গল্পঃ #সে_ফিরে_আসবেই
৫ম_পর্ব
লেখকঃ #অনন্য_শফিক
তড়িঘড়ি করে এসে দরজা খুলতেই দেখি বাইরে নীলা দাঁড়িয়ে আছে। ওর কোলে মানহা।
নীলাকে দেখে আমার গা শিরশির করতে লাগলো। রাগে সাড়া শরীর কাঁপছে। ইচ্ছে করছে ওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেই!
আমি কিছু বলার আগেই মানহা ওর মার কোল থেকে এক লাফে আমার কোলে এসে গেলো। তারপর বললো,' বাবা, তোমায় নিয়ে আমি একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখেছি।'
আমি নিজের রাগ দমন করার চেষ্টা করে বললাম,' কী স্বপ্ন দেখেছো মা?'
মানহা বললো,' তুমি ঘরে আরেকটা নতুন মা এনেছো আমার জন্য।'
নীলা তখন মানহাকে ধমক দিলো। বললো,' বানিয়ে কথা বলা বন্ধ করো!'
মানহা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,' আমি মিথ্যা কথা বলি না। মিথ্যে বললে আল্লাহ জিভ কেটে দেয় কাঁচি দিয়ে।'
মানহাকে আমি বুকের সাথে মিশিয়ে ধরলাম। আর মনে মনে বললাম, আহ নীলা আহ!এটা কী করলে তুমি! একটা সুন্দর ঘর। একটা সুন্দর চড়ুই পাখির সংসার। আমাদের ফুটফুটে একটা মেয়ে। যে কি না বুলি নেয়া তোতার মতো মিষ্টি করে কথা বলে। এইসব কিছুকেই তুমি অবহেলা করে অন্য একটা ছেলের হাত কী করে ধরলে? তোমার কপালে ডিভোর্সের চেয়ে ভালো কিছু নেই! তুমি ওটারই যোগ্য। তোমার প্রাপ্য আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিবো। দু তিনটে দিন যাক।
তারপর আমি অপেক্ষা করি মানহার জন্য। মানহাকে দুপুরে ঘুম পাড়াবো। ও ঘুমিয়ে গেলে নীলাকে ডেকে নিবো বেলকনিতে। তারপর জিজ্ঞেস করবো সবকিছু। মানহার সামনে আমি এসব করতে পারবো না। এতে মেয়ের মনে খারাপ ধারণার জন্ম নিবে। ওর ছোট্ট সুন্দর ভাবনার জগতটা কুৎসিত হয়ে যাবে। মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যেতে থাকবে ধীরে ধীরে।
নীলা কিছু একটা বলে ফেলতে চাচ্ছে বারবার। একবার বলেও ফেললো,' ফাহাদ, তোমার সাথে আমি সবকিছু খুলে বলতে চাই!'
আমি ওকে চুপ করিয়ে দেই। বলি অপেক্ষা করো। মেয়ের সামনে এসব নিয়ে কথা বলা যাবে না।
নীলার মুখটা দেখি তখন মলিণ হয়ে যেতে। চিন্তার ছাপ পড়ে আছে ওর চেহারায়। এর আগে ওকে কখনো এতো চিন্তিত দেখিনি আমি!
ওকে এভাবে দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগে না। কিন্তু রাগও প্রশমিত হয় না। বারবার কেবল মনে হতে থাকে, ও কী করে আমার সাথে প্রতারণা করলো!সব মেনে নিতে পারি কিন্তু এটা না। কিছুতেই না! তাছাড়া ওরা আমার চোখের সামনে পড়েছে। একসাথে। কী বিচ্ছিরি এবং ভয়ংকর ব্যাপার!
মানহা দুপুর গড়িয়ে এলেই ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর আমি নীলাকে ডেকে নিয়ে যাই বেলকনিতে।
নীলা কিছু বলার আগেই আমি বলি,' আমার সাথে তুমি সব বলো কিন্তু এটা কখনো বলো না যে আমি তোমায় যেন আবার বিশ্বাস করি আর ডিভোর্সের চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলি!'
নীলা কথাটা শুনে কেমন কেঁপে উঠে। তারপর কান্না কান্না চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকায়। এমনিতে ওর এমন চোখ দেখলে আমার ভীষণ মায়া হতো। কিন্তু আজ মোটেও হচ্ছে না। বরং রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে ওকে মেরে ফেলতে গলা টিপে!
নীলা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,' ফাহাদ, আমায় তুমি অবিশ্বাস করো না। আমি তোমাকে ঠকানোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। কিছুতেই না!' আমি ওর কথা শুনে হাসি। হেসে বলি,' তুমি আমায় এখনও ঠকাওনি তাই না? আমার স্ত্রী হয়ে তুমি অন্য একটা ছেলের কপালে চুমু খেয়েছো এটাকে কী বলে? আমায় ধোঁকা দেয়া বলে না? বিশ্বাসঘাতকতা বলে না? আর আমায় ছেড়ে সুইজারল্যান্ড যাওয়াল ডিসিশন? আচ্ছা এসব কিছু বাদ দিলাম। গতকাল যে তুমি ওই ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে বের হলা? আমার
নিজের চোখের সামনে দিয়ে ওর সাথে হাঁটতে লাগলে লেকের পাড় ধরে। আমার কলিগের সামনে পড়ে আমার মান সম্মান ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিলে!'
নীলা কান্নাভেজা গলায় বলে,' ফাহাদ, তুমি আমার সবটা কথা শুনো। আমার সব কথা না শুনলে তুমি কিছুই বুঝতে পারবে না!'
আমি ওকে ধমক দেই। বলি,' আর একটা কথাও না। তোমার কোন কথাই আমি শুনবো না! তুমি একটা নষ্টা! নোংরা একটা মেয়ে। আমার নিজের
প্রতি ঘেন্না হচ্ছে খুব। এই এতো দিন একটা নষ্টা মেয়ের সাথে সংসার করেছি আমি। এক বিছানায় রাত যাপন করেছি। আমার সন্তান তোমার গর্ভে দিয়েছি। আমার সন্তান তোমার মতো অপবিত্র একটা মানুষের দুধ পান করে বেড়ে উঠেছে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!'
নীলা আমার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে। তারপর বলে,' কসম করে বলছি আমি তমালের সাথে খারাপ কিছু করিনি!'
আমি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলি,
'তো ভালো কী করেছো ওর সাথে? আমায় মিথ্যে বলে বাবার বাড়ি গিয়ে কোথায় থেকেছো সারাদিন? কোথায়?, বয়ফ্রেন্ড নিয়ে হোটেলে তাই না? নষ্টামি করেছো! ছিঃ! ওয়াক থু! তোমার মতো ইবলিশ একটা মেয়ের উপর আল্লাহর লানত নাজিল হবে! নিজের নিষ্পাপ একটা শিশুকে ঠকিয়েছো তুমি! তোমাকে আর আমি আমার চোখের সামনে দেখতে চাই না। এখান থেকে যাও এখন বলছি!'
নীলা আমার হাতটা ধরে বললো,' ফাহাদ এমন করো না প্লিজ! আমার সবকথা তুমি শুনো। তারপর যদি তোমার মনে হয় আমি অপরাধী তবে তুমি আমায় যা ইচ্ছা তাই করো!'
আমি ওর কাছ থেকে আমার হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে ওকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিলাম। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলাম রাস্তার দিকে। না ওর সাথে আর সম্ভব না। ওকে আর কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না। প্রতারক একটা!আর সবচেয়ে বড় সত্য হলো মানুষের মনের বিশ্বাস কারোর প্রতি একবার উঠে গেলে তা ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব! আমি নীলার কোন কথার উপরই আর বিশ্বাস করতে পারছি না!
বড় রাস্তার একপাশে এলোমেলো হাঁটছি। অফিসের এক কলিগের কাছে ফোন করে জেনেছি পিয়ালীর বিষয়ে। পিয়ালী আজ অফিসে আসেনি। কী সর্বনাশের কথা!সে কী তবে চাকুরিটা ছেড়েই দিবে?
না এটা হতে পারে না। শুনেছি ওর পরিবারের কর্মক্ষম মানুষ একজনই। শুধু পিয়ালী। তার বাবা মৃত্যুশয্যায় পড়ে আছে বিগত তিন বছর ধরে। মা অসুস্থ বাবাকে টানতে টানতে নিজেও রোগী হয়ে গেছে। পিয়ালী সরকার ছাড়া তাদের আর কেউ নাই। পিয়ালী চাকরি ছেড়ে দিলে ওদের সংসার খাওয়া পরা চলবে কী করে? বাবার অষুধ কী করে আসবে?
দুপুরের কাঠফাটা রোদের ভেতর আমি একটা রিক্সা ডেকে নেই। পিয়ালীদের বাসার ঠিকানা জানি না। অফিসে গিয়ে জেনে আসবো।
অফিসে যাওয়ার পর আমার আরেক কলিক সোহাইল রহমান বলে,' ফাহাদ ভাই, পিয়ালী হঠাৎ জবটা ছেড়ে তো?' দিতে চাচ্ছে কেন বলুন
আমি বোকার মতো ওর দিকে তাকিয়ে বলি,' মানে? কী বলছো এসব?কে বলেছে তোমায়?'
'ও ফোন করেছিল আমায়। ফোন করে বলেছে।'
'আরো কিছু বলেছে নাকি? চাকরি কেন ছেড়ে দিবে এসব?'
'না এসব বলেনি। জিজ্ঞেস করেছে শুধু ভাঙতি মাসের স্যালারিটা পাবে কি না!'
অজান্তেই আমার ভেতর থেকে একটা শব্দ গলা বেয়ে বেরিয়ে আসে। উফ শব্দ করে আমি চেয়ারটার উপর বসে পড়ি। তারপর বলি,' ওর নম্বর তো বন্ধ। তোমায় ফোন করলো কীভাবে তাহলে?'
'অন্য একটা নম্বরে।'
'নম্বরটা দেও তো আমায়!'
সোহাইল নম্বর দিলো।
কিন্তু এই নম্বরও বন্ধ। বন্ধ করে ফেলেছে। আমি এবার জিজ্ঞেস করলাম,' সোহাইল, ওর বাসার ঠিকানাটা ম্যানেজ করে দাও।'
সোহাইল পাঁচ মিনিটেই ঠিকানা বের করে ফেললো। ওদের বাসা
নারায়ণগঞ্জ এর সোনারগাঁওয়ের কাঁচপুরে। কালী মন্দিরের ডান পাশে যে সরু রাস্তা গিয়েছে। ওই রাস্তার উত্তরের প্রথম বাসাটায় ওরা থাকে।
সোহাইল আমার কাছে ঠিকানা দিয়ে বললো,' যাবেন নাকি ওদের
বাসায়?'
আমি বললাম,' হুম।'
'আমিও যাবো। একটু বসুন। কাজটা গুটিয়ে নেই। আপনি আজ আসেননি।
কাজের চাপ অনেক।'
আমি সোহাইলের পিঠে হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম। তারপর শান্ত গলায় বললাম,' তুমি থাকো। পরে না হয় একসাথে যাবো। আগে আমি গিয়ে দেখে আসি কী অবস্থা! কেন চাকরিটা ছেড়ে দিতে চাচ্ছে?'
সোহাইল বললো,' ঠিক আছে ফাহাদ ভাই।'
ঘড়িতে বিকেল তিনটে বাজে। আমি দাঁড়িয়ে আছি পিয়ালীদের বাসার সামনে। ওদের বাসার গেটে মস্ত এক তালা ঝুলে আছে। আর গেটের স্টিলের দরজায় দুটো সাদা কাগজ লাগানো। কাগজে লিখা' To Let' আর কাগজের একেবারে নীচে লিখা' contruct no: 01714---আমি তড়িঘড়ি করে কাগজের নম্বর তুললাম আমার ফোনে। তারপর কল দিলাম ওই নম্বরে। মনে বড় আশা ছিল পিয়ালী ফোন রিসিভ করবে। কিন্তু ফোন রিসিভ করলো এক বয়স্ক পুরুষ। সে ফোন রিসিভ করে বললো,' কে?কে বলছেন?'
আমি জিজ্ঞেস করলাম,' এখানে পিয়ালী আছে?'
খসখসে গলার ভদ্রলোক বললেন,' পিয়ালীরা আজ বাসা ছেড়ে চলে গেছে।
ওরা আমার বাসায় ভাড়া থাকতো।'
আমি দ্রুত জিজ্ঞেস করলাম,' আঙ্কেল, ওরা কোথায় গিয়েছে জানেন?'
ভদ্রলোক বললেন,' জানি না।'
বাসায় ফিরেছি ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে। পিয়ালীর জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। নিজকে কেন জানি অপরাধী মনে হচ্ছে। কিন্তু বাসায় ফিরে মন আরও খারাপ হয়ে গেল। নীলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখেই আমার গা জ্বলে উঠলো। আমি--
#চলবে
0 Comments:
Post a Comment