#দায়িত্বের_সংসার
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্বঃ২৬
.
.
ভোর রাতে সায়ান অতসী কে ডেকে তুলেছে। এবাড়িতে সবাই আজানের পর পর নামাজ পড়ে। যদিও অতসী নামাজ সচরাচর বাদ দেয় না তবুও আজানের সাথে সাথে পড়তে পারেনা কিন্তু এবাড়িতে পড়তে হয়।
সায়ান, অতসী যাদের বাড়ি এসেছে সে মূলত সায়ানের বাবার ফুপু। সায়ানের দাদার বড় বোন। ভদ্রমহিলার বয়স শতক পার করেছে কিন্তু কমেনি চেহারার ঝৌলস। যথেষ্ট স্মার্ট মহিলা। বিষয় নামাজ-রোজার হোক কিংবা বিজ্ঞান এখনো খুব ভালোভাবে মেনে চলে।
ভদ্র মহিলা ফ্রিজের কোন জিনিস খান না, ফ্যানের বাতাস নেয় না। উনার সব পছন্দ প্রাকৃতিক নির্বাচন।
তাই হয়তো এখনো জীবিত আছেন এবং সুস্থ আছেন ।
.
.
নামাজ শেষে অতসী দাঁড়িয়ে দেখলো সায়ান হাতে গ্রীনটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পৃথিবীর সব থেকে অসহ্য, বাজে খাবার হচ্ছে গ্রীণটি। নায়িকাদের জন্য ভালো হলেও অতসীদের জন্য বেদনাদায়ক। ওসব মজা করে, মুখ না ভেংচিয়ে শুধু টিভিতেই খাওয়া যায়। বাস্তবে না।
কিন্তু নাইনুকুড় করেও লাভ হয় না। সায়ান প্রতিদিন জোড় করে এসব খাওয়ায়। ইফাদের ভাষ্যমতে অতসী একদম পারফেক্ট কিন্তু যে হারে ঘুমায়! যদি মুটিয়ে যায়?
.
আল্লাহ্! তুমি আমারে উঠাইয়া নাও না কেনো?
.
অতসীর কথাটায় সায়ান কর্ণপাত করলো বলে মনে হলো না।
মুখের সামনে ধরেই আছে। অতসী চুপচাপ কয়েক সিপ নিয়ে বসে আছে। বাকীটা সায়ান ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। তারপর অতসীর হাত ধরে বাহিরে উঠোন পেরিয়ে গ্রামের ফসলি জমির আইল ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো।
অতসী জিজ্ঞেস করলো
.
-মি. মাহমুদ! কোথায় যাচ্ছি?
-তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে।
.
.
দিহানের কাপড় গোছাতে গিয়ে কাল রাইমা কিছু কাগজ পত্র পেয়েছে।
অতসীর ভিসা, পাসপোর্ট। দিহান সব বানিয়ে নিয়েছিলো হয়তো অতসী কে নিয়ে যাবে বলে কিন্তু অদৃষ্টের বিচিত্র ইচ্ছা ছিলো।
রাইমা কে কিছু জিনিস প্রচন্ড যন্ত্রণা দেয়।
প্রতিদিন যখন দিহান নিয়ম করে অতসীর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে, অতসীর গলার চেইন দিহানের হাতে দেখে কিংবা ওয়ালপেপার, ওয়ালেটে অতসীর ছবি।
.
হিংসে হয় না কষ্ট হয় রাইমার।শুধু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। অতসী সব ছেড়েও সব কিছুর অধিকারী কিন্তু আমি? সামান্য একটু অধিকারের জন্য ক্লান্ত পরিশ্রান্ত নারী।
.
.
তাই হয়তো ভোরের আলো, স্নিগ্ধ বাতাস সব কিছু অসহ্য লাগে রাইমার।
দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটু মুক্তি চাই! একটু মুক্তি!
.
.
সায়ান অতসী দাঁড়িয়েছে একটা বাড়ির সামনে। বাড়ি না! হ্যাঁ! এটা তো খামার। আশেপাশের ঘর থেকে পিচ্চি পিচ্চি গরুর বাচ্চা বেরিয়ে আসছে। গ্রাম বাংলায় বাছুর বলে ডাকে। অতসীর কাছাকাছি আসতেই অতসী এক লাফে সায়ানের পায়ের উপর পাড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচন্ডরকম ভয় পায় গরু দেখে।
সায়ান ভ্রু কুঁচকে অতসীর দিকে তাকিয়ে বললো
.
.
-তুমি গরু ভয় পাও?
-হ্যাঁ! জানেন! এগুলো গুতো মারে।
-তাহলে দুধ দোয়াবে কিভাবে?
-মানে?
-তুমিই তো বলেছিলে "চুনুচুনু করে গরুর দুধ পানাবো "
-কবে বলেছি? সব আপনার ষড়যন্ত্র!
-বাহ্! রে এখন ভুলে গেলে? আচ্ছা চলো ওদিক টায় চলো।
.
ওদিকে অনেক গাভী রাখা। সায়ান অতসী কে নিয়ে যায়। একজন মহিলা এসে অতসী কে নিয়ে বসিয়ে দেয় দুধ পানাতে।
অতসী তো ভয়ে শেষ। হাত বাড়িয়ে সায়ানের হাত ধরে, যেনো সায়ানের হাতের থেকে বিশ্বস্ত হাত আর নেই।
সায়ান হেসে অতসীর হাত ধরে বসে। কিন্তু দুধ দোয়াতে তো দুই হাত লাগে আর যদি লাথি মারে?
ঢোক গিললো অতসী। তবুও সাহস করে শুরু করলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সব স্বাভাবিক দেখে অতসী বেশ আনন্দের সাথে কাজটা করছিলো।
এক এক টা গাভী প্রায় সাত -আট কেজি করে দুধ দেয়।
সায়ান এর মাঝে একটা কাজ করে বসলো। অতসীর হাত একটু বাকিয়ে কাচা দুধ খেয়ে নিলো। এই অবস্থা দেখে অতসী প্রায় বমি করেই দিয়েছিলো। সায়ানের টি-শার্ট, মুখে লেগে আছে গরুর কাঁচা দুধ!
.
সায়ান উঠে ভদ্র ছেলের মতো অতসীর আঁচল দিয়ে মুখ মুছে নিলো যাতে এমন কিছুই হয়নি। অতসী ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো।
.
.
ফিরে এসেই সামনে পড়লো একটা পেয়ারা গাছ। অতসীর এই পেয়ারা অনেক পছন্দের। এতই পছন্দ সে পেয়ারার কচি পাতা অবধি খেয়ে ফেলে৷
গাছটি একটু উঁচু। গাছে মাত্র দুটো ফল। সায়ান সহজেই উঠে গেছে। দুটো পেয়ারা হাতে নিয়ে চিন্তা করছে অতসী কে দিবে কি না! অবশ্যই দিবে কিন্তু একটু বাজিয়ে।
.
-মিসেস মাহমুদ! তোমার কি চাই?
-অবশ্যই। প্লিজ দিন না!
-বাচ্চাদের এসব খেতে নেই।
-শাট আপ মি. মাহমুদ! ফাজলামোর সীমা থাকে।
-আমি এটা কষ্ট করে পারলাম। তোমাকে এমনি এমনি দিবো কেনো?
-কি চাই?
-উম্মম! একটা চুম্মা!
-ছিঃ আপনি কি অশ্লীল!
-নিজের বউকে এসব বললে অশ্লীল হলেও আপত্তি নেই।
-লাগবে না।
.
অতসী রাগ করে চলে যাচ্ছিলো। সায়ান দাঁড়াতে বলে, অতসী তো অপেক্ষায় ছিলো।
আঁচল পেতে দেয়। সায়ান ঢেল দিয়ে পেয়ারা দুটো দেয়।
.
তখন হটাৎ একজন এসে বলে বড় মা ডাকছে। আসার পর তো উনার সাথে দেখাই হয়নি।
.
সায়ান অতসীকে একবার দেখে নিলো। সব ঠিকঠাক। নাক ফুলটা একটু ঠিক করে দিয়ে হাত ধরে এগিয়ে যায় একটা ঘরের দিকে।
.
মাটির ঘর! ঠান্ডা পরিবেশ। পুরো ঘরেই আগরবাতির স্মেল। অতসী এই স্মেল ভয় পায়।এই স্মেল মৃত বাড়িতে পাওয়া যায় কি না!
শক্ত করে সায়ানের হাত ধরে আছে অন্য হাতে আঁচলে রাখা দুটো পেয়ারা।
ঘরে প্রবেশ করেই দেখলো সাদা পর্দা দিয়ে ভিতরে আড়াল হয়ে বসে কেউ তিলাওয়াত করছে।মিষ্টি সুর ভেসে আসছে। অতসী কে নিয়ে ভিতরে যায় সায়ান। ওদের দেখে তিলাওয়াত বন্ধ করে ঈশারায় বসতে বলে। কুশলাদি বিনিময় করার পর সায়ান চুপচাপ তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ভদ্র মহিলা এক হাতে সায়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, চোখের পানি স্পষ্টত।
.
মি. মাহমুদ কান্না করছে? আশ্চর্য! কেনো?
.
ভদ্রমহিলা চোখ তুলে তাকায়। শান্ত চাহনী। বয়স্কের ছাপ স্পষ্ট কিন্তু নূরানী চেহারা। অন্য হাত দিয়ে অতসীর হাত ধরে।
.
-আসসালামু আলাইকুম!
-ওয়ালাইকুম আস সালাম। সানুর পছন্দ আছে! সানু তো পুতুল নিয়ে এসেছে।
.
অতসী মুচকি হেসে মাথা নিচু করে। অনেক কথা বলে এমন সময় সায়ানের কল আসাতে সায়ান বাহিরে চলে যায়। অতসী আরো কিছু সময় ছিলো। একটু পর বেরিয়ে রুমে চলে এসে পেয়ারা দুটো রাখে। মাথা ঝিমঝিম করছে। কিছু সময় পর সায়ান এসে অতসীর কপাল নিজের কপালের সাথে ঠেকিয়ে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে আছে। দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাস একজনের মুখে এসে লাগছে।
কিছুক্ষণ পর সায়ান বললো
.
-জানো! বড় মা কি বলেছে?
- উঁহু!
-আমাদের সন্তান আসবে খুব দ্রুত! খুব দ্রুত আমি বাবা হবো।
.
সায়ান মনে করেছিলো অতসী চমকে যাবে। কিন্তু অতসী চমকায় নি।কারণ কিছুক্ষণ আগে তাকেও এই কথা বলেছে বড় মা।
.
সায়ান বেরিয়ে যাওয়ার পর আঁচলে দুটো পেয়ারা দেখতে পায় বড়মা। জিজ্ঞেস করে
.
-সানু পেড়ে দিয়েছে?
-হ্যাঁ! উঠনের শুরুর দিকের গাছ থেকে।
-আঁচলে কি ওই দিয়েছে?
-হ্যাঁ!
-তুমি কি জানো ওই গাছে বছরে দুটো কি একটা ফল হয়। গাছের ফল যে বিবাহিত মেয়ের ঝুলিতে পড়ে সে পোয়াতি হয়। তোমার কোল জুড়ে আমার শামীম, আয়েশা যেনো ফিরে আসে।
.
শামীম আয়েশা সায়ানের মা-বাবার নাম। ছেলেটা সব হারিয়েছে। সন্তান তো বাবা-মায়ের মতোই। দেইখো আমার শামীম, আয়েশা ফিরে আসবে।
.
.
কথাটা শুনে অতসী ফাকা ঢোক গিললো। মি. মাহমুদের সাথে ওমন কোন সম্পর্ক নেই। অনামিকা সুস্থ হলেই চলে যেতে হবে কিন্তু এটা মিথ্যে নয়।
অতসী ইদানীং এমন স্বপ্ন দেখে। মি.মাহমুদ শূন্য আঁচল ভরে দিয়ে ফল দিয়ে। তবে কি সত্যি?
.
এই কথাটা শোনার পরেই অতসী চুপচাপ হয়ে যায়। সায়ানের ডাকে হুশ ফিরে।
.
-অতসী!
-হু!
-সত্যি আসবে তো!
-অবশ্যই! আপু সুস্থ হলেই আপনাদের সন্তান আসবে।
.
সায়ান অতসীর কোথায় পাত্তা না দিয়ে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ তলপেটের দিক টায় শাড়ি সরিয়ে পর মুখ ডুবালো গভীর ভাবে। কয়েক মুহুর্ত পর মুখ তুলে অতসীর দিকে তাকিয়ে বললো
.
- উঁহু! আমার সন্তান এখানে থাকবে। ঠিক এখানে।
.
কিন্তু অতসীর স্থির চাহনী বিছানার এক পাশে রাখা পেয়ারা দুটোর দিকে।
.
কি এমন হবে একটু স্বার্থপর হলে? আচ্ছা! আমি যদি আপুর সুস্থতা কামনা না করি তবে কি খুব খারাপ হয়ে যাবো?এমন কি হতে পারে না আপু আর কখনো সুস্থ না হলো! এটা কি খুব অন্যায় চাওয়া?
.
.
চলবে।
#ছবিয়ালঃঈশিতা 💕
(আগামী তিন গল্প টা দিবো না। তাই পর পর দুদিন দিয়ে দিলাম 🙂)
0 Comments:
Post a Comment