গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ১৫

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


অতীত সমাচারঃ পনেরো


(৩৬)


নিরব, নির্জন কালো আকাশে পূর্ণিমার মেলা আজ। কি সুন্দর আকাশ! মেঘেরা ছুটে যাচ্ছে দলবেঁধে। খোলা রাস্তায় ফিনফিনে বাতাস। ঠিক চল্লিশ মিনিটের মাথায় অবনী বেগম তার কাঙ্খিত জায়গায় এসে পৌঁছালেন। বুকের মাঝে কেমন থেকে থেকে কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে! মাঝে মাঝে তো মনে হচ্ছে শ্বাসই বন্ধ হয়ে যাবে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। অবনী বেগমের বাইশ বছরের সাংসারিক জীবনে সে আমজাদকে কখনোই স্বামী হিসেবে মন থেকে মানতে পারে নি। তবে আজ কেনো হারানোর ভয়? হয়তো মায়া। এতবছর একটা মানুষের সাথে থাকলে মায়া পড়ে যায়। যে মায়ার টানেও মনে হয় মানুষটা থেকে যাক। এই মায়া আর অভ্যাসের কারণে কত মানুষ কত মানুষকে ছাড়তে পারে না। অবনী ধীর পায়ে চারপাশের বাড়ি গুলোতে চোখ বুলায়।  অবশেষে কাঙ্খিত বাড়িটা পাওয়া গেলো বড় একটা অচেনা গাছের ডানদিকে। 


অবনী বেগম ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন বাড়িটার সামনে। বাড়ির গেইটের সামনে একটা লাইট জ্বলছে। লাইটের আলোয় বাড়ির মালিকের নাম জ্বলজ্বল করছে। অবনী বেগমের পা সেখানেই থেমে গেলো। ইংরেজিতে বড় বড় অক্ষরে লিখা "মিসেস জেছি ফ্রাংকিং"। 


অবনীর হৃদপিণ্ড স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ দ্রুতই চলছে। ঠিক এ মুহূর্তে এসে অবনী বেগমের মনে হলো তার বোধহয় বাড়িটার ভেতর যাওয়া উচিৎ হবে না। ভিনদেশে যা লুকিয়ে আছে তা ভিনদেশেই নাহয় লুকিয়ে থাক। বয়স তো অনেক হলো, আর ক'দিনই বা বাঁচবে! কি দরকার হাহাকার নিয়ে বাঁচার? এরচেয়ে জীবন যেমন চলছে, তেমনই নাহয় চললো। অপ্রত্যাশিত কিছু নাহয় আড়ালেই রইলো। জেনে গেলেই তো দূরত্ব বাড়বে। আমজাদ সওদাগর তো তাকে কম ভালোবাসা দেন নি। সে-ই ভালোবাসা আগলে রাখতে পারলো না বরং প্রতিহিংসার অনলে দগ্ধ করতে চেয়েছিল বার বার সেই সওদাগর পরিবারকে। কিন্তু কখন যেন আষ্টেপৃষ্টে সে পরিবারের মায়ায় পরে গেলো, টেরই পেলো না। অথচ অসময়ে মায়া বেড়ে কি লাভ! হারানোর পর মায়া কেবল বিলাসিতা হয়ে রয়।


অবনী বেগম আঁধার রাস্তায় আবার পা বাড়ায়। হসপিটালে ফিরে যাওয়ার অত ব্যস্ততা নেই, ধীর পায়েই যাওয়া যাবে। চারপাশে ততক্ষণে ভোরের আলোও ফুটে যাচ্ছে। নীলাভ আকাশ, শীতল প্রকৃতি। অবনী বেগম হাঁটতে হাঁটতে ডুব দিলেন অতীতে। আজকের এই শক্তপোক্ত অবনী বেগম এমন কখনোই ছিলেন না। অজপাড়াগাঁ এর এক সহজ সরল মেয়ে ছিলো সে। বাবা আর সে ছিলো তাদের ছোট্টো কুটিরের সদস্য। অবনী বেগমের বয়স তখন কত হবে? পনেরো কিংবা ষোলো। গ্রাম ঘুরে বেড়ানো উড়নচণ্ডী ছিলো সে। এ পাড়া ও পাড়া, এ গ্রাম ও গ্রাম করেই তো জীবন কাটছিলো বেশ। পড়াশোনাও করতো না। তখন পড়াশোনার ততটা মূল্য ছিলো না, তাও আবার মেয়েদের। তার উপর অজপাড়াগাঁ। পঞ্চম শ্রেণীতে থাকাকালীন সমাপ্তি ঘটিয়ে ছিলো পড়াশোনার। দেখতেও বেশ ছিলো। বাবা ছিলো দিনমজুর, সারাদিন খেটেখুটে যা রোজগার করতো, তা দিয়ে বাবা-মেয়ের সংসার দিব্যি চলতো। 


একদিন সময়টা ঠিক গ্রীষ্মের মাঝামাঝি, উত্তপ্ত দুপুরে গরমের তীব্রতায় জান যায় যায় অবস্থা সকলের। কি গরম! অথচ অবনী বেগম সেই দুপুরেও বেশ আরামে পাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। শরীরে একটা চকচকে হলুদ রঙের থ্রি-পিস। গোসল করায় চুল গুলো খোলা যা বাতাসে দোল খেয়ে যাচ্ছে। গলায় একটা তাবিজ। শুকনো, সরু দেহখানা নিয়ে সে জারুল গাছের তলায় বসে কামরাঙ্গা খাচ্ছে বেশ আয়েশ করে। সাথে তার বন্ধু বান্ধবের দল। হুট করেই সেখানে পুলিশের জীপ গাড়ি এসে থামলো। এলাকায় তখন ডাকাতের প্রকোপ বেড়েছে বিধায় নতুন অনেক বড় বড় পুলিশ অফিসারের পোস্টিং হয়েছিলো সেথায়। 


পুলিশের গাড়ি দেখতেই অবনীর বন্ধুবান্ধব সব ছুটে পালালো। আকষ্মিক ঘটনায় তাজ্জব অবনী বেগম। অবনী বেগমের ছোটোবেলা থেকেই একটা সমস্যা ছিলো, আকষ্মিক কোনো কিছু সে নিতে পারতো না। মাঝে মাঝে সে উদ্ভট কথাও বলে ফেলতো উত্তেজিত হয়ে। সেদিনও ঠিক এমনটা ঘটলো। পুলিশ দেখে সব ছেলেমেয়ে যখন পালিয়ে গেলো অবনী তখনও ঠাঁই বসে আছে। তখন ছেলেমেয়ে পুলিশকে বাঘ ভাল্লুকের মতন ভয় পেতো। যেন কি ভয়ঙ্কর প্রাণী এই পুলিশ। 


জীপ গাড়ি থেকে তখন বেশ সুঠাম দেহী, শ্যামলা বর্ণের একজন গম্ভীর মতন পুরুষ নেমে এলো। নেমেই সে অবনীর কাছে চলো এলো। অবনীর হাতে কামরাঙ্গা, চোখে বিষ্ময়। 


লোকটি অবনী বেগমের কাছে এসে ভরাট স্বরে প্রশ্ন করলেন,

"এই যে নারী, গাছতলায় কি শুনি? ভরদুপুরে এমন জঙ্গলে কি করছেন?"


অবনী বেগম এর আগে কখনো অপরিচিত পুরুষের সান্নিধ্যে যায় নি। সেদিন হঠাৎ অপরিচিত পুরুষটিকে সামনে দেখে ভয়ে, অস্বস্তিতে তার চোখ টলমল করে উঠলো। ঠোঁট উল্টে ফেললো। কেঁদে দিবে দিবে ভাব। 


অবনীর লম্বাটে মুখ খানায় কালো মেঘের আনাগোনা দেখে ভড়কে গেলো পুলিশের পোশাকে থাকা গম্ভীর মানবটা। ব্যাতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো, 

"এই যে জারুলকন্যা, কেঁদো না কেঁদো না। ভয় পাচ্ছো? আমি তোমায় বকি নি তো।"


জারুলকন্যা নাম শুনতেই অবনী বেগমের কান্না থেমে গেলো। সেই প্রথম, সেই প্রথম অবনী বেগমের মনে কোনো পুরুষের আদল ভেসে উঠলো। সেই প্রথম অবনী বেগম কিছু ভিন্ন অনুভূতির সাথে পরিচিত হলেন। 


হঠাৎ গাড়ির হর্ণে ধ্যান ভাঙে অবনীর। অতীত ভাবতে ভাবতে আকাশের নীলাভ রঙ সরে গিয়ে সাদা সাদা মেঘে ভরে গেছে। দিনের আলো ও ফুটে গেছে। অবনী বেগম হসপিটালের সামনে চলে এসেছে! টেরই পেলো না? অতীত এমনই মধুময় জিনিস যা ভুলিয়ে দেয় বর্তমান। তাই তো মানুষ সদা আফসোসের গান গেয় অতীত নিয়ে। 


(৩৭)


আজ শনিবার। সওদাগর বাড়িতে তুমুল নিরবতা। হৈচৈ নেই কোনোরকমের। তৃষান আর দিশান আজ হোস্টেলে চলে গিয়েছে। অহি ভার্সিটিতে, চিত্রা নিজের কলেজে। ছেলেরা যার যার কাজে। তুহিন গতকাল রাগ করে যে বাহিরে গেলো আর ফিরে আসে নি। তুহিনের রাগ বরারবরই অনেক বেশি। খুব সহজে না রাগলেও, রাগ উঠলে আর হুঁশ থাকে না। 


চঞ্চল বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেলো। খাবার টেবিলের হৈচৈ আর হয় না, টিভির চ্যানেল নিয়ে ভাই-বোনদের আর মিছে মিছে তুমুল ঝগড়া হয় না, মাছের বড় টুকরোটা কে খাবে তা নিয়ে আরেক দফা বাকবিতন্ডাও আর হয় নি। কেমন বাড়িটার প্রতিটি কোণায় হাহাকার লেপ্টানো। 


আফজাল সওদাগর তার নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। কপালে হাত রেখে, চোখ দু'টি বন্ধ। রোজা সওদাগর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করতেই তার চোখ যায় স্বামীর নিস্তব্ধ দেহটার দিকে। রোজা বেগমের বড্ড মায়া হয় স্বামীর জন্য। স্বামীর জন্য এই রোজা সওদাগর কত কিছুই না করেছে? কত অন্যায় না মেনে নিয়েছে, কেবল স্বামীর মুখের হাসি দেখার জন্য। অথচ আজ সেই স্বামীই কিনা নিশ্চুপ! এ পরিবারটাকে সবসময় এক আঁচলের ছায়াতলে সে রাখতে চেয়েছিলেন, তবুও আজ কোথাও যেন ভাঙার সূত্রপাত দেখা দিয়েছে। একটা নারীর সংসারের চেয়ে বড় আর যে কিছু নেই। 


স্বামীকে এক ধ্যানে মগ্ন হতে দেখে রোজা সওদাগর স্বামীর পায়ের কাছটায় এসে বসলেন। ধীর কণ্ঠে শুধালেন,

"আপনি কী জেগে আছেন?"


আফজাল সওদাগরের ধ্যান ভাঙলো। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন করলেন না। যেমন আছে তেমন থেকেই বললেন,

"হ্যাঁ, জেগে আছি। কিছু বলবে?"


"আপনার কি মন খারাপ?"


"মন খারাপ হওয়া টা স্বাভাবিক না, রোজা? যে ভাইদের জন্য এতকিছু করলাম আজ তারাই দাম দিচ্ছে না। এরচেয়ে কষ্ট আর আছে বলো? মা-বাবা যখন মারা গেলেন, দুটো ভাই, একটা বোনের বটগাছ হয়ে দাঁড়ালাম আমি। অথচ আজ আমিই মূল্যহীন।"


রোজা সওদাগরের খারাপ লাগলো। তার স্বামী প্রীতি বেশি। স্বামীর কষ্ট সে মানতে পারে না কখনোই। 


রোজা সওদাগর আশ্বাসের স্বরে বললেন,

"আপনি চিন্তা করবেন না। নুরুল আজকাল কেমন হয়ে গেছে। বয়স বাড়ছে তো। আর আপনি তো চিত্রার বিয়ের কথা আটকাতে চেয়েছিলেন, তা আটকেছে। আপাতত দেখে গেছে। পরে কথা আগানো হবে বলা হয়েছে। আর মন খারাপ করবেন না।"


আফজাল সওদাগর ধপ করে উঠে বসলেন। চোখ তার কেমন হলদেটে ভাব। সে তার স্ত্রীর হাত দুটো মুঠ করে ধরলো। কেমন অসহায় কণ্ঠে বললো, 

"পাপের ভার নিয়ে বেঁচে থাকা অনেক কষ্টের, বিবি। তুমি আমারে অভিশাপ দিছিলা তাই না? তাইতো আজ এ অবস্থা আমার।"


স্বামীর কথায় আৎকে উঠলো রোজা। তওবা করে বললেন,

"কি বলেন আপনি! আপনারে অভিশাপ দেওয়ার আগে আমার জিহ্বা খঁসে পড়ুক। আর আপনি যা পাপ বলছেন তা আদৌও পাপ না। আপনি তো জানেন আর আমার আল্লাহও জানে সেটা। আপনি এসব ভাববেন না।"


আফজাল সওদাগর অনবরত মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন,

"এটা পাপই বিবি। আমি তোমাদের ঠকিয়েছি। নিজের স্বার্থে আরেকজনকে ঠকিয়েছি। ওদের মৃত্যুও তো আমায় অভিশাপ দিয়েছে।"


স্বামীর কথায় ভড়কে গেলে রোজা সওদাগর। উৎকণ্ঠিত কন্ঠে বললেন,

"কাদের মৃত্যু?"


আফজাল সওদাগর উত্তর দিলেন না। আফসোসের অশ্রু গড়িয়ে গেলো তার গাল বেয়ে। 


(৩৮)


গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার চিত্রা। সাদা কলেজ ইউনিফর্ম টা লেপ্টে গেছে শরীরে। চুলের মাঝে দুই বেণী। পিঠে বইয়ের ভারী ব্যাগ। গতকাল তার দেখাদেখিটা সে অব্দিই সীমাবদ্ধ ছিলো। মাহাতাব দুলাভাই এর কারণে তা বেশি দূর অব্দি আগায় নি। আবার নওশাদ নামের লোকটাও বলেছে সময় নেওয়া উচিৎ দুই পক্ষের। 


চিত্রার মনে কেমন যেন অশান্তি। বিরক্তিতে শরীরের প্রতিটা অঙ্গ জ্বালা দিয়ে উঠছে। জীবনটা তার এত অসহ্য ছিলো না কখনো। আগে তার বাবা তাকে পছন্দ করতো না। সে জানতো না বাবা কেনো তাকে অপছন্দ করতো কিন্তু যখন সে জানলো বাবার অপছন্দের কারণ তখন থেকে চিত্রা নিজেই আর নিজেকে পছন্দ করছে না। জীবনটা হঠাৎ ই বিভীষিকাময় হয়ে উঠলো। 


"এই চিত্রা, দাঁড়া।"


পথে মধ্যে চির পরিচিত কণ্ঠ শুনে দাঁড়ালো চিত্রা। পিছে ঘুরতেই চোখে পড়লো অহি আপার লাল টুকটুকে মুখটা। গরমে লাল হয়ে গেছে। চিত্রা কিঞ্চিৎ হাসলো অহি আপাকে দেখে। অহি ততক্ষণে চিত্রার কাছে চলে এসেছে। 


"আপা, তোমার ক্লাস শেষ?"


"না রে, ভালো লাগছে না। যা গরম। বাসায় গিয়ে ঘুম দিবো। তোর ক্লাস শেষ?"


"হ্যাঁ আপা।"


"তো চল, একসাথে বাসায় যাই। ফুচকা খাবি, চিত্রা?"


অহি আপার প্রস্তাবে অবাক হলো চিত্রা। অহি কখনোই বাহিরের খাবার পছন্দ করে না। আর আজ সে কিনা, ফুচকার কথা বলছে! 


চিত্রার অবাক বিষ্মিত মুখ খানা দেখে ফিচলে হাসলো অহি। বাঁকা হেসে বললো,

"কিরে, খাবি না?"


চিত্রা দ্রুত মাথা নাড়ালো, যার অর্থ সে খাবে। অহি মিষ্টি হেসে চিত্রাকে নিয়ে পাশের একটা পার্কে গিয়ে বসলো। পাশের থাকা ফুচকার দোকানটা থেকে দু প্লেট ফুচকা দিতে বললো। 


চিত্রা তখনো অবাক। অহি চিত্রার অবাক ভাবটাকে তেমন পাত্তা না দিয়ে আশেপাশে দেখতে লাগলো। দেখতে দেখতে হুট করে বলে উঠলো,

"একটা সিক্রেট শুনবি চিত্রা?"


চিত্রা তখন তার ব্যাগের ভেতর থেকে পানির বোতল টা বের করেছে। অহির কথায় ভ্রু কুঁচকে বললো,

"কি সিক্রেট, আপা?"


অহি বিবশ কণ্ঠে বললো,

"তোর ফুল গাছের টব গুলো আমি ভেঙেছি।"


#চলবে

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ১৩+১৪

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


পর্বঃ তেরো+চৌদ্দ 


(৩২)


"ওরে পাখি বলিস তারে, কত ব্যাথা রাখি গোপন করে,

কখনো ব্যাথারা মুখ থুবড়ে পড়ে, কখনো বা অশ্রু হয়ে ঝড়ে"


নীল রঙের কালি দিয়ে লিখা ছোটো দু'লাইনের কথা গুলো, কত সুন্দর! কত ব্যাথার! চিত্রা বার কয়েক পড়লো লেখা গুলো, বেশ মনে ধরেছে। সে যখন এসএসসি দেয়, তখন এখানে সেখানে এলোমেলো, অবুঝ মনে কত কথা ই লিখে রাখতো, কত কবিতাই যত্নে গড়তো। টিনেজার সময়টাই তো এমন। বয়ঃসন্ধিতে এসে ছেলে-মেয়ে কিছুটা কাব্যিক হয়ে যায়। তাদের অতি রঙচঙে আবেগ ঝরে পড়ে কাব্যের পাতায়। চিত্রাও তাদের থেকে আলাদা না। অথচ সেদিন যে কথা টা লিখেছিলো একান্তই ফুরফুরে মনের আবেশ অনুভব করার জন্য আজ সে লিখাটাই জীবনের চরম ব্যর্থতা মনে করাচ্ছে। সময় পাল্টাতে ঠিক কতটুকু সময় লাগে? এক সেকেন্ড বা তারও কিছুটা কম। বা'চোখের কাজল ঘেটে মুক্তোর মতন একবিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চিত্রার চোখের কোণে থেকে। আহা, কান্নারা এত অবাধ্য কেন! 


সময়টা আগস্টের সতেরো তারিখ, শুক্রবার। বেলা এখন ঠিক অপরাহ্ন। চিত্রার শরীরে নীল রঙের শাড়ি জড়ানো।  চোখে গাড়ো কাজলের প্রলেপ। অভিমানীনির প্রগাঢ় অভিমান ঢাকতে যেন সক্ষম সেই কাজল। হয়তো নয়নের গভীরে লুকিয়ে থাকা অনুভূতিদের লুকানোর জন্য এ ব্যবস্থা। শ্যামলা শরীরে গাড়ো নীল রঙটা ঠিক খারাপ লাগছে না। চলনসই থেকেও আরও দু'ধাপ বেশি ভালো লাগছে। পিঠ অব্দি চুল গুলো বাতাসে উড়ছে তার। আজকে বিশেষ দিন তার জীবনে, তাই এত সাজগোজ। জীবন তো কিছুর জন্য থেমে থাকে না, সে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় অনেক দূর। যদি এগিয়ে যাওয়া টা খুব দ্রুত হয় তবুও বোধহয় খারাপ হবে না। 


অপেক্ষিত সময়ের অবসান ঘটলো। বাহিরের ঘর থেকে চিত্রার ডাক ভেসে এলো। এইতো চিত্রার ডাক পড়েছে। নতুন কিছুর শুরু হওয়ার আহ্বান এসেছে। চিত্রা বিছানায় বসে রইলো। বুকের মাঝে যন্ত্রণাদের বিক্ষোভ মি*ছিল। তাদের যেন প্রতিবাদ, বুকের মাঝে ঠাঁই দেওয়া মানুষটাকে ছাড়া আর কাউকে সহ্য করবে না চিত্রার জীবনে। কখনোই না। 


চিত্রা শ্বাস নিলো, অনুভব করলো এই চারপাশে বাহার ভাইয়েরই কেবল অস্তিত্ব। এই যে আলমারির ভেতর রাখা বাহার ভাইয়ের শুভ্র রঙের টি-শার্ট, বইয়ের টেবিলের উপর বাহার ভাইয়ের নোটস, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারের ভেতরে বাহার ভাইযের কতশত ফেলে দেওয়া আধখাওয়া সিগারেট, এই যে হৃদয় মাঝে পুষে রাখা আস্ত একটা বাহার ভাই। সব জায়গাতেই তো মানুষ টা। তবে তাকে ভুলার জন্য এত আয়োজন কেনো! এই আয়োজনের স্বার্থকতা কোথায়? 


ভাবনার মাঝে চিত্রার ঘরে প্রবেশ করলো তার মা, মুনিয়া বেগম। চোখে চিকন গ্লাসের চশমা, শরীরে কালো শাড়ি, মুখে চিকচিক করা ঘামের বিন্দুকণা। সে এসেই ব্যাস্ত ভাঙিতে বললো,

"চিতু,তুমি সাজগোজ করেছো কেনো? বাবার সাথে পা*গল হয়েছো? সেখানে তুমি যাবে না। নিজের এত বড় ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে কেনো লেগেছো? আর তোমার বয়সই বা কত? এ বয়সে কিসের বিয়ে! কোনো বিয়ে টিয়ে হবে না।"


মায়ের ব্যস্ততা মেশানো কথার পরিপ্রেক্ষিতে জবাব দিলো না চিত্রা। কেবল মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো অনিমেষ। মা 'টা এত সুন্দর কেনো? ভাইয়াও মায়ের মতন সুন্দর। তাদের দেখলেই কেমন চোখে শান্তি শান্তি লাগে। ভালো লাগায় ছেয়ে যায় হৃদয় জমিন। 


মেয়ের কোনো হেলদোল না দেখে বিরক্ত হলো মুনিয়া বেগম। বিরক্তিকর কণ্ঠে বললো,

"তোমায় কি বলেছি শুনেছো? বিয়ের আশা বাদ দাও। তোমার বাবার তালে নাচা বন্ধ করো। এতটুকু একটা জীবন তোমার।"


"বিয়ে তো করতেই হবে, আম্মু। সমাজের চিরপরিচিত প্রথা অনুসারে মেয়েদের তো আজীবন বাবার ঘরে থাকার নিয়ম নেই। যেতেই যেহেতু হবে তবে আগেই যাই। পরে তো মায়া আরও বেড়ে যাবে, আম্মু।"


মুনিয়া মেয়ের কথায় হতভম্ব হয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন,

"চিত্রা! কি বলছো এসব!"


"ভুল বলেছি আম্মু? তোমরা কী আর আমায় চিরদিন রেখে দিবে, বলো? একদিন তো হস্তান্তর করা হবে আমাকে, তবে আজ কেনো নয়! জীবনটা আমার এই একেক জনের হাতে কেবল হস্তান্তরিত হয়েই যাবে। পড়ে পাওয়া কিনা।"


"চিত্রা!"


মুনিয়া বেগমের কণ্ঠে চরম বিষ্ময়। সে বিষ্ময়ের স্রোতে যেন কথারই খেই হারিয়ে ফেললো। সারাদিন দুষ্টুমিতে মত্ত থাকা চিত্রার আজ কথা গুলোর ওজন বেশি। এত ভারী কথা যে আশা করেন নি মুনিয়া বেগম। তাহলে আজ মেয়েটাকে এত অপরিচিত লাগছে কেনো? কেমন অপরিচিত একটা অবয়ব মেয়েটার মাঝে! 


মুনিয়া বেগম হয়তো আরও কিছু বলতেন কিন্তু তন্মধ্যেই নুরুল সওদাগরের আগমনে কথার নদীতে ভাঁটা পড়লো। 


নুরুল সওদাগরের মুখে বরাবরের চেয়ে আজ হাসির রেখা বেশ গভীর। চোখে মুখে কেমন যেন একটা রাজ্যের শান্তি। শান্তিটা ঠিক কিসের? সবচেয়ে অপছন্দের মানুষটাকে চোখের সামনে দেখতে হবে না, এটাই কী কারণ তবে?


মুনিয়া বেগম নিজের স্বামীর দিকে তাকালেন। তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলেন,

"আমার মেয়ের ধ্বংস না ডেকে আনলেও পারতে।"


নুরুল সওদাগর হয়তো প্রস্তুত ছিলেন না স্ত্রীর এহেন কথায়। তাই সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। বিষ্মিত কণ্ঠে বললেন, 

"কি বলছো এসব! চিত্রা আমারও মেয়ে, ভুলে যেও না।"


বাবার একটা কথায় চিত্রার ভিতরের যত না পাওয়ার হাহাকার ছিলো, সব মিইয়ে গেলো। জীবনের আঠেরোটা বছর সে কেবল অপেক্ষা করেছিলো বাবার মুখ থেকে এ কথাটা শোনার জন্য। আজ মনে হচ্ছে বেঁচে থাকাটা স্বার্থক। বাবার আদর পাওয়ার জন্য চিত্রা এমন কয়েকটা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নাহয় মাথা পেতে নিবে, তবুও তো তার বাবার ভালোবাসা পাবে। এই ঢের। 


"আচ্ছা! চিত্রা তোমার মেয়ে? কবে থেকে তাকে মেয়ে মানা শুরু করলে? তোমার জাত যাবে না?"


স্ত্রীর বিদ্রুপের হাসি দেখে গা জ্বলে উঠলো নুরুল সওদাগরের। সে বেশ খানিকটা জোরেই বললো,

"মুনা, সাবধানে কথা বলো। বাড়ি ভর্তি মেহমান, নাটক টা বন্ধ করো। আমি চিত্রার খারাপ চাইবো না নিশ্চয়।"


"ভালো কেনো চাইতো আসছো? আমার মেয়ের ভালোটা তোমার না চাইলেও হবে। যাদের ভালো এত বছর চেয়ে আসছো, তাদেরটাই চাও। নাকি তাদের ভালোর জন্যই আমার মেয়ের এ সর্বনাশ করছো! কোনটা?"


মুনিয়া বেগমের কথা শেষ হতেই তার ডান গালে সশব্দে চ*ড় বসালো নুরুল সওদাগর। এই ঘটনা টা মুনিয়া আর চিত্রা দুজনের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিলো। মুনিয়া বেগম তাই নিম্চুপ হয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তন্মধ্যেই অহি এলো, চিত্রাকে ধরে নিয়ে গেলো পাত্রপক্ষের সামনে। চিত্রা কেবল পাথরের ন্যায় হেঁটে গেলো। এ জীবনে হুট করেই তার চাওয়া-পাওয়া গুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। কেবল মনে হলো, বিফল এই বেঁচে থাকা। 


(৩৩)


সময়টা ঠিক মধ্যরাত, ভিনদেশের মাটিতে পা রেখেছে অবনী আজ পাঁচদিন হতে চললো। বাড়ির সবাই তাদের নিয়ম করে খোঁজ নিচ্ছে, কিন্তু তবুও অবনী কোথাও নিজেকে একা ফিল করে। এই একা অনুভব করাটা একাকীত্ব না বোধহয়, আমজাদের মাঝে পুরোনো আমজাদকে খুঁজে না পাওয়াটাই এই একা অনুভব হওয়ার কারণ। মানুষ সচারাচর যাকে যেভাবে দেখে অভ্যস্ত, তাকে সেভাবেই দেখতে চায়। মানুষেরও যে বদল আসতে পারে, তা যেন আমরা ভাবতে পারি না বা কোথাও একটা মানতে পারি না। 


হীম শীতল কেবিনের সাদা রঙের আরামকেদারাটাই বসে বসে ঝিমুচ্ছে অবনী। রাত সাড়ে তিনটা বাজছে অথচ তার ঘুম আসছে না। চেরির শরীরের বেশ উন্নতি দেখা দিচ্ছে, এতদূর আসাটা সার্থক। কিন্তু তবুও মনে কোথাও শান্তি নেই। 


অবনী বেগম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কতক্ষণ এপাশ-ওপাশ হাতড়ে নিজের ফোনটা হাতে নিলো। কল লাগালো আমজাদ সওদাগরের ফোনে। আমজাদ সওদাগর প্রতিদিনই এসে মেয়েকে দেখে যান অথচ থাকেন না, এমনকি অবনী বেগমকেও যেতে বলে না আমজাদ সওদাগরের বাসায়। বিষয়টা ভীষণ অদ্ভুত হলেও অবনী এতদিন মাথা ঘামায় নি, অথচ আজ মাঝরাতে তার এ কথা খানা মাথায এলো। গত পাঁচদিন যাবত অবনী হসপিটালেই আছেন। আমজাদ তাকে বাড়িতে গিয়ে বিশ্রামও নিতে বলে নি। 


প্রথম বার কলটা বাজতে বাজতেই কেটে গেলো। অবনী মুখ-চোখ কুঁচকালো। তার হঠাৎ করেই সর্বাঙ্গে অস্বস্তি ছেয়ে গেলো। তার মনে হলো তার অজান্তেই হয়তো ভীষণ অদ্ভুত কিছু হচ্ছে এই ভিনদেশে, যা খুব সস্তা আবরণে ঢেকে আছে। অবনী বেগম ঘুমন্ত চেরির দিকে তাকিয়ে একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়লেন। এই মাঝরাতেই সে সিদ্ধান্ত নিলেন আমজাদ সওদাগরের বাসায় যাওয়ার। যতটুকু জানে সে, হসপিটাল থেকে বাসার দুরত্ব মাত্র আধাঘন্টা। বাড়ির ঠিকানাটাও তার জানা আছে। এই মাঝ রাত্রিরে যেকোনো মূল্যেই তার সংশয় অস্বস্তির পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে। তার মন যে মিছে ভয়ের আতঙ্কে তোলপাড় হচ্ছে, তা এই মুহূর্তেই মিটাতে হবে। 


হসপিটালের নার্সকে চেরির কাছে রেখেই এই ভিনদেশের অপরিচিত রাস্তায় পা চালালো বাঙালি এই নারী। বাঙালি স্ত্রীদের আলাদা একটা শক্তি আছে। তারা সন্তান আর স্বামীর ক্ষেত্রে অদ্ভুত শক্তি,সাহস পেয়ে যায়। 


(৩৪)


সোফায় বসে থাকা বেশ সুন্দর দেখতে ছেলেটাই চিত্রাকে দেখতে এসেছে। নুরুল সওদাগরের ডিপার্টমেন্টেরই একজনের ছেলে সে। নাম নওশাদ। ছেলেটাকে নির্দ্বিধায় সুপুরুষ বলা যাবে। ফর্সা শরীর, উচ্চতাও যথেষ্ট, সুস্বাস্থ্য। কি ভীষণ সুন্দর! কালো রঙের পাঞ্জাবি টা বেশ মানিয়েছে শরীরে। 


ছেলেটার মা-বাবাও ছেলেটার সাথে এসেছে। বেশ সুশীল পরিবারই মনে হলো। বেশ হেসে হেসে কথা বললো। এক দেখায় তাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে সেটাও বলেছে। চিত্রা মাথায় ঘোমটা দিয়ে কেবল ঠাঁই বসে রইলো। ড্রয়িং রুম জুড়ে সবাই যার যার মতন দাঁড়িয়ে আছে, বসে আছে। চাঁদনীর হাসবেন্ড মাহাতাবও আছে। শুক্রবার যেহেতু, তার অফিসও বন্ধ। 


ছেলের বাড়ির থেকে প্রস্তাব দিলো তারা আজই আংটি পড়িয়ে যেতে চায়। নুরুল সওদাগরের মুখের হাসিটা বিস্তৃতি লাভ করলো, অথচ সবাই তখনো হতভম্ব, আহম্মক বনে আছে। তারা যেন কিছুই বুঝতে পারলো না। বাবা-মেয়ের এমন পরিবর্তন যেন সবাইকেই ভাবাচ্ছে। কি এমন হয়ে গেলো, যে এত বড় সিদ্ধান্ত নিতেও তারা দু'বার ভাবছে না! 


বাড়ির সবচেয়ে বড় সদস্য আফজাল সওদাগর সেখানে উপস্থিত নেই। সকালে নুরুল সওদাগর যখন চিত্রাকে দেখতে আসার প্রস্তাবটা জানিয়েছে, তখনই দুই ভাইয়ের এক রকমের কথা কাটাকাটি হয়েছে। এ প্রথম আফজাল সওদাগরের কথাকে গুরুত্ব দিলো না তার ছোটো ভাই। সেই কষ্টে দোর দিলেন সে। যা ইচ্ছে করুক গিয়ে সবাই। তুহিনও বেশ চিৎকার চেঁচামেচি করেছে কিন্তু শেষ মুহূর্তে চিত্রা থামিয়ে দিয়েছে তার ভাইকে। বাবা নাকি তার ভালোর জন্য ই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তুহিনও রাগে, ক্ষোভে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। 


পাত্রের মা হাত জোর করে বেশ বিনীত স্বরে বললেন,

"ভাই সাহেব, আপনাদের মেয়েকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। মায়া মায়া মুখ। আপানারা দেখুন, আমরা চাচ্ছি আজই একটা পাকা ব্যবস্থা করে যেতে।"


নুরুল সওদাগর তো আনন্দে আত্মহারা। সবাই বেশ ভয়ে আছে এই ভেবে যে নুরুল সওদাগর না আবার হ্যাঁ করে দেয়। ভাবসাবও ঠিক তেমন মনে হচ্ছে। 


কথা ঘুরালো মাহাতাব। বেশ বুদ্ধির সাথে হাসি মুখে উত্তর দিলো,

"আন্টি, বিয়েটা তো আর এক কথায় হয় না। আপনারা খাবার খান, আমাদেরও তো পারিবারিক আলোচনা আছে। আমরা তা সেড়ে নেই, তাছাড়া তো মেয়েরও তো একটা মতামত আছে তাই না?"


ভদ্রমহিলাও সম্মতির সুরে বললেন,

"হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। আপানারা আলোচনা করুন। আমদের সমস্যা নেই।"


 

মহিলার কথায় সবাই স্বস্তির শ্বাস ফেললো। নুরুল সওদাগর যেন ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছেন। যে কোনো মূল্যে তাকে থামাতে হবে। 


সবাই যখন নিজ নিজ বাক বিতণ্ডায় ব্যস্ত, চিত্রা তখন পথ ধরলো ছাঁদের দিকে। বাহার ভাইয়ের উপর অভিমান আর বাবার ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্খায় সে অনলে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে, তবুও কী বাহার ভাই তাকে আটকাবে না? বলবে না থেকে যেতে? বাহার ভাই বললে চিত্রা হাসতে হাসতে সব ভুলে যাবে, এমনকি বাবার ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্খাও। 


(৩৫)


সচারাচর আশ্বিন মাসে ঝড়ের আভাস পাওয়া যায় না। পেঁজা তুলোর দলেরা ছুটে যায় আকাশ ঘেষে। কেমন হাওয়ায় মিঠাইয়ের মতন দেখতে লাগে! আদুরে, তুলতুলে। অথচ আজ আকাশে হাওয়ায় মিঠাইয়ের মতন তুলা নেই। আকাশে আজ ধ্বংসাত্মক রূপ। চিত্রার হৃদয়ের ভয়ানক বিধ্বস্ততা বোধহয় ছেয়ে গেছে আকাশেও। 


নিচে পারিবারিক বাকবিতন্ডা চলছে। চিত্রা বেশ কায়দা করেই ছাঁদে চলে এলো। বাহার ভাইকে এক নজর দেখার অসুখে ধরেছে তাকে। যেকোনো মূল্যেই হোক এই অসুখ তাড়াতাড়ি সাড়াতে হবে। 


নীল শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছে। ছাঁদে উঠতেই এক অন্যরকম দৃশ্য চোখে পড়লো চিত্রার। বাহার ভাই ছাঁদের কবুতর দুটোকে খাবার খাওয়াচ্ছেন। কবুতর দুটো ও চিত্রার। কবুতর দুটোকে ঠিক পালে না সে। সবসময় ছেড়ে রাখে। যখন ইচ্ছে হয় তারা ফিরে আসে, খাবার খায়, চিত্রার সামনে উড়ে বেড়ায় আবার নিজেদের মনমতন চলে যায়। বাহার ভাই কখনো এদের এতো আদর যত্ন করে নি, আর আজ কিনা খাবার খাওয়াচ্ছে! 


চিত্রা ধীর পায়ে বাহারের সাথে এসে দাঁড়ালো। খুব মনযোগ দিয়ে দেখলো লোকটাকে। নিচে তাকে দেখতে আসা নওশাদ নামের ছেলেটা বাহার ভাই থেকেও বেশি সুন্দর। উচ্চতায় একটু কম তবে বেশ সুন্দর, ভদ্র, সুশীল, সরকারি চাকরি করে। অন্যদিকে বাহার ভাই প্রচুর অ*ভদ্র, অসামাজিক, বেকার। বাহার ভাইয়ের এত এত নেগেটিভিটি তবুও যেন বাহার ভাইয়ের তুলনা কারো সাথে হবে না। তবুও বাহার ভাই অনবদ্য। 


"আরে চিত্রা যে, তা এই অসময়ে ছাঁদে?"


বাহারের কথায় ধ্যান ভাঙলো চিত্রার। মানুষটা কত স্বাভাবিক ভাবে কথাটা জিজ্ঞেস করলো! অথচ মানুষটার সাথে তার নিরব একটা মান-অভিমান চলছে। যেই মান-অভিমানের জন্য আজ চিত্রা এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ যেন কিছুই হয় নি এমন একটা ভাব লোকটার কথায়। 


"কথা টথা না বলার ব্রত করলে নাকি? বেশ ভালো তো। কথা না বললে মানুষ তোমাকে সিরিয়াসলি নিবে। একটা পাত্তা পাবে বুঝলে! তোমার বাপ তো এমনেই দাম দেয় না, এখন যদি কথা না বলার কারণে একটু পাত্তা পাও তাহলে খারাপ হবে না।"


বাহারের ঠাট্টা মারা কথায় ক্ষাণিক রেগে গেলো চিত্রা। রাগী কণ্ঠে বললো, 

"আমার বাবাকে নিয়ে একদম এসব বলবেন না।"


"আচ্ছা বলবো না।"


বাহার খুব সহজ ভাবে যেন মেনে গেলো চিত্রার কথাটা। চিত্রার রাগ আবার হারিয়ে গেলো। মানুষটা এমন কেন? এমন না হলে কী খুব বড় ক্ষতি হয়ে যেতো! 


মান-অভিমান কিনারে রেখে চিত্রা ধীর কণ্ঠে বললো, 

"বাহার ভাই, আমি নীল শাড়ি পড়েছি। কিছু বললেন না তো।"


বাহার কবুতরকে খাবার খাওয়াতে খাওয়াতে একবার হালকা করে তাকালো চিত্রার দিকে। তারপর আবার নিজের কাজ করতে করতে বললো,

"বেশ ভালো তো। তা তোমার শরীরে নীল শাড়িটা তেমন মানাচ্ছে না। তুমি বরং সাদা শাড়ি পড়তে। মেঘের মতন লাগবে।"


বাহারের কথায় চিত্রার অভিমানেরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। চোখ-মুখ টলমল করে উঠলো। বাহার ভাই এভাবে বলতে পারলো! অথচ অষ্টাদশী বুঝে নি, বাহার ভাই তার গোপন একটা ইচ্ছের কথা কেমন করে জানিয়ে দিলো। বুঝলে অভিমানের জায়গায় ভালো লাগার সৃষ্টি হতো যে! 


বাহার আর চিত্রাকে সিক্ত করতে আকাশ চিরে বেরিয়ে এলো বৃষ্টির ফোঁটারা। হুট করেই তার আগমনে তাজ্জব মানব-মানবী। ভিজে একাকার দু'জনে। 


তন্মধ্যেই চিত্রা বলে উঠলো,

"বাহার ভাই, আজ আমাকে দেখতে আসছে, ওরা আজই আংটি পড়িয়ে যেতে চায়।"


"ওহ্ তাই নাকি! বাহ্ দারুণ খবর দিলে তো। মিষ্টি খাওয়াবে না?"


চিত্রা অবাক হলো বাহারের উত্তরে। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো, 

"আপনি জানতেন না এটা?"


"না তো। তোমাদের পারিবারিক ব্যাপার আমি আর কেমন করে জানবো!"


উত্তর টা বেশ স্বাভাবিক ভাবে দিলেও চিত্রার মন মানতে চাইলো না। সে দিবানিশি যে ছেলেটার জন্য পুড়ে, সে ছেলেটা নাকি তার এত বড় খবরটাই জানতো না! এ কেমন মানুষ! 


চিত্রার অশ্রু রা ততক্ষণে বৃষ্টির পানিতে মিলেমিশে একাকার। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সে বললো,

"আপনি কি কিছু বলবেন না, বাহার ভাই!"


"হ্যাঁ বলবো তো। নতুন জীবনের জন্য তোমাকে শুভেচ্ছা। তুমি তো বাবার ভালোবাসার কাঙালি, তোমার যেন সেই ভালোবাসা মিলে। নিজের বাবার কাছ থেকে না হোক, জীবন সঙ্গীর বাবার থেকেই নাহয় পেলে।"


বাহার ভাইয়ের উত্তরে চিত্রা ব্যাথিত নয়নে চাইলো। মানুষটার কি ব্যাথা হচ্ছে না বুকে! তবে তার কেনো র*ক্তক্ষরণ হচ্ছে! ভালোবাসা এত যন্ত্রণা কেনো! বাহার ভাইরা এত অবুঝ কেনো!


"যাও চিত্রা, নিচে যাও। তোমার সুপুরুষ হবু বর হয়তো অপেক্ষা করছে। সুন্দর মানুষের আশেপাশে থাকলে তোমারই লাভ। সুন্দর মানুষ দেখলে চোখে একটু প্রশান্তি মিলে বুঝলে। আমরা তো শা*লা পুড়ে ছাই।"


"অথচ এই ছাইকেই আমার চাই।"


চিত্রার এত আবেগীয় কথাটাকেও বাহার বরাবরের মতন হেসে উড়িয়ে দিলো। গা ছাড়া ভাবে বললো,

"শুনো মেয়ে, বয়ঃসন্ধির আবেগ কেটে গেলে, বাহারও কেটে যাবে। এ বয়সে ঠোঁট পুড়ে যাওয়া, উন্মাদ, বখাটেদেরই বেশি ভালো লাগে। কিন্তু যখন বাস্তবতা বুঝবে তখন এই ভালো লাগা বড়জোড় তোমার হাসির কারণ ছাড়া কিছুই না। যাও নিচে তোমার অপেক্ষা করছে সবাই।"


চিত্রার কান্নার স্রোত বাড়লো। দু'কদম বাহারের দিকে এগিয়ে গিয়ে কেবল উচ্চারণ করলো, "বাহার ভাই…"


বাহার থামিয়ে দিলো চিত্রাকে। গম্ভীর স্বরে বললো, 

"যাও রঙ্গনা, বখাটে বাহার তোমার না। জীবনে বাঁচতে হলে সুশীল সঙ্গী দরকার। বাহাররা কেবল মনের ফ্যান্টাসি।"


চিত্রার কত কথা বলতে গিয়ে বলা হলো না। আবার কত অনুভূতি না চাইতেও বলে দিলো। বাহার ভাই তবুও নির্বাক! তবে তাই হোক, বাহার ভাইয়ের নাহয় না-ই হলো চিত্রা। 


ভিজে শাড়ি, ভগ্ন হৃদয় নিয়ে চিত্রা যখন পা বাড়ালো সিঁড়ির দিকে, বাহার দু'হাত মেলে আকাশ পানে তাকিয়ে বললো,

"শুনছো গো মেঘ, বাহার আর গিটার ছুঁয়ে দেখবে না। অষ্টাদশীর হৃদয়ে বাহার আর এক্কা-দোক্কা খেলবে না। বাহার যে খুব নির্মম ভাবে সেই দু'টো জিনিসই ভেঙে দিয়েছে। বাহারের আর কেউ নেই মেঘ, না গিটার আর না অষ্টাদশী।"


চোখ বন্ধ করে আপনমনে গেয়ে উঠলো রঙ্গনার বাহার ভাই,

"ভালোবাসা হয় যদি পাঠশালা, 

প্রেমের আরেক নাম, কাঁটার জ্বালা

কাঁটার জ্বালা।"


#চলবে


[২৪০০+ শব্দ]

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ১২

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


পর্বঃ বারো


(২৭)


সময় খুব দ্রুত অতিবাহিত হয়। কত কাজ করবো করবো করেও সময়ের এই দ্রুততায় আর করা হয় না। কেবল সময়ের স্রোত নিয়তিকে ভাসিয়ে যেথায় নিয়ে যায় আমরা নির্লিপ্ত ভাবে সেখানেই যাই। 


গত কাল রাত পুরোটা বাহারের কেটেছে জেলে। তার এত এত বন্ধু হুট করেই যেন মরিচীকার মতন উধাও হয়ে গেলো। যাদের জন্য বাহার জান দিতে প্রস্তুত আজ তারাই নিরুদ্দেশ। বিপদে পড়লেই তো মানুষ চেনা যায়। 


অবশেষে আজ দুপুর দু'টোয় বাহারকে জেল থেকে ছাড়ানো গেলো। এর জন্য আফজাল সওদাগর আর তুহিন কম কাঠখড় পোড়ায় নি। কত ছুটোছুটির পর অবশেষে তারা কাজে সফল। বাহারকে জেল থেকে বের করেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তুহিন। রাজনীতির ঝামেলায় ফেঁসে যাওয়া খুব বিরাট রকমের ঝামেলা। জীবন, ক্যারিয়ার সব ফেঁসে যাবে। 


জেল থেকে ছাড়া পেয়েই সবাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। ধকল তো আর কম গেলো না। শরীর যে ভীষণ ক্লান্ত। বিগত কত গুলো দিন ধরে সওদাগর বাড়িতে ঝড় চলছে। এ ঝড়ের শেষ কোথায়, কতটা নিঃশেষ করার পর, তা জানা নেই কারো। 


(২৮)


সূর্যাস্তের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ইতালির ভ্যাটিকান সিটিতে পা রাখে অবনী সাথে তার অসুস্থ মেয়ে চেরি। আশেপাশের প্রকৃতি, মানুষজনের দিকে চোখ বুলিয়ে নেয় সে। কি সুন্দর! অথচ এ সুন্দর তো সে চায় নি। পরিচিত দেশ ছেড়ে এই ভিনদেশে তো সে কখনো পাড়ি দিতে চায় নি। তবে আজ নিয়তির খেলায় ভাসতে ভসতে সে এতদূর এসেছে! বুক চিরে বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘশ্বাস। ব্যাগ থেকে অবনী ফোনটা বের করলো, পঞ্চম বারের মতন রিং লাগালো তার স্বামী আমজাদ সওদাগরের ফোনে। মানুষটা কেমন দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে এমন সময়ে ফোন রিসিভ করছে না! অথচ এয়ারপোর্টে থেকে তাদের একসাথেই হসপিটালের উদ্দেশ্যে যাওয়ার কথা। 


অবশেষে পঞ্চম বারের মতন ফোনটা রিসিভ না হয়েই কেটে যেতেই হতাশার শ্বাস ফেললো অবনী। মন খারাপের বিজ্ঞাপনে ভরে গেলো তার হৃদ মাঝার। এই অচেনা শহরে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তার নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে। চেরির ঘুমন্ত, নিথর দেহটার দিকে তাকাতেই অসহায়ত্ব যেন পাহাড় ছুয়ে দিলো। জীবনে অনেক কাজ সে করেছে, অনেক অন্যায় করেছে, অল্প বয়সের আবেগে ভেসে গিয়ে পুরো জীবনটা অবহেলার সমুদ্রে ঢেলে দিয়েছে কিন্তু আজকাল তো বয়স হয়েছে, বুঝও হয়েছে, মোটামুটি ভালো-মন্দ সে বুঝতে পারে। তাই তো এখন সন্তান গুলোকে আঁকড়ে ধরার প্রচেষ্টা। কিন্তু সেই সন্তানদের উপরেই আজ বিপদ। এই অচেনা প্লাটফর্মে পরিচিত মুখটা দেখতে পাওয়ার আকাঙ্খা নিয়ে সে গাড়িতে উঠে বসলো। এই গাড়ি এখানের অবস্থানরত হসপিটাল থেকে আনা হয়েছে। যেখানে চেরিকে ভর্তি করানো হবে। অবনী বেগমের হৃদয় তোলপাড় করে কান্না এলো। এত বছরের পাওয়া না পাওয়ার গল্পে ভারী হলো কান্নার সুর। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই বারো মাসের জীবনে তার দশ মাসই কেটেছে শূণ্যতার হাহাকারে। এসব বিষাদের গল্পে তার কান্নার গতিবেগ বাড়ালো বৈ কমালো না। আমজাদ সওদাগর আসেন নি, এই কথা টা তাকে যত বেশি না কষ্ট দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে তাকে তার ভাবনা যে- আমজাদ সওদাগর হুট করে দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে গেছে। 


মানুষ বরাবরই কোমল প্রাণী। তারা চায় তাদের মন খারাপ, একাকীত্ব কেউ বুঝুক। কিন্তু যখন তাদের এই চাওয়া টা পূরণ হবে না বুঝতে পারে তখন তাদের মনের ঘরে নামে ভীষণ শোক। অবনী বেগমও সেই মানুষের বাহিরের না। চৈত্রের অপ্রাপ্তি, বৈশাখের শূণ্যতা সব মনে করে বাড়াচ্ছে তার মন খারাপের খাতা। সন্তান প্রেমি,সহজ-সরল আমজাদ সওদাগরও বদলে যেতে পারেন তা অবনীর মানতে কষ্ট হচ্ছে। 


(২৯)


মাথার উপর নিকোষ কালো আকাশ, হৃদয়ে ব্যাথার আন্দোলন, কণ্ঠে উন্মাদনা মাখানো গান, 

"তীর ভাঙা ঢেউ আমি নীড় ভাঙা ঝড়,

উজান ভাটির দুনিয়াতে সবই হলো পর।"


কি হাহাকার সে গানে! কে জানে, কত গল্প মানুষের হৃদয়ে দাফন দেওয়া থাকে, ক'জনই বা সেসবের খবর রাখে? 


হাতের গিটারে অনবরত সুর তুলে যাচ্ছে, কখনো গেয়েছে বাহার বখাটে হওয়ার গল্প, কখনো সে সুর তুলেছে বিরহের। পর পর কত গুলো গানের পর থেমে গেলো তার হাত। বিরক্তির ঢেঁকুর তুলে অসহ্য অনুভূতিদেন ঝেরে ফেলতে চাইলো। চোখ টকটকে লাল তার, মুখে অবহেলার চাপদাড়ি। হাতের গিটারটা ছাঁদের বেশ প্রশস্ত রেলিঙটার উপর রাখলো, পকেট থেকে তার অতি প্রিয় সাথী নিকোটিনকে বের করেই দুই ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরলো। দিয়াশলাই জ্বালানোর মুহূর্তেই কেউ এসে ছোঁ মেরে টেনে নিলো ঠোঁটের ভাঁজে থাকা সিগারেট টা। বাহার অবাক এবং বিরক্ত হলো। প্রয়োজনের সময় এমন অপ্রয়োজনীয় কাজ তার বরাবরই বিরক্ত করে। সিগারেট হলো তার একান্তই ব্যাক্তিগত সম্পদ যার উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারো নেই। 


বাহার কপাল কুঁচকে সিগারেট ছোঁ মারা ব্যাক্তিটার দিকে তাকাতেই বিরক্তিতে চ উচ্চারণ করলো। অধৈর্য্য কণ্ঠে বললো, 

"এসব কেমন আচরণ তোমার?"


চিত্রা ততক্ষণে সিগারেটটা হাতে মুঠোয় ভরে নেয়। দুষ্টু হেসে বলে,

"এমন আচরণই করা উচিৎ আপনার সাথে। বখাটে পনা ছাড়েন তো এবার। আর কত বখাটে হবেন, এখন তো অন্তত থামুন।"


"কেনো? জেল খেটেছি বলে বখাটেপনা ছাড়তে বলছো? অথচ সভ্য সমাজে বখাটে না হলে পায়ে পিষে যাবে তোমাদের মতন বড়লোকেরা।"


বাহারের তীক্ষ্ণ কথার ধারে হতভম্ব হয়ে গেলো চিত্রা। জেল থেকে এ যেন অন্য এক বাহারের আগমন। বাহার ভাই তো এমন ছিলো না। চিত্রা নিজেকে সামলে নিয়ে বোকা বোকা হেসে বললো, 

"আরে না বাহার ভাই, আপনি ভুল বুজছেন। আমি তো কেবল এমনই বলেছি। সিগারেট তো ক্ষতিকারক তাই।"


"মানুষের চেয়ে কমই ক্ষতিকারক। মানুষের সঙ্গই ছাড়তে পারলাম না আর এ তো আমার একাকীত্বের পরম বন্ধু, এরে ছাড়ি কীভাবে!"


চিত্রা গোঁ ধরলো। আজ সে পণ করেছে বাহারকে আর সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে দিবে না। এখন তার যা করা লাগে সে করবে। 


বাহারের বিরক্তির ভার তড়তড় করে বাড়লো। চিত্রাকে ভয়ঙ্কর রকমের ধমক দিতে গিয়েও আবার দিলো না। পকেট থেকে সে বিনাবাক্য ব্যয়ে আরও একটা সিগারেট বের করলো। যথারীতি সেই সিগারেট টাও চিত্রা ধপ করে টেনে নিয়ে গেলো। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলো বাহারের। তার সবচেয়ে প্রিয় গিটার খানা সেই রাগ বশত ছুঁড়ে মারলো ছাঁদের মেঝেতে। ঝনঝনানি শব্দে ভেঙে চুড়ে একাকার হয়ে গেলো গিটারটা। চিত্রা কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়েই রইলো। জীবনে এমন অবাক সে যেন কখনো হয় নি। বাহার কেবল গিটার না, ভেঙে দিলো যেন স্বয়ং চিত্রাকে। কি নিষ্ঠুর! কি নির্মম! মনে হচ্ছে চিত্রার চিত্তের একেকটা ভাঙা টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছাঁদ জুড়ে। 


চিত্রা অবাক ভরা চোখ মুখ নিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো, 

"বা, বাহার ভাই?"


বাহার যেন এই ডাকটার অপেক্ষায়ই ছিলো। ডাকটার সাথে সাথে সে খেঁকিয়ে উঠলো, ভয়ঙ্কর রকমের ধমকে বললো, 

"একদম আমায় আটকাতে আসবে না, মেয়ে, জ্বালিয়ে দিবো। সাবধান করে ছিলাম না তোমায়? করে ছিলাম কিনা বলো? তবুও আমার ব্যাপারে নাক গলানোর সাহস কীভাবে হলো তোমার? দু একদিন হেসে কথা বলেছি বলে কী মাথা কিনে নিয়েছো? ভদ্রতা দেখিয়েছি, সেটা সহ্য হয় না তাই না? শা*লা শান্তি দিলো না এই মানুষ জাতি।"


কথা শেষ হতেই বাহার নিজের চিলেকোঠার ঘর খানাতে চলে গিয়ে সশব্দে দরজাটা আটকিয়ে ফেললো। চিত্রা কেবল দেখলো সবটা। সে হয়তো সত্যিই অতি অধিকার ফলিয়ে ফেলেছে তাই বলে এমন আচরণ করবে বাহার? অষ্টাদশীর হৃদয় তোলপাড় করে অভিমান জমলো, চোখে টলমল করলো অভিমানের অশ্রু। ভাঙা, বিধ্বস্ত গিটার খানা দেখার পর বাঁধ মানলো না সে অশ্রুর কণা গুলো। অঝোর ধারায় ঝরে গেলো কেবল। বাহার ভাই তার উপর চিৎকার করেছে এটা না যতটা কষ্ট দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে বাহার ভাই নিজেকে কষ্ট দিয়েছে সেটা ভেবে। গিটার টা তো বাহার ভাইয়ের প্রাণ ছিলো, সিগারেট আর গিটার সে কখনো হাত ছাড়া করে নি, যেন সাক্ষাৎ প্রাণ ভোমরা এখানে, অথচ সে গিটারের আজ বিধ্বস্ত অবস্থা! তাও কিনা বাহার ভাই নিজে করেছে! অষ্টাদশীর কান্নায় ভিজে গেলো নেত্র যুগল। চিবুক বেয়ে গড়িয়ে গেলো সেই অশ্রু। বুক সমান কষ্ট নিয়ে অষ্টাদশী অভিমান করলো, বাহার ভাইয়ের দিকে সে আর ফিরে চাইবে না। পাষণ্ড পুরুষ বাহার ভাই, সর্বনাশা পুরুষ সে।


(৩০)


হসপিটালের করিডোরে নতুন একটা দিনের আগমন। সূর্যের আলো হসপিটালের বাগানের বিভিন্ন রকমের রঙিন ফুলের উপর ঝিলিক দিয়ে উঠছে। নতুন সকাল, নতুন আরেকটা দিন। অবনী বেগমের ক্লান্ত শরীরটাকে অবসাদের জন্য বসিয়েছে কাঠের সুন্দর বেঞ্চ খানায়। চোখ দুটো বন্ধ করে ক্ষাণিক ঝিমিয়ে নিলো সে। সূর্যের তেজ বাড়লো, শরীরের অবসাদ টা কিঞ্চিৎ কাটলো। সাথে সতেজ হলো মস্তিষ্ক। হঠাৎ পাশে কারো কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ পেতেই চোখ খুলে তাকালো সে। কাঙ্খিত মানুষটাকে এ সময়ে দেখে ভড়কেও গেলো কিছুটা। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো, 

"আমাজাদ!"


কোট,টাই পড়া ভদ্র লোক অবনীর পাশে এসে বসলো। নরম কণ্ঠে বললো, 

"কেমন আছো, অবনী?"


অবনীর অভিমান হলো। এই কি প্রথম অবনী স্বামীর প্রতি অভিমানে মুখ ফুলালো? হ্যাঁ, এত বছরের বৈবাহিক জীবনে এই প্রথমই এটা হলো। চল্লিশ উর্ধ্বো অবনী অষ্টাদশী হয়ে উঠলে নিমিষেই, মুখ ফুলিয়ে বললো, 

"এতক্ষণে সময় হলো তোমার? গোটা একটা বিকেল আর রাত পার করার পর তোমার আসতে মন চাইলো?"


আমজাদ মাথা ঝুঁকালেন, বেশ অপরাধী কণ্ঠে বললেন,

"একটা ঝামেলায় পড়ে গেছিলাম অবনী। নাহয় তোমায় অপেক্ষা করাতাম না। আমার চেরি কেমন আছে?"


চেরির কথা উঠতেই অবনীর কান্না এলো। লেপ্টে গেলো আমজাদের বুকের মাঝে। হাহাকার মাখানো কণ্ঠে বললো, 

"আমাদের চেরি ভালো নেই, আমজাদ। ভালো নেই।"


আমজাদ হয়তো হুট করে অবনীর এত ঘনিষ্ঠতা আশা করে নি। সামান্য বিব্রতবোধ করলেন সে। অস্বস্তি মাখানো কণ্ঠে স্বান্তনা দিয়ে বললেন,

"চিন্তা করো না, অবনী। ঠিক হয়ে যাবে সে। দেখি উঠো তো, মানুষ দেখছে।"


আমজাদের শেষের বাক্যে অবনীর বাঁধ ভাঙা কান্না থেমে গেলো। আকষ্মিক ভুল কিছু শুনে ফেলেছে এমন একটি ভাব ফুটে উঠলো তার মুখ-মন্ডলে। আমজাদ কিনা বলছে মানুষ দেখছে? আমজাদ! অথচ যখন তাদের নতুন বিয়ে হলো তখন আমজাদ সারাদিন অবনীর পিছে পিছে থাকতো। ভাবীরা ঠাট্টা করে বউ পাগলও বলতো ছেলেটাকে। অবনী মাঝে মধ্যে কেমন ব্যবহার করতো কিন্তু লোকটা হাসি মুখে সব মেনে নিতো। কেমন বোকা বোকা ধাঁচের ছিলো। একদিন অবনীর শাশুড়ি অবনীকে কি একটা যেন রান্না করতে দিয়েছিলো, অবনীর ঠিক মনে নেই, আমজাদ সবার থেকে লুকিয়ে অবনীর রান্না নিজে করে দিয়েছিলো। কই গেলো সেই দিন, কই গেলো সেই বউ পাগল আমজাদ? আজ যেন ভিন্ন পুরুষ সে। গত কয়েকবছর আমজাদ দেশে যায় নি, হয়তো তাই এ বদলটা চোখে লাগে নি। হুট করে একজন মানুষের এত বদল কীভাবে হলো! 


প্রশ্নরা হাতছানি দিলো অবনীর হৃদয় জুড়ে। অবনী ক্রন্দনরত ভাঙা কণ্ঠ নিয়ে বললো,

"তুমি বদলে গেছো, আমজাদ। বদলে গেছো।"


(৩১)


ঘর বন্ধি, বিবশ,বিষণ্ণতায় গোটা একটা দিন গেলো। চিত্রা চুপ চাপ থম মারা। কারো সাথে কোনো কথা বলে নি গতকাল রাতের পর থেকে। গতকাল সারা রাত সে কেঁদেছে, কেঁদে কেটে চোখ-মুখ ফুলিয়েছে। গত এক বছর বাহার ভাইকে তার অসহ্য অসহ্য লাগে বলে সবার গোপনে হৃদয় মাঝে পুষে রেখেছিলো। সে আজ বুজছে, এই বাহার ভাইকে ছাড়া তার গোটা দুনিয়া অসহ্য কিন্তু বাহার ভাই অসহ্য না। 


সময়টা ঠিক সন্ধ্যার পরের ভাগ। এসময়ে বাড়িতে হৈচৈ থাকে কম। যে যার মতন ব্যস্ত থাকে। তুহিন ভাইজান বোধহয় বাহিরে এখনো। দিশান আর তৃষান ভাই রাও বোধহয় পড়ছে। অহি আপারও পড়ার সময়। বড়রা হয়তো ঝিমুচ্ছে কিংবা কথা বলছে। পুরো বাড়ি একদম নিবিড়। একদম শীতল। চিত্রা দরজা খুলেছে সারাদিন পর এখন। বাড়ির মানুষ তাকে তেমন একটা ডাকেও নি আজ। ভেবেছে শরীর তো এমনেতে অসুস্থ, ঘুমাক নাহয়। কেউ কি আর মনের খোঁজ রাখে! 


আঁধার ঘরে অন্য কারো উপস্থিতি অনুভব করতেই চমকে উঠে চিত্রা। এসময় কে আসতে  পারে তার ঘরে ভাবতেই বারান্দার দরজায় উঁচা লম্বা পুরুষালীর অবয়ব ভেসে উঠলো। চিত্রা অবাক কণ্ঠে বললো, 

"আ,আব্বু!"


নুরুল সওদাগর এগিয়ে এলেন মেয়ের দিকে। রেলিং এ ঠেস দিয়ে দৃষ্টি রাখলেন রাস্তায়, মানুষজন দেখা যাচ্ছে বারান্দা থেকে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় কত সজীব দেখা যাচ্ছে রাস্তা টা! নুরুল সওদাগর ছোট্টো শ্বাস ফেললেন। রাস্তায় দৃষ্টি রেখেই বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

"রাস্তা থেকে তো রিক্সা, গাড়ির হর্ণের শব্দ আসে তাই না. তোমার রুমটা নাহয় বদলে ফেলো। অসুবিধা হয় না?"


চিত্রা অবাক হলো। বাবার সাথে এমন কথা বলার সম্পর্ক তার নেই। তাহলে আজ বাবা অন্য সুর গাইছে যে? নতুন কোনো বার্তার আগমন তাহলে ভেসে বেড়াচ্ছে পরিবেশে?


#চলবে

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ১১

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


পর্বঃ এগারো


(২৪)


বিধ্বস্ত এই বাহারকে দেখার পর সবার ভেতর উত্তেজনারা পাখা ঝাপ্টানো শুরু করেছে ক্রমাগত। আজ বছর এক তো হতে চললো মানুষটাকে সবাই দেখছে, অথচ এমন রূপ কখনোই দেখা হয় নি। এ জন্য হয়তো অবাক ভাবটা বেশি। 


বাহারকে দেখে সবার প্রথম মুনিয়া বেগমই দৌড়ে এলেন।  ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,

"বাবা,কী হয়েছে তোমার? এত ব্যাথা পেয়েছো কীভাবে? ইশ, আসো, সোফায় এসে বসো।"


বাহার দ্বিমত পোষণ করলো না বরং বেশ বাধ্য ছেলের মতন সোফায় গিয়ে বসলো। সে সোফায় বসতেই সম্বিৎ ফিরে পেলো সবাই, অতঃপর শুরু হলো হম্বিতম্বি। চিত্রা বাহারের বরাবর সোফাতেই বসে ছিলো। সে উঠে গেলো না, উৎকণ্ঠিত হলো না, কেবল নিশ্চুপ হয়ে দেখলো বাহারকে। এমন বাহারকে কখনো দেখে নি সে হয়তো আজ তাই মানতে পারছে না সে দশা। 


অহি ঠান্ডা শরবত এনে দিলো, চিত্রার ফুপি দুধের মাঝে হলুদ দিয়ে নিয়ে এলো, মুনিয়া বেগম তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে এলো। অথচ বাহার সটান সোজা হয়ে বসে রইলো। কোনো হেলদোল করলো না। ব্যাথার মুখ কুঁচকালো না। কিন্তু তার ক্ষত গুলো দেখলে যেকেউ বুঝবে ব্যাথার গভীরতাটা ঠিক কতটুকু। সবার এত অস্থিরতায় বাহার নিবিড় রইলো। নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো যেন সবটা। সাথে দু একবার পলক ঝাপ্টে দেখে নিলো চিত্রাকেও। 


সবার ব্যস্ততার মাঝে গম্ভীর নুরুল সওদাগরের কণ্ঠ ভেসে এলো, রাশভারী কণ্ঠে সে বললো,

"মারামারি করেছো? গুন্ডামী করার গুণটাও যে তোমার মাঝে আছে, জানা ছিলো না।"


এমন তীক্ষ্ণ কথার পরিবর্তে বাহার মলিন হাসলো। ক্ষীণ স্বরে বললো, 

"বখাটের খাতায় যার নাম জ্বলজ্বল করে, তার বখাটে গুণ থাকবে না সেটা ভাবলেন কীভাবে?"


নুরুল সওদাগর হয়তো আরও কিছু বলতেন কিন্তু তাকে চুপ করিয়ে দিলো চিত্রা। খুব ভদ্রতার সাথে সে বললো,

"আব্বু, থামুন। ক্ষত যার এমনেতেই আছে তার ক্ষত বাড়ানোর কী প্রয়োজন? অনেক তো ক্ষত করলেন। মাঝে মাঝে প্রলেপ লাগালেও পারেন।"


চিত্রা নামের মেয়েটির মুখে যে এমন কথা উচ্চারিত হবে তা সবারই ভাবনার বাহিরে ছিলো। যার জন্য উপস্থিত সবাই হতবিহ্বল। দৃষ্টি চিত্রাতে নিবদ্ধ। আজ যেন একের পর এক চমকে তাজ্জব সওদাগর বাড়ি। হুট করেই বাড়ির মানুষ গুলো যেন বড্ড অপরিচিত হয়ে উঠেছে। এতটা অপরিচিত তারা হয়তো কখনোই ছিলো না। উপস্থিত বিষ্মিত সব চেহারার মাঝে কেবল একজনের মুখে চাপা হাসির রেখা দেখা দিলো। যে মানুষ চিত্রাকে ঘাত-প্রতিঘাতের বাণী শুনিয়েছিলো। 


পর পর ছেলে ও মেয়ের এমন উত্তর দেওয়ার ভঙ্গিমায় নুরুল সওদাগরও যেন কথা বলতে ভুলে গেলেন। মেয়ের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলেন নিরুত্তর। আশপাশ হাতরে যখন ভাঁটা পড়লো শব্দ গুচ্ছের সমুদ্রে, তিনি নতজানু হয়ে প্রস্থান নিলেন। সে যেন দেখলেন, মিছে ক্ষমতার আস্ফালন এখন আর চলবে না। ভ্রমের কার্তুজ ভেঙে পড়ছে অনবরত। 


নুরুল সওদাগর চলে যেতেই সকলের ভেতর থাকা টান টান উত্তেজনারাও মিইয়ে এলো। বুক ভরে শ্বাস নিলো সবাই। তারা ভেবেছে এই হয়তো নুরুল সওদাগরের বাজখাঁই গলা ফেঁটে পরবে৷ এই হয়তো ছোট্টো চিত্রা পিষে যাবে নুরুল সওদাগরের কথার তীক্ষ্ণতায়। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। রুদ্ধশ্বাস সময়ের পরিসমাপ্তি হলো। সবাই আবার ধ্যান দিলো বাহারের দিকে। ছেলেটাকে কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে! মুনিয়া বেগমের ভীষণ মায়া হলো।  ছেলেটার চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে দিলো, ধীর কণ্ঠে শুধালো,

"বাবা, তোমায় যে বড় ক্লান্ত লাগছে! ঠিক কী হয়েছে, বাবা?"


বাহার সে প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বরং কেমন কণ্ঠে যেন বললো,

"আমায় আগে একটু ভাত দিবেন আন্টি? বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে।"


কণ্ঠটা কেমন অসহায় শুনালো। কেবল পেটের ক্ষুধা না, মনে হলো এ যেন কত বছরের না পাওয়ার হাহাকার। বাহারের কণ্ঠে আজ অসহায়ত্ব! খেতে চাওয়ার হাহাকার!


মুনিয়া বেগম সাথে সাথে ছুটে গেলেন রান্নাঘরে। প্লেট ভরে ভাত নিয়ে এলেন। তার জীবনে এমন নিঠুর আবদার যেন সে আর শুনে নি। 'একটু ভাত দিবেন' কথাটার মাঝে যেন কিছু একটা ছিলো যা নাড়িয়ে দিলো সকলের অন্তরের অন্তস্তল। 


ভাত আনতেই কোনো বাক্যব্যয় না করেই হাত ধুয়ে বাহার খাওয়া শুরু করলো। খুব মন দিয়ে সে খাবার খেলো। এতদিনের মাঝে কখনো বাহারকে এমন ভাবে খেতে দেখে নি কেউ। বরং হয়েছে উল্টোটা। কত সময় দেখা যেতো বাহারের পড়ার টেবিলে উন্মুক্ত রাখা খাবারের থাল যার এক বিন্দু খাবার নড়চড় হয় নি। কত কত সময় বাহার খাবারের প্লেট ফিরিয়ে দিতো। খাবারের প্রতি তার বড্ড অনীহা। অথচ সে বাহার আজ তৃপ্তি করে খাচ্ছে। 


মায়া হলো লতা বেগমেরও। কাঠখোট্টা মহিলাটাও আদুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

"বাবা, সারাদিন খাও নি তাই না?"


বাহার খেতে খেতেই খুব স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলো, 

"না আন্টি, আসলে পকেটে টাকা ছিলো না। মাস শেষ তো, টিউশনির টাকাও শেষ। বেকার মানুষের বেঁচে থাকাটাই তো যুদ্ধ আন্টি। সে যুদ্ধে আমাদের ভাত না খেয়ে কতগুলো দিন কাটানোর গল্প থাকে, ফুটপাতে রাত কাটানোর গল্প থাকে, প্রিয় মানুষ হারানোর গল্প থাকে, আপন মানুষদের আবদার পূরণ করতে না পারার গল্প থাকে, সাথে গল্প থাকে আমাদের বখাটে হওয়ার। দারিদ্রতা এমন একটা রোগ যা মানুষকে বেহায়া করে দেয়। আর বেকারত্ব এমন একটা অভিশাপ, যা মানুষকে লজ্জাহীন করে দেয়। অথচ প্রতিনিয়ত আমাদের বাঁচতে হয় লজ্জায়, লজ্জায় হীনমন্যতায়। সিগারেটের ধোঁয়া দেখে মানুষ ঠাট্টা করে বলে বেকারের বিলাসিতা, কেবল ঐ নিকোটিন জানে কত হাহাকার উড়িয়ে দেই আমারা সেই ধোঁয়ায়। মানুষ তো শা*লা বেঈমান, নিকোটিন অন্তত সেটা না।"


কথা শেষ, সাথে খাওয়া শেষ। সবাই কেবল নিরব শ্রোতা। বাহার ছেলেটা এত কথা বলতে জানে এটা কেউ জানতোই না। এক বাক্য থেকে দু বাক্যে কোনো কথা তার গিয়েছে কিনা সন্দেহ। আর আজ সে ছেলে কিনা বেকারত্বের হাহাকার পাঠ করলো! অথচ এতদিন সবাই ভাবতো বাহার মানেই ভবঘুরে, ডোন্ট কেয়ার ভাবের ব্যাক্তি। ব্যাথা, আঘাত যাকে ছুঁতে পারে না। 


খাবার শেষ হতেই অহি প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে রেখে এলো। বাহার হেলান দিয়ে বসলো সোফায়। মুনিয়া বেগমও বসলেন বাহারের সাথে। বাহারের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

"এবার বলো তো, ঠিক কী হয়েছে? তোমায় তো কখনো মারামারি করতে দেখি নি। তবে আজ!"


বাহার ছোট্টো শ্বাস ফেললো। ক্ষীণ স্বরে বললো, 

"আমাদের ভার্সিটির মাঝে অতিরিক্ত রাজনীতির চর্চা। বর্তমানে যেই ছাত্রলীগ নেতা আছেন, তিনি বেশ উশৃংখল। তারই উশৃংখল কাজে প্রতিবাদ করাতেই নেতার চামচারা ক্ষ্যাপে যায়। অতঃপর শুরু হয় ধস্তাধস্তি।"


সবাই আফসোসের দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বর্তমানে পড়াশোনার জায়গা গুলোও হয়তো ব্যবসায়ের জায়গা নাহয় রাজনীতি হয়ে গেছে। এর বিরুদ্ধে কথা বললেই তোমার ধ্বংস নিশ্চিত। তবে কী বাহার পা ফেললো সেই ধ্বংসের পথে? 


(২৫)


রাত সাড়ে আটটা। সওদাগর বাড়ির প্রায় সব সদস্য দাঁড়িয়ে আছে বিমানবন্দরে। আর কিছুক্ষণ পর তাদের বাড়ির ছোটো হাসির জাদুকরটা পথ ধরবে ঐ স্বচ্ছ আকাশ পানে। আবার সুস্থ হয়ে সে ফিরবে কিনা তা জানা নেই কারো। কেবল তারা বুকে এক রাশ আশা পুষে সৃষ্টিকর্তার নিকট করুন প্রার্থনা তুলে দিয়েছে। বাচ্চাটা ফিরে আসুক। বাচ্চা টা বাঁচুক, হাসুক। 


আরেক দফা কান্নার রোল পরলো বিমানবন্দরে। এম্বুলেন্স থেকে ছোটো চেরির দেহটা যখন নামানো হয, হাউমাউ করে উঠে সবাই। মেয়েটা কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দু নয়ন ভরে দেখলো সে বাড়ির সদস্যদের। কত কিছু যেন বলার ছিলো বাচ্চাটার, অথচ ভাগ্যের নির্মমতায় বলা হলো না কত কিছু। কেবল দেখে গেলো সবাইকে। বাচ্চাটার সুস্থ চোখটা দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। বাচ্চাটাও যেন বুঝলো তার অনিশ্চিত ভবিতব্যের কথা। বাচ্চার কান্না দেখে শক্ত, সামর্থ্য মানুষ গুলোও শক্ত রইলো না। কেমন পাংশুটে হয়ে এলো সকলের মুখশ্রী। সবচেয়ে বেশি চিৎকার শোনা গেলো চিত্রার। চেরিকে ছোটো বেলা থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করার কাজটা যেন অগোছালো চিত্রার উপরই ছিলো। আর ছোটো চেরির জানও যে এ চিত্রাতে নিবদ্ধ। চিত্রা আপা ছাড়া যেন তার গতি নেই। অথচ এই আপাকে ছেড়েই যেতে হবে দূরদেশ। 


চেরির ছোটো শরীর টাকে জড়িয়ে ধরলো চিত্রা। চেরি তখনো স্ট্রেচারে শোয়ানো। চিত্রা হাউমাউ করে কাঁদলো। চেরিকে জড়িয়ে ধরে অনবরত বলে গেলো,

"চেরি সোনা, তাড়াতাড়ি ফিরবে কেমন? আপা তোমার জন্য পথ চেয়ে থাকবে। ফিরবে না পাখি? আপা তোমায় অনেক চকলেট দেবো। ভাত খাইয়ে দিবো। তাড়াতাড়ি চলে এসো কেমন?"


আপার কান্না হয়তো সহ্য হলো না বাচ্চাটার। সে কেবল ডানে-বামে ধীর গতিতে মাথা নাড়ালো। হয়তো কান্না না করার ইশারা করলো। একে একে পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্যের সাথে ভাব বিনিময় করলো সে। হয়তো এই শেষ যাওয়া, আবার এমনও হতে পারে হয়তো ফিরে আসবে সে। এক অনিশ্চত উৎকণ্ঠা নিয়ে সবাই বিদায় জানালো চেরিকে। প্লেন যতক্ষণ না আকাশ পথে উড়াল দিলো ততক্ষণ সবাই বিমুখ হয়ে চেয়ে রইলো। কত মজা, আনন্দ আর হবে না। সওদাগর বাড়ির কোণায় কোণায় যেন শূণ্যতার আভাস। 


চেরিদের প্লেন গন্তব্য ধরতেই গন্তব্য ধরলো মুনিয়া, চিত্রা, অহি, নুরুল, আফজাল সওদাগর, তুহিন। যেতে যেতে চিত্রা আবার পিছু ফিরে তাকালো, পিছুটান যে বড় টান।


(২৬)


রাত তখন এগারোটা। ঢাকা শহরের তুমুল জ্যাম পেরিয়ে অবশেষে নিজ বাড়ির গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালো চিত্রাদের গাড়ি। ক্লান্ত দেহ, দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে যখন তারা বেরিয়ে এলো, বাড়ির দারোয়ান চাচা হুড়মুড় করে ছুটে এলো। যেন এতক্ষণ সে তাদের অপেক্ষাতেই ছিলো। 


নুরুল সওদাগর গাড়ির দরজা লাগিয়েই শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

"কী হয়েছে? আপনাকে এমন লাগছে যে!"


বৃদ্ধ দারোয়ান ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে দিলো। বাচ্চাদের মতন অভিযোগ করে বললো,

"স্যার, বাহার বাবাকে পুলিশ নিয়ে গেছে একটু আগে।"


 

#চলবে


[এইতো চমক শুরু হলো বলে। বেশি করে শ্বাস টেনে নিন। কারণ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা আসতে চলেছে।]

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ১০

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা 


পর্বঃ দশ


(২২)


রাত দশটা। অনেক গুলো দিন পর সওদাগর বাড়িতে রাতের খাবারের সময় নক্ষত্রদের মেলা বসলো। বড় চাচী, বড় চাচা, মুনিয়া বেগম, নুরুল সওদাগর, তুহিন, চাঁদনী, মাহতাব,লতা বেগম, চিত্রার ফুপি, অহি, চিত্রা, দিশান, তৃষান সব খাবার টেবিলে অবস্থিত। মুনিয়া বেগম তার বড় জা এবং চিত্রার ফুপি অবশ্য খাবার বেড়ে দিচ্ছে আর বাকিরা খাবার খাওয়ায় মগ্ন। 


এর মাঝেই সিঁড়ি বেয়ে বাহারকে নিচে আসতে দেখে ডাক দিলো নুরুল সওদাগর, 

"এই ছেলে, দাঁড়াও। কথা আছে।"


যেহেতু তাদের মেইন দরজার বাহিরে ছাঁদের সিঁড়ি, সেহেতু সবাই বাহারকে তেমন খেয়াল করে নি, নুরুল সওদাগরের ডাকেই সবার দৃষ্টি বাহারের দিকে গেলো। বাহারও হয়তো প্রস্তুত ছিলো না হুট করে ডাকের। তাও আবার নুরুল সওদাগর এমন অনাকাঙ্খিত সময় ডাকবে সেটা যেন ভাবনার বাহিরেই। 


থমথমে পরিবেশে সকলের অবাক দৃষ্টির দিকে চোখ বোলালো নুরুল সওদাগর অতঃপর ভাত নাড়তে নাড়তে, বেশ ধীর কণ্ঠে বললো, 

"ভেতরে এসো, অতদূর থাকলে কথা বলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবো না।"


"দূরের মানুষ দূরে থাকাই ভালো। আপনি বলুন, আমি শুনছি।"


বরাবরের মতনই বাহারের কাঠখোট্টা জবাবে বিরক্ত হলেন নুরুল সওদাগর। হাতে নেওয়া ভাতের লোকমা টা আবার থালায় রেখে দিলো সে। কপাল কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বললো, 

"আমাদের সন্দেহের তালিকায় কিন্তু তুমিও আছো। তাই এমন কিছু করো না যেন সন্দেহ প্রখর হয়।"


"এটা তো স্বাভাবিক কথাই। যে লোক নিজের মেয়েকে সন্দেহের তালিকায় রাখতে পারে, সে যে আমাকেও রাখবে এটা আমি জানি। নতুন কোনো খবর থাকলে বলেন।"


এমন একটা খবর পাওয়ার পর, অন্য কেউ হলে ঘাম ছুটে যেতো হয়তো অথচ এ ছেলের কেমন গা ছাড়া ভাব। বিরক্তিতে তেঁতো হয়ে উঠলো নুরুল সওদাগরের অনুভূতি। সে আর কথা না দমিয়ে রেখে বেশ ধমকে বললো, 

"কাল তুমি কোথায় গিয়েছিলে? তুমি কী জানো আজ অহিদের উপর এসিড নিক্ষেপ করা বাইকের ছেলে দুটোরই লা*শ পাওয়া গেছে? কাল তুমি শহরে ছিলে না। আজ শহরের বাহিরে খুব পুরোনো একটা বাড়ি থেকে ছেলে দু'টোকে পাওয়া গিয়েছে। মহিন যেদিন খু*ন হলো সেদিনও তোমার খোঁজখবর ছিলো না। হিসেব গুলো কেমন একে একে মিলে যাচ্ছে খেয়াল করেছো?"


অহির সবে মাত্র মুখে দেওয়া ভাতের লোকমাটা গলায় আটকে গেলো নুরুল সওদাগরের কথা শুনে। নাকে-মুখে খাবার উঠে বাজে অবস্থা। নুরুল সওদাগরের বলা কথাটা সবাইকেই যেন অবাক করে তুললো। শেষমেশ কিনা লোকটা বাহারের দিকেও আঙুল তুললো? 


সবাই যখন ব্যাতিব্যস্ত হয়ে অহির দিকে পানি তুলে দিলো বাহার তখন হো হো করে হেসে উঠলো। একটা ছন্নছাড়া ভাব নিয়ে বললো,

"পুলিশদের কি কাজই এটা? অপরাধী না পেলে এরে ওরে অপরাধী বানিয়ে দেওয়া? এ কেমন বিচার! যাই হোক, আপনার দরকারী কথা কি শেষ? আমি এবার যাই।"


নুরুল সওদাগর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। এ ছেলের মনে প্রাণে কী একটুও ভয় নেই? এমন একটা কথা শোনার পরও একটা মানুষ এত স্বাভাবিক কী করে থাকে? ভাবতেই হতাশার একটা শ্বাস বেরিয়ে এলো। 


নুরুল সওদাগরের চুপ থাকা দেখে আফজাল সওদাগর বেশ শীতল কণ্ঠে বাহারকে বললো,

"যেহেতু আইনের চোখ তোমার দিকে পড়েছে একটু সাবধানে থেকো।"


"আচ্ছা! সাবধানে না থাকলে কী হবে? কেঁচো খুঁজতে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে আসবে নাকি?"


বাহারের কথার ধরণে সবাই হতভম্ব চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। বাহার অবশ্য তার ধার ধারলো না বরং খুব স্বাভাবিক ভাবেই হাঁটতে হাঁটতে মেইন গেইট পেরিয়ে রাস্তায় চলে গেলো। রাতের রাস্তা আবার তার খুব প্রিয়। 


নিশ্চুপ হয়ে সবাই কেবল বাহারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। নিরবতাকে ভেঙে আফজাল সওদাগর কথাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললেন,

"আচ্ছা, তোমার কী মনে হয় নুরু, ঐ ছেলে দুটিকে কে মে*রেছে?"


"কোনো ক্লু পাচ্ছি না ভাইজান। যদি মহিন ওদের দিয়ে কাজটা করায় তাহলে মহিন তো মা*রাই গেছে, ওদের খোঁজ জানলো কে? আর খুব সম্ভবত মহিনকে যে মেরেছে সেই একাজ করেছে।"


"তোমরা কী সত্যি সত্যি বাহারকে সন্দেহ করছো?"


"হ্যাঁ ভাইজান, সন্দেহের খাতায় তো সবার নামই রাখতে হয়। আর কেসটা এত জটিল হচ্ছে যে না রেখে উপায় নেই।"


আফজাল সওদাগর হতাশার একটা শ্বাস ফেললেন। কি যেন বলতে না পারায় ছটফট ভাব ফুটে উঠলো মুখে। কেউ খেয়াল করলো কি না কে জানে! 


(২২) 


মাঝে অতিবাহিত হলো আরও দিন দুই। আজ চেরিরা চলে যাবে দেশ ছেড়ে। রাত সাড়ে নয়টার ফ্লাইট। সওদাগর বাড়িতে ঘোর শোকের ছায়া। বাচ্চাটার জ্ঞান ফিরলে কেমন তাকিয়ে থাকে আবার ঘুমের ঔষুধের জোরে ঘুমিয়ে যায়। কোনো কথা বলে না, কেমন জড় পদার্থ। অথচ এই মেয়ের হাসিতেই বাড়িতে মুক্তা ঝরতো। 


বাড়ির ড্রয়িং রুমে সকলের নিস্তব্ধতা যেন হাহাকার করে উঠছে। অবনী বেগম কেবল ধীর স্বরে কেঁদে যাচ্ছেন। অবশেষে অনবরত কান্না থামানোর জন্য ধমক দিলেন মুনিয়া বেগম। শক্ত কণ্ঠে বললেন,

"এত কান্নাকাটি করছো যে, সেই ভিনদেশে গিয়ে শক্ত থাকবে কীভাবে? তোমার সাথে কিন্তু কেউ থাকবে না। এখন থেকেই তো শক্ত হতে হবে।"


"আপনি আর সন্তানের মর্ম কী বুঝবেন! পরগাছা লাগিয়েছেন।"


বজ্রপাত হলেও যেন এমন ভয়ঙ্কর নিশ্চুপতা হতো না যতটা এই কথার প্রভাবে হয়েছে। অপ্রত্যাশিত কথাটা যেন বাড়ির গহীনে রোপন করে রাখা অনেক বছরের ভিত্তিটাকে ক্ষাণিক নাড়িয়ে দিলো। উপস্থিত সবাই বিস্ফো*রিত নয়নে অবনীর দিকে তাকিয়ে রইলো। কথাদের তীক্ষ্ণ আন্দোলনেই যেন চুপ করে গেলো সবাই। অনেকের কাছে বোধগম্য হলো না অবনী কি বলেছে, আবার অনেকে মানতে পারছে না অবনী এমন কিছু বলেছে। 


আফজাল সওদাগরের স্ত্রী রোজা সওদাগর ভয়ঙ্কর এক ধমক দিয়ে উঠলেন ছোট জা'কে। চোখ রাঙিয়ে বললেন,

"আক্কেল জ্ঞান কী শোকে খেয়ে ফেলেছিস? কোথায় কাকে কী বলতে হবে তা কী ভুলেই গেলি? পুরোনো কাসুন্দি ঘাটলে কেবল গন্ধ ছাড়া কিছুই বের হবে না। অহির মা, তুই নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারিস না। তবে অতীতের অনেক কিছু বের হবে।"


অবনী হয়তো নিজেও প্রস্তুত ছিলো না এমন একটা কথা বলার জন্য। অতিরিক্ত শোকে আর রাগে মানুষের বিবেকবুদ্ধি লোপ পায়। তখন তারা কী বলে করে তা নিজেরাও জানে না। তাই অতিরিক্ত রাগে বা শোকের বলা কথার আঘাতে মানুষ অনেক মানুষ হারায়। 


অবনী নিজের ভুল বুঝতে পেরে থতমত খেয়ে গেলো। আমতা-আমতা কণ্ঠে মুনিয়া বেগমের উদ্দেশ্যে বললো,

"ছোটো আপা, আপনাকে আসলে ওভাবে কথাটা বলতে চাই নি। আসলে সন্তানের চিন্তায় মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। বুঝেনই তো।"


"না অবনী, আমি আসলে বুঝি না সেসব। পরগাছা লাগিয়েছি কিনা।"


মুনিয়া বেগমের খোঁচা মারা কথাটা ঠিক গায়ে লেগে গেলো অবনীর। মুখ ছোটো হয়ে এলো তার। বাড়ির ছোটো সদস্য, তুহিন, তৃষান,দিশান,চিত্রা, অহি কেবল দেখে গেলো এ নীরব যুদ্ধ। তারা হয়তো যুদ্ধের ভাষা কিছুই বুঝলো না, কিন্তু এতটুকু তারা ঠিকই জানে যে মুনিয়া আর অবনী নামের নারী দু'জন সবসময় একে অপরের বিপরীতে শীতল একটা যুদ্ধ চালিয়ে যায়৷ অন্যান্য সময় হলে এ যুদ্ধের কোনো কিছুতেই তারা আগ্রহ প্রকাশ করতো না কিন্তু আজকের ব্যাপারটা একদমই ভিন্ন। আজকে কথার ভাষা গুলো কেমন যেন বিষাক্ত, তিক্ত কিছু দ্বারা মোড়ানো। 


এই শীতল যুদ্ধকে স্থগিত করতে রোজা সওদাগর গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,

"বাচ্চাদের সামনে তোদের কথা গুলো বেমানান, এতটুকু বোঝার ক্ষমতা তোদের থাকা উচিৎ।"


"বড়ো চাচী, ছোটো চাচী অমন কথা বললো কেনো? আম্মু কেনো বুঝবে না সন্তানের কষ্ট? আম্মুর আমরা আছি না? এসব কেনো বললো ছোটো চাচী?"


ঠিক এ ভয়টাই পেয়েছিলো ঘরের বড় সদস্য রা। চিত্রার প্রশ্নে তাদের ভেতর ভয়ের দানা গুলো কেমন শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে গেলো। নুরুল সওদাগর ধমকে উঠলেন মেয়েকে,

"এই তুমি বড়োদের মাঝে কথা বলছো কেন? তুমি কখনো ঠিক হবে না, তাই না?"


"বড়রা ছোটোদের মাঝে এমন অহেতুক কথা বলতে পারলে, ছোটোদেরও সে কথার বিশ্লেষণ চাওয়ার অধিকার আছে, আব্বু। আপনি ধমকটা সঠিক জায়গায় ব্যবহার করতে পারেন নি বলে আজ মানুষ এসব কথা বলার সুযোগ পেয়েছে।"


তুহিন সবসময়ই গম্ভীর ছেলে। কিন্তু সঠিক জায়গায় সঠিক কথা বলতে সে ভুলে না। বোনকে প্রচুর ভালোবসে কিনা। 


নুরুল সওদাগরের ধমকে চিত্রার চোখে জলেরা অবাধ্য হলো। টইটুম্বুর হয়ে ঘর বসালো চোখের ভেতরের আস্তরণে। ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না এলো। বাবা সবাইকে কত ভালোবাসে, অথচ তার বেলাতেই এসে এতটা নিষ্ঠুর হয়ে যায় কেনো!


তুহিনের কথা যে অবনী বেগমের তেমন ভালো লাগে নি তা অবনী বেগমের মুখ চোখের ভাব দেখেই বোঝা গেলো। সে মুখটাকে পাংশুটে বর্ণ করে তুহিনের উদ্দেশ্যে বললো, 

"ভুল মানুষ মাত্রই হয়, তুহিন। তাই বলে বড়দের এভাবে বলা উচিৎ না। তোমার মতন ছেলের কাছে অন্তত এসব আশা করা যায় না।"


"বড়রা যদি নিজেদের সীমাবদ্ধতা ভুলে যায় তবে এসব হবেই চাচী। আপনার জন্য এ বাড়ির ইতিহাস টা ভীষণ আঁধার। তাই আপনার এসব অসামঞ্জস্য কথা না বললেই খুশি হবো। সময়ে ভদ্র মানুষ কিন্তু আদব ভুলে বেয়াদব হয়ে যায়।"


অবনী বেগম হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলেন তুহিনের দিকে। তুহিনের মতন ঠান্ডা ছেলে কিনা তাকে এসব বলেছে? অপমানে, অপমানে শিউরে উঠলেন সে। নুরুল সওদাগরের দিকে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বললেন,

"আপনার সন্তান আমার সাথে এমন আচরণ করছে, কিছু বলবেন?"


নুরুল সওদাগর বরাবরই ছেলের সাথে তর্কাতর্কিতে কম যান কারণ সে তার ছেলেকে জানে। ছেলে তার অনেক ভদ্র কিন্তু মা-বোনের প্রতি বেশি পজিটিভ। সেখানে তার এই সত্তার উপর কেউ আঁচর কাটলে সে হিংস্র হয়ে যায়। তবুও নুরুল সওদাগর ডাক দিলেন ছেলেকে, রাশভারী কণ্ঠে বললেন,

"তুহিন, থামো। তোমার চাচী হন উনি। সম্মান দেও তাকে। বড়দের সাথে অভদ্রতা তোমায় শিখাই নি কিন্তু।"


তুহিন সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলো। সোফার সামনে সেন্টার টেবিলের উপর থাকা ফুলদানী টা আঁছাড় মেরে ভেঙে ফেললো। হুট করেই শান্ত তুহিন রাগী হয়ে উঠলো। মুখ চোখে যেন অগ্নি বর্ষন হচ্ছে৷ গলার রগ টানটান হয়ে ফুলে গেছে। সে সিংহের মতন গর্জন দিয়ে উঠে বললো,

"আপনি যা শিখিয়েছেন, তা সমাজে দেখালে আপনার মুখ থাকবে তো? আর কত? বলবেন, আর কত? আপনাদের জন্য আমরা হীনমন্যতায় ভুগী। লজ্জা হয় না আপনাদের? আবার আমার বোনকে নিয়ে আপনি কথা বলেন। আপনার মুখে ওর নামটাও বেমানান।"


কথা শেষ করেই ধপাধপ পা ফেলে তুহিন নিজের রুমে চলে গেলো। হুট করেই ড্রয়িংরুমের এমন বিধ্বস্ততায় অবাক সবাই। 


রোজা সওদাগর মুখ বাঁকিয়ে উঠলেন। বিরক্ত স্বরে বললেন,

"অহির মা, কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না, তুই তার প্রমাণ। তুহিনের মতন ঠান্ডা ছেলেটাকেও রাগিয়ে দিয়েছিস। তোর জন্য আমার ছোটো দেবরটা দেশমুখী হয় না। সংসার থাকতেও বৈরাগী সে। তোর জন্য অহি মেয়েটা আজ এমন নিস্তব্ধ। অথচ তুই মানুষ হইলি না। সংসারটা খেলি। আমার সোনার সংসারে হাত দিয়েছিস।"


অবনী আঁচল মুখে চেপে কেঁদে দিলো। আজ অনেকের অনেক কথায় যেনো কেমন ভয়ঙ্কর অতীতের আভাস দিলো। হতভম্ব মানুষ জন কেবল দেখে গেলো এই কান্ড। তাদেরকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো বিধ্বস্ত বাহার। যার মাথা ফেটে র*ক্ত বেরিয়েছে, টি-শার্টটাও ছিঁড়ে গিয়েছে। ডান হাতের কনুইয়ের দিকে ছিলে আছে।  


#চলবে

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ৯

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস

#মম_সাহা


পর্বঃ নয়



(২০)


সন্ধ্যার প্রকৃতি তখন বিষণ্ণ, সাথে বিষণ্ণ অষ্টাদশীর হৃদয়। দুপুর হতে এ অব্দি সে কেঁদেছে, কাঁদতে কাঁদতে চোখ-মুখ প্রায় ফুলে যাওয়ার উপক্রম। তার জীবনের সবচেয়ে কোমল একটা অংশ হলো তার শখের বাগান। অথচ কেবল আজ না, প্রায় এ নিয়ে দুই বার তার সাথে এই ঘটনা ঘটেছে। কে বা কারা এ কাজটা করে এটা বোধগম্য না কারোরই। কেবল চোখ মেলে দেখতে হয় শখ বাগানের বিধ্বস্ততা। প্রথম যখন এই রকম ঘটনা ঘটলো তখন প্রকৃতিতে কেবল আষাঢ় মাস এসেছে। দিন রাত কেবল বর্ষণ ধারা আপন গতিতে ঝরে যায়। এমনই টানা দুই দিন বৃষ্টির পর ক্ষান্ত হলো প্রকৃতি। বাহার তখন ট্যুরে গিয়েছে। চিত্রারও শরীরে জ্বর। তাই আর বাগানের যত্ন নেওয়া হয় নি, অথচ দু'দিন পর প্রকৃতির ঝড়ের সাথে চিত্রার শরীরের জ্বর কমতেই চিত্রা ছাঁদে গেলো, নিজের প্রিয় গাছ গুলোকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ছাঁদে উঠে সে হতভম্ব। বাগানের সবচেয়ে সুন্দর সুন্দর ফুল গাছ গুলোর টব ভেঙে একাকার। বৃষ্টির পানিতে টবের পানি ধুয়েমুছে কাঁদায় মাখামাখি ছাঁদ। সেদিন চিত্রা পাগলের মতন কেঁদেছিল। সবাই বলেছে ঝড়ের কারণে হয়তো টব গুলো পড়ে ভেঙে গিয়েছে, অথচ চিত্রা বিশ্বাস করে নি। মানে নি সে কথা। কারণ যে ফুলের টব গুলো ভেঙেছে সে গুলো নিচেই রাখা ছিলো। ওগুলো ঝড়ের বাতাসে পড়লে খুব বেশি হলে টব ফেঁটে যেতো, কিন্তু এমন বিশৃঙ্খল ভাবে ভাঙতো না। চিত্রার কান্না দেখে সেদিন বিকেলেই তুহিন অনেক গুলো ফুলের চারা এনে দিয়েছিল। অতঃপর একটানা দু'দিন কান্নাকাটির পর চিত্রা সে ব্যাথা ভুলেছে। আজ আবার এত গুলো মাস পর একই ঘটনা ঘটলো। বাড়িতে এত গুলো মানুষ থাকা শর্তেও ফুলের টবের কি নির্মম অবস্থা! 


ঘরের দরজায় তুমুল শব্দ হতেই ধ্যান ভাঙলো চিত্রার। চোখের অশ্রু ততক্ষণে বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে। চিত্রা কাঠের দরজাটার দিকে দৃষ্টি দিলো। গভীর ভাবে বোঝার চেষ্টা করলো কে এসেছে। তন্মধ্যেই অহির ডাক ভেসে এলো,

"চিত্রা, দরজা খোল তো। দেখি, দরজা খোল।"


অহি আপা হসপিটালেই ছিলেন সারাদিন, হয়তো এখন এসেছে। বাড়ির পরিস্থিতিও তো তত ভালো না, ঘরের দোর দিয়ে বসে থাকাটা আদৌও মানানসই? চিত্রা জানে এ কাজটা বেমানান, তবুও সে কাজটা করেছে। প্রিয় কিছুর কিঞ্চিৎ ক্ষতিও যে ভেতরটা ভেঙে দেয়। হোক সেটা মানুষ কিংবা বস্তু। 


চিত্রার ভাবনার মাঝেই বাহির থেকে অহির আবার ডাক ভেসে এলো,

"চিত্রা, খোল না দরজাটা।"


চিত্রা সারাদিনের অনশন ভাঙলো। ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখার প্রতিজ্ঞা টাও ঝিমিয়ে এলো। অলস শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। ধীর গতিতে দরজা টা খুলে দিতেই মুখমন্ডলের সামনে দৃশ্যমান হলো অহি আপার নিষ্পাপ, সাধাসিধে চেহারাটা। 


চিত্রাকে দরজা খুলতে দেখেই বাড়ির সদস্যদের প্রাণে পানি এলো। একে একে চিত্রার মা, বড়মা ছুটে এলো। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো চিত্রার ঘরে। চিত্রা তখনও নিরুত্তর। 


চিত্রার শ্যামলা রঙের কারণে অধিক কান্নার পরেও গালে লাল আভা দেখা দেয় নি। কিন্তু চোখ মুখে তখনও অশ্রুকনাদের আধিপত্য। চিত্রার মা মুনিয়া বেগম মেয়ের গালে হাত রাখলেন, খুব ধীর থেকে ধীর কণ্ঠে বললেন,

"কেঁদেছিস কেনো বোকা মেয়ে? তোর জন্য তোর তুহিন ভাইজান নাহয় আবারও চারাগাছ এনে দিবে। এমন কারণে কাঁদতে হয় নাকি?"


মায়ের আদুরে আলাপে চিত্রা ঠোঁট ফুলালো, চোখ-মুখ আঁধার হয়ে এলো তার। এইতো, মনে হচ্ছে হয়তো এখনই কেঁদে দিবে। অহি হয়তো বুঝতে পারলো চিত্রার অনুভূতির মতিগতি। তাই ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো, 

"কাঁদিস না, কাঁদিস না, দাঁড়া। আমি তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি।"


চিত্রার কাঁদো কাঁদো চোখে-মুখে ভর করলো বিষ্ময়। অহি আপা তার জন্য কিছু এনেছে! অথচ অহি আপার আগে এসব ব্যাপারে কখনো হেলদোল দেখা যায় নি। 


চিত্রা যখন অধির আগ্রহে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো অহি আপা মিনিট দুইয়ের মাঝেই চারটা ফুলের টব নিয়ে হাজির হলো। দু'টো টব দোয়েলের হাতে আর দু'টো তার নিজের হাতে। চিত্রা ফ্যালফ্যাল করে কেবল তাকিয়ে আছে। সে ঠিক বুঝতে পারছে না তার সাথে হচ্ছে টা কি। এতটুকু বয়সে কী তারও মতিভ্রম হচ্ছে! নাহলে অহি আপার মতন মানুষ কিনা ফুলের টব এনেছে নিজে যেচে, তাও আবার চিত্রার জন্য! 


কেবল চিত্রা না, অবাক হলো উপস্থিত সবাই। অহি কখনোই বাড়িতে ঘটে চলা ঘটনার স্রোতে গা ভাসায় না। তাকে বরাবরই দেখা যাবে পড়ার টেবিলে কিংবা তার ঘরের বারান্দায়। অথচ আজ সে মেয়ে বোনের অশ্রু মুছাতে ফুলের টব এনেছে ভাবতেই সকলের শরীরে কিঞ্চিৎ আনন্দের ধারা বয়ে গেলো। 


অহি সবার হতভম্ব মুখ খানার দিকে একবার চাইলো। মেঝো চাচী, বড়ো চাচী সকলের দৃষ্টিই তার দিকে নিবদ্ধ। এর কারণে সামান্য অস্বস্তিতে গা কাঁপলো অহির। সবার হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললো,

"আসলে বড় আপা দুপুরে কল দিয়ে বলেছিলো চিত্রার গাছ গুলো নাকি ভেঙে গেছে। তাই ও নাকি দরজা আটকে বসে আছে, কান্নাকাটি করছে। তাই কয়েকটা চারাগাছ নার্সারি থেকে কিনে আনলাম। বাড়ির পরিস্থিতি এমনকি চিত্রার পরিস্থিতিও তত একটা ভালো নেই যে এসব নিতে পারবে। তাই নিয়ে এলাম।"


সারাদিনের মন খারাপ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। চিত্রা বরাবরই অহি আপাকে পছন্দ করে বেশি। অহি আপার দৃঢ়তা সম্পন্ন চালচলনটাই চিত্রার পছন্দের কারণ। কিন্তু অহি আপা গম্ভীর মুখো বলে তাদের ভাব এতটা জমে নি কখনোই। অথচ সেই অহি আপা ই আজ চিত্রার খুশির কথা ভাবছে। এটাই যেন চিত্রাকে রাজ্যের সুখ এনে দিলো।


চিত্রা ছুটে এলো অহির দিকে, খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অহি আপার ছোটোখাটো শরীরটা। বা'হাতটায় টান পড়তেই কেমন চিন চিনে ব্যাথা করে উঠলো। কিন্তু সে ব্যাথায় তোয়াক্কা করলো না চিত্রা। সব ব্যাথা ছাপিয়েই যেন আজ অহি আপার আগমন ঘটেছে। 


চিত্রার পাগলামো দেখে উপস্থিত সবাই হাসলো। যাক, বাড়িটাতে এতদিনে প্রাণ ফিরলো। কেমন সতেজতায় ভরে গেলো চারপাশ। 


(২১)


আশ্বিন মাসে সচারাচর বৃষ্টির দেখা মেলে না। আকাশে কেবল তুলোর মতন মেঘেদের ছড়াছড়ি দেখা যায়। শরৎ এর নরম তুলতুলে আকাশ, আদুরে প্রকৃতি, সজীব গাছপালা দেখতেও ভালো লাগে। অথচ আজ আবহাওয়া শরৎ এর রূপে নেই। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে প্রকৃতি কিঞ্চিৎ সিক্ত। যে বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাচ্ছে চিত্রার শরীরের ঢিলেঢালা জামাটাও। জামার জায়গায় জায়গায় বৃষ্টির ফোঁটার চিহ্ন পরিলক্ষিত। অথচ চিত্রার সেখানে ধ্যানই নেই। সে ফুলের টবে নতুন মাটি চেপে চেপে দিতে ব্যস্ত। 


"এই মেয়ে, শুনলাম আজ নাকি প্রচুর কেঁদেছো?"


হুট করে এমন ডাকে ভীত হলো চিত্রা। ডান হাতের মুঠোয় থাকা মাটি গুলোকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে কেঁপে উঠলো। কিন্তু কণ্ঠের মালিককে চিনতে তার সামান্য অসুবিধা হলো না। সে অবাক উত্তর দিলো,

"বাহার ভাই, কোথায় ছিলেন কাল থেকে এ অব্দি?"


কালো টি-শার্ট টার গলার দিকটা টানতে টানতে বাহার উত্তর দিলো,

"পার্সোনাল কাজ।"


"কি কাজ, বাহার ভাই?"


চিত্রার প্রশ্নে বাহার ভ্রু কুঁচকালো, বেশ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো, 

"পার্সোনাল কাজ মানে বুঝো না? যেখানে ব্যাক্তিগত শব্দটা উল্লেখ্য আছে সেখানে সেটার বিশ্লেষণ চাওয়া টা বেশ বোকামি। অথচ তোমায় আমি বুদ্ধিমতী ভাবি।"


বাহারের কথার ধরণে আবারও মনের কোণে মেঘ জমলো চিত্রার। মুখটা অপমানে ছোটো হয়ে গেলো। সে বেশ শুকনো কণ্ঠে উত্তর দিলো,

"দুঃখীত।"


"তা আজ নাকি অনেক চারাগাছ পেয়েছো?"


বাহার যে পরিস্থিতি ঘুরানোর চেষ্টা করলো তা বুঝতে বাকি রইলো না চিত্রার। সেও মাথা নাড়িয়ে বললো, 

"হ্যাঁ বাহার ভাই, জানেন আমার সব সুন্দর ফুলের টব গুলো কে যেন ভেঙে ফেলেছে।"


"কে ভেঙেছে বলো তো? তোমার কাছের কেউ না তো?"


বাহারের প্রশ্নাত্মক বাক্যে অবাক হলো চিত্রা। তার কাছের কেউ ভেঙেছে মানে? বাহার ভাই কী বলতে চাইলো? তবে কী বাহার ভাই জানে, কে একাজ খানা করেছে? 


ভাবুক চিত্রার মাথায় চিন্তারা দলা পাকিয়ে গেলো। হাঁসফাঁস করে উঠলো হৃদয় কোণ। অধৈর্য্য কণ্ঠে তাই সে জিজ্ঞেস করলো,

"আমার কাছের কেউ? কিন্তু কেনো বাহার ভাই? আর কেই বা করেছে?"


চিত্রার প্রশ্নে বাহার ঠোঁট উল্টিয়ে বুঝালো যে এর উত্তর তার জানা নেই। হতাশার দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো চিত্রার বুক চিরে। মন খারাপ করে বললো,

"বাহার ভাই, রঙ্গন ফুলের গাছটাও ভেঙে গেছে।"


"অলকানন্দা তো আছে, তোমায় নাহয় অলকানন্দা বলবো। এবার বলো তো, নতুন চারাগাছ গুলো কোন কোন ফুলের?"


"অলকানন্দা, হাসনাহেনা,সন্ধ্যা মালতী আর শ্বেত চন্দন।"


"বাহ্,অনেক তো। আর কিছু চাই?"


বাহারের প্রশ্নে চিত্রার দুষ্টবুদ্ধি গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। টগবগ করে উঠলো ডানা ঝাপটিয়ে। চিত্রা বাহারের দিকে ঘুরে, বাহারকে পুরো পা থেকে মাথা অব্দি দেখে কুটিল হেসে বললো,

"হ্যাঁ চাই তো, আপনাকে চাই।"


বাহার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। খুব গভীর ভাবে কি যেন ভাবলো অতঃপর আনমনে বললো,

"আমায় চেও না অলকানন্দা, আমায় চাইলে বড়জোর  প্রাপ্তির খাতায় বিরাট এক শূণ্যতার হাহাকার মিলবে, আমায় মিলবে না।"


বাহার দাঁড়ালো না আর। কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে নিজের ঘরে চলে গেলো। চিত্রা কেবল সে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মানুষটাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে মানুষটা কোথায় উধাও হয়ে যায়! 


#চলবে

গল্প চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস পর্ব ৮

 #চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস 

#মম_সাহা


পর্বঃ আট


রাত গভীর থেকে গভীর হলো, সাথে অনুভূতিদের ঝিমিয়ে থাকা অঘোষিত যুদ্ধ টা নিবিড় ভাবে চলতেই থাকলো। ঘড়ির কাঁটায় তখন সময় একটা সাতচল্লিশ। চিত্রার কেবিনের ভেতর চিত্রা সহ আরও দু দু'টো মানুষও নিস্তব্ধ হয়ে আছেন। নুরুল সওদাগরের কথা থামতেই বাহারের হুট করে আগমনে কথার স্রোত একটু ভিন্ন দিকে গেলেও অতঃপর তা আবার আগের জায়গাতেই এসে খুঁটি বাঁধলো। মুনিয়া বেগম স্বামীর দিকে বিষ্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর খুব ধীরে, ছোটো কণ্ঠে বললেন,

"কি বলছো, বুঝেশুনে বলছো তো?"


নুরুল সওদাগরের মুখ-চোখ তখনো কঠিন। কর্কশ কণ্ঠে সে জবাব দিলেন,

"প্রমাণ কথা বলছে, আমি না।"


মুনিয়া হতাশার শ্বাস ফেললেন। হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থাকা চিত্রার দিকে একবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ক্ষীণ স্বরে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন, 

"চিত্রার জন্য এটা কি কোনো বিপদ ডেকে আনবে?"


"প্রমাণ যেহেতু চিত্রার বিরুদ্ধে তাই যেকোনো পদক্ষেপই নিতে হতে পারে আমাদের।"


"আপনার অযৌক্তিক প্রমাণকে একটু দূরে ছুঁড়ে ফেলে যদি মস্তিষ্ক দিয়ে ভাবেন, খুশি হবো। অন্তত এতটুকু তো বুঝবো যে আপনারও ব্রেইন নামক কোনো বস্তু আছে যেটা যুক্তিও বুঝে।"


বাহারের কথায় তুমুল তাচ্ছিল্যের সুর। অথচ নুরুল সওদাগরের তাতে যেন কিছু যায় আসে নি। সে স্বাভাবিক ভাবেই বললো,

"আইন প্রমাণ চেনে।"


"আর আপনি চেনেন মিথ্যা অহংকারে। কিসের আইন শেখাচ্ছেন আমাদের? আপনার আইন কি এতই যুক্তি ছাড়া চালাচল করে যে, একটা মেয়ে যে রাতে অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছে সে মেয়ে কীভাবে আরেকজনকে খু*ন করার আগে-পিছে বা কোনো কিছুতে ছিলো?"


বাহারের প্রতিটি কথা যুক্তিসঙ্গত কিন্তু নুরুল সওদাগরও দমে যাওয়ার পাত্র না। সে ইনিয়ে বিনিয়ে আরও কিছু বলার চেষ্টা করতেই থামিয়ে দিলো মুনিয়া বেগম। মহিলাটা কেমন গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো, 

"বড় আইনের কথা বলছো যে! অন্যদের বেলায় তোমার এত আইনের নিয়ম, নিজের বেলা আইন তোমার অন্ধ বুঝি! এ কেমন আইন!"


এবার আর কোনো কথা বলার সুযোগ পেলেন না নুরুল সওদাগর বরং নিজের স্ত্রীর দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলেন। এত গুলো বছর পর তার স্ত্রী যে তার দুর্বল জায়গায় হাত দিবে এটা যেন তার ধারণার বাহিরেই ছিলো। অবশ্য কথায় আছে না, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বিড়ালও সিংহ হয়ে উঠে আর মুনিয়া তো বুদ্ধিমতীই। 


চিত্রা নিজের মা-বাবার কথা নীরব থেকে শুনে গেলো। এই ক্ষেত্রেই যেন তার তুমুল নীরবতা। বাবার সামনে তার অনেক কিছু বলার থাকলেও বলা হয়ে উঠে না। কেনো এত সংশয়, দ্বিধা তা জানা নেই চিত্রার। সে কেবল এতটুকুই জানে, বাবা মানেই ধারালো তীর। যা খন্ড-বিখন্ড করে অষ্টাদশীর হৃদয়। 


নুরুল সওদাগর যেন চোখ লুকিয়ে বাঁচার জন্য হুট করেই কেবিনের বাহিরে চলে গেলো। মুনিয়া বাঁকা হাসলো। যে মানুষ নিজেদের অতীত ভুলে যায় অতিরিক্ত উড়বার জন্য তার ডানায় অতীতের প্রলেপ লাগিয়ে দিতে হয় নিজ দায়িত্বে। কিছু মানুষকে অতীত ভুলতে দেওয়া যাবে না। 


বাবা যেতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো চিত্রা। কেমন ঝিমানো কণ্ঠে বললো, 

"আম্মু, আব্বু এমন করে কেনো আমার সাথে? আমার দোষ কোথায়?"


"তোমার দোষ আসলে না। দোষটা হলো গিয়ে আমার। আমি তোমার বাবার স্ত্রী হতে পেরেছি তবে প্রেমিকা না। তাই হয়তো কেবল স্ত্রীর কন্যাকে সে গ্রহণ করতে পারে নি।"


মায়ের কথায় ভ্রু কুঁচকালো চিত্রা। কথাটা যে তার বোধগম্য হয় নি সেটা স্ফূর্তিত হলো তার মুখমণ্ডলে। তবে বাহার বোধহয় আঁচ করলো কিছুটা। তাই তো সে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, 

"আপনার কথা'ই নাহয় মানলাম, আন্টি। স্ত্রীর সন্তান বলে চিত্রাকে আজ মানতে পারছে না চিত্রার বাবা। তবে তুহিনের ক্ষেত্রে তো মেনে নেওয়ার ব্যাপারটা ভীষণ স্বাভাবিক। তখন স্ত্রী-প্রেমিকার ভেদাভেদ হাওয়ায় মিলিয়ে যায় কেনো? এখানে অবশ্য ছেলে-মেয়ের বিভেদের কথাও আমি বলবো না। কারণ মেয়ে অপছন্দ হলে চেরি আর অহির নিয়মের ক্ষেত্রেও একই হতো। হিসেবটা কেমন গোলমেলে না, আন্টি?"


বাহার ভীষণ চতুর ছেলে। তার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কিঞ্চিৎ হিমশিম খেলো মুনিয়া বেগম। কথা কাটানোর জন্য সে কেবিন ছেড়ে চেরিকে দেখার অজুহাতে বেরিয়ে গেলো। বাহার হাসলো। সে জানতো এমন কিছুই হবে। 


(১৮)


কেবিন খালি হতেই বাহার এসে চিত্রার সামনে দাঁড়ালো। চিত্রারও ততক্ষণে দৃষ্টি গেলো বাহারের উপর। বাহারের শরীরে ডালিয়া রঙের টি-শার্ট যেটার বাহুর দিক দিয়ে ঘামে ভিজে আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। উচ্চতা অনেক হলেও সুঠাম দেহী বলা যাবে না তাকে। বেশি ছিমছাম গড়ণের। গায়ের রঙও তো আর তত ফর্সা নয়। একদম সাধারণ একজন পুরুষ। অথচ কতটা চুম্বকের মতন আকর্ষণ শক্তি লোকটার ভিতরে! 


বাহার গলা পরিষ্কার করার মতন শব্দ করলো। অতঃপর বললো,

"নারী তুমি হও যদি দাস, 

উপহাস হবে তোমার ভাগ্যের নির্মম পরিহাস।"


হুট করে এই দু'লাইনের তাৎপর্য টুকু বোধগম্য হলো না চিত্রার। সে ভীষণ অবাক হলো। অবাক মিশ্রিত কণ্ঠেই বললো,

"এটা কী ছিলো!"


"ধরতে পারো সাবধান বাণী। যা তোমার জন্য ছিলো। নিজের বাবাকে দেখে তুমি যখন মুখ চুপসে চুপ করে থাকো, দুনিয়ার সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাক্তি আমার কাছে তখন তোমাকে লাগে। তোমার প্রতি বিরক্তে আমি কত রকমের ঢেঁকুর তুলি। তুমি এত বিরক্তিকর কেনো?"


বাহার ভাইয়ের মুখ-চোখ ভাঁজ করা কথার ধরণে তেতে উঠলো অষ্টাদশীর হৃদয়। অযাচিত আন্দোলন ঘোষণা করলো হৃদয় তোলপাড় করে। সে অসহ্য রকমের রাগ ঝেড়ে বললো,

"আমি বিরক্তকর? আমি? আপনি তো জলজ্যান্ত বিরক্তের কারখানা আবার আসছে আমাকে বলতে। ভূতের মুখে রাম নাম।"


"অথচ এই বিরক্তের কারখানাকে হৃদয় মাঝে পুষে রেখে প্রতিনিয়ত কতই না আনন্দ উৎসব করছো মেয়ে!"


চিত্রার কথা থেমে গেলো। আকাশচুম্বী রাগ ফুড়ুৎ করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। লোকটা উচিৎ সময়ে এত উচিৎ কথা বলে কীভাবে? অথচ চিত্রা ঝগড়ার সময়ে সঠিক কথা টা ভুলে যাওয়ার কারণে মাঝে মাঝেই ঝগড়ায় হেরে গিয়ে কেঁদে ফেলে।  


"চুপ থাকলে তোমাকে খারাপ লাগে না, মেয়ে। তবে তোমার বাবার সামনে চুপ করে থাকাটা ভীষণ বাজে স্বভাব। বাবা-মাকে অবশ্যই সম্মান করা উচিৎ। তবে, যে মানুষ তোমাকে উঠতে-বসতে অসম্মান করে বুকের মাঝে আস্ত একটা রগরগে ঘাঁ তৈরী করে দিচ্ছে, তার সামনে চুপ করে থাকাটা নেহাৎ ই পরাধীনতা। অথচ তোমার এখন মুক্ত হয়ে উড়ার সময়।"


বাবাকে চিত্রা ভীষণ বেশিই ভালোবাসে, তাই হয়তো চেয়েও বাবার সামনে সে কঠিন কিছু বলতে পারে না। অথচ বাবা কত নির্দ্বিধায় না চিত্রাকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে! 


বাবার কথা মনে পড়লেই আকাশ-পাতাল আঁধার করে চিত্রার মন খারাপ হয়। তাই কথা ঘুরানোর জন্য চিত্রা বললো,

"আচ্ছা বাহার ভাই, আপনার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছাড়বেন কবে?"


"যেদিন আর ভিতর পুড়বে না, সেদিন আর বাহিরও পুড়াবো না।"


"আপনারও তাহলে ভিতর পুড়ে?"


"কেনো মেয়ে, আমি কী মানুষ না? পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই ভেতর পুড়ে। কেউ প্রকাশ করে, আর কেউ গোপনে রাখে।"


"বাহার ভাই, আপনি এত জটিল কেনো?" 


"তুমি আমায় জটিল ভাবে গ্রহণ করেছো বলে।"


"জানেন বাহার ভাই, আপনি আমার কাছে ক্যাকটাস ফুলের মতন।"


"আর তুমি আমার কাছে অলকানন্দা কিংবা সন্ধ্যার রঙ্গনা।"


ইশ্, লোকটা যেন উত্তর তৈরী করেই এসেছে। এত বিব্রতকর কথা বলেও লোকটাকে বিব্রতবোধ করাতে না পেরে হতাশার শ্বাস ফেললো চিত্রা। হুট করেই তার মাথায় খেলে গেলো দুষ্টবুদ্ধি। কিটকিটে হেসে বললো, 

"আপনি কি জানেন, অষ্টাদশী তার বুকের মাঝে আস্ত একটা বাহার ভাই পুষে রেখেছে।"


"ফুল প্রিয় অষ্টাদশীর কাঁটার প্রতি এত ঝোঁক বড়ই আশ্চর্যের। তুমি কি জানো মেয়ে,


চলতি পথে যাদুকর ভালবাসা

প্রেমিক ডাকাতের মত

তোমাকে ছিনিয়ে নেবে

মৌসুমী বাতাসে উড়ে যাবে ভালবাসা

হৃদয়ের চোরা পথে

তুমি হারিয়ে যাবে

তুমি লুটপাট হয়ে যাবে

তুমি চৌচির হয়ে যাবে……


গানটা শুনেছিলে মেয়ে? তুমি আমার মাঝে ডুবতে এসো না, হারিয়ে যাবে। কী লাভ নিজেকে হারানোর, নিষিদ্ধতে আসক্ততা কেনো, মেয়ে?"


চিত্রা উত্তর দিলো না। এই বাহার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকেও যেন বিশ্বযুদ্ধ জয় করার মতন আনন্দ পাওয়া যায়। অনুভূতিরা মাঝে মাঝে এত মিষ্টি হয় কেনো?


বাহার পকেটে দু'হাত গুঁজে বের হতে নিলেই চিত্রা আনমনেই বলে উঠলো,

"আপনি আমার হুট করে বুকের বা'পাশ ব্যাথা, বাহার ভাই। আপনি আমার মন কেমনের রোগ। আপনি আমার বৃষ্টির দিনে ভিজে চুপচুপে সাদা শাড়ি। আপনি আমার শখ বাগানের ক্যাকটাস ফুল। আপনি আমার সহজসরল অংকের স্যারের দেওয়া লাল কালিতে ফুটে উঠা কিঞ্চিৎ ভুল। আপনি খুব খারাপের বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু আপনি আমারই কেবল।"


বাহার যেতে নিয়েও ফিরে তাকালো। হাসলো না, মুখ গম্ভীরও করলো না। কেবল ধীর কণ্ঠে বললো, 

"আমি তোমার চায়ের কাপের নীল রাঙা বি*ষ। যা পান করলে তোমার মৃ*ত্যু নিশ্চিত, অথচ তুমি পান করতে মরিয়া। শুনো মেয়ে রঙ্গনা, প্রেম ভালো তবে তোমার প্রেমিক না।"


(১৯)


ভাদ্র মাস শেষ। সময়টা ঠিক আশ্বিনের দ্বিতীয় দিন। দীর্ঘ নয় দিন পর চিত্রা পা রাখলো নিজের শখের বাড়িতে। রোগা-সোগা চোখ-মুখ। শরীর শুকিয়ে গেছে। গায়ের রঙটাও কেমন হালকা মেটে রঙ ধরেছে। তবে এখন সে কিছুটা সুস্থ। স্বাভাবিক ভাবেই হাঁটা চলা করতে পারছে। ইতিমধ্যে চেরিকে বাহিরের দেশে নেওয়ার বন্দোবস্ত প্রায় শেষের দিকে। চেরির কোনো উন্নতি দেখা দিচ্ছে না। 


চিত্রা বাড়িতে পা রাখতেই থম মেরে থাকা বাড়িটা উৎসবমুখর হয়ে উঠলো। কিঞ্চিৎ হৈচৈ, শোরগোল শোনা গেলো। কিন্তু এরমধ্যেই ছাঁদ থেকে চিত্রাদের বাড়ির কাজের মেয়ে দোয়েলের চিৎকার ভেসে এলো। সবাই হুড়মুড় করে ছাঁদে যেতেই অবাকে হা হয়ে রইলো। চিত্রার রঙ্গনা, মৌসন্ধ্যা, পিচ ফুলসহ আরও অনেক গুলো ফুল গাছ মাটিতে পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ইচ্ছেকৃত ভাবে কেউ এ কাজটা করেছে। 


#চলবে