বামনের ঘরে চাঁদ
সাজিয়ানা মুনির
২৮.
( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)
নিকষ কালো আকাশটায় সবে আলো ফুটতে শুরু করেছে। অন্ধকার ঢাকা অম্বরে র/ক্তিম আলোর ফোয়ারা জ্বলতে শুরু করেছে। জমিন থেকে মনে হচ্ছে, যেন কেউ অগ্নি তান্ডব মেলেছে। পিনপতন নীরব ঘরটায় যন্ত্রের টিপটিপ আওয়াজ। পিটপিট করে চোখজোড়া মেলল চাঁদ। অন্ধকার মোড়ানো ঘরে ঝাপসা লাগছে সব। এক হাতের উপর জোর দিয়ে উঠে বসতে চাইলো সে। পারলো না। অসহ্য য/ন্ত্রণা ভারী, ব্যথাতুর মাথায় ঝোঁক পড়ায় ব্যথায় চিনচিনিয়ে উঠলো সে। 'আহ!' অফুটন্ত একটা আওয়াজ মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। অপর হাতটা নাড়াতে চাইলো, অমনি কেউ হাত চেপে আছে অনুভব করলো। হাতের দিকে খানিক ঝুঁকল চাঁদ। বাহিরের অস্পষ্ট আলোটা মানুটার মুখে পড়ছে। লালচে আলোতে আষাঢ়ের মলিন মুখখানা ভেসে আছে। চোখমুখ কেমন নেতিয়ে আছে, সেই তুখোড় তেজি রূপটা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। চাঁদের ভীষণ মায়া হলো, ক্যানোলা করা হাত উঁচিয়ে আলতো করে আষাঢ়ে গালে রাখলো। আষাঢ়ের অগভীর, ফিকে ঘুমটা কে/টে গেল। ছিটকে উঠলো একপ্রকার। ঘুমের অপূর্ণতায় মাথাটা ঝিমঝিম করছে। গত চার রাত নিদ্রাহীন, চিন্তায় কে/টেছে। এক্সিডেন্টে চাঁদের ভ/য়ানক রকম চোট লেগেছে। পায়ে গভীর আঘা/ত লেগেছে। প্লাস্টার করা হয়েছে। গত চারদিনে কয়েকবার চাঁদের জ্ঞান ফিরেছে আর অজ্ঞান হয়েছে। যতবার জ্ঞান ফিরেছে ঔষধের সাইড ইফেক্ট আবোলতাবোল বলেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ভ/য়ানক ছিল, চাঁদের বারবার বলা, ' আমি ম/রে যাবো। বাঁচবো না। ওরা নিতে এসেছে আমায়।' এই কথাটা। না চাইতেও একটা ভয়, আতংক আষাঢ়ের বুক চেপে ধরেছিল। এই চারদিন একটা বারের জন্যও হাসপাতাল থেকে বের হয়নি। পুরোটা সময় চাঁদের হাত চেপে পাশে বসে জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করছিলো।
ভোরের অনুজ্জ্বল আলো চাঁদের ফ্যাকাসে মুখখানায় পড়ছে। কপালে ব্যান্ডেজ, কে/টে জখম হওয়া ফোলা ঠোঁট। চঞ্চল চোখজোড়া নিষ্প্রাণ। চারদিন পর চাঁদের জ্ঞান ফেরা, এভাবে সামনে থাকা সবটাই আষাঢ়ের কাছে বিস্ময়কর। কিছুতে বিস্ময় কা/টাতে পারছে না সে। অনেক বেশি অপেক্ষার পর কাঙ্খিত জিনিসটা ঘটলে যেমনটা হয়! আষাঢ়ের অনুভূতি তেমন। জাপ্টে ধরলো চাঁদকে, বুকের মাঝে মিলিয়ে নিলো। চাঁদের ব্যথাতুর শরীরটা আষ্টেপৃষ্টে বুকে জড়িয়ে রাখলো। এই মুহূর্তে দুনিয়ার অন্যকোনো চিন্তাভাবনা মাথায় আসছে না তার। মনে হচ্ছে, এভাবেই বহু যুগ পাড় হয়ে যাক। খানিক বাদেই আষাঢ়ের বুক চিড়ে কান্নার আওয়াজ এলো কানে। হাউমাউ করে কাঁদছে। চাঁদ স্তব্ধ! কাউকে হারানোর ভয়ে পুরুষ মানুষ এভাবেও কাঁদে? আষাঢ়ের বাচ্চাদের মত কান্না চাঁদকে থমকে দিলো। আষাঢ়কে জীবনের নানারকম পরিস্থিতির সম্মোখীন হতে দেখেছে চাঁদ। কিন্তু এতটা ভীতু, এতটা ভেঙে পড়তে দেখেনি কখনো। আষাঢ়কে বরাবরই শক্তপোক্ত হৃদয়হীন ব্যাক্তি বলে মানতো। কিন্তু আজকের ঘটনা এতদিনকার থিউরি পুরোপুরি ভাবে ঘুরিয়ে দিলো। লোকে বলে পুরুষ মানুষদের কান্না করতে নেই! অথচ মানুষ জানেই না পুরুষ মানুষের আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা যতটা সুন্দর, শখের নারীকে হারানোর ভয়ে কান্না ততটাই আবেগপ্রবণ ভয়ঙ্কররকম সুন্দর। এতটা নিষ্ঠার সাথেও কাউকে ভালোবাসা যায়? কাউকে এতটা হারানোর ভয়! পুরুষ মানুষের কান্না সচরাচর দেখা যায় না বলেই হয়তো এতটা সুন্দর, অনুভূতি মাখানো।
আষাঢ় চাঁদকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বুকের গহীনে লুকিয়ে রাখতে চাইছে। যেন কোনো ভয়, আঘা/ত না ছুঁতে পারে তার চাঁদকে। সবে সারতে থাকা জখম গুলোতে আঘা/ত লাগছে। সারা শরীর জুড়ে অসহ্য ব্যথা অনুভব করছে। কিন্তু মুখ দিয়ে টু শব্দ বের করলো না চাঁদ। চোখবুজে আষাঢ়ের বুকের সাথে মিশে রইল। এই মুহূর্তে তার শরীরের ঔষধির দরকার নেই, মনে প্রশান্তির বড্ড প্রয়োজন। যা কেবল আষাঢ়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ। চাঁদের ভারী ভারী গভীর নিশ্বাস। আষাঢ়ের কান্নাভেজা অস্পষ্ট একটা আওয়াজ কানে এলো। কান্নাভেজা কণ্ঠে আষাঢ় ফিসফিস করে বলল,
' আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। ভালোবাসি চাঁদ।'
এই দুই বাক্য চাঁদের সারা শরীরে অদ্ভুতরকম প্রশান্তি মেলে দিলো। হৃদয়ের গভীরে অন্যরকম এক আবেশে আঁকড়ে ধরল। চাঁদকে বুকে জড়িয়ে রেখেই আষাঢ় কয়েকবার ঘাড়ে গভীর করে চুমু দিলো। প্রতি চুমুতে ফিসফিস আওয়াজে শুধু বলল,
' ভালোবাসি..ভালোবাসি...ভালোবাসি।'
উত্তরে চাঁদ কিছু বলল না। আষাঢ়ের বুকে আলতো চুমু দিলো। বুকে কান রেখে চোখ বুজে তার জন্য ধুকধুক বাজতে থাকা হৃদস্পন্দন শুনতে লাগলো, মৃ/ত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মানুষটার জন্য এই ট্রিটমেন্টটা বেশ জরুরী ছিলো।
শরীরের চোট বেশ গাঢ় ভাবে লেগেছে। আরো কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। পৃথা দেশে ফিরেছে, আসার পর থেকে ডিভোর্সের ব্যাপারটা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। সময় করে দিনে একবার হলেও হাসপাতালে এসে চাঁদকে দেখে যাচ্ছে। রাতে বেশি লোক থাকার অনুমতি নেই। রোজ দিনের বেলা আরশি মালা বেগম এসে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকছে। চাঁদ আষাঢ়ের সম্পর্ক ধীরেধীরে গুছিয়ে আসছে। আর পাঁচটা স্বাভাবিক সম্পর্কের মত হচ্ছে। মালা বেগম বেশ খুশি। হয়তো, নিয়তিতে এমনি লেখা ছিল। একবার এক দুর্ঘটনায় দুজন আলাদা হয়েছে। অপর ঘটনাটা দুজনকে মিলানোর জন্য হয়তো।
আষাঢ় চব্বিশ ঘন্টা চাঁদের কাছাকাছি থাকছে, এখানে বসেই অফিস সামলাচ্ছে। যদিও যাবতীয় কাজ ম্যানেজার দেখছে। পুরোটা সময় চাঁদের প্রয়োজন অপ্রয়োজনের খেয়াল রাখছে। চাঁদের উপর অধিকার খাটাচ্ছে, তিনবেলা পাশে বসে নিজে খায়িয়ে দিচ্ছে। ঔষধ খাওয়া নিয়ে ঝামেলা করলে বেশ কড়াকড়ি ভাবে শাসন করছে। বিষয় গুলো চাঁদ বেশ উপভোগ করছে। ইচ্ছে করে আহ্লাদ করছে, হাসপাতালে বেকার বসে বসে আষাঢ়কে জ্বালাতে, নাকানিচুবানি খাওয়াতে বেশ আনন্দ লাগছে। আষাঢ়ও চুপচাপ সব করছে। বউয়ের আহ্লাদ অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিচ্ছে। প্রতিদিন চাঁদকে নতুন করে জানছে। চাঁদের এমন বাচ্চামো একটা রূপ আছে জানা ছিলো না আষাঢ়ের। সবসময় চাঁদকে ম্যাচিউরই দেখেছে। চাঁদের এই ছেলেমানুষী, ঠোঁট উল্টানো, আহ্লাদ করা সবকিছু আষাঢ়ের পছন্দ। দিনদিন আরো গভীর থেকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলছে মেয়েটিকে।
সূর্য হেলে পড়েছ। সন্ধ্যা নামবে নামবে। আষাঢ় স্যুপের বাটি হাতে চাঁদের সামনে বসে। চাঁদ খাবে না বলে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। খাওয়াদাওয়ার প্রতি মেয়েটার প্রচন্ড অনিহা। গত দশ মিনিট যাবৎ আষাঢ় চাঁদকে স্যুপের উপকারিতা বোঝাচ্ছে, চাঁদের মুখ গোমড়া করে নাক ছিঁটকানো উত্তর,
' ভুট্টার স্যুপ আর গরম পানির মধ্যে আমি খুব বেশি তফাৎ খুঁজে পাই না। যদি স্যুপই খাওয়াতে হয় তাহলে থাই স্যুপ আনেন। বেশি করে চিংড়ি চিকেন দিয়ে।'
' চিংড়িতে এলার্জি, মাত্রই ক্ষততে টান ধরেছে। চুলকানিতে ঘা বানাতে চাইছ?'
চাঁদের আগের মতই গোমড়া মুখের গম্ভীর আওয়াজ,
' একটু চিংড়ি খেলে কিছু হয় না তো। একটু তো খাওয়াই যায়!'
আষাঢ় হতাশ নিশ্বাস ফেলল। কন্ঠে বেশ আহ্লাদ জড়িয়ে বাচ্চাদের বোঝানোর মত করে বলল,
' শুনো বউ, তুমি না ভালো মেয়ে? একটু খেয়ে নেও। কথা দিচ্ছি, সুস্থ হলে শুধু থাই স্যুপ কেন? মাশরুম স্যুপ, ভেজিটেবল স্যুপ, সিফুড স্যুপ সব ধরনের স্যুপ খাওয়াবো!'
আষাঢ়ের করুণ মুখখানা দেখে চাঁদ ফিক করে হেসে ফেলতে যেয়েও থেমে গেল। ঠোঁট চেপে হাসলো। জামাইকে বিরক্ত করে এতটা আনন্দ পাওয়া যায়! জানতো না সে। জানলে চার বছর ভেস্তে না দিয়ে নাকানিচুবানি খাওয়াতো আষাঢ়কে।
চাঁদের মিটমিট করে হাসি আষাঢ়ের চোখে পড়লো। মুখের কাছে স্যুপের চামচ নিয়ে দুষ্টু হেসে বলল,
' শুধু সুস্থ হও! ছেলেমানুষী কাকে বলে? কত প্রকার কি কি। সব হাড়ে হাড়ে টের পাবে বউ।'
চাঁদ পাত্তা দিলো না। রুচিহীন স্যুপটা মুখে পুড়ে নিলো। অমনি দরজা খোলার আওয়াজ কানে এলো। পৃথা এসেছে। ভাবিকে দেখে চাঁদ মিষ্টি হাসলো। পৃথা পাশে এসে বসলো। বলল,
' এখন কেমন লাগছে? '
' ভালো। তুমি কেমন আছো?'
' এইতো কোনোরকম।'
পৃথার ক্লান্ত আওয়াজ। চাঁদ কপাল কুঁচকালো। বলল,
' কোনো সমস্যা হয়েছে কি?'
' চিন্তার কিছু নেই। তেমন কিছু না। রুবেল ডিভোর্স দিতে চাইছে না। ঝামেলা করছে। এসব কিছু নিয়েই উকিলের কাছে দৌড়াদৌড়ি চলছে।'
চাঁদ আর কথা বাড়ালো না। পৃথার চোখমুখে অস্বস্তি দেখা দিচ্ছে। কথা ঘুরাতে পৃথা বলল,
' খাওয়া দাওয়া নিয়ে এত অনিয়ম কেন তোর? শুনলাম গতরাতেও নাকি প্রেসার নেমে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলি?'
চাঁদ মুখ কালো করে আষাঢ়ের দিকে এক পলক চাইলো। তারপর আবার পৃথার মুখপানে তাকিয়ে বলল,
' এসব তোমাকে কে বলেছে? উনি? মিথ্যা সব! জোর করে তিনবেলা গামলা ভরে ভরে খাওয়াচ্ছে। এই কয়েকদিনে নিশ্চয়ই পাঁচ কেজি বেড়ে গেছি। সব উনার জন্য। আমার স্লিম ফিগার!'
চাঁদের অভিযোগ শুনে আষাঢ় মৃদু হাসলো। অমনি দরজা নক করার শব্দ এলো। কেউ এসেছে। চাঁদ উৎসুক দৃষ্টি তুলে বাহিরে তাকালো। পৃথার ছোট বোন প্রমি ভেতরে ঢুকলো। পৃথার বিয়ের পর থেকে প্রমির সাথে চাঁদের বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। প্রমির চলনবলন সবকিছু চাঁদের বেশ ভালো লাগতো। রোল মডেল মানতো। কিন্তু ভাবীর সাথে যে প্রমি আপা দেশে এসেছে! এতদিন বলল না কেন?
প্রমিকে দেখে চাঁদ বেশ খুশি হলো। চাঁদ কিছু বলবে, তার পূর্বেই পৃথা পাশ থেকে গম্ভীর গলায় বলল,
' তুই এখানে এসেছিস কেন? আমি মানা করেছিলাম! '
পৃথার কণ্ঠে চাপা ক্রোধ। চাঁদ বেশ হতভম্ব হলো। চাঁদের হতভম্ব দৃষ্টি দেখে পৃথা কথা লুকাতে বলল,
' হাসপাতালে আসা তো তোর পছন্দ না। ভালো লাগে না!'
প্রমি বোনের কথা তোয়াক্কা না করে, চাঁদের দিক চেয়ে নিদারুণ হেসে বলল,
' কাম অন আপা! তাই বলে কি আমার জুনিয়র হাসপাতালে আমি দেখতে আসবো না? আফটার অল আত্মীয় আমরা!'
চাঁদের পাশে বসে প্রমি জিজ্ঞেস করল,
' এখন কেমন আছো চাঁদ?'
' ভালো। আপনি কেমন আছেন?'
' ভালো! দেখো চাঁদ, আমি এখানে আসায় তোমার ভাবি কেমন রেগে যাচ্ছে। তুমি আমাকে দেখে খুশি হওনি?'
ঠোঁট মেলে হাসলো চাঁদ। বলল,
' খুশি হবো না কেন? তুমি এসেছ, ভীষণ ভালো লাগছে আমার।'
প্রমি রহস্যময় হেসে আষাঢ়ের দিকে তাকালো। আষাঢ়ের চোখেমুখে ক্রোধ, অস্বস্তি। বিনাবাক্যে চেয়ার ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পৃথার চোখেমুখেও অস্বস্তি ভাব! পুরো ব্যাপারটা চাঁদের চোখে পড়লো। কয়েক মুহূর্ত পূর্বে এই ঘরে কিছু একটা ঘটলো। সবার চোখেমুখে অস্বস্তি, আতঙ্ক! কিছু একটা চলছে চাঁদের আড়ালে। যা জানে না সে। কি চলছে?
চলবে......
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
টাইপোগ্রাফি করেছে Maksuda Ratna আপু❤️🌺
0 Comments:
Post a Comment