ্ছি।"


আমজাদ সওদাগর বিস্ফোরিত নয়নে অবনী বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এমন সময় এ কথাটা সে আশা করেন নি। আর এ বিষয়ে তাদের পরিবারে কখনো খোলামেলা আলোচনা হয় নি, তাই এমন আলোচনা যে কস্মিনকালেও হতে পারে তা তার ভাবনার বাহিরে ছিলো।


অবনী বেগম আমজাদ সওদাগরের হতভম্বতা দেখে কিঞ্চিৎ হাসলো। বেশ আরাম করে বসে বললো,

"তোমাদের পরিবারে এসেছিলাম মনের পুষে রাখা ক্ষোভ নিয়ে তোমাদের ধ্বংস করে দিতে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তোমাদের প্রতি বেড়ে গেলো মায়া আর আমার ক্ষোভ যে কতটা ভিত্তিহীন ছিলো তাও বুঝতে শুরু করলাম। তবে হয়তো আজ এসব কিছু বলা অহেতুক। তবে মনে হচ্ছে জীবনের এ পর্যায়ে এসে এ সত্যিটা তোমার জানা উচিৎ। কিছু অনুশোচনা তোমাদেরও থাকা উচিৎ ভুল ভাবার জন্য।"


আমজাদ সওদাগরের অবাকের পাল্লা ভারী হলো। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো, 

"কী বলতে চাচ্ছো?"


"যা বলতে চাচ্ছি তা শোনার জন্য তুমিও প্রস্তুত হও। আমার জীবনের মুমূর্ষু সেই অতীত, 


সময়টা গ্রীষ্মের মাঝামাঝি। আমাদের গ্রামে তখন ডাকাতের প্রকোপ বেড়েছে। দিনের বেলা তো কাঠফাটা রোদ আর রাতে হতো তুমুল ঝড়। চারদিকে পানি বেড়েছে, সেই পানি দিয়ে আসতো জলদস্যু। তাই গ্রামে বড় বড় পুলিশ অফিসার আসে, টহল বসানো হয় জায়গায় জায়গায়। তখন আমি ছিলাম পনেরোর কিশোরী। এগ্রাম ও গ্রাম দাপিয়ে বেড়াতাম। একদিন দুপুরেই কাঠফাটা রোদ্দুরে দেখা হয় আমার জীবনের সর্বনাশা পুরুষের সাথে। 


কিশোরী মন তখন সেই অপরিচিত পুরুষটার সান্নিধ্যে এসে কেমন কেঁপে উঠলো! সেই প্রথম আমি অনুভব করলাম বিশেষ কিছু যা কখনো আমি এর আগে অনুভব করি নি। এক দুপুরে সেই অপরিচিত পুরুষকে প্রথম দেখে আমি ভয়ে কেঁদে দেওয়ার উপক্রম। লোকটা কি সুন্দর করে আমাকে কাঁদতে না করলো! কি সুন্দর তার কথা! কিন্তু ভয়টা এতই জেঁকে ধরেছিলো যে রাতে গা কাপিয়ে জ্বর এলো আমার। 


ঘরে আব্বা একা মানুষ, আমার তখন ধুম জ্বর। মধ্যরাতে বাবা-মেয়ের তখন বেহাল অবস্থা। তখন গ্রামে তো তেমন ডাক্তার ছিলো না। জ্বরে আমার দাঁতের সাথে দাঁত লেগে আসার উপক্রম। বাহিরে তুমুল ঝড়। তন্মধ্যেই বাহির থেকে গাড়ির শব্দ পাওয়া গেলো যা তুমুল বৃষ্টির ছাঁট পেরিয়ে শোনা গেলো। বাবা ছুটে বাহিরে গেলেন, আমি তখন প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবো অবস্থা। ঝাপসা চোখে দেখলাম দুপুরের সেই অপরিচিত পুলিশ অফিসারটা হন্তদন্ত হয়ে আমাদের ঘরে এসেছে। পাশে আরেকজন অফিসারও। দ্বিতীয় বার লোকটিকে দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। 


যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি আমাদের সদরের হসপিটালে আমি ভর্তি। চারপাশে রোদের ঝিলিক। জানতে পারলাম পুরো একটা রাত আমি অবচেতন ছিলাম। আমাকে সেই পুলিশ অফিসারই হসপিটালে নিয়ে এসেছে গাড়ি দিয়ে। সারা রাত সে এখানেই ছিলো। বাবাকে অনেক সাহায্য করেছে। কিন্তু জানিনা আমার কেন যেন লোকটাকে ভয় লাগতো, কেমন একটা অনুভূতি হতো নিজেও বুঝতাম না। এই লম্বা চওড়া লোকটাকে দেখলেই বুকে ভয় হতো। হসপিটালে আমি তিনদিন ছিলাম, লোকটা তিনদিন রাতেই এসে দেখে যেতো, আমি তখন ঘুমিয়ে থাকার অভিনয় করতাম। যেন তার চোখে চোখ পরলে আমি শেষ হয়ে যাবো। আমার পনেরো বছরের জীবন তখন ততটাও মজবুত ছিলো না। 


তিনদিন পর বাড়ি ফিরলাম। শরীর সুস্থ হতেই আবার আমার ছুটোছুটি শুরু। গ্রাম চড়ে বেড়ানোও শুরু। কিন্তু যখন পুলিশের গাড়িটা দেখতাম তখনই লুকিয়ে থাকতাম। 


একদিন দুপুরে পুকুরে নেমেছি আমাদের গ্রামের আরও ছেলেমেয়েদের সাথে, বাবা পাশের মাঠ থেকেই চিৎকার চেঁচামেচি করছে যেন উঠে যাই পুকুর থেকে। কিন্তু কে শুনে করা কথা? আমি তো আমার দুষ্টুমিতে মত্ত। হুট করেই তখন সেই চিরপরিচিত গাড়িটা এসে থামলো। ছেলেমেয়ে সব পুকুর থেকে উঠে দৌড়। আমার আবার তৎক্ষনাৎ মাথায় বুদ্ধি আসে কম, যতটুকু বুদ্ধি এলো ততটুকু কাজে লাগিয়েই আমি পুকুরে ডুব মারলাম। কিন্তু কতক্ষণ আর শ্বাস আটকে রাখা যায়? আমারও হলো বেহাল দশা, দম আটকে দ্রুত উঠে গেলাম। উঠতেই চোখ পরলো পুলিশবাবুর দিকে। সে বুকে হাত গুটিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। প্রথম দেখার পর আবার আমাদের দ্বিতীয়বার সরাসরি চোখে চোখ রাখা হলো। মানুষটার মুখটা দেখলেই আমার যেন কি হয়ে যেতো। আমাকে এমন তাকিয়ে থাকতে দেখে সে ধমক দিলো। তার রাশভারী কণ্ঠে শরীরের প্রতিটা নিউরন কেঁপে উঠলো। বাবা ছাড়া আমি কারো ধমকে ভয় পেতাম না, অভিমান তো করবো দূরের কথা, অথচ আমি ভয় পেলাম লোকটার ধমকে। অভিমান করে উঠে গেলাম পুকুর ছেড়ে। বাবার পর এই দ্বিতীয় পুরুষ যার উপর আমার অভিমান হলো। 


এরপর দিন গড়াতে লাগলো, লোকটা আর তার বন্ধুকে দেখতাম প্রায়ই। আমাকে দেখলেই পুলিশ বাবু তার রাশভারী কন্ঠে ডাক দিয়ে এটা ওটা বলতেন। কি সুন্দর হাসতেন! আমি কেবল অপলক তাকিয়ে দেখতাম। বাবা বলতো আমাকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে এক রাজপুত্র, আমি মনে মনে ভাবতাম পুলিশ বাবু সে রাজপুত্র হলে খারাপ হবে না। আবেগের গাছে তখন ভালোবাসার ফুল ফুটলো। ওরা দুই বন্ধু গ্রামে বেশ সুনামও কামালো। ওরা আসার পর কমে গেলো ডাকাতির প্রকোপ। 


উনার সাথে আমি প্রথম মানসিক ভাবে ঘনিষ্ঠ হয় এক ঘটনায়। আগে তো দূর থেকে দেখতাম, হাসতাম, সে ঘটনার পর আমাদের সম্পর্ক হয়ে গেলো সহজ সরল। আমার এক বান্ধবীকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিতে চাইলে সেই মানুষ প্রতিবাদ করেন। আমার বান্ধবী আবার পড়াশোনা করতো। পুলিশ বাবু আমার বান্ধবীর পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। এরপর থেকে মানুষটার প্রতিটা কাজে আমি মুগ্ধ হতাম। আমার সাথে তার সম্পর্ক একদম কাছ থেকে কাছের হয়ে গেলো। মাঝে মধ্যে এটা-সেটা রান্না করে পুলিশ বাবু আর তার বন্ধুর জন্য নিয়ে যেতাম। দু বন্ধু কত তৃপ্তি করে খেতো! এমন করে বছর পেরুলো। পুরো গ্রাম জেনে গেলো আমাদের সম্পর্কের কথা। সবাই জানতো পুলিশ বাবুর সাথেই আমার বিয়ে হবে। কিন্তু,,,,"


কথা থামালো অবনী বেগম। আমজাদ সওদাগরের তখন হাত-পা কাঁপা-কাঁপি অবস্থা। যে সত্যের মুখোমুখি সে আজ হয়েছে, তা না জানতে পারলে যে নিস্তার নেই। সে উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, 

"কিন্তু কী?"


অবনী বেগমের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হলো বুক। চোখে টলমল করে উঠলো সেই অতীত। বাবার বি*ষ খাওয়া শরীর যা কাঁদায় মাখামাখি হয়ে পড়ে ছিলো মাঠে। কি বিভৎস সে স্মৃতি! কি বিশ্বাসঘাতক মানুষ! 


#চলবে


[১৬০০+ হয়ে গেছে। বাকিটুকু রাত এগারোটার পর দিবো]

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ১৮

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


পর্বঃ আঠারো


রাতটা যেন হুট করেই প্রয়োজনের তুলনায় নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। চিত্রা অপলক তাকিয়ে ছিলো তার বাবার দিকে। সে ভেবেছে বাবা হয়তো মজা করছে, পরমুহূর্তেই বাবা হয়তো হো হো করে হেসে উঠে বলবে, 'কেমন ঢপ দিলুম, বলো তো?'- কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বাবার মুখটা গম্ভীর থেকে আরও গম্ভীর হলো। গাম্ভীর্যের সেই আবরণ যেন ছেয়ে গেলো প্রকৃতির মাঝেও। সোডিয়ামের মোহনীয় সেই হলুদ বর্ণ আলোটার মাঝেও কেমন অবিশ্বাস্যের উজ্জ্বলতা। চিত্রা বাবার দিকে তাকিয়ে বেশ খানিকটা সময় নীরব থেকে অবিশ্বাস্যকর কণ্ঠে বললো, 

"আব্বু, কি বলছেন এসব?"


নুরুল সওদাগর খুব গোপনে শ্বাস ফেললেন। সে আর বেশিক্ষণ চিত্রার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলে না। বারান্দার বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বেশ রুক্ষ কণ্ঠে বললেন,

"সত্যিই বলছি সব। তুমি তখন দু'দিনের শিশু। নিষিদ্ধ পল্লির মহিলাদের সন্তান জন্ম দেওয়া নিষেধ। কিন্তু যদি সেই সন্তান মেয়ে হয় তাহলে তারা ধুমধাম করেই বরণ করে নেয় সেই সন্তানকে কারণ ভবিষ্যতে তাদের ব্যবসার লাভজনক মূলধন সেটা। তোমাকে যে জন্ম দিয়েছে, তোমার জন্মদাত্রী, সে চায় নি তার মতন এমন দোযখ তোমার ভাগ্যে জুটুক। তুমি জন্ম নিবে বলে তাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। তখন তোমার তুহিন ভাইজান ও অসুস্থ তাই আমরা সে হসপিটালে গিয়েছিলাম। তোমার জন্মদাত্রী হুট করেই তোমার মায়ের কোলে তোমাকে তুলে দিয়ে আকুতি মিনতি করে উঠলো। তার জীবনের ভয়ঙ্কর বর্ণনাও দিলো। তোমার মায়েরও শিশুদের প্রতি সহমর্মিতা বেশি ছিলো, তাই নিয়ে এলো তোমায়। এ বাড়ির কোনো মানুষ জানেনা তুমি কার মেয়ে। কেবল আমি আর তোমার মা জানি তোমার জন্মপরিচয়।"


চিত্রার নয়নে ঘেঁষে ততক্ষণে ঝরে পড়েছে কত অশ্রুকণা! ঘৃণায় ভরে উঠেছে আঙিনা। এক মুহূর্তে মিছে হয়ে গেলো তার এই জনম। কি নোংরা! কি বিচ্ছিরি অতীত! মনে হলো সে যেন কোনো নর্দমার কীট। সমাজের এক নোংরা মানুষ। আব্বু যে তাকে পছন্দ করতেন না, সেটাই তার প্রাপ্য। এত ভালোবাসা তো কভু তার প্রাপ্য ছিলো না। 


নুরুল সওদাগর চায়ের কাপটা বারান্দার চওড়া গ্রিলটার উপর রাখলো। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে নিলো তার মুখমন্ডল। মুখ মোছার নাম করে কিছু অশ্রুকণাও বোধহয় মুছে নিলেন। কে জানে, আঁধারের কোল ঘেষে যাওয়া গল্পের কথা! 


পকেটের রুমাল পকেটে রেখে নুরুল সওদাগর গলা পরিষ্কার করে বললেন,

"তুমি তো জানলে তোমার অতীত। এখন একটা কথা রাখবে?"


চিত্রার কণ্ঠে তখনও কান্নার ছাপ। তবুও সে অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলো, 

"জি আব্বু, বলেন।"


"তুমি বিয়ে করে ফেলো চিত্রা। মনে করো না তোমায় অপছন্দ করি বলে সেটা বলছি। তুমি আমার দায়িত্বে ছিলে, আমি তোমার ভালো একটা ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে চাই। আজ আছি কাল না ও থাকতে পারি। তোমার দায় ভার তখন কে নিবে? এ বাড়ির সবাই হয়তো তোমায় ভালোবাসে, কিন্তু আমরা না থাকলে তারা হয়তো ফিরেও চাইবে না, কারণ তোমার সাথে তাদের রক্তের সম্পর্ক নেই।"


চিত্রার অবুঝ মন পরপর ধাক্কায় তখন নিস্তব্ধ। রাতের দীর্ঘশ্বাস গুলো তখন বুকের ভেতর জমে জমে পাহাড় সমান হয়ে গেছে। এই পাহাড়ের ভীষণ ওজন নিতে পারছে না চিত্রা। কেমন দমবন্ধ হয়ে এসেছিল সেদিন। আবেগের বশেই কিংবা নিজের প্রতি ঘৃণা থেকে সে রাজি হয়ে গেলো বাবার প্রস্তাবে। হয়তো ঋণ শুধরানোর অপচেষ্টা টাও ছিলো। 


সেদিনের কথা থামতেই বিরাট এক বিষাক্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললো চিত্রা। সেদিন কাঁদলেও, আজ কাঁদছে না চিত্রা। হুট করে কি সে পাথর হয়ে গেলো? 


বাহার তখনও নির্জীব। চোখের দৃষ্টি রাজপথে। হাতের চায়ের কাপের গরম গরম চা, এখন শরবত প্রায়। ভিতরের তরতাজা অনুভূতিও কেমন নিস্তেজ। 


বাহারের নীরবতা ভয় জাগালো চিত্রার মনে। বাহার ভাই বুঝি আজ চির বিচ্ছেদ ঘোষণা করবে! ঘৃণার থুথু বুঝি তার উপর ছুঁড়ে মারবে বাহার ভাই! মারুক নাহয়। সে সহ্য করে নিবে। ঘৃণাটা তো আর তার দোষে পাবে না, অদৃষ্টের পরিহাস। তবে আক্ষেপ কিসের! আফসোস কিসের? নিজের ভাগ্য যদি সে নিজে গড়তো, তাহলে কি আর থু থু ফেলতে পারতো কেউ! না অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ রচিত করতো! তবুও যদি মানুষ তাকেই দোষী ভাবে, তবে মেনে নাহয় নিবে সে দোষ।


চিত্রার মনের ভুল ভাবনার কার্তুজকে ভেঙে গুড়িয়ে দিলো বাহার। হাতের চায়ের কাপটা পাশেই ছুঁড়ে ফেলে বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,

"তোমার কি সেসব শুনে নিজের উপর ঘৃণা জন্মেছিলো, রঙ্গনা!" 


এমন পরিস্থিতি বাহারের এই প্রশ্নটা চিত্রা আশা করে নি। জীবনে তো আশা ছাড়াই কত কিছু হয়! ছোটো কণ্ঠে চিত্রা উত্তর দিলো,

"করাটা স্বাভাবিক না, বাহার ভাই?"


বাহার হাসলো। চিত্রার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলো। এই প্রথম বোধহয় বাহার চিত্রাকে ছুঁয়ে দিলো তাও স্নেহের হাতে। কোনো লোভ, লালসা বিহীন। অতঃপর মিষ্টি করে বললো,

"অস্বাভাবিক সেটা। তুমি নিজেকে কেনো ঘৃনা করবে রঙ্গনা? তোমার বরং বুক ফুলিয়ে একটা ভীষণ স্বচ্ছ শ্বাস নেওয়া উচিৎ। তোমার জন্মদাত্রী, সে কোথা থেকে আসছে, কিবা তার পরিচয় সব ভুলে যাও, মনে রেখো সে কিন্তু মায়ের দায়িত্ব পালন করতে পিছ পা হন নি। এই যে সে তোমায় অন্য কারো কাছে দিয়ে ছিলো, তোমার কি মনে হয় তার উপর কম ঝড় গেছে এর জন্য? তাকে কি না কি সহ্য করতে হয়েছে তোমার ধরণা নেই। একটা কথা শুনেছো? জন্ম হোক যথাতথা, কর্ম হলো আসল। তোমার সাফল্য যখন আকাশ ছুঁয়ে দিবে, তোমার জন্ম পরিচয় তখন মরিচীকা।"


চিত্রা কেবল মনযোগ সহকারে শুনলো এই ছন্নছাড়া লোকটার কথা। মানুষটা কতটা গুছানো কেউ বুঝবে তার বাহ্যিক আবরণ দেখে? 


চিত্রা লম্বা এক নিঃশ্বাস নিলো। শুদ্ধতম হাসি দিয়ে বললো, 

"চলুন বাহার ভাই, ফেরা যাক।"


বাহারও ঘাঁড় কাত করে উঠে দাঁড়ালো। একটা রিক্সা ডাক দিয়ে বসিয়ে দিলো চিত্রাকে। 


বাহারকে উঠতে না দেখে অবাক হলো চিত্রা। কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলো,

"আপনি যাবেন না?"


"তুমি যাও, আমি হেঁটে আসবো।"


বাহারের উত্তরে কুঁচকানো কপাল আরও কুঁচকালো। অবাক কণ্ঠে বললো, 

"আমার সাথেই চলুন। হেঁটে আসার কি দরকার? আজ আমি আপনাকে বাড়ি অব্দি নাহয় নিয়ে গেলাম। কোনো একদিন আপনি পুরো শহর ঘুরাবেন।"


চিত্রার কথায় বিশেষ হেলদোল দেখালো না বাহার। পকেটে দু'হাত গুঁজে কোঁকড়ানো চুল গুলো দুলিয়ে বললো,

"আমি হিমু নই রঙ্গনা। আর না তুমি রূপা। আমরা আমাদের মতনই। আমি এক দরিদ্রতার কষাঘাতে পিষে যাওয়া মানব আর তুমি বাস্তবতার বেড়া কলে ঝলসে যাওয়া নারী। আমাদের গন্তব্য এক হলেও হয়তো পৌঁছানোর পদ্ধতি ভিন্ন। তাতে ক্ষতি কী? শেষ অব্দি যদি সন্ধি হয়, রাস্তা তবে ব্যাপার নয়।"


চিত্রার দিক থেকে নজর সরিয়ে বাহার একবারে হাঁটা ধরলো সোজা। চিত্রা কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো সেই বাহারের দিকে। লোকটা যদি একটু পিছু ফিরে তাকায় সে আশায়। কিন্তু তা আর হলো কই? লোকটা তো আর তাকালো না। সবসময়ই চিত্রার আশা ভেঙে দিতে লোকটা প্রস্তুত। চিত্রা ছোটো শ্বাস ফেললো। থাক, সবার গল্পের বিবরণ এক হলেই সমস্যা। থাক না, বাহার রঙ্গনার গল্প কিছুটা অন্যরকম। ক্ষতি তো আর নেই। 


(৪৬)


আজ অষ্টম তম দিনে পদার্পণ করলো মুনিয়া বেগম ছাড়া সওদাগর বাড়ির লোকজন। তুহিন ভাইজান খুঁজছে, নুরুল সওদাগর খুঁজছে তবে মুনিয়া বেগমের দেখা নেই। কেমন যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো মানুষটা। মানুষটার বাবার বাড়িতে কেউ নেই যে সেখানে যাবে। আপন বলতে এই স্বামীর বাড়িই ছিলো। উনার কলিগদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা চললো কিন্তু কেউ খোঁজ দিতে পারলো না মুনিয়া বেগমের। 


চিত্রারও চোখ-মুখ ভীষণ শুকনো। মা তাকে যতটা যত্ন করতো, অতটা যত্ন আর কেইবা করবে? মুখে ছোটো ছোটো ব্রণ, চোখের নিচে কালো আস্তরণ। মেয়েটার মায়া মায়া মুখ খানার দিকে তাকালো কেমন হাহাকার করে উঠে বুক। 


অন্যদিকে অহির মেজাজ আজকাল কিঞ্চিৎ ভালো। নওশাদ ছেলেটা প্রচুর জ্বালালেও বেশ সম্মান দেয় তাকে। অনেক বেশি সময়ও দেয়। হুটহাট রাস্তায় কোথা থেকে যেন এসর হাজির হয়ে যায়। ঝগড়া করতে মন্দ লাগে না। 


খাবার টেবিলে দুপুরের খাবারের তোরজোর চলছে। অহি,চাঁদনী,অনয়,মাহাতাব, আফজাল সওদাগর, লতা বেগম সবাই ই খেতে বসেছে। রোজা সওদাগর এবং তার ননদ খাবার বেরে দিচ্ছেন। কাজের মেয়ে দোয়েল রান্নাঘর থেকে খাবার এনে দিচ্ছে। 


আজ খাবার টেবিলে ঘটলো অন্যরকম ঘটনা। সবাই যখন খেতে ব্যস্ত দোয়েল তখন মাছের তরকারিটার বাটি টেবিলে এনে রাখলো। চিত্রার হঠাৎ ই দৃষ্টি আটকালো মাছের বাটিতে থাকা বড় মাথাটার দিকে। বয়সে ততটা ছোটো না হলেও চিত্রার আবদার গুলো বেশ ছোটোদের মতন। হুটহাট বলে বসে না ভেবেই কত আবদারের কথা। 


যেমন আজই মাছের মাথাটা দেখে নিষ্প্রাণ চিত্রা ঝলমলে হাসি দিয়ে বলে উঠলো,

"বড় চাচীম্মা, আমায় কিন্তু মাথা দিবে আজ।"


সবাই চিত্রার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। যাক, মেয়েটা নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। আর বরাবরই চিত্রার জন্য বড় মাছের মাথাটা রাখা হয়। সে আবার বেশ মাছ প্রেমী। সবাইকে অবাক করে দিয়ে রোজা সওদাগর মাছের মাথাটা চাঁদনীর প্লেটে উঠিয়ে দিলো। চাঁদনী চিত্রার পাশে বসেই খাবার খাচ্ছিলো। 


রোজা সওদাগরের এমন কান্ডে উপস্থিত সবাই হতভম্ব। চাঁদনী নিজেও অবাক হয়ে গেলো। রোজা সওদাগর সবাইকে তার দিকে এমন হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বোকা বোকা হেসে চিত্রাকে আদুরে স্বরে বললো, 

"তোর আপার তো একটু বেশি পুষ্টি লাগবো, ক? হের তো অহন দুইজনের খাওয়া খাইতে হইবো তাই না? আমি তোরে বড় টুকরাটা দিবো। মাথাটা তোর আপা খাক, কেমন?"


চিত্রার হুট করেই কান্না চলে এলো কিন্তু সে প্রকাশ করলো না। এটা হওয়া টা তো স্বাভাবিক। সবাই কি আর মায়ের মতন হয়? চিত্রা খাবারটা কোনো মতে গিলে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললো, 

"না না চাচীম্মা, তুমি আপারেই দেও। আমি দেখছো কেমন বে*ক্ক*লের মতন আবদার করলাম। এখন তো বড় আপারই ভালো খাবার প্রয়োজন। তুমি ঠিক করেছো।"


কথার নিচে চাপা পরলো চিত্রার প্রগাঢ় অভিমান। চাঁদনী আপা তার প্লেট থেকে মাথাটা উঠিয়ে চিত্রার প্লেটে দিতে দিতে বললো,

"আম্মা, আপনিও না! আমাকে কখনো খেতে দেখেছেন মাথা? সবসময় তো চিতাবাঘই খায়। মেয়েটার পছন্দ। আপনিও না অদ্ভুত।"


"হ হ, খাবি কেমনে তোরা, তোদের চাচী তো চিত্রাকেই সবসময় দিতো। চিত্রা খাবে বলে কি তোরা খেতে পারবি না? সবারই তো হক আছে।"


রোজা সওদাগরের উত্তরটা কেমন মুখ ঝামটি মারলো। রসকষহীন কণ্ঠ। চিত্রা বড় আপার হাতটা ধরে ফেললো,খুব কষ্টে কান্না গিলে বললো,

"আপা দিও না গো, কারো হক মেরে খেতে পারবো না আমি।"


খাবার টেবিলে নিস্তব্ধ নিরবতা। সবাই কেমন ফ্যালফ্যাল, আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে রইলো। চিত্রা এক মনে আলু ভাজা টুকু দিয়েই পরের ভাত টুকু মাখিয়ে নিলো। রোজা সওদাগর তাকে মাছ আর সাধলো না বরং বড় টুকরো টা সে তার মেয়ে জামাইয়ের থালায় উঠিয়ে দিলো। সবাই চোখ মেলে দেখলো এই স্বার্থপরতা। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। চিত্রা আর দু লোকমা ভাত গিলে কোনো মতে উঠে দাঁড়ালো। আর খাওয়া যে সম্ভব হচ্ছে না। এই খাবার যেন বিষের চেয়ে বিষাক্ত মনে হলো। মাহাতাবও আর মাছ ছুঁয়ে দেখলো না। শাশুড়ির একচোখা কাহিনীর নিরব প্রতিবাদ করে সেও চুপ করে খাবার পাত থেকে উঠে গেলো। 


মেয়ে জামাইকে উঠে যেতে দেখে রোজা সওদাগর গদোগদো কণ্ঠে ডাক দিতেই তাচ্ছিল্য হাসি দিলো মাহাতাব। বেশ তাচ্ছিল্য কণ্ঠে বললো, 

"যা খাওয়ালেন, পেট ভরে গেছে। আপনার মেয়েকে নাহয় আমার ভাগের মাছটাও দিয়ে দেন। আমার হকের জিনিসের প্রতি তত টান নেই।"


মাছ পাতে তুললো না অহিও। অপমানে গা শিরশির করে উঠলো রোজা সওদাগরের। সে মুখ বাঁকিয়ে বললো,

"ঘরের চেয়ে পরের টান বেশি এ বাড়ির মানুষের।"


চিত্রা তখন কেবল টেবিল ছেড়ে কিছুদূর গিয়েছে। বড় চাচীর কথায় ডুকরে উঠলো সে। ছুটে গেলো ঘরে। মা ছাড়া দুনিয়া কেমন আঁধার হয়ে গেলো তার! এতদিনের নিয়ম ভেঙে আপন মানুষের বদলে অষ্টাদশী ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ। এ বাড়িতে কেমন যেন বদলের সুর দেখা দিয়েছে। আর যে সুখের দিন নেই চিত্রার, তা বুঝতে তার বাকি রইলো না। 


#চলবে

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ১৭

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


পর্বঃ সতেরো


(৪৩)


তুলোর মতন মেঘ গুচ্ছ বিচরণ করছে আকাশে। মিঠে বাতাস, কোমল লাল বর্ণা আকাশ। প্রকৃতিটা কবির ভাষায় কবিতার যোগ্য, প্রেমিকার প্রেম জাগরণের মতন, বিষাদে আচ্ছাদিত মানুষের মনে উৎফুল্লতা আনার মতন। 


ছাদে মন খারাপে আবিষ্ট চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। সময়টা ঠিক দিনের তৃতীয় ধাপ- অপরাহ্ন। মুনিয়া বেগম বাড়ি ছেড়েছেন আজ দু'টো দিন হতে চললো। গতকাল থেকে এ অব্দি তার কোনো খোঁজ নেই। চিঠিতে সে চরম অভিযোগের স্বরে লিখে গেছে তার চলে যাওয়ার কথা। চিত্রাই যে সে অভিযোগের কারণ তা লিখতেও বাদ রাখেন নি সে। 


চিত্রা তার বা'হাতে গুঁজে রাখা মায়ের চিরকুট টা নিজের অক্ষি দ্বয়ের সামনে মেলে ধরলো। যেখানে কি সুন্দর করে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,


প্রিয় চিত্রাঙ্গণা,

চিঠির শুরুতে আমার এক আকাশ ভালোবাসা নিও। তোমায় আমি কতটা ভালোবাসি তা নিশ্চয় তোমাকে বিশ্লেষণ করতে হবে না, তাই না? তোমার প্রতি আমার এক অগাধ মায়া আছে, কেনো জানো? তোমায় যেদিন দু'হাতের মাঝে পেয়ে চোখ ভরে দেখলাম, সেদিন মনে হলো আমার মাকে দেখছি। সেই দু দিনের শিশুটা কি মায়া লাগালো আমায় কে জানে, এরপর থেকে আমি আমার মা হারানোর শোক ভুলে গেলাম। তোমার পুরো না তোফা চিত্রাঙ্গণা। তোমার নামের আগে পরে কোনো পরিচয় নেই কেনো বলো তো? কারণ আমি তোমায় এমন বানাতে চেয়ে ছিলাম যেন তুমিই তোমার পরিচয় হও। শখ করে রেখেছিলাম তোফা। মানে, উপহার। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সবচেয়ে মূল্যবান উপহার তুমি আমার। অথচ আজ তুমি আমার সব ভালোবাসা ভুলে, বাবার মোহে পরে ভুল সিদ্ধান্তে ডুব দিয়েছো। আমি তোমার এমন ক্ষতি দেখতে পারবো না। আমি এ ও জানি, তোমার বাবা হয়তো খুব বাজে ভাবে পিষে ফেলেছে তোমার মন গোপন কোনো কথার আস্তরণে তাই তোমার ও সিদ্ধান্ত। কিন্তু মা, তুমি পিষে যাওয়া টা দেখলে আর আমায় দেখলে না তা যে মানতে পারবো না। তুমি নাহয় তোমার বাবার কথায় জলাঞ্জলি দেও তোমার জীবন, আমি তা দেখতে পারবো না। ভালো থেকো।


ইতি 

তোমার তথাকথিত 'মা'।"


চিঠির শেষে সম্বোধনটাই যেন চিত্রাকে র*ক্তা*ক্ত করতে যথেষ্ট। মা কতটা কষ্ট পেলে নিজেকে এভাবে সম্বোধন করেছে! কিন্তু সেও বা কী করবে? বাবা সেদিন রাতে তাকে তার জীবনের এমন ভয়াবহতার কথা জানিয়েছে যা সে মানতে পারে নি। এমন একটা অপ্রত্যাশিত অতীত সে ভাবতে পারে নি। ঘৃণায় ভরে গিয়েছিলো তার দেহ। পৃথিবীর সব যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচা যায় কিন্তু নিজেকে ঘৃণা করে আদৌও বাঁচা যায়? অথচ বিধির বিধান, আত্মহত্যা মহাপাপ। যেখানে জীবনটাই পাপের ফসল সেখানে মহাপাপটাও কেমন হাস্যকর। 


অশ্রুরা গোপনে ঝরে গেলো মুক্তোর মতন। তাদের কেমন বিবর্ণতা! 


"আরে আমাদের চিতাবাঘ, করে কি একা একা?"


পেছন থেকে কারো কণ্ঠ ভেসে আসতেই চিত্রা চোখের অশ্রু মুছে ফেললো। দুর্বলতা আড়ালেই রাখতে হবে, জেনে গেলেই তো জ্বালিয়ে দিবে মানুষ। 


চাঁদনীও ততক্ষণে তার ভারী পেট নিয়ে অহির সাহায্যে চিত্রার কাছে এসে দাঁড়ালো। অহি আপাকে কত সুন্দর লাগে আজকাল! মাতৃত্বের সৌন্দর্যতা পৃথিবীর সব সুন্দরকে হার মানায়। কি সুন্দর! 


চাঁদনীর মিষ্টি হাসির পরিবর্তে চিত্রাও হাসলো। কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললো,

"চাঁদ আপা গো, তোমায় এত সুন্দর কেনো লাগে?"


চাঁদনী গাল টেনে দিলো চিত্রার। মিষ্টি হেসে বললো, 

"সত্যিই সুন্দর লাগে নাকি রে? কই তোর দুলাভাই আদর-টাদর করে যে না এখন। মুটিয়ে গেছি কিনা।"


চাঁদনী আপার কথার ধরণে ফিক করে হেসে উঠলো চিত্রা। হাসতে হাসতে বললো,

"ছি আপা, শরম পাচ্ছো না তুমি?"


"শরম কেনো পাবো রে? সত্যি কথা বলতে কিসের শরম? শুনেছি দিনে চৌদ্দ বার সত্যি কথা বলা যায়। আমি তো মাত্র একবার বললাম, তাও তোরা সহ্য করতে পারছিস না?"


চিত্রা আর অহি সশব্দে আবার হেসে উঠলো। চাঁদনী আপা যে চিত্রাকে হাসানোর জন্যই এসব বলেছে তা আর বুজতে বাকি নেই কারো। তাল মিলিয়ে নাহয় হাসা যাক। এই মানুষ গুলো তো ভালোবেসেছে অনেক। 


হাসতে হাসতে কখন যেন আনমনেই চোখ থেকে গাড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা রা। আনমনেই, না চাইতেও শব্দ করে কেঁদে উঠলো চিত্রা। সে যে ব্যাথা লুকানোর মতন অত কঠিন আজও হতে পারে নি। আজও তার হৃদয়কে কংক্রিট ছুঁয়ে দিতে পারে নি। 


চাঁদনী এবং অহি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অহি এই প্রথম চিত্রাকে জড়িয়ে ধরলো। আদুরে স্বরে বললো, 

"কাঁদিস না চিত্রা, চাচী ফিরে আসবে।"


আদুরে আলাপে কান্নারা আহ্লাদ পেয়ে বসলো। গা ছিটকে বেরিয়ে এলো তারা। কিছু কিছু সময় আমাদের অনুভূতিরা বড্ড অবাধ্য হয়। 


(৪৪)


দেখতে দেখতে ভ্যাটিকান সিটিতে আজ কতদিনের বসবাস অবনী বেগমের। চেরিও এখন বেশ সুস্থ। এত দ্রুত তার সুস্থতা কল্পনার বাহিরে ছিলো। মেয়েটাও হয়তো বুঝেছে তার মায়ের এ দেশে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। একাকীত্বের হাহাকার তার মাকেও কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। 


মেয়ের মাথায় অনবরত হাত বুলিয়ে যাচ্ছে অবনী বেগম।  আর কয়েকদিন পরই দেশের মাটিতে হয়তো ফিরে যেতে পারবে তারা। হয়তো দুঃখ ভুলে আবার বাঁচতে পারবে সে। হয়তো আবারও হাসি-খুশি একটা জীবন পাবে তারা। জীবনে অবনী বেগমের চাওয়ার আর কি ছিলো? একটু সুখ, একটু ভালো থাকতে চাওয়ার ইচ্ছে ছাড়া? কিন্তু হঠাৎ জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে যায় সেই অপরিচিত পুরুষের আগমনে। এরপর কত-শত দিন গেলো, অবনী বেগম কেবল বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে ছিলেন। অহি যখন হলো তখন তার বয়স আঠারো-উনিশ হবে। সে মানতে পারে নি অহিকে প্রথম প্রথম। সবার অমতে মেয়েটাকে হোস্টেলে রাখে। কিন্তু যখন মা হওয়ার মর্ম বুঝলো ততদিনে মেয়েটা তার থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। কাছাকাছি এনেও সে দুরত্ব মেটাতে পারে নি সে। 


অবনীর ভাবনার মাঝে কেবিনের দরজা খুলে প্রবেশ করলো আমজাদ। পরনে তার বেশ ফর্মাল পোশাক। প্রতিদিন সে মেয়েকে এসে দেখে যায়। স্ত্রীর সাথে খুব কমই কথা হয় তার। না পারতে বলে আর কি। 


আমজাদকে দেখেও তেমন একটা হেলদোল দেখালো না অবনী। আগের জায়গায় বসে রইলো নীরব হয়ে। আমজাদ কেবিনে প্রবেশ করেই শার্টের বোতাম দু'টো খুলে দিলো। সরাসরি অফিস থেকে এসেছে বোধহয়। ফোনটা চেরির বেডে রেখে সে কেবিনের সাথে লাগোয়া ওয়াশরুমে গেলো বোধহয় হাত-মুখ ধোয়ার জন্য। আমজাদের বয়স পয়তাল্লিশের এপার-ওপার হবে। এখনো দেখতে বেশ সুন্দর লাগে। যখন তাদের বিয়ে হয় তখনও আমজাদ এতটা বোধহয় সুপুরুষ ছিলো না। কেমন বোকা বোকা। সাধে কি আর মানুষ বউ পাগল বলতো! অথচ আজ সে আমজাদ গম্ভীর, শীতল।


হঠাৎ নিস্তব্ধ এই কেবিনটাকে শব্দে ভরিয়ে দিতে উচ্চশব্দে বেজে উঠলো আমজাদ সওদাগরের ফোন। অবনী বেগম তাকাবে না তাকাবে না করেও কৌতুহল নিয়ে তাকালো ফোনের স্ক্রিনে, যেখানে জ্বলজ্বল করছে সেই মধ্য রাতের হৃদয় ঝলসে দেওয়া নাম টা 'জেসি'। 


অবনী বেগম সাথে সাথে শ্বাসটা বন্ধ করে নিলেন। এ বয়সে এসে সঙ্গী হারানোর তীব্র ব্যাথা সে নিতে চায় না। অথচ সে যতই দূরে যাচ্ছে সেসবের থেকে, ততই যেন তাকে এসব জাপ্টে ধরছে। বার বার একই যন্ত্রণা যে কতটা ভয়ঙ্কর তা ব্যাখ্যা করার মতো না। 


ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে যেতেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো আমজাদ। অবনীর ঘামে চুপচুপ হওয়া মুখমন্ডলে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তার। অবনীর কাছে এসেই সে অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

"এমন শীতল রুমেও ঘামছো কেনো, অবু? তোমার কী শরীর খারাপ করছে?"


অবনী বেগম নিজেকে যথেষ্ট সংযত করার চেষ্টা চালালেন। অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষমও হলো সে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিলেন নিজের মুখমণ্ডল টা। অতঃপর বেশ ধীর কণ্ঠে বললো, 

"ঠিক আছি আমি।"


কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারলো না আমজাদ সওদাগর। স্ত্রীর পাশে এসে কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষাও করলেন সে। তাপমাত্রা স্বাভাবিক দেখে কপাল কুঁচকালেন। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,

"জ্বরও তো উঠে নি। তবে এমন অসুস্থ লাগছে কেনো তোমাকে?"


"আজও আমার অসুস্থতা তোমায় ছুঁতে পারে, আমজাদ?"


অবনীর চল্লিশতম বয়সের কণ্ঠে পঞ্চদশীর ছোঁয়া। কি প্রগাঢ় অভিমানে ছাপ! আমজাদ কি বুঝতে পারলো সে অভিমান! 


তন্মধ্যেই আবারও সশব্দে বেজে উঠলো আমজাদের ফোন। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে সে খুব ধীরে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। 


অবনী বেগম শ্বাস ফেললেন। তাচ্ছিল্য করে বললেন,

"কিছু মানুষের কখনো নিজিস্ব ঠিকানা হয় না। ভবঘুরে হয় সে মানুষ। আমিও তেমন কূলহীন।"


(৪৫)


কোচিং এর নাম করে বেশ রাত হলো চিত্রা রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মা ছাড়া বাড়িটাতে তার এক মুহূর্ত ভালো লাগে না। কেমন পানসে লাগে সব! পৃথিবীটা হুট করে কেমন তেতো তেতো ঠেকছে। মা-ই বুঝি পৃথিবীর মধু! 


কাঁধে ব্যাগ। ছোটো চুল গুলো এক পাশে বেণীগাঁথা। শরীরে বেশ সাদামাটা জামা। ছাঁই রাঙা। এধার ও ধার কেবল উদ্দেশ্য বিহীন ঘুরে বেড়ানো। 


"আরে, রঙ্গনা রাস্তায় কি করে?"


চিত্রা থামলো। একা রাস্তায় একাকীত্ব কাটানোর মানুষ এলো। সে ধীর গতিতে পাশ ফিরে চাইতেই বাহারের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দৃষ্টিগোচর হলো। বাহার ভাই সচারাচর হাসেন না, অথচ আজ কি সুন্দর হাসির ঝিলিক মুখ জুড়ে। 


চিত্রা থামলো। ধীর কণ্ঠে বললো, 

"আপনি এ রাস্তায় যে, বাহার ভাই?"


বাহার চিত্রার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললো,

"হ্যাঁ, কাজে এসেছিলাম। তা তুমি এখানে কেনো?"


"এমনেই, কোচিং করতে এসেছিলাম।"


"তোমার কোচিং এর রাস্তা এটা তো না। ঘুরছিলে একা একা?"


বাহারের দৃষ্টি তখনো চিত্রার মুখমন্ডল জুড়ে। চোখে অবাধ প্রশ্নদের ছড়াছড়ি। 


চিত্রা ধীর কণ্ঠে বললো, 

"ভালো লাগছিলো না, বাহার ভাই। আম্মু যে কোথায় গেলো।"


"চিন্তা করো না, ফিরে আসবেন। তোমার মিছে জেদের জন্য উনি বোধহয় অনেক কষ্ট পেয়েছে। অহেতুক কাজ টা না করলেও পারতে।"


চিত্রার খুব গোপনে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কোমল কণ্ঠে বললো, 

"আমি কি করতে চেয়েছিলাম নিজের সর্বনাশ! বাবা'র আকুতি, আমার অতীত নিয়ে তাচ্ছিল্য আমি মেনে নিতে পারি নি, বাহার ভাই।"


বাহার দাঁড়ালো। চিত্রার মুখে তাকালো। কিছু একটা ভেবে সে ফুটপাতের কিনারায় এসে বসলো। হলুদ আলোয় রাস্তাটা কেমন মোহনীয় লাগলো! চিত্রাও বাহারের পাশে এসে বসলো। বহুদিনের শখ তার, বাহার ভাইয়ের পাশে বসে রাতের রাস্তা দেখবে, সোডিয়ামের কৃত্রিম আলোয় নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প করবে। তবে কি খুব দ্রুতই এসে পড়লো সে দিন খানা? 


পাশের টং দোকান থেকে বাহার গরম গরম দু'কাপ চা নিয়ে এলো। চিত্রার দিকে চা এগিয়ে দিয়ে নরম কণ্ঠে বললো, 

"এবার বলো তো, হুট করে বিয়ের মতন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কী? কি হয়েছিলো?"


চিত্রা চায়ের কাপটা হাতে নিলো। চোখ জুড়ে নেমে এলো তার সে দিন রাতের কথা, 


সেদিন নুরুল সওদাগরের এমন পরিবর্তনে অবাক হয়েছিলো চিত্রা। বাবা হঠাৎ এত স্নেহ ঢেলে দিচ্ছে ভেবে চোখ-মুখ টলমল করে উঠে তার। নুরুল সওদাগরের দৃষ্টি তখনো বাড়ির সামনের রাস্তায়। সে রাস্তায় মানুষ-জনের আনাগোনা দেখতে দেখতে হুট করে চিত্রাকে বললো,"চা বানাতে পারো?"


চিত্রা তখনো কিংকর্তব্যবিমুঢ়। বাবার হুট করে বলা উঠে প্রশ্নে সে হতভম্ব। নুরুল সওদাগর মেয়েকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন ছুঁড়লো, "পারো চা বানাতে?"


চিত্রা চা বানাতে পারে না কিন্তু তবুও বাবার প্রশ্নে উপর-নীচ মাথা নাড়ালো। ধীর কণ্ঠে বললো, "হ্যাঁ আব্বু,পারি।"


"তাহলে দুকাপ চা নিয়ে এসো চট জলদি। আমি অপেক্ষা করছি।"


বাবার বলতে দেরি অথচ চিত্রার ছুটে যেতে দেরি নেই। চা না বানাতে পারা চিত্রাও সেদিন হাত পুড়িয়ে চা বানালো। আধাঘন্টার মাঝে সে চা নিয়ে ঘরে পৌঁছালো। তখনও বাবা আগের মতন ঠাঁই বসে আছেন। চিত্রা চা এগিয়ে দিতেই নুরুল সওদাগর বেশ হাসি মুখে চা নিয়ে নিলেন। চিত্রাকেও অপর চায়ের কাপটা মুখে দেওয়ার ইশারা করলেন। 


পোড়া হাত নিয়েই চিত্রা চায়ের কাপ মুখে তুললো। নুরুল সওদাগর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির দৃষ্টি ফেলেন। চমৎকার এক হাসি দিয়ে বলেন, "বাহ্, চা তো বেশ বানাতে পারো।"


চিত্রা কেবল অস্বস্তি নিয়ে ক্ষীণ হাসি দিলো। নুরুল সওদাগর চায়ের কাপটা পিরিচের উপর রেখেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কেমন বিবশ কণ্ঠে বললেন, "তোমায় আজ কিছু কথা বলি, চিত্রা? তোমার তো উচিত নিজের জন্ম পরিচয় জানা, তাই না?"


চিত্রা বাবার কথায় অবাক হলো। হৃদপিণ্ড প্রয়োজনের তুলনায় দ্রুত লাফাচ্ছে যেন। বাবা কি তার জীবনের চির সত্যি কথাটা আজ বলবে? 


নুরুল সওদাগর তন্মধ্যেই বলা শুরু করলেন, 

"তোমায় অপছন্দ করার সবচেয়ে বড় কারণ কি জানো? তুমি আমার মেয়ে না।"


বাবার মুখে এমন একটা কথা শুনে ঘুরে উঠেছিলো চিত্রার পৃথিবী। বিস্ফো*রিত নয়নে সে বাবার দিকে তাকায়। নুরুল সওদাগর সে দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়েই বললেন,

"হ্যাঁ, এটা সত্যি যে তুমি এই সওদাগর বাড়ির কেউ না।"


চিত্রা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। অনড় তার দৃষ্টি, ভাষারা তখন স্তব্ধ। নুরুল সওদাগর তার দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন চিত্রার উপর থেকে, তা রাস্তায় নিবদ্ধ করে বললেন,

"তুমি আমার মেয়ে না, এটা তোমাকে অপছন্দ করার বড় কারণ হলেও, তার চেয়ে বড় কারণ হলো তুমি একজন নিষিদ্ধ পল্লির মায়ের মেয়ে।"


চিত্রা ততক্ষণে হতভম্ব। পায়ের নিচের মাটিটাও যেন খুঁজে পেলো না। কি শব্দ উচ্চারণ করলো বাবা? 

 


#চলবে

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ১৬

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


পর্বঃ ষোলো


(৩৯)


চিত্রার মুখে রাজ্যের বিস্ময়। অহি আপা তার ফুলের টব ভেঙেছে সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। অহি আপা হলো গিয়ে নরম মানুষ, তার দ্বারা এই শক্ত কাজ সম্ভব! 


অহির দৃষ্টি তখনও পার্কের আশপাশ বুলাতে ব্যস্ত। চিত্রার বিস্ময়মাখা মুখ পানে সে একবারও ফিরে তাকায় নি। চোখের সাথে চোখ মিললেই যেন সে কত কথা বলতে পারবে না। তাই তো আজ চোখে চোখ মেলানো বারণ। এতদিনের জমানো কথার প্রজাপতিদের আজ উড়িয়ে দিতে হবে। কথা জমিয়ে রাখলে মনের উপর অত্যাচার চালানো হয়। অথচ অহি নিজের মনের উপর সে অত্যাচার করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। আজ নাহয় অত্যাচারের সমাপ্তি ঘটুক। 


ছোট্টো একটা শ্বাস ফেললো অহি। ধীর কণ্ঠে বললো, 

"ভাবিস না তোর উপর হিংসে থেকে করেছি সেসব। তোর উপর হিংসে করার কিছু নেই। বরং মায়া করার মতন বহু কিছু আছে। তবে আমার মায়া কম। কাক পক্ষীতে ছিঁড়ে খেয়েছে মায়া।"


অহি আপার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝে নি চিত্রা। কেবল ফ্যালফ্যাল নয়নে চাইলো। কথা বলার শক্তিও যেন সে হারিয়েছে। অহি আপা কী বলছে, অহি আপা কি জানে? 


"আপা, তুমি ঠিক আছো?"


চিত্রার প্রশ্নে আকাশ ছোঁয়া বিস্ময়। অহি কিঞ্চিৎ হাসলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,

"আছি ঠিক। তোকে আজ কিছু কথা বলবো চিত্রা। অনেক গুলো বছর এ কথা কাউকে বলা হয় নি। এই লজ্জা, এই আঁধারিয়া জীবনের গল্প কাউকে জানানো হয় নি। আজ তুই শুনিস সে গল্প। অহি আপার মৃত্যুর গল্প শুনে নিস খুব যতনে। কেউ তো আর জানলো না এই অহির ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মনের কথা।"


চিত্রা কেবল অপলক তাকিয়ে রইলো অহির দিকে। আপাকে আজ ঠিক চেনা যাচ্ছে না। কেমন অপরিচিত একটা আদল ভেসে উঠছে। এটা কি সত্যিই অহি আপা? 


"আরে সওদাগর বাড়ির নক্ষত্রমালা যে, তা তোমরা এখানে?"


পুরুষালী কণ্ঠে দুই বোনের কথার খেই হারালো। দু'জনই তাকালো তাদের ডান দিকে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটার দিকে। এলোমেলো চুল, টি-শার্ট এঁটে সেঁটে থাকা শরীর, কাঁধে ব্যাগ আর ক্লান্ত মুখশ্রীর বাহারের দিকে। 


চিত্রা এবং অহি দু'জনই অবাক হলো বাহার ভাইকে দেখে। এসময়ে এখানে বাহার ভাইকে আশা করে নি তারা। বসা থেকে দু'জনই উঠে দাঁড়ালো। অহি অবাক কণ্ঠে বললো, 

"বাহার ভাই আপনি?"


"হ্যাঁ আমি। তা তোমরা দু'জন এখানে কি করছো? তোমাদের তো এসব জায়গায় তেমন দেখা যায় না।"


"আসলে চিত্রা ফুচকা পছন্দ করে তো তাই এসেছিলাম ফুচকা খাওয়াতে।"


অহির উত্তর শুনে চিত্রা গোল গোল চোখে তাকালো অহির দিকে। অহি আপা বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে জানে, এটাও চিত্রার জানা ছিলো না। আজ একের পর এক চমক দিচ্ছে অহি আপা। 


বাহার এগিয়ে এসে ধপ করে বেঞ্চটাতে বসে পড়লো। আড়মোড়া ভেঙে বললো,

"তা বেশ ভালো তো। তোমাদের মধ্যে এত মহব্বত তো ঠিক দেখা যায় না, একবারে ধূমকেতুর মতন।"


কথা শেষ করেই হা হা করে উদ্ভট ভাবে হেসে দিলো বাহার ভাই। বাহার ভাইয়ের অদ্ভুত হাসির সাথে তাল মেলালো অহিও। অথচ এমন একটা বিদঘুটে ঠাট্টা অন্য কেউ করলে অহি আপা তাকে এখানেই উচিৎ জবাব দিয়ে দিতো। 


চিত্রা কেবল দেখে গেলো অহি আপা আর বাহার ভাইয়ের কান্ড। তন্মধ্যেই ফুচকার প্লেট হাজির হলো। অহি নিজের ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দোকানদারকে দিয়ে এসে বাহারের সামনে দাঁড়ালো। বেশ ব্যস্ত কণ্ঠে বললো, 

"আপনি কী এখন বাড়ি যাবেন, বাহার ভাই?


"হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।"


"তাহলে চিত্রাকেও সাথে নিয়ে যাবেন প্লিজ। আসলে আমার একটা দরকারী কাজ আছে তো, এখনই যেতে হবে।"


অহির অনুরোধে বাহার ভাই একবার চিত্রার দিকে তাকালো। চিত্রা এতক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ছিলো বিধায় দু'জনেরই চোখে চেখে পড়লো। বাহার সাথে সাথেই চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। এতে ছোটো হয়ে এলো চিত্রার মন। কারণ সে জানে, বাহার ভাই কখনোই রাজি হবে না। কিন্তু চিত্রাকে অবাক করে দিয়ে বাহার বললো,

"কোলে করে নিবো নাকি কাঁধে করে?"


বাহারের উদ্ভট কথার ভঙ্গিতে আবার হেসে ফেললো অহি। মুখ চেপে বললো,

"আপাতত রিক্সা করে নিলেই হবে।"


চিত্রা মুখ ফুলালো। আড় চোখে অহির দিকে তাকিয়ে বললো, 

"আপা, তোমার না এখন বাড়ি যাওয়ার কথা? তাহলে এখন আবার কোথায় যাবে তুমি?"


অহি চিত্রার কাছে গেলো, চিত্রার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললো, 

"দরকারী কাজে যাবো। টাকাটা রাখ, রিক্সা ভাড়া দিয়ে দিস। বাহার ভাইয়ের কাছে মনে হয় টাকা নেই।"


চিত্রা কেবল আহাম্মকের মতন মাথা দুলালো। অহি ততক্ষণে ঝড়ের গতিতে তাদের সামনে থেকে চলে গেলো। যেন তার কাজটা কত জরুরী। এখন না গেলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। 


(৪০)


কোলাহল পূর্ণ রাস্তায় একদম একা হেঁটে যাচ্ছে অহি। তার কোনো গন্তব্য নেই, না আছে নির্দিষ্ট কাজ। কেবল বাহার আর চিত্রাকে একটু একা ছাড়ার জন্য ই এ মিছে অজুহাত। আর কেউ জানুক আর না জানুক, সে তো জানে, বাহার ভাইয়ের গিটারের করুণ সুরের কথা। মাঝ রাত্তিরে বাহার ভাইয়ের দীর্ঘশ্বাসের কথা। সেখানে যদি চিত্রা এসব দূর করার চাবিকাঠি হয় তাহলে তো আর মন্দ হয় না। সবাইকে কি আর এক জনমে পাওয়া হয়? বাহার ভাই নাহয় অহির একজীবনের অপ্রাপ্তি হয়ে রইলো। 


"এই-যে মিস, শুনেন প্লিজ, সিঙেল আছেন কী?"


অহির ধ্যান ভাঙলো, মনে হলো তাকে উদ্দেশ্য করেই যেন কেউ গানটা গাইলো। পথচারীর কয়েকজন আড় চোখে চাইলো। অহি ঘুরে পেছনে তাকাতেই খুব স্বল্প পরিচিত মুখটা ভেসে উঠলো। অহি অবাক কণ্ঠে বললো, 

"আপনি! গানটা কী আপনি গাইলেন?"


সুন্দর দেখতে সুঠাম দেহী পুরুষ টা মুচকি হাসলো। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, 

"হ্যাঁ মিস. আমিই গাইলাম।"


অহির চোখে-মুখে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়লো। বিস্মিত কণ্ঠে বললো, 

"আপনি কী আমায় চিনতে পারেন নি?"


ভদ্র লোক এগিয়ে এলো, মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,

"চিনবো না কেনো? গত পরশুই তো দেখলাম আপনাকে। কালো জামা পড়নে, গোল গোল চশমায়, মিষ্টি দেখতে মেয়েটা।"


লোকটার কথার ধাঁচ পছন্দ হলো না অহির। এমন একটা ছেলের জন্য কিনা চাচা চিত্রার বিয়ে ঠিক করেছে? ছেলেটা কেমন গায়ে পড়া গোছের। 


অহির চোখ-মুখ কুঁচকানোর ভঙ্গিমা দেখেই নওশাদ হয়তো কিছু আন্দাজ করলো। তাই তো বেশ ঠাট্টার স্বরে বললো, 

"আপনি কী আমায় চরম অভদ্র ভাবছেন, মিস?"


অহি নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে বেশ ভদ্র ভাবে বললো,

"দেখুন মিস্টার, আপনার সাথে আমাদের পরিবারের একটা সুন্দর সম্পর্কের কথা হচ্ছে, তাই আপনার কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করছি না।"


"সুন্দর সম্পর্কে ঠাট্টা করা কি নিষিদ্ধ? চলুন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাক।"


নওশাদ ছেলেটাকে অভদ্র কখনোই মনে হয় না। বেশ ভদ্রই মনে হয়, তবুও তার অহেতুক ঠাট্টা টা অহির পছন্দ হয় নি। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে সে পা মেলালো। অহিকে হাঁটতে দেখে মিষ্টি হাসলো নওশাদ। ক্ষীণ স্বরে বললো, 

"আপনাকে নিয়ে হাঁটা হবে মোর শত আলোকবর্ষ পথ।"


(৪১)


রিক্সার হুড উঠানো, গতি মাধ্যম, চলছে অনবরত। পাশাপাশি বসে আছে চিত্রা আর বাহার ভাই। চুপচাপ, স্তব্ধ। অন্য সময় হলে চিত্রাই কত কথার ঝুড়ি নিয়ে বসতো, কিন্তু আজ তার মনে ভীষণ শোক। কথা বলা যাবে না, আর এ পাষণ্ড পুরুষের সাথে তো আরও আগে কথা বলবে না সে। 


রাস্তার দুই সারিতে কৃষ্ণচূড়া গাছের মেলা। কি সুন্দর লাল টুকটুকে ফুল হাসছে অনবরত। রিক্সার ক্রিং ক্রিং শব্দ। 


নিরবতা ভাঙলো বাহার। বরাবরের মতন গা ছাড়া ভাবে বললো,

"তা রঙ্গনা, মিষ্টি তো খাওয়ালে না।"


চিত্রা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। লোকটা তাকে খুঁচিয়ে কী মজা পায়? হৃদয়ের জ্বালা বাড়িয়ে কি তৃপ্তি মেলে লোকটার? 


ছোটো একটা শ্বাস ফেলে সে। বুকের ভেতর ভারী ভারী হয়ে উঠে কষ্টরা। লোকটার সাথে কথা ই বলবে না সে। 


"অভিমান জমিয়ে রেখে লাভ কী? আমরা বাঁচবোই বা কতদিন?"


বাহার ভাইয়ের গম্ভীর স্বর কাঁপন ধরালো চিত্রার চিত্তে। হুট করে তাকাতেই দু'জনের চোখে চোখ পড়লো। সময়টা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মধুর হলো। নিশ্বাসের গতি বেড়ে গেলো অপ্রত্যাশিত ভাবে। লজ্জারা খেলা করলো সর্বাঙ্গে। 


চিত্রা চোখ সরিয়ে নিলো। বাহিরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে করতে বললো, 

"অভিমান অভিযোগ নেই আমার।"


"না থাকাটাই স্বাভাবিক। পর মানুষের প্রতি অভিমান রাখতে নেই, রঙ্গনা।"


বাহারের কণ্ঠে তুমুল গম্ভীরতা। কথার এমন তীক্ষ্ণতায় অভিমান করলো অষ্টাদশীর হৃদয়। ঠোঁট ফুলিয়ে টলমল করে উঠলো চক্ষুদ্বয়। 


বাহার ছোট্টো ধমক দিলো, গম্ভীর কণ্ঠে বললো, 

"এই মেয়ে, কথায় কথায় কান্না করার স্বভাব বদলাও। কান্নাকে সস্তা বানিয়ো না, নিজের সবটা সত্তাকে সবচেয়ে মূল্যবান রাখার চেষ্টা করবে। হোক কান্না কিংবা হাসি।"


"আমি আপনার সাথে রাগ করেছি, বাহার ভাই।"


"তো রাগ করেই থাকো। আমি কী তোমার রাগ ভাঙাতে এসেছি?"


বাহারের গা ছাড়া ভাবে চিত্রা গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। বাহার ভাই পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালাতে জ্বালাতে বললো,

"তোমায় জ্বালাতে এত সুখ লাগে কেনো? কোন দিন যেন যেচে জ্বলতে এসে ছাই হয়ে যাও।"


"আপনি জ্বালালে, ছাই হতেও রাজি।"


"শুনো রঙ্গনা, অনুভূতির এমন প্রকাশ্যে বর্ণনা আমার পছন্দ না। অনুভূতি গোপনে রাখতে হয়, তবেই না মূল্যবান হবে।"


বাহারের কথায় অপমানিত হলো চিত্রা সাথে তাজ্জবও বনে গেলো। ততক্ষণে রিক্সা এসে থেমেছে বাড়ির সামনে। চিত্রা ভাড়া মিটিয়ে দিতে দিতে বললো,

"আর অনুভূতি মেলে ধরবো না, বাহার ভাই। সবাই তো সবটার মূল্য দিতে জানেনা, আমি ভুলেই গেছিলাম।"


চিত্রার তীক্ষ্ণ কথাতেও হেলদোল হলো না বাহারের। সে বরং বেশ গা ছাড়া ভাবেই বললো,

"এই যে মেয়ে রঙ্গনা, তোমার মুখে অভিমান মানায়, অভিযোগ না।"


চিত্রা ততক্ষণে বাড়ির ভেতরে চলে গেছে। বাহার ছোটো একটা শ্বাস ফেলে। দীর্ঘশ্বাসের হাহাকার ভেসে গেলো তার সাথে। আজ টিউশনিটাও চলে গেছে। এমন মানুষের প্রেমে মত্ত হওয়া মানায়? যার বাঁচা মরারই ঠিক নেই। 


আফসোস গুলো সে হাওয়ায় মিলিয়ে গান ধরে,

"জীবন দিলা কাঞ্চা বাঁশের খাঁচারই মতো, 

যত্ন নেওয়ার আগে তাহা, ভাঙে অবিরত দয়াল, 

ভাঙে অবিরত।"


(৪২)


আজ সারাদিন দেখা মেলে নি মুনিয়া বেগমের। প্রথমে সবাই ভেবেছিলো রাগ করে হয়তো দোর দিয়েছেন, কিন্তু যখন দরজার সামনে পর্দা সরালো তখন দেখা গেলো দরজা বাহির থেকে আটকানো। দরজা খুলে ভেতরে যেতেই শূণ্য রুমখানি জানিয়ে দিলো মুনিয়া বেগম নেই। বিছানার কিনারায় সাদা চিরকুট। 


#চলবে